3

ধারাবাহিকঃ নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক



জলরেখা
নন্দিনী সেনগুপ্ত 


এক

মেঘগুলো জানে। ওরাই জানে, কখন জল ধরে রাখবে আর কখন ছেড়ে দিয়ে বৃষ্টি নামাবে। মানুষ হয়তো ঠিক জানে না; অথবা জানলেও তার ঠিক-ঠাক প্রয়োগ শিখে উঠতে লেগে যাবে অনেক জন্ম। নইলে পৃথিবীতে এমন কি করে হয় যে- কোথাও মানুষ তৃষ্ণার জলটুকু অবধি যোগাড় করতে বেজায় কসরত করে, আবার কোনওখানে বন্যার জলে মানুষ ডুবে মরে! শুনতেই মনে হয় জল, সে আর এমন কি জিনিস? শিশুরাও জানে। বলতেই বলে জলের মত সোজা। কিন্তু ওই যে বললাম, তাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করবার মত শক্তি মানুষের এখনও নেই। স্মৃতিও ঠিক তাই। কখন যে কোথা থেকে জেগে উঠবে, আবার কখন কোথায় তলিয়ে যাবে, কেউ জানেনা। শিশুকাল থেকে শুরু করে একটু আগেই যে মুহূর্ত অতীত হয়ে গেলো, একদম একটা সরলরেখার মত কি তাকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব? বোধহয় না। জেগে ওঠে, হঠাৎ একেকটা ছবি, আবার মিলিয়ে যায়।

এই অবধি পড়ে বন্ধ করলো নীরদা তার ডায়রিখানা। এটা তার বহুদিনের অভ্যাস; মাঝে মাঝে যেটা মনে হয় টুকিটাকি কথা লিখে রাখা ডায়রির পাতায়। এটা অনেকদিন পরে বেরিয়ে এসেছে ঘরদুয়ার গোছাতে গোছাতে। ব্যক্তিগত স্মৃতিমাত্র। বিশেষ কিছু নয়। হঠাৎ করে হয়তো মিলে যায় কারো কারো জীবনের একেকটা বিন্দুর সঙ্গে। সাধারণ মানুষের জীবন যেমন হয় আরকি! প্রাপ্তির সুখ, অপ্রাপ্তির শূন্যতাবোধ একই রকম হয় তো কতকটা। কোনওটাই খুব তীব্র, চিরস্থায়ী হয় না। ওই জলের আল্পনার মতই। নিজের নামের অর্থ ‘মেঘ’ বলেই হয়তো নীরদা শিশুবেলা থেকেই মেঘ নিয়ে ভাবতে ভালবাসতো খুব। কাজেই লিখতে বসলে কি করে যেন মেঘ, জল, বৃষ্টি এসব প্রসঙ্গ আপনা থেকেই চলে আসতো কলমের সম্মুখভাগে। ডায়রির পাতা আবার উল্টে পাল্টে দেখতে গিয়ে চোখে পড়লো সামনের দিকের একটা পাতায় লাগানো একটা জলছবি। একটা জাহাজের জলছবি।

জলছবি। হ্যাঁ--- এরকম একটা জিনিস ছিলো। নীরদার শৈশবে। লজেন্সের সঙ্গে ফ্রি পাওয়া যেতো। ঠিক আঠা দেওয়া স্টিকারের মত নয়, একটু অন্যরকম। মাঝে মাঝে পাঠ্যবই অথবা খাতায় লাগিয়ে ফেলতো নীরদা আর তার তুতো ভাইবোনেরা; ঠাকুরদেবতা, রাক্ষসের মুখ আর কার্টুনের চরিত্রের জলছবি। কারো কাছে একই ছবি দুটো থাকলে নিজেদের মধ্যে বদলাবদলি করে নেওয়া যেতো। সেদিন ওই ধরণের একটা জিনিস ক্লাস থ্রিতে পাঠরতা ভাইঝির খাতায় দেখে সে ভারি আহ্লাদিত হয়ে প্রশ্ন করেছিলো, ‘‘হ্যাঁ রে, জলছবি কোথায় পেলি?’’ সে পিসির অজ্ঞতায় বেজায় হেসে বলেছিলো, ‘‘ওঃ ভালোপিসি, কি যে বল! এগুলো তো ‘ট্যাটু’। মানুষে গায়ে হাতে পায়ে লাগাচ্ছে পার্মানেন্ট একদম। আর জানো... মা বকবে, তাই আমি তো টেম্পোরারি একটা লাগিয়েছি, তাও গায়ে লাগাইনি।’’ দুঃখে ঠোঁট উল্টায় সে। ‘‘খাতায় লাগালাম, বুঝলে! আর তুমি কি বলছো, জলছবি? কি জানি! ওরকম কিছু জানি না।’’ এবার সে একটু কাঁধ ঝাঁকায়।

নীরদার হঠাৎ মনে পড়ে, হ্যাঁ জলছবি লাগানোর জন্য স্কুলে বকা খেতে হতো এমনকি। তার সঙ্গেই এমন একটা কাণ্ড হয়েছিলো। ক্লাস ফোর, বিজনদি, ক্লাস টীচার, পড়াতেন ইংরেজি আর ইতিহাস । বছরের শুরুতে পইপই করে বলে দিতেন, ব্রাউন পেপার দিয়ে সব বই-খাতা মলাট দেবে, সাদা কাগজ কেটে লেবেল বানিয়ে নাম, ক্লাস, রোল নামবার, বিষয় এসব লিখবে। আর হ্যাঁ, একদম, একদম বারণ ইস্কুলের বই খাতায় জলছবি লাগানো।

সেবার নীরদা নতুন বই কেনেনি। কেন কিনবে? দুটো বাড়ি পরে থাকে সীমাদি। এক ক্লাস উপরে পড়ে। খুব ভালো অবস্থায় ছিলো ওর বইগুলো। নতুনের মতই প্রায়। একটুও ছেঁড়া-ফাটা, সেলাই খোলা বা কালির দাগ, সেরকম কিচ্ছু ছিলোনা বইগুলোতে। অর্ধেক মূল্যে সীমাদির কাছ থেকে নিয়েছিলো সব বইগুলো ক্লাস শুরু হবার আগেই। সব বই তো আর পাতা উল্টে উল্টে দেখা সম্ভব নয়। তাছাড়া নীরদার মাথাতেই আসেনি যে সীমাদি বইয়ের মধ্যে জলছবি লাগাতে পারে। সেটাও আবার ইতিহাস বইতে আকবরের ছবির পাশে। একদম পাশাপাশি আকবরের মুখের পাশে ম্যানড্রেক। নীরদা ক্লাসে গিয়ে খেয়াল করেছিলো ম্যানড্রেকের রঙচঙে জলছবির অস্তিত্ব। সেদিন মোঘল সাম্রাজ্যের উত্থানের কারণগুলি আলোচনার প্রসঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে যে তার নিজের শাস্তিও এগিয়ে আসতে পারে, সে ব্যাপারে তার একটু আশঙ্কা ছিলোই। বারে বারে হাত দিয়ে, খাতা দিয়ে ঢাকছিলো খোলা বইয়ের পাতা। সম্ভবত তার শারীরিক ভাবভঙ্গীতে সে গোপন করতে পারেনি তার উদ্বেগ এবং অস্বস্তি। একটু পরেই বিজনদি লক্ষ্য করলেন, ‘‘কি হয়েছে তোমার? অমন করছো কেন? শরীর মোচড়াচ্ছ কেন? শরীর খারাপ? পেটে ব্যথা? অসুবিধে হলে সিক রুমে গিয়ে শুয়ে থাকো, ক্লাসে ডিস্টার্ব করবে না একদম’’ ... ঝড়ের বেগে বলে যান বিজনদি। উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলবার আগেই বিজনদি একদম তার কাছে হেঁটে এসে তুলে নেন তারই পাঠ্য ইতিহাস বইখানা। তখন তো নীরদার ‘‘ধরণী দ্বিধা হও, আমি প্রবেশ করি’’ অবস্থা। বিজনদি মাথা নাড়েন, ‘‘হুমম... এই ব্যাপার! ম্যানড্রেক এসে যাদু করে আকবর বাদশাকে ভ্যানিশ করে দেবে ভেবেছিলে নাকি তুমি? কি সাহস তোমার! আমি এতবার বারণ করা সত্ত্বেও লাগিয়েছো জলছবি! কোনও কথা নয়। যাও ক্লাসের বাইরে।’’ কোনও সুযোগই পায়না নীরদা আত্মপক্ষ সমর্থনের। চোখ ফেটে জল আসতে চায়, সে সামলে নিয়ে ধীরে ধীরে চলে যায় ক্লাসের বাইরে। 

সেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ বিজনদি কিভাবে যেন বেশ বন্ধু হয়ে যান ক্লাসের সব মেয়েদের সঙ্গে হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষার পর থেকেই। এমনকি, পাঁচই সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবসে একটা গোটা পিরিয়ড সবার সঙ্গে গল্প করে, গান শুনে সময় কাটালেন। নীরদার গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে ভূয়সী প্রশংসা করলেন। কে বলবে এই মানুষটা কয়েকমাস আগে ওকে ক্লাস থেকে বার করে দিয়েছিলেন! ক্লাস থেকে বেরোবার আগে বললেন, ‘‘সবাই সবাইকে ভালবাসবে, বন্ধুদের মধ্যে সবার সঙ্গে সবার ভাব, কোনও আড়ি নেই, ক্লাসের মধ্যে ঝগড়া করবে না বাচ্চারা। মানুষের জীবন খুব ছোট। ঝগড়া করে সেই জীবনের অমূল্য সময় নষ্ট করবে না।’’ 

তারপর আর ক্লাস ফোরের বাচ্চারা কেউ বিজনদিকে দেখতে পায়নি। দুমাস ধরে ওঁর ক্লাসগুলো কিছু ফাঁকা যাচ্ছিলো, কিছু এসে পড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছিলেন মায়াদি। বিজনদি অসুস্থ-- এরকম একটা খবর পাওয়া যাচ্ছিলো। নভেম্বর মাসে অ্যানুয়াল পরীক্ষার ঠিক আগে একটা ঠাণ্ডা শিরশিরে সকালে এলো সেই দুঃসংবাদ। বাংলা টীচার বিনতাদি এসে ফোলা ফোলা চোখ আর দুঃখ দুঃখ মুখ নিয়ে তাদের ক্লাসে এসে দিয়েছিলেন খবরটা, ‘‘শোন বাচ্চারা, বিজন আর নাই। তোমরা তোমাদের প্রিয় দিদিকে আর কখনও দেখতে পাবে না। এখন ক্লাসে চুপ করে বসো। কিছুক্ষণের মধ্যে ছুটির ঘোষণা হবে। তোমরা নিঃশব্দে মুখে আঙুল দিয়ে নেমে যাবে নীচে। যাদের গার্জিয়ান আসেন নি, তারা মাঠে লাইন করে অপেক্ষা করবে।’’ আরও কি কি যেন বলেন বিনতাদি, সব বুঝে উঠতে পারে না নীরদা ঐ মুহূর্তে। সে টের পাচ্ছিল যে তার চারপাশে তার ক্লাসের বন্ধুরা অনেকেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সে কাঁদতে পারছিলো না। নীরদার চোখ জ্বালা করছিলো, কিন্তু একফোঁটা জলও বেরচ্ছিলো না চোখ দিয়ে। বিজনদির কাছে জলছবি নিয়ে বকাঝকা খেয়ে এত কষ্ট করে আটকেছিলো চোখের জল, অথচ ওইরকম একটা দুঃসংবাদ পেয়ে নীরদা একটুও কাঁদতে পারছিলোনা। শিশুবেলাতেই নীরদা প্রথম বুঝতে পেরেছিলো তার নামের অর্থ ‘মেঘ’ হলেও সে মেঘে যেকোনো সময় বৃষ্টি নামেনা। সেই প্রথম সে উপলব্ধি করেছিলো যে জল খুব সহজ কোনও জিনিস নয়। 



3 comments: