0

গল্প - মনোজ কর

Posted in




















একাদশ পর্ব

পরেরদিন সকালে পানু রায় ডাইনিং হল থেকে বেরিয়ে দেখল অফিসঘরের দিক থেকে সুন্দরী ডাইনিং হলের দিকে আসছে। সাধারণত সুন্দরী পানু রায় অফিসে আসার পনের-কুড়ি মিনিট আগে চলে আসে। তাড়াহুড়ো করে পানু রায়ের কাছে এসে প্রায় ফিসফিস করে বলল,’ দাদু, অফিসে ঢুকো না। আমার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে পিছনের বাগানের দিকে চল।‘

-কী ব্যাপার, সুন্দরী? অফিসে যেতে বারণ করছ কেন? কী হয়েছে?

-অনেক কিছু। চুপচাপ চলো। কেলো দারোগা সামনের রিসেপশনে বসে আছে। তোমার সঙ্গে দেখা করবে বলে। আমি দেখেই চুপিচুপি অফিসের পিছনের দরজা দিয়ে বাড়ির মধ্যে চলে এসেছি তোমাকে বলব বলে। কেলো দারোগা মোবাইল দেখছিল একমনে।আমাকে দেখতে পায়নি।

-কেলো দারোগা কি চায়? হঠাৎ কী ব্যাপার কে জানে?

-অনেক কিছু ঘটে গেছে। শিবুলাল আজ সকালে খুন হয়েছে।

-কী বলছ সুন্দরী? কখন হলো? তুমি কী করে জানলে?

-টিভিতে দেখাচ্ছে। অফিসে টিভি খুলতেই দেখলাম খবরটা। কাজের মাসি এসে দেখে দরজা খোলা। শিবুলাল চিত হয়ে পড়ে আছে। বুকের মাঝখানে গুলির দাগ।

-কখন ঘটেছে?

-আটটার সময়।

-আরে না না। কখন খুনটা হয়েছে? কিছু বলল?

-সে সব কিছু বলছে না।

-কেলো দারোগা কেন এসেছে?

-জানি না। আমি শুধু দুয়ে দুয়ে আট করার চেষ্টা করছি।

-ঐ জন্য তোমায় আমি এত ভালোবাসি, সুন্দরী। এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হচ্ছে পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ম্যান্ডেভিলা অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে রেবার কাছ থেকে কিছু খবর জোগাড় করা। আজ সারাদিন অনেককে অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। তার আগে বেশ কিছু খবর চাই আমার।

একটা ট্যাক্সি হাত দেখিয়ে থামিয়ে তাতে উঠে পড়ল সুন্দরী আর পানু রায়। পানু রায় ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললেন,’ ম্যান্ডেভিলা অ্যাপার্টমেন্ট!’ সুন্দরী বলল,’ একটা ফোন করা উচিৎ নয়?’ পানু রায় বললেন,’ না। একদম নয়।‘ সুন্দরী বলল,’ ঠিক বলছো? তোমার মনে হয় না…’ পানু রায় সুন্দরীকে থামিয়ে বললেন,’ এখন কোনও কথা নয়। আগে খবর জোগাড় করতে হবে তারপর ভাবব কী করা যায়। তোমার একেবারে ব্যক্তিগত এবং গোপনীয় অবগতির জন্য জানাই কৃষ্ণকালী কাল রাত্রে ৮-১৫ নাগাদ শিবুলালের সঙ্গে দেখা করেছিল। কিন্তু এই কথাটা সে কোনও কারণে আমাকে বলবার প্রয়োজন মনে করেনি। আমি সেইজন্য কাউকে একথা এখনও বলিনি। আর একটা বিষয় মনে হচ্ছে তুমি ভেবে দেখতে পার। কাল রাত্রে সাড়ে আটটায় যখন রেবা শিবুলালের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল তখন সে একজন মৃত ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেছিল। সেই জন্য রেবাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় যে শিবুলাল তাকে কত দাম দিয়েছিল সে নিজের বানানো একটা দাম বলেছিল। সেইজন্য আমাকে শিবুলাল যা বলেছিল তার সঙ্গে রেবাকে যা বলেছিল তার মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

-আমি কিন্তু এইভাবে ব্যাপারটা ভেবে দেখিনি। আমার মাথা সকালবেলা কাজ করে না।

-দিব্য করে। যেভাবে কেলো দারোগাকে ফাঁকি দিয়ে আমাকে পিছনের গেট দিয়ে বের করে আনলে তাতে তোমার মাথা কাজ করে না একথা কোনমতেই বলা যায় না।

- শিবুলালের খবরটা দেখার পরেই কেলো দারগাকে দেখে আমার মাথায় খেলেছিল যে আমার এবং তোমার কারুরই এখন কেলো দারোগার সামনে যাওয়া ঠিক হবে না।

- একদম সঠিক সিদ্ধান্ত। সত্যি খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে তুমি।

পানু রায় ম্যান্ডেভিলা অ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে ট্যাক্সিটাকে অপেক্ষা করতে বলে বাড়ির মধ্যে ঢুকে সামনের বেঞ্চে বসে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে এমন একটা হাসি দিলেন যেন কতদিনের চেনা। তারপর দু’জনে কোনও প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই লিফটের দিকে এগিয়ে এলেন। রেবার ফ্ল্যাটের দরজায় টোকা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে রেবার আওয়াজ ভেসে এল,’কে?’ পানু রায় বললেন,’ আমি পানু রায়।‘ রেবা জিজ্ঞাসা করল,’ আপনি একা?’ পানু রায় বললেন,’ না, সুন্দরী আছে আমার সঙ্গে।‘

দরজা খুলে রেবা ওদের দু’জনকে ভেতরে আসতে বলল। রেবার পরনে হাউসকোট পায়ে হাওয়াই চটি। রেবা বলল,’ দেখুন, সবকিছু একটু এলোমেলো হয়ে আছে। আসলে আমি দেরিতে উঠি। এইমাত্র ব্রেকফাস্ট করলাম। এখনও স্নান করা হয়নি। একটু কফি করে দিই?’

-না, না। ব্যস্ত হবেন না।আমরা কয়েকটা ছোটখাট খবর নিয়েই চলে যাব। আসলে খবরগুলো খুব জরুরি তাই সকালে আপনাকে বিরক্ত করতে হল। কিছু মনে করবেন না।

-কী খবর জানতে চান বলুন।

-কাল রাত্রে যখন আমরা চলে গেলাম তখন কৃষ্ণকালী এখানে ছিলেন। উনি কখন ফিরলেন?

রেবা রেগেমেগে বলল,’ তাতে আপনার কী দরকার?

-দরকার আছে বলেই জিজ্ঞাসা করছি। আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করতে হচ্ছে বলে আমি দুঃখিত।আপনি জানেন কি না জানিনা শিবুলালকে আজ সকালে তার ফ্ল্যাটে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে।

রেবা কিছুটা হতচকিত হয়ে পানু রায়ের দিকে তাকাল। তারপর বাকরুদ্ধ অবস্থায় সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে রইল। সুন্দরী বলল,’ বসুন।‘ রেবা বিছানার ধারে বসে পড়ল। বিছানা তখনও ঠিক করা হয়নি। বালিশ, চাদর অবিন্যস্ত। পানু রায় হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বিছানার দিকে গিয়ে একটা বালিশ ছুঁড়ে সরিয়ে দিতেই দেখা গেল বালিশটা দিয়ে একটা রিভলভার চাপা দেওয়া ছিল। পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’এটা কী?।‘ রেবা উত্তেজিত হয়ে বলল,’ দেখতেই তো পাচ্ছেন যে এটা দাঁত মাজার ব্রাশ নয়।‘

-যদি আমার খুব ভুল না হয় তাহলে কালকে কৃষ্ণকালীর কোটের ভিতরের পকেটে যে রিভলভারটা ছিল সেটা আর এটা অবিকল এক।

পানু রায় রিভলভারটা হাতে নিলেন। রেবা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,’ উনি আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যাপারে খুব চিন্তিত ছিলেন।যেহেতু উনি ঐ লোকগুলো যারা বড় হোটেল বানাতে চায় তাদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চান তাই আমার নিরাপত্তার ব্যাপারটাও খেয়াল রাখছিলেন।আপনার তো জানেন ঐ লোকগুলো আগে কী করেছে?

পানু রায় ততক্ষণে বন্দুকটা খুলে ফেলেছেন। পানু রায় বললেন,’ আপনি বলছেন আত্মরক্ষার জন্য কাজে লাগতে পারে সেই জন্য উনি এই বন্দুকটা আপনাকে দিয়ে গিয়েছিলেন? কিন্তু এই বন্দুকটার কার্টিজে একটা গুলি কম কেন?

- আমি কিছু জানিনা। এটা আমার বন্দুক নয়। এটা কৃষ্ণকালীবাবু কাল এখানে রেখে গেছেন আমার আত্মরক্ষার কাজে লাগতে পারে ভেবে। আমি এটা চাইনি এবং এখনও চাইনা।

-কিন্তু এটা আপনি আপনার বালিশের তলায় রেখেছিলেন?

-আপনি হলে কোথায় রাখতেন?

পানু রায় চেয়ার থেকে উঠে বালিশের তলায় যেখানে বন্দুকটা ছিল সেখানে রেখে দিয়ে এসে বসলেন। রেবা জিজ্ঞাসা করল,’ এখন কী হবে?’

-দেখুন আমি আপনার উকিল নয়। আমি কোনও পুলিশ অফিসার নয়। সুতরাং আমি আপনাকে কোনও প্রশ্ন করতে পারিনা। শুধু একটা কথা বলুন আপনি কি কাল আমরা চলে যাবার পর কোথাও বেরিয়েছিলেন?

-না, কাল আপনাদের সঙ্গে দেখা হবার পর থাকে আমি বাড়িতেই আছি।

-ঠিক আছে। চল, সুন্দরী।‘

রেবা বলল,’ দেখুন শিবুলাল খুন হয়েছে। ঐ লোকটা আমার বাবাকে খুন করেছে। আপনারা কী মনে করেন? ওর মৃত্যুসংবাদে আমি ভেঙে পড়ব না কান্নাকাটি জুড়ে দেব? আপনি কৃষ্ণকালীবাবুর পরামর্শদাতা।আপনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। আপনার অনেক খ্যাতি। আমি জানি কৃষ্ণকালীবাবুকে বাঁচাবার জন্য আপনার পক্ষে যা সম্ভব আপনি তাই করবেন। দরকার হলে আমাকে দোষী সাজিয়ে ওনাকে বাঁচিয়ে দেবেন। আমার সব জানা আছে।

-আমাকে দেখে, শুনে বা আমার কাজকর্ম দেখে কি আপনার তাই মনে হয়? এ বিষয়ে আর কথা না বলাই ভালো। চল, সুন্দরী।

পানু রায় এবং সুন্দরী লিফটে করে নিচে নেমে আসার পর সুন্দরী জিজ্ঞাসা করল,’দাদু, এখন আমরা কোথায় যাব?’

-এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কৃষ্ণকালীর সঙ্গে দেখা করতে হবে। পুলিশ পৌঁছনোর আগে দেখা করতে না পারলে কোনও লাভ নেই।

-কেন পুলিশ কি বড়কালীকে সন্দেহের তালিকায় রাখছে?

-রাখবে যদি রেবা পুলিশকে বন্দুকের ব্যাপারে কোনও কথা বলে।

-রেবা কি পুলিশকে বন্দুকের ব্যাপারটা জানিয়ে দেবে বলে তোমার মনে হয়?

-সে ব্যাপারে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই।

-তোমার কী মনে হয় জানতে চাইছি।

-মাথায় বুদ্ধি থাকলে বলবে। ধর যদি ঐ বন্দুকটা দিয়েই খুন করা হয়ে থাকে তাহলে?

-ওটা তোমার নিয়ে আসা উচিৎ ছিল না?

-পাগল হয়েছ? ওসব কথা মাথায় আনাও ঠিক নয়।

টাক্সিতে উঠে পানু রায় ড্রাইভারকে বড়কালীর ঠিকানা দিলেন। সুন্দরী জিজ্ঞাসা করল,’ বাড়ি থাকবে বলে মনে হয়?’ পানু রায় বললেন,’ দেখা যাক পাওয়া যায় কি না। নাহলে যেভাবেই হোক খুঁজে বের করতে হবে। এবারে আর কোনও সেক্রেটারির সঙ্গে কথা বলা ঠিক হবে না।‘ ট্যাক্সিটাকে দাঁড় করিয়ে দু’জনে বড়কালীর বাড়ির সামনের দরজা ঠেলে দেখল দরজা চাবি দেওয়া। পানু রায় বললেন,’ এটা অফিসের দরজা। কেউ না কেউ তো থাকবেই।‘ দরজায় দু-তিনবার ধাক্কা দিতেও ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। সুন্দরী বলল,’ দাদু, মনে আছে কাল বড়কালী বলেছিল যে এলিনাকে আর আসতে বারণ করে দিয়েছে।‘-তবুও, কেউ না কেউ তো থাকবেই।‘ বলে পানু রায় পাশের দরজাটায় টোকা দিলেন। এটা বড়কালীর ব্যক্তিগত চেম্বার। কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে পানু রায় বললেন,’ মনে হচ্ছে কেউ নেই। চল বাইরে বেরিয়ে ফোন করা যাক।‘ বাইরে এসে বড়কালীকে ফোনে ধরার চেষ্টা করল সুন্দরী। কিন্তু পাওয়া গেল না। পানু রায় বললেন,’ছোটকালীকে ফোন কর।‘ রেবা বলল,’ ছোটকালী এখন হনিমুনে নিশ্চয়ই।‘ পানু রায় বললেন,’ না, সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ির ব্যবসায় অতো সুখ নেই। তাছাড়া ওদের হনিমুন হয়ে গেছে। শোন , তুমি বল যে তুমি একটা গাড়ি কিনতে চাও এবং তুমি কালীকৃষ্ণের সঙ্গেই কথা বলতে চাও। যদি একান্ত দরকার না হয় তোমার পরিচয় দিওনা।‘ সুন্দরী খানিকক্ষণ চেষ্টা করে ফোনটা পেয়ে গেল। ফোনটা পানু রায়কে দিয়ে বলল,’ ছোটকালী। কথা বল।‘ ওপার থেকে ভেসে এল,’ কালীকৃষ্ণ বলছি। আপনি কে?’ পানু রায় বললেন,’ আমি পানু রায়।‘

-আরে আরে অনেকদিন পরে। কী সৌভাগ্য আমার! কেমন আছেন আপনি?

-খুব ভালো। অনেক অভিনন্দন।

-অনেক অনেক ধন্যবাদ। খুব হঠাৎই হয়ে গেল। অবশ্য আপনি তো জানেন আমার কাজকর্মের ধরণ এরকমই।

-তোমার ওখানে কয়েক মিনিটের জন্য আসতে পারি?

-স্বচ্ছন্দে। সকাল থেকে কাজ করছি। আমারও একটু ব্রেক হবে। কোনও গাড়ি বিক্রীর ব্যাপারে?

-না, আর একটু ব্যক্তিগত ব্যাপার। ঠিক আছে, আসছি।

ট্যাক্সিটা এসে একটা ঘেরা মাঠের গেটে দাঁড়াল। গেটের ওপরে বড় বড় হরফে লেখা –এখানে পুরনো গাড়ি কেনা বেচা করা হয়। মাঠভর্তি হরেকরকমের গাড়ি পার্ক করা আছে। পানু রায় বললেন,’ গেটের ভিতরে ঢুকে ঐ অফিসটার কাছে চলো।‘ টাক্সিটাকে অপেক্ষা করতে বলে পানু রায় একতলা অফিসটার ভিতর দিয়ে হেঁটে গিয়ে সোজা কালীকৃষ্ণের ঘরের দরজা খুলে ঢুকে গেলেন। পিছন পিছন সুন্দরীও ভেতরে ঢুকল। কালীকৃষ্ণের বয়স সাতাশ আঠাশ হবে।ছ’ফুটের বেশি লম্বা।মাথায় ঘন কালো চুল। পরনে দামি স্যুট। ছোটকালী তখন ফোনে কথা বলছিল। পানু রায় আর সুন্দরীকে দেখতে পেয়ে বলে উঠল,’আচ্ছা আমি এখন রাখছি। একজন অতিথি এসেছেন।আমি পরে ফোন করছি… কখন বলতে পারছি না।আচ্ছা রাখছি।‘ ফোন রেখে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পানু রায়ের সামনে এসে পানু রায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,’ আপনি কেমন আছেন? আপনার সঙ্গে সত্যিই অনেকদিন দেখা হয়নি।‘ পানু রায় বললেন,’ সত্যিই অনেকদিন পরে দেখা হলো। আন্তরিক অভিনন্দন!’ ছোটকালী হেসে বলল,’খুব সুন্দর মেয়ে। আমি যে কী করে ওকে সম্মোহিত করে ফেললাম কে জানে? আসলে অনেকদিন ধরে লোককে বুঝিয়ে গাড়ি বিক্রী করার অভিজ্ঞতা বোধ হয় কাজে দিয়েছে। সুন্দরী, কেমন আছেন? আপনাকে দেখতে সত্যিই বেশ ভালো লাগছে।‘ সুন্দরী প্রত্যুত্তরে বলল,’ধন্যবাদ।‘ পানু রায় বললেন,’ আমরা তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য গিয়েছিলাম।কিন্তু অফিস বন্ধ।‘

-বন্ধ? কেন বন্ধ থাকার তো কথা নয়। বাবা না থাকলেও এলিনার তো থাকার কথা।

-আমার মনে হয় এলিনা আর তোমার বাবার অফিসে কাজ করছে না। তুমি জান বাবা কোথায়?

-কেন? কাজ করছে না কেন? সত্যি কথা বলতে কি আমি ফেরার পর বাবার সঙ্গে এখনও পর্যন্ত দেখা হয়নি। একটা সামান্য ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপার। মনে হয় সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার ঘন ঘন মত পরিবর্তন বাবার পছন্দ নয়। আসলে আমদের আগের প্রজন্মের মানুষদের পক্ষে বোঝা কঠিন যে এখনকার ছেলেমেয়েরা কী চায়। আমার মনে হয় আমার বাবারও আমার দাদুর সঙ্গে একই সমস্যা হয়েছিল।আমাদের জীবনের গতি অনেক বেড়ে গেছে। আমার ব্যবসার কথাই ধরুন।আমাকে সারাক্ষণ এখানে ওখানে দৌড়তে হয়। আমার নিজের সময় বলে কোনও সময় নেই। এর প্রভাব পারিবারিক জীবনের ওপর পড়তে বাধ্য। আমি আগে যে ভাবে অনুভব করতাম, ভাবতাম এখন আর সেভাবে পারিনা।

-তুমি কি তোমার বাবার সঙ্গে ব্যবসা সংক্রান্ত মতভেদের কথা বলছো?

-না, ব্যক্তিগত ব্যাপারে। আমি দুঃখিত আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারছি না। যখন এসেই পড়েছেন দু-একটা গাড়ি দেখাই। ভালো গাড়ি। যে রকম আপনার পক্ষে সুবিধেজনক। বড়, এয়ারকন্ডিশন্ড, হাই স্পিড ঠিক যে রকম আপনার দরকার। একেবারে নতুনের মত আছে।

-না, আমার এখন কোনও গাড়ির প্রয়োজন নেই। তুমি এলিনার খবর জান? অফিসে না থাকলে কোথায় থাকতে পারে?

-ওর ফ্ল্যাটে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।

- কোথায় থাকে জান?

-এক মিনিট। দেখে বলছি।

ছোটকালী একটা ড্রয়ার থেকে একটা নোটবুক বের করে কয়েকটা পাতা উলটে বলল,’ রোজমেরি অ্যাপার্টমেন্ট।ফ্ল্যাট নম্বর ৩১৭। ফোন নম্বর ৭৯৭৭০৩২৪৮১। কিন্তু ও অফিসেই থাকবে।হয়ত কোনও কাজে একটু বেরিয়েছে। এলিনা খুব নির্ভরযোগ্য। আমিই ওকে বাবার কাছে পাঠিয়েছিলাম। খুব ভালো কাজ করছে। দারুন এফিসিয়েন্ট।দেখতেও খুব সুন্দর। অফিসে গেলে অবশ্যই দেখতে পাবেন। একেবারে অফিস আলো করে বসে থাকে।‘

-ঠিক আছে দেখছি। বাবার সঙ্গে কথা হলে বলো যে আমি ওনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। খুব জরুরি।

-নিশ্চয়ই বলব। সুন্দরী, আপনি একটা গাড়ি দেখতে পারেন। আমি আপনার জন্য সত্যিই অনেক কম দামে দেব।শুধু দাম নয় গাড়িটার ইতিহাস আপনাকে বলে দেব। এক হাতেই গাড়িটা চলেছে এতদিন। আপনার আখেরে লাভই হবে।

-দেখি, পরে অন্য কোনও এক দিনে। আপাতত আমি যেখানেই যাই হয় বাড়ির গাড়িতে না হলে দাদুর সঙ্গে। নিজের গাড়ির দরকার হয়নি এখনও।

ছোটকালী ওদের সঙ্গে ট্যাক্সি অবধি এল। বলল,’যত ভাড়া আপনি ট্যাক্সির জন্য দেন তার চেয়ে অনেক কমে…যাই হোক বাবার সঙ্গে কথা হলে বলে দেব।‘

ট্যাক্সিটা দ্রুতগতিতে বেরিয়ে গেল। ট্যাক্সিটা গেটের বাইরে বেরোতেই সুন্দরী আর হাসি চেপে রাখতে পারল না। খিলখিল করে সশব্দে হেসে উঠলো। পানু রায় বললেন,’ ওর মন্ত্র হচ্ছে- যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন।‘

ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল,’ এখন কোথায়?’ পানু রায় বললেন,’ রোজমেরি অ্যাপার্টমেন্ট। কতদূর জানেন?’ ড্রাইভার বলল,’ মিনিট দশেক লাগবে।‘ সুন্দরী বলল,’ আমার মনে হয় ছোটকালী আর বড়কালীর মধ্যে ঝামেলাটা শুরু হয়েছে তখন থেকে যখন ছোটকালী ফোন করে বাবাকে বিয়ের খবরটা দেয়। তোমার মনে হয় না যে বড়কালীর রাগের কারণ হচ্ছে ছোটকালীর রেবার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা?

-অনেক কারণেই মতবিরোধ হতে পারে। কিছুতো একটা হয়েছে নিশ্চয়ই। দেখা যাক বিয়েটার ব্যাপারে এলিনা কিছু বলতে পারে কি না।

-দেখা যাক। এলিনা কিন্তু তোমার সঙ্গে যে খুব একটা বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করবে এমন কথা বলা যাচ্ছে না।

-করবে না ধরে নাও। সেটাই স্বাভাবিক।

-দাদু, ফোন করে আমাদের যাবার ব্যাপারটা জানানো কিন্তু ভদ্রতার মধ্যে পড়ে। মহিলারা সাধারণত সকালে একটু অবিন্যস্ত থাকে।

-যদি ‘না’ বলে দেয় তাহলে কী হবে?

-সেটা যথেষ্ঠ অপমানজনক ব্যাপার হবে।

-সুতরাং আমার মনে হয় ফ্ল্যাট অবধি গিয়ে দেখা যাক কী হয়। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেব।

রোজমেরি অ্যাপার্টমেন্টের মূল দরজাটা খোলাই ছিল। ভিতরের লবিতে একজন সিকিউরিটির বসার জায়গা আছে কিন্তু তখন কেউ ছিলনা। লিফটে তিনতলায় উঠে ৩১৭ নম্বর ফ্ল্যাটের দরজায় প্রথমে একটা টোকা তারপর একটু থেমে চারটে ছোট টোকা তারপর একটু থেমে আবার দুটো ছোট টোকা দিলেন পানু রায়। ম্যাজিকের মত কাজ হলো। দরজা হাট করে খুলে গেল । এলিনা দরজায়। নিখুঁত সাজগোজ এবং বেরোবার জন্য সম্পূর্ণ তৈরি। বলল,’আমি অনেকক্ষণ… ওহ আপনারা। আমি অন্য একজনকে আশা করছিলাম।‘ পানু রায় বললেন,’ আমি আপনার সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে চাই। ভেতরে আসতে পারি? ইনি সুন্দরী, আমার সহকর্মী।‘

-আমার কোনও সময় নেই। আমি বেরোচ্ছি। আমার একটা জরুরি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।‘

-মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যাপার।

-ঠিক আছে, ভেতরে আসুন।

পানু রায় ফ্ল্যাটে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলেন,’ আপনি আর কৃষ্ণকালীর অফিসে কাজ করছেন না?’

-আপনাকে ধন্যবাদ। না আর করছি না।

-কিন্তু আমি কী করলাম?

-উনি বললেন যে আমার আপনাকে বলা উচিৎ ছিল যে উনি কোথায় গেছেন এবং কোথায় আছেন।

-আপনি জানতেন?

-হ্যাঁ জানতাম। কিন্তু উনি বলেছিলেন কাউকে না বলতে। আমি তো কাউকে মানে কাউকেই বুঝি। আপনি কী বোঝেন?

-আমি বুঝি প্রায় সবাইকেই। কিন্তু কেন? এই নিয়ে কোনও কথা কাটাকাটি হয়েছিল?

-পুরো পরিবারটাই দুর্গন্ধময়। আমি ভাবতাম ছেলেটাই খারাপ । পরে বুঝলাম যেমন বাবা তেমন ছেলে বা যেমন ছেলে তেমন বাবা।

-আমার খুব খারাপ লাগছে যে এমন একটা ভুল বোঝাবুঝির জন্য আপনি চাকরি হারালেন যার সঙ্গে আমার দেখা করতে আসার একটা সম্পর্ক আছে।

-ওসব নিয়ে ভাববেন না। আমি এখন যথেষ্ঠ ভালো আছি।ঐ দমবন্ধকরা পুরনো অফিসটায় আমার সময় নষ্ট হচ্ছিল। আমার অনেক জায়গায় যাওয়ার এবং অনেক কিছু করার বাকি আছে। এবার শুরু করতে হবে।

-সেদিনের ঘটনা সম্বন্ধে একটু বলবেন?

-সেদিন কাঠমান্ডু থেকে ফিরে ওনাকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। উনি আমাকে বলেছিলেন উনি অফিসে না আসা পর্যন্ত আমি যেন অপেক্ষা করি। যদি দেরি হয় আমি যেন ডিনার করে নিই এবং ডিনারের বিল কোম্পানি অ্যাকাউন্টে জমা করে দিই। ওভারটাইমের ব্যাপারে কোনও উচ্চবাচ্চ্য নেই। ডিনারের আর কী এমন খরচ। আমাকে তো আমার ফিগারের দিকেও নজর রাখতেও হবে। যেখানে আমার একটা চিকেন তন্দুরি এবং দু’টো নান খাওয়ার কথা সেখানে আমি একটু ফল আর একটু চিস স্যালাড দিয়েই ডিনার সারি। যে পেশায় আমি আছি সেখানে শারীরিক সৌন্দর্য এবং লাবণ্যের প্রয়োজন বেশি। যাই হোক আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে ওনার অফিস বাড়ির মতই। বাড়িতে যা যা থাকে ওনার অফিসে সব আছে। অফিসে স্নানঘর, ড্রেসিং রুম , কিচেন তো আছেই। তাছাড়াও বার এবং রাত্রে শোবার ব্যবস্থাও আছে। যদি কোনও কারণে অনেক রাত্রে লং ডিস্টেন্স কল থাকে তাহলে এখানেই থেকে যান উনি। সে কথা থাক। সেদিন উনি অফিসে আসার পর মনে হল উনি কোনও কারণে খুবই ব্যস্ত আছেন এবং হয়ত আমাকে চলে যেতে বলবেন। কিন্তু উনি ওনার ছেলের মতই স্বার্থপর। উনি বললেন উনি খুব ক্লান্ত এবং ওনার এখনই স্নানের এবং পোশাক পরিবর্তনের প্রয়োজন। এই বলে স্নানঘরে চলে গেলেন।আমি বসে আছি তো বসেই আছি। বেশ খানিকক্ষণ পরে স্নান সেরে ,স্যুট পরিবর্তন করে এসে আমাকে নিয়ে পড়লেন।

-আপনি কি বললেন?

-আমি বললাম যে আমাকে কাজ ওনার থেকে শিখতে হবে না। আমাকে উনি যা বলেছেন আমি তাই করেছি। ওনার যদি মনে হয় আমার বদলে অন্য কাউকে উনি কাজটা দেবেন উনি স্বচ্ছন্দে করতে পারেন।

-উনি কী বললেন?

-উনি বললেন সেটাই ওনার পক্ষে সুবিধেজনক হবে। শুনে আমি তখনই অফিস থেকে বেরিয়ে যাই।

-তখন কটা বাজছিল?

-ধরুন পৌনে ন’টা হবে।তারপর আমাকে অযথা বসিয়ে রাখলেন যাতে আরাম করে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন। আমার তো পাগল পাগল লাগছিল।

-এম সেকেন্ড। আপনাদের কথা কাটাকাটি আন্দাজ ক’টার সময় শুরু হয়?

-ন’টা পাঁচ-দশ হবে।

-উনি আপনাকে বলেছিলেন যে উনি কাঠমান্ডু থেকে সরাসরি অফিসে এসেছেন?

-উনি তো তাই বলেছিলেন।

-উনি প্লেনে এসেছিলেন না গাড়িতে?

-আমি জানিনা। ওনার সঙ্গে গাড়ি ছিল। ওনার চার পাঁচটা গাড়ি। তা সত্ত্বেও ইচ্ছে হলে ছেলের দোকান থেকে অন্য গাড়িও নিয়ে আসেন।

-কতদিন উনি কাঠমান্ডুতে ছিলেন?

-দু’দিন।

-আচ্ছা আমি কি আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে পারি যে আপনি এখন কী করবেন ভাবছেন?

-আমি এখন তাই করতে চাই যা আমার অনেক আগে থেকেই করা উচিৎ ছিল। মঞ্চাভিনয় ।

-আমি জানতাম না আপনি আগে মঞ্চে অভিনয় করেছেন।

-আমি বলিনি যে আমি করেছি। কিন্তু আমি মঞ্চাভিনয়ের জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছি।আমি আজ সকালে একটা ইন্টারভিউ দিয়েছি এবং আমাকে এক্ষুণি বেরোতে হবে। মিঃ রায় , আমি দুঃখিত। আপনার বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিযোগ নেই কিন্তু আমার সঙ্গে মোটেই ঠিক কাজ করা হয়নি।

-কেন ঐ অফিসে কি সত্যিইন আপনি আর যেতে চান না?

-আমি তো যাবই না। আমি পুরো দুনিয়াকে সেকথা বলতে চাই।আমার কিন্তু আপনাদের বের করে দেবার ইচ্ছে নেই। আপনারা দয়া করে আসুন। অনেক সময় নিয়েছেন আপনারা। আপনি কৃষ্ণকালীবাবুকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করুন উনি বলতে পারবেন কী হয়েছিল।

-না, না। আমি আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই। উনি তো ওনার কথা বলবেন।

-আপনি যদি আমার ক্তহা শুনতে চান তাহলে সারা সকাল কেটে যাবে। ওনার ছোটলোক ছেলে আমাকে জোর করে এখানে নিয়ে এল। তারপর কিছুদিন যেতে না যেতেই বাবার অফিসে সেক্রেটারি করে দিয়ে ভেগে গেল। তারপরে শুরু হল রেবা কৈরালাকে নিয়ে আদিখ্যেতা। হোটেলে, বারে সর্বত্র ওদের দু’জনকে একসঙ্গে দেখা যাচ্ছিল। তারপর শুনলাম পাটনায় গিয়ে একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে। মেয়েটি আসলে কাঠমান্ডুর। কোনও কারণে মেয়েটি ওর পুরনো গাড়ির দোকানে গিয়েছিল।মেয়েটিকে ও একটা পুরনো গাড়ি বিক্রী করেছিল। মেয়েটি তার বদলে নিজেকে দিয়ে দিয়েছে ঐ অসভ্যটার হাতে। আপনি মিলিয়ে নেবেন আমার কথা ছ’মাসের মধ্যেই ওকে ছেড়ে আবার একজনকে পাকড়াবে লোকটা। ও নিজেই জানেনা ও কী চায়। এবার আপনারা দয়া করে আসুন।আমাকে বেরোতে হবে।

-আপনি কিসে যাবেন? আপনার গাড়ি আছে?

-না, একটা ট্যাক্সি নিয়ে নেব।

-আপনি কোথায় যাবেন।

-আমি সিনেমাপাড়ায় যাবো।

-আমাদের একটা ট্যাক্সি নিচে অপেক্ষা করছে। আপনি আমাদের অফিস অবধি আমাদের সঙ্গে আসতে পারেন। আমাদের অফিস সিনেমাপাড়ার পথেই পড়বে। তারপর ওখান থেকে এই ট্যাক্সিটা নিয়ে নেবেন।

-আপনি কিন্তু সত্যিই খুব অদ্ভুত। চলুন।

খুব তাড়াতাড়ি ফ্ল্যাট বন্ধ করে বাইরে বেরিয়ে ট্যাক্সিতে উঠল এলিনা এবং ওরা দু’জন। ট্যাক্সিটা পানু রায়ের অফিসে পৌঁছলে ওরা দু’জন নেমে পড়ল। পানু রায় ড্রাইভারকে বললেন,’ এখান থেকে সিনেমাপাড়া যেতে যা লাগবে যোগ করে কত হয়েছে বল। এই ভদ্রমহিলাকে সিনেমাপাড়ায় নামিয়ে দিও।‘ তারপর ড্রাইভারকে পয়সা মিটিয়ে ফুটপাথে উঠতেই দেখলেন পাশে কেলো দারোগা।

0 comments: