প্রবন্ধঃ অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
কবিতার সেকাল ও একাল
অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের পাতা ওল্টালে প্রথমেই যে অধ্যায় চোখে আসে সেটা চর্যাপদ। প্রথম চর্যাকায়া তরুবর পঞ্চ বি ডাল। ...কবি লুইপাদ। এটাই বোধহয় আদিকবির প্রথম কবিতা। বাংলা ভাষা তখন আধুনিক যৌবনের ছোয়া পায়নি। চর্যাপদ যে বাংলা ভাষা, সেটা নিয়েও বিস্তর বাকযুদ্ধ। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় জিতে নিলেন সেই যুদ্ধ। চর্যাপদ স্থান পেলো বাংলা সাহিত্যের প্রথম অধ্যায় হিসেবে। বাংলা ভাষা বিকাশ লাভ করেছে ত্রিস্তরীয় বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে। এই বিবর্তনের ইতিবৃত্ত ডারউইন বা লামার্ক-এর মতবাদের থেকে কম রোমাঞ্চকর নয়। চর্যাপদে চিয়ে শব্দের প্রয়োগ প্রমান করে এটা বাংলা ভাষার বিবর্তনের দ্বিতীয় ধাপ। অন্তমিল বজায় রেখে, কবিতার ফরম্যাটে লেখা চর্যাপদ বাংলা ভাষার আদি গ্রন্থ। অলংকার আর ছন্দ সেখানে প্রবল। কবি ভুসুকুপাদের লেখা ‘আপনা মাসে হরিনা বৈরী’ - নিজের মাংসই হরিনের প্রধান শত্রু। অলংকার এভাবেই তারঝংকার শুনিয়েছে প্রতি ছত্রে। এরপর বাংলা ভাষার বিকাশ আর কবিতার বিন্যাস দুটোই ঘটেছে মঙ্গলকাব্য আর বৈষ্ণব পদাবলীর হাত ধরে। ‘শ্রবনেনো পথ দুহু লোচনেন লে ল’ - চোখ কানের পথে এগিয়ে গেল। এভাবেই রাধার আড় চোখে কৃষ্ণদর্শন অলংকারের মোড়ক পেয়েছে। অলংকার আর ছন্দের প্রবল প্রাচুর্যে উদ্ধত হয় কবিতার যৌবনের উপবন।
এই বিবর্তনের মাঝে পৃথিবীতে আসে শিল্প বিপ্লব। মানুষের চিন্তাধারা এক লহমায় পরিবর্তন করে দেয় সব কিছু। সাহিত্যেও আসে বিপ্লব। সময়টা 1798-1832। রোমান্টিক মুভমেন্ট। লিরিক্যাল বালাড্স নিয়ে আসে ভাব সমুদ্রে সুনামি। উল্টে যায় চিরাচরিত লেখনশৈলী। সেই ঢেউ চলে আসে বাংলার বুকে। যদিও ঢেউটা আগে আসে গদ্য সাহিত্যে। তবে কবিতাও পিছিয়ে ছিলোনা। অধুনিকতার ছোঁয়ায় আদিকবির প্রথম কবিতা। এখানে আদিকবি কবিগুরু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। কবি সার্বভৌম্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে বলে গেছেন - কবিগুরু তুমি হে(বিদ্যাসাগর)। সেই পর্যায়ে বাংলা কবিতায় আসে এক নতুন দিগন্ত। অমিত্রাক্ষর ছন্দের জনক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কাব্যের কারিগর লিখলেন মেঘনাদ বধ কাব্য। উপমান উপমিত কর্মধারার সার্থক প্রয়োগে ভাষার রূপ লাবন্য উঠলে উঠছে। ডানচোখ মাইকেলের ভাষায় বামেতর নয়ন। ‘প্রমীলার বামেতর নয়ন নাচিল।’ প্রাচীন সংস্কার কবিতার ভাষায় ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে তুলল।
প্রসঙ্গ কবিতা। কবিতা ভাব প্রধান। কিন্তু সেই ভাবের মাঝেও কবিতার প্রকাশ অলংকার আর ছন্দের মধ্যে দিয়ে। ছন্দপ্রধান কাব্য সাধারণত পদ্য নামেই বিশেষ পরিচিত। প্রসঙ্গত, বাংলায় এক বিশেষ সাহিত্য পাঁচালি। আর পাঁচালির মধ্যে কৃত্তিবাস ওঝার (1381–1461) শ্রীরাম পাঁচালি বাংলা ভাষায় অগ্রগণ্য। সেখানে এক বিশেষ ফরম্যাটে লেখা কবিতা নর্তক ছন্দ বলে বাংলা ভাষায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে। 1803 সালে জয়গোপাল তর্কালঙ্কার শ্রীরাম পাঁচালির পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশ করেন। যা আজ কৃত্তিবাসী রামায়ন নামে পরিচিত।
কবিতার মূল উপাদান ভাব। ভাব আবার নয় প্রকার। কবিতার সার্থকতা সেই ভাবের বিশ্লেষণে। অন্তর্নিহিত অর্থের মূল্যায়নে। অর্থ মূলত চতুর্বিধা শক্তিযুক্ত। অভিধাগত অর্থ। লক্ষনাগত অর্থ। ব্যাঞ্জনাগত অর্থ। আর তাত্পর্য। রূপক ধর্মী কবিতা মূলত লক্ষনাগত অর্থকে প্রকাশ করে। কবিতার উত্কর্ষ ফুটে ওঠে ব্যঞ্জনা তে। আর সর্বশেষ শক্তি তাত্পর্য। কবিতার বাণী যে বিশেষ অর্থ পাঠকের মনে পৌছে দেয়, সেটাই কবিতার আসল উদ্দেশ্য। কবিতার আধুনিকতা বিশ্লেষণে বাংলা ভাষায় সবার আগে একটাই নাম আসে। কবি সার্বভৌম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কবিতায় আকাশ হয়ে ওঠে শব্দ। আকাশ আর শব্দের প্রাচীন সংযোগ - আকাশ আনন্দ নস্যাত। রবীন্দ্রনাথের কথায় – ‘আকাশ এস এস ডাকিছ বুঝি ভাই।’ বিজ্ঞান আর সাহিত্যের সংযোগ ঘটে। ‘অন্ধকারের উত্স হতে উত্সারিত আলো।’ উত্স কথার অভিধাগত অর্থ ঝরনা। প্রয়োগে উত্স কথার অর্থ সোর্স (ইংলিশ)। বিজ্ঞান বলছে, আলো দেখা যায় না। কোনও বস্তুর ওপর আলো পড়লে আমরা সেই বস্তু কে দেখতে পাই। কবি সেই বিজ্ঞান কে ভাষা দিলেন। ‘সেই তো তোমার আলো।’ বিবর্তনবাদ এলো জীবনের নদী স্রোতে। ‘আমি সদা অচল থাকি। গভীর চলা গোপন রাখি।’ অন্তমিলহীন কবিতা বা গদ্য কবিতা, এই সবই সম্পূর্ণতা পেয়েছে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। বাংলা সাহিত্যের বিবর্তনে 1923 থেকে 1935, এই সময়টার মধ্যে একটা বিশেষ যুগের সূচনা হয়। যাকে বলে কল্লোল যুগ। কল্লোল পত্রিকাকে কেন্দ্র করে যে যুগের সূচনা। কল্লোল যুগে আরো দুজন কবি বাংলা ভাষায় চিরস্মরণীয়। কাজী নজরুল ইসলাম আর জীবনানন্দ দাস।
নজরুল গেয়েছেন যৌবনের জয়গান। বিপ্লবের টান। জীবনানন্দ নীল মৃত্যুর মাঝে অর্ধনারীশ্বর রূপে সৃষ্টি করেছেন বাংলার রূপ।
এরপর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এসেছে অনেক পরিবর্তন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ টেনেছে সাম্রাজ্যবাদে যবনিকা। এসেছে অর্থনৈতিক নবজাগরণ। মার্ক্সবাদ পরিবর্তন এনেছে বাংলার চিন্তনে। এই সবই প্রতিফলিত হয়েছে আধুনিক কবিতায়। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সরাসরি প্রশ্ন করেছেন সাম্রাজ্যবাদকে – ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’ শঙ্খ ঘোষ বাবরের প্রার্থনায় মধ্যযুগীয় অর্বাচীনতা কাটিয়ে এনেছেন আধুনিকতায় যোগ্যতমের উদবর্তন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হঠাৎ নীরার জন্য ঘটিয়েছে ভাষা বিপ্লব। কিন্তু এইসব পরিবর্তনের মাঝেও, কবিতা নয়, ছড়া, একদম শিশু সাহিত্য আবোল তাবোল আজও স্বমহিমায় উজ্জ্বল। সুকুমার রায় আর শিশু-সাহিত্য সমার্থক। রামগরুড়ের ছানা বা হাঁসজারু, এর সাথে বিভাব বা অনুভাবের কোনো সংযোগ হয় কিনা সন্দেহ। কিন্তু নির্মল আনন্দ হয়। কবিতা বা পদ্য কোনওটাই বোধহয় আবোল তাবোলকে ম্লান করে না। ছড়া। নির্মল আনন্দ। এটাই বোধহয় সমার্থক হবে সুকুমার রায়ের সাথে।
আজকের বাঙালি ঢুকে পড়েছে ওয়েব দুনিয়ায়। ফেইসবুক আর হোয়াট্সাপ। যা ছাপ ফেলেছে বাঙালির চিন্তনে। ইন্টারনেট একদিকে মনের দরজা খুলে দিচ্ছে। কিন্তু কোথাও যেন হারিয়ে যাচ্ছে সবেকিয়ানা। মুছে যাচ্ছে শাস্ত্রীয় বিশ্লেষণ। কবিতার চিরন্তন ফরম্যাট মুছে যাচ্ছে। খেয়াল গান যতই লাগাম ছাড়া বিস্তার পাক, গানের শেষে সমে এসে মিলতেই হয়। কবিতাও সেরকম। ছন্দ বা অক্ষর যতই আপন মনে ছুটে চলুক, গানের তালের মত কোথাও না কোথাও মিলতেই হয়। আজকের কবিতায় সেই মিলটাই খুঁজে নিতে হবে ফেইসবুক আর হোয়াট্সাপ বা অন্য কোনও পথের মধ্যে দিয়ে।
0 comments: