Next
Previous
Showing posts with label প্রচ্ছদ নিবন্ধ. Show all posts
0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in




















বলতে পারো বড়মানুষ মোটর কেন চড়বে,
গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?

                                                                     --সুকান্ত


একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো’র ডেটা বলছে ২০২১ সালে আমাদের গোটা দেশে বিভিন্ন ঘটনায় খুন হয়েছে ২৯,২৭২ জন। অথচ, ‘বেপরোয়া গাড়ি চালানো’য় মারা পড়েছে ৪৩, ৪৯৯ জন। তাহলে যারা বেপরোয়া গাড়ি চালায় তারা সবচেয়ে বড় খুনি? কারা চালায় অমন ভাবে গাড়ি? গতির নেশায় মাতাল হয়ে!

এদের কাছে আছে বুঝি মস্ত হাওয়াগাড়ি?

আছেই তো, মার্সিডিজ, পোর্শে, বিএমডব্লিউ,? কাদের আছে? যারা কোটি টাকার গাড়ি কিনতে পারে, জন্মদিনে নাতিকে অমন গাড়ি উপহার দিতে পারে।

তারপর সেই গর্বিত নাতি বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে গাড়িতে বসে আর হাওয়াগাড়ি উড়ে চলে হাওয়ার বেগে, দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে। পথচারীরা ঝড়ের সামনে শুকনো পাতার মত উড়ে যায়। আর ‘চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন’-- কেউ শোনে না।

চালকের কখনও মনে হয়-- ‘অজস্র মৃত্যুরে পার হয়ে আসিলাম’। সে গাড়ি থামায়, তবে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে। উদ্দেশ্য একটাই অপরাধ থুড়ি দুর্ঘটনার সাক্ষ্য মুছে ফেলা। নেমপ্লেট বদলে দেয়া, রক্তের দাগ ধোয়া, ড্রাইভার বদলে নেয়া।

কিন্তু পিষে দেয়া মানুষগুলো? যাদের সময়মত হাসপাতালে নিয়ে গেলে কিছুটা বাঁচার সম্ভাবনা ছিল? না, এরা হাওয়াগাড়ি থামিয়ে সেই লোকগুলোকে তোলে না। তাহলে যে দুর্ঘটনার দায় নিতে হবে! আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। বাজারে বদনাম হবে।

ব্যাপারটা বোধহয় আর একটু অন্যরকম।

আসলে এদের হয়তো কোন দোষ নেই। দোষ তাদের যারা গাড়ির সামনে এসে গেছল। হাওয়াগাড়ি তো হাওয়ার বেগেই চলবে।

তবুও সুর্য এখনও পূবে ওঠে, পশ্চিমে ডোবে।

তাই কিছু কেস খবর হয়। কিছু কেসে পুলিশ আসে, গ্রেফতার করে। জামিন হয়, মামলা চলে। মোটা টাকার অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। তারপর সবাই ভুলে যায়। ভোলে না নিহতদের পরিবার। ওরা ভগবানকে ডাকে আর আশা করে-- একদিন ন্যায়ের দণ্ড নামিয়া আসিবে।

দুর্ঘটনার ডিফেন্স

কেস খেলে এসবের জন্য বাঁধা ডিফেন্স আছে।

এক, আমি চালাচ্ছিলাম না, আমার ড্রাইভার চালাচ্ছিল।

--তাহলে ড্রাইভার জেলে যাবে। আমার অর্থদণ্ড হবে, ড্রাইভারের পরিবারকে মোটা টাকা দেয়া হবে। ওরা মুখ বুজে মেনে নেবে। একেবারে বজ্রসেন-উত্তীয় কেস!

দুই, আমি চালাচ্ছিলাম বটে, কিন্তু মদটা একটু বেশি গিলেছিলাম। চোখে আবছা দেখছিলাম। কাউকে চাপা দিয়েছি? আমার কিচ্ছু মনে নেই।

--এটা ভাল ডিফেন্স। সঙ্গে সঙ্গে আইন অনুযায়ী অপরাধের মাত্রা কমে যায়। কেসটা ধারা অনিচ্ছাকৃত নরহত্যা থেকে অসাবধানে মদ খেয়ে চালিয়ে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, অর্থাৎ ধারা ৩০৪ থেকে ৩০৪এ হয়ে যায়।

আহা, বেচারি! ভালমানুষ। একটু নেশা হয়ে গেলে কী করবে? ও খুনি নয়।

ফলে দু’বছরের জেল এবং মোটা অর্থদণ্ড। অথবা প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে শুধু অর্থদণ্ড। কেউ জিজ্ঞেস করবে না-- এই অবস্থায় কেন গাড়ি চালিয়েছিলে বা তোমার কাজের পুরো দায়িত্ব কেন তুমি বইবে না?

তিন, আমি পূর্ণবয়স্ক নই। ১৮ পূর্ণ হতে এখনও চার দিন বাকি! আমার বিচার প্রাপ্তবয়স্কদের আইনে হবে না, জুভেনাইল বা অপ্রাপ্তবয়স্কদের আইনে হবে।

--এই কেসে গার্জেনদের দু’বছরের জেল এবং মোটা অর্থদণ্ড হবে। গাড়িটির লাইসেন্স একবছরের জন্য বাতিল। আর আদরে বাঁদর হওয়া কুলতিলক যাবেন সংশোধনাগারে ,মানসিক কাউন্সেলিং এর জন্য—সেটা তার নিজের মাসির বাড়িও হতে পারে। আর তাকে কয়েকমাস বা এক বছর কমিউনিটি সার্ভিস করতে হবে।

সেটা কী জিনিস কেউ জানে না। কোন আইনে বলা নেই। সেটা কি মন্দিরে করসেবা? হাসপাতালে কাউন্টারে বসা? নাকি এক লক্ষ বার রামনাম লেখা? শুধু বিচারক জানেন। কিন্তু আদরে বাঁদর ছেলের কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডের জন্য কোন ধনীর দু’বছরের জেল হয়েছে শুনেছেন কখনও? আমি তো শুনি নি। শুনলে বলবেন তো!

চেনা গল্পঃ চেনা ছক


রাজধানী দিল্লি; এপ্রিল ২০১৬। মার্কেটিং পেশার সিদ্ধার্থ শর্মা (৩২) কাজের শেষে বাড়ি ফেরার পথে নর্থ দিল্লির সিভিল লাইন্স এলাকায় একটি মার্সিডিজের নীচে পিষে গেলেন। যে ছেলেটি বাবার গাড়ি চালাচ্ছিল তার বয়েস ১৭ বছর ৩৬১ দিন। অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক হতে মাত্র চার দিন বাকি।

ছেলেটির লাইসেন্স ছিল না। পুলিশের রেকর্ড বলছে সে এর আগেও তিন বার ট্রাফিক আইন ভেঙে ফাইন দিয়েছে। তদন্তে দেখা যাচ্ছে যে ও ট্রাফিক পুলিশের কাছে তিনবারই ‘মিথ্যে’ তথ্য দিয়েছিল। ছেলেটির পরিবার তাদের বাড়ির ড্রাইভারকে থানায় পাঠিয়ে দিল –যাও, গিয়ে বল যে তুমিই তখন গাড়িটা চালাচ্ছিলে।

সিসিটিভির ফুটেজ, চাকার দাগ এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে পুলিস বোঝে যে ছেলেটি সেদিন সন্ধ্যায় ট্রাফিক রুলে স্বীকৃত গতির চেয়ে বেশি স্পীডে গাড়ি চালাচ্ছিল।

পুলিস বলে নতুন আইন অনুযায়ী অপরাধীকে নাবালক নয়, প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে বিচার করা হোক। কিন্তু জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট (২০১৫) অনুসারে সেটা সম্ভব যদি নাবালকের করা কাজটি ‘জঘন্য’ (heinous) অপরাধের শ্রেণীতে আসে। তাহলে শাস্তি - অন্ততঃ সাত বছরের জেল।

জুভেনাইল বোর্ড সব দেখেশুনে তার সাত পৃষ্ঠার রায়ে বলল—এই ছেলেটির বিচার প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবেই হোক। ও যে কাজটা করেছে তার সম্ভাব্য ফলাফল সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। সে মানসিক এবং শারীরিক , দু’দিক থেকেই, এমন অপরাধ করতে সক্ষম।

ফেব্রুয়ারি ২০১৯শে দিল্লির এক দায়রা আদালত ওই মতেই সায় দিল। কিন্তু দিল্লি হাইকোর্ট এই রায় খারিজ করে দিলে নিহতের বোন শিল্পা শর্মা সুপ্রীম কোর্টে আপিল করে ।

সুপ্রীম কোর্টের মহামান্য বেঞ্চ (জাস্টিস দীপক গুপ্তা এবং অনিরুদ্ধ বোস) হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে মামলা খারিজ করলেন।

ওনাদের মতে ধারা পেনাল কোডের ৩০৪ লাগিয়ে মামলা দায়ের হয়েছে। অর্থাৎ নরহত্যার অপরাধ, কিন্তু মার্ডার বা খুন নয়। এটা ‘জঘন্য’ (heinous) অপরাধের শ্রেণীতে আসে না। তাই ছেলেটিকে প্রাপ্তবয়স্ক নয়, ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ (জুভেনাইল) মেনে বিচার করতে হবে।

কেন আসে না?

কারণ, অপরাধ যদি ‘জঘন্য’ হয় তাতে ‘ন্যূনতম’ এবং ‘অধিকতম’ দুই শাস্তিরই উল্লেখ থাকে। কিন্তু এই ধারাতে শাস্তি হিসেবে খালি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলা আছে। ‘ন্যূনতম’ কোন শাস্তির কথা বলা নেই। অর্থাৎ এই অপরাধ ‘জঘন্য’ শ্রেণীর নয়। অতএব, অভিযুক্তের বিচার জুভেনাইল কোড হিসেবেই হবে, পেনাল কোডে নয়।

বেশ, কিন্তু জুভেনাইল অ্যাক্টের ধারা ২(৩৩) বলছে ‘জঘন্য’ অপরাধ সেটাই যাতে পেনাল কোডে কম-সে-কম সাত বছরের জেল বলা রয়েছে। কিন্তু এতে সাত বছরের বেশি শাস্তি আছে, সাতবছরের কম বা কম-সে-কম কোনও শাস্তি নেই।

জাস্টিস গুপ্তা এটাও বললেন যে খারাপ লাগলেও আমাদের আইন মেলে চলতে হবে। মানছি আইনে ‘ফাঁক’ আছে। কিন্তু আইনে সংশোধন তো সংসদের কাজ, আমাদের নয়। যেখানে আইনের দু’রকম ব্যাখ্যা সম্ভব, সেখানে যে ব্যাখ্যয় নাবালকের জন্য ‘লাভ’ সেটাই মানতে হবে।

জুভেনাইল অ্যাক্টে ছেলেটির শাস্তি হতে পারে—গ্রুপ কাউন্সেলিং, কমিউনিটি সার্ভিস অথবা অর্থদণ্ড!

অভিযুক্ত আর একটা অতিরিক্ত দিনও গরাদের পেছনে কাটাবে না।

বিদ্বান ন্যায়াধীশদের ‘জঘন্য’ অপরাধের সংজ্ঞা নিয়ে এমন ব্যাখ্যায় আমার মত সাধারণ নাগরিক বুঝভম্বুল হয়ে যায়।



না, এসব নতুন কোন ঘটনা নয়, অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। তাই তো এত নিয়মকানুন, মোটর ভেহিকল অ্যাক্ট (১৯৮৮), তার সংশোধনী (২০১৯) এবং ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে লোককে আহত করা, নিহত করা, ইচ্ছে করে চাপা দিয়ে মেরে ফেলা ইত্যাদি হয়েছে।

কিন্তু তাতে কি মূল ছবিটা কিছু বদলেছে?

এখন আমরা তিনটে ঘটনা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।

২.১ দিল্লির লোধী কলোনি, ১০ জানুয়ারি, ১৯৯৯

একটি বি এম ডব্লিউ গাড়ি তিনজন পুলিস অফিসার সমেত ছ’জনকে পিষে দিল। ঘটনাটি এরকমঃ

ভারতের নৌবাহনীর প্রাক্তন অ্যাডমিরাল নন্দার নাতি সঞ্জীব নন্দা গুড়গাঁওয়ে রাতভোর পার্টি করার পর তাঁর দুই বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বি এম ডব্লিউ গাড়িটি চালিয়ে দিল্লি ফিরছিলেন। প্রচণ্ড গতিতে চলার কারণে গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লোধী কলোনির পুলিশ চেকপোস্টের ভেতরে ঢুকে পড়ে। দু’জন পুলিশ এবং অন্য দুই পথচারি সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। আরেকজন পুলিশ ও অন্য এক পথচারি হাসপাতালে মারা যায়। সপ্তম শিকার বেঁচে ওঠেন।

গাড়িটি একটু এগিয়ে থামে, ওঁরা টের পান যে চাকার নীচে লোক। তাঁরা চটপট গলফ লিংকের একটি বাড়িতে গাড়িটি দাঁড় করিয়ে বাড়ির চৌকিদারও ড্রাইভারকে নির্দেশ দেন গাড়ির বনেট ও বাম্পার পরিষ্কার করে ফেলতে।

ওই দুজনকেও পুলিশ সাক্ষ্য-প্রমাণ লোপাট করার অভিযোগে আদালতে পেশ করে।

ক’দিন পরে ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী এসে নিজের সাক্ষ্য দেয়। পুলিশ তিনবন্ধুর বিরুদ্ধে ‘culpable homicide not amounting to murder’এর মামলা রুজু করে।

(মানুষ মরতে পারে জেনেও কিছু করা এবং তার ফলে কারও মৃত্যু= culpable homicide বা নরহত্য্যা। কিন্তু যে নরহত্যা কাউকে মারার উদ্দেশে আগে থেকে ভেবে করা হয় সেটা খুন বা মার্ডার।

১৯৯৯ সালের বিচারে তিনজনই অভিযুক্তই ছাড়া পেয়ে যায়। কিন্তু এ’নিয়ে ফের বিচারের দাবি ওঠে।

২০০৮ সালের পুনর্বিচারে দিল্লির সেশন কোর্ট ২ সেপ্টেম্বর এদের দোষী সাব্যস্ত করে এবং দু’বছরের জেল হয়। এনডিটিভি’র স্টিং অপারেশনে ধরা পড়ে ডিফেন্স ল’ইয়ার সাক্ষীদের মোটা টাকা অফার করছে, আদালত তাদের চার মাসের জন্য লাইসেন্স রদ করে। বলা হয় যে গাড়ির গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১৪০ কিলোমিটার ।

কিন্তু অভিযুক্তরা সুপ্রীম কোর্টে আপীল করলে সর্বোচ্চ আদালত ৩ আগস্ট ২০১২ তারিখে এদের দু’বছর জেলে বিচার চলাকালীন জেলে কেটেছে বলে মুক্তির আদেশ দেয়। এছাড়া ৫০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড এবং দু’বছর কমিউনিটি সার্ভিস করার নির্দেশ দেয়।


২.২ কানপুরের কিশোর, সাতমাসের মধ্যে দু’বার লোককে গাড়িচাপা দেয়া!

গত বছর অক্টোবর মাসে কানপুর শহরের এক ১৫ বছরের কিশোর বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে গঙ্গা ব্যারেজের উপর সাগর নিষাদ এবং আশিস রাম চরণ নামের দুই ব্যক্তিকে মেরে ফেলে। সাত মাসও যায়নি ছেলেটি আবার ওইভাবে বাবার গাড়ি চালিয়ে চারজনকে গুরুতর আহত করেছে। ওই কিশোর কানপুর শহরের একজন নামজাদা ডাক্তারের সন্তান।

পুলিশ কমিশনারের বক্তব্যঃ ওরা বাবা সমানভাবে দোষী। কেন উনি নাবালক ছেলেকে গাড়ি চালাতে দিয়েছেন! তায় দু’জনকে মেরে ফেলার পর আবার!

ছেলেটিকে আপাততঃ জুভেনাইল হোমে পাঠানো হয়েছে। তবে ছ’মাস আগের মামলাটির ধারা বদলে আরও কড়া করা হয়েছে—ধারা ৩০৪ এ (অসতর্কভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষ মারা) থেকে ধারা ৩০৪ (নরহত্যা , তবে খুন নয়)।

২.৩ পুণের কুখ্যাত পোর্শে গাড়ি চালিয়ে দু’জনকে মেরে ফেলার কেস!

এবছর ১৯ মে, শহর পুণে।

প্রোমোটর দাদু আদরের নাতি বেদান্ত আগরওয়ালকে ১৭ বছরের জন্মদিনে একটি পোর্শে গাড়ি (দাম এক কোটির কম নয়) উপহার দিয়েছেন। নাতির ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। সে বন্ধুদের নিয়ে সারারাত উদ্দাম পার্টি করে ভোরের দিকে প্রচণ্ড গতিতে গাড়ি চালিয়ে পুণে শহরের কল্যাণী নগরে এক দু’চাকার বাহনকে ধাক্কা দেয়, দুজন আইটি প্রফেশনাল—অশ্বিনী কোস্টা এবং অনীশ অবধিয়া-- মারা যায়।

এক রাজনৈতিক নেতার হাসপাতালে ফোন এবং থানায় উপস্থিত হয়ে তদন্তকারীদের সঙ্গে কথার ফলে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের সুপারিশে ছেলেটি দুয়েক ঘণ্টায় জামিন পেয়ে যায়। তাকে শাস্তি হিসেবে বলা হয় যারবেদা ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে ১৫ দিন ডিউটি করতে এবং পথ সতর্কতা নিয়ে তিনশ’ শব্দের একটি রচনা লিখতে!

এরপর শুরু হয় কভার আপ! যাতে হাসপাতালের ডাক্তার থেকে পুলিশ প্রশাসন, জুভেনাইল বোর্ড, রাজনৈতিক নেতা –সবাই অপরাধী পরিবারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।

দেখা যায় তার রক্তের নমুনা বদলে তার মায়ের রক্ত দেয়া হয়েছে। তার রিয়েল এস্টেট প্রোমোটর দাদু ড্রাইভারকে ঘরে বন্ধ করে ধমকে বলেন—তুমি দোষ নিজের ঘাড়ে নাও; বল তুমিই চালাচ্ছিলে—আমার নাতি নয়।

পুলিশ বলছে ওকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবেই বিচার করা হোক, সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরার আগে একটি বারে বসে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে মদ খাচ্ছে, বিল দিয়েছে ৪৮০০০ টাকা।

জনরোষের ফলে পুলিশ ওর দাদু, মা, বাবা সবাইকে গ্রেফতার করে। এখন সবাই হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন। আর ছেলেটিকে হাইকোর্ট বলেছে জুভেনাইল বোর্ডেরসংশোধনাগারে নয়, তার পিসির বাড়িতে পর্যবেক্ষণে রাখতে—এটাই নাকি আইনসম্মত উপায়!

সরকারপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করতে ইচ্ছুক নয়। তবু পুলিশ বলছে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আপিল করবে। করবে তো?

বেপরোয়া গাড়ি চালানো আর

নবী মুম্বাইয়ের ঘটনাঃ এক ১৭ বছরের কিশোর সাত সকালে বাবার গাড়ি চালিয়ে ৬০ বছরের এক মহিলাকে মেরে ফেলে। এখানে ছেলেটি অপ্রাপ্তবয়স্ক, এবং তার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই—তাই গাড়ির মালিকের শাস্তি হবে—তিনমাসের জেল এবং ১০০০ টাকা ফাইন। কিন্তু গাড়ির মালিক বাবা তো একমাস আগে মারা গিয়েছেন। তাহলে?

নয়ডার ঘটনাঃ

গত মে মাসের ঘটনা। প্রমোদ শর্মা সপরিবারে হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। গাড়ি চালাচ্ছিল তাঁর ১৭ বছরের ছেলে। গাড়িটি স্কুলগামী একটি মোটরবাইককে ধাক্কা দেয়। তাতে ১৫ বছরের অমন কুমার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। সঙ্গের বাকি দুই ছাত্র হাসপাতালে।

৩ ‘সমরথ কো নাহি দোষ গোঁসাই’!

৩.১ হেমা মালিনীঃ বিজেপি’র মথুরা’র সাংসদ এবং মুম্বাই সিনেমার মহাতারকা

রাজস্থানের হাইওয়ে। জুন মাসের শেষ। হর্ষ খান্ডেলওয়াল সপরিবার মারুতি অল্টো চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সামনে একটা মোড় ঘুরতে হবে। ফাঁকা রাস্তা, তিনি ইণ্ডিকেটর দিয়ে গাড়ি ঘোরালেন। হঠাৎ পেছন থেকে প্রচণ্ড গতিতে একটি মার্সিডিজ গাড়ি এসে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা মারল। খান্ডেলওয়াল এবং তাঁর পত্নী আহত হলেন। তাঁর ছ’বছরের ছেলেটির দুটো হাত দুটো পা ভাঙল। দু’বছরের বাচ্চা মেয়ে চিন্নি গুরুতর আহত।

মার্সিডিজ থেমে গেছে। আরোহী হেমা মালিনী সামান্য চোট পেয়েছিলেন। খান্ডেলওয়াল দম্পতি চাইছিলেন গুরুতর আহত বাচ্চা দুটোকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোক। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে হেমা’র কপালে সামান্য চোট লেগেছিল এবং ওঁরা অনুরোধে কর্ণপাত না করে মার্সিডিজ গাড়িটি ওখানেই ফেলে স্থানীয় বিজেপি নেতার গাড়িতে চড়ে ঝড়ের বেগে জয়পুর চলে গেলেন।

বাচ্চা মেয়েটি মারা গেল। বাকি সবাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হর্ষ খান্ডেলওয়ালের মতে মার্সিডিজের স্পীড ছিল ঘন্টায় ১৫০ কিলোমিটার। পরে ড্রাইভার গ্রেফতার হয় বেয়াড়া স্পীডে গাড়ি চালানোর অভিযোগে।

হেমা টুইট করে বললেন—সব দোষ বাচ্চা মেয়ের বাবার। ও যদি ট্রাফিক রুল ভেঙে মার্সিডিজের সামনে না আসত তাহলে বাচ্চাটি বেঁচে যেত।

হাসপাতাল থেকে মেয়ের বাবা জবাব দিলেন—আমি রুল ভাঙিনি, আপনার ড্রাইভারকেই পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। আমার দু’ বছরের বাচ্চা মেয়ে বেঁচে যেত যদি আপনি আপনার গাড়িতে বাচ্চাটাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌঁছে দিতেন।

না, ওঁরা হেমা মালিনীর থেকে কোন ক্ষতিপূরণ পান নি।

৩.২

‘বিগ বস’ সলমান খান এবং ফুটপাতে লোকচাপা

ঘটনার সংক্ষিপ্ত কালপঞ্জী

২৮/৯/২০০২

অভিনেতা সলমান খান মাঝরাতে ফুটপাথে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত মানুষের উপর তাঁর টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ি চড়িয়ে একজনকে মেরে ফেলার এবং চারজনকে ঘায়েল করার অভিযোগে গ্রেফতার হলেন।

অক্টোবর, ২০০২- কেস খেলেন পেনাল কোডের ধারা ৩০৪ (নরহত্যা, কিন্তু খুন নয়)।

অক্টোবর, ২০০৩- মুম্বাই হাইকোর্ট ধারা বদলে ৩০৪এ করে দিল, অর্থাৎ নরহত্যা নয়, শুধু বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনা, যাতে মৃত্যু হয়েছে।

৬ মে, ২০১৫- মুম্বাইয়ের দায়রা আদালত মদ খেয়ে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগে শাস্তি দিল-- পাঁচ বছর জেল ।

সেদিনই মুম্বাই হাইকোর্ট অভিযুক্ত সলমানকে জামিন দিয়ে অন্তিম ফয়সালা পর্য্যন্ত শাস্তি স্থগিত করে দিল।

ডিসেম্বর, ২০১৫- মুম্বাই হাইকোর্ট প্রমাণের অভাবে সলমান খানকে সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্তি দিল।

জুলাই ৫, ২০১৬—মহারাষ্ট্র সরকার ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আপিল করল। সেখানে ৮ বছর ধরে মামলা লম্বিত রয়েছে।

কিন্তু আসল তামাশা বুঝতে হলে নীচের টিপ্পনিগুলো দেখুন।

দুর্ঘটনার পর যখন জনমানস বিক্ষুব্দ তখন বলিউডি গায়ক অভিজিত ভট্টাচার্য মন্তব্য করলেন—ফুটপাথ কি শোবার জন্য?

আমার বিনীত প্রশ্নঃ ফুটপাথ কি গাড়ি চালানোর জন্য? তাও ফাঁকা রাস্তা ছেড়ে!

যুবক পুলিস কনস্টেবল রবীন্দ্র পাতিল সলমান খানের দেহরক্ষী নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনিই ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০০২ তারিখে জবানবন্দী দিয়েছিলেন যে গাড়ি চালাচ্ছিলেন সলমান নিজে, তাঁর ড্রাইভার নয়।


কিন্তু মহামান্য মুম্বাই হাইকোর্ট তাঁর সাক্ষ্যকে নির্ভরযোগ্য মানলেন না। কেননা, তিনি গোড়ায় সলমানের মদ্যপানের কথা বলেননি। তিনদিন পরে ১ অক্টোবর তারিখে বললেন যে মত্ত সলমানকে তিনি গাড়ি চালাতে বারবার নিষেধ করেছিলেন।


বলা হয়, পাতিলের উপর বয়ান বদলে দেবার প্রচণ্ড চাপ ছিল। শুনানিতে পাঁচবার অনুপস্থিত থাকায় আদালত তাঁর নামে ওয়ারেন্ট জারি করে। ডিউটিতে গরহাজির থাকায় পুলিশ বিভাগ প্রথমে সাস্পেন্ড, পরে ডিসমিস করে।


পত্নী ডিভোর্স দেয়, বাবা-মা অজ্ঞাত কারণে তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করে।


২০০৭ সালে তাঁকে রাস্তায় পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায়, তিনি তখন যক্ষ্মারোগে মরণাপন্ন। শেষে ৪ অক্টোবর, ২০০৭ তারিখে মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি মারা যান।


তাঁর শেষ কথাঃ “আমি শেষ পর্য্যন্ত বয়ানে কোন পরিবর্তন করি নি। কিন্তু আমার ডিপার্টমেন্ট আমার সঙ্গে রইল না। আমি চাকরিতে ফেরত যেতে চাই, বাঁচতে চাই। একবার পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে চাই”।


রবীন্দ্র পাতিল ছিলেন ‘মুখ্য সাক্ষী’। অনেকের সন্দেহ, মূল শুনানির সময় তাঁকে জোর করে আটকে রাখা হয়েছিল যাতে তিনি আদালতে উপস্থিত হতে না পারেন।

সলমানের ড্রাইভারঃ বয়ান বদল

সলমানের ড্রাইভার অশোক সিং ১৩ বছর বাদে হঠাৎ বয়ান বদলে বললেন—গাড়ি নাকি তিনিই চালাচ্ছিলেন, সলমান নয়। আরও বললেন যে টায়ার ফেটে যাওয়ায় গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফুটপাতে উঠে গেছল।


কিন্তু সরকারি পক্ষ জোর দিয়ে বলে—এটা ডাহা মিথ্যে। এস ইউ ভি গাড়ির টায়ার ওভাবে ফেটে যায় না।

তারপর অশোক সিংকে আদালতে মিথ্যে বলার জন্য গ্রেফতার করা হয়।

যাঁরা বেখেয়ালে গাড়ি চালানোর শিকারঃ

২৮ সেপ্টেম্বর,২০০২ এর রাতে ফুটপাতে শুয়েছিলেন পাঁচজন। গাড়ি রাস্তায় ওঠায় তৎক্ষণাৎ মারা পড়েন নুরুল্লা শরীফ। বাকি আহত চারজনের কারও কারও পা পিষে যায়। ওদের মতে সলমান চালকের আসন থেকে ডানদিকের দরজা দিয়ে নেমে আসেন।

সলমানের বক্তব্য অন্যদিকের দরজা নাকি জ্যাম হয়ে গেছল। সলমান মুক্তি পাওয়ায় ওঁরা কিছু আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়েছিলেন, পেয়েছেন বলে জানা যায় নি।

উপসংহার

আমরা নব্বইয়ের দশক থেকে বর্তমান বছর পর্য্যন্ত এতগুলো কেসের বিহঙ্গম দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করলাম। যা মনে হল—বড়মানুষের গাড়িতে সাধারণ মানুষ চাপা পড়লে কিছু আশা না করাই ভাল।

পুলিশের প্রাক্তন উচ্চপদের আমলা শ্রী কিরণ বেদীর টুইটারের বক্তব্যটি আপাতত শেষকথা বলেই মনে হয়।

“ ইফ ইউ আর এ ভিআইপি, সেলিব্রিটি, প্রিভিলেজড্‌, রিচ অ্যান্ড ইউ ক্যান অ্যাকসেস বেস্ট লীগ্যাল এইড, ইউ ক্যান অ্যাভয়েড জেল’।
4

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - স্মৃতিকণা সামন্ত

Posted in








শ্মশানের জমিটা ঘাসে ঢেকে আছে। ছোটছোট গর্তে সকালের বৃষ্টিজমা জল। ব্যাঙ লাফিয়ে বেড়াচ্ছে দেদার। জমির পুবে তালপুকুরের পাড়, উত্তরের ঝোপঝাড় আর বাঁশবন ছুঁয়ে চলে গেছে মোরাম ফেলা বড় রাস্তা। রাস্তার উল্টোদিকের ঝুরো বটগাছ, আর গাছের ওপারে ডোমদীঘির কালো জল। বিকেলের রঙ নীলচে সবুজ।


দাদুর সাথে এসে বসি ওই বটের তলায়, শ্মশানের দিকে স্থির চেয়ে থাকে দাদু। দাদুর বাবা সূর্যনারায়ণ, তার বাবা সহদেব, তার বাবা এবং তার আর তারও আগের সব পুরুষের চলে যাওয়া দেখেছে এই সবুজ জমি, তালপুকুর, ডোমদীঘি আর ওই রাস্তা। চোদ্দপুরুষের সালতামামি লেখা আছে এই বংশের খেরোর খাতায়, দলিলে, পাট্টায়।

কোনও এক অখ্যাত দিনে এই গ্রামে এসেছিল আমাদের পূর্বজ, খড় মাটি বাঁশ দিয়ে তৈরি হয়েছিল আমাদের প্রথম বসত। জমিজিরেত, ঠাকুর দেবতার নামে কাটা হয়েছিল মন্দিরের ভিত, শিকড় চারিয়ে যাচ্ছিল মূল, আমাদের শাখাপ্রশাখারা বাড়ছিল ডালপালায়।


চৈতন্যদেব যখন দন্ডভুক্তির রাস্তা ধরে পৌঁছে যাচ্ছিলেন শ্রীক্ষেত্র তখনই কোনও এক মেঠোপথ ধরে রাস্তায় হাঁটছিল আমার পূর্বপুরুষ, পূর্বনারী আর তাদের বংশজ সন্তানরা। জাতিতে সদগোপ, পেশায় চাষী পেয়েছিল মল্লভূমের রাজস্ব আদায়ের ঠিকা। ডোম বাগদী দুলেরা ছিল তাদের সেপাই। কিন্তু তার আগে? তার, তার কিংবা তারও আগে কোন পাটক, বাটক কিংবা নগরীর কোণে ছিল আমাদের মেটে ঘর, গোয়ালঘর, চাঁপাফুলের উঠোন? কোন ভুক্তি, কোন দন্ড, কোন ভূমি?


বিকেল রঙ বদলাচ্ছে হনহন করে। দাদুর সাথে হাঁটছি ওই মেটে রাস্তায়। পায়ে পায়ে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি শতকের পর শতক। হাজার হাজার বছরের ধুলো জমছে আমাদের পায়ে, জামায়, চুলে। এই রাস্তা দেখেছে বর্গীর দল, কালা পাহাড়। তারও আগে কোনও আদিম কৌম জনগোষ্ঠীর পায়ের ছাপ পড়ে আছে এইখানে, এই ধুলোর আস্তরণে।


প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ বলছেন কায়স্থ, সদগোপ আর কৈবর্ত সমাজ বাঙালীর প্রকৃত প্রতিনিধি। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ আর বৃহদ্ধর্মপুরাণ লিখেছে বর্ণসংকর বাঙালির কুল গোত্রের তালিকা। নৃতাত্ত্বিক সেই তালিকা হাতে খুঁজতে বেরিয়েছে বাঙালির জন্মসূত্র, আমার বাপ, দাদা, ঠাকুরদা, তস্য এবং তস্য ঠাকুরদার উৎসমুখের কথা।


ঝুরঝুরে সন্ধ্যা নামছে দীঘির জলে, বুনো ঝোপে, বাঁশের বনে, রাস্তায়। হুন হুনা, হুন হুনা, হুন হুনা রে, হুন হুনা...

পালকি চড়ে নতুন বউ আসছে গাঁয়ে। এসেছিল আমার ঠাকুমা, দিদি ঠাকুমা এবং আরও আরও সমস্ত প্র প্র প্রপিতামহীর দল। নববধূর সাজে, অলক্ত পা ফেলেছিল লালমাটির গায়ে, কাজল টানা চোখ তুলে প্রথম দেখেছিল এ গাঁয়ের গাছপালা, টলটলে দীঘি আর খোড়ো ছাউনির মেটে বসত। নৈষধ চরিতের দময়ন্তী সেদিন নববধূ। লাক্ষারসে রাঙানো ঠোঁট, পায়ে লাল আলতা, কানে মণিকুন্ডল, হাতে কেয়ুর কাঁকন, শঙ্খের বালা। তেমনই কি আমার সেই অজানা কোনও পিতামহীর ছিল– হাতে শঙ্খের বালা, কানে তালপাতার কুন্ডল, পরনে আটপৌরে সুতোর কাপড়, ঘোমটা ঢাকা আয়ত একজোড়া চোখ?


‘দ্য এনালস অফ রুরাল বেঙ্গল’ লিখতে গিয়ে হান্টার আক্ষেপ করেছেন বাঙালির এমন কোনও লিখিত ইতিহাস নেই যা দেখে তার আদিকথা জানা যায়। যা আছে, যেটুকু আছে তা প্রায় সবই রাজাদের দলিল, দানপত্র। সেখানে সাধারণের কথা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিছু লিপি আছে, সেও সমাজের ছবি নয়। তবুও ইতিহাসবিদ খোঁজে সেইসব অন্ধগলিতে, সেইসব লিপি, দানপত্র, সাহিত্য, পুরাণ কিংবা পোড়ামাটির ফলকে। পাহাড়পুর আর ময়নামতীর বিহারে মন্দিরের গায়ে শিল্পী ঢেলে সাজিয়েছে সমাজের কথা, সাধারণ জীবনের কথা, মাঠেঘাটে কাজ করা মানুষের দিনযাপনের অনাড়ম্বর সব দলিল।


হাওয়া বইছে। বাঁশের পাতায়, তালগাছের মাথায় ঘষা খেয়ে শব্দ হচ্ছে শরশর, শনশন।দীঘির জলে ছোটছোট ঢেউ। মাটির দাওয়ায় বসে কুটনো কুটছে আমার পিতামহী কোনও এক প্রাগৈতিহাসিক সন্ধ্যায়। বেগুন, লাউ, কাঁকরোল, কচু, ইচা, বাচা, শকুল, রোহিতের ঝোলে ঝালে ভাজায় ম ম করছে আমাদের উঠোন, টুপটাপ ঝরে পড়ছে গোলকচাঁপার ফুল। পুকুরঘাটে বর্ষা নেমেছে।


প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোয় তো বটেই; বর্মা, চীন, ইন্দোনেশিয়া, জাপান জুড়ে প্রধান খাবার ভাত মাছ– বাংলা আসাম উড়িষ্যারও তাই। মধ্য ভারত থেকে দক্ষিণে সিংহল অব্দি, পূর্বে উড়িষ্যা বাংলা আসাম পর্যন্ত, সিংহল থেকে অস্ট্রেলিয়া অব্দি ছড়িয়ে ছিল এক আদিম কৌমগোষ্ঠী। নৃতাত্বিকরা বললেন এই সেই আদি অস্ট্রালয়েড জন, যে জনের গঠনগত মিল পাওয়া গেছে কোল মুন্ডা সাঁওতাল শবর হো ভূমিজ উপজাতির শরীরে। করোটি, কপাল, নাক, চোখ, চুল, উচ্চতার খুঁটিনাটি বিচারে জানা গেছে এই আদি অস্ট্রালয়েড গোষ্ঠীর সাথে মিশেছে আর এক ভূমধ্যসাগরীয় জনস্রোত আলপাইন, এলপো দিনারীয় স্রোত। এক প্রাগৈতিহাসিক ভোরে মিলেমিশে যাওয়া সেই সংকর স্রোতে জন্ম নিল আমার প্রথম পূর্বজ।


পশ্চিমের গুজরাট থেকে মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু হয়ে একটা অ্যালপো দিনারীয় দল পৌঁছেছিল হয়ত উড়িষ্যা, বাংলার মাটিতে। তারও আগে কোনসময় এসেছিল ভূমধ্যসাগরিয় কোন নরগোষ্ঠী। এদের সঙ্গে মিশে গেছিল বাংলার সেইসব আদিম সাঁওতাল, ওঁরাও কিম্বা মুন্ডা জনজাতির আদি অস্ট্রালয়েড রক্ত। রক্তের সাথে রক্তের মিশেলে যেমন জন্ম নেয় নতুন প্রজন্ম তেমনই মিশে যায় রীতিনীতি, আর বিশ্বাস।


জল থৈ থৈ জমি। জল টুপটুপ মেঘ। বীজধান দুলছে হাওয়ায়। তার আগে লাঙল চলেছে, মসৃণ কাদামাটি। সাতপুরুষের জমি, নিজের হাতে লাঙল চষে আমার পূর্বপুরুষ, ফালাফালা মাটি। মাটি ঘাঁটতে ঘাঁটতে আরও আরও বহুদূর হেঁটে যায় আমাদের দাদু,তস্য এবং তস্য বাপ দাদারা। লাঙল নামানোর আগে পুজো দেয় হারান কাকা,পূজো দেয় আমার পূর্বপুরুষ। গোলায় ধান তুলে এনে লক্ষ্মীর বেড় পড়ে মরাইয়ের গায়ে; তেল সিঁদুরের ফোঁটা, গোবর নিকোনো মরাইতলায় অল্পনার আঁকিবুকি। ধানের ছড়া, কলার পাতা, কলা গাছ, হলুদ, পানে আমাদের কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। ভেজা চুল, এলো খোঁপায় আসন সাজায় আমারই কোনও দিদিঠাকুমা।


প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপে দ্বীপে জ্বলে ওঠে প্রদীপ। সুপারি, হলুদবাটা, ধানের ছড়া,কলার পাতার গন্ধ মেখে ভেসে যায় শাঁখের আওয়াজ, দূরে বহুদূরে গ্রাম নদী সাগর পেরিয়ে অজানা কোন দেশে। বাঙালির পুজোপার্বনে আদি নর্ডিক আর্য সভ্যতার ছাপ অল্পই, বাঙালির জীবন এবং চরিত্রেও তাই। যেটুকু বা তাও ওপরে, তার গভীরেও সেই আদি অস্ট্রেলিয় ধারা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলিতে এই পান সুপারি, ধানের ছড়া, কলাপাতা, হলুদের ব্যবহার সমস্ত মাঙ্গলিক কাজে, ধানের ছড়ায় পুজো করে নাগা আর মুন্ডারী জনজাতি। পুজো করে বাঙালি আর তার ব্রাহ্মণ।


সামাজিকভাবে বাঙালি ব্রাহ্মণ উত্তরভারতীয় ব্রাহ্মণের মর্যাদা পায়নি কখনও। বাঙালী ব্রাহ্মণের নিকটতম সম্পর্ক বাংলার কায়স্থ আর বৈদ্যের সাথে। আর বাংলার নমঃশূদ্র চন্ডাল গোষ্ঠীর শরীর গঠনগতভাবে ঘনিষ্ঠ মিল খুঁজে পায় উত্তরের বর্ণব্রাহ্মণের সঙ্গে। ঠিক তারই পাশে বাংলার কায়স্থ কৈবর্ত আর সদগোপ দেহগত বৈশিষ্টে বাঙালির সব বর্ণের সবচেয়ে কাছের জন। বিহারের কিছু গোত্র ছাড়া এই তিন দলের আর কারোর সঙ্গে কোনও মিল তেমন পাওয়া যায়নি, নৃবিজ্ঞানীরা এমনটাই বলেন।


চাষ করে আমার সদগোপ পূর্বপুরুষ। ফালাফালা মাটি, আকাশ ছেঁচা জল, মাটি ঘেঁটে ঘেঁটে ফসল তোলে ঘরে। লাঙলের ফালে তেল সিঁদুরের পূজো অম্বুবাচীর দিনে। লাঙলের ব্যবহার অস্ট্রালয়েড জনের ধারা। লাঙল শব্দও এসেছে এদেরই ভাষা থেকে। অস্ট্রালয়েড ভাষায় লাঙল শব্দের মানে চাষ করা, কিংবা হল। এই একই অর্থে লাঙল শব্দের ব্যবহার সংস্কৃতে। ভাষাতাত্বিক যুক্তি দিলেন যদি কোনও জিনিসের ব্যবহার অজানা হয় তবে তার নির্দেশক শব্দও অভিধানে থাকেনা। আদি নর্ডিক আর্যরা কৃষিকাজ শিখেছে এদেশে এসে, লাঙল শব্দও তখন জুড়ে গেছে সংস্কৃত ভাষার অভিধানে। একই ভাবে দা, করাত, কানি, চোঙা, চিখিল, চোঙ, লেবু, কামরাঙা, ডুমুর ঝোপঝাড় ইত্যাদি এসেছে অস্ট্রিক শব্দ থেকে। দামলিপ্তি(তাম্রলিপ্ত) আর পৌন্ড্র, বঙ্গ এসব শব্দও অস্ট্রিক। নদী পাহাড় জঙ্গলেও পড়ে আছে অস্ট্রালয়েড জনের ছাপ। দাক্ হলো জল, দাক্ থেকে সংস্কৃত উদক। দাম-দাক্ দামোদর। আমাদের ভরা বর্ষার দামোদর।


মেঘ নামছে পাকুড় গাছের মাথায়। রাখাল ফিরে আসছে, দীঘির জলে ডোঙা বেয়ে ঘোরে হারান কাকার ছেলে পরেশ। মাথায় তালের টোকা। পেরিয়ে যাচ্ছি ফণীমনসার ঝোপ, মনসার থান, বর্গী’র মাঠ। বীজধান রোয়ার সময় এখন। চিকচিকে সবুজ ঢেউ ধানি জমির গায়ে। লাঙলের ফালে মাটি কেটে কেটে চাষ করে সেইসব অস্ট্রালয়েড মানুষ, সমতল জুড়ে, ধাপ কেটেকেটে পাহাড়ের গায়ে। চাষ করে আমার চৌদ্দপুরুষ, চাষ করে হারান বাগদী, কানন দুলে, শিবু ডোম।


পণ, গন্ডা, কাহনের হিসেবে বীজ রুইছে। মাড়াই করা খড়ের হিসেব হচ্ছে কাহন দরে। আজ নয়, কাল নয়, হাজার হাজার বছর ধরে আমার চাষী পূর্বজ শিখেছে এই হিসাব। প্রতি চারে এক গন্ডা, কুড়ি গণ্ডায় এক পণ, ষোল পণে এক কাহন। কাহনে পণে আঁটি গুনছে আমাদের ঠাকুরদা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপের আদিম মানুষ গোনে দু হাতের দশ আঙুল, কুড়ির হিসাবে। গন্ডা হল একক, গন্ডা হল চার। চার কুড়িতে এক পণ। বিড়বিড় করে বীজধানের হিসাব কষে দাদু, বীজতলা জুড়ে সবুজ বিছায় হারান কাকা।


ভুবনেশ্বর শিবের ভাঙ্গা মন্দিরের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াই। স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা। কবেকার এই মন্দির ছিল জানেনা আমার দাদু, জানেনা গ্রামের কেউ। হয়ত মন্দির নয় ,বৌদ্ধ বিহার। বৌদ্ধ জৈন ব্যবসায়ীরা আসতো দ্বারকেশ্বরের ঘাটে ঘাটে, সওদা হত ধুনো, কাঁসার বাসন, আখের গুড়। ক্রিট দ্বীপের সাথে বাঙালির ব্যবসা ছিল মশলা, হাতির দাঁত, কাপড়ের।

দেবরাজ ইন্দ্র পণিদের কাছে শিখছেন পনীর আর ছানা তৈরির হালহকিকত। পণি থেকে আসা পণ্য কিম্বা বণিক শব্দের সূত্র আমাদের নিয়ে যায় দূরে, ভূমধ্য সাগরের দেশে। এই সেই ভূমধ্যসাগরীয় দল যারা হয়ত এসেছিল তামা'র খোঁজে। প্রফেসর এলিয়ট স্মিথ এই তামার ব্যবহারকেই দায়ী করেছেন মধ্যপ্রাচ্য আর ভূমধ্যসাগর উপকূলের মানুষগুলোর ভারত সহ নানান দেশে ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে, ঠিক যে কারণে মেগালিথ কাল্টে বিশ্বাসী সূর্যপূজারী লোকেরাও ছড়িয়ে যাচ্ছিল পৃথিবীর নানান কোণায়। আর্যভাষী অ্যালপো দিনারীয় দলগুলোও হয়ত এসেছিল এদেরই পিছু পিছু, সম্ভবতঃ নর্ডিক আর্যদেরও আগে।


বর্ধমানের আউস গ্রামের কাছে যে পাণ্ডু রাজার ঢিবি, সেই ঢিবিতেই পাওয়া গেছে ক্রিট দ্বীপে ব্যবহার হওয়া লিপিতে লেখা এক সিলমোহর। মিশরীয় এক নাবিকও তাঁর 'পেরিপ্লাস" বইয়ে লিখছেন প্রায় তিন হাজার বছর আগে ক্রিট দ্বীপে বাঙালি উপনিবেশের কথা।


বর্ষা ছিল সেদিন, উপুড় হয়ে পড়েছে আকাশ। লাল চেলি, চন্দনের টিপ– কড়ি খেলে ঠাকুমা, কড়ি খেলে আমার দিদিঠাকুমা। কড়ি খেলে ফিজি, নিউগিনি, পাপুয়ার মেয়েরা। মাঠঘাট ভাসছে বৃষ্টিফোঁটায়, বৃষ্টি নাচছে দীঘির জলে। কলার ডোঙায় ভেসে বেড়ায় কালু ডোম, পদ্মপাতায় টলটলে জল। পাড়ে ভিজছিল ডোমনি রাধু আর তার বাঁশের চুপড়ি। রাধুর চিকন সবুজ গা, ভ্রমরকালো চোখ, ছড়ানো নাক, ছোট্ট কপাল।


“এক সো পদমা চউসট্‌ঠী পাখুড়ি।

তহিঁ চড়ি নাচই ডোম্বি বাপুড়ি॥”


ডিঙ্গা ভাসছিল জলে। কাঠের সাথে কাঠ জুড়ে জুড়ে মস্ত ডোঙা ভেসে যাচ্ছিল জলে, প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউয়ের মাথায়। ভেসে যাচ্ছিল আদি অস্ট্রালয়েড মানুষ আর তাদের জলজ অভিসার সিংহল, ইন্দোনেশিয়া, মেলানেশিয়া ছাড়িয়ে আরও দূরে অস্ট্রেলিয়ার আদিম মাটিতে, প্রাগৈতিহাসিক এক সন্ধ্যার উপকূলে।


বৃষ্টি পড়ছিল খুব… বৃষ্টি পড়ছে জোরে। ভেসে যাচ্ছে মাঠ, দীঘির পাড়। দূর ,অতি দূর থেকে বিনবিন শব্দ উড়ে আসে হাওয়ায় এক কুড়ি, দু কুড়ি... চার কুড়ি পণ…
1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সৈকত মণ্ডল

Posted in






বাল্মীকি রামায়ণে অনেকগুলি উপেক্ষিত চরিত্রের মধ্যে শান্তা অন্যতম। কাব্যে তিনি ঠাঁই পেয়েছেন শুধু আদিকাণ্ডেই। তার পরিধি খুবই সামান্য, কিন্তু রামায়ণ কাব্যে তাকে নিয়ে আলোচনার যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। রামায়ণে তিনি ঠিক কার কন্যা সেটাই একটা রহস্য। তিনি ঋষ‍্যশৃঙ্গের পত্নী। এই ঋষ‍্যশৃঙ্গ মুনির সাহায্য নিয়ে রাজা দশরথ পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করেন ও ফলস্বরূপ তাঁর চারটি পুত্র হয়। রামায়ণ ব্যতীত অন্যত্র কবিরা শান্তাকে কেমন ভাবে দেখেছে এই সমস্ত দিক গুলো নিয়ে এই লেখাটির বিষয়বস্তু, তবে শুরুতে বাল্মীকি রামায়ণে শান্তার জন্ম নিয়ে আলোচনা করা যাক।

বাল্মীকি রামায়ণের লিখিত রূপে সমস্ত ভারতবর্ষে যতগুলি পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়, সেটিকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই বিভাজন পন্ডিতরা করেছেন লিপি ও তাদের মধ্যে সম্পর্ক অনুযায়ী। সংস্কৃত ভাষার নিজস্ব কোনো হরফ / স্ক্রিপ্ট নেই। এটি যে কোনো লিপিতে লেখা যায়। এমনকী রোমান হরফেও। দক্ষিণ ভারতের লিপি - গ্রন্থ, তেলুগু ও মালায়লমে - যে সমস্ত বাল্মীকি রামায়ণের পাণ্ডুলিপি পাওয়া গিয়েছে, তাদের একাডেমিক ভাষায় বলা হয়েছে দক্ষিণ /সাউথ রিসেন্সন। সহজ ভাবে বললে দক্ষিণ ভারতের বাল্মীকি রামায়ণের পাণ্ডুলিপি। দক্ষিণের পাণ্ডুলিপির মধ্যে পাঠান্তর থাকলেও মোটামুটি ভাবে টেক্সটগুলির মধ্যে তেমন বিশেষ ফারাক নেই। তার উপর দক্ষিণের পন্ডিতদের (ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের) মধ্যে একটা সুদীর্ঘ্য কাল ধরে রামায়ণের উপর টীকা লেখার চল ছিল। মধ্যযুগের পন্ডিত গোবিন্দরাজ ও তিলকদের টীকা ও টেক্সট কালের প্রবাহে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এর মধ্যে তিলকের টেক্সট (যার মধ্যে বাল্মীকি রামায়ণের টেক্সট ও তিলকের নিজের টীকা আছে) প্রচলিত টেক্সট / ভালগেট টেক্সট হিসেবে পরবর্তী কালে মান্যতা পায়। তেমনি ভাবে উত্তর ভারতের পাণ্ডুলিপি রয়েছে বাংলা, মৈথিলি, কাশ্মীর, ওড়িয়া, ও নেপালি লিপিতে। এরা হলো নর্থ রিসেন্সন। এই নর্থ রিসেন্সন আবার দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটি গৌড়-বঙ্গ থেকে নেপালের ধারা নিয়ে বয়ে চলেছে, অর্থাৎ ভারতের নর্থ-ইস্ট রিসেন্সন, অন্যটি কাশ্মীর থেকে পাকিস্তান (বিভাজনের আগে) হয়ে, অর্থাৎ নর্থ-ওয়েস্ট একটা আলাদা ঘরানায় গড়ে উঠেছে। দেবনাগরী লিপি নর্থ ও সাউথ দুটোতেই পাওয়া যায়। নর্থ ও সাউথের টেক্সট মোটামুটি ভাবে একই থাকলেও তাদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে কাহিনী স্তরে ও শ্লোক গঠনে তফাৎ পরিলক্ষিত হয়। ঠিকই এমনই একটি আকর্ষক অংশ হলো শান্তার জন্ম রহস্য।

প্রচলিত টেক্সটে (অষ্টম সর্গ থেকে) আমরা জানতে পারি রাজা দশরথ অপুত্রক। তিনি পুত্রলাভের আশায় সুমন্ত্র (প্রধান মন্ত্রী) ও বিভিন্ন পন্ডিতদের সঙ্গে আলোচনা করছেন একটি অশ্বমেধ যজ্ঞ করার। সরযূ নদীর উত্তরতীরে যজ্ঞানুষ্ঠানের উপযুক্ত ভূমি নির্মাণ করে, একটি অশ্বকে ভ্রমণের জন্য ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলো। তারপর সুমন্ত্র রাজাকে গোপনে একটি কাহিনী বলেন। তিনি ঋষিগণকর্তৃক কথিত একটি শ্রুতি-কাহিনী শুনেছিলেন বহু পূর্বে -- ব্রহ্মার পুত্র সনৎকুমার ঋষিদের জানিয়েছিলেন কীভাবে রাজা দশরথ পুত্রলাভ করতে পারবেন। গল্পটি এরকম: কাশ্যপ মুনির একটি পুত্র আছেন, যিনি বিভান্ডক নামে প্রসিদ্ধ। তার পুত্র হলো ঋষ‍্যশৃঙ্গ যার ব্রহ্মচর্য্যের গুন সংসারে প্রসিদ্ধিলাভ করেছিল। সমসাময়িক অঙ্গদেশে রোমপাদ নামে এক মহাপ্রতাপশালী রাজা রাজ্যপালন করতেন। তার দুরাচরণের জন্য অঙ্গরাজ্যে দারুন অনাবৃষ্টি হয়। এর থেকে মুক্তির পথ একটাই বেরিয়ে আসে, সেটি হলো ঋষ‍্যশৃঙ্গ মুনিকে যেভাবেই হোক অঙ্গরাজ্যে নিয়ে আসতে হবে, এবং তার সঙ্গে রাজার কন্যা শান্তাকে বিধিপূর্বক সম্প্রদান করতে হবে - "প্রযচ্ছ কন্যাং শান্তাং বৈ বিধিনা সুসমাহিত (১/৯/১৩)"।

এই প্রথম আমরা জানতে পারলাম শান্তার কথা। উনি রাজা রোমপাদের কন্যা। তারপর ছলের দ্বারা (বার্বনিতা দের সাহায্যে) ঋষ‍্যশৃঙ্গকে রাজ্যে আনা হলো, এবং তিনি নগরে পা দেওয়া মাত্রই বৃষ্টি আরম্ভ হলো। ঋষিকে এভাবে ছলনাপূর্বক আনয়ন করার ফলে তার অন্তরে যেন ক্রোধের উদয় না হয়, তাই বিধি অনুসারে শান্তাকে শুদ্ধমনে সমর্পণ করে রাজা আনন্দ লাভ করলেন। সুমন্ত্র দশরথকে বলেন ঐ "জামাতা" ঋষ‍্যশৃঙ্গ আপনার পুত্রপ্রাপ্তিসম্পাদন করতে পারবেন (১/৯/১৯)। এটাকে দুটিভাবে ব্যখ্যা করা যায়। রোমপাদের মেয়ে-জামাই যেন দশরথেরও মেয়ে-জামাই তুল্য। সনৎকুমার এটাও বলেছিলেন যে ইক্ষ্বাকু বংশে দশরথ নামে একজন সত্যনিষ্ঠ রাজা জন্মাবেন, দশরথ নামে, এবং অঙ্গরাজ্যের রাজা রোমপাদের সঙ্গে তার মিত্রতা হবে। তাই মিত্রের কন্যা-জামাইকে নিজের মেয়ে-জামাই ভাবতে দোষ কোথায়? দ্বর্থক অর্থে তেমনি এটাও হতে পারে, শান্তা হয়তো রাজা দশরথের কন্যা। উনি রোমপাদকে তার কন্যা দান করেছিলেন।

সনৎকুমারের কথা অনুযায়ী দশরথ রোমপাদের কাছে গিয়ে বলবেন - "আমি নিঃসন্তান। আপনার জামাতা, শান্তার স্বামী, ঋষ‍্যশৃঙ্গকে আপনার আদেশমত যজ্ঞ করতে বলুন। সেটা হলে আমার বংশরক্ষা হয় (১/১১/৪-৫)"। ঋষ‍্যশৃঙ্গ মুনি আসবেন, যজ্ঞ করবেন ও রাজার চারটি পুত্র হবে। এই শুনে রাজা দশরথ তার তিন স্ত্রী ও অন্তঃপুরস্থিত মহিলাগণদের সঙ্গে নিয়ে অঙ্গদেশে উপস্থিত হলেন। ওখানে সাত-আটদিন কাটানোর পর, একদিন দশরথ তার মিত্রকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বললেন - "আপনার কন্যা শান্তা পতিসহ মদীয় নগরী অযোধ্যায় গমন করুন - শান্তা তব সুতা রাজন্! সহ ভর্ত্রা বিশাংপতে (১/১১/১৯)"। রোমপাদ অনেক ভাবনা চিন্তা করে ঋষ‍্যশৃঙ্গকে বললেন - "তাই হোক, তুমি পত্নীর সহিত গমন করো।"

রামায়ণের একজন বিখ্যাত স্কলার ও অনুবাদক রালফ গ্রিফিথের এই অংশটির অনুবাদ পড়লে মনে হয় শান্তা যেন দশরথের নিজ কন্যা।

“This king,” he said, “from days of old
A well beloved friend I hold.
To me this pearl of dames he gave
From childless woe mine age to save,
The daughter whom he loved so much,
Moved by compassion's gentle touch.
In him thy Śántás father see:
As I am even so is he."

(Canto X)

শান্তা ও ঋষ‍্যশৃঙ্গ মুনি দীর্ঘ্য সময় অযোধ্যায় কাটিয়েছিলেন। ঋষ‍্যশৃঙ্গর তত্ত্বাবধানে অশ্বমেধ ও পুত্রেষ্টি যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়। এবং তাদের দুজনই বিশেষভাবে পূজিত হয়ে আবার অঙ্গদেশে ফিরে যায়। তাহলে লক্ষ করলে দেখা যাবে প্রচলিত টেক্সটে দু-একটি জায়গায় হাল্কা ইঙ্গিত থাকলেও কোথাও স্পষ্ট করে বলা নেই শান্তা দশরথের মেয়ে। এমনকী তিনি রোমপাদকে তার কন্যা দান করেছেন একথা কোথাও উল্লেখ নেই।

এবার নর্থ রিসেন্সন দেখা যাক। এখানকার পাণ্ডুলিপিতে অঙ্গদেশের রাজার নাম রোমপাদ নয়, বরং লোমপাদ - "এতস্মিন্নেব কালে তু লোমপাদঃ প্রতাপবান্ (১/৮/১১)"। দশম সর্গতে সুমন্ত্র জানায় তিনি সনৎকুমারের শ্রুতিকথনে জেনেছিলেন অঙ্গরাজ লোমপাদের সঙ্গে রাজা দশরথের মিত্রতা হবে। রাজা দশরথের শান্তা নামে সৌভাগ্য-শালিনী একটি কন্যা জন্মলাভ করবে।

ইক্ষাকুবংশজো রাজা ভবিষ্যতি মহাযশাঃ।
নাম্না দশরথো নাম ধীমান্ সত্যপরাক্রমঃ॥২॥
সখ্যং তস্যাঙ্গরাজেন ভবিষ্যতি মহাত্মনঃ।
কন্যা চাস্য মহাভাগা শান্তা নাম ভবিষ্যতি ॥৩॥

অঙ্গরাজের কোনো সন্তান হবে না। তিনি রাজা দশরথের নিকট প্রার্থনা করবেন - "সখা, আমি নিঃসন্তান। তুমি প্রসন্ন মনে তোমার এই শান্তা নাম্নী অসামান্য-রূপ-লাবন্যবতী তনয়া আমাকে প্রদান কর - আমি "পুত্রিকা" করব। করুনহৃদয়ের রাজা তার হৃদয়-নন্দিনীকে প্রদান করবেন (১/১০/৫-৮)"।

দশরথ ও ঋষ‍্যশৃঙ্গ মুনির সামনে, লোমপাদ আরো বলেন - "ঋষিকুমার! এই রাজা দশরথ আমার পরম-প্রিয় সখা। আমার সন্তান না হওয়াতে আমি "পুত্রিকা করবার নিমিত্ত" ইঁহার আত্মজা বরবর্ণিনী শান্তাকে যাচঞা করেছিলাম। ইনিও তৎক্ষণাৎ অক্ষুব্ধ-হৃদয়ে এই প্রিয়তমা কন্যা আমায় প্রদান করেছিলেন। আমার ন্যায় এই দশরথও সম্পর্কে আপনার শ্বশুর হন। আপনি শান্তাকে নিয়ে অযোধ্যায় গমন করুন (১/১০/২৫-২৯)"।

তাহলে নর্থ রিসেন্সন (সমগ্র উত্তর ভারতের বাল্মীকি রামায়ণের পাণ্ডুলিপিতে) রামায়ণে পরিষ্কার উল্লেখ পাই শান্তা দশরথেরই কন্যা। রামায়ণের শুদ্ধ সংস্করণ (ক্রিটিক্যাল এডিশন) এক্ষেত্রে দক্ষিণের পাঠ রেখে দিয়েছে। ক্রিটিক্যাল এডিশন রামায়ণের টেক্সট গঠনের মেথড একটু ভিন্ন ক্রিটিক্যাল এডিশন মহাভারতের টেক্সট গঠনের থেকে। মহাভারতে যেমন শারদা (কাশ্মীর) ও মালায়লম লিপিকে একটা একটা base ধরে বাকি পাণ্ডুলিপির প্রক্ষেপ ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা হয়েছে (এটা খুবই সরল ভাবে বলা হলো, আসল প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল), রামায়ণের ক্ষেত্রে সেরকম নয়। এখানে দক্ষিণের টেক্সটের ৭৫% রাখা হয়েছে এবং সেই অংশগুলো দক্ষিণের টেক্সট থেকে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে যেগুলো উত্তর ভারতে সাক্ষ্য দেয় না। কিন্তু উত্তর ভারতে যদি কোনো অংশ এক্সট্রা থাকে যেটা আবার দক্ষিণে সাক্ষ্য দেয় না, সেক্ষেত্রে তারা সেটিকে বাদ দিয়েছে, তাদের মেথড এটাকে প্রক্ষেপ বলে মনে করে।

এখানে সমস্যাটি আরো গভীর। তার কারণ বহু রামায়ণ গবেষকদের মতে আদিকান্ডের বেশ অনেক অংশ পরের সংযোজন। জন ব্রকিংটন Rama the Steadfast: The Early Form of Ramayana তে লিখছেন গোটা আদিকান্ড টাই পরে যোগ হয়েছে। ওঁর মতে রামায়ণের একদম প্রাথমিক স্টেজে মূল কবির হাতে আদিকান্ড রচনা হতে পারে না, এবং এই ধারণা একেবারেই ভ্রান্ত বলা যায় না। হার্মান জেকবি, কামিল বুলকে, রবার্ট গোল্ডম্যান, চিন্তামনি বৈদ্য, ক্রিটিক্যাল এডিশনের প্রত্যেকটি এডিটর ও আরো অনেক পন্ডিতরাই মনে করেন আদিকান্ডের মধ্যেও অনেক স্তর আছে যেগুলির সময়কাল ইতিহাসের মেথড দিয়ে বের করা সম্ভব। ব্রকিংটনের মতো পুরোটাই পরে রচিত হয়েছে না বলে, বেশিরভাগ পন্ডিত এটাই বলেন শুরুতে আদিকান্ডের খুব অল্প অংশ মূল কাব্যের অন্তর্গত ছিল।

জেকবি তার বিখ্যাত বই Das Ramayana তে লিখছেন রামের জন্ম ও গোটা ঋষ‍্যশৃঙ্গ অধ্যায়টাই পরের সংযোজন। উনি মনে করেন কাব্যের নায়কের জন্মের একটা সংক্ষিপ্ত কাহিনী হয়তো একটি ছিল, কেমন আকারে জানা নেই, কিন্তু সেটা কোনো অজ্ঞাত কারণে হারিয়ে গেছে। সেটাকে পূরণ করতে এরকম একটি কাহিনীর অবতারণা করতে হয়েছে যেখানে বিষ্ণু নিজে অবতার রূপ ধারণ করে দসরথের পুত্র হয়ে জন্মাবেন। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে রাম শুরুতে বিষ্ণুর অবতার ছিলেন না, এটির ধারণা টেক্সটে ঢুকছেন অনেক পরে, যখন বিষ্ণু-কাল্ট ভারতে পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ক্রিস্টপূর্ব ৭০০-৬০০ তে এই কাব্যের গোড়ার স্টেজে (গোল্ডম্যান বালকাণ্ডের ভূমিকা) লেটার-বৈদিক পটভূমিকায় বিষ্ণু অবতার রূপে কখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন না। ফলে রামের জন্মের পুরো অধ্যায়টাই হয়তো পরে রচিত হয়েছে, এমনটা অনেকেই মনে করেন। সেক্ষেত্রে, শান্তার কাহিনীও পরে যোগ হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, তবে এটা বলাটা খুবই মুস্কিল নর্থ রিসেন্সনে বর্ণিত অংশগুলি সম্পূর্ণরূপে প্রক্ষেপ কিনা। এটা বলা যায় না কারণ কোনো রাজা নিজের কন্যা অন্য মিত্র রাজাকে দান করেছেন, এরকম উদাহরণ আমরা মহাভারতেও দেখেছি, কুন্তীর ক্ষেত্রে। তেমনি রোমপাদ / লোমপাদ যদি পুত্রিকা হিসেবে কন্যাকে গ্রহণ করেন, সেক্ষত্রে ব্যাপারটি খুবই ইন্টারেস্টিং হয়ে যায়। একটু বিশদে আলোচনা করা যাক।

মহাভারতে রামকথার একটি অংশ পাওয়া যায় বনপর্বে। ওটি ছাড়াও সমগ্র মহাভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক উপাদান আছে যেগুলিকে রামায়ণের সঙ্গে যুক্ত করা যায়। তীর্থযাত্রা পর্বে (৩/১১০) আমরা জানতে পারি অঙ্গদেশের রাজার নাম লোমপাদ। মূল কাহিনীটি মোটামুটি রামায়ণের সঙ্গে এক, শুধু এখানে ঋষ‍্যশৃঙ্গকে ছলনা করে এনে মেয়েদের কক্ষে রাখা হয়েছিল। বিভান্ডক ঋষি তার পুত্রকে না খুঁজে পেয়ে রেগে আগুন হয়ে যায় এবং বুঝতে পারে তার পুত্রকে অঙ্গরাজ নিয়ে গেছে। কিন্তু পরে তার মন গলে যায়। রাজাকে বলে শান্তার গর্ভে সন্তান আসার পর ঋষ‍্যশৃঙ্গ যেন বনে ফিরে আসে। বাধ্য সন্তানের মত ঋষ‍্যশৃঙ্গ বনে ফিরে যেতে চাইলে শান্তাও তার সঙ্গে পতিব্রতা নারীর মত সঙ্গ দিতে চায়। সেক্ষেত্রে শান্তার সন্তান অঙ্গরাজ্যেই রয়ে যায় (অনুমান করা যায়), এবং ঋষ‍্যশৃঙ্গ-র পরের সন্তান (অনুমান করা যায়) শ্বশুরের বংশের দ্বীপ হয়ে জন্মলাভ করার কথা। পুত্রিকা হলো সেই কন্যা যার সন্তান তার মায়ের বংশের উত্তরাধিকারী হবে। অনেক ক্ষেত্রে সেই নারী ক্ষতিকারক হতে পারে যে বংশে তার বিয়ে হচ্ছে তাদের কাছে। মহাভারতে এই উদাহরণ প্রচুর আছে - চিত্রাঙ্গদা, সাবিত্রী, ইত্যাদি। যেমন চিত্রাঙ্গদা ছিলেন পুত্রিকা। অর্জুন তাকে বিয়ে করতে চাইলে চিত্রাঙ্গদার বাবা বলেন তার একমাত্র কন্যার পুত্র-ই এই বংশের রাজা হবে। অর্জুন সেটি জানা সত্ত্বেও তাকে বিবাহ করে। তাদের পুত্র হয় বভ্রুবাহন। এই বভ্রুবাহন কিন্তু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেনি। কিন্তু পরে বাবা আর ছেলের মধ্যে যুদ্ধ হয় (অনেকটা পারস্য কাব্যের শাহনামের সোহরাব ও রোস্তমের কাহিনীর মত) এবং সেখানে অর্জুন মারা যায়। আবার সে অলৌকিক ভাবে উলুপির (তার অন্য একটি পত্নী) কৃপায় বেঁচে হস্তিনাপুরে ফিরে আসে। সেখানে তার বিধবা পুত্রবধূ পরীক্ষিত নামে একটা সন্তানের জন্ম দেয় ও যুধিষ্ঠিরের পরে সেই বংশের রাজা হয়। কিন্তু যেসব ব্যক্তির অর্জুনের মত একাধিক পত্নী নেই এবং একটি মাত্র স্ত্রী-ই যদি পুত্রিকা হয়? তাই শান্তার বিষয়টি খুবই আকর্ষক। এটা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার যে শান্তা তার স্বামীর সঙ্গে বনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। রামায়ণে এরকম কোন ইঙ্গিত নেই। তেমনি মহাভারতের রামোপাখ্যান অংশে পুত্রেষ্টি যজ্ঞেরও উল্লেখ নেই।

তাহলে কী দাঁড়ালো?

রামায়ণের ভিন্ন রিসেন্সনে শান্তার জন্ম নিয়ে পাঠ্ভেদ আছে। প্রচলিত টেক্সট শুধু এটুকুই বলে দশরথ ও রোমপাদ ছিলেন ভালো বন্ধু, এবং শান্তা রোমপাদের কন্যা (১/৯/১৩ ও ১/১১/১৯)। যখন শান্তা অযোধ্যায় আসে ওর স্বামীর সাথে টেক্সট কিন্তু বলেনি যে সে তার বাপের বাড়ি ফিরে আসছে, বা শান্তার দিক থেকেও কোনো প্রতিক্রিয়া কবি জানায়নি, যেটা অস্বাভাবিক মনে হতে পারে। তেমনি টেক্সট এটাও বলে দশরথ অনপত্য (১/১১/৫) অর্থাৎ নিঃসন্তান ছিলেন। এমনকী নর্থ রিসেন্সনে শান্তাকে লোমপাদের কন্যাও বলা হয়েছে (গৌড়ীয় ১/৮/২৬; লাহোর এডিশন ১/৮/২৫)। মহাভারতে শান্তা লোমপাদেরই কন্যা এবং কবি জানাচ্ছেন না যে দশরথ তাঁর পুত্রীকে দান করেছিলেন (৩/১১০/৫; ১২/২২৬/৩৫ ও ১৩/১৩৭/২৫)। তেমনি হরিবংশ পুরাণ (১/৩১/৪৬), মৎস্য পুরাণ (৪৮/৯৫), বায়ু পুরাণ (১১/১০৩) এগুলিতে শান্তাকে লোমপাদের মেয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু অন্যদিকে দক্ষিণী পাঠের মধ্যেই সুমন্ত্রের কথায় আমরা ইঙ্গিত পাই (১/৯/১৯) যে শান্তা হয়তো দশরথের কন্যা ছিলেন। তেমনি (১/১১/২-৩) শ্লোক গুলি খুবই ইনটারেস্টিং।

ইক্ষাকূণাং কুলে জাতো ভবিষ্যতি সুধার্মিক:৷
রাজা দশরথো নাম্না শ্রীমান্সত্যপ্রতিশ্রব: II
অঙ্গরাজেন সখ্যং চ তস্য রাজ্ঞো ভবিষ্যতি৷
কন্যা চাস্য মহাভাগা শান্তা নাম ভবিষ্যতি ৷৷

ক্রিটিক্যাল এডিশন টেক্সট "অস্য" রেখেছে যেটা অঙ্গরাজকে ইঙ্গিত করে, কিন্তু দক্ষিণের প্রচুর পাণ্ডুলিপিতে এটি আছে "তস্য"। উত্তর ভারতের লিপিগুলোতে তো আছেই (ক্রিটিক্যাল এডিশন ফুটনোট - ১/১০/৩) তস্য, যেটা পরিষ্কার ইঙ্গিত করে শান্তা দশরথের কন্যা। নর্থ রিসেন্সনে ঠিক এই শ্লোকের পরে আমরা জানতে পারি কোন পরিস্থিতিতে রাজা দশরথ শান্তাকে দান করেছিলেন (পূর্বেই লিখেছি - ১/৯/৪-৫)।

এই সমস্যার মূল উৎপত্তি হয়তো অন্যত্র। হরিবংশ, মৎস, বায়ু ও ব্রহ্ম পুরাণে অঙ্গরাজার নাম চিত্ররথ। তার পুত্রের দুটি নাম - লোমপাদ ও দশরথ। এমনটি হয়তো হয়েছিল শান্তা প্রথমে অঙ্গের রাজা দশরথের কন্যা ছিল, কিন্তু ততদিনে অজের পুত্র দশরথ খুবই জনপ্রিয় রাজা হয়ে উঠেছেন। এবং তার পর থেকে শান্তা দশরথের কন্যা বলেই পরিচিতি লাভ করেছে। তেমনি বিষ্ণু পুরাণ (৪/১৪/১৪), ভাগবত পুরাণ (৯/২৩/৮), ভবভূতির উত্তররামচরিত, স্কন্দ পুরাণ, পদ্ম পুরাণের পাতালকান্ড, আনন্দ রামায়ণ (১/১/১৬-১৭), সরলা দাসের ওড়িয়া মহাভারতে শান্তা দশরথের কন্যা। ১৬-শতাব্দী বলরাম দাসের রামায়ণে আমরা প্রথম জানতে পারি শান্তা হলো কৌশল্যার মেয়ে। কৃত্তিবাস রামায়ণে (১/২৯) দশরথ তার কন্যাকে দান করেন লোমপাদকে। মেয়েটির নাম হেমলতা। অনুমান করতে অসুবিধা হয়না ইনিই শান্তা। চন্দ্রাবতীর রামায়ণে ও কাশ্মীরি রামায়ণে আমরা পাই কৈকেয়ীর একটি কন্যার কথা যে সীতাকে সহ্য করতে পারতো না। একই থিম আমরা পাই সুবর্চ রামায়ণে যেখানে সীতা শান্তাকে অভিশাপ দেয়। ইন্দোনেশিয়ার "হিকায়েত সেরি রাম" এ শান্তা হলো ভরত-শত্রুঘ্নর নিজের বোন। সিয়াম এর রাম-জাতকে শান্তার বিয়ে হয় রাবণের সঙ্গে। তেমনি প্রাচীন পালি টেক্সট দশরথ জাতকে সীতা রাজা দশরথের মেয়ে। ফলে দশরথের কন্যা ছিল এটা এনটিকুইটি সাক্ষ্য দেয় -- বাল্মীকি ও অন্যান্য রামকথায় আমরা পাই। তবে সব থেকে বিচিত্র কাহিনী পাওয়া যায় মাধবদাসের বিচিত্র রামায়ণে। ওখানে এক ঋষি রাজাকে অভিশাপ দেন ও বলেন সে নিঃসন্তান হবে। পরে আবার দেখা হলে ও রাজা ক্ষমা চাইলে, ঋষি অভিশাপ পাল্টে ফেলে বলেন তার প্রথম সন্তান একটি কন্যা হবে এবং তার বিয়ে হবে ঋষ‍্যশৃঙ্গের সঙ্গে। তারপর ঋষ‍্যশৃঙ্গ যজ্ঞ করলে তার চারটি সন্তান হবে। তারপর শান্তার বিবাহের বয়স উপস্থিত হয়ে স্বয়ম্বর আয়োজন করা হয়। সেখানে হঠাৎ উপস্থিত হন পরশুরাম। তিনিই বলেন শান্তার সঙ্গে ঋষ‍্যশৃঙ্গের বিবাহ দেওয়া হোক।


পাঠ্যসূচী

কৃতজ্ঞতা স্বীকার - যে দুজন ব্যক্তি আমাকে উপকার করেছেন এটি লিখতে, রবার্ট গোল্ডম্যান ও কনাদ সিংহ।

১) আকর সূত্র

পঞ্চানন তর্করত্ন - রামায়ণম
আর্য্যশাস্ত্র - বাল্মীকি রামায়ণ
রামায়ণ সারানুবাদ - রাজশেখর বসু
বাল্মীকি রামায়ণ ক্রিটিক্যাল এডিশন - Vol 1
রবার্ট গোল্ডম্যান - The Ramayana of Valmiki vol 1
ভগবৎ দত্ত - The Ramayana of Valmiki (North West Recension)
অমরেশ্বর ঠাকুর - বাল্মীকি রামায়ণম
এম এন দত্ত - দি মহাভারত (vol 2)
বিষ্ণু সুকথঙ্কর - ক্রিটিক্যাল এডিশন মহাভারত (আরণ্যক পর্ব)
জন স্মিথ - দি মহাভারত
রালফ গ্রিফিথ - The Ramayana of Valmiki
এম এন দত্ত - হরিবংশ
সাইমন ব্রডব্রেক - Krishna's lineage: The Harivamsa of Vyasa's Mahabharata
শান্তি লাল নগর - আনন্দ রামায়ণ

২) রামায়ণের টেক্সট গঠন

জন ব্রকিংটন - Rama the Steadfast: The Early form of Ramayana
হার্মান জেকবি - Das Ramayana
এল এ ভ্যান ডালেন - Valmiki's Sanskrit
রবার্ট গোল্ডম্যান - Vol 1 ভূমিকা
জি এস আলটেকর - Studies on Valmiki Ramayana

৩) পুত্রিকা

কনাদ সিংহ - From Dasrajana to Kurukshetra
সাইমন ব্রডবেক - Putrika interpretation of the Mahabharata
সাইমন ব্রডবেক - The Mahabharata Patriline

৪) ভিন্ন রামকথা

ভি রাঘবন - The Ramayana tradition in Asia
ভি রাঘবন - The Greater Ramayana (পুরাণ নিয়ে আলোচনা)
শ্রীনিবাস আইয়েঙ্গার - Asian variations in Ramayana
কামিল বুলকে - অনুবাদ প্রদীপ ভট্টাচার্য: The Rama Story - Origins and Growth
অভদেশ কুমার সিংহ - Ramayana through the ages
2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিরুদ্ধ গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in


 



         

চারপাশে গাছপালা ঘেরা একটি পুকুর। চাঁদনী রাতের আলোতে তার টলটলে জলে মায়াবী ঝিলিমিলি খেলা। পুকুরের ঘাটে বসে এক তরুণ আনমনে বাজিয়ে চলেছে বাঁশি। তার মূর্চ্ছনা পৌঁছে যায় এদিক সেদিক। পাশের একটি বাড়ির জানালায় এক কিশোরীর মুখ। বাঁশির সুর তাকে করেছে সম্মোহিত। পরদিন দুজনের দেখা। মেয়েটি বললো, “কাল রাতে আপনি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন ? আমি শুনেছি।“

যুবকটি গাছের ছায়ায় শীতলপাটিতে বসে দিনের পর দিন অবলীলায় রচনা করে কবিতা,অনায়াসে বেঁধে চলে কত গান। মেয়েটিকে শেখায় সে গান, গ্রামের অন্য ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরও। স্বল্পশিক্ষিতা গ্রাম্য তরুণীটি এমন প্রতিভা, এমন অনাবিল স্বতস্ফূর্ত সৃজনী আগে দেখেনি। তার চোখেমুখে বিস্ময়, মুগ্ধতা। আর তরুণটি অভিভূত ঐ ষোড়শী কন্যাটির অনন্যা রূপে। তার সৌন্দর্য্, সৌষ্ঠভ তরুণটির হৃদয়ে এনে দিলো এক অনাস্বাদিত আলোড়ন। জাগিয়ে তুললো সৃষ্টিসুখের উল্লাস।

আর এক দৃশ্য। মেয়েটি জ্বরাক্রান্ত। যুবকের মন ব্যাকুল। সে চায় তার পাশে বসে তার তপ্ত কপালে হাত বুলিয়ে দিতে। কিন্তু রীতিনীতির বাঁধা। অবশেষে সুযোগ হলো। অনেক বছর পরে লিখেছিলো,”বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তোমার শুভ্র ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল; তোমার তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজো অনুভব করতে পারি। তুমি কি চেয়ে দেখেছিলে ? আমার চোখে ছিল জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রীবিধাতার চরণে তোমার আরোগ্য লাভের জন্য করুণ মিনতি।“

এরা কালিদাসের কোন কাব্য, সেক্সপীয়রের কোন নাটক, বা শরৎচন্দ্রের কোন উপন্যাসের পাত্রপাত্রী হতে পারত অনায়াসে। কিন্তু এই চরিত্ররা কাল্পনিক নয়, নেহাতই বাস্তব। গ্রামটির নাম কুমিল্লা জেলার দৌলতপুর। তরুণীটির নাম সৈয়দা খাতুন। আর যুবকটি কাজী নজরুল ইসলাম।

নজরুলের বন্ধু কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছেন, একদিন নজরুল সৈয়দা খাতুনকে বললেন, “এমন ফুলের মত যার সৌন্দর্য, তার এ নাম কে রেখেছে ? আজ থেকে তোমার নাম নার্গিস।“ সেই থেকে তাঁর নাম হয়ে গেলো নার্গিস, পুরো নাম নার্গিস আসার খানম। পারস্যদেশের একটি গুল্মের অতি সুগন্ধী শ্বেতবর্ণা ফুলের ফারসি ভাষায় নাম নার্গিস।

প্রেমের এই আলোড়ন নজরুলের সৃজনীসত্বাকেও উদ্বেলিত করেছিল এক বিপুল আবেগে। দৌলতপুরে অবস্থানকালেই নজরুল প্রায় ১৬০টি গান ও ১২০টি কবিতা রচনা করেছিলেন। ‘পাপড়ি খোলা’, ‘অবেলায়’, ‘অনাদৃতা’, ‘বিদায় বেলায়’, ‘হারমানা হার’, ‘হারামণি’, ‘বেদনা অভিমান’, ‘বিধুরা’, ‘পথিক প্রিয়া’ ইত্যাদি কবিতা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এই পর্বের অনেক বছর পরেও একাধিক বিরহ-বেদনা-অভিমানের গান তিনি সৃষ্টি করেছেন, যা এই সময়ের প্রতিফলন বলে অনেকে মনে করেন।

হ্যাঁ, এই প্রেম পূর্ণতা পায়নি। এর ব্যাপ্তি ছিলো মাত্র আড়াই মাস, বা তারও কম। অথচ নজরুল-নার্গিসের বিবাহ অনুষ্ঠানও অতি সমারোহে আয়োজিত হয়েছিল। কিন্তু সেই অনুষ্ঠান থেকে কোন কারণে নজরুল নিজেকে প্রত্যাহৃত করেন। ঠিক কি ঘটেছিল তা নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। অনেক নজরুল গবেষক বা জীবনীকাররা অনেক কথাই লিখেছেন। ষড়যন্ত্র, প্রতারণা, অসততা ইত্যাদির উপাদান সম্বলিত বেশ কিছু কাহিনী প্রচলিত। সে সবের সত্যাসত্য নিয়েও মতভেদ আছে। কিন্তু এই প্রেমপর্বের যে ঘটনাক্রম নিয়ে দ্বিমত নেই, তাই প্রথমে বিবৃত করা যাক।

বিশ্বযুদ্ধের শেষে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পেয়ে নজরুল তখন কলকাতায়। ফজলুল হকের নবযুগ পত্রিকায় কিছুদিন সম্পাদনার কাজ করেছিলেন,তখন তাও নেই। এদিক ওদিক কিছু কিছু লেখা বেরিয়েছে কয়েকটি পত্রপত্রিকায়। তবে খ্যাতি-পরিচিতি তখনও তেমনভাবে আসেনি। তিনি তখন যুক্ত ছিলেন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে, থাকতেন ৩২ কলেজ স্ট্রীটে তাদেরই ভবনে। সেখানে মোহম্মদ মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওয়াদুদ, মহম্মদ শহীদুল্লাহ ইত্যাদি তখনকার তরুণ মুসলিম লেখকরা তাঁর বন্ধু ও সহকর্মী ছিলেন। সদা প্রাণোচ্ছল, হাস্যময় নজরুলের বান্ধববৃত্ত বিস্তৃতই ছিল।

এদেরই মধ্যে একজন ছিলেন আলী আকবর খান। তিনি নজরুলের থেকে বয়সে বেশ কিছুটা বড় ছিলেন। কলেজ স্ট্রীটেই দুজনের পরিচয়। আলী আকবর কিছু কিছু লেখালেখি করতেন, একটা নাটক ও কয়েকটি কবিতা লিখেছিলেন, কিন্তু তার মান বিশেষ উঁচু ছিল না। তিনি নিজেই সে সব ছাপিয়ে বিক্রী করার চেষ্টা করতেন। ঐ পাড়ায় তাঁর একটি প্রকাশনা ছিল, মূলত পাঠ্যপুস্তকের। অবশ্য নজরুলের সম্ভাবনাময় প্রতিভা চিনে নিতে তাঁর দেরী হয়নি।

এই আলী আকবর খান ছিলেন কুমিল্লার মুরাদনগর থানার দৌলতপুর গ্রামের এক সম্পন্ন ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য। গ্রামে বিষয়-সম্পত্তি তাঁদের কম ছিল না। তিনি বেশ কিছুদিন ধরে নজরুলকে তাঁদের গ্রামের বাড়ীতে যাবার আমন্ত্রণ করছিলেন। শেষে আলী আকবরের অগ্রজ নেজাবৎ আলীর মেয়ে আম্বিয়া খানম মানিকের বিবাহ উপলক্ষ করে নজরুল দৌলতপুর যেতে রাজি হন।

১৯২১ সালের ৩রা এপ্রিল নজরুল ও আলী আকবর রেলপথে যাত্রা করে পরদিন রাতে কুমিল্লা পৌঁছান। কুমিল্লা শহর থেকে দৌলতপুরের দূরত্ব আরও প্রায় ৪০ কিলোমিটার। সে সময়ে রাতের বেলায় অত দূর পাড়ি দেওয়া নিরাপদ ছিল না। কুমিল্লার কান্দিরপাড় এলাকায় আলী আকবরের এক স্কুলের সহপাঠী বন্ধু বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়ীতে দুজনে থাকা মনস্থ করেন। বাড়ীটি ছিল বীরেন্দ্রর বাবা ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের। তাঁর স্ত্রী এবং ইন্দ্রকুমারের মা’র নাম বিরজাসুন্দরী। এই পরিবারটি ছিল সুশিক্ষিত, সংস্কৃতিমনস্ক এবং উদারমনা। নজরুল-নার্গিস পর্বে এবং নজরুলের পরবর্তী জীবনেও বিরজাসুন্দরী ও তাঁর পরিবারের একটি বিশেষ ভুমিকা ছিল বলে মনে করা হয়। এক রাত মাত্র নয়, নজরুলরা এ বাড়ীতে আরও দু-চার দিন অতিবাহিত করেন। এই স্বল্প পরিসরেই নজরুল এই পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন, এবং বিরজাসুন্দরীকে ‘মা’ সম্বোধন করতেন।

কান্দিরপাড় ছেড়ে নজরুল ও আলী আকবর অবশেষে দৌলতপুরে পৌঁছোন। সেখানে আলী আকবরের পরিবার ও দৌলতপুরবাসীরা নজরুলকে অতি সমারোহে অভ্যর্থনা করেন বলে কথিত আছে।

বিয়ের আসর নজরুল মাতিয়ে দিয়েছিলেন গান গেয়ে আর তাঁর স্বভাবসিদ্ধ উচ্ছলতা দিয়ে। সেই বিয়েতে গান গেয়েছিল আরেকটি মেয়ে – আলী আকবরের ভাগ্নী সৈয়দা খাতুন। সেই প্রথম পরিচয়। দুই তরুণ মনের পারস্পরিক আকর্ষণের সুত্রপাত। সৈয়দা খাতুন আলী আকবরের বোন আসমাতুন্নিসার ছয় সন্তানের পঞ্চম। তাদের বাড়ী পাশেই ছিল। শৈশবেই অনাথা হওয়ায় মেয়েটি আলী আকবরের পরিবারের স্নেহ-দাক্ষিণ্য অর্জন করেছিল, তাদের বাড়ীতে অবাধ যাতায়াত ছিল। নজরুলের সঙ্গে পরিচয়ের পর সেই যাওয়া আসা আরও বেড়ে গেল। নজরুলের কোঁকরা বাবরি চুল, তীক্ষ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, স্বভাবের উষ্ণতা আর সাহিত্য-সঙ্গীতের প্রতিভা যে কোন তরুণীকে বশীভূত করার জন্য পর্যাপ্ত ছিল। আর নজরুল নিজে ? অগ্রজ বন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা সেই সময়ের এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “এক অচেনা পল্লীবালিকার কাছে এত বিব্রত ও অসাবধান হয়ে পড়েছি যা কোন নারীর কাছে হইনি।“

প্রথম পরিচয় থেকে পুরোদস্তুর প্রেম রূপায়িত হতে এক-দেড় মাসের বেশী সময় লাগেনি। এরই মধ্যে বদলে গেল মেয়েটির নাম, ভালবাসা উদযাপিত হতে লাগল নতুন নতুন গানে কবিতায়, অদম্য হয়ে উঠল দুজনে দুজনকে বেশী করে কাছে পাওয়ার আকুতি। এ সব দৃষ্টি এড়ালো না একজনের। তিনি মামা আলী আকবর খান। অনেকের মতে ঘটনাক্রমের এই বিবর্তনে তাঁর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল। অচিরেই তিনি দুজনের বিয়ের প্রস্তাব পেশ করলেন। শোনা যায় তখনকার ‘চালচুলোহীন’ নজরুলকে নিয়ে খান পরিবারে একটু আপত্তি ছিল। কিন্তু শিক্ষিত বিএ পাশ আলী আকবরের সিদ্ধান্ত শেষে সকলকেই মেনে নিতে হল। আর মিয়াঁ-বিবিকে রাজী করাতেও বেশী সময় লাগেনি। অতএব বিয়ের দিন ধার্য হল ১৭ই জুন ১৯২১ (৩রা আষাঢ় ১৩২৮)।

নজরুল নার্গিসের এই বিবাহানুষ্ঠান বেশ ধুমধাম করেই আয়োজিত হয়েছিল। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত সঙ্গীতবিশারদ ওস্তাদ আলাউদ্দিন।

খাঁ ও তাঁর ভাই ওস্তাদ আফতাবুদ্দিন ফকির যিনি সেই অনুষ্ঠানে বাঁশিও বাজিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আনা হয়েছিল ২০ জনের একটি গাইয়ে-বাজিয়ের গোষ্ঠি। স্থানীয় গণ্যমান্যদের মধ্যে বাঙ্গরার জমিদার রায়বাহাদুর রূপেন্দ্রলোচন মজুমদার, সেখানকার হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অবনীমোহন মজুমদার ইত্যাদিরা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নজরুলের কলকাতার বন্ধুবান্ধবরা কেউই গিয়ে উঠতে পারেননি। অবশ্য কান্দিরপাড়ের বিরজাসুন্দরী, তাঁর স্বামী ইন্দ্রকুমার ও পুত্র বীরেন্দ্রকুমার সহ সেই পরিবারের বেশ কয়েকজন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সমগ্র অনুষ্ঠানের জন্য নাকি ১৫০০০ টাকা খরচা হয়েছিল। আর,

দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাসভবন যেখানে নজরুল-নার্গিসের প্রেম প্রস্ফুঠিত হয়েছিল
      



এমনও শোনা যায় যে নার্গিসের জন্য দেনমোহর ধার্য্য হয়েছিল ২৫০০০ টাকা (মতান্তরে ২০০০০ টাকা)!

কিন্তু বিয়ের আকদ পর্বেই কাবিননামা নিয়ে শুরু হলো সমস্যা, বাঁধল বিরোধ। ঐস্লামিক বিবাহে কাবিননামা বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষের সম্মতিক্রমে নির্ধারিত একটি চুক্তিপত্র। এই কাবিননামায় একটি শর্ত ছিল এই যে, বিয়ের পর নার্গিসকে নিয়ে নজরুল কোথাও যেতে পারবেন না, তাঁদের দৌলতপুরেই থাকতে হবে। এই শর্তটি নিয়ে বিশেষ মতবৈষম্য কোন বিবরণীতে পাইনি। স্বাধীনচেতা, উচ্ছল বোহিমিয়ান স্বভাবের নজরুলের পক্ষে এই শর্ত মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাঁর কাছে এ ছিল তাঁকে ঘরজামাই করে রাখার প্রস্তাব। তিনি অসম্মতি জানালে শুরু হয় প্রবল বাকবিতন্ডা। বরপক্ষে নজরুল ছিলেন একা। অন্যপক্ষ থেকে বর্ষিত হয় নানা কটূক্তি। কিছু আমন্ত্রিত বয়স্কদের মধ্যস্থতায় আবহাওয়া সামান্য শান্ত হলেও নজরুল প্রচন্ড অপমানিত বোধ করেন এবং বিবাহ অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন।

কোন কোন গবেষকদের মতে নজরুল নার্গিসকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর সঙ্গে চলে যেতে, কিন্তু তরুণী নার্গিস এত বড় ফয়সালা করে উঠতে পারেননি। অগত্যা অসীম তিক্ততা নিয়ে ক্ষুব্ধচিত্ত নজরুল উপস্তিত হন বিরজাসুন্দরীর কাছে, এবং তাঁকে তাঁর সিদ্ধান্তের কথা জানান। সব শুনে বিরজাসুন্দরীর মনে হয়, সেই মুহুর্তে নজরুলের মনের যা অবস্থা, তাতে তাকে বিরত করা সম্ভব নয়। তখন ঘোর রাত, বাইরে ঝড়বৃষ্টি চলছে। বিরজাসুন্দরী তাঁকে অনুরোধ করেন বীরেন্দ্রকুমারকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। অতঃপর নজরুল ও বীরেন সেই বৃষ্টিবাদলার মধ্যে কর্দমাক্ত রাস্তা খেতখামার পায়ে হেঁটে পার করে কান্দিরপাড় পৌঁছলেন। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়ায় কয়েকদিন অতিবাহিত করার পর মুজফ্ফর আহমেদের অর্থসহায়তায় নজরুল কলকাতা ফেরৎ যান।

সেই যে গেলেন, আর কখনো দৌলতপুরে ফিরে যাননি। নার্গিসের সঙ্গে দেখা হওয়া তো দূরের কথা, তাঁকে লেখা নার্গিসের একাধিক চিঠির উত্তর পর্যন্ত দেননি। অথচ ব্যর্থ প্রেমের জ্বলনে দগ্ধ চিত্তে রচনা করেছেন কখনো ট্র্যাজিক, কখনো ক্ষুব্ধ বিদ্রোহী গান-কবিতা। বন্ধুকে লিখেছেন, “এই বন্ধন ছিন্ন করে দুঃখ পেয়েছি আমিই সব চেয়ে বেশি। আমার নিজের বুকই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে. হিয়ায় হিয়ায় আমার এক বীভৎস খুন-খারাবি . . খানখান খুন! কেমন এক বিদ্রোহ অভিমানে আমার দুচোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ছে। নাই নাই, এ বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা নিয়ন্তা কেউ নাই।“

দৌলতপুরে না গেলেও কুমিল্লায় কিন্তু নজরুল এর পরও গিয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। কখনো সাহিত্য সভায় যোগ দিতে, কখনো ইংরেজদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সভায় মিছিলে অংশ নিতে। তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন এই কুমিল্লাতেই। কিন্তু অন্য আরেকটি কারণও ছিল কুমিল্লা আসার। তা হল বীরেন্দ্রকুমারের বিধবা জ্যেঠিমা গিরিবালা দেবীর কন্যা আশালতা সেনগুপ্তা। কান্দিরপাড় থেকে বিরজাসুন্দরীর পরিবারের যে সদস্যরা নজরুল-নার্গিসের বিবাহ অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে এই আশালতাও ছিলেন। তখন তাঁর বয়স ১৩ বছর। প্রথম প্রেমের শোচনীয় পরিনতির পর নজরুল যখন কুমিল্লায় আসতে লাগলেন তখন আশালতার সঙ্গে ক্রমে ক্রমে পরিচয়, সখ্যতা পেরিয়ে পুনরায় ভালবাসার উদ্ভব হল, এবং পরিশেষে ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতায় তাঁদের অনাড়ম্বর বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিরজাসুন্দরী ও তাঁর পরিবার এই পরিণয়ের পক্ষে ছিলেন না, কিন্তু বিধবা গিরিবালার অত্যাশ্চর্য্য দৃঢ়তা এই আন্তরধর্মীয় বিবাহ সম্ভব করেছিল। বিয়ের পর নজরুল আশালতার নাম রাখেন প্রমীলা। প্রমীলাই আমৃত্যু নজরুলের জীবনসঙ্গিনী ছিলেন।

আর নার্গিস ? তিনি সুদীর্ঘ ১৭ বছর অপেক্ষা করেছিলেন। নজরুলকে গোটাচারেক চিঠি লিখেছিলেন। শেষ চিঠিটি ছাড়া আগেরগুলির কোন উত্তর নজরুল দেননি। নার্গিসের চিঠিগুলির বয়ান নজরে আসেনি। তবে শেষ চিঠিতে তিনি নাকি লিখেছিলেন যে প্রমীলাকে বিয়ে করার জন্য তাঁর কোন অনুযোগ নেই, কিন্তু একবার তিনি নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে চান। এমনকি আত্মহত্যার ইচ্ছাও নাকি প্রকাশ করেছিলেন। এর উত্তরে নজরুল একটি বিস্তারিত চিঠি লেখেন। এই গুরত্বপূর্ণ নথিটি কিন্তু সর্বত্র উপলব্ধ। তার থেকে সামান্য উদ্ধৃতি শুরুতে দিয়েছি, প্রয়োজন মত অন্য জায়গায় আবার উল্লেখ করা যাবে। নার্গিস অবশ্য আত্মহত্যার পথে যাননি। দীর্ঘ প্রতীক্ষা এবং দু-একটি ঘটনার পর তিনিও বিবাহসুত্রে আবদ্ধ হন, ১৯৩৮এর ১২ই ডিসেম্বর, আলী আকবর খানের ঢাকার গ্রন্থন ব্যবসায়ের সহযোগী সাহিত্যিক আজিজুল হাকিমের সাথে।

য়ৌবনে নজরুল
                   



বিবরণীর এই পর্যায়ে আলোচনায় আসি বিবিধ বিতর্কিত বাদ-প্রতিবাদের বিষয়গুলিতে।

নজরুলের গুণগ্রাহীরা তাঁর প্রেমের এই কঠিন বেদনাসম্পৃক্ত পরিণতির জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী করেছেন আলী আকবর খানকে। এঁদের মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোঘ্য নজরুলের অভিভাবকস্থানীয় সুহৃদ কমরেড মুজফ্ফর আহমেদের স্মৃতিচারণা ‘কাজী নজরুল ইসলাম: স্মৃতিকথা’। তিনি সরাসরি আরোপ করেছেন, ‘আলী আকবর খান দাম্ভিক, মিথ্যাভাষী ও শঠ’। স্বপক্ষের অভিমত পোষণকারীরা বলেন, আলী আকবর খানের হাবভাব এবং কোন কোন ক্রিয়াকলাপ নজরুলের কলকাতার বন্ধুরা মোটেই ভাল চোখে দেখতেন না। তাঁর সঙ্গে দৌলতপুর যাওয়া থেকে বিরত করার জন্য নজরুলকে বন্ধুরা উপদেশ দিয়েছিলেন। মুজফ্ফর আহমেদের ভাষায় তিনি স্পষ্টতই কবিকে বলেছিলেন, ‘কি মতলবে তিনি তোমায় তাঁদের বাড়ী নিয়ে যেতে চান তা কেউ জানেন না। তিনি তোমাকে একটা বিপদেও ফেলতে পারেন।‘ সরলমতি কবিকে কিন্তু নিরস্ত করা যায়নি। এঁদের মতে, আলী আকবরের অভিসন্ধি ছিল নজরুলের বিরল প্রতিভাকে নিজের প্রকাশনা ব্যবসার একচেটিয়া স্বত্বাধীন করা, এবং সেই উদ্দেশ্যেই পারিবারিক আবদ্ধতার চক্রান্ত ও কাবিননামার ওই শর্ত রচিত হয়েছিল। এই যুক্তির সমর্থনে তৎকালীন দৌলতপুরবাসী মুন্সি আবদুল জব্বারের জবানি উল্লেখযোগ্য: “অন্যদিকে আলী আকবর খান বড় বোন নার্গিসের মাকে যেয়ে বলেছেন, ভাগিনীকে আমরা বিবাহ দিব। .......আমাদের বাড়ীর একটি মেয়েও এই পাত্রের পছন্দ হয় নাই। তোমার মেয়েকে পাত্র পছন্দ করেছে। বর্তমানে যে কোন উপায়ে এই কাজীকে আটকিয়ে রাখতেই হবে। এই কাজী নজরুল ইসলাম পৃথিবী বিখ্যাত এক দার্শনিক কবি হইবে। .....তাহার নমুনা আমরা পাইয়াছি। তাহাকে হাতছাড়া করা যায় না। ......তাহাকে আটকাইয়া রাখিলে ভবিষ্যতের জন্য একটা পথ আবিষ্কার হইতে পারে, তাহাতে সারা জীবনে সুখ থাকিতে পারিবে।“

নজরুল তাঁর বিবাহের সিদ্ধান্ত পত্রযোগে কলকাতার কয়েক বন্ধুদের জানিয়েছিলেন। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর প্রথম চিঠিতে (৫ই জুন ১৯২১) এই সিদ্ধান্তের সঠিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে লিখেছিলেন, “.... তোর বয়েস আমাদের চাইতে ঢের কম, অভিজ্ঞতাও তদনুরূপ, feeling-এর দিকটা অসম্ভব রকম বেশী। কাজেই ভয় হয় যে হয়ত বা দুটো জীবনই ব্যর্থ হয়। ....... যৌবনের চাঞ্চল্যে আপাতঃ মধুর মনে হলেও ভবিষ্যতে না পস্তাতে হয়।” এর উত্তরে নজরুল নার্গিস সম্বন্ধে তাঁর যে অসহায় মনোভাবের কথা ব্যক্ত করেছিলেন তা আগেই বলেছি। অগত্যা পবিত্রবাবু তাঁর দ্বিতীয় চিঠিতে (২৫শে জ্যৈষ্ঠ ১৩২৮) নজরুলের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েও শেষে লিখেছিলেন, “তুই যে এরূপ একটা আজগুবি কান্ড বাঁধিয়ে বসবি, তা সকলে আমরা জানতুম।“ তাঁর কলকাতার বন্ধুরা যে অকস্মাৎ বিয়ের ফয়সালায় বিশেষ সন্তুষ্ট ছিলেন না, তা বুঝতে পেরে নজরুল তাঁর আর এক সুহৃদ সাহিত্যিক ও সম্পাদক মোহম্মদ ওয়াজেদ আলীকে একটি পত্রে সম্ভবত কিঞ্চিত দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। তার উত্তরে ওয়াজেদ আলী লেখেন (১৩ই জুন ১৯২১), “আমার বোধ হয় আপনার বন্ধুরা অসন্তুষ্ট হয়েছেন একটা কারণে। আপনি ‘নারায়ণে’ ‘দহন-মালা’ লিখে নারীর কাছে ক্ষমা চাইলেন; তার পরই এত সত্বর প্রেমের ফাঁদে ধরা পড়লেন। ‘যৌবনের জোয়ার’ বড় সাংঘাতিক; তাকে ঠেলে রাখা বড় দায় – এ আমি স্বীকার করছি।“

স্বপক্ষীয়রা বলেন, বিবাহ অনুষ্ঠানে নজরুলের বিস্ফোরণ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, এর প্ররোচনা কিছু দিন ধরে ক্রমাগত দানা বাঁধছিল। আলী আকবর ও তাঁর পরিবারের কোন কোন কথায় আচরণে নজরুল বিরক্ত হয়েছিলেন, এমন কি অপমানিতও বোধ করেছিলেন। কিন্তু নার্গিসের প্রতি সেই সময়ে তাঁর সুগভীর অনুভুতি তাঁকে সহ্যশীল থাকতে বাধ্য করে। শোনা যায়, নার্গিসের আগে আলী আকবর তাঁর এক ভাইঝি হেনার সঙ্গে নজরুলের বিয়ের প্রস্তাব রেখেছিলেন। নজরুল রাজী হননি। কিন্তু হেনা বা নার্গিস, কারোর সঙ্গেই নজরুলের বিয়েতে অধিক অমত ছিল আলী আকবরের পরিজনদেরই। তাঁরা এই অদ্ভুত স্বভাবের ছন্নছাড়া নিঃসম্পদ ছেলেটিকে ঘরের জামাই করা মেনে নিতে পারেননি, এবং প্রায়শই নজরুলের সামনেই তাঁদের এ অভিমত প্রকাশ হয়ে পড়ত। নজরুল স্বাভাবিক ভাবেই ব্যথা পেয়েছিলেন। কুমিল্লার সাপ্তাহিক লালমাই পত্রিকার ১লা জুন ১৯৬৯ সংখ্যায় অধ্যাপক বদরুল হাসান লিখেছেন, “.....নজরুলের বাঁধনহারা ভাব তাঁর পরিবারের গুরুজনদের চোখে তাচ্ছিল্যের কারণ ছিল। সম্প্রতি নেজামত আলী খান (আলী আকবরের বড় ভাই) একথা অকপটেই স্বীকার করেছেন।” কিন্তু আগেই বলেছি, শিক্ষিত আলী আকবরের জেদের কাছে তাঁদের নতিস্বীকার করতে হয়। আলী আকবর খান তাঁর সম্বন্ধে নজরুলের কলকাতার বন্ধুদের মনোভাব ভালোই জানতেন। তাই বিয়ে ঠিক হবার পর নাকি তাঁদের চিঠিপত্র নজরুলের হাতে দিতেন না, এবং নজরুলের লেখা চিঠিগুলিও ডাকে তাঁদের কাছে পাঠাতেন না। অনেক বছর পরে নার্গিসের স্বামী আজিজুল হাকিমের উদ্যোগে সে সব চিঠি প্রকাশিত হয়। স্বপক্ষের লোকেরা এমনও বলেন যে বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্রও আলী আকবর কলকাতার ঠিকানাগুলিতে ইচ্ছাকৃতভাবেই দেরী করে পাঠান যাতে সেখান থেকে কেউ বিয়ের অনুষ্ঠানে পৌঁছতে না পারেন। অন্য একটি ব্যাপারও নজরুলের কাছে বিসদৃশ লেগেছিল। বিয়ের দিন যখন পাকা, তখন থেকে নার্গিসকে তাঁর মামা নিজের বাড়ীতে এনে রাখেন এবং স্বল্পশিক্ষিতা মেয়েকে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই নজরুলের উপযুক্ত করে তোলার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। তিনি শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের ও অন্য বিশ্বসাহিত্য থেকে বেছে বিভন্ন নারীচরিত্রের কাহিনী, শহুরে আদবকায়দা ইত্যাদি নার্গিসকে সারাদিন ধরে শেখানো-পড়ানোর ঝোঁক ধরে বসলেন। নজরুল তো নার্গিসকে সেইভাবেই ভাল বেসেছিলেন যেমনভাবে তিনি তাঁকে দেখেছিলেন, পেয়েছিলেন। তাঁর কাছে এ সব নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়েছিল।

কিন্তু এই সব মতের বিপক্ষেও কিছু দৃষ্টিকোণ সময়ের সাথে সাথে প্রকাশ পেয়েছে।

একটি ধারণা এমন আছে যে প্রমীলার সঙ্গে নজরুলের বিবাহ অনেকেই ভালো ভাবে নিতে পারেননি। তাঁকে ধর্মান্তরিত না করে বিয়ে করা, এবং বিয়ের পর শাঁখা সিঁদুর উপাসনা ইত্যাদি আচারাদি পালনের অনুমতি দেওয়া মুসলমান সম্প্রদায়ের একাংশকে ক্ষুব্ধ করেছিল। উল্টোদিকে ব্রাহ্ম সমাজের মেয়ের আন্তর্ধমীয় বিবাহ নিয়ে ব্রাহ্ম ও হিন্দু সমাজের অনেক মাতব্বরও রূষ্ট হয়েছিলেন। তবে নজরুল-নার্গিস পর্বের নজরুল-স্বপক্ষের মতগুলিকে খন্ডন করতে মাত্র এঁরাই যে সচেষ্ট হয়েছিলেন, তা নয়। দু’পক্ষেরই দৃষ্টিকোণের সমর্থন বা অন্যথায় স্বতন্ত্র গবেষকরাও আছেন।

বিপক্ষীয়রা বলেন মুজফ্ফর আহমেদের বৃত্তান্ত আলী আকবর খানের প্রতি তাঁর নেতিবাচক পক্ষপাতের ফসল। ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার এক ঈদ সংখ্যায় ‘নার্গিস’ নামে একটি উপন্যাসের লেখক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর মত: “নজরুলের বই প্রকাশ করে রাতারাতি ধনী হওয়ার পরিকল্পনা আলী আকবরের মনে আসবে কেন ? বই বিক্রী করে প্রচুর অর্থ উপার্জন কি নজরুলের জীবনে আদৌ ঘটেছিল ? তাঁর পেছনে প্রকাশকেরা সারি বেঁধে অপেক্ষা করতেন, এমন তথ্যও তো ইতিহাস ঘেঁটে পাওয়া যায় না। বরং এক-দুই শ টাকার বিনিময়ে বইয়ের স্বত্ব বিক্রী করার জন্য নজরুল দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, এই নির্মম বাস্তবতাই তো বিভিন্ন জীবনী গ্রন্থ থেকে পাই।“ এই বিপক্ষীয়দের মত, নজরুল ও নার্গিসের বৈবাহিক জীবনে আর্থিক সুরক্ষা এবং মাথার ওপর আচ্ছাদন সুনিশ্চিত করতেই আলী আকবর মোটা রকমের দেনমোহর ও কাবিননামার ঐ শর্ত প্রস্তাব করেন। সুলতান মাহমুদ মজুমদার দাবী করেন, নার্গিসের সাথে তাঁর একবার সাক্ষাত হয়েছিল, এবং সেই সাক্ষাতের বিবরণী তিনি ‘কবিপ্রিয়ার সান্নিধ্যে কিছুক্ষণ’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন (‘সাপ্তাহিক আমোদ’, ১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৭)। সেখানে, এমন ছিল নার্গিসের জবানী: “আমাকে সে নিয়ে যেত কোথায় ? চুরুলিয়ার বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না। থাকতো পরের আস্তানায়। তখনও লেখায় তেমন পয়সা পেতো না। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে খরচ দিতে হতো অন্যের......। কুমিল্লায় আসার সময় মামার অতিথি হিসাবে আমার মামাই খরচ দিয়েছিলেন। এই লোক বউ নিয়ে তুলতো কোথায় ? খাওয়াতো কি ? ......আমাদের সামাজিক মান সম্ভ্রম ও আমার মনের দিকটা একবারও কি সে ভেবে দেখেছে ? .....ঘরছাড়া এক পথিক যুবাকে বর করে নিলাম। তাই আমি দোষী, আর সে বুক ফুলিয়ে সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে লিখছে কবিতা, আর আমি জ্বলছি দুঃখ দহনে। স্ত্রী পুত্র নিয়ে সে হাসে, আমি চোখের জলে ভাসি।“ বিপক্ষগোষ্ঠী বরং নজরুলের দৌলতপুর থেকে পবিত্রবাবুকে লেখা চিঠি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখাতে চান যে তিনি কেবল নার্গিসের রূপগুণেই বিভোর হয়েছিলেন এমন নয়, সে পরিবারের দৌলতও তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। নার্গিসের বর্ণনায় কবি লিখেছিলেন: “চিরজনমের হারানো গৃহলক্ষী, প্রিয়া..... তার বাইরের ঐশ্বর্যও যথেষ্ট।” নার্গিসকে সারাদিন আলী আকবরের প্রশিক্ষণের প্রসঙ্গে বিপক্ষের অভিমত, নজরুলের ভাবাবেগ তখন এতই প্রবল যে তিনি সর্বদাই প্রিয়ার সঙ্গসুখ চাইতেন, যা তখন সমাজের চোখে দৃষ্টিকটু ছিল, এবং নার্গিসকে দূরে রাখার জন্যই আলী আকবরের এই ছিল পদ্ধতি। অধ্যাপক মিলন দত্ত তাঁর ‘প্রথম প্রেম ও নার্গিস বেগম’ প্রবন্ধে বলেছেন, “আলী আকবর খান নার্গিসকে ..... নজরুলের সঙ্গে মেশার সুযোগ না দেওয়ার ইচ্ছায় অধিকাংশ সময় নিজের কাছেই রাখতেন, বিয়ের পূর্বে তাঁদের মেলামেশা নিয়ে সমাজের নানা আলোচনা চলছিলো। মানুষের মুখও তো তাঁকে বাঁচিয়ে চলতে হবে। কিন্তু এ অবস্থা নজরুলের অসহনীয় ছিল - ......”। বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র দেরীতে বিয়ের অনুষ্ঠানের পর কলকাতার বন্ধুদের কাছে পৌঁছনোর কারণ হিসেবে বিপক্ষবাদীদের যুক্তি, তখন রেলপথ ও জলপথ পরিবহন কর্মীদের ধর্মঘট চলার জন্যই এমন হয়েছিল।

নজরুল-নার্গিস উপাখ্যানের যে মাত্র দু-তিনটি নথি জনসমক্ষে পাওয়া যায়, এই নিমন্ত্রণ পত্রটি তার মধ্যে বিশেষ কৌতুহলোদ্দীপক। কলকাতার বন্ধুদের কাছে যথাসময়ে না পৌঁছলেও সে পত্র ‘মোহম্মদী’ পত্রিকার সম্পাদক মোহম্মদ ওয়াজেদ আলীর হাতে যে করেই হোক পৌঁছয়, এবং তিনি তাঁর পত্রিকায় তা অবিলম্বে ছাপিয়ে দেন। ‘অপূর্ব নিমন্ত্রণ পত্র’ শিরোনামে তা ‘বাঙালী’ পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়। এই দীর্ঘ পত্রটি শুরু হয় রবীন্দ্রনাথের গান ‘জগতের পুরোহিত তুমি’র প্রথম দু’ ছত্র দিয়ে। পাত্রের পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছিল এই ভাবে: “বর্ধমান জেলার ইতিহাস প্রখ্যাত চুরুলিয়া গ্রামের দেশ বিখ্যাত পরম পুরুষ, আভিজাত্য গৌরবে পরম গৌরবান্বিত, আয়মাদার, মরহুম মৌলবী কাজী ফকির আহমদ সাহেবের দেশ বিশ্রুত পুত্র মুসলিম কুলগৌরব মুসলিম বঙ্গের ‘রবি’ কবি সৈনিক নবযুগের ভূতপূর্ব সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলাম.........বাণীর দুলাল দামাল ছেলে, বাংলার এই তরুণ সৈনিক কবি ও প্রতিভাবান্বিত লেখকের নতুন করে নাম বা পরিচয় দেবার দরকার নেই।“ এমনও প্রচারিত হয় যে এর বয়ান নাকি স্বয়ং নজরুলের ‘মুসাবিদা’ করা।

পত্রিকায় প্রকাশিত এই নিমন্ত্রণ পত্র কলকাতার বন্ধুদের গোচরে অবশ্যই আসে। কেউ কেউ নজরুলকে চিঠিতে অভিনন্দন ও শুভকামনা জানালেও, অনেকেই তার ভাষ্য নিয়ে অখুশী ছিলেন। নজরুলের ঐ বর্ণনা, বিশেষ করে ‘মুসলিম বঙ্গের রবি’ উপাধি (যা তাঁকে রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ দাবী করার তরলমতি প্রয়াস বলে অনেকে মনে করেন), এবং পত্রিকায় এমন নিমন্ত্রণ প্রকাশের ঔদ্ধত্য অনেকের কাছেই অসমর্থনীয় ছিল। মুজফ্ফর আমেদ (২৬শে জুন ১৯২১) এক ‘অত্যন্ত গোপনীয়’ চিঠিতে নজরুলকে স্পষ্টতই তাঁর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে লিখেছিলেন: “পত্রখানা আপনারই মুসাবিদা করা দেখিলাম। পত্রের ভাষা দু’এক জায়গায় বড় অসংযত হইয়াছে। একটু যেন কেমন দাম্ভিকতা প্রকাশ পাইয়াছে। আপনার হাত দিয়া অমন লেখা বাহির হওয়া কিছুতেই ঠিক হয় নাই। আমার বড় ভয় হইতেছে যে, খান সাহেবের সংস্রবে থাকিয়া আপনিও না শেষে দাম্ভিক হইয়া পড়েন। অন্যে বড় বলিলে গৌরবের কথা হয়, আর নিজেকে নিজে বড় বলিলে অগৌরবের মাত্রাই বাড়িয়া যায়। ‘মোহম্মদী’কে বিবাহের কথা ছাপিতে অনুরোধ করাটা ঠিক হইয়াছে কি ? তাঁরা ত নিজ হইতেই ও খবর ছাপিতে পারিতেন। .... বাস্তবিক আমার প্রাণে বড় লাগিয়াছে বলিয়া আমি এত কথা বলিলাম। এই নিমন্ত্রণ পত্র আবার ‘অপূর্ব নিমন্ত্রণ পত্র’ শিরোনামে ‘বাঙালী’তে মুদ্রিত হইয়াছে, দেখিলাম। ‘বাঙালী’কে এই নিমমন্ত্রণ পত্র কে পাঠাইল ?”

এ চিঠি যখন লেখা হল, ততদিনে অবশ্য গোমতি দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। নজরুল দৌলতপুর ছেড়েছেন, এবং সন্পূর্ণ তথ্য বোধহয় তখনও মুজফ্ফর আহমেদের অজানা। এর কিছুদিন পরে, সাপ্তাহিক ‘বিজলী’র ২২শে জুলাই সংখ্যায় ‘কবিবরের প্রতিবাদ’ শিরোনামে নজরুলের লেখা একটি চিঠি ছাপা হয়। ঢাকার বাংলা একাডেমী সম্পাদিত ‘নজরুল-রচনাবলী’র টীকায় বলা হয়েছে, “এই চিঠিটি নজরুল-নার্গিস বিবাহ সংক্রান্ত প্রতিবাদলিপি। নজরুল-বিবাহে আলী আকবর খান যে নিমন্ত্রণ-পত্র ছাপান, নজরুল-বন্ধুরা ধারনা করেছিল সেটা নজরুলের মুসাবিদায় ছাপা হয়। নজরুল ইসলাম তার প্রতিবাদ করেন।“ নজরুলের বিবৃতি ছিল: “প্রথমেই বলে রাখি, আমার এই ‘কবি-বরে’র অর্থ ‘কবি-শ্রেষ্ঠ’ নয়, এ ‘কবি-বরের’ মানে – ‘যে কবি বিয়ের বর’। কারণ, দিন কতক আগে আমি বাস্তবিকই – অন্তত ঘন্টা কয়েকের জন্যে ‘বর’ সেজেছিলুম, যদিও বরের এখনো বধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ নেই। যাক সে কথা, আমার ঐ ‘ত্রিশঙ্কু বিয়েতে’ শ্বশুরকুলের কর্তৃপক্ষগণ এক কাব্যিক নিমন্ত্রণপত্র ছাপিয়েছিলেন এবং সেটি চরমে গিয়ে পৌঁছেছে এই জন্যে যে, সেটা আবার আমার সাহিত্যিক ও কবি বন্ধুবর্গকে পাঠানো হয়েছে। সেটা একপ্রকার জামাই বিজ্ঞাপন বললেও হয়। ওতে আমার নামের আগে ও পিছনে এত লেজুড় লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, কোনো চতুষ্পদ জীবেরই অতগুলো ল্যাজ থাকে না।“

নজরুল-নার্গিসের বিবাহ কি সম্পূর্ণ হয়েছিল ?

এই প্রশ্নের উত্তরেও মতান্তর আছে। নজরুলের উপরোক্ত ‘প্রতিবাদ’ পড়লে দেখা যাবে যে, নিমন্ত্রণপত্র তাঁরই রচনা, এ কেবল সে কথারই খন্ডন নয়। মূলত বিয়ের সামগ্রিকতাকেই যেন তিনি অস্বীকার করেছেন। বিয়ের অসম্পূর্ণতার ইঙ্গিত দিয়ে যে ‘ত্রিশঙ্কু বিয়ে’ শব্দ তিনি ব্যবহার করলেন, তা আবার বিরজাসুন্দরী দেবীর একটি রচনায়ও পাওয়া যায়। প্রায় বছরখানেক পরে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’র শ্রাবণ ১৩২৯ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘নৌকাপথে’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে দৌলতপুর যাত্রা ও ঐ বিবাহ অনুষ্ঠানের বর্ণনা প্রসঙ্গে বিরজাসুন্দরী লিখেছিলেন, “বিয়ে তো ত্রিশঙ্কুর মত ঝুলতে লাগলো মধ্য পথেই, এখন আমাদের বিদায়ের পালা .....।“ স্বপক্ষীয়রা বলেন, যেহেতু বিরজাসুন্দরী স্বয়ং অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, তাই তাঁর সাক্ষ্য প্রমাণ করে যে বিবাহ পর্ব সম্পন্ন হয়নি।

মুজফ্ফর আহমেদ মুসলিম বিবাহ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, তা আধ্যাত্মিক নয়, মূলত হবু স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একধরণের চুক্তি যার কিছু শর্ত থাকে। এই বিয়েতেও শর্ত ছিল, এবং নজরুল তা অনুমোদন করতে অস্বীকার করেন। তাছাড়া বিয়ের পরে সহবাস না হলে বিয়ে পরিপূর্ণতা লাভ করে না। নজরুল বাসর রাত্রিও যাপন করেননি। মুজফ্ফরের মতে, “কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে যে সৈয়দা খাতুন ওর্ফে নার্গিস বেগমের বিয়ে (আকদ) হয়নি এ সম্বন্ধে আমি স্থির নিশ্চিত হয়েছি।“

কিন্তু বিপক্ষীয়রা বলেন, বিরজাসুন্দরীর প্রবন্ধ নজরুলেরই সম্পাদিত, তাতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া যায় না। তাঁরা বরং একটি চিঠির উপস্থাপনা করেছেন। এটি ‘বিয়ে’র কিছুদিন পরে নজরুল কান্দিরপাড়ে অবস্থানকালীন আলী আকবর খানকে লিখেছিলেন বলে দাবী করা হয়। এটিতে তিনি আলী আকবরকে ‘বাবাশ্বশুর’ সম্বোধনে শুরু করে লিখেছেন, “আপনাদের এ অসুর জামাই পশুর মত ব্যবহার ক’রে এসে যা কসুর করেছে, তা ক্ষমা করো সকলে, অবশ্য যদি আমার ক্ষমা চাওয়ার অধিকার থাকে।........আমার মান-অপমান সম্বন্ধে কান্ডজ্ঞান ছিল না বা ‘কেয়ার’ করিনি ব’লে, আমি কখনো এতবড় অপমান সহ্য করিনি, যাতে আমার ‘ম্যানলিনেসে’ বা পৌরুষে গিয়ে বাজে-যাতে আমাকে কেউ কাপুরুষ বা হীন ভাবতে পারে। আমি সাধ ক’রে পথের ভিখারী সেজেছি বলে’ লোকের পদাঘাত সইবার মতন ‘ক্ষুদ্রআত্মা’ অমানুষ হয়ে যাইনি।.....বাবা, আমি মানুষের উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। দোওয়া করবেন, আমার এ ভুল যেন দুদিনেই ভেঙে যায়, এ অভিমান যেন চোখের জলে ভেসে যায়।..... বাকী উৎসবের জন্য যত শীগগীর পারি বন্দোবস্ত করব।.......চির সত্য, স্নেহ সিক্ত, নুরু।“ বিপক্ষের মত, চিঠিতে আলী আকবরকে বাবাশ্বশুর বা বাবা এবং নিজেকে জামাই সম্বোধন, এবং পুরো চিঠির ভাষা ও বিষয়বস্তু প্রমাণ করে যে নজরুল মেনে নিয়েছিলেন তিনি বিবাহিত, নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত এবং তাঁর অভিমান যে ভুল সে কথা স্বীকার করতে প্রস্তুত। কিন্তু স্বপক্ষীয় গোষ্ঠী ঠিক এই কারণেই এ চিঠির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। যিনি বড়জোড় ‘মামাশ্বশুর’ হতে পারতেন, তাঁকে ‘বাবাশ্বশুর’ বা ‘বাবা’ সম্বোধন কতটা গ্রহণযোগ্য ? চিঠির সম্বোধনা বা ভাষ্য, কোনটাই নজরুলের প্রকৃতিগত স্বাভাবিক ভাষা নয় বলে তাঁদের দাবী। তা ছাড়া আরও একটি অসঙ্গতিও ছিল। এই চিঠি কবে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে তা জানা যায় না। মুজফ্ফর আহমেদ যখন এ চিঠি দেখেন, তখন তার তারিখ ছিল ২৩ জুলাই ১৯২১, আর স্থান উল্লেখিত ছিল কান্দিরপাড়। কিন্তু ঐ তারিখে নজরুল ছিলেন কলকাতায়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত চিঠিতে তারিখ দেখা যায় ২৩শে জুন। মূল চিঠি কোথাও পাওয়া গেছে বলে জানা যায়নি। স্বপক্ষীয়রা আরও বলেন, যদি ধরেও নেওয়া হয় যে এই চিঠি নজরুলেরই লেখা, তবে তার শেষভাগের বাক্য প্রমাণ করে যে বিবাহের কিছু উৎসব ‘বাকী’ ছিল, অর্থাৎ বিবাহ অসম্পূর্ণ ছিল।

ঐ চিঠি যদি নজরুলেরই লেখা হয়, তা হলেও তিনি সম্ভবত ‘শীগগীর’ কোন ‘বন্দোবস্ত’ করেননি। ফলত আলী আকবর সে বছর সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় এসে উপস্থিত হ’ন। তালতলা লেনের বাসায় নজরুলের সঙ্গে দেখা করেন। সেখানে মুজফ্ফর আহমেদও থাকতেন। তাঁর জবানীতে, “নজরুলের স্বভাব ছিল যে নূতন কেউ এলে চেঁচিয়ে আনন্দ প্রকাশ ক’রে সে তাকে গ্রহণ করত।.....সেদিন আলী আকবর খান আসাতে নজরুল কোন উচ্ছাস প্রকাশ তো করলই না, একবার বসতেও বলল না তাকে। শক্ত হয়ে চুপ ক’রে বসে থাকল সে। ..... খান সাহেব নিজেই নজরুলের পাশে তখৎপোশের ওপর বসলেন। তাঁর হাতে বেশ পুরু একতাড়া দশ টাকার নোট ছিল। খুব নীচু আওয়াজে কথা বলছিলেন তিনি, আর নোটের তাড়াটি নাড়ছিলেন-চাড়ছিলেন। অকারণে নাড়াচাড়ার মত দেখালেও আসলে ভাবখানা ছিল এই যে এই নোটের তাড়াটি তোমারই জন্যে।“ এই বিবরণীর সমর্থন বিরজাসুন্দরী দেবীকে লেখা নজরুলের একটি চিঠিতেও পাওয়া যায়, যেখানে তিনি লিখেছেন, “মা, আলী আকবর খান আমাকে নোটের তাড়া দেখিয়ে গেল।“ শেষমেষ নজরুলের কী প্রতক্রিয়া ছিল তা স্পষ্ট নয়, তবে মোটামুটি ধরা যায়, খান সাহেব যদি কোন একটা মীমাংসার অভিপ্রায়ে এই সাক্ষাতে উদ্যোগী হয়ে থাকেন, তবে তা ফলপ্রসু হয়নি।

দিন কাটতে লাগল। বছর গড়িয়ে গেল। নজরুল ‘বিদ্রোহী’ লিখে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন, ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশিত হল, তাঁর সম্পাদনায় ‘ধূমকেতু’র আবির্ভাব হ’ল। অচিরেই রাজদ্রোহের অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হলেন, জেলে অনশন করলেন, কিছু মাস পরে মুক্তিও পেলেন। কবি, সঙ্গীতকার, বিদ্রোহী হিসেবে তাঁর খ্যাতি প্রসারিত হ’ল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘বসন্ত’ নাটক উৎসর্গ করলেন। প্রমীলা এলেন জীবনে। এক সন্তানের মৃত্যু, আরও দুই পুত্রের জন্ম হল। নজরুল গ্র্যামোফোন কোম্পানীতে গীতিকার-সুরকার হয়ে চাকরী করতে লাগলেন।

একদিন যখন তিনি এচ এম ভির স্টুডিওয় বসে কাজ করছেন, বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁকে একটি চিঠি এনে দিলেন। নার্গিসের লেখা। আগেও এসেছে তাঁর চিঠি, নজরুল উত্তর দেননি। এবারও চিঠি পড়ে শৈলজানন্দকে ফিরিয়ে দিলেন। শৈলজানন্দ বললেন, একটা উত্তর তো দিতে হবে। নজরুল অবিলম্বে লিখে দিলেন একটি গান, “যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পারো নাই, কেন মনে রাখো তা’রে”। বললেন, এটাই তাঁর উত্তর।

এই গানটির রচনাকাল স্পষ্ট নয়। আগেই বলেছি, নার্গিস মোট চারটি চিঠি লিখেছিলেন, সুদীর্ঘ ষোল বছরে। নজরুল উত্তর দিয়েছিলেন মাত্র একটি, ১লা জুলাই ১৯৩৭ তারিখে। সে পত্রটিতেও স্থানের উল্লেখে আছে ১০৬ আপার চিতপুর রোড, গ্রামাফোন রিহার্সাল রুম, কলকাতা। তাই অনুমান করা যায়, ঐ গানটিও এই একই সময়ে রচিত। অর্থাৎ, কেবল গান নয়, একটি পত্রও অবশেষে নার্গিস পেয়েছিলেন নজরুলের কাছ থেকে। চিঠির শেষের দিকে লিখেছিলেন, “তোমাকে লেখা এই আমার প্রথম ও শেষ ছিঠি হোক।“ এই চিঠির ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পেয়েছে আবেগ, অভিমান, অনুযোগ, আবার আশ্বাসও। কিছু নির্বাচিত উদ্ধৃতিমাত্র দিলাম:

“তুমি বিশ্বাস করো, আমি যা লিখছি তা সত্য। লোকের মুখের শোনা কথা দিয়ে যদি আমার মূর্তির কল্পনা ক’রে থাকো, তা হলে আমায় ভুল বুঝবে – আর তা মিথ্যা।

“তোমার উপর আমি কোন জিঘাংসা পোষণ করি না – এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা। কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি - তা দিয়ে তোমায় কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না – আমি ‘ধূমকেতু’র বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। .......ভুলে যেও না আমি কবি – আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। ..... আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কি জান বা শুনেছ, জানি না) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবীও নেই।

“আমি কখনো কোন ‘দূত’ প্রেরণ করিনি তোমার কাছে। আমাদের মাঝে যে অসীম ব্যবধানের সৃষ্টি হয়েছে, তার ‘সেতু’ কোন লোক ত’ নয়ই – স্বয়ং বিধাতাও হতে পারেন কিনা সন্দেহ। ..... আমি যদিও গ্রামোফোনের ট্রেড মার্ক ‘কুকুরের’ সেবা করছি, তবুও কোন কুকুর লেলিয়ে দিই নাই। তোমাদেরই ঢাকার কুকুর একবার আমাকে কামড়েছিল আমার অসাবধানতায়, কিন্তু শক্তি থাকতেও আমি তার প্রতিশোধ গ্রহণ করিনি-তাদের প্রতি আঘাত করিনি।

“সেই কুকুরদের ভয়ে ঢাকায় যেতে আমার সাহসের অভাবের উল্লেখ করেছ, এতে হাসি পেল। তুমি জান, ছেলেরা (যুবকেরা) আমায় কত ভালবাসে। আমারই অনুরোধে আমার ভক্তরা তাদের ক্ষমা করেছিল। নৈলে তাদের চিহ্ন-ও থাকত না এ পৃথিবীতে। .... তুমি রূপবতী বিত্তশালিনী, গুণবতী, কাজেই তোমার উমেদার অনেক জুটবে – তুমি যদি স্বেচ্ছায় স্বয়ম্বরা হও, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। আমি কোন্ অধিকারে তোমায় বারণ করব-বা আদেশ দিব ? .....

“তোমার আজিকার রূপ কি, জানি না। আমি জানি তোমার সেই কিশোরী মূর্তিকে, যাকে দেবীমূর্তির মত আমার হৃদয়বেদীতে অনন্ত প্রেম অনন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। সেদিনের তুমি সে বেদী গ্রহণ করলে না। পাষাণ-দেবীর মতই তুমি বেছে নিলে বেদনার বেদী-পীঠ। ....

“দেখা ? নাই হ’ল এ ধুলির ধরায়। .... তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালবাস, আমাকে চাও, ওখান থেকেই আমাকে পাবে। .... আত্মহত্যা মহাপাপ, এ অতি পুরাতন কথা হলেও পরম সত্য। আত্মা অবিনশ্বর, আত্মাকে কেউ হত্যা করতে পারে না। প্রেমের সোনার কাঠির স্পর্শ যদি পেয়ে থাক, তা হলে তোমার মত ভাগ্যবতী কে আছে ? .....

“...... তুমি সুখী হও, শান্তি পাও – এই প্রার্থনা। আমায় যত মন্দ বলে বিশ্বাস কর, আমি তত মন্দ নই – এই আমার শেষ কৈফিয়ৎ।“

চিঠি শেষ করেও আবার একটি PS. দিয়ে লিখেছেন, “আমার ‘চক্রবাক’ নামক কবিতা-পুস্তকের কবিতাগুলো পড়েছ ? তোমার বহু অভিযোগের উত্তর পাবে তাতে। তোমার কোনো পুস্তকে আমার সম্বন্ধে কটূক্তি ছিল।”

ঐ সময় নার্গিস ঢাকায় থাকতেন। তাঁর চিঠির বয়ান তো উপলব্দ্ধ নয়। তবে নজরুলের উত্তর থেকে তার কিছুটা আন্দাজ হয়তো করা যায়। নজরুল তাঁকে নিজের সম্বন্ধে ‘লোকের কথায়’ বিশ্বাস না করতে বলেছেন। বলেছেন আপোষের জন্য কোন বার্তাবাহক তিনি পাঠাননি। একদা তিনি নার্গিসকে ‘দেবীমূর্তি’তে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও নার্গিস স্বেচ্ছায় সেদিন ‘পাষাণ-দেবী’ হয়েছিলেন, এমন অনুযোগ করেও বলছেন সে বেদনার আগুনে তিনিই দগ্দ্ধ হয়েছেন, এবং সেই দহন থেকেই তাঁর বিদ্রোহী সৃজনী সম্ভব হয়েছে। বর্তমানে নার্গিসের প্রতি তাঁর কোন ‘জিঘাংসা’ নেই। ‘আত্মহত্যা’র বিশ্লেষণও আছে যার উল্লেখ আগে করেছি। ‘চক্রবাক’ পুস্তকে যে অভিযোগের উত্তরের কথা কবি বলেছেন, তা সম্ভবত তাঁর ‘হিংসাতুর’ কবিতাটিকে নির্দেশ করে।

এই পত্রালাপের মধ্যে একটি ‘ঢাকার কুকুরের’ প্রসঙ্গও এসেছে। এর সম্বন্ধে একটি ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়। ১৯২৮ সালে ঢাকার রাস্তায় একদিন রাতের অন্ধকারে নজরুল তাঁর কিছু অনুরাগীদের সঙ্গে পথ চলার সময় কয়েকজন দুর্বৃত্ত দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর প্রাক্তন ক্যাপ্টেন নজরুলের বাহুবলের কাছে আক্রমণকারীরা অচিরেই পরাস্ত হয়ে পলায়ন করে। খুব সম্ভবত এই কান্ডেরই ইঙ্গিত এসেছে চিঠিতে। এখানে ‘তোমাদেরই ঢাকার কুকুর’ এই বর্ণনা লক্ষণীয়। নজরুল স্বপক্ষবর্গের অনেকেরই বিশ্বাস, ঐ আক্রমণের পিছনে আলী আকবর খানের ভূমিকা ছিল, যদিও তার সমর্থনে কোন সাক্ষ্যপ্রমাণ আছে বলে জানা নেই।

কিন্তু নার্গিস ও তাঁর পরিবারের কাছে চিঠিটির সব থেকে গুরত্বপূর্ণ বাক্য অবশ্যই: “তুমি যদি স্বেচ্ছায় স্বয়ম্বরা হও, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। আমি কোন্ অধিকারে তোমায় বারণ করব-বা আদেশ দিব ?” যদিও নজরুল ইন্সটিটিউট পত্রিকার পঞ্চদশ সংকলনে ‘কুমিল্লায় নজরুল-নার্গিস প্রসঙ্গ’ শীর্ষক নিবন্ধে শান্তিরঞ্জন ভৌমিক লিখেছেন যে বিয়ের অনুষ্ঠানের সে রাতের পর দুজনের “জীবনে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হয়নি”, কিন্তু অন্য কতিপয় বিবরণীতে আবার পাওয়া যায় যে নজরুলের ঐ চিঠি পাওয়ার পর সে বছরেই ৪ঠা নভেম্বর কলকাতায় এসে নার্গিস তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। দুই মামাতো ভাইকে নিয়ে নার্গিস শিয়ালদদহের কোন হোটেলে এই সাক্ষাৎ করেন বলে তাঁরই জবানীতে দাবী করা হয়েছে। তিনি নজরুলকে নাকি অনুরোধ করেন, তাঁকে প্রথমা স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে, কিন্তু ‘অপ্রস্তুত’ নজরুলের মত ছিল তা প্রমীলার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, এবং নার্গিসের ফিরে যাওয়া উচিত। তিনি এও নাকি আশ্বাস দিয়েছিলেন যে শীঘ্র ঢাকায় গিয়ে তিনি কোন ব্যবস্থা করবেন, কিন্তু তা তিনি করেননি। কোন কোন ভাষ্যে অবশ্য বলা হয়েছে যে ঐ সাক্ষাৎকারের সময়েই দুজনের ‘তালাক’ পর্ব সম্পন্ন হয়। আবার অন্য কয়েকটি বিবরণে পাওয়া যায় যে, নজরুল-নার্গিসের ‘তালাকনামা’ কলকাতায় সাক্ষীদের উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১৯৩৭এর ডিসেম্বরে (ডঃ রফিকুল ইসলাম: নজরুল জীবনী, ১৯৭২), অথবা অন্যমতে, পরের বছর অর্থাৎ ১৯৩৮এর ২০শে এপ্রিল (এ.এফ.এম মাহবুবুর রহমান, দৈনিক জনকণ্ঠ, ২০২৩), এবং সেখানে নার্গিস উপস্থিত ছিলেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। অর্থাৎ, এই বিষয়ে হয়ত কিছু ধুসর এলাকা আছে।

স্বপক্ষীয়রা বলেন, যখন বিয়েই সম্পন্ন হয়নি, তখন তালাকের প্রশ্নই আসে না। বিয়ে হয়নি বলেই নজরুল চিঠিতে নার্গিসকে লিখেছিলেন যে তাঁর প্রতি কোন অধিকার নেই এবং তিনি স্বয়ম্বরা হলে আপত্তি নেই। যদি বিয়ে হয়েই থাকত, তবে নার্গিস ও আলী আকবরের পরিবার এত দীর্ঘ অপেক্ষার পরিসরে বিচ্ছেদের ও আর্থিক দাবীর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারতেন, যা তাঁরা করেননি। যদি ‘তালাক’ও হত, তবে নার্গিসের প্রাপ্য ‘মাহর’ নজরুল তাঁকে দিয়েছিলেন, এমন প্রমাণ বা সাক্ষ্য কোথাও পাওয়া যায় না। তবে এমন ‘তালাক’ কি করে সিদ্ধ হয় ? সর্বোপরি, বিরজাসুন্দরীর বর্ণনায় ‘ত্রিশঙ্কু বিয়ে’, এবং নজরুলের নিজের ভাষ্য ‘বর সেজেছিলুম’ প্রমাণ করে যে এই তথাকথিত বিয়ে তাঁরা স্বীকার করেননি।

বিপক্ষীয়রা বলেন, ঐ বিবাহ সিভিল ম্যারেজ ছিল না, কারণ আইনত নার্গিস তখন নাবালিকা ছিলেন। তাই আইনানুগ উপায়ে বিচ্ছেদ সম্ভব ছিল না। বিয়ে ছিল কাজীর পড়ানো ঐস্লামিক পদ্ধতিগত (যদিও এই মতও স্বপক্ষ মানেন না, আগেই উল্লেখ করেছি)। সেই জন্যই তালাকনামার প্রয়োজন ছিল। তাঁরা এও বলেন, নার্গিস ও নজরুল, দুজনেই দুজনকে ভাল বেসেছিলেন, সাময়িক ভুল বোঝাবুঝি দূর করে নার্গিস যন্ত্রণা সহ্য করেও একটা মীমাংসা করতে বহুকাল অপেক্ষা করেছিলেন। তা ছাড়া সেই সময়ে সামাজিক সম্মানেরও একটা গন্ডী ছিল। তাই নজরুলের চিঠির পর যখন তাঁরা বুঝলেন যে করণীয় আর কিছুই নেই, তখন তালাকই শেষ উপায় ছিল। নজরুলের প্রতি নার্গিসের অনুরাগবশতই এবং নজরুলের আর্থিক অবস্থা বিবেচনা করে তাঁরা দেনমোহর বা মাহর পরিত্যাগ করেন।

কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ স্পষ্টতই বলেছেন বিয়ে হয়নি। নজরুল জীবনীকার রফিকুল ইসলামও মোটামুটি এই বক্তব্য সমর্থন করেছেন। অন্যদিকে বেগম সামসুন্নাহার, মো. ওয়াজেদ আলী, আব্দুল কাদির প্রভৃতির লিখন ইঙ্গিত করে যে বিয়ে হয়েছিল। কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ দস্তাবেজ, যেমন নার্গিসের চিঠিগুলি, কাবিননামা বা স্বাক্ষরিত তালাকনামার মূল লিপিগুলির বা কোন অনুলিপির কোন হদিস পাওয়া যায়নি, যা হয়তো এই বিষয়ে আলোকপাত করতে পারত। বিষয়টি তাই বিতর্কিতই রয়ে গেছে।

সুদীর্ঘ ১৭ বছরের অপেক্ষার শেষে, কিছু মাস পরে, ১৯৩৮এর সম্ভবত ১২ই ডিসেম্বর ঢাকায় নার্গিস বিবাহসুত্রে আবদ্ধ হন আজিজুল হাকিমের সাথে। আলী আকবর খান তখন ঢাকায় তাঁর পুস্তক প্রকাশনা ও বিক্রীর ব্যবসা করতেন। আজিজুল হাকিম তাঁর সহযোগী হিসেবে কাজ করলেও নিজ প্রতিভাগুণে একজন কবি, অনুবাদক ও সম্পাদক ছিলেন। তিনি আবার নজরুলের অত্যন্ত গুণগ্রাহীই শুধু ছিলেন না, তাঁর পরিচিত ও স্নেহধন্যও ছিলেন। নার্গিসের এই পরিণয় উপলক্ষে ১৯৩৮এর ১লা ডিসেম্বর নজরুল তাঁকে আরেকটি সংক্ষিপ্ত পত্রে লিখেছিলেন, “তোমাকে পেয়েও হারালাম। তাই মরণে পাবো – সেই বিশ্বাস ও সান্ত্বনা নিয়ে বেঁচে থাকব। প্রেমের ভুবনে তুমি বিজয়িনী, আমি পরাজিত। আমি আজ অসহায়। বিশ্বাস করো -আমি প্রতারণা করিনি। আমাদের মাঝে যারা এ দূরত্বের সৃষ্টি করেছে, পরলোকেও তারা মুক্তি পাবে না।“ সঙ্গে একটি কবিতাও ছিল: ‘তোমার প্রিয় যদি পাশে রয় / মোরও প্রিয় সে করিও না ভয় / কহিব তারে, আমার প্রিয়ারে আমারো অধিক ভালবাসিও।‘

এই বিচিত্র প্রেমপর্ব আর তার পরের সুদূরবিস্তৃত বিরহ-বেদনা নজরুল-সৃষ্ট কাব্যে ও সঙ্গীতে গভীর প্রভাব রেখে গেছে, তা বহু বিশ্লেষিত। শান্তিরঞ্জন ভৌমিকের ভাষায়, “নজরুলের কবিতায় ও গানে নানা অনুষঙ্গে নার্গিস তাঁর সৃষ্টিশীলতায় সবসময় জাগ্রত ছিল। নজরুলের সৃষ্টিশীল রচনায় পূর্ণতার ক্ষেত্রে পরোক্ষে নার্গিসের অবদান অসীম।“ এ বিষয়ে আলোচনায় গেলে একটি ভিন্ন নিবন্ধ হতে পারে।

কাজী নজরুল ইসলাম সুবিখ্যাত। কিন্তু সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস আসার খানমের লোকপরিচিতি সীমায়িত। তবে তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিও সৃজনীতে পরবর্তী সময়ে প্রমাণ করেছিলেন যে তিনিও এক বহু গুণসম্পন্না রমণী ছিলেন। নজরুলের সঙ্গে পরিচয়ের সময়ে তিনি ছিলেন অল্পশিক্ষিতা, হয়তো নিজ সিদ্ধান্তে দ্বিধাগ্রস্তা। সতেরো বছরের নিদারুণ সময় তিনি যে স্থৈর্য ও আত্মস্থতায় অতিবাহিত করেছিলেন, তা নিঃসন্দেহে উল্লেখনীয়। সময়ের কঠিনতাকে অতিক্রম করে তিনি নিজেকে উন্নততর করার প্রয়াস করেছিলেন। স্বেচ্ছায় ঘরে বসেই তিনি পড়াশোনায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৩৫ সালে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন, এবং ১৯৩৭ সালে ইডেন গার্লস কলেজ থেকে আই এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ইতিমধ্যে আলী আকবর খান তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। সেখানে বাংলাবাজার এলাকায় একটি বাড়ী নির্মাণ করে তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়। নার্গিস মামার পুস্তক ব্যবসাও পরিচালনা করতে শুরু করেন, সম্ভবত সে সময়ের একমাত্র সফল মহিলা ব্যবসায়ী।

নার্গিস সাহিত্য রচনায়ও লেখনী ধরেছিলেন। তাঁর বেশ কয়েকটি উপন্যাস, ধর্মীয় গ্রন্থ এবং কবিতা ও গান রসিক পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছে। বিচ্ছেদের বেদনা, জ্বালা ও হয়তো কিছুটা তিক্ততা তাঁর রচনাকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর উপন্যাস ‘তাহমিনা’য় তিনি বর্ণনা

  পরিনত বয়সে নার্গিস



করেছেন বীর রুস্তমের স্ত্রী তাহমিনার একাকীত্ব ও দুরূহ সংগ্রামের কথা, যাকে নিঃসঙ্গ করে তার স্বামী যুদ্ধ করতে চলে যায়। প্রচলিত ধারণা এই যে এই উপন্যাসটিই নজরুলকে ‘হিঁংসাতুর’ কবিতা রচনায় প্ররোচিত করেছিল। তেমনি ‘ধূমকেতু’ উপন্যাসে নার্গিস লিখেছেন কোন নারীর শান্ত, নিস্তরঙ্গ জীবনে কেমন করে ধূমকেতুর মত এক পুরুষের অযাচিত আবির্ভাব ও প্রস্থান সব কিছু ছাড়খার করে দিয়ে চলে যায়। ‘পথের হাওয়া’র নায়কের চরিত্রেও বোহেমিয়ান স্বভাবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে। ১৯৮০ সালে নার্গিস যমুনা সাহিত্য গোষ্ঠী প্রদত্ত ‘বিদ্যাবিনোদিনী’ সম্মাননা লাভ করেন।

নার্গিসের সংস্পর্শে এসেছেন এমন কয়েকজনের বিবরণীতে, এবং তাঁর দেওয়া কতিপয় সাক্ষাৎকারে, এই নারীর স্বভাব ও চরিত্রের বিবিধ দিক উন্মোচিত হয়েছে। এই বিষয়ে মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া রচিত ‘কবিপ্রিয়া নার্গিস: তোমাকে যেমন দেখেছি’ (অভিনন্দন, ১৯৯৬) প্রবন্ধ থেকে কিছু উধৃতি এখানে প্রাসঙ্গিক: “যখনই তাঁর সান্নিধ্যে যেতাম, তখনই আমার মনে হতো: আমি এক যন্ত্রণাদগ্ধ মহিয়সী নারী এবং ইতিহাসের কিংবদন্তী নায়িকার মুখোমুখি। নার্গিস যেভাবে এবং যে সকল বিষয়ে আলোচনা করতেন, আমি বিশ্বাস করি: সমকালে কোনো মুসলিম মহিলার সাথে তাঁর তুলনা হয় না। রূপের রাণী নার্গিস অতিথিপরায়ণা, রুচিশীল, পরিচ্ছন্নপ্রিয়তা, স্বল্পভাষিণী ছিলেন। তাঁর হাসি ছিলো মধুর, মুগ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না।......নিজের হাতে রান্না করতেন, নামাজ পড়তেন এবং তিনি অবিশ্বাস্য রকম দায়িত্বশীল ছিলেন। স্বামীর প্রতি তিনি অত্যন্ত দায়িত্বশীল ছিলেন।.....নার্গিস প্রায় নিয়মিত নজরুলসংগীত শুনতেন। বিশেষ করে, নজরুলের বিরহদীর্ণ প্রেমাশ্রয়ী সংগীতমালা শুনে তাঁকে আমি নিরবে কাঁদতেও দেখেছি। নিজে ছিলেন সুকণ্ঠি । শৈশবে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানও গাইতেন, সে কথা নিজেই বলেছেন আমাকে।“

আজিজুল হাকিম ও নার্গিসের দুই সন্তান – পুত্র ডঃ ফিরোজ আজাদ ছিলেন ম্যানচেস্টারে চিকিৎসক, এবং কন্যা ডঃ শাহনারা অক্সফোর্ডে বাস করতেন। ১৯৬২ সালে আজিজুল হাকিমের মৃত্যু হয়। ১৯৭১ সালের প্রারম্ভে নার্গিস ম্যানচেস্টারে ছেলের কাছে চলে যান। সেখানেই ১৯৮৫ সালে ৮১ বছর বয়সে তাঁর দেহাবসান হয়, এবং নজরুল-প্রিয়াকে সমাধিস্থ করা হয়।