প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সমরেন্দ্র বিশ্বাস
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধরাঙাডাক্তার গ্রামের পথ দিয়ে ফিরে আসছেন। ভাঙড়ের বাগবাড়ীতে তাদের সংগ্রাম পর্যুদস্ত হয়েছে। মন তার ভারাক্রান্ত। সেই মুহূর্তে তার মনে বার বার ফিরে আসছিল একটাই প্রশ্ন – ‘আমিই কি সেই নায়ক যে পরাজিত হয়ে পাটখেতের মধ্য দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে?’
চল্লিশ দশকের শেষার্দ্ধ। তখন কলেজ থেকে ডাক্তারী পাশ করে কম্যুনিষ্ট পার্টির ডাকে এই তরুণ ডাক্তার গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন। মেডিকেল টিম তৈরীর চেষ্টা করছেন। আন্দোলনকারী কৃষকদের চিকিৎসা করছেন। বিভিন্ন আন্দোলনে অংশও নিচ্ছেন।
সে সময়গুলো পেরিয়ে আজকে দিনে যদি দেখি, মাঝখানে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। তেভাগা আন্দোলন থেকে নকশালবাড়ি, হাল আমলের কৃষক আইনের বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলন। রাঙাডাক্তারের বিংশ শতাব্দী পেরিয়ে এখনকার একবিংশ শতক। তার মৃত্যুর পর একত্রিশ বছর কেটে গেছে। আজকের দিনটা তার মৃত্যু দিন। নানা রোগ ব্যাধি, সামাজিক সমস্যা, ভোটের ডামাডোল এসবের মধ্য দিয়েও আজকের দিনে তেভাগা আন্দোলন খ্যাত রাঙা ডাক্তার পূর্ণেন্দু ঘোষকে স্মরণ করা প্রাসঙ্গিক।
‘আমিই কি সেই নায়ক যে পরাজিত হয়ে পাটখেতের মধ্য দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে?’ এই প্রশ্নটা বোধ হয় সারা জীবনই রাঙাডাক্তাররের মনকে আলোড়িত করেছিল। সারা জীবন এর উত্তর তিনি খুঁজেছেন। সারা জীবনই তিনি সক্রিয় থাকার চেষ্টা করেছেন। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক আর্নেষ্ট হেমিংওয়েও মতো সারা জীবনই এই বোধে অবিচল থেকেছেন, “A man can be destroyed, but not defeated”! আজীবন যোদ্ধা, ব্যক্তিত্বময় পুরুষ, আড্ডাবাজ, সবার ভালোবাসার এই মানুষটি তার সাধাসিধা দিন যাপন ও চর্চার মধ্য দিয়ে উপরোক্ত জয় ও পরাজয়ের উত্তরটা খুঁজেছেন।
মানুষকে ধ্বংস করা যেতে পারে; কিন্তু যা যায় না, তা হলো তাকে পরাজিত করা। দুরারোগ্য ক্যান্সারের প্রত্যাশিত আক্রমনে এই রাঙা ডাক্তার বিগত ১৯৯০ সালের ৪ঠা মে প্রয়াত হয়েছিলেন; তৎকালীন মধ্যপ্রদেশের (অধুনা ছত্তিশগড়ের) বিলাসপুরে। ডাক্তার পুর্ণেন্দু ঘোষের জন্ম ১৯২৩এর মহালয়ার দিন, বিহারের ভাগা কয়লাখনি অঞ্চলে। বাবা ছিলেন রেল কর্মী। তাই শৈশব কেটেছে নানা জায়গায়, কখনো বিলাসপুরে, কখনো মানভূমে, কখনো কোলকাতায়। ১৯৪২ এ তিনি বিদ্যাসাগর কলেজে আই এস সি পড়তে শুরু করেন। তারপর তিনি ডাক্তারী পড়তে ভর্তি হন কলকাতার কারমাইকেল কলেজে। ডাক্তারী পড়ার থার্ড ইয়ারে কবি রাম বসুর (সম্পর্কে মামাতো ভাই) হাত ধরে তিনি সক্রিয় ভাবে ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। ১৯৪৮ সালে তিনি ডাক্তারী (এম বি বি এস) পাশ করেন। এরপর তিনি ঘরের সুখশয্যা ছেড়ে কম্যুনিষ্ট পার্টির ডাকে সুন্দরবনের কাকদ্বীপে চলে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার গ্রামে গিয়ে আন্দোলনকারী ও সংগ্রামরত কৃষকদের মধ্যে মেডিকেল ইউনিট গড়বেন। এর পরে ১৯৪৯এ রেল ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সাঁতরাগাছি আসেন। তারপরে মেডিকেল ক্যাডার তৈরীর কাজে হাওড়ার আন্দুলে নিজেকে নিযুক্ত করেন। সব মিলিয়ে এই মানুষটি মনে করিয়ে দেন চীনের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী ডাক্তার নরম্যান বেথুনের কথা। সন্দেশখালিতে ধরা পরার পর বসিরহাট সাব জেলে একরাত কাটিয়ে তাকে আসতে হয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। সেখানেও জেলের মধ্যে থেকেও নানা দাবী দাওয়া ও অধিকারের প্রশ্ন নিয়ে চলতে থাকে সক্রিয় আন্দোলন। তারপর আলিপুর জেল থেকে তাকে স্থানান্তরিত করা হয় দমদম সেন্ট্রাল জেলে। ততদিনে কম্যুনিষ্ট পার্টির ভেতরকার অবস্থা দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভরে উঠেছে। তিনি জেল থেকে বেরিয়ে এসে পার্টির সাথে সব সম্পর্ক প্রায় চুকিয়েই ফেললেন।
১৯৫৩ থেকে স্থায়ীভাবে তিনি বিলাসপুরে বসবাস ও ডাক্তারী প্রাকটিস করা শুরু করলেন। এ সময়ে রাজনীতির সাথে তেমন সম্পর্ক না থাকলেও সাধারণ মানুষদের সাথে তার ছিল অটুট সম্পর্ক। ১৯৬৮/৬৯ সালে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের যে আওয়াজ ভারতবর্ষকে উদ্বেল করে তুলেছিল, তিনি সেই আন্দোলনের শরিক হয়ে যান। তারই পরিণতিতে ১৯৭০ এ আবার তাকে জেলে যেতে হয়। এর পরবর্তী সময়ে কাকদ্বীপের পূর্বতন আন্দোলনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি ভোজপুরে কৃষকদের আন্দোলনে সামিল হন। উদ্দেশ্য সেখানে মেডিকেল ইউনিট গঠন করা। পুনরায় ভারতবর্ষের ঘোষিত জরুরী অবস্থার সময়ে তাকে আবার জেলে যেতে হয়। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বিপ্লবী কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের সাথে তিনি যোগাযোগ রেখে চলেন। এই হলো সংক্ষেপে তার রাজনৈতিক জীবনের কথা।
এসবের পাশাপাশি শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে তার বিভিন্ন প্রয়াস মনে রাখবার মতো। এইসব প্রয়াসের পেছনে কাজ করেছে সমাজের প্রতি, মানবতার প্রতি তার এক নিরন্তর দায়বদ্ধতা। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, গল্পকার, লেখক, চিত্রশিল্পী ও নাট্যকার। এমন কি অভিনয়ও করেছেন। তিনি ছিলেন সম্পাদক। তার সম্পাদিত সেতু পত্রিকা (বাংলা ও হিন্দী ভাষায়) সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
ডাক্তার পূর্ণেন্দু ঘোষের কবিতার বই ‘লালগঞ্জে পৌঁছাবোই ও অন্যান্য কবিতা’ তেভাগা কৃষক আন্দোলনের কথা মনে করিয়ে দেয়। তার সাতটি একাঙ্ক নাটকের সংকলন একত্রে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৮/৮৯-এ। তার সব চাইতে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম ‘তেভাগার স্মৃতি’ – যার মধ্যে ধরা আছে তার সময়কার কিছু সংগ্রামী মানুষের স্মৃতিকথা ও উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনার বিবরণ। ‘তেভাগার স্মৃতি’ বইটির হিন্দী অনুবাদও (তার ভাই অমল ঘোষ কৃত) এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন ভাষাভাষী সাহিত্যের পারষ্পরিক অনুবাদের মধ্য দিয়েও তিনি চেয়েছিলেন নানা ভাষা ও নানা মতের যোগসূত্র স্থাপিত হোক। তার নিজস্ব অনুবাদ কর্মের মধ্যে আছে কৃষণচন্দের উপন্যাস ‘ফুটপাথের দেবদূত’ ও শ্রীরাবিন শাঁ ‘পুষ্প’-এর গল্প সংকলন ‘লড়াই’ (আলোক রায়ের সাথে যৌথভাবে)।
তার পরিচালনায় বিলাসপুরের সেতু সাহিত্য পরিষদ বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশে একসময়ে উদ্যোগী হয়েছিল। এই সমস্ত গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশের বিখ্যাত লেখক, কবি ও রাজনৈতিক মানুষটিকে নিয়ে লেখা একটি সংকলনগ্রন্থ ‘চেরাবান্দারাজু : ব্যক্তিত্ব ও কবিকৃতি’। এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছেন মধু ভট্টাচার্যর কাব্যগ্রন্থ ‘একটি শান্তির আস্তানা বানাবার জন্যে’ ; এই মধু ভট্টাচার্যবাবু যিনি একসময়ে বিলাসপুরে থাকতেন, ডাক্তারবাবুর সান্নিধ্য পেয়েছেন; এখন তিনি ভিলাইবাসী ও ডাক্তারবাবুর ‘সেতু’ পত্রিকাটিকে এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন। ডাক্তার বাবুর উদ্যোগে সে সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল বিলাসপুরবাসী রেলকর্মী, সমাজিক ভাবে সক্রিয় ব্যক্তিত্ব ও লেখক মহাদেব রাও (বর্তমানে প্রয়াত)এর লেখা ‘মহাদেব রাও নির্বাচিত রচনা সংগ্রহ’। সেতু সাহিত্য পরিষদ ও ডাক্তারবাবুর উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছিল একটি ছবির অ্যালবাম ‘যারা আলো দিলেন’; উদ্দেশ্য ছিল বিখ্যাত শিল্পী দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের দিকে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া।
ডাক্তার পূর্ণেন্দু ঘোষ রোগীর চিকিৎসা করতেন, তাতে নাম মাত্র পয়সা নিতেন, কখনো বা পয়সা নিতেনই না। মধ্যবিত্ত জীবনের মধ্য থেকে উঠে আসা এই মহান চিকিৎসকটির স্বপ্ন ছিল সমাজে যেন শোষণ না থাকে। মানুষ যেন সুখে শান্তিতে থাকে, ভালো থাকে। আজীবন তিনি ছিলেন সহজ সরল নিরলস এক ছাত্র, তবুও আমাদের কাছে তিনি একজন মহান শিক্ষক। তাকে আমি বিলাসপুরে দেখেছি বেশ কয়েকবারই। পথ চলতি রাস্তা ঘাটের মানুষজনের সাথে তার ছিল সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক। নিজের জীবনে তিনি তার ব্যক্তিগত গন্ডীটাকে ভেঙ্গে হয়ে উঠেছিলেন সার্বজনীন।
চার পাশে চলা কম্যুনিষ্ট আন্দোলনগুলো সম্পর্কে শেষ জীবনে তার নানা প্রশ্ন ছিল। বিভিন্ন প্রগতিশীল সামাজিক আন্দোলনের বাঁকে বাঁকে নানা ফাঁফ-ফোকর, সুবিধাবাদ, অন্যায়, অসম্পূর্ণতা এসব তিনিও নিজের চোখে দেখে গেছেন। এসব তাকে বিচলিত করেছিল, দুঃখ পেয়েছেন। সামাজিক আন্দোলনের এই সব ফাঁফ-ফোকর দেখেই হয়তো তাকে লিখতে হয়েছে –
‘বলেছিলাম-
জনতা হচ্ছে জল আর আমরা সেই জলের মাছ
কিন্তু জল যদি সরে যায়
তবে মাছেরা যে ধড়ফড়িয়ে মরে
সে কথা বুঝতেই পারিনি’।
মৃত্যুর পর ডাক্তার পূর্ণেন্দু ঘোষের স্মরণে ‘খুঁজে ফিরি এক আদর্শ প্রাণ’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সেখান থেকে তারই একটা লেখা কবিতা তুলে দিচ্ছি এখানে।
< ততদিন বিভ্রান্তির অবকাশ কোথা >
নিরাশা আর হতাশায় ছিন্ন ভিন্ন হয়ে
শুয়ে আছি অন্ধকার আকাশের নীচে!
নিরন্ধ্র আঁধার রাতে
কোনোখানে নেই কোন আশার আলোক
তারকার সারি কোথা লুকিয়েছে মুখ
অসহায় মন শুধু ভেঙে ভেঙে যায়।
এমন সময় -
তোমার উদীপ্ত স্বর চমক ভাঙায়,
‘সব্যসাচী, দূর করে দাও এই ক্লীবত্ব তোমার।
অসহায় নয় তুমি,
চারিদিকে চেয়ে দ্যাখো
ছিন্ন বস্ত্রে আচ্ছাদিত শত শত বুভুক্ষু মানুষ
চেয়ে আছে তোমার দিকেতে।
তাদের দেখেছো তুমি,
কিন্তু দেখোনিকো তাদের হৃদয়
সেখানে অসংখ্য জ্বালা আর অঙ্গারের বেগ
নিত্য প্রজ্জ্বলিত হয়ে আগুন ছড়ায়
তারা তো তোমার পাশে
ওঠো, ছিঁড়ে ফ্যালো হতাশার মিথ্যা আবরণ,
মানুষের পরে মানুষের শোষণের
যতদিন শেষ নাহি হবে
ততদিন বিভ্রান্তির অবকাশ কোথা?’
[ বিলাসপুর, ২০-১২-১৯৮৯ ]
‘পরাণ মাঝি হাঁক দিয়েছে’ কিংবা তেভাগা আন্দোলনের সংগ্রামী দিনগুলো আজ অস্তমিত। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয় আমাদের সামনে! এরকম একটা বিভ্রান্ত সময়ে, আজকেও ডাক্তার পূর্ণেন্দু ঘোষ ও তার জীবনবীক্ষাকে স্মরণ করা খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয়।
==== # ====
[ লেখার সূত্র –
১/ রাঙা ডাক্তার পূর্ণেন্দু ঘোষ – প্রশান্ত ভট্টাচার্য [ লেখক সমাবেশ, মে-১৯৯০ সংখ্যা]
২/ তেভাগার স্মৃতি – পূর্ণেন্দু ঘোষ , সেতু সাহিত্য পরিষদ।
৩/ স্বদেশ ( পত্রিকা) – ৬১ সংখ্যা/ ১৯৯০ ]