ভৌতবাক - দীপারুণ ভট্টাচার্য
Posted in ভৌতবাক
ভৌতবাক
শিশির বাবুর গল্প
দীপারুণ ভট্টাচার্য
স্ত্রীর মৃত্যুর পর একা একা কলকাতায় থাকতে কিছুতেই মন চাইলো না শিশিরবাবুর। ছেলে চাকরি করে দিল্লিতে। তাছাড়া জুটমিলেও নিত্যদিনের অশান্তি। তাই চাকরি বদলে এক সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে কাজ নিয়ে শিশিরবাবু চলে এলেন রাজস্থানের যোদপুর জেলার মাথানিয়া গ্রামে।
এখানে মাইলের পর মাইল বালি আর পাথুরে জমি। তার উপরে এদিকে ওদিকে কাঁটা ঝোপ আর ফণীমনসার গাছ। যেখানে পাথর নেই সেখানে কিছু কিছু চাষ হয়। সেই জায়গাগুলোতেই গড়ে উঠেছে ছোটো ছোটো গ্রাম। দিনের বেলা প্রবল গরম হলেও রাতে বেশ ঠাণ্ডা এখানে। এখানে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের বেশ রমরমা।
শিশিরবাবু যেখানে কাজ নিয়েছেন সেটিও মরুভূমির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক বিদ্যুৎ প্রকল্প। প্রায় চল্লিশ একর জমিতে একের পর এক লাগানো রয়েছে সোলার প্যানেল। দিনের বেলা সূর্যের আলো পড়তেই সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়। সন্ধেবেলা আপনা আপনি বন্ধও হয়ে যায়।
এখানে কর্মী বলতে ইঞ্জিনিয়ার রামশরণ, শিশিরবাবু আর বৃদ্ধ চৌকিদার, প্রফুল্ল। গেটের পাশে প্রফুল্লের ঘর। এসব অঞ্চলে চুরি আদৌ নেই। লোকে নিশ্চিতে ঘরের দরজা খুলে ঘুমায়। তাই প্রফুল্লের বিশেষ কাজ নেই। স্থানীয় এক গ্রামে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকেন শিশির আর রামশরণ। রামশরণের কাজ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের হিসেব রাখা, রিপোর্ট দেওয়া এবং যন্ত্রপাতির দেখভাল। সে সকাল আটটা থেকে সন্ধে ছয়টা পর্যন্ত কাজ করে। শিশিরবাবুর কাজ হল রাতের বেলায়। সোলার প্যানেলগুলোকে নিয়মিতভাবে মুছে পরিষ্কার করতে হয়। নইলে উৎপাদন কমে যায়। দিনের প্রবল গরমে কাজটা অত্যন্ত কঠিন। কাজ হয় রাত্রিবেলা। আশপাশের গ্রামের কিছু প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত লোক কাজটা করে। এই কাজের দেখভালের ভার শিশিরবাবুর উপর।
তিনি সারাদিন ঘরে শুয়ে বসে থাকেন আর রাতের অন্ধকারে প্রকল্পের এদিক ওদিক ঘুরে সাফাই তদারকি করেন। ঘুম পেলে কন্ট্রোল রুমের বেঞ্চের উপর বিশ্রাম নিয়ে নেন। কাজটা মন্দ নয়। তবে সমস্যা হল কথাবার্তা বলা। জুটমিলে সারাদিনে কত লোকের সঙ্গে বকতে হতো। বাড়ি ফিরে পাড়া প্রতিবেশী থেকে শুরু করে ক্লাবের আড্ডা। কথা বলার লোককি কম ছিল। শিশিরবাবু ছিলেন ভূতের গল্প বলার স্পেসালিষ্ট। অন্ধকার ক্লাব ঘরে তার ভূতের গল্প শুনতে শুনতে কতজন যে ভিরমি খেয়েছে! এখানে তাই কথা না বলতে পারে তিনি কষ্ট পান।
আজ শিশিরবাবু এলেন সন্ধে ছয়টায়। একটু পড়ে রামশরণ বিদায় নিল। প্রফুল্লও তার ছোট্ট ঘরে গিয়ে রান্নার কাজে মন দিলো। সূর্য ডুবে যেতেই যান্ত্রিক শব্দ ক্রমে বন্ধ হয়ে এলো। শিশিরবাবু কন্ট্রোল রুমের আলো জ্বেলে একটা পত্রিকার পাতায় চোখ রাখতেই মেঘের গর্জন শুনতে পেলেন। এই মরুভূমি অঞ্চলে বছরে কয়েকদিনই মাত্র বৃষ্টি হয়। একটা সিগারেট ধরিয়ে জানলায় দাঁড়াতেই ঝম ঝম করে বৃষ্টি নেমে পড়ল। আজ আর সাফাইওয়ালারা আসবে না। প্রয়োজন ও নেই। বৃষ্টিতেই সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে। খানিক পরে রাতের খাওয়া শেষ করে শিশিরবাবুও বেঞ্চের উপর লম্বা হলেন। দিনে ঘুমিয়েছিলেন বটে তবুও তার চোখ লেগে এল।
যখন ঘুম ভাঙল তখন রাত প্রায় তিনটে বাজে। বাইরের হালকা জোৎসায় বেরিয়ে এলেন শিশিরবাবু। বেশ সুন্দর একটা হওয়া চলছে। ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ আসছে এদিক ওদিক থেকে। স্বভাব বসত একটা সিগারেট ধরিয়ে অন্য দিনের মতোই তিনি হাঁটতে শুরু করলেন সোলার প্যানেলের মধ্যে দিয়ে। হঠাৎ তার চোখে পড়লো এক জায়গায় কয়েক জন যেন বসে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছে। শিশিরবাবু মোটামুটি হিন্দি জানেন। সিগারেটের শেষ অংশটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ভাঙা হিন্দিতে শিশিরবাবু বললেন, "তোদের কাজতো সব উপরওয়ালাই করে দিলো। তা তোরা এখানে বসে গুলতানি করছিস কেন? ঘরে শুয়ে ঘুমালেই তো পারতিস।" লোক গুলো কেবল একটু হাসল। শিশিরবাবু আবার বললেন, "বুঝেছি, তোদেরও আমার মতোই রাত জাগা অভ্যাস হয়ে গেছে, তাই না।" আবার হালকা হাসির শব্দ শোনা গেল। শিশিরবাবু একটা পাথরের উপর বসে বললেন, "তোদের তাহলে একটা গল্পই শোনাই। শুনবি?" এবার মূর্তিগুলো একটু নড়ে চড়ে বসল। যেন তারা শিশিরবাবুকে ঘিরেই বসেছে গল্প শোনার লোভে। অন্ধকারের মধ্যে কয়েকটা অন্ধকারের দলা যেন আর এক অন্ধকারকে ঘিরে বসে আছে।
শিশিরবাবু গল্প শুরু করলেন, "তখন জুটমিলের চাকরি। একরাতে হঠাৎ যান্ত্রিক গোলমালের কাজ বন্ধ হয়ে গেল। কর্মীদের মধ্যে অনেকেই বাড়ি চলে গেল। আমার বাড়ি অনেক দূরে, তাই ভাবলাম ভোরের ট্রেন ধরেই ফিরবো। হাতে খানিকটা সময় ছিলো। জুটমিলে পাশেই বয়ে চলেছে গঙ্গা। ভাবলাম বাকি রাতটুকু গঙ্গার ধারে বসে হওয়া খেয়েই কাটিয়ে দেওয়া যাক। একটা বেঞ্চে বসে সুন্দর সময় কেটে যেতে লাগলো। হঠাৎ দেখলাম গঙ্গায় একটা লোক ডিঙ্গি নৌকো নিয়ে মাছ ধরছে। মনে মনে ভাবলাম যদি কিছু তাজা মাছ লোকটার থেকে কিনে নিতে পারি তবে বাড়ি গেলে বউ দারুন খুশি হবে। পাড়ে গিয়ে একটা ডাক দিলাম, ও মাঝি ভাই মাছ বেচবে নাকি? লোকটা পাশের একটা ঘাটের দিকে আঙ্গুল দেখালো। যেন আমাকে ওই ঘাটেই যেতে বলছে সে। আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধীরে ধীরে সেই ঘাটের দিকে এগিয়ে গেলাম। লোকটাও নৌকা নিয়ে আসতে লাগলো সেই দিকেই।
খানিকটা কাছে আসতেই দেখলাম তার ডিঙ্গি নৌক মাছে মাছে একদম ভরে গেছে। মাছ গুলোর উপর চাঁদের হালকা আলো পড়েছে। গলুইয়ের ভিতর থেকে সেই আভাই ঠিকরে পড়ছে চারিদিকে। নৌকা কাছে আসতেই মাঝি দুটো মাছ আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি মাছ দুটোকে সাবধানে ডাঙ্গায় রেখে টাকা এগিয়ে দিলাম। কিন্তু কি আশ্চর্য লোকটা টাকা নিলো না। উল্টে আমার হাতটা ধরে বসল। তারপর আমার হাতের উপর হালকা ভাবে হাত বোলাতে লাগল। আমার সমস্ত গায়ে তখন রোমাঞ্চ খেলে যাচ্ছে। শরীরের রোম একে একে খাড়া হয়ে উঠেছে। কি এক অনির্বচনীয় উত্তেজনা যেন আমাকে ডাকছে নৌকোর দিকে। আমি এক পা এক পা করে নৌকোর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। আর সেই মাঝিও আমাকে হাত ধরে টানতে লাগল। এভাবে কতক্ষন ছিলাম জানিনা। হঠাৎ, 'চলে আয়' বলে মাঝি আমাকে এক হ্যাঁচকা টান দিল। আর সঙ্গে সঙ্গেই শুনলাম অনেক লোকের চিৎকার। জুটমিলের শ্রমিকরা ততক্ষনে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমায় তুলে আনতে। দেখলাম আমি গঙ্গায় হাবুডুবু খাচ্ছি। আমাকে পাড়ে এনে তুলতেই মূর্ছা গেলাম।
পরে সুস্থ হয়ে শুনেছিলাম গঙ্গার ওই অঞ্চলে এক মেছো ভূত নাকি এমন ভাবেই লোককে মাছের লোভ দেখিয়ে ডুবিয়ে মারার চেষ্টা করে।"
এই পর্যন্ত বলে থামলেন শিশিরবাবু। তখন সবে ভোর হচ্ছে। একটু রহস্যময় হেসে শিশিরবাবু বললেন, "গল্পটা কেমন লাগলো তোদের?" আবার একটা নড়াচড়া উঠলো শ্রোতাদের মধ্যে। উঠল একটা মিহি হাসির শব্দ। একজন একটু নাকে নাকে বলল, "বাঙালি স্বজাতির গল্প শুনে ভালোই কাটলো সময়টা।" এরপর শ্রোতারা বেশ শব্দ করেই হাসতে লাগল আর একে একে অদৃশ্য হয়ে গেল। শিশিরবাবুর হাত থেকে সিগারেট আর দেশলাই পড়ে গেল। তিনি এবার সত্যি সত্যিই মূর্ছা গেলেন।
0 comments: