0

অনুবাদ সাহিত্যঃ ইন্দ্রাণী ঘোষ

Posted in


অনুবাদ সাহিত্য



বাতাসবাড়ির সিম্ফনি 
মূল রচনা: The Windmill (Paulo Coelho) 
ভাষান্তর: ইন্দ্রাণী ঘোষ 



আমার জীবন এই মুহূর্তে এক সিম্ফনির মত। তিনটি ধারায় বিভক্ত তার গতি। 
‘বহু মানুষ’, ‘স্বল্প মানুষ’ আর ‘একলা যাপন’। এই তিনের সমন্বয়ে চলে আমার সিম্ফনি। হয়তো কোনও মাসে তিনটে নোটেশন একসাথে বাজে, কিন্তু কেউ কারুর নিজস্ব গণ্ডীকে অতিক্রম করে না। বরং সস্মভ্রমে জায়গা ছেড়ে দেয় পরস্পরকে। 

বহু মানুষের সুর বাজে যখন আমি আমার পাবলিশার্স, প্রকাশক, জনসাধারণ এবং সাংবাদিকদের সাথে থাকি। ‘স্বল্প মানুষের’ সিম্ফনি শুনি যখন আমি ফিরে যাই ব্রাজিলে, পুরনো বন্ধুদের কাছে, আমার একলা চলার কোপাকাবানা সমুদ্রতটে বা কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে। আর বাতাসবাড়িতে চলে আমার ‘একলা যাপন’। 

এই মুহূর্তে আমার ‘একলা যাপন’ চলছে। রাত নেমেছে পাহাড়ের ঢালু পথে। আমি এই পাহাড়ের কোলে এক ছোট্ট অনামিকা পাইরেনিয়ান গ্রামে একটি বাতাসবাড়ি কিনেছি। এই মুহূর্তে আমার মস্তিষ্ক শুধু বাতাসবাড়ির বাতাসে ভর্তি। 

আমার কোনও প্রশ্ন নেই, কোনও উত্তর নেই। আমি এই মুহূর্তে শুধু এই মুহূর্তটুকুতে বেঁচে আছি। রোজ প্রাতরাশের পর জব আর ভুট্টার ক্ষেত ধরে হাঁটতে বেরই। এই পাহাড়ের বিস্তীর্ণ হলুদ ক্ষেতে মিশে যাই, ঠিক যেমন নীল পাহাড়ের কোলে হলুদ শস্যের বিস্ফোরণে নীল হলুদ রঙ মিশে যায়, সেরকম। 

এই মুহূর্তে ইরাক বা আফগানিস্তানের দাঙ্গা আমায় ভাবাচ্ছে না। এই মুহূর্তে এই গ্রামের মানুষগুলোর মতন প্রকৃতির খেয়ালিপনা ছাড়া আর কিছুই ভাবছি না। 

এক চাষি হাল চালাচ্ছে মাঠে, আমি একটু দাঁড়িয়ে এই প্রকৃতির খেয়ালখুশির প্রলেপের খবর, ঝড় বৃষ্টির ঠিকানা, বাতাসিয়া রকমফেরের খবর, রোদ্দুরের হালফিলের সংবাদ, সব শুনে হাঁটতে শুরু করলাম। চাষি আবার হাল চালাতে শুরু করলো। 

আমি বাতাসিয়া বাড়ির পথ ধরলাম। মেঘবিহীন রোদজ্বলা আকাশে একবার মুখ তুলে চাইলাম। আমার চিঠির বাক্সে গ্রামীণ খবরের কাগজ দিয়ে গেছে কেউ। সেই কাগজ বলছে, পাশের গ্রামে নৃত্যোৎসব আছে। কাছের একটি পানশালায় জঞ্জালের টিনে অগ্নিসংযোগ হওয়ার ফলে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। 

একটি কিশোরের মৃত্যুর প্রতিবাদে কিছু গাছ ধবংসের ছক কষছে একটি গোপন সংস্থা। 

আমার বাতাসবাড়ির পাশেই আছে ছোট্ট তিরতিরে ঝিল। আমি শুয়ে পড়ি তার পাশে। উপুর করা নীল স্ফটিকের বাটির মত আকাশটা আমায় ঢেকে দেয়। এই গরমে দাবদাহে পাঁচ হাজার লোক মারা গেছে শুধু ফ্রান্স ও তার আশপাশে। এরপর আমি ধ্যান করি ‘কিউদো’ ফ্যাশনে (এক ধরনের তিরন্দাজি খেলা মারফত প্রাণায়াম করা)। হালকা মধ্যাহ্ন ভোজনের পর আমি বাতাসবাড়ির এ ঘর সে ঘর ঘুরে বেড়াই। ঘুরতে ঘুরতে আমার চোখে পড়ে এক যন্ত্র, স্ক্রীন আর কীবোর্ড যুক্ত। একটা বোতাম এই যন্ত্রের টিপলেই সমস্ত পৃথিবীটা হাঁ হাঁ করে আমার নাগালে চলে আসবে। 

আমি সংযত হয়েও শেষ অবধি টিপেই ফেলি সে জাদু বোতাম। ব্রজিলিয়ান খবরের কাগজ, সাক্ষাৎকার, ইরাক ও আফগানিস্তানের খবর, আমার উড়োজাহাজের টিকিট, আমার নেওয়া না নেওয়া সিদ্ধান্তরা, সব একসাথে আমার জীবনরেখায় সিম্ফনি তোলে। বেশ কিছু ঘণ্টা আমি কাজ করি। আমি আলোর পথের সৈনিক, আমি দায়িত্ব ভুলি না। এই বাতাসবাড়ির একলাযাপনের সময় কম্পিউটার স্ক্রীনে ভেসে ওঠা দুনিয়াটা থাকে যোজন যোজন দূরে। আবার মানুষের সাথে ওঠাবসার সময় এই বাতাসবাড়ী থাকে প্রায় এক মহাশূন্য ওপারে। 

সূর্য্যিদেব পাটে বসছেন। কম্পিউটার বন্ধ ক’রে দি। আমার খামারের বাতাসবাড়ির পৃথিবী আর আমি দুজনে জড়িয়ে ধরি দুজনকে, দুজনে দুজনের বুকের ঘ্রাণ নিই। ঘাসের ভেজা গন্ধ, ভেড়াদের ঘরে ফেরার গান তৈরি করে এক নরম সিম্ফনি। 

আমি আমাকে শুধোই, এই তিন পৃথিবীর আমি কোনটা আসল আমি? 

উত্তর পাই না। আমার মনের কানায় কানায় খুশি ভরে চলকে পড়ে, যখন এই কয়েক লাইন লিখে ফেলি।

0 comments: