Next
Previous
Showing posts with label প্রচ্ছদ নিবন্ধ. Show all posts
0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in



















রাঙাডাক্তার গ্রামের পথ দিয়ে ফিরে আসছেন। ভাঙড়ের বাগবাড়ীতে তাদের সংগ্রাম পর্যুদস্ত হয়েছে। মন তার ভারাক্রান্ত। সেই মুহূর্তে তার মনে বার বার ফিরে আসছিল একটাই প্রশ্ন – ‘আমিই কি সেই নায়ক যে পরাজিত হয়ে পাটখেতের মধ্য দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে?’
চল্লিশ দশকের শেষার্দ্ধ। তখন কলেজ থেকে ডাক্তারী পাশ করে কম্যুনিষ্ট পার্টির ডাকে এই তরুণ ডাক্তার গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন। মেডিকেল টিম তৈরীর চেষ্টা করছেন। আন্দোলনকারী কৃষকদের চিকিৎসা করছেন। বিভিন্ন আন্দোলনে অংশও নিচ্ছেন।
সে সময়গুলো পেরিয়ে আজকে দিনে যদি দেখি, মাঝখানে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। তেভাগা আন্দোলন থেকে নকশালবাড়ি, হাল আমলের কৃষক আইনের বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলন। রাঙাডাক্তারের বিংশ শতাব্দী পেরিয়ে এখনকার একবিংশ শতক। তার মৃত্যুর পর একত্রিশ বছর কেটে গেছে। আজকের দিনটা তার মৃত্যু দিন। নানা রোগ ব্যাধি, সামাজিক সমস্যা, ভোটের ডামাডোল এসবের মধ্য দিয়েও আজকের দিনে তেভাগা আন্দোলন খ্যাত রাঙা ডাক্তার পূর্ণেন্দু ঘোষকে স্মরণ করা প্রাসঙ্গিক।
‘আমিই কি সেই নায়ক যে পরাজিত হয়ে পাটখেতের মধ্য দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে?’ এই প্রশ্নটা বোধ হয় সারা জীবনই রাঙাডাক্তাররের মনকে আলোড়িত করেছিল। সারা জীবন এর উত্তর তিনি খুঁজেছেন। সারা জীবনই তিনি সক্রিয় থাকার চেষ্টা করেছেন। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক আর্নেষ্ট হেমিংওয়েও মতো সারা জীবনই এই বোধে অবিচল থেকেছেন, “A man can be destroyed, but not defeated”! আজীবন যোদ্ধা, ব্যক্তিত্বময় পুরুষ, আড্ডাবাজ, সবার ভালোবাসার এই মানুষটি তার সাধাসিধা দিন যাপন ও চর্চার মধ্য দিয়ে উপরোক্ত জয় ও পরাজয়ের উত্তরটা খুঁজেছেন।
মানুষকে ধ্বংস করা যেতে পারে; কিন্তু যা যায় না, তা হলো তাকে পরাজিত করা। দুরারোগ্য ক্যান্সারের প্রত্যাশিত আক্রমনে এই রাঙা ডাক্তার বিগত ১৯৯০ সালের ৪ঠা মে প্রয়াত হয়েছিলেন; তৎকালীন মধ্যপ্রদেশের (অধুনা ছত্তিশগড়ের) বিলাসপুরে। ডাক্তার পুর্ণেন্দু ঘোষের জন্ম ১৯২৩এর মহালয়ার দিন, বিহারের ভাগা কয়লাখনি অঞ্চলে। বাবা ছিলেন রেল কর্মী। তাই শৈশব কেটেছে নানা জায়গায়, কখনো বিলাসপুরে, কখনো মানভূমে, কখনো কোলকাতায়। ১৯৪২ এ তিনি বিদ্যাসাগর কলেজে আই এস সি পড়তে শুরু করেন। তারপর তিনি ডাক্তারী পড়তে ভর্তি হন কলকাতার কারমাইকেল কলেজে। ডাক্তারী পড়ার থার্ড ইয়ারে কবি রাম বসুর (সম্পর্কে মামাতো ভাই) হাত ধরে তিনি সক্রিয় ভাবে ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। ১৯৪৮ সালে তিনি ডাক্তারী (এম বি বি এস) পাশ করেন। এরপর তিনি ঘরের সুখশয্যা ছেড়ে কম্যুনিষ্ট পার্টির ডাকে সুন্দরবনের কাকদ্বীপে চলে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার গ্রামে গিয়ে আন্দোলনকারী ও সংগ্রামরত কৃষকদের মধ্যে মেডিকেল ইউনিট গড়বেন। এর পরে ১৯৪৯এ রেল ধর্মঘটের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি সাঁতরাগাছি আসেন। তারপরে মেডিকেল ক্যাডার তৈরীর কাজে হাওড়ার আন্দুলে নিজেকে নিযুক্ত করেন। সব মিলিয়ে এই মানুষটি মনে করিয়ে দেন চীনের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী ডাক্তার নরম্যান বেথুনের কথা। সন্দেশখালিতে ধরা পরার পর বসিরহাট সাব জেলে একরাত কাটিয়ে তাকে আসতে হয় আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে। সেখানেও জেলের মধ্যে থেকেও নানা দাবী দাওয়া ও অধিকারের প্রশ্ন নিয়ে চলতে থাকে সক্রিয় আন্দোলন। তারপর আলিপুর জেল থেকে তাকে স্থানান্তরিত করা হয় দমদম সেন্ট্রাল জেলে। ততদিনে কম্যুনিষ্ট পার্টির ভেতরকার অবস্থা দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভরে উঠেছে। তিনি জেল থেকে বেরিয়ে এসে পার্টির সাথে সব সম্পর্ক প্রায় চুকিয়েই ফেললেন।

১৯৫৩ থেকে স্থায়ীভাবে তিনি বিলাসপুরে বসবাস ও ডাক্তারী প্রাকটিস করা শুরু করলেন। এ সময়ে রাজনীতির সাথে তেমন সম্পর্ক না থাকলেও সাধারণ মানুষদের সাথে তার ছিল অটুট সম্পর্ক। ১৯৬৮/৬৯ সালে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের যে আওয়াজ ভারতবর্ষকে উদ্বেল করে তুলেছিল, তিনি সেই আন্দোলনের শরিক হয়ে যান। তারই পরিণতিতে ১৯৭০ এ আবার তাকে জেলে যেতে হয়। এর পরবর্তী সময়ে কাকদ্বীপের পূর্বতন আন্দোলনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি ভোজপুরে কৃষকদের আন্দোলনে সামিল হন। উদ্দেশ্য সেখানে মেডিকেল ইউনিট গঠন করা। পুনরায় ভারতবর্ষের ঘোষিত জরুরী অবস্থার সময়ে তাকে আবার জেলে যেতে হয়। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বিপ্লবী কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের সাথে তিনি যোগাযোগ রেখে চলেন। এই হলো সংক্ষেপে তার রাজনৈতিক জীবনের কথা।

এসবের পাশাপাশি শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে তার বিভিন্ন প্রয়াস মনে রাখবার মতো। এইসব প্রয়াসের পেছনে কাজ করেছে সমাজের প্রতি, মানবতার প্রতি তার এক নিরন্তর দায়বদ্ধতা। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, গল্পকার, লেখক, চিত্রশিল্পী ও নাট্যকার। এমন কি অভিনয়ও করেছেন। তিনি ছিলেন সম্পাদক। তার সম্পাদিত সেতু পত্রিকা (বাংলা ও হিন্দী ভাষায়) সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
ডাক্তার পূর্ণেন্দু ঘোষের কবিতার বই ‘লালগঞ্জে পৌঁছাবোই ও অন্যান্য কবিতা’ তেভাগা কৃষক আন্দোলনের কথা মনে করিয়ে দেয়। তার সাতটি একাঙ্ক নাটকের সংকলন একত্রে বই আকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৮/৮৯-এ। তার সব চাইতে উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম ‘তেভাগার স্মৃতি’ – যার মধ্যে ধরা আছে তার সময়কার কিছু সংগ্রামী মানুষের স্মৃতিকথা ও উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনার বিবরণ। ‘তেভাগার স্মৃতি’ বইটির হিন্দী অনুবাদও (তার ভাই অমল ঘোষ কৃত) এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন ভাষাভাষী সাহিত্যের পারষ্পরিক অনুবাদের মধ্য দিয়েও তিনি চেয়েছিলেন নানা ভাষা ও নানা মতের যোগসূত্র স্থাপিত হোক। তার নিজস্ব অনুবাদ কর্মের মধ্যে আছে কৃষণচন্দের উপন্যাস ‘ফুটপাথের দেবদূত’ ও শ্রীরাবিন শাঁ ‘পুষ্প’-এর গল্প সংকলন ‘লড়াই’ (আলোক রায়ের সাথে যৌথভাবে)।
তার পরিচালনায় বিলাসপুরের সেতু সাহিত্য পরিষদ বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশে একসময়ে উদ্যোগী হয়েছিল। এই সমস্ত গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশের বিখ্যাত লেখক, কবি ও রাজনৈতিক মানুষটিকে নিয়ে লেখা একটি সংকলনগ্রন্থ ‘চেরাবান্দারাজু : ব্যক্তিত্ব ও কবিকৃতি’। এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছেন মধু ভট্টাচার্যর কাব্যগ্রন্থ ‘একটি শান্তির আস্তানা বানাবার জন্যে’ ; এই মধু ভট্টাচার্যবাবু যিনি একসময়ে বিলাসপুরে থাকতেন, ডাক্তারবাবুর সান্নিধ্য পেয়েছেন; এখন তিনি ভিলাইবাসী ও ডাক্তারবাবুর ‘সেতু’ পত্রিকাটিকে এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন। ডাক্তার বাবুর উদ্যোগে সে সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল বিলাসপুরবাসী রেলকর্মী, সমাজিক ভাবে সক্রিয় ব্যক্তিত্ব ও লেখক মহাদেব রাও (বর্তমানে প্রয়াত)এর লেখা ‘মহাদেব রাও নির্বাচিত রচনা সংগ্রহ’। সেতু সাহিত্য পরিষদ ও ডাক্তারবাবুর উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছিল একটি ছবির অ্যালবাম ‘যারা আলো দিলেন’; উদ্দেশ্য ছিল বিখ্যাত শিল্পী দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের দিকে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেয়া।
ডাক্তার পূর্ণেন্দু ঘোষ রোগীর চিকিৎসা করতেন, তাতে নাম মাত্র পয়সা নিতেন, কখনো বা পয়সা নিতেনই না। মধ্যবিত্ত জীবনের মধ্য থেকে উঠে আসা এই মহান চিকিৎসকটির স্বপ্ন ছিল সমাজে যেন শোষণ না থাকে। মানুষ যেন সুখে শান্তিতে থাকে, ভালো থাকে। আজীবন তিনি ছিলেন সহজ সরল নিরলস এক ছাত্র, তবুও আমাদের কাছে তিনি একজন মহান শিক্ষক। তাকে আমি বিলাসপুরে দেখেছি বেশ কয়েকবারই। পথ চলতি রাস্তা ঘাটের মানুষজনের সাথে তার ছিল সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক। নিজের জীবনে তিনি তার ব্যক্তিগত গন্ডীটাকে ভেঙ্গে হয়ে উঠেছিলেন সার্বজনীন।
চার পাশে চলা কম্যুনিষ্ট আন্দোলনগুলো সম্পর্কে শেষ জীবনে তার নানা প্রশ্ন ছিল। বিভিন্ন প্রগতিশীল সামাজিক আন্দোলনের বাঁকে বাঁকে নানা ফাঁফ-ফোকর, সুবিধাবাদ, অন্যায়, অসম্পূর্ণতা এসব তিনিও নিজের চোখে দেখে গেছেন। এসব তাকে বিচলিত করেছিল, দুঃখ পেয়েছেন। সামাজিক আন্দোলনের এই সব ফাঁফ-ফোকর দেখেই হয়তো তাকে লিখতে হয়েছে –
‘বলেছিলাম-
জনতা হচ্ছে জল আর আমরা সেই জলের মাছ
কিন্তু জল যদি সরে যায়
তবে মাছেরা যে ধড়ফড়িয়ে মরে
সে কথা বুঝতেই পারিনি’।

মৃত্যুর পর ডাক্তার পূর্ণেন্দু ঘোষের স্মরণে ‘খুঁজে ফিরি এক আদর্শ প্রাণ’ শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল। সেখান থেকে তারই একটা লেখা কবিতা তুলে দিচ্ছি এখানে।
< ততদিন বিভ্রান্তির অবকাশ কোথা >
নিরাশা আর হতাশায় ছিন্ন ভিন্ন হয়ে
শুয়ে আছি অন্ধকার আকাশের নীচে!
নিরন্ধ্র আঁধার রাতে
কোনোখানে নেই কোন আশার আলোক
তারকার সারি কোথা লুকিয়েছে মুখ
অসহায় মন শুধু ভেঙে ভেঙে যায়।
এমন সময় -
তোমার উদীপ্ত স্বর চমক ভাঙায়,
‘সব্যসাচী, দূর করে দাও এই ক্লীবত্ব তোমার।
অসহায় নয় তুমি,
চারিদিকে চেয়ে দ্যাখো
ছিন্ন বস্ত্রে আচ্ছাদিত শত শত বুভুক্ষু মানুষ
চেয়ে আছে তোমার দিকেতে।
তাদের দেখেছো তুমি,
কিন্তু দেখোনিকো তাদের হৃদয়
সেখানে অসংখ্য জ্বালা আর অঙ্গারের বেগ
নিত্য প্রজ্জ্বলিত হয়ে আগুন ছড়ায়
তারা তো তোমার পাশে
ওঠো, ছিঁড়ে ফ্যালো হতাশার মিথ্যা আবরণ,
মানুষের পরে মানুষের শোষণের
যতদিন শেষ নাহি হবে
ততদিন বিভ্রান্তির অবকাশ কোথা?’
[ বিলাসপুর, ২০-১২-১৯৮৯ ]

‘পরাণ মাঝি হাঁক দিয়েছে’ কিংবা তেভাগা আন্দোলনের সংগ্রামী দিনগুলো আজ অস্তমিত। বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয় আমাদের সামনে! এরকম একটা বিভ্রান্ত সময়ে, আজকেও ডাক্তার পূর্ণেন্দু ঘোষ ও তার জীবনবীক্ষাকে স্মরণ করা খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয়।

==== # ====

[ লেখার সূত্র –
১/ রাঙা ডাক্তার পূর্ণেন্দু ঘোষ – প্রশান্ত ভট্টাচার্য [ লেখক সমাবেশ, মে-১৯৯০ সংখ্যা]
২/ তেভাগার স্মৃতি – পূর্ণেন্দু ঘোষ , সেতু সাহিত্য পরিষদ।
৩/ স্বদেশ ( পত্রিকা) – ৬১ সংখ্যা/ ১৯৯০ ]
0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সঞ্চিতা বসু

Posted in







দ্বারকেশ্বর নদীর ধারে বালি-দেওয়ানগঞ্জ, আরামবাগের গোঘাট অঞ্চলের একটি গ্রামই বলা চলে। গোঘাটেরই একটি অঞ্চল কামারপুকুর। ১৮৮০ সালে এই বালি-দেওয়ানগঞ্জে বাড়ি বানিয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণ-ভক্ত বংশীধর মোদক। নতুন বাড়িতে যাওয়ার আগে তাঁর ইচ্ছা ঠাকুর ও মা তাঁর বাড়িতে একবার পদার্পণ করুন, সুযোগের অপেক্ষা করছেন। এল সুযোগ! একদিন ভাগ্নে হৃদয়ের সঙ্গে শ্রীমাকে নিয়ে ঠাকুর কামারপুকুর যাচ্ছেন, পথে প্রচণ্ড বৃষ্টি প্রচণ্ড বৃষ্টি! নৌকো এসে ভিড়ল বালি-দেওয়ানগঞ্জে, সম্ভবত দ্বারকেশ্বর নদীতেই। ঠাকুর, শ্রীমা ও হৃদয়কে নিয়ে তিন দিনের জন্য থেকে গেলেন বংশীধর ও তাঁর স্ত্রী গিরিবালার বাড়ি। স্থানীয়দের সঙ্গে শাস্ত্রালাপে ও আনন্দে কেটে গেল তিন দিন, ধন্য হল বংশীধরের বালি-দেওয়ানগঞ্জের তৎকালীন নতুন বাড়িটি। এই স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য বংশীধরের বাড়ির একটি ঘরে রয়ে গেল, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, মা সারদা ও স্বামী বিবেকানন্দর ছবি, তিন দিনের স্মৃতিচিহ্ন ও আজীবনের অভিজ্ঞান। তাছাড়া রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সেবামূলক কাজ বালি দেওয়ানগঞ্জে এখনও নিয়মিত সংগঠিত হয়।

এবার আসা যাক অন্য প্রসঙ্গে। বালি-দেওয়ানগঞ্জ আরামবাগের একটি বিখ্যাত মন্দির অঞ্চল। একাধিক মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্যর বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় এই অঞ্চলে। ১৯৭২-এ David McCutchion, তাঁর ‘Late Mediaeval Temples of Bengal: Origin and Classification’ বইতে এই অঞ্চলের মন্দিরগুলির বৈশিষ্ট্যর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। শুধু বৈশিষ্ট্যই নয়, মন্দিরগুলির মাপও তিনি উল্লেখ করেছিলেন। বালি-দেওয়ানগঞ্জের চারটি মন্দিরের উল্লেখ করতেই হয়।

১. দুর্গা মন্দির, ২১’১০’’ স্কোয়ারফিট স্থান জুড়ে জোড়-বাংলা রীতির ওপর নবরত্ন মন্দির (আনুমানিক উনিশ শতক)১
২. সর্বমঙ্গলা মন্দির বা বিষ্ণু মন্দির (বা দামোদর মন্দির David McCutchion-এর উল্লেখ অনুযায়ী), ২২.৫’’ স্কোয়ারফিট স্থান জুড়ে পঞ্চরত্ন মন্দির (আনুমানিক উনি শতক)২
৩. দামোদর মন্দির, ২২’ x ১৯.৫’ স্কোয়ারফিট স্থান জুড়ে ঘোষ পরিবারের উনিশ শতকীয় মেদিনীপুর ঘরানার আটচালা রীতির মন্দির (১৮২২)৩
৪. মঙ্গলচণ্ডী মন্দির, ত্রিতল ত্রয়োদশরত্ন, কিন্তু প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত (ফলে David McCutchion-এর উল্লেখ অনুযায়ী এটি কথিত তথ্য)৪

দুর্গামন্দিরের পাশের মন্দিরটি এই মুহূর্তে লোকমুখে সর্বমঙ্গলা মন্দির বা স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে বিষ্ণু মন্দির হিসেবে পরিচিত, কিন্তু David McCutchion তাঁর বইতে মন্দিরটিকে রাউতপাড়ার দামোদর মন্দির২ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ তথ্য আর অন্য কোনো সূত্র দ্বারা সমর্থিত নয় বলেই আমরা মন্দিরটিকে সর্বমঙ্গলা বা বিষ্ণু মন্দির বলে উল্লেখ করছি। বালি-দেওয়ানগঞ্জের মন্দিরের মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দুর্গা মন্দিরটি। কারণ এর স্থাপত্য। মন্দিরটির নীচের অংশ জোড়-বাংলা রীতিতে গঠিত, অর্থাৎ পাশাপাশি দুটি দোচালা মন্দিরকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। দুটি আয়তাকার দোচালাকে জুড়ে দিয়ে যেন একটি বর্গাকার মন্দিরভিত্তি প্রস্তুত হয়। দোচালা রীতি স্বভাবতই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মাটির বাড়ি ও মাথায় ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে আসা খড়ের ছাউনিকে মনে পড়িয়ে দেয়। দোচালা মন্দিরকে একবাংলা রীতির মন্দিরও বলা যায়।৫ সেই হিসেবেই পাশাপাশি দুটি দোচালা মন্দিরই হল জোড়-বাংলা। পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো মন্দির শুধুমাত্রই দোচালা বা জোড়-বাংলা রীতিতে গঠিত। কিন্তু বালি-দেওয়ানগঞ্জের এই মন্দিরটিকে স্বতন্ত্র করে তুলেছে এই জোড়-বাংলা রীতির মন্দিরের ওপরের নবরত্ন স্থাপত্যটি। দুটি দোচালার মাঝের অংশ দিয়ে উঠে গেছে এই নবরত্ন স্থাপত্য। এর জন্য জোড়-বাংলার ওপরে আরো দুটি তল নির্মাণ করতে হয়েছে। জোড়-বাংলা অংশের ঠিক ওপরে রয়েছে ত্রিখিলান যুক্ত একটি অংশ, যার চারদিকে রয়েছে চারটি রত্ন। এরও ওপরে রয়েছে আরো একটি ত্রিখিলান-যুক্ত তল, সেখানেও চারদিকে রয়েছে চারটি অপেক্ষাকৃত ছোটো রত্ন। আর এই অংশটির মাথার ওপর দিয়ে উঠে গেছে নবম রত্নটি, যেটি আকারে সব থেকে বড়ো। প্রতি তলের ছাদগুলি ঢালু। ত্রিখিলান-যুক্ত প্রবেশ পথের মধ্যে মাঝে সমান দূরত্বে দুটি পূর্ণ খিলান আর দুপাশে দুটি অর্ধ-খিলান দেখতে পাওয়া যায়। যেন মনে হয় তিনটি দরজা। জোড়-বাংলার ওপরে নবরত্ন মন্দির হিসেবে এই দুর্গা মন্দির আলাদা। তাছাড়া, এটির অনন্য হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ, জোড়-বাংলা অংশের মন্দিরগাত্রের টেরাকোটা প্যানেল। অনেক গুলি ছোটো ছোটো প্যানেল ছাড়াও মন্দিরের ত্রিখিলান প্রবেশ পথের ওপরের জ্বলজ্বল করছে টেরাকোটার দুর্গাপ্যানেল, সঙ্গে লক্ষ্মী-সরস্বতী-গণেশ-কার্তিক। সম্ভবত এটিই পশ্চিমবঙ্গের মন্দিরগাত্রের সবথেকে বড়ো টেরাকোটার দুর্গা প্যানেল। এখানে দুর্গা ও তার চারটি পুত্রকন্যা একই সঙ্গে সন্নিবিষ্ট নন। প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা মন্দিরাকৃতির কারুকার্য খচিত বর্ডার তৈরি করা হয়েছে, যাকে বলা যেতে পারে স্টাকোর কাজ। প্রতিটি মূর্তির নির্মাণশৈলী ত্রিভঙ্গ স্টাইল বা নাচের মুদ্রার মতো, যা খুবই শিল্পসম্মত। চারটি মূর্তি যেন পাশাপাশি চারটি আলাদা মন্দিরের কারুকার্য খচিত বর্ডারের মধ্যে নৃত্যরত, দুর্গা মূর্তিটি অন্য মূর্তিগুলির থেকে একটু বড়ো। দুর্গা মূর্তি যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত, অন্য মূর্তিগুলি তুলনায় ভালো অবস্থায় রয়েছে। দুর্গা, গণেশ ও কার্তিকের বাহন থাকলেও লক্ষ্মী, সরস্বতীর বাহন নেই, লক্ষ্মীর হাতে পদ্ম দেখতে পাওয়া গেলেও সরস্বতীর বীণা মনে হয় এখন ক্ষতিগ্রস্ত, শুধু বীণা ধরার ভঙ্গিটি পরিলক্ষিত হয়। প্রতিটি মন্দির চূড়ার মাথায় একটি করে ছোটো লাল পতাকা উড়ছে। একদম ওপরের অংশে কয়েকটি পুরুষমূর্তি মন্দির গাত্রে চুন-সুড়কি দিয়ে খোদিত, যাকে অমিতাভ গুপ্ত বলছেন স্টাকোর কাজ, যেন তারা মন্দিরের রক্ষী, হাতে অস্ত্র নিয়ে পাহাড়া দিচ্ছে মন্দিরকে। জোড়-বাংলা অংশের মন্দিরের গায়ে ছোটো ছোটো অনেকগুলি টেরাকোটা প্যানেল রয়েছে। এই সব প্যানেলে দেব-দেবীর মূর্তির প্রাধান্যই বেশি, অল্প কিছু সাধারণ নর-নারীর মূর্তিও রয়েছে। তারাপদ সাঁতরা উল্লেখ করছেন এই প্যানেলের মধ্যে ভগীরথের গঙ্গা আনয়নের দৃশ্যর কথা। এছাড়া, শিব-পার্বতী, কালী, মৈথুনরত নরনারী, গঙ্গা, গণেশজননী, হুঁকো খাওয়ার দৃশ্য রয়েছে। হুঁকোসেবনের প্যানেলে অনেকেই শৈব প্রভাব খুঁজে পেতে পারেন। এছাড়াও একাধিক প্যানেল ক্ষতিগ্রস্ত। তবে দেবদেবী, নরনরী মূর্তির প্রাধান্যই বেশি। একটি প্যানেলে টুপি পরা এক সাহেবের সঙ্গে এক দেশিয় ব্যক্তিকে মুখোমুখি বসে থাকতে দেখা যায়। প্যানেলের বিষয়ের দিক থেকে এগুলিই জনপ্রিয় বলা যেতে পারে।

আরো একটি কারণে মন্দিরটি মনে রাখার মতো। সেটি হল ত্রিখিলান যুক্ত অংশের ঠিক ওপরে উল্লম্ব অবস্থানে থাকা তেকোনা বর্শা ফলক বা মৃত্যুলতা প্যানেল। এই মন্দিরে চারটি বর্শা ফলক বা মৃত্যুলতা প্যানেল আছে। যার মাঝের প্যানেলগুলিতে নরনারীর মূর্তি এবং ধারের দুটি প্যানেলে অশ্বপৃষ্ঠে সৈনিক বা জীবজন্তু বা নারীমূর্তি খোদিত রয়েছে। এই বর্শা ফলক সম্পর্কে জরুরি তথ্য দিয়েছেন তারাপদ সাঁতরা।৬ তাঁর মতে রত্নশৈলীর ধরনটির সঙ্গে রথের গঠন কৌশলের মিল আছে। রথ নির্মিত হত কাঠ দিয়ে। কাঠখোদাইয়ের ভাস্কর্যের ছাপ পড়েছে রত্ন রীতিতেও।

“কাঠের রথের প্রতি কোণে কোণে (সূত্রধর স্থপতিদের পরিভাষায় যা ‘বর্শা’ নামে খ্যাত) খাড়াভাবে উৎকীর্ণ করা তিনকোনা আকারের যে কৌণিক ভাস্কর্যটি দেখা যায়, সেটিতে রূপায়িত হত হাতি, ঘোড়া, বাঘ, সিংহ, হরিণ ও মোষ প্রভৃতি জন্তুজানোয়ারের মিছিলের উপর সন্নিবদ্ধ বর্শা হাতে কোনো অশ্বারোহী সৈন্য অথবা কোনো নর্তকী বা নারী প্রভৃতি খোদিত মূর্তি। রথের এই কৌণিক ভাস্কর্যের মতোই বিশেষ করে বাংলার রত্ন মন্দিরের অলংকরণ সজ্জা হিসাবে মন্দিরের চারকোণে এই ধরনের ‘বর্শা’ ভাস্কর্য প্রযুক্ত হয়েছে...।”৭

খেয়াল করার দুর্গা মন্দিরের জোড়-বাংলা অংশের চার কোনায় নয়, খিলানের ওপরের চারটি অংশে বর্ষা ফলক বা মৃত্যুলতা খোদিত রয়েছে। যেন মন্দিরে প্রবেশ ও প্রস্থানের সময় মোহমুক্তির দিক নির্দেশ করবে এই প্যানেলগুলি। হাতে বর্শা নিয়ে সৈন্যরা যুদ্ধরত, এজন্যই হয়ত নাম বর্শা ফলক। আবার যেন মৃত্যুকেই এই ফলকগুলি মনে করিয়ে দিচ্ছে, লতার মতো মন্দিরগাত্রে উল্লম্ব ভাবে সজ্জিত, তাই এর নাম মৃত্যুলতা, তাও হতে পারে।

দুর্গা মন্দিরের ঠিক পাশের রয়েছে সর্বমঙ্গলা মন্দির। একে স্থানীয়রা বিষ্ণুমন্দিরও বলে থাকেন। আবার David McCutchion-এর মতানুযায়ী এটি দামোদর মন্দির। কিন্তু আপাতত এটিকে সর্বমঙ্গলা মন্দির বলে উল্লেখ করা গেলেও, David McCutchion-এর আরো একটি উল্লেখ এখনকার দৃশ্যর সঙ্গে মেলে না। তাঁর মতে এটি পঞ্চরত্ন মন্দির। কিন্তু মাঝের রত্নটি ছাড়া এই মন্দিরের অন্য কোনো রত্ন অবশিষ্ট নেই, এমনকি মন্দিরগাত্রের টেরাকোটা কাজগুলিও নেই। তবে কোনো এক সময়ে এটি সে একটি সুসজ্জিত মন্দির ছিল, তার ছাপ এখনো রয়ে গেছে। এই মন্দির গুলির পেছনের অংশের রয়েছে মঙ্গলচণ্ডীর মন্দির। যেটি ত্রয়োদশ রত্ন বলে লোকমুখে কথিত, কিন্তু যার ভগ্নাবশেষটুকুই এখন অবশিষ্ট, এবং David McCutchion-ও এই ভগ্নাবশেষের উল্লেখই করেছেন। চারটি মন্দিরের মধ্যে এটিই সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত, যার ইঁটগুলিই শুধু এখন দেখা যায়, মন্দিরের দেওয়ালে। শুধু মাত্র একটি অর্ধভগ্ন রত্ন কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছে। খুব সামান্য ভাস্কর্যই দেখতে পাওয়া যায় মন্দিরের ওপরের ও নিচের দিকের অল্প অংশে। মঙ্গলচণ্ডী মন্দিরের ঠিক উল্টোদিকে রয়েছে দামোদর মন্দির। এর গঠনে উনিশ শতকীয় মেদিনীপুরের চালা রীতির ধরন দেখতে পাওয়া যায়। David McCutchion এই মন্দিরটিকে আটচালা ধরনের মন্দির বলেছেন, যার রীতি মেদিনীপুরের আটচালার মতো। তিনি আটচালা মন্দিররে দুটি আলাদা শৈলী লক্ষ করেছিলেন, যেটি হুগলি, হাওড়া ও দুই চব্বিশ পরগণায় দেখতে পাওয়া যায় যেটি তাঁর মতে আঠারো শতকের হুগলি-বর্ধমান রীতির অন্তর্গত আটচালা, অন্যটি উনিশ শতকের মেদিনীপুরের ধরন। এক্ষেত্রে চারচালা মন্দিরের মতো ‘রথপগ’ বিন্যাসটি আটচালা মন্দিরের ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত হয়। এই ‘রথপগ’ বিন্যাসের আটচালা রীতিকেই McCutchion উনিশ শকের মেদিনীপুরের রীতি বলতে চেয়েছিলেন। বালি-দেওয়ানগঞ্জের এই দামোদর মন্দিরটির সামনের অংশে একটি টিনের ছাউনি অনেক পরে লাগানো হলেও, এর বেশ কিছু টেরাকোটা প্যানেল এখনও বেশ অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। মন্দিরের ওপরের অংশের কারুকার্যও অনেকটাই দেখতে পাওয়া যায়। প্যানেলগুলির মধ্যে অনেকগুলিতেই বিষ্ণুর দশাবতারকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। তারাপদ সাঁতরা এই মন্দিরের ষষ্ঠীদেবীর মূর্তির প্রতি আলাদা করে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।৮ কারণ তাঁর মতে পৌরাণিক দেবদেবীর প্রাধান্য থাকলেও লৌকিক দেবদেবীকেও শিল্পী পুরোপুরি অগ্রাহ্য করতে পারেননি।

নিঃসন্দেহে মন্দিরগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত, এবং তার রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন। পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের একটি সাইনবোর্ড মন্দির সংলগ্ন অংশে দেখতে পাওয়া গেলেও, প্রশ্ন থেকেই যায় সংরক্ষণ নিয়ে। এই লেখাটি ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসের। পরবর্তী পাঁচ বছরে মন্দিরের কিছু সংরক্ষণ হয়েছে বটে। তবে তাকে ইতিবাচক অর্থে গ্রহণ করা যাবে কিনা সন্দেহ আছে। কারণ, ইউ টিউবের বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে বর্তমানে মন্দিরটি রঙ করা হয়েছে এবং কিছু অংশ সারানো হয়েছে। সমস্যা হল, এ ধরনের মন্দির সারানোর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। কিন্তু ভিডিওগুলি দেখে মনে হচ্ছে সারানো হলেও দুর্গামন্দিরের ওপরের নবরত্ন অংশটির সূক্ষ্ম কারুকার্য আর দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না বা নতুন করা রঙের আড়ালে তার বেশ কিছুটা অদৃশ্য। এমনভাবেই রঙ করা হয়েছে যে, অপরের নবরত্ন অংশটির সঙ্গে নিচের জোড়-বাংলা অংশের রঙের সাদৃশ্য নেই, বেশ একটু বেমানান লাগছে। অনেক পর্যটকেরই মনে হতে পারে, আশেপাশের মানুষজনের আনাগোনা মন্দিরটির ক্ষতি করছে, হয়ত কিছুটা সত্যিই। কারণ মন্দিরের সামনের অংশ ও সামনের প্রাচীর স্থানীয়দের অবাধ ব্যবহার্য, তা ওপরের তোলা ছবি থেকেই পরিস্কার। তবে এখন সামনের অংশ রেলিং দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে, তাতে কতটা উন্নতি হয়েছে তা জানা যায় না। তাছাড়া মন্দিরের দেখভাল যে স্থানীয় মানুষেরাই করেন, এ বিষয়ে সংশয় নেই। মন্দিরের পুজোর আয়োজনও তাঁরাই করেন। মন্দিরগুলির ভেতরের দেবদেবীর মূর্তি দেখার সৌভাগ্য হয়নি ২০১৯-এ, বাইরের কারুকার্য দেখেই মন ভরাতে হয়েছিল, তা এতই দৃষ্টি আকর্ষণকারী ছিল। তাছাড়া, মন্দিরগুলি বিখ্যাতই হয়েছে মন্দিরের বহির্ভাগের কারুকার্যের জন্য।

বালি-দেওয়ানগঞ্জ নামটি অনেকের কাছেই পরিচিত নয়। রাস্তা খুঁজে রাউতপাড়ার মন্দির পর্যন্ত পৌঁছতে ২০১৯-এ বেশ অসুবিধেই হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মন্দির নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের লেখায় এই অঞ্চল এবং দুর্গা মন্দিরের কথা একাধিকবার উঠে এসেছে, এবং খুবই পরিচিত নাম। কারণ এত অনন্য স্থাপত্য ও ভাস্কর্য। তাছাড়া কামারপুকুর থেকে খুব বেশি দূরে অবস্থিত না হওয়ার কারণে এবং রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সেবামূলক কাজের জন্য জায়গাটির পরিচিতি ক্রমশ বাড়ছে। মন্দির সংরক্ষণের দিকটিতে আরো একটু মনোযোগ দেওয়া গেলে হয়ত জায়গাটি আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পারে। শ্রীরামকৃষ্ণ যখন উনিশ শতকের শেষভাগে বালি-দেওয়ানগঞ্জে এসেছিলেন, মন্দিরগুলির অস্তিত্বও তখনও ছিল হয়ত, অন্তত গবেষকদের হিসেব তাই বলছে। মন্দির সংলগ্ন অংশ থেকে দ্বারকেশ্বর নদী খুব দূরে নয়। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময়ের লাল আভা, নদীর ধারের লাল মাটি, দ্বারকেশ্বরের জল ও চারপাশকে যখন রাঙিয়ে দেয়, তেমনই সূর্যরশ্মি রাঙিয়ে দিয়ে যায় মন্দির চত্বর। ঠিক সেই মুহূর্তগুলিতে পশ্চিমবঙ্গের সম্ভবত সবথেকে বড়ো দুর্গা প্যানেলের ওপরের উড়ন্ত লাল পতাকা তাতে যে আরো একটু রঙ যোগ করে তাতে কোনো সন্দেহই নেই।



তথ্যসূত্র:

১. McCutchion, J, David, Late Mediaeval Temples of Bengal: Origin and Classification, The Asiatic Society, Kolkata, 1972, Page – 28-29
২. Ibid, Page – 47
৩. Ibid, Page – 36
৪. Ibid, Page – 55
৫. সাঁতরা, তারাপদ, পশ্চিমবাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য মন্দির ও মসজিদ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৮, পৃষ্ঠা – ১৭
৬. ঐ, পৃষ্ঠা – ২৬
৭. ঐ, পৃষ্ঠা – ২৬
৮. ঐ, পৃষ্ঠা - ৬০

সহায়ক গ্রন্থ:

১. সান্যাল, হিতেশরঞ্জন, বাংলার মন্দির, কারিগর, কলকাতা, জানুয়ারি ২০২৩
২. সাঁতরা, তারাপদ, পশ্চিমবাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য মন্দির ও মসজিদ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৮
৩. সাঁতরা, তারাপদ, কলকাতার মন্দির-মসজিদ: স্থাপত্য-অলংকরণ-রূপান্তর, আনন্দ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৬
৪. রায়, প্রণব, বাংলার মন্দির: স্থাপত্য ও ভাস্কর্য, পূর্বাদ্রী প্রকাশনী, তমলুক, জানুয়ারী, ১৯৯৯
৫. McCutchion, J, David, Late Mediaeval Temples of Bengal: Origin and Classification, The Asiatic Society, Kolkata, 1972
৬. Michell, George (Edited), Brick Temples of Bengal: From the Archives of David McCutchion, Princeton University Press, Princeton, December 1983
৭. Companions and Followers of Sri Ramakrishna, Advaita Ashram, Uttarakhand, March 2021

সহায়ক ওয়েবলিঙ্ক:

১. Bali Dewanganj, Holy Trio Footprints.com, A Virtual Pilgrimage
২. Datta Rangan, Bali Dewanganj: Terracotta at its Best, Wordpress.com
Date: 2.1.2022
৩. Gupta, Amitabha, The Most Unique Brick Temple of Bengal, Wordpress.com
Date: 2.1.2022
৪. Bansidhar Modak and Giribala – Biographies, biographies.rkmm.org
Date: 22.09.2024

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - বেবী সাউ

Posted in






তারপর মানুষ নিজের কাছে ফেরে। অনেক অনেক দিন পেরিয়ে, বছর পেরিয়ে, শত্রু- মিত্র ভেঙে ফেরে। সময় তাকে অনেক কিছু দেয়। অনেককিছু নেয় সে সময়ের কাছ থেকে। ধার করে। পরে ফেরত দেবে ভাবে। জল-ঝড়-বাতাসের ঝাপট। খোলা মাঠ; বদ্ধ দরজা। রোমাঞ্চ, শিহরণ। মান-অপমান। সময় কেড়েও নেয় প্রচুর। ওইযে ছিল নির্মল একটা মন; ভালোলাগার একটা পৃথিবী; রোমাঞ্চ মণ্ডিত একটা চিলেকোঠা--- হারিয়ে যাওয়া সেই চাবি। কাকে বলবে এইসব গাল-গল্প! কাকে শোনাবে একঘেঁয়েমির চিত্র! সবাই যে আজ একরকম, প্রৌঢ়ত্বের মন নিয়ে হাঁটছে। অনেক কিছু জেনে গেছে এই অজানার চেতনা। তার কাছে যে আজ, আলো বাতাসের সবটুকু রিদম জানা। সান্দ্র বিকেলের হাওয়ায় ততক্ষণে শ্রান্ত অবসন্ন সেই মন, হৃদয়। অথচ, নির্জন হয়েছে সে; শক্ত হয়েছে আরও। ঝুরো ঝুরো বালির প্রাচীরে লেগেছে যেন সিমেন্টের ধারালো প্রলেপ। কিন্তু সে নিঃসঙ্গ, একাকী। সমস্ত অভিজ্ঞতার ঝুলি নিয়ে শহরের দিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখে-- এই শহর আবিষ্কারের নয়; নতুনের নয়; নাকি রোমাঞ্চকর শিহরণকারী। তখন সে হয়ে পড়ে আরও বিধ্বস্ত। একা। নির্জন। পৃথিবীর এই নিঃসঙ্গতম মানুষটি কী ভাবে তখন! আলো অন্ধকার ডিঙিয়ে কীভাবে তুলে আনা যাবে আলোচনার পর্ব! কীভাবে নিজেকে ভাসানো যাবে আবার সেই নতুনের স্রোতে! একে একে খুলে রাখা বর্ম পরে নিয়ে আবার যদি ঝাঁপ দিতে পারা যেত মারিয়ানার খাদে! যদি এই দমবন্ধ ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ার আগে খোলা আকাশের স্পর্শ আবার আরেকবার পাওয়া যেত যদি! আর তখনই সে খুঁজতে বসে নিজেকে। যুদ্ধ করে। প্রাণপণে ফিরিয়ে আনতে চায় সেই দুনিয়াটিকে। আর তখন আবার আলো-বাতাসের সঙ্গে কথা বলে। অন্ধকার এবং ভ্যাপসা গন্ধের সঙ্গে ভাব জমায়। জানলার ফাঁক দিয়ে খোঁজে নীলনদের বিস্তৃত উপত্যকা।

"The man spoke little. This is the way of those who live alone, but one felt that
he was sure of himself, and confident in his assurance. That was unexpected in
this barren country. He lived, not in a cabin, but in a real house built of stone
that bore plain evidence of how his own efforts had reclaimed the ruin he had
found there on his arrival. His roof was strong and sound. The wind on its tiles
made the sound of the sea upon its shore"

ঠিক এরকমই, জাঁ গিয়োনো ফ্রাঁস লেরক নিজেকে খুঁজেছিলেন। তার আগের সেই জীবন্ত পৃথিবী-- যে তাকে বাঁচতে শিখিয়েছিল, জল-ক্ষুধা-আশ্রয় দিয়েছিল। মেষ পালকের গানে ভরে উঠেছিল জীবন। তার বহুবছর পরে, যুদ্ধ হিংস্র পৃথিবী ভেঙে একটা নিঃসঙ্গ লোক প্রান্তর ডিঙিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ওই আশ্রয়ের খোঁজে। শান্তির আশ্রয়ে। নির্জনতার আশ্রয়ে। যেখানে সে মুখোমুখি হবে নিজের। কথা বলবে। নিজের সঙ্গে নিজেকে মেলাবে। আর এই আত্মপরীক্ষনটি চলে নির্জনে। অন্ধকারের ভিতর আত্মসমীক্ষার মাধ্যমে। তখনই লেখক বসেন, পুরনো অক্ষরের কাছে। তেমন সীমিত অক্ষরমালা তাঁকে এতদিন ভ্রান্ত একটি পথের সন্ধান দিয়েছে। আর সারা টি জীবন তিনি সেই সীমিত অক্ষরের পেছন পেছন ছুটেছেন। সৃষ্টির নেশায়। আবিষ্কারের নেশায়। দিস্তার পর দিস্তা কাগজে সেই সীমিত অক্ষর নিয়ে খেলা করেছেন। নেড়েচেড়ে দেখেছেন। সাজিয়েছেন। ভেবেছেন, দারুণ একটা আবিষ্কার! সারা পৃথিবী আশ্চর্য হয়ে দেখবে এই অক্ষরের ঝলকানি। কিন্তু আজ যখন সময় হয়েছে, সেই অক্ষরের কাছে ফিরে দেখেন যে আত্ম গর্বীমন খুঁজে পায় একঘেয়েমি, বিড়ম্বনা। সবকিছুই তখন ফ্যাকাশে। বহু ব্যবহৃত।

" আসলে সবই আদ্যিকালের। পৃথিবীও বদ্যিবুড়ি। শুধু কচিকাঁচারা, তরুণ-তরুণীরা প্রথম প্রথম দেখছে বলে, স্বাদ নিচ্ছে বলে তাদের চোখে জিভে সব আশ্চর্য ঠেকে। সতেরো বছরের ছেলেটি কলকাতা শহরে এসে যে রোমাঞ্চ অনুভব করবে আমি টোকিও, লন্ডন, নিউইয়র্কে গিয়ে তার এক কণাও পাব না। কলকাতাই আমাকে দীর্ঘ দিন ধরে তার সহোদরা নগরীদের সম্পর্কে অভিজ্ঞ করে তুলেছে, তালিম দিয়েছে। "
( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

নতুন সিলেবাস। পাঠ্যসূচি। নতুন বই। ভাবি, কি না কী লুকানো আছে তার অন্তরে। মলাট খোলার পর দেখা গেল, চর্বিতচর্বন। বুঝতে পারলাম, এই পর্বের পরে আসবে অন্য একটি পর্ব। ঠিক যেটা আমি জানি, সেও জানে। লেখকও জানেন হয়ত সেটুকু। তারপর পাঠক হিসেবে তাকে আর খোলার প্রয়োজন অনুভব করি না। কেননা, রোমাঞ্চের অভাব মানুষকে উৎসাহী করে তোলে যেমন, রোমাঞ্চের পরে পৌঁছে দেয় একটি স্থিরতায়। তখন সে তার পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলাতে বসে, বর্তমান রোমাঞ্চকর অবস্থানটিকে। তাই আমরা বাস্তবে যখন কারো সঙ্গে কথা বলি, নতুন অপরিচিত ব্যক্তিটি আশ্চর্যতম অভিজ্ঞতা নিয়ে হাজির হন আমাদের সামনে। তারপর যখন দু-চারটি কথার পরে বুঝতে পারি, আসলে আমার পূর্বে জানা ব্যক্তিটির সঙ্গে সাদৃশ্য আছে বর্তমান ব্যক্তিটির। তখন আমরা যত না ওই অচেনা ব্যক্তিটির মধ্যে নতুনত্বের খোঁজ করি তার অধিক মেলাতে বসি পূর্বে চেনা ব্যক্তিটির সঙ্গে। আর তখনই আমরা হাঁপিয়ে পড়ি। ক্লান্ত হই।

তা বলে কিন্তু পৃথিবীতে বৈচিত্র্যের অভাব নেই! শুধু দৃষ্টি পাল্টেছে আমার। আমি-ই পুরনো হচ্ছি পৃথিবীর কাছে। জাবালির মতো। অসহায়তার চোখ নিয়ে কোথায় খুঁজবো রোমান্সের শরীর? মন? বয়েসে না, মনে এসে ছায়াপাত করে বার্ধক্য। মনে হয় এতদিন কী করলাম! শুধুমাত্র কিছু ডিগ্রির কাগজ। অ্যাডমিশন ফি। কলেজ। ক্যাম্পাস থেকে বেরোতেই পারলেই যেন বাঁচি তখন। দমবন্ধ লাগে। হাঁপ এসে যায়। স্কুল লাইফের বন্ধুরা নেই। প্রিয় শিক্ষকেরা এখন বহুদূরের। ছাড়তে ছাড়তে হারাতে হারাতে এই বিরাট কোলাহলে। সম্বল মাত্র কয়েকটি অক্ষর। শব্দ। আর এই পুরনো অভ্যেস, মনখারাপ নিয়ে কী আর কলম চলে? "এই অবস্থায় এসে কি আর লেখালিখি করা যায়!" ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

তখনই সামনে এসে দাঁড়ায় অভিজ্ঞতা। অনন্তের পৃথিবী। সময় ভেঙে মেশে মহাকালের স্রোতে। আনন্দের গতিধারা আবার বইতে শুরু করে। একে একে উঠে আসে, দেশের বাড়ি। জানলা-ভাঙা নিগমানন্দ প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছুট ছুট করে কবাডির মাঠ। প্রথম চোখের ইশারা। হেরে যাওয়া নয়, পূর্ণ ব্যাগের ভারে আমি নতুন হই। সামনের দিকে তাকাই। আবার হাঁটে মানুষের আকাঙ্খার পথ।

" আমি এখন কালস্রোতের কোথায় আছি? কত মাইল উত্তরে, কত মাইল দক্ষিণে? আমার ডানদিকে কত আলোকবর্ষ? আর বাঁয়েই বা কত? অঙ্কটা বেশি জানলে বা ধারণাশক্তি বেশি থাকলে হিসেবটা কিভাবে করা যেত জানি না। আপাতত আমার ছোটো হিসেবে, আমি এই ১৯৮৮ তে, পৃথিবীতে কলকাতায় আছি। আমি পেরিয়ে এসেছি অনন্ত কাল+ ষাট বছর। আর এখনো যেতে হবে হয়তো বছর পাঁচেক+ অনন্ত কাল।" আর তখনই ঝুমঝুম করে বেজে উঠল জাদুগরের ম্যাজিক বাক্স। অনন্ত শব্দটাতেই বিশাল বড় একটা পৃথিবী যেন খুলে গেল তার রঙবেরঙের ওড়না উড়িয়ে। তখনই আবার এসে বসল কবিতার খাতা। অক্ষরের পংক্তি। " এই দৃশ্যমান এবং বেদনীয় জগৎই কবিতার বিষয়-- আধার এবং আধেয়। এতদিন আমি ওই জগতের কথা ভেবেই কাটিয়েছি। অনন্তকালকে দুইপাশে রেখে এবার সাহস করে অন্যভাবে দেখা যাক। এই প্রকাশিত জগতের ওপিঠে বা অন্তরালে নিশ্চয়ই রয়েছে অপ্রকাশিত জগৎ। যেমন চাঁদের দেখা-পিঠের আড়ালে রয়েছে তার অদেখা-পিঠ। যেমন গাছের পাতার আলো-পড়া পিঠের অন্যদিকে রয়েছে তার অন্ধকার-জমা পিঠ। এমন কি বিন্দুরও, যদি অবস্থিতি থাকে, তারও সূচিমুখের আড়ালে আছে অজানা আঘাত।" ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

আর এখানেই মণীন্দ্র গুপ্ত খুঁজে দেন একটি অন্ধকার জগতের সকাল। যাতে অন্ধকার রাজ্যেও ভেসে উঠছে সন্ধের ইমন। তৈরি হচ্ছে অসংখ্য রাগ-রাগিনী। এতদিন মনে রাখা অন্ধকার আসলে অন্ধকার নয়। বরং আশ্চর্য রহস্যময় একটা কবিতা। যার পরতে পরতে আবিষ্কারের কাপড়। ঘোমটার আড়ালে আশ্চর্য সেই রূপের ঝলক। ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথের ছবির রহস্যময়ী অবগুণ্ঠন। নির্জন অন্ধকার তাঁকে দিয়েছিল আলোর মহিমা- দ্যুতি। আর তখনই অনুভব করি, আবহমানের ধারা। নিজেকে স্নান করাই। শুদ্ধ হই।

প্রকৃতি আমাদের সত্ত্বা। আমাদের বিকাশ। আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়া পথের পথপ্রদর্শক। আর প্রকৃতির আপন ধারার পথই হচ্ছে নিয়ম। রীতি। ধর্ম। অনুশাসন। আধার এবং আধেয়। আর সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে খুঁজে ফেরাটাই সাধনা। প্রকৃতির সঙ্গে মেলানোর প্রচেষ্টাই ধর্ম। অজস্র ধুলোর বিন্দুর মাঝে নিজের আমিকে খোঁজা।অনন্তের খোঁজ বিপুলের খোঁজ। সেই খোঁজাটাই যখন দুর্বার হয়ে ওঠে তখনই আমরা সৃষ্টি আনন্দের খোঁজ পাই। ছুঁতে পারি তার এক দুটি আলোক স্ফুলিঙ্গ। ধন্য হই। আসলে সমস্তটাই প্রকৃতিতে বর্তমান। সমস্ত জিনিসই সাজানো আছে প্রকৃতির ঘরে। তার অতীত নেই, ভবিষ্যৎ নেই। নিত্য সঙ্গে অনিত্য মিশে গেছে প্রবহমান কালে। ‘একো বশী সর্বভূতান্তরাত্মা একং রূপং বহুধা যঃ করোতি’ (কঠোপনিষদ (২:২:১২))। শুধু তোমার প্রয়োজন মতো খুঁজে নাও তাকে। সাজিয়ে নাও ব্যবহার যোগ্য করে। ক্ষুদ্র আমি তখনই মেলে বিরাট আমি'র সঙ্গে। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে, স্পর্শের মধ্য দিয়ে এই anticlimax পথের সূচনা। বিস্তারিত দৃশ্যের মধ্য থেকে প্রসারিত হবে এইসব রোমাঞ্চকর পথের অনুভব । বোধ। জ্ঞান। এতদিন যা যা সংগ্রহ করেছ তা থেকে বানিয়ে নিতে হবে সংযোজন। তাই কবিতা বিজ্ঞানীর কথায়,

" কবির খুব প্রয়োজনীয় নিকট বন্ধু হতে পারেন নৃতত্ত্ব, প্রত্নতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, সমুদ্রতত্ত্বের লোকেরা; ভূবিদ্যা, পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতিবিদ্যার লোকেরা-- যাবতীয় অনুসন্ধিৎসু মানুষের দল। আড্ডা মারতে হয় তো এঁদের সঙ্গে। যেমন ভাব তেমনি লাভ। প্রথমোক্তদের মানুষ-ঘেঁষা পেশা ক্রমশ তাঁদের মূঢ়মতি ও হীনবুদ্ধি করতে থাকে। মনুষ্য সংশ্রব মনুষ্যত্বের পক্ষে সর্বথা ভালো নাও হতে পারে। দ্বিতীয়োক্তেরা ঠিক উলটো-- মহাপ্রকৃতির মধ্যে ঘুরে ঘুরে, খুঁজে খুঁজে তাঁদের চেতনা উদ্ভাসিত হতে থাকে। তাঁরা খুঁজে খুঁজে যাকে পান সে তো অভিজ্ঞতা বটেই, তাছাড়া যেপথে খোঁজেন সে পথও অভিজ্ঞতায় ছাওয়া। এই অভিজ্ঞতাগুলি কবির জগতের ভূমি, আকাশ, আবহাওয়া ও স্বপ্নের মৌল।" ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

তাই অসীমের পথে যাত্রী হতে পারেন কবিরাই। আলোকের ঝরণা ছেড়ে সহজেই নেমে যেতে পারেন মারিয়ানার গভীর খাদে। কেউ নেই। অনুসরণ অনুকরণের কোনও ধারা ততটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় না তাঁর কাছে। তিনি খোঁজেন এবং খোঁজেন। তিনি দেখেন এবং বোঝেন। উপলব্ধি ও অনুভবের মধ্য থেকে ছেঁকে তোলেন শব্দ। ধনী থেকে দরিদ্র সবাই তাঁর বন্ধু। আবার কেউ না বন্ধু নন। তাদের উপলব্ধির অভিজ্ঞতাটুকুই বন্ধু তাঁর। সৎসঙ্গের ব্যাখ্যাটা তাই এখানে যোজন বিস্তৃত। শিশুটিও তাকে দিতে পারে তার শিশুদের সন্ধান, ষোড়শী যুবতী দিতে পারে প্রথম প্রেমের ইশারা আবার মৃত্যুমুখে পতিত বৃদ্ধটি দিতে পারেন রহস্যময় পরাবাস্তবের ইঙ্গিত।

"কবিতা যার একদিক অনির্দেশ্য অনির্বচনীয়কে স্পর্শ করে আছে, সে কেমন হবে, কেমন হওয়া তার উচিত, এমন কোনও ফরমান জারি করা করা আমার পক্ষে ধৃষ্টতা। তবু প্রারম্ভিকভাবে এটুকু বলা যায়, কম্পিউটার, গাইগার কাউন্টার, পরমাণবিক বোমা, মঙ্গল চাঁদ শুকতারায় যাবার হাউই ও জাহাজ যে সূক্ষ্ম, নিপুণ, সংবেদনশীল, নির্ভুল, প্রলয়বীর্য, অনন্তভেদী, অমোঘলক্ষ্য ধ্যানের ফল, আমাদের কবিতাকেও যেতে হবে সেই পথে। এ কথার অর্থ কিন্তু এই নয় যে আমি কবিতার মধ্যে কিছু সফিস্টিকেটেড যন্ত্রপাতির লোহালক্কড় বা নাড়িভুঁড়ি বা কিছু বৈজ্ঞানিক সমীকরণ ভরে দিয়ে তাকে এক মহাপন্ডিত রোবট বানাতে চাইছি। আমি চাইছি তার আত্মা হোক অনন্তসম্ভব, আর সেই অনুযায়ী তার দেহ হোক নিখুঁতগঠন।’ ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

এই নির্বিকার যাপনের শেষে ঘরে তুলতে পারবো শব্দের মালাকে! সাজাতে পারবো! প্রকৃতির দিকে মুখ করে বলতে পারি যদি- দেখো, তোমার ঘর থেকে জিনিস এনে কীভাবে সাজিয়ে তুলেছি, অন্দরসজ্জা। "আর কবিতার শেষে, ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছানো বা অভাবিত মোচড় দিয়ে থামা বা এতক্ষণের সারা শরীর ভরা চাপকে অকস্মাৎ মুক্ত করে দেওয়া এইভাবে শেষ করার অর্থ নাটকীয়তা, প্রকটতা, বাদ্যকারের তেহাই মারার লোভ"। তখনই ভেঙে যাচ্ছে নিরহংকার সাধনা। লোভ আসছে; প্রতিহিংসা পরায়ন মন আসছে। পুরস্কারের লোভে নিজের স্বতন্ত্রতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে প্রকৃত কবি। তখন ভ্রান্ত পথ তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে না, " ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

আমরা যেখানে আছি, যেখানে ছিলাম, যেখানে থাকব তার একদিকে অনাদি, অন্যদিকে অশেষ। সব কবিতা, সব গল্প, সব জীবনেরই শুরু যেমন স্রোতের মাঝখান থেকে ধরে নিতে হয় তেমনি তার শেষও ছেড়ে দিয়ে যেতে হয় মাঝখানেই।" তবে এই যে আমি রোজ প্রত্যহ নিয়ম করে খোলা খাতার সামনে বসে থাকছি। ধরতে চাইছি অখন্ডের নিত্যতাকে! কী হবে? শুধু শুধু হাপিত্যেশ করে বসে থাকা অনন্তের দিকে মুখ করে? কিছু পাওয়া নেই? অনন্ত আমাকে ফিরিয়ে নেবে স্রোতে? আর আমি ভেসে যাবো খড়কুটোর মতো? না; তা নয়। তোমার চাওয়াটা ঠিক। পাওয়াটা নয় হয়ত। এইযে তুমি পাওয়ার জন্য চাইতে বসেছ তখনই তোমার মধ্যে অস্থিরতা আসছে। অসন্তোষ আসছে। তুমি ধ্যানমগ্ন হতে পারছ না তোমার সৃষ্টির কাছে। বাইরের কোলাহল তোমাকে ভ্রমের লোভে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে ভোগের দিকে। আর তুমি তোমার ফেলে রাখা কাজ ছেড়ে উঠে যাচ্ছ শুঁড়ি মাতালের ঠেকে। ওখানে গিয়েও শান্তি নেই। তোমার ফেলে রাখা কাজ তোমাকে কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। কিছুতেই থাকতে দিচ্ছে না এই নেশার পৃথিবীতে। অথচ, যেতেও পারো না তুমি। এই অস্থিরতা যখন তোমাকে ফিরিয়ে আনলো তোমার দায়বদ্ধতার কাছে, সৃষ্টির সমীপে; তখন মনে হচ্ছে শিকল লাগল পায়ে। তুমি চাইলে মুক্তি। আকাশের দিকে। পাখির মতো করে। কিংবা হয়ত যখন ফিরে এলে ফেলে রাখা কাজের কাছে, ততক্ষণে অভিমান বশত চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে সেও। আর এই হল " অ্যান্টিক্ল্যাইম্যাক্স। কি হবে কি হবে ভেবে মন ক্রমাগত উত্তেজিত ও আকুল হতে থাকে, এবং তারপর হয়তো কিছুই ঘটে না। পাঠক শূন্যে ঝুলে থাকেন, আর তাঁর কল্পনা কাজ করতে থাকে গল্পের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়ে"। ( চাঁদের ওপিঠে, মণীন্দ্র গুপ্ত)

আমারও আর ফেরা হয়না। সব ছেড়ে যাওয়া-রা চেয়ে চেয়ে দেখে শুধু। সামনে এসে দাঁড়ায় আরও দৃশ্য। আর আমিও প্রতিটি দৃশ্যমানের কাছে তুলে ধরি আমার কবিতা; শব্দ; অক্ষর। মিলেমিশে তৈরি হয় কবিতা ভাবনা। সাদা কাগজের সামনে এসে বসি। একপাশে কোলাহল করে হেঁটে যায়, আমার বাস্তব; অন্যদিকে মৌন সাধনায় রত আমার যাপন। কোনও দ্বন্দ্ব নেই, রেশ নেই। শুধু হেঁটে যেতে হবে ভেবে হেঁটে যাওয়া। বসত গড়ি। মনের মধ্যে লালন বাজে। রবীন্দ্রনাথ বাজে। সুমন এসে মেশে মাঝের স্রোতে। দেখি ততক্ষণে জমে ওঠা-রা মিলিয়ে গেছে শূন্যে। আর তখনই অসংখ্য খোঁজের মধ্যে তৈরি হয় প্রবহমানের ধারা। যেন এটাই মোক্ষ নয়, এখানেই শেষ নয়। বরং অন্তিম ভেবে শুরুর খোঁজ শুরু হয় এখান থেকেই। এখান থেকেই মহাকাব্যের চলন। যুধিষ্ঠির হেঁটে যাচ্ছেন। চারপাশে শীতল অতীত। সামনে অপার সৌন্দর্য। হাতছানি দিচ্ছে। সত্য বলে কিছু কী আদৌ! বরং এতদিনের জেনে আসা প্রিয় সত্য-রা, পদে পদে ভুল বলে প্রমাণিত হচ্ছে। মৃত্যু ঘটছে। তখনই তিনি অনুভব করেন, সত্য মানে তখন এগোনো। চিরন্তন। এগোও, এগোও। এগিয়ে যাও। চরৈবতি...চরৈবতি। আমিও হাঁটি। আর ভাবি, " একবার খুলে দে মা চোখের ঠুলি, দেখি শ্রীপদ মনের মতো"( রামপ্রসাদ সেন)। আর আমি চোখ খুলে নত হই, নতুন হই দৃশ্যের কাছে। এইযে অন্তিম লাইন বলে ভেবে এসেছি এতদিন, সেখানেই সংযোজিত হয় আবিষ্কারের পথ। আলোক বিন্দু। যে আমাকে পথ দেখাবে শুধু। থেমে থাকা, স্থিরতা থেকে মুক্তি দিয়ে মেলাবে অনন্ত আবহমানতার স্রোতে।
1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - স্মৃতিকণা সামন্ত

Posted in








আকাশে সেদিন জল টসটস মেঘ। সরোবরের জল মেঘের ছায়ায় গভীর কালো। পদ্মবনে নীল আলো ফেলে ভোর আসছে। মহাদেব ডুব দিলেন। পরপর তিনটি। ভোরের সূর্যের দিকে তাকিয়ে প্রথম অঞ্জলিটি ঢেলে দিলেন জলে। মেঘমন্দ্র স্বরে গুড়গুড় গমগম করে উঠল চারপাশ। আকাশে কড়াৎ কড় বাজ, রুদ্রবীণায় বেজে উঠল ভৈরবী সুর। তাঁর মেঘের মত জটায় উথালপাথাল পদ্মবন, দিশেহারা ভ্রমরের দল। চুলে লেগে রইল কয়েকটি বৃন্তচ্যুত পদ্মকলি। মহাদেব ফুলগুলি নিয়ে এলেন দেবী পার্বতীর পুজোঘরে। দেবী তখন ধ্যানমগ্না। হেমবর্ণ আলো এসে পড়েছে তাঁর মুখে। কপালে জ্বল জ্বল করছে কুমকুমের ফোঁটা। ভোর হচ্ছে চরাচর জুড়ে। দেবী ফুলের সাজিটি টেনে নিলেন। উঠে এল ফুটফুটে এক মেয়ে। কে তুমি!

"মনসা, শঙ্কর নন্দিনী।"

বিষে ভরে গেল আকাশ পাতাল।ঝিকিয়ে উঠল কাল নাগিনীর ফণা। দেবীর মনের বিষে অধিষ্ঠান হল বিষের দেবী, সাপের দেবী মনসার।

মনসা জন্মের এ গল্প বিহারের। এই গল্পই একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাঙালির মনসামঙ্গলে। কিন্তু এমন এক সর্পদেবীর জন্ম নিছক মহাদেবের ফুলের সাজিতে হয়না। দেবী জন্মাতে থাকেন মনে মনে, তলে তলে। হাজার হাজার বছরের মানুষী স্রোতের গভীরে। মনসার উৎস খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হয় সময়ের পথে হাজার হাজার মাইল। পৃথিবীর তখন সদ্য কৈশোর। মানুষের দল চলে যাচ্ছে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে । "আ কন্টিনিউয়াস মুভমেন্ট অফ হিউম্যান রেসেস" তখন জল জমিনের খোঁজে। আদি অস্ট্রালয়েড, অ্যালপো দিনারীয়, নর্ডিক কত না গোষ্ঠী, দলকে দল ছড়িয়ে পড়েছে পারস্য,ইরান, ইউরোপ, এশিয়ার মাঠে মাঠে।

কত তো মানুষ এসেছে গেছে, ধুলোর পায়ে পায়ে...

ভারতবর্ষে আর্যরা এসেছিল আলাদা আলাদা দুটি বড় দলে বেশ কিছু সময়ের আগে পরে। তারও অনেক আগে এসে গেছে তুরানি মানুষ। তুরানি মানুষ ছড়িয়ে গেছে সারা পৃথিবীতেই। সঙ্গে নিয়ে গেছে তাদের জীবন , যাপন। মিশে গেছে সে দেশের ছায়ায় মায়ায়।

ঐতিহাসিক ফার্গুসন বলছেন পৃথিবীজোড়া সর্পপূজার চল হয়েছে তুরানিদের থেকেই। যেখানে যেখানে তারা পা রেখেছে সেইসব দেশেই পাওয়া গেছে জ্যান্ত সাপের পুজো করার রীতি। সেই কবে টোটেম জমানা থেকেই পশু পুজোর চল মানুষের পাড়ায় পাড়ায়। কুমির, বাঁদর, হাতি, কচ্ছপ, ভাল্লুক, বাঘ আরও কত কী । কিন্তু সাপ? দেশে দেশে সাপ ছিল শয়তানের ভূমিকায়। শয়তান থেকে দেবত্বে উঠে আসার এই রাস্তাটা সহজ ছিল খুব?

বেদে বা বেদের পরে মহাভারত কিম্বা প্রথমদিকের পুরাণগুলোতে কোথাও সর্পপূজার কথা নেই। তারও পরে বিভিন্ন উপপুরাণ , দেবী ভাগবত, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ইত্যাদিতে সাপের দেবী হিসেবে মনসার নাম পাওয়া যায়। জায়গায় জায়গায় সাপের ঘর। গুহার ভেতর দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছে কারা? কাদের ঘরে ঘরে বিষের আড়ৎ? খুঁজতে খুঁজতে পায়ে পায়ে চষে ফেলতে হয় দীনদুনিয়ার আদাড়বাদাড়–ব্যাবিলন থেকে রোম, ইংল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়া। ব্যাবিলনীয়,আসিরিয়, সুমেরীয়দের ঘরে ঘরে সাপের বেদী। বেদীতে নাগ দেবতার চাষ। মিশরের স্থাপত্যে সাপ ছিল বড় পবিত্র । মনে পড়ে সেই আলেকজান্ডারের কথা? তার বাবা ফিলিপ নিজে রাজ্যে বলে বেড়ালেন আলেকজান্ডারের বাবা নাকি কোন এক সাপ।

যেদিন খান্ডব বন পুড়িয়ে বনভোজন করছিলেন কৃষ্ণ,অর্জুন সেদিন সেই দাউদাউ বনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল তক্ষক নাগ–জোড়হাত, নত মস্তক। আগুনে না পুড়িয়ে তাকে সপরিবার বন ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দিল কৃষ্ণ। চিরঋণী হয়ে রইল নাগ। যেদিন মহাভারত লেখা হচ্ছিল সেদিন নাগ শব্দের ব্যবহার সাপ অর্থে করা হতনা। নাগ ছিল সম্ভবতঃ সাপ টোটেমের এক উপজাতি। কশ্যপ মুনির স্ত্রী কদ্রু নাগদের আদিমাতা। বাসুকি, অনন্ত, শেষ নানান বিখ্যাত নাগের দলে মেয়েটি অজ্ঞাতনামা, জরৎকারু। জরৎকারুর বিয়ে হয়ে গেল জরৎকারু মুনির সাথে, কুটির আলো করে সন্তান জন্ম হল। আস্তিক। এতদিনে একটা বলার মতো পরিচয় পেল মেয়েটি "আস্তিকস্য মুনির্মতা"! কিন্তু তারপর? তারপর মেয়েটি হারিয়ে গেল অন্ধকারে। স্বামী পরিত্যক্তা, ভাই বাসুকির সাম্রাজ্যে মেয়েটি বেঁচে রইল নামহীন খ্যাতিহীন অস্তিত্বের মতো।

খান্ডব বন থেকে বেঁচে ফেরা তক্ষক নাগের রাজ্য দেখতে দেখতে তক্ষশিলা। আবারও ফার্গুসন বললেন, এই তক্ষশীলা আদতে এক নাগরাজ্য। তথাগত বুদ্ধ তখন ছড়িয়ে যাচ্ছেন জলে। পাহাড় ছাড়িয়ে, গিরিপথ পেরিয়ে দূরে, আরো দূরে। বোধিবৃক্ষের বেদীটিতে তখন পুণ্য আয়োজন। সাঁচি আর অমরাবতীর স্তূপের গায়ে গায়ে সেইসব বৃক্ষপূজা, চক্রপূজার স্মৃতি। পাঁচমাথাওয়ালা নাগের ছবি ফিরে এসেছে বারে বারে। হিন্দু পুরুষ, নারী ছাড়াও যাদের পোশাকআশাক খানিক আলাদা, যারা চেহারায় ঠিক আর্যসুলভ নয়, বরং তারও আগের সময়ের লোকজনের মতো তাদের ফার্গুসন বললেন তক্ষক কিম্বা দস্যু। তারা থাকে অরণ্যের আড়ালে, গাছের ছায়ায়। শহর থেকে দূরে তাদের ঘর। ঘরের ভেতর সাপের ঝাঁপি, সদর দুয়ারে আগুন মশাল। দেশের রাজা যায় দস্যু সন্দর্শনে ।

আগুন আর সাপের উপাসনা আসলেই সূর্য উপাসনার প্রতীক কিনা সে কথা বলবেন পণ্ডিত। কিন্তু ঋকবেদে দশম মণ্ডলের সর্পরাজ্ঞী সূক্তে বাক বিজ্ঞানের আলোচনায়, এবং তৃতীয় মণ্ডলের ঋষি বিশ্বামিত্র সূর্যরশ্মির ভেতরের কাঁপনের প্রকৃতিকে নাম দিয়েছেন "সসর্পরী বাক" ।

বাক সেই শুদ্ধতম প্রকাশের একক যার আলোয় আলোময় হয়ে ওঠে মানুষের নৈর্ব্যক্তিক আত্মা । আর সাপের কামড়ে চিকিৎসা এমন এক বিদ্যা যার নামে অথর্ব বেদে আলাদা এক শাখাই তৈরি হয়ে যায় ধীরে ধীরে। সেইসব প্রাচীন দিনে যখন ঠান্ডা দেশের মানুষ আর্যরা ধীরে ধীরে পরিচিত হচ্ছে ভারতের উষ্ণ জলবায়ু আর সাপের বিভিন্ন প্রজাতির সাথে, ততই সাপ হয়ে উঠছে এক ভয়ানক অস্তিত্ব। মহাভারতে ঘৃতাচি নামের শূদ্র মেয়েটি ছিল সর্পবেদে বিশারদ। এই ঘৃতাচীই মনসার প্রথম প্রতিচ্ছবি। বাগদেবী সরস্বতীর হাতে প্রথমদিকে ছিল বীণা আর সাপ। আভিজাত আর্যরা পরে অনার্যদের সাপকে সরিয়ে বেদ দিয়েছে সরস্বতীর হাতে। সেকালে বেদ বিশারদ হতে হলে সর্পবেদের জ্ঞান থাকা ছিল প্রথম শর্ত।

গাঙ্গুরের জলে কলার মান্দাস ভাসাল যে একলা মেয়েটি,ভেসে গেল ঠিকানাহীন নিরুদ্দেশ সেই কি কবির হৃদয়ে গান হয়ে উঠল না কি সেই মানুষটি যে শত বিপণ্নতার প্রেক্ষাপটেও নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল সে হঠাৎ অন্ধকার ঠেলে সব মানুষের হয়ে গান গেয়ে উঠল?

কাব্য আসলে হাঁটাপথ বেয়ে জীবনেরই কথা বলে। বাংলার নিজস্ব সাহিত্যচর্চার একেবারে প্রথম ধাপটিতেই লেখা মঙ্গলকাব্য-কথা। এ সেই সেদিনের কথা যেদিন জলাজঙ্গলে ঢাকা বাংলার কালো মানুষগুলো আর্য-ভারতের কাছে ব্রাত্য ছিল,জীবন বয়ে যেত তিরতিরে স্রোতে নিজস্ব ধারায়,মানুষ বাঁচত মাটির ছন্দে।

আবহাওয়ার নিয়মেই এ জায়গা সাপের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। সেই কোন আদিম সময় থেকে অরণ্যচারী মানুষ ভয় পেতে শিখেছে এই সরীসৃপটিকে,ধীরে ধীরে তার উপরই আরোপ করেছে দেবত্ব, পুজো করেছে,দয়া প্রার্থনা করেছে।

মনসা,বাংলার সর্পদেবী। ইতিহাসের ধুলো সরিয়ে এই দেবীর যাত্রাপথ খুঁজবো আমরা।

সেই কোন ভুলে যাওয়া অতীতে ইউফ্রেটিস নদীর ধারে থাকত তুরানী উপজাতি,তারা ছিল সর্প উপাসক। একসময় তারা এদেশের পশ্চিমসীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়ল সিন্ধুনদের তীরে,ঘর বানাল,চাষ করল সঙ্গে আনল তাদের উপাস্যকেও। এরাই দ্রাবিড়দের আদিপুরুষ। সিন্ধুনদের তীরে হরপ্পা আর মহেঞ্জদরোতে এদেরই সর্প দেবতার মূর্তি পাওয়া গেছে। এখনো বালুচিস্তানে ব্রুহাই ভাষী দ্রাবিড়রা রয়েছে। ভারত ছাড়া আরো যে যে দেশে তারা গেছে যেমন গ্রিস স্ক্যান্ডানেভিয়া ইত্যাদি জায়গাতেও সর্পপূজার প্রথা এরাই বয়ে নিয়ে গেছে।

এই তুরানী দ্রাবিড়রাই পরে আর্যদের কাছে হেরে গিয়ে সরে যায় দাক্ষিণাত্যের দিকে। বাকিরা চলে যায় পূর্বদিকে আসাম ,ত্রিপুরা,বাংলায়।সেখানে কখনো অস্ট্রালয়েড কখনো বা মোঙ্গলদের সাথে মিশে তৈরি হতে থাকে এক মিশ্র জাতির।

আজকের মনসা আসলে দ্রাবিড় বৌদ্ধ আর ব্রাহ্মণ্য তিন ধারার মিশেলে পাওয়া এক দেবী। বৌদ্ধ মহাযানদের তন্ত্রমতে জাঙ্গুলি নামে এক দেবী পাওয়া যায়। তিনি শুক্লবর্ণ,শুক্ল অলঙ্কার শোভিতা,বীণাবাদিনী,কোথাও বা ময়ূরপালক হাতে লেখনীর প্রতীক হিসেবে। সেই হিসাবে সরস্বতীর সাথে মিল প্রচুর। এঁরই একহাতে সাপ।

যজুর্বেদে সঙ্গীতের মতো সর্পবিদ্যারও কথা বলা আছে। আবার সরস্বতীকে বলা হয়েছে বিষনাশিনীও। অথর্ববেদে সর্পবেদ আর সর্পবিদ্যা নামে দুই শাস্ত্রের কথাও আছে। তাহলে বলাই যায় এই জাঙ্গুলিতারা আর সরস্বতী প্রায় একই।

আর্য সমাজে স্ত্রীদেবতার পুজোর চল ছিলনা। কিন্তু চন্ডী, কালি ইত্যাদি লৌকিক দেবীর মত মনসারও পৌরাণিক পরিচিতি পাবার কারণ মনে হয় এ দেশের প্রবল সংস্কারের প্রভাব,সাথে সর্পভীতি। শীতের দেশে সাপের উপস্থিতি কম,তুলনায় ভারতের উষ্ণ ভেজা আবহাওয়া সাপের পক্ষে অনুকূল এবং তার ছাপ পড়ে সমাজ ও লোকাচারেও।

তবুও খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর আগে সর্পদেবী হিসাবে মনসার গুরুত্ব সেভাবে পৌরাণিক সাহিত্যে জায়গা পায়নি। প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ এবং দেবীভাগবতে।কাজেই ইতিহাসের নিয়মে হয়ত তারও বেশকিছু আগে প্রায় দশম একাদশ শতাব্দীতে মনসাপূজা আর্য সমাজেও চালু ছিল।

পাশাপাশি দক্ষিণাত্যে মুদমা, মঞ্চাম্মা ইত্যাদি নামের সর্পদেবীর খোঁজ পাওয়া যায়।মঞ্চাম্মা এক ধরনের সাপ। তাতে দেবত্ব আরোপ করে পুজো করেন দুএকটি আদিবাসী গোষ্ঠী। মুদমা মূর্তি মহীশুরে ব্যাপক হারে পাওয়া গেছে মন্দির ভাস্কর্যেও। বাংলার বর্তমান মনসা সম্ভবতঃ পৌরাণিক দেবী সরস্বতী,জাঙ্গুলিতারা ও মুদমার মিলিত রূপ।

প্রাচীন মনসামূর্তির নমুনা হিসেবে পাওয়া গেছে বীরভূমের পাইকোড়ে, সেন বংশের প্রথম রাজা বিজয়সেনের তৈরি মূর্তিটি।সেন রাজারা দক্ষিণাত্য থেকেই এখানে এসে রাজত্ব করেছিলেন। সেক্ষেত্রে রাজার সাথে দক্ষিণভারতীয় বিশ্বাস ও লোকাচার বাংলায় আসাই স্বাভাবিক,এবং তা সহজেই মিশেও গেছে বাংলার দ্রাবিড় সংস্কারের সাথে। সমাজতাত্বিকের ধারণা যদি কোনো সংস্কার বা প্রথা অন্য সমাজে গিয়ে সহজেই মিশে যেতে পারে তবে বুঝতে হবে সেই প্রথা ওই সমাজেও প্রচ্ছন্নভাবে বহমান ছিল। এক্ষেত্রেও আদতে দুই দ্রাবিড় সংস্কৃতির মূলগত বনিবনা সহজেই হয়েছে এবং সর্পদেবীর পূজা বাংলায় হাজার বছরেরও প্রাচীন সংস্কার বলেই প্রমাণ হয়।

'মনসা' নামের উৎপত্তি কিন্তু সঠিক বলা মুশকিল। মহাভারত বলছে জরৎকারু কাশ্যপের মানসকন্যা,শিবের শিষ্যা। বাসুকির বোন। চতুর্বেদ বিশারদ।জরৎকারু মুনির স্ত্রী। অস্তিকের মাতা। আস্তিকের কৃতিত্ব হল জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞের সময় নাগকুলকে রক্ষা করা।

মনে করা হয় অনার্য মনসা চরিত্রে আভিজাত্য যোগের উদ্দেশ্যই মনসা এবং জরৎকারু এক ও অভিন্ন করে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে পরবর্তী সময়ে,যদিও মহাভারতে মনসা নামের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়না এবং জরৎকারু চরিত্রেও দেবত্ব আরোপিত হয়নি।

আবার অন্যদলের পন্ডিতরা বলছেন মনচা আম্মা―> মনসা মা উৎপত্তি হতে পারে। দক্ষিণী ভাষায় চ এর উচ্চারণ প্রায় স এর মতো। তবে এমতও স্থিরভাবে বলা মুশকিল। চেংমুড় হল তেলেগু ভাষায় ফনীমনসা গাছ। ফনীমনসা গাছের নিচেই মনসাপুজো হয় বাংলায়। চাঁদ সদাগর মনসাকে বলেছেন চেংমুড়ী কানী। অথচ চেংমুড়ী শব্দের কিন্তু কোনো বাংলা প্রয়োগ নেই। তাহলে এমনও ভাবা যেতে পারে এটি আদতে দক্ষিণী শব্দ।

পাণিনি বা অমরকোষে মনসা শব্দের উল্লেখ নেই,কাজেই বলাই যায় যে আদতে এটি কোনো অনার্য শব্দ সংস্কৃত ভাষার প্রভাবে রূপান্তরিত হয়ে এই নাম এসেছে।

এইসব জটিল বিবর্তনের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ঢুকে পড়ব মঙ্গলকাব্যের যুগে। পন্ডিতেরা বলছেন মনসামঙ্গল কাব্যের জন্ম মোটামুটি দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতাব্দী এবং তার অন্ততঃ দেড়শ বা দুশ বছরের আগে মনসাপুজোর রীতি চালু হয়।

সেসময় মনসা বন্দনার গান ছোট ছোট পালায় গাওয়া হত,কোনো লিখিত রূপ ছিলনা।

খন্ডে খণ্ডে ছড়িয়ে থাকা এইসব গান ও গল্প পরম্পরাকে একসময় পুঁথিবদ্ধ করলেন কোনো কবি,সেদিন থেকেই মনসামঙ্গল কাব্যের যাত্রা শুরু।

যদিও দ্বাদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত সমস্ত লেখকই তাঁদের রচনাকে মনসা পাঁচালী নামেই পরিচয় দিয়েছেন। প্রথম কবি হিসেবে নাম পাওয়া যায় কানা হরিদত্তের।তারপর একেএকে বিজয়গুপ্ত,নারায়ণ দেব,ষষ্ঠীধর,বিপ্রদাস,দ্বিজবংশীদাস কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ এবং আরো অনেকেই লেখেন এই মনসাপাঁচালী।

এইসব গল্পের অভিনবত্ব তেমন হয়তো নেই, এবং অনেকখানিই পুরাণের গল্পনির্ভর হলেও যা নিজস্ব তা হল চাঁদ সদাগরের গল্প। এ গল্পের হদিস নেই পুরাণে। চাঁদ আসলে মঙ্গলকাব্যের নিজস্ব চরিত্র।

এ গল্পও সেই সময়ের যখন ব্রাহ্মণ্য মাহাত্ম্য ভারী করে তোলেনি মানুষের বিশ্বাস ও লোকাচার। সমস্ত গল্পের কোথাও ব্রাহ্মণ চরিত্রের হদিস নেই।

চরিত্রের নামকরণ খেয়াল করলেও তা স্পষ্ট। চাঁদ, সোনেকা, বেহুলা, লখিন্দর , সাহো, হরিসাধু এসবই অনার্য নাম।

সমাজের মাথা তখন বণিকগোষ্ঠী। ধনী বণিক চাঁদ সমাজপতি। এ গল্পে দেব চরিত্রের চেয়ে মানবচরিত্রই প্রাধান্য পেয়েছে,মাহাত্ম্যও মানুষেরই। দেবচরিত্র নেহাতই পূজার ভিক্ষাপ্রার্থী,তাই নিয়েই গল্পের অলিগলি।

মঙ্গলকাব্য হিসাবে মনসামঙ্গলের জনপ্রিয়তার কারণও বুঝি তাই। এ মানুষের নিত্যকার সুখদুঃখ চাওয়া পাওয়ার গল্প। সোনেকার চরিত্রটি যে কোনো মাঝবয়সী মহিলার রোজনামচা।ইতিহাসের হিসাবে সেসময় বাংলায় এসেছে মুসলমান শাসক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিড়ম্বনায় মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে চারিত্রিক আদর্শ। চাঁদ সেই আদর্শের প্রতীক। তুলনায় ব্যতিক্রমী বেহুলা। বঙ্গনারীর তুলনায় সে অনেকবেশী স্বাধীনচেতা, সাবলীল ও সাহসী। স্বর্গের সভায় তার নৃত্য প্রদর্শনের নমুনাও বাংলার সমাজে বিরল। এই নৃত্যবিদ্যা দক্ষিণের মন্দিরে সুপ্রচলিত। দেবদাসী সেই প্রথার নাম। সে হিসাবে অনেকে এই গল্পকে দক্ষিণের গল্প বলেও মনে করেন। তবে কি এই গল্পের চরিত্রেরা বাস্তবে কোথাও ছিল?

দুই বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ,বিহার আসাম ত্রিপুরায় চাঁদের বাড়ি,লখিন্দরের বাসর,নেতি ধোপানীর ঘাট ইত্যাদির লোকপ্রবাদ চালু রয়েছে। অনেকে বলেন বিহারের চম্পাই নামের জায়গাই চাঁদ সদাগরের চম্পকনগরী। সোনেকা, মানিকো, সাহো এইসব নামের সাথে ওই অঞ্চলের নামকরণরীতিরও মিল পাওয়ায় পন্ডিতেরা মনে করছেন বিহারই হল মনসামঙ্গলের গল্পের উৎসস্থল। বাসর ঘরে নববধূর বৈধব্যের গল্প হয়ত সত্যি,তেমনই সত্যি হয়ত চাঁদ সদাগরের মতো ব্যক্তিত্ব। সমাজের উঁচুতলায় থাকা সর্বজনমান্য শৈব মানুষটির কাছে পুজো পেলে যে এক লৌকিকদেবীর সামাজিক প্রতিষ্ঠা হয় এও সত্যি।

সাহিত্য হিসাবে মনসামঙ্গল খুব উঁচুদরের কদর পায়নি কখনও। মুকুন্দরাম কিংবা ভারচন্দ্রের মতো কবির পরশ পায়নি এইসব লেখা। তা সত্বেও বাংলা বিহার আসামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রায় একই গল্প অবিকৃত ভাবে স্বীকৃত হয়েছে দেখেও একথা মনে হওয়া স্বাভাবিক গল্পটির কাহিনী সত্যতা না থাকলে এমন ব্যাপক স্বীকৃতি সম্ভব ছিলনা। আর এসব টুকরো সত্যি ঘিরেই হয়ত কবিকল্পনা গল্প তৈরি করে যা কালক্রমে হয়ে ওঠে মঙ্গলকাব্য।

এতদূর পায়ে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে যখন হাঁফিয়ে উঠবে পাঠকের মন,তখন যাবার আগে টুক করে বলে যাই এ কাব্য কেন মঙ্গলকাব্য।

মঙ্গল মানে সুর করে গাওয়া গান। মঙ্গল মানে দেবতার আশীর্বাদ কামনায় প্রার্থনা। আবার এই গান মঙ্গলবার শুরু হয়ে একসপ্তাহ পরে আরেক মঙ্গলবার শেষ হয়,যদিও মনসামঙ্গল ব্যতিক্রম। এই গান সারা শ্রাবণমাস জুড়ে গাওয়া হয়। একে ভাসানের গানও বলে।

সমস্ত মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে মনসামঙ্গলই সবচেয়ে বেশী প্রচার পেয়েছে। তার কারণ বোধহয় চরিত্রগুলির বাস্তব চিত্রায়ন। সাধারণের সুখদুখের সাথে চরিত্রগুলিকে মিলিয়ে দেবার দক্ষতা,তাই মনসামঙ্গল বাঙ্গালীর প্রাণের কথা হয়ে থেকেছে বহু শত বছর। আজও সেই স্রোত বহমান।

ফিরতি পথে বিকেল ফুরানো আলোয় হয়ত আজও কানে ভেসে আসবে লখিন্দরের করুণ আর্তনাদ.....


"ওঠো ওঠো ওহে প্রিয়া কত নিদ্রা যাও।

কালনাগে খাইল মোরে চক্ষু মেলি চাও।।

তুমি হেন অভাগিনী নাহি ক্ষিতিতলে।

অকারণে রাঁড়ি হইলা খন্ড ব্রত ফলে।।

কত খন্ড তপ তুমি কৈলা গুরুতর।

সে কারণে তোমা ছাড়ি যায় লখিন্দর।।

মাও সোনকা মোর মৃত্যু কথা শুনি।

অগ্নিকুন্ড করি মাও ত্যজিব পরাণি।।

আমার মরনে মায় বড় পাবে তাপ।

পুত্রশোকে মাও মোর সাগরে দিবে ঝাঁপ।

......."

গুনগুনিয়ে উঠবে সুর,পাক খাবে বাংলার মাঠেঘাটে, জমিতে, হাওরে....

আমরা হেঁটে যাব হাজার বছরের পথ অবিরাম।
0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in






শীত যাচ্ছে, বাজারে শাকসব্জীর দাম ফের চড়তে শুরু করেছে। বাজেটের দিন এল এবং গেল। তাতে সরকারের আয়ব্যয়ের ফিরিস্তির সঙ্গে রয়েছে আগামী বছরের করব্যবস্থা। মানতেই হবে, বাজেটে একটা ঘোষণা চমকে দিয়েছে। যাদের বার্ষিক আয় ১২ লক্ষ টাকা তাদের নাকি এক পয়সা আয়কর দিতে হবেনা। ঠিক করে বললে—বার্ষিক আয় ১২.৭৫ লক্ষ পর্য্যন্ত জিরো আয়কর। পেনসনভোগীদের জন্য লক্ষণরেখাটি ১৩ লক্ষ। কারণ, স্ট্যান্ডার্ড ডিডাকশন হল ৭৫ হাজার, এবং পেনসনভোগীদের জন্য এক লক্ষ। ফলে আমার মত পেনসনভোগী এবং আরও অনেকে প্রথমে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করে নিল।

তারপর একটু ভাবতেই কপালে ভাঁজ। পুরনো আয়কর নিয়মেও ৭ লক্ষ পর্যন্ত বার্ষিক আয়ে কর দিতে হত না। তাহলে তাঁরাই লাভবান হলেন যাঁদের বার্ষিক আয় ৭ থেকে ১৩ লক্ষের মধ্যে! ফলে আমার মত লোকের কোন লাভ হয়নি। লাভ হয়েছে নাকি মধ্যবিত্তের বা মিডল ক্লাস। এখন এই মিডল ক্লাস সংজ্ঞাটি বড় গোলমেলে। কাকে বলব মিডল ক্লাস?

বিগত ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে বাজেট পেশের (২০২৩-২৪) আগে বিত্তমন্ত্রী সীতারামন বলেছিলেন যে মিডল ক্লাসের কষ্ট উনি বোঝেন, কারণ উনিও তাই। কী কাণ্ড! ওঁর মাসিক বেতন তো ২ লক্ষ টাকা, মানে বার্ষিক ২৪ লক্ষ!

তাহলে আয়করে কী ধরণের ছুট দিলে এই মাগ্যি গণ্ডার বাজারে সাধারণ মানুষের একটু সাশ্রয় হত? এই আলোচনা গুছিয়ে করার আগে একটা কথা বলা দরকার।

আমাদের দেশের কাঠামো হল আধুনিক কল্যাণকারী রাষ্ট্রের। আমরা ধরে নিই সরকার আয়ের জন্য বিভিন্ন খাতে ট্যাক্স আদায় করবে এবং তার উল্লেখযোগ্য অংশ খরচ হবে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং অধিকাংশ মানুষের খাদ্য-বস্ত্র ইত্যাদির গ্যারান্টির খাতে। আমাদের আইনের চোখে সব নাগরিক সমান, প্রধানমন্ত্রী বলেন—সব কা সাথ, সবকা বিকাশ।

বেশ কথা। সরকারের আয়ের একটা বড় অংশ আসে আয়করের মত প্রত্যক্ষ কর এবং পণ্য ও বিক্রয় কর (জিএসটি) গোছের অপ্রত্যক্ষ কর থেকে।

সজাগ নাগরিক হিসেবে কর দিতে কোন আপত্তি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু একই সঙ্গে এটা দেখা দরকার যে সেই করের বোঝা কাদের উপর বেশি চাপানো হচ্ছে আর সেই আয় সরকার কাদের উপর বেশি খরচ করছেন। এই নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমরা শুধু করের ভার নিয়ে আলোচনা হবে।

একটা ভুল ধারণা জনমানসে গেড়ে বসেছে—গরীব মানুষ ট্যাক্স দেয় না, শুধু উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত দেয়। গরীব মানুষ কেবল সরকারের থেকে খয়রাত পায়। কথাটা সর্বৈব ভুল। ট্যাক্সো সবাই দেয়। আমির-গরীব সবাই। কীভাবে?

উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত দেয় আয়কর, সম্পত্তি কর জাতীয় প্রত্যক্ষ কর যা প্রগ্রেসিভ। অর্থাৎ সবার জন্য সমান নয়, যার আয় বেশি তার করের অনুপাত বেশি। কিন্তু গরীব মানুষ দেয় বিক্রয় কর—জিএসটি। এই অপ্রত্যক্ষ কর সবার জন্যে সমান। ওষুধ কিনলে, আনাজপাতি কিনলে, দোকান থেকে জিনিস কিনলে প্রত্যেকটি জিনিসের জন্য উচ্চবিত্ত বা বিত্তহীন সবাইকে সমান জিএসটি হয়—তাই এই ট্যাক্সটি বিষমানুপাতি বা রিগ্রেসিভ।

গত কয়েকটি ত্রৈমাসিকের আর্থিক তথ্যের বিশ্লেষণ বলছে তিনটে কথা—শিল্পোৎপাদনের নিম্নগতি, বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি। তার সঙ্গে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে আর একটা কথা—মধ্যম বর্গ বা মিডল ক্লাস শেষ হয়ে যাচ্ছে।

কেন মধ্যমবর্গের কথিত বিলুপ্তি নিয়ে এত চিন্তা?

কারণ মহানগর ও শহরে অধিকাংশ ভোগ্যপণ্যের ক্রেতা এই মধ্যম বর্গ। দেশের সমস্ত মল এবং বিপণিতে থরে থরে যে পণ্যসম্ভার সাজানো থাকে তার লক্ষ্য প্রধানতঃ উচ্চবর্গ এবং মধ্যমবর্গ বা মিডলক্লাস। হিসেব সোজা; উচ্চবর্গের উপভোক্তার সংখ্যা কম। তারা কিনবে ইম্পোর্টেড ও প্রিমিয়ার আইটেম, মূলতঃ যেগুলো বিলাসদ্রব্যের আওতায় পরে।

মিডিয়ায় এবং সাইনবোর্ডে বিজ্ঞাপনের লক্ষ্য এই বিশাল মিডলক্লাস, যার বিকাশ হয়েছে মূলতঃ এই শতাব্দীর প্রথম দশকে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের খোলা বাজার নীতির ফলে। মিডলক্লাসকে উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন কনজিউমার লোন বা ভোগ্যবস্তু কেনার জন্যে সহজ ঋণ এবং ওভারড্রাফট দিতে ব্যাংকগুলিও মুখিয়ে আছে।

কিন্তু দুটো দশক পেরোতেই কী হয়েছে?

২০২৪ সালের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে ভারতের সবচেয়ে বড় এফ এম সি জি হিন্দুস্থান ইউনিলিভারের প্রফিট ৩.৭% কমে গেছে। এফ এম সি জি মানে ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস; এতে অধিকাংশ মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন ব্যবহারের প্যাকেজ করা ভোগ্য পণ্য যেমন সব খাবার জিনিস, প্রসাধন, ঘর পরিষ্কারের কেমিক্যাল, হেলথ সাপ্লিমেন্ট, বাচ্চার ডায়পার সবই পড়ে।

হিন্দুস্থান ইউনিলিভারের সিইও রোহিত জাভা, নেসলে ইণ্ডিয়ার চেয়ারম্যান সুরেশ নারায়নন, টাটা কনজিউমার প্রোডাক্টসের এবং আইটিসি লিমিটেডের মুখপাত্র সবার একই সুর -- শহরের মিডল ক্লাসের ক্রয়ক্ষমতা কমছে, তাই বাজারে ডিমান্ড কমছে, ভোগ্যবস্তুর যোগান কমছে এবং দাম বাড়ছে।

কেন দেশের এই দুরবস্থা? বড় বড় করপোরেট ঘরানা বলছে দুটো কারণ।

এক, শহুরে মধ্যমবর্গের ক্রয়ক্ষমতা সমানে কমছে। মুদ্রাস্ফীতি ও করের বোঝার ভারে ওদের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমহ্রাসমান।

দুই, অধিকাংশ সাধারণ মানুষ পরিশ্রম বিমুখ, খাটতে চায় না।

আমরা দুটো বক্তব্যকেই খুঁটিয়ে দেখব।

মধ্যবর্গ বা মিডলক্লাস কারা?

আমরা বর্তমান নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিসরের কথা মনে রেখে একাডেমিক বিতর্ক এড়িয়ে একটি খুব সরল আর্থিক সংজ্ঞাকে বেছে নেব। ভারতের সমাজকে আয়ের ভিত্তিতে মোটাদাগের এই বর্গবিভাগটি করেছেন জনৈক ব্যবসায়ী কিশোর বিয়ানী।

উপভোক্তার বর্গভেদ লোকসংখ্যা গড় বার্ষিক আয়

উচ্চবর্গ ১২ কোটি ১২.৩ লক্ষ টাকা

মধ্যম বর্গ ৩০ কোটি ২.৫ লক্ষ টাকা

আবার ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ অ্যাপ্ল্যায়েড রিসার্চের মতে মিডল ক্লাস হল যাদের পারিবারিক আয় বার্ষিক ২ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ আয়ের লোকজন।

উচ্চবর্গের রয়েছে বিশাল চল-অচল সম্পত্তি এবং শেয়ারে বিনিয়োগ করার মতন বাড়তি আয়। বিদেশ ভ্রমণ এবং বিদেশি বিলাসিতার পণ্য কেনা এঁদের কাছে জলভাত। এঁদের চিকিৎসাও দরকারে বিদেশে হয়। রাজনীতি এবং ক্ষমতার অলিন্দে এঁদের অবাধ এবং মসৃণ যাতায়াত।

মধ্যমবর্গের অধিকাংশ চাকুরিজীবি; রয়েছে নিজস্ব বাড়ি অথবা ফ্ল্যাট, ছোট গাড়ি, ব্র্যাণ্ডেড জামাকাপড়, উচ্চশিক্ষা, বীমার সাহায্য নিয়ে প্রাইভেট নামী হাসপাতাল বা নার্সিং হোমে চিকিৎসার সুবিধে, ছেলেমেয়েদের দামী স্কুলে ভর্তি করা, ছুটিতে বেড়াতে যাওয়া, ভাল রেস্তোরাঁয় মাঝেমধ্যে খাওয়াদাওয়া এবং সামান্য হলেও কিছু আর্থিক জমাপুঁজি যার জোরে সাময়িক আর্থিক এবং পারিবারিক সংকট সামলে নেয়া যায়।

জনসংখ্যার বাদবাকি অংশ, প্রায় ৯০ থেকে একশ কোটি, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ঘর চালাতে ব্যস্ত। কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় ৮০ কোটি জনসংখ্যাকে নিয়মিত, এবং প্রায় বিনামূল্যে রেশন পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করে এই বর্গভেদকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। একই কথা বঙ্গের দুয়ারে- রেশন জাতীয় যোজনার ব্যাপারেও প্রযোজ্য। শুরু হয়েছিল কোভিডের সময়, এখন বাজারের যা অবস্থা তাতে সরকার বাধ্য হয়েছে অমৃতকালে এই ধরণের অমৃত বিতরণের ব্যবস্থা করতে।

এদের কোন জমাপুঁজি নেই। অসুখ হলে যায় সরকারি হাসপাতাল-- যার অবস্থা সবাই জানেন। উত্তর প্রদেশ এবং কোলকাতায় গত কয়েক বছরে ব্যাপক শিশুমৃত্যুর খবর এখনও স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি।

গরীব মানুষ আলসে?

বড় বড় শিল্পপতি ঘরাণার কথা শুনুন, মনে হবে দারিদ্র্যের আসল কারণ ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমের অভাব, ওরা অলস।

ইনফোসিসের নারায়ণ মূর্তির বক্তব্য ভারতের চাকরিজীবিদের সপ্তাহে ৭০ ঘন্টা কাজ করা উচিত। আর একজন বিজ্ঞের মতে সপ্তাহের শেষে শনি-রবি ছুটি নাকি পাশ্চাত্য সংস্কার, আরেকজনের নিদান—রবিবারে বৌয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে না থেকে অফিসে চলে এস।

কিন্তু বাস্তব চিত্রটি কী?

সব বড় কর্পোরেট ঘরানার লাভ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, অথচ কর্মচারিদের বাস্তবিক মাইনে কমছে। অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতির দরের চেয়ে কম দরে বৃদ্ধি হচ্ছে—এটাই মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের আসল কারণ।

The FICCI-Quess Corp Income Report 2022-23 বলছে “ profit of Indian corporates across six major sectors increased 4 times. Real Salary growth negative”. এর অর্থ গড় মুদ্রাস্ফীতির দর 5.7% , বেতনবৃদ্ধির দর তারচেয়ে বেশ কম।

খোদ ভারত সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ভি নাগেশ্বরন বলছেন-- Corporate profitability has gone up from 5.3 trillion in FY 20 to 20.6 trillion in FY 23. Wage growth has not grown in the same pace.

এক দিকে তো কোম্পানিগুলো সুপার প্রফিট করছে, অথচ কর্মচারিদের মজুরি বেতন ইত্যাদি বাড়াতে কোন আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আবার কেন্দ্রীয় সরকার তাদেরই কর আদায়ে বিরাট ছাড় দিচ্ছে। ২০১৯ থেকেই মোদী সরকার কর্পোরেট ট্যাক্স কমাতে শুরু করে।

৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ বিত্তমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন গোয়াতে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে জানান যে ভারত সরকারের বিত্ত মন্ত্রক Taxation Law (Amendment) Ordinance 2019 আয়কর আইন (সংশোধন) অর্ডিনান্স জারি করে income Tax Act 1961 Finance (nO.2) Act 2019।তাতে দেশি কোম্পানির জন্য কর্পোরেট ট্যাক্স কমিয়ে ২২% এবং নতুন কোম্পানির জন্য ১৫% করা হয়েছে। আরও অনেক সুবিধে দেয়া হয়েছে, উদ্দেশ্য তাতে দেশে বিনিয়োগ বাড়বে , শিল্পের বিকাশ হবে এবং আম জনতার চাকরি ও রোজগার বৃদ্ধি হবে। এই ছাড় দেয়ায় সেবছরই ভারত সরকারের ১.৪৫ লাখ কোটি আয় কমে যায়। আর শিল্প , রোজগার এবং বিনিয়োগ যে কী বেড়েছে, কোথায় বেড়েছে সেটা এখন সবাই জানেন।

অক্সফ্যামের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী

এটা খেয়াল করার মত যে ২০১৯ সালে সরকারের কর থেকে আয়ের ৫৮.৩% আদায় হত কর্পোরেট ট্যাক্স থেকে। এখন ২০২৩-২৪ সালে সেই প্রতিশত নেমে এসেছে ৪৬.৫% পর্য্যন্ত। অর্থাৎ আয়কর দাতা মধ্যম বর্গ থেকেই সরকারের কর আদায় বেশি হচ্ছে। এবার ১১.৫৬ লাখ কোটি টাকা বা ট্রিলিয়ন আসছে আয়কর থেকে, আর কর্পোরেট ট্যাক্স থেকে ১০.৪২ লাখ কোটি, (অনুমানিত) ২০২৪-২৫।

দেশের জনসংখ্যার মাত্র ৩% আয়কর দেয়। কিন্তু ওই ৩% থেকে দেশের সমস্ত কর্পোরেট ঘরাণার থেকে বেশি কর দিচ্ছে।

মনমোহন সিং সরকারের সময় সরকারের সমস্ত আয়ের ৩৫% আদায় হত করপোরেট ট্যাক্স থেকে, বর্তমান সরকারের সময় সেটা নেমে ২৬% হয়েছে।

অনেক আন্তর্জাতিক স্তরের অর্থনীতিবিদের মতে ভারতের মত দেশের সরকারের আমদানি আয়করের উপর বেশি নির্ভরশীল হওয়া সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়।

গল্পটা এখানেই শেষ নয়। মধ্যম বর্গ নিজের মাইনে এবং অন্য আয়ের উপর ট্যাক্স দেয়। কিন্তু করপোরেট ট্যাক্স দেবে নিজের আয় থেকে খরচা কেটে শুধু প্রফিটের উপর। দেশের সবচেয়ে বড় দশটি কর্পোরেট ঘরানা ১৯৮২ সাল পর্য্যন্ত লাভের উপর কোন ট্যাক্স দেয় নি। এদের বলা হয় জিরো ট্যাক্স কোম্পানি। এমনকি রিলায়েন্স ৩০ বছর জিরো ট্যাক্স কোম্পানি ছিল, ১৯৯৬-৯৭ সালে প্রথম ট্যাক্স দেয়। তারপর রয়েছে ট্যাক্স-মুক্ত কিছু দেশে শেল কোম্পানি (কাগুজে কোম্পানি) খুলে ট্যাক্স এড়িয়ে যাওয়া।

সাম্প্রতিক কালে পানামা পেপার্স ঘটনায় আদানি পরিবারের বিনোদ আদানির শেল কোম্পানি নিয়ে সুপ্রীম কোর্ট তদন্ত করার নির্দেশ দিয়েছিল।

এই পুঁজিবন্ধু নীতির ফলে দেশের বাকি জনতার কী অবস্থা।

অক্সফ্যামের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের জনসংখ্যার মাথাপিছু আয়ের তালিকায় নীচের দিকের ৫০%

জনতার রাষ্ট্রীয় আয়ে ভাগীদারি মাত্র ১৩% , আর রাষ্ট্রীয় সম্পদে অধিকার ৩% এর কম।

এবার দেখা যাক জিএসটি নামক রিগ্রেসিভ ট্যাক্সের বোঝা কার ঘাড়ে বেশি।

একই অক্সফ্যাম রিপোর্ট বলছে নীচের ৫০% থেকে জিএসটির ৬০% এর বেশি আদায় হচ্ছে, আর জনসংখ্যার ৪০% যে মধ্যমবর্গ, তাদের থেকে জিএসটি আদায় হচ্ছে ৩৩%, অথচ শিখরে বসে থাকা উচ্চবিত্ত ১০% দিচ্ছে ৩-৪% জিএসটি।

সবার দরকারি জিনিস যেমন ওষুধের ৮০% আইটেমে, জিএসটি ৯% থেকে বেড়ে ১২%, হয়েছে।

এমনকি জীবন বীমা এবং মেডিক্লেমেও জিএসটি ১৫% থেকে ১৮% প্রতিশত!

তাহলে দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশ মানুষ সরকারের থেকে কী পরিষেবা পাচ্ছে? সরকারি স্কুল ও হাসপাতালের মান খারাপ হলেও সাধারণ মানুষ প্রাইভেট স্কুল ও হাসপাতালে যেতে পারে না। রাস্তাঘাট, পরিবেশ দূষণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। কিন্তু এইসব ইস্যুতে বাজেটের কত প্রতিশত খরচের জন্য নির্ধারণ করা হয়? এসব দেখেই যখন সংসদে দিল্লির এক সাংসদ রাঘব চাড্ডা সরকারের দিকে আঙুল তুলে বলেন যে তোমরা কর আদায় কর ইংল্যাণ্ডের মত, অথচ পরিষেবা দাও আফ্রিকার সোমালিয়ার মত, তখন আমরা সায় না দিয়েই পারি না।

বিশ্ব অসাম্য পরীক্ষাগার

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি (ফ্রান্স) তাঁদের ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুয়ালিটি ল্যাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আয়ের কাটাছেঁড়া করে বলেছেন—আয় বৈষম্যের ব্যাপারে ভারত ইতিমধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে আয়-অসাম্যের দেশের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। গত কয়েক দশকে জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হয়েছে বটে, কিন্তু বেশিরভাগটাই গেছে জনসংখ্যার উপরতলার ১০% এর পকেটে; ঠিক করে বললে তাদের মধ্যেও উপরের ২% এর হাতে।

ফলটা ভালো হয়নি। সাধারণ মানুষের বাস্তবিক আয় কমেছে। বাজারে উপভোগ বস্তুর চাহিদা কমেছে এবং বেসরকারি বিনিয়োগে ভাটার টান দেখা যাচ্ছে। এই কথাগুলো নানা ভাবে সরকারের বাজেট পূর্ব আর্থিক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনেও এসেছে। কিন্তু বিত্তমন্ত্রীর বাজেটে তার প্রতিফলন কোথায়? পরিকাঠামোতে বড় বিনিয়োগের কথা রয়েছে, তাতে বড় শিল্পপতি এবং সরকার যুক্তভাবে কাজ করবে এবং বার্ষিক ১২ লক্ষ আয়ে আয়করে ছুট—আর কিছু?

শিক্ষা, গবেষণা এবং স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের প্রতিশত প্রতিবছর কমছে।

সবচেয়ে বড় কথা গত একদশকের বাজেটে যেসব লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছিল, যেসব বড় বড় যোজনার কথা বলা হয়েছিল (যেমন, কৃষিক্ষেত্রে আয় দ্বিগুণ করা, ‘নমামি গঙ্গে’ যোজনা) তার উপলব্ধি -- সে নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য দেখলাম না।

সরকারের বিত্তীয় ঘাটতি (ফিসক্যাল ডেফিসিট) কম করার দুটো উপায়— করের মাধ্যমে আয় বাড়ানো এবং খরচ কমানো। দেখা যাচ্ছে সরকার আয়করে কর্পোরেট ঘরাণাকে বড় ছাড় দিয়ে জিএসটি বাড়িয়ে জনতার থেকে নিজের আয়ের ভরপাই করছেন। অন্যদিকে শিক্ষা স্বাস্থ্য খাতে হাত টেনে রেখেছেন। চিন স্বাস্থ্যখাতে ৭.১৯% এবং গবেষণায় জিডিপি’র ২.৪৩% , ভারত ১.৮৪% এবং ০.৬৫%।

অন্য উপায়?

পিকেটির মতে উপরের সারির বিত্তবানদের বা কর্পোরেট ঘরাণার থেকে চড়া হারে সম্পত্তি/বিত্ত কর আদায়।

শোনামাত্র অনেকে আপত্তি করছেন।

তাঁদের বক্তব্যঃ ভারতের মত দেশে সম্পত্তি/বিত্ত কর (wealth tax) লাগিয়ে লাভ হবে না। এই কর আদায় করতে আয়ের চেয়ে প্রশাসনিক খরচ বেশি হবে।

কিন্তু যাঁরা সম্পত্তি কর চড়া হারে লাগানোর পক্ষে তাঁরা বলছেনঃ এটা অজুহাত। বর্তমান ভারতে আর্থিক এবং বিত্তীয় লেনদেনের রেকর্ড ডিজিটালাইজেশনের ফলে নির্দিষ্ট রেকর্ডের বা কেনাবেচার পাত্তা লাগানো খুব সোজা।

এরসঙ্গে দরকার সাধারণ মানুষকে রেহাই দিতে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস এবং পরিষেবার উপর জিএসটি হার কমিয়ে দেয়া। কিন্তু বাস্তবচিত্রটি ঠিক কী?

উপসংহার

জিএসটি কাউন্সিলের সাম্প্রতিক বৈঠকের পর বিত্তমন্ত্রী সীতারমনের প্রেস কনফারেন্স থেকে জানা গেল পপকর্নের তিনরকম জিএসটি ধার্য হয়েছে। সাধারণ মান—৫%, ব্র্যান্ড –১২% ,ক্যারামেল যুক্ত—১৮%

হাসব না কাঁদব?

এদিকে রোজকার চাল-ডাল-আটা-চিনি-ময়দার উপর জিএসটি দিতে হবে, কিন্তু বস্তা যদি ২৫ কেজির বেশি হয় তাহলে কোন জিএসটি দিতে হবে না।

একসঙ্গে ২৫ ২৫ কেজির দ্রব্য কে কিনতে পারে? হাসিম শেখ, রামা কৈবর্ত? আপনি আমি?

তাই এই বাজেটের আগে আমার বিনীত প্রশ্নঃ শাহেনশাহ্‌ , তুমি কোন শিবিরে?
0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in




















বলতে পারো বড়মানুষ মোটর কেন চড়বে,
গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?

                                                                     --সুকান্ত


একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো’র ডেটা বলছে ২০২১ সালে আমাদের গোটা দেশে বিভিন্ন ঘটনায় খুন হয়েছে ২৯,২৭২ জন। অথচ, ‘বেপরোয়া গাড়ি চালানো’য় মারা পড়েছে ৪৩, ৪৯৯ জন। তাহলে যারা বেপরোয়া গাড়ি চালায় তারা সবচেয়ে বড় খুনি? কারা চালায় অমন ভাবে গাড়ি? গতির নেশায় মাতাল হয়ে!

এদের কাছে আছে বুঝি মস্ত হাওয়াগাড়ি?

আছেই তো, মার্সিডিজ, পোর্শে, বিএমডব্লিউ,? কাদের আছে? যারা কোটি টাকার গাড়ি কিনতে পারে, জন্মদিনে নাতিকে অমন গাড়ি উপহার দিতে পারে।

তারপর সেই গর্বিত নাতি বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে গাড়িতে বসে আর হাওয়াগাড়ি উড়ে চলে হাওয়ার বেগে, দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে। পথচারীরা ঝড়ের সামনে শুকনো পাতার মত উড়ে যায়। আর ‘চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন’-- কেউ শোনে না।

চালকের কখনও মনে হয়-- ‘অজস্র মৃত্যুরে পার হয়ে আসিলাম’। সে গাড়ি থামায়, তবে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে। উদ্দেশ্য একটাই অপরাধ থুড়ি দুর্ঘটনার সাক্ষ্য মুছে ফেলা। নেমপ্লেট বদলে দেয়া, রক্তের দাগ ধোয়া, ড্রাইভার বদলে নেয়া।

কিন্তু পিষে দেয়া মানুষগুলো? যাদের সময়মত হাসপাতালে নিয়ে গেলে কিছুটা বাঁচার সম্ভাবনা ছিল? না, এরা হাওয়াগাড়ি থামিয়ে সেই লোকগুলোকে তোলে না। তাহলে যে দুর্ঘটনার দায় নিতে হবে! আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। বাজারে বদনাম হবে।

ব্যাপারটা বোধহয় আর একটু অন্যরকম।

আসলে এদের হয়তো কোন দোষ নেই। দোষ তাদের যারা গাড়ির সামনে এসে গেছল। হাওয়াগাড়ি তো হাওয়ার বেগেই চলবে।

তবুও সুর্য এখনও পূবে ওঠে, পশ্চিমে ডোবে।

তাই কিছু কেস খবর হয়। কিছু কেসে পুলিশ আসে, গ্রেফতার করে। জামিন হয়, মামলা চলে। মোটা টাকার অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। তারপর সবাই ভুলে যায়। ভোলে না নিহতদের পরিবার। ওরা ভগবানকে ডাকে আর আশা করে-- একদিন ন্যায়ের দণ্ড নামিয়া আসিবে।

দুর্ঘটনার ডিফেন্স

কেস খেলে এসবের জন্য বাঁধা ডিফেন্স আছে।

এক, আমি চালাচ্ছিলাম না, আমার ড্রাইভার চালাচ্ছিল।

--তাহলে ড্রাইভার জেলে যাবে। আমার অর্থদণ্ড হবে, ড্রাইভারের পরিবারকে মোটা টাকা দেয়া হবে। ওরা মুখ বুজে মেনে নেবে। একেবারে বজ্রসেন-উত্তীয় কেস!

দুই, আমি চালাচ্ছিলাম বটে, কিন্তু মদটা একটু বেশি গিলেছিলাম। চোখে আবছা দেখছিলাম। কাউকে চাপা দিয়েছি? আমার কিচ্ছু মনে নেই।

--এটা ভাল ডিফেন্স। সঙ্গে সঙ্গে আইন অনুযায়ী অপরাধের মাত্রা কমে যায়। কেসটা ধারা অনিচ্ছাকৃত নরহত্যা থেকে অসাবধানে মদ খেয়ে চালিয়ে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, অর্থাৎ ধারা ৩০৪ থেকে ৩০৪এ হয়ে যায়।

আহা, বেচারি! ভালমানুষ। একটু নেশা হয়ে গেলে কী করবে? ও খুনি নয়।

ফলে দু’বছরের জেল এবং মোটা অর্থদণ্ড। অথবা প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে শুধু অর্থদণ্ড। কেউ জিজ্ঞেস করবে না-- এই অবস্থায় কেন গাড়ি চালিয়েছিলে বা তোমার কাজের পুরো দায়িত্ব কেন তুমি বইবে না?

তিন, আমি পূর্ণবয়স্ক নই। ১৮ পূর্ণ হতে এখনও চার দিন বাকি! আমার বিচার প্রাপ্তবয়স্কদের আইনে হবে না, জুভেনাইল বা অপ্রাপ্তবয়স্কদের আইনে হবে।

--এই কেসে গার্জেনদের দু’বছরের জেল এবং মোটা অর্থদণ্ড হবে। গাড়িটির লাইসেন্স একবছরের জন্য বাতিল। আর আদরে বাঁদর হওয়া কুলতিলক যাবেন সংশোধনাগারে ,মানসিক কাউন্সেলিং এর জন্য—সেটা তার নিজের মাসির বাড়িও হতে পারে। আর তাকে কয়েকমাস বা এক বছর কমিউনিটি সার্ভিস করতে হবে।

সেটা কী জিনিস কেউ জানে না। কোন আইনে বলা নেই। সেটা কি মন্দিরে করসেবা? হাসপাতালে কাউন্টারে বসা? নাকি এক লক্ষ বার রামনাম লেখা? শুধু বিচারক জানেন। কিন্তু আদরে বাঁদর ছেলের কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডের জন্য কোন ধনীর দু’বছরের জেল হয়েছে শুনেছেন কখনও? আমি তো শুনি নি। শুনলে বলবেন তো!

চেনা গল্পঃ চেনা ছক


রাজধানী দিল্লি; এপ্রিল ২০১৬। মার্কেটিং পেশার সিদ্ধার্থ শর্মা (৩২) কাজের শেষে বাড়ি ফেরার পথে নর্থ দিল্লির সিভিল লাইন্স এলাকায় একটি মার্সিডিজের নীচে পিষে গেলেন। যে ছেলেটি বাবার গাড়ি চালাচ্ছিল তার বয়েস ১৭ বছর ৩৬১ দিন। অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক হতে মাত্র চার দিন বাকি।

ছেলেটির লাইসেন্স ছিল না। পুলিশের রেকর্ড বলছে সে এর আগেও তিন বার ট্রাফিক আইন ভেঙে ফাইন দিয়েছে। তদন্তে দেখা যাচ্ছে যে ও ট্রাফিক পুলিশের কাছে তিনবারই ‘মিথ্যে’ তথ্য দিয়েছিল। ছেলেটির পরিবার তাদের বাড়ির ড্রাইভারকে থানায় পাঠিয়ে দিল –যাও, গিয়ে বল যে তুমিই তখন গাড়িটা চালাচ্ছিলে।

সিসিটিভির ফুটেজ, চাকার দাগ এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে পুলিস বোঝে যে ছেলেটি সেদিন সন্ধ্যায় ট্রাফিক রুলে স্বীকৃত গতির চেয়ে বেশি স্পীডে গাড়ি চালাচ্ছিল।

পুলিস বলে নতুন আইন অনুযায়ী অপরাধীকে নাবালক নয়, প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে বিচার করা হোক। কিন্তু জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট (২০১৫) অনুসারে সেটা সম্ভব যদি নাবালকের করা কাজটি ‘জঘন্য’ (heinous) অপরাধের শ্রেণীতে আসে। তাহলে শাস্তি - অন্ততঃ সাত বছরের জেল।

জুভেনাইল বোর্ড সব দেখেশুনে তার সাত পৃষ্ঠার রায়ে বলল—এই ছেলেটির বিচার প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবেই হোক। ও যে কাজটা করেছে তার সম্ভাব্য ফলাফল সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। সে মানসিক এবং শারীরিক , দু’দিক থেকেই, এমন অপরাধ করতে সক্ষম।

ফেব্রুয়ারি ২০১৯শে দিল্লির এক দায়রা আদালত ওই মতেই সায় দিল। কিন্তু দিল্লি হাইকোর্ট এই রায় খারিজ করে দিলে নিহতের বোন শিল্পা শর্মা সুপ্রীম কোর্টে আপিল করে ।

সুপ্রীম কোর্টের মহামান্য বেঞ্চ (জাস্টিস দীপক গুপ্তা এবং অনিরুদ্ধ বোস) হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে মামলা খারিজ করলেন।

ওনাদের মতে ধারা পেনাল কোডের ৩০৪ লাগিয়ে মামলা দায়ের হয়েছে। অর্থাৎ নরহত্যার অপরাধ, কিন্তু মার্ডার বা খুন নয়। এটা ‘জঘন্য’ (heinous) অপরাধের শ্রেণীতে আসে না। তাই ছেলেটিকে প্রাপ্তবয়স্ক নয়, ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ (জুভেনাইল) মেনে বিচার করতে হবে।

কেন আসে না?

কারণ, অপরাধ যদি ‘জঘন্য’ হয় তাতে ‘ন্যূনতম’ এবং ‘অধিকতম’ দুই শাস্তিরই উল্লেখ থাকে। কিন্তু এই ধারাতে শাস্তি হিসেবে খালি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলা আছে। ‘ন্যূনতম’ কোন শাস্তির কথা বলা নেই। অর্থাৎ এই অপরাধ ‘জঘন্য’ শ্রেণীর নয়। অতএব, অভিযুক্তের বিচার জুভেনাইল কোড হিসেবেই হবে, পেনাল কোডে নয়।

বেশ, কিন্তু জুভেনাইল অ্যাক্টের ধারা ২(৩৩) বলছে ‘জঘন্য’ অপরাধ সেটাই যাতে পেনাল কোডে কম-সে-কম সাত বছরের জেল বলা রয়েছে। কিন্তু এতে সাত বছরের বেশি শাস্তি আছে, সাতবছরের কম বা কম-সে-কম কোনও শাস্তি নেই।

জাস্টিস গুপ্তা এটাও বললেন যে খারাপ লাগলেও আমাদের আইন মেলে চলতে হবে। মানছি আইনে ‘ফাঁক’ আছে। কিন্তু আইনে সংশোধন তো সংসদের কাজ, আমাদের নয়। যেখানে আইনের দু’রকম ব্যাখ্যা সম্ভব, সেখানে যে ব্যাখ্যয় নাবালকের জন্য ‘লাভ’ সেটাই মানতে হবে।

জুভেনাইল অ্যাক্টে ছেলেটির শাস্তি হতে পারে—গ্রুপ কাউন্সেলিং, কমিউনিটি সার্ভিস অথবা অর্থদণ্ড!

অভিযুক্ত আর একটা অতিরিক্ত দিনও গরাদের পেছনে কাটাবে না।

বিদ্বান ন্যায়াধীশদের ‘জঘন্য’ অপরাধের সংজ্ঞা নিয়ে এমন ব্যাখ্যায় আমার মত সাধারণ নাগরিক বুঝভম্বুল হয়ে যায়।



না, এসব নতুন কোন ঘটনা নয়, অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। তাই তো এত নিয়মকানুন, মোটর ভেহিকল অ্যাক্ট (১৯৮৮), তার সংশোধনী (২০১৯) এবং ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে লোককে আহত করা, নিহত করা, ইচ্ছে করে চাপা দিয়ে মেরে ফেলা ইত্যাদি হয়েছে।

কিন্তু তাতে কি মূল ছবিটা কিছু বদলেছে?

এখন আমরা তিনটে ঘটনা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।

২.১ দিল্লির লোধী কলোনি, ১০ জানুয়ারি, ১৯৯৯

একটি বি এম ডব্লিউ গাড়ি তিনজন পুলিস অফিসার সমেত ছ’জনকে পিষে দিল। ঘটনাটি এরকমঃ

ভারতের নৌবাহনীর প্রাক্তন অ্যাডমিরাল নন্দার নাতি সঞ্জীব নন্দা গুড়গাঁওয়ে রাতভোর পার্টি করার পর তাঁর দুই বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বি এম ডব্লিউ গাড়িটি চালিয়ে দিল্লি ফিরছিলেন। প্রচণ্ড গতিতে চলার কারণে গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লোধী কলোনির পুলিশ চেকপোস্টের ভেতরে ঢুকে পড়ে। দু’জন পুলিশ এবং অন্য দুই পথচারি সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। আরেকজন পুলিশ ও অন্য এক পথচারি হাসপাতালে মারা যায়। সপ্তম শিকার বেঁচে ওঠেন।

গাড়িটি একটু এগিয়ে থামে, ওঁরা টের পান যে চাকার নীচে লোক। তাঁরা চটপট গলফ লিংকের একটি বাড়িতে গাড়িটি দাঁড় করিয়ে বাড়ির চৌকিদারও ড্রাইভারকে নির্দেশ দেন গাড়ির বনেট ও বাম্পার পরিষ্কার করে ফেলতে।

ওই দুজনকেও পুলিশ সাক্ষ্য-প্রমাণ লোপাট করার অভিযোগে আদালতে পেশ করে।

ক’দিন পরে ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী এসে নিজের সাক্ষ্য দেয়। পুলিশ তিনবন্ধুর বিরুদ্ধে ‘culpable homicide not amounting to murder’এর মামলা রুজু করে।

(মানুষ মরতে পারে জেনেও কিছু করা এবং তার ফলে কারও মৃত্যু= culpable homicide বা নরহত্য্যা। কিন্তু যে নরহত্যা কাউকে মারার উদ্দেশে আগে থেকে ভেবে করা হয় সেটা খুন বা মার্ডার।

১৯৯৯ সালের বিচারে তিনজনই অভিযুক্তই ছাড়া পেয়ে যায়। কিন্তু এ’নিয়ে ফের বিচারের দাবি ওঠে।

২০০৮ সালের পুনর্বিচারে দিল্লির সেশন কোর্ট ২ সেপ্টেম্বর এদের দোষী সাব্যস্ত করে এবং দু’বছরের জেল হয়। এনডিটিভি’র স্টিং অপারেশনে ধরা পড়ে ডিফেন্স ল’ইয়ার সাক্ষীদের মোটা টাকা অফার করছে, আদালত তাদের চার মাসের জন্য লাইসেন্স রদ করে। বলা হয় যে গাড়ির গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১৪০ কিলোমিটার ।

কিন্তু অভিযুক্তরা সুপ্রীম কোর্টে আপীল করলে সর্বোচ্চ আদালত ৩ আগস্ট ২০১২ তারিখে এদের দু’বছর জেলে বিচার চলাকালীন জেলে কেটেছে বলে মুক্তির আদেশ দেয়। এছাড়া ৫০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড এবং দু’বছর কমিউনিটি সার্ভিস করার নির্দেশ দেয়।


২.২ কানপুরের কিশোর, সাতমাসের মধ্যে দু’বার লোককে গাড়িচাপা দেয়া!

গত বছর অক্টোবর মাসে কানপুর শহরের এক ১৫ বছরের কিশোর বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে গঙ্গা ব্যারেজের উপর সাগর নিষাদ এবং আশিস রাম চরণ নামের দুই ব্যক্তিকে মেরে ফেলে। সাত মাসও যায়নি ছেলেটি আবার ওইভাবে বাবার গাড়ি চালিয়ে চারজনকে গুরুতর আহত করেছে। ওই কিশোর কানপুর শহরের একজন নামজাদা ডাক্তারের সন্তান।

পুলিশ কমিশনারের বক্তব্যঃ ওরা বাবা সমানভাবে দোষী। কেন উনি নাবালক ছেলেকে গাড়ি চালাতে দিয়েছেন! তায় দু’জনকে মেরে ফেলার পর আবার!

ছেলেটিকে আপাততঃ জুভেনাইল হোমে পাঠানো হয়েছে। তবে ছ’মাস আগের মামলাটির ধারা বদলে আরও কড়া করা হয়েছে—ধারা ৩০৪ এ (অসতর্কভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষ মারা) থেকে ধারা ৩০৪ (নরহত্যা , তবে খুন নয়)।

২.৩ পুণের কুখ্যাত পোর্শে গাড়ি চালিয়ে দু’জনকে মেরে ফেলার কেস!

এবছর ১৯ মে, শহর পুণে।

প্রোমোটর দাদু আদরের নাতি বেদান্ত আগরওয়ালকে ১৭ বছরের জন্মদিনে একটি পোর্শে গাড়ি (দাম এক কোটির কম নয়) উপহার দিয়েছেন। নাতির ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। সে বন্ধুদের নিয়ে সারারাত উদ্দাম পার্টি করে ভোরের দিকে প্রচণ্ড গতিতে গাড়ি চালিয়ে পুণে শহরের কল্যাণী নগরে এক দু’চাকার বাহনকে ধাক্কা দেয়, দুজন আইটি প্রফেশনাল—অশ্বিনী কোস্টা এবং অনীশ অবধিয়া-- মারা যায়।

এক রাজনৈতিক নেতার হাসপাতালে ফোন এবং থানায় উপস্থিত হয়ে তদন্তকারীদের সঙ্গে কথার ফলে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের সুপারিশে ছেলেটি দুয়েক ঘণ্টায় জামিন পেয়ে যায়। তাকে শাস্তি হিসেবে বলা হয় যারবেদা ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে ১৫ দিন ডিউটি করতে এবং পথ সতর্কতা নিয়ে তিনশ’ শব্দের একটি রচনা লিখতে!

এরপর শুরু হয় কভার আপ! যাতে হাসপাতালের ডাক্তার থেকে পুলিশ প্রশাসন, জুভেনাইল বোর্ড, রাজনৈতিক নেতা –সবাই অপরাধী পরিবারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।

দেখা যায় তার রক্তের নমুনা বদলে তার মায়ের রক্ত দেয়া হয়েছে। তার রিয়েল এস্টেট প্রোমোটর দাদু ড্রাইভারকে ঘরে বন্ধ করে ধমকে বলেন—তুমি দোষ নিজের ঘাড়ে নাও; বল তুমিই চালাচ্ছিলে—আমার নাতি নয়।

পুলিশ বলছে ওকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবেই বিচার করা হোক, সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরার আগে একটি বারে বসে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে মদ খাচ্ছে, বিল দিয়েছে ৪৮০০০ টাকা।

জনরোষের ফলে পুলিশ ওর দাদু, মা, বাবা সবাইকে গ্রেফতার করে। এখন সবাই হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন। আর ছেলেটিকে হাইকোর্ট বলেছে জুভেনাইল বোর্ডেরসংশোধনাগারে নয়, তার পিসির বাড়িতে পর্যবেক্ষণে রাখতে—এটাই নাকি আইনসম্মত উপায়!

সরকারপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করতে ইচ্ছুক নয়। তবু পুলিশ বলছে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আপিল করবে। করবে তো?

বেপরোয়া গাড়ি চালানো আর

নবী মুম্বাইয়ের ঘটনাঃ এক ১৭ বছরের কিশোর সাত সকালে বাবার গাড়ি চালিয়ে ৬০ বছরের এক মহিলাকে মেরে ফেলে। এখানে ছেলেটি অপ্রাপ্তবয়স্ক, এবং তার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই—তাই গাড়ির মালিকের শাস্তি হবে—তিনমাসের জেল এবং ১০০০ টাকা ফাইন। কিন্তু গাড়ির মালিক বাবা তো একমাস আগে মারা গিয়েছেন। তাহলে?

নয়ডার ঘটনাঃ

গত মে মাসের ঘটনা। প্রমোদ শর্মা সপরিবারে হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। গাড়ি চালাচ্ছিল তাঁর ১৭ বছরের ছেলে। গাড়িটি স্কুলগামী একটি মোটরবাইককে ধাক্কা দেয়। তাতে ১৫ বছরের অমন কুমার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। সঙ্গের বাকি দুই ছাত্র হাসপাতালে।

৩ ‘সমরথ কো নাহি দোষ গোঁসাই’!

৩.১ হেমা মালিনীঃ বিজেপি’র মথুরা’র সাংসদ এবং মুম্বাই সিনেমার মহাতারকা

রাজস্থানের হাইওয়ে। জুন মাসের শেষ। হর্ষ খান্ডেলওয়াল সপরিবার মারুতি অল্টো চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সামনে একটা মোড় ঘুরতে হবে। ফাঁকা রাস্তা, তিনি ইণ্ডিকেটর দিয়ে গাড়ি ঘোরালেন। হঠাৎ পেছন থেকে প্রচণ্ড গতিতে একটি মার্সিডিজ গাড়ি এসে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা মারল। খান্ডেলওয়াল এবং তাঁর পত্নী আহত হলেন। তাঁর ছ’বছরের ছেলেটির দুটো হাত দুটো পা ভাঙল। দু’বছরের বাচ্চা মেয়ে চিন্নি গুরুতর আহত।

মার্সিডিজ থেমে গেছে। আরোহী হেমা মালিনী সামান্য চোট পেয়েছিলেন। খান্ডেলওয়াল দম্পতি চাইছিলেন গুরুতর আহত বাচ্চা দুটোকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোক। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে হেমা’র কপালে সামান্য চোট লেগেছিল এবং ওঁরা অনুরোধে কর্ণপাত না করে মার্সিডিজ গাড়িটি ওখানেই ফেলে স্থানীয় বিজেপি নেতার গাড়িতে চড়ে ঝড়ের বেগে জয়পুর চলে গেলেন।

বাচ্চা মেয়েটি মারা গেল। বাকি সবাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হর্ষ খান্ডেলওয়ালের মতে মার্সিডিজের স্পীড ছিল ঘন্টায় ১৫০ কিলোমিটার। পরে ড্রাইভার গ্রেফতার হয় বেয়াড়া স্পীডে গাড়ি চালানোর অভিযোগে।

হেমা টুইট করে বললেন—সব দোষ বাচ্চা মেয়ের বাবার। ও যদি ট্রাফিক রুল ভেঙে মার্সিডিজের সামনে না আসত তাহলে বাচ্চাটি বেঁচে যেত।

হাসপাতাল থেকে মেয়ের বাবা জবাব দিলেন—আমি রুল ভাঙিনি, আপনার ড্রাইভারকেই পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। আমার দু’ বছরের বাচ্চা মেয়ে বেঁচে যেত যদি আপনি আপনার গাড়িতে বাচ্চাটাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌঁছে দিতেন।

না, ওঁরা হেমা মালিনীর থেকে কোন ক্ষতিপূরণ পান নি।

৩.২

‘বিগ বস’ সলমান খান এবং ফুটপাতে লোকচাপা

ঘটনার সংক্ষিপ্ত কালপঞ্জী

২৮/৯/২০০২

অভিনেতা সলমান খান মাঝরাতে ফুটপাথে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত মানুষের উপর তাঁর টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ি চড়িয়ে একজনকে মেরে ফেলার এবং চারজনকে ঘায়েল করার অভিযোগে গ্রেফতার হলেন।

অক্টোবর, ২০০২- কেস খেলেন পেনাল কোডের ধারা ৩০৪ (নরহত্যা, কিন্তু খুন নয়)।

অক্টোবর, ২০০৩- মুম্বাই হাইকোর্ট ধারা বদলে ৩০৪এ করে দিল, অর্থাৎ নরহত্যা নয়, শুধু বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনা, যাতে মৃত্যু হয়েছে।

৬ মে, ২০১৫- মুম্বাইয়ের দায়রা আদালত মদ খেয়ে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগে শাস্তি দিল-- পাঁচ বছর জেল ।

সেদিনই মুম্বাই হাইকোর্ট অভিযুক্ত সলমানকে জামিন দিয়ে অন্তিম ফয়সালা পর্য্যন্ত শাস্তি স্থগিত করে দিল।

ডিসেম্বর, ২০১৫- মুম্বাই হাইকোর্ট প্রমাণের অভাবে সলমান খানকে সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্তি দিল।

জুলাই ৫, ২০১৬—মহারাষ্ট্র সরকার ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আপিল করল। সেখানে ৮ বছর ধরে মামলা লম্বিত রয়েছে।

কিন্তু আসল তামাশা বুঝতে হলে নীচের টিপ্পনিগুলো দেখুন।

দুর্ঘটনার পর যখন জনমানস বিক্ষুব্দ তখন বলিউডি গায়ক অভিজিত ভট্টাচার্য মন্তব্য করলেন—ফুটপাথ কি শোবার জন্য?

আমার বিনীত প্রশ্নঃ ফুটপাথ কি গাড়ি চালানোর জন্য? তাও ফাঁকা রাস্তা ছেড়ে!

যুবক পুলিস কনস্টেবল রবীন্দ্র পাতিল সলমান খানের দেহরক্ষী নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনিই ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০০২ তারিখে জবানবন্দী দিয়েছিলেন যে গাড়ি চালাচ্ছিলেন সলমান নিজে, তাঁর ড্রাইভার নয়।


কিন্তু মহামান্য মুম্বাই হাইকোর্ট তাঁর সাক্ষ্যকে নির্ভরযোগ্য মানলেন না। কেননা, তিনি গোড়ায় সলমানের মদ্যপানের কথা বলেননি। তিনদিন পরে ১ অক্টোবর তারিখে বললেন যে মত্ত সলমানকে তিনি গাড়ি চালাতে বারবার নিষেধ করেছিলেন।


বলা হয়, পাতিলের উপর বয়ান বদলে দেবার প্রচণ্ড চাপ ছিল। শুনানিতে পাঁচবার অনুপস্থিত থাকায় আদালত তাঁর নামে ওয়ারেন্ট জারি করে। ডিউটিতে গরহাজির থাকায় পুলিশ বিভাগ প্রথমে সাস্পেন্ড, পরে ডিসমিস করে।


পত্নী ডিভোর্স দেয়, বাবা-মা অজ্ঞাত কারণে তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করে।


২০০৭ সালে তাঁকে রাস্তায় পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায়, তিনি তখন যক্ষ্মারোগে মরণাপন্ন। শেষে ৪ অক্টোবর, ২০০৭ তারিখে মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি মারা যান।


তাঁর শেষ কথাঃ “আমি শেষ পর্য্যন্ত বয়ানে কোন পরিবর্তন করি নি। কিন্তু আমার ডিপার্টমেন্ট আমার সঙ্গে রইল না। আমি চাকরিতে ফেরত যেতে চাই, বাঁচতে চাই। একবার পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে চাই”।


রবীন্দ্র পাতিল ছিলেন ‘মুখ্য সাক্ষী’। অনেকের সন্দেহ, মূল শুনানির সময় তাঁকে জোর করে আটকে রাখা হয়েছিল যাতে তিনি আদালতে উপস্থিত হতে না পারেন।

সলমানের ড্রাইভারঃ বয়ান বদল

সলমানের ড্রাইভার অশোক সিং ১৩ বছর বাদে হঠাৎ বয়ান বদলে বললেন—গাড়ি নাকি তিনিই চালাচ্ছিলেন, সলমান নয়। আরও বললেন যে টায়ার ফেটে যাওয়ায় গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফুটপাতে উঠে গেছল।


কিন্তু সরকারি পক্ষ জোর দিয়ে বলে—এটা ডাহা মিথ্যে। এস ইউ ভি গাড়ির টায়ার ওভাবে ফেটে যায় না।

তারপর অশোক সিংকে আদালতে মিথ্যে বলার জন্য গ্রেফতার করা হয়।

যাঁরা বেখেয়ালে গাড়ি চালানোর শিকারঃ

২৮ সেপ্টেম্বর,২০০২ এর রাতে ফুটপাতে শুয়েছিলেন পাঁচজন। গাড়ি রাস্তায় ওঠায় তৎক্ষণাৎ মারা পড়েন নুরুল্লা শরীফ। বাকি আহত চারজনের কারও কারও পা পিষে যায়। ওদের মতে সলমান চালকের আসন থেকে ডানদিকের দরজা দিয়ে নেমে আসেন।

সলমানের বক্তব্য অন্যদিকের দরজা নাকি জ্যাম হয়ে গেছল। সলমান মুক্তি পাওয়ায় ওঁরা কিছু আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়েছিলেন, পেয়েছেন বলে জানা যায় নি।

উপসংহার

আমরা নব্বইয়ের দশক থেকে বর্তমান বছর পর্য্যন্ত এতগুলো কেসের বিহঙ্গম দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করলাম। যা মনে হল—বড়মানুষের গাড়িতে সাধারণ মানুষ চাপা পড়লে কিছু আশা না করাই ভাল।

পুলিশের প্রাক্তন উচ্চপদের আমলা শ্রী কিরণ বেদীর টুইটারের বক্তব্যটি আপাতত শেষকথা বলেই মনে হয়।

“ ইফ ইউ আর এ ভিআইপি, সেলিব্রিটি, প্রিভিলেজড্‌, রিচ অ্যান্ড ইউ ক্যান অ্যাকসেস বেস্ট লীগ্যাল এইড, ইউ ক্যান অ্যাভয়েড জেল’।