ব্যক্তিগত গদ্যঃ সুস্মিতা বসু সিং
Posted in ব্যক্তিগত গদ্যব্যক্তিগত গদ্য
অপেক্ষা
সুস্মিতা বসু সিং
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিনদুয়েক পর। উৎসবের রেশ স্তিমিতপ্রায়। হেমন্তের শেষ বিকেলটা সেদিন বিষণ্ণতায় মাখামাখি। হঠাৎ বেজে উঠলো ফোনটা। অচেনা নম্বরে ‘‘হ্যালো’’ বলতেই ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এলো, ‘‘কেমন আছো? চিনতে পারছো কি?’’ গভীর গম্ভীর অথচ অসম্ভব মিষ্টি সুরেলা এক পুরুষ কন্ঠ। ভীষণ চেনা বাচনভঙ্গী... আমি ঠিক চিনেছি কি? দ্বিধান্বিত গলায় আবার প্রশ্ন করি,‘‘কে বলছেন?’’ উত্তর এলো, ‘‘সেকি? চিনতে পারছো না? শিমুল...’’ আমার উত্তেজনার বাঁধ ভাঙলো, ‘‘আরে...কবে এলে? বলো নি তো? হ্যাঁ...তাই তো, ঠিকই তো!! এখানকারই নম্বর তো? আমার নম্বর পেলে কি করে? কতোদিন আছো? থাকবে তো এখন??’’ ---- ওপাশ থেকে সহাস্য উত্তর এলো, ‘‘দাঁড়াও, দাঁড়াও... তুমি তো সব প্রশ্ন একসঙ্গেই করে ফেললে! আরে তুমি এতো উত্তেজিত হবে জানলে তো তোমার বাড়ীতেই চলে যেতাম। তোমার এই অসম্ভব এক্সাইটেড ঝলমলে হাসি হাসি মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছে যে!’’ আমার প্রশ্ন তখনও শেষ হয় নি, ‘‘শুনেছিলাম এখানে আসো না আর, কোথায় ছিলে এতদিন? একা এসেছো? কোথায় উঠেছো এখানে? তোমাদের বাড়ীটা তো...’’ প্রশ্নটা শেষ করতে না দিয়েই উত্তর এলো, ‘‘হ্যাঁ, বাবা চলে যাওয়ার পর বাড়ীটা এখন আর নেই, আমি তো চিরকালই একা... হা হা হা...’’ সেই একই রকম প্রাণখোলা হাসি, হঠাৎ-ই গলাটা খাদে নামিয়ে জানতে চাইলো, ‘‘কাল দুপুরে দেখা হতে পারে? এইচ.এইচ.আই। একসঙ্গে লাঞ্চ করবো। যদি অবশ্য তোমার কোনও কাজ না থাকে!’’ আমার কাজ!!! থাকলেও কি ‘যাবো না’ বলতাম? নিজেকে যথাসম্ভব সংযত করে স্বাভাবিক গলায় বললাম, ‘‘আচ্ছা, কাল সকালে বলছি, এটা কি হোটেলের নম্বর? এই নম্বরে ফোন করবো?” বললো, ‘‘হ্যাঁ, এটা হোটেলেরই নম্বর। কিন্তু তোমায় কষ্ট করতে হবে না, আমি ফোন করে নেবো... কখন করবো, বলো।’’ ‘‘দশটা?’’ ‘‘আচ্ছা, তাহলে কাল দেখা হচ্ছে। অনেক কথা আছে। রাখি এখন?’’ ‘‘রাখো’’ বলতে না বলতেই ‘‘গুড নাইট’’ বলেই আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোনটা রেখে দিলো। বুঝলাম, ভেতরে ভেতরে শিমুলও যথেষ্টই উত্তেজিত।
এই শিমুল লোকটার সঙ্গে সেই কিশোরী-বেলা থেকে কতবার যে দেখা হলো, তার ঠিক নেই। কোনও বারই খুব বেশী দিনের জন্য নয়। তবুও কেমন যেন একটা দাগ রেখে গেছে প্রতিবারই। শিমুলের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হাজারিবাগে। ক্লাস টেন পরীক্ষা দিয়ে ছোটো পিসির বাড়িতে বেড়াতে গেছি তখন। পিসিদের একেবারে একই পাঁচিলের প্রতিবেশী রমা কাকিমার মেয়ে লাজো-দিদির বিয়েতে এসেছিলো ওরা। রমা কাকিমার দাদার ছেলে ও। বিয়ের চার-পাঁচদিন আগে থেকে বৌভাতের দু-তিনদিন পর পর্যন্ত, প্রায় দিন দশেক... খুব ভাব হয়ে গিয়েছিলো। শিমুলও সেবার ক্লাস টেন দিয়েছিলো। তারপর কলকাতায় ফিরে অবশ্য আর কোনও যোগাযোগ ছিলোনা যথারীতি। শিমুলের সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা হয় আমার ইউনিভার্সিটির শেষ দিনে। সেকেণ্ড ইয়ারের রেজাল্ট তুলতে গেছি, লাইনে মারপিট লেগে গেলো। ভীড়ের মধ্যে হঠাৎ চোখে পড়লো, ছিপছিপে রোগা রোগা নেই আগের মতো, তবুও বিলক্ষণ চেনা যায়। জার্নালিজম পড়ছিলো এখানে, আর আমার কম্পারেটিভ। আশ্চর্য!! দু’বছরে একদিনও দেখা হলো না কেন, ভেবেই মন খারাপ লাগছিলো। যাই হোক, অনির্দিষ্ট কালের জন্য রেজাল্ট বিলি স্থগিত রাখা হলো। আমাদের তো পোয়া বারো। পরের একমাস প্রায় রোজই দেখা হতে লাগলো, যত দিন না রেজাল্ট হাতে পাওয়া যায়। সেই সময় নম্বর এক্সচেঞ্জ হয়েছিলো। তারপর বেশ কিছু দিন টুকটাক ফোন, টেক্সট চালাচালি, কিন্তু নিজেদের ব্যস্ততায় ধীরে ধীরে কমে আসতে আসতে তাও বন্ধ হয়ে গেলো একদিন। এর পরে অন্তত আরো দু’বার দেখা হয়েছিলো শিমুলের সঙ্গে। একবার একটা পত্রিকার অফিসে আর দ্বিতীয়বার একটা প্রেস কনফারেন্সে। এগুলো তেমন বিশেষ উল্লেখযোগ্য নয়। যদিও প্রতিবারই একটা জিনিস লক্ষ্য করেছি, দেখা হলে আমাদের দুজনেরই খুব ভালো লাগে, আর এই ভালো লাগাটা আমরা কেউই চেপে রাখতেও পারি না।
কিন্তু শেষ বারের দেখা হওয়াটাই খুব সিগনিফিক্যান্ট। ১৭ই জানুয়ারি, ২০১০। সাল তারিখ এই ভাবে মনে থাকার একটা কারণ আছে। বলছি সেই কথাটাই। সেবার অফিসের কাজ পড়লো কাশীপুর কলেজে। সোমবার সকাল দশটার মধ্যে পৌঁছতে হবে কলেজে। তাই আগের দিন, মানে রবিবার ভোরবেলা চেপে বসলাম রূপসী বাংলায়। ট্রেনটা ঘন্টা খানেক লেট। ট্রেন থেকে নামার আগেই শুনলাম দীর্ঘদিন রোগ ভোগের পর জ্যোতি বসু চলে গেছেন, সোমবার সব বন্ধ। আদ্রা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে সবে মাত্র পা রেখেছি, পিছন থেকে নিজের নাম ধরে ডাক শুনে ফিরে তাকালাম। দেখি একগাল হাসি নিয়ে দুহাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে শিমুল। পিঠে মস্ত একখানা ব্যাগ। হেসে এগিয়ে যেতেই শক্ত করে দুহাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো,‘‘তোমাকে এখানে দেখবো স্বপ্নেও ভাবতে পারার কথা নয়। কোথায় এসেছো? কাল সব বন্ধ, জানো তো?’’ বললাম আমার কথা। শুনলাম ও-ও এসেছে কাজেই। ইদানিং থাকে কেপটাউনে। গ্রামবাংলার লুপ্তপ্রায় স্থাপত্যের উপর একটা ইন্টারন্যাশনাল জার্নালের জন্য তথ্যানুসন্ধান ও ছবি সংগ্রহের কাজ নিয়ে ডিসেম্বরে বারো সপ্তাহের জন্য এসেছে দেশে। আমার গাড়ী বলা ছিলো। আদ্রা স্টেশনের বিখ্যাত মাটির সরায় গরম গরম সাম্বর-ঢালা ইডলি খেয়ে সেই গাড়ীতে করে আদ্রার একমাত্র বাসযোগ্য হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম একসঙ্গেই। আমার সোমবার বিকেলের আরণ্যকে ফেরার কথা, শিমুলের মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। এখন একদিন করে পিছিয়ে যাবে। শিমুল বললো, ‘‘আরও একদিন থেকে যাও, অনেকগুলো মন্দির দেখাবো, বৃহস্পতিবার ভোর বেলা আসানসোল থেকে অমৃতসর মেল ধরে সক্কাল সক্কাল পৌঁছে যাব কলকাতা।’’
ইতিহাসের হাতছানি অপ্রতিরোধ্য, তাই প্ল্যান চেঞ্জ। হোটেলে এসে চটপট কিছু প্রয়োজনীয় ফোন কল, স্নান খাওয়া সেরে গাড়ী নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম কাশীপুর রাজবাড়ী দেখতে। শীতের দুপুরে তখন রোদের তেজ অনেকটাই কমে এসেছে। লাল ইঁট, পাথর ও কাঠের তৈরি রাজবাড়ীর স্থাপত্য ও শিল্পকলা অসাধারণ। মুঘল আক্রমণের সময় পঞ্চকোট রাজারা তাঁদের গড় কাশীপুরে স্থানান্তরিত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরদিন খুব ভোরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম কাশীপুর রাজার কেল্লা, গড়পঞ্চকোট দেখতে। বাংলা ঝাড়খণ্ড সীমান্তে পুরুলিয়া জেলার উত্তর-পূর্ব কোণে পঞ্চকোট পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই গড়পঞ্চকোট। চারিদিকে সবুজের সমারোহ, শাল পিয়ালের নিভৃত অবকাশে পাহাড়ী পথ বেয়ে ঘন জঙ্গলের মধ্যে পাখির কলকাকলি। শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই নয়, গড়পঞ্চকোটের অতীত ইতিহাসও যথেষ্ট সমৃদ্ধিশালী। পঞ্চকোট রাজবংশের অতীত ইতিহাস নিয়ে পাহাড়ের উপরের অংশেই রয়েছে মন্দির ক্ষেত্র। এই মন্দির ক্ষেত্রই ছিল পঞ্চকোট রাজবংশের রাজধানী। টেরাকোটার শিল্পবৈশিষ্ট্য সম্পন্ন কয়েকটি মন্দির আজও অতীতের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। একসময় মাইকেল মধুসূদন দত্ত পঞ্চকোট রাজার এস্টেট ম্যানেজার হিসাবে চাকরি করতেন। গড়পঞ্চকোটের পাহাড়ী পথে একটি সুন্দর ট্রেকিং রুটও রয়েছে। গোবাগ মোড় থেকে পাঞ্চেৎ জলাধারে যাওয়ার পথে তিন কিলোমিটার দূরে পঞ্চকোট পাহাড়ের পশ্চিম দিকে হদহদি নামে আরেকটি জলাধার রয়েছে। এই হদহদি থেকে সাত কিলোমিটার ট্রেক করে পাহাড়ের চড়াই উতরাই পেরিয়ে বৈচিত্র্যময় শাল, পিয়াল, কেন্দুর জঙ্গলের ভিতর দিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় ২১০০ ফুট উচ্চতায়। ফেরার পথে এখান থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে মাইথন ড্যাম ও কল্যাণেশ্বরী মন্দির দেখে ফিরলাম। বিশেষ দ্রষ্টব্য, মন্দিরের পিছন দিকে মন্দির চত্বরের বাইরে একটা ছোট্ট স্বচ্ছতোয়া ঝিরঝিরে ঝর্ণা। যেন ঝলমলে পোশাক পরা একটা ছোট্ট মেয়ে নাচতে নাচতে তিরতির করে লাফিয়ে লাফিয়ে কুলকুল শব্দে হাসতে হাসতে নেমে আসছে পাহাড়ের গা বেয়ে। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।
পরদিন সকালটা আমার কলেজ নিয়ে আর ওর সারাদিনটাই কতকগুলো সরকারী দপ্তরের কাজ নিয়েই কেটে গেলো। কাজের মধ্যে কাজ, সন্ধ্যার পর কোথা থেকে একটা বাইক জোগাড় করে নিয়ে এলো। বললো, “গ্রামের রাস্তায় বাইক নিয়ে চলাফেরা করা সহজ, কাল আমরা বাইকে যাব।”
বুধবার খুব ভোরে বেরনোর ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু শীতের সকালে রেডি হয়ে বেরতে বেরতে আটটা বেজে গেলো। পুরুলিয়ায় যে এতো দর্শনীয় স্থাপত্য কীর্তি আছে, ধারণা ছিলো না। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসেছে এই জেলা। কল্পসূত্র থেকে জানা যায়, খৃষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর এই জেলা পরিভ্রমণ করেন। এই জেলার বিভিন্ন প্রান্তের মানুষেরা আজও জৈন ধর্মের প্রথাগুলিকে সযত্নে লালন পালন করে চলেছেন। মহাবীরের সময় থেকেই এই জেলা জৈন ধর্মের সংস্পর্শে এলেও এই ধর্ম পূর্ণবিকশিত হয় যখন অনন্ত বর্মন দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গদেশ দখল করে বাঁকুড়ার অম্বিকা নগরে তাঁর দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেন। অনন্ত বর্মন ছিলেন জৈন ধর্মের পৃষ্ঠপোষক। সেই কারণে জৈন ধর্ম রাজানুকূল্যে প্রস্ফুটিত ও বিকশিত হয়, এবং এর সূত্র ধরে একাদশ ও দ্বাদশ শতকে পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার বিভিন্ন স্থানে পরশনাথ ও মহাবীরের সম্মানে বেশ কিছু মন্দির গড়ে ওঠে। কিন্তু রাজা অনন্ত বর্মন পরবর্তীকালে হিন্দু ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং বেশ কিছু জৈন মন্দিরকে বিষ্ণু ও শিবের মূর্তি সম্বলিত হিন্দু মন্দিরে রূপান্তরিত করেন। এখনও পুরুলিয়ার বেশ কিছু জৈন মন্দিরের মূর্তিগুলি সেই রূপান্তরের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি হলো, পুরুলিয়ার এক বিরাট অংশ, যা তেলকূপি নামে খ্যাত, সংরক্ষণ ও নথিকরণের অভাবে ডি ভি সি-র বাঁধের জলে নিমজ্জিত হয়ে যায়। তেলকূপি ছিল একটি বিখ্যাত জৈন-বসতি, যেখানে নবম শতকে পাল বংশের আমলে নির্মিত অসংখ্য জৈন মন্দির ও স্থাপত্য কীর্তি ছিল।
এ সমস্ত তথ্য অবশ্য নেট ঘাঁটলেই পাওয়া যায়। সারাদিন সর্বাঙ্গে ইতিহাস মেখে এবং বিশেষত দুর্লভ স্থাপত্যগুলির বিলুপ্তপ্রায় ধ্বংসাবশেষ দেখে পরিশ্রান্ত, ভারাক্রান্ত মন নিয়ে শেষ বিকেলের দিকটায় ফেরার পথ ধরতেই হলো। শীতের বিকেলে অন্ধকার নামছে দ্রুত, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঠাণ্ডা। ফুলস্পীডে আমাদের বাইক ছুটে চলেছে কখনও মাঠের মাঝখান দিয়ে, কখনও নিবিড় জঙ্গল চিরে, কখনও গ্রামের মাঝ-বরাবর, কখনওবা গ্রামগুলোকে একপাশে রেখে। এমনই এক গ্রামের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে দেখলাম কাঁচা রাস্তা থেকে প্রায় একশো হাত দূরে একটা গাছের চারপাশে গোল হয়ে কিছু আদিবাসী নারীপুরুষ। অনেকগুলো মশাল জ্বলছে। অসম্ভব ঠাণ্ডায় একটু আগুনের লোভে বাইকটাকে একটু দূরে পার্ক করে পায়ে পায়ে গিয়ে হাজির হলাম ওদের কাছে। একজন প্রৌঢ় মানুষ ইনিয়ে বিনিয়ে একঘেয়ে করুণ সুরে গেয়ে চলেছে–
পাঁচেত ডেমে বুধনী
গেল কাম করতে
এক ডঁড়রী ভাতের লাগ্যে
হামি বঁলিয়েছিলি যা'স না বিটি।
যুয়ান বিটি বললেক
কাম না করল্যে খাব কি বাপ্
চাষ গেল বাস গেল, মাথার উপর
খাপরার চালটাও গেল
ঘর খাঁয়েছে দুয়ার খাঁয়েছে
হামদের গাঁ টাও খাঁয়েছে
গতরখাওকি ডেমে---
----------
বুধনী আমার হারাঁয় গেল জলে।
পাঁচেত ডেমের জল নকি কাল
খড়ি গুনে বলত ঠাকুর
বিটির আমার এমন ক্যেনে হল্য।
তবে কি পাঁচেত ডেমও জাত খুয়াল্য?
পাঁচেত ডেমে বুধনী
গেল কাম করতে
এক ডঁড়রী ভাতের লাগ্যে
হামি বঁলিয়েছিলি যা'স না বিটি।
যুয়ান বিটি বললেক
কাম না করল্যে খাব কি বাপ্
চাষ গেল বাস গেল, মাথার উপর
খাপরার চালটাও গেল
ঘর খাঁয়েছে দুয়ার খাঁয়েছে
হামদের গাঁ টাও খাঁয়েছে
গতরখাওকি ডেমে---
----------
বুধনী আমার হারাঁয় গেল জলে।
পাঁচেত ডেমের জল নকি কাল
খড়ি গুনে বলত ঠাকুর
বিটির আমার এমন ক্যেনে হল্য।
তবে কি পাঁচেত ডেমও জাত খুয়াল্য?
লোকটার পাশে বসে বসে আরেকজন মাদলে তাল দিয়ে যাচ্ছে... ধিম ধিম ধিম... কেমন এক ছায়া ছায়া ভৌতিক পরিবেশ। আমরা যে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, মনে হলোনা কেউ লক্ষ্য করেছে। বুঝলাম, মহুয়া আর হাঁড়িয়ার নেশায় বুঁদ সবাই। গাছের নীচে কমলা আর লাল সিঁদুর মাখা কতকগুলো পাথর। শিমুল বলল, মারাংবুরু – ওদের দেবতা। তারপর ওর দেখাদেখি আমিও মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে প্রণাম করলাম দেবতাকে। বুঝলাম, প্রশ্নটা এখানে আমাদের নয়, ওদের বিশ্বাসের - এই মাঝরাতে যেটা না ঘাঁটানোই ভালো। আদিবাসীদের বৃত্তটার বাইরে এসে জিন্সের হাঁটুর কাছের ধুলো ঝাড়ছি, শিমুল নিচু হয়ে একমুঠো লাল কাঁকর ওয়ালা ধুলো তুলে আমার জামাকাপড়ে ছড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘‘এখানকার ধুলো ঝাড়তে হয়না, বোকা, মাখতে হয়।’’
আগুনের মায়া ত্যাগ করে ফেরার পথ ধরলাম আমরা আবার। ঘড়িতে তখন আটটা বেজে গেছে। কাছাকাছি সময়ে মনে হয় পূর্ণিমা ছিলো বা আছে। চারিদিক জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। বিশ্বচরাচর শুনশান, একটানা কেবল ঝিঁঝিঁর ডাক আর মাঝে মাঝে কিছু রাতজাগা পাখীর ডানা ঝাপ্টানোর শব্দ। মাঘের হিম সোয়েটার জ্যাকেট জামা কাপড় ভেদ করে হাড় পর্যন্ত কনকনিয়ে দিচ্ছে। হাতপায়ের অঙ্গুলগুলো সব অবশ হয়ে গেছে। আধমড়া অবস্থায় যখন হোটেলে ফিরলাম, ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় হাত জোড়া করেছে। ঘণ্টা তিনেকের মধ্যে আবার বেরতে হবে, তাই আর ঘুমনোর সাহস হল না। ঠিক করলাম, বাকি সময়টুকু গল্প করেই কাটিয়ে দেবো। কিন্তু আমার এবার শরীর খারাপ করতে শুরু করেছে। আমার একটু ঠাণ্ডার ধাত, বুঝলাম হিম লেগে গেছে বেশ। তিনটে চারটে কম্বলের নীচেও কাঁপছি ঠক ঠক করে। রুম হিটারে কাজ হচ্ছে না। হঠাৎ টের পেলাম কম্বলের নীচে আমার ঠাণ্ডা পা দুটো ওর কোলের ওপর তুলে নিয়ে জোরে জোরে মাসাজ করতে শুরু করলো। আমার অবশিষ্ট সমস্ত শক্তিটুকু দিয়ে একটা ক্ষীণ প্রতিবাদ করে কোনও লাভ হলো না দেখে ওর উষ্ণতার আহ্বানে আত্মসমর্পন করলাম একপ্রকার নিরুপায় হয়েই।
এর পর আর আমাদের একটাও কথা হয়নি। না, সেই মাঝরাত থেকে পরের দিন সকাল পর্যন্ত একটাও কথা নয়। কেমন যেন ওর দিকে তাকাতেই পারছিলাম না। শুধু হাওড়া স্টেশনে নেমে প্রিপেড ট্যাক্সি বুথের দিকে এগোতে এগোতে পিছন ফিরে দেখলাম, নতুন প্ল্যাটফর্মের এগজ়িট গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে তখনও। দিনতিনেকের মধ্যে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালো ফেসবুকে, অ্যাকসেপ্ট করলাম, কিন্তু ওই... কথা হলো না কিছুই। এর প্রায় মাস চারেক পর হঠাৎ ইনবক্সে শিমুল– ‘‘আজ সারাটা দিন ধরে আকাশের মুখ ভার। তোমার নিবিড় সমন্বিত আদুরে সংসারে ঝলমলে রোদ কি? ইচ্ছে করে ফাঁকি দিয়ে চুরি করে আনি তোমায়। একটু মেঘের ভাগ দিই, একটু রোদের ভাগ নিই। তারপর আলোছায়ার বোঝাপড়ায় অতলস্পর্শী খেলা। তলিয়ে যেতে যেতে গভীরে গহনে আরও গভীরে...শেষমেষ নির্ভার, নিষ্কাম শুধু চেতনার আলোটুকু নিয়ে উদ্বেল, উদ্ভাসিত একাকার অস্তিত্ব হয়ে নদীগর্ভে শুয়ে থাকা পাশাপাশি অনাদি, অনন্ত কাল।’’
পড়লাম, অনেকবার। কিন্তু কি উত্তর দেবো বুঝতে পারলাম না বলেই আর উত্তর দেওয়া হলো না। তারপর কেটে গেছে কতগুলো দিন, কতগুলো বছর… কতশত পুরনো স্মৃতি আর নানান রকম সম্ভাবনার কথা একসঙ্গে ভীড় করে আসছে মনের মধ্যে। কখন যে সন্ধ্যা পার হয়ে রাত্রি নেমেছে চুপিসারে, টেরও পাইনি। শুধু বুঝেছি, আজ আর সারারাত ঘুম হবে না। পায়ে পায়ে এসে দাঁড়াই আমার বড়ো প্রিয় দক্ষিণের বারান্দায়। এখানেই বসি একটু এই উঁচু ব্যাকরেস্ট-ওয়ালা আরাম কেদারাটায়। আজও আকাশে সেই সেদিনের মতোই এত্ত বড় সোনার থালা চাঁদ... জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে চারিদিক! এমনই কোনও জ্যোৎস্নারজনীতে মনে কি পড়েছিলো আমায় তার! কখনও কোনও পরিশ্রান্ত দিনান্তের অবসন্ন অখণ্ড অবসরে! বলছিলো, অনেক কথা আছে... অনেক কথা? কত কথা? কি কি কথা? কখন থেকে সেই একই কথা ভেবেই চলেছি। মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করতে চাই পরেরদিন দুপুরের জন্য। কিন্তু ক্লান্তিতে চোখের পাতা দুটো ভারী হয়ে আসছে... দুপুরবেলা এতো জ্যোৎস্না এলো কোথা থেকে? আমার জিন্সেও কতো ধুলো... ধুলো মাখতে হয়... ধুলো মাখতে হয়... মারাংবুরু, মারাংবুরু, বুধনী একা একা কোথায় হারিয়ে গেলো? একা একা! একা? তুমি তো চিরকালই একা... আমিও খুব একা, জানো! আমি আসছি, শিমুল... আসছি... আসছি... অপেক্ষা করো, প্লীজ... অপেক্ষা করো... অপেক্ষা... অ পে ক খ্ খ্ আ আ...
খুব মন ছুঁয়ে গেল।
ReplyDeleteগল্পের নিপুণ বুননে ইতিহাস,লোককথা আর প্রেম ত্রিবেণী সঙ্গম রচনা করেছে।মুগ্ধতা জানালাম।
ReplyDeleteগল্পের নিপুণ বুননে ইতিহাস,লোককথা আর প্রেম ত্রিবেণী সঙ্গম রচনা করেছে।মুগ্ধতা জানালাম।
ReplyDelete