2

প্রবন্ধঃ অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

Posted in




প্রবন্ধ


বানান-অজ্ঞের বানান-ব্যঞ্জন
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী



এটা ঠিকই যে বানান নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখার বরাত ‘ঋতবাক’-এর সম্পাদক, সুস্মিতা বসু সিংজী আমাকে দিয়েছেন। এটাও ঠিক যে সিংজী যেমন নামভারী, তেমনই গ্রামভারী এক মহিলা, যিনি ছবিতে আমার পলিত কেশ এবং কদাকার আনন দেখে আমাকে জ্ঞানাকর এক প্রাবন্ধিক ঠাওরে বসে আছেন। আবার এটাও ঠিক যে আমার মতো তুলা রাশির ব্যক্তির পক্ষে সিংহ রাশির কোনও মহিলার বরাত উপেক্ষা করা দুঃসাহসের নামান্তর। তাই বলে সম্পূর্ণ ভাষাজ্ঞানহীন, ব্যাকরণভীত ব্যক্তি হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে কলম বাগিয়ে প্রবন্ধ লিখতে বসে যাবে!

এ-হেন বেআক্কেলে সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে একটা কৈফিয়ত দেওয়া প্রয়োজন। সেটা যুক্তিসিদ্ধ হোক বা না হোক, মাঠে নামার আগে খেলোয়াড়দের ওয়ার্ম-আপ করার মতো আমার কলমের গা-টি একটু ঘামিয়ে নেওয়া যাবে।

১৯৬৫ সালের কথা। মফস্বল শহরের এক নামী স্কুলে বছর দেড়েক আগে নিযুক্ত হওয়া সহ প্রধান শিক্ষক নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার বাংলার খাতা দেখছিলেন। একটি ছেলের খাতা দেখে তিনি হতবাক হয়ে গেলেন। ওই ক্লাসে তিনি বাংলা পড়ান না। ছেলেটিকে তেমন চেনা নেই। তবে নাম জানা, ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত ছেলেটির সঙ্গে গত বছর একবার সাক্ষাতও হয়েছিল। পণ্ডিতমশায়ের অনুপস্থিতির কারণে সেদিন অষ্টম শ্রেণির সংস্কৃত ক্লাস নিতে নিজেই গিয়েছিলেন। ছেলেটির সংস্কৃত-জ্ঞান পরখ করতে গিয়ে হতাশ ও ক্রুদ্ধ হয়ে সেদিন তার পিঠের ধুলো ঝেড়ে দিয়ে এসেছিলেন। এই তো ভালো ছেলের নমুনা! উপরন্তু, গ্রীষ্মের ছুটিতে হা-ডু-ডু খেলতে গিয়ে ঠ্যাং ভেঙে বিছানায় পড়ে থাকায় নবম শ্রেণির শেষ ছ’মাস স্কুলেই আসতে পারেনি। সেই ছেলেই এত ভালো পরীক্ষা দেয় কী করে! সব চেয়ে বড় কথা, একটা বানান ভুল নেই! তিনি জনে জনে সেই কথাটি বলে বেড়াতে লাগলেন।

একটিও বানান ভুল না করার রহস্যটি এই যে, ছেলেটি ছিল গল্পের বই-এর পোকা। সেই বয়সেই সে বঙ্কিম-শরৎ শেষ করে রবীন্দ্রনাথে ঢুকে পড়েছিল। বানানের নীতি-নিয়মের বিন্দুবিসর্গ না জেনেও নির্ভুল বানান লিখতে পারার কারণ প্রতিটি বাংলা শব্দের ছবি তার চোখের সামনে ভাসত। ভুল বা প্রচলিত বানানের ব্যতিক্রম দেখলেই তা চোখকে পীড়া দিত। বাংলা ভাষার বানান পরিবর্তনের নীতি-নিয়ম সে সময়েই অনেকাংশে প্রবর্তিত হলেও তার প্রচার ও প্রয়োগ তেমন ভাবে ঘটেনি। ফলে বানান নিয়ে সংশয়ের অবকাশও তৈরি হয়নি। আজ এই পরিণত বয়সে এসে একই শব্দের বহুরূপী বানান দেখতে দেখতে অহরহ সংশয়ে ভুগছি। আমার ধারণা, বাংলা ভাষার অধিকাংশ নিষ্ঠাবান পাঠক এবং কিয়দংশ লেখক ও সম্পাদকের আমারই মতো দুর্দশা। হ্রস্ব ই-কার দেব, না দীর্ঘ ঈ-কার দেব – এই ভাবতে ভাবতেই কলমের কালি শুকিয়ে যাওয়ার জোগাড়! যতদিন বানানবিধি নিয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলাম, ততদিন সমস্যা ছিল না। বিপদ হল, বাংলা লিপি, ভাষা ও বানান বিবর্তনের ইতিহাস পড়তে গিয়ে। জ্ঞানবৃক্ষের ফলটি খাওয়ার ফল এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। দশটি শব্দের মধ্যে অন্তত তিনটি শব্দের বানান নিয়ে দোলাচলে ভুগি। শব্দটির চোখে-ভাসা ছবিটির ওপর আর ভরসা রাখা যায় না। তখন তার জাত নির্ণয় করাটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। শব্দটি তৎসম-অর্ধতৎসম-তদ্ভব, না কি দেশি-বিদেশি-অনার্য বা অজ্ঞাতকুলশীল? আবার মূল শব্দটির ব্যুৎপত্তি জানলেই তো হবে না, শব্দটি উপসর্গ বা প্রত্যয়যুক্ত হলে সেগুলি সংস্কৃত, বাংলা না বিদেশি, কৃৎ না তদ্ধিত, মিশ্রশব্দ, সমাসবদ্ধ বা সন্ধিযুক্ত হলে তার জাত কী দাঁড়াল– ইত্যাদি ব্যাপারে আপনাকে পণ্ডিত হতে হবে। পণ্ডিত হয়েও কি সব শব্দের বানান সম্বন্ধে নিঃসংশয় হতে পারবেন? বোধ হয় না। কারণ, এসব ব্যাপারে পণ্ডিতদের মধ্যেও ঐকমতের অভাব আছে। আমার হাতের কাছে সব রীতির বানানবিধি নিয়ে লেখা পণ্ডিতদের বই এবং অভিধান আছে। সেগুলি থেকে টুকে টুকে পণ্ডিতি ফলাবার উদ্দেশ্যে আমার কলম বাগানো নয়; আমি সাহসে ভর করেছি আমার মতো সাধারণ পাঠক ও লেখকদের বানান-সমস্যার কিঞ্চিৎ সমাধানে কয়েকটি অতি ব্যবহার্য সাধারণ শব্দের বানান বিষয়ে আলোকপাত করতে। বানান নিয়ে যাঁদের সার্বিক ব্যুৎপত্তি লাভের আগ্রহ আছে, তাঁদের জন্যে এই প্রবন্ধের শেষে আমি কয়েকটি বই-এর নাম উল্লেখ করে দেব।

প্রবন্ধের মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বাংলায় বানান পরিবর্তনের ধারাটির দিকে সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিপাত করলে সুবিধে হয়। বাংলা লিপির বিবর্তনেরও একটি ইতিহাস আছে। সে প্রসঙ্গে ঢোকার কোন প্রয়োজন নেই। কেবল এটুকুই বলার যে, ঊনবিংশ শতাব্দের আগে বাংলা লিপির সাক্ষাৎ মেলে কেবলমাত্র হাতে লেখা বাংলা পুঁথিতে। মুদ্রণযন্ত্র না থাকার কারণে সে সময় বাংলা শব্দের কোন আদর্শ বানান গড়ে ওঠেনি। লিপিকারগণ নিজেদের জ্ঞানবুদ্ধিমতো শব্দের উচ্চারণানুগ বানান লিখতেন। তার একটি নমুনা পেশ করা যাক-

শ্রীচৈতন্য মোহাপ্রভু য়মরা শিখর।
জারো রশে উনমত হৈল শঙ্কর।।
গদাধর বেশে লক্ষ্মী জার পদ শেবে।
যনুক্ষ্যন ভাবিয়া না পায় কোন দেবে।।

(হৃদানন্দের ‘চৈতন্যচরিত’)

১৭৭৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারী নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণ ছাপার প্রয়োজনে প্রাচ্যবিদ্যায় পণ্ডিত চার্লস উইলকিন্স বাংলা লিপির সাট তৈরি করেন। পরবর্তী কালে উইলকিন্সের কর্মচারী পঞ্চানন কর্মকার এই সাট তৈরির কাজে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। পরে এদের সাহায্যে উইলিয়াম কেরি শ্রীরামপুরে টাইপ ঢালাই-এর কারখানা স্থাপন করেন। এইভাবেই বিদেশিদের চেষ্টায় বাংলা-মুদ্রণের যুগ শুরু হয়।

মুদ্রণের সঙ্গে সঙ্গে আরও দুটি লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটতে লাগল বাংলা ভাষার। প্রথমত, বাংলা গদ্যের সূচনা হল। দ্বিতীয়ত, এই ভাষা মধ্যযুগের বাংলা ভাষার থেকে অনেকখানি স্বতন্ত্র চরিত্রের এক উচ্চবর্গীয় ভাষা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল। বাংলা ভাষার এই নবরূপের কারিগর ছিলেন মূলত ইউরোপীয় মিশনারিরা এবং ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত এদেশের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতজন। তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক অবদান ছিল পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। কিঞ্চিৎ ইংরাজি এবং মূলত সংস্কৃত অনুসারী এই বাংলা ভাষা তখন থেকেই সংস্কৃত বানানবিধির নিগড়ে বাঁধা পড়ে গেল। তাতে একদিকে যেমন বাংলা শব্দের বানানে একটা সমতা এল, অন্যদিকে তেমনি সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা এবং লিখিত ভাষার মধ্যে এক দুস্তর ব্যবধান তৈরি হল।

ঊনবিংশ শতাব্দের শেষের দিকে ভাষাবিদরা একটু অন্যরকম চিন্তাভাবনা শুরু করলেন। ততদিনে বাংলা ভাষার খানিকটা বিবর্তন ঘটেছে। মিশনারি ও সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতজনের তৎসম শব্দ-প্রধান লিখনশৈলীর বদলে তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি শব্দ সমন্বিত নতুন গদ্যশৈলী তৈরি হচ্ছে। সে সব শব্দের উচ্চারণ সংস্কৃত থেকে একেবারেই আলাদা। তাহলে সংস্কৃত বানানবিধি মেনে চলার যৌক্তিকতা কী? তার চাইতে ভালো নয় কি বাংলা উচ্চারণের সঙ্গে সমতা রেখে বাংলা বানানে পরিবর্তন আনা? ১৮৭৮ সালে শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় এক প্রবন্ধে লিখলেন যে বাংলা উচ্চারণে দীর্ঘ স্বর নেই, ঞ নেই, ণ নেই, য নেই, ষ নেই, ম-ফলা, ব-ফলা, য-ফলা, বিসর্গ ইত্যাদি সংস্কৃতের মতো উচ্চারিত হয় না। তাহলে অ-তৎসম শব্দে এত দীর্ঘ ঈ-কার ঊ-কার, ন, য, ষ, বিসর্গ, ক্ষ লেখার কী প্রয়োজন?

এরপর ১৮৮৫ সাল থেকে বাংলায় উচ্চারণ-অনুসারী বানান প্রবর্তনের পক্ষে নানাভাবে নিজের মতামত প্রকাশ করতে লাগলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৬ সালে ‘বাংলা বানান’ প্রবন্ধে তিনি লিখলেন,-- ‘প্রাকৃত ও পালি, বানানের দ্বারা নির্ভয়ে নিজের শব্দেরই পরিচয় দিয়াছে, পূর্বপুরুষের শব্দতত্ত্বের নয়। পুরাতত্ত্বের বোঝা মিউজিয়ম বহন করিতে পারে, হাটে বাজারে তাহাকে যথাসাধ্য বর্জন করিতে হয়।’ এই প্রসঙ্গে তিনি বাংলা পুঁথির উচ্চারণানুগ বানানকে নির্ভীক বলে প্রশংসা করলেন। এরপর ১৯৩৫ সালে বানান সংস্কার নিয়ে লিখলেন, ‘অচিরে এমন সাহসিকের সমাগম হবে যাঁরা নিঃসংকোচে বানানকে দিয়ে সম্পূর্ণভাবেই উচ্চারণের সত্য রক্ষা করবেন।’

ফল মিলল অচিরেই। ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি বানান সমিতি নিয়োগ করলেন। তাঁরা বানানের কিছু নতুন নিয়ম সুপারিশ করলেন। কিন্তু সেসব নিয়মের প্রচার বা প্রয়োগ কোনটাই তেমনভাবে না হওয়ায় সাধারণ পাঠক, এমনকি লেখকদেরও বেশির ভাগ পুরনো বানানকেই আঁকড়ে থাকলেন। এই অবস্থার খানিক পরিবর্তন ঘটলো ষাটের দশক থেকে, যখন আনন্দবাজার সংস্থা তাঁদের পত্রপত্রিকায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানানরীতির বাইরেও কিছু কিছু শব্দের বানানে সরলতা আনতে সচেষ্ট হলেন। সেই অভিনব পরিবর্তনের ধাক্কায় পাঠকেরা নতুন বানানরীতি সম্বন্ধে সচেতন হতে শুরু করলেন। এইসব পত্রপত্রিকার প্রচার তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ার কারণেও শিক্ষিত জনসাধারণের একটি বড় অংশ নতুন বানানে অভ্যস্ত হতে লাগলেন। কিন্তু তাতে বিপত্তিও কম হল না। পুরনো এবং নতুন – একই শব্দের দু’রকম বানান সাধারণ পাঠকদের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করল। তাঁরা লিখতে গিয়ে সংশয়াকুল হতে লাগলেন। আমারই মতো অনেকেই ছাত্রজীবনে বানান-প্রত্যয়ী হয়েও পরিণত জীবনে এসে বানান-সংশয়ীতে পরিণত হলেন।

পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি রাজ্যের কয়েকজন ভাষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে একটি বানান সমিতি গঠন করলেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা, তর্কবিতর্ক ইত্যদি করে এবং সরকারি স্তরে বাংলাদেশের ভাষাবিদদেরও মতামত গ্রহণ করে একটি বানানবিধি তৈরি করলেন। সেই বিধি আকাদেমি একটি অভিধান মারফত প্রকাশ করলেন ১৯৯৭ সালে। এটিকে সরকারি বানানবিধি বলে ধরে নিতে হয়। যদিও আনন্দবাজারের বানানবিধি, সঙ্গত কারণেই, প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বেশির ভাগই মেনে চলেন। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে এই সব বিধি নিয়ে ভিন্নমতের কোনও অবকাশ নেই। এগুলি নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক বরং একটু বেশিই আছে। তবে সাধারণ পাঠক এবং লেখকদের সেই বিতর্কে না ঢোকাই ভালো। লেখকদের অবশ্য সমস্যা বিশেষ নেই। তাঁদের লেখায় প্রসাদগুণ যদি থাকে, বহুরূপী বানান তাকে ভক্ষণ করতে পারবে না। বিপদ হল পত্রিকার সম্পাদক আর প্রুফ রিডারদের। তাঁরা সকলেই তো আর ভাষাবিজ্ঞানে পণ্ডিত নন। প্রতিটি শব্দের ব্যুৎপত্তি, উপসর্গ-প্রত্যয় যোগে বা সমাসবদ্ধ-সন্ধিযুক্ত হয়ে তাদের রূপান্তরের ইতিহাসটি জানা সম্ভব নয় সকলের পক্ষে। সব শব্দের উচ্চারণও সর্বত্র এক হয় না। বাক্যের মধ্যে তার অবস্থান ভেদে উচ্চারণ পালটে যায়। কাজেই উচ্চারণানুগ বানান লিখেও যে পার পাবেন তা নয়। সমাধান একটিই। প্রথমে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি কোন বানানবিধি অনুসরণ করবেন। তারপর হাতের কাছে সেই বিধির একটি অভিধান নিয়ে বসবেন। তবে সেখানেও একটি সমস্যা থেকেই যায়। এমন কিছু শব্দ আছে যার দু’রকম বানান হয়(যেমন ‘কি’ এবং ‘কী’)। বাক্যের কোথায় কোন বানানটি হবে সেই নিয়মটি আপনাকে জানতেই হবে। এই ধরনের কিছু সাধারণ নিয়ম এবং যে সব শব্দ বা শব্দবন্ধ আমাদের খুব বেশি ব্যবহার করতে হয়, সেগুলির বানানবিধির উপর আলোকপাত সম্বন্ধীয় আলোচনা, অর্থাৎ যেটি এই প্রবন্ধের মূল বিষয় বলে চিহ্নিত করা আছে, তার মধ্যে এবার ঢুকে পড়া যাক।

বাংলা বানানে তিনটি প্রধান সমস্যা – হ্রস্ব-দীর্ঘ কার, ন-ণ এবং শ-ষ-স। এই তিনটি ব্যাপারে সব বিধিগুলিই মোটামুটি সহমত যে – (১) তৎসম শব্দের দীর্ঘ কার থাকবে এবং অতৎসম শব্দে সর্বত্রই হ্রস্ব কার হবে, (২) তৎসম শব্দে ণত্ব বিধির নিয়ম অনুসারে ণ থাকবে এবং অতৎসম শব্দে সর্বত্রই ন হবে, এবং (৩) তৎসম শব্দে ষত্ব বিধি অনুসারে ষ থাকবে, তদ্ভব শব্দে প্রচলন অনুসারে তিনটিই(শ, ষ ও স) বজায় থাকবে। অধিকাংশ বিদেশি শব্দে স হবে। কিছু কিছু ইংরাজি শব্দে উচ্চারণ অনুযায়ী এবং আরবি-ফারসি-তুর্কি শব্দে প্রচলন অনুসারে শ হবে।

পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদে যা লিখলাম তাতে যে সাধারণ লিখিয়েদের বিন্দুমাত্র সুবিধে হবে না তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু ওই নিয়মগুলি নির্দিষ্ট করে লিখতে গেলে এই প্রবন্ধের যে বপু হবে তার ভার বহন করার সাধ্যি সম্ভবত ‘ঋতবাক’-এর নেই। তাছাড়া, সেগুলি উল্লেখ করার পরেও শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করার জটিলতা থেকেই যায়। তাই এবারে আমি সাধারণ নিয়ম সরিয়ে রেখে সাধারণ লিখিয়েদের বোধগম্য কিছু অতি প্রয়োজনীয় শব্দ ও শব্দবন্ধের নির্দিষ্ট বানান প্রসঙ্গে এক এক করে আসি।

(১) কি বনাম কীঃ এই নামে পলাশ বরন পাল, যিনি পেশায় বিজ্ঞানী হলেও ভাষাবিজ্ঞানে সুপণ্ডিত, একটি সম্পূর্ণ প্রবন্ধই লিখেছেন। এছাড়াও তাঁর ‘হ্রস্ব-দীর্ঘ’ নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ ২০১০ সালে শারদীয় ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে তিনি আকাদেমি ও আনন্দবাজারের অতৎসম শব্দে দীর্ঘ কার বর্জনের বিস্তৃত সমালোচনা করেছেন। ‘কি’ ও ‘কী’ প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত, ‘কি’ অব্যয় এবং ‘কী’ সর্বনাম ও বিশেষণ। রবীন্দ্রনাথও নাকি সে হিসেবেই শব্দ দুটি ব্যবহার করতেন। তবে আমার মতো সাধারণ লিখিয়েদের পক্ষে যেহেতু অব্যয়-সর্বনাম-বিশেষণ চিহ্নিত করা দুঃসাধ্য, সুতরাং এ ব্যাপারে আকাদেমির ব্যাখ্যাটিই বোধ হয় সহজবোধ্য হবে। ব্যাখ্যাটি হল, যে-প্রশ্নের উত্তর কেবল ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ হবে সেখানে ‘কি’ লিখবেন। অন্যথায় সর্বত্রই ‘কী’ লিখবেন। উদাহরণ দিই:

অভিপ্রেত উত্তর যদি হয় ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ তাহলে লিখতে হবে – ‘তুমি কি গান শুনছো?’ আর যদি গানের ধরন, নাম ইত্যাদি জানার অভিপ্রায় থাকে তাহলে লিখতে হবে – ‘তুমি কী গান শুনছো?’

(২) ক্রিয়াপদে ও-কার: আকাদেমি বানান অভিধানে ডজনখানেক পৃষ্ঠাব্যাপী বিভিন্ন ক্রিয়াপদের কাল অনুযায়ী বানানের রূপভেদ দেওয়া আছে, প্রধানত ক্রিয়ার অন্তে কোথায় ও-কার দেবেন আর কোথায় দেবেন না - তা বোঝাতে। কিন্তু তার কোনও নির্দিষ্ট নীতি বের করতে ব্যর্থ হয়েছি বলে সেগুলি উল্লেখ করা সম্ভব হল না। এ প্রসঙ্গে যে কয়টি নির্দিষ্ট নীতি পাওয়া গেছে সেগুলি উল্লেখ করা যাকঃ

(ক) ক্রিয়াপদের অতীত ও ভবিষ্যৎ রূপে শেষ বর্ণে ও-কার বর্জনীয়। ‘বললো’-‘বলতো’-‘বলবো’ নয়, লিখতে হবে ‘বলল’-‘বলত’-‘বলব’।

(খ) ক্রিয়াপদের অনুজ্ঞা-রূপে ও-কার প্রয়োগ সংগত। যেমন-- ‘বোসো’, ‘এসো’, ‘পোড়ো’, ‘ভেবো’ ইত্যাদি।

(গ) সাধিত ধাতু থেকে নিষ্পন্ন ক্রিয়াবাচক বিশেষ্যের শেষে ‘–নো’ যুক্ত হবে। যেমন-- খাওয়ানো, দেখানো, থামানো, চালানো, লাগানো, ভাজানো ইত্যাদি।

(ঘ) দ্বি-দল ধাতুর দ্বিতীয় ব্যঞ্জনে ও-কার দিতে হবে। যেমন-- এগোবে, পিছোবে, ঘুমোল, ফুরোল ইত্যাদি।

(৩) তদ্ভব শব্দে ক্ষ-এর বদলে খ-এর ব্যবহার সংগত। যেমন-- খিদে, খুদ, খেত, খ্যাপা ইত্যাদি।

(৪) বিদেশি শব্দে ঋ-কার: বিদেশি শব্দে ঋ-কার না দিয়ে র-ফলা ই-কার দিন। যেমন খৃস্ট, বৃটিশ, বৃটেন নয়, লিখুন খ্রিস্ট, ব্রিটিশ, ব্রিটেন।

(৫) লিপ্যন্তরে বিদেশি শব্দ: এ ব্যাপারে ণ-বর্জন সঠিক হলেও হ্রস্ব কার এবং স কে প্রাধান্য দেওয়ার যে বিধি সেটি আমার খুব যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয় না। কারণ, লিপ্যন্তরে শব্দের বিদেশি উচ্চারণের যতটা সম্ভব কাছাকাছি থাকা বাঞ্ছনীয়। তার জন্যে দীর্ঘ কার এবং শ-এর ব্যবহার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

(৬) প্রত্যয় যোগে সমতা বিধান: স্ত্রীবাচক ঈ-প্রত্যয়, জীবিকা-ভাষা-জাতি-গোষ্ঠী ইত্যাদি বাচক ই-প্রত্যয়, মিশ্র ও বিদেশি বিশেষণ শব্দে ই-প্রত্যয় যোগে যে সব শব্দ গঠিত –- সব ক্ষেত্রেই ই-কার দেওয়ার বিধান। যেমন, কাকি-বাঘিনি-সাপিনি, ডাকাতি-নবাবি-হাকিমি, মারাঠি-আরবি- ফরাসি, ইরাকি-জাপানি- কাবুলি, কংগ্রেসি-অকালি, কয়েদি-খুনি-মজলিশি, ইত্যাদি। বানানে সমতা রক্ষার জন্যে নাকি এই বিধান। কিন্তু বিদেশি বা অতৎসম শব্দে সংস্কৃত ঈয়-প্রত্যয় যুক্ত হলে সমতার কথা ভুলে আপনাকে ঈ-কার লাগাতে হবে। যেমন -- ইউরোপীয়, এশীয়, আর্টেজীয় ইত্যাদি।

(৭) কি না এবং কিনা: কি এবং না কোথায় বিচ্ছিন্ন থাকবে আর কোথায় সংযুক্ত তা বোঝাতে উদাহরণই প্রকৃষ্ট পন্থা। ‘তুমি যাবে কি না?’ ‘ভাবছি যাওয়া উচিত হবে কিনা।’ বিচ্ছিন্নতায় জিজ্ঞাসা চিহ্ন, সংযুক্তিতে দাঁড়ি।

(৮) না-নি-নেঃ ‘না’ ক্রিয়াপদের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন থাকবে। কিন্তু ‘নি’ এবং ‘নে’ ক্রিয়াপদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। উদাহরণ – আর কখনও প্রবন্ধ লিখব না। এমন ঝামেলার কাজ আগে করিনি। এখন লিখলাম বলে ভেবোনে যেন এটা সহজ কাজ। তবে ‘না’ যখন নিষেধাত্মক না হয়ে অনুরোধাত্মক, তখন তা ক্রিয়াপদের সঙ্গে জুড়ে বা হাইফেন দিয়ে লিখবেন। যেমন – দেখোনা/দেখো-না কী করে।

(৯) হাইফেন: দুয়ের বেশি শব্দের দ্বন্দ্বসমাসের ক্ষেত্রে হাইফেন দেওয়া যুক্তিযুক্ত। যেমন – তেল-নুন-লকড়ি, বাপ-মা-ভাই-বোন ইত্যাদি। তবে সমার্থক বা সমগোত্রের দুটি শব্দের সমাস হলে হাইফেন নয়। যেমন -- ঘরবাড়ি, ভেবেচিন্তে, রাজাবাদশা ইত্যাদি। আবার এ ক্ষেত্রে পরবর্তী শব্দটির গোড়ায় স্বরবর্ণ থাকলে হাইফেন দিন। যেমন -- আশা-আকাঙ্ক্ষা, বিষয়-আশয়, ভাদ্র-আশ্বিন ইত্যাদি। 

উপরোক্ত ন-দফা নিয়ম বহু নিয়মের ভিড় থেকে উদ্ধার এবং সাধ্যমতো সরল করে সাজিয়ে দিলাম। পাঠকের কতটুকু কাজে লাগবে সে ব্যাপারে সংশয় থেকেই গেল। আর মাত্র কয়েকটি শব্দের বিতর্কমূলক বানান নিয়ে আলোচনা করেই প্রবন্ধের ইতি টানতে চাই। ধরুন ‘ভারী’ শব্দটির কথা। সংসদ বানান অভিধানের মতে ‘ভারযুক্ত’ অর্থে ‘ভারী’ লিখতে হবে, যেমন, ‘ভারী বস্তা’। আর ‘খুব’ অর্থে ‘ভারি’ লিখতে হবে, যেমন, ‘ভারি তেজ হয়েছে’। আনন্দবাজার এবং আকাদেমির বিধান কিন্তু সব অর্থেই ‘ভারী’ লেখার। আমি বলি কি, কাজ কি ওসব বিতর্কে গিয়ে? তার চেয়ে বরং ‘হেভি’ বা ‘হেভ্‌ভি’ লিখুন। যেমন, ‘হেভ্‌ভি সুন্দর’। ইংরেজরা তাঁদের শব্দটির এমন অসাধারণ বাংলা-ব্যবহার দেখে যৎপরোনাস্তি গর্ব অনুভব করবেনই করবেন। তবে কিনা কারুর কানভারী করতে চাইলে হেভিত্যাগ করা ছাড়া উপায় নেই।

‘নীচ’ লিখবেন, না কি ‘নিচ’ লিখবেন। সংস্কৃতে ‘নীচ’ শব্দটির অর্থ ‘হীন’ বলে জানা ছিল রবীন্দ্রনাথের। তাই তিনি ‘নিম্ন’ অর্থে ‘নিচ’-কে আলাদা একটি অসংস্কৃত শব্দ ধরে নিয়ে ই-কার দিয়ে লিখেছেন, -- ‘তুমি তাই এসেছ নিচে – ’ । কিন্তু মণীন্দ্রকুমার ঘোষ পরে দেখিয়ে দেন যে ‘হীন’ ও ‘নিম্ন’ – এই দুই অর্থেই সংস্কৃত ‘নীচ’ শব্দটির ব্যবহার আছে। সুতরাং এটি নিছকই তৎসম শব্দ বিধায়ে সব অর্থেই ঈ-কার দিয়ে লেখার বিধান বলবৎ হল। মণীন্দ্রের এই ‘নীচতায়’ যদি কেউ আঘাত পেয়ে থাকেন, তার সান্ত্বনা এই যে তিনি তদ্ভব বিধায়ে ‘নিচু’-কে ই-কার যোগেই লেখার বিধান দিয়েছেন।

ধনুকের ‘তির’-এ ঈ-কার বর্জন করে নদীর ‘তীর’-এ ওঠার বিধানটি সর্বসম্মত হলেও পলাশ বরন পাল মশায়ের এটি ‘অদ্ভুত’ বলে মনে হয়েছে। ‘নিশানা’ অর্থে ‘লক্ষ’ লেখার পক্ষপাতী আনন্দবাজার। আকাদেমি সেখানে ‘লক্ষ্য’ বানানটিকেই শিরোধার্য করেছেন। এই মূর্খের পক্ষপাত আকাদেমির দিকে, নইলে লক্ষপতি হতে গিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। ‘রেফ’-এর সঙ্গে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব বর্জনের ব্যাপারে সবাই সহমত(মূর্ত্তি>মূর্তি, বর্জ্জন>বর্জন, কার্য্য>কার্য ইত্যাদি)। কিন্তু আকাদেমি একই বর্ণের দ্বিত্বের ক্ষেত্রে বর্জনশীল হলেও ভিন্ন বর্ণের দ্বিত্বের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল। যেমন, অর্ঘ্য, মর্ত্য, হার্দ্য ইত্যাদিতে আনন্দবাজার য-ফলা বর্জন করলেও আকাদেমি তা রেখে দেওয়ার বিধান দিয়েছেন। শেষ বর্ণে যুক্তাক্ষর থাকা বিশেষণের সঙ্গে য-প্রত্যয় যোগে বিশেষ্য হওয়া শব্দের বানানে আকাদেমি ও আনন্দবাজারের বিধিভেদ প্রকটতর। যেমন – বৈশিষ্ট্য(<বিশিষ্ট), স্বাচ্ছন্দ্য(<স্বচ্ছন্দ), স্বাতন্ত্র্য(<স্বতন্ত্র), দারিদ্র্য(<দরিদ্র) ইত্যাদি। এই সব শব্দে আকাদেমি য-ফলা রাখলেও আনন্দবাজার য-ফলা বর্জন করেছেন। আপনি সহজ বানানের লক্ষ্যে আনন্দবাজারের মতো ‘ব্যাকরণ মানি না’ বলবেন, নাকি ব্যাকরণ মেনে সুবোধ বালক হবেন, তা আপনাকেই ঠিক করতে হবে।

তাহলে মোদ্দা কথা এই দাঁড়াল যে প্রবন্ধটি পড়ে আপনার মাথাটি আরও গুলিয়ে গেল। বানানকে সরল, বাংলা উচ্চারণের উপযোগী করে তুলতে গিয়ে যে সব নিয়মের প্রবর্তন করলেন ভাষাবিজ্ঞানীরা তাতে ঐকমতের অভাব এতটাই বিস্তৃত যে লেখার মাঠে এখন বানানের মাৎস্যন্যায় চলছে। সেটিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে চাইলে নীচের বইগুলি পড়ে নিন। তবে তার আগে ঋতবাকের সম্পাদকের কাছে একটি প্রস্তাব রাখি। বানান-অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের জন্য তিনি একটি আন্তর্জালিক তাকিয়া(অনলাইন ডেস্ক) রাখুন। সেখানে পাঠকদের প্রশ্নের নিয়মিত উত্তর যোগাবেন সম্পাদক-নিযুক্ত বানান-বিশেষজ্ঞগণ। তাতে কাজিয়া জমে ওঠার মহৎ সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতেও নীচের বইগুলি যথেষ্ট সাহায্য করবে।

১) বাংলা বানান সংস্কারঃ সমস্যা ও সম্ভাবনা –-পবিত্র সরকার(দে’জ)।

২) বাংলা বানান-- মণীন্দ্রকুমার ঘোষ(দে’জ)।

৩) বাংলা কী লিখবেন কেন লিখবেন(আনন্দ)।

৪) সংসদ বানান অভিধান –- অশোক মুখোপাধ্যায়(সাহিত্য সংসদ)।

৫) আকাদেমি বানান অভিধান(পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি)।

তথ্যসূত্রঃ (১) পুরানো শাস্ত্র ও সাহিত্য অনুশীলনে পাণ্ডুলিপি চর্চার ভূমিকা প্রসঙ্গে – করুণাসিন্ধু দাস’ (‘অনুষ্টুপ’, বিশেষ বাংলা পুঁথি সংখ্যা-১৪২২)।

(২) রাজন্য-শাসিত কোচবিহারের পুথি-সাধনা – ত্রিপুরা বসু(ঐ)।

(৩) বিভিন্ন পাণ্ডুলিপির পুনঃপাঠের প্রয়োজনীয়তা ও কিছু প্রাসঙ্গিক কথা – নীরদবরণ মণ্ডল(ঐ)।

(৪) হ্রস্ব-দীর্ঘ – পলাশ বরন পাল (‘অনুষ্টুপ’, শারদীয়-১৪১৭)।

(৫) প্রবন্ধের শেষে দেওয়া ৩), ৪) ও ৫) নং তালিকাভুক্ত গ্রন্থসমূহ।

2 comments:

  1. উপকৃত হলাম, অজস্র ধন্যবাদ

    ReplyDelete
  2. অনেক সমৃদ্ধ হলাম। অসংখ্য ধন্যবাদ।

    ReplyDelete