0

ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

Posted in

ধারাবাহিক


এক কিশোরীর রোজনামচা - ৩৩
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়


Diary Entry - 32
19th. November, 1942, Thursday
 

প্রিয় কিটী, 

ড্যাসেল লোকটা বেশ ভাল। মনে হয় ও'কে এবং অর উপস্থিতিকে আমি ক্রমান্বয়ে সইয়ে নিতে পারব। আমার ঘরেই ত' থাকবে, তাই চিন্তাটা আমারই সবথেকে বেশী। আশা করি, আমরা যেরকম লোকের কল্পনা করেছিলাম, ড্যাসেল ঠিক সেইরকমই লোক হবে। সে'ও চেষ্টা করব আমাদের সাথে মানিয়ে নিতে। আমার সঙ্গে এক ঘরে থাকতেও তার কোন অসুবিধা হবে না। অন্ততঃ এখানে আসার পর থেকে, ড্যাসেল সেরকম অসুবিধার কথা এখনও বলেনি। 

তবে একটা সত্যি কথা আমায় বলতেই হবে। একজন অপরিচিত ব্যক্তি আমার ঘরে থাকবে, আমার জিনিষপত্র গুলো, যেমন লেখার টেবিল, বসার চেয়ার ইত্যাদিতে ভাগ বসাবে, ঘাঁটাঘাঁটি করবে, এ'টা যদিও আমি প্রথমে মন থেকে মেনে নিতে পারিনি। তবুও আমি উদারমনস্ক হয়ে এ'টা মেনে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কারণ কোন ভাল কাজ করার জন্যে কিছু ত' দায় স্বীকার করতেই হয়, একই সাথে কিছুটা স্বার্থ ত্যাগও করতে হয়। তাই আমি আমার শুভ ইচ্ছাকে প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠা করার জন্যে, এবং অন্যের প্রতি আমার সহৃদয়তা দেখানোর জন্যে, এইটুকু নিজের সুবিধা ও "ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা" থেকে বেরিয়ে এসে, আমি আমার স্বার্থপরতা থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছি। আমার বাবা বলেন, "তুমি যদি সত্যিই কাউকে বাঁচাতে পার, তবে তার বিনিময়ে আর সবকিছুই তোমার কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হবে। আর এটা যদি করতে পার তবেই তুমি নিঃস্বার্থ বলে দাবি করতে পারবে।" বাবা ঠিক কথাই বলেন। জীবন ও এর চারপাশ সর্ম্পকে বাবার উপলব্ধি, বাবার মন আর ব্যবহারের মতোই স্বচ্ছ্ব। 

প্রথম যেদিন ড্যাসেল আমাদের এখানে এলেন, সেদিন আসার পরপরই আমায় বিভিন্ন প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। 

নীচের অফিসে কখন ঝাড়পোছ দেওয়ার জন্যে ঝি আসে? 

বাথরুম ব্যবহার করার নিয়ম কি? একজন সদস্য কখন বাথরুম ব্যবহার করতে পারবে?শৌচাগার ব্যবহারের নিয়ম কি? কখন কখন শৌচাগার ব্যবহার করা যাবে? 

প্রশ্নগুলো শুনে তোমার হাসি আসতে পারে। কিন্তু আমরা যারা এই গুপ্তগৃহে লুকিয়ে আছি, একমাত্র তারাই জানে, তাদের প্রাত্যাহিক জীবনে প্রশ্নগুলো কতটা জরুরী আর গুরুত্বপূর্ণ। আর কারোর পক্ষে এটা বোঝা সম্ভব নয়। জান, দিনের বেলায় আমরা কোনরকম শব্দ করতে পারি না। এমনকি এমনভাবে হাঁটতে হয়, যাতে জোরে পায়ের শব্দ শোনা না যায়। কোনরকম শব্দ হলেই নীচের অফিস ঘর থেকে তা' শোনা যাবে। তখন যদি অফিসে বাইরের কোন অজানা লোক থাকে---যেমন অফিস ঘর পরিষ্কার করার ঝি, এরকম কেউ---তা'হলে সে অ্যানেক্সের ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে উঠবে। তাই এইসব সময়ে আমাদের বেশী করে সাবধান থাকতে হয়। এ'সব কিছুই আমি ড্যাসেলকে যত্ন করে সময় নিয়ে বোঝালাম। কিন্তু অবাক কাণ্ড, আমার বলার চেয়েও দ্রুতগতিতে সে সমস্ত ভুলে গেল। প্রতিটি প্রশ্ন আমায় প্রায় দু'বার করে করার পর এবং আমি ধৈর্যধরে ওকে বলার পর এবং বোঝানোর পর, আবার আমায় সেই একই প্রশ্ন করে চলেছে। অর্থাৎ আমি যা যা বলেছি, তার অনেকটাই তার মনে নেই। আমার মনে হয় শুধু সময় অতিবাহিত করার জন্যেই আমি ও'কে বললাম। অবশ্য এত দ্রুত ভুলে যাওয়ার একটা কারণও আছে। হঠাত করে ড্যাসেলের জীবনে এমন একটা পরিবর্তন এসেছে, যে সে হতচকিত হয়ে গেছে। মানুষকে যে এ'রকম করে বাঁচতে হয়, এটাই সে, তার ধারণার মধ্যে আনতে পারছে না। 

এ'ছাড়া আর সবকিছুই ঠিকঠাক চলছে। আমাদের গুপ্ত অ্যানেক্সের বাইরের জগতে কি কি ঘটে চলেছে, সে কথা আমরা ড্যাসেলের কাছে কিছু কিছু শুনছিলাম। গুপ্তগৃহে থাকার জন্যে আমরা ত' আর কিছুই জানতে বা দেখতে পারিনা। তাই আমরা ধারণাও করতে পারি না, কি হতে পারে, বা, কি ঘটে চলছে। কিন্তু দুঃখের কথা কি জান, ড্যাসেলের গল্পগুলো আমাদের মধ্যে হতাশাই শুধু বাড়িয়ে দিচ্ছিল। আমাদের অগুন্তি বন্ধু পরিচিতের ভাগ্যে যে ভয়ঙ্কর দুরাবস্থা ঘটে চলেছে, তা' আমরা শুধু শুনছিলাম আর আমাদের হতাশা বেড়ে যাচ্ছিল। প্রায় প্রতিটি সন্ধ্যেতে সৈন্যবাহিনীর সবুজ আর ধুসর রঙের লরিগুলো বোঝাই করে উদ্বাস্তু আর ইহুদিদের নিয়ে গেছে অজানা জায়গায়। শুনলাম জার্মান সৈন্য এলাকার প্রতিটি বাড়িতে কড়া নেড়ে বা ডোরবেল বাজিয়ে ডেকে, জিজ্ঞাসা করছে, "বাড়িতে কোন ইহুদি বা উদ্বাস্তু আশ্রয় নিয়েছে?" শুধু "আশ্রয় নিয়েছে কি'না", সে'কথাই জিজ্ঞাসা করছে না, কোনরকম সন্দেহ হলে, জোর করে বাড়িতে ঢুকে, নিজেরা খুঁজে দেখছে কোন ইহুদি বা উদ্বাস্তু আছে কি'না ! আর এইভাবে কোন বাড়িতে ইহুদিকে পাওয়া গেলে, তাকে ত' নিয়ে যাচ্ছেই উপরন্তু বাড়ির সবাইকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আর কোন বাড়িতে কিছু না পেলে, সাথে সাথেই পাশের বাড়িতে তল্লাশীর জন্যে চলে যাচ্ছে। তাদের হাত থেকে শেষ পর্যন্ত কারুর বাচাঁর উপায় নেই। মানুষগুলো অসহায় হয়ে, তাদের খঁজে পাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করে চলেছে। একমাত্র সে বা তার পরিবার যদি গা'ঢাকা দেয়, বা কোন নিশ্চিন্ত গুপ্তস্থানে চলে যায়, তবেই তারা জার্মান পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে পারবে। কিন্তু কতজনের আর সেই ভাগ্য বা যোগাযোগ আছে ? আনেক সময়, তারা তাদের হাতে এলাকার লোকেদের নামের তালিকা নিয়ে ঘুরছে। উদ্দেশ্য হল, যাতে নির্ধারিত বাড়িতে, অতিরিক্ত সময় নষ্ট না করে, বেল বাজাতে পারে, এবং সুনিশ্চিতভাবে কোন এক সদস্যকে ইহুদি হওয়ার অপরাধে টেনে হিঁচড়ে বার করে নিয়ে যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে আবার এরা মাথাপিছু ঘুষ নিয়ে অর্থের বিনিময়ে কাউকে কাউকে রেহাইও দিচ্ছে। বিষয়টা অনেকটা ইতিহাসের দাসযুগের সময়কার "দাসলুন্ঠন বা দাস কেনাবেচার" মত শুনতে লাগে। তবে, আমার এই কথাটা আমি রসিকতা করে বলছি না; আমার মনে হচ্ছে, তাই বলছি। বিষয়টা যাদের সঙ্গে হচ্ছে, তাদের পক্ষে, এটা শুধু কষ্টকরই নয়, উপরন্তু ভয়ঙ্কর অপমানজনক। অথবা এটা তাদের জীবন-মরণের ব্যাপার। ভয়ঙ্কর রকমের বিষাদময়। 

অনেক রাত্রে অন্ধকার হয়ে গেলে আমি চিলেকোঠার ছাদে উঠে দেখেছি, লাইন দিয়ে নিরাপরাধ ভাল মানুষগুলো জীবনের প্রতি চরম উদাসীন ও বিশ্বাসহীনতা নিয়ে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। আর তাদের পিছন পিছন তাদের শিশুরা জোরে জোরে কাঁদতে কাঁদতে চলেছে। মনে হচ্ছে যেন, কান্নাটাই তাদের শেষ মুক্তির পথ দেখাবে। লোকগুলো উদ্দেশ্যহীনভাবে হেঁটেই চলেছে, পিছনে পিছনে গেস্টাপো যুবক তর্জন গর্জন করতে করতে তাদের তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। যাওয়ার পথে যারা ক্ষণিকের জন্যেও থেমে পড়ছে, তাদের ওপর নেমে আসছে চাবুকের আঘাত। লোকগুলো আঘাতের ঘায়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আবার উঠে দাঁড়াচ্ছে অজানার দিকে এগোবার জন্যে। কারুর রেহাই নেই; বৃদ্ধ, শিশু, গর্ভবতী মহিলা, রোগে অসুস্থতায় কাতর ---- সবাইকে হাঁটতে হবে। মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিতে হবে। 

সত্যি, আমরা কত ভাগ্যবান! আমরা এখানে সুরক্ষিত ও নিশ্চিন্ত জীবনযাপন করছি। আমাদের অ্যানেক্সের বাইরে অহরহ যে মৃত্যুর মিছিল চলেছে, যে কষ্টকর দুর্বিষহ জীবনযাপন চলেছে, তার কোনটাই আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে না। আমরা এখানে কেবল আমাদের প্রিয়জন, পরিচিতজনদের জন্যে অ্যানেক্সে বসেই মনকষ্ট ভোগ করে চলেছি। কিন্তু তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কোন ক্ষমতাই আমাদের নেই। 

আমার মনে হচ্ছে, আমি এক চরম পাপিষ্ঠের মত অ্যানেক্সের গরম ঘরের নরম বিছানায় শুয়ে আছি। অথচ ঠিক এইসময় আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়তঃ ঠাণ্ডায় জমে যেতে যেতে কোন এক অমানবিক বস্তির মধ্যে কোনরকমে দিন কাটাচ্ছে। আমার সেইসব প্রিয় বন্ধুর কথা ভেবে আমার ভয় করছে কষ্ট হচ্ছে, যারা হয়তঃ সেইসব হিংস্র পশুদের হাতে ধরা পড়ে গেছে, যারা এই মুহূর্তে সারা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর এ'সব কিছু তাদের সঙ্গে ঘটছে, তার কারণ একটাই ঃ জাতিতে তারা ইহুদি। 

ইতি, 

অ্যানি। 

0 comments: