ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত
Posted in ধারাবাহিক১২. নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় যে প্রেম সে কি কাম?
হৃদিবরেষু বাসু
''হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে,/ মন বাড়িয়ে ছুঁই,/ দুইকে আমি এক করি না/ এককে করি দুই।'' এ যেন হৃদয়ের ভেতর থেকে আচমকা উঠে আসা একটি কবিতা! এই চিঠি যখন লিখছি তুমি নিশ্চয় তখন বেনারসে। পুজোর ছুটি নিয়ে ঘরে বসে আছি। সময় কাটাতে তাই অনেক খুঁজে বের করেছি নির্মলেন্দু গুণের নির্বাচিত কবিতা সংকলন। বইটা স্বয়ং কবির হাত থেকে পেয়েছিলাম। তোমাকে তার কবিতা নিয়ে বলার কিছু নেই জানি এমনকি বাংলাদেশের কাব্য-কবিতা–শিল্পসাহিত্য বিষয়ে যাঁদেরই একটু প্রাথমিক খোঁজখবর আছে, তাঁরা বোধ করি খুব বেশি দ্বিমত করবেন না যে নির্মলেন্দু গুণ যথেষ্ট পাঠকপ্রিয় কবি। এই কবি বেড়ে উঠেছেন উত্তপ্ত অগ্নিবলয়িত সময়ের ভেতর। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদের লড়াইয়ের দিনগুলোতে তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিকাশে সক্রিয় ছিলেন। এজন্য সমাজ ও জীবনের প্রতি দায়বদ্ধ তিনি এখনো। এই কবি কবিতার মাধ্যমে একাত্মতার বাণী প্রচার করেছেন। মানুষের সঙ্গে মানুষের একাত্ম হওয়ার সেই বাণী অসংখ্য পাঠককে মুগ্ধ করেছে, বাংলা কবিতায় নির্মিত হয়েছে একটি স্বতন্ত্র ধারা। তিনি প্রতিবাদ-সংগ্রামসর্বস্ব কবি নন মোটেও। বরং তাঁর কাব্যজগৎ পরিভ্রমণ করলে তাঁকে প্রধানত রোমান্টিক কবি বলেই মনে হবে। প্রেমই তাঁর কবিতার মূল প্রতিপাদ্য। তাহলে যা হওয়া অসম্ভব বলে তিনি মনে করেছিলেন শেষ পর্যন্ত তিনি কি তা-ই হয়েছেন? হয়তো সেটাই সত্য। তবে এই সত্যের সঙ্গে কিছু শর্ত জুড়ে আছে। তিনি ‘নিরপেক্ষ বা নির্ভেজাল রোমান্টিক কবি’ হওয়াকে অসম্ভব বলেছেন, অর্থাৎ ‘পক্ষপাতী বা ভেজাল রোমান্টিক কবি’ হতে অসুবিধা নেই। তাহলে এই ‘পক্ষপাতী বা ভেজাল রোমান্টিক কবি’র চারিত্র্য কী? তিনি কি সেটাই হয়েছেন? এ-সম্পর্কিত তাঁর একটি স্বঘোষণা এক্ষেত্রে পর্যালোচনা করা যেতে পারে – আমি অন্তহীন আনন্দের উৎস খুঁজে পেয়েছি জীবনের মাঝে। পরিপার্শ্ব যতো বৈরীই হোক না কেন, – আমি তো আর মেনে নিচ্ছি না তা। আমি জানি, সংগ্রামই সত্য, সংগ্রামই সুন্দর। প্রেম, সেও এক সংগ্রাম। প্রেম এবং সংগ্রাম তাঁর দৃষ্টিতে অবিচ্ছিন্ন। অর্থাৎ ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীর আকাঙ্খাকে তিনি অভিন্ন বলে বিবেচনা করেন। তাঁর প্রেম ও দ্রোহকে এই দৃষ্টিতে বিচার করাই যুক্তিযুক্ত হবে বলে আমার মনে হয়। নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই – প্রথম প্রকাশ ১৯৭০ সালে। এই গ্রন্থের সব কবিতা ষাটের দশকে লেখা, যে-সময়টা ‘উদ্দাম যৌবনতরঙ্গের মতো … মুক্তিমন্ত্রে ফুঁসে উঠেছিল’, যখন ‘নিরপেক্ষ বা নির্ভেজাল রোমান্টিক কবি হওয়া একেবারেই সম্ভব ছিল না’। কিন্তু তখনো তিনি প্রেমবিবর্জিত ছিলেন না, তবে তাঁর প্রেম ছিল সংগ্রাম-অভিমুখী, বা তাঁর সংগ্রাম ছিল প্রেম-প্রাণিত।
কবি নির্মলেন্দু গুণের প্রেমের কবিতায় আমরা চারটি প্রধান প্রবণতা খুঁজে পাই। প্রথমটি সুখী বা বিবাহিত জীবন অথবা পারস্পরিক ভালোবাসা। দ্বিতীয়টি প্রেমের প্রতি অবজ্ঞা, নিন্দা। প্রেম সম্পর্কে নিষ্ঠুর মনোভাব- যা নারীবিরোধী মনে হয়। তৃতীয়টি অধরা প্রেম বা প্লেটোনিক প্রেমের আধিপত্য সম্পদর্কিত, প্রেমের প্রতি সমর্পণ। চতুর্থ প্রবণতা হচ্ছে নারী সৌন্দর্যের চিত্রায়ণ খুব কমই।প্রথম প্রবণতার কবিতাগুলো সরল, বিশুদ্ধ, পারস্পরিক প্রেম ও দাম্পত্য প্রেমের সেরাটি সমর্থন করে। প্রেমের প্রতি সমর্পণের কথা রয়েছে। দুই আত্মা; কিন্তু মন যেন একটি- এসব কবিতার বৈশিষ্ট্য। এসব কবিতায় প্রিয়জন ছাড়া অন্য কোনো সত্তা নেই। এই প্রবণতার কবিতার সংখ্যা অনেক। কবি তার বন্ধুকে কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই একে অন্যকে ভালোবাসতে বলেন। কারণ তারা বিশ্বের কোনো ক্ষতি করছে না। তারা সব জড়জগৎ ত্যাগ করেছে। কবি বলেন যে, তাদের নিরীহ শারীরিক প্রেমের মাধ্যমে তারা প্রেমের জন্য আদর্শ হিসেবে অনুমোদিত হবে। তিনি প্রেমকে পারস্পরিক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে মনে করতেন। তিনি বাইরের হস্তক্ষেপের উল্লেখ ছাড়াই এবং প্রেয়সীর মধ্যে অপর্যাপ্ততার কোনো ইঙ্গিত ছাড়াই পারস্পরিক প্রেম তৈরির আনন্দ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের কবিতায় অতিমাত্রায় নারী ও যৌনতার অনুপ্রবেশ ঘটানোর দায় নির্মলেন্দু গুণের এই কথা চোখ বন্ধ করে বলা যায়। যদিও আমার মনে হয়, গুণের জনপ্রিয়তার মূলে ওই নারী ও যৌনতাবিষয়ক কবিতাগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। অমীমাংসিত রমণী কাব্যগ্রন্থ থেকে তাঁর এই যাত্রা শুরু। এরপর বিভিন্ন সময়ে নারী ও সংস্কারহীন যৌনতা প্রাধান্য পাওয়া কবিতাগুলো যথেষ্ট পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ মুঠোফোনের কাব্য, নিশিকাব্য, বাৎসায়ন কাব্যগ্রন্থগুলোর মাধ্যমে গুণ ভিন্নভাবে যেন হানা দিলেন। এর ভেতর দিয়ে ‘বাহ্যিক আদর্শ শাসিত’ পাঠকসমাজের গোপন বাজারটি তিনি দখল করে নিলেন। ফলে গুণের জনপ্রিয়তার পরিসর আরও বিস্তৃত হলো। নির্মলেন্দু গুণ নারীদের সম্পর্কে কথা বলতে পারেন, অনেক কবিতায় সৌন্দর্যের প্রশংসাও করেছেন। কিন্তু নারী সৌন্দর্যের চিত্রায়ণ খুব কমই আছে। তিনি সরাসরি বলেননি যে, তিনি তার প্রিয়জনের চুল বা ঠোঁট পছন্দ করেন। তিনি প্রেম-ভক্ত এবং শারীরিক চেহারা নয়, আবেগের কথা বলেন। তার কাছে ভালোবাসা মানে শুধু যৌনতা নয়। যদি সে তার প্রেয়সীর শরীরের কোনো অংশের কথা বলে, তা হলে সে কেবল তার মোহনীয়তা বর্ণনা করে। সরাসরি নারীর চরিত্র নির্মাণ না করা নির্মলেন্দু গুণের প্রেমের কবিতায় অন্যতম ও আকর্ষণীয় প্রবণতা বলে মনে করি। প্রেমের কবিতায় নির্মলেন্দু গুণের সবচেয়ে মৌলিক অবদান সম্ভবত কল্পনার সঙ্গে চিন্তার মিশ্রণ, বুদ্ধির সঙ্গে আবেগ ও বাস্তবতার প্রতিফলন। পান্ডিত্যপূর্ণ এবং কল্পনাপ্রসূত তুলনা দ্বারা তিনি তার কবিতায় একটি বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি তৈরি করার জন্য বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে চমৎকার সেতুবন্ধন তৈরিতে অসাধারণ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। প্রেমের অপূর্ব কিছু চিত্রকল্প। নির্মলেন্দু গুণের 'তোমার চোখ এত লাল কেন' কবিতাটি বেশ জনপ্রিয়। কোনো রাক-ঢাক না রেখেই একজন পুরুষের জবানিতেই কবিতায় উঠে এসেছে একাকী এক পুরুষের একাকীত্বের প্রগাঢ় বেদনা। খুব সরলভাবে মুখের ভাষায় তিনি কবিতায় বলেন, 'বাইরে থেকে দরজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত'। তাই, তিনি চান, কেউ একজন তার জন্য অপেক্ষা করুক। অপেক্ষা করুক ঘরের ভেতর। সেই অপেক্ষারতার কাছে বেশি কিছু প্রত্যাশা থাকবে না একাকী পুরুষটির। সে শুধু চায় ঘরের ভেতর থেকে একটি হাত দরজাখানি খুলে দেবে! এইটুকু! শুধু এইটুকু! এই সামান্য আকাঙ্ক্ষার কথা পড়তে পড়তে পাঠকের হৃদয় আর্দ্র হয়ে ওঠে। এই আকাঙ্ক্ষা শুধু কোনো একাকী পুরুষের নয়। একজন পুরুষের জবানিতে হলেও এই আকাঙ্ক্ষার কাছে এসে কবিতাখানি হয়ে ওঠে নারী-পুরুষ সকলের কবিতা। খাবার টেবিলে দিনের পর দিন একাকী রাতের খাবার এই নগরীর বহু মানুষ খায়। কোনো এক দুর্বল দিনে একাকী আহারের সময় কার না মনে হয়, আহা! কেউ একজন থাকুক পাশে বসে। খেতে-খেতে দু'জনে গল্প হবে। খুনসুটি হবে। তারপর আবার না হয় ফেরা যাবে যে যার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের প্রাচীর ঘেরা কুঠুরিতে।
নর-নারীর মৌলিক সম্পর্ক যৌনসম্বন্ধ নিয়ে প্রাচীন ভারতে কোনো কূপমণ্ডূকতা ছিল না। নারী যেমন নিজের শরীরের প্রয়োজনে আকাঙ্খা করতো পুরুষশরীর, পুরুষও তেমনি নিজের প্রয়োজনেই কামনা করতো নারীশরীর। শরীর বিষয়ে কোন সংস্কার তাঁরা মনের গোপন গহীনে লালন করতো না। বাঁধা হয়ে দাঁড়াতো না কোনো সামাজিক রক্তচক্ষু। এমনি অবাধ, স্বচ্ছন্দ, উদার, চিরকাক্ষিত ও ধ্রুপদী জীবনপ্রবাহের যুগেই জন্মেছিলেন ঋষি বাৎসায়ন। সমগ্র পৃথিবীতে তিনিই প্রথম নারী-পুরুষের যৌনজীবন এবং তার বিভিন্ন দিক নিয়ে রচনা করেছেন অসাধারণ গবেষণাগ্রন্থ ‘কামসূত্র’। ‘কামসূত্র’ শাস্ত্রটির যৌক্তিকতা, মৌলিকতা, তথ্যের প্রাচুর্য অর্থাৎ বিষয়ের বিচিত্র ব্যাপকতা এত শক্তিশালী ছিল যে বর্তমানে সারা পৃথিবীতে যৌনবিজ্ঞান বিষয়ক প্রথম গ্রন্থ হিসেবে ‘কামসূত্র’ সম্মানিত হয়। এই চির আধুনিক গ্রন্থ ‘কামসূত্র’ রচনা করতে গিয়ে বাৎসায়নের থাকতে হয়েছিল যৌনবিষয়ে সন্ধানী, যুক্তিবাদী, কৌতুহলী, বিশ্লেষণপ্রবণ এবং নির্মোহ একটি মন। ঋষিসুলভ প্রাজ্ঞ অন্বেষণ দিয়ে বাৎসায়ন নারীশরীর ও পুরুষশরীরের প্রতি বর্গইঞ্চির প্রতিটি সুগন্ধকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি মৈথুন বিষয়ে পোষণ করতেন উদার ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী। মানব শরীরের প্রতিটি ভাঁজ-বাঁকে লুকিয়ে থাকে যে আনন্দ সেই আনন্দ অন্বেষায় বাৎসায়ন ছিলেন মৌলিক, নান্দনিক ও বৈজ্ঞানিক মনোভঙ্গীর অধিকারী। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন নর-নারী সম্পর্কের প্রধান ভিত্তি শরীর। প্রেম বা ভালোবাসা নামক কল্পিত বিষয়টি মূলতঃ গাছে ফোটা ফুলের মতো বড়ই বাহ্যিক। তার রং ও সৌন্দর্যটা সহজে চোখে পড়ে কিন্তু যা মূল তা থেকে যায় চোখের আড়ালে। বাৎসায়ন অন্যদের মতো শুধু ফুল দেখে মুগ্ধ হননি। বৈজ্ঞানিক সচেতনতা নিয়ে খুঁজে বের করেছেন গাছের প্রাণের উৎস শিকড়কে তথা নর-নারীর প্রাণোচ্ছলতার শুদ্ধ উৎস কামপ্রবণতাকে। প্রাজ্ঞ কবি নির্মলেন্দু গুণ উপলব্ধি করেছেন নর-নারী সম্পর্কের আদি ও মৌলিক উৎসটি এখনও যথেষ্ট ক্রিয়াশীল। মানুষের গভীর সম্পর্ক ও আকর্ষণের ভিত্তি এখনও শরীর। মানুষ হিসেবে- পুরুষ হিসেবে নির্মলেন্দু গুণ এই ধ্রুপদী ও জৈবিক প্রত্যাশাকে প্রবলভাবে নিজের জীবনে অনুভব করেছেন। ‘বাৎসায়ন’ কাব্যটি তাঁর এই মানবিক বোধের সতেজ প্রস্ফুটন। তিনি পুরুষ হিসেবে নারীর শরীরের প্রতিটি গিরিগুহাকে, প্রতিটি স্পর্শকে, প্রতিটি আলিঙ্গনকে, প্রতিটি শীৎকারকে প্রবল প্রাণপ্রবণতায় উপভোগ করেছেন। পুরুষ নির্মলেন্দু একলব্যের অধ্যবসায়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছেন নারীর শরীর ও কামসূত্রকে। তাঁর কবিমন ও ‘কাব্যকামকুশলতা’ আশ্রয় পেয়েছে শরীর মন্থনে। তিনি জানেন মানুষের সর্বোচ্চ আনন্দের অনুভূতি ও জ্ঞানের উপলব্ধি ঘটে এই শরীর বিনিময়েই। তাই তিনিই বলতে পারেন- “আনন্দের শ্রেষ্ঠ উৎস হচ্ছে কাম। কাম থেকে জন্ম নিয়েছে কবি।”নির্মলেন্দু গুণের প্র্রেমজ কবিতা গুলো দিকে নজর ফেরালে দেখা যাবে নির্মলেন্দু গুণের একটি প্রিয় বিষয় দেহ ও দেহানুষঙ্গ। তিনি কপট নন। তাই অকপটে নিজের বিশ্বাস ও কল্পনা প্রকাশ করেন। কিন্তু কখনো, কখনো তা নারীকে প্রয়োজনীয় সম্মানের পক্ষে আপত্তিজনক। যেমন, তিনি যখন লেখেন: ‘রান্নাঘর থেকে টেনে এনে স্তনগুচ্ছে চুমু খাও তাকে, বাথরুমে ভেজানো দরোজা ঠেলে অনায়াসে ঢুকে যাও- সে যেখানে নগ্ন দেহে গানার্র্থেই তৈরি হয়ে আছে আলোকিত দুপুরের কাছে-, মনে রেখো, তোমার রাত্রি নেই, অন্ধকার বলে কিছু নেই। বিবাহিত মানুষের কিছু নেই একমাত্র যত্রতত্র স্ত্রীশয্যা ছাড়া।’ -স্ত্রী তখন, অশ্লীলতার চূড়ান্তে পৌঁছেও কবিতার স্বার্থে তা হজম করা যায়। কিন্তু নির্মলেন্দু গুণ যখন লেখেন নিচের পঙ্ক্তিগুলো, তখন? ‘যেমন প্রত্যহ মানুষ ঘরের দরোজা খুলেই দেখে নেয় সবকিছু ঠিক আছে কিনা, তেমনি প্রত্যহ শাড়ির দরোজা খুলে স্ত্রীকেও উলঙ্গ করে দেখে নিতে হয়, ভালো করে দেখে নিতে হয়: -জঙ্ঘায়, নিতম্বে কিংবা সংরক্ষিত যোনির ভিতরে অপরের কামনার কোনো কিছু চিহ্ন আছে কিনা।’ -ঐ এগুলো কীভাবে গ্রহণ করা যাবে? কবির দৃষ্টিতে এখানে ‘মানুষ’ হলো পুরুষ আর সেই পুরুষের স্ত্রী যেন আসবাব, তালাবদ্ধ ঘরের জিনিসপত্র! নির্মলেন্দু গুণ এখানে পুরুষতান্ত্রিক প্রথাবদ্ধ দৃষ্টিতে আবদ্ধ। ‘স্ত্রী’ কবিতাটি কবির ১৯৭২ সালে প্রকাশিত না প্রেমিক না বিপ্লবী কাব্যগ্রন্থভুক্ত। তার মানে, গুণের কবিতায় কামগুণ শুরু থেকেই ছিল। ২০০০ সালে বেরিয়েছে বাৎসায়ন, এর পর কামগন্ধী বহু কবিতা মিলিয়ে বের করেন কামকানন (২০০৭)। কেন কামের রাজ্যে বসবাস?- এক সাক্ষাৎকারে (প্রথম আলো : ২২শে জুন, ২০০৭) নির্মলেন্দু গুণ জানিয়েছেন: ‘আমি [নির্মলেন্দু গুণ] কিছুটা সচেতনভাবেও করেছি বলা যায়। আমি ভেবেছি, কামকেন্দ্রিক কবিতার ধারাটিকে আরও প্রবল করে উপস্থাপন করি।’ নির্মলেন্দু গুণের এ ভাষ্যে আমার আপত্তি আছে। নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় প্রেম-কাম-রাজনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে- এটাই তাঁর বৈশিষ্ট্য। তিনি মনে করেন না যে, কবিতা গণশিক্ষা কার্যক্রমে মাস্টারমশাইয়ের ভূমিকা নেবে। আবার নারীর স্তনাগ্র-চূড়ায় তাঁর বিশ্ব কেঁপে ওঠে। তিনি চুম্বনাকাক্সক্ষায় উটের মতো গলা বাড়িয়ে দেন : ‘আমার অন্তিম চুম্বনের জন্য আমি তোমার নেত্রকোণার উদ্দেশ্যে তখন প্রসারিত করবো আমার অধরোষ্ঠ। ঝর্নার উচ্ছল জলের দিকে যেরকম তৃষিত গ্রীবাকে প্রসারিত করে উষ্ট্র। তোমার বাম চোখে আমি পান করব এক লক্ষ ক্যান ঠাণ্ডা জার্মান বিয়ার, ডান চোখে লক্ষ পেগ স্কচ হুইস্কি।’ -এক সময় কামকে কাব্যের বড় উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হতো। আমাদের পূর্বপুরুষরা সেটা চেষ্টা করেছেন। আমি চেষ্টা করেছি কামকে কতটা শিল্পরূপ দিয়ে প্রকাশ করা যায়। এ চেষ্টা এখনও অব্যাহত আছে। প্রেম তো যৌনতারই একটি সংস্কৃত প্রকাশ।’ (মহুয়া : নির্মলেন্দু গুণ সংখ্যা : ২০০৮)।
কবি ও কবিতাকে বিচার করার মতন পড়ালেখা ও জ্ঞান কোনটাই আমার হয়ত নেই তবু কেন যেন বিশ্বাস করতে মন চায় প্রেমের কবিতাগুলোয় কবি নির্মলেন্দু গুণের জগৎ নারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হলেও নারীর প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিটি কবিতায় ভিন্ন। কোথাও তারা অনুগত আবার কোথাও তারা অবিশ্বস্ত। নির্মলেন্দু গুণের প্রেমের কবিতা তার অভিজ্ঞতাকে প্রতিফলিত করে। একজন প্রেমের কবি হিসেবে নির্মলেন্দু গুণ পার্থিব প্রেমের প্রতি তার মনোযোগ নিবদ্ধ করেছেন। পাঠকরা কবির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ও আবেগের কোথাও সে তার প্রিয়তমার সঙ্গের কথা বলে; কোথাও তিনি জীবনের অন্য যে কোনো জিনিসের চেয়ে প্রেম পছন্দ করেন। কিছু সময়ে তিনি নারীদের অবিশ্বস্ত প্রকৃতি সম্পর্কে কথা বলেছেন। তারুণ্য গুণের কবিতার বড় সম্পদ। কবিতায় ও যাপনে তিনি কখনো বুড়িয়ে যাননি। জীবন ও চারপাশ নিয়ে প্রথম জীবনেও তিনি হেঁয়ালি করেছেন, এখনো করেন। আর তাই কিনা জানিনা তিনি বলে ফেলতে পারেন, “আমার স্তনস্তবমুখরিত কবিতায়, তাই দুগ্ধবতী নারীরা হয়েছে আমার ঈশ্বরী” তিনি নারীর বুকের পুষ্পযুগলের অপরূপ শোভা প্রাণভরে উপভোগ করেছেন। বিকশিত পুষ্পদ্বয়ের গভীরে প্রাণরূপ মধু ও কামরূপ শক্তির যে বিরাট খনি লুকিয়ে আছে তার সৌন্দর্য দেখে মোহিত হয়েছেন। কামশাস্ত্রজ্ঞ যে কবি বিস্ময়ে তাকিয়ে তাকিয়ে- “দেখিলেন সেই অপরূপ শোভা, মনোলোভা, নিদ্রিতা, নিশ্চুপ।” সেই তিনিই দেখেছেন সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো সুডৌল পুস্পকলি দুটি প্রস্ফুটনের জন্য অপেক্ষা করে পুরুষআঙ্গুলের সামান্য স্পর্শের, আর তারপরেই ঘটে যায় মহাবিস্ফোরণ- “অসতর্ক পুরুষ-আঙুলের সামান্য আঘাতে বিভাজিত হল পরমাণু, বিস্ফোরিত হল বোমা।” নির্মলেন্দু গুণের জীবনে কবিতা ও সেই সম্পর্কিত প্রতিটি অবস্থানই চির আকাঙ্খার। তিনি দেখেছেন তাঁর সমস্ত কাব্যসাধনা, কাব্যযশ এবং‘কাব্যকামকুশলতা’র প্রধান উৎস কাম। সমকালীন বাস্তববিমুখ মানুষের কাছে তা অপরিচিত হলেও প্রেমিক কবি চণ্ডীদাশ ও বাৎসায়নকে অনুধাবন করে তিনি জেনে নিয়েছেন পরম সত্যটিকে- “তাঁরই কল্যাণে নারীকে চিনেছি, শিখেছি সঙ্গম কলা, রতিরঙ্গরস; তা না হলে সকলি গরল ভেল, কামসিদ্ধি বিনা ব্যর্থ কাব্যযশ।” নাকি দেহ মনেরই প্রকাশ?” এই অমীমাংসিত প্রশ্ন বাৎসায়নের মতো নির্মলেন্দু গুণকেও বিক্ষত করেছে চলেছে জীবনভর। অবশেষে উত্তীর্ণ যৌবনে কবি পেয়েছেন সত্যের সন্ধান। “বুঝেছেন মন বড় সত্য নয় মানবের দেহই প্রধান।”
আমার সাথে তোমার ভাবনা কতটা মিললো আদৌ মিললো কিনা জানিনা, কয়েকদিন ধরে নির্মলেন্দু গুণ পড়তে পড়তে যা মনে এলো তাই তোমাকে লিখে দিলাম। কেমন হলো তোমার বেনারস ভ্রমণ? খুব যদি ভুল না করে থাকি এটাই তোমার জীবনে কোন বন্ধুর সাথে পারিবারিক ট্যুর। মনতোষ কি সেই আগের মতন নিজের ভেতরে গুটিয়ে থাকে? তোমার সাথে প্রথম বেঞ্চ শেয়ার করা মানুষটি কোন অভিমানে নিজেকে তোমার থেকে গুটিয়ে নিয়ে এতবছর কষ্ট পেলো সেই সন্ধান নিশ্চয় করেছো? গিনির কথা শুনে তাকে খুব দেখার শখ জেগেছে। তার ভালো হোক, অনেক বড় হোক সে। বৈশুকে আমার শুভকামনা ও ভালবাসা দিও। মনতোষ তো এমন একজন সঙ্গীই ডিজার্ভ করে তাই না? তোমাদের ঘোরাঘুরির ছবি পাঠিও সঙ্গে ভ্রমণ বৃত্তান্ত। বহুবছর তোমাকে দেখিনা এই সুযোগে তোমাকে দেখা হবে সঙ্গে মনতোষ, বৈশু আর গিনি মা কেও দেখে নেয়া যাবে। নিরন্তর ভালো থেকো। মনতোষ ও তাঁর সংসার দেখে এবার অন্তত নিজেকে নিয়ে ভাবো। সবশেষে একরাশ দুষ্টু হাসি...
ভালবাসা ও শুভকামনায়
সুস্মি
দশমী সন্ধ্যা
০২.১০.২০২৫
0 comments: