3

প্রবন্ধঃ আইভি চট্টোপাধ্যায়

Posted in



প্রবন্ধ




প্রসঙ্গ : ১০০বছরের শ্রেষ্ঠ নিগ্রো কবিতা
(অনুবাদ – শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মুকুল গুহ )
আইভি চট্টোপাধ্যায় 


সাম্প্রতিক কবিতার জগতে আমার প্রবেশাধিকার স্বচ্ছন্দ নয়। বস্তুত দু’চারজন বিশিষ্ট চিন্তাশীল জীবন-অনুভবী সত্যদ্রষ্টা কবি মনীষী ছাড়া কারো কবিতায় আমার মনের জগতে নাড়া পড়ে না। আবার এই অজ্ঞতা আর না-বোঝা থেকেই মনে মনে একটা টানও টের পাই। কবিতা আমায় টানে। অপ্রতিরোধ্য সে টান। কবিতার প্রতীকীবাদ, ছায়াবাদ, প্রগতিবাদ, বস্তুবাদ, সমাজবাদ, বিপ্লববাদ, দেহধর্মবাদ, সহজিয়াবাদ, মরমিয়াবাদ ইত্যাদি নানা প্রকট বা অপ্রকট মতবাদের চাপে অনেক সময়ই যেমন সহজ ছন্দোময় সুললিত সুভাষিত সুবোধ্য রসটি নিতে পারি না, তেমনই অনেক সময় কোনও পঠনের পর ভিন্ন রুচির কবিমানুষের প্রজ্ঞামনের আর আনন্দ-অনুভূতির সুরটি অতীন্দ্রিয় জগতের আভাস এনে দেয়। কখনও অকারণেই অনামী এক কবির একটি কবিতা আকর্ষণ করে। কোনও কবিতার একটি লাইন ঝলমল করে উঠেছে, কখনও বা কোনও কবিতা শব্দঝঙ্কারে কানকে তৃপ্তি দিয়েছে, আপাত-সাধারণ কোনও একটি পংক্তি সমুদ্রের ঢেউ হয়ে এসে মন জুড়ে থেকেছে। কবিতা বুঝি বা না বুঝি, এটুকু বুঝি যে এ এক মায়া মায়া জগত। কবিতার জগত এক অন্য জগত। এই ভাবনা থেকেই আমার কবিতাপাঠে আগ্রহ বাড়ে।

সদ্যপঠিত কোনও কবিতার বই সম্বন্ধে লিখতে বেশ দোলাচলে পড়লাম। কবিতাচর্চার জন্য যতখানি জ্ঞানের দরকার, তা আমার নেই। সাহিত্যচর্চার আনন্দে যেটুকু কবিতাপাঠ, আমার পুঁজি সেটুকুই। সেই সম্বল নিয়ে কোনও পত্রিকার কবিতা-সংখ্যায় অন্তরঙ্গভাবে যোগ দেবার ক্ষমতা বা অধিকার আমার আছে বলে মনে করি না আমি। এমন সময় আমার হাতে এল এই কবিতার বইটি। “১০০ বছরের শ্রেষ্ঠ নিগ্রো কবিতা : অনুবাদ শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মুকুল গুহ”।

প্রথম নজরে বইটির প্রচ্ছদ বেশ আকর্ষণ করলো। কালো রঙের পশ্চাতপটে সাদা ডানা ঝাপটানো পাখির বিমূর্ত আবছায়া। ‘নিগ্রো’ আর ‘কালো’ শব্দ দুটি প্রায় সমার্থক বলেই বোধহয় প্রচ্ছদ শিল্পীর এই তুলির টান। কবিতাগুলো কিন্তু ‘কালো’কে ছাপিয়ে উঠে আলোর ছবি আঁকে।

‘নিগ্রো’ শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে দাসত্ব, অপমান আর কান্না। বিদ্রোহ আর সংগ্রামের অনুভূতি। অনুবাদক কবিযুগল পরম মমতায় সেই অনুভূতি ধারণ করেছেন প্রতিটি কবিতায়। কবিতার সঙ্গে উপরি পাওনা নিগ্রো কবিতার ইতিহাস এবং নিগ্রো কবিদের পরিচিতি। তথ্যের কারণেও এ বইটি স্বচ্ছন্দে একটি লাইব্রেরির সংগ্রহ তালিকায় জায়গা করে নিতে পারে। 

কোনও একজন কবির রচনাশৈলী, নির্মাণভাষা, বৈচিত্র্য, শব্দের কারুকাজ নিয়ে আলোচনা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। কবিতার অনুবাদ হয়েছে যে দুজন কবির হাত দিয়ে, তাঁরাও সে নিয়ে মাথা ঘামান নি। কবিতাগুলো নির্বাচন করেছেন অনুবাদক কবিরাই। তাঁদের বিবেচনাই এ সঙ্কলনের মূলসূত্র। আমার মনে হয়েছে, একটি সময় বা কালকে ধরে রাখা যেমন এ সংগ্রহের উদ্দেশ্য তেমনই ভাষা ও ব্যঞ্জনায় বৈচিত্র্যও মাথায় রাখা হয়েছে। তবু অনেক নিগ্রো কবির কবিতা এ সঙ্কলনে স্থান পায় নি, সে নিয়ে আমাদের আগ্রহ থেকেই যায়। 

এই সংগ্রহের কবিতাগুলো লেখা হয়েছে ১৮৬৮ থেকে ১৯৬৮ সালে। ১০০ বছরের কবিতা। বইটির ভূমিকা পড়ে জানতে পারি, প্রথম আমেরিকান নিগ্রো যিনি কবিতা লিখেছিলেন, তিনি একজন মহিলা, নাম লুসী টেরী। তিনি একজন ক্রীতদাসী ছিলেন। তারপর যাঁদের নাম পাওয়া যায়, তাঁরা জুপিটার হ্যামন, ফিলিস সুইটল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে অনেক নিগ্রো কবির প্রকাশ। ক্লড ম্যাকে, জেন টুমার, ল্যাংসটন হিউজেস এমন অনেক কবি। “বস্তুত সমস্ত নিগ্রো সাহিত্যের কবিতার ইতিহাসই জ্বলন্ত জীবনের স্পষ্ট ইতিহাস। ভাল লাগা, ভালবাসা, সংগ্রামের গতিশীল ইতিহাস, যে ইতিহাস মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে প্রতিনিয়ত।’’

“সূর্য এসেছিলো মিস ব্রুকস, রাত্রির অন্ধকার 
পার হয়ে মুখের হাপরে আগুনের হল্কা ছুটিয়ে,
আর আমরা সরে পড়েছিলাম, সব নির্মাণ নষ্ট হয়ে গেল
কঠিন হাতুড়ি সংকেতের জন্য তৈরি নয় আমাদের
চোখ, কান, হৃদয়ের, অন্তঃকরণের –
এখন সূর্য রক্তের লাল বমন করতে করতে ঐ পাহাড়
পেরিয়ে চোখের জল লুকোচ্ছে ..
…আজ যে অন্ধকার ঠিক আগের মত নয়-

সূর্য এসেছিলো ঠিক তার কথা রেখেছিলো মিস ব্রুকস..” (“সূর্য এসেছিলো”- এথ্রিজ নাইট, ১৯৩৩)

ইতিহাস বলে, ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে স্পেনের মানুষরা আমেরিকায় প্রথম আফ্রিকান নিগ্রো মানুষদের ক্রীতদাস হিসেবে এনেছিলো। ১৬১৯ সালে ভার্জিনিয়ার জেমসটাউনে প্রথম আফ্রিকান নিগ্রো ক্রীতদাস হিসেবে এসেছিলো বলে জানা যায়। যদিও ভার্জিনিয়ার আইনে নিগ্রোদের ক্রীতদাস হিসেবে উল্লেখ করা হয় ১৬৬২ সালে। এমনও বলা হয়, একবার ক্রীতদাস হলে ক্রীতদাস হিসেবে আজীবন থাকাই নিয়ম। এর মধ্যে ১৬৩০ সাল থেকে ইংল্যান্ডে নিগ্রো ক্রীতদাস আনার জোয়ার আসে। সেই সঙ্গে আমেরিকার বহু জায়গায় তামাক, নীল, আখ, তুলো, ধান ইত্যাদি চাষের কাজে ক্রীতদাসের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। ১৯৭১ সালে আমেরিকায় ক্রীতদাসের অবস্থান পরিষ্কার করে একটি নতুন আইন হয়, যাতে বলা হয় যে আজীবন ক্রীতদাস থাকার নিয়ম খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করলেও একই থাকবে। মানবিক আইনের কথার বিপক্ষে দাঁড়ালো বাইবেলের বাণীও। সবাই একযোগে বিধান দিলেন, ‘দাসত্ব ঈশ্বরের ইচ্ছা। জীসাস কখনও দাসত্বকে আক্রমণ করেন নি। সেন্ট পলও নয়।’ কবিতা পড়ার আগেই কবিতার বইয়ের ভূমিকায় এই কথাগুলো পড়ে পাঠকের চোখে জল আসবে। খুব জানতে ইচ্ছে করবে, কেমন সে কবিতা। এমন দমবন্ধ পরিস্থিতিতে বাস করেও কবিতা লিখতে পারার ক্ষমতা যাঁদের, তাঁরা কেমন আলোর মানুষ। 

“পন্ডিতরা আমাকে বলেছিলো
ক্রীস্টমাস একটা ছেলেখেলা
হয়ত ওদের কথায় সত্যি ছিলো –
দু’হাজার বছর আগে
তিনজন প্রাচ্যদেশীয় পন্ডিতব্যক্তি
একটি তারাকে অনুসরণ ক’রে ক’রে
একটা গোটা মহাদেশ পার হ’য়ে 
আস্তাবলে সদ্য জন্মানো একটি শিশুর 
মধ্যে সুন্দরতা, সরলতা দেখতে পেয়েছিলেন,
এখন যখন বোমা পড়ে,
ভাঙচুর হয়,
সারা পৃথিবী জুড়ে
আজ,
সত্যিকারের পন্ডিতব্যক্তিরা 
কিন্তু জানেন যে,
আমাদের যা করণীয় তা হচ্ছে 
তারাদের অনুসরণ করা আর একবার অন্তত আশার জন্যেও
ওই দু’হাজার বছর আগে
জন্মানো ছেলেখেলার
কিছুটা পাওয়ার জন্য,
যা প্রয়োজন –’’ (“ছেলেখেলা”– ফ্রাংক হর্ন, ১৮৯৯) 

বুকের মধ্যে আবেগ, অকারণে কান্না পায় আমার। কিংবা আওরেন ডডসনের লেখা কবিতা ‘মেরী আজ মারা গেছে’; জিশুর মৃত্যু, জুডাসের বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস, এক অপরূপ চিঠি-কবিতা। মার্থাকে লিখছে জোসেফ। দিনপঞ্জীর মতো। অনেক বড় কবিতা, তাই এখানে উদ্ধৃত করা গেল না। ধর্মের গুঢ় তত্ত্বটি হৃদয়ে গ্রহণ করতে না পারলে এমন কবিতা লেখা যায় না। পড়তে গিয়ে পাঠক আমি সচেতন হয়ে উঠি। 

আবার এই কবিতাটা;

“এইমাত্র একটি অদ্ভূত জিনিস দেখতে পেলাম,
সোনালি সোনালি আকাশের পটভূমিতে,
অন্ধকারাচ্ছন্ন সাইপ্রাস বনের উপর দিয়ে
জীবন্ত
সুন্দর
রোগা দীর্ঘ একটা কালো আঙুল
ঊর্দ্ধে দিকনির্দেশ করে রয়েছে –
কেন হে সুন্দর স্থির আঙুল তোমার
রঙ কালো,
কেন ঊর্দ্ধে দিকনির্দেশ করে আছো অচঞ্চল –’’ (“কালো তর্জনী”- ওয়েল্ড গ্রিমকে, ১৮৮০)

এমন বিদ্রোহের সুর, কান্নার গান বেশ কিছু কবিতায়। তবু বুঝি, কোনও প্রাকনির্দিষ্ট মতবাদের জমাট দানা বেঁধে নেই কবির মনে। এ কবিতা পড়ার পর জীবনের সমস্যার ঘোলাজলের আবর্তে শালিখপাখির মত স্নান করার অনুভূতি জাগে না, বরং আসন্ন নদীর জলে বিকেলের সাদা রোদ্দুরের ছবি জেগে ওঠে। 

আমি বিশ্বাস করি, কবিকে হতে হবে অগণিত মানুষের সংগ্রামী জীবনের শরিক। সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার অংশীদার। কবি যখন নিঃসঙ্গতায় আত্মস্থ, তখনও তাঁর মনে বহির্জগতের ছায়া জেগে থাকে। প্রয়োজন ও আবেগ অনুযায়ী কবিতায় তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সেই শিল্পচেতনা, সেই কবিমন সমাজকে প্রেরণা দেয়। 

আর একটি কবিতা...

“স্বাধীনতা কোনদিনই আসবে না
আজ নয়
কোনদিনই নয়
ভয় অথবা সমঝাওতার মধ্যে –
আমারও তো অন্য সকলের মতন 
অধিকার রয়েছে
দুপায়ের উপরে দাঁড়িয়ে থাকার,
দুকাঠা জমির মালিকানার-
শুনে শুনে কান পচে গেল, 
‘সময়ে সবই হবে 
কাল একটা নূতন
দিন’-
মৃত্যুর পরে তো আমার কোন 
স্বাধীনতার প্রয়োজন হবে না,
আগামীকালের রুটি দিয়ে কি আজ বাঁচা যায়-
স্বাধীনতা একটা শক্তিশালী
বীজপ্রবাহ,
প্রোথিত,
একটা বড় প্রয়োজনের জন্যে
আমিও এখানে বাস করি,
তাই
স্বাধীনতা আমার প্রয়োজন-
তোমার যেমন” (“স্বাধীনতা”– ল্যাংনসটন হিউজেস, ১৯০২)

অনুভব করি, ব্যক্তিহৃদয় জীবনের বৃহত্তর পরিধি স্পর্শ করার জন্যে আকুল। এ কবিতা চিত্তকে উন্মুখ করে বৃহতের দিকে, নিমেষে বর্তমান যুক্ত হয় বিগত ও আগামীর সঙ্গে। 

ইতিহাসে পড়েছি, স্বদেশী আন্দোলনের সময় অনেক গ্রাম্য কবির কবিতা, তেমন খ্যাতনামা নন কেউ, সাগ্রহে শুনতো মানুষ। সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনে রাজনৈতিক কর্মীর ভূমিকার মতনই কবির ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জেনেছি, যুদ্ধক্ষেত্রে বসেও মুক্তিযোদ্ধারা কবিতা লিখেছেন। ভিয়েতনামের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উঠে আসা অনেক কবিতা সে সময়ের দলিল। এ দেশেও বাঙালি কবিরা লিখেছেন তেভাগা আন্দোলানের পটভুমিতে, দেশভাগের সময়, ইতিহাসের সব সন্ধিক্ষণে।

কবির কাছে তাই মানুষের অনেক আশা। কবি যদি সে কাজে সৎ না থেকে কারো মুখপাত্র হয়ে থাকেন, তাতে সমাজের ক্ষতি। কবির প্রতিবাদ মূল্য হারায়। এ কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে এ কথা নতুন করে বুঝি। শুধুই শব্দমালায় প্রতিবাদ, কারো মুখপাত্র হবার দায় নেই, তবু বুকের মধ্যে নাড়া পড়ে। 

“যখন মৃত্যু 
হবে আমার, আমি জানি
বড়সড় একটা শোকসভার আয়োজন হবে নিশ্চয়ই,
কৌতূহলী
লোকজনেরা চারদিকে
ভিড় করে আসবে দেখতে
আমি সত্যি সত্যিই মারা গেছি
নাকি
আর একটা 
গণ্ডগোল পাকাবার
চেষ্টা করছি মাত্র-’’ (“বিদ্রোহী”- মেরী ইভানস, ১৯২১)

বলা বাহুল্য, কবি-মানসিকতার এই ভিন্নতার জন্যেই এই কবিরা সাধারণের মধ্যে থেকে বিশিষ্ট হয়ে উঠতে পেরেছেন। আমার মনে হয়েছে, এ কবিতাগুলোকে পড়তে হলে সেই সময়টা বোঝা দরকার। কারণ, কবিতা সময়ের সৃষ্টি। কবির কাজ পরিশুদ্ধ সমাজের স্বপ্ন দেখানো। অন্ধকারকে অতিক্রম করে সাহিত্যকে প্রবাহিত মনুষ্যত্বের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

সার্থক কবি মাত্রেই সত্যদ্রষ্টা এবং মানবকল্যাণের আলোকশিখায় উজ্জ্বল। একই সঙ্গে কোমল ও শক্তিশালী। তাই তাঁরা অন্তরতমের সাধনা করতে পারেন। বাল্মিকী, বেদব্যাস, হোমার, দান্তে থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, শেলি, কীটস, মিল্টন, এলিয়ট, হুইটম্যান, সমস্ত কবির মিল এক জায়গায়। তাঁরা মানবমুখী। তাঁরা শিল্পসৃষ্টির কাজটি সততার সঙ্গে করেন। 

এই কবিতাগুলো পড়ার সময় পাঠক সেই সততা চিনতে পারেন। রাজনৈতিক এবং সামাজিক নির্যাতন সহ্য করেও যে তাঁরা কবিতায় দিগন্ত স্পর্শ করেছেন। আজকের কবিতায় যেমন দেখি, বর্তমান মানেই অন্ধকার, সন্ত্রাস, রক্তাক্ত .. ভবিষ্যত নৈরাশ্যব্যঞ্জক। বাঁচার জন্যে যে পরিমাণ উল্লাস, প্রাণ, আলো নিয়ে লেখা দরকার, তেমন বলিষ্ঠপ্রাণ কবি কই?

আধুনিক কবিদের মধ্যে কতজন অমরত্ব পাবেন জানা নেই। কিন্তু বিপুলা এই পৃথিবীর নিরবধি এই কালের প্রেক্ষিতে বেঁচে থাকবেন তাঁরাই, যাঁদের চিন্তাধারা নির্যাসিত। 

যেমন এই কবিতাটি - “একটি নিগ্রো সৈনিকের ভিয়েতনামের ডায়েরি” 

“…আসলে এখানকার বুলেটগুলো আমাদের দেশের বুলেটগুলির 
মতনই হত্যা করতে পারে,
ভয় আসলে যা কিছু অপছন্দ করে সব নষ্ট করে দিতে চায়, 
আর কোনওদিন হত্যা না করার কথা ভেবেছি সারাক্ষণ-
যখন দেশে ফিরব, যদি ফিরি, আমাকে অভিনন্দন জানিও না,
পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণ্য প্রাণীদের কাছাকাছি ঘুরঘুর করছি আমি
প্রার্থনা করি খুব সাবধানে,
.. তুমি কি ইদানিং প্রার্থনা করেছ, সেজন্যে” (হারবার্ট মার্টিন, ১৯৩৩)

এক অনির্বচনীয় চিত্রকল্প। মেধা বা বুদ্ধি দিয়ে নয়, শুধুই অনুভবে এ কবিতা পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারে। আমার এইরকম মনে হয়েছে। এ কবিতাগুলোয় হয়ত সেরিব্রাল শব্দ ব্যবহার হয় নি। অনিবার্য অপ্রকাশিতব্য স্বপ্নের ভাষায় লেখা কবিতা। যেন প্রকাশ না করে কবির উপায় ছিলো না।

কেমন মনে হয় আমার, কবিতায় কোনও শেষ কথা হয় না। মানুষের স্বপ্নের নাম কবিতা। মানুষই কবিতা লিখতে পারে, কারণ মানুষ স্বপ্ন দেখতে জানে। এ কবিতাগুলো সেই স্বপ্নের কথা বলে। আবেগের কথা বলে। পাঠকের মধ্যেও জন্ম নেয় অবশ্যম্ভাবী এক আবেগ। কবির নিজের সত্য, নিজের অন্তরদর্শন পাঠকের সত্য হয়ে ওঠে। 

এখানেই এই বইটি সার্থক।

আজকের বিপণনের দুনিয়ায় যখন বিনোদনই কবিতা সৃষ্টির একমাত্র এবং মূল কথা, যখন দেখি নেহাত ছন্দের ব্যবহার আর অন্ত্যমিলের কারসাজিতে হালকা বিনোদন-কবিতা প্রচারমাধ্যমের হাত ধরে আপামর বাঙালির মননসঙ্গী, যখন বিশেষ বিশেষ সময়ের আবেগকে পণ্য করে কবিতা লেখা চলছে, তখন এই কবিতাগুলো উদাহরণ হয়ে ওঠে। আজকের সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠিত ও প্রচারিত কবিদের কবিতায় রক্ত আর অন্ধকারের উপাসনা পড়ে ক্লান্ত পাঠক-আমি যখন এ কবিতাগুলো পড়ি, অনুভব করি সমকালের অন্ধকারের কবিতাও কোন জাদুকলমের পরশে আলোর কবিতা হয়ে উঠতে পারে। আত্মার শুদ্ধিকরণ লক্ষ্য না হলে এমন কবিতা লেখা যায় না। 

“মুখোশের মানুষজন অনর্গল মিথ্যে কথা বলে। হাসে, 
মুখোশের আড়ালে
দৃষ্টি আসল মুখচ্ছবি লুকোন থাকে,
ওই চতুরতার জন্য ঋণ পরিশোধ করতে হয়
আমাদের, রক্তাক্ত এবং ক্ষতবিক্ষত হৃদয় নিয়েও 
আমরা হাসি, মিথ্যে ইমারত বানিয়ে চলি –
..

হে ঈশ্বর, নির্যাতিত আত্মাসম্ভুত আমরা গান গাই
পায়ের নিচে মাটি জলে নরম, কাদায় হে ঈশ্বর
এগোন যায় না। আমাদের দূরত্ব ক্রমশ বেড়েই যায়..’’ (“মুখোশের মানুষ”– পল লরেন্স ডানবার, ১৮৭১)

১৮৭১ সালের কবিতা আজও সমকালীন প্রাসঙ্গিক হয়ে বুকের মধ্যে নাড়া দেয়। কিংবা কার্ল গার্ডনারের কবিতা “প্রতিবিম্ব”(১৯৩১).. 

“আমি নিজেকে চলে যেতে দেখেছিলাম,
দ্রুত ছুটে যাই,
পিছোতে হয় তাই, দেখার প্রয়োজনে
নিজের আয়নায়….”

আমিও পিছিয়ে আসি, একটু দাঁড়াই, নিজেকে দেখি। জীবন অন্বেষণের মন্ত্র যে। 

কবির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, যন্ত্রণা এক অনির্বচনীয় চেতনার স্তরে উত্তীর্ণ। এ কবিতায় জীবনের অমোঘ যাত্রার সুর। বেশিরভাগ কবির কবিতাই সর্বত্রগামী নয়। সাধারণত সমাজের আপেক্ষিকভাবে উচ্চস্তরের বুদ্ধিমান আবেগপ্রবণ পাঠকদের কাছে কবিতার বিশেষ সমাদর। কবিতা সাধারণভাবেই অস্পষ্ট, ছায়া ছায়া, মায়া মায়া। রূপক ও নতুনত্বের চমক না থাকলেও এ বইয়ের কবিতাগুলো কিন্তু সর্বজনবোধ্য। 

এ কবিতা দেখার চোখকে পরিশীলিত করে, মার্জিত করে। দম বন্ধ করা পরিস্থিতি কিভাবে পরিসরকে খুলে ধরে, কিভাবে অপমান আর কান্নার ভাষা অন্ধকারের সঙ্কট কাটিয়ে উঠে অবলীলায় মহাবিশ্বের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে তোলে, সেই অনুভূতি অপরূপ হয়ে ধরা পড়ে পাঠকের কাছে। এ কবিতা পড়ে পাঠক-আমি বুঝি, কবির কাছে অন্ধকার নিবিড় তন্ময়তা নিয়ে আসতে পারে। সেই তন্ময়তা থেকে জন্ম নেয় এক অন্তর্দৃষ্টি, যে অন্তর্দৃষ্টি পাঠের সম্পদ। সংগ্রামের মুহূর্তগুলো আমাদের আলোড়িত করে, প্রধানত যে আবেগে পাঠক নুগ্ধ হন তা হলো ভাবনার সংঘাত। এলোমেলো খাপছাড়া প্রান্তিক ভাষার প্রয়োগে সৃজনকর্মটি মানুষের বহতা জীবন-যাপনের ছবি।

চিরকালই কবিরা রাষ্ট্রবিপ্লব, মানবজীবনের বৃহত্তর সব সমস্যা, সামাজিক অবিচার নিয়ে কবিতা লিখেছেন। সমসাময়িক কবির রচনা থেকে একটি সময়কে আমরা ধরতে পারি তাই। সে কথা মনে রেখেও বুঝি, এ কবিতাগুলো শুধুই সময়ের কবিতা নয়। নিগ্রো সমাজের প্রতিটি মানুষের মুক্তির আকাঙ্খার কথা, হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতির নিপুণ বিশ্লেষণ, এক মুক্ত আকাশের জন্য আকুল আর্তি এ কবিতাগুলোয় ফুটে উঠেছে। অনুবাদক কবি কতখানি মরমী হলে এমনভাবে একটি ভিন্ন সমাজের ভিন্ন ছবি নিপুণ আকুতিতে ফুটিয়ে তুলতে পারেন, সেই ভাবনাও আসে। 

“যতক্ষণ আমি মনে রাখতে পারব,
যতক্ষণ আমার চোখ দেখতে পাবে,
যতক্ষণ আমার হাত তোমার হাতে
যতক্ষণ আমার পা টেনে নিয়ে যেতে পারবে আমাকে,
ততক্ষণ সমস্ত সময় এবং তোমারই নাম
মনে রাখি,
আকাশের তারাদের নিয়ে তোমারই
চোখের উপরে চোখ রাখি।..
.. এরকম স্বপ্নই সূর্যের চারিদিকে ছড়িয়ে রাখি পূর্ণতার,
যতক্ষণ আমি বেঁচে থাকব –’’ (“যতক্ষণ বেঁচে আছি”– মাজিসি কিউনেনে, ১৯৩০)

ইনি নিয়াসাল্যান্ডের কবি। আকাশ দেখার মুগ্ধতা কাটতে না কাটতেই পড়ে ফেলি কেপভার্দি দ্বীপপুঞ্জের কবি আগুইনালদো ফোনসেকার কবিতা ‘সমুদ্র অঞ্চলের সরাইখানা’। 

‘‘দূরে জ্বলছে
আনন্দ উচ্ছ্বাসে আলো
কালো রাত্রির মুখে
সব কিছু লবণাক্ত, স্নেহময় উৎসুক,
বাতাস পিঠে নিয়ে ঢেউ ছুটে চলেছে
কাঁপিয়ে দিচ্ছে সরাইখানা
নোঙর করা জাহাজে
..
..
আঃ নাবিকের কি মরুভূমির মতন তৃষ্ণা..
উল্কির দাগ চামড়ায়,
ব্যথা এবং দুঃসাহস ছড়ায়
বন্দরে পলাতকদের মধ্যেও,
সমস্ত জাতিধর্মের মানুষজন, সেই সব মানুষ যাদের গৃহ নেই, পরিচয় নেই
শুধু সমুদ্রেই যাদের পরিচয়, লবণ আর বাতাসের ভাষায়
জাহাজের নির্মম দৃষ্টিতে।..”(“সমুদ্র অঞ্চলের সরাইখানা”, ১৯২২)

আমেরিকার নিগ্রো কবি জেমস এ ইম্যানুয়েলের কবিতা “ইমেটি টিল” (১৯২১) স্নিগ্ধ সুন্দর জীবনের জলছবি।

‘‘জলশব্দে শিস দিয়ে কে ডাকছে
শুনতে পাই,
ছোট্ট ইমেট শান্ত হয় না।
সে ভেসে বেড়ায় অন্ধকারে,
নিস্তব্ধ হিমে সাঁতার কাটতে কাটতে –
আর একবার বল না গো, বল না,
ঘুমপাড়ানি সেই গান,
সেই গল্পটা পরীদের নিয়ে কিংবা 
নদীতে সন্তরণরত সেই ছেলেটির গল্প
যে
প্রবালের মালা গলায় পরে
আবহমানকাল 
গভীর ঐশ্বর্যে সাঁতার কেটে চলে
অবিশ্রাম-’’

আমেরিকার নিগ্রো কবি ছাড়াও এ সংগ্রহে আছে মাদাগাসকার, সেনেগাল, গাম্বিয়া, ঘানা, নাইজিরিয়া, কঙ্গো, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিয়াসাল্যান্ড, মোজাম্বিক, কেপভার্দি দ্বীপ, সাও টোমে, কেনিয়া, ইত্যাদি অনেক জায়গার নিগ্রো কবিদের কবিতা। এই কবিদের কেউ জন্মসূত্রে ক্রীতদাস হয়ে জীবন শুরু করেছেন, কেউ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক জীবন কাটিয়েছেন, কেউ দেশ থেকে নির্বাসিত কবি, কেউ নিগ্রো লেখক আন্দোলনের নেতা। কেউ শিক্ষক, কেউ সঙ্গীতশিল্পী, কেউ চিত্রকর, কেউ গবেষক। এক জায়গায় সবার মিল। সবার গাত্রবর্ণ কালো, কিন্তু মনে অন্ধকার কালোর বদলে মুক্ত চেতনার আলো।

কেউ প্রেমকে নতুন চিন্তায় যাচাই করতে চেয়েছেন, কেউ প্রকৃতির চিরন্তন রূপকে নতুন ছবিতে এঁকেছেন, কেউ রাজনৈতিক চেতনাকে কবির ভাষা দিয়েছেন, কেউ মানব-অন্তরের রহস্য সন্ধান করেছেন। কেউ সমাজব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছেন, কেউ নতুন পৃথিবীর কল্পনায় বিভোর থেকেছেন। 

সব মিলিয়ে একটি বিশেষ সময়, সমাজব্যবস্থা, অশান্ত পৃথিবীর বহুবিধ চিন্তার অভিঘাত, ব্যক্তিগত সূক্ষ্ম মনন... এই সঙ্কলনটিকে আমার একটি শোভাযাত্রার মতন মনে হয়েছে। শোভাযাত্রার পুরোভাগে আছেন অনুবাদক কবিযুগল, নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যে এই অনুবাদে যাঁরা অবলীলায় পাঠকমন জুড়ে থাকেন।

এ বইয়ে যেমন জীবন মৃত্যুর নিষ্ঠুর দ্বন্দ্বের রূপায়ণ আছে, তেমনি আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছবি, মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতি। মনে দাগ রেখে যাবার মতন বই।

3 comments:

  1. বেশ ভালো লাগলো! তবে আজ এই বিশ্বায়নের যুগে বিনোদন ও তো একটা পণ্যমাত্র! কবে যে কোন কর্পোরেটের নজর পড়ে এদিকে তাই ভয়ে থাকি!

    ReplyDelete
  2. ভালো রিভিউ দিদি। অনেক ভালো লাগল।

    আমি কুয়াশার রাজা
    আমি কালো
    আকাশে অবস্থান করি আমি
    ছড়াই ধ্বনিত বিশ্বকে উর্ধ্বে,
    উচ্চ চূড়ায় স্পন্দিত কর্মযজ্ঞের
    চিন্তা রাশি স্থাপন করি।
    আমি মৃত আত্মার হৃদয় আর
    ছোট ঝরণার কলগুঞ্জণ
    সবুজ তৃণখণ্ড থেকে আমি ঈশ্বরের
    নিকটে উঠে যাই
    আমি কুয়াশার রাজা
    আমি কালো

    ReplyDelete