1

ধারাবাহিকঃ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক



বানরায়ণ, পর্ব - ১২
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়


আমরা চলেছিলাম সেতুর উপর দিয়ে। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ সৈন্য সারবদ্ধভাবে পদক্ষেপে পদক্ষেপ মিলিয়ে চলেছিলো সমুদ্রের উপর দিয়ে। সমুদ্র এখন শান্ত। যেন এতদিন ধরে সেতুবন্ধনের প্রতিবাদ করার পর অবশেষে হার মেনেছে। পদানত হয়েছে লক্ষ লক্ষ দৃঢ়সংকল্প, সুসংবদ্ধ যোদ্ধার। তারা এখন অস্ত্র হাতে, দেহে বর্ম আর মুখে মুখোশ পরে চলেছে উদ্ধত পদক্ষেপে। চামড়ার তৈরি বানরের মুখোশগুলোতে হিংস্র জিঘাংসার অভিব্যক্তি। প্রায় সবাই পরে আছে মুখোশ। অন্তত আমি যাদের দেখতে পাচ্ছি, তারা সকলে পরে আছে।

আমরা কুমারিকার শিবিরে যোগ দেওয়ার পর থেকে প্রায় আট মাস কেটে গেছে। সমুদ্র লঙ্ঘন করে সেতু পৌঁছে গেছে লঙ্কার উপকূলে। এইবার যুদ্ধযাত্রা। কয়েকদিন আগে অবধিও শিবিরে যে উৎসবের ভাবটা ছিলো, সেটা এখন আর নেই। অদূর ভবিষ্যতের ভয়াবহ অনিশ্চয়তার হাতছানি সবাইকে যেন ধীর, স্থির, আত্মস্থ করে তুলেছে। গত কয়েকদিন কেউ খুব বেশি কথা বলেনি। চুপচাপ অনুশীলন আর নিজেদের কাজ করে গেছে।

সেতুনির্মাণ যেদিন সম্পূর্ণ হলো, তার পরের দিন ঊষালগ্নে রামচন্দ্র নৈবেদ্য সাজিয়ে পূর্বাস্য হয়ে সমুদ্রতীরে পূজায় বসলেন। দেবী আদ্যাশক্তির পূজা। লঙ্কার অধিষ্ঠাত্রী, রাবণের উপাস্যা দেবী। তাঁর আশীর্বাদেই নাকি লঙ্কার শক্তি ও সমৃদ্ধি। তাই লঙ্কার বিরূদ্ধে যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে তাঁকে তুষ্ট করা প্রয়োজন।

দেবী আদ্যাশক্তির পূজা সহজ নয়। নানান রকম নৈবেদ্য, বহু উপচার এবং জটিল প্রক্রিয়া। সে সব প্রক্রিয়া যাঁর কাছ থেকে জানা গেছে, তাঁর নাম বিভীষণ। রাবণের সহোদর। তিন ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠতম। সেতুবন্ধন শুরু হওয়ার কিছুদিন বাদে ইনি জনা চারেক অনুচরসহ লঙ্কা ছেড়ে এসে রামচন্দ্রের দলে যোগ দেন।শান্ত, সমাহিত, মিষ্টভাষী পুরুষ। রাবণের স্বেচ্ছাচার ও অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি লঙ্কা ত্যাগ করেছেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, তিনি রাবণকে বহুবার অনুরোধ করেন সীতাকে রামের কাছে ফিরিয়ে দিতে। অনিচ্ছুক পরস্ত্রী হরণ, বিশেষত রামচন্দ্রের মতন ত্রিভুবনজয়ী মহাবীরের স্ত্রীকে হরণ করার মতন জঘন্য অপরাধের ভয়াবহ পরিণতির কথা বার বার স্মরণ করিয়ে দেন রাবণকে। কিন্তু তাঁর অতিদর্পী অগ্রজ যথারীতি তাঁর কথায় কর্ণপাত করেননি। উল্টে সভাভর্তি মন্ত্রী-অমাত্যদের সামনে তাঁকে অশ্রাব্য ভাষায় অপমান করেন। হত্যা করার ভয়ও দেখান। সে অপমান সহ্য করতে না পেরে বিভীষণ এবং তাঁর চার অনুগামী লঙ্কা ছেড়ে চলে আসেন এবং রামের শরণ নেন। তাঁর সততার বিষয়ে নিশ্চিত হবার পর রাম তাঁকে সাদরে নিজপক্ষে গ্রহণ করেন। সেই থেকে বিভীষণ এই যুদ্ধ বিষয়ে রামচন্দ্রের অন্যতম প্রধান উপদেষ্টা। তাঁর নিজের দেশের সামরিক শক্তি ও তার সীমাবদ্ধতার বিষয়ে আক্রমণকারীদের নিয়ত সংবাদ জোগাচ্ছেন।

ততদিনে লঙ্কার ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতির বিষয়ে বহু তথ্য জেনেছি। শব্দগুলোর অর্থ আর তাৎপর্য বুঝতে কিছুটা সময় লেগেছিলো। তারপর বাকিটা বোঝা সহজ হয়ে গেছিলো। বছর তিরিশেক আগে পর্যন্ত এই দ্বীপরাষ্ট্রের উপর একছত্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য ছিলো কুবের নামক এক ব্যবসায়ীর। তিনি লঙ্কার মানুষ নন। দাক্ষিণাত্য বা আর্যাবর্তেরও মানুষ নন। অন্য কোনও দেশ থেকে নিজের জ্ঞাতিগোষ্ঠীদের নিয়ে এসে তিনি লঙ্কায় একটি উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন, এবং সেখান থেকে সমগ্র দাক্ষিণাত্য ও অধিকাংশ আর্যাবর্তের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন।

রাবণ, তাঁর দুই ভাই কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণ এবং তাঁদের একমাত্র বোন শূর্পনখার শৈশব কেটেছিলো তাঁদের মাতামহ সুমালীর রাজ্যে। সুমালী ছিলেন লঙ্কার একটি অঞ্চলের শাসক। লঙ্কার শাসনব্যবস্থা তখন ছিলো অনেকগুলি ছোট ছোট স্বাধীন গোষ্ঠীতে বিভক্ত। কুবের ও তাঁর দলবল লঙ্কায় এসে জাঁকিয়ে বসে ধীরে ধীরে সেই শাসনব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করলে গোষ্ঠীপ্রধানদের সঙ্গে তাঁদের সংঘাত আরম্ভ হয়। সুমালীও সেই সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন, এবং একটি সংঘর্ষে নিহত হন। মাতৃরাজ্য থেকে বিতাড়িত নিঃসহায়, নিঃসম্বল রাবণ ও তাঁর ভাইবোনদের কৈশোর কাটে নিদারুণ দারিদ্র ও অসহায়তার মধ্যে। কিন্তু তারপর রাবণ নিজের বাহুবল ও ক্ষুরধার রাজনৈতিক বুদ্ধির জোরে ধীরে ধীরে আবার মাথা তুলে দাঁড়ান, এবং গোপনে এই ঔপনিবেশিক শক্তির বিরূদ্ধে একটি দল সংগঠিত করেন। তারপর, আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগের এক গভীর রাতের অন্ধকারে কিছু বাছাই করা যোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে তিন ভাই অসন্দিগ্ধ, অপ্রস্তুত কুবেরের নিদ্রামগ্ন প্রাসাদ আক্রমণ করেন। অনুচরদের তৎপরতায় কুবের সে যাত্রা পালাতে সক্ষম হলেও লঙ্কা তাঁর হস্তচ্যূত হয়, এবং ততদিনে সমগ্র দ্বীপরাষ্ট্রটির উপর কায়েম একাধিপত্যের শিখরে আরোহণ করেন রাবণ। কুবেরের অতুল ঐশ্বর্য রাতারাতি করতলগত হয় তাঁর।

গত তিরিশ বছরে রাবণ সেই ঐশ্বর্য আরও বাড়িয়েছেন। অনুজ কুম্ভকর্ণ এবং প্রহস্ত, মহাপার্শ্ব, মহোদয়, বিরূপাক্ষদের মতন প্রবল পরাক্রান্ত সেনাপতিদের সহযোগে একটার পর একটা রাজ্য জয় করে নিয়ে এসেছেন বিপুল অর্থ, ধনরত্ন। লঙ্কা আজ সর্বার্থে স্বর্ণমণ্ডিত। সম্পূর্ণ দাক্ষিণাত্য ও অধিকাংশ আর্যাবর্তের স্থল ও সমুদ্র বাণিজ্য আজ লঙ্কার নিয়ন্ত্রণে। সামরিক শক্তিতেও লঙ্কার সমকক্ষ কেউ নেই। সেই অপরাজেয় বাহিনীর পুরোভাগে থাকেন রাবণপুত্র তরুণ মেঘনাদ। তাঁর বীরত্বের যশ ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। তাঁকে যুদ্ধে জয় করা নাকি অসম্ভব!

এসব সংবাদ আমি নানা সময়ে নানান লোকের মুখ থেকে পেয়েছি। শুধু একটা প্রশ্ন বার বার মনে এসেছে। সবাইকে জিজ্ঞেস করেছি। কুবের কোথা থেকে এসেছিলেন? কোথাকার মানুষ তিনি?কেউ ঠিক করে বলতে পারেনি। শুধু কারও কারও ভাসা ভাসা উত্তরে বুঝেছি, বিন্ধ্যপাহাড়ের ওপারের যে সমতলভূমিকে এরা আর্যাবর্ত বলে, তার উত্তরপ্রান্তে আছে এক দু্র্লঙ্ঘ্য পর্বতপ্রাচীর। তার নাম হিমালয়। সেই হিমালয়েরও সুদূর উত্তরে আছে এক চিরতুষারাবৃত রহস্যময় দেশ। সেখানে কেউ কোনওদিন যায়নি। অন্তত এখানকার কারও পরিচিত কেউ কখনও যায়নি। অত্যন্ত দু্র্গম, বিপদবহুল পথ। সাধারণ মানুষের প্রায় অগম্য। সেখানকার অধিবাসীদের নাকি কাম্যও নয় সেখানে কেউ যাক। তাঁরা নাকি সাধারণ মানুষ নন। তাঁদের ক্ষমতা অসীম। মাঝে মাঝে পাহাড় পেরিয়ে তাঁরা কেউ কেউ নেমে আসেন আর্যাবর্তের সমতলভূমিতে। ক্কচিৎ কদাচিৎ বিন্ধ্যপাহাড়ের এপাশে, দাক্ষিণাত্যেও। তাঁদের আসার উদ্দেশ্য ও কারণ অধিকাংশ সময়েই অত্যন্ত গূঢ়। কুবের সম্ভবত সেই রহস্যময় হিমশীতল দেশ থেকেই এসেছিলেন। উদ্দেশ্য তাঁর প্রাথমিক পর্যায়ে গূঢ় থাকলেও পরবর্তীকালে সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক বলেই প্রমাণিত হয়ে গেছিলো...

সদ্যসমাপ্ত সেতুর উপর দিয়ে সহযোদ্ধাদের সঙ্গে পা মিলিয়ে চলতে চলতে এই সবই ভাবছিলাম। নিজেকে যোদ্ধা ভাবতে বেশ লাগে। সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে লড়তে, অন্যায় অত্যাচারকে শাস্তি দিতে যাচ্ছি! সমুদ্রের উপর এমন সেতুও নির্মিত হয়নি কোনওদিন। এত বড় যুদ্ধও এর আগে কোনওদিন হয়নি এই পৃথিবীতে। এ যুদ্ধের কথা উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা থাকবে পৃথিবীর ইতিহাসে, আর আমরা তার শরিক! ভাবলেই রক্ত গরম হয়ে ওঠে...

একটা পরিচিত শব্দে চিন্তার রেশটা কেটে গেলো। চম্পক ডাকছে। আমার থেকে অনেকটা পিছনে অশ্ববাহিনীর সঙ্গে হাঁটছে চম্পক। পিঠে কোনও এক মুখোশ-পরা সওয়ার। আরও অন্য ঘোড়াও ডাকছে মঝে মাঝেই। কিন্তু চম্পকের ডাক আমি চিনি। ও আমাকে খুঁজছে।

মাস ছয়েক আগে চম্পক আমাদের চিকিৎসাশিবিরে এসেছিলো একটা আহত পা নিয়ে। চাঁপা ফুলের মতন গায়ের রং। অল্পবয়সী, অসম্ভব তেজী, ছটফটে ঘোড়া। সহজে কাউকে সওয়ার হতে দিতে চায়না। পিঠে বসলেই লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। সেই রকমই এক মুহূর্তে চোট লাগিয়ে ফেলেছিলো সামনের বাঁপায়ে। বিশালদেহী আরোহীর চাপ সামলাতে পারেনি ঠিক করে।

শুশ্রূষা করতে করতেই চম্পকের সঙ্গে ভাব হলো। সুষেণ স্বয়ং দায়িত্বটা আমায় দিয়েছিলেন। প্রগাঢ় অভিজ্ঞতায় উনি বুঝেছিলেন, তরুণ অশ্বটি পূর্ণবয়স্ক বলিষ্ঠ পুরুষদের ভয় পাচ্ছে। আমার মতন ছোটখাট মানুষের পরিচর্যা নিতে হয়তো আপত্তি হবেনা। হলোও না। প্রথমটা একটু ছটফট করলেও দু’দিনের মাথায় আমার সঙ্গে পুরো ভাব হয়ে গেলো।

কি অসম্ভব বুদ্ধিমান প্রাণী! আমি গাঁয়ে মোষ-ছাগল-শুয়োরের পরিচর্যা করেছি। এর সঙ্গে তাদের তুলনাই চলে না। চুচু বলে আমার যে ন্যাওটা কুকুরটা ছিলো, সে বেশ বুদ্ধিমান ছিলো। কিন্তু তাও চম্পকের মতন নয়। ওর পা সম্পূর্ণ সারার পর আমি প্রথম যেদিন ওর পিঠে উঠলাম, সেদিন ও আস্তে আস্তে চলছিলো। ও বুঝতে পেরেছিলো, অশ্বারোহণ আমার এই প্রথম। তাই আমাকে ধাতস্থ হবার সুযোগ দিচ্ছিলো। একবারও লাফায়নি। ছোটেওনি। তাই প্রথম দিনেই অশ্বারোহণ আমার রপ্ত হয়ে গেলো। পরদিন থেকে চম্পকের অশ্বশালায় ফিরে যাওয়ার দিন অবধি আমি রোজ ওর পিঠে চড়ে কিছুক্ষণ টহল দিতাম।

ওর অশ্বশালায় ফিরে যাওয়ার দিন একটা ঘটনা ঘটলো। আমিই গেছিলাম ওকে দিয়ে আসতে। দিয়ে যখন চলে আসছি, চম্পক আরম্ভ করলো তুমুল লাফালাফি। আমাকে যেতে দেবে না কিছুতেই। কিছুতেই বোঝাতে পারি না যে আমি চলে যাচ্ছি না। কাছেই থাকবো। মুখ দিয়ে আমার কাপড়ের প্রান্ত টেনে ধরেছে। অশ্বরক্ষকরা প্রথমটা মজা পেলেও তারপর বিরক্ত হচ্ছিলো। ওদের অনেক কাজ। তার মধ্যে এই ঝামেলা!

আমি তখন রীতিমতন হিমসিম খাচ্ছি। প্রায় কাপড় খুলে যায় আর কি! অশ্বরক্ষকরা নানারকম বিরক্তিসূচক ভঙ্গী আর শব্দ করতে করতে চেষ্টা করছে চম্পককে সামলানোর। কিন্তু পারছে না। কারণ চম্পক প্রাণপণে পিছনের পায়ে লাথি ছুঁড়ছে। ঠিক এমন সময় সবাই হঠাৎ তটস্থ হয়ে থেমে গেলো। চম্পকও যেন একটু থমকে গিয়ে লাথি ছোঁড়া বন্ধ করলো।

থমকে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমি দেখলাম, প্রধান অশ্বপাল শরভের সঙ্গে এদিকে আসছেন তিনি। সেই শ্বেতকায় পর্বতসন্নিভ পুরুষ। হনুমান। শরভের মতন বিশালদেহীকেও তাঁর পাশে বালক মনে হচ্ছে। কাছাকাছি এসে আমার দিকে তাকালেন। শরভ ততক্ষণে বুঝতে পেরেছেন কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কি হচ্ছে এখানে?’’

ঠিক তক্ষুনি, বোধহয় শরভের গম্ভীর কন্ঠস্বরে ঘাবড়ে গিয়ে, আবার চম্পক লাফিয়ে উঠে লাথি ছুঁড়তে আরম্ভ করলো, এবং মুহূর্তের অসাবধানতাবশত একটু কাছে এসে পড়া এক অশ্বরক্ষক সেই লাথির এক মোক্ষম আঘাতে ছিটকে পড়লো এক পাশে।

ব্যাপারটা আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। কেউ এগোতে সাহস পাচ্ছে না চম্পকের আশেপাশে। শরভও ভ্রূ কুঁচকে ভাবছেন কি করবেন। বেশ বুঝতে পারছি, চম্পকের মুখ থেকে মুক্তি পেতে হলে এবার আমার লজ্জাবস্ত্র ত্যাগ করতে হবে...

এই সময় এগিয়ে এলেন হনুমান। মুখে মৃদু হাসি। ভঙ্গিতে সতর্কতা। চম্পক কিছু আঁচ করতে পেরে ওঁর দিকে পিছন ফিরে লাথি ছুঁড়তে গেলো। দেখলাম, হনুমান বিদ্যুৎগতিতে উল্টো দিকে সরে এসে নিজের বিশাল ডান হাতটি দিয়ে চম্পকের কোমরটা চেপে ধরলেন, এবং বাঁ হাতে জড়িয়ে ধরলেন ওর গলা। চম্পক যত ছটফট করে ছাড়া পাবার চেষ্টা করছে, হনুমান তত জোরে চাপ দিচ্ছেন। কয়েক মুহূর্ত পর চম্পক বুঝতে পারলো, এই বাহুবেষ্টন থেকে মুক্তি পাওয়া ওর সাধ্য নয়। তখন হাল ছেড়ে দিলো।

হনুমান আরও কিছুক্ষণ ওকে ওইভাবে ধরে থেকে তারপর আস্তে আস্তে ছেড়ে দিলেন। চম্পক ততক্ষণে শান্ত হয়ে গেছে। মুখ থেকে আমার কাপড়ের প্রান্তটাও ছেড়ে দিয়েছে। হনুমান আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তোমাকে চিকিৎসা শিবিরে দেখেছি না?’’

আমার তখন মহা অপ্রস্তুত অবস্থা। কাপড় সামলাতে সামলাতে কোনওরকমে মাথা নাড়লাম।

‘‘ও তোমাকে ছাড়ছিলো না কেন?’’ হনুমান প্রশ্ন করলেন। 

ততক্ষণে তিনজন রক্ষক এসে চম্পকের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে তাঁর হাত থেকে। আমিও মোটামুটি সামলে গেছি। বললাম, ‘‘ও চিকিৎসাশিবিরে এসেছিলো আহত হয়ে। সুষেণ আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন ওর পরিচর্যা করার।’’

হনুমান আবার হাসলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তুমি অশ্বারোহণ জানো? চড়েছো ওর পিঠে কখনও?’’

আমি আবার মাথা নাড়লাম। বললাম, ‘‘গত দশ-বারো দিন রোজ চড়েছি।’’

হনুমান চম্পকের দিকে একবার তাকিয়ে তারপর শরভকে বললেন, ‘‘এর জন্য কোনও লঘু আকৃতির আরোহী নির্দিষ্ট করুন। ওর ওতে অভ্যাস হয়ে গেছে। ভারী কেউ চড়লে সমস্যা করবে।’’ তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘তুমি রোজ এসে অন্তত একবার ওর সঙ্গে দেখা করে যাবে। কেমন?’’

আমি সানন্দে সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম... এবং তারপর থেকে গতকাল পর্যন্ত সে নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি একদিনও। আজ হয়েছে। কারণ আজ ঊষালগ্নে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছে। সুযোগ পাওয়া যায়নি চম্পকের সঙ্গে দেখা করার। তাই সম্ভবত ও উদ্বিগ্ন হয়ে আমায় খুঁজছে। কিন্তু কিছু করার নেই। গন্তব্যে না পৌঁছনো অবধি ওর সঙ্গে দেখা হবে না।








1 comment:

  1. প্রাথমিক উত্তেজনা ও টান টান ভাবটাকে টেনে এতদূর নিয়ে আসার জন্যে লেখকের অবশ্যই ধন্যবাদ প্রাপ্য!

    ReplyDelete