ভৌতবাক - দীপারুণ ভট্টাচার্য
Posted in ভৌতবাক
ভৌতবাক
লুটপুরের ঘটনা
দীপারুণ ভট্টাচার্য
গ্রামের নাম লুটপুর। কি জানি এক কালে হয়তো খুব লুটতরাজ হতো এখানে। এখন চুরি ছিনতাই যে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়েছে, এমন বলা যাবে না। আর শুনতে খারাপ লাগলেও, বাংলাদেশে এ প্রত্যাশা করাও ঠিক নয়। তবে এখন বেশ বড় জনবসতি গড়ে উঠেছে এখানে। স্কুল, প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র ইত্যাদি সবই আছে আর আছেন লিজা ডেভিজ। লিজা মার্কিন নাগরিক। তার স্বামী জোসেফ ডেভিজের সঙ্গে তিনি লুটপুরে এসেছেন প্রায় বছর দুয়েক হল। জোসেফ একজন এগ্রিকালচারাল ইঞ্জিনিয়ার। এক মার্কিন কোম্পানি তাকে এখানে পাঠিয়েছে। এদের ব্যবসা হল কৃষকদের ধান, গম বা ডালের বীজ বিক্রি করা। আর সেই বীজের রেসপন্স সম্পর্কে মার্কিন মুলুকের বৈজ্ঞানিকদের তথ্য সরবরাহ করা। এই কাজের জন্য জোসেফকে গ্রামে গ্রামে অনেক ঘুরে বেড়াতে হয়। গ্রামের যাতায়াত ব্যবস্থা খারাপ বলে সে মাঝে মধ্যেই রাতে লুটপুরের বাড়িতে ফিরতে পারেন না।
একা একা সময় কাটানো লিজার জন্য বেশ সমস্যার। বিশেষ করে শহুরে বিলাস থেকে বহুদূরে এই গ্রাম্য নির্জনতায়। এখানে এসে সে বাংলা ভাষাটা একটু একটু শিখেছে। কথায় কথায় একদিন স্থানীয় এমপি, মোক্তার আলী তাকে বলেছিলেন "আপনি ম্যাডাম লুটপুর উচ্চ-বিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়াবেন? তাহলে বাচ্ছারা কিছু শিখতে পারে।" লিজা শুনেই রাজি হয়ে যায়। এখন তার বেশ সময় কেটে যায়।মাঝেমধ্যে উঁচু ক্লাসের কয়েকজন বাড়িতেও পড়া বুঝতে চলে আসে।এখন জোসেফ বাড়ি না থাকলেও আর তেমন ফাঁকা লাগেনা। যেমন আজও জোসেফ ফেরেননি। আর কদিন বাদেই পঁচিশে ডিসেম্বর। এখন বেশ ঠান্ডা গেড়ে বসেছে। সন্ধ্যের দিকে মাঠের উপর হালকা কুয়াশার চাদর ভাসতে থাকে। চারিদিকের চাষের জমির গন্ধ এই কুয়াশার গন্ধের সঙ্গে মিলে মিশে এক অদ্ভুত পরিবেশ রচনা করে।
বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে রান্না শেষ করতে করতে আটটা বেজে যায় লিজার। রান্না বলতে স্কুল ফেরত আনা টাটকা সবজি দিয়ে স্যুপ, খানকয়েক রুটি আর তরকারি। এতেই সে বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।শীতের সময় গ্রামে আটটা বেশ রাতই বটে। তবে মার্কিন মুলুকের নারী লিজা ডেভিস সেটা মানবেন কেন। রাত দশটার আগে তার কিছুতেই ঘুম আসে না। চট করে ডিনার শেষ করে লিজা বেরোলেন পায়চারি করতে। ঘরের টুকিটাকি জিনিসেরও প্রয়োজন। যদি দোকান খোলা থাকে তবে সেগুলো কিনে নেবেন ভেবে বাজারের দিকে চললেন তিনি।
একজন মহিলার ঠিক যতটা সাহস থাকা উচিত লিজার সাহস তার চেয়ে অনেক বেশি। তাছাড়া তার এমন উচ্চতা ও স্বাস্থ্য যে, একজন জোয়ান বাঙালি লোককে কাবু করতে তাকে বেশি বেগ পেতে হবে না। তাই সে নির্ভয়েই যাতায়াত করে গ্রামের পথে ঘাটে। বাড়ির কাছের ছোট্ট বাজারে গিয়ে লিজা দেখলো সব দোকানই প্রায় বন্ধ। কাজেই কাল সকালে আসবে ভেবে সে ফেরার পথ ধরলো। গ্রামের রাস্তার দুই দিকে আম জাম লিচু আর নারকেল সুপুরীর সারি। কোথাও কোথাও এলো মেলো ঝোপ ঝাড়। একটানা ডাকছে ঝিঁঝিঁ পোকা। গাছের সারির পিছনে কোথাও জলা জমি, কোথাও পানের বরজ। ঝোপের পাশে পাশে জমাট অন্ধকারের মধ্যে স্থির হয়ে আছে সাদাটে কুয়াশার স্তর আর জোনাকির মিটমিটে আলো ঘন অন্ধকারে বুদবুদের মত উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে। লিজা বুঝলো গ্রামের বিদ্যুৎ গেছে। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার এই অভিজ্ঞতা লিজার জীবনে কোনোদিনই হতোনা যদি না সে বাংলাদেশে আসতো। জন্ম থেকে আমেরিকায় কাটানো তার ত্রিশ বছরের জীবনে সে কখনও লোডশেডিং দেখেনি।
লিজা পাশের দিকের ছোট রাস্তাটা নিলো। অন্ধকারে বড় রাস্তা আর ছোট রাস্তায় বিশেষ তফাৎ নেই এই গন্ডগ্রামে। টর্চের আলোয় নিকষ অন্ধকার কেটে লিজা চলতে শুরু করলো। কিন্তু এতই জমাট আঁধার যে টর্চের আলো খুব ভরসা দিচ্ছেনা। একটু দূরে বেশ কিছুটা অঞ্চল জুড়ে বিরাট বাঁশঝাড়ের ঝোপ। সরু রাস্তা গেছে তার পাশ দিয়ে। বাঁশঝাড়ের পাশেই একটা পচা পুকুর। কাছে যেতেই নাকে একটা নোনা গন্ধ আসে লিজার। সে পাশ এড়িয়ে এগিয়ে যায়। এবার বাঁশঝাড়ের মধ্যে কিছু যেন একটা নড়ে ওঠে। কুকুর বিড়াল কি? লিজা আলো ফেলে। কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না। হঠাৎ ফিসফিস করে কথা বলার আওয়াজ পায় লিজা।আওয়াজ ওই বাঁশঝাড়ের দিক থেকে আসছে যেন, সে সতর্ক হয়ে ওঠে। কি জানি চোর ডাকাত সেখানে লুকিয়ে আছে কিনা! হয়তো সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু একটু পরেই সে একটা বাচ্চা মেয়ের কান্নার শব্দ শুনতে পায়। আর তো এড়ানো যায়না। অন্ধকার নির্জনতায় একটা বাচ্ছাকে একলা ফেলে যাওয়া মানবিক আচরণ নয়। এবার সে টর্চের আলোতে দেখতেও পায় ফ্রক পরা বছর পাঁচেকের মেয়েটাকে। সে লিজার দিকে পিছন করে বসে আছে বাঁশঝাড়ের মাটিতে। আর তার পা দুটো ঝোলানো পচা পুকুরের দিকে। মেয়েটার পিছনে এগিয়ে গিয়ে লিজা বলে, "কে, কে তুমি খুকী, কাঁদছো কেন?" মেয়েটি কোনো উত্তর দেয় না। লিজা আবার বলে, "কি হলো, কেন কাঁদছো বলো! আমাকে বলো, আমি তোমাকে সাহায্য করবো। বলো, বলো কি হয়েছে? পথ হারিয়েছ?" মেয়েটা একই ভাবে একটানা কেঁদেই চলেছে দেখে লিজা নিচু হয়ে তার পিছনে বসে। বার কয়েক ডেকেও কোনো উত্তর পাচ্ছে না দেখে সে মেয়েটির কাঁধে হাত রেখে একটা মৃদু ঝাকুনি দেয়। আর তখুনি সামনের ফাঁসুড়ে অন্ধকার ঘন ঝোপের থেকে একটা বুক কাঁপানো হাসি শুনতে পায় লিজা। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটির মাথাটা খুলে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে পচা পুকুরে। শুধু মুণ্ডহীন ধড়টা একই ভাবে বসে থাকে সেই পুকুর পাড়ে। ঠিক তখনই একটা হ্যাচকা টান অনুভব করে লিজা। সেই টানে, সে নিজেও হয়তো গড়িয়ে পড়তো ওই পুকুরে মধ্যে কিন্তু কোনো ভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বাড়ির দিকে উর্ধশ্বাসে ছুটতে থাকে লিজা। তার হাত থেকে ছিটকে পড়া টর্চের আলো স্থির ভাবে ছড়াতে থাকে বাঁশঝড়ের গভীরে।
ছুটতে ছুটতে বাড়ির কাছের বট গাছের নীচে এসে একজনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় লিজা। ভালো করে লক্ষ করে লিজা দেখে সাদা কাপড় জড়ানো এক বুড়ি, মদিনার মা। মদিনার মা লিজার বাড়িতে কাজ করে। কিন্তু এতো রাতে সে বটতলায় কি করছিল! না, সেই মুহূর্তে এসব ভাবে না লিজা। পরিচিত একজনকে দেখে সে বেশ খানিকটা ভরসা খুঁজে পায়। মদিনার মা হাত ধরে লিজাকে তোলে মাটি থেকে। তারপর বলে, "মেম সাহেব, আপনি হাঁপান কেন?" উত্তেজিত লিজা হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, "ওই বাঁশঝাড়ের পাশে একটা মেয়ে বসে কাঁদছিলো। আমি ডাকতেই তার মাথাটা পুকুরের মধ্যে…"
- "ও কিছু না মেম সাহেব, আপনি বাড়ি যান" মদিনার মা লিজার হাত ধরে টান মারে।
-"কিন্তু আমি যে দেখলাম!" লিজার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
-"আপনি তারে ধাক্কা দেন নি তো!" চিন্তিত দেখায় মদিনার মা'কে।
-"না না, আমি তো এই ভাবে তাকে ডেকেছিলাম শুধু" বলে একই ভাবে লিজা মদিনার মায়ের কাঁধে হাত রেখে মৃদু ঝাঁকুনি দিতে তার মাথাটাও সে ভাবে ধড় থেকে খসে পড়ে মাটিতে গড়াতে থাকে। আবারও সেই বুক কাঁপানো হাসি অন্ধকার চিরে দিয়ে লিজার চারদিকে আছড়ে পড়ে, সেই ভয়ংকর অট্টহাসি নাগাড়ে শোনা যায়।
মদিনার মায়ের ধড় একই ভাবে তখনও দাঁড়িয়ে থাকে লিজার খুব কাছেই। পরমুহূর্তেই লিজার অচৈতন্য দেহটা লুটিয়ে পড়ে বটতলায়।
পরদিন সকালে গ্রামের লোকেরা বটতলায় লিজার প্রাণ হীন দেহটা আবিস্কার করে। বাঁশ বাগানের পাশে পড়ে থাকা লিজার টর্চটাও পাওয়া যায়। এই ঘটনার পর জোসেফ আর লুটপুরে থাকতে পারেননি।
(ছবি: সোময়েত্রী ভট্টাচার্য)