Next
Previous
Showing posts with label প্রচ্ছদ নিবন্ধ. Show all posts
0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in







আমাদের দেশের যে রাজ্যটি আয়তনের দিক থেকে বৃহত্তম তার নাম ‘রাজস্থান’। আর, এই রাজস্থানের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর হল ‘জয়পুর’। জয়পুরকে আমরা ডাকি ‘পিঙ্ক সিটি' বা ‘গোলাপী শহর’ বলে। কেন? ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় যে, ১৮৭৬ সালে প্রিন্স অফ ওয়েলস এবং মহারাণী ভিক্টোরিয়ার আগমন উপলক্ষ্যে গোটা জয়পুর শহরকে ও সেখানকার বেশিরভাগ ভবন বা ইমারতগুলোকে আতিথেয়তার রং গোলাপীতে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন সেখানকার মহারাজ রাম সিং। লর্ড অ্যালবার্ট প্রথমবারের মতো জয়পুরকে ‘পিঙ্ক সিটি’ বা ‘গোলাপি শহর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। সেই থেকে জয়পুর আমাদের কাছে ‘গোলাপী শহর’ হিসেবে পরিচিত। বলা হয়, আজও এই গোলাপী ঐতিহ্যকে বজায় রাখা হয়েছে। পুরনো জয়পুরের সমস্ত বাড়ির রং আজও গোলাপী রঙের এবং নগরবাসীও আইনতভাবে এই গোলাপী রং করতে বাধ্য হয়। সে যাই হোক, এক ‘গোলাপী শহর’ যে আমাদের দেশে রয়েছে তা নিয়ে আমরা সবাই বেশ গর্বই অনুভব করে থাকি। কিন্তু, বহুদূরের দেশের একেবারে পশ্চিম প্রান্তের এই গোলাপী শহরকে কেন্দ্র করে দেশের প্রায় পূর্ব প্রান্তের বিশেষত আমাদের বাঙালিদের গর্বের পরিমাণটা বেশি থাকা উচিত। কেননা, এই জয়পুর শহরের স্থাপত্যনকশা করেছিলেন যে একজন বাংলার মানুষ তথা বাঙালি— বিদ্যাধর ভট্টাচার্য।

বিধাতা ভট্টাচার্য ১৭শ শতাব্দীর শেষভাগে ১৬৯৩ সালে এই বাংলার নৈহাটিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সন্তোষরাম ভট্টাচার্য। বিদ্যাধর ভট্টাচার্য সম্পর্কে জানা যায় যে, তিনি গণিত, জ্যোতিষ (তখন জ্যোতির্বিদ্যাকেও জ্যোতিষ বলা হত), পূর্তবিদ্যা এবং রাজনীতিতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তিনি সদূর রাজস্থানের আম্বার বা আমের শহরে কনিষ্ঠ নিরীক্ষক হিসেবে কাজ পেয়েছিলেন। আর এই আম্বারে কাজ করার সময়ে তিনি প্রথম জয়পুরের মহারাজের সংস্পর্শে আসেন। মহারাজা সাওয়াই (বা সোয়াই) জয় সিং (দ্বিতীয়) বিদ্যাধরকে তাঁর নানা গুণের পরিচয়লাভ করে মন্ত্রীপদে নিযুক্ত করেন। জানা যায় যে, বিদ্যাধর রাজসভায় কোষাধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করতেন। তা একসময় মরুর শহর অম্বরে জলের সঙ্কট দেখা দেয় আর তার সাথে গোদের ওপর বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দেয় জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যা। এরফলে, মহারাজা ঠিক করলেন যে তাঁর রাজধানী স্থানান্তরিত করা হবে অম্বর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে যে এখনকার জয়পুরে। মহারাজা বিদ্যাধরের বাস্তু ও পূর্তবিদ্যার পারদর্শীতার ব্যাপারে জেনে জয়পুর শহর নির্মাণের জন্য অনুরোধ করেন। এই জয়পুর শহরই দেশের প্রাচীনতম শহরগুলোর মধ্যে একটি এবং এর পাশাপাশি এই শহর দেশের প্রথম পরিকল্পিত শহর। প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সাহিত্য, জ্যোতির্বিদ্যা, বাস্তুবিজ্ঞান এমনকি বিদেশি গণিতজ্ঞ টলেমি ও ইউক্লিডের লেখা গাণিতিক বইগুলোর ব্যাপারে বিস্তর জ্ঞান রাখতেন বিদ্যাধর। সেখান থেকে উল্লেখিত জ্ঞান ও শহর গড়ার ব্যাপারে নানান পরিকল্পনা নিয়ে মহারাজা সাওয়াই জয় সিং (দ্বিতীয়)- এর সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেন। ১৭২৭ সালে, প্রযুক্তি ও কৌশলগত পরিকল্পনার সাথে জয়পুর শহরটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। শহরটির প্রধান প্রাসাদ ও রাস্তাঘাট সম্পূর্ণ করতে চার বছর সময় লেগে গিয়েছিল। পুরো শহরটাই নির্মিত হয়েছিল ভারতীয় শিল্পকলার শিল্পশাস্ত্রের রীতি-নীতি মেনে চলে। শহরের মডেল তৈরি করার জন্য তিনি শিল্পশাস্ত্র ও বাস্তুশাস্ত্রের বিভিন্ন নীতি প্রয়োগ করেন। পৃথিবীর বৃহত্তম মানমন্দির এবং নগর প্রাসাদ নির্মাণ করার ক্ষেত্রে তিনি তাঁর সমস্ত স্থাপত্যবিদ্যার জ্ঞান প্রয়োগ করেন। ভারতে কর্মরত একজন সুপরিচিত প্রকৌশলী এবং স্থপতি স্যার স্যামুয়েল স্নিন্টন জ্যাকব-এর সাথে তাঁকেও জয়পুরের সিটি প্যালেসের স্থপতি হিসেবে গণ্য করা হয়। জয়পুর শহর তৈরির পাশাপাশি কোনও শহরের ক্ষেত্রে যা অপরিহার্য হয়ে ওঠে অর্থাৎ নিরাপত্তার ব্যাপারে মহারাজা জয় সিং বড়োই উদ্বিগ্ন ছিলেন। বিদ্যাধরের পরামর্শ মতো তিনি একটি নব্য বা কল্পিত শহর নির্মাণ করেছিলেন কিন্তু বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা শহরের নিরাপত্তার দিকটিও ভাবা হয়। কেননা, তখন বৈদেশিক ও দেশীয় অন্যান্য প্রদেশ থেকে হামলার সম্ভাবনা থাকত। তাই, শহরের নিরাপত্তার জন্যে দৃঢ় স্থাপত্য স্থাপন করা হয়েছিল। আর, এর পাশাপাশি দৃঢ় সাতটি দরজাযুক্ত বিশাল দুর্গ প্রাচীরও বানানো হয়েছিল। আজ এই আধুনিক যুগে দেশের আন্তর্জাতিক বর্ডারও বেশ কিছু অংশে তেমন দৃঢ় নয় কিন্তু সে যুগে একটা শহর গড়ে তোলার জন্য কত কিছু ভাবা হয়েছিল। তা মোটামুটি ভাবে ১৭৩১ কি ১৭৩২ সালে শেষ হয় সহ নির্মাণের কাজ। গোটা জয়পুর শহরকে সৌরমণ্ডলের নয়টি গ্রহের প্রতীক হিসেবে নয়টি বর্গক্ষেত্রে ভাগ করা হয়। যার মধ্যে দুটি ভাগ থাকে রাজা ও রাজকীয় কাজকর্মের জন্যে আর বাকি সাতটি ভাগ থাকে স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্যে। মহারাজ দ্বিতীয় জয় সিংয়ের নামেই শহরের নামকরণ হয় জয়পুর। তাঁর এই নতুন রাজধানী জয়পুর নকশাকার বিদ্যাধরের হাত ধরে হয়ে উঠল যেন স্থাপত্য, বিজ্ঞান ও সৌন্দর্যের মিশ্রণ।

বিদ্যাধর ভট্টাচার্যের প্রস্তুত করা নকশা থেকেই জয়পুর শহর নির্মাণ করা হয়। এই মহান স্থাপত্যবিদ জয়পুর শহরের চেহারা বদলে দিয়েছিলেন। সেই যুগে, জয়পুরে স্থাপত্য ছিল অত্যন্ত উন্নত, বিজ্ঞানসম্মত ও তার স্থাপত্যশৈলী ছিল গোটা দেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম। ১৭৫১ সালে ৫৮ বছর বয়সে মারা গেলেও, এই বাঙালি স্থাপত্যবিদকে জয়পুর তো বটেই এমনকি গোটা উপমহাদেশ মনে রেখেছে ‘শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী স্থপতি’ হিসেবে। স্থাপত্যের ক্ষেত্রে দেশীয় ও প্রথাগত পদ্ধতি এবং উপকরণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিদ্যাধর অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। রাজস্থানের জয়পুর শহরের স্থাপত্যের পাশাপাশি দেশের আধুনিক স্থাপত্যের প্রবর্তক হিসেবে তিনি সুপরিচিত হয়ে আছেন। বাংলার মানুষ তাদের এই প্রধান স্থপতি, গণিতজ্ঞ, বাস্তুশাস্ত্রী ও নগর পরিকল্পনাবিদকে একপ্রকার ভুলে গেলেও বা তাঁকে নিয়ে বিশেষ কোনও কিছু না বানালেও জয়পুর তথা রাজস্থানের সংরক্ষিত সেরা বাগানগুলোর মধ্যে একটি হল ‘বিদ্যাধর বাগান’ যা শহরের স্থপতিকারের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১৯৮৮ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল। জয়পুর শহরের গর্ব এই বাগানটি জয়পুরের ৮ কিলোমিটার পূর্বে জয়পুর-আগ্রা সড়কে অবস্থিত। প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্য সম্পর্কিত ‘শিল্প শাস্ত্র’ নামক গ্রন্থসমূহ বিদ্যাধর ব্যবহার করেছিলেন জয়পুর শহরের পরিকল্পনাকালে। সেই গ্রন্থসমূহ দ্বারাই বাগানটি নির্মাণ করা হয়। মনে করা হয় যে, সেসোদিয়া উদ্যানের আশেপাশে অবস্থিত ছিল বাগানের একটি দ্রাক্ষাক্ষেত্র বা আঙুরের ক্ষেত।

নৈহাটি অনেক কৃতি মানুষকে উপহার দিয়েছে যাঁদের মধ্যে আমাদের আলোচ্য দেশের অন্যতম কৃতি স্থাপত্যবিদ ও রাজস্থানের 'গোলাপী শহর' জয়পুরের নকশাকার বিদ্যাধর ভট্টাচার্য তো আছেনই আর আছেন দেশের স্বাধীনতা লড়াইয়ের মূলমন্ত্র ‘বন্দে মাতরম্'-এর রচয়িতা, বাংলার নবজাগরনের অন্যতম রূপকার, কিংবদন্তি উপন্যাসিক, গল্পকার তথা সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক, ভারততত্ত্ববিদ,চর্যাপদের পুঁথি আবিষ্কর্তা, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচয়িতা পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক সমরেশ বসু, জনপ্রিয় গায়ক শ্যামল মিত্র, বাংলায় ব্রাহ্ম আন্দোলনের তো বটেই এমনকি বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা কেশবচন্দ্র সেন।
0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in







এই আন্তর্জাতিক মানবতার যুগে দাঁড়িয়ে কোনও জাতিগত গৌরবের কথা বলাটা একটু কম আধুনিক। তবু হালখাতা প্রসঙ্গে যে কটা কথা বলতেই হয়, তার মধ্যে বাঙালীর কিছু গৌরবের ইতিহাস লুকিয়ে আছে। ইতিহাস জানে, কতটা পথ চললে কোনও জাতি তার সংকীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক চেতনায় পৌঁছতে পারে। হালখাতা উৎসব আদতে বাঙালীর নিজস্ব একটি পালন। যেকালে সাধারণ মানুষ তার জমিতে ফসল ফলিয়ে খাজনা দিতে যেত জমিদারকে, সম্বৎসরের দেয় খাজনা মিটিয়ে জমিদার বা ছোটখাট রাজার বাড়িতে বসে নিমন্ত্রন খেয়ে আসত, পরনে থাকত ভালো জামা, সেইকাল থেকে হালখাতার শুরু। এখন সেই বিশেষ দিনটি কিভাবে চিহ্নিত করি?

ইতিহাস বলছে গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক ৫৯৪ খৃষ্টাব্দের ১২ই এপ্রিল, সোমবার, প্রথম বৈশাখ বঙ্গাব্দের সুচনা করেন (বঙ্গাব্দের উৎস কথা - শ্রী সুনীল কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)। আমরা জানি শশাঙ্কপূর্ববর্তী সময়ে গৌড়ের তেমন কোনও ইতিহাস নেই। শশাঙ্কই প্রথম, যিনি গৌড়কে, তথা তাবৎ বাঙালীকে মর্যাদা দিলেন। সেসময় ভারতে নানা সনের প্রচলন ছিল। শকাব্দ, বিক্রম সংবৎ, ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রান্তরাজ্য গৌড়ও নিশ্চয় এমনই কোনও সন তারিখ মেনে ব্যবসাসংক্রান্ত কাজকর্মগুলো করত। শশাঙ্ক প্রথম গৌড়ের জন্য একটি পৃথক বঙ্গাব্দ প্রচলন করলেন। কিন্তু সংশয় তো জাগেই! বঙ্গাব্দ প্রবর্তন করলেও, এর আগে যে বাংলায় মাসের নাম প্রচলিত ছিলনা তা মনে করা হয়না। যাই হোক, বৈশাখের পয়লা তারিখ শুরু হয় নতুন বছরের। এরপর বৌদ্ধ রাজাদের সময় শশাঙ্কের এই সনের হিসেব যায় হারিয়ে। পালরাজাদের নতুন হিসেবে বঙ্গাব্দের প্রচলন দেখতে পাইনা। যদিও লক্ষনাব্দ শুরু হয়েছিল, তবু অনেকেই মনে করেন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ আবার বঙ্গাব্দ ফিরিয়ে আনেন। তাঁর মৃত্যুর একশো বছর পরে সম্রাট আকবর ৯৯২ হিজরীতে, ইংরাজি ১৫৮৪ সালে আবার বঙ্গাব্দ ফিরিয়ে আনেন। যদিও কর্ণসুবর্ণে শশাঙ্কর রাজধানীপ্রতিষ্ঠার দিনটি এই বছর শুরুর দিন বলে যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন তবু ধারাবাহিকভাবে বঙ্গাব্দ সেই সময় থেকে প্রচলিত হতে পারেনি। ছেদ অবশ্যই পড়েছিল।

এসব তো হোল আমাদের বাংলা বছরের শুরুর ইতিহাস। যা নিয়ে পণ্ডিতমহলে বিস্তর মতের অমিল আছে। কিন্তু হালখাতা নিয়ে আমরা নিঃসন্দেহ। আগেকার দিনে চাষাভুষো মানুষ তাদের জমিদারের খাজনা মেটাত চৈত্রের শেষে। আর তাই জমিদার বাড়িতে পাত পেড়ে খাওয়ার নিমন্ত্রণ পেত। জমিদার বাড়ি বলে কথা। যেটুকু ভালো কাপড়চোপড় থাকত তাইই পরে যেত তারা। নেমন্তন্নয় যেত পুরুষ ও বাচ্চারা। বাড়ির মেয়েরা নয়। এরপর জমিদারি গেলো বণিকের হাতে। বেণের পো জমিদারের চেয়ে বুদ্ধি ধরে বেশি। তারা খাতকদের যা ধারকজ্জ দিতো সেসব উশুল করত সারাবছর ধরেই। যে ধার রয়ে যেত, জমিদারের দেখাদেখি সেটুকু উদ্ধারের জন্য তারা প্রচলন করল হালখাতার। অর্থাৎ, সারাবছর যে দেনদার ধারে মালপত্র নেবে, বছর শুরুর এই দিনে সে গত বছরের সব দেনা সুদে আসলে মিটিয়ে দেবে।

এই প্রথা আমরা বাল্যেও দেখেছি। আমাদের ছোটবেলায়, দোকানে ধার থাকুক বা না থাকুক, পয়লা বৈশাখ, কিংবা অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে নির্দিষ্ট দোকানে গিয়ে আমরা ক্যালেন্ডার ও মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আসতাম। সেসব নেহাতই ছোটখাট দোকান। আমাদের পাড়ার বইখাতার দোকান বা ষ্টেশনারী, মুদিখানা পর্যন্ত গতি। এছাড়া কাপড়ের দোকান বা সোনার দোকানে গতি ছিল বাবার। সেখান থেকে বচ্ছরকার দিনে মায়ের একটা শাড়ি বা ছোট দুল আসত মিষ্টির প্যাকেটের সঙ্গে। আমরা অবাক হতাম। কই, আমাদের তো নতুন একটা বইও দিলনা পরিমলকাকু? মা বলেছিল, ওটা কথা নয়। কথা হোল, বাবা আগের বছরের খাতা বন্ধ করে নতুন খাতা খুলে এসেছে। সেখানে বাবার নামে আবার এই বছরের হিসেব শুরু হবে। এই যে বাবা সোনার দুল কিনে আনল, এতে সোনার দোকানের মালিক, সুবোধকাকুর ভালো হবে। ব্যবসায়ে উন্নতি হবে। আর তাই, খুশি হয়ে দোকানের মালিক বাবাকে মজুরীতে ছাড় দেবে। নতুন কাপড়েও ছাড় দেয়।

এই ব্যবসাপদ্ধতি এখন অবশ্য সারাবছর জুড়ে চলছে। নতুন বছরের শুরুতে লাল শালুতে মোড়া লম্বা হিসেবের খাতার প্রথম পাতায় সিঁদুরে ডোবানো কয়েনের ছাপ দিয়ে সিদ্ধিদাতা গনেশ ও মা লক্ষ্মীকে স্মরণ করে সেই যে হালখাতার উৎসব, সেসব এখন খানিক রঙ হারিয়েছে। আছে এখনও, মিষ্টির বদলে কেউ কেউ বিরিয়ানির প্যাকেটও দেন দেখতে পাই, কিন্তু সেভাবে আর নেই। এখন সাধারণ মধ্যবিত্ত ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন। দোকানে গিয়ে ধার করেননা। কার্ডের মাধ্যমে ধার হয় সরাসরি ব্যাংকে। দোকানদার আর ক্রেতার মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে ব্যাংক। ফলে যে ছাড় ক্রেতা পেতেন সেই লাভের অংশ, কি তার চেয়েও বেশি, ঢোকে ব্যাংকে। ক্রেতা বুঝতেই পারেননা আসলে জিনিসটার লিখিত দামের চেয়েও বেশি মূল্যে তিনি কিনছেন। একটা দেখনদারিতে ঠেকেছে আমাদের কেনাকাটা থুড়ি শপিং। আমরা মোবাইল খুললেই দেখতে পাই শপিংমলে সেল চলছে। অনলাইন পোর্টালে সেল চলছে। কোথাও বিশেষ বিশেষ উৎসবের মরশুমে। কোথাও সপ্তাহান্তিক সেল। বাই টু গেট ওয়ান ফ্রির ছড়াছড়ি। সাবেক পাড়ার দোকানী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে আছেন। তাঁর দোকানে অমন চাকচিক্য কই? চীনে জিনিসের মতন অমন রঙিন অথচ পলকা বস্তুতে বাজিমাত করার শিক্ষা তো তাঁর নেই। তিনি তো জানেন অটুট মজবুত জিনিসের বেচাকেনা। অটুট সম্পর্কের মতোই। যা ইউজ এন্ড থ্রো’র যুগে অচল। তাঁর তো ধরা খদ্দের! এ পাড়ার হলদে তেতলা বাড়ি থেকে শুরু করে ও পাড়ার সবুজ একতলা পর্যন্ত। তিনি তো জানেন কোন বাড়ির লোকেরা কোন কোন জিনিস নেন। সেইমত মালপত্র তোলেন। হঠাৎ পরিবর্তনে তিনিও দিশেহারা। তাঁর ছেলেরা হয় অন্য কাজে যুক্ত, দোকান ধুঁকছে, নয়ত এই দোকানকে আধুনিক করে তুলতে বদ্ধপরিকর। তাঁর যুক্তি খাটেনা। ক্রমে আমাদের একান্ত নিজস্ব সৌহার্দ্যের উৎসবরীতি পর্যবসিত হয়েছে বছরজোড়া কেনাকাটায়। তার স্বাদ হারিয়েছে অসময়ের ফলের মতো। হালখাতার যে ভিত্তি, পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা, সেটির আর প্রয়োজন নেই এখন। মানুষের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছাড়াও যে ব্যক্তিগত সৌহার্দ্যের সম্পর্ক ছিল সেটি এখন অনুপস্থিত।

একান্ত বাঙালী এই উৎসবরীতি কিভাবে স্বর্গে পৌঁছেছে তাই নিয়ে খুব ভাবি। যমের রাজ্যে চিত্রগুপ্ত কেরানি। কেমন করে তিনি আমাদের কৃতকর্মের হিসেব রাখেন? যেমন দেখেছি আশৈশব, তেমনই একটা লাল খাতা কি তাঁর হিসেবের খাতা? কিন্তু অনন্ত কালের অসংখ্য মানুষের কর্মফলের হিসেব রাখা তো চাট্টিখানি কথা নয়! গল্পকথা, কিন্তু তার শেকড় জল মাটি পায় বাস্তব থেকেই। নিশ্চয় চিত্রগুপ্ত বাঙালী। তাঁর শিক্ষাদীক্ষা বাংলায়। নইলে এই বুদ্ধি তাঁর মাথায় আসলো কি করে?

আমজনতা তাহলে এইসব ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের বাইরে? প্রশ্ন থেকে যায়। লাল শালুতে মোড়া একটা হিসেবের খাতা আমরা কি নিজেরাও রেখে দিইনা? সেখানে শুরু থেকে লিখতে থাকি নানা দেনাপাওনার কথা? সেসব দেনাপাওনা অবিশ্যি স্থুল চোখে তেমন ধরা পরেনা। কখনও কখনও মনের সিন্দুকে সেই খাতাটা ধুলো ঝেড়ে উঠতে চায়। আমরা গোপনে খুলি। হিসেব মেলাতে হবে। কাকে দিতে হবে ছাড়? যে অনুজ তার বাল্যে আমাকে না জেনে আঘাত দিয়েছে, ছাড় তার প্রাপ্য। যে অগ্রজ আমাকে জীবনের পাঠ দিতে গিয়ে অকারণ নিষ্ঠুর হয়েছে, তাকে ছাড়। না, সুদ কেন, আসলটুকুও ছেড়ে দিতে হবে। হিসেব মিলবেনা নইলে। আমারও যে দেনা মেটাবার থাকে! কিন্তু পাওনাদার হয়ত তার লাল খাতাখানা হারিয়ে ফেলেছে। কিংবা হয়ত না ফেরার দেশে সেখানা আর বয়ে নিয়ে যায়নি। তাই আমিও চেষ্টা করি।

[যুগশঙ্খ নববর্ষ ক্রোড়পত্র ২০১৯]
0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in






মানুষ মাত্রেই শিকড় খোঁজে । যেহেতু সে উদ্ভিদ নয় তাই তার মূল এক ক্ষেত্রে প্রোথিত থাকেনা । খাদ্যের খোঁজে জলের খোঁজে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের খোঁজে সে বারবার বেরিয়ে পড়ে পথে । তাই মূলও সরতে থাকে এক স্থান থেকে আর এক স্থানে । প্রাক ইতিহাস কাল হোল সেই কাল যখন মানুষ অস্থির হয়ে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে বাসভূমির খোঁজে । এই বাহ্যিক খোঁজ কালের নিয়মে কখনও ক্ষান্ত হয় কিছুকাল। তারপর আবার যখন প্রকৃতির খেয়ালে ওলটপালট হয়ে যায় মানব পরিবেশের কিছুদিনের অর্জিত স্থিতি, তখন আবার শুরু হয় পর্যটন। আমরা আলোচনা করি এই স্থিতিকালের মধ্যে মানুষের আভ্যন্তরীণ খোঁজ কতটা গভীরে প্রবেশ করে। পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতার ইতিহাস এই আভ্যন্তরীণ অগ্রগতির ইতিহাস। মানুষ যখন তার বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্ত পুরন করে উঠতে পারে তখনই সে নিজের ভিতরে ডুব দেয়। অবসর ও নিশ্চিন্ত জীবন ছাড়া এই আত্মানুসন্ধান সম্ভব হয়না। আমরা আজ যে ভারতবর্ষে বাস করি, যার ভৌগোলিক সীমা আপাতনির্দিষ্ট একটি রেখায় বাঁধা, প্রাগৈতিহাসিক ভারতবর্ষের রূপটি সেরকম ছিল বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। বরং তার মধ্যে মানব সভ্যতার সেই অস্থিরতার ছাপ সুপরিস্ফুট ছিল। আমাদের এই ভুখন্ডের ইতিহাসে বারবার সীমানার পরিবর্তন হয়েছে। সে তো অবশ্যম্ভাবী! আমরাও তাই নিজেদের পিতৃপুরুষের খোঁজে মাঝে মাঝে অতীত চারন করে থাকি। এইরকমই একটি অনুসন্ধিৎসা বাসা বেঁধেছিল মনে। আর তার খোঁজেই পাওয়া গেল অমূল্য কিছু সম্পর্ক ও প্রজ্ঞার আলোয় উদ্ভাসিত কিছু রচনা। হাতে এসেছিল শ্রদ্ধেয় শ্রীহরপ্রসাদ শাস্ত্রীর রচনাবলী। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেছি আমার এ অনুসন্ধিৎসা তো কোনও হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে ঝলমল করে ওঠা চিত্তের কথা নয়! শাস্ত্রীমশায় তো কবেই এই উৎসের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছেন! পেলাম শ্রীরাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সেই যে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার করে সকলকে তাক লাগিয়ে দেওয়া পণ্ডিত এবং সুরসিক, জ্ঞানী অথচ অগোছালো মানুষটি! এইভাবেই তো তাঁকে বর্ণনা করেছেন সহকর্মী বন্ধু আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়! ছিলেন শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার মশায়ও। বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে এইসব উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক কিন্তু অনেকটাই আলোকিত করেছেন আমাদের পূর্ব ইতিহাস সম্পর্কে। তবে কেন এই রচনা? কারণ নিজের মত করে তাঁদের দেওয়া গভীর তথ্য কতটা হৃদয়ঙ্গম করা গেল তার হিসেব কষব বলে। আপাতত ডুব দেওয়া যাক প্রাক ইতিহাস বঙ্গে। তার আগে শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রদত্ত একটি ভাষণের সংক্ষিপ্তসার দেওয়া যাক। বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের সপ্তম অধিবেশন। স্মৃতিচারণ করছেন শ্রীরাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। মহামহোপাধ্যায় বলছেন “আমার বিশ্বাস বাঙালি একটি আত্মবিস্মৃত জাতি। বাংলার ইতিহাস এখনও এত পরিষ্কার হয় নাই যে কেহ নিশ্চিত করিয়া বলিতে পারেন বাংলা ইজিপ্ট হইতে প্রাচীন অথবা নতুন”। তাঁর অনুমান যে যখন আর্যগন মধ্যএশিয়া থেকে পাঞ্জাবে আসে তখনও বাংলা সভ্য ছিল। তারা যখন এলাহাবাদ পর্যন্ত অগ্রসর হয়, তখন বাংলার সভ্যতায় ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে বাঙালিকে ‘ধর্মজ্ঞানশূন্য’ এবং ‘ভাষাশূন্য’ পক্ষী বলে বর্ণনা করেছে। এই আত্মবিস্মৃতি আমাদের মজ্জায় মজ্জায় বলেই একটি প্রাচীন সমৃদ্ধ জাতি হয়েও নিজেদের ইতিহাস সেভাবে রচনা ও রক্ষায় আমরা ব্রতী হইনি । কিছু বিচ্ছিন্ন চর্চা হয়েছে নিঃসন্দেহে, তবে তা এখনও জনমানসে বঙ্গীয় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারকে থিতু করতে পারেনি । এই বিশ্বাস থেকেই এই রচনার অবতারণা।

বিদেশী ইতিহাসবিদদের দ্বারা প্রচলিত তত্ত্ব অনুসারে খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০/২০০০ নাগাদ ককেশাস পর্বত অতিক্রম করে আদি ইন্দোইউরোপীয়দের একটি দল, যারা ইরানী ও ভারতীয় আর্যদের পূর্বপুরুষ বলে মনে করা হয়, ক্রমে উপস্থিত হয় উত্তর ইরাকে১। এই দলকেই সুনীতিকুমার বলছেন ইন্দোইউরোপীয়গণের আর্য শাখা। তিনি জানিয়েছেন পাঞ্জাবেই এদের বাস বেশি করে ঘটে, কারণ এই অঞ্চল আর্যদের কেন্দ্রস্থানীয় ইরাণের পাশেই অবস্থিত ছিল। তাঁর মতে – ঈরাণ বলিলে পারস্য আফগানিস্তান ও বেলুচিস্তান এই তিনদেশকেই ধরিতে হয়। অতএব পরিষ্কার হয়ে যায় যে পুরুষপুর বা পেশোয়ার, তক্ষশীলা ইত্যাদি ভারতীয় নামের জনপদগুলি তৎকালীন ভারত ভুখন্ডের অবিচ্ছিন্ন অংশ ছিল। যদিও আর্যরা আসলে বাইরে থেকে এই শ্বাপদসঙ্কুল অরন্যে ঢাকা দেশকে সভ্য করেছিল বলে দাবী ওঠে, কিন্তু এইসব টুকরো প্রমাণ দেখে বোঝা যায় বহিরাগত জাতিতত্ত্বটি আসলে আমাদের হীন জাতি প্রমানের মরিয়া চেষ্টা। ইতিহাসবিদ অধাপিকা রোমিলা থাপার এই দায় চাপিয়েছেন মিল প্রমুখ পাশ্চাত্যের ইতিহাসবিদদের ওপর। এঁরা প্রাচ্যভূমিকে সভ্য তকমা দিতে নারাজ। এছাড়াও শ্রীমতী থাপার উনবিংশ শতকের ভারতীয় জনমানসে এদেশের সেই বর্বর চিত্রটি আঁকার দায় তথাকথিত ইভাঞ্জেলিকালদের বলেও দাবী করেছেন। আদতেই তা নয়। অবশ্য আর্যদের পিতৃভূমি হিসেবে কাস্পিয়ান সাগরের উত্তরে ও উরাল পর্বতের দক্ষিণের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডকেই মার্কা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে ওখান থেকেই তাদের যাত্রা শুরু। সে তো মানবসভ্যতা সদা সঞ্চরনশীল! আমরা তাই ধরে নিই যে আর্যরা আমাদের তৎকালীন বাসভূমির উত্তর পশ্চিমের পার্বত্য উষর ভূমি থেকে নেমে এসেছিল শস্যশ্যামল নদীবাহিত উপত্যকা অঞ্চলে, মুলত জল ও খাদ্যের খোঁজে। তারা বহিরাগত নয়, তবে তাদের বাস ছিল সমগ্র মধ্য এশিয়া জুড়ে । কখনও তারা চলে গেছে পূর্ব ইউরোপ ধরে, কখনও নেমে এসেছে এশিয়া ভূমি ধরে। আর তাদের সেই নেমে আসার সময়ে তারা মোটেই সভ্য কোনও জনগোষ্ঠী ছিলনা। যাযাবর জাতি যেমন হয় ঠিক তেমনি মারকুটে হিংস্র স্বভাবের ছিল এরা। তারা তাদের পিতৃভূমি থেকে ঘোড়া এনেছিল। মানব সভ্যতাকে আর্যদের শ্রেষ্ঠ দান হোল বুনো ঘোড়াকে পোষ মানানো। ঘোড়ার অদ্ভুত গতিকে কাজে লাগিয়ে এরা সমৃদ্ধ জনপদে লুঠতরাজ করত, কখনও বা একটি দুটি ঘোড়া সেখানে বিক্রি করে যেত। এভাবেই উত্তরের ঘোড়া দক্ষিণে আসে ও দক্ষিণের গরু উত্তরে আসে। মনে করতে পারি অশ্বমেধ যজ্ঞের কথা। রাজার অশ্ব ছুটে চলবে নিজের রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে। অন্য রাজ্যে যদি সে অবাধ গতি পায় তার অর্থ সে রাজ্য এই রাজার বশ্যতা স্বীকার করেছে। এই অপ্রতিহতগতি অশ্ব আসলে দুর্নিবার আর্য সভ্যতার রূপক। অবশিষ্ট ভারতভূমির অবস্থা তবে কেমন ছিল? আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি যে সিন্ধু সরস্বতী অববাহিকায় তখন এক অতি উচ্চমানের সভ্য মানবজাতির বসবাস ছিল। নাগরিক সভ্যতার চরম উৎকর্ষ ঘটেছিল এদের মধ্যে। সিন্ধু সভ্যতা বৈদিক সভ্যতার চেয়ে বহু প্রাচীন এবং পৃথিবীর অন্যান্য প্রাচীন নদীমাতৃক সভ্যতা, যেমন মিশরে নীলনদের অববাহিকায় গড়ে ওঠা মিশরীয় সভ্যতা, মেসোপটেমিয়ার টাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা সুমেরীয় সভ্যতা, ইত্যাদির সমসাময়িক। সিন্ধু সভ্যতার বিশেষ দিকগুলি নিয়ে আলোচনার পরিসর অন্যত্র খুঁজে নেওয়া যাবে। আপাতত বলি, সেই সময়ে দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক জাতির মানুষ এই ভূখণ্ডের অধিবাসী ছিল। তারাও কোনও না কোনও সময়ে এখানে এসে বাসা বাঁধে। সে তো মানুষ তার উপযোগী বাসভূমি খুঁজেই চলেছে। যেহেতু সেইকাল নিতান্তই প্রাগৈতিহাসিক সেহেতু আমরা ধরে নিতে পারি এই অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীই ভারতবর্ষের আদি বাসিন্দা । অস্ট্রিক জাতির মানুষ মুলত অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী বলেই মান্যতা পেয়েছেন । আর দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর আদি হোল ভুমধ্যসাগরীয় অঞ্চল । এখন এরা যখন বহু আগেই ভারতে নিজেদের আস্তানা বেঁধেছেন তখন ধরেই নেওয়া যায় যে এদের জীবনধারণের প্রাথমিক শর্তাবলী পুরন হয়েছে আর্যদের আগেই । অতএব আর্যদের মধ্য, দক্ষিণ ও অবশেষে পূর্ব ভারতে প্রবেশের সময়ে সেইসব অঞ্চলে ইতিমধ্যেই উন্নত নাগরিক ও গ্রামীণ মানবজাতি বসবাস করছিল । দ্রাবিড় সভ্যতার কতখানি উৎকর্ষ ঘটেছিল তার প্রমাণ আমরা পাই লঙ্কাধীশ দশাননের প্রবল পরাক্রম ও স্বর্ণলঙ্কার কুবেরের মত সম্পদের বর্ণনায় । মেঘনাদের মত বৈজ্ঞানিক প্রতিভার স্বাক্ষরে ও বিভীষণের মত কূটনীতির ধুরন্ধর ব্যাক্তিত্বে । কেউ যদি মনে করেন যে বিভীষণ লঙ্কাকে রামচন্দ্রের হাতে সঁপে দিয়েছিলেন তবে তা ভুল । তিনি স্বাধীন লঙ্কাকে নিরঙ্কুশ ভাবে স্বাধীন রাখতেই রামচন্দ্রের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন । সেখানে তিনিই রাজা । লঙ্কার প্রজাদের শান্তির জন্যে এই জটিল রাজনৈতিক অঙ্কটি তিনি কষেছিলেন । এর সমর্থনে একটি তথ্য দেওয়া যাক। রামায়ণে লঙ্কাদ্বীপকে সিংহলও বলা হয়েছে। বুদ্ধদেবের জন্মের অনেক আগে বাঙালীরা জলে স্থলে এত প্রবল হয়েছিল যে বঙ্গরাজ্যের এক রাজপুত্র সাতশ লোক নিয়ে নৌকাযোগে লঙ্কাদ্বীপ দখল করেছিলেন। তাঁরই নাম থেকে এই দ্বীপের নাম হয় সিংহল। রাজপুত্রের নাম ছিল বিজয় সিংহ। যদিও বিজয় সিংহ নামটি আর্য ছোঁয়ায় সিক্ত। সিংহলের ইতিহাস থেকেই জানা যায় যে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বিজয়সিংহ নামে কোনও বঙ্গরাজপুত্র সিংহলে উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন।

কত প্রাচীন বঙ্গ সভ্যতা? জানা যায় যে মিশর ব্যাবিলন প্রভৃতি দেশে ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত তামার ব্যাবহার অপ্রতিহত ছিল। প্রাচীন এই সাম্রাজ্যগুলো আর্যআক্রমণে ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ ধ্বংস হয়ে যায়। ভারতবর্ষের তাম্রযুগ হয়ত সিন্ধুসভ্যতার ধ্বংসের পরে পরেই শেষ হয়ে যায়। তামার উল্লেখের কারণ বাংলার যে প্রধান নদীবন্দরটির কথা আমরা প্রাচীন সব সাহিত্যে ভ্রমণবৃত্তান্তে ও শাস্ত্রে দেখতে পাই তার নাম তাম্রলিপ্তি। তমলুক বা তাম্রলিপ্তির নামের মধ্যে তামা যতটাই প্রভাব বিস্তার করুক না কেন, বাংলাদেশে মাত্র তিনস্থানে তামার অস্ত্র পাওয়া গিয়েছে। ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমাংশে ঝটিযান পরগনায় তামাজুয়া গ্রামে একটি তামার কুঠারফলক পাওয়া যায়। কিন্তু তাম্রলিপ্তির আশেপাশে তো কোনও তামার খনি নেই! তবে এদেশে তামা এলো কি করে? শ্রীরাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন যে দক্ষিণাপথবাসী আদিম মানবের সাথে উত্তরাপথবাসী মানবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মাদ্রাজ ও বাংলায় আবিষ্কৃত নতুন প্রস্তরযুগের অস্ত্রগুলোর সাদৃশ্য প্রচুর। শুধু তাই নয়, অস্ত্রগুলির পাথরও একই জাতীয়। কিন্তু যেখানে এই পাথর পাওয়া যেত সে জায়গা বাংলা থেকে বহুদূরে। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট বলের অনুমান যে এইসব প্রাচীন অস্ত্র আদিম মানব দক্ষিণ থেকে বাংলায় আনেন। তাই তামাও একইভাবে দক্ষিণ থেকে বাংলায় আনা সম্ভব। অর্থাৎ ভারতে যখন তাম্রযুগ চলছে তখন বাংলায় তামার তৈরি নানা জিনিস, উৎপন্ন না হলেও, আমদানি হচ্ছে।এই অঞ্চলের তখনকার তাম্রসভ্যতা কেবল সিন্ধু সভ্যতার কাছাকাছি মানের ছিলনা, উভয়ের মধ্যে ধর্ম ও কালচারের অনেক মিল ছিল এবং বানিজ্যিক সম্পর্কও মজবুত ছিল। বাংলার মত দক্ষিণ বিহারের তখনকার বাসিন্দারাও ছিলেন অস্ট্রিক দ্রাবিড় ও মঙ্গোলীয় রক্ত ও ভাষাভাষী মেশানো মনবগোষ্ঠী। রাজায় রাজায় যুদ্ধ থাকলেও এই অঞ্চলগুলির মধ্যে কোনও যুদ্ধের খবর পাওয়া যায়নি। কারণ আন্দাজ করা যায় যে, যে মানবগোষ্ঠী চাষবাসের উদ্ভব ঘটানো ছাড়াও দুনিয়ার সঙ্গে ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল তাদের কাছে যুদ্ধের চেয়ে শান্তি ও সহযোগিতাই কাম্য ছিল। যুদ্ধ বর্বরের চরিত্র।

তাম্রলিপ্তির সংস্কৃত অর্থ হতে পারে তামার লেপ। কিন্তু আগেই বলেছি তমলুকের কাছে কোনও তামার খনি নেই। অন্য একটি অর্থ ধরি। বহু প্রাচীন সংস্কৃতে তাম্রলিপ্তিকে বলা হয়েছে দামলিপ্তি। অর্থাৎ দামলদের একটি বন্দর। বাংলায় যে এককালে দামল বা তামিল জাতির প্রাধান্য ছিল সেটা এথেকেই বোঝা যায়। লৌহযুগ শুরু হবার বহু আগেই বাঙালিরা নানাদেশে ধান চাল বিক্রি করত। যেসব নৌকোয় এই শস্য তারা নিয়ে যেত, সেগুলো বেতে বাঁধা হত। কেননা লোহার প্রচলন হয়নি তখনও। এই বেতে বাঁধা নৌকোকে বলা হত বালাম নৌকো। সেই বালাম নৌকোয় যে চাল আসত তাকে বলা হত বালাম চাল। এই চালের নাম তো সবাই জানে। বালাম কোনও সংস্কৃত কথা নয়। এই যে জলে স্থলে প্রবল, বানিজ্যে লক্ষ্মীর বসত, এমন একটি জাতিকে ঈর্ষা করা তো স্বাভাবিক! গাঙ্গেয় উপত্যকায় আর্য সাম্রাজ্যের সীমা শতপথ ব্রাহ্মনে পরিবেশিত একটি গল্পের মধ্যে খুব সুন্দর প্রকাশিত। কথিত আছে যে বিদেহ রাজ্যের রাজা বিদেগ মাথব, আগ্নি নিয়ে সদানীরা নদীর তীর পর্যন্ত পর্যটন করেন। এখানে এসে তিনি থেমে যান। কারণ পূর্বতীরের ভূমি অগ্নিকে উৎসর্গ করা হয়নি। রাজা তখন বিদেহভূমির বাকি অংশ, নদীর অপরপারের ভূমিকে ম্লেচ্ছদেশ বলে ঘোষণা করলেন। শ্রীমতী থাপার জানিয়েছেন জৈন ধর্মে মিলাক্কু, অর্থাৎ বর্বর, শবর, পুলিন্দা, ইত্যাদি আদি অধিবাসীদের সঙ্গে সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের মেলামেশা নিষেধ ছিল। কিন্তু বৌদ্ধধর্মে আর্যদেশ ও ম্লেচ্ছদেশের মধ্যে কোনও বিভেদ ছিলনা। তাই আমরা পরবর্তী কালে দেখতে পাই বঙ্গের (বৌদ্ধ)সিদ্ধাচার্যরা সব তথাকথিত এই অন্ত্যজ বা নীচজাতির মানুষ ছিলেন। কিন্তু এঁদের প্রণীত ধর্ম, দর্শন ও গীতিগ্রন্থ গুলি কোনভাবেই অসংস্কৃত মানুষের রচনা তো নয়ই, বরং উচ্চভাবের দর্শনের ছবি পাওয়া যায়।

বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস প্রথম ভাগ, প্রথম খণ্ডে প্রাচ্যবিদ্যাবিশারদ শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু একটি সংস্কৃত শ্লোককে মনুর বাক্য বলে উদ্ধৃত করেছেন, যার বক্রার্থ মিথিলা বাদে অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ সৌরাষ্ট্র ও মগধ দেশে তীর্থযাত্রা বিনা অন্য কারণে গমন করলে পাতিত্যদোষ হয় ও পুনঃসংস্কার প্রয়োজন হত। সংস্কার মানে প্রায়শ্চিত্ত। শ্লোকটি পড়া যাক।

অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গেষু সৌরাষ্ট্রমগধেষু চ তীর্থযাত্রাং বিনা গচ্ছন্ পুনঃ সংস্কারমর্হতি।

অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ধ্বজাধারীরা নানা বৈদিক ক্রিয়াকর্মের দ্বারা শুদ্ধ করে নিত তাদের বংশজদের। মিথিলা বাদ কেন? কারণ মিথিলার রাজা জনক ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের শিষ্যত্ব গ্রহন করেছিলেন। স্বয়ম্বর সভায় আগত আর্য রাজপুত্র অযোধ্যার যুবরাজকে নিজের পালিতা কন্যার পাণিগ্রহণের অনুমতি দেন। সীতা কিন্তু ভূমিকন্যা। লাঙলের ফলায় উঠে আসা শিশুকন্যাটির জনকদুহিতা হিসেবে পরিচয় দুটি সাক্ষ্য দেয়। এক, তিনি ভূমিকন্যা, অর্থাৎ অনার্য। দুই, তিনি জন্মে পরিত্যক্ত। জনকদুহিতার বিবাহ আর্যরাজপুত্রর সঙ্গে হওয়ার অর্থ জনক আর্যসমাজভুক্ত হলেন।

বৃহৎ বঙ্গে তখন অস্ট্রিক জাতির মানুষ বাস করতেন। কোল, মোন, খোর ইত্যাদি। পরে যারা লোধা শবর ইত্যাদি জাতিবৈশিষ্ট বহন করেছেন । বাঙালীর ইতিহাস ধরতে গেলে তাই শ্রদ্ধেয় সুনীতিকুমারের মতে বাঙালি জাতির উৎপত্তি নিয়ে ভাবতে হয় । আজকাল যদিও সমভাষিতাকেই জাতীয়তার প্রধান লক্ষণ বলে ধরা হয়, তবে আচার্য সুনীতিকুমার অবশ্য সে যুক্তি মানেননি। তাঁর কাছে টানা ও পোড়েন দুটিই যদি ঠিক ভাবে না বোনা হয় তবে বস্ত্রের কোনও অস্তিত্ব থাকেনা । আমরা অবশ্যই ভাষার আলোচনায় যাবো, তবে তার আগে একটি উন্নত জাতির জন্মক্ষণটিকে ধরা বড়ই পবিত্র বলে মনে হয়। বিশেষত এখনও এই অঞ্চলে সাঁওতাল মুন্ডারী হো কুরকু শবর ইত্যাদি আরণ্যক ভাষাগুলি প্রাচীন অস্ট্রিক ভাষারই অবশেষ। তারা কি তবে বাঙালি নন? এ প্রশ্ন তো বড়ই প্রাসঙ্গিক! এখানে উল্লেখ্য যে ভারতবর্ষের পূর্ব দিকে যে সভ্যতা ছিল সেখানে মানুষ যুদ্ধ করতে ভালবাসত না । অবিশ্বাসের কোনও কারণ নেই কেননা আমরা সকলেই জানি যে সিন্ধু সভ্যতার মানুষও অস্ত্রের ব্যবহার জানত না। অত সভ্য ও উন্নত মানুষ অস্ত্র ব্যবহার করত না মানে তারা শত্রু হিসেবে কাউকে গণ্য করতনা । এরও একটি মনস্তাত্ত্বিক যুক্তি আছে । যে মানুষ তার জীবনের প্রাথমিক চাহিদা গুলি পূর্ণ করে ফেলেছে সে কখনই নিজেকে নিয়ে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কিত নয় । বরং বাহ্যিক জীবন থেকে সে তখন আভ্যন্তরীণ জীবনে বেশি আকৃষ্ট । আরও সে কী চায় ! আরও সে কিসের অনুসন্ধান করে!

ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গ বগধ চের জাতির উল্লেখ আছে । হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন “অতি অল্পদিন হইল ঐতরেয় আরণ্যকের একটি ব্রাহ্মনে উহাদের নাম পাওয়া গিয়াছে। বঙ্গ যে বাংলা ইহাতে কোনও সন্দেহ নাই। বগধ যে মগধ তাইতেও সন্দেহ হওয়া উচিত নয়। আর চের হলো কেরল প্রদেশের একটি শাখা।” ঐতরেয় ব্রাহ্মণে ভারতবর্ষ অথবা আর্যভূমির অথবা আর্যজাতির বসতি বিস্তারের সীমা নির্ধারণ করলেও তারপরই ঐতরেয় আরণ্যকে বলা হোল বঙ্গ-বগধ-চেরজাতি পক্ষীবিশেষ। এদের ধর্ম নেই। এরা নরকগামী। এর মোটামুটি অর্থ হোল যে এরা আর্যদের শত্রুবিশেষ। বসতি বিস্তারে বাধা দিতেন, তাই। এদেরকে আর্যরা তাই মানুষ না বলে পক্ষী বানর রাক্ষস ইত্যাদি নামে অভিহিত করত। এখন দেখা যাচ্ছে যে বুদ্ধদেব, মহাবীর ও আরও পাঁচটি অহিংস অনার্য ধর্ম এই পক্ষীদেশে প্রচলিত ছিল। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে ইন্দ্র দেবতার মন্ত্রে অভিষেক হওয়াতে যেসব রাজা বিশেষ অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন তার একটি সুদীর্ঘ তালিকা আছে । এই তালিকার শেষভাগে লেখা আছে যে ভরতরাজা ইন্দ্র অভিষেক নিয়ে ১৩৩টি অশ্বমেধ করেছিলেন । এর মধ্যে ৭৮টা যমুনার পশ্চিমে মরুষ্ণ দেশে ও ৫৫টা গঙ্গার পূর্বে জলবৃষ্টির দেশে । ৭৮ টা দেশের মধ্যে বেলুচিস্তান ছিলনা । কারণ তাহলে সেটাও ভরতের নামাঙ্কিত হত । এখন বাকি ৫৫ টির জন্য কতটা স্থান দরকার? শাস্ত্রীমশায় বলেছেন এলাহাবাদ থেকে ঠিক উত্তর মুখে রেখা টানলে ঐ রেখা ও গঙ্গার পূর্ব পারের মধ্যে যত দেশ পড়ে তা ওই অশ্বমেধের পক্ষে যথেষ্ট । এখানেই প্রমাণ পাওয়া গেল যে বঙ্গভূমি আর্য উপনিবেশ গড়ে ওঠার আগেই একটি সভ্য দেশ বলে মান্য ছিল । কত আগে থেকে তবে এ অঞ্চলে সভ্য মানুষের বাস? সভ্য অর্থে যারা অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের বাইরে আরও কিছু , যেমন চারুকলা, গীতি ও কাব্যরস, উন্নত দর্শন ইত্যাদির চর্চা করেছেন। একটু দেখে নিই লিখিত ঐতিহাসিক তথ্য আমাদের কতদুরে নিয়ে ফ্যালে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এক বিখ্যাত প্রামাণিক গ্রন্থ। সেখানে সাংখ্যদর্শনের প্রশ্বস্তি শোনা যায়। যে ষড়দর্শন ভারতীয় দর্শনের মূলসাংখ্য তারই একটি। সাঙ্খ্যের রচয়িতা হলেন কপিল মুনি। আর্যরা যে সময়ে পশ্চিমে যাগ যজ্ঞ নিয়ে, দেশ দখল করতে, শূদ্রদের আয়ত্ত করতে, তাদের দাস বানিয়ে রাখতে ব্যস্ত তখন বঙ্গ বগধ চেরগণ পরকাল নিয়ে ব্যস্ত । কিসে জন্ম জরা মরণের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যায় তাই নিয়ে ব্যস্ত । কি আছে সাংখ্যে? মহামুনি কপিল শুরু করেছেন যে সূত্র দিয়ে তার তাৎপর্য এইরূপ – ত্রিবিধ দুঃখের যে অত্যন্ত নিবৃত্তি তাহাই অত্যন্ত অর্থাৎ পরমপুরুষার্থ নামে অভিহিত হইয়া থাকে। ত্রিবিধ দুঃখ হোল আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক দুঃখ। এর অনন্তকালের জন্য উপশম, আর কখনও আত্মাকে কোনরূপ দুঃখের অনুভূতি পোহাতে হবেনা। জড়সম্বন্ধরহিত হয়ে এইরূপ আত্মস্বরূপে অবস্থানই হোল মুক্তি। কপিলমুনির সিদ্ধাশ্রম হোল গঙ্গাসাগরে। কপিলমুনি বাঙালি। আর কবতাক্ষের তীরে তাঁর গ্রাম। আর তিনি জন্মেছিলেন কপিলাবাস্তুতে । কপিলের বাস্তু । সেখান থেকে নেমে এসেছিলেন দক্ষিণের সাগরতীরে। গৌতমের চেয়ে অন্তত হাজার বছরের বড় । প্রমাণ, বুদ্ধ জন্মাবার আগে ২৪ জন বুদ্ধ জন্মেছেন । মহাবীর জন্মাবার আগে আরও ২৪ জন তীর্থঙ্কর জন্মেছেন । সর্বোপরি বৌদ্ধধর্ম যে সাংখ্যমত থেকে উৎপন্ন হয়েছে এ কথা অশ্বঘোষ একরকম বলেই গেছেন। বুদ্ধদেবের যে দুজন গুরু অড়াঢ় কালাম ও উদ্রক দুজনেই সাংখ্যমতাবলম্বী ছিলেন ও দুজনেই বলেছেন ‘কেবল’ অর্থাৎ জগতের সঙ্গে সম্পর্কশূন্য হতে পারলেই মুক্তি। বুদ্ধ সেই অবস্থান থেকে সরে এসে বলছেন কেবল হলেও অস্তিত্ব থেকে যায়। সুতরাং অস্তিত্ব থাকলে মুক্তি নেই। শ্রদ্ধেয় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন যে যদি বৌদ্ধধর্মের উৎস হিসেবে সাংখ্যমতকে ধরা হয় তবে একরকম স্বীকার করে নেওয়া হলো যে বৌদ্ধধর্ম আর্য ধর্ম থেকেই উৎপন্ন হয়েছে। কিন্তু তা নয়। সাংখ্যমতকে শঙ্করাচার্য তো বৌদ্ধ মতের মতই অবৈদিক বলেছেন। “Chronology of the Samkhya Literature” প্রবন্ধে শাস্ত্রীমহাশয় সাংখ্যমতের সঙ্গে বৌদ্ধমতের সম্পর্ক বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। সাংখ্যমতে ঈশ্বরের অনস্তিত্বই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সাংখ্য বলছেন, ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ প্রমানাভাবাৎ। প্রমানের অভাবে ঈশ্বর সিদ্ধ হইলেননা। বুদ্ধদেবও অনুরূপভাবে প্রমানের অভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের আগে পূর্বাচলে প্রচলিত ছিল আরো পাঁচটি ধর্ম মত ।এগুলিরও প্রধান নীতি ছিল অহিংসা। সুতরাং বুদ্ধদেব বা মহাবীর প্রথম ধর্মে অহিংসা প্রচার করেন তা ভাবা ভুল। প্রথম প্রথম বৌদ্ধ পণ্ডিতরা তাঁদের সাহিত্যে মাগধী, পালি ও অর্ধমাগধী ব্যবহার করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁরাও সংস্কৃত ব্যবহার করতে শুরু করলেন। এইখানে একটি কথা বলা চলে। কপিলমুনি সাংখ্যদর্শনের প্রবক্তা হলেও মনে করা চলে যে যে ভাষায় সাংখ্য (সংস্কৃত) লিপিবদ্ধ হয়েছে তা অনেক পরের কথা। তখনও লিপি জন্ম নেয়নি। শ্রুতিতেই শাস্ত্রের প্রচলন ছিল। সুতরাং সাংখ্যকে খ্রিস্টপূর্ব অন্তত হাজার বছর আগে জন্মানো শাস্ত্র বলে অনুমান করাই যায়। তথাগতের দুই গুরু অড়ার কালাম ও উদ্রক ছিলেন সাংখ্যমতাবলম্বী । আমরা বৌদ্ধধর্মের মূল কথাগুলি মনে করলে দেখব যে বুদ্ধদেব নিজে কতখানি প্রভাবিত ছিলেন সাংখ্যের দ্বারা। তাঁরও তো প্রধান লক্ষ্য ছিল জরাব্যাধিমৃত্যুর ত্রিফলা দুঃখের থেকে নিবৃত্তি! আর তিনি যখন জন্মেছেনই সাংখ্যের বাস্তুতে তখন এই প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। অশ্বঘোষ বলছেন – গোতমঃ কপিলো নাম মুনিধর্মভূতাঃ বয়ঃ । কৌটিল্য ২৩০০ বছর পূর্বেকার লোক। তিনি যে তিনটি দর্শনের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন সেগুলি হোল সাংখ্য, যোগ ও লোকায়ত। অন্য দর্শনশাখা গুলির তখনও উৎপত্তি হয়নি। যদিও অধুনা যে বাইশটি সূত্র কপিলের রচনা বলে প্রচলিত সেগুলি ঈশ্বরকৃষ্ণ (খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতক) রচিত কারিকা দেখে লেখা। সেগুলি বড় প্রাচীন নয়। কারণ তার আগেও সাংখ্য মতের পুস্তক ছিল। মাঠর ভাষ্যের কথা ও শোনা যায়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও সাংখ্যমত যে অতি প্রাচীন সে অশ্বঘোষ ও কৌটিল্যের লেখা থেকেই বোঝা যায়।

শাক্য মুনি শেষ বুদ্ধ । মহাবীর শেষ তীর্থঙ্কর । সেসময় পূর্বাচলে সাংখ্য দর্শনের খ্যাতি তুঙ্গে । পূর্বাচল আর্থিক সমৃদ্ধিতেও মহীয়ান তখন । ফলে সমাজজীবনে উচ্চতর দর্শনচর্চা চলছে । ফলত আর্য্যদের মারকুটে মনোবৃত্তিকে ভালো চোখে তো দেখা হয়ই না , উপরন্তু কিভাবে দূরত্ব ও স্বাতন্ত্র বজায় রাখা যায় সেদিকেই সব প্রয়াস। সাংখ্যও তাই বেদবেদান্তের ছায়ামুক্ত। সাংখ্যের পুরুষপ্রকৃতিতত্ত্ব তাই বেদে খুঁজে পাওয়া যায়না। অনেকেই বলবেন যে সাংখ্যের ভাষা তো সংস্কৃত! এখানে ভাষাপ্রসারের তত্ত্বও বলতে হয় তবে। আর্যরা যে ভাষা ব্যাবহার করত তা সংস্কৃত নয়, বৈদিক। আচার্য সুনীতিকুমার বলছেন খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১৪০০ বা ১৩০০ পর্যন্ত যেসব আর্যভাষার নাম পাওয়া যায় সেগুলিকে বৈদিক সংস্কৃতের পূর্বঅবস্থার ভাষার শব্দ ও নাম বলা যায়। একে একসঙ্গে প্রাক-সংস্কৃত ও প্রাক-ইরানী বলা যায়। এই প্রাক-সংস্কৃত তখনও কোনও বিশিষ্ট সংস্কৃতির বাহন হতে পারেনি কারণ আর্যজাতি তখনও কতকটা আদিম যাযাবর অবস্থায় ছিল। পার্থিব সভ্যতায় বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। পূর্বাঞ্চলে তখন অস্ট্রিক সভ্যতা মুখ্যতর গ্রামীণ সভ্যতা ছিল বলে অনুমান করা হয়। দ্রাবিড় সভ্যতার মত নাগরিক সভ্যতা ছিলনা। এ থেকে এই ধারণাই প্রবল হয় যে পূর্বাঞ্চলের মানুষজন বস্তুবাদী ছিলেননা। ধীরে ধীরে অনার্য ভাষাগুলির সঙ্গে আর্যভাষার মিলন ঘটতে লাগল। বৈদিক ভাষায় ভাঙন ধরল ও তা প্রাকৃতের রূপধারণ করল। পাঞ্জাব অঞ্চলে, বিশেষ করে, পাণিনি ও তাঁর পূর্ববর্তী পণ্ডিতদের চেষ্টায় একটি সাহিত্যের ভাষা গড়ে উঠল ও সেটি সংস্কৃত নামে সুপ্রতিষ্ঠিত হোল।

এবার আসি আরও একটু এগিয়ে। মোটামুটিভাবে ধারণা করা গেছে যে আজ থেকে অন্তত তিন হাজার কি তারও কিছু বেশি সময় ধরে আমাদের এই ঠিকানা বেশ অগ্রসর এক মানবগোষ্ঠীর ঠিকানা। দেখে নিই কোথায় কি উল্লেখ আছে এর। গ্রীক ঐতিহাসিক ডায়োডরাস সিকুলাস লিখেছেন – যখন মহামান্য আলেকজান্ডার তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে আরও পূবে অগ্রসর হচ্ছেন তখন দুত এসে তাকে জানালো যে যে রাজা পুরুকে (পরমানন্দ চন্দ্র, কাঙরা উপত্যকার কাটচবংশীয় রাজা) তিনি পরাজিত(?) করেছিলেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র পুরু এখন গঙ্গাহৃদয় রাজ্যের শরনাপন্ন। তিনি ফেগাসের কাছ থেকে আরও জেনেছেন যে, সিন্ধুনদের অপরপ্রান্তে প্রথমে একটি মরুভুমি পড়ে। সেটিকে অতিক্রম করতে সময় লাগে প্রায় বারোদিন। তারপর আসে গঙ্গা নামে এক বিশাল নদী। তার গভীরতা ও ব্যাপ্তি যেকোনো ভারতীয় নদীর চেয়ে অনেক বেশি। এই নদী পেরিয়ে আসে প্রাচ্য (গ্রীক উচ্চারণে প্রাসি) ও গঙ্গাহৃদয় নামে দুই রাজ্য। এই রাজ্যের রাজা চন্দ্রমেষ। তাঁর দু লক্ষ পদাতিক, কুড়ি হাজার ঘোড়া, দুহাজার রথী এবং চারহাজার হাতী আছে। এই হাতীগুলি যুদ্ধের জন্য অস্ত্রসজ্জিত ও পুরো মাত্রায় প্রশিক্ষিত।৩ খুব সম্ভবত এই কারণেই আলেকজান্ডার আর এই নদী পার হবার সাহস করেননি। তাঁর সেনাদল রনহস্তী সামলানোর মত বীর ছিলনা বলেই মনে হয়। যেহেতু এ অঞ্চলে তখন সাম্রাজ্যবাদী রাজাদের অস্তিত্ব ছিলনা, নিজেরা নিজেদের রাজ্যের সীমার মধ্যেই খুশী থাকতেন, যেটুকু সৈন্যসামন্ত রাখা হত সে শুধু সমুদ্রবাহিত হয়ে এই মোহনারাজ্যে যদি জলদস্যু বা অন্য কোনোরকম বহিঃশত্রুর মোকাবেলা করতে হয়, তার জন্য। প্লুটার্কের বিবরণ থেকে জানতে পারি যে প্রাচ্য ও গঙ্গাহৃদয়ের রাজারা দুলক্ষ পদাতিক, আশিহাজার অশ্বারোহী, আটহাজার রথী ও ছহাজার রনহস্তী নিয়ে আলেকজান্ডারের সঙ্গে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়েছিলেন।৪ মেগাস্থিনিস জানিয়েছেন গঙ্গার নিম্নগতিতে অবস্থিত এই সম্পন্ন রাজ্যগুলি কখনও সার্বভৌমত্ব হারায়নি। কোনও বিদেশী রাজা এগুলিকে আক্রমণ করে নিজ বশ্যতায় আনতে পারেনি। একদিকে যেমন এরা নিজেরাই খুব পারদর্শী ছিলেন রাজ্যরক্ষা ব্যাপারে, তেমনই গঙ্গা তার প্রছুর শাখাপ্রশাখা নিয়ে উর্বর অথচ বিদেশীর পক্ষে অগম্য ছিল। উপরন্তু হাতীকে সামলানোর বিদ্যে এই বিদেশীদের অধরা ছিল। মেগাস্থিনিসের বিবরনে গঙ্গাহৃদয়ের মোহনার কাছের এলাকাগুলো এখনকার সুন্দরবন অঞ্চলকেই মনে করায়। এবং আশ্চর্যের কথা এই যে সেইসব ছোট ছোট এলাকার ভূপতিরাও পদাতিক অশ্বারোহী ও রথী রাখতেন। যদিও সংখ্যায় তা নগণ্য।৫ শুধুই বিবরণ নয়। একসময়ে পূর্ব ভূখণ্ড যে বৈদেশিক বানিজ্যেও উন্নত ছিল তার প্রমাণস্বরূপ কিছু নিদর্শন পাই আমরা। যেমন বাংলাদেশের ময়নামতী অঞ্চলে পাওয়া এই রোমান মুদ্রা দুটি। এতে হারকিউলিসের মুখ মুদ্রিত।

Roman coins with inscriptions of Hercules have been discovered in Mainamati, Bangladesh

যে সময় থেকে ভারত ভূখণ্ডের ইতিহাস নানা নিদর্শনের মাধ্যমে একটা কাঠামো পেতে শুরু করেছে প্রায় সেই সময় থেকেই জানা যায় যে ভূখণ্ডের বণিক সম্প্রদায় বহির্বাণিজ্যে পোক্ত ছিল । সড়ক পথে যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে জল পথে পণ্য আমদানি রপ্তানি হত । জলপথ বলতে পূর্ব ভূখণ্ডের বন্দর গুলো প্রধান ছিল বলে মনে করতে পারি । খৃষ্টপূর্ব যেসব ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় সেখানেও তাম্রলিপ্তির উল্লেখ পাই । যুক্তি বলে যেখানে নৌ বাণিজ্য এমন সমৃদ্ধ ছিল সেখানে নৌ নির্মাণ শিল্পও নিশ্চয় অনেক উন্নতি লাভ করেছিল । তবে কেন বঙ্গের কোনও রাজত্বের কোনও বিশিষ্ট ব্যাক্তির নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়না ? কোনও মুদ্রা, কোনও শিলালেখে কেন বঙ্গের সেইসময়ের সমৃদ্ধির কথা নেই?

প্রাক বুদ্ধ ইতিহাসে , এমনকি শশাঙ্ক পূর্ববর্তী ইতিহাসেও বাংলার উল্লেখ সেভাবে নেই । শিল্পে বাণিজ্যে শিক্ষায় শিল্পকলায় যেন বঙ্গদেশের কোনও স্থানই নেই । অসভ্য এক ভূখণ্ড যেন । অরণ্য সংকুল, শ্বাপদ সংকুল এক বিপজ্জনক স্থান । এমনটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক । অথচ ফাহ ইয়েনের বিবরণ থেকে স্পষ্ট যে বাংলায় তখন বৌদ্ধ ধর্ম শুধু প্রভাব বিস্তার করেনি , ধর্ম ও বিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রও প্রস্তুত করেছিল । তাম্রলিপ্তি ছিল বন্দর নগর । সেখান থেকে জাহাজ যেত সুমাত্রা যবদ্বীপ সুবর্ণদ্বীপ ইত্যাদি দূর প্রাচ্যের দেশগুলিতে বাণিজ্য করতে । ভারতের বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যের প্রধান যাত্রাপথ । কি যেত সেইসব জাহাজে ? সমগ্র উত্তর ভূখণ্ডের রপ্তানীযোগ্য পণ্য নদীবাহিত হয়ে এসে জড়ো হত বন্দর নগরটিতে । আর সেখানে নিশ্চয় ঠাঁই পেত বাংলার নিজস্ব শষ্যসম্পদের সঙ্গে সঙ্গে খাঁটি বঙ্গীয় মসলিন ও আখের গুড় । অতএব আর্থিক সমৃদ্ধি বাংলার কিছু কম ছিলনা । একটি সূত্র নিবেদন করি। কেমন ছিল সেইসময়ে বাংলার অর্থনীতি?

‘সাগরকে দক্ষিণে রেখে এবং তীরকে বামে রেখে নৌযানে ভাসার সময়ে গঙ্গা চোখের সামনে এলো। আর এর একেবারে কাছেই পূর্বের সর্বশেষ ভূমিখণ্ড, ক্রাইস। এই ভূখণ্ডের কাছের নদীটির নাম গঙ্গা। এটি নীলনদের মতই গতিশীল। এর তীরবর্তী যে বাণিজ্য নগরটি আছে তারও নাম এই নদীর নামে। এই নদীপথ দিয়েই মালাবথ্রম (মালাপত্র?), গাঙ্গেয় জটামাংসী, ও মুক্তা, এবং উৎকৃষ্ট মসলিন সরবরাহ হয়। শোনা যায় যে এই স্থানের নিকটে স্বর্ণখনিও আছে”। এটি খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে পেরিপ্লাসের লেখা।৭

একটি অল্পখ্যাত সূত্র জানাই এবার। চন্দ্রকেতুগড়। বারাসাতের কাছে উত্তর চব্বিশ পরগণার বেড়াচাঁপা নামে একটি অঞ্চলের কাছে এক পুরাতাত্ত্বিক ক্ষেত্র পাওয়া গিয়েছে। শ্রদ্ধেয় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি মহেঞ্জোদারো আবিস্কারের কারণে বিখ্যাত, ১৯২২এ লিখছেন চন্দ্রকেতুগড় সম্পর্কে -ভগ্নাবশেষ এবং মূর্তিসমুদয় ইতিহাসের বিস্ময়! ১৯৫৬/৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউসিয়াম এই ভগ্নস্তুপে একটি মন্দির আবিষ্কার করেছে। মনে করা হয় যে এই মন্দিরটি খনা মিহিরের সমসাময়িক। আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বলছে যে এই মন্দির ও দুর্গ খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্যাপ্ত এক নাগরিক সভ্যতার চিন্হ। মন্দিরটি পালযুগে নির্মিত।৮ এই সময়কাল শুরু হয়েছে মৌর্যযুগের শুরু থেকে এবং শেষ হয়েছে পালযুগের শেষ পর্যন্তয়। এই চন্দ্রকেতু কে, এই নিয়ে বেশ বিভ্রান্তি আছে। পণ্ডিতরা মনে করেন গ্রীক ঐতিহাসিকরা যে সান্দ্রকোটাস এর নাম উল্লেখ করেছেন তাঁদের বিবরণে তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। সান্দ্রকোটাস এর সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের কিছু মিল পাওয়া যায়, তবে চন্দ্রকেতুর মিল বেশি। এই সমস্ত তথ্যের উল্লেখ এইজন্যে যে বঙ্গভুমি, যদিও তার ভৌগোলিক সীমা হয়ত অন্যরকম ছিল, আদ্যন্ত এক সভ্য পৃথক কৃষ্টিসমৃদ্ধ জাতির মাতৃভূমি ছিল। অধ্যাপক সুনীতিকুমার তাঁর একটি প্রবন্ধে৯ জানিয়েছেন তাঁর এক ছাত্র শ্রীমান মোল্লা রবীউদ্দিন মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমায় সালু ডাকঘরের অন্তর্গত গীতগ্রামে বাস করতেন। সেখানে তাঁর গ্রামের ঠিক বাইরে সৈদগুর ডাঙা বলে একটি ঢিবি আছে। আচার্য জানিয়েছেন এই এলাকাটি সভতায় বাংলাদেশে অগ্রণী। বহু প্রাচীন দীঘি, বিহারের ধ্বংসাবশেষ, ঢিবি এখানে আছে, যা এখনও প্রত্নতত্ত্ববিভাগ খুঁড়তে শুরু করেননি। কর্ণসুবর্ণ এখানকার বিখ্যাত নগরী ছিল। এই সৈদগুর ডাঙাটি যদিও কবরে ভর্তি, তবুও ঝড় বৃষ্টি পড়লে ওপরের মাটি সরে গিয়ে বেশ কিছু অদ্ভুত জিনিস বেরিয়ে পড়ে। ওপর ওপর বেরিয়ে আসা জিনিসের মধ্যে নীল মীনেকাজের কাঁচের বড় বড় দানা, নীল মীনেকাজের পাত্রের টুকরো, ধাতুমূর্তি ইত্যাদি। এগুলিকে বিশেষ গুরুত্ব তিনি দেননি। কিন্তু একবছর প্রবল বর্ষায় সেই ঢিবির একাংশ ধ্বসে পড়ে। তখন সেখানে যা পাওয়া যায় তার একটি তালিকা দেওয়া যাক।

১ সাতটি তাম্রমুদ্রা। কোনটায় সুন্দর ভাবে আঁকা হাতী, কোনটায় বৃষমুণ্ড। কোনটা আবার প্রাচীন মিশরীয় হাতল সমেত ক্রস (crux ansata)। এছাড়া চৈত্য, পুকুর, গোড়া বাঁধানো গাছের চিত্রও আছে। শ্রীযুক্ত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রীযুক্ত কাশীনাথ দীক্ষিত জানিয়েছেন এগুলো ভারতের সবচেয়ে পুরনো কাস্ট কয়েন, যা পুরাণযুগে প্রচলিত ছিল, ঠিক তার পরের সময়ের। এই তাম্রমুদ্রা গুলির সময় এঁরা নির্ধারণ করেছেন খৃস্টীয় দ্বিতীয় শতক। তবে এইসব মুদ্রা কোনও রাজার নামাঙ্কিত নয়। কারণ এগুলির প্রচলন ঘটত বনিকসঙ্ঘের দ্বারা। নিজেদের টাঁকশালে এই মুদ্রাগুলি তারা তৈরি করতেন। প্রমাণ হোল মুদ্রাগুলি মাঙ্গল্যসুচক চিহ্ন এবং ধাতুর বিশুদ্ধির উল্লেখ বহন করে। এ বানিজ্যে শ্রী ও অর্থলাভের আশায়, এমনটা ভাবা অসঙ্গত নয়।

২ বেশ কটি পোড়ামাটির পাত্রের টুকরো, এগুলি এলাহাবাদ অঞ্চলের ভীটাতে প্রাপ্ত বহুপ্রাচীন নিদরশনের সঙ্গে মেলে।

যদিও আচার্যের সময়কালে এই ঢিবিটির স্বরূপ উন্মোচিত হয়নি, আশা রাখি পরবর্তী কোনও সময়ে তা হয়েছে বা হবে।

এবার একটু ভাষার দিকে তাকানো যাক। পূর্বের রাজ্যগুলির এই শ্রী ও সমৃদ্ধি ইতিমধ্যে প্রমাণিত। নিশ্চয়ই এবার এঁদের নিজস্ব ভাষার প্রয়োজন পড়বে। কেননা ভাবনাচিন্তার জগত কাব্যের জগত তো একটি প্রয়োজনীয় স্বতন্ত্র ভাষার দাবী করে! যেহেতু বাংলা ভাষার উৎপত্তি আমরা চর্যাপদ থেকে ধরি, তাই এ অঞ্চলে তৎকালীন প্রচলিত ভাষা অনুমান করা যায় - মাগধী । উত্তর পূর্বাঞ্চলে তখন মাগধীই বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ পরিগ্রহ করে প্রচলিত ছিল। তবে বিদ্যাচর্চার ভাষা ছিল সংস্কৃত। বাংলাভাষা যখন গড়ে উঠছে বাঙালি কবিরা সংস্কৃত ছাড়া আরও দুরকম ভাষা ব্যবহার করতেন। একটি সেদিনের নির্মীয়মাণ বাংলাভাষা, অন্যটি সমগ্র আর্যভারতের সাহিত্যে ও ভাববিনিময়ে আচরিত পশ্চিমী অপভ্রংশ, অর্থাৎ চারহাজার বছর আগেকার হিন্দুস্থানী ভাষা১০। এই কবিদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলাভাষার স্বতন্ত্র একটি রূপ সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন এবং নিজেরা বাংলাভাষী হিসেবে গৌরব বোধ করতেন। আচার্যের অবিকল ভাষায় তুলে দিই, কিভাবে সেসময়ের একজন কবি সংস্কৃত ভাষায় আর্যাছন্দে রচিত একটি পদ্যে বাংলাভাষার সঙ্গে গঙ্গানদীর তুলনা করেছেন। “গঙ্গা যেমন বারির প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ, বাংলাভাষার রচনায়ও তেমনি রয়েছে বিভিন্ন প্রকারের প্রাচুর্য। গঙ্গা সুন্দর তাঁর বক্রগতিশীলতায় আর বাংলাভাষা সুন্দর তার সূক্ষ্ম-তীক্ষ্ণ চতুরতায়”। উভয়েরই আশ্রয় গ্রহন করেছেন কবিরা। তাঁরা যেমন গঙ্গার সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন তেমনই বাংলাভাষাতে তাঁদের রচনা নির্মাণ করেছেন। ভেবেছেন এর সংস্পর্শে যারা আসবেন তারাই নদী আর ভাষা উভয়ের পূতস্পর্শলাভে পবিত্র হবেন। “ঘন-রস-ময়ী বঙ্কিম-সুভগা উপজীবিতা কবিভিঃ। অবগাঢ়া চ পুনীতে গঙ্গা বঙ্গালবাণী চ”১০। এখানে তবে পণ্ডিত কবি শ্লোককারদের দেখা পাইনা কেন? তার কারণ তখন কাব্যরচনা করতেন যাঁরা, তাঁরা রাজসভায় রাজ অনুগ্রহে সভাকবি ছিলেন। তাঁদের কাব্যচর্চা শুরুই হত রাজস্তুতি দিয়ে। এর নিদর্শন ভূরি ভূরি। কিন্তু সেসময় বাংলায় কোনও রাজসভার কবির দেখা মেলেনা। কারণ? কারণ বাংলায় প্রবল পরাক্রমশালী নৃপতিরা রাজত্ব করতেন না। করতেন ছোট ছোট রাজারা। এঁদের বড়সড় জমিদার বলা চলে। এঁরা শিল্পে ও বাণিজ্যে এতটাই স্বনির্ভর ছিলেন যে নিছক অন্য রাজার ধনসম্পদের লোভে পড়ে সে রাজ্য আক্রমণ করতেন না। বরং বহির্বাণিজ্যের আবশ্যিক শর্ত মেনে পরস্পর সৌহার্দ্য রক্ষা করে অনেকটা সমবায় প্রথা অবলম্বন করে সমুদ্রে জলযান পাঠাতেন। ভারতের মূল ভূখণ্ডের সম্রাটও বিলক্ষণ বুঝতেন এর মহিমা। তাই মনে হয় এখানে সৈন্য পাঠানোয় অনীহা ছিল তাঁদের । অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে । অপরদিকে বাংলা নদীমাতৃক দেশ । চিরকাল সুজলা সুফলা । ধান, গুড় আর তণ্তুজাত বস্ত্র তার একান্ত নিজের জিনিস । সমৃদ্ধ শিল্প । সুতরাং বাংলার মানুষ খেয়ে পড়ে ভালো থাকতেন । যুদ্ধ করবার ইচ্ছে জাগত না । কে না জানে যুদ্ধ হলো অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে খর্ব করতে সবলের অত্যাচার ? এখনো দুনিয়া জুড়ে যে যুদ্ধ চলছে তার কারণ যাই বলা হোক না কেন মূল কারণ টাকা । এসময়ে মহাজনপদগুলি নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় আসীন কোনও সম্রাটের অধীন। যেমন ধরা যাক অশোক। অশোকের রাজত্বকালে কিরকম ছিল বাংলার অবস্থা? পুণ্ড্রবর্ধন। আধুনিক উত্তরবঙ্গের প্রাচীন নাম। পুণ্ড্র হোল সেই জনগোষ্ঠী যারা ইন্দোএরিয়ান ভাষা বলতনা। বাংলাদেশের বগুড়া জেলার করতোয়া নদীর অববাহিকায় এই প্রাচীন রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। যেহেতু এরা বৈদিক কৃষ্টিকে আত্মস্থ করেননি তাই ব্রাহ্মণ্য যুগে এদেরকে অস্পৃশ্য বলে হীন করা হয়েছে। মহাস্থানগড়ে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের একটি শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে যেখানে ব্রাহ্মি হরফে প্রাকৃত ভাষায় লেখা। মনে করা হয়, অশোকের অনেক পূর্বেই পুণ্ড্রে বৌদ্ধধর্মের চর্চা শুরু হয়। পুণ্ড্র যদি উত্তরবঙ্গ হয় তবে তা কপিলাবাস্তু থেকে দুরত্বে বেশি নয়। সর্বোপরি তখন পূর্বাঞ্চলে সাংখ্য মতের জয়জয়কার। বৈদিক ধর্ম নয়, বরং সাংখ্যের প্রবর্তিত মত ও তা থেকে উদ্ভুত ধর্মই সাধারণের ধর্ম ছিল। স্বয়ং গৌতম ছিলেন সাংখ্যের পরিবর্তিত ও উন্নত মতের জন্মদাতা। পুণ্ড্রবর্ধনে এইসময়ে অজীবিক ধর্মাবলম্বী মানুষের বাস ছিল। মক্ষলি পুত্র গোশাল ছিলেন অজীবিক ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। উল্লিখিত শিলালিপিটিতে বলা হয়েছে, অশোকবদনের সূত্র অনুযায়ী, সম্রাট অশোক পুণ্ড্রের সমস্ত অজীবিকদের হত্যা করতে আদেশ দিয়েছিলেন। কারণ কোনও একজন অজীবিক একটি চিত্র এঁকেছিলেন যাতে গৌতম বুদ্ধ নির্গ্রন্থ জ্ঞাতিপুত্রের পদমূলে নত হয়ে প্রণাম জানাচ্ছেন। অজীবিকরা তখনও বৌদ্ধধর্মের আশ্রয়ে আসেনি। তাঁদের নিজস্ব ধর্মমত যথেষ্ট প্রগতিশীল ছিল। বৌদ্ধধর্ম তখন রাজধর্ম। বুদ্ধদেব স্বয়ং সম্রাটের আরাধ্য। তাই এই চিত্র তাঁর অভিমানে এমন আঘাত করেছিল যে তিনি এই নির্দেশ দেন। এর ফলে প্রায় আঠেরো হাজার অজীবিককে হত্যা করা হয়। তাহলে শুধু বৈদিক ধর্ম নয়, বৌদ্ধধর্মেও সন্ত্রাস ছিল! রাজধর্ম তখন বৌদ্ধধর্ম এবং স্পষ্টতই সম্রাট অশোক তখন বৌদ্ধধর্ম গ্রহনপূর্বক ধর্মাশোকে পরিবর্তিত। কলিঙ্গযুদ্ধের মর্মান্তিক পরিণতিতে যে অশোক গভীর অনুতপ্ত, পরবর্তীতে তাঁর পক্ষে আঠেরো হাজার ভিন্নধর্মের মানুষকে হত্যা করা অধর্ম হয়নি? সব্বজীবে দয়া তবে কই? এথেকে স্পষ্ট, কেন সেইসময়ের পুণ্ড্র, সমতট, গৌড়, বা গঙ্গাহৃদির উল্লেখ আমরা সমকালীন দলিলগুলিতে পাইনা। দুটি প্রত্যক্ষ কারণ হোল – এক, এই অঞ্চলের অধিবাসীরা ভিন্নজাতি, ধর্ম, ভাষা ও কৃষ্টির অনুসারী ছিলেন, যা তৎকালীন সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের চোখে হীনজাতি, হীনকৃষ্টি, হীনভাষা, ও হীনধর্ম। হীন অর্থ অনার্য। দুই, এই হীন মানুষগুলো কিন্তু স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে নিজেদের অস্তিত্বের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে গেছে চিরকাল। এখনও কি পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বাকি ভারতের কিছু পার্থক্য থেকে যায়নি? কিন্তু বৌদ্ধধর্মের দুকুলপ্লাবী প্রভাব নিয়ে যখন তা সব প্রচলিত ধর্মকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল তখন সবার আগে পূর্বাঞ্চলেই তা ঘটল। বৌদ্ধধর্মের ঔপনিবেশিক প্রভাবের কথা কিন্তু মাথায় রাখতে হয়। পূর্বভারতে তখন যে সমস্ত সম্প্রদায় ছিল সেগুলিকে ঐচ্ছিক সমিতি বলা যেতে পারে। বৌদ্ধধর্ম প্রথম একটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ও ক্ষেত্রবিশেষে বলপূর্বক অন্য সম্প্রদায়ের মানুষকে বৌদ্ধধর্মের ছত্রের তলায় আনে। বুদ্ধ ক্ষত্রিয় ছিলেননা । তাঁর দেহসৌষ্ঠবে মঙ্গোলীয় প্রভাব স্পষ্ট। পরবর্তী কালে আর্যরাজারা বুদ্ধকে ক্ষত্রিয় ও আর্যবংশজাত বানিয়ে ছেড়েছেন।

৩৯৯ খ্রীষ্টাব্দে ফাহ ইয়েন ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন । তখন উত্তর ভূখণ্ডের সম্রাট বিক্রমাদিত্য । পাটলিপুত্রে ফাহ ইয়েন তিন বৎসর কাল ছিলেন । সেখান থেকে আসেন তাম্র্লিপ্তিতে । এখানে তিনি বাইশটি সংঘারাম দেখেছিলেন । অর্থাৎ বাংলায় তখন বৌদ্ধ ধর্ম প্রধান ধর্ম । এখান থেকেই তিনি যবদ্বীপ যাত্রা করেন। অতএব সেই চতুর্থ শতকে বাঙালি যথেষ্ট সমৃদ্ধ এক জাতি যারা ধর্মের প্রসারে বিদ্যার প্রসারে অর্থ কাল ও স্থান ব্যয় করতে পারেন।

বাংলায় বৌদ্ধধর্মের প্রসারের ফলে পুণ্ড্র, সমতট, গৌড়, তাম্রলিপ্তি ইত্যাদি বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচুর বিহার নির্মিত হয়। তখন আমরা সর্বভারতীয় সম্রাটের অধীন। তবুও যে জাতিবৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়নি তার প্রমাণ বাংলার ধর্মে ও ধর্মীয় সাহিত্যে। যে চর্যাপদকে আমরা বাংলার প্রথম সূর্যকিরণ বলে মনে করি সেগুলিও তো আসলে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের রচিত গুঢ় আধ্যাত্মিক সঙ্কেতধর্মী গীত, যা ধর্মীয় আসরে হোক বা নিভৃতে, গাওয়া হত। সহজযান ও বজ্রযান বৌদ্ধমতের প্রতিষ্ঠা ও বাংলায় হয়। দীপঙ্করশ্রী জ্ঞান অতীশ তো বৌদ্ধধর্মকে সমুহ বিনাশ থেকে বাঁচিয়েছিলেন। তাঁর মত পণ্ডিত ও প্রজ্ঞাবান আচার্য সেসময়ে আর কেউ নিশ্চয়ই ছিলনা। থাকলে তাঁর নাম ইতিহাসে সগৌরবে ঘোষিত হত। তবে তন্ত্রের প্রবেশে বৌদ্ধধর্মের মূলসুরটি গেল কেটে। দেহতত্ত্বের নামে নানা কদর্য আচার প্রবেশ করল ধর্মে। হয়ত সেইসময়ে এ ধর্মের বিনাশকাল চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল। সেন রাজারা সুদূর কর্ণাটক থেকে এসে যখন বাংলা অধিকার করলেন তখন পালযুগ সবে শেষ। পালরাজারা বৌদ্ধ হলেও সকল ধর্মে তাঁদের উদার দৃষ্টি ছিল। কিন্তু সেনরাজাদের সেই দূরদৃষ্টির অভাব বাংলার মানুষদের সঙ্গে তাঁদের এক হতে দিলনা। সঙ্কীর্ণ ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বাঙালি জাতির মধ্যে জাতিগত সঙ্কীর্ণতা, অস্পৃশ্যতা ইত্যাদি প্রবিষ্ট করলেন। ধীরে ধীরে বিষবৃক্ষ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। আমরা সেইসব প্রাচীন বঙ্গীয় জনগনকে সমাজের নীচু, অশিক্ষিত, দরিদ্র ও হীনকর্মে প্রবৃত্ত মানুষ বলে দাগিয়ে দিলাম। এখনও সেই ট্র্যাডিশন চলছে। এখনও যেন উপলব্ধির সময় আসেনি যে, আমরা সমগ্রতার মাধ্যমেই হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারি। শ্রীমতী থাপার দুঃখ প্রকাশ করেছেন, যেভাবে সিন্ধুসভ্যতার আবিষ্কার হয়েছিল ভূখণ্ডের সমান্তরাল খননের দ্বারা, সেই একভাবে পূর্বাঞ্চলের ভূমিখণ্ড কেন যে সমান্তরাল খননকার্যের উপযুক্ত বলে মনে করা হলনা! প্রত্নতত্ত্ব তাহলে কিছু খুচরো লম্বখননের দ্বারা প্রাপ্ত নিদর্শনের ওপর নির্ভর করতনা। গাঙ্গেয় ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা জুড়ে একটি সমান্তরাল খননের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা কার্যকরী হলে আমাদের ইতিহাস অন্যরকম হত। এও যে ইচ্ছাকৃত নয় কে বলতে পারে? বারান্তরে এইসব অনার্য জাতির উৎস ও গতি সম্পর্কে একটি রচনার অবতারণা করা যাবে।

এরপরের ইতিহাস আমরা জানি। কিভাবে পালযুগের শেষে উত্তর ভারতে শোনা যাচ্ছিল এক নতুন ধর্মের মানুষের পদধ্বনি। কিভাবে তারা ভারতবর্ষ আক্রমণ করতে ধেয়ে আসছে। সব আমরা জানি। আমরা আরও জানি কি করে সেইসময়ের বাংলায় বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা নিজেদের সমস্ত পুঁথি, সমস্ত আরাধনার ধন গোপন করে ফেলেছিলেন। সর্বজনশ্রদ্ধেয় শ্রীহরপ্রসাদ শাস্ত্রীমহাশয় তিব্বত থেকে বহু বৌদ্ধপুঁথি উদ্ধার করে আমাদের সামনে হাজির করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে কী আত্মিক সম্পদে আমরা সম্পদবান! তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া আলোচকের অসাধ্য। কোনও জাতি আত্মিক বা দার্শনিক ব্যাপারে তখনই মাথা ঘামাতে পারে যখন সে অন্ন বস্ত্র সংস্থানের চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারে।

তাই বাংলা কোনও অরণ্যসংকুল শ্বাপদসঙ্কুল জংলী জাতির বাসভূমি নয়। আর্যরা এসে তাঁদের শিক্ষিত ও সভ্য করেনি। বরং আর্যরাই অসভ্য বর্বর এক যাযাবর উপজাতি ছিল। যারা বসতির জন্যে খাদ্যের জন্যে এই ভূমির শান্তিপ্রিয় বাসিন্দাদের আক্রমণ করেছে। সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে। এই ইতিহাস পুনরুদ্ধারের প্রয়োজন আছে। এই ইতিহাস আবার আমাদের পথপ্রদর্শক হতে পারে।



তথ্য সূত্র

১/ আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত এশিয়া খণ্ডে সংস্কৃত ভাষার প্রসার ও প্রভাব । শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩৫০ সন ।
২/ শ্রীহরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রণীত বৌদ্ধধর্ম- কোথা হইতে আসিল?। ‘নারায়ণ’ পত্রিকা ফাল্গুন চৈত্র ১৩২১।
৩/ Diodorus Siculus (c.90 BC – c.30 BC). Quoted from The Classical Accounts of India, Dr R.C. Majumder, p. 170-72/234.)
৪/ Plutarch (42-120 AD). Quoted from The Classical Accounts of India, p.198
৫/ Megasthenes (c.350 BC-290 BC).Quoted from the Epitome of Megasthenes, Indika. (Diod. II. 35-42.), Ancient India as Described by Megasthenes and Arrian. Translated and edited by J.W. McCrindle
৬/ Ptolemy (2nd century AD). Quoted from Ancient India as Described by Ptolemy, John W. McCrindle, p. 172.
৭/ The Periplus of the Erythraean Sea (1st century AD). Quoted from The Periplus of the Erythraean Sea, Wilfred H. Schoff, p. 47-8.
৮/http://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/Finally-heritage-tag-for-2500-yr-old-Chandraketugarh/articleshow/11531973.cms
৯/“গীতগ্রাম আবিষ্কার”। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা ২ সংখ্যা, ১৩৩৫
১০/ আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বাংলার সংস্কৃতি’ প্রবন্ধ থেকে।
১১/ রমেশচন্দ্র মজুমদার রচিত বাংলাদেশের ইতিহাসঃ প্রাচীন যুগ। কলকাতা ১৯৮৮
১২/ অতুল সুর রচিত বাংলা ও বাঙালীর বিবর্তন। কলকাতা ২০০১
১৩/ সুকুমার সেন রচিত প্রাচীন বাংলা ও বানালী। কলকাতা ১৩৫০ (বাংলা সন)
১৪/ Thapar Romila (2010): Ancient Indian Social History, Some Interpretations. Orient BlackSwan. hyaderabad

[একালের রক্তকরবী বৈশাখ ২০১৭]
0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in






জীবন থেকে হারিয়ে যায় অনেক কিছুই l কালের নিয়মে l তবুও কখনো কখনো মনে হয় কিছু কিছু ঐতিহ্য ধরে রাখার দায় আমাদের ও ছিল l বাঙালী সত্যিই আত্মঘাতী l নাহলে কলকাতার অন্যতম গর্ব পেশাদার রঙ্গমঞ্চ গুলো এভাবে শেষ হয়ে যায় ! গ্রে স্ট্রীট আর কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটের সংযোগে দাঁড়িয়ে থাকা স্টার থিয়েটার l পঞ্চাশের দশক থেকে স্টারের খ্যাতি আকাশ ছুঁতে থাকে l সেই সময়ে স্টারের সত্বাধিকারী সলিল কুমার মিত্র স্টার কে ঢেলে সাজান l প্রথম ঘূর্ণায়মান মঞ্চ তৈরি হয় l উত্তম কুমার সারা জীবনে একটি মাত্র কমার্শিয়াল নাটক করেছিলেন l সেটি হলো শ্যামলী l মূক এক তরুণীর ভূমিকায় সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় l নাটকটি ১৯৫৩ সালের ১৫ই অক্টোবর মুক্তি পায় ও প্রথম দফায় ৪৮৪টি অভিনয় হয় ১৯৫৫ সালের ১৩ই নভেম্বর পর্যন্ত l শ্যামলী থেকেই পেশাদার রঙ্গমঞ্চে বৃহস্পতি শনি রবি ও ছুটির দিন শোয়ের চল শুরু হয় l এই প্রথা পাবলিক থিয়েটারের অবলুপ্তি পর্যন্ত বহাল ছিল l শ্যামলী থেকে যে খ্যাতি ও অর্থপ্রাপ্তি ঘটে তাইতে উত্সাহিত হয়ে সলিল মিত্র আবার স্টারের সংস্কার শুরু করেন l প্রথম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহ স্টার l সেই সময়ে এই সংস্কারের জন্যে পাঁচ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল l কতদুর ভালবাসা থাকলে এ সম্ভব হয় তা দৈনিক বসুমতীতে উচ্ছসিত ভাষায় প্রকাশ পেয়েছিল l এ হেন স্টার থিয়েটার নানা মঞ্চসফল প্রযোজনার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে পরবর্তী দশকে l নীহার রঞ্জন গুপ্তের কাহিনী অবলম্বনে তাপসী নাটক মঞ্চস্থ হয় ১৯৬৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি l এই নাটকে নায়ক দীপকের ভূমিকায় ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় l অত্যন্ত সফল হয় এই নাটক ও l কত পরে ১৯৭৯\৮০ নাগাদ কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে সৌমিত্র নিজের পরিচালনায় করেন নামজীবন l ততদিনে তাঁর চিন্তা ভাবনায় মহান পরিচালক সত্যজিত রায়ের ছাপ সুস্পষ্ট l নাটকের ডিটেলিং দেখলে মনে হতে বাধ্য l অদ্ভুত ভাবে সেসময়ে কারো মনে হয়নি যে পেশাদার রঙ্গমঞ্চে সস্তা হালকা শিল্প রচিত হয় l তৃপ্তি মিত্র প্রথম নায়িকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন সেতু নাটকে l বিশ্বরূপা তে l গ্রুপ থিয়েটারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুখ হয়েছিলেন তিনি l সেতু তেও তাঁর অভিনয় অসামান্য l সেতু বিশ্বরূপায় আর অঙ্গার মিনার্ভায l এই দুটি নাটকে আলোকসম্পাতে ছিলেন তাপস সেন l কী অসাধারণ সাধনা ছিল যে তাঁর l

স্টার থিয়েটারের গৌরবের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে l ১৮৮৮ সালের ২৫শে মে নসীরাম নাটক দিয়ে স্টারের যাত্রা শুরু l স্বয়ং গিরিশচন্দ্র এই নাটকটি নসীরাম ছদ্মনামে রচনা করেন l প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই স্টারেই স্বামী বিবেকানন্দ ভগিনী নিবেদিতাকে একটি অনুষ্ঠানে পরিচয় করিয়ে দেন সুধী সমাজে l সাধারণ রন্গালযের প্রতিষ্ঠা কাল ১৮৭২ l তার মাত্র ষোল বছরের মাথায় স্টার শুরু করে তার জীবন l প্রথম থেকেই স্টারের ভাগ্যে বৃহস্পতি l ১৯৩৮ সাল থেকে প্রায় তেত্রিশ বছর এই রঙ্গমঞ্চের দায়িত্বে ছিলেন সলিল কুমার মিত্র l এই সুদীর্ঘ তেত্রিশ বছরে স্টারে কত যে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে তা বলার নয় l এইসব নাটকের কুশীলবরা জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছিলেন l সলিল কুমার মিত্র প্রথম কর্মীদের জন্যে প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু করেন l স্টারের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে থিয়েটারের প্রতি অকুণ্ঠ দরদ নিয়ে পরিচালক, কতৃপক্ষ, শিল্পী ও কলাকুশলীরা সফল ও শিল্প গরিমায় উজ্জ্বল নাটক একাদিক্রমে উপহার দিয়ে গেছেন l তাই বড় রকমের বিপর্যয় স্টারের ভাগ্যে জোটেনি l কিন্তু হঠাতই সলিল মিত্র স্টারের দায়িত্ব রঞ্জিত পিকচার্স এর হাতে তুলে দেন l কারণ সম্পূর্ণ অজ্ঞাত l দিনটা ছিল ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের ৩১শে মার্চ l রঞ্জিতমল কাংকারিযা হন নতুন মালিক l বলা যায় স্টারের সৌভাগ্য লক্ষ্মী সেদিনই বিদায়ের লগ্ন স্থির করে ফেলেন l ধীরে ধীরে মানের অবনতি ঘটতে থাকে l নাট্যকার দেবনারায়ন গুপ্তের শেষ নাটক জনপদবধু অভিনীত হয় ১৯৭৩ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর। পারিবারিক উপভোগ্য কাহিনীর নাট্যকার হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। ১৯৭৪ থেকে রঞ্জিতমল নিজেই সব দায়িত্ব নিয়ে ভাড়া করা লোক দিয়ে নিজের নামে নাটক রচনা, নির্দেশনার সব কাজ করাতেন। ১৯৮০ থেকে নাটকের মানের অবনতি ঘটতে থাকে। ১৯৮৭তে টগরী নাটক দিয়ে রঞ্জিতমলের অধ্যায় শেষ হয়। ১৯৯১তে যখন স্টারে আগুন লাগে তখন স্টার ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি ওখানে ঘটক বিদায় নাটক করছিলেন। ১৯৭৪, ওই সময়ে মাত্র দশ কি এগারো হব, দেখেছিলাম পরিচয় বলে একটি নাটক l শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় ও শমিতা বিশ্বাস ছিলেন মুখ্য ভূমিকায় l অভিনয় ভালো হলেও বড়দের মুখে শুনেছি নাটক রসোত্তীর্ণ হয়নি l বিশেষ সেই সময়ে উৎপল দত্তের লিটল থিয়েটার, অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়ের নান্দীকার একের পর এক মননশীল নাটক মঞ্চস্থ করে চলেছে l তখনও নাটক দেখার অনুমতি জোটেনি l তবু রবিবার বা ছুটির দিনে সকালে স্টারে অফিস রিক্রিয়েশন ক্লাবের নাটক বৈকুন্ঠের উইল দেখেছিলাম l সরযু দেবী ছিলেন নাটকে l তিনি নাট্যজনের এতই শ্রদ্ধার পাত্রী ছিলেন যে শিল্পীরা তাঁকে সরযু মা বলে ডাকতেন l আমাদের খেলাধুলার জন্যে কাছাকাছি গোয়াবাগান পার্ক ছাড়া মাঠ ছিলনা l নানারকম নেশাভাঙ জনিত দুষ্কর্ম চলত বলে সেখানে যাওয়া মানা l ফলে স্টারের পেছনে স্টার লেন, রাজাবাগান, ক্ষুদিরাম বোস রোড এইসব এলাকায় ছোটাছুটি করে খেলতাম l বড় রাস্তায় যেতাম না l তবুও থিয়েটার আরম্ভ আর ভাঙার সময় স্টারের আশেপাশে যাওয়া বারণ ছিল l ভিড়ে হারিয়ে যেতে পারি এমন আশঙ্কা ছিল হয়ত l স্টারের গায়ে গ্রে স্ট্রীট ঘেঁষে একটা আতর আর জর্দার দোকান ছিল l ছেলেবেলায় সেইটি ছিল প্রবল আকর্ষণ l দোকানের সামনে ফুটপাতে দাঁড়ালে সুবাসে মাথা ঝিমঝিম করত l একটা বিষয় লক্ষণীয় যে স্টারে কখনই ক্যাবারে গার্ল দিয়ে তথাকথিত বস্ত্রবিপ্লব ঘটিয়ে বাজার ধরার চেষ্টা হয়নি। মানের অবনতি সত্বেও সুস্থ রুচির নাটক উপস্থাপনার চেষ্টা হত।



এখানে একটু বলা প্রয়োজন যে সে সময়ে কিভাবে এইসব থিয়েটার গুলো চালানো হত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হলমালিকের থেকে লিজে বা ভাড়ায় কেউ হল নিয়ে পরিচালনার দায়িত্বে থাকতেন। তিনিই থিয়েটার কোম্পানির কর্ণধার। থিয়েটারে অভিনেতা অভিনেত্রীরা বাঁধা মাইনেতে কাজ করতেন। বহু সময়ে কর্ণধার নাটক পরিচালনার দায়িত্বেও থাকতেন। নাট্যকারকে শো পিছু রয়্যালটি দেওয়া হত। কোনও কোনও সময়ে নাট্যকারকে মাইনে দিয়ে রাখার ঘটনাও ঘটেছে। পরিচালক তাই নানাপ্রকারে সফল ও জনমোহিনী নাটক মঞ্চস্থ করতে চেষ্টা করতেন। বিভিন্ন সময়ে দেখা যায় যে কুশীলবদের জমকালো পোশাক, অনর্থক নাচ গান, বা মঞ্চে মায়াজাল, ইংরেজিতে যাকে বলে ইল্যুশন, সৃষ্টি করে দর্শকের চিত্তজয়ের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এসব সমালোচিত হয়েছে বারবার। কারণ এসবই মূল নাটক ও অভিনয় থেকে দর্শকমনের একাগ্রতা হরন করে। উদাহরনে বলা চলে অঙ্গার নাটকের শেষ দৃশ্যটি। দৃশ্যটি বড়ই ট্র্যাজিক। কয়লাখনির খাদের মধ্যে কয়েকজন কর্মী আটকে পড়েছে। এদিকে হু হু করে জল বাড়ছে খাদে। অবশেষে এই জলের মধ্যে ডুবে তাদের মৃত্যু হোল। দৃশ্যটি তাপস সেন অদ্ভুত নৈপুণ্যে নির্মাণ করেন। মঞ্চের ভেতর খাদের জল বাড়ার দৃশ্য এত অপূর্ব হয়েছিল যে হল হাততালিতে ফেটে পড়ত। মাঝ থেকে যে মর্মান্তিক দৃশ্যে মানুষ মরছে সেই ট্র্যাজেডি কেউ অনুভব করতনা। সব ছাপিয়ে তাপস সেনের আলোর কারসাজি মুগ্ধ করত দর্শককে। বলা ভালো স্বয়ং নাট্যাচার্য শিশির কুমার মঞ্চে ইল্যুশনের পক্ষপাতী ছিলেন না। সুতরাং আধুনিক নাটকের আঙ্গিক ও প্রয়োগ নিয়ে যত কথাই হোক না কেন এসবে পেশাদার রঙ্গমঞ্চের ভুমিকা যে অনস্বীকার্য তা স্বীকার করে নেওয়াই ভালো। এই যে থিয়েটার, এর দর্শক কারা ছিলেন, জানলে এখনকার প্রযোজকরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন। এখন যখন হলে দর্শক টানার হাজার চেষ্টা করেও হাউসফুল বোর্ড ঝোলানো প্রায় মিথ তখন থিয়েটার পাড়ায় দিনের পর দিন হলগুলোতে হাউসফুল বোর্ড ঝুলত। অগ্রিম কাউন্টারেই টিকিট নিঃশেষ হয়ে যেত। শুধু যে কলকাতার লোকজন বা কাছাকাছি মফস্বলের লোক আসত নাটক দেখতে তা মোটেই নয়। অনেক দূর থেকেও মানুষ আসত নাটক দেখতে। পুজোর কেনাকাটার সঙ্গে নাটক দেখা অবিচ্ছেদ্য ছিল। নিজের পরিবারেও দেখেছি বার্ষিক ছুটিতে আসা দূরাগত আত্মীয় স্বজন ভ্রমণসুচীতে নাটক দেখা ও রেখেছেন। নামী শিল্পী, অনবদ্য অভিনয়, অপূর্ব আলোক সম্পাত, নাটকের আবেদন ইত্যাদি ইত্যাদি খবরের কাগজ বাহিত হয়ে শুধু মফস্বল নয়, দূর প্রবাসেও ছড়িয়ে পড়ত। ফলশ্রুতি এই বিপুল দর্শক সমাগম। একেবারে শুরুর দিকে সম্পন্ন গ্রামীন ভদ্রলোকেরাও আসতেন। হোটেলে থেকে থিয়েটার আর কালীঘাট ঘুরে যেতেন। ক্রমশ গণ্ডী সংকুচিত হতে থাকে। অবশ্য সত্তরের দশক পর্যন্ত এই ঢল অব্যাহত ছিল। তবে পেশাদার রঙ্গমঞ্চে বিপুল মুনাফার চিত্র কখনই ধরা পড়েনি। অনেক আগে দর্শক টানতে নাটক নামান হত পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে। যাতে তার জাঁকজমকে মানুষ আকৃষ্ট হয়। হতও হয়ত। তবে নাটক নামাতে যে পরিমাণ ব্যয় হত, সেট পোশাক ইত্যাদি জনিত, তার খুব স্বল্প অংশই উঠে আসত। মাঝে কিছু ব্যতিক্রম আছে। কিন্তু তা কখনই সামগ্রিক চিত্র নয়। স্টারের পর আলোচনায় রাখলাম মিনার্ভাকে। যদিও এই অতীতচারিতা বিভিন্ন দিকে ছুটে যাচ্ছে বারবার, কিন্তু তা খানিকটা স্বেচ্ছাকৃত। সামগ্রিক ছবি ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস মাত্র। ১৮৯৩ সালে ৬নং বিডন স্ট্রীটের গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রেক্ষাগৃহ নিশ্চিন্হ হয়ে গেলে প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের দৌহিত্র নগেন্দ্রভূষণ মুখোপাধ্যায় ওই জমির ওপর মিনার্ভা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। ২৮শে জানুয়ারী সেকশপীয়ারের ম্যাকবেথের মঞ্চরুপ নিয়ে গিরিশচন্দ্র মিনার্ভার দ্বারোদঘাটন করেন। এরপর ৫ই ফেব্রুয়ারী মুকুল মঞ্জুরা, ২৫শে মার্চ আবু হসেন, ও ২৩শে ডিসেম্বর জনা, প্রভৃতি বিখ্যাত নাটকগুলি অভিনীত হয়। এরপর ১৮৯৫ সালের গিরিশচন্দ্র আবার (আগে স্টারে অভিনীত) প্রফুল্ল নাটকটি নঞ্চস্থ করেন। নাটকে তিনি যোগেশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁর অভিনয় এতই অনবদ্য হয়েছিল যে নট-নাট্যকার অপরেশচন্দ্র তাঁর রঙ্গালয়ে ত্রিশ বছর বইতে লিখেছেন, - গিরিশের যোগেশের পাশে অমৃতলালের (স্টারে অমৃতলাল যোগেশ সাজতেন) যোগেশ হীনপ্রভ হইয়া পড়িল। মনে হইল একজন যথার্থ যোগেশ, আর একজন যোগেশ সাজিয়াছেন। এরপরই ১৮৯৬ সালের ২৩শে মার্চ গিরিশ মিনার্ভার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করেন। এই সময়ে অর্ধেন্দুশেখর মিনার্ভার দায়িত্ব নেন। এরপর গিরিশচন্দ্র আবার এক বছরের জন্য মিনার্ভায় ফেরেন। মিনার্ভার ইতিহাস বড়ই উথাল পাথাল। অনেকগুলি নাটক কিন্তু এই অস্থির সময়ের মধ্যেও অভিনীত হয়। ১৯০৪ সালে অমরেন্দ্রনাথ দত্ত মিনার্ভার দায়িত্ব দেন বন্ধু চুনীলাল দেবকে। এরপর মিনার্ভার লিজ হস্তান্তরিত হয় মনোমোহন গোস্বামীর হাতে। এত কিছুর মাঝেই মিনার্ভায় গিরিশচন্দ্রের বলিদান ও সিরাজউদৌলা, দ্বিজেন্দ্রলালের রাণা প্রতাপ সিংহ নাটক মঞ্চস্থ হয়। অথচ দেখতে পাচ্ছি যে এর মাঝে হাইকোর্ট নিযুক্ত মিনার্ভার রিসিভার শেলী ব্যানার্জি মিনার্ভা নিলামে দিলেন। গিরিশচন্দ্রের বুদ্ধিতে মনোমোহনবাবু ষাট হাজার টাকায় থিয়েটারটি কিনে নেন। এরপর নানা মালিকানা, অংশীদারি পরিচালনার চক্রে পড়ে অবশেষে ১৯২২ সালে মিনার্ভা আরও একবার ভীষণ আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায়। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে এভাবে পুড়ে যাওয়া কোনও নতুন ট্রেন্ড নয়। আজ যখন স্টার রংমহল, বিশ্বরুপা আগুনে পুড়ে তাদের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিচ্ছে তখন আমাদের মতন কিছু স্পর্শকাতর, অতীতবিলাসী বাঙালি ভাবছি এ কী হোল! এমন করে অস্তিত্বের বিলুপ্তি! আরও কিছু বছর পরে তো সমসাময়িক প্রজন্ম জানতেই পারবেনা যে পেশাদার রঙ্গমঞ্চ বলে কিছু ছিল আর বেশ কিছু মানুষ সেই সব রঙ্গমঞ্চে কী অদ্ভুত ভালবাসায় দারিদ্র ভুলে, অপমান ভুলে দিনের পর দিন ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন। নাটকের ইতিহাস। শুধু মনে হয় আর একটু সচেতনতা দরকার ছিল বোধ হয়। যাই হোক তবু মিনার্ভা চলতে থাকে। ১৯৫১ সালেও দেখতে পাই শরৎচন্দ্রের চন্দ্রনাথ অভিনীত হয়। এই নাটকের প্রধান তিনটি ভূমিকায় অহীন্দ্র চৌধুরী, ছবি বিশ্বাস ও সরযূ দেবী অভিনয় করেন। ১৯৫৩ সালে মিনার্ভার দুঃসময়ে রাসবিহারী সরকার এসে দাঁড়ান মিনার্ভার পাশে। থিয়েটার হলটি ভাড়া নিয়ে মঞ্চস্থ করেন ঝিন্দের বন্দী। নাটকটি অসাধারণ জনপ্রিয় হয়। অনেকেই মনে করেন এই নাটক নাটকের ইতিহাসে একটি মাইলস্টোন। পঞ্চাশের দশকে বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠীও এখানে নাটক করেছেন। রক্তকরবী মঞ্চস্থ হয়। তবে ব্যবসায়িক থিয়েটারের সঙ্গে পাল্লা না দিতে পেরে ছেড়ে দিতে হয় এই মঞ্চ। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত উৎপল দত্তের লিটল থিয়েটার মিনার্ভাতে নাটক করে। শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে যে, উৎপল দত্তের অধিনায়কত্বে লিটল থিয়েটার মিনার্ভায় নিয়মিত অভিনয় শুরু করে। ১৯৫৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর প্রথম অভিনীত হয় অঙ্গার। পণ্ডিত রবিশঙ্কর সুর সংযোজনায়। আর তাপস সেনের সেই ঐন্দ্রজালিক আলোকসম্পাত। অত্যন্ত জনপ্রিয়তার সঙ্গে অঙ্গার দু বছর ধরে চলে। এরপর আসে ফেরারী ফৌজ। এতেও তাপস সেন স্বীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। বলা যেতে পারে লিটল থিয়েটারের আগমনে মিনার্ভা আবার প্রাণ ফিরে পায়। উৎপল দত্ত পরপর অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম, সেকস্পীয়ারের চারশ বছরের জন্মোৎসব উপলক্ষে A Midsummer Night’s Dream অবলম্বনে চৈতালি রাতের স্বপ্ন, ওথেলো, জুলিয়াস সীজার, প্রভৃতি নাটক উপহার দিতে থাকেন। অবশেষে জাহাজের নাবিক বিদ্রোহের পটভূমিকায় কল্লোল মঞ্চস্থ হয়। নাটকের নির্মাণেও বিপ্লব ঘটে যায়। এখানে বরং উৎপল দত্ত সম্বন্ধে দু চার কথা বলে নেওয়া যাক। কী বলেছিলেন তিনি যখন কল্লোল বিরূপ সমালোচনায় বিদ্ধ হয়? বলছেন – কলকাতার দৈনিক পত্রিকাগুলোর নাট্যসমালোচকবৃন্দ থিয়েটার নাটক বা অন্য কলাবিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞানের জন্য বিশেষ পরিচিত নন। কিন্তু তারা বরাবরই তাদের প্রভুদের সেবাদাসত্বে সমর্পিতপ্রাণ বিশ্বস্ত সৈনিক। এরাই কল্লোল নাটকের সমালোচনার নামে যেমন খুশি কাল্পনিক গুঁতোগুঁতি শুরু করেছেন। চীনাদের বিরুদ্ধে প্রবল জাতিগত বিদ্বেষের কারণে আমরা কল্লোল নাটকে এদের ঢুকতে দিইনি। কিন্তু এদের প্রভুদের নির্দেশে এরা টিকিট কেটে ঢুকলেন এবং সমালোচনার নামে ইতিহাসের অজ্ঞাত সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে দুঃসাহস দেখালেন। (Towards a revolutionary theatre) . এমন কড়া সমালোচনা স্বয়ং নির্দেশক করছেন এ একমাত্র উৎপল দত্তের সিগনেচার উবাচ। এই আধুনিকতায় দাঁড়িয়েও কিন্তু এই বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব পূর্বসূরিদের প্রতি তাঁর চরম শ্রদ্ধা রেখে গেছেন। ভিত তৈরি নাহলে যে কিছুই হতনা। দেখা যাক তাঁর শ্রদ্ধা নিবেদনের ভঙ্গীটি। “এটা অনস্বীকার্য যে নবাব বাদশাদের দরবারে যেমন রাগসঙ্গীতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুশীলন হত বা উচ্চতম স্তরের শেরেশায়েরি হত, সেটা এইসব নয়া ব্যবসায়ীদের বিশৃঙ্খল মাতাল আসরে সম্ভব ছিলনা। কিন্তু এইসব আসরে জনতার প্রবেশাধিকার ছিল। যা বাদশার দরবারে জীবনে কখনও হবার আশা ছিলনা। এভাবে শিল্পের গনতন্ত্রীকরন হল, এবং এটি বুর্জোয়াদের আঘাতে সৃষ্ট। এভাবে কাব্য সঙ্গীত অভিনয়ের বৃহৎ এক দর্শকগোষ্ঠী তৈরি নাহলে বাংলা থিয়েটারের জন্মই হতনা। গিরিশবাবুরা সাহস করে টিকিট বেঁচে নাটক করার কথা ভাবতেই পারতেন না। দর্শকদের চাহিদা মেটাতে গিয়েই পেশাদার নাট্যশালার সৃষ্টি হয় সারা দুনিয়ায়। এবং রাজা রাজড়াদের একচেটিয়া অধিকার ভেঙে নাটক ও সঙ্গীতকে আপামর জনতার নাগালের মধ্যে আনে বুর্জোয়ারাই” (আশার ছলনে ভুলি)। তবে এই সাধারণ জনের কাছে তুলে ধরা সত্বেও নাটকের কলাকে যে বরেন্যজন চেষ্টা করে গেছেন উচ্চতর শিল্পে উন্নীত করতে সেও তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেছেন যখন তিনি গিরিশচন্দ্রের মঞ্চসজ্জা নিয়ে বলছেন – গিরিশবাবু অবশ্যই মঞ্চকৌশলের ক্ষেত্রে নতুন যুগের প্রবর্তক। ধরা যাক তাঁর কমলে কামিনী নাটক। সমুদ্রযাত্রার দৃশ্যে মঞ্চ জোড়া বিশাল তরণীতে শ্রীমন্ত সওদাগর ও নাবিকরা। পিছনে দৃশ্যপটটা সচল। সামুদ্রিক ঝড়ও দেখানো হয়েছিল মঞ্চে। গিরিশের প্রায় সব নাটকেই মঞ্চ কৌশলের সচেতন উপস্থিতি আমরা লক্ষ করি। শঙ্করাচার্য চলেছেন আর নদীর স্রোত তাঁকে অনুসরণ করছে, বা জনা নাটকে অকস্মাৎ গাছে আগুন জ্বলে ওঠা এবং দেখতে দেখতে পত্রপুষ্পহীন দগ্ধ বৃক্ষকাণ্ডের দাঁড়িয়ে থাকা – এ সবে শুধু মঞ্চনিপুণ গিরিশকে পাইনা, পাই কবি গিরিশচন্দ্রকে (আশার ছলনে ভুলি)। অথচ এই মানুষটিই নিজের অনুপম প্রয়োগের কৌশল বলতে গিয়ে বলছেন – থিয়েটার এবং দর্শক পেলে আমি যবনিকা বাদ দেব। তারপরে বাদ দেব উইংস বর্ডার প্রভৃতি। তারপর হটাবো সীন জাতীয় জিনিস। মেঝেটাকে নানা আকারের বেদী দিয়ে ভরে দেব। এলোমেলো শ্রমিক এদিক ওদিক সিঁড়ি দিয়ে ... অভিনেতা যাতে চলতে গেলেই সিঁড়ি ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। ঝড় বোঝাতে ব্যবহার করব ক্রেস এর আঁকা কালো রেখা কাঁটা পর্দা বা ব্রেশট বর্ণিত বিদ্যুৎ আঁকা পর্দা। জল বোঝাতে ব্যবহার করব নীল পোশাক পরা জনা কুড়ি নর্তকী। আগুন বোঝাতে হয়ত উদয়শংকর প্রচলিত কিছু লাল রিবন নাড়াবো। বৃষ্টি বোঝাতে ছাতা খুলে ধরব। যুদ্ধ বোঝাতে পর্দা আর বেদীগুলো নাড়াবো ভীমবেগে (চায়ের ধোঁয়া)। এই উত্তরণ অনুশীলন যোগ্য। মিনার্ভা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে এই তথ্য উদ্গীরনে আমার ব্যক্তিগত আবেগ নিঃসন্দেহে কাজ করেছে। নাত্যশিল্পের একশ বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে মিনার্ভায় পা রেখেছেন প্রতিটি যুগের প্রায় প্রতিটি কিংবদন্তী নাট্যব্যক্তিত্ব। মিনার্ভার জীবনযুদ্ধ যতই প্রবল হয়েছে ততই সফল হয়েছে সেখানে প্রতিভার বিকাশ। আর শেষ পর্যন্ত উৎপল দত্তের আবির্ভাবে মিনার্ভা মুছে দিয়েছে পেশাদার নাটক ও গণনাট্যের বিভাজন। বড় অদ্ভুত এই বিভাজন। শেষকথা তাত্বিকেরা বলবেন, আমার সীমাবদ্ধ বোধে মনে হয় কমার্শিয়াল থিয়েটার রুজির জন্য, মুনাফার জন্য শিল্পের শর্তের সঙ্গে কোথাও একটা আপস করে, যেটা গ্রুপ থিয়েটার করেনা। যদিও বর্তমানে এ ধরনের আলোচনাই চলেনা। শিল্প মানোত্তীর্ণ কিনা বলার সময়ে বন্ধুদের মধ্যে এধরনের উক্তি করে বড়ই বিপদে পড়েছি। হয়ত ব্যাখ্যা দিয়েছি যে এ শিল্প মেধা বা মননের কাছে আবেদন রাখেনি, এর আবেদন নিতান্তই জৈব। তখন দেখেছি সেই ছোট আলোচনা সভাতেও বিরুদ্ধ মত উঠে এসেছে। শিল্প শিল্পই। তার ভালো খারাপ হতে পারেনা। শিল্প সমাজ জীবনের প্রেক্ষাপট। সমাজ যদি আদর্শহীনতা ও অবক্ষয়ের শিকার হয় তবে শিল্পে তার প্রভাব পড়বেই। এখন আমিও এ প্রসঙ্গে সহমত।



কথায় বলে ধান ভানতে শিবের গীত! সেইরকম রঙ্গমঞ্চের ধ্বংসের ইতিহাস বলতে গিয়ে নাট্যজগতের মানুষজনের কথা এসে যায়। এসে যায় তাঁদের কথা যারা নাটকের ইতিহাসে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন। সেটা স্বাভাবিক। কারণ নাটক ছাড়া নাট্যশালার কিবা অস্তিত্ব! শুরু করা যাক আরও একটি ঐতিহ্যশালী রঙ্গমঞ্চের কথা। রঙমহল থিয়েটার। স্টারের ফুটপাত ধরে কলেজ স্ট্রিট মুখো হাঁটতে শুরু করলে কিছুটা গেলে একই দিকে পড়বে রঙমহল থিয়েটার। ১৯৩১ সালের ১৭ই বৈশাখ ৬৫/১ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে এই নাট্যশালার উদ্বোধন হয়। একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলি, নাট্যাচার্য শিশির কুমার এর কিছুদিন আগেই দলবল নিয়ে আমেরিকা সফরে যান। এখন যারা নাটক করেন আশা করি আশা করি তাঁরা সকলেই এ বিষয়টি অবগত আছেন। পূর্বসূরিদের কাছে আমাদের যে কত ঋণ! রঙমহল উদ্বোধন করেন নট-নাট্যকার অপরেশচন্দ্র লাহিড়ী। এই সময়ে শিশির কুমার ও সতু সেন আমেরিকা থেকে সদ্য ফিরেছেন। সতু সেনকে তাপস সেনের পূর্বসূরি বলা চলে। তিনি তখন অসামান্য দক্ষতায় শিল্প নির্দেশনা ও আলোক সম্পাতের কাজ করছেন। ১৯৩১ সালে নাট্যনিকেতনে অভিনীত ঝড়ের রাতে নাটকে সতু সেনের এই অদ্ভুত আলো ও মঞ্চ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। শ্রীযোগেশ চৌধুরীর পরিচালনায় রঙমহলে প্রথম শ্রীশ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া নাটক মঞ্চস্থ হয়। তারপর ১৯৩৩ সালে শিশিরকুমার মহানিশা নাটকের পরিচালনার দায়িত্বে। মঞ্চ ও আলো সতু সেন। সতু সেন প্রথম এই থিয়েটারে ঘূর্ণায়মান মঞ্চ তৈরি করেন। সে সময়ের নিরিখে এই কাজ একান্তই বৈপ্লবিক। তখন এত টেকনোলজির উন্নতি হয়নি। এই নাটকটিও নাটকের ইতিহাসে এক মাইলস্টোন। ১৯৩১ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত রঙমহলে বিভিন্ন বিখ্যাত পরিচালক ও নটনটীদের নিয়ে বহু সার্থক নাটক মঞ্চস্থ হয়। যোগেশচন্দ্র চৌধুরীর নাট্যরূপে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিটেকটিভ, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের স্বামি স্ত্রী ও তটিনী বিচার, বিধায়ক ভট্টাচার্যের মেঘমুক্তি, মাটির ঘর, বিশবছর আগে, প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের রত্নদীপ-নাটক বিধায়ক ভট্টাচার্য, প্রভৃতি মঞ্চস্থ হয়। এরপর রঙমহলের দরজা বন্ধ হয়। আবার জুন মাসে যামিনী মিত্র দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কে নিয়ে রঙমহলের দরজা খোলেন। বিধায়ক ভট্টাচার্যের রক্তের ডাক, তুমি ও আমি মঞ্চস্থ হয়। কিন্তু যামিনী মিত্র দায়িত্ব ছেড়ে দেন। ১৯৪২ থেকে ৪৭ এর মধ্যে রঙমহলে অভিনীত অনেক নাটকের মধ্যে রামের সুমতি, সন্তান, বাংলার প্রতাপ, রাজপথ, এবং সেই তিমিরে রঙমহলের আর্থিক সাফল্য এনে দেয়। অহীন্দ্র চৌধুরী, জহর গাঙ্গুলি, নিরমলেন্দু লাহিড়ী, সন্তোষ সিংহ, মিহির ভট্টাচার্য, রানীবালা, সুহাসিনী, প্রমুখ বিশিষ্ট অভিনেতা অভিনেত্রী তখন রঙমহলের সাথে যুক্ত। কিন্তু অভিনেতা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন রঙমহলের লেসী রূপে যথেষ্ট দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে কাজ করলেও তাঁর বেহিসেবী খরচে বিপুল ঋণভারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। নটসূর্য অহীন্দ্র চৌধুরী তখন নিজের উদ্যোগে একের পর এক নাটক নামান। রিজিয়া ও মেবারপতন দারুন সফল হয় তবুও শরৎচন্দ্র সম্পূর্ণ ঋণমুক্ত হতে পারলেন না। কোর্টের আদেশে তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হন ও তাঁকে থিয়েটারের কর্তৃত্ব ছাড়তে হয়। সীতানাথ মুখোপাধ্যায় এরপর রঙমহলের ভার নেন। তাঁর আমলে দেবনারায়ন গুপ্তের নাট্যরূপে নিষ্কৃতি নাটক উল্লেখযোগ্য। অভিনয় হয় ১৯৫০ সালের ২রা অক্টোবর। এই নাটকের আর্থিক সাফল্য রঙমহলে স্বচ্ছলতা এনে দিলেও মামলা পিছু ছাড়েনা। ১৯৫৪ সালে জিতেন বসু ও বিঠল ভাই মানসাটা থিয়েটারের লেসী হন। সেই বছরে নভেম্বরে ডঃ নীহাররঞ্জন গুপ্তের উল্কা মঞ্চস্থ হয়। অত্যন্ত জনপ্রিয় নাটকটি প্রায় দু বছর ধরে চলে। এরপর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পরিচালনায় তারাশঙ্করের কবি। একটা কথা লক্ষ্য কড়া যাচ্ছে যে সেসময়ে বিখ্যাত কথাসাহিত্য থেকে নাটক করার চল ছিল। ১৯৬২ সালে রঙমহলের লেসীদের তরফে কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় যে হল ভাড়া দেওয়া হবে। এমনকি গুজব ওঠে যে এটি সিনেমা হলে রূপান্তরিত হবে। স্বভাবতই নাটকের শিল্পী ও কলাকুশলীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁদেরই অক্লান্ত পরিশ্রমে এতগুলি সফল নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। তাঁরা ডঃ প্রতাপচন্দ্র চন্দ্রের কাছে এব্যাপারে আবেদন জানালে তিনি মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে বিষয়টি জানান। তাঁর মধ্যস্থতায় শেষপর্যন্ত ঠিক হয় লেসীরা অতঃপর শুধু কলাকুশলীদের বেতন দেবেন। নাটকের টিকিট বিক্রির অ্যাঁয় থেকে শিল্পীরা হলভাড়া দেবেন লেসীদের, আর অবশিষ্ট আয় নিজেদের মধ্যে বেতন হিসেবে ভাগ করে নেবেন। নতুন ব্যবস্থায় শিল্পীদের পক্ষে সরযূ দেবী ও জহর রায় এই দায়িত্ব গ্রহন করেন। অর্থাৎ শিল্পীরা নিজেদের রুজি ও নাটক বাঁচাতে লেসীদের এই দাবী শিরোধার্য করার ঝুঁকি নেন। অন্যথায় হল হাতছাড়া হওয়া আটকানো যেতনা। এঁদের প্রথম নাটক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শ হিন্দু হোটেল। ১৯৬২ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি প্রথম অভিনয়। ১৯৬২ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে এই শিল্পীগোষ্ঠী বারোটি নতুন নাটক মঞ্চস্থ করে। এর মধ্যে বিধায়ক ভট্টাচার্যের অতএব, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের নহবত, সুনীল চক্রবর্তীর আমি মন্ত্রী হব, মনোজ মিত্রের বাবাবদল উল্লেখযোগ্য। এরপর ও জহর রায় মৃত্যুকাল পর্যন্ত রঙমহলের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯৭৭ সালের ১লা অগাস্ট পরলোকগমন করেন। বর্তমানে এই থিয়েটার হল আর নেই। এখানে এখন সিগনাম এরিস্ট্রো বলে একটি শপিং মলের নির্মাণ জারি। ২০০১ সালে হলে আগুন লাগে। এর আগে হলটি বিয়েবাড়ি ও প্রদর্শনী উপলক্ষে ভাড়া দেওয়া হচ্ছিল। তদন্তে প্রকাশ যে একটি শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন লাগে। যদিও স্যাবোট্যাজ এর তত্বওঅনেকে সামনে এনেছেন। এতকালে নিশ্চয় সেই হলের পরিবর্তে নতুন দোকানবাড়িটির কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। শুধু এক সময়ের বাংলার সংস্কৃতির পীঠ এই মঞ্চগুলো আর নেই। রঙমহলের জীবনযাত্রা মাত্র সত্তর বছরেই শেষ হয়ে গেল। খুব আশ্চর্য লাগে যখন দেখি অন্য দেশে ঐতিহ্যপূর্ণ কোনও ভবন, যা সেখানকার সংস্কৃতিকে বা ইতিহাসকে কোনও না কোনোভাবে ধনী করেছে, তার সংরক্ষণে সরকার, সাধারণ মানুষ, ও সংশ্লিষ্ট দপ্তর এক সাথে হাতে হাত রেখে কাজ করে চলেছে, সেখানে আমাদের চোখের সামনে সংস্কৃতির ইতিহাস, মানচিত্র সব ধ্বংস হয়ে চলেছে, আমাদের কিছু ভ্রূক্ষেপ নেই। আধুনিক অর্থনীতির গড্ডালিকাতে এক একটি ভোগায়তন জন্মেই চলেছে। যেন আমাদের শুধু চোখ ধাঁধানো পোশাক গয়না জুতো চাই, আসবাবে ঠাসা কামরা চাই, আর পেটে ঢোকানোর জন্য সুখাদ্য চাই। এছাড়া আর কোনও ক্ষুধা নেই, থাকতেই পারেনা।

যে চারটে প্রধান রঙ্গমঞ্চের কথা বলব বলে লেখা শুরু করেছিলাম তার মধ্যে শেষ হোল বিশ্বরুপা। যে নাট্যনিকেতন মঞ্চে ঝড়ের রাতে নাটকে সতু সেন ঝড় তোলেন সেই মঞ্চ শিশির কুমার লিজ নেন ১৯৪২ সালে। নামকরণ হয় শ্রীরঙ্গম। তার আগে ১৯৩২ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে সেখানে ষোলটি নাটক সেখানে অভিনীত হয়। নাট্যনিকেতনের শেষ নাটক তারাশঙ্করের কালিন্দী। তারপরই শ্রীরঙ্গম। সূচনাকাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত অভিনীত নাটকগুলি হোল, মাইকেল, বিপ্রদাস, বিন্দুর ছেলে, ও দুঃখীর ইমান। প্রতিটি নাটকেই প্রায় নাট্যাচার্যর অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর ছিল। শুধু বিন্দুর ছেলে নাটকে শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি অভিনয় করেননি। কিন্তু দারুন ছিল পরিচালনা। ১৯৪৬ এর পর নাট্যাচার্য আর্থিক লাভালাভকে তুচ্ছ করে পরীক্ষামূলক ভাবে কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ করেন। এর মধ্যে দুঃখীর ইমান ও পরিচয় নাটক দুটি উল্লেখযোগ্য। শিশির কুমারের নটজীবনের শেষ ঐতিহাসিক নাটক তখত ই তাউস। এই নাটকে জাহান্দার শাহ্‌র ভুমিকায় তাঁকে মানুষ মনে রেখেছে। বলিষ্ঠ মঞ্চায়ন। দুঃখের কথা হোল পরীক্ষামূলক নাটকের প্রযোজনার ফলে তাঁকে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হোল। ১৯৫৩ সালে প্রশ্ন নাটক মঞ্চস্থ হয়। অহীন্দ্র চৌধুরী, ছবি বিশ্বাস, জহর গাঙ্গুলি, সরযূ দেবী, প্রমুখের প্রবল চেষ্টায়ও নাট্যাচার্য শ্রীরঙ্গমকে ধরে রাখতে পারলেননা। ১৯৫৬ সালে সরকার ব্রাদার্সের হাতে শ্রীরঙ্গমের মালিকানা হস্তান্তর হয়ে যায় এবং তাঁরা হলটিকে নতুন করে ঢেলে সাজান। তাঁদের প্রযোজিত প্রথম নাটক তারাশঙ্করের আরোগ্য নিকেতন। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয়। এখানে উল্লেখের প্রয়োজন আছে যে, নাট্যাচার্য শিশির কুমারের মূল্যায়ন কথাটার অনেক ভার। আমার মত অর্বাচীনের এই ধৃষ্টতা অমার্জনীয়। বরং শ্রদ্ধায় দুটো কথা নিবেদন কড়া যাক। পরবর্তী কালে যারা অপেশাদার রঙ্গমঞ্চেও নাটক নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন, নাটককে একটি জনমোহিনী শিল্পমাধ্যম থেকে মননশীল চারুশিল্পে উত্তরণ ঘটিয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই নাট্যাচার্যের কাছে কোনও না কোনোভাবে ঋণী। ১৯৫৭ সালের ৬ই বৈশাখ মঞ্চস্থ হয় বিধায়ক ভট্টাচার্যের নাটক ক্ষুধা। বিশ্বরুপার দ্বিতীয় নাটক। এই নাটক অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। পরপর অসামান্য সব নাটক নামতে থাকে। এরপরই নামে সেতু। এই নাটকে তৃপ্তি মিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আবার তাপস সেনের সেই দারুন আলোকসম্পাত। মঞ্চের ওপর চলন্ত রেলগাড়ির ইঞ্জিনের আলো বিস্ময়কর রকমের জীবন্ত হয়ে উঠত। একটানা চলার ক্ষেত্রে সেতু রেকর্ড সৃষ্টি করে। ১৯৬৭/৬৮ সাল পর্যন্ত সরকারদের তত্ত্বাবধানে পরপর রঙ্গিনী, এক পেয়ালা কফি, আগন্তুক ইত্যাদি নাটক চলে। আগন্তুক ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রায় দুবছর ধরে চলে। উপরোক্ত শেষ তিনটে নাটকে থিয়েটার সেন্টারের শিল্পীরা অভিনয় করেন। পরিচালনা তরুন রায়ের। বিশ্বরুপায় এরপর রাসবিহারী সরকার সরাসরি পরিচালনায় আসেন। তাঁর প্রথম সফল নাটক বিমল মিত্রের কাহিনী অবলম্বনে বেগম মেরী বিশ্বাস। এখনও যারা স্মৃতিচারণ করতে পারেন সেইরকম প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে তুলে ধরছি এক উদ্ধৃতি। ইনি অন্য কেউ নন, স্বয়ং বিধায়ক ভট্টাচার্যের কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীবিমোচন ভট্টাচার্য। সেতু নাটক চলাকালীন তাঁর অভিজ্ঞতাও কিছুটা ধরা পড়ে।

“কি এমন ছিল পেশাদারী মঞ্চে ? মহিলা অভিনেত্রীদের ছোটরা ডাকতেন মা বলে ,প্রভা মা , আঙ্গুর মা , ইন্দু মা , সরজু মা । আমার নিজের দেখা সেই অন্তরঙ্গ পরিবেশ । এটা পাল্টিয়ে গেল যখন তৃপ্তি মিত্র এলেন সেতু নাটকে অভিনয় করতে। ম্যাডাম ডাক চালু হল ।নতুন নাটক যখন পড়া হত আগের নাটকের সবাই গোল হয়ে বসতেন । নাটক পড়া হয়ে গেলে পরিচালক বলে দিতেন কোন চরিত্রের জন্যে কাকে ভাবা হয়েছে । দেখা যেত কেউ কেউ বাদ পড়েছেন । থিয়েটার এর টাকাটাই তাঁদের স্থায়ি রোজগার ছিল । ফলে বেকার হয়ে যাবার ভয়ে নাট্যকারের কাছে ছুটতেন তাঁরা ।নাট্যকার লিখেও দিতেন কোন ছোট চরিত্র। ব্যাস , অন্তত এক দু বছরের জন্যে নিশ্চিন্ত হতেন তাঁরা”।

রাসবিহারী সরকারের পরিচালনায় শঙ্করের চৌরঙ্গী বিশ্বরুপার আর এক মাইলস্টোন। এ নাটকে প্রথম মঞ্চে ক্যাবারে দেখানো হয়। মিস সেফালি ছিলেন সেই নৃত্যশিল্পী। গল্পের প্রয়োজনে হোটেলে এই নাচের দৃশ্যের অভিনয় হত। এর জন্য চৌরঙ্গীর গায়ে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তকমা লাগে। সে সময়ের কিছু স্মৃতির উল্লেখ করি। বিশ্বরুপা ছিল গ্রে স্ট্রিট থেকে শুরু হওয়া ক্ষুদিরাম বোস রোডের শেষ মাথায়। আমাদের খেলার এলাকায় পড়ে। খেলতে খেলতে কখনও চলে গেছি। ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুযোগে মাঝে মাঝেই গ্রিনরুমে ঢুকে পড়তাম। বলা বাহুল্য শো শুরুর বেশ আগে। তখন মেক আপ চলছে। মনে পড়ে তরুন কুমার তাঁর বিরাট ভুঁড়ি নিয়ে বসে মেক আপ নিতেন। আমি কখনও তাঁর ভুরিতে খোঁচা দিয়ে দেখতে চেয়েছি ওটা সত্যিই ভুঁড়ি, নাকি বানানো। ছোট বেলায় হাটেবাজারে ছবিতে সেই পেট থেকে কলের মতন জল পড়ার দৃশ্য মনে করে ভাবতাম এত বড় ভুঁড়িতে জল না হয়ে যায়না। উনিও স্নেহপূর্ণ প্রশ্রয়ে কখনও কিছু বলেননি। বরং টুকরো টুকরো কথায় গল্প চালিয়ে যেতেন। বাবার বিশেষ বন্ধু ছিলেন অজয় গাঙ্গুলি। তিনিই বরং দেখতে পেলে পাঠিয়ে দিতেন। যাও এখান থেকে। এটা বড়দের জায়গা। তখন প্রাপ্তবয়স্কদের নাটক চলছে। একদিন বাবা কটা সংলাপ লেখা কাগজ হাতে দিয়ে বললেন যা বুড়োদা কে দিয়ে আয়। কিসের সংলাপ আর মনে নেই। তো সেই কাগজের তাড়া নিয়ে গিয়েছি ওঁকে দিতে। উনি বললেন তাই তো তুই এলি তোকে কি দেখাই? বলে মুখের পেশি স্থির রেখে একটা কানকে অদ্ভুত ভাবে নাড়াতে লাগলেন। আমি অবাক। খুব চেষ্টা করলাম নিজেও, যদি পারি। অবশ্যই হলনা। উনি কাছে বসিয়ে বললেন আমি তো বুড়ো, আমার মতন বুড়ো হ তখন পারবি। ছোট বেলা থেকে কত কানমলা খেয়েছি, তাইতেই কান লুজ হয়ে গেছে। আমি কি জানি কি খেয়ালে হঠাৎ বলে বসলাম তোমার দাদাকে একদিন দেখাবে? তাঁর সে কি হাসি! বললেন তুইও আমার দাদাকে দেখতে চাস? এই জন্মালি যে রে! তখন ধারণাই ছিলনা যে এঁরা সেলিব্রিটি। তাঁদের ব্যবহারে তা কখনও প্রকাশ পেতনা।

মানিকতলা খালের পাশে আর একটি মঞ্চ ছিল। নাম কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ। ১৯৫৩ সালে তৈরি মঞ্চতি ১৯৫৭ সালে নট নাট্যকার মহেন্দ্র গুপ্ত এই মঞ্চে অভিনয় শুরু করেন। তাঁর পরিচালনায় রাজা রামপাল ও শাপমুক্তি নাটক মঞ্চস্থ হয়। ১৯৬৬ সালে নান্দিক গোষ্ঠী বিধায়ক ভট্টাচার্য রচিত এন্টনি কবিয়াল মঞ্চস্থ করেন। বলা চলে এই নাটকের হাত ধরেই কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ নাট্যামোদীদের কাছে পরিচিতি লাভ করে। নাটকে অভিনয় করেন এন্টনির ভূমিকায় সবিতাব্রত দত্ত, সৌদামিনী কেতকী দত্ত ও ভোলা ময়রা জহর গাঙ্গুলি। গান এ নাটকের বিশেষ সম্পদ। আড়াই বছর চলেছিল নাটকটি। এরপর নটী বিনোদিনী, মুখোশের আড়ালে, দয়াল অপেরা ইত্যাদি নাটক মঞ্চস্থ হয়। ১৯৭২ সালে হরিদাস স্যান্যাল এই মঞ্চ ভাড়া নেন। জরাসন্ধের মল্লিকা মঞ্চস্থ হয়। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ছিলেন নামভূমিকায়। তাঁর মর্মস্পর্শী অভিনয় যারা দেখেছেন কখনও ভোলেননি। এই নাটকের একটি দৃশ্যের কথা বলি। জ্ঞানেশ মুখার্জি বাবা। তিনি একটি চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। তাঁর ছেলে অনুপ কুমার। বেকার। ছেলের ক্রিকেট খেলার ঝোঁক। তার হাতে একটা ক্রিকেট ব্যাট। সে দাঁড়িয়ে আছে বাবার চেয়ারের পেছনে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে শ্যাডো প্র্যাকটিস করে চলেছে। বাবা একটি একটি করে প্রশ্ন করে চলেছেন আর ছেলে প্র্যাকটিস করতে করতে তার উত্তর দিচ্ছে। ক্রমশ প্রশ্ন তীক্ষ্ণ হচ্ছে। বেকার ছেলে। সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হাতের ব্যাট থামছেনা অথচ বডি ল্যাংগুয়েজে যন্ত্রণা ফুটে উঠছে। ভোলবার নয় সে দৃশ্য। বহুদিন চরিত্রটির জন্যে মনে কষ্ট পোষা ছিল। এর বেশ ক বছর পর সৌমিত্র করেন নামজীবন। প্রায় এই সময়েই প্রতাপ মঞ্চে অসীম চক্রবর্তী পরিচালিত সুবোধ ঘোষের বারবধূ মঞ্চস্থ হয়। কেতকী দত্ত ছিলেন মুখ্য ভূমিকায়। এ নাটকটিও প্রাপ্তবয়স্ক তকমাধারী ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে অসীম চক্রবর্তী নাটকে প্রথম পাশ্চাত্য ভাবধারায় অণুপ্রানিত বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে সেই সব নাটক সেসময়ে দর্শক আনুকুল্য পায়নি। তিনি যখন বারবধূ করেন তখন সুবোধ ঘোষের এই গল্পটিকে ভুলে মানুষ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এই নাটক দেখতে ভিড় জমায়। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে অপসংস্কৃতির অভিযোগে নাটকটি বন্ধ করে।

১৯৭০ সালে রাজা রাজকিশন স্ট্রিটে রঙ্গনা নামে আর একটি মঞ্চ স্থাপিত হয়। অহীন্দ্র চৌধুরী মঞ্চের নামকরণ করেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেন। এই মঞ্চে নান্দীকার গোষ্ঠী নিয়মিত অভিনয় করতেন। এঁদের প্রথম নাটক তিন পয়সার পালা। তারপর পরপর নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র, মঞ্জুরী আমের মঞ্জুরী, শের আফগান, নটী বিনোদিনী মঞ্চস্থ হয়। নিতান্ত বালিকা বয়স। তবুও এই সব নাটকের কিছু কিছু দৃশ্য মনে পড়ে। মনে পড়ে তিন পয়সার পালায় গান - চেষ্টা করলে হাঙরেরও মুখ দেখতে পাবে। মনে পড়ে নটী বিনোদিনীতে মঞ্চের এক কোণে চেয়ারে গুরমুখ রূপী রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত বসে, আর অপর প্রান্ত থেকে ঠমকে ঠমকে আসছেন বিনোদিনী কেয়া। মনে পড়ে মঞ্জুরী আমের মঞ্জুরীর সেই মনোলগ। কিন্তু বড় অস্পষ্ট। আজ আর অজিতেশ নেই। সেই সব স্বাদ ফিরিয়ে দেবার কেউ নেই। যখন সাংস্কৃতিক মুখ হিসেবে উৎপল দত্ত ও শম্ভু মিত্র কলকাতার রঙ্গমঞ্চে রাজত্ব করছেন তখন লালমাটির দেশ থেকে ঝড়ো হাওয়ার মত অজিতেশ এলেন।

হয়ত সস্তা নাটক হত, পারিবারিক নাটক হত, আবার মননশীল নাটক ও হত, কিন্তু সব শেষে সৃষ্টিশীল কিছু মানুষ থিয়েটার ভালোবেসে কয়েক দশক কলকাতার রঙ্গমঞ্চ মাতিয়ে রেখেছিলেন। এভাবেই স্বল্পস্থায়ী জীবনকাল নিয়ে পেশাদার বঙ্গরঙ্গমঞ্চের শেষঅঙ্ক দেখতে হোল কলকাতার মানুষকে। এ দুঃখ কোথায় রাখি!

ঋণ স্বীকার – বিমোচন ভট্টাচার্য।

বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস – দর্শন চৌধুরী

একশো বছরের নাট্য প্রসঙ্গ – দেবনারায়ন গুপ্ত।

উৎপল দত্তের কিছু রচনা, বিভিন্ন বই থেকে নেওয়া।

[নবাবী বইমেলা সংখ্যা ২০১৮]
0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in







শীতল স্মৃতি 

আমরা যারা দক্ষিণ বঙ্গের এই জনাকীর্ণ শহরের অলিতে গলিতে প্রথম নিঃশ্বাস নিয়েছি , এবং হয়ত শেষ নিঃশ্বাস ও নেবো , তাদের কাছে শীত একটা উৎসব । না , শহরে প্রথম তুষারপাত জাতীয় ঘটনা ঘটেনা বটে , তবে যেটুকু শীত আসে তা আমরা উদযাপন করি ষোল আনা । কতই বা নামে পারদ ? দশের নীচে তো নয়ই , অধুনা তাও হয়না । বসন্তের আমেজ মাখানো একটা শীত শীত ভাব । কি কষ্ট কি কষ্ট ! তোরঙ্গ দেরাজ থেকে রঙবেরঙের শীতপোশাক , মাফলার টুপি বের করা হয়না । দশবছর আগে মাসতুতো দিদির শ্বাশুড়ী যে দারুণ সাদা ধবধবে কার্ডিগানটা বুনে দিয়েছিলেন, এবছর তার সঙ্গে ম্যাচ করে একটা শিফন কিনেছিলাম । সঙ্গে মুক্তোর গয়না । শীতের বিয়েবাড়ির আগাম ফ্যাশান । সে গুড়ে বালি । এ তো রীতিমত গরম ! কার্ডিগান পরে কে ? তবুও অভ্যাসের ফলে ছাতে যাই । দিনের প্রথম নরম রোদ্দুর বের হলেই বাক্স টেনে ছাতে এনে ফেলি । ডালা খুলে দিই । ভেতর থেকে উঁকি দেয় আমার আদুরে শীতবস্ত্র । অবিশ্যি বাই ল আমি এখন এক মফস্বলের বাসিন্দে । কলকাতা থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে গঙ্গাতীরবর্তী এক মফস্বল । এখানে বসত ঘন হলেও কলকাতার মত বাড়েনি । নানা অসুবিধেতে জীবনযাত্রা আর সরল হয়না । ফলে এখান থেকেই মানুষের ঢল নামে দেশের সব শহরে । এখানে অপেক্ষাকৃত ভাবে শীত তাই প্রবল । কলকাতার মতন ঘাম প্যাচপ্যাচে শীত নয় মোটেই । কালীপুজোর পরপরই আমরা গায়ে দেবার জন্য বিছানায় কাঁথা রাখি । আর সত্যি সত্যি শীত টের পাই অঘ্রানের নবান্নের ঘ্রাণে । নবান্নের দিন সকালে ঠাকুরদালান থেকে প্রসাদ বয়ে এনে দেয় সুখোদা । কাঁচা দুধ , নতুন গুড় , কড়াইশুঁটি, গোবিন্দভোগ চাল , মূলো , আদা , কমলালেবু , আপেল , বেদানা , কিশমিশ দিয়ে তৈরি আমাদের নিজস্ব ফ্রুট ডেজার্ট । কি অপরূপ স্বাদ আর সুবাস ! বিশবছর আগে আমার শ্বাশুড়ীমা , আমি ভালোবাসতুম বলে বিশেষ করে , বাড়িতে নিজের হাতে আমাকে তৈরি করে দিতেন এই ডেজার্ট । প্রসাদ তো কণিকামাত্র । এখন অবশ্য প্রসাদেই কুলিয়ে যায় । কারণ ও বস্তুটির স্বর্গীয় আস্বাদ গ্রহণে পরিবারের বাকি সদস্যরা অসমর্থ । আর দ্বিতীয় যে কারণ তা হলো এমন শীত আর পড়েনা নবান্নে যে শীতসুবাসিত নলেন গুড় ডেজার্ট এর স্বাদ বাড়াবে ।
তখন তখন আমরা শীতকালে ছাত থেকে মোটেই নামতে চাইতুম না । রুটিনটা মোটামুটি এরকম ছিল - সকালে কাঁপতে কাঁপতে লেপের তলা থেকে উঠে বসে গায়ে সোয়েটার চাদর জড়ানো । ( আহা ! সাদা মোটা সুতির মশারীও তখন কত আরামদায়ক ছিল !) তারপর সাহস সঞ্চয় করে বিছানার বাইরে আসা । মুখ ধোবার জলে হাত ঠেকানো মাত্র তড়িত্ চমক । গরম চায়ের মত এমন অমৃত আর ছিলনা । জীবনদায়ী । ঘরের জানলা দিয়ে সামনে গঙ্গার দিকে তাকালে কেবল এপারের ঘাটটা দেখা যেত । সাদা কুয়াশার চাদরে ঢাকা গঙ্গার ওপার একেবারেই দৃষ্টির বাইরে । মনে হত যেন সাগরপার । আর গঙ্গার রং ও শীতে সাগরঘেঁষা । হালকা নীল ও ধূসরের মাঝামাঝি । জলের কাজকর্ম সেরে রান্নাঘরের দিকে ছুটতাম সকলে । আগুন পোহানোর স্নিগ্ধতার কি কোনও তুলনা হয় ? আর বেলা একটু গড়ালেই বাগান নয়ত ছাত আমাদের বৈঠকখানা । গান, গল্প, লুডো খেলা , শুকনো কাপড় ভাঁজ করা , কমলালেবু খাওয়া , রোদ্দুরে দেওয়া লেপ কম্বল উল্টোনো , উলবোনা , - যেন নিত্যদিনের বনভোজন । ঠিক তিনটের পর রোদ্দুর ফিকে হতে শুরু করলেই ছাতজোড়া সংসার গুটোতে হত । আস্তে আস্তে নেমে আসতাম আমরা । কিন্তু সন্ধ্যে হলেই আমরা বিছানাআশ্রিত হয়ে পড়তাম । রাতের খাবার গরম করে পরিবেশন করা যেন ফাঁসির সাজার থেকেও বেশি দণ্ড মনে হত । তবু শীত চাইতাম আমরা । আমাদের এবাড়ির পাথরের মেঝেতে , গঙ্গামাটির গাঁথনির ত্রিশ ইঞ্চির দেওয়ালে শীত ঠাকুরানী বনেদী বাড়ির ঠাকুরঝির মত রয়ে যেতেন আরও কিছুকাল । সবচেয়ে মারাত্মক শীত পড়ত পৌষে । সংক্রান্তিতে । সাগরের এলোমেলো মরারোদের হাওয়া খড়খড়ি নড়িয়ে , ঘুলঘুলি দিয়ে , শার্সির ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ত শোবার ঘরের বিছানায় । রোদের অভাবে ঠান্ডা লেপের মধ্যে ওম তৈরি হতনা । হি হি করে কাঁপতুম সকলে । তবে এর চেয়েও কঠিন ছিল পৌষের লক্ষ্মীপূজোর দিন । কাকভোরে লক্ষ্মী পাতা নিয়ম । ভোরবেলার সেই স্নান যে কি বিভীষিকা ছিল ! তবে সারাদিন বেশ ঝরঝরে হয়ে থাকতাম সেদিন । এখন আর তেমন শীত পড়েনা । আর শীতের কষ্ট পোহাতে হয়না । বাড়ির লোকজন অবশ্য বলে উচ্চরক্তচাপহেতু আমি শীত বোধ করি কম ।
বহু আগে , চল্লিশ বছর তো হবেই , কলকাতা শহরেও কিঞ্চিদধিক শীত পড়ত । খেলে ফেরবার সময়ে দেখতাম ফুটপাতে জড় হয়ে গরীব গুর্বো মানুষ আগুন পোহাচ্ছেন । তখন শীত মানে দুপুরের ময়দান । শীত মানে চিড়িয়াখানা । শীত মানে নাহুমের কেক । শীত মানে বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন । শীত মানে দিদির জন্মদিন । শীত মানে আমার জন্মদিন । এর সাথে শীত আমাদের জন্য আরও একটু বাড়তি আনন্দ বয়ে আনত । আমাদের মামারবাড়ি ছিল বিহারে । ছোটনাগপুরের এক অল্পখ্যাত রেলওয়ে জংশন , চক্রধরপুর । পাঁচ মামার মধ্যে দুই মামা রেলের চাকরিতে এখানেই পোস্টেড ছিলেন সারাজীবন । বড়মামার কোয়ার্টার বেশ লোভনীয় হলেও আমরা ঘাঁটি গাড়তাম ন’ মামার বাসাবাড়িতে । কারণ দিদিমা ওখানেই থাকেন । বেশির ভাগ রাতের গাড়িতেই আমরা যেতাম মামার বাড়ি ।
ভোর রাত্রে ট্রেন নামিয়ে দিত স্টেশনে । ঘুম জড়ানো চোখে ঠান্ডায় জমতে জমতে আমরা রিকশা চেপে যেতাম প্রেম নিবাসে । মামার বাড়ির পোশাকী নাম । তখনও অন্ধকার আকাশে । রিকশার হর্ণ শুনতে পেয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে মামা এসে জাফরীর দরজা খুলে দাঁড়াত । আমরা ওই আধঘুমের মধ্যেই যথেষ্ট স্নেহ আদর সঞ্চয় করে ঢুকে পড়তাম লেপের তলায় । মায়িমা , মাসি , দিদিমার সদ্য ছেড়ে যাওয়া ওম্ ধরা লেপের তলায় । আবার ঘুমিয়ে পড়তাম আরামে । সকালে ঘুমচোখ খুলে নিজেরই বিশ্বাস হতোনা যে সত্যি সত্যি পৌঁছে গেছি মামার বাড়ি । সূর্য উঠলেই কিন্তু দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠত জায়গাটা । আমরা বাড়ির সামনের লম্বা ফালি ঘাসজমিতে খেলাধুলো করতাম । সামনে দিয়েই চলে গেছে চাইবাসা রোড । যার ডানদিকে চাইবাসা আর বাঁদিকে এতোয়ারি বাজার । ছোটবেলায় ওই রাস্তা , ওই গন্তব্য যেন কি রহস্যময় লাগত । ভিড়ে ঠাসা বাস দেখে মনে হত কোন সুদূরের যাত্রী এরা ! মামার বাড়ির পাশেই গায়ে গায়ে ছিল সরকার জেঠুদের বাড়ি । জেঠুর ছিল শিকারের নেশা । জেঠুর জিপে চড়ে এই শীতকালেই তো আমরা যেতাম টেবোপাহাড়ে । সেসব দিন শিকার করতনা জেঠু । জঙ্গলে জঙ্গলে ধুলো মেখে ঘুরে বেড়ানোই তখন আনন্দ ছিল আমাদের । একবার ফেরবার সময়ে জিপের পেছনে একদম ধারে বসেছি । জিপ ছুটছে । পিচরাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন ঘোর লেগে গেলো । গাড়ি থেকে একটু ঝুঁকে গেলাম আর ছিটকে পড়ে গেলাম । ঠোঁট কেটে গেলো । কেমন করে যেন ছোটবেলায় হাজার চোট পেলেও হাতপা ভাঙতনা । সেভাবে কেটেকুটেও যেতনা । ফেরবার পর দিদিমা বললেন - আর জঙ্গলে যেতে হবেনা । এই অবেলায় সারাদেহ ধুলোয় রাঙা করে ফিরলেন সব । দিদিমা খাঁটি সর্ষের তেল ঘষে ঘষে মাখিয়ে দিতেন গায়ে । চান করে সে কি আরাম ! অমন গন্ড গাঁয়ে কি করে আর নাহুমের কেক পাওয়া যাবে ! অগত্যা মামা একবার ওপরে বালি নীচে বালির খোলা করে উনুনের আঁচে কেক বানালো । কি যে স্বাদ তার ! আজও ভুলিনি । সেবছর পয়লা জানুয়ারি আমরা মামার বাড়িতে । দিদির জন্মদিন । সব পাঁচ সাতের খোকা খুকু আমরা । সকালবেলা মামা ভাবছে মাংস ভাত রান্না হবে আজ । মুশকিল হলো দিদিমা বামুনের ঘরের বিধবা । রাঁধবেন বাড়বেন কিন্তু অবেলায় স্নানও করবেন । হঠাত্ খেলতে খেলতে দেখি স্টেশনের দিক থেকে যে রাস্তাটা এসে মিশেছে চাইবাসা রোডে , তার মুখে বাবা দাঁড়িয়ে । রাস্তা পেরোলেই আমাদের হাতের নাগালে চলে আসবে । বাবার হাতে ঝুলছে দড়িবাঁধা একটা বাঁধাকপি । সবাই অবাক ! দিদি হতাশ । নাকিসুরে মাকে বলছে - ওঁমা দেঁখোনা ! বাবা কিঁ এনেছে । মা বিরক্ত । এই ভবঘুরে অসংসারী মানুষটাকে আর মানুষ করা গেলোনা । বাঁধাকপি ঝুলিয়ে এই ডবল উৎসবে কেউ শ্বশুরবাড়ি আসে । দিদির জন্মদিন আর নতুন বছর একসাথে । বাবা ততক্ষণে নাগালে চলে এসেছে । রহস্যময় হেসে মামার হাতে বাঁধাকপিটা দিতেই মামা একটু ঝুঁকে পড়ল । ওজনটা বুঝতে পারেনি মামা । অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল - এত ভারী কেন গো ? বাবা বলল - ওটা কেক । বাবির জন্মদিন তো আজ ! সব্বাই খুউব অবাক । এই বাঁধাকপি কপি নয় ? কেক ? সেই নাহুমের ? খুব মজা হলো সেদিন । মায়েরও মুখটা আলোকিত হয়ে উঠেছিল ।
আজ কিছুকাল হলো পৌষ আমার কাছে তেমন সুখস্মৃতি বয়ে আনেনা । এরকমই এক পৌষের শীতে গিয়েছিলাম মামার বাড়ি । সেবছর ডিসেম্বরের একুশে চলে গেলেন দিদিমা । মামার বাড়ির সব মায়া যেন একাই নিয়ে চলে গেলেন । আর তারও পর , এরকমই এক তীব্র শীতের রাতে , পৌষের শেষে চলে গেলেন শ্বশুরমশাই । তাঁর শীতের ব্যবহারের নানান সরঞ্জাম পড়ে রইল খাট জুড়ে , ঘর জুড়ে , আর আমাদের চেতনা জুড়ে । আর এইতো সেদিন ! দার্জিলিং পাহাড়ে শেষ ডিসেম্বরের সোনাঝরা রোদ্দুরে শ্বেতাম্বর কাঞ্চনজঙ্ঘাকে ঐশ্বরিক মহিমায় অনুভব করছি , হঠাত্ জানতে পারলাম জন্মদাতা চলে গেলেন ওই উচ্চতম শৃঙ্গেরও ওপরে । সেদিন ওই মহিমময়ের উপস্থিতিও আমার শোককে এতটুকু ঘোচাতে পারেনি । বয়স যত বাড়তে থাকছে পৌষমাস আর শীতকাল ততই মৃত্যুর তীব্রতা বহন করে আনছে । শীতের সুখময় স্মৃতি দ্রুত অপসৃয়মান । এখন তাই উষ্ণতা টুকুই চাই । আপনজনের , প্রিয়জনের সান্নিধ্যে , আলিঙ্গনের নিরাপত্তাজনিত উষ্ণতা । মৃত্যুর মতন হিমশীতল শীত আর চাইনা ।

[সৃজন ওয়েবজিন শীত সংখ্যা ২০১৭]
0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in






- ওমা তুমি এসে গেছ? এই দেখো আমি এখনো সেই খাতাখানা খুঁজেই চলেছি।

আমার বান্ধবী সোনা তার প্রিয় অধ্যাপিকা এবং লেখিকা শ্রীমতী নবনীতা দেব সেনের সঙ্গে আমার একটি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। অনেকদিন ধরেই খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, ও সেটা পুরন করেছে। তবে আমি যেহেতু সাহিত্যের ছাত্রী নই তাই কী নিয়ে কথা বলব সেবিষয়ে মনে বেশ ধন্দ ছিল। সোনাই সাহায্য করল। বলল, কেন রে, তুই ওঁর রামায়ণের ওপরে অসামান্য কাজ আছে, তাই নিয়ে কথা বলিস। উনি নিজেই কত কিছু বলবেন দেখিস। ভারি ভালোবাসেন কথা বলতে। আর এত আদর করতে পারেন যে তোর মন খারাপ সব ভালো হয়ে যাবে দেখিস। আমি অবশ্য মনে মনে ভেবে নিয়েছি। চুপ করেই থাকব বেশি। উনি নিজে যা বলবেন তাইই তো হীরে কুঁচি!

আমার আপাত অন্যমনস্কতা কাটিয়ে উনি ঘরে এসে বসলেন। আলুথালু খোলা চুলে চওড়া লাল পাড়ের গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি আর খুব বড়ো তৃতীয় নয়নের মতো টিপ নিয়ে তিনি একেবারে উজ্জ্বল। একমুখ হাসি। কিন্তু হাসিতে একটু কুণ্ঠা। কী যেন হারিয়ে গিয়েছে উনি তার হদিশ রাখেননি। শুধুই কি খাতা? আমি ততক্ষণে বসে পড়েছি। খাতা তো পাওয়া যাবেই। ওই কতগুলো ব্যাগের মধ্যে হয়তো গুছিয়ে রেখেছেন। হাতড়ে ঠিক বেরিয়ে পড়বে। এর মধ্যেই ঘরের মধ্যে থেকে আর একটি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। “কোনোদিন জায়গায় জিনিস রেখে মনে করতে পারো? শুধু খুঁজে পাচ্ছিনা আর খুঁজে পাচ্ছিনা”। আবার হাসিমুখে একটা ছায়া খেলে গেল । বললেন – ও মায়ের গলা । খুকু তো আর বড়ো হলোনা! খুকুর কন্যেরা সব বড়ো হয়ে গেল । কিন্তু মা বকাবকি না করলে খুকু ঠিক করে কিছুই করতে পারেনা । আমি অবশ্য রোমাঞ্চিত হচ্ছি। রাধারানী দেবীর গলা!

আবার উনি ঝর্ণার মতো হাসলেন। তারপর বললেন – আচ্ছা বলো তো তুমি আমার কাছে কী চেয়েছিলে? আমি এবার বুঝেছি । নবনীতাদি, মানে নবনীতা দেব সেন ভুলেই গিয়েছেন আমার কী চাওয়ার আছে ওঁর কাছে। আমিও এবার হেসে ফেলি। আমার প্রিয়বান্ধবী ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছে। সে বলেছিল, দিদি কিন্তু বেমালুম ভুলে যান। ওটাই দিদির রোগ। তাই একটু সময় নিয়ে বললাম -দিদি, আপনার পোস্ট ডক্টরাল কাজ তো বাল্মীকি রামায়ণের স্ট্রাকচারাল অ্যানালিসিস নিয়ে। আমি সেটা নিয়েই খুব আগ্রহী।

একজন মানুষ যে কতটা হাসতে পারেন সে সম্পর্কে আমার আগের ধারণা সব ভেঙে চুরমার । এ হাসি থামছে না। বললেন – মা গো! ও তো সেই খাতায় নেই! ও যে ওদের দেশের সম্পত্তি! তা চিন্তা নেই। তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারো। আমি বলব। তা হ্যাঁ গো তুমি কি এর ওপরে কিছু করতে চাইছ নাকি? এবার আমি কুণ্ঠিত – না। সেরকম কিছু নয় যদিও ।

ভেতর থেকে আবার গলা ভেসে এলো, খাতাখানা খুঁজে পেলে? উনি আমায় ইশারা করলেন। একটু বসো। ঘুরে আসি। পাশের ঘরে শুনতে পেলাম চিরকালীন খুকুর কথা।

-মা তোমার শরীর খারাপ। একটু চুপ করে শুয়ে থাকো। একটু কি হরলিক্স খাবে?

– না, ও তোমার বেড়ালকে খাইও । আমার চাই না । শুয়ে তো তোমারও থাকার কথা। ডাক্তার ইনজেকশন দিয়ে যায়নি তোমায়?

এমন অমূল্য কথোপকথন শুনতে আমার একাডেমিক কাজের কথা ভুল হয়ে যাচ্ছে। উনি আবার এলেন । গুছিয়ে বসলেন । এবার আমি লক্ষ করলাম কথা বলার সময়ে ওঁর শ্বাসের স্বর শোনা যাচ্ছে। এতটা অসুস্থ? ইনজেকশন নিয়ে শুয়ে থাকার কথা! আমি উঠে পড়লাম। দিদি পরে আসবো। অন্য দিন। আপনার শরীর এত খারাপ। আপনি বিশ্রাম নিন ।

উনি চোখ বড়ো করে তাকালেন। ছদ্ম গাম্ভীর্যঁ। -বসো চুপ কর। আনমনে বলে উঠলেন, বিছানা আঁকড়ে সারাদিন শুয়ে থাকা? বলো তুমি কি বলছিলে। আমি ততক্ষণে স্থির করে ফেলেছি। আজ একটিও একাডেমিক আলোচনা নয়। ওসবের আমি ছাই কী বুঝি? আজ বরং ওঁর মুখ থেকে গল্প শুনি। হালকা হাসির গল্প। মনটা তো বিশ্রাম পাক। বললাম – দিদি যা জানতে এসেছি তার জন্য নয় আবার আসবো । আজ বরং আপনার থেকে কিছু মজার স্মৃতি শুনি । “মজার স্মৃতি? মজার স্মৃতি তো ভুলে যাই গো! মনে থাকে শুধু দুঃখের স্মৃতি। তবে আমার স্বভাবে দুঃখবিলাস নেই কিনা, তাই সেসবও মজার লাগে। তুমিই বরং বলো কিরকম গল্প শুনতে চাও। তবে তোমার মূল প্রশ্নটা আমার খেয়াল আছে। সীতাকে নিয়ে আমাদের আবেগ তো কম নয়! দেখো, রামকে যতই মর্যাদাপুরুষোত্তম বলে মুনি কবিরা সম্মান টম্মান দিয়ে থাকুন না কেন আদতে তো সে একটি ভীতু পুরুষমানুষ! শুধু ভীতুই নয়, সন্দেহবাতিকও বটে। ও নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কত যে জানলুম কী বলব! বেশির ভাগ মেয়েদের লেখা বা গাথা রামায়ণের নানা ভার্সন পেলুম। অবাক আমি! নিজেদের রোজকার সুখ দুঃখ বঞ্চনা দিয়ে তারা সীতার ছবি এঁকেছে! আর তাতে এতটুকু মিথ্যে নেই! আমি চুপ করে শুনছি। হঠাৎ বলে উঠলেন – ও মেয়ে, তোমার বিয়ে হয়েছে তো দেখি! তা একটু বলো না, নিজের জীবন দিয়ে মহাকাব্য কেমন বুঝছ? খুব দুর্বল জায়গা। আমি চুপ করেই থাকি। দিদি আবার বললেন – এই ধরো তুমি আমার বাড়ি থেকে ফিরবে যখন তখন তো বেশ রাত হয়ে যাবে। কীভাবে যাবে তা নিয়ে আমার তো চিন্তা থাকবেই, এমনকি আমার মা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করবেন, সে মেয়ে পৌঁছেছে তো? তারপর তোমার আবার বাড়ি গিয়ে সব কাজ সারতে হবে। সেসবে দেরি হলে শ্বশুরবাড়ির লোকজন বিরক্ত হয় না কি? কিংবা ধরো তোমার সহকর্মী পুরুষটির সঙ্গে বেশ বন্ধুত্ব আছে। এই নিয়ে কোনো রাগারাগি হয়না নিশ্চয়? আমি ঘামতে শুরু করি। উনি কী করে এত কিছু টের পেলেন? নবনীতাদি হাসছেন- কী? ঠিক বলেছি তো? আরে বাবা, এ আর না জানার কি আছে? এরকম সাত সতেরো ঝামেলা নিয়েই তো মেয়েদের জীবন। মহাকাব্যের নায়িকা এ থেকে রক্ষা পাবেন কি করে? আমি সাহস সঞ্চয় করলাম –দিদি, সাধারণ ঘরের মেয়েদের এমন করেই কাটে বটে, তবে বিদুষী স্বক্ষেত্রে উজ্জ্বল মানবী নিশ্চয় এই ছকে বাঁধা পড়েন না? খানিক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে ঘরে। যেন এমন প্রশ্নের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলেন না। তারপর বলে উঠলেন –স্বক্ষেত্রে উজ্জ্বল হতে কত কাঠখড় পোড়াতে হয় জানো? কত বিষাদ নদী পেরিয়ে জীবনের হাত ধরতে হয়? জানো কি, বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে কি পরিমাণ যুদ্ধ নিজের সঙ্গে করতে হয়? সেসবও তো সীতার জীবনকাহিনী! তাই না? আমি অজান্তে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। মুখ নীচু করে বসে আছি। উনি নিজেই প্রসঙ্গ পালটালেন।

- দেখো আমাদের শহরটা কেমন বদলে গেছে। এখন মেয়েরা আর তেমন সংকোচে ম্রিয়মাণ নয়, বলো? আমার কিন্তু বেশ লাগে। স্বাধীন সব মেয়ে। নিজের ইচ্ছে মতন বাঁচে। কত কত কাজ করছে সব! আমারই কত ছাত্রী আছে চারিদিকে দেশেবিদেশে ছড়িয়ে। এত আনন্দ হয়! অনেকে বলেন বটে, মেয়েরা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে। সাজপোশাকে জীবনধারণে কেমন যেন উদ্দাম। আমি ভাবি বেশ তো। এতকালের পাথর চাপা মন যদি খুলে যায় আর আলো দ্যাখে তবে হোক না একটু উদ্দাম?

আমি মনে মনে ওঁর সব কথাগুলো ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিচ্ছি। এ সুযোগ আর আসবেনা। মনের রেকর্ডারে অনর্গল রেকর্ড করে চলেছি। বাইরে সন্ধ্যে নামছে। ওঁর ঘরের লাগোয়া ছোট্ট বারান্দায় কটা গাছের মাথায় অন্ধকার নামছে। সময় হাতে কম। আমি একবার বলে উঠলাম –দিদি, আপনি জন্ম থেকেই ভাগ্যবতী। কত কত মহৎ মানুষের স্নেহ পেয়েছেন, সংস্পর্শ পেয়েছেন। নিজের বাবা মা তো বটেই, এছাড়াও কত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ! উনি মাথা নাড়লেন –সে বলতে পারো। আমার বাবা তো বট গাছের মতোই বিশাল ছিলেন। আর মায়ের আশ্রয় তো এ জীবনে ঘুচবে না। আমার জীবনে সাহিত্যযোগ অবশ্য বুদ্ধদেব বসুর হাত ধরে, জানো তো? উনি গুরু হয়ে হাত না ধরলে এতটা হতো না। এ ঠিক। আমি একটু অনুযোগের সুরে বললাম – আপনি যে কেন আরও আরও প্রবন্ধ লেখেননি! রম্যরচনা পড়ে আনন্দ পেয়েছি ঠিক কিন্তু আপনার প্রবন্ধগুলো অমূল্য। -না না, তা কেন? আমার বহু একাডেমিক লেখা আছে বইকি! রম্যরচনা যা বলছ ও আমার স্মৃতির ভাঁড়ার। লিখতে খুব ভালোবাসি। এইটুকু জীবনে আনন্দ যদি না দিতে পারলাম তবে আর আসা কেন? ওঁর কণ্ঠস্বর কি ভারী হয়ে উঠছে? ভেতর ঘর থেকে আবার সেই গলা ভেসে আসছে।

-খুকু একটু বিশ্রাম করো এবার। সারাটা দিন কেবল কথা বলা আর ছুটে বেড়ানো। উনি উঠে পড়লেন। আমি নিস্তব্ধ হয়ে দেখছি, আঁচল কাঁধ থেকে ছড়িয়ে লুটিয়ে যাচ্ছে মেঝেয়। খোলা চুল উড়ে যাচ্ছে বাতাসে। ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছেন যেন। ঘরের দেওয়াল সরে সরে যাচ্ছে। মিলিয়ে যাচ্ছে আকাশ বারান্দা গাছ আর সময়। দ্রুত দিন আসছে দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামছে, বিকেল গড়িয়ে রাত। জীবন যেন ফাস্ট ট্র্যাকে দৌড়চ্ছে। কিশোরী হাসিখুশি মেয়েটি যেন দ্রুত ছুটে চলেছে অনিবার্য পরিণতির দিকে। চারপাশে তার কত না ভক্ত! কত স্তাবক! কিন্তু শেষপর্যন্ত ভালো বাসা বাড়ির সেই বাসিন্দা ভালোবাসা নিয়ে পথ হাঁটছেন। গন্তব্য সেই কণ্ঠস্বর, খুকু এবার একটু বিশ্রাম নাও।

[শহরতলির ডায়েরি শারদীয়া ২০২০]