undefined
undefined
undefined
ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
সোয়ানার রহস্যময় মানুষ
নন্দিনী সেনগুপ্ত
২
যে জায়গাটায় আমাকে বসিয়েছিল লোকটা, সেখান থেকে উপত্যকার অসাধারণ দৃশ্যাবলী যেন পরতে পরতে খুলে গেলো চোখের সামনে। আল্পসের দৃশ্য দেখে প্রথমে বাক্যহারা হয়ে গেলাম, তারপর নানা রকম বিস্ময় ও প্রশংসাসূচক শব্দ বেরিয়ে এলো আমার মুখ থেকে, তারপর আবার বাক্যহারা হয়ে গেলাম। কারণ, প্রকৃতির ঐ অপরূপ সৌন্দর্য বর্ণনা করবার জন্য কোনো ভাষা যথেষ্ট নয়। এমনকি ঐ লোকটাকেও যেন অন্যরকম ঠেকছিল ঐ নিস্তব্ধ সৌন্দর্যের মাঝখানে। মনে হচ্ছিল যেন একটা অন্য লোক! কী শান্ত, সৌম্যভাব! তাহলে কি ওঁর সম্বন্ধে যা শোনা যায় সেগুলো মিথ্যে? জানিনা কেন সেসব শোনা কথা মনে পড়তেই মনটা হঠাৎ একটা অস্বস্তিতে ভরে উঠলো। নাহ, এই জায়গাটা এত সুন্দর, যে সেসব অস্বস্তি আর অনাবশ্যক কৌতূহল কিছুক্ষণের মধ্যেই মন থেকে উধাও হয়ে গেলো।
আল্পসের মন্টে জেনারাসো যাবার দুর্গম পথের মাঝখানের সেই উপত্যকার চাতালে এখনও কেউ গেলে হয়তো দেখতে পাবে যে পাথরের একটা গোল টেবিলমত উঁচু জায়গা আছে, যেটা ঘিরে একটু নিচু নিচু পাথরেরই বেঞ্চির মত বসবার জায়গা। ‘রহস্যময় লোক’টা আমার সামনে অসাধারণ খাবার দাবার সাজিয়ে দিল সেই পাথরের টেবিলের উপরে। ‘স্ত্রাকিনো দি লেকো’ চীজ ( গরুর দুধ থেকে তৈরি বিশেষ ধরণের ইতালিয়ান চীজ), সাদা নরম ইতালিয়ান রুটি, সালামি, জলপাই, ডুমুর, খোবানি, পাত্র ভর্তি লাল মদিরা যেটা সদ্য নিয়ে এসেছে ওঁর কেলার (পরে জেনেছিলাম ঐ বন্ধ দরজা গুহাটাই ওর কেলার, ভাঁড়ার সব কিছু) থেকে। ছাগলের চামড়ার পোশাক পরা লোকটার মুখোমুখি বসে, অবিন্যস্ত লম্বা ঢেউখেলানো চুল আর দাড়িওয়ালা মুখে ভয়ংকর সাঙ্ঘাতিক গোপনীয় কোনো ভাবের খেলা আমার চোখে ধরা পড়লনা; বরং সৌহার্দ্যপূর্ণ অদ্ভুত বিনীতভাব দেখেছিলাম তার চোখে।
এই মুহূর্তে আর মনে নেই আমার, ঠিক কি কি বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলে ঐ প্রথম সাক্ষাতের এলাহি পানাহারের পুরো সময়টা কেটে গিয়েছিল। এক দুটো কথা মনে আছে যেমন, লোকটা চাইছিল যে আমি যেন ওকে ‘লুডোভিকো’ বলে সম্বোধন করি, মানে নাম ধরে ডাকি আর কি! লোকটা আর্জেন্টিনা নিয়ে অনেককিছু বলছিল। মাঝে যখন একবার অনেক নিচের উপত্যকার গির্জা থেকে ঘণ্টাধ্বনি শোনা যাচ্ছিল, তখন লোকটা ভ্রু কুঁচকে নিজের মনে কী যেন বলে উঠেছিল। সম্ভবত ‘বিরক্তিকর’ বা ঐধরণের কোনো শব্দ। আমি একটু যে অবাক হইনি তা নয়। এক দুবার সেনেকার নাম উল্লেখ করেছিল। সুইজারল্যান্ডের রাজনীতি নিয়ে নানা আলোচনা হয়েছিল। জার্মানি নিয়ে অনেককিছু জানতে চাইছিল লোকটা, যেহেতু সে দেশটা আমার জন্মভূমি। তবে যে কথাটা একেবারেই ভুলতে পারিনি সেটা হল যে বিদায় নিয়ে চলে আসবার সময় লোকটা বারবার বলেছিল যে আমাদের আবার নিশ্চয়ই দেখা হবে এবং আমাকে স্বাগত জানাতে সে সর্বদা প্রস্তুত।
নিঃসন্দেহে লোকটার সম্বন্ধে ভীষণ কৌতূহল ছিল আমার। মানুষজনের কাছ থেকে নানা অদ্ভুত গালগল্প শুনে সেটা আরও বেড়েছিল। তবে এটা ঠিক যে সেরকম কোনো রহস্যের প্রতি আমার আকর্ষণ ছিলনা। আমার খালি মনে হত যে কি এমন ঘটেছিল ওর অতীতে যে ও ওইরকম একটা দুর্গম জায়গায় বাস করে! মনুষ্য সমাজ, প্রচলিত ধর্ম, আচার আচরণ এসবের থেকে দূরে থাকে। কেন? কি ওর ব্যক্তিগত জীবনদর্শন? কোথায় ওর অতীতের শিকড়? এরকম অজস্র প্রশ্ন আমার মনে জাগতো।
আমি যতবার লুডোভিকোর সঙ্গে দেখা করেছি, একাই গিয়েছি। উপত্যকায় ওর গোরু ছাগল ভেড়ার দলের মধ্যে কিংবা ওর ঐ ডেরায়। একাই দেখা করেছি। দেখতাম ও কখনো দুধ দোয়াচ্ছে, কখনো আবার ছাগলভেড়ার বাচ্চাগুলোর পরিচর্যা করছে। মেষপালকের কাজ আর গোয়ালার কাজ লোকটা নিবিষ্টচিত্তে করে যেতো। গর্ভিণী কিংবা সদ্য মা হওয়া ছাগলের মাটিতে ঠেকে যাওয়া ভারি বাঁট দেখে সে খুশি হত, আসলে এই জীবগুলোর মধ্যেই সে খুঁজে পেয়েছিল নিজের জীবন এবং জীবিকা। ঐ গরু-ছাগল-ভেড়াগুলোই যেন ওর বন্ধু ছিল। একদিন একটা ছাগলের দিকে তাকিয়ে বলছিল সে, ‘দেখেছ কি দুষ্টুমি করছে? উফফ, ওর চোখভর্তি যেন আগুন! কত রাগ আর নালিশ পুষে রেখেছে আমার উপর!’ কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছিল লোকটার চোখেই যেন আমি আগুনের ঝলক দেখেছিলাম। আশার আগুন, ভালোবাসার আগুন। লোকটা দাঁত দেখিয়ে হাসলেও ওর হাসিতে কেমন যেন একটা বিষণ্ণতা লেগে থাকতো। অলসভাবে মাঝেমধ্যে সে তাকিয়ে থাকতো তার পশুর পালের দিকে, আবার কখনো বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিতে কোনো একটা দানবিক চেহারার বলদের স্বাস্থ্যপরীক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়ত।
‘রহস্যময়’ লোকটা আবার কখনো বাঁশি বাজাতো। পাহাড়ের উপত্যকা ভরে উঠত বাঁশির সহজ সরল সুরের ওঠাপড়ায়। আমি বেশ কয়েকবার শুনেছি। হ্যাঁ, মনে পড়েছে; ওর সঙ্গে আমার সঙ্গীত নিয়েও আলোচনা হত। দেখেছি যে বেশ জ্ঞানগম্যি আছে ওর সে ব্যাপারেও। তবে যখন ও গরুভেড়ার পালের সঙ্গে থাকতো, তখন গরু ছাগলদের কাণ্ডকারখানা বা ওদের সঙ্গে ওর কীভাবে সময় কাটে, সেসব ছাড়া বিশেষ কোনো কথা বলতে শুনিনি। না, পশুদের মনোবিজ্ঞান নিয়ে সেরকম গুরুগম্ভীর আলোচনা বা অতীত ইতিহাস কিংবা মহাকাব্যের মেষপালকদের নিয়ে আলোচনা যে সবসময় করত, তা নয়। তবে মনে আছে একবার অ্যাপোলোকে নিয়ে পড়ল। সেই যে অ্যাডমেটোসের বাড়িতে, ট্রোজান রাজা লাওমেডনের সময়ে দেবতা অ্যাপোলো স্বয়ং ভৃত্য হয়ে মেষপালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, সেই গল্প।
-‘আমি খালি ভাবি যে কী যন্ত্রে বাজিয়ে তুলতেন অ্যাপোলো সেই অদ্ভুত সঙ্গীতের সুর যে গরুভেড়াছাগলের দল একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেতো।’ লুডোভিকো বলেছিল একদিন, ‘উফফ, যদি শুনতে পেতাম!’ ঐসময় ওকে দেখে আমার একটু অদ্ভুত পাগলাটে গোছের মনে হয়েছিল বটে! তবে একদিক থেকে ভেবে দেখলে ব্যাপারটা অদ্ভুত তো বটেই। পশুর পালকে সুরের জালে আচ্ছন্ন করে রাখা, বিশ্রাম করতে পাঠানো, গানের সুরে শান্ত করে এদিক ওদিক ঘাস খাবার জন্য ছড়িয়ে দেওয়া, আবার একজায়গায় নিয়ে আসা বা সারিবদ্ধভাবে পেছনে পেছনে একসঙ্গে নিয়ে খামারে নিয়ে ফেরা, সবই নানারকম সুরের সাহায্যে- এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবনার অবকাশ আছে বইকি! পশুদের মনে নিশ্চয়ই সঙ্গীতের প্রভাব বেশ গভীর। মেষপালকের বাজনার সুরের ব্যাপারটা খুব একটা সরলসিধে নয় সেটা আমারও পরে মনে হল।
তবে সবসময় যে ওর সঙ্গে আমার প্রচুর গালগল্প হত, ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়। একবার এরকম হয়েছিল যে আমাদের দেখা হয়েছিল অথচ সেভাবে কোনো কথাই হয়নি।
(চলবে)
গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা
0 comments: