Next
Previous
Showing posts with label প্রচ্ছদ নিবন্ধ. Show all posts
1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - স্মৃতিকণা সামন্ত

Posted in








শ্মশানের জমিটা ঘাসে ঢেকে আছে। ছোটছোট গর্তে সকালের বৃষ্টিজমা জল। ব্যাঙ লাফিয়ে বেড়াচ্ছে দেদার। জমির পুবে তালপুকুরের পাড়, উত্তরের ঝোপঝাড় আর বাঁশবন ছুঁয়ে চলে গেছে মোরাম ফেলা বড় রাস্তা। রাস্তার উল্টোদিকের ঝুরো বটগাছ, আর গাছের ওপারে ডোমদীঘির কালো জল। বিকেলের রঙ নীলচে সবুজ।


দাদুর সাথে এসে বসি ওই বটের তলায়, শ্মশানের দিকে স্থির চেয়ে থাকে দাদু। দাদুর বাবা সূর্যনারায়ণ, তার বাবা সহদেব, তার বাবা এবং তার আর তারও আগের সব পুরুষের চলে যাওয়া দেখেছে এই সবুজ জমি, তালপুকুর, ডোমদীঘি আর ওই রাস্তা। চোদ্দপুরুষের সালতামামি লেখা আছে এই বংশের খেরোর খাতায়, দলিলে, পাট্টায়।

কোনও এক অখ্যাত দিনে এই গ্রামে এসেছিল আমাদের পূর্বজ, খড় মাটি বাঁশ দিয়ে তৈরি হয়েছিল আমাদের প্রথম বসত। জমিজিরেত, ঠাকুর দেবতার নামে কাটা হয়েছিল মন্দিরের ভিত, শিকড় চারিয়ে যাচ্ছিল মূল, আমাদের শাখাপ্রশাখারা বাড়ছিল ডালপালায়।


চৈতন্যদেব যখন দন্ডভুক্তির রাস্তা ধরে পৌঁছে যাচ্ছিলেন শ্রীক্ষেত্র তখনই কোনও এক মেঠোপথ ধরে রাস্তায় হাঁটছিল আমার পূর্বপুরুষ, পূর্বনারী আর তাদের বংশজ সন্তানরা। জাতিতে সদগোপ, পেশায় চাষী পেয়েছিল মল্লভূমের রাজস্ব আদায়ের ঠিকা। ডোম বাগদী দুলেরা ছিল তাদের সেপাই। কিন্তু তার আগে? তার, তার কিংবা তারও আগে কোন পাটক, বাটক কিংবা নগরীর কোণে ছিল আমাদের মেটে ঘর, গোয়ালঘর, চাঁপাফুলের উঠোন? কোন ভুক্তি, কোন দন্ড, কোন ভূমি?


বিকেল রঙ বদলাচ্ছে হনহন করে। দাদুর সাথে হাঁটছি ওই মেটে রাস্তায়। পায়ে পায়ে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি শতকের পর শতক। হাজার হাজার বছরের ধুলো জমছে আমাদের পায়ে, জামায়, চুলে। এই রাস্তা দেখেছে বর্গীর দল, কালা পাহাড়। তারও আগে কোনও আদিম কৌম জনগোষ্ঠীর পায়ের ছাপ পড়ে আছে এইখানে, এই ধুলোর আস্তরণে।


প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ বলছেন কায়স্থ, সদগোপ আর কৈবর্ত সমাজ বাঙালীর প্রকৃত প্রতিনিধি। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ আর বৃহদ্ধর্মপুরাণ লিখেছে বর্ণসংকর বাঙালির কুল গোত্রের তালিকা। নৃতাত্ত্বিক সেই তালিকা হাতে খুঁজতে বেরিয়েছে বাঙালির জন্মসূত্র, আমার বাপ, দাদা, ঠাকুরদা, তস্য এবং তস্য ঠাকুরদার উৎসমুখের কথা।


ঝুরঝুরে সন্ধ্যা নামছে দীঘির জলে, বুনো ঝোপে, বাঁশের বনে, রাস্তায়। হুন হুনা, হুন হুনা, হুন হুনা রে, হুন হুনা...

পালকি চড়ে নতুন বউ আসছে গাঁয়ে। এসেছিল আমার ঠাকুমা, দিদি ঠাকুমা এবং আরও আরও সমস্ত প্র প্র প্রপিতামহীর দল। নববধূর সাজে, অলক্ত পা ফেলেছিল লালমাটির গায়ে, কাজল টানা চোখ তুলে প্রথম দেখেছিল এ গাঁয়ের গাছপালা, টলটলে দীঘি আর খোড়ো ছাউনির মেটে বসত। নৈষধ চরিতের দময়ন্তী সেদিন নববধূ। লাক্ষারসে রাঙানো ঠোঁট, পায়ে লাল আলতা, কানে মণিকুন্ডল, হাতে কেয়ুর কাঁকন, শঙ্খের বালা। তেমনই কি আমার সেই অজানা কোনও পিতামহীর ছিল– হাতে শঙ্খের বালা, কানে তালপাতার কুন্ডল, পরনে আটপৌরে সুতোর কাপড়, ঘোমটা ঢাকা আয়ত একজোড়া চোখ?


‘দ্য এনালস অফ রুরাল বেঙ্গল’ লিখতে গিয়ে হান্টার আক্ষেপ করেছেন বাঙালির এমন কোনও লিখিত ইতিহাস নেই যা দেখে তার আদিকথা জানা যায়। যা আছে, যেটুকু আছে তা প্রায় সবই রাজাদের দলিল, দানপত্র। সেখানে সাধারণের কথা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিছু লিপি আছে, সেও সমাজের ছবি নয়। তবুও ইতিহাসবিদ খোঁজে সেইসব অন্ধগলিতে, সেইসব লিপি, দানপত্র, সাহিত্য, পুরাণ কিংবা পোড়ামাটির ফলকে। পাহাড়পুর আর ময়নামতীর বিহারে মন্দিরের গায়ে শিল্পী ঢেলে সাজিয়েছে সমাজের কথা, সাধারণ জীবনের কথা, মাঠেঘাটে কাজ করা মানুষের দিনযাপনের অনাড়ম্বর সব দলিল।


হাওয়া বইছে। বাঁশের পাতায়, তালগাছের মাথায় ঘষা খেয়ে শব্দ হচ্ছে শরশর, শনশন।দীঘির জলে ছোটছোট ঢেউ। মাটির দাওয়ায় বসে কুটনো কুটছে আমার পিতামহী কোনও এক প্রাগৈতিহাসিক সন্ধ্যায়। বেগুন, লাউ, কাঁকরোল, কচু, ইচা, বাচা, শকুল, রোহিতের ঝোলে ঝালে ভাজায় ম ম করছে আমাদের উঠোন, টুপটাপ ঝরে পড়ছে গোলকচাঁপার ফুল। পুকুরঘাটে বর্ষা নেমেছে।


প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোয় তো বটেই; বর্মা, চীন, ইন্দোনেশিয়া, জাপান জুড়ে প্রধান খাবার ভাত মাছ– বাংলা আসাম উড়িষ্যারও তাই। মধ্য ভারত থেকে দক্ষিণে সিংহল অব্দি, পূর্বে উড়িষ্যা বাংলা আসাম পর্যন্ত, সিংহল থেকে অস্ট্রেলিয়া অব্দি ছড়িয়ে ছিল এক আদিম কৌমগোষ্ঠী। নৃতাত্বিকরা বললেন এই সেই আদি অস্ট্রালয়েড জন, যে জনের গঠনগত মিল পাওয়া গেছে কোল মুন্ডা সাঁওতাল শবর হো ভূমিজ উপজাতির শরীরে। করোটি, কপাল, নাক, চোখ, চুল, উচ্চতার খুঁটিনাটি বিচারে জানা গেছে এই আদি অস্ট্রালয়েড গোষ্ঠীর সাথে মিশেছে আর এক ভূমধ্যসাগরীয় জনস্রোত আলপাইন, এলপো দিনারীয় স্রোত। এক প্রাগৈতিহাসিক ভোরে মিলেমিশে যাওয়া সেই সংকর স্রোতে জন্ম নিল আমার প্রথম পূর্বজ।


পশ্চিমের গুজরাট থেকে মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু হয়ে একটা অ্যালপো দিনারীয় দল পৌঁছেছিল হয়ত উড়িষ্যা, বাংলার মাটিতে। তারও আগে কোনসময় এসেছিল ভূমধ্যসাগরিয় কোন নরগোষ্ঠী। এদের সঙ্গে মিশে গেছিল বাংলার সেইসব আদিম সাঁওতাল, ওঁরাও কিম্বা মুন্ডা জনজাতির আদি অস্ট্রালয়েড রক্ত। রক্তের সাথে রক্তের মিশেলে যেমন জন্ম নেয় নতুন প্রজন্ম তেমনই মিশে যায় রীতিনীতি, আর বিশ্বাস।


জল থৈ থৈ জমি। জল টুপটুপ মেঘ। বীজধান দুলছে হাওয়ায়। তার আগে লাঙল চলেছে, মসৃণ কাদামাটি। সাতপুরুষের জমি, নিজের হাতে লাঙল চষে আমার পূর্বপুরুষ, ফালাফালা মাটি। মাটি ঘাঁটতে ঘাঁটতে আরও আরও বহুদূর হেঁটে যায় আমাদের দাদু,তস্য এবং তস্য বাপ দাদারা। লাঙল নামানোর আগে পুজো দেয় হারান কাকা,পূজো দেয় আমার পূর্বপুরুষ। গোলায় ধান তুলে এনে লক্ষ্মীর বেড় পড়ে মরাইয়ের গায়ে; তেল সিঁদুরের ফোঁটা, গোবর নিকোনো মরাইতলায় অল্পনার আঁকিবুকি। ধানের ছড়া, কলার পাতা, কলা গাছ, হলুদ, পানে আমাদের কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। ভেজা চুল, এলো খোঁপায় আসন সাজায় আমারই কোনও দিদিঠাকুমা।


প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপে দ্বীপে জ্বলে ওঠে প্রদীপ। সুপারি, হলুদবাটা, ধানের ছড়া,কলার পাতার গন্ধ মেখে ভেসে যায় শাঁখের আওয়াজ, দূরে বহুদূরে গ্রাম নদী সাগর পেরিয়ে অজানা কোন দেশে। বাঙালির পুজোপার্বনে আদি নর্ডিক আর্য সভ্যতার ছাপ অল্পই, বাঙালির জীবন এবং চরিত্রেও তাই। যেটুকু বা তাও ওপরে, তার গভীরেও সেই আদি অস্ট্রেলিয় ধারা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলিতে এই পান সুপারি, ধানের ছড়া, কলাপাতা, হলুদের ব্যবহার সমস্ত মাঙ্গলিক কাজে, ধানের ছড়ায় পুজো করে নাগা আর মুন্ডারী জনজাতি। পুজো করে বাঙালি আর তার ব্রাহ্মণ।


সামাজিকভাবে বাঙালি ব্রাহ্মণ উত্তরভারতীয় ব্রাহ্মণের মর্যাদা পায়নি কখনও। বাঙালী ব্রাহ্মণের নিকটতম সম্পর্ক বাংলার কায়স্থ আর বৈদ্যের সাথে। আর বাংলার নমঃশূদ্র চন্ডাল গোষ্ঠীর শরীর গঠনগতভাবে ঘনিষ্ঠ মিল খুঁজে পায় উত্তরের বর্ণব্রাহ্মণের সঙ্গে। ঠিক তারই পাশে বাংলার কায়স্থ কৈবর্ত আর সদগোপ দেহগত বৈশিষ্টে বাঙালির সব বর্ণের সবচেয়ে কাছের জন। বিহারের কিছু গোত্র ছাড়া এই তিন দলের আর কারোর সঙ্গে কোনও মিল তেমন পাওয়া যায়নি, নৃবিজ্ঞানীরা এমনটাই বলেন।


চাষ করে আমার সদগোপ পূর্বপুরুষ। ফালাফালা মাটি, আকাশ ছেঁচা জল, মাটি ঘেঁটে ঘেঁটে ফসল তোলে ঘরে। লাঙলের ফালে তেল সিঁদুরের পূজো অম্বুবাচীর দিনে। লাঙলের ব্যবহার অস্ট্রালয়েড জনের ধারা। লাঙল শব্দও এসেছে এদেরই ভাষা থেকে। অস্ট্রালয়েড ভাষায় লাঙল শব্দের মানে চাষ করা, কিংবা হল। এই একই অর্থে লাঙল শব্দের ব্যবহার সংস্কৃতে। ভাষাতাত্বিক যুক্তি দিলেন যদি কোনও জিনিসের ব্যবহার অজানা হয় তবে তার নির্দেশক শব্দও অভিধানে থাকেনা। আদি নর্ডিক আর্যরা কৃষিকাজ শিখেছে এদেশে এসে, লাঙল শব্দও তখন জুড়ে গেছে সংস্কৃত ভাষার অভিধানে। একই ভাবে দা, করাত, কানি, চোঙা, চিখিল, চোঙ, লেবু, কামরাঙা, ডুমুর ঝোপঝাড় ইত্যাদি এসেছে অস্ট্রিক শব্দ থেকে। দামলিপ্তি(তাম্রলিপ্ত) আর পৌন্ড্র, বঙ্গ এসব শব্দও অস্ট্রিক। নদী পাহাড় জঙ্গলেও পড়ে আছে অস্ট্রালয়েড জনের ছাপ। দাক্ হলো জল, দাক্ থেকে সংস্কৃত উদক। দাম-দাক্ দামোদর। আমাদের ভরা বর্ষার দামোদর।


মেঘ নামছে পাকুড় গাছের মাথায়। রাখাল ফিরে আসছে, দীঘির জলে ডোঙা বেয়ে ঘোরে হারান কাকার ছেলে পরেশ। মাথায় তালের টোকা। পেরিয়ে যাচ্ছি ফণীমনসার ঝোপ, মনসার থান, বর্গী’র মাঠ। বীজধান রোয়ার সময় এখন। চিকচিকে সবুজ ঢেউ ধানি জমির গায়ে। লাঙলের ফালে মাটি কেটে কেটে চাষ করে সেইসব অস্ট্রালয়েড মানুষ, সমতল জুড়ে, ধাপ কেটেকেটে পাহাড়ের গায়ে। চাষ করে আমার চৌদ্দপুরুষ, চাষ করে হারান বাগদী, কানন দুলে, শিবু ডোম।


পণ, গন্ডা, কাহনের হিসেবে বীজ রুইছে। মাড়াই করা খড়ের হিসেব হচ্ছে কাহন দরে। আজ নয়, কাল নয়, হাজার হাজার বছর ধরে আমার চাষী পূর্বজ শিখেছে এই হিসাব। প্রতি চারে এক গন্ডা, কুড়ি গণ্ডায় এক পণ, ষোল পণে এক কাহন। কাহনে পণে আঁটি গুনছে আমাদের ঠাকুরদা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপের আদিম মানুষ গোনে দু হাতের দশ আঙুল, কুড়ির হিসাবে। গন্ডা হল একক, গন্ডা হল চার। চার কুড়িতে এক পণ। বিড়বিড় করে বীজধানের হিসাব কষে দাদু, বীজতলা জুড়ে সবুজ বিছায় হারান কাকা।


ভুবনেশ্বর শিবের ভাঙ্গা মন্দিরের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াই। স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা। কবেকার এই মন্দির ছিল জানেনা আমার দাদু, জানেনা গ্রামের কেউ। হয়ত মন্দির নয় ,বৌদ্ধ বিহার। বৌদ্ধ জৈন ব্যবসায়ীরা আসতো দ্বারকেশ্বরের ঘাটে ঘাটে, সওদা হত ধুনো, কাঁসার বাসন, আখের গুড়। ক্রিট দ্বীপের সাথে বাঙালির ব্যবসা ছিল মশলা, হাতির দাঁত, কাপড়ের।

দেবরাজ ইন্দ্র পণিদের কাছে শিখছেন পনীর আর ছানা তৈরির হালহকিকত। পণি থেকে আসা পণ্য কিম্বা বণিক শব্দের সূত্র আমাদের নিয়ে যায় দূরে, ভূমধ্য সাগরের দেশে। এই সেই ভূমধ্যসাগরীয় দল যারা হয়ত এসেছিল তামা'র খোঁজে। প্রফেসর এলিয়ট স্মিথ এই তামার ব্যবহারকেই দায়ী করেছেন মধ্যপ্রাচ্য আর ভূমধ্যসাগর উপকূলের মানুষগুলোর ভারত সহ নানান দেশে ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে, ঠিক যে কারণে মেগালিথ কাল্টে বিশ্বাসী সূর্যপূজারী লোকেরাও ছড়িয়ে যাচ্ছিল পৃথিবীর নানান কোণায়। আর্যভাষী অ্যালপো দিনারীয় দলগুলোও হয়ত এসেছিল এদেরই পিছু পিছু, সম্ভবতঃ নর্ডিক আর্যদেরও আগে।


বর্ধমানের আউস গ্রামের কাছে যে পাণ্ডু রাজার ঢিবি, সেই ঢিবিতেই পাওয়া গেছে ক্রিট দ্বীপে ব্যবহার হওয়া লিপিতে লেখা এক সিলমোহর। মিশরীয় এক নাবিকও তাঁর 'পেরিপ্লাস" বইয়ে লিখছেন প্রায় তিন হাজার বছর আগে ক্রিট দ্বীপে বাঙালি উপনিবেশের কথা।


বর্ষা ছিল সেদিন, উপুড় হয়ে পড়েছে আকাশ। লাল চেলি, চন্দনের টিপ– কড়ি খেলে ঠাকুমা, কড়ি খেলে আমার দিদিঠাকুমা। কড়ি খেলে ফিজি, নিউগিনি, পাপুয়ার মেয়েরা। মাঠঘাট ভাসছে বৃষ্টিফোঁটায়, বৃষ্টি নাচছে দীঘির জলে। কলার ডোঙায় ভেসে বেড়ায় কালু ডোম, পদ্মপাতায় টলটলে জল। পাড়ে ভিজছিল ডোমনি রাধু আর তার বাঁশের চুপড়ি। রাধুর চিকন সবুজ গা, ভ্রমরকালো চোখ, ছড়ানো নাক, ছোট্ট কপাল।


“এক সো পদমা চউসট্‌ঠী পাখুড়ি।

তহিঁ চড়ি নাচই ডোম্বি বাপুড়ি॥”


ডিঙ্গা ভাসছিল জলে। কাঠের সাথে কাঠ জুড়ে জুড়ে মস্ত ডোঙা ভেসে যাচ্ছিল জলে, প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউয়ের মাথায়। ভেসে যাচ্ছিল আদি অস্ট্রালয়েড মানুষ আর তাদের জলজ অভিসার সিংহল, ইন্দোনেশিয়া, মেলানেশিয়া ছাড়িয়ে আরও দূরে অস্ট্রেলিয়ার আদিম মাটিতে, প্রাগৈতিহাসিক এক সন্ধ্যার উপকূলে।


বৃষ্টি পড়ছিল খুব… বৃষ্টি পড়ছে জোরে। ভেসে যাচ্ছে মাঠ, দীঘির পাড়। দূর ,অতি দূর থেকে বিনবিন শব্দ উড়ে আসে হাওয়ায় এক কুড়ি, দু কুড়ি... চার কুড়ি পণ…
1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সৈকত মণ্ডল

Posted in






বাল্মীকি রামায়ণে অনেকগুলি উপেক্ষিত চরিত্রের মধ্যে শান্তা অন্যতম। কাব্যে তিনি ঠাঁই পেয়েছেন শুধু আদিকাণ্ডেই। তার পরিধি খুবই সামান্য, কিন্তু রামায়ণ কাব্যে তাকে নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। রামায়ণে তিনি ঠিক কার কন্যা সেটাই একটা রহস্য। তিনি ঋষ‍্যশৃঙ্গের পত্নী। এই ঋষ‍্যশৃঙ্গ মুনির সাহায্য নিয়ে রাজা দশরথ পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করেন ও ফলস্বরূপ তাঁর চারটি পুত্র হয়। রামায়ণ ব্যতীত অন্যত্র কবিরা শান্তাকে কেমন ভাবে দেখেছে এই সমস্ত দিক গুলো নিয়ে এই লেখাটির বিষয়বস্তু, তবে শুরুতে বাল্মীকি রামায়ণে শান্তার জন্ম নিয়ে আলোচনা করা যাক।

বাল্মীকি রামায়ণের লিখিত রূপে সমস্ত ভারতবর্ষে যতগুলি পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়, সেটিকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই বিভাজন পন্ডিতরা করেছেন লিপি ও তাদের মধ্যে সম্পর্ক অনুযায়ী। সংস্কৃত ভাষার নিজস্ব কোনো হরফ / স্ক্রিপ্ট নেই। এটি যে কোনো লিপিতে লেখা যায়। এমনকী রোমান হরফেও। দক্ষিণ ভারতের লিপি - গ্রন্থ, তেলুগু ও মালায়লমে - যে সমস্ত বাল্মীকি রামায়ণের পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে, তাদের একাডেমিক ভাষায় বলা হয়েছে দক্ষিণ /সাউথ রিসেন্সন। সহজ ভাবে বললে দক্ষিণ ভারতের বাল্মীকি রামায়ণের পাণ্ডুলিপি। দক্ষিণের পাণ্ডুলিপির মধ্যে পাঠান্তর থাকলেও মোটামুটি ভাবে টেক্সটগুলির মধ্যে তেমন বিশেষ ফারাক নেই। তার উপর দক্ষিণের পন্ডিতদের (ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের) মধ্যে একটা সুদীর্ঘ্য কাল ধরে রামায়ণের উপর টীকা লেখার চল ছিল। মধ্যযুগের পন্ডিত গোবিন্দরাজ ও তিলকদের টীকা ও টেক্সট কালের প্রবাহে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর মধ্যে তিলকের টেক্সট (যার মধ্যে বাল্মীকি রামায়ণের টেক্সট ও তিলকের নিজের টীকা আছে) প্রচলিত টেক্সট / ভালগেট টেক্সট হিসেবে পরবর্তী কালে মান্যতা পায়। তেমনি ভাবে উত্তর ভারতের পাণ্ডুলিপি রয়েছে বাংলা, মৈথিলি, কাশ্মীর, ওড়িয়া, ও নেপালি লিপিতে। এরা হলো নর্থ রিসেন্সন। এই নর্থ রিসেন্সন আবার দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটি গৌড়-বঙ্গ থেকে নেপালের ধারা নিয়ে বয়ে চলেছে, অর্থাৎ ভারতের নর্থ-ইস্ট রিসেন্সন, অন্যটি কাশ্মীর থেকে পাকিস্তান (বিভাজনের আগে) হয়ে, অর্থাৎ নর্থ-ওয়েস্ট একটা আলাদা ঘরানায় গড়ে উঠেছে। দেবনাগরী লিপি নর্থ ও সাউথ দুটোতেই পাওয়া যায়। নর্থ ও সাউথের টেক্সট মোটামুটি ভাবে একই থাকলেও তাদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে কাহিনী স্তরে ও শ্লোক গঠনে তফাৎ পরিলক্ষিত হয়। ঠিকই এমনই একটি আকর্ষক অংশ হলো শান্তার জন্ম রহস্য।

প্রচলিত টেক্সটে (অষ্টম সর্গ থেকে) আমরা জানতে পারি রাজা দশরথ অপুত্রক। তিনি পুত্রলাভের আশায় সুমন্ত্র (প্রধান মন্ত্রী) ও বিভিন্ন পন্ডিতদের সঙ্গে আলোচনা করছেন একটি অশ্বমেধ যজ্ঞ করার। সরযূ নদীর উত্তরতীরে যজ্ঞানুষ্ঠানের উপযুক্ত ভূমি নির্মাণ করে, একটি অশ্বকে ভ্রমণের জন্য ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলো। তারপর সুমন্ত্র রাজাকে গোপনে একটি কাহিনী বলেন। তিনি ঋষিগণকর্তৃক কথিত একটি শ্রুতি-কাহিনী শুনেছিলেন বহু পূর্বে -- ব্রহ্মার পুত্র সনৎকুমার ঋষিদের জানিয়েছিলেন কীভাবে রাজা দশরথ পুত্রলাভ করতে পারবেন। গল্পটি এরকম: কাশ্যপ মুনির একটি পুত্র আছেন, যিনি বিভান্ডক নামে প্রসিদ্ধ। তার পুত্র হলো ঋষ‍্যশৃঙ্গ যার ব্রহ্মচর্য্যের গুন সংসারে প্রসিদ্ধিলাভ করেছিল। সমসাময়িক অঙ্গদেশে রোমপাদ নামে এক মহাপ্রতাপশালী রাজা রাজ্যপালন করতেন। তার দুরাচরণের জন্য অঙ্গরাজ্যে দারুন অনাবৃষ্টি হয়। এর থেকে মুক্তির পথ একটাই বেরিয়ে আসে, সেটি হলো ঋষ‍্যশৃঙ্গ মুনিকে যেভাবেই হোক অঙ্গরাজ্যে নিয়ে আসতে হবে, এবং তার সঙ্গে রাজার কন্যা শান্তাকে বিধিপূর্বক সম্প্রদান করতে হবে - "প্রযচ্ছ কন্যাং শান্তাং বৈ বিধিনা সুসমাহিত (১/৯/১৩)"।

এই প্রথম আমরা জানতে পারলাম শান্তার কথা। উনি রাজা রোমপাদের কন্যা। তারপর ছলের দ্বারা (বার্বনিতা দের সাহায্যে) ঋষ‍্যশৃঙ্গকে রাজ্যে আনা হলো, এবং তিনি নগরে পা দেওয়া মাত্রই বৃষ্টি আরম্ভ হলো। ঋষিকে এভাবে ছলনাপূর্বক আনয়ন করার ফলে তার অন্তরে যেন ক্রোধের উদয় না হয়, তাই বিধি অনুসারে শান্তাকে শুদ্ধমনে সমর্পণ করে রাজা আনন্দ লাভ করলেন। সুমন্ত্র দশরথকে বলেন ঐ "জামাতা" ঋষ‍্যশৃঙ্গ আপনার পুত্রপ্রাপ্তিসম্পাদন করতে পারবেন (১/৯/১৯)। এটাকে দুটিভাবে ব্যখ্যা করা যায়। রোমপাদের মেয়ে-জামাই যেন দশরথেরও মেয়ে-জামাই তুল্য। সনৎকুমার এটাও বলেছিলেন যে ইক্ষ্বাকু বংশে দশরথ নামে একজন সত্যনিষ্ঠ রাজা জন্মাবেন, দশরথ নামে, এবং অঙ্গরাজ্যের রাজা রোমপাদের সঙ্গে তার মিত্রতা হবে। তাই মিত্রের কন্যা-জামাইকে নিজের মেয়ে-জামাই ভাবতে দোষ কোথায়? দ্বর্থক অর্থে তেমনি এটাও হতে পারে, শান্তা হয়তো রাজা দশরথের কন্যা। উনি রোমপাদকে তার কন্যা দান করেছিলেন।

সনৎকুমারের কথা অনুযায়ী দশরথ রোমপাদের কাছে গিয়ে বলবেন - "আমি নিঃসন্তান। আপনার জামাতা, শান্তার স্বামী, ঋষ‍্যশৃঙ্গকে আপনার আদেশমত যজ্ঞ করতে বলুন। সেটা হলে আমার বংশরক্ষা হয় (১/১১/৪-৫)"। ঋষ‍্যশৃঙ্গ মুনি আসবেন, যজ্ঞ করবেন ও রাজার চারটি পুত্র হবে। এই শুনে রাজা দশরথ তার তিন স্ত্রী ও অন্তঃপুরস্থিত মহিলাগণদের সঙ্গে নিয়ে অঙ্গদেশে উপস্থিত হলেন। ওখানে সাত-আটদিন কাটানোর পর, একদিন দশরথ তার মিত্রকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বললেন - "আপনার কন্যা শান্তা পতিসহ মদীয় নগরী অযোধ্যায় গমন করুন - শান্তা তব সুতা রাজন্! সহ ভর্ত্রা বিশাংপতে (১/১১/১৯)"। রোমপাদ অনেক ভাবনা চিন্তা করে ঋষ‍্যশৃঙ্গকে বললেন - "তাই হোক, তুমি পত্নীর সহিত গমন করো।"

রামায়ণের একজন বিখ্যাত স্কলার ও অনুবাদক রালফ গ্রিফিথের এই অংশটির অনুবাদ পড়লে মনে হয় শান্তা যেন দশরথের নিজ কন্যা।

“This king,” he said, “from days of old
A well beloved friend I hold.
To me this pearl of dames he gave
From childless woe mine age to save,
The daughter whom he loved so much,
Moved by compassion's gentle touch.
In him thy Śántás father see:
As I am even so is he."

(Canto X)

শান্তা ও ঋষ‍্যশৃঙ্গ মুনি দীর্ঘ্য সময় অযোধ্যায় কাটিয়েছিলেন। ঋষ‍্যশৃঙ্গর তত্ত্বাবধানে অশ্বমেধ ও পুত্রেষ্টি যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়। এবং তাদের দুজনই বিশেষভাবে পূজিত হয়ে আবার অঙ্গদেশে ফিরে যায়। তাহলে লক্ষ করলে দেখা যাবে প্রচলিত টেক্সটে দু-একটি জায়গায় হাল্কা ইঙ্গিত থাকলেও কোথাও স্পষ্ট করে বলা নেই শান্তা দশরথের মেয়ে। এমনকী তিনি রোমপাদকে তার কন্যা দান করেছেন একথা কোথাও উল্লেখ নেই।

এবার নর্থ রিসেন্সন দেখা যাক। এখানকার পাণ্ডুলিপিতে অঙ্গদেশের রাজার নাম রোমপাদ নয়, বরং লোমপাদ - "এতস্মিন্নেব কালে তু লোমপাদঃ প্রতাপবান্ (১/৮/১১)"। দশম সর্গতে সুমন্ত্র জানায় তিনি সনৎকুমারের শ্রুতিকথনে জেনেছিলেন অঙ্গরাজ লোমপাদের সঙ্গে রাজা দশরথের মিত্রতা হবে। রাজা দশরথের শান্তা নামে সৌভাগ্য-শালিনী একটি কন্যা জন্মলাভ করবে।

ইক্ষাকুবংশজো রাজা ভবিষ্যতি মহাযশাঃ।
নাম্না দশরথো নাম ধীমান্ সত্যপরাক্রমঃ॥২॥
সখ্যং তস্যাঙ্গরাজেন ভবিষ্যতি মহাত্মনঃ।
কন্যা চাস্য মহাভাগা শান্তা নাম ভবিষ্যতি ॥৩॥

অঙ্গরাজের কোনো সন্তান হবে না। তিনি রাজা দশরথের নিকট প্রার্থনা করবেন - "সখা, আমি নিঃসন্তান। তুমি প্রসন্ন মনে তোমার এই শান্তা নাম্নী অসামান্য-রূপ-লাবন্যবতী তনয়া আমাকে প্রদান কর - আমি "পুত্রিকা" করব। করুনহৃদয়ের রাজা তার হৃদয়-নন্দিনীকে প্রদান করবেন (১/১০/৫-৮)"।

দশরথ ও ঋষ‍্যশৃঙ্গ মুনির সামনে, লোমপাদ আরো বলেন - "ঋষিকুমার! এই রাজা দশরথ আমার পরম-প্রিয় সখা। আমার সন্তান না হওয়াতে আমি "পুত্রিকা করবার নিমিত্ত" ইঁহার আত্মজা বরবর্ণিনী শান্তাকে যাচঞা করেছিলাম। ইনিও তৎক্ষণাৎ অক্ষুব্ধ-হৃদয়ে এই প্রিয়তমা কন্যা আমায় প্রদান করেছিলেন। আমার ন্যায় এই দশরথও সম্পর্কে আপনার শ্বশুর হন। আপনি শান্তাকে নিয়ে অযোধ্যায় গমন করুন (১/১০/২৫-২৯)"।

তাহলে নর্থ রিসেন্সন (সমগ্র উত্তর ভারতের বাল্মীকি রামায়ণের পাণ্ডুলিপিতে) রামায়ণে পরিষ্কার উল্লেখ পাই শান্তা দশরথেরই কন্যা। রামায়ণের শুদ্ধ সংস্করণ (ক্রিটিক্যাল এডিশন) এক্ষেত্রে দক্ষিণের পাঠ রেখে দিয়েছে। ক্রিটিক্যাল এডিশন রামায়ণের টেক্সট গঠনের মেথড একটু ভিন্ন ক্রিটিক্যাল এডিশন মহাভারতের টেক্সট গঠনের থেকে। মহাভারতে যেমন শারদা (কাশ্মীর) ও মালায়লম লিপিকে একটা একটা base ধরে বাকি পাণ্ডুলিপির প্রক্ষেপ ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা হয়েছে (এটা খুবই সরল ভাবে বলা হলো, আসল প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল), রামায়ণের ক্ষেত্রে সেরকম নয়। এখানে দক্ষিণের টেক্সটের ৭৫% রাখা হয়েছে এবং সেই অংশগুলো দক্ষিণের টেক্সট থেকে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে যেগুলো উত্তর ভারতে সাক্ষ্য দেয় না। কিন্তু উত্তর ভারতে যদি কোনো অংশ এক্সট্রা থাকে যেটা আবার দক্ষিণে সাক্ষ্য দেয় না, সেক্ষেত্রে তারা সেটিকে বাদ দিয়েছে, তাদের মেথড এটাকে প্রক্ষেপ বলে মনে করে।

এখানে সমস্যাটি আরো গভীর। তার কারণ বহু রামায়ণ গবেষকদের মতে আদিকান্ডের বেশ অনেক অংশ পরের সংযোজন। জন ব্রকিংটন Rama the Steadfast: The Early Form of Ramayana তে লিখছেন গোটা আদিকান্ড টাই পরে যোগ হয়েছে। ওঁর মতে রামায়ণের একদম প্রাথমিক স্টেজে মূল কবির হাতে আদিকান্ড রচনা হতে পারে না, এবং এই ধারণা একেবারেই ভ্রান্ত বলা যায় না। হার্মান জেকবি, কামিল বুলকে, রবার্ট গোল্ডম্যান, চিন্তামনি বৈদ্য, ক্রিটিক্যাল এডিশনের প্রত্যেকটি এডিটর ও আরো অনেক পন্ডিতরাই মনে করেন আদিকান্ডের মধ্যেও অনেক স্তর আছে যেগুলির সময়কাল ইতিহাসের মেথড দিয়ে বের করা সম্ভব। ব্রকিংটনের মতো পুরোটাই পরে রচিত হয়েছে না বলে, বেশিরভাগ পন্ডিত এটাই বলেন শুরুতে আদিকান্ডের খুব অল্প অংশ মূল কাব্যের অন্তর্গত ছিল।

জেকবি তার বিখ্যাত বই Das Ramayana তে লিখছেন রামের জন্ম ও গোটা ঋষ‍্যশৃঙ্গ অধ্যায়টাই পরের সংযোজন। উনি মনে করেন কাব্যের নায়কের জন্মের একটা সংক্ষিপ্ত কাহিনী হয়তো একটি ছিল, কেমন আকারে জানা নেই, কিন্তু সেটা কোনো অজ্ঞাত কারণে হারিয়ে গেছে। সেটাকে পূরণ করতে এরকম একটি কাহিনীর অবতারণা করতে হয়েছে যেখানে বিষ্ণু নিজে অবতার রূপ ধারণ করে দসরথের পুত্র হয়ে জন্মাবেন। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে রাম শুরুতে বিষ্ণুর অবতার ছিলেন না, এটির ধারণা টেক্সটে ঢুকছেন অনেক পরে, যখন বিষ্ণু-কাল্ট ভারতে পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ক্রিস্টপূর্ব ৭০০-৬০০ তে এই কাব্যের গোড়ার স্টেজে (গোল্ডম্যান বালকাণ্ডের ভূমিকা) লেটার-বৈদিক পটভূমিকায় বিষ্ণু অবতার রূপে কখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন না। ফলে রামের জন্মের পুরো অধ্যায়টাই হয়তো পরে রচিত হয়েছে, এমনটা অনেকেই মনে করেন। সেক্ষেত্রে, শান্তার কাহিনীও পরে যোগ হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তবে এটা বলাটা খুবই মুস্কিল নর্থ রিসেন্সনে বর্ণিত অংশগুলি সম্পূর্ণরূপে প্রক্ষেপ কিনা। এটা বলা যায় না কারণ কোনো রাজা নিজের কন্যা অন্য মিত্র রাজাকে দান করেছেন, এরকম উদাহরণ আমরা মহাভারতেও দেখেছি, কুন্তীর ক্ষেত্রে। তেমনি রোমপাদ / লোমপাদ যদি পুত্রিকা হিসেবে কন্যাকে গ্রহণ করেন, সেক্ষত্রে ব্যাপারটি খুবই ইন্টারেস্টিং হয়ে যায়। একটু বিশদে আলোচনা করা যাক।

মহাভারতে রামকথার একটি অংশ পাওয়া যায় বনপর্বে। ওটি ছাড়াও সমগ্র মহাভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক উপাদান আছে যেগুলিকে রামায়ণের সঙ্গে যুক্ত করা যায়। তীর্থযাত্রা পর্বে (৩/১১০) আমরা জানতে পারি অঙ্গদেশের রাজার নাম লোমপাদ। মূল কাহিনীটি মোটামুটি রামায়ণের সঙ্গে এক, শুধু এখানে ঋষ‍্যশৃঙ্গকে ছলনা করে এনে মেয়েদের কক্ষে রাখা হয়েছিল। বিভান্ডক ঋষি তার পুত্রকে না খুঁজে পেয়ে রেগে আগুন হয়ে যায় এবং বুঝতে পারে তার পুত্রকে অঙ্গরাজ নিয়ে গেছে। কিন্তু পরে তার মন গলে যায়। রাজাকে বলে শান্তার গর্ভে সন্তান আসার পর ঋষ‍্যশৃঙ্গ যেন বনে ফিরে আসে। বাধ্য সন্তানের মত ঋষ‍্যশৃঙ্গ বনে ফিরে যেতে চাইলে শান্তাও তার সঙ্গে পতিব্রতা নারীর মত সঙ্গ দিতে চায়। সেক্ষেত্রে শান্তার সন্তান অঙ্গরাজ্যেই রয়ে যায় (অনুমান করা যায়), এবং ঋষ‍্যশৃঙ্গ-র পরের সন্তান (অনুমান করা যায়) শ্বশুরের বংশের দ্বীপ হয়ে জন্মলাভ করার কথা। পুত্রিকা হলো সেই কন্যা যার সন্তান তার মায়ের বংশের উত্তরাধিকারী হবে। অনেক ক্ষেত্রে সেই নারী ক্ষতিকারক হতে পারে যে বংশে তার বিয়ে হচ্ছে তাদের কাছে। মহাভারতে এই উদাহরণ প্রচুর আছে - চিত্রাঙ্গদা, সাবিত্রী, ইত্যাদি। যেমন চিত্রাঙ্গদা ছিলেন পুত্রিকা। অর্জুন তাকে বিয়ে করতে চাইলে চিত্রাঙ্গদার বাবা বলেন তার একমাত্র কন্যার পুত্র-ই এই বংশের রাজা হবে। অর্জুন সেটি জানা সত্ত্বেও তাকে বিবাহ করে। তাদের পুত্র হয় বভ্রুবাহন। এই বভ্রুবাহন কিন্তু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি। কিন্তু পরে বাবা আর ছেলের মধ্যে যুদ্ধ হয় (অনেকটা পারস্য কাব্যের শাহনামের সোহরাব ও রোস্তমের কাহিনীর মত) এবং সেখানে অর্জুন মারা যায়। আবার সে অলৌকিক ভাবে উলুপির (তার অন্য একটি পত্নী) কৃপায় বেঁচে হস্তিনাপুরে ফিরে আসে। সেখানে তার বিধবা পুত্রবধূ পরীক্ষিত নামে একটা সন্তানের জন্ম দেয় ও যুধিষ্ঠিরের পরে সেই বংশের রাজা হয়। কিন্তু যেসব ব্যক্তির অর্জুনের মত একাধিক পত্নী নেই এবং একটি মাত্র স্ত্রী-ই যদি পুত্রিকা হয়? তাই শান্তার বিষয়টি খুবই আকর্ষক। এটা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার যে শান্তা তার স্বামীর সঙ্গে বনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। রামায়ণে এরকম কোন ইঙ্গিত নেই। তেমনি মহাভারতের রামোপাখ্যান অংশে পুত্রেষ্টি যজ্ঞেরও উল্লেখ নেই।

তাহলে কী দাঁড়ালো?

রামায়ণের ভিন্ন রিসেন্সনে শান্তার জন্ম নিয়ে পাঠ্ভেদ আছে। প্রচলিত টেক্সট শুধু এটুকুই বলে দশরথ ও রোমপাদ ছিলেন ভালো বন্ধু, এবং শান্তা রোমপাদের কন্যা (১/৯/১৩ ও ১/১১/১৯)। যখন শান্তা অযোধ্যায় আসে ওর স্বামীর সাথে টেক্সট কিন্তু বলেনি যে সে তার বাপের বাড়ি ফিরে আসছে, বা শান্তার দিক থেকেও কোনো প্রতিক্রিয়া কবি জানায়নি, যেটা অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। তেমনি টেক্সট এটাও বলে দশরথ অনপত্য (১/১১/৫) অর্থাৎ নিঃসন্তান ছিলেন। এমনকী নর্থ রিসেন্সনে শান্তাকে লোমপাদের কন্যাও বলা হয়েছে (গৌড়ীয় ১/৮/২৬; লাহোর এডিশন ১/৮/২৫)। মহাভারতে শান্তা লোমপাদেরই কন্যা এবং কবি জানাচ্ছেন না যে দশরথ তাঁর পুত্রীকে দান করেছিলেন (৩/১১০/৫; ১২/২২৬/৩৫ ও ১৩/১৩৭/২৫)। তেমনি হরিবংশ পুরাণ (১/৩১/৪৬), মৎস্য পুরাণ (৪৮/৯৫), বায়ু পুরাণ (১১/১০৩) এগুলিতে শান্তাকে লোমপাদের মেয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে দক্ষিণী পাঠের মধ্যেই সুমন্ত্রের কথায় আমরা ইঙ্গিত পাই (১/৯/১৯) যে শান্তা হয়তো দশরথের কন্যা ছিলেন। তেমনি (১/১১/২-৩) শ্লোক গুলি খুবই ইনটারেস্টিং।

ইক্ষাকূণাং কুলে জাতো ভবিষ্যতি সুধার্মিক:৷
রাজা দশরথো নাম্না শ্রীমান্সত্যপ্রতিশ্রব: II
অঙ্গরাজেন সখ্যং চ তস্য রাজ্ঞো ভবিষ্যতি৷
কন্যা চাস্য মহাভাগা শান্তা নাম ভবিষ্যতি ৷৷

ক্রিটিক্যাল এডিশন টেক্সট "অস্য" রেখেছে যেটা অঙ্গরাজকে ইঙ্গিত করে, কিন্তু দক্ষিণের প্রচুর পাণ্ডুলিপিতে এটি আছে "তস্য"। উত্তর ভারতের লিপিগুলোতে তো আছেই (ক্রিটিক্যাল এডিশন ফুটনোট - ১/১০/৩) তস্য, যেটা পরিষ্কার ইঙ্গিত করে শান্তা দশরথের কন্যা। নর্থ রিসেন্সনে ঠিক এই শ্লোকের পরে আমরা জানতে পারি কোন পরিস্থিতিতে রাজা দশরথ শান্তাকে দান করেছিলেন (পূর্বেই লিখেছি - ১/৯/৪-৫)।

এই সমস্যার মূল উৎপত্তি হয়তো অন্যত্র। হরিবংশ, মৎস, বায়ু ও ব্রহ্ম পুরাণে অঙ্গরাজার নাম চিত্ররথ। তার পুত্রের দুটি নাম - লোমপাদ ও দশরথ। এমনটি হয়তো হয়েছিল শান্তা প্রথমে অঙ্গের রাজা দশরথের কন্যা ছিল, কিন্তু ততদিনে অজের পুত্র দশরথ খুবই জনপ্রিয় রাজা হয়ে উঠেছেন। এবং তার পর থেকে শান্তা দশরথের কন্যা বলেই পরিচিতি লাভ করেছে। তেমনি বিষ্ণু পুরাণ (৪/১৪/১৪), ভাগবত পুরাণ (৯/২৩/৮), ভবভূতির উত্তররামচরিত, স্কন্দ পুরাণ, পদ্ম পুরাণের পাতালকান্ড, আনন্দ রামায়ণ (১/১/১৬-১৭), সরলা দাসের ওড়িয়া মহাভারতে শান্তা দশরথের কন্যা। ১৬-শতাব্দী বলরাম দাসের রামায়ণে আমরা প্রথম জানতে পারি শান্তা হলো কৌশল্যার মেয়ে। কৃত্তিবাস রামায়ণে (১/২৯) দশরথ তার কন্যাকে দান করেন লোমপাদকে। মেয়েটির নাম হেমলতা। অনুমান করতে অসুবিধা হয়না ইনিই শান্তা। চন্দ্রাবতীর রামায়ণে ও কাশ্মীরি রামায়ণে আমরা পাই কৈকেয়ীর একটি কন্যার কথা যে সীতাকে সহ্য করতে পারতো না। একই থিম আমরা পাই সুবর্চ রামায়ণে যেখানে সীতা শান্তাকে অভিশাপ দেয়। ইন্দোনেশিয়ার "হিকায়েত সেরি রাম" এ শান্তা হলো ভরত-শত্রুঘ্নর নিজের বোন। সিয়াম এর রাম-জাতকে শান্তার বিয়ে হয় রাবণের সঙ্গে। তেমনি প্রাচীন পালি টেক্সট দশরথ জাতকে সীতা রাজা দশরথের মেয়ে। ফলে দশরথের কন্যা ছিল এটা এনটিকুইটি সাক্ষ্য দেয় -- বাল্মীকি ও অন্যান্য রামকথায় আমরা পাই। তবে সব থেকে বিচিত্র কাহিনী পাওয়া যায় মাধবদাসের বিচিত্র রামায়ণে। ওখানে এক ঋষি রাজাকে অভিশাপ দেন ও বলেন সে নিঃসন্তান হবে। পরে আবার দেখা হলে ও রাজা ক্ষমা চাইলে, ঋষি অভিশাপ পাল্টে ফেলে বলেন তার প্রথম সন্তান একটি কন্যা হবে এবং তার বিয়ে হবে ঋষ‍্যশৃঙ্গের সঙ্গে। তারপর ঋষ‍্যশৃঙ্গ যজ্ঞ করলে তার চারটি সন্তান হবে। তারপর শান্তার বিবাহের বয়স উপস্থিত হয়ে স্বয়ম্বর আয়োজন করা হয়। সেখানে হঠাৎ উপস্থিত হন পরশুরাম। তিনিই বলেন শান্তার সঙ্গে ঋষ‍্যশৃঙ্গের বিবাহ দেওয়া হোক।


পাঠ্যসূচী

কৃতজ্ঞতা স্বীকার - যে দুজন ব্যক্তি আমাকে উপকার করেছেন এটি লিখতে, রবার্ট গোল্ডম্যান ও কনাদ সিংহ।

১) আকর সূত্র

পঞ্চানন তর্করত্ন - রামায়ণম
আর্য্যশাস্ত্র - বাল্মীকি রামায়ণ
রামায়ণ সারানুবাদ - রাজশেখর বসু
বাল্মীকি রামায়ণ ক্রিটিক্যাল এডিশন - Vol 1
রবার্ট গোল্ডম্যান - The Ramayana of Valmiki vol 1
ভগবৎ দত্ত - The Ramayana of Valmiki (North West Recension)
অমরেশ্বর ঠাকুর - বাল্মীকি রামায়ণম
এম এন দত্ত - দি মহাভারত (vol 2)
বিষ্ণু সুকথঙ্কর - ক্রিটিক্যাল এডিশন মহাভারত (আরণ্যক পর্ব)
জন স্মিথ - দি মহাভারত
রালফ গ্রিফিথ - The Ramayana of Valmiki
এম এন দত্ত - হরিবংশ
সাইমন ব্রডব্রেক - Krishna's lineage: The Harivamsa of Vyasa's Mahabharata
শান্তি লাল নগর - আনন্দ রামায়ণ

২) রামায়ণের টেক্সট গঠন

জন ব্রকিংটন - Rama the Steadfast: The Early form of Ramayana
হার্মান জেকবি - Das Ramayana
এল এ ভ্যান ডালেন - Valmiki's Sanskrit
রবার্ট গোল্ডম্যান - Vol 1 ভূমিকা
জি এস আলটেকর - Studies on Valmiki Ramayana

৩) পুত্রিকা

কনাদ সিংহ - From Dasrajana to Kurukshetra
সাইমন ব্রডবেক - Putrika interpretation of the Mahabharata
সাইমন ব্রডবেক - The Mahabharata Patriline

৪) ভিন্ন রামকথা

ভি রাঘবন - The Ramayana tradition in Asia
ভি রাঘবন - The Greater Ramayana (পুরাণ নিয়ে আলোচনা)
শ্রীনিবাস আইয়েঙ্গার - Asian variations in Ramayana
কামিল বুলকে - অনুবাদ প্রদীপ ভট্টাচার্য: The Rama Story - Origins and Growth
অভদেশ কুমার সিংহ - Ramayana through the ages
2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিরুদ্ধ গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in


 



         

চারপাশে গাছপালা ঘেরা একটি পুকুর। চাঁদনী রাতের আলোতে তার টলটলে জলে মায়াবী ঝিলিমিলি খেলা। পুকুরের ঘাটে বসে এক তরুণ আনমনে বাজিয়ে চলেছে বাঁশি। তার মূর্চ্ছনা পৌঁছে যায় এদিক সেদিক। পাশের একটি বাড়ির জানালায় এক কিশোরীর মুখ। বাঁশির সুর তাকে করেছে সম্মোহিত। পরদিন দুজনের দেখা। মেয়েটি বললো, “কাল রাতে আপনি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন ? আমি শুনেছি।“

যুবকটি গাছের ছায়ায় শীতলপাটিতে বসে দিনের পর দিন অবলীলায় রচনা করে কবিতা,অনায়াসে বেঁধে চলে কত গান। মেয়েটিকে শেখায় সে গান, গ্রামের অন্য ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরও। স্বল্পশিক্ষিতা গ্রাম্য তরুণীটি এমন প্রতিভা, এমন অনাবিল স্বতস্ফূর্ত সৃজনী আগে দেখেনি। তার চোখেমুখে বিস্ময়, মুগ্ধতা। আর তরুণটি অভিভূত ঐ ষোড়শী কন্যাটির অনন্যা রূপে। তার সৌন্দর্য্, সৌষ্ঠভ তরুণটির হৃদয়ে এনে দিলো এক অনাস্বাদিত আলোড়ন। জাগিয়ে তুললো সৃষ্টিসুখের উল্লাস।

আর এক দৃশ্য। মেয়েটি জ্বরাক্রান্ত। যুবকের মন ব্যাকুল। সে চায় তার পাশে বসে তার তপ্ত কপালে হাত বুলিয়ে দিতে। কিন্তু রীতিনীতির বাঁধা। অবশেষে সুযোগ হলো। অনেক বছর পরে লিখেছিলো,”বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল; তোমার তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজো অনুভব করতে পারি। তুমি কি চেয়ে দেখেছিলে ? আমার চোখে ছিল জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রীবিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুণ মিনতি।“

এরা কালিদাসের কোন কাব্য, সেক্সপীয়রের কোন নাটক, বা শরৎচন্দ্রের কোন উপন্যাসের পাত্রপাত্রী হতে পারত অনায়াসে। কিন্তু এই চরিত্ররা কাল্পনিক নয়, নেহাতই বাস্তব। গ্রামটির নাম কুমিল্লা জেলার দৌলতপুর। তরুণীটির নাম সৈয়দা খাতুন। আর যুবকটি কাজী নজরুল ইসলাম।

নজরুলের বন্ধু কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, একদিন নজরুল সৈয়দা খাতুনকে বললেন, “এমন ফুলের মত যার সৌন্দর্য, তার এ নাম কে রেখেছে ? আজ থেকে তোমার নাম নার্গিস।“ সেই থেকে তাঁর নাম হয়ে গেলো নার্গিস, পুরো নাম নার্গিস আসার খানম। পারস্যদেশের একটি গুল্মের অতি সুগন্ধী শ্বেতবর্ণা ফুলের ফারসি ভাষায় নাম নার্গিস।

প্রেমের এই আলোড়ন নজরুলের সৃজনীসত্বাকেও উদ্বেলিত করেছিল এক বিপুল আবেগে। দৌলতপুরে অবস্থানকালেই নজরুল প্রায় ১৬০টি গান ও ১২০টি কবিতা রচনা করেছিলেন। ‘পাপড়ি খোলা’, ‘অবেলায়’, ‘অনাদৃতা’, ‘বিদায় বেলায়’, ‘হারমানা হার’, ‘হারামণি’, ‘বেদনা অভিমান’, ‘বিধুরা’, ‘পথিক প্রিয়া’ ইত্যাদি কবিতা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এই পর্বের অনেক বছর পরেও একাধিক বিরহ-বেদনা-অভিমানের গান তিনি সৃষ্টি করেছেন, যা এই সময়ের প্রতিফলন বলে অনেকে মনে করেন।

হ্যাঁ, এই প্রেম পূর্ণতা পায়নি। এর ব্যাপ্তি ছিলো মাত্র আড়াই মাস, বা তারও কম। অথচ নজরুল-নার্গিসের বিবাহ অনুষ্ঠানও অতি সমারোহে আয়োজিত হয়েছিল। কিন্তু সেই অনুষ্ঠান থেকে কোন কারণে নজরুল নিজেকে প্রত্যাহৃত করেন। ঠিক কি ঘটেছিল তা নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। অনেক নজরুল গবেষক বা জীবনীকাররা অনেক কথাই লিখেছেন। ষড়যন্ত্র, প্রতারণা, অসততা ইত্যাদির উপাদান সম্বলিত বেশ কিছু কাহিনী প্রচলিত। সে সবের সত্যাসত্য নিয়েও মতভেদ আছে। কিন্তু এই প্রেমপর্বের যে ঘটনাক্রম নিয়ে দ্বিমত নেই, তাই প্রথমে বিবৃত করা যাক।

বিশ্বযুদ্ধের শেষে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পেয়ে নজরুল তখন কলকাতায়। ফজলুল হকের নবযুগ পত্রিকায় কিছুদিন সম্পাদনার কাজ করেছিলেন,তখন তাও নেই। এদিক ওদিক কিছু কিছু লেখা বেরিয়েছে কয়েকটি পত্রপত্রিকায়। তবে খ্যাতি-পরিচিতি তখনও তেমনভাবে আসেনি। তিনি তখন যুক্ত ছিলেন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে, থাকতেন ৩২ কলেজ স্ট্রীটে তাদেরই ভবনে। সেখানে মোহম্মদ মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওয়াদুদ, মহম্মদ শহীদুল্লাহ ইত্যাদি তখনকার তরুণ মুসলিম লেখকরা তাঁর বন্ধু ও সহকর্মী ছিলেন। সদা প্রাণোচ্ছল, হাস্যময় নজরুলের বান্ধববৃত্ত বিস্তৃতই ছিল।

এদেরই মধ্যে একজন ছিলেন আলী আকবর খান। তিনি নজরুলের থেকে বয়সে বেশ কিছুটা বড় ছিলেন। কলেজ স্ট্রীটেই দুজনের পরিচয়। আলী আকবর কিছু কিছু লেখালেখি করতেন, একটা নাটক ও কয়েকটি কবিতা লিখেছিলেন, কিন্তু তার মান বিশেষ উঁচু ছিল না। তিনি নিজেই সে সব ছাপিয়ে বিক্রী করার চেষ্টা করতেন। ঐ পাড়ায় তাঁর একটি প্রকাশনা ছিল, মূলত পাঠ্যপুস্তকের। অবশ্য নজরুলের সম্ভাবনাময় প্রতিভা চিনে নিতে তাঁর দেরী হয়নি।

এই আলী আকবর খান ছিলেন কুমিল্লার মুরাদনগর থানার দৌলতপুর গ্রামের এক সম্পন্ন ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য। গ্রামে বিষয়-সম্পত্তি তাঁদের কম ছিল না। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে নজরুলকে তাঁদের গ্রামের বাড়ীতে যাবার আমন্ত্রণ করছিলেন। শেষে আলী আকবরের অগ্রজ নেজাবৎ আলীর মেয়ে আম্বিয়া খানম মানিকের বিবাহ উপলক্ষ করে নজরুল দৌলতপুর যেতে রাজি হন।

১৯২১ সালের ৩রা এপ্রিল নজরুল ও আলী আকবর রেলপথে যাত্রা করে পরদিন রাতে কুমিল্লা পৌঁছান। কুমিল্লা শহর থেকে দৌলতপুরের দূরত্ব আরও প্রায় ৪০ কিলোমিটার। সে সময়ে রাতের বেলায় অত দূর পাড়ি দেওয়া নিরাপদ ছিল না। কুমিল্লার কান্দিরপাড় এলাকায় আলী আকবরের এক স্কুলের সহপাঠী বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়ীতে দুজনে থাকা মনস্থ করেন। বাড়ীটি ছিল বীরেন্দ্রর বাবা ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের। তাঁর স্ত্রী এবং ইন্দ্রকুমারের মা’র নাম বিরজাসুন্দরী। এই পরিবারটি ছিল সুশিক্ষিত, সংস্কৃতিমনস্ক এবং উদারমনা। নজরুল-নার্গিস পর্বে এবং নজরুলের পরবর্তী জীবনেও বিরজাসুন্দরী ও তাঁর পরিবারের একটি বিশেষ ভুমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। এক রাত মাত্র নয়, নজরুলরা এ বাড়ীতে আরও দু-চার দিন অতিবাহিত করেন। এই স্বল্প পরিসরেই নজরুল এই পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন, এবং বিরজাসুন্দরীকে ‘মা’ সম্বোধন করতেন।

কান্দিরপাড় ছেড়ে নজরুল ও আলী আকবর অবশেষে দৌলতপুরে পৌঁছোন। সেখানে আলী আকবরের পরিবার ও দৌলতপুরবাসীরা নজরুলকে অতি সমারোহে অভ্যর্থনা করেন বলে কথিত আছে।

বিয়ের আসর নজরুল মাতিয়ে দিয়েছিলেন গান গেয়ে আর তাঁর স্বভাবসিদ্ধ উচ্ছলতা দিয়ে। সেই বিয়েতে গান গেয়েছিল আরেকটি মেয়ে – আলী আকবরের ভাগ্নী সৈয়দা খাতুন। সেই প্রথম পরিচয়। দুই তরুণ মনের পারস্পরিক আকর্ষণের সুত্রপাত। সৈয়দা খাতুন আলী আকবরের বোন আসমাতুন্নিসার ছয় সন্তানের পঞ্চম। তাদের বাড়ী পাশেই ছিল। শৈশবেই অনাথা হওয়ায় মেয়েটি আলী আকবরের পরিবারের স্নেহ-দাক্ষিণ্য অর্জন করেছিল, তাদের বাড়ীতে অবাধ যাতায়াত ছিল। নজরুলের সঙ্গে পরিচয়ের পর সেই যাওয়া আসা আরও বেড়ে গেল। নজরুলের কোঁকরা বাবরি চুল, তীক্ষ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, স্বভাবের উষ্ণতা আর সাহিত্য-সঙ্গীতের প্রতিভা যে কোন তরুণীকে বশীভূত করার জন্য পর্যাপ্ত ছিল। আর নজরুল নিজে ? অগ্রজ বন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা সেই সময়ের এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “এক অচেনা পল্লীবালিকার কাছে এত বিব্রত ও অসাবধান হয়ে পড়েছি যা কোন নারীর কাছে হইনি।“

প্রথম পরিচয় থেকে পুরোদস্তুর প্রেম রূপায়িত হতে এক-দেড় মাসের বেশী সময় লাগেনি। এরই মধ্যে বদলে গেল মেয়েটির নাম, ভালবাসা উদযাপিত হতে লাগল নতুন নতুন গানে কবিতায়, অদম্য হয়ে উঠল দুজনে দুজনকে বেশী করে কাছে পাওয়ার আকুতি। এ সব দৃষ্টি এড়ালো না একজনের। তিনি মামা আলী আকবর খান। অনেকের মতে ঘটনাক্রমের এই বিবর্তনে তাঁর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল। অচিরেই তিনি দুজনের বিয়ের প্রস্তাব পেশ করলেন। শোনা যায় তখনকার ‘চালচুলোহীন’ নজরুলকে নিয়ে খান পরিবারে একটু আপত্তি ছিল। কিন্তু শিক্ষিত বিএ পাশ আলী আকবরের সিদ্ধান্ত শেষে সকলকেই মেনে নিতে হল। আর মিয়াঁ-বিবিকে রাজী করাতেও বেশী সময় লাগেনি। অতএব বিয়ের দিন ধার্য হল ১৭ই জুন ১৯২১ (৩রা আষাঢ় ১৩২৮)।

নজরুল নার্গিসের এই বিবাহানুষ্ঠান বেশ ধুমধাম করেই আয়োজিত হয়েছিল। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীতবিশারদ ওস্তাদ আলাউদ্দিন।

খাঁ ও তাঁর ভাই ওস্তাদ আফতাবুদ্দিন ফকির যিনি সেই অনুষ্ঠানে বাঁশিও বাজিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আনা হয়েছিল ২০ জনের একটি গাইয়ে-বাজিয়ের গোষ্ঠি। স্থানীয় গণ্যমান্যদের মধ্যে বাঙ্গরার জমিদার রায়বাহাদুর রূপেন্দ্রলোচন মজুমদার, সেখানকার হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অবনীমোহন মজুমদার ইত্যাদিরা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নজরুলের কলকাতার বন্ধুবান্ধবরা কেউই গিয়ে উঠতে পারেননি। অবশ্য কান্দিরপাড়ের বিরজাসুন্দরী, তাঁর স্বামী ইন্দ্রকুমার ও পুত্র বীরেন্দ্রকুমার সহ সেই পরিবারের বেশ কয়েকজন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সমগ্র অনুষ্ঠানের জন্য নাকি ১৫০০০ টাকা খরচা হয়েছিল। আর,

দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাসভবন যেখানে নজরুল-নার্গিসের প্রেম প্রস্ফুঠিত হয়েছিল
      



এমনও শোনা যায় যে নার্গিসের জন্য দেনমোহর ধার্য্য হয়েছিল ২৫০০০ টাকা (মতান্তরে ২০০০০ টাকা)!

কিন্তু বিয়ের আকদ পর্বেই কাবিননামা নিয়ে শুরু হলো সমস্যা, বাঁধল বিরোধ। ঐস্লামিক বিবাহে কাবিননামা বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের সম্মতিক্রমে নির্ধারিত একটি চুক্তিপত্র। এই কাবিননামায় একটি শর্ত ছিল এই যে, বিয়ের পর নার্গিসকে নিয়ে নজরুল কোথাও যেতে পারবেন না, তাঁদের দৌলতপুরেই থাকতে হবে। এই শর্তটি নিয়ে বিশেষ মতবৈষম্য কোন বিবরণীতে পাইনি। স্বাধীনচেতা, উচ্ছল বোহিমিয়ান স্বভাবের নজরুলের পক্ষে এই শর্ত মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাঁর কাছে এ ছিল তাঁকে ঘরজামাই করে রাখার প্রস্তাব। তিনি অসম্মতি জানালে শুরু হয় প্রবল বাকবিতন্ডা। বরপক্ষে নজরুল ছিলেন একা। অন্যপক্ষ থেকে বর্ষিত হয় নানা কটূক্তি। কিছু আমন্ত্রিত বয়স্কদের মধ্যস্থতায় আবহাওয়া সামান্য শান্ত হলেও নজরুল প্রচন্ড অপমানিত বোধ করেন এবং বিবাহ অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।

কোন কোন গবেষকদের মতে নজরুল নার্গিসকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর সঙ্গে চলে যেতে, কিন্তু তরুণী নার্গিস এত বড় ফয়সালা করে উঠতে পারেননি। অগত্যা অসীম তিক্ততা নিয়ে ক্ষুব্ধচিত্ত নজরুল উপস্তিত হন বিরজাসুন্দরীর কাছে, এবং তাঁকে তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানান। সব শুনে বিরজাসুন্দরীর মনে হয়, সেই মুহুর্তে নজরুলের মনের যা অবস্থা, তাতে তাকে বিরত করা সম্ভব নয়। তখন ঘোর রাত, বাইরে ঝড়বৃষ্টি চলছে। বিরজাসুন্দরী তাঁকে অনুরোধ করেন বীরেন্দ্রকুমারকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। অতঃপর নজরুল ও বীরেন সেই বৃষ্টিবাদলার মধ্যে কর্দমাক্ত রাস্তা খেতখামার পায়ে হেঁটে পার করে কান্দিরপাড় পৌঁছলেন। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়ায় কয়েকদিন অতিবাহিত করার পর মুজফ্ফর আহমেদের অর্থসহায়তায় নজরুল কলকাতা ফেরৎ যান।

সেই যে গেলেন, আর কখনো দৌলতপুরে ফিরে যাননি। নার্গিসের সঙ্গে দেখা হওয়া তো দূরের কথা, তাঁকে লেখা নার্গিসের একাধিক চিঠির উত্তর পর্যন্ত দেননি। অথচ ব্যর্থ প্রেমের জ্বলনে দগ্ধ চিত্তে রচনা করেছেন কখনো ট্র্যাজিক, কখনো ক্ষুব্ধ বিদ্রোহী গান-কবিতা। বন্ধুকে লিখেছেন, “এই বন্ধন ছিন্ন করে দুঃখ পেয়েছি আমিই সব চেয়ে বেশি। আমার নিজের বুকই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে. হিয়ায় হিয়ায় আমার এক বীভৎস খুন-খারাবি . . খানখান খুন! কেমন এক বিদ্রোহ অভিমানে আমার দুচোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ছে। নাই নাই, এ বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা নিয়ন্তা কেউ নাই।“

দৌলতপুরে না গেলেও কুমিল্লায় কিন্তু নজরুল এর পরও গিয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। কখনো সাহিত্য সভায় যোগ দিতে, কখনো ইংরেজদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সভায় মিছিলে অংশ নিতে। তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন এই কুমিল্লাতেই। কিন্তু অন্য আরেকটি কারণও ছিল কুমিল্লা আসার। তা হল বীরেন্দ্রকুমারের বিধবা জ্যেঠিমা গিরিবালা দেবীর কন্যা আশালতা সেনগুপ্তা। কান্দিরপাড় থেকে বিরজাসুন্দরীর পরিবারের যে সদস্যরা নজরুল-নার্গিসের বিবাহ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে এই আশালতাও ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ১৩ বছর। প্রথম প্রেমের শোচনীয় পরিনতির পর নজরুল যখন কুমিল্লায় আসতে লাগলেন তখন আশালতার সঙ্গে ক্রমে ক্রমে পরিচয়, সখ্যতা পেরিয়ে পুনরায় ভালবাসার উদ্ভব হল, এবং পরিশেষে ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতায় তাঁদের অনাড়ম্বর বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিরজাসুন্দরী ও তাঁর পরিবার এই পরিণয়ের পক্ষে ছিলেন না, কিন্তু বিধবা গিরিবালার অত্যাশ্চর্য্য দৃঢ়তা এই আন্তরধর্মীয় বিবাহ সম্ভব করেছিল। বিয়ের পর নজরুল আশালতার নাম রাখেন প্রমীলা। প্রমীলাই আমৃত্যু নজরুলের জীবনসঙ্গিনী ছিলেন।

আর নার্গিস ? তিনি সুদীর্ঘ ১৭ বছর অপেক্ষা করেছিলেন। নজরুলকে গোটাচারেক চিঠি লিখেছিলেন। শেষ চিঠিটি ছাড়া আগেরগুলির কোন উত্তর নজরুল দেননি। নার্গিসের চিঠিগুলির বয়ান নজরে আসেনি। তবে শেষ চিঠিতে তিনি নাকি লিখেছিলেন যে প্রমীলাকে বিয়ে করার জন্য তাঁর কোন অনুযোগ নেই, কিন্তু একবার তিনি নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে চান। এমনকি আত্মহত্যার ইচ্ছাও নাকি প্রকাশ করেছিলেন। এর উত্তরে নজরুল একটি বিস্তারিত চিঠি লেখেন। এই গুরত্বপূর্ণ নথিটি কিন্তু সর্বত্র উপলব্ধ। তার থেকে সামান্য উদ্ধৃতি শুরুতে দিয়েছি, প্রয়োজন মত অন্য জায়গায় আবার উল্লেখ করা যাবে। নার্গিস অবশ্য আত্মহত্যার পথে যাননি। দীর্ঘ প্রতীক্ষা এবং দু-একটি ঘটনার পর তিনিও বিবাহসুত্রে আবদ্ধ হন, ১৯৩৮এর ১২ই ডিসেম্বর, আলী আকবর খানের ঢাকার গ্রন্থন ব্যবসায়ের সহযোগী সাহিত্যিক আজিজুল হাকিমের সাথে।

য়ৌবনে নজরুল
                   



বিবরণীর এই পর্যায়ে আলোচনায় আসি বিবিধ বিতর্কিত বাদ-প্রতিবাদের বিষয়গুলিতে।

নজরুলের গুণগ্রাহীরা তাঁর প্রেমের এই কঠিন বেদনাসম্পৃক্ত পরিণতির জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী করেছেন আলী আকবর খানকে। এঁদের মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোঘ্য নজরুলের অভিভাবকস্থানীয় সুহৃদ কমরেড মুজফ্ফর আহমেদের স্মৃতিচারণা ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’। তিনি সরাসরি আরোপ করেছেন, ‘আলী আকবর খান দাম্ভিক, মিথ্যাভাষী ও শঠ’। স্বপক্ষের অভিমত পোষণকারীরা বলেন, আলী আকবর খানের হাবভাব এবং কোন কোন ক্রিয়াকলাপ নজরুলের কলকাতার বন্ধুরা মোটেই ভাল চোখে দেখতেন না। তাঁর সঙ্গে দৌলতপুর যাওয়া থেকে বিরত করার জন্য নজরুলকে বন্ধুরা উপদেশ দিয়েছিলেন। মুজফ্ফর আহমেদের ভাষায় তিনি স্পষ্টতই কবিকে বলেছিলেন, ‘কি মতলবে তিনি তোমায় তাঁদের বাড়ী নিয়ে যেতে চান তা কেউ জানেন না। তিনি তোমাকে একটা বিপদেও ফেলতে পারেন।‘ সরলমতি কবিকে কিন্তু নিরস্ত করা যায়নি। এঁদের মতে, আলী আকবরের অভিসন্ধি ছিল নজরুলের বিরল প্রতিভাকে নিজের প্রকাশনা ব্যবসার একচেটিয়া স্বত্বাধীন করা, এবং সেই উদ্দেশ্যেই পারিবারিক আবদ্ধতার চক্রান্ত ও কাবিননামার ওই শর্ত রচিত হয়েছিল। এই যুক্তির সমর্থনে তৎকালীন দৌলতপুরবাসী মুন্সি আবদুল জব্বারের জবানি উল্লেখযোগ্য: “অন্যদিকে আলী আকবর খান বড় বোন নার্গিসের মাকে যেয়ে বলেছেন, ভাগিনীকে আমরা বিবাহ দিব। .......আমাদের বাড়ীর একটি মেয়েও এই পাত্রের পছন্দ হয় নাই। তোমার মেয়েকে পাত্র পছন্দ করেছে। বর্তমানে যে কোন উপায়ে এই কাজীকে আটকিয়ে রাখতেই হবে। এই কাজী নজরুল ইসলাম পৃথিবী বিখ্যাত এক দার্শনিক কবি হইবে। .....তাহার নমুনা আমরা পাইয়াছি। তাহাকে হাতছাড়া করা যায় না। ......তাহাকে আটকাইয়া রাখিলে ভবিষ্যতের জন্য একটা পথ আবিষ্কার হইতে পারে, তাহাতে সারা জীবনে সুখ থাকিতে পারিবে।“

নজরুল তাঁর বিবাহের সিদ্ধান্ত পত্রযোগে কলকাতার কয়েক বন্ধুদের জানিয়েছিলেন। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর প্রথম চিঠিতে (৫ই জুন ১৯২১) এই সিদ্ধান্তের সঠিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে লিখেছিলেন, “.... তোর বয়েস আমাদের চাইতে ঢের কম, অভিজ্ঞতাও তদনুরূপ, feeling-এর দিকটা অসম্ভব রকম বেশী। কাজেই ভয় হয় যে হয়ত বা দুটো জীবনই ব্যর্থ হয়। ....... যৌবনের চাঞ্চল্যে আপাতঃ মধুর মনে হলেও ভবিষ্যতে না পস্তাতে হয়।” এর উত্তরে নজরুল নার্গিস সম্বন্ধে তাঁর যে অসহায় মনোভাবের কথা ব্যক্ত করেছিলেন তা আগেই বলেছি। অগত্যা পবিত্রবাবু তাঁর দ্বিতীয় চিঠিতে (২৫শে জ্যৈষ্ঠ ১৩২৮) নজরুলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েও শেষে লিখেছিলেন, “তুই যে এরূপ একটা আজগুবি কান্ড বাঁধিয়ে বসবি, তা সকলে আমরা জানতুম।“ তাঁর কলকাতার বন্ধুরা যে অকস্মাৎ বিয়ের ফয়সালায় বিশেষ সন্তুষ্ট ছিলেন না, তা বুঝতে পেরে নজরুল তাঁর আর এক সুহৃদ সাহিত্যিক ও সম্পাদক মোহম্মদ ওয়াজেদ আলীকে একটি পত্রে সম্ভবত কিঞ্চিত দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। তার উত্তরে ওয়াজেদ আলী লেখেন (১৩ই জুন ১৯২১), “আমার বোধ হয় আপনার বন্ধুরা অসন্তুষ্ট হয়েছেন একটা কারণে। আপনি ‘নারায়ণে’ ‘দহন-মালা’ লিখে নারীর কাছে ক্ষমা চাইলেন; তার পরই এত সত্বর প্রেমের ফাঁদে ধরা পড়লেন। ‘যৌবনের জোয়ার’ বড় সাংঘাতিক; তাকে ঠেলে রাখা বড় দায় – এ আমি স্বীকার করছি।“

স্বপক্ষীয়রা বলেন, বিবাহ অনুষ্ঠানে নজরুলের বিস্ফোরণ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, এর প্ররোচনা কিছু দিন ধরে ক্রমাগত দানা বাঁধছিল। আলী আকবর ও তাঁর পরিবারের কোন কোন কথায় আচরণে নজরুল বিরক্ত হয়েছিলেন, এমন কি অপমানিতও বোধ করেছিলেন। কিন্তু নার্গিসের প্রতি সেই সময়ে তাঁর সুগভীর অনুভুতি তাঁকে সহ্যশীল থাকতে বাধ্য করে। শোনা যায়, নার্গিসের আগে আলী আকবর তাঁর এক ভাইঝি হেনার সঙ্গে নজরুলের বিয়ের প্রস্তাব রেখেছিলেন। নজরুল রাজী হননি। কিন্তু হেনা বা নার্গিস, কারোর সঙ্গেই নজরুলের বিয়েতে অধিক অমত ছিল আলী আকবরের পরিজনদেরই। তাঁরা এই অদ্ভুত স্বভাবের ছন্নছাড়া নিঃসম্পদ ছেলেটিকে ঘরের জামাই করা মেনে নিতে পারেননি, এবং প্রায়শই নজরুলের সামনেই তাঁদের এ অভিমত প্রকাশ হয়ে পড়ত। নজরুল স্বাভাবিক ভাবেই ব্যথা পেয়েছিলেন। কুমিল্লার সাপ্তাহিক লালমাই পত্রিকার ১লা জুন ১৯৬৯ সংখ্যায় অধ্যাপক বদরুল হাসান লিখেছেন, “.....নজরুলের বাঁধনহারা ভাব তাঁর পরিবারের গুরুজনদের চোখে তাচ্ছিল্যের কারণ ছিল। সম্প্রতি নেজামত আলী খান (আলী আকবরের বড় ভাই) একথা অকপটেই স্বীকার করেছেন।” কিন্তু আগেই বলেছি, শিক্ষিত আলী আকবরের জেদের কাছে তাঁদের নতিস্বীকার করতে হয়। আলী আকবর খান তাঁর সম্বন্ধে নজরুলের কলকাতার বন্ধুদের মনোভাব ভালোই জানতেন। তাই বিয়ে ঠিক হবার পর নাকি তাঁদের চিঠিপত্র নজরুলের হাতে দিতেন না, এবং নজরুলের লেখা চিঠিগুলিও ডাকে তাঁদের কাছে পাঠাতেন না। অনেক বছর পরে নার্গিসের স্বামী আজিজুল হাকিমের উদ্যোগে সে সব চিঠি প্রকাশিত হয়। স্বপক্ষের লোকেরা এমনও বলেন যে বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্রও আলী আকবর কলকাতার ঠিকানাগুলিতে ইচ্ছাকৃতভাবেই দেরী করে পাঠান যাতে সেখান থেকে কেউ বিয়ের অনুষ্ঠানে পৌঁছতে না পারেন। অন্য একটি ব্যাপারও নজরুলের কাছে বিসদৃশ লেগেছিল। বিয়ের দিন যখন পাকা, তখন থেকে নার্গিসকে তাঁর মামা নিজের বাড়ীতে এনে রাখেন এবং স্বল্পশিক্ষিতা মেয়েকে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই নজরুলের উপযুক্ত করে তোলার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। তিনি শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের ও অন্য বিশ্বসাহিত্য থেকে বেছে বিভন্ন নারীচরিত্রের কাহিনী, শহুরে আদবকায়দা ইত্যাদি নার্গিসকে সারাদিন ধরে শেখানো-পড়ানোর ঝোঁক ধরে বসলেন। নজরুল তো নার্গিসকে সেইভাবেই ভাল বেসেছিলেন যেমনভাবে তিনি তাঁকে দেখেছিলেন, পেয়েছিলেন। তাঁর কাছে এ সব নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়েছিল।

কিন্তু এই সব মতের বিপক্ষেও কিছু দৃষ্টিকোণ সময়ের সাথে সাথে প্রকাশ পেয়েছে।

একটি ধারণা এমন আছে যে প্রমীলার সঙ্গে নজরুলের বিবাহ অনেকেই ভালো ভাবে নিতে পারেননি। তাঁকে ধর্মান্তরিত না করে বিয়ে করা, এবং বিয়ের পর শাঁখা সিঁদুর উপাসনা ইত্যাদি আচারাদি পালনের অনুমতি দেওয়া মুসলমান সম্প্রদায়ের একাংশকে ক্ষুব্ধ করেছিল। উল্টোদিকে ব্রাহ্ম সমাজের মেয়ের আন্তর্ধমীয় বিবাহ নিয়ে ব্রাহ্ম ও হিন্দু সমাজের অনেক মাতব্বরও রূষ্ট হয়েছিলেন। তবে নজরুল-নার্গিস পর্বের নজরুল-স্বপক্ষের মতগুলিকে খন্ডন করতে মাত্র এঁরাই যে সচেষ্ট হয়েছিলেন, তা নয়। দু’পক্ষেরই দৃষ্টিকোণের সমর্থন বা অন্যথায় স্বতন্ত্র গবেষকরাও আছেন।

বিপক্ষীয়রা বলেন মুজফ্ফর আহমেদের বৃত্তান্ত আলী আকবর খানের প্রতি তাঁর নেতিবাচক পক্ষপাতের ফসল। ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার এক ঈদ সংখ্যায় ‘নার্গিস’ নামে একটি উপন্যাসের লেখক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর মত: “নজরুলের বই প্রকাশ করে রাতারাতি ধনী হওয়ার পরিকল্পনা আলী আকবরের মনে আসবে কেন ? বই বিক্রী করে প্রচুর অর্থ উপার্জন কি নজরুলের জীবনে আদৌ ঘটেছিল ? তাঁর পেছনে প্রকাশকেরা সারি বেঁধে অপেক্ষা করতেন, এমন তথ্যও তো ইতিহাস ঘেঁটে পাওয়া যায় না। বরং এক-দুই শ টাকার বিনিময়ে বইয়ের স্বত্ব বিক্রী করার জন্য নজরুল দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, এই নির্মম বাস্তবতাই তো বিভিন্ন জীবনী গ্রন্থ থেকে পাই।“ এই বিপক্ষীয়দের মত, নজরুল ও নার্গিসের বৈবাহিক জীবনে আর্থিক সুরক্ষা এবং মাথার ওপর আচ্ছাদন সুনিশ্চিত করতেই আলী আকবর মোটা রকমের দেনমোহর ও কাবিননামার ঐ শর্ত প্রস্তাব করেন। সুলতান মাহমুদ মজুমদার দাবী করেন, নার্গিসের সাথে তাঁর একবার সাক্ষাত হয়েছিল, এবং সেই সাক্ষাতের বিবরণী তিনি ‘কবিপ্রিয়ার সান্নিধ্যে কিছুক্ষণ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন (‘সাপ্তাহিক আমোদ’, ১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৭)। সেখানে, এমন ছিল নার্গিসের জবানী: “আমাকে সে নিয়ে যেত কোথায় ? চুরুলিয়ার বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না। থাকতো পরের আস্তানায়। তখনও লেখায় তেমন পয়সা পেতো না। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে খরচ দিতে হতো অন্যের......। কুমিল্লায় আসার সময় মামার অতিথি হিসাবে আমার মামাই খরচ দিয়েছিলেন। এই লোক বউ নিয়ে তুলতো কোথায় ? খাওয়াতো কি ? ......আমাদের সামাজিক মান সম্ভ্রম ও আমার মনের দিকটা একবারও কি সে ভেবে দেখেছে ? .....ঘরছাড়া এক পথিক যুবাকে বর করে নিলাম। তাই আমি দোষী, আর সে বুক ফুলিয়ে সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে লিখছে কবিতা, আর আমি জ্বলছি দুঃখ দহনে। স্ত্রী পুত্র নিয়ে সে হাসে, আমি চোখের জলে ভাসি।“ বিপক্ষগোষ্ঠী বরং নজরুলের দৌলতপুর থেকে পবিত্রবাবুকে লেখা চিঠি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখাতে চান যে তিনি কেবল নার্গিসের রূপগুণেই বিভোর হয়েছিলেন এমন নয়, সে পরিবারের দৌলতও তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। নার্গিসের বর্ণনায় কবি লিখেছিলেন: “চিরজনমের হারানো গৃহলক্ষী, প্রিয়া..... তার বাইরের ঐশ্বর্যও যথেষ্ট।” নার্গিসকে সারাদিন আলী আকবরের প্রশিক্ষণের প্রসঙ্গে বিপক্ষের অভিমত, নজরুলের ভাবাবেগ তখন এতই প্রবল যে তিনি সর্বদাই প্রিয়ার সঙ্গসুখ চাইতেন, যা তখন সমাজের চোখে দৃষ্টিকটু ছিল, এবং নার্গিসকে দূরে রাখার জন্যই আলী আকবরের এই ছিল পদ্ধতি। অধ্যাপক মিলন দত্ত তাঁর ‘প্রথম প্রেম ও নার্গিস বেগম’ প্রবন্ধে বলেছেন, “আলী আকবর খান নার্গিসকে ..... নজরুলের সঙ্গে মেশার সুযোগ না দেওয়ার ইচ্ছায় অধিকাংশ সময় নিজের কাছেই রাখতেন, বিয়ের পূর্বে তাঁদের মেলামেশা নিয়ে সমাজের নানা আলোচনা চলছিলো। মানুষের মুখও তো তাঁকে বাঁচিয়ে চলতে হবে। কিন্তু এ অবস্থা নজরুলের অসহনীয় ছিল - ......”। বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র দেরীতে বিয়ের অনুষ্ঠানের পর কলকাতার বন্ধুদের কাছে পৌঁছনোর কারণ হিসেবে বিপক্ষবাদীদের যুক্তি, তখন রেলপথ ও জলপথ পরিবহন কর্মীদের ধর্মঘট চলার জন্যই এমন হয়েছিল।

নজরুল-নার্গিস উপাখ্যানের যে মাত্র দু-তিনটি নথি জনসমক্ষে পাওয়া যায়, এই নিমন্ত্রণ পত্রটি তার মধ্যে বিশেষ কৌতুহলোদ্দীপক। কলকাতার বন্ধুদের কাছে যথাসময়ে না পৌঁছলেও সে পত্র ‘মোহম্মদী’ পত্রিকার সম্পাদক মোহম্মদ ওয়াজেদ আলীর হাতে যে করেই হোক পৌঁছয়, এবং তিনি তাঁর পত্রিকায় তা অবিলম্বে ছাপিয়ে দেন। ‘অপূর্ব নিমন্ত্রণ পত্র’ শিরোনামে তা ‘বাঙালী’ পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়। এই দীর্ঘ পত্রটি শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের গান ‘জগতের পুরোহিত তুমি’র প্রথম দু’ ছত্র দিয়ে। পাত্রের পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছিল এই ভাবে: “বর্ধমান জেলার ইতিহাস প্রখ্যাত চুরুলিয়া গ্রামের দেশ বিখ্যাত পরম পুরুষ, আভিজাত্য গৌরবে পরম গৌরবান্বিত, আয়মাদার, মরহুম মৌলবী কাজী ফকির আহমদ সাহেবের দেশ বিশ্রুত পুত্র মুসলিম কুলগৌরব মুসলিম বঙ্গের ‘রবি’ কবি সৈনিক নবযুগের ভূতপূর্ব সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলাম.........বাণীর দুলাল দামাল ছেলে, বাংলার এই তরুণ সৈনিক কবি ও প্রতিভাবান্বিত লেখকের নতুন করে নাম বা পরিচয় দেবার দরকার নেই।“ এমনও প্রচারিত হয় যে এর বয়ান নাকি স্বয়ং নজরুলের ‘মুসাবিদা’ করা।

পত্রিকায় প্রকাশিত এই নিমন্ত্রণ পত্র কলকাতার বন্ধুদের গোচরে অবশ্যই আসে। কেউ কেউ নজরুলকে চিঠিতে অভিনন্দন ও শুভকামনা জানালেও, অনেকেই তার ভাষ্য নিয়ে অখুশী ছিলেন। নজরুলের ঐ বর্ণনা, বিশেষ করে ‘মুসলিম বঙ্গের রবি’ উপাধি (যা তাঁকে রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ দাবী করার তরলমতি প্রয়াস বলে অনেকে মনে করেন), এবং পত্রিকায় এমন নিমন্ত্রণ প্রকাশের ঔদ্ধত্য অনেকের কাছেই অসমর্থনীয় ছিল। মুজফ্ফর আমেদ (২৬শে জুন ১৯২১) এক ‘অত্যন্ত গোপনীয়’ চিঠিতে নজরুলকে স্পষ্টতই তাঁর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে লিখেছিলেন: “পত্রখানা আপনারই মুসাবিদা করা দেখিলাম। পত্রের ভাষা দু’এক জায়গায় বড় অসংযত হইয়াছে। একটু যেন কেমন দাম্ভিকতা প্রকাশ পাইয়াছে। আপনার হাত দিয়া অমন লেখা বাহির হওয়া কিছুতেই ঠিক হয় নাই। আমার বড় ভয় হইতেছে যে, খান সাহেবের সংস্রবে থাকিয়া আপনিও না শেষে দাম্ভিক হইয়া পড়েন। অন্যে বড় বলিলে গৌরবের কথা হয়, আর নিজেকে নিজে বড় বলিলে অগৌরবের মাত্রাই বাড়িয়া যায়। ‘মোহম্মদী’কে বিবাহের কথা ছাপিতে অনুরোধ করাটা ঠিক হইয়াছে কি ? তাঁরা ত নিজ হইতেই ও খবর ছাপিতে পারিতেন। .... বাস্তবিক আমার প্রাণে বড় লাগিয়াছে বলিয়া আমি এত কথা বলিলাম। এই নিমন্ত্রণ পত্র আবার ‘অপূর্ব নিমন্ত্রণ পত্র’ শিরোনামে ‘বাঙালী’তে মুদ্রিত হইয়াছে, দেখিলাম। ‘বাঙালী’কে এই নিমমন্ত্রণ পত্র কে পাঠাইল ?”

এ চিঠি যখন লেখা হল, ততদিনে অবশ্য গোমতি দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। নজরুল দৌলতপুর ছেড়েছেন, এবং সন্পূর্ণ তথ্য বোধহয় তখনও মুজফ্ফর আহমেদের অজানা। এর কিছুদিন পরে, সাপ্তাহিক ‘বিজলী’র ২২শে জুলাই সংখ্যায় ‘কবিবরের প্রতিবাদ’ শিরোনামে নজরুলের লেখা একটি চিঠি ছাপা হয়। ঢাকার বাংলা একাডেমী সম্পাদিত ‘নজরুল-রচনাবলী’র টীকায় বলা হয়েছে, “এই চিঠিটি নজরুল-নার্গিস বিবাহ সংক্রান্ত প্রতিবাদলিপি। নজরুল-বিবাহে আলী আকবর খান যে নিমন্ত্রণ-পত্র ছাপান, নজরুল-বন্ধুরা ধারনা করেছিল সেটা নজরুলের মুসাবিদায় ছাপা হয়। নজরুল ইসলাম তার প্রতিবাদ করেন।“ নজরুলের বিবৃতি ছিল: “প্রথমেই বলে রাখি, আমার এই ‘কবি-বরে’র অর্থ ‘কবি-শ্রেষ্ঠ’ নয়, এ ‘কবি-বরের’ মানে – ‘যে কবি বিয়ের বর’। কারণ, দিন কতক আগে আমি বাস্তবিকই – অন্তত ঘন্টা কয়েকের জন্যে ‘বর’ সেজেছিলুম, যদিও বরের এখনো বধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ নেই। যাক সে কথা, আমার ঐ ‘ত্রিশঙ্কু বিয়েতে’ শ্বশুরকুলের কর্তৃপক্ষগণ এক কাব্যিক নিমন্ত্রণপত্র ছাপিয়েছিলেন এবং সেটি চরমে গিয়ে পৌঁছেছে এই জন্যে যে, সেটা আবার আমার সাহিত্যিক ও কবি বন্ধুবর্গকে পাঠানো হয়েছে। সেটা একপ্রকার জামাই বিজ্ঞাপন বললেও হয়। ওতে আমার নামের আগে ও পিছনে এত লেজুড় লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, কোনো চতুষ্পদ জীবেরই অতগুলো ল্যাজ থাকে না।“

নজরুল-নার্গিসের বিবাহ কি সম্পূর্ণ হয়েছিল ?

এই প্রশ্নের উত্তরেও মতান্তর আছে। নজরুলের উপরোক্ত ‘প্রতিবাদ’ পড়লে দেখা যাবে যে, নিমন্ত্রণপত্র তাঁরই রচনা, এ কেবল সে কথারই খন্ডন নয়। মূলত বিয়ের সামগ্রিকতাকেই যেন তিনি অস্বীকার করেছেন। বিয়ের অসম্পূর্ণতার ইঙ্গিত দিয়ে যে ‘ত্রিশঙ্কু বিয়ে’ শব্দ তিনি ব্যবহার করলেন, তা আবার বিরজাসুন্দরী দেবীর একটি রচনায়ও পাওয়া যায়। প্রায় বছরখানেক পরে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’র শ্রাবণ ১৩২৯ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘নৌকাপথে’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে দৌলতপুর যাত্রা ও ঐ বিবাহ অনুষ্ঠানের বর্ণনা প্রসঙ্গে বিরজাসুন্দরী লিখেছিলেন, “বিয়ে তো ত্রিশঙ্কুর মত ঝুলতে লাগলো মধ্য পথেই, এখন আমাদের বিদায়ের পালা .....।“ স্বপক্ষীয়রা বলেন, যেহেতু বিরজাসুন্দরী স্বয়ং অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, তাই তাঁর সাক্ষ্য প্রমাণ করে যে বিবাহ পর্ব সম্পন্ন হয়নি।

মুজফ্ফর আহমেদ মুসলিম বিবাহ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, তা আধ্যাত্মিক নয়, মূলত হবু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একধরণের চুক্তি যার কিছু শর্ত থাকে। এই বিয়েতেও শর্ত ছিল, এবং নজরুল তা অনুমোদন করতে অস্বীকার করেন। তাছাড়া বিয়ের পরে সহবাস না হলে বিয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করে না। নজরুল বাসর রাত্রিও যাপন করেননি। মুজফ্ফরের মতে, “কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে যে সৈয়দা খাতুন ওর্ফে নার্গিস বেগমের বিয়ে (আকদ) হয়নি এ সম্বন্ধে আমি স্থির নিশ্চিত হয়েছি।“

কিন্তু বিপক্ষীয়রা বলেন, বিরজাসুন্দরীর প্রবন্ধ নজরুলেরই সম্পাদিত, তাতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া যায় না। তাঁরা বরং একটি চিঠির উপস্থাপনা করেছেন। এটি ‘বিয়ে’র কিছুদিন পরে নজরুল কান্দিরপাড়ে অবস্থানকালীন আলী আকবর খানকে লিখেছিলেন বলে দাবী করা হয়। এটিতে তিনি আলী আকবরকে ‘বাবাশ্বশুর’ সম্বোধনে শুরু করে লিখেছেন, “আপনাদের এ অসুর জামাই পশুর মত ব্যবহার ক’রে এসে যা কসুর করেছে, তা ক্ষমা করো সকলে, অবশ্য যদি আমার ক্ষমা চাওয়ার অধিকার থাকে।........আমার মান-অপমান সম্বন্ধে কান্ডজ্ঞান ছিল না বা ‘কেয়ার’ করিনি ব’লে, আমি কখনো এতবড় অপমান সহ্য করিনি, যাতে আমার ‘ম্যানলিনেসে’ বা পৌরুষে গিয়ে বাজে-যাতে আমাকে কেউ কাপুরুষ বা হীন ভাবতে পারে। আমি সাধ ক’রে পথের ভিখারী সেজেছি বলে’ লোকের পদাঘাত সইবার মতন ‘ক্ষুদ্রআত্মা’ অমানুষ হয়ে যাইনি।.....বাবা, আমি মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। দোওয়া করবেন, আমার এ ভুল যেন দুদিনেই ভেঙে যায়, এ অভিমান যেন চোখের জলে ভেসে যায়।..... বাকী উৎসবের জন্য যত শীগগীর পারি বন্দোবস্ত করব।.......চির সত্য, স্নেহ সিক্ত, নুরু।“ বিপক্ষের মত, চিঠিতে আলী আকবরকে বাবাশ্বশুর বা বাবা এবং নিজেকে জামাই সম্বোধন, এবং পুরো চিঠির ভাষা ও বিষয়বস্তু প্রমাণ করে যে নজরুল মেনে নিয়েছিলেন তিনি বিবাহিত, নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত এবং তাঁর অভিমান যে ভুল সে কথা স্বীকার করতে প্রস্তুত। কিন্তু স্বপক্ষীয় গোষ্ঠী ঠিক এই কারণেই এ চিঠির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। যিনি বড়জোড় ‘মামাশ্বশুর’ হতে পারতেন, তাঁকে ‘বাবাশ্বশুর’ বা ‘বাবা’ সম্বোধন কতটা গ্রহণযোগ্য ? চিঠির সম্বোধনা বা ভাষ্য, কোনটাই নজরুলের প্রকৃতিগত স্বাভাবিক ভাষা নয় বলে তাঁদের দাবী। তা ছাড়া আরও একটি অসঙ্গতিও ছিল। এই চিঠি কবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে তা জানা যায় না। মুজফ্ফর আহমেদ যখন এ চিঠি দেখেন, তখন তার তারিখ ছিল ২৩ জুলাই ১৯২১, আর স্থান উল্লেখিত ছিল কান্দিরপাড়। কিন্তু ঐ তারিখে নজরুল ছিলেন কলকাতায়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত চিঠিতে তারিখ দেখা যায় ২৩শে জুন। মূল চিঠি কোথাও পাওয়া গেছে বলে জানা যায়নি। স্বপক্ষীয়রা আরও বলেন, যদি ধরেও নেওয়া হয় যে এই চিঠি নজরুলেরই লেখা, তবে তার শেষভাগের বাক্য প্রমাণ করে যে বিবাহের কিছু উৎসব ‘বাকী’ ছিল, অর্থাৎ বিবাহ অসম্পূর্ণ ছিল।

ঐ চিঠি যদি নজরুলেরই লেখা হয়, তা হলেও তিনি সম্ভবত ‘শীগগীর’ কোন ‘বন্দোবস্ত’ করেননি। ফলত আলী আকবর সে বছর সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় এসে উপস্থিত হ’ন। তালতলা লেনের বাসায় নজরুলের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে মুজফ্ফর আহমেদও থাকতেন। তাঁর জবানীতে, “নজরুলের স্বভাব ছিল যে নূতন কেউ এলে চেঁচিয়ে আনন্দ প্রকাশ ক’রে সে তাকে গ্রহণ করত।.....সেদিন আলী আকবর খান আসাতে নজরুল কোন উচ্ছাস প্রকাশ তো করলই না, একবার বসতেও বলল না তাকে। শক্ত হয়ে চুপ ক’রে বসে থাকল সে। ..... খান সাহেব নিজেই নজরুলের পাশে তখৎপোশের ওপর বসলেন। তাঁর হাতে বেশ পুরু একতাড়া দশ টাকার নোট ছিল। খুব নীচু আওয়াজে কথা বলছিলেন তিনি, আর নোটের তাড়াটি নাড়ছিলেন-চাড়ছিলেন। অকারণে নাড়াচাড়ার মত দেখালেও আসলে ভাবখানা ছিল এই যে এই নোটের তাড়াটি তোমারই জন্যে।“ এই বিবরণীর সমর্থন বিরজাসুন্দরী দেবীকে লেখা নজরুলের একটি চিঠিতেও পাওয়া যায়, যেখানে তিনি লিখেছেন, “মা, আলী আকবর খান আমাকে নোটের তাড়া দেখিয়ে গেল।“ শেষমেষ নজরুলের কী প্রতক্রিয়া ছিল তা স্পষ্ট নয়, তবে মোটামুটি ধরা যায়, খান সাহেব যদি কোন একটা মীমাংসার অভিপ্রায়ে এই সাক্ষাতে উদ্যোগী হয়ে থাকেন, তবে তা ফলপ্রসু হয়নি।

দিন কাটতে লাগল। বছর গড়িয়ে গেল। নজরুল ‘বিদ্রোহী’ লিখে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন, ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশিত হল, তাঁর সম্পাদনায় ‘ধূমকেতু’র আবির্ভাব হ’ল। অচিরেই রাজদ্রোহের অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হলেন, জেলে অনশন করলেন, কিছু মাস পরে মুক্তিও পেলেন। কবি, সঙ্গীতকার, বিদ্রোহী হিসেবে তাঁর খ্যাতি প্রসারিত হ’ল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘বসন্ত’ নাটক উৎসর্গ করলেন। প্রমীলা এলেন জীবনে। এক সন্তানের মৃত্যু, আরও দুই পুত্রের জন্ম হল। নজরুল গ্র্যামোফোন কোম্পানীতে গীতিকার-সুরকার হয়ে চাকরী করতে লাগলেন।

একদিন যখন তিনি এচ এম ভির স্টুডিওয় বসে কাজ করছেন, বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁকে একটি চিঠি এনে দিলেন। নার্গিসের লেখা। আগেও এসেছে তাঁর চিঠি, নজরুল উত্তর দেননি। এবারও চিঠি পড়ে শৈলজানন্দকে ফিরিয়ে দিলেন। শৈলজানন্দ বললেন, একটা উত্তর তো দিতে হবে। নজরুল অবিলম্বে লিখে দিলেন একটি গান, “যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই, কেন মনে রাখো তা’রে”। বললেন, এটাই তাঁর উত্তর।

এই গানটির রচনাকাল স্পষ্ট নয়। আগেই বলেছি, নার্গিস মোট চারটি চিঠি লিখেছিলেন, সুদীর্ঘ ষোল বছরে। নজরুল উত্তর দিয়েছিলেন মাত্র একটি, ১লা জুলাই ১৯৩৭ তারিখে। সে পত্রটিতেও স্থানের উল্লেখে আছে ১০৬ আপার চিতপুর রোড, গ্রামাফোন রিহার্সাল রুম, কলকাতা। তাই অনুমান করা যায়, ঐ গানটিও এই একই সময়ে রচিত। অর্থাৎ, কেবল গান নয়, একটি পত্রও অবশেষে নার্গিস পেয়েছিলেন নজরুলের কাছ থেকে। চিঠির শেষের দিকে লিখেছিলেন, “তোমাকে লেখা এই আমার প্রথম ও শেষ ছিঠি হোক।“ এই চিঠির ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে আবেগ, অভিমান, অনুযোগ, আবার আশ্বাসও। কিছু নির্বাচিত উদ্ধৃতিমাত্র দিলাম:

“তুমি বিশ্বাস করো, আমি যা লিখছি তা সত্য। লোকের মুখের শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা ক’রে থাকো, তা হলে আমায় ভুল বুঝবে – আর তা মিথ্যা।

“তোমার উপর আমি কোন জিঘাংসা পোষণ করি না – এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা। কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি - তা দিয়ে তোমায় কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না – আমি ‘ধূমকেতু’র বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। .......ভুলে যেও না আমি কবি – আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। ..... আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কি জান বা শুনেছ, জানি না) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবীও নেই।

“আমি কখনো কোন ‘দূত’ প্রেরণ করিনি তোমার কাছে। আমাদের মাঝে যে অসীম ব্যবধানের সৃষ্টি হয়েছে, তার ‘সেতু’ কোন লোক ত’ নয়ই – স্বয়ং বিধাতাও হতে পারেন কিনা সন্দেহ। ..... আমি যদিও গ্রামোফোনের ট্রেড মার্ক ‘কুকুরের’ সেবা করছি, তবুও কোন কুকুর লেলিয়ে দিই নাই। তোমাদেরই ঢাকার কুকুর একবার আমাকে কামড়েছিল আমার অসাবধানতায়, কিন্তু শক্তি থাকতেও আমি তার প্রতিশোধ গ্রহণ করিনি-তাদের প্রতি আঘাত করিনি।

“সেই কুকুরদের ভয়ে ঢাকায় যেতে আমার সাহসের অভাবের উল্লেখ করেছ, এতে হাসি পেল। তুমি জান, ছেলেরা (যুবকেরা) আমায় কত ভালবাসে। আমারই অনুরোধে আমার ভক্তরা তাদের ক্ষমা করেছিল। নৈলে তাদের চিহ্ন-ও থাকত না এ পৃথিবীতে। .... তুমি রূপবতী বিত্তশালিনী, গুণবতী, কাজেই তোমার উমেদার অনেক জুটবে – তুমি যদি স্বেচ্ছায় স্বয়ম্বরা হও, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। আমি কোন্ অধিকারে তোমায় বারণ করব-বা আদেশ দিব ? .....

“তোমার আজিকার রূপ কি, জানি না। আমি জানি তোমার সেই কিশোরী মূর্তিকে, যাকে দেবীমূর্তির মত আমার হৃদয়বেদীতে অনন্ত প্রেম অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলে না। পাষাণ-দেবীর মতই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদী-পীঠ। ....

“দেখা ? নাই হ’ল এ ধুলির ধরায়। .... তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালবাস, আমাকে চাও, ওখান থেকেই আমাকে পাবে। .... আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরাতন কথা হলেও পরম সত্য। আত্মা অবিনশ্বর, আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারে না। প্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাক, তা হলে তোমার মত ভাগ্যবতী কে আছে ? .....

“...... তুমি সুখী হও, শান্তি পাও – এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস কর, আমি তত মন্দ নই – এই আমার শেষ কৈফিয়ৎ।“

চিঠি শেষ করেও আবার একটি PS. দিয়ে লিখেছেন, “আমার ‘চক্রবাক’ নামক কবিতা-পুস্তকের কবিতাগুলো পড়েছ ? তোমার বহু অভিযোগের উত্তর পাবে তাতে। তোমার কোনো পুস্তকে আমার সম্বন্ধে কটূক্তি ছিল।”

ঐ সময় নার্গিস ঢাকায় থাকতেন। তাঁর চিঠির বয়ান তো উপলব্দ্ধ নয়। তবে নজরুলের উত্তর থেকে তার কিছুটা আন্দাজ হয়তো করা যায়। নজরুল তাঁকে নিজের সম্বন্ধে ‘লোকের কথায়’ বিশ্বাস না করতে বলেছেন। বলেছেন আপোষের জন্য কোন বার্তাবাহক তিনি পাঠাননি। একদা তিনি নার্গিসকে ‘দেবীমূর্তি’তে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও নার্গিস স্বেচ্ছায় সেদিন ‘পাষাণ-দেবী’ হয়েছিলেন, এমন অনুযোগ করেও বলছেন সে বেদনার আগুনে তিনিই দগ্দ্ধ হয়েছেন, এবং সেই দহন থেকেই তাঁর বিদ্রোহী সৃজনী সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে নার্গিসের প্রতি তাঁর কোন ‘জিঘাংসা’ নেই। ‘আত্মহত্যা’র বিশ্লেষণও আছে যার উল্লেখ আগে করেছি। ‘চক্রবাক’ পুস্তকে যে অভিযোগের উত্তরের কথা কবি বলেছেন, তা সম্ভবত তাঁর ‘হিংসাতুর’ কবিতাটিকে নির্দেশ করে।

এই পত্রালাপের মধ্যে একটি ‘ঢাকার কুকুরের’ প্রসঙ্গও এসেছে। এর সম্বন্ধে একটি ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। ১৯২৮ সালে ঢাকার রাস্তায় একদিন রাতের অন্ধকারে নজরুল তাঁর কিছু অনুরাগীদের সঙ্গে পথ চলার সময় কয়েকজন দুর্বৃত্ত দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর প্রাক্তন ক্যাপ্টেন নজরুলের বাহুবলের কাছে আক্রমণকারীরা অচিরেই পরাস্ত হয়ে পলায়ন করে। খুব সম্ভবত এই কান্ডেরই ইঙ্গিত এসেছে চিঠিতে। এখানে ‘তোমাদেরই ঢাকার কুকুর’ এই বর্ণনা লক্ষণীয়। নজরুল স্বপক্ষবর্গের অনেকেরই বিশ্বাস, ঐ আক্রমণের পিছনে আলী আকবর খানের ভূমিকা ছিল, যদিও তার সমর্থনে কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে বলে জানা নেই।

কিন্তু নার্গিস ও তাঁর পরিবারের কাছে চিঠিটির সব থেকে গুরত্বপূর্ণ বাক্য অবশ্যই: “তুমি যদি স্বেচ্ছায় স্বয়ম্বরা হও, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। আমি কোন্ অধিকারে তোমায় বারণ করব-বা আদেশ দিব ?” যদিও নজরুল ইন্সটিটিউট পত্রিকার পঞ্চদশ সংকলনে ‘কুমিল্লায় নজরুল-নার্গিস প্রসঙ্গ’ শীর্ষক নিবন্ধে শান্তিরঞ্জন ভৌমিক লিখেছেন যে বিয়ের অনুষ্ঠানের সে রাতের পর দুজনের “জীবনে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয়নি”, কিন্তু অন্য কতিপয় বিবরণীতে আবার পাওয়া যায় যে নজরুলের ঐ চিঠি পাওয়ার পর সে বছরেই ৪ঠা নভেম্বর কলকাতায় এসে নার্গিস তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। দুই মামাতো ভাইকে নিয়ে নার্গিস শিয়ালদদহের কোন হোটেলে এই সাক্ষাৎ করেন বলে তাঁরই জবানীতে দাবী করা হয়েছে। তিনি নজরুলকে নাকি অনুরোধ করেন, তাঁকে প্রথমা স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে, কিন্তু ‘অপ্রস্তুত’ নজরুলের মত ছিল তা প্রমীলার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, এবং নার্গিসের ফিরে যাওয়া উচিত। তিনি এও নাকি আশ্বাস দিয়েছিলেন যে শীঘ্র ঢাকায় গিয়ে তিনি কোন ব্যবস্থা করবেন, কিন্তু তা তিনি করেননি। কোন কোন ভাষ্যে অবশ্য বলা হয়েছে যে ঐ সাক্ষাৎকারের সময়েই দুজনের ‘তালাক’ পর্ব সম্পন্ন হয়। আবার অন্য কয়েকটি বিবরণে পাওয়া যায় যে, নজরুল-নার্গিসের ‘তালাকনামা’ কলকাতায় সাক্ষীদের উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৩৭এর ডিসেম্বরে (ডঃ রফিকুল ইসলাম: নজরুল জীবনী, ১৯৭২), অথবা অন্যমতে, পরের বছর অর্থাৎ ১৯৩৮এর ২০শে এপ্রিল (এ.এফ.এম মাহবুবুর রহমান, দৈনিক জনকণ্ঠ, ২০২৩), এবং সেখানে নার্গিস উপস্থিত ছিলেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। অর্থাৎ, এই বিষয়ে হয়ত কিছু ধুসর এলাকা আছে।

স্বপক্ষীয়রা বলেন, যখন বিয়েই সম্পন্ন হয়নি, তখন তালাকের প্রশ্নই আসে না। বিয়ে হয়নি বলেই নজরুল চিঠিতে নার্গিসকে লিখেছিলেন যে তাঁর প্রতি কোন অধিকার নেই এবং তিনি স্বয়ম্বরা হলে আপত্তি নেই। যদি বিয়ে হয়েই থাকত, তবে নার্গিস ও আলী আকবরের পরিবার এত দীর্ঘ অপেক্ষার পরিসরে বিচ্ছেদের ও আর্থিক দাবীর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারতেন, যা তাঁরা করেননি। যদি ‘তালাক’ও হত, তবে নার্গিসের প্রাপ্য ‘মাহর’ নজরুল তাঁকে দিয়েছিলেন, এমন প্রমাণ বা সাক্ষ্য কোথাও পাওয়া যায় না। তবে এমন ‘তালাক’ কি করে সিদ্ধ হয় ? সর্বোপরি, বিরজাসুন্দরীর বর্ণনায় ‘ত্রিশঙ্কু বিয়ে’, এবং নজরুলের নিজের ভাষ্য ‘বর সেজেছিলুম’ প্রমাণ করে যে এই তথাকথিত বিয়ে তাঁরা স্বীকার করেননি।

বিপক্ষীয়রা বলেন, ঐ বিবাহ সিভিল ম্যারেজ ছিল না, কারণ আইনত নার্গিস তখন নাবালিকা ছিলেন। তাই আইনানুগ উপায়ে বিচ্ছেদ সম্ভব ছিল না। বিয়ে ছিল কাজীর পড়ানো ঐস্লামিক পদ্ধতিগত (যদিও এই মতও স্বপক্ষ মানেন না, আগেই উল্লেখ করেছি)। সেই জন্যই তালাকনামার প্রয়োজন ছিল। তাঁরা এও বলেন, নার্গিস ও নজরুল, দুজনেই দুজনকে ভাল বেসেছিলেন, সাময়িক ভুল বোঝাবুঝি দূর করে নার্গিস যন্ত্রণা সহ্য করেও একটা মীমাংসা করতে বহুকাল অপেক্ষা করেছিলেন। তা ছাড়া সেই সময়ে সামাজিক সম্মানেরও একটা গন্ডী ছিল। তাই নজরুলের চিঠির পর যখন তাঁরা বুঝলেন যে করণীয় আর কিছুই নেই, তখন তালাকই শেষ উপায় ছিল। নজরুলের প্রতি নার্গিসের অনুরাগবশতই এবং নজরুলের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে তাঁরা দেনমোহর বা মাহর পরিত্যাগ করেন।

কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ স্পষ্টতই বলেছেন বিয়ে হয়নি। নজরুল জীবনীকার রফিকুল ইসলামও মোটামুটি এই বক্তব্য সমর্থন করেছেন। অন্যদিকে বেগম সামসুন্নাহার, মো. ওয়াজেদ আলী, আব্দুল কাদির প্রভৃতির লিখন ইঙ্গিত করে যে বিয়ে হয়েছিল। কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ দস্তাবেজ, যেমন নার্গিসের চিঠিগুলি, কাবিননামা বা স্বাক্ষরিত তালাকনামার মূল লিপিগুলির বা কোন অনুলিপির কোন হদিস পাওয়া যায়নি, যা হয়তো এই বিষয়ে আলোকপাত করতে পারত। বিষয়টি তাই বিতর্কিতই রয়ে গেছে।

সুদীর্ঘ ১৭ বছরের অপেক্ষার শেষে, কিছু মাস পরে, ১৯৩৮এর সম্ভবত ১২ই ডিসেম্বর ঢাকায় নার্গিস বিবাহসুত্রে আবদ্ধ হন আজিজুল হাকিমের সাথে। আলী আকবর খান তখন ঢাকায় তাঁর পুস্তক প্রকাশনা ও বিক্রীর ব্যবসা করতেন। আজিজুল হাকিম তাঁর সহযোগী হিসেবে কাজ করলেও নিজ প্রতিভাগুণে একজন কবি, অনুবাদক ও সম্পাদক ছিলেন। তিনি আবার নজরুলের অত্যন্ত গুণগ্রাহীই শুধু ছিলেন না, তাঁর পরিচিত ও স্নেহধন্যও ছিলেন। নার্গিসের এই পরিণয় উপলক্ষে ১৯৩৮এর ১লা ডিসেম্বর নজরুল তাঁকে আরেকটি সংক্ষিপ্ত পত্রে লিখেছিলেন, “তোমাকে পেয়েও হারালাম। তাই মরণে পাবো – সেই বিশ্বাস ও সান্ত্বনা নিয়ে বেঁচে থাকব। প্রেমের ভুবনে তুমি বিজয়িনী, আমি পরাজিত। আমি আজ অসহায়। বিশ্বাস করো -আমি প্রতারণা করিনি। আমাদের মাঝে যারা এ দূরত্বের সৃষ্টি করেছে, পরলোকেও তারা মুক্তি পাবে না।“ সঙ্গে একটি কবিতাও ছিল: ‘তোমার প্রিয় যদি পাশে রয় / মোরও প্রিয় সে করিও না ভয় / কহিব তারে, আমার প্রিয়ারে আমারো অধিক ভালবাসিও।‘

এই বিচিত্র প্রেমপর্ব আর তার পরের সুদূরবিস্তৃত বিরহ-বেদনা নজরুল-সৃষ্ট কাব্যে ও সঙ্গীতে গভীর প্রভাব রেখে গেছে, তা বহু বিশ্লেষিত। শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের ভাষায়, “নজরুলের কবিতায় ও গানে নানা অনুষঙ্গে নার্গিস তাঁর সৃষ্টিশীলতায় সবসময় জাগ্রত ছিল। নজরুলের সৃষ্টিশীল রচনায় পূর্ণতার ক্ষেত্রে পরোক্ষে নার্গিসের অবদান অসীম।“ এ বিষয়ে আলোচনায় গেলে একটি ভিন্ন নিবন্ধ হতে পারে।

কাজী নজরুল ইসলাম সুবিখ্যাত। কিন্তু সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস আসার খানমের লোকপরিচিতি সীমায়িত। তবে তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিও সৃজনীতে পরবর্তী সময়ে প্রমাণ করেছিলেন যে তিনিও এক বহু গুণসম্পন্না রমণী ছিলেন। নজরুলের সঙ্গে পরিচয়ের সময়ে তিনি ছিলেন অল্পশিক্ষিতা, হয়তো নিজ সিদ্ধান্তে দ্বিধাগ্রস্তা। সতেরো বছরের নিদারুণ সময় তিনি যে স্থৈর্য ও আত্মস্থতায় অতিবাহিত করেছিলেন, তা নিঃসন্দেহে উল্লেখনীয়। সময়ের কঠিনতাকে অতিক্রম করে তিনি নিজেকে উন্নততর করার প্রয়াস করেছিলেন। স্বেচ্ছায় ঘরে বসেই তিনি পড়াশোনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৩৫ সালে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন, এবং ১৯৩৭ সালে ইডেন গার্লস কলেজ থেকে আই এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ইতিমধ্যে আলী আকবর খান তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেখানে বাংলাবাজার এলাকায় একটি বাড়ী নির্মাণ করে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়। নার্গিস মামার পুস্তক ব্যবসাও পরিচালনা করতে শুরু করেন, সম্ভবত সে সময়ের একমাত্র সফল মহিলা ব্যবসায়ী।

নার্গিস সাহিত্য রচনায়ও লেখনী ধরেছিলেন। তাঁর বেশ কয়েকটি উপন্যাস, ধর্মীয় গ্রন্থ এবং কবিতা ও গান রসিক পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছে। বিচ্ছেদের বেদনা, জ্বালা ও হয়তো কিছুটা তিক্ততা তাঁর রচনাকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর উপন্যাস ‘তাহমিনা’য় তিনি বর্ণনা

  পরিনত বয়সে নার্গিস



করেছেন বীর রুস্তমের স্ত্রী তাহমিনার একাকীত্ব ও দুরূহ সংগ্রামের কথা, যাকে নিঃসঙ্গ করে তার স্বামী যুদ্ধ করতে চলে যায়। প্রচলিত ধারণা এই যে এই উপন্যাসটিই নজরুলকে ‘হিঁংসাতুর’ কবিতা রচনায় প্ররোচিত করেছিল। তেমনি ‘ধূমকেতু’ উপন্যাসে নার্গিস লিখেছেন কোন নারীর শান্ত, নিস্তরঙ্গ জীবনে কেমন করে ধূমকেতুর মত এক পুরুষের অযাচিত আবির্ভাব ও প্রস্থান সব কিছু ছাড়খার করে দিয়ে চলে যায়। ‘পথের হাওয়া’র নায়কের চরিত্রেও বোহেমিয়ান স্বভাবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে। ১৯৮০ সালে নার্গিস যমুনা সাহিত্য গোষ্ঠী প্রদত্ত ‘বিদ্যাবিনোদিনী’ সম্মাননা লাভ করেন।

নার্গিসের সংস্পর্শে এসেছেন এমন কয়েকজনের বিবরণীতে, এবং তাঁর দেওয়া কতিপয় সাক্ষাৎকারে, এই নারীর স্বভাব ও চরিত্রের বিবিধ দিক উন্মোচিত হয়েছে। এই বিষয়ে মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া রচিত ‘কবিপ্রিয়া নার্গিস: তোমাকে যেমন দেখেছি’ (অভিনন্দন, ১৯৯৬) প্রবন্ধ থেকে কিছু উধৃতি এখানে প্রাসঙ্গিক: “যখনই তাঁর সান্নিধ্যে যেতাম, তখনই আমার মনে হতো: আমি এক যন্ত্রণাদগ্ধ মহিয়সী নারী এবং ইতিহাসের কিংবদন্তী নায়িকার মুখোমুখি। নার্গিস যেভাবে এবং যে সকল বিষয়ে আলোচনা করতেন, আমি বিশ্বাস করি: সমকালে কোনো মুসলিম মহিলার সাথে তাঁর তুলনা হয় না। রূপের রাণী নার্গিস অতিথিপরায়ণা, রুচিশীল, পরিচ্ছন্নপ্রিয়তা, স্বল্পভাষিণী ছিলেন। তাঁর হাসি ছিলো মধুর, মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না।......নিজের হাতে রান্না করতেন, নামাজ পড়তেন এবং তিনি অবিশ্বাস্য রকম দায়িত্বশীল ছিলেন। স্বামীর প্রতি তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীল ছিলেন।.....নার্গিস প্রায় নিয়মিত নজরুলসংগীত শুনতেন। বিশেষ করে, নজরুলের বিরহদীর্ণ প্রেমাশ্রয়ী সংগীতমালা শুনে তাঁকে আমি নিরবে কাঁদতেও দেখেছি। নিজে ছিলেন সুকণ্ঠি । শৈশবে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানও গাইতেন, সে কথা নিজেই বলেছেন আমাকে।“

আজিজুল হাকিম ও নার্গিসের দুই সন্তান – পুত্র ডঃ ফিরোজ আজাদ ছিলেন ম্যানচেস্টারে চিকিৎসক, এবং কন্যা ডঃ শাহনারা অক্সফোর্ডে বাস করতেন। ১৯৬২ সালে আজিজুল হাকিমের মৃত্যু হয়। ১৯৭১ সালের প্রারম্ভে নার্গিস ম্যানচেস্টারে ছেলের কাছে চলে যান। সেখানেই ১৯৮৫ সালে ৮১ বছর বয়সে তাঁর দেহাবসান হয়, এবং নজরুল-প্রিয়াকে সমাধিস্থ করা হয়।
0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সেবিকা ধর

Posted in









নারীর ভেতর যে আগুন বা অগ্নিময় শক্তি আছে তাকে সমাজ বা সমসমাজ বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ চিনতে পারে না।ফলে নারীকে সবসময়ই একটা কোমল,পেলব ছায়াতরু হিসেবে দেখানর চেষ্টা করা হয়।আমরা যারা সমাজতত্ত্ব বা সামাজিক জীবন বা নারী এবং পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে ভাবি তখন দেখতে পাই যে নারীকে বৃক্ষ ভাবার অর্থ তাকে কুড়োল দিয়ে মারলে সে কথা বলবে না, তার গায়ে আগুন দিয়ে দিলে সে কথা বলবে না,তার গায়ে এসিড ঢেলে দিলেও সে কথা বলবে না,তাকে দড়ির ফাঁস তৈরি করে, সটান ঝুলিয়ে দিলেও সে কথা বলবে না।কারণ গাছ নীরব থাকে।কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে বৃক্ষের সঙ্গে নারীর তুলনা হলেও নারী কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার স্বজ্ঞান নিয়ে জাগরিত থাকে। তার বুদ্ধিমত্তা, তার প্রজ্ঞা,তার মেধা তার জিজ্ঞাসা, তার যাবতীয় আবিষ্কারের চিন্তা -সবটা একটা নতুন ভুবন এবং নতুন ভুবনের যে পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে আমাদের সামনে, যেটা আমরা বারে বারে যুগে যুগে কালে কালে দেখেছি দেশে এবং বিদেশে। বেদের যুগে,উপনিষদের যুগে পরবর্তী সময় মহাভারত, রামায়ণকে যদি মহাকাব্যও ধরে নি, কল্পনাও করি।সেই সময়টা ধরে নিয়ে দেখবো নারী কিন্তু সব সময় অত্যন্ত সচেতন, সংবেদনশীল তাকে সেইদিক থেকে বৃক্ষ যেমন বলা যায়, তার মধ্যে একটা স্বাভাবিক প্রতিরোধের ক্ষমতাও আছে। যে প্রতিরোধ করে, প্রতিরোধের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে সে নতুন করে সমাজ বাস্তবতার চেহারা বদলে দেয়।এখানে আগুনের ডালপালা বলা হয়েছে মেয়েদের।আগুনের ডালপালা অর্থে বৃক্ষ গভীরে যখন আগুন লেগে যায় অর্থাৎ সামাজিক পরিবেশ শোষণ, বঞ্চনা এবং নারীকে দাবিয়ে রাখার যে স্বভাব -প্রবণতা সেইটা যখন ভেতরে ভেতরে পেট্রোল, কেরোসিন, বারুদ জমাতে জমাতে দেশলাই কাঠি জ্বেলে বা মশালের আলোয় আগুন জ্বালিয়ে দেয়, তখন এই শান্ত বৃক্ষরা হয়ে ওঠে অগ্নিময় কালান্তক কোনো যাত্রা।আর এই অগ্নিময়তা নিয়েই সে যাত্রা করে সূর্য শিকারে।সূর্য শিকার অর্থে এখানে জীবনের চরম সত্যকে চরম ভাবনাকে চরম জিজ্ঞাসা এবং প্রশ্নের প্রতি উত্তরকে সমূহভাবে, সামূহিকভাবে নিয়ে আসা,এটাই তার আগুনের ডালপালা হিসেবে সূর্য শিকারের দিকে যাত্রা আমাদের মনে হয়।ফলে সূর্য শিকার থাকে আগুনের ডালপালাও থাকে। নারী তার সমাজ বাস্তবতা এবং তার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ত্যাগ তিতিক্ষা ও জীবনের যাবতীয় যে কষ্ট, বঞ্চনা তার মধ্য দিয়ে এক নতুন পৃথিবীকে আকর্ষণ করে। সেই পৃথিবীর নাম সবুজ, এবং চিরন্তন এক যাত্রার স্বপ্ন নিয়ে থাকা ভুবন পথে যাত্রার কথাই বলে দেয় আমাদের।
নারী আমার কাছে শেকলে বাাঁধা সারমেয় ,পুরুষতন্ত্র বা পিতৃতন্ত্রের এই আস্ফালন যেন আবহমানের।আগেকার দিনে রাজা মহারাজার সভায় চিতা বাঘ দেখা যেত, আকবর ও জাহাঙ্গীরের সভায় চিতা রয়েছে গলায় শেকল বেল্ট বাধা।শিকারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতো তারা।আর কুকুরকে তো রাখেই।এই ব্যাপারটা ক্রমশ করে দেওয়া হল। পুরুষ নারীর সব অধিকার হরণ করবে কিন্তু নারী তার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে পারবে না।নারী অসূর্যম্পশ্যা। সে সূর্যের মুখও দেখতে পারবে না।প্রাচীন কালে মুঘল শাসনের সময়, মুঘল সম্রাটরা তাদের মেয়েদের বিয়ে দিতেন নাা পাছে সম্পত্তি ভাগ হয়, এই ভালো না লাগাকে মাথায় রেখে জাহানারা, রোশেনারা কারোরই বিয়ে হয় নি। আকবর এই আইন চালু করেছিলেন। তারা কিন্তু ঝরোখার ভিতর দিয়ে রাজপুত বীরদের দেখতেন- সুউচ্চ বুক, চওড়া কাঁধ, সুন্দর গোঁফ,সুপুরুষরা যাচ্ছে বা মধ্য এশিয়ার কোনো যোদ্ধাকে দেখতেন।কারণ তখন তো মধ্য এশিয়া থেকে আসতেন পেশাদার যোদ্ধারা মুঘল সেনা দলে চাকরি করতে, তাতার,তুর্ক,উজবেক,ইরানি থেকে সবাই আসতেন আর্মিতে-মোঘল সৈন্য দলে।তখন রাজ প্রাসাদের নারীরা লুকিয়ে বীর যোদ্ধাদের দেখতেন।কিন্তু বাইরে থেকে যোদ্ধারা বাইরে থেকে তাঁরা দেখতে পেতেন না।মুঘল হারেমে খোজা অর্থাৎ নপুংসক পাহারাদার রাখতেন।বা যাঁরা বাদশাহদের রক্ষিতা ছিলেন, তাদের পাহারাদারির জন্য - খোজা, নয়তো তাতারানি রাখা হতো পাহারাদার হিসেবে।তাদের মন মানসিকতা হচ্ছে এমন তুমি আমার সম্ভোগের বস্তু। আমার বাগানের গোলাপ তুমি।তোমাকে যখন ইচ্ছে ছিঁড়ব। যখন ইচ্ছে বুক পকেটে রাখব,যখন মনে হয় গন্ধ শুঁকব৷কখনও ফুলদানিতে রাখব,কখনও তাকে পদদলিত করব। আমাকে কেউ কিচ্ছু বলার নেই।আবার ইচ্ছে হলে পাপড়িগুলো ছিঁড়ে দূরে ভাসিয়ে দেবো কোথাও।এটা যে সবটাই আমার ইচ্ছে। গোলাপের কোনো ইচ্ছে নেই। তার কোনো ইচ্ছে থাকতে নেই।সে শুধু ফুটে যাবে।গন্ধ বিলিয়ে পুরুষ নামক বস্তুকে খুশি রাখবে।কখনো ফুলদানিতে, কখনো তাকে পদদলিত করব।এই যে পুরুষতন্ত্রের পুরনো খেলা, এই খেলাটা ক্রমশঃ নারী ধরে ফেলেছে। কল্যাণী দত্তের 'পিঞ্জরে বসিয়া'তে কিন্তু অন্যভাবে আঁকা হিয়েছে মেয়েমহল,নারীমহলের ছবি।সেখানে দেখা যায় যে আমাদের হিন্দু বাঙালি নারীরা অন্দর মহলে তাস খেলছে দাবা খেলছে, গ্রাবু, বিন্তি, সামনে সাজান পানের বাটায়,পান, জর্দা,চুন,,ছোটো এলাচ,বড় এলাচ, কিমাম। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন,কখনো কখনো চাপা গলায় মহিলা মহলের খিস্তি মৃদু গালাগালি-চাপা স্বরে, কখনও কখনও রসের কথা-আদি রসের কথা,একটু আদি রসাত্মক গুপ্তজ্ঞান জগতের কথাও হচ্ছে। এটা মেয়ে মহলের মুক্তি কিন্তু নয়। পুরুষরা যে বারমুখো, অর্থাৎ সন্ধ্যা হলে বাবু ধুতিটি পরে পাঞ্জাবিটি গায়ে দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ,কানে আতর দিয়ে, চললেন রক্ষিতার বাড়ি, নয়তো বাইজি সন্নিধানে।তাদের প্রতিহত করার, রেজিস্ট করার ক্ষমতা কিন্তু অন্তঃপুরবাসিনীদের থাকছে না।

আসলে নারী প্রকৃতপ্রস্তাবে প্রতিভাবান। যেহেতু নারী ভালো সংগঠক,যেহেতু সমস্ত পৃথিবীটাকে ভালো করে চালাতে পারেন,যেহেতু নারী পূর্ণ আকাশ,তাই পুরুষের ভয় যদি নারীর কাছে হেরে যাই,যদি তাকে দাবিয়ে দেয়,তাকে যদি তাড়িয়ে দেয়,তাড়িয়ে দেয় মানে গৃহ ত্যাগ নয়,কোন মতামত পছন্দ না হলে যদি তা নিমেষে উড়িয়ে দেয় তার ভয় পুরুষের। এটা নারীর স্বাধিকারের প্রশ্ন।আমি সন্তান ধারণ করব কী করব না, আমার গর্ভে সন্তান আসবে কি আসবে না,এই সিদ্ধান্ত নারী যদি নিতে না পারে, তাহলে কী করে নারী স্বাধীনতা আসবে।আগুনের ডালপালা বলা হচ্ছে কেন, নারীর ভেতর যে বিস্ফার আছে,যে প্রতিভা আছে,সেই প্রতিভাকে সে বিস্তৃত করতে চায়। হ্যাঁ, না বলতে চায়,তখনই সে বিদ্রোহী ।কিন্তু তার শিকড়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়।কিন্তু সে যখন শুদ্ধ স্বরে হ্যাঁ বা না বলতে চায় তখনই সে বিদ্রোহী। এই যে আগুনের ডালপালা, এই যে শিরোনামের দিকে আমরা আসছি, এই আগুনের ডালপালাগুলি ক্রমশঃ সম্প্রসারিত করছে তারা সূর্য শিকার করতে।সূর্য যা পৃথিবীকে আলো দেয়,নিজের গাত্র বর্ণ বা হেমবর্ণ অগ্নিবর্ণ আলো দিয়ে সে সূর্য শিকার করতে চাইছে।এই সূর্য শিকারের মধ্য দিয়েই ত্রিপুরার নারীদের লেখা অন্য নারী লেখকদের চেয়ে আলাদা।এবং সূর্য শিকার তারাই করবেন কারণ তাদের আগুনের ডালপালা আছে।এবং সেইটা তারা গোড়া থেকে মানে একটা মেয়ে যখন বড় হয়ে উঠে, আস্তে আস্তে যখন তার বালিকা বেলা থেকে কৈশোর বেলা,কৈশোর থেকে যখন যৌবন বেলা তখন থেকেই ঘরের মা বাবারা বুঝাতে থাকেন এটা করতে হবে,ওটা করতে হবে,এসব না মানলে পাপ হবে।এবং অদ্ভুত ভাবে মেয়েরা সবই মেনে চলতো।নারীর এতো প্রতিভা যে তাকে পুরুষ একশোতে একশো না বলে সাত বলতে চায়।পুরুষরা বরাবরই বলে থাকেন মেয়ে মানুষ বারো হাত কাপড়েও লেংটা।মেয়ে মানুষ উড়বে ছাই,....গুণ গাই।এটি নারীর বিপর্যয়।
প্রথম জীবনে পিতা, দ্বিতীয় জীবনে পতি,তৃতীয় জীবনে পুত্র।ফলে নারী সকলের কর্তা।এখানে নারী সমান সমান ফলে সকলের কর্তাকে সব সময়ই মানসিক এবং শারিরীকভাবে সুস্থ থাকতে হবে।বছরের পর বছর নারীকে সন্তান জন্ম দেয়া,প্রত্যেক মাসে রজঃ নিবৃত্তি হয় দীর্ঘ সময় ধরে এদিকে পুরুষের কোনো খেয়ালই নেই।সেটাকে যদি সমাজ বুঝতে না পারে,তাহলে আগামী দিনে পরিবার,সমাজ,দেশ, রাষ্ট্র কীভাবে এগোবে।

রাষ্ট্র কিন্তু আসলে মনহীন একটা যন্ত্র।একটা হেডলেস ক্রিচার।সে সবাইকে গ্রাস করতে চায়।মাথার চিবিয়ে ফেলতে চায়।নষ্ট করতে চায়।সে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি মেয়ে দাঁড়ায়।একটি পুরুষ মানুষের স্বাবলম্বী হয়ে দাঁড়ানো ও মেয়ের দাঁড়ান মধ্যে ফারাক আছে।একটি জেলে একজন পুরুষ প্রচন্ড মার খেতে পারেন কিন্তু একটি মেয়েকে তো সেখানে ধর্ষিত হতে হয়।এ-ইটা হচ্ছে রাষ্ট্র। মহেশ্বেতা দেবীর দ্রৌপদী গল্পের শেষে দোপদী মেঝেন শেষে মনে করছেন অর্থাৎ যখন তাকে ধর্ষণ করছে তখন তার পুলিশ অফিসারের উচ্ছ্রিত পুরুষাঙ্গ সমেত গোটা শরীরটাকে নিজের গভীরে প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিতে বাধ্য হয়ে,পুরুষাঙ্গটিকে চলমান পিস্টন ভাবতে শুরু করে ভয়ানক যন্ত্রণা ও ব্যথার ভেতর। এখানে একটি রাষ্ট্র কীভাবে নারীর শরীর দখল করে।এর পর মীনাক্ষী সেনের গল্প,এর পর জয়া গোয়ালা,নারী এবং তার স্বকীয়তা, স্বাধীনতা এইটা যদি তার পুরুষের সহমর্মিতার,বন্ধুতার সব কিছুর মধ্য দিয়ে তাঁরা এগুচ্ছেন ,নারী ক্রমশঃ ক্রমশঃ রিভোল্ট করবে।তাকে পিঞ্জরে রাখা যাবে না।পিঞ্জরে বসিয়া সুখ হয়ে সে কথা বলবে না।এর জন্য কিন্তু দায়ী থাকবে পুরুষ এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থা।

অর্থাৎ মেয়ে মানুষ যে একটা ইমপর্টেন্ট পার্সন তাকে যে গুরুত্ব দিতে হয় সেইটাই শেখানো হয় না বেশিরভাগ পরিবারে।ঘরে যেকোনো কথা বললে মেয়ে শুনতে চাইলে বা বলতে চাইলে তাকে সব সময়ই বলা হয় এই তুমি মেয়েছেলে সব কথার মধ্যে তুমি কথা বলছ কেন।মনে হয় মেয়েমানুষ যেন মানুষই নন তাই এই বিষয়ে ঘর থেকেই শিক্ষা দেয়া দরকার। সেটা একমাত্র হতে পারে নারী জাগরণ এবং সাহিত্যের যে মহানুভব খেলা তার মধ্য দিয়ে হতে পারে।
তবে ত্রিপুরার সাহিত্য পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য থেকে আলদা তার কারণ ত্রিপুরার ভৌগোলিক যে অবস্থান, যে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক যে পরিবেশ, যেভাবে আর্মি এবং রাষ্ট্র অত্যাচারের থাবা নামিয়েছে সেটা বাংলায় কিছুটা হয়েছে হয়তো কিন্তু ত্রিপুরায় একটি পর্যায়ে ভীষণভাবে হয়েছে।ফলে সেখানকার নারী লেখকদের লেখা আলাদা তো হবেই। স্বতন্ত্র উচ্চারণ স্বাভাবিক ভাবেই হবে।এবং সেই স্বতন্ত্র উচ্চারণের মধ্য দিয়েই কিন্তু তাঁরা এগুচ্ছেন। এবং এগুতে এগুতে অর্জন করছেন একটা স্বাধীনতা।সেই স্বাধীনতার পতাকা- সংগ্রামের নিশান,তাঁরা নিজেদের স্বোপার্জিত ভূমিতে প্রোথিত করেছেন।

জীবনকে অন্তঃস্থল থেকে দেখার মানস-চক্ষু ও শক্তিশালী কলমের লেখিকা মীনাক্ষী সেন বন্দ্যোপাধ্যায় যৌবন প্রারম্ভেই সাহিত্যের অঙ্গনে পা রেখেছিলেন।তাঁর কথায় ঐশ্বরিক প্রেমের কাহিনি নয় ছিল সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ,হাসি কান্নার বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। লেখক মীনাক্ষী সেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে ওঠে এসেছে নারীর সমকালীন সমাজের নানা দ্বন্দ্ব, জটিলতা,অপরিনত প্রেম,অবৈধ প্রেম ও নানা মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপ। তিনি উপন্যাসে নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও নারী স্বাধীনতা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন।

মীনাক্ষী সেনের 'জেলের ভেতর জেল' উপন্যাসটি দুটি ভাগে বিভক্ত। প্রথমটি 'পাগলাবাড়ি' ও দ্বিতীয়টি 'হাজতি নম্বর মেয়াদী নম্বর।' পাগলাবাড়ি পর্বটি চৌদ্দটি কাহিনির মাধ্যমে তোলে ধরেছেন লেখক।
মা কাহিনিতে মা'এর নাম মীরা।মীরা বদ্ধ পাগল।তাই তাকে জেলে ঢুকিয়ে চেন দিয়ে বেধে রাখা হত।কিছুদিন পর তার গর্ভে মানব শিশুর ভ্রূণ বেড়ে ওঠছিল।তাকে পুলিশ প্রথমে দু রাত থানায় রাখে।তারপর স্থানীয় জেল ঘুরে পাগলবাড়িতে।সে কোথাও ধর্ষিত হয়েছে - হয় থানায় নয় তো পথে।পিতার ধারণা পুলিশই তাকে ধর্ষণ করেছে।পাগলবাড়িতে কয়েকমাস থাকার পর সুস্থ হয়ে ওঠে - জ্ঞান ফিরে পায়।তখন সে সাত মাসের গর্ভবতী। সে ঠিক সময়ে সজ্ঞানে শিশুপুত্রের জন্ম দিয়েছে।শিশুর পিতৃ পরিচয় জানা নেই।সে কুমারী মা।লেখকের বর্ণনায়- ' মায়ের চেয়েও ভয়াবহ তার চেহারা।হাড়গুলো অপুষ্টির ফলে সরু-সরু।এক ফোঁটা মেদ তো নয়ই,কোনো মাংসও নেই শরীরে। মনে হয়; শীর্ণ হাড়ে আলগাভাবে যেন জড়ানো আছে গায়ের চামড়া।'
কুমারী-মা মীরার কঠোর সংগ্রাম শুরু হয় পরম ধন সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার।সন্তানের জন্য কোন আহার জেল কর্তৃপক্ষ মঞ্জুর করে নি।কারণ সে হল ' না- বন্দি শিশু।' স্বেচ্ছায় তার মা জেলে রেখেছে।না বন্দী,না অপরাধী শিশুর মায়েরা সর্বদা ক্ষমতাধর অত্যাচারীদের পায়ে পড়ে থাকে।হাত কচলে,তোষামোদ করে,পা টিপে,পিঠ চুলকে,শরীর দিয়ে- সর্বস্বান্ত হয়।
'সেই নীল নীলিমা ও একজন ওয়ার্ডার' কাহিনিতে রয়েছে রূপ লাবণ্যে পূর্ণ অসামান্য সুন্দরী নীলিমার স্থান হল ডিগ্রি ঘরে।ডিগ্রিঘর হল শাস্তি ঘর। নীলিমা অনাথ।ছোটো বেলায় মা বাবা মারা যাবার পর এক অভিজাত -ধনী দম্পতি নিজ সন্তানের মতো নীলিমাকে স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে,লেখাপড়া শিখিয়ে লালন পালন করে। বয়ঃসন্ধিকালে নীলিমা জেনে যায় সে হিন্দু ও অনাথ। মনের অন্তর্দ্বন্দ্ব সে লড়াই করে একদিন ঘরে ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।নারীমাংস লোলুপ শ্বাপদের হাতে পড়ে ধর্ষিত হয়।তারপর হাত বদল হতে হতে চলে আসে পতিতা পল্লীতে।এখানে তার মূল্য চড়া।কাজেই তার বিশ্রাম নেই।এই পতিতা পল্লীতে ঢোকা সহজ কিন্তু বেরনো প্রায় অসম্ভব। অনাথ হলেও নীলিমা রাজনন্দিনীর মতো বেড়ে উঠেছিল।ফলে পতিতা পল্লীতে অসহ্য যন্ত্রণায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে নীলিমা।পতিতাপল্লীর সঙ্গে জেলের নিবিড় যোগাযোগ। চিকিৎসার জন্য পাগলবাড়িতে ঠাঁই হলেও তার নিরাপত্তার কথা ভেবে ডিগ্রিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।যদি কোনো পাগল তার সোনার অঙ্গে দাগ ফেলে দেয় আঁচড় কামড় দিয়ে।ডিগ্রিতে থাকলেও খাওয়া দাওয়ায়,চিকিৎসা, ওষুপথ্য,কম্বল এসব সে তার মালিকদের তদারকিতে পেয়ে যেত।কারণ সে যত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে তার স্থানে যাবে ততই তাদের লাভ।ওরা ওঁৎ পেতে থাকে ঠিকানাহীন পাগলীরা সুস্থ হয়ে ওঠলে আত্মীয় সেজে এদের নিয়ে নিষিদ্ধ পল্লীতে ঢুকিয়ে দেয়।
এর পরের কাহিনি শোভা।অপরূপ সুন্দরী ষোড়শী শোভার সঙ্গে প্রণয়ের অভিনয় করেছিল পাশের বাড়ির এক ধনীর দুলাল।কালীঘাটে নিয়ে বিয়ে করে এবং ভাড়াবাড়িতে রেখে শোভার শরীর ভোগ করে।পরে শোভার পেটে সন্তান এলে ভাড়া বাড়িতে তাকে ফেলে চলে যায়।শোভার পিতা শোভাকে বাড়ি নিয়ে আসে।পরে শোভার এই অবস্থা দেখে মামলা করতে বাধ্য হয় । মামলার ফলে তিনজনই জেলে আসতে বাধ্য হয়।শোভা- তার সন্তান ও সন্তানের জনক।পরে ছেলেটি অবশ্য জামিনে ছাড়া পেয়ে যায় এবং জেলে পড়ে রইল শোভা।

বেশ কিছুদিন পর জেলের চূড়ান্ত অবহেলার মধ্যেই আবার এক শিশু পুত্রের জন্ম দেয় শোভা।পুত্রসন্তানের জন্মের জন্য শোভা আশায় বুক বাঁধে এবার নিশ্চয়ই স্বামী ও শ্বশুর তাকে বাড়ি নিয়ে যাবে।কিন্তু তা হয় নি।তাঁর সন্তান নিয়ে স্বামীর সংশয়।শোভা আদালতে শুনেছে সন্তানের রক্ত পরীক্ষায় প্রমাণিত হবে সন্তানের পিতৃত্ব।কিছুদিন পর হাসপাতালের ভাঙা জং ধরা উন্মুক্ত লোহার খাটে কয়েকদিন কাটিয়ে শোভার শিশুপুত্রটি মারা যায়।নানা কুৎসিত গালাগালি করে শোকাতুরা শোভাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল নোংরা অস্বাস্থ্যকর হাজতি নম্বরে।সন্তান-শোক ও জীবন যন্ত্রণা শোভাকে বিধ্বস্ত করে তুলে। জেলে এমন রটনাও ছিল যে শোভাই তার আত্মজাকে খুন করেছে।সদ্যোজাত পুত্রের মৃত্যুতে শোভার সমস্ত আশাই শেষ।

শোভার দেড় বছরের জেল।কোনোদিন মেয়াদি নম্বরের দিদিদের সঙ্গে কথা হয় নি।একরাতে মীরা,আরতিরা খুব মারধর করে শোভাকে।পরদিন জেলের দিদিরা ওকে সান্ত্বনা দিয়ে মারধরের কারণ জানতে চাইল।শোভা উত্তরে জানায় হাজতি নম্বরের এক বন্দিনী শোভার বান্ধবী। তাকে শোভা প্রেমপত্র লিখে দিয়েছিল। শোভা লেখাপড়া জানতো- হাতের লেখা যেহেতু শোভার সুন্দর। জেলখানার ভেতর এসব চলত।প্রেমপত্র লেখার পুরুষ চরিত্র মেটরা।মেট অর্থাৎ সাজা পাওয়া পুরুষ বন্দীরা নানা কাজের জন্য মহিলা ওয়ার্ডে ঢোকার অনুমতি পেত।যেমন- দুজন বন্দিনী মিলে এক ত্রিকোণ প্রেমের কাহিনি তৈরি হয়।এর মধ্যে মীরা একজন।সেই চিঠি গিয়ে পড়ে মীরার হাতে।হাতের লেখা যেহেতু শোভার তাই যত আক্রোশ তার ওপর।শোভা সেই মেটকে চেনেও না।সে সম্পূর্ণ নির্দোষ। মীরা শোভাকে শাসিয়ে ডিগ্রি ঘরে ঢুকিয়েছে।অবশেষে শোভা জেলারের নির্দেশে নিরপরাধ কিশোরী শোভাকে ডিগ্রি থেকে মুক্ত করা হয়।অথচ আইনের আশ্রয়ে থেকে শোভাকে চূড়ান্ত গঞ্জনা, অত্যাচার সইতে হয়েছে।মাতৃত্ব নিয়ে নানা কদর্য-প্রশ্ন।আত্মজকে হারাতে হয়েছে।তার স্বামী বিয়ে করেছে।সন্তান হয়েছে।এতোসব মানসিক আঘাত সইতে না পেরে স্বাভাবিক ভাবেই শোভা পাগল হল।
হাওয়াবিবির কাহিনিতে আমরা দেখতে পাই হাওয়াবিবি কৃষক দম্পতির একমাত্র বেঁচে থাকা সন্তান। অত্যন্ত আদরে বেড়ে ওঠা তার। তখন তাকে বিয়ে দেবার জন্য এক রাজপুত্রের সন্ধান পাওয়া গেল।হাওয়ার বাবা জায়গাজমি বিক্রি করে ধারদেনা করে তেরো বছরের আদরের হাওয়াকে বড় লোকের বাড়ি বিয়ে দেওয়ার জন্য।হাওয়া কুরূপা এই অজুহাতে তার বর তাকে নির্যাতন শুরু করে।শ্বশুরবাড়ির লোকজন বলতে তাকে বউ ছেলের মন ভরাতে পারছে না।দোষ হাওয়ারই।কিছুদিন পর হাওয়া শ্বশুর বাড়ির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বাপের বাড়ি চলে আসে।কন্যার এই অবস্থা দেখে মা -বাবাও অসুস্থ হয়ে যায়। হাওয়া বাবা মাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দায়িত্ব নিয়ে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে।পাশেই ফুপুর বাড়ি।ফুপুতো ভাইয়েরা ও ফুপু তাদের দেখাশোনা ও খোঁজ খবর নিত।কিছুদি পর উভয় বাড়ির ইচ্ছায় ফুপুতো ভাইয়ের সঙ্গে হাওয়াবিবির বিয়ে হয়।হাওয়ার দিন সুখে কাটতে লাগলো শরীরে স্বাস্থ্য ও লাবণ্যের জোয়ার এলো।ঠিক তখনই লম্পট প্রথম স্বামী রূপ লাবণ্যে ভরপুর হাওয়ার দিকে কু-নজর দেয়। হাওয়াকে একদিন একা পেয়ে বলাৎকার করার চেষ্টা করে।হাওয়া সে কথা স্বামী ও দেবরকে জানালে তারা সেই লম্পটকে হত্যা করে। তিন জন জেলে যায়।হাওয়া আর জামিন পায় নি।
দুই নারী কাহিনির নায়িকা শিবানীদি।শিবানীদির ভাগ্য বিড়ম্বিত হয়েছিল- আর দশজন মেয়ের মতোই।প্রেমে প্রতারণা, অবৈধ সহবাস, অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর অস্বীকার হওয়ার পর অস্বীকার করা ইত্যাদি। শিবানী অত্যন্ত দরিদ্র-ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে।রোগা-পাতলা চেহারা।আকর্ষণীয় তেমন কিছু ছিল না।তবে বয়সের স্বভাবে যৌবন এসেছিল এবং এক অবস্থাপন্ন ঘরের শিক্ষক ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেটা ক্রমে দৈহিক সম্পর্কে পরিণত হয়।শিবানী গর্ভবতী হয়।পাড়ার লোকজন শিবানীর পক্ষে ছিল।ওরা চাপ দেয় ছেলের বাড়িতে।কিন্তু প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে অস্বীকৃত হয়।

শিবানী ছেলেটিকে খুব ভালোবাসত এবং জানত সেই তার স্বামী। অভিযোগ ছিল ছেলেটির বাবার ওপর।বাবার অসম্মতি ছিল। শিবানীর বাবাও তাকে আর বাড়িতে স্থান দেয় নি।ফলে জেলখানার নিরাপদ আশ্রয়ে তাকে চলে যেতে হয়। রুগ্ন স্বাস্থ্য শরীরে আরেকটি জীবন বড় হতে থাকে শিবানীর ভেতর সবার আশঙ্কার মধ্যে সে শিশুপুত্রের জন্ম দিল। ঔষধ-পত্রের যোগান নেই,কীকরে সে সন্তানকে বাঁচাবে।অনেক কষ্টে শিশুর জীবন রক্ষা করে।বাচ্চাটিও দুর্ভাগা, কারণ শিবানীর বুকে দুধ না থাকায় সে অপুষ্টিতে ভুগতে থাকে।বিচারের দিন শিক্ষক তার ছেলে ও স্ত্রীকে অস্বীকার করল। সে তাদের চেনেই না।হাকিম রক্ত পরীক্ষার কথা বলল।প্রকৃত বাবা কে তা প্রমাণের জন্য কিন্তু শিবানীর স্পষ্ট কথা 'আমার ছেলেকে বাঁচাতে হবে।এ ছেলে শুধু আমার।' সে আর কোনোদিন তার পিতৃত্ব দাবী করতে পারবে না।অর্থাৎ মনে প্রাণে শিবানী তাকে ত্যাগ করেছে।
এক্ষেত্রে শিবানী অন্যান্য মেয়েদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।অন্যান্য মেয়েরা শত প্রবঞ্চনার পরেও আবার স্বামীর ঘরে যেতে বা স্বামীকে নিয়ে ঘর করতে চায়।কিন্তু জেলখানা থেকে বেরিয়ে তার শিশুসন্তানকে নিয়ে কোথায় যাবে শিবানী?ঠিক এই সময় আরেক নারী তাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল।নবদ্বীপের এক মাসী এসে প্রস্তাব দিল তার বাড়ি যেতে একজন স্ত্রী লোকের অভাবে তার সংসারটি ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছে শিবানী রাজি হয়ে গেল।শীর্ণ,উপোসী,মলিন, দুর্বল শরীর, কিন্তু মন প্রচণ্ড শক্তিশালী, জেলখানার সবাই শিবানীর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিল। কিন্তু শিবানীর বুকে অসীম সাহস।প্রতারক প্রেমিকের দ্বারা ধাক্কা খেয়ে জীবনের কঠিন পরীক্ষায় সে উত্তীর্ণ হয়েছে।

ভালোবাসার কাহিনিতে লেখক মেয়েদের প্রেমের পরিণতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন।একটি মেয়ে বিয়ে করেছে, তার বিয়ের বয়স হয় নি।এদিকে সে অন্তঃসত্ত্বা। বাবা তাকে জেদ মেটানোর জন্য একটা হোমে রেখে দেন - যাতে সে তার ভালোবাসার পাত্রকে ভুলে যায়।মেয়েটি হোমে সন্তানের জন্ম দেয়। ছাড়া পেয়ে শ্বশুর বাড়ি যায়।মেয়েটি নিজে নানা সামাজিক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে নিজ আত্মমর্যাদা লাভ করে।
রীতা নামে একটি মেয়েকে ওর মা লাভ কেসে ফাঁসিয়ে জেলবন্দী করেছিল।মিথ্যা অভিযোগ এনেছিল গৃহ শিক্ষকের বিরুদ্ধে। মায়ের হীন বেশ্যাবৃত্তিতে রীতার সহমত ছিল না।এই ছিল তার অপরাধ।
হাজতি নম্বর কাহিনিতে রয়েছে বিচারাধীন বন্দীদের থাকার কথা।কিন্তু বাস্তবে ঐ ঘরে সাজা পাওয়া মেয়াদি এবং নিরপরাধ বন্দিনীরা থাকত।শিশুরা,না-অপরাধী পাগলরাও থাকত।হাজতি নম্বরের ভিড় দিনে দিনে বেড়েই চলছিল।ফলে আয়তন তো আর বাড়ে নি।শুলে একজনের পা অপরজনের গায়ে লাগে।হাসি, কান্না, ঝগড়া গল্প সবই চলতে থাকে সমান তালে।হাজতি নম্বরের এক মেয়ে শিখা।আর দাপটে বন্দিনীদের অবস্থা কাহিল।সে ছিল সকলের ত্রাস।এ হেন কাজ নেই যে সে পারে না।অশ্লীল ভাষায় গালাগাল-মারপিট,সবই সে অবলীলায় করে যেত।
শিখার জেলে আসার কারণ সে ছিল গরীবের মেয়ে- তার স্বামী শ্রমিক। কারখানার মালিকের ছেলের সঙ্গে শিখা পালিয়ে যায়। কিছুদিন পর তাদের টাকা পয়সা ফুরিয়ে যায়।তারপর বাঁচার তাগিদে শুরু করে জালিয়াতি।পরে পুলিশের হাতে দুজনেই ধরা পড়ে।ছেলেটি অবশ্য জামিনে বাড়ি চলে যায়।তখন স্বামী তাকে ত্যাগ করে। শিখার আর কেউ নেই খোঁজ খবর করার।কাজেই তার আর জামিন হয় নি।সে সহজেই মেট্রনের খুব কাছের লোক হয়ে গেল।শিখা প্রধান মেট হয়ে ওঠে।সে আচারে ব্যবহারে যেমন ব্যাতিক্রম তেমনি পোশাক -আশাকেও উদ্ভট। শুধু হাত কাটা ব্লাউজ আর সায়া পড়ে ঘুরে বেড়াত।শিখার নিষ্ঠুরতা ও অত্যাচারের কথা লিখে শেষ করা যাবে না।শারীরিক চাহিদা পূরণের জন্য শিখার পুরুষ সঙ্গীর অভাব হয় না।তার আবার মেয়ে সঙ্গীও চাই।মনের চাহিদা পূরণ না হলে নানাভাবে অত্যাচার চালাত অন্যান্য বন্দীদের ওপর।বিশেষত সন্ধ্যার পর জেলখানার মৃদু আলোতে শিশু, কিশোর-কিশোরী,বৃদ্ধাদের সামনে চলত জৈবিক প্রবৃত্তি চরিতার্থের প্রয়াস।শুধু শিখা নয় অন্যান্য বন্দিনীরাও এই আচরণে সামিল হত।
জেলের ভেতর জেল উপন্যাসে একটি জেলখানার মহিলা ওয়ার্ডের বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশকের ছবি চিত্রিত করা হয়েছে।

জয়া গোয়ালার প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস 'এই সীমান্তে।' এই কাহিনির জীবন স্রোত চা বাগানের খেটে খাওয়া সাধারণ নারী পুরুষ। চা-বাগানের শ্রমিকদের জীবন যুদ্ধের পাশাপাশি নারীদের শোষণ, অত্যাচার ও নারীর নিরাপত্তাহীনতার ছবি দিয়ে রচিত হয়েছে এই আখ্যান।কাহিনির নায়ক যদু।সমগ্র উপন্যাসে টুকরো টুকরো গল্প ফুটে ওঠেছে।নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, রীতিনীতি সব পেছনে ফেলে যদুরা কীভাবে বাগানের কুলি হয়ে ওঠে তার ইতিহাস এখানে ফুটে ওঠেছে। সমাজের মহাজনেরা সুদের ব্যবসায় কীভাবে ফুলে ফেঁপে ওঠে তার গল্পও রয়েছে।যদুর মেয়ে চম্পা কাঁচা কুয়োয় পড়ে ঠ্যাং ভাঙে।সেই মেয়েকে সারিয়ে তুলতেই নকুল সাহার দ্বারস্থ হয়।আর সেই সুযোগে তার অসহায়তাকে পুঁজি করেই মহাজনের গদি মজবুত করে। পাঠক ভারাক্রান্ত হয় লীলার দেহ বিনিময়ের অধ্যায়ে।ক্ষুধার কাছে সতীত্ব তার অর্থ হারায়।দেহ বিক্রি করে স্বামী সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দেয় লীলা।পরিণতিতে লীলার গর্ভসঞ্চার। পরে জড়িবুটি দিয়ে খালাস পাবার চেষ্টা করে।এবং শেষে মৃত্যুর কাছে হার মেনে নেয় লীলা।লীলার শরীর বিক্রির ঘটনার শিউরে ওঠে যদু।মনে পড়ে চম্পার মুখ।চম্পার জীবনের অন্তিম পরিণতি যদি লীলার মতই হয়,যদু কি পারবে তা রুখতে? ভীত হয় দরিদ্র পিতা।
জয়া গোয়ালা সমাজের ক্ষত,সমাজের ব্যাধির ছবি,প্রান্তিক মানুষের জীবন যুদ্ধের ছবি আঁকে বিশ্বস্তভাবে।একদিকে গরিবী অপরদিকে জীবনে টিকে থাকার লড়াই,'এই সীমান্তের' শরীর জুড়ে।
'তবু মাদল বাজে' উপন্যাসে জয়া গোয়ালা সম্পূর্ণ অন্য পথে হেঁটেছেন। প্রান্তিকমানুষের অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের জীবন যুদ্ধ এই উপন্যাসের বিষয় বস্তু নয়।সমাজের বেআব্রু কুসংস্কারের দগদগে ঘা'কে কীভাবে শুধুমাত্র নারীদের ওপরই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন লেখক।
উপন্যাসের শুরুতেই আঁতুড় ঘরে ডমরুর বউ ফুলির এক ভয়ানক মৃত্যু দৃশ্য। বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে অঝোরে রক্ত ঝরেছে ফুলির শরীর থেকে।ধাই ফুলমতী ফুলির প্রসব করালেও প্রসব সম্পন্ন হয় নি।ফুলির পাগলের মতো অবস্থা।ডাকা হল ডমরু ওঝাকে।ফুলিদের অগাধ বিশ্বাস ওঝার ওপর।কিন্তু তা যে সম্পুর্ণ কুসংস্কার। ফলে ফুলি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।এখানে যে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভাব তা জয়া গোয়ালা চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন।
তারপর উন্মোচিত হল ধাই ফুলমতির ডাইনি হবার গল্প।ওঝার এত সব ঝাড়ফুঁক, তন্ত্রমন্ত্র তো বিফলে যাবার কথা নয়,তাহলে হলটা কী? তবে ধাই- এরই কীর্তি। এই ধাই আস্তএকটা ডাইনি।কিন্তু নিরক্ষর ডমরু কিছুতেই বিশ্বাস করে না ফুলমতী ডাইনী।তার শুধু মনে পড়ে আতুড় ঘরে ফুলিকে প্রাণ ঢেলে সেবা করেছিল ফুলমতী।'তবু মাদল বাজে'এই প্রান্তিক মানুষদের সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এক জেহাদ।
দিপালী ভট্টাচার্যের 'বিদগ্ধা ধরিত্রী' উপন্যাসটি প্রকৃতপক্ষে আপামর পুরুষকুলের বিরুদ্ধে। তিনি লিখেছেন-' আমার ঠাকুমাকে আমার দাদু পাঁচকুড়ি পাঁচটাকা দিয়ে এনেছিল।ঠাকুরমার মুখেই শুনেছি এই কথা।যার যত কন্যা সন্তান থাকবে, সে তত বড় ব্যবসায়ী।আজকাল যুগ পাল্টেছে। এখন রাজকন্যার সঙ্গে অর্ধেক রাজত্ব। এ কোন ব্যবস্যা।পুত্র বিক্রয় না ব্যবসায় মালিক বদল। স্বামীর ক্ষুধা মেটানোই তাদের জীবনের উদ্দেশ্য।
পুরুষ - মানুষের অনেক রূপ। সে কখনো স্বামী, কখনো পুত্র, কখনো পিতা, কখনো বন্ধু।তবে যাই হোক না কেন প্রকৃত পক্ষে পুরুষজাতি নারীকে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থে। সে রাজা থেকে শুরু করে সবাই।সত্যি কথা হল আমাদের সমাজের নিম্ন মানসিকতা, শিক্ষার অভাব প্রতিটি পরিবারের প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে সঞ্চারিত। প্রকৃত পক্ষে উপন্যাসটি আপামর পুরুষকুলের বিরুদ্ধে। উপন্যাসের কাহিনি শুরু হয়েছে দেশভাগের ফলে নারীদের অসহায়তা নিয়ে।সুরেশ্বর, সৌদামিনী ও কৌমুদিনীর একদিকে দেশ হারা অপরদিকে শেকড় ছেঁড়ার বেদনা,অসহায়ত্ব তাকে পশুতে পরিণত করে।এর মধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠা দাম্ভিক পৌরুষত্ব।ভারতী নাম্নী নামে এক সাধারণ মেয়ে আর পাঁচজন নারীর মতোই স্বামীর অবহেলা ও অত্যাচারে ওষ্ঠাগত প্রাণ। স্বামী নামক ব্যক্তিটির কাছে সে চিরকাল অবহেলিত। উপন্যাসিকের উদ্দেশ্যই হল মেয়েদের অসহায়ত্ব বর্ণনা করা।
'যোগ্য কন্যা' মঞ্জুরাণী বিশ্বাসের লেখা এক অভিনব উপন্যাস। কাহিনির শুরুতেই আমরা দেখতে পাই কমলনাথ ও কাকলি বাড়ৈ- এর সন্তান হিসেবে এক কন্যা সন্তানের জন্ম হল। প্রত্যেক পরিবারের চির কাঙ্ক্ষিত পুত্র সন্তান কিন্তু কমল ও কাকলী তাদের কন্যা অর্পিতাকে নিয়েই সুখী। ক্রমে অর্পিতার বুদ্ধির বিকাশ ও প্রতিভার স্ফূরণ ও চিন্তাশীলতার ছাপ লক্ষ্য করা গেল। অর্পিতা এন সি সি করত।সে জানে এন সি সি করা মেয়েরা নির্ভীক হয়।আর শারীরিক গঠন হয় অটুট। এন সি সি করা মেয়ের উপর কোন পুরুষ অত্যাচারের কথা ভাবতেই পারে না। দশম,দ্বাদশ পাশ করে এম বি বি পড়ে চাকরি পায়।ফলে সে বিয়ে করে মৃণাল নামে এক যুবককে।বিয়ের সময় সে শর্ত রাখে যেগুলো পুরুষতন্ত্রকে সরাসরি নাকিচ করেছে সমাজের প্রতিভূ রূপে।
অর্পিতা সম্পূর্ণ উপন্যাস জুড়ে নারী স্বাধীনতার বীজ বহন করেছে। প্রথাগত হিন্দু ধর্মের কৌলিণ্য প্রথার বিরুদ্ধে সে সোচ্চার হয়ে নিজ শর্তে বিবাহ করেছে। অর্পিতা ও মৃণাল আর পাঁচটা দম্পতির মতো একঘেয়ে জীবনযাপন করেনি।তারা নিজেদের আত্মনিয়োজিত করেছে সমাজের নানা কাজে।অর্পিতা ও মৃণালের সুখী সংসারে কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।এই আনন্দকে তারা খুশির উৎসবে পরিনত করে।সমগ্র উপন্যাসটিতে রয়েছে নারীমুক্তির বীজ।মেয়েদের রক্ষা করার জন্য অর্পিতা একটি সামাজিক সংস্থা গঠন করে।নারী নির্যাতন, ধর্ষণ এবং গার্হস্থ হিংসার বিরুদ্ধে। তাদের কাজ বিভিন্ন ঘটনা পুলিশের গোচরে নিয়ে আসা।পূজা সেন হত্যা মামলা,রেবা দাশের ওপর ঘটে যাওয়া ধর্ষণ এর মতো ঘটনাকে পুলিশের প্রত্যক্ষ গোচরে আনে।শুধু তাই নয় নারীর ওপর ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অত্যাচারের বিরুদ্ধে মৌন মিছিলের মাধ্যমে সমাজে প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় অর্পিতার নেতৃত্বে।
স্বল্পায়তন এই উপন্যাসটিতে লেখক সুকৌশলে নারীবাদী ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন।আজও রাষ্ট্রে,সমাজে,পরিবারে ও ঘরে নারীরা যে কত অবহেলিত ও অত্যাচারিত তার অবস্থা এবং তা থেকে উত্তরণের প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে এই উপন্যাসে।নারীর কলমে নারীর সামাজিক অবস্থানের নিখুঁত প্রতিবিম্ব প্রস্ফুটিত হয়েছে আলোচ্য আখ্যানে।মল্লিকা সেনগুপ্ত, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, বাণী বসুর মতো মহিলা কথাকারদের মতো মঞ্জুরাণী বিশ্বাস- এর উপন্যাসেও ফুটে ওঠেছে নারীদের মুক্তির প্রয়াস, তাদের ক্ষমতায়ন এবং স্বাধিকার অর্জনের লড়াই। ত্রিপুরার বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে মহিলা কথাকার হিসেবে তার অভিনবত্ব ও স্বাতন্ত্র্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
টগর ভট্টাচার্যের 'খোলা জানালায়' আখানে প্রধানত নারী জীবনের নানা সামাজিক সমস্যা ও নারীর জন্মগত কিছু ত্রুটির কথা তোলে ধরা হয়েছে।একজন নারী তার পারিবারিক, সামাজিক এবং শারিরীক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে কীভাবে জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়েছে তাই উপন্যাসে ফুটে ওঠেছে। মা হারা অরুণিমা সংসারে তিন ভাই আর বাবা থাকলেও সকলের উদাসীনতায় সে ছোটোবেলা থেকেই নিঃসঙ্গ।এক নিঃসন্তান মাসীর তত্ত্বাবধানে সে বড় হয়।অনাদর অবহেলায় সে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞ হতে থাকে।সে বুঝে নেয় বেঁচে থাকতে হলে স্বাবলম্বী হতে হবে,নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।স্বাধীনচেতা অরুণিমা প্রতিষ্ঠিত বাড়ির ছেলে দীপ্তনুর সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক থাকলেও সে কখনো দীপ্তনুর উপর নির্ভর করে বাঁচতে চায় নি।অরুণিমার জীবনে অনেক সমস্যা এসেছে, এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য সে অন্যের সাহায্যও পেয়েছে।একটা সময় সে কলকাতায় ত্রিপুরা ভবনে ক্লার্ক কাম রিসেপশনিস্ট এর চাকরি পায়।কর্ম জীবনে অরুণিমা একটি হোস্টেলে ছিল।সেখানের জীবনও ছিল দুর্বিষহ। হোস্টেলে ভিন্ন ভিন্ন পেশায় নারীদের সঙ্গে অবস্থানকালে তাকে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে।একাধিকবার মুখোমুখি হতে হয়েছে অশ্লীল মন্তব্য ও ইঙ্গিতের। কখনো আবার পুরুষের লোভ লালসায়ও নিগৃহীত হতে হয়েছে।প্রতি পদে পদে হোঁচট খেয়েও সে পথ চলা বন্ধ করেনি।এমনকি উচ্চপদস্থ ডাক্তারের আহবানে সারা দেয়নি অরুণিমা।সে ব্যক্তিত্বময়ী,স্বতন্ত্র। দীপ্তনুর জন্য সে ভালোবাসাকে পোষে রাখে অন্তরে।
তবে অরুণিমার কিছু শারিরীক ত্রুটি ছিল যার জন্য সে মা হবার সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত ছিল।ডা মিত্রের কাছ থেকে নিজের শারিরীক অক্ষমতার কথা জেনেও নিজেকে শক্ত রাখতে চেষ্টা করেছে।নিজের অসহায়তার জন্য অন্যের দেওয়া সুযোগের অসৎ ব্যবহার জরে সে প্রতিষ্ঠিত হতে চায় নি।গ্রহণ করেনি ডা মিত্রের দেওয়া বিবাহের প্রস্তাব। পাশাপাশি দীপ্তনুকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসলেও পিতা হবার সুখ দিতে অক্ষম বকে তাকে বিবাহ না করার সীদ্ধান্ত নেয়।সমগ্র উপন্যাসে অরুণিমাকে কোথাও অন্যের ওপরে নির্ভরশীল হতে দেখা যায় নি।নিজের সচেতনতাই অরুণিমাকে জীবনের সঠিক পথ বেছে নিতে সাহায্য করেছে।
উপন্যাসটি পাঠ করতে গিয়ে বার বার সুচিত্রা ভট্টাচার্যের 'আমি রাইকিশোরী' উপন্যাসটির প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠেছে। দুটি উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র নারী।দুটি উপন্যাসের মধ্যেই রয়েছে নারীর একক পথ চলা,তার উত্তরণের কাহিনি। অন্দরমহলের সকল সংস্কারের বাধা অতিক্রম করে রাইকিশোরী পেয়েছিল তার আত্মোপলব্ধির নিজস্ব জমি।অরুণিমাও নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিল।দুজনেই ঘটনাক্রমে পুরুষের লালসার শিকার হলেও দুজনেই সততা আর প্রচেষ্টার জোরে নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছিল।এখানেই উপন্যাসিকের সার্থকতা।

আসলে আগুনের ডালপালারা তো পুড়তে চায়। পোড়াতে চায় না।তারা পুড়তেই চায়।সারাজীবন পুড়তে পুড়তে তাদের গভীর থেকে ওঠে আসে একধরনের দীর্ঘশ্বাস।একধরনের প্রলম্বিত দীর্ঘশ্বাস।যে দীর্ঘশ্বাসের কথা সমাজের কার্পেটের নীচে,সমাজের জুতোর তলায় সমাজের টেবিলের নীচে একটু একটু করে চাপা পড়ে যায়। নারীর সৌন্দর্য, আসলে নারীর সৌন্দর্যে পুরুষ আপাত মুগ্ধ থাকে কিন্তু নারীর যে বিদ্যাবত্তা, যে সারস্বত চেতনা সেইটাকে কিন্তু অন্যভাবে বাঁচতে দিতে হয়। মানে যে গান গায়,পড়ে,যে লেখা,ছবি আঁকে,সিনেমা বানায়,নাটক লিখে,নাটক পরিচালনা করে,নাটক বানায়,যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে কথা বলে এদের কথা কিন্তু সবার আগে আসা উচিৎ। যে গ্রামের মেয়ে ফসল ফলায়,যে কিষাণী ফসল ফলান।একা কৃষক ফসল ফলান না,কিশানীও ফসল ফলান।তিনি জমিকে উর্বর করতে চান।শ্রমিক মহল্লায় যারা নারী কর্মী তারা দায়বদ্ধভাবে শুধু স্বামীটিকেই আড়াল করেন না,ঘরের মধ্যে যাতে পরিচালন ব্যবস্থা ঠিক থাকে,সেই নিয়েও তার মাথা ব্যথার অন্ত নেই।নারী তার দায়িত্ব পালন করেও নিজের গায়ের যে আগুনের যে শুদ্ধতা সেই শুদ্ধতা,সেই শুদ্ধতাকে ঘিরে যে সারস্বত চেতনা,সেই চেতনাকে থেকে তিনি সমাজকে শুদ্ধ করতে চান করতে করতে নিজে জ্বলে যান নীরবে, নিভৃতে,একা।তার খবর কেউ রাখে না,রাখতে চায় না।দু'একজন সংবেদনশীল মানুষ হয়তো মনে করেন যে নারীর এই কষ্ট, এই যাতনা পাওয়া উচিৎ।

আখ্যানের বেশ কয়েকটি শব্দের উচ্চারণ আমরা করলাম।ত্রিপুরার নারী লেখকরা যে লেখা লিখেছেন, লিখছেন এবং আগামী দিনে লিখবেন তার একটা সংক্ষিপ্ত পুনরুদ্ধার করতে আমরা চেষ্টা করা হল এই গ্রন্থে।এই রূপরেখা সর্বাত্মক সম্পূর্ণ তো নয়ই।কিন্তু তার মধ্যে একটা সম্পূর্ণতার যাত্রা রয়েছে। দীপালি ভট্টাচার্য বা মীনাক্ষী সেন বন্দ্যোপাধ্যায় দুজন দু'প্রান্তের লেখক।তবু তাদের লেখার মধ্যে কোথাও যেন একটা মিল রয়েছে।তাদের যে আখ্যান যাত্রা প্রত্যেকটি আলাদা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আখ্যানযাত্রা বলতে থাকে আমাদের সামনে।আমরা এই আখ্যানগুলোর চরিত্র নির্মাণ করার বলেছি, বলেছি সব চরিত্রদের যাত্রাপথের কথা,বলেছি দীর্ঘ ও সংক্ষিপ্ত মানুষের যাত্রার ফলাফল ও ফসল সংকেত।আমরা জানি নারীই ফসল ফলান এবং তিনি ফসল তোলেন।ফলে এই যে লেখকরা আছেন,সেই নারী লেখকরা তাদের নিজস্ব উচ্চারণে, নিজস্ব মনোভূমির যে শাব্দিক কাঠামো সেইটাকে এক সম্পূর্ণত নতুনতর আঙ্গিকে যা পুরুষরা দেখতে পান না, দেখতে চান না বা দেখাতে চেন না,নারী তার নিজস্ব চোখ দিয়ে সেই ভুবনটিকে বারবার আবিষ্কার করে, ফলে যে আগুনের ডালপালা তৈরি হয়, তার গভীর প্রত্যন্ত যাতনায় যে আগুনের ডালপালা তৈরি হয়,ভয়ানক কষ্ট এবং বিভোর মনস্তাপের মধ্যে সেই আগুনের ডালপালাই চলে যায় সূর্য শিকারে, সূর্য ছিনিয়ে আনতে।আমরা সূর্য শিকার এবং আগুনের ডালপালা দিয়ে শুরু করেছিলাম, এবার শেষ লগ্নে,লেখা যখন অন্তিম চরণে এসে পৌঁছেছে তখন আবারও স্মরণ করি ত্রিপুরার এইসব আখ্যানকারদের যারা তাদের আগুনের ডালপালাকে বিস্তৃত থেকে বিস্তৃততর করে খুঁজে নিতে চেয়েছেন সম্পূর্ণত অন্য এক সূর্য ভুবনকে।সেই সূর্য ভুবনের কথা,সূর্য শিকারের কতা,সূর্য সন্ধানের কথা সূর্য আহবানের কথা আমরা বারবার বলে গেলাম এই নিবন্ধের মধ্য দিয়ে। এই আলোচনা একেবারেই সম্পূর্ণ নয় কিন্তু অসম্পূর্ণতার যেটুকু সেটুকু একেবারে নস্যাৎ করে দেওয়া যায়, বিভিন্ন ধরনের আখ্যান এবং আখ্যান চর্চার মধ্য দিয়ে যাত্রা কীভাবে আমরা করলাম তার ফলাফলে।আমরা আশা করব আগামী দিনে ত্রিপুরায় যারা নারী লেখকরা আছেন, তাঁরা সমানভাবে সমাজের কথা,সমাজের যে বিচ্যুতি এবং অসংগতি, ভাবনার যে বহিঃপ্রকাশে নানারকম যাতনা এবং কষ্টের যে চিত্র সেই চিত্র তারা তাদের অন্দরমহলের ভাষায় নয় বাহির মহলের ভাষাকেও তোলে ধরবেন কেননা নারী আজ শুধুমাত্র সহনশীল বৃক্ষ নন, তিনি আগুনে ডালপালা সহ তার হাত প্রশস্ত প্রসারিত করে খুঁজে দিচ্ছেন সূর্য এবং সূর্যের ভুবন জয় করছেন আকাশ। পূর্ণ আকাশের চিন্তাই নারীকে ঘিরে করা উচিত, নারী সম্পূর্ণ আকাশ,পূর্ণ আকাশ,সেই পূর্ণ আকাশের যে দিগন্ত নিশ্চিত যাপন সেখানেই সূর্য শিকারের জন্য এগিয়ে এসেছেন আগুনের ডালপালারা। আমরা তাকে স্বাগত জানাই।