0

প্রাচীন কথাঃ সৌরেন চট্টোপাধ্যায়

Posted in


প্রাচীন কথা


উত্তরাপথের পথে
সৌরেন চট্টোপাধ্যায়

= সপ্তম পর্ব = 



“সুখমাপতিতং সেব্যং দুঃখমাপতিতং তথা, 
চক্রবৎ পরিবর্তন্তে দুঃখানি চ সুখানি চ।” 

(আগত সুখ যেমন গ্রহণীয়, আগত দুঃখও সেইভাবে গ্রহণীয়। সুখ এবং দুঃখ চাকার মতই পরিবর্তিত হয়।) 


রাত্রির চতুর্থ প্রহর, আকাশের অন্ধকার তখনও কাটেনি। চতুর্থীর ক্ষীণ চাঁদের ম্লান আলোয় আশপাশের সব কিছুই অস্পষ্ট ও রহস্যময়। উত্তর আর্যাবর্তের তীব্র শীতের ভোরে চারিদিক ঘন কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে গভীর সুষুপ্তিতে নিমগ্ন। কান্যকুব্জের অনতিদূরে একটি নির্জন প্রমোদ-উদ্যানের খিড়কিদ্বার পথ থেকে দুটি নারীমূর্তি চুপিসারে ভীত পদক্ষেপে বাইরে এলো। একজন কনৌজ-রাজ্ঞী রাজ্যশ্রী, অন্যজন দাসী অন্তরা। রাজ্যশ্রীর পরণে অতি সাধারণ দাসীর পোশাক, ভেড়ার লোমের মোটা চাদরে উভয়েরই মস্তক ও উর্ধাঙ্গ সম্পূর্ণ আবৃত, অন্তরার হাতে একটি ছোট কাপড়ের পুঁটুলি। উত্তর ভারতের প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহ তীক্ষ্ণ সূচের মত বিঁধে দুজনেরই শরীরে তীব্র কম্পন ধরিয়ে দিচ্ছে। 

উদ্যানের পিছনদিকে প্রাচীরের ভিতরে ধারে ধারে সারিবদ্ধ গুবাক ও দেবদারু গাছ, বাইরেও কতকগুলি ঘন পত্রাচ্ছাদিত গাছ থাকায় স্থানটি ছায়ান্ধকার। কয়েক পা অগ্রসর হতেই পাশের শিংশপা গাছের আড়াল থেকে একটি দীর্ঘকায় পুরুষের ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এল। রাজ্যশ্রী ভীতা হরিণীর মত থমকে দাঁড়ালেন, এক হাতে নিজের মুখ চেপে উদ্গত আর্ত চীৎকার দমন করলেন। পাশ থেকে অন্তরা চাপা স্বরে বলল, ‘‘মহারাণী ভয় পাবেন না, এ আপনার হিতৈষী, এই প্রমোদ-কাননের মালাকরের বুদ্ধি আর সাহসেই আপনি বন্দিনীদশা থেকে মুক্ত হতে চলেছেন। মালাকরের কথা মেনে চলাই এখন আমাদের পক্ষে শ্রেয়।’’

পুরুষটি কাছে এলে অস্পষ্ট আলোছায়ায় রাজ্যশ্রী চিনতে পারলেন তাকে, এই যুবকটিই বন্দীজীবনে তাঁকে প্রতিদিন একটি করে গোলাপ ছুঁড়ে দিতো নীচের পুষ্পোদ্যান থেকে। মালাকর হাতের ইশারায় দক্ষিণ দিক নির্দেশ করে নিম্নকন্ঠে বলল, ‘‘এই দিকে সোজা চলতে থাকুন, মুখ যতটা সম্ভব ঢেকে মাথা নীচু করে হাঁটবেন, আর পথে কারো সঙ্গেই কোনও কারণে কথা বলবেন না। আপনার কষ্ট হবে জানি মহারাণী, কিন্তু এ ছাড়া যে গত্যন্তর নেই!’’ একটু থেমে সে অন্তরাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘‘দাসী, তিন ক্রোশ দূরে একটি ছোট নদী পাবে, সেখানে বিশ্রাম নেবে। তার আগে কোথাও থেমো না, যে কোনও উপায়েই হোক মহারাণীকে রক্ষা করবে, আমি পরে তোমাদের সঙ্গে মিলিত হবো।’’ কথাগুলো বলেই মালাকর ঘনসন্নিবিষ্ট বৃক্ষান্তরালে অন্তর্হিত হলো। 

অন্ধকার থাকতে থাকতেই রাজ্যশ্রী ও অন্তরা দ্রুতপায়ে প্রমোদ-কানন পরিত্যাগ করে ক্রোশ দুয়েক পথ অতিক্রম করে এসেছেন। হাঁটার পরিশ্রমের ফলে শীতের কম্পন অনেকটাই দূরীভূত হলেও আজন্ম সুখে লালিত রাজ্যশ্রীর নবনীত-কোমল শরীর পরিশ্রম, ক্ষুধা ও দুশ্চিন্তায় খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। অন্তরার অবস্থাও তথৈবচ, কিন্তু মহারাণী অপেক্ষা সে স্বভাবতই বেশী কষ্টসহিষ্ণু। পূর্বাকাশে প্রভাতী আলোয় একটু একটু করে রঙের ছোপ লাগছে, নবারুণ-আলোকে চারিপাশের দৃশ্যপট ক্রমশ পরিস্ফুটিত হচ্ছে। জনশূন্য ঢেউখেলানো ভূমিতে যব এবং গোধুমের কৃষিক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে পায়েচলা পথ, কুয়াশার আবরণ ছিন্ন হতে অনেক দূরে দূরে ছোট ছোট কয়েকটি নিদ্রামগ্ন গ্রামের অস্পষ্ট চিত্র ধীরে ধীরে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। আরও কিছুটা হাঁটার পর সামনে একটি স্বচ্ছ জলের তড়াগ দেখতে পেয়ে দাঁড়ালেন দুজনে, একটু বিশ্রামের খুবই প্রয়োজন। শ্যামল তৃনাচ্ছাদিত তড়াগের পাড়ে একটি বড় অশ্বত্থ গাছ, জনপদের বাইরে এই তড়াগটির জল সম্ভবত সেচের কাজেই ব্যবহৃত হয়। শ্রান্ত রাজ্যশ্রী চর্ম-পাদুকা খুলে অশ্বত্থ গাছটির নীচে তৃণাসনে পা ছড়িয়ে বসে কিছুটা আরাম অনুভব করলেন। অন্তরা তার হাতের পুঁটুলি থেকে একটি ছোট তামার ঘট বার করে তড়াগের জল এনে রাজ্যশ্রীর তৃষ্ণা নিবারণ করে বললো, ‘‘দেবী, আমাদের এখানে থামলে চলবে না, আরো দূরে যেতে হবে। কিছু দূরেই জনবসতি রয়েছে। দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে, এখন ফসলের সময়, গ্রামের কৃষক বা অন্য কেউ যে কোনও সময় এসে পড়তে পারে।তারা আপনাকে না চিনলেও আপনার দেহের ওই বহুমূল্য গহনাগুলি গ্রামের দরিদ্র মানুষের মনেও লোভের উদ্রেক করে বিপদ সৃষ্টি করতে পারে।’’

রাজ্যশ্রী অন্তরার কথার যুক্তি মেনে বললেন, ‘‘তুই ঠিকই বলেছিস অন্তরা।তাছাড়া আমার তো এগুলির কোন প্রয়োজনও নেই, আমার আসল অলঙ্কার তো পড়ে আছে কনৌজের রাজপুরীতে, তুই এগুলি রাখ।’’বলে রাজ্যশ্রী এক এক করে সমস্ত অলঙ্কার খুলে অন্তরার হাতে দিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করলেন। চলতে চলতে গত রাত্রির দুঃস্বপ্নের মত ঘটনাগুলি তাঁর মনে পড়তে লাগলো...

প্রমোদকাননের দ্বিতলে সুরম্য কক্ষটিতে পালঙ্কের বাজুতে হেলান দিয়ে প্রস্তর-প্রতিমার মত বসেছিলেন সালঙ্কারা রাজ্যশ্রী, মনে তাঁর সম্ভব-অসম্ভব নানা চিন্তার তুফান। রাত্রির মধ্য যামে কক্ষের দ্বার সশব্দে অর্গলমুক্ত হল, আতঙ্কিত রাজ্যশ্রী দেখলেন এক বিশালাকায় স্ফীতোদর রাজপুরুষ নেশাতুর স্খলিতপদে কক্ষে প্রবেশ করলেন। তাঁর অঙ্গের বিচিত্র বর্ণের মহার্ঘ পরিধেয় বস্ত্র ও নানা রত্নভূষণ দেখে অনুমানে বুঝলেন, তিনিই মালবরাজ দেবগুপ্ত। মহারাজের পিছনে পিছনে দুজন দাসী স্বর্ণ-রেকাবিতে নানা উত্তম খাদ্যবস্তু ও সুরাপাত্র, ভৃঙ্গার, তাম্বুলকরঙ্ক, পিকদানি ইত্যাদি নিয়ে এসে পালঙ্কের পাশে মঞ্চকে সাজিয়ে রাখলো। দাসীদের মধ্যে একজন তাঁর পূর্বপরিচিতা অন্তরা।সে সকলের অলক্ষ্যে চোখের চকিত ইশারায় রাজ্যশ্রীকে কিছু বোঝাতে চেষ্টা করলো। রাজ্যশ্রী তার চোখের ভাষা পড়তে না পারলেও শুধু এটুকু বুঝলেন, মেয়েটি তাঁকে অভয় প্রদান করলো। 

মালবরাজ হাতের ইঙ্গিত করতেই দাসীরা কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হল। তিনি আসন গ্রহণ করে সুরাপাত্রে আয়েস করে চুমুক দিতে দিতে বেশ কিছু সময় ধরে রাজ্যশ্রীকে দেখতে লাগলেন। বহুমূল্য রত্নালঙ্কারে সজ্জিতা এই অপরূপা নারীটির কথা তিনি অনেক শুনেছেন, সেই স্বপ্নহারিণী রূপবতী আজ তাঁর অঙ্কশায়িনী হতে চলেছে, এ যেন তাঁর বিশ্বাসই হচ্ছে না। অত্যন্ত মিহি মসলিনের সংক্ষিপ্ত ও কামনা-উদ্রেককারী নেত্রবাসে রাজ্যশ্রীর বরাঙ্গের যৌবন অতিমাত্রায় প্রকটিত। দেবগুপ্তর সুরারক্তিম চোখদুটি তাঁর উচ্ছলযৌবন শরীরের ময়ূরী-গ্রীবা, মেখলাশোভিত অবলগ্ন, গিরিবর্ত্ম-স্তনবিভাজিকা, কঞ্চুলিকাবন্ধনে শ্বেতশঙ্খ-পয়োধরে চারুবৃন্তের আভাস, কোরক-নাভি, সুচারু বস্তিদেশ, কদলিকাণ্ডসম সুডৌল জঙ্ঘা ইত্যাদি প্রতিটি উচ্চাবচ বাঁক কদর্য লালসায় লেহন করতে লাগলো।

রাজ্যশ্রী আনতমস্তকেও তা উপলব্ধি করে লজ্জায় ঘৃণায় সংকুচিত হয়ে মোতিদন্তে অধরপ্ললব দংশন করে স্থির হয়ে বসে পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য মনে মনে প্রস্তুত হতে লাগলেন। ওই অন্তরা নামের দাসীটির বলা কথাগুলিই যা ভরসা শুধু।

দেবগুপ্ত তাম্বুলকরঙ্ক থেকে একসঙ্গে দুটি সুগন্ধি তাম্বুল নিয়ে চিবোতে চিবোতে বললেন, ‘‘আমি জীবনে বহু নারী দেখেছি, কিন্তু তোমার মত এমন রূপসী আর দেখিনি।এতদিন তোমার রূপের কথা শুনেছি, আজ তোমাকে পেয়ে আমার জীবন সার্থক হল সুন্দরী।’’

কথা বলতে বলতে আরও একপাত্র সুরা উদরস্থ করে ও তাম্বুল মুখে পুরে মালবরাজ জিভ দিয়ে ঠোঁটের কোণের রক্তের মত তাম্বুলরস চেটে নিয়ে জড়িতকণ্ঠে বললেন, ‘‘মৌখরি রাজ্য এখন আমার অধিকৃত। খুব শীঘ্রই আমি সমগ্র আর্যাবর্তের সম্রাট হবো, তুমি হবে আমার পাটরাণী। বুঝলে! আমাকে তৃপ্ত করতে পারলে জগতের সব রকম সুখভোগ করবে তুমি, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই।’’

দেবগুপ্ত সুরাপান ও তাম্বুলচর্বণ করতে করতে ক্রমশ আরও নেশাতুর হয়ে প্রলাপ বকতে বকতে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হিংস্র শ্বাপদের মত এক পা এক পা করে রাজ্যশ্রীর দিকে এগিয়ে আসতে লাগলেন। তার সেই লালসাপূর্ণ কুৎসিত মুর্তি দেখে ভয়ে ঘৃণায় রাজ্যশ্রীর শরীর শিরশির করে উঠলো। মনে হলো একটা ঘৃণ্য ভয়াল সরীসৃপ যেন তাঁকে গ্রাস করার জন্য অপেক্ষা করছে। নির্জন প্রমোদকুঞ্জের বদ্ধ কক্ষে নিতান্ত নিরুপায় রাজ্যশ্রী চোখ বুজে আকুল হয়ে তাঁর ইষ্ট দেব ভগবান শঙ্করের শরণাপন্ন হলেন।

অকস্মাৎ যেন কোন দৈবযোগে পর পর কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেলো। বাতায়ন পথে আসা বিপুল ধূমরাশীতে সমস্ত কক্ষটি ভরে গেলো, সেই সঙ্গে নীচে অনেক মানুষের সমবেত চীৎকার শোনা গেলো। এমন আকস্মিক ছন্দপতনে বিরক্ত মালবরাজ ক্রোধে ভ্রূভঙ্গি করে অলিন্দের দিকে এগিয়ে গেলেন, কিন্তু কিছুই তাঁর বোধগম্য হলো না। সেখান থেকে টলায়মান পদে ফিরে এসে রাজ্যশ্রীকে বক্ষলগ্না করার আগেই তাঁর বিশাল বপুখানি কাষ্ঠনির্মিত প্রমোদগৃহ কম্পিত করে হতচেতন হয়ে কক্ষতলে আছড়ে পড়লো।

সেই মুহূর্তেই বাইরের অর্গলমুক্ত করে অন্তরা উল্কাগতিতে কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করল। তার হাতে দাসীর পরিধানযোগ্য অতি সাধারণ কিছু পোশাক। 

................................


দিগন্তব্যাপী ঊষর প্রান্তরে ছোট ছোট নিরস গুল্ম ও কাঁটা গাছের ঝোপ ছাড়া বড় গাছ বিশেষ নেই। তাদের সামনে আর যত দূর চোখ যায় এক প্রাণস্পন্দনহীন বৃষলা ভূমি শ্মশানের স্তব্ধতা নিয়ে পড়ে আছে। বহুদূরে ধূসর দিকচক্রবালে আঁকা পাহাড় ও বনভূমির চালচিত্র। রাজ্যশ্রী ও তাঁর সহচরী অন্তরা সেই মরুক্ষেত্রসদৃশ প্রান্তরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে দেখলেন, জমি হঠাৎ এক জায়গায় ঢালু হয়ে একটি স্বচ্ছতোয়া ক্ষীণা স্রোতস্বিনীর উপল-সমাকীর্ণ তীরে গিয়ে মিশেছে।নদীতটে কয়েকটি পত্র-পুষ্পহীন বৃক্ষ আর আশেপাশে বেশ বড় বড় কিছু প্রস্তরখণ্ড ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। পথশ্রমে ক্লান্ত রমণীদ্বয় গিয়ে একটি বৃক্ষতলে উপবেশন করলেন।

পদব্রজে অনভ্যস্ত কনৌজেশ্বরীর নলিনী-কোমল পা দুটি ইতিমধ্যেই বিক্ষত ও স্ফীত হলেও তিনি মুখ বুজে সহ্য করেছেন, অন্তরাকে কিছুই বলেন নি। অন্তরা তাঁর পায়ের অবস্থা দেখে শিউরে ঊঠলো।তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে বেশ কিছু দূর্বাঘাস ছিঁড়ে এনে দুই হাতে মর্দন ও চর্বণ করে সযত্নে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলো।

‘‘এরপর কি হবে অন্তরা?’’শিশিরসিক্ত তৃণশয্যায় শ্রান্ত দেহখানি এলিয়ে বামবাহুর উপর মাথা রেখে ব্যাকুল কন্ঠে শুধালেন রাজ্যশ্রী।

‘‘ভেঙে পড়বেন না মহারাণী, আর একটু ধৈর্য ধরুন।’’ চারিদিকে চোখ বুলিয়ে অন্তরা বললো, ‘‘ওই নর-পিশাচ মালবরাজের শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার থেকে এই বিজন রূক্ষ প্রান্তরের ভূমিশয্যা কি অনেক বেশী সুখপ্রদ নয়, দেবী?’’

‘‘তা ঠিক।’’রাজ্যশ্রী মাথা নেড়ে তার কথায় সায় দিয়ে বললেন, ‘‘কিন্তু এরপর মৃত্যু ছাড়া আমার আর কি কোন গত্যন্তর আছে?’’

‘‘মার্জনা করবেন মহারাণী, আপনাকে উপদেশ দেবার ধৃষ্টতা আমি করি না।’’অন্তরা বিনীত কন্ঠে বললো, ‘‘মৃত্যু তো আমাদের কারো আজ্ঞাধীন নয় দেবী, সে তার নিজের ইচ্ছাতেই আসে; ভেবে দেখুন, মানুষ যেন তার হাতের ক্রীড়ণক ছাড়া কিছুই নয়; তাই মৃত্যুকে জয় করে জীবনকে পূর্ণ মর্যাদা দেওয়াই মানুষের কর্তব্য।’’

রাজ্যশ্রী বিস্মিত হয়ে উঠে বসলেন, এক সামান্যা পরিচারিকার মুখে এ কি শুনলেন তিনি! চমৎকৃতা রাজমহিষী নিজের পতি-পিতৃকুলের মর্যাদা বিস্মরণ হয়ে, স্বাভিমান ভুলে দাসীকে বুকে টেনে নিলেন। দুটি অসম সঙ্গতি ও মর্যাদার নারীর বিমল অবিরত অশ্রুধারায় কঙ্করসমাচ্ছন্ন প্রান্তরের রূক্ষ ভূমি সিক্ত হলো।শুধুমাত্র নয়নবারি স্বাক্ষী রেখে তাঁরা একে অপরকে সখীত্বে বরণ করে নিলেন। 

কত পল-দণ্ড অতিবাহিত হল। দিনাধিপতির স্বপ্তাশ্ববাহিত অদম্য-গতির রথ প্রথম প্রহরের গণ্ডী অতিক্রম করে দ্বিতীয় প্রহরের সীমানায় পৌঁছে গিয়েছে। একসময় অশ্রু সংবরণ করে রাজ্যশ্রী আবার প্রশ্ন করলেন, ‘‘আমরা এরপর কি করবো, অন্তরা? সামনে অজানা অচেনা পথ, দুজন নিঃসহায় নারী আমরা, কোথায় যাবো, কিছুই জানি না!আর পিছনে বিভীষিকার মত অতীত! ওই মালাকর যুবক আর তুই লম্পট দেবগুপ্তর হাত থেকে আমাকে রক্ষা করেছিস ঠিকই, কিন্তু এর পর?’’

‘‘উতলা হবেন না মহারাণী, সে নিশ্চয়ই যথাসময়ে আমাদের সঙ্গে মিলিত হবে।’’

‘‘কিন্তু, এখনও জানি না আমার পতি এখন কি অবস্থায় আছেন! তিনি কি জানেন না আমি কোথায় আছি! আমার, আমাদের রাজ্য কি শত্রুরা অধিকার করেছে! না কি কনৌজের সৈন্যবাহিনী তাদের উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে বিতাড়িত করতে পেরেছে? আমার পিতা স্থান্বীশ্বরের মহারাজাধিরাজ প্রভাকরবর্ধনের কাছে আমার এই দুঃসংবাদ পৌঁছেছে কি না তাও জানি না। অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের মত আমার দুই ভ্রাতা মহাবীর রাজ্যবর্ধন ও হর্ষবর্ধনের এই সংবাদ কর্ণগোচর হলে তাঁরা আমার স্বামীকে সাহায্য করতে অবশ্যই ছুটে আসবেন। এই দুর্দিনের পরিসমাপ্তি ঘটবে, আবার হয়তো আমরা মিলিত হবো,আবার আমার প্রিয়তম মানুষটিকে কাছে পাবো।’’ ধূলিশয্যায় শয়ন করে মলিন বেশে কনৌজের মহারাণী অস্ফুটে এমন কত কথাই না বলে যেতে লাগলেন। 

রাজ্যশ্রীর কথার মধ্যেই পিছন থেকে অশ্বখুরধ্বনি শোনা গেলো। দুজনেই সচকিতে সেই দিকে ফিরে তাকালেন। প্রস্তরাকীর্ণ প্রান্তরের বুকে দূর থেকে একটি অশ্বখুরোত্থিতধূলার মেঘ সেই দিকেই এগিয়ে আসছে। আশায় ও আশঙ্কায় দুটি নারী উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন সেই ধূলিমেঘাচ্ছন্ন প্রহেলিকার পানে। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত উদ্বেগের নিরসন হল। অশ্বারোহীগণ নিকটবর্তী হলে দেখা গেল তিনটি ঘোড়া ও দুটি অশ্বেতর। প্রথম ঘোড়াটির সওয়ার সেই মালাকর যুবক, অন্য দুটিতে দুজন রমণী; তাদের পরণে পুরুষের পোশাক। অশ্বেতর দুটির পিঠে বেশ বড় বড় দুটি গাঁটরি। তারা অশ্ব থেকে অবতরণ করে রাজ্যশ্রীকে সসম্ভ্রমে অভিবাদন করলে সেই প্রতিকূল পরস্থিতিতেও তাঁর কন্ঠ থেকে বিস্ময়মিশ্রিত অস্ফুট হর্ষধ্বনি বেরিয়ে এলো!

‘‘বৈদেহী, সুকন্যা! তোরা এখানে কি করে এলি? মহারাজ এখন কোথায় কি অবস্থায় আছেন তা কি জানিস? আমাদের রাজপুরী কি শত্রুমুক্ত হয়েছে?’’পুনঃপুনঃ প্রশ্ন করতে করতে রাজ্যশ্রীর কন্ঠস্বর কান্নায় বিকৃত হতে হতে রুদ্ধ হয়ে গেল। তিনি সুকন্যা ও বৈদেহীকে জড়িয়ে ধরে অঝোরধারায় অশ্রুপাত করতে লাগলেন। 

অন্তরা রাজ্যশ্রীর পদসেবা করতে করতে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, ‘‘মালাকর আর আপনার প্রিয় সহচরীরা এসে গিয়েছেন, আর কোনও ভয় নেই, এখন অশ্রু সংবরণ করুন দেবী।’’

‘‘মহারাণী, রাজপুরী শত্রু-কবলিত হওয়ার পর আমরা অনেক খুঁজেও আপনার সন্ধান পাইনি।’’ সুকন্যা বললো, ‘‘আজ ভোররাত্রে এই মালাকর যুবক রাজপুরীর দাসীমহলে গিয়ে আমাদের ডেকে আপনার কথা জানাতেই আমরা দুজন ঘুমন্ত প্রতিহারীদের নজর এড়িয়ে ওর সঙ্গে চলে এসেছি।’’

‘‘আর তোদের মহারাজ! তিনি কেন আমাকে উদ্ধারের চেষ্টা করেন নি?’’রাজ্যশ্রী ব্যাকুল কন্ঠে শুধালেন, ‘‘তিনি কি ---- ?’’

সুকন্যা উত্তর না দিয়ে মাথা নীচু করে কান্না সংবরণ করলো।মধ্যবয়স্কা দাসী বৈদেহী বিমর্ষ গলায় বললো, ‘‘শুনেছি তিনি নিরস্ত্র অবস্থায় মালবরাজের হাতে বন্দী হয়েছেন।আর কোনও সংবাদ আমারা জানি না।’’

দাসীদের কথা শুনে রাজ্যশ্রী হাহাকার করে উঠলেন। 

‘‘মহারাণী, স্থির হন।’’অন্তরা বললো, ‘‘আমাদের মহারাজ বীর, বুদ্ধিমান, তিনি নিশ্চয়ই নিজেকে রক্ষা করে শত্রুদের উপর প্রতিঘাত করার কিংবা স্থান্বীশ্বর বা অন্য কোনও বন্ধু রাজ্যের সাহায্যের জন্য নিজেকে গুপ্ত রেখে সুযোগের অপেক্ষায় আছেন।’’

ইত্যাবসরে মালাকর ঘোড়া এবং অশ্বেতরদুটিকে গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে রাজ্যশ্রীকে প্রণাম জানিয়ে পদপ্রান্তে বসে বলল, ‘‘দেবী, আমি কিশোর বয়স থেকে ওই উদ্যানের মালাকর, মহারাজ আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। তিনি উদ্যানে এলে আমি তাঁর পরিচর্যা করতাম। এই অন্তরাও উদ্যানের একজন দাসী, আপনাকে আগে কখনো দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয় নি। সেই রাত্রে দেখেছিলাম, কয়েকজন সন্ন্যাসী বেশধারী আপনাকে ঘুমন্ত অবস্থায় শিবিকা থেকে নামালো।সম্ভবত তারা কোনও ভেষজ প্রয়োগ করে আপনাকে সংজ্ঞাহীন করে রেখেছিল। সেই সময় আড়াল থেকে তাদের কিছু কথা শুনে বুঝেছিলাম, আপনি আমাদের মহারাণী, আর আমাদের রাজ্য মালবের সৈন্যরা দখল করেছে। কাল সকালে যখন অন্তরার কাছে জানতে পারলাম মালবরাজ রাত্রে উদ্যানে আসছেন, তখন তাঁর উদ্দেশ্য বুঝতে কিছু বাকি রইলো না। কিন্তু আমরা সামান্য দাস-দাসী। কি করে আপনাকে ঐ পিশাচের হাত থেকে রক্ষা করবো, প্রথমে ভেবে পেলাম না। কিন্তু ইচ্ছা, সাহস আর বুদ্ধি থাকলে কি না করা যায়! ভেবে উদ্যমী হলাম।’’ একটু থেমে মালাকর বলতে লাগল, ‘‘আমি অনার্যগোষ্ঠীর মানুষ।আমার অতিবৃদ্ধ পিতামহ একজন ভিষক।নানা ভেষজের গুণাগুণ তাঁর জানা। কয়েক ক্রোশ দূরে আমাদের গ্রামে ছুটে গিয়ে তাঁর কাছ থেকে অচৈতন্য করার গুণসম্পন্ন কিছু শুকনো গাছের শিকড় নিয়ে এলাম। অন্তরা গোপনে সেগুলি মালবরাজের তাম্বুলে মিশিয়ে দিয়েছিলো। সুরার সঙ্গে সেই তাম্বুলের প্রভাবে উনি সহজেই হতজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। দ্বিপ্রহরে এক সময় সুযোগ বুঝে আমি মন্দুরায় ঘোড়ার জন্য রাখা ঘাস সরিয়ে প্রচুর শুকনো ঘাসপাতা রেখেছিলাম। প্রমোদ উদ্যানটির নিম্নতলে রন্ধনশালা ও দাস-দাসীদের ঘর, আর কাছেই ছোট একটি রক্ষীনিবাস ছাড়া আশেপাশে কোনও জনবসতি নেই। গভীর রাত্রে শুকনো ঘাসে অগ্নিসংযোগ করতেই রক্ষীরা অন্যমনস্ক হয়ে আগুন নেভাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আর অন্য দাসীটিকেও অন্তরা সেই ভেষজমিশ্রিত তাম্বুল খাইয়ে অচেতন করে নীচের একটি ঘরে অর্গলরুদ্ধ করে রাখে। তারপরের ঘটনা তো আপনি সবই জানেন।’’

‘‘এই ঘোর দুঃসময়ে তোমরাই আমার একমাত্র হিতৈষী ও সঙ্গী, তোমরাই আমার সম্ভ্রম ও প্রাণ রক্ষা করেছো। তোমাদের এই ঋণ আমি সারা জীবনেও শোধ করতে পারবো না। 

‘‘আপনি রাজ্যের মহারাণী, আমাদের মাতৃসমা, আমাদের প্রাণ দিয়েও আপনাকে রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। এখন আমি যা বলছি দয়া করে মন দিয়ে শুনুন।’’মালাকর সবিনয়ে বললো, ‘‘মালবরাজকে অচেতন করে ও রক্ষীদের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে আপনাকে উদ্ধার করতে পারলেও এখনও আপনি নিরাপদ নন। জ্ঞান ফিরলে মালবরাজ আপনাকে না পেয়ে উন্মাদ কুক্কুরের মত খুঁজবেন, হয়তো সৈন্যদেরও সে কাজে নিযুক্ত করবেন, তাই আমাদের কনৌজের সীমানা ছাড়িয়ে যত দূরে সম্ভব চলে যেতে হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন আগত দিনের কষ্ট সহ্য করার জন্য আপনাকে মন শক্ত করতে হবে দেবী।’’

রাজ্যশ্রীর সম্বিত ফিরলো।বস্ত্রাঞ্চলে চোখের জল মুছে তিনি শান্ত হয়ে পাদপমূলে একটি বৃহৎ প্রস্তরখণ্ডে অধ্যাসীন হলেন। এখন তিনি আর আগের মত বিচলিতা নন। স্বাভাবিক বুদ্ধিতেই বুঝেছেন, পরিবার-পরিজনহীন সহায়সম্বলশূন্য অবস্থায় এরাই তাঁর একমাত্র ও পরম শুভার্থী। এই অতি সাধারণ ও সামান্য মানুষগুলিই অত্যন্ত চাতুর্য ও ক্ষিপ্রতায় তাঁর নারীত্বের সম্ভ্রম ও জীবন রক্ষা করেছে ঠিকই, কিন্তু পরবর্তী সময়ে এক বিপুল রাজশক্তির বিরুদ্ধে তাদের সীমিত ক্ষমতা কতটা কার্যকারী হতে পারে তা ভেবে পেলেন না। ---- (ক্রমশ প্রকাশ্য) 



-------------------------------------------------------------------------- 

কয়েকটি স্বল্প-প্রচলিত শব্দের অর্থ -- 

পরির্বহ - রাজচিহ্ন পরিচ্ছদ / মঞ্চক – ছোট টেবিল / তাম্বুলকরঙ্ক - পানের বাটা / বস্তিদেশ – নাভির নিম্নাংশ (তলপেট) / অবলগ্ন – কোমর / নেত্রবাস - সাপের খোলসের মত সূক্ষ বস্ত্র/ অশ্বেতর – খচ্চর/ ভিষক – বৈদ্য/ মন্দুরা- আস্তাবল 





0 comments: