Next
Previous
Showing posts with label ভৌতবাক. Show all posts
0

ভৌতবাক - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in

ভৌতবাক


লুটপুরের ঘটনা
দীপারুণ ভট্টাচার্য


গ্রামের নাম লুটপুর। কি জানি এক কালে হয়তো খুব লুটতরাজ হতো এখানে। এখন চুরি ছিনতাই যে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়েছে, এমন বলা যাবে না। আর শুনতে খারাপ লাগলেও, বাংলাদেশে এ প্রত্যাশা করাও ঠিক নয়। তবে এখন বেশ বড় জনবসতি গড়ে উঠেছে এখানে। স্কুল, প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র ইত্যাদি সবই আছে আর আছেন লিজা ডেভিজ। লিজা মার্কিন নাগরিক। তার স্বামী জোসেফ ডেভিজের সঙ্গে তিনি লুটপুরে এসেছেন প্রায় বছর দুয়েক হল। জোসেফ একজন এগ্রিকালচারাল ইঞ্জিনিয়ার। এক মার্কিন কোম্পানি তাকে এখানে পাঠিয়েছে। এদের ব্যবসা হল কৃষকদের ধান, গম বা ডালের বীজ বিক্রি করা। আর সেই বীজের রেসপন্স সম্পর্কে মার্কিন মুলুকের বৈজ্ঞানিকদের তথ্য সরবরাহ করা। এই কাজের জন্য জোসেফকে গ্রামে গ্রামে অনেক ঘুরে বেড়াতে হয়। গ্রামের যাতায়াত ব্যবস্থা খারাপ বলে সে মাঝে মধ্যেই রাতে লুটপুরের বাড়িতে ফিরতে পারেন না।

একা একা সময় কাটানো লিজার জন্য বেশ সমস্যার। বিশেষ করে শহুরে বিলাস থেকে বহুদূরে এই গ্রাম্য নির্জনতায়। এখানে এসে সে বাংলা ভাষাটা একটু একটু শিখেছে। কথায় কথায় একদিন স্থানীয় এমপি, মোক্তার আলী তাকে বলেছিলেন "আপনি ম্যাডাম লুটপুর উচ্চ-বিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়াবেন? তাহলে বাচ্ছারা কিছু শিখতে পারে।" লিজা শুনেই রাজি হয়ে যায়। এখন তার বেশ সময় কেটে যায়।মাঝেমধ্যে উঁচু ক্লাসের কয়েকজন বাড়িতেও পড়া বুঝতে চলে আসে।এখন জোসেফ বাড়ি না থাকলেও আর তেমন ফাঁকা লাগেনা। যেমন আজও জোসেফ ফেরেননি। আর কদিন বাদেই পঁচিশে ডিসেম্বর। এখন বেশ ঠান্ডা গেড়ে বসেছে। সন্ধ্যের দিকে মাঠের উপর হালকা কুয়াশার চাদর ভাসতে থাকে। চারিদিকের চাষের জমির গন্ধ এই কুয়াশার গন্ধের সঙ্গে মিলে মিশে এক অদ্ভুত পরিবেশ রচনা করে।

বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে রান্না শেষ করতে করতে আটটা বেজে যায় লিজার। রান্না বলতে স্কুল ফেরত আনা টাটকা সবজি দিয়ে স্যুপ, খানকয়েক রুটি আর তরকারি। এতেই সে বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।শীতের সময় গ্রামে আটটা বেশ রাতই বটে। তবে মার্কিন মুলুকের নারী লিজা ডেভিস সেটা মানবেন কেন। রাত দশটার আগে তার কিছুতেই ঘুম আসে না। চট করে ডিনার শেষ করে লিজা বেরোলেন পায়চারি করতে। ঘরের টুকিটাকি জিনিসেরও প্রয়োজন। যদি দোকান খোলা থাকে তবে সেগুলো কিনে নেবেন ভেবে বাজারের দিকে চললেন তিনি।

একজন মহিলার ঠিক যতটা সাহস থাকা উচিত লিজার সাহস তার চেয়ে অনেক বেশি। তাছাড়া তার এমন উচ্চতা ও স্বাস্থ্য যে, একজন জোয়ান বাঙালি লোককে কাবু করতে তাকে বেশি বেগ পেতে হবে না। তাই সে নির্ভয়েই যাতায়াত করে গ্রামের পথে ঘাটে। বাড়ির কাছের ছোট্ট বাজারে গিয়ে লিজা দেখলো সব দোকানই প্রায় বন্ধ। কাজেই কাল সকালে আসবে ভেবে সে ফেরার পথ ধরলো। গ্রামের রাস্তার দুই দিকে আম জাম লিচু আর নারকেল সুপুরীর সারি। কোথাও কোথাও এলো মেলো ঝোপ ঝাড়। একটানা ডাকছে ঝিঁঝিঁ পোকা। গাছের সারির পিছনে কোথাও জলা জমি, কোথাও পানের বরজ। ঝোপের পাশে পাশে জমাট অন্ধকারের মধ্যে স্থির হয়ে আছে সাদাটে কুয়াশার স্তর আর জোনাকির মিটমিটে আলো ঘন অন্ধকারে বুদবুদের মত উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে। লিজা বুঝলো গ্রামের বিদ্যুৎ গেছে। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার এই অভিজ্ঞতা লিজার জীবনে কোনোদিনই হতোনা যদি না সে বাংলাদেশে আসতো। জন্ম থেকে আমেরিকায় কাটানো তার ত্রিশ বছরের জীবনে সে কখনও লোডশেডিং দেখেনি। 

লিজা পাশের দিকের ছোট রাস্তাটা নিলো। অন্ধকারে বড় রাস্তা আর ছোট রাস্তায় বিশেষ তফাৎ নেই এই গন্ডগ্রামে। টর্চের আলোয় নিকষ অন্ধকার কেটে লিজা চলতে শুরু করলো। কিন্তু এতই জমাট আঁধার যে টর্চের আলো খুব ভরসা দিচ্ছেনা। একটু দূরে বেশ কিছুটা অঞ্চল জুড়ে বিরাট বাঁশঝাড়ের ঝোপ। সরু রাস্তা গেছে তার পাশ দিয়ে। বাঁশঝাড়ের পাশেই একটা পচা পুকুর। কাছে যেতেই নাকে একটা নোনা গন্ধ আসে লিজার। সে পাশ এড়িয়ে এগিয়ে যায়। এবার বাঁশঝাড়ের মধ্যে কিছু যেন একটা নড়ে ওঠে। কুকুর বিড়াল কি? লিজা আলো ফেলে। কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না। হঠাৎ ফিসফিস করে কথা বলার আওয়াজ পায় লিজা।আওয়াজ ওই বাঁশঝাড়ের দিক থেকে আসছে যেন, সে সতর্ক হয়ে ওঠে। কি জানি চোর ডাকাত সেখানে লুকিয়ে আছে কিনা! হয়তো সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু একটু পরেই সে একটা বাচ্চা মেয়ের কান্নার শব্দ শুনতে পায়। আর তো এড়ানো যায়না। অন্ধকার নির্জনতায় একটা বাচ্ছাকে একলা ফেলে যাওয়া মানবিক আচরণ নয়। এবার সে টর্চের আলোতে দেখতেও পায় ফ্রক পরা বছর পাঁচেকের মেয়েটাকে। সে লিজার দিকে পিছন করে বসে আছে বাঁশঝাড়ের মাটিতে। আর তার পা দুটো ঝোলানো পচা পুকুরের দিকে। মেয়েটার পিছনে এগিয়ে গিয়ে লিজা বলে, "কে, কে তুমি খুকী, কাঁদছো কেন?" মেয়েটি কোনো উত্তর দেয় না। লিজা আবার বলে, "কি হলো, কেন কাঁদছো বলো! আমাকে বলো, আমি তোমাকে সাহায্য করবো। বলো, বলো কি হয়েছে? পথ হারিয়েছ?" মেয়েটা একই ভাবে একটানা কেঁদেই চলেছে দেখে লিজা নিচু হয়ে তার পিছনে বসে। বার কয়েক ডেকেও কোনো উত্তর পাচ্ছে না দেখে সে মেয়েটির কাঁধে হাত রেখে একটা মৃদু ঝাকুনি দেয়। আর তখুনি সামনের ফাঁসুড়ে অন্ধকার ঘন ঝোপের থেকে একটা বুক কাঁপানো হাসি শুনতে পায় লিজা। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মেয়েটির মাথাটা খুলে গিয়ে গড়িয়ে পড়ে পচা পুকুরে। শুধু মুণ্ডহীন ধড়টা একই ভাবে বসে থাকে সেই পুকুর পাড়ে। ঠিক তখনই একটা হ্যাচকা টান অনুভব করে লিজা। সেই টানে, সে নিজেও হয়তো গড়িয়ে পড়তো ওই পুকুরে মধ্যে কিন্তু কোনো ভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বাড়ির দিকে উর্ধশ্বাসে ছুটতে থাকে লিজা। তার হাত থেকে ছিটকে পড়া টর্চের আলো স্থির ভাবে ছড়াতে থাকে বাঁশঝড়ের গভীরে।

ছুটতে ছুটতে বাড়ির কাছের বট গাছের নীচে এসে একজনের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় লিজা। ভালো করে লক্ষ করে লিজা দেখে সাদা কাপড় জড়ানো এক বুড়ি, মদিনার মা। মদিনার মা লিজার বাড়িতে কাজ করে। কিন্তু এতো রাতে সে বটতলায় কি করছিল! না, সেই মুহূর্তে এসব ভাবে না লিজা। পরিচিত একজনকে দেখে সে বেশ খানিকটা ভরসা খুঁজে পায়। মদিনার মা হাত ধরে লিজাকে তোলে মাটি থেকে। তারপর বলে, "মেম সাহেব, আপনি হাঁপান কেন?" উত্তেজিত লিজা হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, "ওই বাঁশঝাড়ের পাশে একটা মেয়ে বসে কাঁদছিলো। আমি ডাকতেই তার মাথাটা পুকুরের মধ্যে…" 

- "ও কিছু না মেম সাহেব, আপনি বাড়ি যান" মদিনার মা লিজার হাত ধরে টান মারে।

-"কিন্তু আমি যে দেখলাম!" লিজার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

-"আপনি তারে ধাক্কা দেন নি তো!" চিন্তিত দেখায় মদিনার মা'কে।

-"না না, আমি তো এই ভাবে তাকে ডেকেছিলাম শুধু" বলে একই ভাবে লিজা মদিনার মায়ের কাঁধে হাত রেখে মৃদু ঝাঁকুনি দিতে তার মাথাটাও সে ভাবে ধড় থেকে খসে পড়ে মাটিতে গড়াতে থাকে। আবারও সেই বুক কাঁপানো হাসি অন্ধকার চিরে দিয়ে লিজার চারদিকে আছড়ে পড়ে, সেই ভয়ংকর অট্টহাসি নাগাড়ে শোনা যায়।
মদিনার মায়ের ধড় একই ভাবে তখনও দাঁড়িয়ে থাকে লিজার খুব কাছেই। পরমুহূর্তেই লিজার অচৈতন্য দেহটা লুটিয়ে পড়ে বটতলায়।

পরদিন সকালে গ্রামের লোকেরা বটতলায় লিজার প্রাণ হীন দেহটা আবিস্কার করে। বাঁশ বাগানের পাশে পড়ে থাকা লিজার টর্চটাও পাওয়া যায়। এই ঘটনার পর জোসেফ আর লুটপুরে থাকতে পারেননি।

(ছবি: সোময়েত্রী ভট্টাচার্য)
0

ভৌতবাক - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in

ভৌতবাক


শেষ কাজ
দীপারুণ ভট্টাচার্য 



ঘড়ি যদিও বলছে দুপুর দু'টো কিন্তু চারপাশের পরিবেশ দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই। আকাশ অন্ধকার, ঝির ঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে এক নাগাড়ে আর তার সঙ্গে চলছে হাওয়া। মনে হচ্ছে সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। পুষ্কর সরোবরের কোটা ঘাটে এই অকাল সন্ধেবেলা বসে আছে এই ঘাটেরই পাণ্ডা বিনোদ বিহারী ভট্টাচার্য এবং তার ভাইপো সুকুমার। যদিও ভাইপো বলছি যাকে সেই সুকুমারের সঙ্গে বিনোদ বিহারীরির কোন রক্তের সম্পর্ক নেই। বিনোদ বিহারীরা কয়েক পুরুষ ধরে এই পুষ্কর তীর্থের বাঙালি পান্ডা। বহু দিন আগে কোটা’র মহারাজ বিনোদ বিহারীর বৃদ্ধ প্রপিতামহ নিত্যানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়কে এখানে কাজে লাগিয়েছিলেন। তখন থেকেই চলে আসছে এই পারিবারিক পেশা। তবে এখন এই কাজে নতুন প্রজন্মের ছেলেদের বিশেষ উৎসাহ নেই। তাই বিনোদ বিহারী আর তার স্ত্রী ছায়াই এখন পুষ্করে থাকেন। তাদের বাকি আত্মীয় স্বজন সকলেই বাইরে। কেউ জয়পুর আবার কেউ থাকে নতুন দিল্লিতে। অবসর সময়ে নিঃসন্তান বিনোদ বিহারী পরিবারের এসব কথাই চিন্তা করতো। আর প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে প্রার্থনা করতো যেন তিনি পুষ্কর তীর্থকে বাঙালি পান্ডা শুন্য না করে দেন। 

প্রজাপতি ব্রহ্মা হয়তো শুনেছিলেন বিনোদ বিহারীর এই প্রার্থনা। তাই একদিন খুব ভোরের ট্রেনে জয়পুর যাওয়ার সময় তার স্ত্রী ছায়া কাপড়ে জড়ান অবস্থায় সুকুমার কে আবিষ্কার করে। “কি নিষ্ঠুর মানুষ, দুধের শিশুকে এমন ভাবে কেউ ফেলে যায়!” চিৎকার করে উঠেছিল ছায়া। প্রথমে বিনোদ বিহারী ভেবেছিল শিশুটি নিশ্চয়ই মেয়ে। কন্যা শিশুর জন্মকে এদেশে অনেকেই ভাল চোখে দেখে না। কিন্তু যখন বিনোদ বিহারী বুঝল শিশুটি ছেলে তখন সে শতকোটি প্রণাম জানিয়েছিল ঈশ্বরকে। শিশুটিকে ব্রহ্মার মানস পুত্র হিসাবেই মেনে নিয়েছিল বিনোদ ও ছায়া। নাম দিয়েছিল সুকুমার। স্নেহ আর মমতা দিয়ে তাকে মানুষ করেছে তারা। সমাজে পরিচয় দিয়েছে ভাইপো হিসাবে। যেন কেউ তাকে কুড়িয়ে পাওয়া সন্তান হিসাবে তাড়িয়ে না দেয় এই পেশা থেকে। প্রাণ ঢেলে সুকুমারকে সব কাজ শিখিয়েছে বিনোদ বিহারী। বলেছে, “নিজের সব টুকু ব্রহ্মাকে নিবেদন কর। তাহলেই তিনি যজমানের প্রার্থনাও তোর হাতে গ্রহণ করবেন”। পৃথিবীতে পুষ্করই এক মাত্র স্থান যেখানে প্রজাপতি ব্রহ্মার পুজো হয়। মন্দিরের সামনে বিশাল পবিত্র পুষ্কর সরোবর। আর এই সরোবরকে ঘিরে রয়েছে বাহান্নটি ঘাট। সেখানে স্নান যেমন হয় তেমন হয় পূজাপাঠ এবং পিণ্ড দানের কাজ।

আজ অবশ্য কেউ আসেনি কোন কাজ নিয়ে। ক্ষতি নেই, এক একদিন এমন হয়। বৃষ্টির তেজ এমনই যে মোটর সাইকেল চেপে বাড়ি যাওয়াও সম্ভব নয়। কাজেই ছাওনির নিচে ঘাটের সিঁড়ি উপর বসে গল্প করছিল তারা। খুবই তুচ্ছ সেই কথাবার্তা। ঘাট আজ একেবারেই জনবিরল। সাধারণত বাঙালি যজমানরা খুঁজে খুঁজে আসেন এই ঘাটে। বিনোদ বিহারীর কাছে অনেক পুরনো খাতাপত্র আছে। বহুবছর আগে পিণ্ড দেওয়া হয়েছে এমন পূর্ব পুরুষদের নাম এই খাতায় দেখতে পেয়ে অনেকে প্রসন্ন হয়ে বেশি বেশি দক্ষিণা দিয়ে থাকেন। বিষয়টা বিনোদ বিহারীকে বেশ তৃপ্তি দেয়। 

দুজনের কথার মধ্যে হঠাৎ সঞ্জয় এসে উপস্থিত হল। সঞ্জয় স্থানীয় এক হোটেলের বাঙালি কর্মী। সঞ্জয়কে দেখে বিনোদ বিহারী বলল, "কি রে এই বৃষ্টিতে, কি মনে করে?"

-"আর বলবেন না ভট্টাচার্য মশাই, আমাদের হোটেলে কোলকাতা থেকে এক বাঙালি পরিবার এসেছে বাবার পিণ্ড দিতে। ভদ্রলোকের মায়ের অবস্থা ভালো নয়। তিনি নাকি ঘরে একা থাকলেই তার মৃত স্বামীকে দেখতে পাচ্ছেন। মৃত আত্মা নাকি পুষ্কর ধামেই পিণ্ড চাইছে।"

-"তা, সঙ্গে করে নিয়ে এলেই পারতিস। কাজ সেরে দিতাম।"

-"ছেলেটা বৃষ্টির মধ্যে আসতে কিছুতেই রাজি হল না। আপনি কি ফেরার পথে হোটেলে এসে একবার কথা বলে যাবেন। তাহলে কাল সকাল সকাল নিয়ে আসবো।"

বিনোদ বিহারীর মুখে একটা প্রসন্ন ভাব ফুটে উঠল, "ঠিক আছে তুই যা। আমি ফেরার পথে দেখা করে যাবো।" সঞ্জয় যেমন এসেছিল ঠিক তেমন ভাবেই বৃষ্টির মধ্যে মিলিয়ে গেল।

সঞ্জয় চলে যেতেই সুকুমার প্রশ্ন করলো, "কাকা, এমন হয় নাকি, মৃত মানুষ কি পিণ্ডের জন্য স্বপ্নে দেখা দেয়?”

বৃষ্টি ভেজা আকাশের দিকে একটু তাকিয়ে থেকে বিনোদ বিহারীর বলল, “কিছুই অসম্ভব নয় রে। মাদ্রাজে মন্মথবাবুর বাড়িতে স্বয়ং বিবেকানন্দের সঙ্গেও এমন একটি ঘটনা হয়েছিল। প্রেতাত্মারা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইতো। তাদের কথা শুনে বিবেকানন্দ বুঝতে পারেন তারা মুক্তি চাইছে। কিন্তু তখন তাঁর নিজের খাওয়ার পয়সা নেই। পিণ্ড সামগ্রী কিনবেন কিভাবে। তাই বালি দিয়েই পিণ্ড দিয়েছিলেন”। একটু থেমে বিনোদ বিহারী বললেন, “ভক্তিটাই বড় কথা বুঝলি। পিণ্ডদানের সময় যজমানের বাবা মা কে নিজের বাবা মা ভেবে কাজ করতে হয়। তবেই সেটা আত্মা গ্রহণ করেন। বিশ্বাস ছাড়া লোকাচার অর্থহীন”। একটা পান মুখে দেয় বিনোদ বিহারী। তারপর আবার বলতে থাকে, “কাজ সঠিক হলে আত্মা যেমন যজমানকে আশীর্বাদ করেন তেমন আমাদেরও করেন”।

একটু নড়ে বসে সুকুমার; প্রশ্ন করে, “এই আশীর্বাদ তুমি কি বুঝতে পারো?”

-“মাঝে মাঝে পারি। কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখলাম, উঁচু টিলার উপর একটা ছোট্ট মন্দির। আমি মন্দিরের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকেছি। মেঝের উপর পুজারি শুয়ে আছেন। তাকে ডাকতে গিয়ে দেখলাম, দেহে প্রাণ নেই। আর তখনই কে যেন বলল, আমায় মুক্তি দে। স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেল। তখন থেকেই মনের মধ্যে কেমন যেন করছিল। এখন সঞ্জয়ের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টা পরিষ্কার হল। হতেও তো পারে, সঞ্জয় যার কথা বলে গেল সেই আসলে আমার স্বপ্নে দেখা পুজারির”।

-“তুমি কি যে বলো না কাকা, কোলকাতায় উঁচু টিলা আর তার উপর মন্দির।”

একটু হাসে বিনোদ বিহারী, “সব মিলবে এমন তো নয়! তাছাড়া উঁচুটা তো তিনি শিক্ষায়, ভক্তিতে বা অন্য কোন গুনেও হতে পারেন, না কি? নইলে বউ ছেলে এতদূর আসবে কেন? কোলকাতার কজন গয়া ছেড়ে পুষ্করে আসেন, বল”।

একটু দমে গিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুকুমার। বিনোদ বিহারী আবার বলেন, “অন্ধ যেমন পথ দেখতে পারে না, তেমন কোন কোন আত্মাও পথ খুঁজে পায় না। তখন সে সহানুভূতিশীল একজনের খোঁজ করে। যে তাকে পথ দেখাবে।“

-“এই খোঁজ কি শুধু স্বপ্নের মধ্যেই হয় নাকি?”

সুকুমারের প্রশ্নের শেষ নেই। দুই ঢোক জল খেয়ে বিনোদ বিহারী বলে, " তা কেন, বাস্তব জীবনে এসেও তারা সাহায্য প্রার্থনা করে। আমরা সব সময় তাদের চিনতে পারিনা।"

-“কি বলছ কাকা! তার মানে মানুষের বেশে ভুতরাও চলে ফিরে বেড়াচ্ছে আমাদের সমাজে? কিন্তু, তাদের চেনার উপায় কি?” 

-"একটা ঘটনা বলি শোন। বিষয়টা প্রায় বছর ত্রিশ আগের। তখন তিলরা বাজারে স্বপন মাহেশ্বরীর দোকানে রাজু নামে, বছর পনেরোর একটা ছেলে কাজ করতো। ছেলেটাকে স্বপন খুবই ভালবাসতো। বৃদ্ধ স্বপন মাহেশ্বরীর সাত কূলে কেউ ছিলনা। বাজারের মধ্যেই ছিল তার দোতলা বাড়ি। তারই এক তলার দুটো ঘরে ছিল দোকান। এই রাজুই ছিল মাহেশ্বরীর একমাত্র সম্বল। সে ভেবেছিল গঙ্গা প্রাপ্তির আগে রাজুকেই সব কিছু দিয়ে যাবে। এ কথা মাহেশ্বরী নিজেই আমাকে বলেছিল। আমি তার দোকানে তখন মাঝে মধ্যে যেতাম। একদিন শুনলাম রাজু গাড়ীর ধাক্কায় মারা গেছে। এই ঘটনায় মাহেশ্বরী একেবারেই ভেঙ্গে পড়ল। যাই হোক, ঘটনার কয়েক মাস পরে এমনই এক বৃষ্টির সন্ধেবেলা মাহেশ্বরীর দোকানে গিয়ে দেখি একটা নতুন ছেলে কাজ করছে। ভারি ভালো লাগলো ছেলেটিকে দেখে। দেখলাম মাহেশ্বরীও খুব খুশি এই নতুন কর্মচারিকে পেয়ে। আমি হাসি মুখে প্রশ্ন করলাম, তোমার নাম কি বাবা? ছেলেটা আমার দিকে কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল। তারপর সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেল।”

-“তারপর?”

-“বিষয়টাতে আমি আর মাহেশ্বরী দুজনেই অবাক হয়ে গেলাম। প্রশ্ন করলে মাহেশ্বরী বলল, ঘন্টা কয়েক আগে ছেলেটা নিজেই এসে বলেছে, সে দোকানে কাজ করতে চায়। মাহেশ্বরী অবশ্য তার নাম ধাম না শুনেই তাকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সে কিছু না বলে এভাবে দোতলায় উঠে গেল কেন? এরপর আমি আর মাহেশ্বরী দোতলার সব ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে ও ছেলেটাকে পেলাম না। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া গেল না”।

-“পাওয়া গেল না মানে; সে গেল কোথায়?”

-“মানুষ হলে তো পাওয়া যাবে! কেউ কোন দিন তাকে খোঁজ করতেও আসেনি।“

-“তাহলে হলটা কি?”

-“আসলে কি জানিস, ভূতেরা মিথ্যা বলতে পারে না। তাই তারা নিজেদের নাম বলতে চায় না। বলতে গেলেই নিজের নামের আগে চন্দ্রবিন্দু বেরিয়ে যাবে কি না। মনে হয় এই ভয়েই ছেলেটা সেদিন পিঠটান দিয়েছিল”।

একজনের কাশির শব্দে সম্বিত ফিরে পেল দুজনেই। লোকটা কখন যে এসে তাদের পিছনে বসেছে, তারা বুঝতে পারেনি। বয়েস চল্লিশ ও হতে পারে আবার পঞ্চাশ ও হতে পারে। চোখে একটা ভারী কাঁচের চশমা। শরীরটা আপদ মস্তক রেইন কোর্টে ঢাকা। লোকটি সম্পর্কে তেমন কিছু বোঝার উপায় নেই। আর একবার হালকা কেশে সে বাংলায় বলল, “বিনোদ বিহারী ভট্টাচার্য কি আপনিই?”

বিনোদ বিহারী হাত জোর করে নমস্কার করে বলল, “কি বিষয় বলুন?”

-“এক বন্ধুর পিণ্ড দিতে চাই। আপনি সাহায্য করবেন?”

-“কি যে বলেন, এটাই তো আমার কাজ। তা কি নাম আপনার বন্ধুর? গোত্র কি জানা আছে? তিন পুরুষের নাম? যেটুকু জানেন বলুন, বাকিটা ঈশ্বরের নামে, , ,”

কথা শেষ করার আগেই লোকটা ইশারায় পাশে সিঁড়ির উপর রাখা একটা খাতা দেখালেন, “এই খাতাতে সব লেখা আছে”।

বিনোদ বিহারী খাতাটা হাতে তুলে নিল। খাতার প্রথম পাতাতে নাম, গোত্র, তিন পুরুষের পরিচয়, কি কি দিয়ে পিণ্ড মাখতে হবে সব কিছু লেখা আছে। খাতার ভিতরে বেশ কয়েকটি টাকার নোটও রয়েছে। বিনোদ বিহারী লোকটার দিকে চোখ তুলতেই সে বলল, ”এই টাকাতে কাজটা হয়ে যাবে তো?”

-“নিশ্চয়ই হবে। আমি সামগ্রী জোগাড় করছি, আপনি ততক্ষণ সরোবরের জলে স্নান করে আসুন। তারপরেই কাজ শুরু করবো”।

-“আমি খুব অসুস্থ, আমার পক্ষে একাজ সম্ভব নয়”; লোকটা যেন ঝিমোচ্ছে।

-“তাহলে কে করবে এই কাজ?”

-“আপনি আর আপনার ছেলেই করে দিন না। বড় উপকার হয়”।

সাধারণত বিনোদ বিহারী কাউকেই ‘না’ বলে না। শেষ কাজে, না বলতে নেই। সে আর একবার খাতাটার উপর চোখ দেয়, মৃতের নাম গোপাল মজুমদার, বাৎস গোত্র। পরিবার পরিচয় পড়তে পড়তে চোখ তুলে লোকটি কে বিনোদ বিহারী প্রশ্ন করল, “আপনার বন্ধুকি অগ্রদানী ব্রাহ্মণ ছিলেন?” লোকটি মাথা নেড়ে কিছু একটা বললেন বটে কিন্ত সেটা হ্যাঁ কি না, ঠিক বোঝা গেল না।“

সামগ্রী জোগাড় করে কিছুক্ষণের মধ্যেই বিনোদ বিহারী আর সুকুমার কাজ শুরু করল। সূর্য আজ সারাদিন আছেন মেঘের আড়ালে তবু সেই সূর্য কে সাক্ষী করেই শুরু হল পিণ্ড দানের কাজ। লোকটা সিঁড়িতে ঠিক একই ভাবে বসে দেখতে লাগলেন সেই কাজ।

যে কোন যজমানকে দিয়ে কাজ করাতে অনেকটা সময় লাগে। কেন না তাদের সবটা বলে বলে দিতে হয়। সুকুমার এখন বেশ কাজ শিখে ফেলেছে। বিনোদ বিহারী শুধু পড়ে পড়ে নাম বলছে বাকিটা করছে সুকুমার নিজেই। একবার চোখ তুলে লোকটিকে দেখল বিনোদ বিহারী। কেমন উদাস ভাবে চেয়ে আছেন সরোবরের দিকে। নিশ্চয়ই প্রিয় বন্ধুকে শেষ বিদায় জানাতে বেদনা হচ্ছে। বিনোদ বিহারী লোকটির বেদনা নিজে অনুভব করার চেষ্টা করে। আর মনে মনে লোকটির জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে প্রার্থনা করে।

দেখতে দেখতে কাজ শেষ হয়। নিয়ম হল, কাজের পরে পিণ্ড, দুধ, কলা সরোবরের জলে বিসর্জন দেওয়া। কখনও কখনও ধর্মের ষাঁড় কলা খেয়ে যায়। আজ বৃষ্টিতে তাদেরও দেখা নেই। কাজের শেষে বড় পাত্রে সরোবর থেকে জল এনে কাজের জায়গাটা ধুয়ে দিতে থাকে সুকুমার। খাতার মধ্যে বেশ অনেকটা টাকা। সামগ্রী কেনার পরেও অনেক টাকা রয়েছে। কিছু টাকা ব্রাহ্মণ সমিতিতে দান করার নিয়ম। সেইটুকু রেখে বাকি টাকা বিনোদ বিহারী ফিরিয়ে দেবে সিদ্ধান্ত নিল। এতে যদি অসুস্থ লোকটার চিকিৎসা হয় তবে মন্দ কি। এই ভেবে পিছন ঘুরে বিনোদ বিহারী দেখল লোকটি হাঁটতে হাঁটতে চলেছেন রাস্তার দিকে।

বিনোদ বিহারী তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উপরের বড় চাতালে উঠে এল। লোকটা ততক্ষণে ছাওনি পার করে বৃষ্টিতে নেমে পড়েছে। তার রেইন কোর্টের উপর শব্দ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। ডেকে উঠল বিনোদ বিহারী, “ও দাদা, আপনার বাকি টাকাটা নিয়ে যান।“ লোকটা পিছন না ঘুরেই বলল, “ওটা আপনার পারিশ্রমিক, রেখে দিন।

-“না না এটা আপনি নিয়ে যান, আপনার চিকিৎসার কাজে লাগবে”। কথাটা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা। কিন্তু পিছন ফিরলো না। শুধু বলল, “ধন্যবাদ; তার দরকার হবেনা।

অবাক হল বিনোদ বিহারী, এমন যজমান সে কোনদিন দেখেনি। শেষ কাজ শেষ করে লোকটা পিছন ফিরতেও রাজি নয়। পরম প্রশান্তিতে বিনোদ বিহারী বলল, “ভাল থাকবেন। আপনার নামটা জানতে পারলে খাতায় লিখে রাখতাম!”

কয়েক মুহূর্ত এই ভাবেই কেটে গেল। কোন উত্তর নেই। তারপর বৃষ্টি ধোয়া চাতালের উপর হঠাৎ খসে পড়ল একটা রেইন কোর্ট আর চশমা। না, তার ভিতরে কোন মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায় নি।
0

ভৌতবাক - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in


ভৌতবাক


সাক্ষাৎকার
দীপারুণ ভট্টাচার্য



দেশ ভাগের সময় আমার পূর্বপুরুষ, পূর্ববঙ্গ থেকে চলে এসেছিলেন কলকাতায়। তাই বর্তমান বাংলাদেশের সঙ্গে আমার সেভাবে যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। বছর কয়েক আগে অফিসের আন্তর্জাতিকব্যবসার দায়িত্ব পেতেই আমার ঘন ঘন বাংলাদেশ যাওয়া শুরু হয়। লতায় পাতায় কিছু সম্পর্ক যে এখনও রয়ে গেছে সেটা আমি অনুভব করেছি সম্প্রতি। একদিন এভাবেই পেলাম এক চাকরি প্রার্থীর ফোন। নিতাইয়ের বয়েস বছর পঁচিশ। বি এ পাস করে বেকার বসে ছিল। বাবার এক দূর সম্পর্কের ভাই রতন কাকার থেকে নিতাই আমার খবর পায়। পরে জানলাম সেও সম্পর্কে আমার ভাই হয়। তার সঙ্গে ফোন কথা বলতে বলতে বাবার মুখে শোনা আনেক গল্প মনে পড়ে গেল। আসলে দেশ ভাগের সময় বাবারা সেই যে কোলকাতায় চলে আসেন, তারপর আর যোগাযোগ নেই। বাবা কেন জানিনা সব ভুলে যেতে চেয়েছিলেন তাই আমাদের ও আর উৎসাহ দেন নি। অথচ ছোটবেলায় গল্প শুনেছি বাবা, রতন কাকা, তপু কাকা সব এক সঙ্গে নিশিনাথ তলার মাঠে ফুটবল খেলেছেন। কেউ কেউ ভাবে দেশ ভাগ বুঝি শুধুমাত্রই রাজনৈতিক। অথচ তার সামাজিক, অর্থনৈতিক, পারিবারিক, এমন কি ব্যক্তিগত প্রভাব কাটিয়েও আমরা উঠতে পারলাম না, এত বছর বাদেও।

যাই হোক, নিতাইয়ের জন্য একটা সামান্য কাজের ব্যাবস্থা হয়ে গেল। আর তাতেই বেশ খুশি সে। নিতাই এখন ল্যান্ডফিলিং সুপারভাইসর। চট্টগ্রামের কাছে মীরসরাই অঞ্চলে সমুদ্রের বালি ভরাট করে এক বিশাল শিল্প তালুক তৈরি হচ্ছে। জায়গাটা আগে ছিল একটা নোনা জলের বিল। জোয়ারের সময় সমুদ্রের জল ঢুকে আসতো আর ভাটায় সময় চররের মতো উঁচু হয়ে যেতো। এখন সমুদ্র থেকে ড্রেজিংকরে বালি এনে জায়গাটা উঁচু করা হচ্ছে। বাংলদেশ সরকারের পরিকল্পনা আছে ওখানে কেমিক্যাল হাব হবে, পাওয়ার প্ল্যান্ট হবে, আরও কত কি। তারই মধ্যে একশো একর জমিতে আমাদের কোম্পানির কাজ চলছে। নিতাই সেখানে থেকে বালি ভরাটের কাজটা দেখা শোনা করছে। 

স্থানীয় কর্মী খালেদ কে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামের এক ইস্পাত কারখানায় এসেছিলাম একটা কাজের ব্যাপারে। হঠাৎ নিতাইয়ের ফোন পেলাম। সে বলল, "দাদা, আপনি তো কাছেই আসছেন, একবার আমারএখান থেকে ঘুরে যান। কিছুদিন হলো এক আত্মার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে।

আপনার বিষয়ে তার সঙ্গে আমার অনেক কথা হয়েছে। সে সব শুনে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেও আগ্রহী।" নিতাইয়ের কথার কোনো উত্তর দিলাম না। শুধু বললাম, "দেখছি, যদি সময় হয়।" তবেমনের ভিতরে এক তীব্র টান অনুভব করলাম। ভূত বা আত্মার সঙ্গে সাক্ষাৎকার, যে সে বিষয় নয়। আমি যে চট্টগ্রামে এসেছি সেটা নিতাইয়ের জানার কথা নয়। তবু জেনেছে। তাই মনে হচ্ছে, বিষয়টা সত্যি হলেও হতে পারে। এই সব ভাবতে লাগলাম।

নিতাইয়ের সঙ্গে আমার আলাপ ফোনে ফোনে। সামনে থেকে তাকে কখনও দেখিনি। খালেদ অবশ্য তাকে ভালো ভাবেই চেনে। তবে কথাটা আমি খালেদার কাছে ভাঙলাম না। বললাম, "কাজ শেষ করেএকবার মীরসরাই ঘুরে তবে হোটেলে যাবো।" খালেদ রাজি হয়ে গেল। আমরা

ফেরার পথে ঢাকা-চট্টগ্রাম বিশ্বরোড ছেড়ে মীরসরাই মোড় থেকে ডানদিকে ঢুকলাম গ্রামের মধ্যে। কিলো মিটার দুয়েক যেতে না যেতেই গ্রামটা শেষ হয়ে গেল। এরপর যতদূর চোখ যায় ধান জমি।বিকেলের রোদে প্রায় পেকে যাওয়া সোনালী ধানের মাঠ দেখে মন ভরে উঠল। এরপর দুই বিলের মধ্যে দিয়ে চলল সরু রাস্তাটা। অপূর্ব শাপলা ও পদ্মের শোভা। এবারে ডানদিকে একটা মোড় ঘুরতেই শুরুহল শিল্প তালুক অঞ্চল। নিশ্চিৎ ভাবে বলতে পারি শিল্প তালুক তৈরির আগে এপথে মানুষের পা পড়েনি একেবারেই।

খালেদ পথ দেখিয়ে নিয়ে এল আমাদের কাজের জায়গাতে। অনেক বড় বড় জমি দেওয়া হয়েছে এক একটা কোম্পানিকে। তারা বালি ভরাট করে এখন জমি প্রস্তুত করছেন। তারপর কারখানা হবে। বছরকয়েক বাদে এ জায়গার পরিবেশ পাল্টে যাবে সম্পূর্ণ। আমাদের জমিতে বিকট শব্দ করে চলছে বিরাট বিরাট যন্ত্রপাতি। গভীর সমুদ্র থেকে বালি এনে স্তরে স্তরে ভরাট হচ্ছে আমাদের ১০০ একর জমি।সময় লাগবে আরও মাস ছয়েক। আশেপাশে নিতাইকে দেখা গেল না। খালেদ একজন বুড়ো মতো লোককে নিতাইয়ের বিষয়ে প্রশ্ন করলো। জায়গাটায় যন্ত্রের শব্দে কান পাতা দায়। বুড়ো লোকটা কি বললকে জানে, তবে আঙ্গুল দিয়ে দূরের পোর্টা কেবিনের দিকে দেখালো। জাহাজে মালপত্র নেওয়ার জন্য বিশাল বিশাল লোহার কন্টেইনার থাকে। সেই কন্টেইনার পুরনো হলে তাকে কেটে দরজা জানালাবানিয়ে দিব্যি একটা বাস যোগ্য ঘর তৈরি হয়। একেই বলে পোর্টা কেবিন। ছয়টা উঁচু কংক্রিটের থামের উপর সেই পোর্টা কেবিন বসিয়ে তৈরি হয়েছে আমাদের অস্থায়ী অফিস। অফিসের পিছনের দিকেএকটা বিশাল জঙ্গল। অন্য কারখানার কাজ চলছে বহু দূরে দূরে।

প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছে। কেবিনের দারজাটা খোলা। ভিতরে গভীর অন্ধকার। খালেদ কেবিনের দরজা কাছে কিছু একটা জিনিসে হোঁচট খায়। নিজেকে বাঁচাতে প্রায় হুমড়ি খেয়ে কেবিনের ভিতরে এসেপড়তে পড়তে সামলে নেয় খালেদ। আমি তাড়াতাড়ি তার হাত ধরলে সে বলে দরজার উপর একটা বেড়াল শুয়ে ছিল। অসতর্ক অবস্থায় বেড়ালের গায়ে পা দিয়ে ফেলেছে সে। অথচ বেড়ালটা চিৎকার করেনি। বিষয়টা আমার খুব সাধারন মনে হলেও খালেদ বেশ অবাক হয়। অন্ধকার ঘরের মধ্যে সে আমাকে ফিস ফিস করে বলে, “নিশ্চয়ই বেড়ালটাকে কেউ বশ করছে”। আমি আমল না দিয়ে এদিক ওদিক দেখতে থাকি। অন্ধকারে বেশি দূর চোখ যায় না।



হঠাৎ কি যেন একটা দেখে খালেদ, "হ্যায় আল্লা” বলে চিৎকার করে ওঠে। তার চিৎকারে আমিও চমকে উঠি। অন্ধকারে যে নিতাই দাঁড়িয়ে আছে সেটা সে বুঝতে পেরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “তুমিএই অন্ধকারে দাঁড়ায় আছো ক্যান? আমি তো ভয় পাইয়া গেছিলাম।" এরপর আমার দিকে ফিরে বলল, "অরুনদা, এই হল নিতাই।" নিতাই আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, "বসেন দাদা, চা দিচ্ছি।" চল্লিশ ফুট কেবিনের একদিকে চেয়ার টেবিল দেওয়া অফিস অন্যদিকে খাট লাগিয়ে শোয়ার ব্যবস্থা। নিতাই বলল, "জেনারেটর টা খারাপ হইসে তো তাই অন্ধকার। মেকানিকআসতেছে।" বুঝলাম জেনারেটর ছাড়া এখানে বিদ্যুৎ নেই। নিতাই একটা ছোট্ট এল ই ডি লাইট জ্বালাল। তার মৃদু আলোয় কেবিনের ভিতরে অস্পষ্ট একটা আলো আলো ভাব হয়েছে। নিতাই ফ্লাস্ক থেকেচা ঢেলে বিস্কুট সহযোগে দিলো আমাদের।

কিভাবে ভূতের প্রসঙ্গে আসবো ভাবছি এমন সময় নামলো প্রবল বৃষ্টি। কেবিনের খোলা দরজার দিকে থেকে ছাঁট এসে আমাদের ভিজিয়ে দিতে লাগল। তখন নিতাই উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।জানালা দিয়ে সুন্দর হওয়া খেলা করছে কেবিনের মধ্যে। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলাম, "তা তোমার সেই আত্মা বন্ধুর কি খবর? তাকে দেখতেই কিন্তু এসেছি।" নিতাই একটু হাসলো। তারপর বলল, “ভালোই করেছেন। আমিও তো অপেক্ষাতেই ছিলাম” । আমার প্রশ্ন শুনে খালেদ হতবাক। তাকে তখন বিষয়টা বুঝিয়ে বললাম। আগে বললে সে যদি না আসে তাই তাকে বলিলি, এটাওজানালাম। কিন্তু দেখলাম উৎসাহ তার কিছু কম নয়। সে বলল, "কি বিষয় নিতাই, খুইলা কন তো।"

নিতাই দুই হাতদিয়ে নিজের চুলের মধ্যে বিলি কেটে বলল, "দিন রাত কাজ হয় তো, তাই এখানেই থাকবো বলে ঠিক করলাম। প্রথম দুই দিন কিছুই টের পাই নাই। তার পরদিন রাত্রে হঠাৎ মনে হলো কেযেন কেবিনের মধ্যে ঘোরা ফেরা করে। দুই দিকের জানালা খোলা থাকলি রাত্রে জেনারেটর লাগে না। তাই টর্চ জ্বালালাম। কিন্তু কেবিনে তো কিছুই নাই! শব্দটা আবার পালাম একটু পরেই। টর্চের আলোয়এবারও কিছু দেখা গেল না। এই রকম কয়েক বার হওয়ার পর আমি ভয়ে চিৎকার করলাম, 'ঘরে কে'? খুট করে একটা শব্দ হল। আর কে যেন গম্ভীর অথচ ফিসফিসে গলায় বলল, 'ভয় নেই। আমিআপনার ক্ষতি করবো না।' সেই গলা শুনে আমি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম।"

আগ্রহ নিয়ে খালেদ বলল, "তারপর"। নিতাই আবার শুরু করলো, "পরদিন রাতে সে আবার এলো। একটু সাহস করে প্রশ্ন করলাম, আপনি কি চান? এক গম্ভীর গলায় জবাব এলো, 'একটু পরিচয় করতেচাই।' আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি কে? উত্তর এল, 'ধরে নিন ভূত, বা আত্মা। তবে একদিন আমি আপনার মতোই মানুষ ছিলাম। তখন আমার নাম ছিল রবার্তো পেতরেচি।' আমি আতঙ্কিত গলায়বললাম, আপনি সাহেব? একটা হাসির শব্দ পালাম। সাহেব বলল, ‘রাগের মাথায় আমি একজনকে গুলি করেছিলাম। ইতালির পুলিশ তখন আমাকে শিকারী কুকুরের মত খুঁজছে। বহু কষ্টে পুলিশের চোখেধুলো দিয়ে আমি কুলি সেজে একটা জাহাজে উঠলাম। সেই জাহাজটা ভাসতে ভাসতে একদিন এই চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছাল। কিছুদিন ভালোই ছিলাম। তারপর মারা গেলাম সাপের কামড়ে।প্রতিবেশীরা এই বিলে একটা ভেলাতে করে আমার লাশটা ভাসিয়ে দিলো। তখন এখানে একটা বিরাট নোনা জলের বিল। বিলের মধ্যে ভাসতে, ভাসতে ভেলাটা এই জঙ্গলের কাছে এসে থামলো। দেহটাপচে গেলে শেষ হয়ে গেল। তখন থেকে আমি এই জঙ্গলেই থাকি। কোথাও যেতে পারিনা, কারও সঙ্গে মিশতে পারিনা। বড় কষ্ট হয়। আপনি এখানে আছেন জেনে গল্প করতে ইচ্ছা করছিল। তাই এলাম।'আমি বললাম, ভালোই তো, আসবেন না হয় মাঝে মাঝে।" 

- "তারপর" আবার প্রশ্ন করল খালেদ।

-"তাই মাঝে মাঝে আসেন, গল্প হয়। একদিন আমাকে বললেন, 'আমাকে কি আপনার দেখতে ইচ্ছা করে না?' আমি বললাম, করে তো। 'তাহলে আলো টা জ্বালান, ভয় পাবেন না কিন্তু।' আলো জ্বেলে তারমুখ দেখে আতঙ্কে চিৎকার করে আমি সেদিনও অজ্ঞান হয়ে গেলাম।"

এবার আমিই প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা আমাদের সঙ্গে এই রবার্তো পেতরেচি'র কি দেখা হবে না?”

নিতাই একটু নড়ে বসল, “নিশ্চয়ই হবে। আপনার সঙ্গে দেখা করতেই তো তিনি আগ্রহী। আসলে চাইলেই তাঁরা আলাদা আলাদা রূপ নিতে পারে কি না! একটা কথা বলি, যদি কোন সময় বুঝতে পারেন সে এসেছে, ভয় পাবেন না। সে কিন্তু খারাপ নয়।“

এবার আমার আশ্চর্য হবার পালা। অবাক হয়ে প্রশ্ন করি, “আমার সঙ্গে দেখা করতে চায় কেন?” নিতাই একটু হাসে। তারপর একটা কাগজ এগিয়ে দেয় আমার দিকে। প্রায় অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারিনা তাতে কি লেখা আছে। আবার প্রশ্ন করতে সে বলে, “পেতরেচি'র ছেলে এখন দিল্লিতে। সে ইতালির হাইকমিশন অফিসে চাকরি করে। তার নাম, টেলিফোন নাম্বার সব এই কাগজে লেখা আছে। আপনিযদি তাকে সব ঘটনা খুলে বলেন; আর সে যদি গীর্জায় গিয়ে বাবার জন্য প্রার্থনা করে….”। 

নিতায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই দারজায় কে যেন বাইরে থেকে ধাক্কা দেয়। বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে অনেক্ষন। কেবেনের ভিতরটা গুমোট হয়ে গেছে। দারজা খুললে হাওয়া আসবে। খালেদ উঠে সে দিকে যেতেই নিতাই গম্ভীর হয়ে বলে, "এখনও দারজা খোলার সময় হয়নি। আপনাদের আর একটু অপেক্ষা করতে হবে।" নিতাইয়ের এই গম্ভীর গলা শুনে খালেদ ভয়ে চেয়ারে বসে পড়ে। কে অপেক্ষা করছে ওই দরজার বাইরে? নিতাই আরও কিছুটা সময় চাইছে কেন? আমার হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে গেছে বুঝতে পারলাম। খালেদের ও নিশ্চয়ই একই অবস্থা। এমন সময় নিতাই আমার দিকে হাত বাড়ায়, করমর্দনের জন্য। আমিও একটা ঘোরের মধ্যে তার হাত ধরি। ঠিক সময় কেবিনের দরজায় বাইরে থেকে আবার ধাক্কা পড়ে। আমরা চমকে উঠি। এবার খুলবো কি খুলবো না এমন যখন ভাবছি তখন মনে হল বহু দূর থেকে একটা কথা ভেসে আসছে, "জাস্ট ওপেন দা ডোর, এবার দারজাটা খুলে দাও।" 

আতঙ্কিত অবস্থায় দরজাটা খুলতেই একটা বেড়ালের চিৎকার কানে এল। আর তখনই আমাদের হতচকিত করে দিয়ে বাইরে থেকে কেবিনে ঢুকে আসে নিতাই নিজেই। আমি পাশের চেয়ারে তাকিয়ে দেখি যার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলাম সেই নিতাই নেই। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠতে যাবো এমন সময় এই নিতাই বলল, “আমি তো জেনারেটরের মিস্তিরি আনতে গিয়ে…” একটু থেমে বলল,”আপনাদের তাহলে দেখা হয়েছে। আমি বিড়ালের চিৎকার থেকেই বুঝেছি। পেতরেচি আসলেই বেড়ালটা কেমন নির্জীব হয়ে যায়। আর সে চলে গেলেই চিৎকার করে”। 

এতক্ষণ তবে কার সঙ্গে কথা হল? কার হাত ধরলাম, আমি? এসব যখন ভাবছি তখন একটা চাপা গোঙানির শব্দ পেলাম। খালেদের বলে উঠল, "অরুণদা আর পারছি না, চলেন হোটেলে ফিরে যাই।"
0

ভৌতবাক - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in

ভৌতবাক


অতৃপ্ত অশরীরি 
দীপারুণ ভট্টাচার্য 


ঘটনাটা ১৯৮৭ সালের। আমি তখন বি এস সি পড়তে ভর্তি হয়েছি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সবে ছেড়ে এসেছি জন্মস্থান, দুর্গাপুর। একটা হোস্টেল বিল্ডিংয়ের মেরামতির কাজ চলছিলো। তাই আমরা বেশ কয়েকজন হোস্টেল পেলাম না। মেরামতি শেষ হলেই হোস্টেল পাওয়া যাবে এমন অঙ্গীকার ছিল। তবে মনে হলো, সেটা চার পাঁচ মাসের ধাক্কা। এই সময়টা বাড়ি ভাড়া নিয়েই থাকতে হবে বাইরে কোথাও। তখন ছোট্ট শান্তিনিকেতন অঞ্চলে এক সঙ্গে এত জন ছাত্র ছাত্রীর জন্য বাড়ি ভাড়া পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। কাজেই শরণার্থীর মতো গাদাগাদি করে থাকতে শুরু করলাম অন্য বন্ধুদের হোস্টেলের ঘরে। 

যাদের যোগাযোগ, বুদ্ধি বা টাকার জোর ছিল, তারা একে একে বাড়ি নিয়ে চলে যেতে লাগলো। শেষ দিকে পড়ে রইলাম আমারাই কয়েকজন বোকা। একদিন হারান একটা বাড়ির সন্ধান আনলো। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খানিকটা দূরে বটে, তবে ভাড়াটা খুব কম। কোনও রকম চিন্তা না করেই আমরা চার বন্ধু মিলে বাড়িটা ভাড়া নিয়ে ফেললাম। 

সেখানে গিয়ে জানলাম, বাড়িটি এক বিখ‍্যাত লেখকের। পাঁচিল ঘেরা যত্নহীন বিরাট এক বাগান। তারই একদিকে একখানা দোতলা বাড়ি, লেখক মাঝে মধ্যে ছুটি কাটাতে এলে এই বাড়িতেই থাকেন। অন্যদিকে মাটি আর ইট দিয়ে গাঁথা একটি বিশাল হল ঘর। চালটা খড়ের বটে, তবে মেঝেটি পাকা। সঙ্গে এ্যটাচড্ বাথ, জল আর ইলেকট্রিকের ব্যবস্থা। আমরা ভাড়া নিয়েছি এই ঘরটা। 

ঘরের পিছনে সাপ খোপে ভরা এক বিশালকায় গর্ত। আরও পেছনে বড় বড় গাছ আর আগাছার জঙ্গল। ত্রিসীমানায় কোন মানুষের অস্তিত্ব নেই। শুধুমাত্র এক আদিবাসী কেয়ারটেকার ছাড়া। সে থাকে দোতলা বাড়ির পেছনের দিকে ছোট্ট একটা কুঠিতে। বড় লেখকদের উপন্যাসের প্লট ভাবতে বুঝি এমনই নির্জনতার প্রয়োজন হয়। 

কেয়ারটেকার রামলালচারটে ফোল্ডিং খাট ঘরটার চারদিকে সেট করে দিয়ে বলল, "যেরকম কইরে দিলাম, এই রকমই রাখবেন বটে। বিছানা লিয়া এদিক ওদিক করবেক লাই বাবুরা।" এমন নির্দেশের কারণ জানতে চাইলে সে খানিকটা আমতা আমতা করে বলল, "সাফাই করতে এসে রোজ বিছানা হ‍্যাঁচড়া হেঁচড়ি করতে পারবোনা বটে।" 

ঘরের একদিকে রান্নার ব্যবস্থা। রাত একটু গড়াতেই আমরা চারজন খাওয়া দাওয়া সেরে, মশারি খাটিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। আকাশ জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডাকছে ঝিঁঝিঁ। বেশ গা ছমছমে পরিবেশ। শুধুই মনে হচ্ছে জানলার বাইরে থেকে যদি কেউ হাত ঢুকিয়ে দেয়! বাবা বলেছিলেন, "ভয় করলেই গুরুমন্ত্র জপ করবি।" আমি, গুরুমন্ত্র জপ করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ হারান ডাকলো, "কিরে, শুনতে পাচ্ছিস?" ধড়মড় করে উঠলাম সবাই। তারপর শুনলাম; সমস্ত ঘর জুড়ে যেন একটা খুড়খুড়, খসখস্ শব্দ। উঠে আলোটা জ্বালতেই শব্দটা মিলিয়ে গেল। অনীক বলল, "ঘরের নিচে নিশ্চই ইঁদুরের গর্ত আছে। সাপে ইঁদুরে মারামারি করে বেড়াচ্ছে। একটা ছোট আলো এনে সারারাত জ্বেলে রাখতে হবে।" 

পরের দিনই একটা নাইট ল‍্যাম্প লাগানো হল। তবে শব্দটা বন্ধ হল না। এক এক দিন মনে হতো কেউ বুঝি হেঁটে হেঁটে ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। খাটের পাশে দাঁড়িয়ে মশারির বাইরে থেকে গভীর মনযোগ দিয়ে দেখছে আমাকে। চোখ খুলে অবশ্য কিছুই খুঁজে পাইনি। এভাবে কিছুদিন চলল। তারপর আমরা চারজনেই এই পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম। বেশ আনন্দেই কাটতে লাগলো সময়। 

দেখতে দেখতে শুরু হল আমাদের প্রথম পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ হলেই যাবো বাড়ি আর ফিরে এসেই পেয়ে যাবো হোস্টেল। আমি একা অংকের ছাত্র। বাকিদের বিষয় আলাদা। তাই তাদের পরীক্ষা শেষ হতেই তারা একে একে পালাল। এমন পরিস্থিতি হল যে, এই বাড়িতে আমাকে একাই থাকতে হবে দিন পাঁচেক। হোস্টেলে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে থাকা যায় বটে, কিন্তু সেই ফাঁকে যদি জিনিস পত্র চুরি হয়ে যায়! তাই হোস্টেলের দুই বন্ধুকেই রাজি করলাম আমার সঙ্গে এসে থাকার জন্য। তারা এসে একটা রাত রইল। পরদিন সকালে উঠে দেখি একটা বিছানায় তারা দুজনে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে আর ভয়ে কাঁপছে। রাতে ঘরের মধ্যে তারা কি যেন দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছে। সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। গলা দিয়ে আওয়াজ করে আমাকে ডাকতেও পারেনি। তাদের আর ধরে রাখা গেল না। ঘটনাটা মুহূর্তে রটে গেল। কাজেই আর কেউ আমার সঙ্গে এসে রাত কাটাতে রাজি হলো না। অগত্যা একাই রইলাম বাকি দিনগুলো। 

নির্বিঘ্নেই কাটলো দুটো দিন। কোথাও যাওয়ার নেই। সারাদিন পড়াশুনা, খাওয়া আর ঘুম। বলতে নেই, পড়াশুনাতে আমি ভালোই ছিলাম। মোটে একটা পেপার বাকি। আমি তখন পরীক্ষার জন্য সম্পূর্ণ তৈরি। দুটো রাত কাটলেই পরীক্ষা আর তারপরই দুর্গাপুর ফেরা। মনে বেশ একটা আনন্দের ভাব। সমস্যা ছিল শুধুমাত্র আবহাওয়া। সেবার গরম ছিল মারাত্মক। এতটুকু বৃষ্টি নেই। ঘেমে ঘেমে শরীর অতিষ্ঠ। হঠাৎ মনে হল খাটটা টেনে দুই জানলার মাঝখানে রাখলে একটু বেশিই হওয়া আসবে। তাই করলাম। খাওয়া শেষ করে খাটে বসে পুরনো নোট্সগুলো উল্টে পাল্টে দেখছি, এমন সময় হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন আমার পিছনে এসে বসলো। পিছন ফিরে তাকাতেই ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। যাঃ, লোডশেডিং। টর্চ জ্বেলে অবশ্য কিছুই দেখতে পেলাম না। বাইরে বেরিয়ে এলাম। চাঁদের আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। একটু দাঁড়িয়ে সেই পরিবেশ উপভোগ করছি, এমন সময় আলো এসে গেল। ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে খড়ের চালের কালো কালো বাটামের সংখ্যা গুনতে লাগলাম। তখন ঘরে জ্বলছে সেই নাইট বাল্বটা। কোথায় যেন খসখস করে খানিকটা শব্দ হলো। হঠাৎ দেখলাম একটা কালো ধোঁয়ার মত কুণ্ডলী ঘুরছে মাথার ওপরে। সেটা যে ঠিক কি তা বোঝার আগেই ধোঁয়ার কুণ্ডলী বেশ বড়ো আকৃতি ধারণ করে আমার বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ওপর থেকে মানুষ যে ভাবে লাফিয়ে পড়ে ঠিক সেই ভাবেই। ছায়া মূর্তির এই অপ্রত্যাশিত আক্রমণে আমি তখন হতবাক; কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মুহূর্তের মধ্যে শরীর আমার ঠাণ্ডা বরফ হয়ে গেল। কানের মধ্যে ভোঁভোঁ শব্দ হচ্ছে। আর চোখের সামনে দেখছি ঘন কালো একটা ধোঁয়ার মতো একটা মানব আকৃতি আমার বুকের উপর বসে আছে। তার উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে আমার মুখ পুড়ে যাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছি তার চোখে জ্বলছে ঘৃণার আগুন। সে প্রথমে আমার মুখে তিন চারটে ঘুষি মারার চেষ্টা করল। আমার মাথাটা এদিকে ওদিকে দুলে উঠলো প্রচণ্ড জোরে। তারপর ছায়ামূর্তি আমার গলা টিপে শ্বাস বন্ধ করার চেষ্টা করতে লাগলো। কি প্রবল তার আক্রোশ। খাটটা পর্যন্ত শব্দ করে দুলে উঠলো। তাক থেকে পড়ে গেল বাসনপত্র। শ্বাস বন্ধ অবস্থায় কিছুক্ষণ থাকতেই আমার পা দুটো ছটফট করতে লাগলো। আমি বুঝতে পারলাম আমার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসতে লাগলো শরীর। এবার ছায়ামূর্তি তার হাতের জোর বাড়াল। আমি বুঝতে পারলাম আমার শেষ মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে। এক শান্ত অনাবিল পুকুরে আমি যেন ক্রমশ ডুবে যাচ্ছি। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল পরিচিত মুখ গুলি। প্রথমে মায়ের শান্ত মুখচ্ছবি। তারপরেই এলেন বাবা। আর তখনই মনে পড়ল বাবার নির্দেশ। শেষ প্রাণশক্তিটুকু দিয়ে আমি মনে মনে গুরুমন্ত্র জপ করতে লাগলাম। আর তারপরই ক্রমশ আলগা হতে থাকলো গলার চাপটা। একটু শক্তি ফিরে পেয়েই আমি তেড়েফুঁড়ে উঠতে গেলাম। যেন এক অসীম শক্তিশালী প্রেতাত্মাকে সম্মুখ সমরে আহ্বান করছে এক তরুণ বাঙালি। এমন সময় ধোঁয়ার মূর্তিটিকে লাথি মারবো বলে যেই না পা ছুঁড়েছি সঙ্গে সঙ্গেই বোম ফাটার মতো ফেটে ছিটকে অদৃশ্য হয়ে গেল সেই ছায়ামূর্তি। বাকি রাতটা কিছুতেই ঘুমাতে পারলাম না। সকালেই ঠিক করলাম, আজ থেকে হোস্টেলেই থাকবো। এখানে আর থাকা সম্ভব নয়। 

কথাটা রামলালকে বলতেই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "চৈলে যাবেন বাবু। আপনারা থাকলে মনডা ভালো থায়ে।" আমি তখন রাগে ফুসছি। 

হুমকির স্বরে রামলালকে বললাম, "না, যাবে না! এখানে কি শহীদ হতে এসেছি! ঘরের মধ্যে ভূত পুষে তুমি মানুষ মারার কল পেতেছো। আগে জানলে এই ঘর কখনোই ভাড়া নিতাম না!" 

রামলাল ঘরে ঢুকে খাট সরিয়েছি দেখে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। কাঁদো কাঁদো গলায় সে বলল, "আপনি বাঁচি গেছেন বাবু"। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। পরে মনে পড়ল রামলালের সেই সাবধান বাণী, খাট সরাবেন না। কিন্তু কেন? আসল কথাটা কি? সে যা বলল তার মর্মার্থ হলো; বিশ্বভারতী কলাভবনের দুই তরুণ ও তরুণী কয়েক বছর আগে বাড়ির অমতে বিয়ে করে এই বাড়িটি ভাড়া নিয়ে সংসার পেতেছিলো। প্রথমে সব ঠিক থাকলেও পরে সেই তরুণীর সঙ্গে অন্য এক তরুণের প্রেম হয়। কিছুদিন পর মেয়েটি হঠাৎ একদিন তার প্রেমিকের সঙ্গে উধাও হয়ে যায়। ঘটনাটা জানাজানি হতেই মেয়েটির স্বামী গলায় দড়ি দেয়। গতরাতে যেখানে আমি খাট রেখেছিলাম, ঠিক তার উপরের বাটামের থেকে ঝুলছিলো তার নিষ্প্রাণ দেহটা। 

দেখতে দেখতে তিন দশক কেটে গেছে। বাড়ির মালিক, স্বনামধন্য সেই লেখক দেহ রেখেছেন অনেকদিন আগেই। আজ সকালের খবরের কাগজে পড়লাম সে বাড়ি ভেঙে তৈরি হচ্ছে বহুতল। হঠাৎ মনটা খারাপ হয়ে গেল, এক অতৃপ্ত অশরীরির গৃহহীন হওয়ার আশঙ্কায়। 


(নোট: সত্যি ঘটনা অবলম্বনে। অভিজ্ঞতা:আশীষ কুমার সামন্ত। ছবি: সোময়েত্রী ভট্টাচার্য।)
0

ভৌতবাক - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in


ভৌতবাক


শিশির বাবুর গল্প
দীপারুণ ভট্টাচার্য


স্ত্রীর মৃত্যুর পর একা একা কলকাতায় থাকতে কিছুতেই মন চাইলো না শিশিরবাবুর। ছেলে চাকরি করে দিল্লিতে। তাছাড়া জুটমিলেও নিত্যদিনের অশান্তি। তাই চাকরি বদলে এক সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে কাজ নিয়ে শিশিরবাবু চলে এলেন রাজস্থানের যোদপুর জেলার মাথানিয়া গ্রামে।

এখানে মাইলের পর মাইল বালি আর পাথুরে জমি। তার উপরে এদিকে ওদিকে কাঁটা ঝোপ আর ফণীমনসার গাছ। যেখানে পাথর নেই সেখানে কিছু কিছু চাষ হয়। সেই জায়গাগুলোতেই গড়ে উঠেছে ছোটো ছোটো গ্রাম। দিনের বেলা প্রবল গরম হলেও রাতে বেশ ঠাণ্ডা এখানে। এখানে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের বেশ রমরমা। 

শিশিরবাবু যেখানে কাজ নিয়েছেন সেটিও মরুভূমির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক বিদ্যুৎ প্রকল্প। প্রায় চল্লিশ একর জমিতে একের পর এক লাগানো রয়েছে সোলার প্যানেল। দিনের বেলা সূর্যের আলো পড়তেই সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়। সন্ধেবেলা আপনা আপনি বন্ধও হয়ে যায়। 

এখানে কর্মী বলতে ইঞ্জিনিয়ার রামশরণ, শিশিরবাবু আর বৃদ্ধ চৌকিদার, প্রফুল্ল। গেটের পাশে প্রফুল্লের ঘর। এসব অঞ্চলে চুরি আদৌ নেই। লোকে নিশ্চিতে ঘরের দরজা খুলে ঘুমায়। তাই প্রফুল্লের বিশেষ কাজ নেই। স্থানীয় এক গ্রামে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন শিশির আর রামশরণ। রামশরণের কাজ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের হিসেব রাখা, রিপোর্ট দেওয়া এবং যন্ত্রপাতির দেখভাল। সে সকাল আটটা থেকে সন্ধে ছয়টা পর্যন্ত কাজ করে। শিশিরবাবুর কাজ হল রাতের বেলায়। সোলার প্যানেলগুলোকে নিয়মিতভাবে মুছে পরিষ্কার করতে হয়। নইলে উৎপাদন কমে যায়। দিনের প্রবল গরমে কাজটা অত্যন্ত কঠিন। কাজ হয় রাত্রিবেলা। আশপাশের গ্রামের কিছু প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত লোক কাজটা করে। এই কাজের দেখভালের ভার শিশিরবাবুর উপর। 

তিনি সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে থাকেন আর রাতের অন্ধকারে প্রকল্পের এদিক ওদিক ঘুরে সাফাই তদারকি করেন। ঘুম পেলে কন্ট্রোল রুমের বেঞ্চের উপর বিশ্রাম নিয়ে নেন। কাজটা মন্দ নয়। তবে সমস্যা হল কথাবার্তা বলা। জুটমিলে সারাদিনে কত লোকের সঙ্গে বকতে হতো। বাড়ি ফিরে পাড়া প্রতিবেশী থেকে শুরু করে ক্লাবের আড্ডা। কথা বলার লোককি কম ছিল। শিশিরবাবু ছিলেন ভূতের গল্প বলার স্পেসালিষ্ট। অন্ধকার ক্লাব ঘরে তার ভূতের গল্প শুনতে শুনতে কতজন যে ভিরমি খেয়েছে! এখানে তাই কথা না বলতে পারে তিনি কষ্ট পান।

আজ শিশিরবাবু এলেন সন্ধে ছয়টায়। একটু পড়ে রামশরণ বিদায় নিল। প্রফুল্লও তার ছোট্ট ঘরে গিয়ে রান্নার কাজে মন দিলো। সূর্য ডুবে যেতেই যান্ত্রিক শব্দ ক্রমে বন্ধ হয়ে এলো। শিশিরবাবু কন্ট্রোল রুমের আলো জ্বেলে একটা পত্রিকার পাতায় চোখ রাখতেই মেঘের গর্জন শুনতে পেলেন। এই মরুভূমি অঞ্চলে বছরে কয়েকদিনই মাত্র বৃষ্টি হয়। একটা সিগারেট ধরিয়ে জানলায় দাঁড়াতেই ঝম ঝম করে বৃষ্টি নেমে পড়ল। আজ আর সাফাইওয়ালারা আসবে না। প্রয়োজন ও নেই। বৃষ্টিতেই সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে। খানিক পরে রাতের খাওয়া শেষ করে শিশিরবাবুও বেঞ্চের উপর লম্বা হলেন। দিনে ঘুমিয়েছিলেন বটে তবুও তার চোখ লেগে এল। 

যখন ঘুম ভাঙল তখন রাত প্রায় তিনটে বাজে। বাইরের হালকা জোৎসায় বেরিয়ে এলেন শিশিরবাবু। বেশ সুন্দর একটা হওয়া চলছে। ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ আসছে এদিক ওদিক থেকে। স্বভাব বসত একটা সিগারেট ধরিয়ে অন্য দিনের মতোই তিনি হাঁটতে শুরু করলেন সোলার প্যানেলের মধ্যে দিয়ে। হঠাৎ তার চোখে পড়লো এক জায়গায় কয়েক জন যেন বসে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছে। শিশিরবাবু মোটামুটি হিন্দি জানেন। সিগারেটের শেষ অংশটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ভাঙা হিন্দিতে শিশিরবাবু বললেন, "তোদের কাজতো সব উপরওয়ালাই করে দিলো। তা তোরা এখানে বসে গুলতানি করছিস কেন? ঘরে শুয়ে ঘুমালেই তো পারতিস।" লোক গুলো কেবল একটু হাসল। শিশিরবাবু আবার বললেন, "বুঝেছি, তোদেরও আমার মতোই রাত জাগা অভ্যাস হয়ে গেছে, তাই না।" আবার হালকা হাসির শব্দ শোনা গেল। শিশিরবাবু একটা পাথরের উপর বসে বললেন, "তোদের তাহলে একটা গল্পই শোনাই। শুনবি?" এবার মূর্তিগুলো একটু নড়ে চড়ে বসল। যেন তারা শিশিরবাবুকে ঘিরেই বসেছে গল্প শোনার লোভে। অন্ধকারের মধ্যে কয়েকটা অন্ধকারের দলা যেন আর এক অন্ধকারকে ঘিরে বসে আছে।

শিশিরবাবু গল্প শুরু করলেন, "তখন জুটমিলের চাকরি। একরাতে হঠাৎ যান্ত্রিক গোলমালের কাজ বন্ধ হয়ে গেল। কর্মীদের মধ্যে অনেকেই বাড়ি চলে গেল। আমার বাড়ি অনেক দূরে, তাই ভাবলাম ভোরের ট্রেন ধরেই ফিরবো। হাতে খানিকটা সময় ছিলো। জুটমিলে পাশেই বয়ে চলেছে গঙ্গা। ভাবলাম বাকি রাতটুকু গঙ্গার ধারে বসে হওয়া খেয়েই কাটিয়ে দেওয়া যাক। একটা বেঞ্চে বসে সুন্দর সময় কেটে যেতে লাগলো। হঠাৎ দেখলাম গঙ্গায় একটা লোক ডিঙ্গি নৌকো নিয়ে মাছ ধরছে। মনে মনে ভাবলাম যদি কিছু তাজা মাছ লোকটার থেকে কিনে নিতে পারি তবে বাড়ি গেলে বউ দারুন খুশি হবে। পাড়ে গিয়ে একটা ডাক দিলাম, ও মাঝি ভাই মাছ বেচবে নাকি? লোকটা পাশের একটা ঘাটের দিকে আঙ্গুল দেখালো। যেন আমাকে ওই ঘাটেই যেতে বলছে সে। আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধীরে ধীরে সেই ঘাটের দিকে এগিয়ে গেলাম। লোকটাও নৌকা নিয়ে আসতে লাগলো সেই দিকেই।

খানিকটা কাছে আসতেই দেখলাম তার ডিঙ্গি নৌক মাছে মাছে একদম ভরে গেছে। মাছ গুলোর উপর চাঁদের হালকা আলো পড়েছে। গলুইয়ের ভিতর থেকে সেই আভাই ঠিকরে পড়ছে চারিদিকে। নৌকা কাছে আসতেই মাঝি দুটো মাছ আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি মাছ দুটোকে সাবধানে ডাঙ্গায় রেখে টাকা এগিয়ে দিলাম। কিন্তু কি আশ্চর্য লোকটা টাকা নিলো না। উল্টে আমার হাতটা ধরে বসল। তারপর আমার হাতের উপর হালকা ভাবে হাত বোলাতে লাগল। আমার সমস্ত গায়ে তখন রোমাঞ্চ খেলে যাচ্ছে। শরীরের রোম একে একে খাড়া হয়ে উঠেছে। কি এক অনির্বচনীয় উত্তেজনা যেন আমাকে ডাকছে নৌকোর দিকে। আমি এক পা এক পা করে নৌকোর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। আর সেই মাঝিও আমাকে হাত ধরে টানতে লাগল। এভাবে কতক্ষন ছিলাম জানিনা। হঠাৎ, 'চলে আয়' বলে মাঝি আমাকে এক হ্যাঁচকা টান দিল। আর সঙ্গে সঙ্গেই শুনলাম অনেক লোকের চিৎকার। জুটমিলের শ্রমিকরা ততক্ষনে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমায় তুলে আনতে। দেখলাম আমি গঙ্গায় হাবুডুবু খাচ্ছি। আমাকে পাড়ে এনে তুলতেই মূর্ছা গেলাম। 

পরে সুস্থ হয়ে শুনেছিলাম গঙ্গার ওই অঞ্চলে এক মেছো ভূত নাকি এমন ভাবেই লোককে মাছের লোভ দেখিয়ে ডুবিয়ে মারার চেষ্টা করে।"

এই পর্যন্ত বলে থামলেন শিশিরবাবু। তখন সবে ভোর হচ্ছে। একটু রহস্যময় হেসে শিশিরবাবু বললেন, "গল্পটা কেমন লাগলো তোদের?" আবার একটা নড়াচড়া উঠলো শ্রোতাদের মধ্যে। উঠল একটা মিহি হাসির শব্দ। একজন একটু নাকে নাকে বলল, "বাঙালি স্বজাতির গল্প শুনে ভালোই কাটলো সময়টা।" এরপর শ্রোতারা বেশ শব্দ করেই হাসতে লাগল আর একে একে অদৃশ্য হয়ে গেল। শিশিরবাবুর হাত থেকে সিগারেট আর দেশলাই পড়ে গেল। তিনি এবার সত্যি সত্যিই মূর্ছা গেলেন।
0

ভৌতবাক - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in


ভৌতবাক


পদ্মার ফেরি
দীপারুণ ভট্টাচার্য


ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্থল পথের চেকপোস্ট গুলোর মধ্যে বেনাপোল বর্ডারটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আন্তর্জাতিক এই চেকপোস্টটি শুধুমাত্র দিনের বেলায় খোলা থাকে। সন্ধের পর বর্ডার সিল করে দেওয়া হয়। শেষ বেলায় খানিকটা হৈচৈ দেখা যায় প্রতিদিনই। তারপর ধীরে ধীরে নিশ্চুপ হয়ে আসে দুই দেশের চেকপোস্ট সংলগ্ন বাজার, দোকান, দালাল ঘর, মালপত্র ওঠা নামার শব্দ । কাস্টমস কর্তৃপক্ষ অফিস ছুটি করতেই অঞ্চলটা ঝুপ করে ঘুমিয়ে পড়ে। কোলকাতার শাড়ি ব্যবসায়ী বছর ত্রিশের পার্থ রায় এই পথে মাঝে মধ্যে ঢাকায় যায় জামদানি, টাঙ্গাইল আনতে। শিয়ালদহ থেকে দুপুরের লোকাল ট্রেন ধরে প্রতিবার সে শেষ বেলাতেই বর্ডার পার করে। তারপর বেনাপোল থেকে সন্ধে সাতটার শেষ বাসটা ধরলে ঢাকা পৌঁছে যায় ভোর বেলা। পরিকল্পনা মতই হয় প্রতিবার। তবে আজ হিসাবটা মিলবে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। প্রতিবার মাঝরাতের অন্ধকারে বাস ফেরিতে চড়ে পার হয় পদ্মা নদী। আজ বাস ফেরিতে উঠতেই পার্থ জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। মনে হচ্ছে একটা হালকা কুয়াশা বাইরে। দূরের প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একটু পরে ফেরি ছাড়তেই একটা সিগারেট ধরিয়ে পার্থ সবচেয়ে উপরের ডেকে উঠে আসে। শেষ ডিসেম্বরের ঠান্ডায় উপরের এই ডেকটা আজ সম্পূর্ণ ফাঁকা। বাল্বের হলুদ আলোটা মিটমিট করে জ্বলছে। পার্থ চেয়ারে বসে ধোঁয়া ছাড়তে থাকে।


একটু দূরেই একজন লোক চেয়ারে বসে আছে। লোকটার সর্বাঙ্গ একটা চাদরে ঢাকা। মুখটাও অস্পষ্ট লাগছে এই হালকা আলোতে। ডেকের ঠিক মাঝখানের জায়গাটায় নামাজ পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে কে যেন একজন লোক শুয়ে ঘুমাচ্ছে। এছাড়া আর কেউ নেই এখানে। একে ঠান্ডা তার উপর অমাবশ্যার রাত, পরিবেশটা কেমন যেন থমথমে। দুপুরে স্টেশন থেকে পার্থ একটা কাগজ কিনেছিল। রবিবাসরীয়তে আজ একটা ভুতের গল্প ছেপেছে। ভুতের গল্প পার্থকে খুব টানে। সিগারেট ফেলে দিয়ে সেই গল্পটাই পড়বে বলে কাগজটা খুলে ধরলো পার্থ। নাঃ এত কম আলোয় ছাপার ছোট অক্ষর গুলো পড়া সম্ভব নয়। কাগজটা আবার গুটিয়ে দূরের অন্ধকারের দিকে তাকাল পার্থ। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধুমাত্র অন্ধকার চিরে একটা একঘেয়ে ধাতব শব্দ ভেসে আসছে, একটানা। পদ্মা ব্রিজের কাজ চলছে। একদিন হয়তো এই ফেরি পারাপার বন্ধ হয়ে যাবে।


দুইবার হুইসেল দিয়ে ফেরিটা গতি বাড়াল। একটু পরে, সামান্য কেশে সেই চাদর জড়ানো লোকটা বলল, "দাদা কি ইন্ডিয়ার?" একটু আশ্চর্য হল পার্থ। তবে কি এই লোকটাও তারই বাসে এসেছে? কোনো উত্তর দিলো না পার্থ। খানিকটা পরে আবার প্রশ্ন এলো, "অন্ধকারে পড়লে চোখে চাপ পড়ে। তা, দাদা কি ভুতের গল্প পড়তে পছন্দ করেন?"
পার্থ নিশ্চিত হয় লোকটা তার সঙ্গে একই বাসে এসেছে। নাহলে আর সে জানবে কি করে যে পার্থ বাসের মধ্যে অন্ধকারে গল্পটা পড়তে পারেনি বলেই উপরের ডেকে উঠে এসেছে! পার্থ একটু হেসে বলল, "মন্দ কি!"
খুনখুন শব্দে একটা হাসি শোনা গেল। লোকটা বলল, "ভুত দেখেছেন কখনো? কিংবা দেখার ইচ্ছা আছে?" এমন একটা অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে পার্থ একটু অবাকই হল। তবে বাচাল লোক সে বড় একটা পছন্দ করে না। লোকটার কথায় এমন একটা ভাব যেন চাদরের তলায় সে ভুত ধরে রেখেছে, চাইলেই বার করে দেবে। কাজেই একটু কৌতুক করে পার্থ বলল, "সম্ভব হলে দেখান। ভুত দেখে চোখ দুটো সার্থক করি।"
তার কথা শুনে নড়ে বসল চাদর মুড়ি লোকটা। বলল, "বেশ সাহস দেখছি আপনার!" লোকটার ঘড়ঘড়ে গলার মধ্যে থেকে হাপানির টানের মতো একটা শব্দ বের হল।


পার্থ উত্তর না দেওয়ায় কথা এগোয় না আর। বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ কাটতে থাকে সময়। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ফেরিটা থেমে যায়। ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে চারিদিক। পাড়ের আলো, গ্রাম বা অপর দিকের ফেরি, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এমন হলে দাঁড়াতেই হয়। 
ডেকের মেঝেতে শুয়ে থাকা লোকটার দিকে এবার তাকায় পার্থ। অস্পষ্ট আলোয় মনে হচ্ছে কম্বল বা চাদরহীন গায়ে দিব্যি ঘুমাচ্ছে লোকটা। অথচ কি প্রবল ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে ডেকে। বেশ অবাক হয়ে পার্থ বলেই ফেলল "মানুষ, ঘুমোতে পারেও বটে!" তার কথাটা শুনে হালকা কেশে পাশের লোকটা ছড়া কেটে উঠল, "ঘুম মৃত্যুর জমজ ভাই/ তার সাথে ভাব করিস নে"। গলায় মাফলারটা শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে পার্থ বলল, "আপনি নিজে কখনও ভুত দেখেছেন?"


এবার যেন লোকটা ফিক করে একটু হাসল। তারপর বলল, "অনেকদিন ধরেই দেখছি তাকে। একবার ইদারায় প্রায় ঠেলেই ফেলে দিচ্ছিল আমাকে। আর সেবার পুকুরে সে আমারে টেনে নিয়ে যেতো; নেহাৎ ভাগ্য ভাল ছিলো! তখনই সাবধান করেছিল, পুকুরে পারলাম না, একদিন নদীতে…" কথাটা শেষ না করেই কেমন অদ্ভুত ভাবে হাসতে থাকে লোকটা। মুখ ফসকে একটা প্রশ্ন করে ফেলে পার্থ, "আচ্ছা, ভুতরা কি খুব বিচ্ছিরি দেখতে হয়?" প্রশ্ন শুনে লোকটা হিসহিসিয়ে বলে ওঠে, "মানুষের কল্পনায় ভুতের যে মুখ গুলো আসে, সত্যি বলতে আসল ভুতের চেহারার সঙ্গে তার কোন মিল নেই। অন্ততঃ আমি যাদের দেখেছি তারা সবাই ঐ সব ছবির থেকে সুন্দর।"


-"তার মানে আমাদের কল্পনা সম্পূর্ণই ভুল, তাই বলছেন কি?"


- "না তা নয়। তবে কিছু দেখে তবেই সেই রকম কিছুকে সঠিক ভাবে কল্পনা করা যায়! কিন্তু সমস্যা হল, যারা ভুতের গল্প লেখে তারা নিজেরাই ভুত দেখেনি। বিশ্বাস ও করে না। লিখতে হবে তাই লেখে। আর এই সব পড়েই আপনার মতো লোকেরা ভুতের চেহারা সম্পর্কে ধারনা করেন, তাই না?" কথাটা বলে একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে লোকটা আবার বলে, "আপনি দেখবেন নাকি? একটা আসল ভূত? ভুত দেখা কিন্তু ভাগ্যের ব্যাপার!"


ঝাঁকুনি দিয়ে আবার ফেরিটা চলতে শুরু করে। পূবদিকের আকাশটা একটু যেন হালকা হতে শুরু করেছে। ফজরের নামাজের সময় হয়ে আসছে। চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে পার্থ। কোন উত্তর না পেয়ে লোকটা আবার বলে ওঠে, "ভুত দেখবেন কি না বললেন না তো। সময় কিন্তু খুব কমে আসছে।" লোকটার কথায় এবার একটু মজাই পায় পার্থ, "কে দেখাবে; আপনি?" লোকটা গম্ভীর গলায় খুকখুক করে দুবার কেশে নিয়ে বলে, "নিশ্চই। তবে, তার আগে তো জানতে হবে, ভুত কি জিনিস!"


একটু অবাক হয়ে পার্থ বলে, "মানে?"
লোকটার গলা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলে, "মৃত্যুর পর আত্মা ধীরে ধীরে অশরীরী হয়ে যায়। এই সময় কখনও কখনও সে অবলম্বন খোঁজে!"


- "অবলম্বন, মানে?" পার্থ কথার মাঝেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয়। আর সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দেয় লোকটা, "এই যেমন, এখন আপনি! সবাই কি আর নিজে নিজে মুক্তি পায়!" 


ঠিক এমন সময় দুইজন নামাজী লোক ডেকে উঠে আসে। একজন নামাজী শুয়ে থাকা লোকটাকে দেখেই একটা দমফাটা চিৎকার করে ওঠে, "হে আল্লা, খুন"। চিৎকার শুনে তাকায় পার্থ। ডেকের মৃদু আলোয় এবারে শুয়ে থাকা লোকটাকে কিছুটা অস্পষ্ট হলেও দেখে বুঝতে পারে আর শরীরের মধ্যে কাঁপুনি অনুভব করে, লোকটার বুকে একটা ছুরি গাঁথা। পার্থ এবারে চিৎকার করে ওঠে, "আমি জানি খুনী কে?" তারপর তাকায় চাদর ঢাকা লোকটার দিকে , "খুনী …এ-এই যে"; বলে এক ঝটকায় চাদরে টান দিতেই দেখে চেয়ার সম্পূর্ণ শূণ্য। হঠাৎ মাথাটা ঘুরতে থাকে পার্থর। জ্ঞান হারাবার মুহূর্তে সে শুনতে পায় একজন নামাজী বলছেন, "ধরেন, ধরেন, লোকটারে ধরেন।"
----
(চিত্র: সোময়েত্রী ভট্টাচার্য)
2

ভৌতবাক - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in


ভৌতবাক


ভবানী বুড়ি
দীপারুণ ভট্টাচার্য


সন্ধের পর জায়গাটা একটু শান্ত হয়ে আসে। আজ অবশ্য বেশ রাতই হয়ে গেছে। সুকান্ত যেখানে বাস থেকে নামে সেই জায়গাটার নাম তেঁতুলতলা। বুড়ি গঙ্গা নদী পেরিয়ে ঢাকার এপারের জনবসতি। আগে সে ঢাকাতেই বাসা ভাড়া করে থাকতো। মা মারা গেছেন বছর তিনেক হলো। বাবাও চলে গেলেন গতবছরের শীতে। মৃত্যুর আগে বাবা তার শেষ সম্বলটুকু দিয়ে তেঁতুলতলার এই জমি কিনেছিলেন। বাবার ইচ্ছা ছিল গ্রামের মতোই একটা ছোট বাড়ি হোক। ছোট পরিচ্ছন্ন উঠান, তুলসী মঞ্চ, পাতকুয়ো থাকুক। থাকুক একফালি বাগানে বেল, করবী, জবা, উচ্ছের চারাটা। কিন্তু বাড়িটা শেষ হওয়ার আগেই বাবা চলে গেলেন। তাই বাড়ি শেষ হওয়ার পর সুকান্ত আর ঢাকার ভাড়া বাড়িতে থাকেনি। স্ত্রী ছন্দাকে নিয়ে চলে এসেছে এই তেঁতুল তলায়। কিছুদিন হলো ছন্দা গেছে বাপের বাড়ি রংপুরে। সুকান্ত এখন একা। তাই অফিস থেকেও দেরীতে বাড়ি ফিরছে আজকাল। হোটেলে দুটো খেয়ে বাড়ির খাটে পিঠটান দিয়ে আরামের ঘুম। 

বাস থেকে নেমে চারদিকটা কেমন অন্ধকার লাগে সুকান্তর। এখানে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঢাকা থেকে অনেক বেশি। রাস্তার পাশের চায়ের দোকান গুলোও বন্ধ। সন্ধের দিকে বেশ খানিকটা বৃষ্টি হয়েছে। সোজা পথে যেতে সুকান্তর প্রায় দশ মিনিট হাঁটতে হবে। মাঠের মধ্যে দিয়ে কোনাকুনি গেলে অবশ্য পাঁচ মিনিট। তবে এপথে একটা পুরনো কবরখানা পড়ে।

সুকান্ত আজ মাঠের রাস্তা নিলো। তাড়াতাড়ি গিয়ে শুতে পারলে সে বাঁচে। বড়ই ক্লান্ত লাগছে। মাঠের পথে মিনিট খানেক যাওয়ার পরই বুঝলো সে ভুল করেছে। একে তো ঘুটঘুটে অন্ধকার, তার উপর পথে বেশ কাদা হয়েছে। ধীরে ধীরে চলতে লাগল সে। মোবাইলের আলোয় খুব ভাল ঠাহর হচ্ছে না। চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ, ব্যাঙের ডাক আর দূরে কুকুরের আওয়াজ। সুকান্ত এক হাতে ব্যাগটা শক্ত করে ধরে। অন্যহাতে মোবাইলের আলোতে পথ দেখার চেষ্টা করে। এই কাদা রাস্তায় সাপের দংশন খুব বিচিত্র নয়। কোন রকমে কবরখানার কাছে পৌঁছে যায় সুকান্ত। এমন সময় হঠাৎ দপ দপ করতে করতে বন্ধ হয়ে যায় মোবাইল টা। এবার সম্পূর্ণ অন্ধকার। মরা চাঁদের আলোয় যতটুকু যা ঠাহর হচ্ছে। হঠাৎ কলার খোসা গোছের কিছুতে পিছলে যায় সুকান্ত। পড়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে মনে হয় কে যেন তার হাতটা ধরে ফেলল। অবলম্বন পেয়ে সুকান্ত সামলে নেয়। কিন্তু আশেপাশে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কেউ পাশে আছে বলেও মনে হচ্ছেনা। কেমন একটা ভয় এক মুহূর্তে গ্রাস করে তাকে। হৃদকম্পন বেড়ে যায় দু-গুণ। কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। মনকে প্রস্তুত করে আবার চলতে শুরু করে সুকান্ত। দুপা যেতেই অন্ধকারে কার সঙ্গে যেন ধাক্কা খায় এবারে। কিন্তু শব্দ করতে পারেনা। চাঁদের আলোয় দেখে এক বিরাট কালো মূর্তি তার সামনে দাঁড়িয়ে। তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত চাদরে ঢাকা। হাতে লাঠি। চোখ দুটো যেন জ্বলছে। ভয়ে কুঁকড়ে যায় সুকান্ত। লোকটির লোমশ কালো হাতের বরফ শীতল স্পর্শ সুকান্তকে প্রায় জ্ঞান শূন্য করে দেয়। হঠাৎ লোকটি বলে ওঠে, "আপনাকেই খুঁজতে এসেছিলাম। না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিলাম। এই চিঠিটা আপনার তুলোরামপুরের ঠাকুমা দিয়েছেন। খুব তাড়াতাড়ি আসবেন। নইলে সব জলে যাবে…আমি এখন চললাম।" চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই লোকটি কোথায় যেন মিলিয়ে যায়। ঠিক বুঝতে পারে না সুকান্ত। কুকুরের ডাক দূর থেকে দূরে ঘুরতে থাকে। 

ঘরে এসে চিঠিটা পড়ে সুকান্ত। একটা হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজে পেন্সিল দিয়ে লেখা, "শিগগিরি আয় দাদুভাই। আশির্বাদ নিস, ভবানী ঠাকুমা"। বাবার বিধবা নিঃসন্তান পিসিমা থাকতেন তুলোরামপুরে। সুকান্ত সেখানে কয়েকবার গেছে বাবার সঙ্গে কিন্তু সে তো প্রায় পঁচিশ ত্রিশ বছর আগের কথা। "সেই ঠাকুমা কি এখনও বেঁচে থাকতে পারে!" মনে মনে ভাবে সুকান্ত। শুয়ে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করে । কিন্তু ঘুম আসতে চায় না। বার বার ভবানী ঠাকুমার মুখটা তার মনে পড়ে। মনে হয় বিছানার পাশে যেন ডাকছে হাজার হাজার ঝিঁঝিঁ পোকা। 

সকালে হতেই প্রস্তুতি নেয় সুকান্ত। কাল সারারাত ঘুম হয়নি তার। তেঁতুলতলা থেকে বাসে ঢাকা। সেখান থেকে বাস বদলে মাওয়া ঘাট। তারপর পদ্মা নদী পেরোনো। ওপারে গিয়ে একটা বাস নিলো সে। সেই বাস তাকে নামলো ভাঙা নামে একটা জায়গাতে। সেখান থেকে আবার বাস বদলে সুকান্ত এলো মধুমতি নদীর পাড়ে। খেয়াতে নদী পেরিয়ে কালনাঘাট আসতে আসতেই হয়ে গেল বিকাল। সেখান থেকে সাইকেল ভ্যান ধরে বাসস্ট্যান্ড। খুলনা যাওয়ার বাস ধরে লক্ষীবাসা, নড়াইল পেরিয়ে সে যখন তুলোরামপুরের ব্রিজের উপর বাস থেকে নামল তখন ঘড়িতে রাত আটটা বাজে। বড় রাস্তা থেকে গলিতে নামতেই সব অন্ধকার। 

ছোটবেলার স্মৃতি থেকে মনে পড়ছে এই পথ ধরে চলতে চলতে নদীর পাড়েই ছিল ভবানী বুড়ির ভিটা। তবু যে একটু জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হবে…পথে কোনো জন মানব নেই। ভৈরব নদ আর চিত্রা নদীর শাখা প্রশাখা ছড়িয়ে আছে এই অঞ্চলে। যেন দুই নদ-নদীর সংসার। রাস্তার দুই দিকে ঝোপ জঙ্গল। অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে কয়েকটা টিনের বাড়ি। ঝোপের পাশে থোকায় থোকায় জ্বলছে জোনাকি। সুকান্ত পথ চলতে চলতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। "না, একটু জেনে নিশ্চিত হয়েই যাওয়া উচিৎ।" পথ ছেড়ে পাশের বাড়িটির দিকে যাবে এমন সময়, "কি হল, দাঁড়ালেন যে"। সেই অলৌকিক ছায়া মূর্তি এসে দাঁড়াল সুকান্তর পাশে। সে কি তবে পিছনেই আসছিল! মুহূর্তে একটা ভয় যেন লাফ দিয়ে পড়ে সুকান্তর উপর। শরীরটা ভারী মনে হয় তার। এবার ছায়ামূর্তি বলে ওঠে, "আমি হারান, কাল চিঠি দিলাম না। বাসস্ট্যান্ডেই ছিলাম। আপনি ঠিক পথে আছেন দেখে, পিছন পিছন আসছিলাম। আসেন আমার সঙ্গে। "

সুকান্ত হারানের পিছু নেয়। অন্ধকার পথ আরও যেন অন্ধকার হয়ে আসে। তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে হারান, সে জানে না। ছোটবেলায় সে হারানকে দেখেছে। ভবানী বুড়ির চাকর। কিন্তু সে তেঁতুলতলার ঠিকানাটা কিভাবে জানলো। জানতে ইচ্ছা করে কিন্তু প্রশ্নটা করতে পারেনা সুকান্ত। কেমন একটা ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকে সে। একবার মনে হয় উল্টোদিকে দৌড় দেবে … পারে না। এক অদ্ভুত যাদুবলে সে হারানের পিছু পিছু চলতে থাকে। দুই তিন বার চোখ ঘষে সুকান্ত। সে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তবে কি হারান তার চোখ বেঁধে দিলো। কথা বলতে চেষ্টা করে সুকান্ত, চিৎকার করে ওঠার চেষ্টা করে কিন্তু তার গলা দিয়ে একটাও শব্দ শোনা যায় না। তার মনে হয় হারান বাতাসে উড়ে উড়ে চলেছে। আর সে ও চলেছে তার সঙ্গে প্রায় উড়তে উড়তে। 

নদীর পাড়ে এক মালঞ্চের বেড়া দেওয়া ভিটের সামনে এসে হারান হাত দেখায়। তারপর উল্টোদিকে হাটা শুরু করে। হালকা চাঁদের আলোয় দেখা যায় চারপাশটা। বেড়ার পাশ দিয়ে একটা পায়ে চলা পথ চলে গেছে নদীর ঘাটের দিকে। দরজাটা খুবই জীর্ণ। কড়া নাড়ার আগেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে খুলে গেল দরজাটা। সাদা চুল সাদা শাড়ির ভবানী বুড়িকে দেখে একটু নিশ্চিন্ত হল সুকান্ত। পিঠে একটা খুব ঠান্ডা স্পর্শ লাগে সুকান্তর, "আয় আয় কত বছর পর, না না প্রণাম করতে হবেনা। খাটে বোস দাদুভাই।" সুকান্ত খাটের উপর বসে। ঘরের কোনায় একটা ছোট্ট প্রদীপ জ্বলছে। এবাদে কোনো আলো নেই। চাঁদের আলো এসে পড়ছে জানলা দিয়ে। তবে ঘরের মধ্যে যেন প্রবল এক ঠান্ডা। লাশকাটা ঘরের মতন। শ্বাস নিতে কষ্ট হয় সুকান্তের। মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকে। হাতে পায়ের জোর ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকে। এক প্রবল ক্লান্তি আর অদ্ভুত সম্মোহনে সে লুটিয়ে পড়তে থাকে বিছানায়। 
- "এই নে, দুটো মুখে দে দাদু ভাই,সেই তো কোন সকালে বেইরেছিস।" একটা মাটির থালায় কিছুটা ভাত ও মাছ এগিয়ে দেয় ভবানী বুড়ি। খিদের পেটে মুঠো মুঠো করে তাই খেতে থাকে সুকান্ত। এরপর ধীরে ধীরে এলিয়ে পরে বিছানায়। 

ঠাকুমা নাতির চুলে বিলি কেটে দেন, সাথে গুনগুন করে সেইই ছোটবেলার ঘুমপাড়ানি গান, হালকা আলোয় ঠাকুমার গলায় একটা মোটা নেকলেস চক চক করতে থাকে। এই গহনার কথা সুকান্ত তার বাবার মুখে শুনেছে।
"সব জলে গেছে রে দাদুভাই, শুধু এইটাই রয়েছে" ভবানী বুড়ি বলে ওঠে। সুকান্ত কিছুই বুঝতে পারে না। সে, হাপরের মতো মাঝে মাঝে শুধু শ্বাস নিতে থাকে। মনে হয় তার গলাটা কেউ চেপে ধরেছে। এবার ঠাকুমা ডুকরে কেঁদে ওঠেন। বলেন, "সকালে তুলসী মঞ্চের নিচেতে দেখিস, দাদু ভাই। নইলে বাকিটুকুও জলে যাবে।"
নদীতে একটা বিরাট কিছু পড়ার শব্দ হতেই ঘরের আলোটা নিভে সব অন্ধকার হয়ে যায়।

চোখে জলের ঝাপটা লেগে ঘুম ভাঙ্গে সুকান্তের। তখনও ভোর হয়নি। কয়েকজন মাঝি গোছের লোক ঘিরে আছে তাকে। আর তার শরীরটা দাওয়া থেকে ঝুলছে। সুকান্ত তাকাতেই মাঝিরা নিজেদের মধ্যে, "বাঁচি আছে, বাঁচি আছে" বলতে থাকে। এবার বয়স্ক লোকটা বলে, "যাক, আল্লার দোয়ায় বাঁচি গেছো। এখান থেকে কেউই বাঁচি ফেরেনা। গতবছর হারানও এই খানেই…চলে যাও, চলে যাও।" সুকান্ত বেকুবের মতো সবটা বোঝার চেষ্টা করে। মাথা যে খুব ভাল কাজ করছে তা নয়। কেমন একটা ঘোরের মত লাগে তার।

আর একজন মাঝি দরজার কোনায় রাখা মাটির থালায় কিছুটা ভাত আর মাছের ঝোল ঢেলে দেয়। মাটির থালাটা দেখে সুকান্তর গতরাতের কথা মনে পড়ে। হৃদকম্পন চলতে থাকে প্রবল গতিতে। মাঝিরা ঘাটের দিকে এগিয়ে যায়। এবার সুকান্ত উঠে দাঁড়ায়। পায়ে যেন বল নেই একেবারে। "ও মাঝি, ওই মাছ ভাত রাখলা কেন?" চিৎকার করে ওঠে সুকান্ত। নৌকা ছাড়তে ছাড়তে এক মাঝি বলে, "ওইটা না দিলে বুড়ির ভিটার উপর দিয়া মাছ ধরতে জামু কেমনে!" 

ধীরে ধীরে সকাল হতে থাকে। সুকান্ত তাকিয়ে দেখে পড়ো বাড়িটার দরজা জানলায় কোনো কপাট নেই। ঘরের ভিতরের জঙ্গলে মনে হয় সাপের আড্ডা। ভেঙ্গে যাওয়া কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে চামচিকের দল। বাড়ির অনেকটা অংশ চলে গেছে নদীর ভাঙ্গনে। হঠাৎ তার গত রাতের কথা মনে পড়ে। ভবানী বুড়ি বলছে, "নইলে বাকি টুকুও জলে যাবে। এবার তুলসী মঞ্চের দিকে চোখ যায় তার। বহু দিনের যত্নের এভাবেও বেচে আছে তুলসী গাছটা। তবে তুলসী মঞ্চেরও অর্ধেকটা গেছে নদীর ভাঙনে। একটা বাঁশের টুকরো দিয়ে সুকান্ত প্রাণপনে খুঁড়তে থাকে তুলসী মঞ্চের গোড়াটা। খানিকটা মাটি সরাতেই একটা কলসী উঠে আসে। আর তার ভিতরে সেই নেকলেসটা আর হলুদ হয়ে যাওয়া বাড়ির দলিলের কাগজপত্র।

কোথায় যেন একটা পাখি ডেকে ওঠে। মাটির থালার ভাত আর মাছের উপর ঘুরতে থাকে মাছির দল।
0

ভৌতবাক - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in

ভৌতবাক


রঞ্জন ডাক্তার
দীপারুণ ভট্টাচার্য




গ্রামের নাম কবিরহাট। সেযুগে কি কবিগানের লড়াই হতো এখানে! রঞ্জন ডাক্তার এসব জানে না। মাস কয়েক হল ডাক্তার রঞ্জন রায় শহর ছেড়ে এই গণ্ড গ্রামে এসেছেন ডাক্তারী করতে। মেডিকেল কলেজ থেকে ডিগ্রি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে অবশ্য শহরের বড় হাসপাতালে কাজ পেয়েছিল। বহু কষ্টে মাস ছয়েক কাজ করেও ছিল সে। কিন্তু আর পারলো না। রোগীদেরকে অকারণে এক গাদা টাকার ওষুধ দেওয়া বা দামি দামি টেস্ট করানো তার অদৌ পছন্দ নয়। সে কিভাবে জানবে যে এই স্বভাবটাই তার বিরুদ্ধে যাবে। একদিন তাকে আলাদা ঘরে ডেকে হাসপাতালের কিছু প্রবীণ ডাক্তাররা বলে দিল, "আমাদের কথা মতো যদি কাজ করো তো ভালো নইলে, রুগীর আত্মীয় স্বজন সাজিয়ে গুণ্ডা লেলিয়ে তোমার হাড় মাংস এক করে ছাড়বো।" এরপরই সে আবেদন করে গ্রামের হাসপাতালের জন্য। লোকে গ্রাম থেকে শহরে যায় আর রঞ্জন চলল গ্রামে! খবরটা জানাজানি হতেই বন্ধু আর পরিচিত মহলে একটা ডাক নাম পেলো সে, "বোকা রঞ্জন"। অবশ্য এতে রঞ্জন চিন্তিত নয়।

গ্রামে অবশ্য মাসখানেকের মধ্যেই বেশ জমিয়ে নিয়েছে রঞ্জন। এখানে তেমন ওষুধপত্র নেই, নেই যন্ত্রপাতিও। তবুও রঞ্জন তার সেবা দিয়ে গ্রামের মানুষের মন জয় করেছে। গ্রাম প্রধান সুকুমার মন্ডল তো সেদিন বলেই ফেলল, "ডাক্তার সাহেব, গেরামে অনেক সমস্যা। তাই কেউ থাকতে চায় না। সব ডাক্তাররাই পাইলে যায়। আপনি থাকেন, আমরা বুক দিয়া আপনারে আগলামু।" বিষয়টা সেদিন ঠিক বুঝতে পারেনি রঞ্জন তবে সরল মানুষদের জন্য কাজ করতে তার ভালো লাগছে। হাসপাতালে যতক্ষন রোগী থাকে সে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের চিকিৎসা দেয়া। এক এক দিন ঘরে ফিরতে অনেক রাত হয় তার। তারপর ও রাত বিরাতে ডাক পড়ে। গত দুই সপ্তাহে মাঝরাতে খবর পেয়ে সে তিন তিনটে রোগীকে বাঁচিয়েছে। একজন বিষ খেয়েছিল অন্য দুজনের সাপের কামড়। এক এক সময় তার মনে হয় সে আসার আগে কিভাবে চলতো কবিরহাটের চিকিৎসা ব্যবস্থা!

আজ সন্ধে থেকে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। গ্রামের পথ ঘাট খুবই নির্জন। একটু তাড়তাড়ি ঘরে এসে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে রঞ্জন সবে খেতে বসেছে এমন সময় টেলিফোনটা বেজে উঠলো। সে খেতে খেতেই ফোন ধরলো, "কি হয়েছে ... বিষ খেয়েছে ... নিয়ে আসুন না… কি, আনার কোন ব্যবস্থা নেই ... হাসপাতালে আনতে পারবেন… আচ্ছা আচ্ছা, আমি আসছি…কি ঠিকানা…ও আচ্ছা ঠিক আছে…এই মিনিট দশেক!" টেলিফোন রেখেই রঞ্জন উঠে হাত ধুয়ে আবার জামা কাপড় পরে মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যায়।

বড় রাস্তা দিয়ে কিছুটা পথ যাওয়ার পরই রঞ্জন বাদিকের একটা কাঁচা পথে ঢুকে পড়ে। মোটরসাইকেলের আলোয় যা দেখা যাচ্ছে সেই টুকুই যেন সত্যি। বাকি সবটাই যেন অন্ধকার। হালকা হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। এদিক ওদিক থেকে ডাকছে হাজারো কোলাব্যাঙ। মোটরসাইকেলের চাকা চলেছে কাদা ভরা রাস্তা দিয়ে। মাঝে মাঝেই সে রাস্তায় খানা খন্দ। পড়ি কি মরি করে রঞ্জন চলেছে কোনো এক বিষ খাওয়া রোগীকে বাঁচাতে। দুইদিকের ধান ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে রাস্তা সরু থেকে আরও সরু হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ রাস্তায় একটা সাদা চাদর উড়তে দেখে রীতিমতো অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল রঞ্জন। কোন রকমে নিজেকে আর মোটরসাইকেল সামলে সে দাঁড়ায় রাস্তার উপর। চাদর নড়া বন্ধ হলে রঞ্জন দেখে লুঙ্গী পরা একটা লোক রাস্তার কাঁদায় দাঁড়িয়ে আছে। তার খালি গা। মাথার চুল এলোমেলো। আর চোখ দুটো যেন জ্বলন্ত কয়লার মতো লাল হয়ে আছে।

রঞ্জন দাঁড়িয়ে যেতেই লোকটা বলল, "মোটরসাইকেল আর যাবে না…" বলেই সে তার ডান হাতটা তুলে দূরের কি যেন একটা দেখায়। সেদিকে তাকিয়ে রঞ্জন দেখে দূরে বাগান ঘেরা একটা বেশ বড় বাড়ি দেখা যাচ্ছে। তার মনে পড়ল টেলিফোনে লোকটা বলেছিল পথে একজন লোক থাকবে। যাক, ভালোই হয়েছে। মোটর সাইকেলটাকে রাস্তায় রেখে রঞ্জন তার ওষুধের ব্যাগটা নিয়ে সরু আলের উপর দিয়ে ছুটতে লাগলো ওই বাড়িটার দিকে। তার হঠাৎ মনে হল ওই লোকটা কেন আসছেনা! চিন্তাটা আসতেই পেছন ফিরে দেখলো রঞ্জন, কই লোকটা কে তো দেখা যাচ্ছে না!

বাড়িটার ভিতরে খুব সামান্য একটা আলো জ্বলছিলো। টেলিফোনে লোকটা নাম বলেছিল, মিজান। উঠানে পৌঁছে রঞ্জন ডাক দিল, "মিজান, মিজান আছো নাকি।" হঠাৎ কে যেন কেঁদে উঠলো ঘরের মধ্যে। মনে হল যেন মহিলা কন্ঠ। তবে কি দেরি হয়ে গেল। রোগী কি আর বেঁচে নেই! ভাবতে ভাবতে রঞ্জন নিজেই গিয়ে ঢুকলো ঘরের মধ্যে। একবার যেন তার মনে হলো, বাড়িটার দরজা জালনায় কোন পাল্লা নেই। ভালো মতো কিছু বোঝার আগেই সে লক্ষ্য করলো একজন খাটে শুয়ে আছে। শরীরটা সম্পূর্ণ চাদরে ঢাকা। ঘরের কোনায় একটা হালকা আলো জ্বলছে। তাতে ঘরের পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। তবু যেন মনে হচ্ছে দেওয়ালটা নোনা ধরা। নাকে একটা বোটকা গন্ধ আসছে রঞ্জনের। যে কাঁদছিলো তাকে কোথাও দেখতে পায়না রঞ্জন। মোবাইলের আলো জ্বেলে এদিক ওদিক তাকাতেই রঞ্জন দেখে ঘরের কোনায় একজন মহিলা মাটিতে বসে আছে। তার উপর আলো ফেলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে মহিলাটি। কেঁদে কেঁদে সে বলে, "সে আর নেই ডাক্তার সাহেব…সব শেষ!" 

নিজেকে অপরাধী মনে হয় রঞ্জনের। হয়তো আর একটু দ্রুত এসে লোকটাকে বাঁচানো যেত! তবুও সে মৃত রোগীর কাছে এগিয়ে যায়। হঠাৎ বাইরে ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। তার সঙ্গে তুমুল ঝড়। রঞ্জন মৃত রোগীর মুখের চাদর সরিয়ে দিতেই তার বুক শিউরে ওঠে। কুৎসিত দেখতে লোকটা বীভৎস মুখ করে মরে আছে। তার লাল জিভটা মুখের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে। জিভের উপর শক্ত করে বসেছে দুটো দাঁত। আর রক্তে ভেসে গেছে বিছানা। এমন মৃত্যু রঞ্জন কোনদিন দেখেনি। নাড়ি দেখবে বলে হাত বাড়িয়ে দিল রঞ্জন। হঠাৎ দপ করে ঘরের ছোট্ট আলোটা নিভে গেল। মৃতের হাত অনুমান করে চাদরের তলায় হাত দেয় রঞ্জন। এমন সময় সেই মৃত রোগীটা একটা দম ফাটা চিৎকার করে ওঠে। রঞ্জন হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়ে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়ে। আর তখনই তার গায়ের উপর কি যেন একটা পড়ে কিলবিল করতে থাকে। রঞ্জন বুঝতে পারে সেটি একটি বিষধর সাপ। তাড়াতাড়ি গা ঝাড়া দিয়ে উঠতেই সাপটা মেঝেতে পড়ে কোথায় যেন চলে যায়।

মৃত রোগী ততক্ষণে খাটের উপর উঠে বসেছে। তার মুখ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। চোখ দুটো জ্বলছে লাল হয়ে। তার দমফাটা চিৎকারে চমকে গিয়ে রঞ্জন পিছু হাটতে শুরু করে। একটু পরে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় তার। সেই মৃত রোগী ততক্ষণে খাট ছেড়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসেছে রঞ্জনের দিকে। তার দুই হাত দিয়ে সে চেপে ধরেছে রঞ্জনের গলা। বহু চেষ্টা করেও রঞ্জন তাকে আটকাতে পারছে না। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। একম অমানুষিক শক্তির মুখোমুখি সে কখনও হয়নি। চিৎকার করতে চায় রঞ্জন। কিন্তু মুখ দিয়ে একটুও আওয়াজ করতে পারে না সে। এমন সময় এক প্রবল শব্দে কোথায় যেন ঘন্টা বাজতে আরম্ভ করে। রঞ্জন বুঝতে পারে তার শেষ ঘন্টা বেজে গেছে। তবুও প্রাণপনে সে তার গলার বাঁধন খুলতে চায়। এমন সময় তার তলপেটে আছড়ে পড়ে এক নির্মম আঘাত। কেউ যেন লাথি মারছে, একের পর এক।

প্রায় শ্বাস বন্ধ হয়ে অজ্ঞান হওয়ার আগের মুহূর্তে রঞ্জন শুনতে পায় বাইরে কয়েকজন লোকের চিৎকার। হঠাৎ তার গলার থেকে সেই হাতটা সরে যায়। তারপরই কয়েক জনের দৌড়ে যাওয়ার শব্দ শোনে রঞ্জন। এর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ঘরে কারা যেন প্রবেশ করে। একজন চার ব্যাটারির টর্চের আলো ফেলে রঞ্জনের মুখে। অন্যজন চিৎকার করে ওঠে, "এইতো ডাক্তার সাহেব।" বাকিরা রঞ্জনের অবস্থা দেখে আঁতকে ওঠে। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগের মুহূর্তে রঞ্জনের যেন মনে হয় সুকুমার মন্ডল তার পা জড়িয়ে ধরে বলছে, "আমাদের ভুল বুইঝো না ডাক্তার।"

গ্রামের লোকের নিরলস সেবায় দিন কতক বাদে সুস্থ হয়ে ওঠে রঞ্জন। সকলের সঙ্গে কথা বলে সে বুঝতে পারে, গ্রামের হাসপাতালে তার আসার ফলে এলাকার হাতুড়ে ডাক্তারের ভাত মারা যাচ্ছিলো। এর আগের এক ডাক্তারকেও তারা এভাবেই ওই ভাঙা বাড়িতে ডেকে নিয়ে ভয় দেখায়। ডাক্তারটি সেখানেই হার্টফেল করেছিল। রাতের রাস্তার সেদিন রঞ্জনের মোটরসাইকেল দেখতে পেয়ে হারান মোল্লা গ্রামের লোকদের খবর দেয়। দুইজন অভিযুক্ত হাতুড়ে ডাক্তার ইতিমধ্যেই পুলিশের হাতে পড়েছে। বাকি অভিযুক্তরা পালিয়েছে গ্রাম ছেড়ে।