0

প্রবন্ধ - অনিরুদ্ধ গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in




















বন্দে মাতরম্ – মাতৃবন্দনার এই সুবিখ্যাত স্তবগীতি, যা গত প্রায় দেড়শো বছর ধরে ভারতীয়দের উদ্বুদ্ধ এবং ভাববেগে আন্দোলিত করেছে, তার রচয়িতা যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সে তথ্য সর্বজনবিদিত। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, বন্দে মাতরম-এর সুরস্রষ্টা কে, তবে একটু ভাবতে এবং জানতে হবে।


এক কথায়, বন্দে মাতরম্ শতাধিক বার সুরারোপিত হয়েছে। এবং অনেক সুরকারেরই পরিচয় অজ্ঞাত।


তাহলে প্রশ্ন ওঠে প্রথম কে সেই সুরকার যিনি এই স্তবগাথাকে গানে পর্যবসিত করেন ?


এ কথা সকলেই জানেন যে বন্দে মাতরম্ বঙ্কিমের আনন্দমঠ উপন্যাসে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে। আনন্দমঠ বঙ্গদর্শন পত্রিকায় ১২৮৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যা (মার্চ, ১৮৮০) থেকে শুরু করে ১২৮৯ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা (জুন, ১৮৮২) পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হয়। প্রথম মাসেই বন্দে মাতরম্ প্রকাশ পায়। বঙ্গদর্শন পত্রিকায় শেষ কিস্তি প্রকাশিত হবার অব্যবহিত পরই ১৮৮২ সালে পুস্তকাকারে আনন্দমঠ প্রকাশিত হয়।


বন্দে মাতরম্ কিন্তু আনন্দমঠে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বেশ কিছু বছর, অন্তত চার-পাঁচ বছর, আগেই রচিত হয়েছিল। কবে এবং কোথায়, তা নিয়ে কিছু মতভেদ ছিল। বহরমপুর, লালগোলা, চুঁচুড়া, বারাসত ইত্যাদি স্থান দাবীদার হলেও, এখন মোটামুটি স্বীকৃত যে ১৮৭৫-৭৬ সালে প্রায় আট মাস তাঁর কাঁটালপাড়ার বাড়ীতে অবস্থান কালে কোন এক সময়ে বঙ্কিম বন্দে মাতরম্ রচনা করেন। চুঁচুড়াবাসী নবজীবন পত্রিকা সম্পাদক অক্ষয়চন্দ্র সরকার তাঁর ‘বঙ্কিম প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন যে কাঁটালপাড়ায় অবকাশযাপন করার সময়ে বঙ্কিম বন্দে মাতরম্ লিখেছিলেন বলে তিনি শুনেছিলেন, এবং পরে চুঁচুড়ায় অবস্থানের সময়ে বঙ্কিমকে তিনি বন্দে মাতরম্-এর কিছু অদল-বদল করতেও দেখেছেন। ১৮৭৪ সালে কোন একটি শীতের সকালে বন্ধুদের সকাশে আলাপরত বঙ্কিম সহসা, ‘আমি এখন জাতীয় গান রচনা করতে যাচ্ছি’, এই বলে ঘরে ঢুকে বন্দে মাতরম্ লিখে ফেললেন, এমন সব কাহিনি প্রচলিত থাকলেও তাদের পক্ষে জুতসই সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। প্রধাণত গল্প, উপন্যাস, প্রহসনের লেখক বঙ্কিমচন্দ্র কেন বাংলা হরফে অধিকাংশ সংস্কৃত আর মাত্র কিছু বাংলা বাক্য মিশিয়ে এমন একটি গাথা রচনা করলেন, এবং এত বছর তাকে অপ্রকাশিত রাখলেন, সেও বহু আলোচিত বিষয়। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে প্রকাশিত (আষাঢ়, ১৩৪৫) আনন্দমঠ-এর যুগ্ম সম্পাদক শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রীসজনীকান্ত দাস তাঁদের ভুমিকায় লিখেছেন, ‘“বন্দে মাতরম্” গান রচনা সম্পর্কে ইতিমধ্যেই বহু কিম্বদন্তী প্রচলিত হইয়াছে। অনেকের ধারণা ইহা ‘আনন্দমঠ’ লেখার পূর্ব্বে রচিত; কেহ কেহ মনে করেন বঙ্কিমচন্দ্র বহরমপুরে ডফিন্ সাহেব কর্তৃক অপমানিত হইয়া প্রতিহিংসাপরবশচিত্তে ইহা রচনা করিয়াছিলেন।‘ অবশ্য গোপালচন্দ্র রায় আবার তাঁর ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ গ্রন্থে মতপ্রকাশ করেছেন, ‘১২৮১ সালের আশ্বিনে বা ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বঙ্কিমচন্দ্র মালদহের ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন। পূজার ছুটিতে মালদহ থেকে কাঁটালপাড়ার বাড়িতে এসে বাড়ির দুর্গাপূজা দেখে প্রথমে “আমার দুর্গোৎসব” এবং পরে “বন্দে মাতরম্” রচনা করেছিলেন ... ।‘ এই উক্তিতে সময় নিয়ে ভিন্ন মত থাকলেও, স্থান নিয়ে বিরোধ নেই, এবং রচনার প্রেক্ষাপট ডফিন্ সাহেব নন, দুর্গাপূজা। সে যা হোক, রচনাটি বঙ্কিমচন্দ্র যে সেই সময়ে প্রকাশনায় অসম্মত ছিলেন, তা তাঁরই ভাই পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণায় ব্যক্ত হয়েছে। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত বঙ্কিমপ্রসঙ্গ গ্রন্থে তিনি বিবৃত করেছেন এই ঘটনা: “বন্দেমাতরম্” গীতটি উহার [অর্থাৎ ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের] বহু দিন পূর্ব্বে রচিত হইয়াছিল।—বঙ্গদর্শনে মাঝেমধ্যে দুই এক পাতা matter কম পড়িলে পণ্ডিত মহাশয় [অর্থাৎ ‘বঙ্গদর্শন’-এর কার্যাধ্যক্ষ রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়] আসিয়া সম্পাদককে জানাইতেন, তিনি তাহা ঐদিনেই লিখিয়া দিতেন। —‘বন্দেমাতরম্’ গীতটি রচিত হইবার কিছু দিবস পরে পণ্ডিত মহাশয় আসিয়া জানাইলেন, প্রায় এক পাতা matter কম পড়িয়াছে। সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র বলিলেন, ‘আচ্ছা, আজই পাবে’। এক খানা কাগজ টেবিলে পড়িয়াছিল, পণ্ডিত মহাশয়ের উহার প্রতি নজর পড়িয়াছিল, বোধ হয় উহা পাঠও করিয়াছিলেন, কাগজ খানিতে ‘বন্দেমাতরম্’ গীতটি লেখা ছিল। পণ্ডিত মহাশয় বলিলেন, ‘বিলম্বে কাজ বন্ধ থাকিবে, এই গীতটি লেখা আছে, উহা মন্দ নয় ত—ঐটা দিন না কেন?’ সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্র বিরক্ত হইয়া কাগজ খানি টেবিলের দেরাজের মধ্যে রাখিয়া বলিলেন, ‘উহা ভাল কি মন্দ, এখন তুমি বুঝিতে পারিবে না, কিছুকাল পরে উহা বুঝিবে — আমি তখন জীবিত না থাকিবারই সম্ভব, তুমি থাকিতে পার।’” [‘বন্দে মাতরম্ এবং একটি উদ্ধৃতিচিহ্ণ’ – মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় / banglalive.com]


এই মাতৃবন্দনার গাথাকে বঙ্কিম একটি গীত হিসেবেই কল্পনা করেছিলেন, নেহাৎ একটি স্তোত্র হিসেবে নয়। যখন আনন্দমঠে তিনি অন্তর্ভুক্ত করলেন, তখন ভবানন্দ মহেন্দ্রকে এই গান গেয়ে মাতৃপরিচয় বোঝাচ্ছেন। তিনি নিজে সঙ্গীতপ্রেমী ছিলেন, এবং সঙ্গীত শিক্ষাও পেয়েছিলেন, এমন কথিত আছে। কিন্তু মৌলিক সুরস্রষ্টা তিনি ছিলেন না। ছাপার অক্ষরে প্রকাশে আগ্রহী না হলেও বঙ্কিম পরিচিত মহলে বন্দে মাতরম্ পাঠ করতেন, এবং তৎকালীন এক প্রসিদ্ধ সঙ্গীত বিশারদকে দিয়ে তাকে সুরবদ্ধ করতে প্রয়াসী হ’ন। ‘“বন্দে মাতরম্”-এর সুর : উৎস ও বৈচিত্র্য’ গ্রন্থে এর বিবরণে বলা হয়েছে: “... ‘বন্দে মাতরম্’ গানে প্রথম সুরারোপ করেন কে? এ-সম্পর্কে একই তথ্য এবং একই উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন জগদীশ ভট্টাচার্য ও গোপালচন্দ্র রায়। সকলেই জানেন, ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসটি উৎসর্গ করা হয় বঙ্কিমচন্দ্রের অভিন্নহৃদয় সুহৃদ দীনবন্ধু মিত্রের নামে। দীনবন্ধু মিত্রের পুত্র ললিতচন্দ্র মিত্র তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘বন্দে মাতরম’ রচিত হইবার পরে বঙ্কিমচন্দ্রের গৃহে তদানীন্তন সুকণ্ঠ গায়ক ভাটপাড়ার স্বর্গীয় যদুনাথ ভট্টাচার্য মহাশয় ইহাতে সুরতাল সংযুক্ত করিয়া প্রথম গাহিয়াছিলেন।....”


এই যদুনাথ ভট্টাচার্য আর কেউ নন, বাংলায় যদুভট্ট নামে যিনি স্বনামখ্যাত। বঙ্কিম তাঁর কাছে গানও শিখতেন, এমনও শোনা যায়। সুতরাং ললিতচন্দ্র মিত্রের বয়ান অনুযায়ী যদুভট্টই বন্দে মাতরম্-এর প্রথম সঙ্গীতকার।


দুর্ভাগ্যবশত যদুভট্টের সৃষ্ট সেই বন্দে মাতরম্ কেমন ছিল তা আর আজ জানার উপায় নেই, কারণ এই সৃষ্টিকে তিনি বা অন্য কেউ যদি স্বরলিপিতে রূপান্তরিত করেও থাকেন, তা এখন আর উপলব্দ্ধ নয়। তবে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে যদুভট্টের এই সুরারোপ আনন্দমঠ প্রকাশের অনেক আগেই ঘটে থাকবে। তার কারণ, আনন্দমঠ-এর প্রথম সংস্করণে যে বন্দে মাতরম্ ছাপা হয়েছিল, তার নীচে লেখা হয়েছিল, ‘মল্লার রাগ, কাওয়ালি তাল’। এখন কথা হচ্ছে যে, যদুভট্ট ছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার সঙ্গীতজ্ঞ, যে ঘরানায় কাওয়ালি তাল কখনো ব্যবহৃত হয় না। অতএব ধরে নিতে হয়, যে বন্দে মাতরম্ আনন্দমঠে প্রকাশিত হয়, তার সুর যদুভট্ট রচিত সুর থেকে পৃথক।


এই প্রসঙ্গে অক্ষয়চন্দ্র সরকারের একটি লেখার কিছু উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক। সম্ভবত তখনো আনন্দমঠ-এর একটি কল্পরূপই বঙ্কিমচন্দ্রের ধারণায় ছিল, লিখিত আকার নেয়নি। অক্ষয়চন্দ্র লিখেছেন, “যখন আনন্দমঠ সূতিকাগারে, তখন ক্ষেত্রনাথ মুখোপাধ্যায় এখানকার আর একজন ডেপুটি ছিলেন, বঙ্কিমবাবু ত একজন ছিলেন; উভয়ের পাশাপাশি বাসা। সন্ধ্যার পর তিনি আসেন, আমিও যাই। তিনি সুরজ্ঞ,বড় টেবল হারমোনিয়ম্ লইয়া তিনি ‘বন্দে মাতরম্’ গানে মল্লারের সুর বসান । বঙ্কিমবাবুকে সুরের খাতিরে যৎসামান্য অদল বদল করিতে হয়।“


এই সময়কাল ১৮৭৬ সাল নাগাদ হবে, কারণ সেই সময়েই বঙ্কিম হুগলীর ডেপুটি কালেক্টর হয়ে এসে চুঁচুড়ায় বসবাস করতেন। অক্ষয়চন্দ্র এখানে যাঁকে ক্ষেত্রনাথ নামে পরিচয় দিয়েছেন, সেই ‘আর একজন ডেপুটি’র আসল নাম ছিল ক্ষেত্রমোহন। লক্ষ্যনীয়, এখানে মল্লার রাগের উল্লেখ রয়েছে, পরবর্তীতে যা আনন্দমঠ-এ নিবদ্ধ হয়েছে। অবশ্য যদুভট্টও মল্লার রাগ ব্যবহার করে থাকতে পারেন, কিন্তু কাওয়ালি তাল তাঁর ঘরানাসিদ্ধ নয়। এই কারণে একটি মত এই যে ক্ষেত্রমোহন মুখোপাধ্যায়ই বন্দে মাতরম্-এর আদি সুরকার। তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সৃষ্ট বন্দে মাতরমকে সঙ্গীতরূপ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সুরকারদের দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাচ্ছেন, আনন্দমঠ রচনার পূর্বেই। এই সব সুরের কিছুই আর পাওয়া যায় না, এটাই আক্ষেপ।


১৮৮২ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশ পাওয়ার পরের বছর ১৮৮৩তে আনন্দমঠ অভিনীত হয় দ্য গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারে। কেদার চৌধুরী পরিচালিত নাটকে তৎকালীন বিশিষ্ট সঙ্গীত পরিচালক ও শিল্পী দেবকান্ত বাগচী রাগ তিলক-কামোদে বন্দে মাতরম গেয়েছিলেন, এমন বিবরণ পাওয়া যায়। কথিত আছে স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র এই নাট্যরূপ দেখেছিলেন, কিন্তু আশাহত হয়ে সাহিত্যিক শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের কাছে অত্যন্ত বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন।


আনন্দমঠ বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত হবার সময় থেকেই সুধীসমাজে আগ্রহ এবং প্রসংসার তরঙ্গ তুলেছিল। কলকাতার সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রথম পরিবার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ী তার ব্যতিক্রম ছিল না। উপন্যাসের ঐ অপূর্ব বন্দনাগীত যুবক রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করল। তিনি এর আগের যদুভট্ট- বা ক্ষেত্রমোহন-কৃত সুরগুলি শুনেছিলেন কিনা জানা নেই, কিন্তু নিজে মৌলিকভাবে সুরারোপের প্রচেষ্টা করেন, এবং প্রথম দেশ রাগে বন্দে মাতরম সঙ্গীতবদ্ধ করেন, এমনটাই অধিকাংশ ভাষ্যকারের বিবরণে প্রকাশ পেয়েছে।


প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘রবীন্দ্রজীবনী’তে লিখেছেন যে, শোনা যায়, বঙ্কিমচন্দ্রের জীবিতাবস্থায়ই রবীন্দ্রনাথ বন্দে মাতরম্ গানে সুর বসিয়ে তাঁকে শুনিয়েছিলেন। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ নেপাল মজুমদারও তা সমর্থন করেছেন [ভারতে জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ, প্রথম খন্ড]। “বন্দে মাতরম – প্রেরণা ও বিতর্ক” প্রবন্ধ সংকলন বইতে ‘বন্দে মাতরম ও রবীন্দ্রনাথ’ নিবন্ধে সন্তোষকুমার দে বঙ্কিম জন্ম শতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের ভাষণের এই রকম উদ্ধৃতি দিয়েছেন: “তাঁর (বঙ্কিমচন্দ্রের) বন্দে মাতরম্ গানে আমিই প্রথম সুর দিয়ে তাঁকে শোনাই। সবটা আমি গান করিনি, যতটা আমি সুর দিয়েছিলাম ততটা তাঁকে শুনিয়েছি। তিনি তাতে খুব প্রসন্ন হয়েছিলেন।“


রবীন্দ্রনাথের এই উদ্ধৃতিকে সত্য মেনে চললে কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয়।


প্রথমত, তিনি কেন বললেন যে তিনিই প্রথম সুর দিয়েছিলেন ? কারণ স্পষ্ট নয়, তবে খুব সম্ভবত তাঁর পূর্ববর্তী সুরকারদের সুর সম্বন্ধে তিনি অবহিত ছিলেন না। যেহেতু কোন পূর্বতন স্বরলিপি ছিল না, এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয়।


দ্বিতীয়ত, তিনি ‘যতটা সুর’ দিয়েছিলেন, তা কতটা ? এ সম্বন্ধে সকলেই সহমত যে মোট ছয় স্তবকের প্রথম দুটি স্তবকই (বন্দে মাতরম্ ........ সুখদাং বরদাং মাতরম্) রবীন্দ্রনাথ দেশ রাগে সুরবদ্ধ করেন। নেপাল মজুমদারের ভাষ্য অনুযায়ী “রবীন্দ্রনাথ ‘বন্দে মাতরম্’ গানটির প্রথম অংশটি সুরসংযোগ করিয়া বঙ্কিমচন্দ্রকে শুনাইয়াছিলেন। এর বহুকাল পর ১৯৩৭-৩৮ সালে ..... কবি স্বয়ং তাহা স্বীকার করেন।“ সেই সময়ে রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথের পত্নী জ্ঞনদানন্দিনী, ঠাকুর পরিবারের থেকে প্রকাশিত ছোটদের জন্য ‘বালক’ নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সেই পত্রিকায় বিভিন্ন বিভাগের একটি ছিল সঙ্গীত-চর্চা সম্বন্ধীয়। রবীন্দ্রনাথের এক ভাগ্নী প্রতিভাসুন্দরী, যিনি ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য উভয় ধারার ধ্রুপদী সঙ্গীতে সুদক্ষ ছিলেন, ১২৯২ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ (অর্থাৎ ১৮৮৬ সালের মে) সংখ্যায় বন্দে মাতরম্-এর ওই প্রথম দুই স্তবকেরই ‘দেশ-কাওয়ালি সুরতালে নিবদ্ধ স্বরলিপি প্রকাশ করেন’ (রবিজীবনী, তৃতীয় খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল)। কিন্তু সেখানে স্বরলিপিকার হিসেবে প্রতিভাসুন্দরীর নাম দেওয়া হলেও সুরকারের নাম প্রকাশ হয়নি। এই জন্য একটি ভ্রান্ত ধারণা এও আছে যে দেশ রাগে নিবদ্ধ এই অংশটির প্রথম সুরকার প্রতিভাসুন্দরী। তবে এই প্রথম বন্দে মাতরম্-এর কোন স্বরলিপি সর্বসমক্ষে এলো। তবে এর ১৪ বছর পর ১৯০০ সালে রবীন্দ্রনাথের অন্য এক ভাগ্নী সরলা দেবী প্রকাশিত ‘শতগান’ বইতে এই অংশটুকুরই দেশ রাগে নিবদ্ধ স্বরলিপি পুন: প্রকাশিত হয়, এবং সেখানে সুরকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ মুদ্রিত স্বীকৃতি পান।


এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে এর চার বছর আগে ১৮৯৬ সালে কলকাতার বিডন স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে গুরুদেব বন্দে মাতরম্ গেয়েছিলেন। প্রশান্তকুমার পাল রবিজীবনী চতুর্থ খণ্ডে লিখেছেন, “.... কংগ্রেস অধিবেশনের সূচনায় রবীন্দ্রনাথ গাইলেন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম’ গানের প্রথম দুটি কলি, .... সুরটি তাঁর নিজেরই দেওয়া।“ রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ প্রবোধচন্দ্র সেনও এই ঘটনা সম্পর্কে কবির দ্বারা বন্দে মাতরম্-এর প্রথমাংশ গাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। ১৯০৫ বা ১৯০৬ সালে হেমেন্দ্র মোহন বোস-এর টকিং মেশিন সিলিন্ডার রেকর্ডে ধরা রবীন্দ্রনাথের একটি বন্দে মাতরম্-এর রেকর্ডিং পাওয়া যায়, সেও ঐ দুই স্তবকই। অনেক পরে যখন স্বরবিতান সংকলিত হতে লাগল, তখন স্বরবিতান-৪৬এ প্রথম দুই স্তবকেরই স্বরলিপি সংযোজিত হয়।


অর্থাৎ যা কিছু তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়, সবই নির্দেশ করে যে রবীন্দ্রনাথ ঐ প্রথম দুই স্তবকের আগে আর অগ্রসর হননি – সুরকার অথবা গায়ক হিসেবে। এর বহু পরে, ১৯৩৭ সালে যখন জাতীয় কংগ্রেস দেশের জন্য একটি জাতীয় সংগীত নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তাদের একটি প্রতিনিধি দল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন, এবং গবেষকদের মতে, তিনি এই অভিমত দিয়েছিলেন যে, যদি বন্দে মাতরম্ দেশের জাতীয় সংগীত নির্বাচিত হয়, তবে তার প্রথম দুই স্তবকই নেওয়া উচিৎ। এর কারণ ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ আলোচনার অবকাশ এই স্তরে নেই, পরে কিছু তথ্য নিয়ে আলোচনা করা যাবে। স্বাধীনতার পর ১৯৫০ সালে দেশের গণপরিষদ রবীন্দ্রনাথের দেশ রাগে সুরারোপিত বন্দে মাতরম্-এর প্রথম দুই স্তবককেই জাতীয় গানের মর্যাদা দেয়।


তৃতীয় প্রশ্ন হ’ল, রবীন্দ্রনাথ ঠিক কবে এই সুরারোপ করেছিলেন। সঠিক সিদ্ধান্তে আসা মুস্কিল। বঙ্কিমের দেহাবসান হয় ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে। যদি রবীন্দ্রনাথ তাঁকে এই সুর শুনিয়ে থাকেন, তবে তার রচনা এর আগেই হয়েছিল। ১৮৯৬এর কংগ্রেস অধিবেশনে গুরুদেবের বন্দে মাতরম্ গাওয়ার কথা, যা আগেই বলেছি, তা সব ইতিহাসেই নথিবদ্ধ। কিন্তু তারও আগে, ১৮৯০এর কংগ্রেস অধিবেশন, যেটি কলকাতাতেই হয়েছিল, সেখানেও রবীন্দ্রনাথের বন্দে মাতরম্ গাওয়ার একটি বিবরণ আছে, যার উল্লেখ অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। Calcutta Municipal Gazette, Special Issue, 1941-এ এই রিপোর্টে দেখা যায়: “{Tagore) … attends the sixth session of the Indian National Congress in Calcutta (Dec., 1890) under the presidentship of Pherozshah Mehta, when he sings the Bande Mataram on the opening day.” মনে রাখতে হবে, ১৮৮৬ সালেই প্রতিভাসুন্দরী-কৃত স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছিল। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ১৮৮৬ বা সমসময়ে রবীন্দ্রনাথ দেশ রাগের সুরসংযোগ করে থাকবেন, কারণ তার পরেই স্বরলিপি বা গায়নের উল্লেখ পাওয়া যায়।


এবার আসা যাক বন্দে মাতরম-এর অন্য কিছু সুরসংযোগের কয়েকটির উল্লেখনীয় দৃষ্টান্তে। কংগ্রেসের অধিবেশন ছাড়া সাধারণ জনসমাজে এই গান বহু বছর প্রায় সুপ্তই ছিল। এর পুনরুজ্জীবন ঘটল ১৯০৫এর বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলন ঘিরে। সে এক অভাবনীয় জাতিয়তাবাদের ভাবপ্রবনতা উদ্বেল করল বাংলা এবং দেশকে। শুধু গান নয়, বন্দে মাতরম্ এক রাজনৈতিক ধ্বনি হয়ে ছড়িয়ে পড়ল জনসমাজে। সে সময় ‘বন্দে মাতরম্ সম্প্রদায়’ নামে একটি গোষ্ঠি জায়গায় জায়গায় এই গান গেয়ে বেড়াত। তাঁরা সমবেত কণ্ঠে মিশ্র সুরে এই গান গাইতেন। ‘নারায়ণ’, ১৩২২ বৈশাখ সংখ্যায় হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ লিখেছেন: “আজ আমার সেই দিনের কথাই মনে পড়িতেছে — তখন সমগ্র বঙ্গদেশ 'বন্দে মাতরম্' গানে মুখরিত। বন্দে মাতরম্ সম্প্রদায়ের উদাত্ত সুর হইতে আরম্ভ করিয়া বৈষ্ণবের কীর্তনের সুর পর্যন্ত কত সুরে কতজন এই গান গাহিতেছে।“ দক্ষিণাচরণ সেন বন্দে মাতরম্ সম্প্রদায়ের জন্য রাগ খাম্বাজে একটি সুর রচনা করেছিলেন। আবার অন্য আর এক দল, ‘ভবানীপুর সেবক সম্প্রদায়ের’ জন্য রাইচরণ মুখোপাধ্যায় রাগ মল্লারে অন্য একটি সুর বেঁধেছিলেন। মল্লারেই নারায়ণচন্দ্র মুখার্জির গাওয়া একটি সংস্করণও পাওয়া যায়। হিমাংশু দত্ত, অমলা দাস, সরলা দেবী, সতী দেবী, সাহানা দেবী, কনক দাস ইত্যাদি অনেক শিল্পীরা বঙ্গ প্রদেশে এই গান অনেক সুরে পরিবেশন করেছেন।


স্বাধীনতার পূর্বে এবং পরে দেশের অন্য রাজ্যেও বহু সুরকার এবং শিল্পীরা বন্দে মাতরম্-এর সুর নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। পণ্ডিত ওঙ্কারনাথ ঠাকুর এই গানকে বেঁধেছিলেন যে রাগে তার নাম তিনি দিয়েছিলেন বঙ্গীয় কাফি । বিষ্ণু দিগম্বর পালুসকার (কাফি), কেশবরাও ভোলে (দেশকর), বিষ্ণুকান্ত পাগনিশ (সারঙ) ইত্যাদি প্রমুখ শিল্পীরা সুরবৈচিত্র্যে গানটিকে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯২৬ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে মিশ্র খাম্বাবতী রাগে সুরবদ্ধ করে ভি ডি অম্বাইকার নাগপুরে গান্ধীজিকে মুগ্ধ করেছিলেন, পরে বাবাসাহেব আম্বেদকারও এই সুরটিকে জাতীয় সঙ্গীতের জন্য সুপারিশ করেন। সুভাষচন্দ্র বসুর অনুরোধে তিমিরবরণ রাগ দুর্গার ভিত্তিতে কুচকাওয়াজের ঢঙে সঙ্গীতবদ্ধ করেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও পরবর্তী কালে আনন্দমঠ ছায়াছবির জন্য দ্রুত লয়ে এই ধাঁচের একটি সুরারোপ করেছিলেন। দিলীপকুমার রায় একক কণ্ঠে ধ্রুপদ-ধামার ভাবে, এবং এম এস শুভলক্ষীর সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে মিশ্র রাগে গেয়েছেন। শুভলক্ষী পরে ভজনের ঢঙেও এই গান গেয়েছেন। মাষ্টার কিষণরাও ফুলামব্রিকার সুর বসিয়েছিলেন ঝিঞ্ঝোটি রাগে। পঙ্কজ মল্লিক, ভবানীচরণ দাস প্রভৃতি কত যে গুণী সঙ্গীত রচয়িতারা বন্দে মাতরম-এ সুর সংযোজনা করেছেন, তা বলে শেষ করা যায় না। এই নিবন্ধের শেষে তেমনই কিছু অল্পশ্রুত সুরের লিংক দেওয়া হ’ল।


বন্দে মাতরম্-এর সুর প্রসঙ্গ এই পর্যন্তই। এই বিষয়ের সঙ্গে সরাসরি ভাবে সম্পর্কিত না হলেও, গানটিকে নিয়ে অনবরত যা কিছু বিতর্ক চলে আসছে, অনুসন্ধানকালে সে সম্পর্কে কিছু তথ্য সামনে পাই, যার অনেকটাই হয়ত পাঠকরা অবগত থাকবেন। যাঁরা নন, তাঁদের সুবিধার্থে খুব সংক্ষেপে তা নিয়ে কিছু ব্যক্ত করলাম। এই বিবরণ নেহাতই তথ্য জ্ঞাপন, লেখকের ভুমিকা নৈর্ব্যক্তিক।


বন্দে মাতরম্-এর রচনাকালেই সংস্কৃতের শব্দ নির্বাচন নিয়ে কিছু বিরূপ সমালোচনা হয়েছিল। কথিত আছে, বঙ্কিমের কন্যাও এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন, একটি শ্রুতিপাঠের আসরে প্রথম শোনার পর উপস্থিত অনেকেই মন্তব্য করেন যে, কিছু অংশ “অত্যন্ত শ্রুতিকটু হইয়াছে। শস্য শ্যামলাং শ্রুতিকটু নয় তো কি ? দ্বিসপ্তকোটী ভুজৈর্ধৃত খরকরবালে ইহাকে কেহই শ্রুতিমধুর বলিবেন না। বঙ্কিমচন্দ্র প্রায় এক ঘণ্টা ধরিয়া ধীর ভাবে শুনিলেন, তাহার পর বলিলেন, ‘আমার ভাল লেগেছে, তাই লিখেছি। তোমাদের ইচ্ছা হয় পড়, না হয় ফেলে দাও, না হয় প’ড় না।“


সব থেকে বেশি বিতর্ক জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বন্দে মাতরম্-এর নির্বাচন না হওয়া, এবং জাতীয় গান হিসেবে মাত্র দু স্তবকের ব্যবহার নিয়ে। এই সিদ্ধান্তের পেছনে রবীন্দ্রনাথের মতামতের একটা ভুমিকা নিশ্চিতভাবে ছিল। আগেই বলেছি, ১৯৩৭ সালে জাতীয় কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি একটি চার সদস্যের সাব কমিটি গঠন করে, বন্দে মাতরম্-কে জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেওয়ার যুক্তিযুক্ততা এবং তার পরিণাম পর্যালোচনা করে অভিমত পেশ করার জন্য। এই কমিটির সদস্যরা ছিলেন জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু, আবুল কালাম আজাদ ও আচার্য্য নরেন্দ্র দেব। এঁরা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করেন। রবীন্দ্রনাথের মত ছিল, এর প্রথম দুটি স্তবক দেশমাতৃকার বর্ণনা এবং বন্দনা হিসেবে অতীব সৌন্দর্যময়, কিন্তু পরেরগুলি উপযুক্ত নয়। ১৯৩৭এর ২৬শে অক্টোবর একটি চিঠিতে তিনি লেখেন, “To me the spirit of tenderness and devotion expressed in its first portion, the emphasis it gave to the beautiful and beneficent aspects of our motherland made a special appeal, so much so that I found no difficulty in dissociating it from the rest of the poem and from those portions of the book of which it is a part, with all the sentiments of which, brought up as I was in the monotheistic ideals of my father, I could have no sympathy.”, কেন তিনি প্রথম দুই স্তবকের বেশি সুর সংযোজনায় বিরত থাকলেন, এই উক্তির মধ্যে তার কি একটা সম্ভাব্য কারণ পাওয়া যেতে পারে ?


এই প্রসঙ্গে একটি তথ্য জানাতে হয়। আনন্দমঠ বঙ্গদর্শনে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ হওয়ারও আগে, এবং ১৮৮২তে গ্রন্থাকারে বেরোবার বহু পূর্বে, ১৮৭৯ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ একটি গান রচনা করেন, যাতে তিনি ‘বন্দে মাতরম্’ শব্দ দুটি ব্যবহার করেছিলেন (একসুত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন, এক কাজে সঁপিয়াছি সহস্র জীবন - বন্দে মাতরম্)। এর থেকে একটি উপপাদ্য এও এসেছে যে বঙ্কিম শুরুতে গানের প্রথমাংশই শুধু লিখেছিলেন, যা কোন ভাবে তরুণ রবীন্দ্রনাথের গোচরে আসে এবং তাঁকে প্রভাবিত করে। উপন্যাসে সংযোজনের প্রয়োজনে বঙ্কিম পরে আরও স্তবক জুড়ে দেন। অবশ্য এই সবই জল্পনা, এবং প্রমাণ করার মত কোন উপাদান এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।


বন্দে মাতরম্-এর শেষ চার স্তবক সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ সহ অন্য বিরোধীদের মত ছিল যে ওগুলিতে যে মাতৃমূর্তির বন্দনা করা হয়েছে, আসলে তা হিন্দু দেবী দুর্গা বা কালীরই প্রতিরূপ। সুভাষচন্দ্র বসুকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ খোলাখুলি ভাবেই এই মত ব্যক্ত করেন। তাঁদের যুক্তিতে এর জন্যই এই গান সব সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হোত না। ১৯০৫ সালে যখন বন্দে মাতরম্ ধ্বনি সরকার নিষিদ্ধ করা নিয়ে চিন্তা করছে, তখন নাকি এই গানের যথার্থ অর্থ উদ্ধারের জন্য কোন তথাকথিত বিশেষজ্ঞ আমলার পরামর্শ নেওয়া হয়, যিনিও এই সিদ্ধান্তে আসেন যে এই গানে উপাসিত মাতা আদতে কালীরই মূর্তি। সে যাই হোক, এ কথা স্বীকার্য যে সাম্প্রদায়িক সৌহার্দ্য বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা চিন্তা করেই বন্দে মাতরম্ সম্বন্ধে কংগ্রেস ও স্বাধীনতার পর গণপরিষদ নির্ণয় করে থাকবে।


অনেকের মতে, অন্য একটি বিষয়ও বিবেচনায় ছিল। একটি বহুস্বীকৃত দৃষ্টিকোণ ছিল এবং আছে যে বঙ্কিমচন্দ্র যে দেশকে মাতৃরূপে কল্পনা করেছিলেন, সে দেশ ভারত নয়, সে আসলে অবিভক্ত বঙ্গদেশ। গর্গ চট্টোপাধ্যায় (History revisited: ‘Bande Mataram was written as a song about Bengal, not India / scroll.in, May 31, 2017) বলছেন, ১৮৭১এর আদমশুমারি অনুযায়ী অবিভক্ত বাংলার জনসংখ্যা ছিল ৬.২৬ কোটি, যার ভিত্তিতে বন্দে মাতরম রচনাকালে বঙ্কিম লিখলেন ‘সপ্তকোটি কণ্ঠ’। ভারতবর্ষকে মাতা রূপে কল্পনা করলে তাঁর লেখা উচিত ছিল ‘ত্রয়োবিংশকোটি’, কারণ ঐ শুমারি মতে ভারতের জনসংখ্যা তখন ছিল ২৩.৮৮ কোটি। প্রসঙ্গত, ১৯০৫-এর বারাণসী কংগ্রেসে রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী সরলা দেবী বন্দে মাতরম-এর প্রথম দুই স্তবকের পরবর্তী স্তবকও গেয়েছিলেন, এবং তখন স্বেচ্ছাকৃত ভাবে ‘সপ্তকোটি’কে পরিবর্তন করে ‘ত্রিংশকোটি’ বলে গেয়েছিলেন, যা তখন ভারতের জনসংখ্যা ছিল। (ঋষি) অরবিন্দ ঘোষ বন্দে মাতম-এর ইংরাজী অনুবাদ করে লিখেছিলেন: “It is difficult to translate the National Anthem of Bengal into verse in another language owing to its unique union of sweetness, simple directness and high poetic force.”


২০০৬ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি নিবন্ধে অমৃতসূদন ভট্টাচার্য আরও একটি বিতর্কিত প্রশ্নের অবতারনা করেন। তিনি বলেন, আনন্দমঠ-এ বন্দে মাতরম্ যখন প্রকাশ পায়, তখন তার ২৮ চরণের মধ্যে প্রথম ১২ চরণ (‘বন্দে মাতরম্’ থেকে ‘রিপুদলবারিণীং মাতরম্’ পর্যন্ত) ছাপা হয়েছিল উদ্ধৃতিচিহ্নের মধ্যে। তাঁর প্রশ্ন ছিল, তার অর্থ কি ঐ প্রথম ১২ পংক্তি সাহিত্য সম্রাটের নিজের রচনা ছিল না ? বঙ্কিম সাহিত্যে উদ্ধৃতিচিহ্নের ব্যবহার চর্চা করে অন্য বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলেছেন যে শুধুমাত্র এই কারণের ওপর ভিত্তি করে এমন সন্দেহ অমূলক।


শেষ পর্যন্ত তবে এইটাই সার কথা যে বন্দে মাতরম্ গানের রচয়িতা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, এবং দেশের জাতীয় গান হিসেবে যে অংশ গাওয়া হয়, তার সুর সংযোজনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। অন্য গায়ক-সুরকারের কিছু অল্পশ্রুত সৃষ্টির নিদর্শন নীচের লিংকগুলিতে রইল।


ওঙ্কারনাথ ঠাকুর (বঙ্গীয় কাফি)



বিষ্ণুপন্থ পাগনিস (সারঙ্গ)



বিষ্ণু দিগম্বর পালুসকার কৃত সুর সুভদ্রা দেসাই-এর কণ্ঠে (কাফি)



বিনায়করাও দেশরাও অম্বাইকার (মিশ্র খাম্বাবতী)



কেশবরাও ভোলে (দেশকর)



নারায়ণচন্দ্র মুখার্জী (মল্লার, টপ্পা)



মাষ্টার কৃষ্ণরাও ফুলাম্ব্রিকার (ঝিঞ্ঝোটি)



সবলারাম্বোয়া সেজবল



দিলীপকুমার রায় (ধ্রুপদ/ধামার)



দিলীপকুমার রায় ও এম এস শুভলক্ষী (রাগমালিকা)


দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, জগন্ময় মিত্র, কনক দাস, দ্বিজেন চৌধুরী ও অন্যান্য (সুরকার সরলা দেবী)


0 comments: