প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সব্যসাচী মজুমদার
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধজাদু বাস্তবের প্রসঙ্গে
তত্ত্ববিশ্বের জায়মানতার ওপর নির্ভর না করেও বা তত্ত্ব বিশ্বকে কোনওভাবে না জেনেও আমরা বাংলা কবিতায় কী সেই জাদুকে খুঁজে পাই না,যার প্রকোপে আমাদের জটিল অ্যালিস একটি ওয়ান্ডারল্যান্ড খুঁজে পেতে পারে!এমন একটা ভূখণ্ড যেখানে আপনার সর্বৈব স্বাধীনতা ঘটতে পারে।অবশ্যই এক্ষেত্রে বিনির্মাণের স্বাধীনতার কথা বলতে চাইছি।
দৃশ্যের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে দৃশ্য।যাদের সঙ্গে আপনার জায়মান বাস্তবের দৃশ্য সম্পর্ক ক্রমশ সুদূরবর্তী হয়ে উঠছে । কিন্তু আপনি সে দৃশ্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারছেন আপনার গহিনতম পরিস্থিতিকে। আপনার অবলোকিতের ভেতর গড়ে উঠছে আপনারই অবয়ব।
সে যাই হোক, বাংলা কবিতা পড়ার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে যখন জাদু এবং বাস্তবতার কথা উঠলই ,একবার দেখে নেওয়া যাক সাহিত্য ক্ষেত্রে জাদু বাস্তবতা কীরকম স্বভাব যাপন করতে পারে,
" Magical realism portrays fantastical events in an otherwise realistic tone. It brings fables, folk tales, and myths into contemporary social relevance. Fantasy traits given to characters, such as levitation, telepathy, and telekinesis, help to encompass modern political realities that can be phantasmagorical.(The Concise Oxford Dictionary of Literary Terms (3rd ed.). Oxford University Press. 2008)
বস্তুতপক্ষে এই উদ্ধৃতিটি কিন্তু তাত্ত্বিক জাদু চেতনা বিশ্বের বহু বিস্তৃত দিক তুলে ধরে। আমরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করতে পারছি অতীত থেকে লোকযান, ইতিহাস থেকে জনবিশ্বাস পর্যন্ত বিস্তার নিয়েছে এই কৌশল। এবং,সমস্তটাই ঘটেছে সমসাময়িকের প্রেক্ষিতে।যদিও 'সমসাময়িক' কথাটা বোধহয় একটু টীকা চায়। 'সমসাময়িক' বলতে বোঝাতে চাইছি ,একটি অদূর অতীতকে।যে সময়টুকুতে বাঁচছি,তার সঙ্গে সংলগ্ন একটি মোটামুটি করে বিগত একশো বছরকে 'সমসাময়িক' বলতে চাইছি। এবং এই কথাটিও মেনে নিতে হচ্ছে যে আমার জায়মানতা আংশিক নিয়ন্ত্রিত হয় একটি অদূর অতীতের প্রভাবে। এটা আলোচনার জন্য একটা সীমা প্রস্তত করে নেওয়া মাত্র। কেননা,এই সময়পার্বিক বিনির্মাণের প্রশ্নে একটি বিরাট আংকিক প্রসঙ্গ তৈরি হয়।তার বিস্তার এতটাই বিশাল যে সেখানে 'ভ্রমি বিস্ময়ে '-র আয়াসে নিয়োজিত না হয়ে এই সীমা নির্ধারণ করে নেওয়া জরুরি। তাছাড়া উদ্ধৃতিটিতে 'morden political realities ' কে জরুরি প্রচ্ছন্ন উপাদান বলেও মনে করা হচ্ছে।কাজেই সময়টাকে নির্দিষ্ট করা জরুরি।
একই সঙ্গে কিন্তু মার্কেসের ১৯৮২ সালে নোবেল বক্তৃতার একটি অংশকে মনে করতে চাইছি, *১যেখানে তিনি বলতে চাইছেন এই 'বিশাল বাস্তবতা'কে লাতিন আমেরিকার বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব নয়। সেই সূত্রে কী এই বিশ্বাসে স্থিত হতে পারি না কী,যে, মানচিত্র সাপেক্ষে বদলে যেতে পারে জাদু বাস্তবতার উপাদান ও ভঙ্গিমা এমনকি উপস্থাপনও!তাকে আর পূর্ব পরিচিত জাদু বাস্তবতার মতো মনে নাও হতে পারে।
এই ধারণাকে উদাহরণ দেওয়ার জন্য চেষ্টা করব বাংলা কবিতার যে ক'জন কবি এই কাজটি সম্পন্ন করেছেন, তাঁদের কয়েজনের কবিতা পড়ে দেখতে।
শরৎ মেঘ ও কাশফুলের কবি
_______________________________
মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা বিচিত্র পরিবহনে উতরোল।প্রভূত আলোচনা তাঁর কবিতা সম্পর্কে ইতিপূর্বে রচিত হয়েছে।প্রাজ্ঞ সে সব আলোচনা মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতাকে পাঠকের কাছে যথাযথ উপস্থাপন করেওছে। তবুও এই রচনার প্রয়োজনের কৈফিয়তে বলা যায়,এটা একান্তই জনৈক পাঠকের অভিজ্ঞতা মাত্র।যে অভিজ্ঞতা থেকেই মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতায় তন্ত্র কতটা স্থান দখল করেছে সে সন্দেহও উদ্গত হয়।
'শরৎমেঘ ও কাশফুলের বন্ধু 'প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে।সময় হিসেবে এই দশকটি আমাদের দেশের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।আমরা যদি মনে করি, এই তথ্য আমাদের কাছে অপরিচিত হবে না যে,বিগত শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক চিন্তা মার্ক্সিজম তখন গোটা পৃথিবীর কাছে, বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বের কাছে প্রশ্ন ও সন্দেহের মুখে।নব্বইয়ের গ্লাসনস্ত এবং পেরেস্ত্রৈকার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। মোটামুটিভাবে স্বপ্নভঙ্গ ঘটছে ও স্বপ্নের স্বরূপটি তখন উদ্ভাসিত হচ্ছিল,সেই সময়ের ভারতীয়…বলা ভালো, বাঙালি মনন কিন্তু তার রাজনৈতিক নিস্তার চাইল মার্কসের চিন্তার ওপরেই। এবং গড়ে তুলতে চাইল একটি কাল্পনিক যৌথখামারকে।সেই রাজনৈতিক আয়াস কতটা সাফল্য পায়,সে বিষয়ে এ আলোচনা অগ্রসর না হয়ে বরং নব্বইয়ের মানচিত্রে লক্ষ্য রাখতে চাইছে।মানে,সে সময়ের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মানচিত্রের ওপর। দেখা যাচ্ছে,
১.মুক্ত বিশ্ব ধারণা কেবল টিভির মাধ্যমে ওতপ্রোত হয়ে উঠছে।
২.বাংলা দেশের কবিতার কাছে কম্পিউটার ও আন্তর্জাল একটি নতুন অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখা দিচ্ছে,পশ্চিবঙ্গের বাঙালিরা কী করা উচিত - এ তর্কে বিভ্রান্ত।
৩.যোগাযোগ স্হাপন সুবিধাজনক হয়ে উঠতে শুরু করল, আর, তথ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি তথ্য সরবরাহের আগ্রাসনও দেখা দিতে লাগল।
মোট কথা,আশির দশকের পর থেকেই সময় দ্রুত বদলাতে শুরু করল। এবং প্রশ্ন করার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ তৈরি হতে শুরু করল। তখন পাঠকের কাছে কেবল মার্ক্স আর ফ্রয়েডই নয়,আরও বেশ কিছু নাম পরিচিত হতে শুরু করেছে।
এইরকম একটা উচ্চাবচতাময় সময়ে মণীন্দ্র গুপ্ত প্রশ্ন তুলছেন,
"পশু থেকে যোদ্ধা,যোদ্ধা থেকে মহাপুরুষ হতে
তারাদের ক'কোটি বছর লেগেছে -"(তিব্বতী)
আবার একই সঙ্গে সংশয়মান অনুভব করছে,
"যেন ঘন কুয়াশার মধ্যে চিমনি পরানো লণ্ঠনের আলো নিয়ে
কেউ পথ খুঁজছে।(তিব্বতী)
কেন তাকে পথ খুঁজতে হচ্ছে সেই নব্বইয়েও?কেন সে নিশ্চিন্ত ' লাল টুকটুকে দিন '-এর দিকে নিঃশংসয় এগোতে পারছে না? কেন 'ঘন কুয়াশা ' হয়ে রয়েছে তখনও?
- এ সব প্রশ্নের মুখোমুখি থেকে নিস্তার পেতে পরবর্তী কবিতার কাছে গেলেই সেও কিন্তু এমনই একটি সমাধানহীন প্রশ্নের উথ্থাপন করছে যে, বস্তুত এই পাঠকের বারবার মনে পড়ছে আশির শেষ থেকে নব্বইয়ের প্রথম প্রহরের উত্তেজনাময়, উদভ্রান্ত সময়ের ছবিটাই…
"গা থেকে রঙিন পালক,বাড়তি পালক ঝেড়ে ফেলি
কেননা আমি-যে উঁচুতে যাব সেখানে এখনও কোনও পাখি ওড়েনি,
শরীরের সব কাঁটা আর শল্ক উপড়ে ফেলি
কেননা আমাকে এক চুলচেরা ফাটলের ফাঁক দিয়ে এমন এক দেশে যেতে হবে
যেখানে কোনও সরীসৃপ পৌঁছয়নি।"(শরৎমেঘ ও কাশফুলের বন্ধু)
আরও আরও বেশি করে খোঁজ হতে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে।তাঁরা স্বপ্নের ভেঙে যাওয়াটিকে স্বীকার করে নিয়ে যেভাবে নতুন জটিলতাকে, নতুন বহকৌণিক বেঁচে থাকার পদ্ধতিকে ভেবে ওঠার চেষ্টা করছিলেন,সেই অনুরণন কী নব্বইয়ের প্রারম্ভেই মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতায় উপস্থাপিত হয়েছিল নাকী!সেই সময়ের নতুন বাংলা কবিতা যখন ব্যালাড নির্ভর শরীর প্রেম, আঞ্চলিক দীনতার লড়াই,দেশ বিভাগের স্মৃতি, নারী স্বাধীনতা, ঐতিহ্য ও তাকে বিনির্মাণ, শ্লেষ আর আরবান হয়ে ওঠার ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠতে চাইছিল, ঠিক সেই সময়েই এই বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির দিকে নজর ফিরিয়ে মণীন্দ্র গুপ্ত লিখে ফেলতে চাইছেন লিঙ্গ নিরপেক্ষ আগামী পৃথিবীর দৃষ্টি বিক্ষেপ।
অন্ততঃ এখনও বাংলা কবিতার প্রেক্ষিতে দেখা যায়,যা কিছু দৃশ্য সব কিছুই নির্মীত হয়েছে মানুষের চোখ থেকে দেখেই।অন্য বহুতর প্রাণীর দৃষ্টিকে 'মনুষ্যেতর' বলেই চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। বাংলা গল্পে যদি 'বুধির বাড়ি ফেরা '(বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)কে একটা উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করি,তবে,সেই দৃষ্টি চেতনা বাংলা কবিতার ইতিপূর্বে ঘটে থাকলেও অন্তত এই পাঠকের অপিরিচিত ছিল।যতক্ষণ না পড়ে ফেলা গেল,
"মৃত ইঁদুর আর আমি ছাতে উঠে দেখি:
জ্যোৎস্না রাত্রের বেগবান গহিন গম্ভীর নদীতে বান ডেকে
চরাচর ভেসে গেছে-
সেই আরকে ডুবে একতলা দোতলা সতরোতলা বাড়ি,
ফুটপাথ,ট্রামডিপো ক্রমশঃ গলিতাঙ্গ হয়ে অন্তর্ধান করছে।
ইঁদুর এইমাত্র জন্মমৃত্যু ভেদ করে এসেছে-
'ঐ দেখো বেদ আর সমস্ত প্রলাপ একই নর্দমা দিয়ে ভেসে চলেছে -'
ইঁদুর বললে ,আমি জানি না আমার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে।'
তারপরেই সে মাকড়শার মতো আট টা হল,
শেষে ডিমের মতো গোল হয়ে কাঁপতে লাগল, অধৈর্য,অস্থির।"(ইঁদুর বা মাকড়শা)
এই তথাকথিত 'আধুনিক'-এর উত্তর চিন্তা, বহকৌণিক ও বহুমাত্রিক দৃষ্টি এবং অস্তিত্বের বহুমাত্রাকে স্বীকার করে নেওয়া কী বাংলা কবিতায় খুব সুলভ?
মানে ,এই যে কবি ক্রমাগত তাঁর দৃষ্টি বদল করে করে দেখতে চেষ্টা করছেন যা দেখা হয়নি এতদিন - তাকেই।এই প্রসঙ্গেই এই আলোচকের
মনে পড়ছে অব্যবহিত পূর্বে রচিত দুটি পঙক্তিকে,
" আমরা শিখিনি পরে যারা আছে তারা?
তারা শিখবে না এর ঠিক ব্যবহার!"(জয় গোস্বামী:সৎকারগাথা:উন্মাদের পাঠক্রম:১৯৮৮)
মণীন্দ্র গুপ্তের এই আয়াসকে কী সেই ব্যবহার শেখার আততি হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি না! এবং এখানেই মণীন্দ্র গুপ্তের উত্তরণ নিয়োজিত রয়েছে বলে কী আমরা ভাবতে পারি না?
যদি তাই না হয়,তবে কেন আমাদের পড়তে হচ্ছে,'ঁসংসারচন্দ্র'-র মতো কবিতা?একজন মানুষ চাকরির জন্য ঈশাহী হয়ে তারপর স্ত্রী গ্রহণের ব্যাকুলতায় ইসলামপন্থী হয়ে শেষে
"বউ এবং ইসলাম থেকে মুক্তি পেতে হলেন নানকপন্থী-
শেষে ধীরে ধীরে আবার ফিরে এলেন
তাঁর বর্ণহীন ঘুমন্ত হিন্দুত্বে।"
ভাবী পৃথিবীর মানুষেরা ধর্মকে,তার জায়মানকে অর্থহীন,কৌতুককর বিষয়ে পরিণত করবে, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার বদলে তাকে মূল্যহীন করে দেওয়াটাই জরুরি বলে মনে করবে,সংসারচন্দ্র আমাদের এই বার্তা শিখিয়ে একটা ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে, প্রতিবাদের রূপ বদল হচ্ছে।হওয়াটাই স্বাভাবিক,
"তার চেয়ে বিবাহবিহীন দেশে চল মুসাফির,রাহী,
স্লাভ,টিউকনিক,বাংলা কোনো ভাষাতেই হৃদয়ানুবাদ হয় না"(বিবাহস্মৃতি)
প্রত্যাহারও একধরণের বর্ম।
মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা পড়তে পড়তে আপনি এব্যাপারে সচেতন যে,এ কবিতাবিশ্বকে একটি অঞ্চলের চিহ্ন দিয়ে পরিচয় করান যায় না। বিচিত্র ও বিস্তৃত অঞ্চল কবিতাগুলিকে ভারতীয় কবিতার নমুনা করে তোলে এবং এই গ্রন্থে আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় যে,কাল বারবার ওভারল্যাপড হয়ে তৈরি করেছে একটা বিস্তৃত টাইম জোন,যার ভেতরে অতীতের দিকে যেতে যেতে মণীন্দ্র খুঁজে ফেলতে চান অস্তিত্ব আর শিল্পের সম্বন্ধকে। একটা জবাব পেতে চান - কোথায় নিহিত রয়েছে উচ্চারণের মূল সূত্র!আর এই অনুসন্ধানে দেখা যায় সময়ভেদ করতে করতে কবিসত্তা বলে উঠছে,
"তাহলে এই কবিতাবলির জন্মউৎস কত দূর অতীতে?
মনে হয়,কূর্মাবতারের শক্ত খোলার পিঠে
প্রলয়সমুদ্রের অন্ধকার নিশীথ জল আর
ফসফরাস আর বালি
অতি ধীর লয়ে
এখনও খোদাই করে চলেছে
৬৮ সংখ্যক কবিতা,
যা বইটির শেষ কবিতা।"(আমার শেষ কবিতার বই)
এটাও কিন্তু সমান ভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি বিজ্ঞান ভাবনার কী স্বতোৎসারিত সঞ্চার ! বাঙালির কবিতায় বিজ্ঞানের সঞ্চার খুব বেশি করে ঘটেনি বটে, কিন্তু,যে ক'টি ক্ষেত্রে ঘটেছে - বিস্ফোরণ হয়েছে।যেমন রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ কিংবা জয়। মণীন্দ্র গুপ্তকেও এই ধারারই অন্যতম উজ্জ্বল পথিক হিসেবে গ্রহণ করতে সহায়তা করে বৈকি আলোচ্যমান বইটি। কেবল বিজ্ঞানের তথাকথিত শব্দের ব্যবহার নয়,তত্ত্বকে সমসময়ের জীবনের সম্পৃক্তিতে দেখার নিবিড় উদাহরণ অবশ্যই যেমন পূর্বোদ্ধৃত পঙক্তিগুলি, তেমনই,
"কৌটোর ভিতর পোকা পুষলেও তাকে সময়ে
খাওয়াতে হয়।আর তুমি কি রকম মা,
পেটের মধ্যে বাচ্চা রেখে তাকে বিয়োতেই ভুলে গেলে।
তোমার পেটের মধ্যে ফুলের গাছটি বেয়ে
তোমার থেলিডোমাইড খোকা বারবার ওঠে
আর পিছলে পিছলে পড়ে।"(পাতা ঝরা)
কবিতায় বিজ্ঞান ভাবনার সঞ্চার ঘটলে আবেগ আর যুক্তির সাম্য তৈরি হয়,ভাষার বহুমুখীতা তৈরি হয়,গঠনের অভিনবত্বের সঙ্গে সঙ্গে কমে আসে অতি নাটকীয় নাবালক সুলভ আবেগবাহুল্য।
এ প্রস্তাবের শুরুতে একটি প্রসঙ্গক্রম আলোচনা করার চেষ্টা করেছিলাম ।জাদু বাস্তবতাকে বৈয়াকরণিকের পন্থায় অনুমান করার সে বিনীত চেষ্টায় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত দু 'হাজার আট সনের সঙস্করণে প্রদত্ত লক্ষণ অনুসারে দেখতে পাচ্ছি,জাদু বাস্তবতার একটি বড় বৈশিষ্ট্য হল সে উপকথা, লোককথা আর প্রবাদকে সমকালের প্রেক্ষিতে উপস্থাপন করে।এই কথা ক'টি মনে রেখেই যদি কাব্যটির পাঠ নিই,
"শুধু যেদিন শিবচৌদশীতে বিবাহযোগ্যা মেয়েরা দলে দলে এসে
ওঁর কাছে দীপ জ্বালে,ছোঁয়
বছরে শুধু এক দিনই
একটি করস্পর্শে আচম্বিতে ওঁর ভিতরের আগুন ধকধক করে ওঠে-
বাকি তিনশ চৌষট্টি দিন আবার নির্বিকার;
স্মৃতিকে ভস্মের মতো ব্যবহার করেন।"(শিবস্তোত্র-২)
শিব চতুর্দশী আর বিবাহযোগ্যা কুমারী মেয়েদের স্পর্শ সংবাদ হয়তো অনুদিত হতে পারে। কিন্তু,কেবল তৃতীয় পৃথিবীর, বিশেষ করে ভারতীয় মানচিত্রের অধিবাসী হলে,পাঠক তবেই বুঝতে পারবে যৌন বেদনাখানি কতটা অর্থনীতি আর সমাজ অতীত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।ওই বিবাহযোগ্যার কুমারী স্পর্শে যে আকুতি থাকে,তার ওপর কতটা পীড়ন আর দায়ভার চেপে থাকে তাকে তন্ত্র প্রেক্ষিতে চিন্তা করলে এই আলোচকের জন্য কিছুটা বিভ্রান্তি নির্মাণ হচ্ছে। কেননা এ শিব আমাদের চৌহদ্দি থেকে দূরের তো নন একেবারেই বরং
"চোর ডাকাত সংসারী ভিখিরি সবাই এসে
মাথায় হাত বুলিয়ে যায়।ওঁর কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।"(শিবস্তোত্র -২)
এ শিবের মিথ বুঝতে গেলে আমাদের কী জীব…; অর্থনৈতিক ও বিমূর্ত জীব ধারণার কাছে যেতে হয় না ! -
"কালক্রমে চর কাশফুলে ভরে গেল।
উনি সারা দিন কাশের বনের দিকে চেয়ে থাকেন,
বেলা পড়ে এলে সূর্যাস্ত দেখেন,সন্ধে হলে
শিব শিব বলে নিজেই নিজের নাম গান করেন।"(শিবস্তোত্র -১)
অন্তিম পঙক্তিটির ওপর কৌতুহল স্থাপন করলে কি শিব আর কোনও অমূর্ত ধারণায় নির্ভর করে কি? এই 'শিব 'তো অনায়াসে শিবপদ বিশ্বাস হয়ে যায় কিংবা শিবচন্দ্র হালদার।
এই কাব্যে ব্যবহৃত শব্দগুলির ওপর দৃষ্টিপাত করলেই আমরা বুঝতে পারি, বিস্তৃত একটি কবিতা পৃথিবী তৈরি করছেন মণীন্দ্র গুপ্ত।যে পৃথিবীর অন্তর্গত বিপুলসংখ্যক বিচিত্র উপাদান-
ক্যানেস্তারা,গৌড় সারং,ধান্দা, ফিজিক্স,সুতিকা,বৈদ্য,পূর্ণিমা বিশ্বাস,মুগ্লি,পর্নো হোয়াইট ডাবল মাস্টেকটমি, অর্ধনারীশ্বর, হারেম,ওম পুরি,গ্রেটা গার্বো,রাইগার মর্টিস ইত্যাদি।কিছু কিছু চিহ্নকে বিস্ময়কর ভাবে কোলাজে ব্যবহার করেছেন,যাদের সম্পর্কসূত্রে ভাবা প্রায় অসম্ভব। মণীন্দ্র গুপ্ত তাঁর কবিতায় সেই দুরূহ কৌণিক অবস্থানে নিজেকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন বলেই সম্ভবতঃ আমরা পড়তে পারছি,
"পেটে বাচ্চা নিয়ে যে মারা গেছে,এই রাতে সে পাগলিনীর মতো খুঁজে খুঁজে
এসেছে ভ্রুণের গোড়ের কাছে।তারা মা - ব্যাটা এই গনগনির মাঠে
দু'জনার একটা ডাকাত দল খুলবে - পথিককে ভুলিয়ে এনে
ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলবে!
কিন্তু ফ্যাকাশে চাঁদের আলোয় দেখা যায় সেই ভূত একলা
ভিখারিনীর মতো দাঁড়িয়ে আছে।
এদিকে শেয়ালনী ছোট্ট মাথাটিকে দুই পায়ের মধ্যে রেখে
কাঁকড়া খাবার মতো করে এক কামড়ে ভেঙে দিলে
বাচ্চাটা ককিয়ে উঠল : মা -!
শেয়ালনী করুণ স্বরে,'বাছা,এই তো আমি -'বলে
ঘুমপাড়ানি গান গাইতে গাইতে খেতে লাগল।"(মাহাতদের মরা শিশু)
মা -নিষাদ
____________
উপরোক্ত কৈফিয়তটুকু রেখে আরেকটি প্রসঙ্গে এক্ষেত্রে প্রবেশ করা যায়। জাদুবাস্তবতাবাদ।এই জাদু ও বাস্তবতার সমান্তরাল জায়মানতা যেমন একটি নতুন দৃষ্টি অবস্থানের জন্ম দেয়, জাদুবাস্তবতাবাদ সেখান থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে যায়।সেখানে কেবল জাদু,পুরাণ, ইতিহাস আর বাস্তবতাকে পাশাপাশি রাখলে চলবে না, বরং বাস্তবতার ভেতর থেকেই জন্ম নেবে জাদু। এখন,দেবেশ রায় আবার এই জাদুবাস্তবতাবাদ'কে বাস্তবতারই অবজারভেটরি হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। বাস্তবতার ওপর একটা বিশেষ দৃশ্য মাধ্যম ব্যবহার করে দেখা।এই দৃশ্য মাধ্যমটিকে যদি জাদুবাস্তবতাবাদ বলে বিবেচনা করতে ইচ্ছে করি,তবে, কী সে বিধায় আমাদের মনে পড়ে না,বাংলা কবিতায় এই সময়ের বাস্তবের দুরূহতম উদ্ভটকে পৃথক পৃথক দৃশ্য মাধ্যমে দেখতে চাইছিলেন আরও কয়েক জন কবি। নব উদ্ভুত রাজনৈতিক পরিস্থিতি'কে বিশ্বাস না করতে পেরেই হয়তো বাস্তবতাকে বলতে চেয়েছিলেন এমন এক ভাবে যা বিশ্বাস্য আর অবিশ্বাস্যের ভেতর চলাচল করে। সচেতন কিংবা অসচেতনেই বাংলা কবিতায় এই পর্যবেক্ষণটি গাঢ় হতে থাকে নব্বই দশকে।জয় গোস্বামীর 'মা নিষাদ 'নামক দীর্ঘ কবিতাটিকে কী এর একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যায় না!
"স্তব্ধতা ফাটে,পাকিয়ে উঠছে ধুলো
ধূলিস্তম্ভে মেঘযূথ মিশে যায়
ভূগোল ঘুরছে,ধক ধক করে চুলো
সূর্য লুপ্ত প্রায়
সূর্য তো নয়,কালরাত্রির চাঁদ
চাঁদ মুখে নিয়ে উড়ে যায় কালো পাখি
সেই চাঁদকেই বাণে বেঁধে উন্মাদ
ব্যাধ নামে তারে ডাকি"
কিংবা,
" পোড়া বাড়ি ভাঙা হাড়গোড় ইটকাঠ
স্তূপের পেছনে স্তূপ ওঠা জনপদে
চুরমার মাটি,দগ্ধশস্য মাঠ
মানুষ মরেছে ঘরে দপ্তরে পথে
মানুষ মরেছে,জন্মেছে আরও আরও
বাঁকা হাত,ঘোর জড়ভরতের দেহ --
মুখে জিভ নেই পায়ে হাড় নেই কারও
জন্তুর মতো হামাগুড়ি দেয় কে ও?"
এ সবই ঘটেছিল। উনিশশো আটানব্বই-এর ভারতীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায়।পোখরান টু বললেই আমাদের মনে পড়ে যেতে বাধ্য। আমাদের মনে পড়ে পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের আত্মপ্রকাশ।আর সেই বিস্ফোরণ প্রক্রিয়ার ঘটমানতাগুলির সঙ্গে নিকটবর্তী ইতিহাসের ফিউসনে আমাদের স্মৃতি যেসব দৃশ্য বহন করছে,কবি তাদের স্রেফ সম্পাদনা করে দিলেন। কয়েকটি কাল মুহূর্ত'কে সরিয়ে দিতেই গোটা ঘটমান বাস্তবকে আমাদের মনে হতে থাকল একটি ভুডুময় জগত,একটি মহাবিদ্যাময় পৃথিবী,
"সন্তান আর শস্যের ভার ব'হে
তুমি শুয়ে আছ স্তব্ধ বসুন্ধরা
স্তব্ধতা ফেটে উত্থিত হয় কাল
মাথায় আকাশ -মুঠোয় দণ্ড ধরা
দণ্ডের মুখে গেঁথে আছে ভাঙা চাঁদ
পায়ের তলায় সমুদ্র আছড়ায়
কাঁধ ছুঁয়ে আছে পাহাড়ের উঁচু কাঁধ
রাত্রি লুপ্তপ্রায়"
এ কবিতার ব্যাখ্যা খুব প্রয়োজন হয় না।তবে,একথা বলে রাখা কী অতিরিক্ত হতে পারে,ব্যঞ্জনা আর শব্দের বহুধা বিস্তৃত অর্থকে সম্পূর্ণ ব্যবহার করলেন জয় গোস্বামী। নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের দৃশ্যাবলি,স্মৃতি আর পৌরাণিক ঈশারায়; কেবল 'কালো পাখি 'কেই উড়ে যেতে দেখলেন,কোন পাখি সে তথ্য না দিয়ে তার মুখে চাঁদের অবস্থান রাখলেন। দুটো পরস্পর ঘটে যাওয়া দৃশ্যের সামান্য অংশটুকু রেখে চাঁদের সম্মুখ দিয়ে পাখি উড়ে যাওয়ার গোটা ঘটনাকে বাদ দিয়ে তারপরেই ব্যাধ আর বাণের চিত্রকল্পে দেখার চেষ্টা করলেন অস্ত্রের তাৎপর্যকে আর পুরাণ আর প্রত্নপ্রতিমায়।ধুলোর স্তম্ভ তৈরি করা,বা ভূগোলের ঘোরা অথবা হঠাৎ শূন্য থেকে নৈঃশব্দ্যের বিপুলভাবে নস্যাৎ হয়ে যাওয়া যেমন ঘোর ঘটমান বাস্তব, তেমনই এটাও ঠিক এই সব দৃশ্যের পরস্পর সংলগ্নতাটা একটা সম্পাদনা।কবির দেখার মাধ্যম যে সম্পাদনাটি করেছিল হয়তো।তাই মানুষের কিমাকার বর্ণনা আমাদের মধ্যে আধা পৌরাণিক বিভৎস রস যেমন তৈরি করতে সক্ষম, বাস্তব দৃশ্যের পূণর্নিমাণেও প্ররোচিত করে। হিরোশিমা -নাগাসাকি উত্তর পর্বে মানুষের অপর রূপ,অচেনা অসুস্থতার ছবিটা তো আর আমাদের কাছে অস্পষ্ট নয়।
আসলে সম্ভবত, আমাদের ঘটমান চারপাশে নিয়ত সব জাদু ঘটে চলেছে।পরম্পরা একটা যুক্তি তৈরি করে।যে যুক্তি বোধের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের অভ্যাস ও অভিজ্ঞতা।এখন এই পরম্পরার একটি বা দুটি ক্রমকে ঢেকেই তো জাদু তৈরি হয়।মানে টুপির ভেতর পায়রা ঢোকানর পদ্ধতি ঢেকে কেবল বের করার উপায়টাই দেখালে যা ঘটতে পারে। কিন্তু,জয় গোস্বামী তার সঙ্গে যুক্ত করলেন পুরান প্রসঙ্গ।পুরান তো আসলে পুরনো সব কথা।সব সমষ্টির স্মৃতি।যেই সেই পুরনো স্মৃতি থেকে উঠে এল 'জড়ভরত' প্রসঙ্গ,এ কবিতা সময়কে একটা বিরাট বিস্তার দিয়ে ফেলল।আলাপ থেকে বিস্তারে যাওয়ার মতো প্রলম্বিত বিস্তার নয়, বরং কোমল থেকে কড়িতে যাওয়ার মতো একটি বিক্ষুব্ধ বিস্তার।পুরানের আর সব কথা বাদ দিয়ে কেবল 'জড়ভরত'কে তুলে আনলেন,তাকে বসালেন আমাদের সমজায়মানের শরীরে।খাপ খেয়ে যেতেই বিদ্দুচ্চমকের মতো সা যেন একটা বিপুল সময়কে নিমেষে অতিক্রম করার শক্তিতে আমাদেরও সময়ভেদী একটি অভিজ্ঞান জানায়।জানায়,নিয়তি তাড়িত অক্ষম বেঁচে থাকার স্বমূর্তির সত্যকে। আমরাও নিজেদের জড়ভরতের খাপে আবিস্কার করে শিহরিত হই,মনে তৈরি হয় দৃশ্যের পরিশুদ্ধি।
'মা নিষাদ 'নামক দীর্ঘ কবিতাটির ছত্রে ছত্রে জাদুর বিস্তার আর তাকে ভেঙে কিছুক্ষণ জাদুকর দর্শকের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নির্মাণ করেই আবার ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন জাদুর ভেতরে,
"তুমি কত সালে জন্মেছ বিজ্ঞানী?
কত সালে তুমি জন্মেছ হে শাসক?
তোমাদের ঘরে ছেলেপুলে জন্মেছে?
ঠিক -ঠিক আছে নাক মুখ হাত চোখ?
আমাদের আরও জন্মানোর কি বাকি?
আছে তুলে নেওয়া ধানের গুচ্ছ,ঘাস
আছে মাটি থেকে ডালে তুলে দেওয়া পাখি
গান বাঁধবার নানক তুলসীদাস"
দেখুন,বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর সবচাইতে বৈচিত্র্যময় কবির পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে রচিত একটিমাত্র দীর্ঘ কবিতা 'মা নিষাদ 'নামক দীর্ঘ কবিতাকে কেন্দ্র করে তাঁর কবিতায় জাদুবাস্তবতার সন্ধান একপ্রকার শোচনীয়ভাবে অসম্পূর্ণ একটি ঘটনা। উনিশশো নিরানব্বই সালে রচিত এই কবিতাতেই কেবল নয়,গোটা নব্বই দশক জুড়েই,নব্বই দশক কেন প্রায় প্রথমাবধি জয় গোস্বামীর কবিতায় এই প্রবণতা কী আমরা দেখতে পাচ্ছি না!সে 'উন্মাদের পাঠক্রম' বা 'সূর্যপোড়া ছাই' বা 'ভুতুম ভগবান' বা 'পাতার পোশাক' কিংবা 'ঔরস'-এও।
এখন প্রশ্ন হল,গোটা কবিতা জীবন জুড়েই যখন জয় গোস্বামী এই কাজটি করেছেন বলে এই আলোচকের দাবি,তাহলে,কেন কেবল নব্বই দশককেই সাব্যস্ত করে এই আলোচনায় মণীন্দ্র গুপ্তকে এবং তাঁর সেই দশকের শুরুর দিকে রচিত একটি কাব্যকে যুক্ত করা হচ্ছে!সোজা কথায়, রচনার অভিপ্রায় কী?
তার কারণ,নব্বইয়ের আগে সত্তর দশক সোচ্চারভাবে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাপেক্ষে উতরোল ছিল।এটা প্রকাশ্য।এরপর আশি নয়,আশিতে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অভিঘাতে নব্বই উতরোল হল।যার পরিচয় আলোচনার পূর্বেই দেওয়া গেছে। কিন্তু,নব্বই সোচ্চার নয়।প্রকাশ্যে তার মধ্যে বিক্ষোভ দেখা যায়নি।কারণ শত্রু তখন আর প্রকাশ্য নয়।সে রূপ বদল করেছে,বিস্তার বদল করেছে।বৌদ্ধিক হয়ে যেতে চাইছে প্রধানত।সেই প্রচ্ছন্ন বিক্ষুব্ধ সময়ে জাদু বাস্তবতাকে অবলম্বন করা একটা সমষ্টি স্বভাবকে চিহ্নিত করতে চাইছি বৈকি।
লাতিন আমেরিকায় যে সময় জাদু বাস্তবতার আবির্ভাব ঘটছে, রাজনৈতিকভাবে সে সময়টিও ছিল উদ্ভ্রান্ত।প্রতিবাদময়। লাতিন আমেরিকায় তৈরি হচ্ছে।যদি, ইউরোপের বাইরে জাদু বাস্তবতার প্রসারে হোর্হে লুই বোর্হেসকে আমরা চিহ্নিত করি অগ্রগণ্য হিসেবে,অন্য মতও অবশ্যই আছে,তবে দেখব সে সময় বিপ্লব গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপট। এভাবে কী আমরা ধরে নিতে পারি,না,বিক্ষোভের সময় শাসকের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য জাদুবাস্তবতাবাদের উপায় অবলম্বন করলেন এই সব বিপ্লব সমর্থকেরা?আর কী অদ্ভুত কাণ্ড দেখুন,একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আপাত নিরাপদ পরিস্থিতিতে জয় গোস্বামীকেও অবলম্বন করতে হচ্ছে একই পন্থা!কী মুগ্ধ করা গোপন দ্বন্দ্ব। প্রত্যক্ষ নয়, কিন্তু একটা জায়মান শাসন কবিকে যেন ঐতিহাসিকভাবে স্বভাব উপায় আলম্বন করায়(যেন,'লেখে না কেউ লেখায় তাকে ')। বাংলা কবিতায় তৈরি হয় নতুন একটি স্বতোৎসারিত পরিস্থিতি। সঙ্ঘবদ্ধ ও ঘনিষ্ঠ পরিস্থিতি। অবশ্য এই প্রবণতা ইতিপূর্বেও কী রাজনৈতিক কারণেই দেখা যায়নি!চর্যাপদে যখন 'রুখের তেন্তলী কুম্ভীরে 'খায় ,সেই একই প্রবণতার বিচ্ছিন্ন আভাস লক্ষ্য করি না?
এই প্রবণতা অবশ্যই মণীন্দ্র গুপ্তের মতো সংবেদী কবিকেও স্পৃষ্ট করেছিল।রাষ্ট্রিয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জয় গোস্বামীও যেন একটি মহাকাব্যের আয়োজন করেন, ঐতিহাসিক কারণেই করেন,
"ওই যে রাত্রি বইছে যমুনাতীরে
ওই যে এসেছ আমাদের শ্যাম-রাই
ওই শুনছ না,ভাঙা মন্দিরে বসে
প্রেম গাইছেন আমাদের মীরাবাঈ!
অতই সহজ আমাদের মেরে ফেলা?
আমাদের পায়ে রাত্রিচক্র ঘোরে
আমরা এসেছি মহাভারতের পর
আমরা এসেছি দেশকাল পার করে"
এখন কথাটা তো ম্যাজিক রিয়ালিটি।কাজেই এই ম্যাজিকের ধারণা আর জাদুর ধারণা কতটা কাছাকাছি -তা নিয়ে সংশয় থাকেই।মানে, গৌড়জন 'জাদু' বলতে যা বোঝেন,'ম্যাজিক' কী ঠিক তাইই বোঝায়?
the skill of performing tricks to entertain people, such as making things appear and disappear and pretending to cut someone in half(Collins dictionary)
এই সূত্র ধরে যদি ম্যাজিককে বুঝতে যাই,বা, অন্য অভিধানেরও সাহায্য নিই,তাহলেও দেখা যাবে, সবসময় ম্যাজিকের সঙ্গে একটা পারফরম্যান্স জুড়ে আছে।একটা একটা পারফরম্যান্স, যা,প্রাণির দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে এবং সংঘটনটি মানুষকে বিনোদিত করছে।এমন বিনোদন যা যুক্তি পরম্পরার সাহায্যে নির্মাণ অসম্ভব। এবং এই magic শব্দটির বুৎপত্তি খুঁজতে গেলে 'magai' শব্দটি খুব প্রাসঙ্গিক ও অনিবার্য হয়ে ওঠে।পুরোহিত তন্ত্রের নানা কর্মকাণ্ড এবং তৎসংক্রান্ত অন্ধকার চেতনা এই ম্যাজিক ধারণাটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। কিন্তু,জাদুর ধারণাটি কীরকম?
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন জাদু শব্দের অর্থ হতে পারে কুহক,ইন্দ্রজাল বা ভেলকি।এই ভেলকি অর্থে magic শব্দটি ব্যবহার করতে চাইছেন। এবার ,এই ভেলকি শব্দার্থে পাওয়া যাচ্ছে,'জাদুর খেলা' এবং 'ধোঁকা' শব্দ দুটোকে।শব্দ দুটোই মানুষের অনুষঙ্গে ব্যবহৃত হয়।এখন' কুহক ' এই শব্দটির দিকে তাকালে আমরা অর্থ পেতে পারি,বিস্ময়াপক,বঞ্চক,শঠ এবং ধূর্ত্ত। বস্তুত প্রত্যেকটিই প্রায় মানব সংক্রান্ত। একমাত্র 'ইন্দ্রজাল' শব্দার্থে প্রণিধান করলে পাওয়া যায়,পরমেশ্বরের জাল,মায়াতুল্য এবং ইন্দ্রিয়ের জালবৎ আবরক সহ অন্যান্য পূর্বে উল্লেখিত শব্দসমূহ।
এই আলোচকের মনে হয়েছে, বাংলাদেশের জাদুর ধারণা কিছুটা আলাদা হলেও মোটামুটিভাবে মানুষের পারফরম্যান্সের মাধ্যমে উদগত আর তার সঙ্গে প্রবঞ্চনার সম্পর্ক রয়েছে - এই দুটো বিষয়ে সহমত লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ এভাবে দেখা যেতে পারে,জাদু আসলে একপ্রকার মনুষ্য সৃষ্ট প্রবঞ্চনা।যা আমাদের যুক্তির পরম্পরাকে নষ্ট করে দিতে চায়। ঠিক এই জায়গাটাকেই আমার মনে হয়,শিল্প হাতিয়ার করেছে। একটা প্রতিস্পর্ধি হাতিয়ার।
সমাজের প্রবল অংশ যখন, নির্দিষ্ট যুক্তি পরম্পরা তৈরি করে তার শাসনটাকেই চাপিয়ে দিতে চাইছে,সেই যুক্তির ক্রমবিণ্যাসকে ভেঙে দিলেই তার স্বভাব ও অপ্রাসঙ্গিকতাকে হয়তো সম্যক ধারণা করা যায়।আর সেই লিপ্সাতেই বোধহয় বিংশোত্তর পৃথিবীতে জাদু বাস্তবতাবাদের চর্চা শুরু হয় এবং নব্বইয়ের বাংলা কবিতাতেও।কারণ বলে অনুমিত হয় যে,জাদু সবসময় আপনার যুক্তির ক্রমপরম্পরাকে ভেঙে দেয়;মানে, ধরুন আপনি টুপির তলায় অভিনব টেবিল রাখা,তার ভেতর খরগোশ ঢুকিয়ে দেওয়ার পূর্ব প্রস্তুতিটুকু আপনাকে দেখতে দেওয়া হল না,কেবল আপনি দেখলেন টুপির ভেতর থেকে খরগোশ বের করে আনা এবং ওই প্রস্তুতি আপনি দেখে ফেললেই সেটা আর জাদু থাকত না;শিল্পের জাদু বাস্তবতা সম্ভবত দৃষ্টি পাতের উপকরণ হিসেবে এমন ভাবে ক্রিয়া করল,যার ফলে ভেঙে যেতে থাকল প্রবলের যুক্তি পৃথিবী। অন্তত 'মা নিষাদ ' তো সেরকমই অভিঘাত তৈরি করল এ পাঠকের পাঠচেতনায়,
"অস্ত্র মাটিতে অস্ত্র আকাশগামী
দিগন্ত রাঙা অস্ত্রের মহিমায়
রাঙা অস্ত্রের কিরণ পড়েছে জলে
গ্রন্থসাহেব নদীজলে ভেসে যায়
সেই জলে ভাসে বেহুলার মান্দাস
মশারির নীচে শোয়ানো লখিন্দর
বিকলাঙ্গ সে, তেজস্ক্রিয়ার বিষে।
থামে মান্দাস,একঘাট অন্তর
একেকটি ঘাটে থমকে একেক যুগ
নদী সমুদ্রে বিরাট সেতুর ছায়া
পঙ্গু কামড়ে ধরেছে তোমার বুক
স্বামী না শ্বাপদ শিশুসন্তান মায়া" …
কিন্তু কী বিস্ময় তৈরি হয় ভাবি যখন,বাংলা কবিতা যখন শরীর থেকে গীতলতাকে খুলে ফেলার চেষ্টায় ব্যাপৃত,সেই গীতিময়তাকে আবার নির্ভর করেই সে কিন্তু জাদু বাস্তবতাবাদকে,জাদু বাস্তবতাকে নির্দিষ্ট চিন্তা হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করল।
জানি না এই প্রবণতাকে জাদু প্রবণতা বলা যায় কিনা! তবে একটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অন্তর্ঘাতময় সময়ে এই প্রবজ্যা গ্রহণ আমাদের লাতিন আমেরিকার প্রতিবেশের স্মৃতিও মনে পড়ে যায়। এবং আমরা মনে মনে অনেকটাই বিশ্বাস করে ফেলতে চাই যে, জাদুবাস্তবতা হল এমন একটি বাস্তবতা যা নিঃসন্দেহে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ভূখণ্ডের আর্থ -সাঙস্কৃতিক দ্বন্দ্বে এক এক রকম ফর্মে তৈরি হবে।শ্লেষ বা বিদ্রুপের আরও ওপরে রচিত হবে একটি কালখণ্ডের একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের প্রবল শক্তির বিরুদ্ধে সন্ধ্যা উচ্চারণ।যে উচ্চারণ কিন্তু চিহ্নিত করে দেবে শাসকের চরিত্র ও চারিত্র। এবং এই উচ্চারণের মাত্রা কিন্তু মানচিত্র ভেদে বদলে যেতে পারে।
তবে,এদিক থেকে দেখলে,বা,এভাবে দেখলে কিন্তু আবার কঙ্কাবতী বা বাংলা সাহিত্যের বেশ কিছু রচনাকে জাদুর আওতায় আনলেও জাদু বাস্তবতা থেকে দূরে রাখতে হয়। কেননা,জাদু আসলে উঁচু শক্তির প্রবঞ্চনা হিসেবে এখানে চর্চিত হয় বলে ধারণা করি। এবং সেই প্রবঞ্চনার বাস্তবাতাকেই বোঝাতে এবং বর্ণনা করতে চেষ্টা করে বোধহয় এই জাতীয় চিন্তা।তাদের কর্মকাণ্ডগুলোর অথবা স্বভাবের চিহ্নগুলোকে আমাদের সম্মুখে এমন একটি কোলাজে পরিবেশন করে যে,অমাদের প্রাথমিকভাবে বুঝতে অসুবিধে হলেও,আস্তে আস্তে চোখ সয়ে গেলে বেশ বোঝা যায়,কোলাজটি আসলে একটি সম্পূর্ণ অন্য আরেকটি ছবিকে, ঘটনার কাঠাম'কে তুলে ধরছে। দৃশ্যের ভেতর দৃশ্যকে লুকিয়ে রাখা,বিন্যাসের ভেতর বিন্যাসকে লুকিয়ে রাখার প্রবণতা এই চর্চার যদি অন্যতম বিষয় হয়,তবে 'ছিল রুমাল হয়ে গেল বিড়াল ' কিংবা 'সাত দুগুণে তেরো'… কে সমবাস্তবতার শরীরে স্থাপন করলেই বস্তুত জাদু তৈরি হয়।
নব্বইয়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি হয়তো বা বাঙালি কবিদেরও বাধ্য করেছিল সেই মানসিক পরিস্থিতে পৌঁছতে,যেখান থেকে প্রবঞ্চনাগুলির দিকে তাকালে তৈরি হয় চিহ্নের কোলাজ।ক্রমশ জটিল হতে থাকা সামাজিক বিন্যাসের বিভিন্ন চিহ্ন ও সংবদল ধরা পড়তে থাকে জাদুবাস্তবতাবাদের চোখে। এখনও পর্যন্ত এই প্রস্তাবে যে দু'জন কবির উল্লেখ হতে পেরেছে, তাঁদের একজন বিগত শতাব্দীর ছয়ের দশক থেকে এবং আরেকজন সাতের দশক থেকে কবিতা রচনা আরম্ভ করেছিলেন। তাঁদের নব্বইকালীন প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল। এবার যদি দুটি এমন উচ্চারণকে এখানে ব্যবহার করা যায়,যাঁদের বেড়ে ওঠাটাই নব্বইকে কেন্দ্র করে।সেই পরিস্থিতির মধ্যে,তার সঙ্গে যুঝতে যুঝতে কী প্রতিক্রিয়া তাঁরা রাখছেন,সেটিও গুরুত্বপূর্ণ বলে অনুমিত হয়।এখন, মণীন্দ্র -জয়ও কী নব্বইয়ের পরিস্থিতিকে যাপন করেননি!তাঁরাও কী যোঝেননি ওই দশকের ক্রমব্যপ্ত জটিলতার সঙ্গে?তথ্য সংরক্ষণ ও বিস্ফোরণের অভিঘাতের সঙ্গে? নিশ্চয়ই।তবে তাঁদের ক্ষেত্রে প্রজ্ঞার নান্দীপাঠ করেছিল পূর্ববর্তী প্রহরের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিগুলি।ষাটে স্বাধীনতা প্রাপ্তির বিহ্বলতা কেটে যাচ্ছে,বিক্ষোভ তৈরি হচ্ছে।সত্তরে তার বিস্ফোরণ ঘটছে।এই অভিজ্ঞতাগুলো অবশ্যই প্রস্তত করেছিল অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা। কিন্তু,নব্বইয়ে বেড়ে ওঠা কবির সেই সুবিধাটুকু ছিল না। আমার মনে হয়,এই অভিজ্ঞতার ফারাক গড়ে দিয়েছিল ভাষার,অবস্থানের ফারাকও।
অটো চড়ে চাঁদে যাওয়ার বিপাসনা
__________________________________
সেক্ষেত্রে আমরা যদি আরও কয়েকটি উদাহরণকে এখানে ব্যবহার করি, বক্তব্য বিষয় স্পষ্ট হতে পারে। এক্ষেত্রে সবার আগে মনে পড়ছে অচ্যুত মণ্ডলের কথা।যদিও জীবদ্দশায় একটিও কাব্য গ্রন্থ প্রকাশ না করা অচ্যুত মণ্ডলের মৃত্যুর পর দু'হাজার এগার নাগাদ প্রকাশিত হয় 'একটি তারার তিমির 'নামক বইটি।বইটির প্রায় সব কবিতাই নব্বই দশকে রচিত।এই বইয়ের কবিতাগুলির দিকে অভিনিবেশ করলে পাচ্ছি এই কবিতাটি --
কে যেন ভোরের দিকে চলে যায় কুয়োতলা ডাকে
তোমারও উঠোনে এত চাঁদ ছিল আগে তো দেখিনি
কে গেল সূর্যের দিকে পার হয়ে শান্ত স্রোতঃস্বিনী
তুমি তার নাম জানো, কোনোদিন বলো নি আমাকে !
পথে পড়ে থাকে তার তোমাদের জানালার আলো
ফাটলের হাসির দাগ, মনঃক্ষুণ্ণ দেওয়ালের কোনে
যেন ব্যঙ্গ করে তাকে -- বাধা দেয় ভোরের ভ্রমণে
যেন অনন্তের কাছে কেউ তার অভ্যেস জানালো !
পূজো পূজো রোদে এই সিঁড়িতে লক্ষ্মীর পা আঁকো
কে যেন পুবের দিকে যেতে চায় --- চই চই হাঁস
পালক ভেজায় রোদে ব্যর্থ করে ভোরের সন্ন্যাস
তুমি ওকে ভয় পাও -- আমাকেও অন্য নামে ডাকো
দেওয়ালই উল্লম্ব হয় -- তোমাদের কবিতার খাতা
নৈরঞ্জনা সিক্ত হাতে ছিঁড়ে ফেলে বান্ধবী সুজাতা॥
(বুদ্ধপূর্ণিমার ব্যাখ্যা অথবা বন্ধুকে খোলা চিঠি:অচ্যুত মণ্ডল: একটি তারার তিমির)
এ নমুনা পাঠের সময় আপনার সবার প্রথমে যে ক'টি তাৎপর্য চোখে পড়ল,সেগুলিকে এভাবে যদি সাজাই --
১.জাদু প্রবণতাকে প্রকাশ করতে অচ্যুত মণ্ডল লিরিক নির্ভর হচ্ছেন।
২.তাৎপর্যপূর্ণভাবে কোনও ঘটনাকে পরম্পরায় বলতে চাইছে না বরং পরম্পরাকে ভেঙে দিতে চাইছে।
৩.বাংলা কবিতার ঐতিহ্যকে, ঐতিহ্য ব্যবহৃত প্রত্নকে প্রকাশ্যে ধারণ ও বহন করছে এবং করছে তাৎপর্যভেদে।এই প্রবণতাকেই সম্ভবত আত্মীকরণ বলা যেতে পারে।যেমন কুয়োতলা আর চাঁদের প্রসঙ্গ এসেছে প্রথম দুটো পঙক্তিতেই। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের চির বাংলার বসতিকে যেমন মনে করিয়ে দেয় চকিতে, তেমনই শক্তি চট্টোপাধ্যায় চলে আসেন এক অনিবার্য প্রসঙ্গে। বস্তুত 'অনন্ত কুয়োর জলে 'যেভাবে চাঁদকে শুইয়েছেন শক্তি,যে প্রলম্বন ও প্রশমনের দ্বান্দ্বিক তরঙ্গ তুলে দিয়েছেন বাঙালির অনতিঅতীতের যৌথ স্মৃতিতে,যে কুয়ো আর চাঁদ সমীপে এলেই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ আসতে বাধ্য।এখন,অচ্যুত কী তা জানতেন না! অত্যন্ত জেনে বুঝেই তাকে ব্যবহার করলেন এবং ব্যবহার করলেন ভিন্ন মাত্রায়।এই পাঠককে যেন স্পষ্ট আত্মহননের ছবিতেই নিয়ে যেতে চাইছেন কবি।কুয়োতলার ডাকে ভোরের অস্পষ্ট চাঁদে অনির্দেশ্যেরা ঘুম থেকে জেগে আসে। ছন্দ এবং কুহক দুটোকেই রক্ষা করলেন অচ্যুত 'কুয়োতলা' থেকে সম্বন্ধ বাচক 'র' বিভক্তি বাদ রেখে।এর ফলে কুয়োতলার ডাক একটি ঘটমান বর্তমান পেয়ে যেতে পারে।ফলত এই ডাক যেন শেষ হতে চায় না।এগোতেই থাকে।ডাক চলতেই থাকে।কাল ভেদে ঘুম ভেঙে জাগা চলতেই থাকে। অস্পষ্ট চাঁদে।তবে,এখান থেকে পরিত্রাণ চাইতে নেই আলো নির্মাণ করতে চাইছে এ কবিতা,ওমনি সিঁড়িতে আঁকা লক্ষীর পা-এর প্রসঙ্গ,পুজোর রোদের প্রসঙ্গ এসে প্রত্ন -প্রতিমার অবভাস নিয়ে আসে।নিয়ে আসে বঙ্গদেশের নিজস্ব ভৌগলিক রেফারেন্স।আর এই পুজো রোদের অনুষঙ্গে লক্ষীর পায়ের সারি আঁকার ভেতর থেকে যে অনুচ্চারিত দৃশ্য তৈরি হয়,তাতেও কল্যাণ চিহ্ন তার য সমস্ত সহযোগী চিহ্ন সমেত উপস্থিত হয়, তাতেই তো জাদু নির্মিত হয়,আর এই দৃশ্যের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা অচিন্তিত বাস্তবতাকেও বাংলাদেশের বাইরের মানচিত্র থেকেও বোঝা সম্ভব নয়।
এবার,যদি প্রথম তাৎপর্যের প্রসঙ্গে আসি,তবে তা একদমই কবির নিজস্ব বলে কিন্তু চিহ্নিত করতে চাইছি না।নব্বই দশকের কবিতার একটা অংশ যেমন লিরিক প্রবণতার দিকে ঝুঁকে তখন আরেকটা অংশ কিন্তু প্রবলভাবে গীতলতাহীন হয়ে উঠতে চাইল।এই প্রসঙ্গটি স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করা যেতে পারে।কিংবা এভাবেও বলা যায় যে স্বাভাবিক ভাবেই লিরিকের সমান্তরাল একটি ছন্দ প্রকল্প গড়ে উঠেছিল।সে একটা প্রলম্বন চাইল গদ্যের কাছে।এক্ষেত্রে কিন্তু অচ্যুত সমিল অক্ষরবৃত্ত লিখেছেন। সনেটের চলন নির্মাণ করেছেন,তবে,আট দশ মাত্রায়। অদ্ভুতভাবে লক্ষ করা যায়,'গদ্য কবিতা '-র রচয়িতা হিসেবে পরিচিত অচ্যুত কী প্রবল ভাবে প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্ন নির্মাণ -দুটো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের নিজস্ব ফরম্যাটকে ব্যবহার করলেন।
দ্বিতীয় তাৎপর্যকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে --কবি লোক চিহ্ন থেকে লোক চিহ্নে ঘুরতে ঘুরতে,নিজেকে,কথন'কে,কথনের ভাণ'কে নিয়ে গিয়েছেন কেন্দ্রিয় চিহ্নের কাছে। অর্থাৎ বৌদ্ধ চিহ্নের কাছে।বৌদ্ধ চেতনা লোক চেতনা তো নয়ই বরং বলা যায় বৈদিক চেতনার সমান্তরাল আরেকটি প্রতিষ্ঠা। অন্ততঃ ভারতীয় মানচিত্রের সাপেক্ষে। দেখুন,দুর্গা বা লক্ষী পুজোয় আলপনায় চালের গুঁড়ো ব্যবহার করতে হয়,এটা ধর্মীয় ব্যকরণজাত বিষয় নয়। বাংলাদেশে চাল অপ্রতুল ছিল বলেই এই প্রথা।যদি গম অপ্রতুল হতো,তবে আলপনার উপাদানও বদলে যেত।এ সবই কৃষি সভ্যতার অর্জিত প্রত্ন-স্বভাব।এ কারণেই লক্ষীর পায়ের চিহ্ন'কে লোকযানের অন্তর্ভুক্ত করতে চাইছি।
এবার কবিতার পতন ক্রিয়া আর ক্লাইম্যাক্স একসঙ্গে নির্মিত হচ্ছে।সেই শীর্ষ বিন্দুতে 'নৈরঞ্জনা'কে"২ যদি হতাশার প্রতীক মনে করি,তবে 'সুজাতা ' অর্থে প্রেম কিংবা জীবনের কাঙ্খা সেই হতাশার উদ্বোধন পর্দা ছিঁড়ে ফেলে কী ঝলমলে একটি লিরিক্যাল রোদ ওঠায়!নদীকেও ছিঁড়ে ফেলতে পারে নারী!
এখানে এটাই বলতে চাওয়ার যে,জাদু বাস্তবতা বাংলা কবিতাতেও এমন ভাবে প্রস্তাবিত হয়েছে যে তাকে বাংলার বাইরের মানচিত্র থেকে অনুভব করা কঠিন।বাংলার নিজস্ব দ্রোহ ও মনস্তস্ত্ব ও আবহমান এবং প্রতীবেশই রচনা করেছে এই প্রবণতা।আসলে আবারও মনে করে নেওয়ার যে,কোনও প্রবণতাই ব্যক্তিমানসের অভিব্যাক্তি হতে পারে না। বরং একটি চলমান সময় তার অভিঘাতে তৈরি করতে পারে এক একটি প্রবণতা।এই কারণেই ধারণাটি আরও দৃঢ় হয় যে নব্বই দশকের বহুকৌণিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বাঙালি কবিদের জাদু বাস্তবতার 'অবজারভেটরি'তে দাঁড়াতে হয়েছিল সম্ভবত।
অচ্যুত মণ্ডলের আরেকটি কবিতার পাঠ নেওয়া যাক,
দিদিমণি দৃপ্ত হলে সমস্ত চাকর চলে যায়
একটি যুবক আসে বেহালা বাজাতে ছাতা নিয়ে।
হাসির অনতিদীর্ঘ মীড়ে কেঁপে উঠে পার্কে বসা বুড়ো
মিশে যাচ্ছে কুয়াশায় হাতে নিয়ে সন্ত্রস্ত রেডিও---
‘কিছু একটু কথা বলো কিছু বলো না হলে কীভাবে’
একটি ড্রাকুলা যাচ্ছে রিক্সা নিয়ে সঙ্গে দুটি পরী
‘চল একটু দেখি তাকে, এসো গল্প করি’।
দিদিমণি দীপ্ত হলে সমস্ত চাকর চলে গিয়ে
একটি যুবকই থাকে, কানকো তার কেঁপে ওঠে ধীরে,
অতি শুষ্ক, সমীচীন, প্রথাসিদ্ধ অত্যন্ত সমীরে --
‘আমি কি বুঝি না কিছু পাই না কি টের ?’
‘তুমি বড্ড বোকা সাজো আসলে তো গভীর জলের’ --
ঝাপটা লাগে, চোখে মুখে নোনা তরলের ঝাপটা লাগে
হাসির অনতিদীর্ঘ মীড়ে একটি যুবক আসে
ফিরে যায় ------ বেহালা বাজিয়ে , ছাতা নিয়ে। (যন্ত্র সংগীত)
এ কবিতার গঠনটি কিছুটা বদলে শ্রুতিতে একটি অভিনবত্ব আনা হল। প্রথমত,অক্ষরবৃত্তের চলন আট দশ মাত্রা বজায় রাখল। কিন্তু মূল কবিতাটি পাঠকের ধারণাকে ভেঙে দিয়ে পনর পঙক্তিতে বিস্তৃত হয়। এবং পনেরতম পঙক্তিতে কবি একটি ড্যাশ চিহ্নের ব্যবহার করে তাতে দুই মাত্রা কমিয়ে দিলেন।ওই ড্যাশের নির্জনতায় দ'মাত্রা যেন ছেড়ে দিলেন।যেমন গোটা কবিতায় তিনি দৃশ্যকে,দৃশ্যের নির্মাণকে,নির্মাণের ব্যপকতাকে একবারও নিয়ন্ত্রণ করলেন না। তাদের ছেড়ে দিলেন ভরহীনতায়।পরপর সম্পৃক্তিহীন ছবি তৈরি হতে থাকল,যেন ক্যামেরার কাজ কেবল উদ্যেশ্যহীন ঘুরে যাওয়া, পরপর দৃশ্যের বিণ্যাস তৈরি করা ব্যতীত আর কিছুই নয়।
এ কবিতা যেন কোথাও পৌঁছতে চায় না।কোনও লক্ষ্য নেই তার। বাংলা কবিতা যে বিমূর্তের অভ্যাসে হয়তো আগামীতে পৌঁছবে,এমনই একটা স্মারক তৈরি করে রাখলেন যেন অচ্যুত।মিল বিণ্যাস রাখলেন, কিন্তু তাকে রাখলেন মাত্র ছ'টা পঙক্তিতে।অনিয়মিত এল সেই পঙক্তিরা।অর্থাৎ বিণ্যাসের দিক থেকেও এই রচনায় অচ্যুত রাখতে চাইলেন আকস্মিক। ঠিক যেমন কথন ভঙ্গিমাতেও।'দৃপ্ত দিদিমণি'র পাশে সাযুজ্য পাচ্ছে 'সমস্ত চাকর '। 'একটি যুবক' আসছে কিন্তু,তার সমস্ত অনুষঙ্গের ভেতর ফুটে উঠছে কেবল 'বেহালা' আর 'ছাতা'খানি ।যার সঙ্গে সঙ্গে যেন হাসির মীড়কে অনুভব করতে পারছেন,দেখতে পাচ্ছেন শব্দের তরঙ্গদৈর্ঘ্য আঘাত করছে জনৈক বৃদ্ধকে।যে বসে আছে পার্কে।তার সঙ্গে সংঘর্ষ হয় হাসির একটি নির্দিষ্ট স্পন্দের।এই বিমূর্তের বিস্তার ঘটতে ঘটতেই তৈরি হয় আরেকটি আরেকটি ঘটনা জন্মায়।বৃদ্ধকে কেন্দ্র করেই পাঠককে আঘাত করতে চান কবি।হাসির সম্পর্কটিকে মুছে দিতে 'কুয়াশা' আর 'রেডিও'র পাশে এনে বসালেন 'সন্ত্রস্ত' শব্দটিকে। সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের অভিপ্রায় ঘুরে গেল,যেতে বাধ্য হল আরেকটি স্ফিয়ারে।আর 'ড্রাকুলাস' আর 'দুই পরী'র রিকশা নিয়ে 'গল্প ' করতে যাওয়া তো মারাত্মক এক বিনির্মাণ তৈরি করে।কাউন্ট ড্রাকুলার মিথ উপমহাদেশ পেরিয়ে বাবু সংস্কারকে পেরিয়ে পৌঁছে যায় সমকালের সচরাচরে। তীব্র ভাবে প্রত্যেকটা পদক্ষেপে চিহ্ন ও ইঙ্গিত ছড়িয়ে রেখে এগিয়েছেন কবিতার জাদু অনিশ্চিতের দিকে।একই সঙ্গে একটি বিষয় কিন্তু অস্বীকার করার জো নেই,এ রচনাতেও কবি কিন্তু অক্ষরবৃত্তের আট দশ মাত্রার সনেট প্রবণতাকেই মূল ভিত হিসেবে রেখে তবে বিণ্যাসের উচ্চাবচতা তৈরি করেছেন। এক্ষেত্রে বলা যায় ,জাদু তৈরি হল,তবে, তৈরি হল বাংলা কবিতার নিজস্ব অভ্যাসেই।
জগৎ এবং গৌরি সংবাদ
__________________________
আমরা এও দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদের চারপাশের দৃশ্যাবলি থেকেই বেরিয়ে আসছে জাদু এবং জাদুর উপাদান। এবং এই উপাদানগুলি প্রধানত তুলে ধরছে একটি সময় পর্বের, একটি কালখণ্ডের এমন কিছু চিহ্ন,যাদের মাধ্যমে আমরা খুঁজে পেতে পারি কবির অনুভবের অবস্থানটিকে, তেমনই একটি নৈর্ব্যক্তিক মনস্তস্ত্বের পরিস্থিতিকেও বোঝা যায়,যা কবির বসত কালকে প্রতিনিধিত্ব করে।নব্বই থেকে ভারতীয় সামাজিক পরিস্থিতি যে দিশা ও চারিত্র্য পেতে শুরু করল জাদু বাস্তবতার জন্ম অন্তত পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতায়, বলে যে বিশ্বাস পোষণ করেছি,তাকে আরও সমর্থন দিতে গেলে অবশ্যই প্রয়োজন হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতার উদাহরণ।
এক্ষেত্রে 'মংপো লামার গল্প 'বইটির প্রথম রচনাটিকে ব্যবহার করা যাক না এই আলোচনার স্বভাবকে ভেঙে।কেননা অনেক সময় দেখা যায়,গদ্য তার স্বভাবকে অতিক্রম করে আরও বহুস্তরিক হতে চাইছে।যেমন 'জেন' গল্পের আদলে তৈরি হওয়া এই রচনাটি,
"আকাশ যেখানে শেষ হয়েছে,সেখানে ভালবাসা থাকে।এই শুনে এক
গাধা সেই আকাশের দিকে হাঁটতে শুরু করল।পথ আর ফুরোয় না।আর সেকি পিচ্ছিল রাস্তা!দু'পাশে অসম্ভব খাদ নেমে গেছে।তার তল নেই কোনও। অনেক নিচ থেকে শোনা যাচ্ছে শহরের গান। অনেক নিচ থেকে উঠে আসছে শহরের আলো। সেইসব শব্দ আর আলোগুলো যেন আকাশের দিকে হাত মেলে আর্তনাদ করছে।বিলাপ করছে। কিন্তু গাধার পথ আর ফুরোয় না।সে বুড়ো হতে হতে হঠাৎ একদিন টের পায় চলার শক্তি হারিয়েছে সে।
এমন সময় তার হাত ধরে এক নরম মেঘ।সে বলে, তুমি এবার চলো।আমি তোমাকে প্রাণ দেব।গাধা ভাবে এর নাম বোধহয় ভালবাসা।সে খুশি হয়।ভাবে পথ ফুরল।মেঘ বলে,আমি তো ভিজিয়ে দিতে এসেছি তোমাকে । আমার তো ঘর আছে।চলে যেতে হবে।আপাতত চলো। তারপর একা যেও।সকলকে একা যেতে হয়।
মেঘ চলে যায়।গাধা দেখে সামনে আকাশ।আরও দূরে উঠে গেছে।ভাবে ভালবাসা এত কষ্ট দেয় কেন?তার কী শ্বাসকষ্ট হয় না?
গাধা এগিয়ে যায়।
তার শ্বাস থেমে আসে ।
সে পড়ে যায়।উল্টে পড়ে দেখে আকাশ নেমে আসছে তার দিকে। সমস্ত আকাশ খুব দ্রুত নেমে আসছে।
গাধা আর কিছুই বলতে পারে না।
তার চোখ দিয়ে শুধু জল পড়ে,আর সে বুঝতে পারে,এক ফোঁটা চোখের জল কয়েক হাজার কিলোমিটারের মতো।
গাধা আর ভালবাসা খোঁজে না।"(বুদ্ধ)
আগেই বলা গিয়েছে যে,বাস্তবতাকে দেখার একটা প্রেক্ষণবিন্দু এই জাদু বাস্তবতা।একটা কাচ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।যার ভেতর দিয়ে দেখলে চরিত্রের অবয়ব ও সংস্থান বদলে যেতে পারে। তারা ভিন্ন মাত্রায় দেখা দিতে পারে।এই অনিশ্চিত অথচ সম্ভাবনাগুলোই কবিতাকে জাদু বাস্তবিক করে তোলে বলে মনে হয়।এমন প্রতিবেশ রচিত হয়,যার ফলে খুব চেনা দৃশ্যগুলোকেও অপিরিচিত মনে হতে থাকে।
উদ্ধৃত কবিতাটিতেই ধরুন না,একটি গাধা জেনে ফেলল ভালবাসা কোথায় থাকে! কিন্তু এই সূচনারও পূর্বাহ্নে কিছু কথা রয়েছে।একটি গাধা, এমন একটি গাধা,যে জেনে গেছে ভালবাসা বলে কিছু আছে।সে জেনেছে কেমন করে? কিন্তু,এবার প্রশ্ন,সে শুনেছে ভালবাসার বসত সম্পর্কে।কে তাকে বলল?সেই বা জানল কী করে!ভালবাসার কাছেই বা কেন গাধাকে যেতে হবে? একটি পূর্ব নির্ধারিত ধারণার বশবর্তী হয়ে এগোনো?নাকি নিয়তির মতো একটি নির্দিষ্ট অনুভবকে কবি ব্যবহার করতে চেয়েছেন,যার মিথ আছে কিন্তু জায়মান নেই! কিংবা সেই কখনও ঘটতে না পারা অস্তিত্বের খোঁজ করা? অস্তিত্ব বলতে ঘটনাকে চিহ্নিত করতে চাইছি।যা পূর্বনির্ধারিত নয়,যার ঘটমানতার ব্যাখ্যা হয় না,তাকেই খুঁজতে যাওয়া? খুঁজে পাবে না জেনেও তাকে খুঁজতে যাওয়ার বিভ্রান্তি?
শেষতক গাধা বোধহয় বুঝতে পারে। খুঁজতে যাওয়াটা অর্থহীন।এতটাই বিশাল হয়ে উঠতে পারে,এক একটা মুহূর্ত যে তাদের নির্ধারণ করাটা একধরনের বোকামি।কারণ তারপরেই চলে আসছে আরেকটি নির্ধারণের দায়। আবার কোনও নির্ধারণই সম্পূর্ণ নয়। কেননা ভালবাসা কেবল এক ফোঁটা চোখের জল নয়। অনিঃশেষ ফোঁটার সমাহার।আর একটি ফোঁটা কয়েক হাজার কিলোমিটার ব্যাপ্ত।
এখন,দেখা যাক,নব্বই দশকে লিখতে শুরু করা হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতা কীভাবে জাদু বাস্তবতার দৃষ্টি নিচ্ছে!
এক্ষেত্রে আমরা ব্যবহার করতে পারি 'এসেছি রচিত হতে ' কাব্যটির কিছু উদাহরণ।
"উঠোনে রোদ্দুর পড়ে।অল্প কিছুক্ষণ ।ভেজা ভেজা মেঝের গায়ে কত পায়ের চিহ্ন,কত ঘর পোড়া ভয় !ডানা ঝাপটানোর পালক পড়ে থাকা সে উঠোন,তোমায় ভালোবেসেছিলাম একদিন।এক কোণে এবড়খেবড় একটা তুলসী গাছ ,অল্প কিছু শ্যাওলা।উপরের দিকে তাকালেই কিছু শোক ও স্বাস্থ্যহীন মুখ করুণার মতো তাকিয়ে রয়েছে ।তোমায় আমি চেয়েছিলাম একদিন ।ওই সদর দরজা দিয়ে যে রাতে বর্গীরা দখল করেছিল এই বঙ্গদেশ,মহাকাল হেসেছিলেন।সেই হাসির শব্দ আমার বুকে বেজে উঠত।আর মাথার ওপর আকাশ নেমে আসত রোদ্দুর,এই হেমন্তকালেও। আমার শীত লাগত না।"(গান্ধারী)
বস্তুত স্বভাব অতিক্রম করে পূর্বের 'মংপো লামার গপ্প 'থেকে উদাহরণ ব্যবহার করার এটাও একটা অন্যতম কারণ,যে,এই সূত্র ধরেই উপনীত হতে চাইছি আরেকটি প্রসঙ্গে।যা,পূর্বেও চর্চিত।আগের উদাহরণগুলিতে রচনার 'পদ্য' স্বভাব প্রত্যক্ষ। কিন্তু, হিন্দোল এক্ষেত্রে লুকিয়ে ফেললেন সেই স্বভাবকে। বরং অনেক বেশি গদ্যের কাছাকাছি আসতে চেষ্টা করলেন।বলা ভাল গদ্য -পদ্যের ভেদরেখা থেকে এমন একটা দিকে চলে যেতে চাইলেন,যার ওপর কেবল ক্যাথারসিসের দাবি। তবুও কী গীতলতা গেল রচনার শরীর থেকে?,যাওয়াটা খুব বেশি বাস্তবোচিত নয় বলেই অনুমান করি। কেননা বাংলা ভাষা,চলিত ও তৎসমপ্রবণ বাংলা থেকে লিরিক দূরীকরণ অসম্ভব। এবং এটাই,এই স্বভাবটাই হয়তো বাংলা কবিতার একান্ত নিজস্ব একটা ভূগোল গড়ে দিতে সহায়ক হয়েছে।সাব্যস্ত করেছে তার স্বভাবকে।
এবং এখানে আরও নতুন একটি স্বভাব এসে জুড়ছে।এই কবিতায় তৈরি হচ্ছে একটি নির্ভার অবস্থান।একটা দায়হীনতা।এ কবিতা জোর করে বলতে চাইছে না কিছুই,কেবল কয়েকটা মুহূর্তকে , কয়েকটি স্মৃতিকে পাশাপাশি রেখে দিচ্ছে।রোদ্দুর,ভেজা মেঝে,ডানা ঝাপটানোর পালক, এবড়খেবড় তুলসী গাছ তাই অনায়াসে পাশাপাশি বসতে পারে।একই মুহূর্তের সহযাত্রী হতে পারে জনৈককে জনৈকের ভালবাসার স্মৃতি।কিংবা বর্গীর আক্রমণ অথবা হেমন্তকালের রোদ্দুর নেমে আসার স্মৃতি। বস্তুত সময় আর অবস্থান ক্রমাগত পাঠকের আকাঙ্খাকে ভেঙে দিয়ে দুটো সমান্তরাল বাস্তবকে একসঙ্গে দেখতে চাইছে।জাদুর পরিধি বাড়ল।কথপোকথন ভঙ্গিমা তৈরি হল। এবং অবশ্যই এল অনির্ধারিত চলন।
এই কথপোকথনের ,কথকতার ভঙ্গিটা কিন্তু আমরা লাতিন আমেরিকার জাদু বাস্তবতাবাদেও লক্ষ করে থাকি। শুধু তাই নয়,আমরা এভাবেও বলতে পারি, মানুষের গল্প শোনার অভিপ্সাকে ব্যবহার করে জাদু বাস্তবতা। বাংলা উপন্যাসেও কী আমরা এই পদ্ধতি অবলম্বন করতে দেখিনি। অলৌকিককে বিশ্বাস করেই এমনভাবে কথকতা এসেছে 'হাঁসুলী বাঁকের উপকথা 'য় ,যে,তার অভিঘাতে একটি জায়মান বাস্তবতা তৈরি হয়।সুচাঁদের রামায়ণ পাঠের বর্ণনায়,বলা ভাল ,গোটা হাঁসুলী বাঁকের প্রতীবেশটাই হয়ে উঠেছিল উপকথাময় জাদুর। হয়তো তারাশঙ্কর সচেতন চেষ্টায় এই জাদুর উপকরণ ব্যবহার করেননি।হয়তো তাঁর দেশজ মনস্তস্ত্ব এটা করিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু বাংলা উপন্যাসের প্রেক্ষিতে এই জাদুকে অস্বীকার করার উপায় কী!
হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতায় সেই প্রক্রিয়ার জায়মানতা আমরা যেমন দেখতে পাচ্ছি,একই সঙ্গে কিন্তু বর্ণনা এমন একটি পরিবেশ তৈরি করছে,যা সচরাচরের নয় অথচ সচরাচর থেকেই সংগৃহীত।যদি আরেকটি কবিতার পাঠ নিই,
"কলকাতার পশ্চিম আকাশে দুটি চিল উড়ে বেড়ায়। আমি দেখি ছাদ থেকে ভালো ওড়ার ভঙ্গি। ঈশ্বরের মতো হাবভাব। মৃত্যুর মতো নীরবতা। আদরের মতো ডানার ঝাপট। তাদের দুচোখও যে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, সেটিও বুঝি। মধ্য কলকাতা থেকে গঙ্গার দিকে, যেখানে কুয়াশায় হাওড়া ব্রিজটিকে মায়াবী মনে হয়, সেদিকে উড়ে যায় এই দুই চিল। যতক্ষণ বিন্দুর মতো লাগে, আমি দেখি। সব রোদ তাদের দিকে ছুটে গেছে মনে হয়। দূরে, গঙ্গার ধারে আকাশের দিকে উঁচু হয়ে আছে স্তম্ভ ।ধোঁয়া বেরোয় অনর্গল।
যে শহরে নদী নেই, সমুদ্র নেই, তার জীবনের কথা ভাবি। জল, আমি তোমার কাছে হাঁটু মুড়ে বসেছিলাম একদিন। ইকবাল মিয়াঁর নমাজের মতো। গঙ্গাপুজোর মতো তিনি পশ্চিমের দিকে তাকিয়ে ঘাটে বসে নমাজ পড়তেন। অস্তগামী সূর্যের আলো এসে পড়ত তার কপালে। আকাশে ওলোট পালোট করত একঝাঁক কালো কালো পাখি। আর আরও উপরে সেই দুটি চিল ঈশ্বরের চোখের মতো তাকিয়ে থাকত এই শহরের দিকে।
এখনও এক ঝাঁক পাখি উড়ে যায় গোধূলির দিকে। রাজমিস্ত্রীদের ঘামের গন্ধের মতো চৈতণ্য হোক, বলি। আমি দাঙ্গা দেখিনি কোনও নকশাল আন্দোলন দেখিনি, যুদ্ধবিমান থেকে আমার শহরে নেমে আসেনি কখনও তিরিশ কেজির মৃত্যু। শৈশব থেকে দুটি চিল শুধু পশ্চিম আকাশে ওড়ে, দেখেছি, কোনও বিবাহ ছাড়াই। কখনও কখনও পাক খেতে খেতে নেমে আসে লক্ষ রাখে নিয়তির মতো।
আমি তাদের দেখতে পাই, ওড়ার ভঙ্গিমা দেখে বুঝতে পারি তারাও, আমাকে দেখছে। আর সতর্ক করছে। মেঘ জমছে, অন্ধকার জমছে , চাঁদ ও তারাও জমছে । অন্ধকারে এসব কিছুই দেখা যায় না সন্দীপন,আলো যখন সূর্য হয়ে ওঠে তখনও না।"(পাশ্চাত্য)
কবিতাটির দিকে মনোনিবেশ করলেই প্রথমেই যেটা চোখে পড়ে খোলা চলন।কোনও একটি প্রসঙ্গ ধরে এগোচ্ছে না সে।একটি প্রসঙ্গের সূত্র ধরে ঢুকে পড়ছে আরেকটি প্রসঙ্গে।যেন একটা খেয়াল। নিজের সুরের চলন নিজেই তৈরি করে নিচ্ছে।এ কবিতাও যেন সেই স্বাধীন ও স্বস্তস্ফূর্ত এবং অপূর্বনির্ধারিত হয়েই চলতে চাইছে।হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতায় এই 'অপূর্বনির্ধারিত' শব্দটি ভীষণভাবে জরুরি হয়ে পড়ে।
কেন জরুরি?দিশা ঠিক না করে এগোনোর সার্থকতাই বা কী?এই প্রশ্ন দুটির সামনে দাঁড়িয়ে আপাতত যা মনে হয়,জাদুর অন্তত যে কোনও রকম জাদুই শেষ পর্যন্ত আপনার ধারণাকে ভেঙে আপনাকে হতচকিত দিতে চাইছে।এমন একটি উপস্থাপনা ঘটাতে চাইছে,যার কোনওরকম সম্ভাবনা আপনি টের পাননি।টের পাওয়ার মতো কোনও ইঙ্গিতই রাখতে চায় না জাদু।হিন্দোলের কবিতায় সেই অসম্ভবের বাস্তবতা আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে। একটা নির্দিষ্ট ধারণার বশবর্তী হতে পারেন না পাঠক।একই সঙ্গে প্রসঙ্গান্তরে যেতে যেতে পূর্ববর্তী প্রসঙ্গ থেকেও সরে যেতে থাকেন।একই সঙ্গে একাধিক পরিস্থিতি সমান্তরালভাবে তৈরি হতে থাকে।একটি অংশ উদ্ধৃত করলে সম্ভবত ধারণার সাপেক্ষে মুক্তি দেওয়া যাবে,
"এখনও এক ঝাঁক পাখি উড়ে যায় গোধূলির দিকে।>রাজমিস্ত্রিদের ঘামের গন্ধের মতো চৈতণ্য হোক,বলি।>আমি দাঙ্গা দেখিনি কোনও,নকশাল আন্দোলন দেখিনি ,যুদ্ধবিমান থেকে আমার শহরে নেমে আসেনি কখনও তিরিশ কেজির মৃত্যু ।"
উদ্দেশ্যহীনভাবে সময় থেকে সময়ে যেতে যেতে হিন্দোল একটা কোলাজ তৈরি করে ফেলেন।যাতে ফুটে উঠতে থাকে মানবিকতার আরেকটি রূপ।আরেক বিকারে ফুটে উঠতে থাকে পরিপার্শ্ব।যার পাশাপাশি চলতে থাকে আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ পৃথিবী। তাদের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তৈরি হয়। আবার তারা অনায়াসেই পরস্পরের সঙ্গে অসংলগ্ন হয়,
'শৈশব থেকে দুটি চিল শুধু পশ্চিম আকাশে ওড়ে,দেখেছি,কোনও বিবাহ ছাড়াই।'
কবি কোনও সিদ্ধান্ত নিলেন না কিন্তু।কেবল একটি দৃশ্যের চিত্র এঁকে দিলেন,কেবল তার একটি বৈশিষ্টকে কেবল বলে দিলেন, চিহ্নিত করে দিলেন 'বিবাহ ছাড়াই '। সর্বোপরি 'ওড়ে' ক্রিয়াপদ ব্যবহার করে বাক্যটিকে একটি ঘটমান বর্তমান দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যটি কবিতার সঙ্গে সংযুক্ত থেকেও আরেকটি আলাদা প্রসঙ্গের জন্ম দেয় যেমন,তার এই বায়ু নির্ভর গতি অবদমিত হয় না।গতি প্রাবল্য নেয়।সে এগোতে এগোতেই ভঙ্গি পাল্টাতে থাকে গতি ।এই পাল্টে যাওয়াটুকুকেই রেখে দেন কবি।বাকি আর কিছু অনির্দেশ্য হয়ে উঠতে থাকে।জাদু বাস্তবতার অনিশ্চয়তার স্বভাবকে ধারণ করে হিন্দোল ভট্টাচার্য তাঁর কবিতাকে একটি খোলা জায়গা দেন।'জায়গা' শব্দটিকে ব্যবহার করলেও একটি সীমা চলে আসে। বরং হিন্দোল ভট্টাচার্যের জাদু বাস্তবতায় দেখা যায় কেবল ওই খোলামি।ওপেননেস পাঠককে দেয় আরও অধিক বহুমুখীতা, পিচ্ছিল অনুষঙ্গ।
আপেলে নির্মীত শহরের ছায়াছবি
_________________________________
রচনা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট দীর্ঘ হয়েছে। এবার ইতি টানার প্রয়োজন। কিন্তু, অংশুমান করের কবিতাকে এই প্রস্তাবে ব্যবহার না করলে খামতি আরও বাড়বে।সদ্য আলোচিত হিন্দোল ভট্টাচার্যের মতোই তাঁরও কবিতা লেখার শুরু নব্বই দশকে।'আপেল শহরের সম্রাট '(২০০১) -এই জাদু বাস্তবতার সবচেয়ে বেশি প্রভাব থাকলেও এক্ষেত্রে ব্যবহার করব 'মিমিজান' কাব্যের প্রসঙ্গ।
ইতিপূর্বে আলোচিত হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতায় আমরা দেখতে পেলাম গদ্য আর পদ্যের ভেদ মুছে এমন একটি ভাষার আয়োজন হয়েছে,যা সর্বাঙ্গিনভাবে পাঠকের দার্শনিক বোধের কাছে আবেদন জানায়।প্রবণতাটি অংশুমান করের কবিতাতেও সমানভাবে দেখতে পাচ্ছি। এবং কথপোকথনের ভঙ্গিমাকেও মনে রেখে বক্তব্য পরিচ্ছন্ন করার জন্যে একটি কবিতার উদ্ধার প্রয়োজন,
"মিমি দিদিমণি চলেছেন। তাঁর হাসি থেকে ঝরে ঝরে পড়ছে পুটুস ফুল। তাঁর নূপুরে বাজছে মাদল।লতামণি সরেন তাঁকে ভাবছে সরস্বতী ঠাকুর।গড় হয়ে প্রণাম করছে।মিমি দিদিমণির সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। তিনি চলেছেন। তাঁর কেশরাজি ধূম্রবৎ,যেন ছোটো পাহাড়ের শীর্ষ।কটিবন্ধে,কেউ জানে না,রাজারকুমারের দেওয়া মুকুর লুকোনো।সেই মুকুরে তিনি মাঝে মাঝে দেখে নেন স্বীয় বিম্ব।দেখে নেন লতামণি সরেন তাকে সরস্বতী ঠাকুর ভাববে কি না।এই জঙ্গল ও ছোটো পাহাড়ের দেশে এসে তিনি ভুলে যেতে চান তাঁর স্বর্গ নিবাস।ভুলে যেতে চান সর্পশয্যায় অন্তিমশয়ানে শ্রীবিষ্ণু।
মিমি দিদিমণি চলেছেন। তাঁর কটিদেশে লুকোনো আছে মুকুর।অন্তরে রাজকুমার। শ্রীবিষ্ণু জেনেছেন। কিন্তু লতামণি সরেন এসব জানে না।সে আর পাঁচজনের মতো ভাবছে মিমি দিদিমণি আসলে সরস্বতী ঠাকুর।"(সরস্বতী ঠাকুর)
আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ করতে পারছি হিন্দোল এবং অংশুমানের কাব্য বোধ কত আলাদা, বিভিন্ন তাঁদের দেখবার প্রেক্ষিত ও কোণ। কিন্তু,কিছু চিহ্নকে দু'জনেই আয়ত্ব করেছেন তাঁদের কবিতায়।
পূর্বেই কিছুটা ইঙ্গিত দেওয়া গিয়েছে বলে আবার বলাটা অতিকথন হলেও মনে থাকার জন্য বলে নেওয়া যাক,
(ক)গদ্য আর কবিতার ভাষার আর্কেটাইপ তফাৎটাকে ঘুচিয়ে দিলেন। বাংলা উপন্যাসে এ প্রচেষ্টা যথেষ্টই হয়েছে বিভূতিভূষণের কাল থেকে। কিন্তু কবিতায় এহেন তফাৎ বিশেষ দেখা যায়নি কিন্তু এর আগে।হয় কবিতা পুরোপুরি কাব্যিক অলংকার খুলে ফেলে গদ্যই হয়ে উঠতে চেয়েছে।নয়তো কবিতা পুরোপুরি কবিতার প্রচলিত আর্কেটাইপকে ধরে রেখেছে। কিন্তু,এই ভাষা কবিতার স্বভাবে গদ্যকে স্থাপন করছে,না,গদ্যের কাঠামোয় নিয়ে আসছে কবিতায় - এই সমাধান দেয় না।তার চলনের স্বভাবকেও অনিশ্চিতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
(খ)কথকতার ভঙ্গি জোরদার হল।কথন ভঙ্গিমা নিল দেশি রীতির চলন।মিমি দিদিমণির চলাচলের খবর পরপর দুই স্তবকে যেভাবে পরিবেশিত হলি,তাতে আপনার মনে পড়ছে উপকথা বলার পদ্ধতি।
(গ)মিমি দিদিমণির ছবি,একটি নির্দিষ্ট আকারে প্রতিষ্ঠা করার পর হঠাৎ তার হাসি থেকে পুটুস ফুলের ঝরে পড়া কিংবা নুপূরে মাদল বেজে ওঠায় পাঠক বিষয়ের ওপেননেস পেয়ে যায়।এখন মিমি দিদিমণিকে কল্পনা করে নিতে পাঠকের অসুবিধা হয় না।যখনই কবি মিমি দিদিমণির বস্তুগত বিবরণ তৈরি করতে যেতেন,পাঠককে তাঁর দৃষ্টির সঙ্গে সাযুজ্য পাওয়ার চেষ্টা করতে হতো।এরফলে কবিতা অনেকটাই অভিপ্রায়িক হয়ে যায় বলেই মনে হয়। এখন,এ কবিতায় অংশুমান কর সেই অভিপ্রায়কে ভেঙে পাঠকের হাতে ছেড়ে দিলেন পাঠকের স্বাধীনতার কাছে।পাঠক তার প্রত্ন প্রতিমাকে ব্যবহার করতে পারেন,অথবা, নিজের জায়মান অবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারেন।
এই কয়েকটি বিষয় হিন্দোল ভট্টাচার্যের কবিতাতেও ভিন্ন উপস্থাপনায় পেয়ে থাকি। সময়ের নিজস্ব চাহিদায় এই বৈশিষ্ট্যগুলি এক হয়েছে নাকি জাদু চেতনার প্রভাবে এই মিল,তা নির্ণয় করার ভার বৃহত্তর পাঠকের। এক্ষেত্রে দেখা যেতে পারে অংশুমান কর আর কী কী রক্ষা করছেন এই কবিতায় ,
১.লোক চিহ্ন।যা বাংলাদেশের নিজস্ব।যেমন, পুটুস ফুল,মাদল।
২.লোকযান ও নাগরিক নান্দিনকতার দুটি সমান্তরাল যাত্রা বজায় রাখলেন।
৩.কটিদেশে মুকুর আর অন্তরে রাজকুমারের সঙ্গে সরস্বতী ঠাকুর ও লতামণি সরেনের যে দ্বান্দ্বিক অবস্থানটি তৈরি করলেন,তাতে,আবহমান মানুষের রাজনৈতিক চরিত্রের উচ্চাবচতাময় স্বভাবটি যেমন পরিচ্ছন্ন হয়, তেমনই,যৌন মনস্তস্ত্বের কী নিপুণ ব্যবহারও চোখে পড়ে।অন্তরে রাজকুমার লুকিয়ে রেখে, এখানে'লুকিয়ে' শব্দটি অত্যন্ত জরুরি,দেবি প্রমাণিত হওয়ার তাড়নায় মানুষের যৌন স্বভাবের বহুতলটিও চোখে পড়ে।
৪.একই সঙ্গে পুরাণের অনুষঙ্গ তৈরি করে অংশুমান বস্তুত বাস্তবতার ভেতরেই,মিমি দিদিমণির চলাচলের ভেতরেই তৈরি করলেন একাধিক বাস্তবতা।কেবল মিমি দিদিমণি আর লতামণি সরেনের দ্বিস্তরিক বাস্তবতা নয়।এক একটি অনুষঙ্গে আখ্যান এক একটি ভিন্ন কথা তৈরি করতে চাইছে।তা,সে পুরাণের অনুষঙ্গেই হোক,আর মুকুরে মুখ দেখার প্রসঙ্গে কিংবা,মাদলের প্রসঙ্গ। কখনও কখনও একান্তই একটি মানচিত্রের কথাও বলে দেয় কবিতাটি।
অংশুমান করের কবিতার এই স্বভাবকে তুলে আনতে আমরা দেখতে পারি আরেকটি বিনির্মাণকে।
'শহর' কবিতাটির কথা বলতে চাইছি। একটা অনাগত সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে বিভিন্নভাবে নির্মাণ করে করে দেখছেন অংশুমান।কেবল তাই নয় গড়ে তুলছেন শহরটির প্রতীবেশকেও,
"ওই শহরে তুমি ট্রেন থেকে নামবে একটু পরে।
হাতে ভারী ব্যাগ।
বয়স হয়েছে।আর তরুণী নও।
হাঁটা বাতাসে ভেসে বেড়ানো শিমুল তুলোর মতো
ওড়া আর নয়,
গন্ধরাজের মতো স্নিগ্ধ, সুন্দর।
একটি কুকুর চেয়ে থাকবে ওই হাঁটার দিকে,
একটি ভিখিরি, একজন টোটো চালক
আর একজন মুগ্ধ যুবক।
এই শহরে তুমি ট্রেন থেকে নামবে একটু পরে।
রোদ্দুর প্রচুর,তবু মনে হবে সন্ধে ঘনাল,
যেন তুমি ট্রেন ভরতি মেঘ নিয়ে এলে।
আমি আর এসবের মধ্যে নেই।
যোগ বলতে এই
যে -শহরে ট্রেন থেকে তুমি নামবে একটু পরে
একদিন সে শহরে আমিও থাকতাম।"
এই কবিতার ভেতরেও নিখুঁত ভারতীয় লক্ষণ ফুটে উঠল।ধ্রুবপদ করে তুলছেন কবি একটি ঘটমানতাকে।আর সেই ধ্রুবপদ ঘিরে তৈরি হচ্ছে অযুত সম্ভাবনা।সম্ভাবনা বলতে একটি সম্ভাব্য ভবিষ্যতের অস্তিত্ব আর একটি সম্ভাব্য অতীতের অস্তিত্বের দ্বন্দ্বের সূত্রে তৈরি হওয়া যাবতীয় বর্তমান। লক্ষ্য করা যাচ্ছে,এই নির্মীত এক একটি বাস্তবতার ফ্রেম,যেমন,'আর তরুণী নও' কিংবা 'একটি ভিখিরি, একজন টোটো চালক।"- সবটাই তৈরি হচ্ছে একটি সম্ভাবনার সূত্রে।এ তো নাও ঘটতে পারে।হয়তো ঘটতে পারে অন্য কিছু। কিন্তু সেই প্রত্যক্ষ বাস্তবের পাশে এই সম্ভাব্য বাস্তবকেও কবি রেখে দিতে চাইছেন,আরেকটি সমান্তরাল বিশ্ব যেন।একটি কুকুর কেন চেয়ে থাকবে রমণীর হাঁটার দিকে -সেই সত্যেই যেন জাদু অপেক্ষা করে।যার অভিঘাতে সে পদযাত্রা 'গন্ধরাজের মতো স্নিগ্ধ ' হয়ে যেতে পারে।এ হয়তো কখনও ঘটে না।অথচ যেন ঘটতেই পারে।এই অনিশ্চয় রচনাটির স্বভাবকে যেমন নির্মাণ করে, তেমনই তাকে জাদু বাস্তবতায় প্ররোচিত করে,তাকে বাস্তবতার ভেতর থেকেই আরেকটি অসচরাচর বাস্তবের নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করে।
বলার কথা
____________
বাংলা কবিতায় চর্যাপদ থেকেই জাদুর ব্যবহার আছে,এ কথা অস্বীকার করা দুস্কর।সে আপনি পাঁচটি শাখা সমৃদ্ধ বৃক্ষের ছবিটিই ভাবুন না,বা,মাদী কাছিমকে দোহন করার বিষয়টিকেই মনে করুন নাই।সমস্যা হল, জাদু মানেই তো জাদু বাস্তবতা বা জাদু বাস্তবতা নয়।কিংবা কখনও কখনও জাদু বাস্তবতার আভাস প্রকট হয়ে উঠলেও তাকে প্রতিষ্ঠা করার কোনও সংহত প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। তাছাড়া এ প্রসঙ্গে এও স্মরণ করা যায় যে,বাংলা কবিতার ইতিবৃত্তে যে ক'টি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল,তাদের প্রায় সবকটিই নির্দিষ্ট পরিসরে গুরুত্ব তৈরি করতে পারলেও বৃহত্তর বাংলা কবিতার বড় রদবদল ঘটাতে পারেনি বলেই অনুমান করি।হয়তো এই উদাহরণের অভিঘাত অবচেতনে ক্রিয়া করেছিল,বলেও হয়তো জাদু বাস্তবতাকে নিয়ে সংহত কোনও প্রচেষ্টা বিশেষ লক্ষ করা যায়নি।নব্বই দশকের বাংলার রাজনৈতিক ও মনস্তস্ত্বাত্ত্বিক পরিস্থিতি হয়তো জাদুর আশ্রয়ে যেতে বাধ্য করেছিল কবিদের।এমন একটা সময় যখন 'গোপনীয়তার নেই মালিকানা '(কবীর সুমন)।এমন একটা সময়,যখন আপনার সমস্ত ব্যক্তিগত তথ্য রাষ্ট্রের দখলে চলে যাচ্ছে ও সংরক্ষিত হচ্ছে। এমন একটি সময়,যখন,আপনার প্রতিটি মুহুর্তস'কে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।এই 'রাষ্ট্র' বললে একটি নির্দিষ্ট মানচিত্র ও তার নির্বাচিত সরকার বুঝলে কিন্তূ ভুল হবে।এই রাষ্ট্র মানে একটি বৃহত্তর পুঁজির সংহত স্বভাব। এবং এই 'দেশ ' বিষয়টিকেও আর প্রাধান্য দিতে চাইল না মুক্ত বাণিজ্যের ধারণা;তখন অনায়াসে আপনার 'রাষ্ট্র' হয়ে যাচ্ছে সুইডেন কিংবা কানাডা অথবা সুইজারল্যান্ডের কোনও অর্থনৈতিক সংস্থা।ফলত এই বদলে যেতে শুরু করা ভৌগলিক ধারণা এবং সমাজ বোধ হয়তো কবিকে প্ররোচিত করে কোড তৈরি করতে। প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধ কিংবা আত্মীকরণের কোড।
ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়েছে নব্বই দশক থেকেই যথাযথভাবে বাংলা কবিতায় জাদু বাস্তবতার প্রসার শুরু হয়েছে। এবং তা হয়েছে নব্বই দশকের কারণেই।ধীরে ধীরে এই প্রবণতা দৃঢ় হচ্ছে,বিবিধ প্রসঙ্গ তৈরি করছে,আরও অনিশ্চয় ও অনিঃশেষের দিকে যেতে চাইছে।এই আকাঙ্খাটুকুই তো আসলে পূণর্জন্মের ঈশারা।
*১ One million people have fled Chile, a country with a tradition of hospitality – that is, ten per cent of its population. Uruguay, a tiny nation of two and a half million inhabitants which considered itself the continent’s most civilized country, has lost to exile one out of every five citizens. Since 1979, the civil war in El Salvador has produced almost one refugee every twenty minutes. The country that could be formed of all the exiles and forced emigrants of Latin America would have a population larger than that of Norway.
I dare to think that it is this outsized reality, and not just its literary expression, that has deserved the attention of the Swedish Academy of Letters. A reality not of paper, but one that lives within us and determines each instant of our countless daily deaths, and that nourishes a source of insatiable creativity, full of sorrow and beauty, of which this roving and nostalgic Colombian is but one cipher more, singled out by fortune. Poets and beggars, musicians and prophets, warriors and scoundrels, all creatures of that unbridled reality, we have had to ask but little of imagination, for our crucial problem has been a lack of conventional means to render our lives believable. This, my friends, is the crux of our solitude.( Nobel Lectures, Literature 1981-1990, Editor-in-Charge Tore Frängsmyr, Editor Sture Allén, World Scientific Publishing Co., Singapore, 1993)
*2 নৈরঞ্জনা নদীতে দীর্ঘ কৃচ্ছ্র সাধনের পর স্নান করে বুদ্ধদেব সুজাতার হাতের পায়েস গ্রহণ করেন ।
সহায়ক পাঠ:
1)The Concise Oxford Dictionary of Literary Terms (3rd ed.). Oxford University Press. 2008
2)Collins dictionary
3)Nobel Lectures, Literature 1981-1990, Editor-in-Charge Tore Frängsmyr, Editor Sture Allén, World Scientific Publishing Co., Singapore, 1993)
১.বঙ্গীয় শব্দকোষ: হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
২.উপন্যাস নিয়ে:দেবেশ রায়
৩.জাদু বাস্তবতাবাদ প্রয়োগ ও পরম্পরা:হামীম কামরুল হক
৪.উইকিপিডিয়া
৫. আন্তর্জাল
ঠিক আছে দাদা
Hide quoted text
On Tue, Sep 5, 2023, 11:07 Hindol Bhattacharjee <hindol.myself@gmail.com> wrote:
একটা ওয়ার্ড ফাইলে দাও
সব ভেঙে গেছে
Hindol Bhattacharjee
Creative Consultant
C3/6 Kalindi Housing Estate, Kolkata -700089
9051781537/8240711621/ hindol.myself@gmail.com, hindolspeaks@gmail.com, abahaman.magazine@gmail.com,
web: www.abahaman.com
On Tue, 5 Sept 2023 at 02:02, sabyasachi Majumder <sabyasachimajumder619@gmail.com> wrote:
বাস্তবতার জাদু ও জাদুপ্রবণতা এবং বাংলা কবিতার একটি অংশ
সব্যসাচী মজুমদার
জাদু বাস্তবের প্রসঙ্গে
তত্ত্ববিশ্বের জায়মানতার ওপর নির্ভর না করেও বা তত্ত্ব বিশ্বকে কোনওভাবে না জেনেও আমরা বাংলা কবিতায় কী সেই জাদুকে খুঁজে পাই না,যার প্রকোপে আমাদের জটিল অ্যালিস একটি ওয়ান্ডারল্যান্ড খুঁজে পেতে পারে!এমন একটা ভূখণ্ড যেখানে আপনার সর্বৈব স্বাধীনতা ঘটতে পারে।অবশ্যই এক্ষেত্রে বিনির্মাণের স্বাধীনতার কথা বলতে চাইছি।
দৃশ্যের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে দৃশ্য।যাদের সঙ্গে আপনার জায়মান বাস্তবের দৃশ্য সম্পর্ক ক্রমশঃ সুদূরবর্তী হয়ে উঠছে । কিন্তু আপনি সে দৃশ্যের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারছেন আপনার গহিনতম পরিস্থিতিকে। আপনার অবলোকিতের ভেতর গড়ে উঠছে আপনারই অবয়ব।
সে যাই হোক, বাংলা কবিতা পড়ার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে যখন জাদু এবং বাস্তবতার কথা উঠলই ,একবার দেখে নেওয়া যাক সাহিত্য ক্ষেত্রে জাদু বাস্তবতা কীরকম স্বভাব যাপন করতে পারে,
" Magical realism portrays fantastical events in an otherwise realistic tone. It brings fables, folk tales, and myths into contemporary social relevance. Fantasy traits given to characters, such as levitation, telepathy, and telekinesis, help to encompass modern political realities that can be phantasmagorical.(The Concise Oxford Dictionary of Literary Terms (3rd ed.). Oxford University Press. 2008)
বস্তুতপক্ষে এই উদ্ধৃতিটি কিন্তু তাত্ত্বিক জাদু চেতনা বিশ্বের বহু বিস্তৃত দিক তুলে ধরে। আমরা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করতে পারছি অতীত থেকে লোকযান, ইতিহাস থেকে জনবিশ্বাস পর্যন্ত বিস্তার নিয়েছে এই কৌশল। এবং,সমস্তটাই ঘটেছে সমসাময়িকের প্রেক্ষিতে।যদিও 'সমসাময়িক' কথাটা বোধহয় একটু টীকা চায়। 'সমসাময়িক' বলতে বোঝাতে চাইছি ,একটি অদূর অতীতকে।যে সময়টুকুতে বাঁচছি,তার সঙ্গে সংলগ্ন একটি মোটামুটি করে বিগত একশো বছরকে 'সমসাময়িক' বলতে চাইছি। এবং এই কথাটিও মেনে নিতে হচ্ছে যে আমার জায়মানতা আংশিক নিয়ন্ত্রিত হয় একটি অদূর অতীতের প্রভাবে। এটা আলোচনার জন্য একটা সীমা প্রস্তত করে নেওয়া মাত্র। কেননা,এই সময়পার্বিক বিনির্মাণের প্রশ্নে একটি বিরাট আংকিক প্রসঙ্গ তৈরি হয়।তার বিস্তার এতটাই বিশাল যে সেখানে 'ভ্রমি বিস্ময়ে '-র আয়াসে নিয়োজিত না হয়ে এই সীমা নির্ধারণ করে নেওয়া জরুরি। তাছাড়া উদ্ধৃতিটিতে 'morden political realities ' কে জরুরি প্রচ্ছন্ন উপাদান বলেও মনে করা হচ্ছে।কাজেই সময়টাকে নির্দিষ্ট করা জরুরি।
একই সঙ্গে কিন্তু মার্কেসের ১৯৮২ সালে নোবেল বক্তৃতার একটি অংশকে মনে করতে চাইছি, *১যেখানে তিনি বলতে চাইছেন এই 'বিশাল বাস্তবতা'কে লাতিন আমেরিকার বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব নয়। সেই সূত্রে কী এই বিশ্বাসে স্থিত হতে পারি না কী,যে, মানচিত্র সাপেক্ষে বদলে যেতে পারে জাদু বাস্তবতার উপাদান ও ভঙ্গিমা এমনকি উপস্থাপনও!তাকে আর পূর্ব পরিচিত জাদু বাস্তবতার মতো মনে নাও হতে পারে।
এই ধারণাকে উদাহরণ দেওয়ার জন্য চেষ্টা করব বাংলা কবিতার যে ক'জন কবি এই কাজটি সম্পন্ন করেছেন, তাঁদের কয়েজনের কবিতা পড়ে দেখতে।
শরৎ মেঘ ও কাশফুলের কবি
_______________________________
মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা বিচিত্র পরিবহনে উতরোল।প্রভূত আলোচনা তাঁর কবিতা সম্পর্কে ইতিপূর্বে রচিত হয়েছে।প্রাজ্ঞ সে সব আলোচনা মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতাকে পাঠকের কাছে যথাযথ উপস্থাপন করেওছে। তবুও এই রচনার প্রয়োজনের কৈফিয়তে বলা যায়,এটা একান্তই জনৈক পাঠকের অভিজ্ঞতা মাত্র।যে অভিজ্ঞতা থেকেই মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতায় তন্ত্র কতটা স্থান দখল করেছে সে সন্দেহও উদ্গত হয়।
'শরৎমেঘ ও কাশফুলের বন্ধু 'প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে।সময় হিসেবে এই দশকটি আমাদের দেশের পক্ষে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।আমরা যদি মনে করি, এই তথ্য আমাদের কাছে অপরিচিত হবে না যে,বিগত শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক চিন্তা মার্ক্সিজম তখন গোটা পৃথিবীর কাছে, বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বের কাছে প্রশ্ন ও সন্দেহের মুখে।নব্বইয়ের গ্লাসনস্ত এবং পেরেস্ত্রৈকার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। মোটামুটিভাবে স্বপ্নভঙ্গ ঘটছে ও স্বপ্নের স্বরূপটি তখন উদ্ভাসিত হচ্ছিল,সেই সময়ের ভারতীয়…বলা ভালো, বাঙালি মনন কিন্তু তার রাজনৈতিক নিস্তার চাইল মার্কসের চিন্তার ওপরেই। এবং গড়ে তুলতে চাইল একটি কাল্পনিক যৌথখামারকে।সেই রাজনৈতিক আয়াস কতটা সাফল্য পায়,সে বিষয়ে এ আলোচনা অগ্রসর না হয়ে বরং নব্বইয়ের মানচিত্রে লক্ষ্য রাখতে চাইছে।মানে,সে সময়ের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মানচিত্রের ওপর। দেখা যাচ্ছে,
১.মুক্ত বিশ্ব ধারণা কেবল টিভির মাধ্যমে ওতপ্রোত হয়ে উঠছে।
২.বাংলা দেশের কবিতার কাছে কম্পিউটার ও আন্তর্জাল একটি নতুন অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখা দিচ্ছে,পশ্চিবঙ্গের বাঙালিরা কী করা উচিত - এ তর্কে বিভ্রান্ত।
৩.যোগাযোগ স্হাপন সুবিধাজনক হয়ে উঠতে শুরু করল, আর, তথ্য সংরক্ষণের পাশাপাশি তথ্য সরবরাহের আগ্রাসনও দেখা দিতে লাগল।
মোট কথা,আশির দশকের পর থেকেই সময় দ্রুত বদলাতে শুরু করল। এবং প্রশ্ন করার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ তৈরি হতে শুরু করল। তখন পাঠকের কাছে কেবল মার্ক্স আর ফ্রয়েডই নয়,আরও বেশ কিছু নাম পরিচিত হতে শুরু করেছে।
এইরকম একটা উচ্চাবচতাময় সময়ে মণীন্দ্র গুপ্ত প্রশ্ন তুলছেন,
"পশু থেকে যোদ্ধা,যোদ্ধা থেকে মহাপুরুষ হতে
তারাদের ক'কোটি বছর লেগেছে -"(তিব্বতী)
আবার একই সঙ্গে সংশয়মান অনুভব করছে,
"যেন ঘন কুয়াশার মধ্যে চিমনি পরানো লণ্ঠনের আলো নিয়ে
কেউ পথ খুঁজছে।(তিব্বতী)
কেন তাকে পথ খুঁজতে হচ্ছে সেই নব্বইয়েও?কেন সে নিশ্চিন্ত ' লাল টুকটুকে দিন '-এর দিকে নিঃশংসয় এগোতে পারছে না? কেন 'ঘন কুয়াশা ' হয়ে রয়েছে তখনও?
- এ সব প্রশ্নের মুখোমুখি থেকে নিস্তার পেতে পরবর্তী কবিতার কাছে গেলেই সেও কিন্তু এমনই একটি সমাধানহীন প্রশ্নের উথ্থাপন করছে যে, বস্তুত এই পাঠকের বারবার মনে পড়ছে আশির শেষ থেকে নব্বইয়ের প্রথম প্রহরের উত্তেজনাময়, উদভ্রান্ত সময়ের ছবিটাই…
"গা থেকে রঙিন পালক,বাড়তি পালক ঝেড়ে ফেলি
কেননা আমি-যে উঁচুতে যাব সেখানে এখনও কোনও পাখি ওড়েনি,
শরীরের সব কাঁটা আর শল্ক উপড়ে ফেলি
কেননা আমাকে এক চুলচেরা ফাটলের ফাঁক দিয়ে এমন এক দেশে যেতে হবে
যেখানে কোনও সরীসৃপ পৌঁছয়নি।"(শরৎমেঘ ও কাশফুলের বন্ধু)
আরও আরও বেশি করে খোঁজ হতে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে।তাঁরা স্বপ্নের ভেঙে যাওয়াটিকে স্বীকার করে নিয়ে যেভাবে নতুন জটিলতাকে, নতুন বহকৌণিক বেঁচে থাকার পদ্ধতিকে ভেবে ওঠার চেষ্টা করছিলেন,সেই অনুরণন কী নব্বইয়ের প্রারম্ভেই মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতায় উপস্থাপিত হয়েছিল নাকী!সেই সময়ের নতুন বাংলা কবিতা যখন ব্যালাড নির্ভর শরীর প্রেম, আঞ্চলিক দীনতার লড়াই,দেশ বিভাগের স্মৃতি, নারী স্বাধীনতা, ঐতিহ্য ও তাকে বিনির্মাণ, শ্লেষ আর আরবান হয়ে ওঠার ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠতে চাইছিল, ঠিক সেই সময়েই এই বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির দিকে নজর ফিরিয়ে মণীন্দ্র গুপ্ত লিখে ফেলতে চাইছেন লিঙ্গ নিরপেক্ষ আগামী পৃথিবীর দৃষ্টি বিক্ষেপ।
অন্ততঃ এখনও বাংলা কবিতার প্রেক্ষিতে দেখা যায়,যা কিছু দৃশ্য সব কিছুই নির্মীত হয়েছে মানুষের চোখ থেকে দেখেই।অন্য বহুতর প্রাণীর দৃষ্টিকে 'মনুষ্যেতর' বলেই চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। বাংলা গল্পে যদি 'বুধির বাড়ি ফেরা '(বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)কে একটা উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করি,তবে,সেই দৃষ্টি চেতনা বাংলা কবিতার ইতিপূর্বে ঘটে থাকলেও অন্তত এই পাঠকের অপিরিচিত ছিল।যতক্ষণ না পড়ে ফেলা গেল,
"মৃত ইঁদুর আর আমি ছাতে উঠে দেখি:
জ্যোৎস্না রাত্রের বেগবান গহিন গম্ভীর নদীতে বান ডেকে
চরাচর ভেসে গেছে-
সেই আরকে ডুবে একতলা দোতলা সতরোতলা বাড়ি,
ফুটপাথ,ট্রামডিপো ক্রমশঃ গলিতাঙ্গ হয়ে অন্তর্ধান করছে।
ইঁদুর এইমাত্র জন্মমৃত্যু ভেদ করে এসেছে-
'ঐ দেখো বেদ আর সমস্ত প্রলাপ একই নর্দমা দিয়ে ভেসে চলেছে -'
ইঁদুর বললে ,আমি জানি না আমার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে।'
তারপরেই সে মাকড়শার মতো আট টা হল,
শেষে ডিমের মতো গোল হয়ে কাঁপতে লাগল, অধৈর্য,অস্থির।"(ইঁদুর বা মাকড়শা)
এই তথাকথিত 'আধুনিক'-এর উত্তর চিন্তা, বহকৌণিক ও বহুমাত্রিক দৃষ্টি এবং অস্তিত্বের বহুমাত্রাকে স্বীকার করে নেওয়া কী বাংলা কবিতায় খুব সুলভ?
মানে ,এই যে কবি ক্রমাগত তাঁর দৃষ্টি বদল করে করে দেখতে চেষ্টা করছেন যা দেখা হয়নি এতদিন - তাকেই।এই প্রসঙ্গেই এই আলোচকের
মনে পড়ছে অব্যবহিত পূর্বে রচিত দুটি পঙক্তিকে,
" আমরা শিখিনি পরে যারা আছে তারা?
তারা শিখবে না এর ঠিক ব্যবহার!"(জয় গোস্বামী:সৎকারগাথা:উন্মাদের পাঠক্রম:১৯৮৮)
মণীন্দ্র গুপ্তের এই আয়াসকে কী সেই ব্যবহার শেখার আততি হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি না! এবং এখানেই মণীন্দ্র গুপ্তের উত্তরণ নিয়োজিত রয়েছে বলে কী আমরা ভাবতে পারি না?
যদি তাই না হয়,তবে কেন আমাদের পড়তে হচ্ছে,'ঁসংসারচন্দ্র'-র মতো কবিতা?একজন মানুষ চাকরির জন্য ঈশাহী হয়ে তারপর স্ত্রী গ্রহণের ব্যাকুলতায় ইসলামপন্থী হয়ে শেষে
"বউ এবং ইসলাম থেকে মুক্তি পেতে হলেন নানকপন্থী-
শেষে ধীরে ধীরে আবার ফিরে এলেন
তাঁর বর্ণহীন ঘুমন্ত হিন্দুত্বে।"
ভাবী পৃথিবীর মানুষেরা ধর্মকে,তার জায়মানকে অর্থহীন,কৌতুককর বিষয়ে পরিণত করবে, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার বদলে তাকে মূল্যহীন করে দেওয়াটাই জরুরি বলে মনে করবে,সংসারচন্দ্র আমাদের এই বার্তা শিখিয়ে একটা ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে, প্রতিবাদের রূপ বদল হচ্ছে।হওয়াটাই স্বাভাবিক,
"তার চেয়ে বিবাহবিহীন দেশে চল মুসাফির,রাহী,
স্লাভ,টিউকনিক,বাংলা কোনো ভাষাতেই হৃদয়ানুবাদ হয় না"(বিবাহস্মৃতি)
প্রত্যাহারও একধরণের বর্ম।
মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতা পড়তে পড়তে আপনি এব্যাপারে সচেতন যে,এ কবিতাবিশ্বকে একটি অঞ্চলের চিহ্ন দিয়ে পরিচয় করান যায় না। বিচিত্র ও বিস্তৃত অঞ্চল কবিতাগুলিকে ভারতীয় কবিতার নমুনা করে তোলে এবং এই গ্রন্থে আরও একটি লক্ষ্যনীয় বিষয় যে,কাল বারবার ওভারল্যাপড হয়ে তৈরি করেছে একটা বিস্তৃত টাইম জোন,যার ভেতরে অতীতের দিকে যেতে যেতে মণীন্দ্র খুঁজে ফেলতে চান অস্তিত্ব আর শিল্পের সম্বন্ধকে। একটা জবাব পেতে চান - কোথায় নিহিত রয়েছে উচ্চারণের মূল সূত্র!আর এই অনুসন্ধানে দেখা যায় সময়ভেদ করতে করতে কবিসত্তা বলে উঠছে,
"তাহলে এই কবিতাবলির জন্মউৎস কত দূর অতীতে?
মনে হয়,কূর্মাবতারের শক্ত খোলার পিঠে
প্রলয়সমুদ্রের অন্ধকার নিশীথ জল আর
ফসফরাস আর বালি
অতি ধীর লয়ে
এখনও খোদাই করে চলেছে
৬৮ সংখ্যক কবিতা,
যা বইটির শেষ কবিতা।"(আমার শেষ কবিতার বই)
এটাও কিন্তু সমান ভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি বিজ্ঞান ভাবনার কী স্বতোৎসারিত সঞ্চার ! বাঙালির কবিতায় বিজ্ঞানের সঞ্চার খুব বেশি করে ঘটেনি বটে, কিন্তু,যে ক'টি ক্ষেত্রে ঘটেছে - বিস্ফোরণ হয়েছে।যেমন রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ কিংবা জয়। মণীন্দ্র গুপ্তকেও এই ধারারই অন্যতম উজ্জ্বল পথিক হিসেবে গ্রহণ করতে সহায়তা করে বৈকি আলোচ্যমান বইটি। কেবল বিজ্ঞানের তথাকথিত শব্দের ব্যবহার নয়,তত্ত্বকে সমসময়ের জীবনের সম্পৃক্তিতে দেখার নিবিড় উদাহরণ অবশ্যই যেমন পূর্বোদ্ধৃত পঙক্তিগুলি, তেমনই,
"কৌটোর ভিতর পোকা পুষলেও তাকে সময়ে
খাওয়াতে হয়।আর তুমি কি রকম মা,
পেটের মধ্যে বাচ্চা রেখে তাকে বিয়োতেই ভুলে গেলে।
তোমার পেটের মধ্যে ফুলের গাছটি বেয়ে
তোমার থেলিডোমাইড খোকা বারবার ওঠে
আর পিছলে পিছলে পড়ে।"(পাতা ঝরা)
কবিতায় বিজ্ঞান ভাবনার সঞ্চার ঘটলে আবেগ আর যুক্তির সাম্য তৈরি হয়,ভাষার বহুমুখীতা তৈরি হয়,গঠনের অভিনবত্বের সঙ্গে সঙ্গে কমে আসে অতি নাটকীয় নাবালক সুলভ আবেগবাহুল্য।
এ প্রস্তাবের শুরুতে একটি প্রসঙ্গক্রম আলোচনা করার চেষ্টা করেছিলাম ।জাদু বাস্তবতাকে বৈয়াকরণিকের পন্থায় অনুমান করার সে বিনীত চেষ্টায় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত দু 'হাজার আট সনের সঙস্করণে প্রদত্ত লক্ষণ অনুসারে দেখতে পাচ্ছি,জাদু বাস্তবতার একটি বড় বৈশিষ্ট্য হল সে উপকথা, লোককথা আর প্রবাদকে সমকালের প্রেক্ষিতে উপস্থাপন করে।এই কথা ক'টি মনে রেখেই যদি কাব্যটির পাঠ নিই,
"শুধু যেদিন শিবচৌদশীতে বিবাহযোগ্যা মেয়েরা দলে দলে এসে
ওঁর কাছে দীপ জ্বালে,ছোঁয়
বছরে শুধু এক দিনই
একটি করস্পর্শে আচম্বিতে ওঁর ভিতরের আগুন ধকধক করে ওঠে-
বাকি তিনশ চৌষট্টি দিন আবার নির্বিকার;
স্মৃতিকে ভস্মের মতো ব্যবহার করেন।"(শিবস্তোত্র-২)
শিব চতুর্দশী আর বিবাহযোগ্যা কুমারী মেয়েদের স্পর্শ সংবাদ হয়তো অনুদিত হতে পারে। কিন্তু,কেবল তৃতীয় পৃথিবীর, বিশেষ করে ভারতীয় মানচিত্রের অধিবাসী হলে,পাঠক তবেই বুঝতে পারবে যৌন বেদনাখানি কতটা অর্থনীতি আর সমাজ অতীত দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।ওই বিবাহযোগ্যার কুমারী স্পর্শে যে আকুতি থাকে,তার ওপর কতটা পীড়ন আর দায়ভার চেপে থাকে তাকে তন্ত্র প্রেক্ষিতে চিন্তা করলে এই আলোচকের জন্য কিছুটা বিভ্রান্তি নির্মাণ হচ্ছে। কেননা এ শিব আমাদের চৌহদ্দি থেকে দূরের তো নন একেবারেই বরং
"চোর ডাকাত সংসারী ভিখিরি সবাই এসে
মাথায় হাত বুলিয়ে যায়।ওঁর কোনও প্রতিক্রিয়া নেই।"(শিবস্তোত্র -২)
এ শিবের মিথ বুঝতে গেলে আমাদের কী জীব…; অর্থনৈতিক ও বিমূর্ত জীব ধারণার কাছে যেতে হয় না ! -
"কালক্রমে চর কাশফুলে ভরে গেল।
উনি সারা দিন কাশের বনের দিকে চেয়ে থাকেন,
বেলা পড়ে এলে সূর্যাস্ত দেখেন,সন্ধে হলে
শিব শিব বলে নিজেই নিজের নাম গান করেন।"(শিবস্তোত্র -১)
অন্তিম পঙক্তিটির ওপর কৌতুহল স্থাপন করলে কি শিব আর কোনও অমূর্ত ধারণায় নির্ভর করে কি? এই 'শিব 'তো অনায়াসে শিবপদ বিশ্বাস হয়ে যায় কিংবা শিবচন্দ্র হালদার।
এই কাব্যে ব্যবহৃত শব্দগুলির ওপর দৃষ্টিপাত করলেই আমরা বুঝতে পারি, বিস্তৃত একটি কবিতা পৃথিবী তৈরি করছেন মণীন্দ্র গুপ্ত।যে পৃথিবীর অন্তর্গত বিপুলসংখ্যক বিচিত্র উপাদান-
ক্যানেস্তারা,গৌড় সারং,ধান্দা, ফিজিক্স,সুতিকা,বৈদ্য,পূর্ণিমা বিশ্বাস,মুগ্লি,পর্নো হোয়াইট ডাবল মাস্টেকটমি, অর্ধনারীশ্বর, হারেম,ওম পুরি,গ্রেটা গার্বো,রাইগার মর্টিস ইত্যাদি।কিছু কিছু চিহ্নকে বিস্ময়কর ভাবে কোলাজে ব্যবহার করেছেন,যাদের সম্পর্কসূত্রে ভাবা প্রায় অসম্ভব। মণীন্দ্র গুপ্ত তাঁর কবিতায় সেই দুরূহ কৌণিক অবস্থানে নিজেকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন বলেই সম্ভবতঃ আমরা পড়তে পারছি,
"পেটে বাচ্চা নিয়ে যে মারা গেছে,এই রাতে সে পাগলিনীর মতো খুঁজে খুঁজে
এসেছে ভ্রুণের গোড়ের কাছে।তারা মা - ব্যাটা এই গনগনির মাঠে
দু'জনার একটা ডাকাত দল খুলবে - পথিককে ভুলিয়ে এনে
ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলবে!
কিন্তু ফ্যাকাশে চাঁদের আলোয় দেখা যায় সেই ভূত একলা
ভিখারিনীর মতো দাঁড়িয়ে আছে।
এদিকে শেয়ালনী ছোট্ট মাথাটিকে দুই পায়ের মধ্যে রেখে
কাঁকড়া খাবার মতো করে এক কামড়ে ভেঙে দিলে
বাচ্চাটা ককিয়ে উঠল : মা -!
শেয়ালনী করুণ স্বরে,'বাছা,এই তো আমি -'বলে
ঘুমপাড়ানি গান গাইতে গাইতে খেতে লাগল।"(মাহাতদের মরা শিশু)
মা -নিষাদ
____________
উপরোক্ত কৈফিয়তটুকু রেখে আরেকটি প্রসঙ্গে এক্ষেত্রে প্রবেশ করা যায়। জাদুবাস্তবতাবাদ।এই জাদু ও বাস্তবতার সমান্তরাল জায়মানতা যেমন একটি নতুন দৃষ্টি অবস্থানের জন্ম দেয়, জাদুবাস্তবতাবাদ সেখান থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে যায়।সেখানে কেবল জাদু,পুরাণ, ইতিহাস আর বাস্তবতাকে পাশাপাশি রাখলে চলবে না, বরং বাস্তবতার ভেতর থেকেই জন্ম নেবে জাদু। এখন,দেবেশ রায় আবার এই জাদুবাস্তবতাবাদ'কে বাস্তবতারই অবজারভেটরি হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। বাস্তবতার ওপর একটা বিশেষ দৃশ্য মাধ্যম ব্যবহার করে দেখা।এই দৃশ্য মাধ্যমটিকে যদি জাদুবাস্তবতাবাদ বলে বিবেচনা করতে ইচ্ছে করি,তবে, কী সে বিধায় আমাদের মনে পড়ে না,বাংলা কবিতায় এই সময়ের বাস্তবের দুরূহতম উদ্ভটকে পৃথক পৃথক দৃশ্য মাধ্যমে দেখতে চাইছিলেন আরও কয়েক জন কবি। নব উদ্ভুত রাজনৈতিক পরিস্থিতি'কে বিশ্বাস না করতে পেরেই হয়তো বাস্তবতাকে বলতে চেয়েছিলেন এমন এক ভাবে যা বিশ্বাস্য আর অবিশ্বাস্যের ভেতর চলাচল করে। সচেতন কিংবা অসচেতনেই বাংলা কবিতায় এই পর্যবেক্ষণটি গাঢ় হতে থাকে নব্বই দশকে।জয় গোস্বামীর 'মা নিষাদ 'নামক দীর্ঘ কবিতাটিকে কী এর একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা যায় না!
"স্তব্ধতা ফাটে,পাকিয়ে উঠছে ধুলো
ধূলিস্তম্ভে মেঘযূথ মিশে যায়
ভূগোল ঘুরছে,ধক ধক করে চুলো
সূর্য লুপ্ত প্রায়
সূর্য তো নয়,কালরাত্রির চাঁদ
চাঁদ মুখে নিয়ে উড়ে যায় কালো পাখি
সেই চাঁদকেই বাণে বেঁধে উন্মাদ
ব্যাধ নামে তারে ডাকি"
কিংবা,
" পোড়া বাড়ি ভাঙা হাড়গোড় ইটকাঠ
স্তূপের পেছনে স্তূপ ওঠা জনপদে
চুরমার মাটি,দগ্ধশস্য মাঠ
মানুষ মরেছে ঘরে দপ্তরে পথে
মানুষ মরেছে,জন্মেছে আরও আরও
বাঁকা হাত,ঘোর জড়ভরতের দেহ --
মুখে জিভ নেই পায়ে হাড় নেই কারও
0 comments: