0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in

ধারাবাহিক


প্রতিস্রোত
সুবল দত্ত



II২৮II



কোলাহল তো বারণ হলো এবার কথা কানে কানে

জেরেকা

দুধঝর্ণার আড়ালে এমন সুন্দর এক উপত্যকা রয়েছে এটা এই এলাকার কারোর নজরে আসেনি। মসৃণ ঘাসে ঢাকা বিশাল এই স্বর্গীয় ভ্যালি দেখে জেরেকা অবাক। একটা অদ্ভুত ভালো লাগা তার গায়ে এখন কাঁটা দিচ্ছে। এই প্রাকৃতিক সম্পদটি জঙ্গলবাসীদের নিজস্ব। অথচ কেউই জানে না। হয়তো এখানের আগম নির্গম পথ বড়োই বিপদসঙ্কুল ও গোপন। জেরেকা মনস্থির করল সবকিছু মিটে গেলে এটি দেশ বিদেশের কাছে দৃশ্যমান করতে চেষ্টা করবে। উপত্যকা এতো বিশাল যে ওপারে পাহাড়ের পাদদেশে যেতে দলবলের অনেক সময় লেগে গেল। পাহাড়ের কোলে পৌঁছে ছায়ায় বিশ্রাম নিতে ঘাসভূমিতেই জিনিসপত্র নামিয়ে অনেকে শুয়ে পড়ল। পাহাড়টি পিরামিডের আকারের। বিশাল গ্রানাইট পাথরের চাঁই যেন থাক থাক সাজিয়ে রাখা। কালো সাদা পাথরগুলি এমন অপূর্ণ চিত্রবিচিত্র সাজানো যে সেটার দিকে তাকিয়েই থাকতে হয়। যেন কোনো ভাস্কর নিপুণ ভাবে গড়ে তুলেছেন। পাহাড়ের পাদদেশে বিশাল দুটি পাথরের খাঁজ থেকে ঢাকের মৃদু ডিমডিম শব্দ ভেসে আসছিল। সেই জায়গাটি বেশ দূরে। জেরেকা ও বয়স্ক মানুষেরা সবাই কান পেতে সচেত হয়ে গেল। এটি একটি নির্দেশ। এতে বলা হচ্ছে পাহাড়ের নিচে ব্যাঙের মতো দেখতে এক বিশাল সাদা পাথরের কাছে যেন সবাই চলে আসে। সবাই দূর থেকেই পরিষ্কার দেখল ব্যাঙের মতো দেখতে একটা ছোটোখাটো পাহাড়। সবাই সেখানে পৌঁছে দেখল একটা সাদা মসৃণ চট্টানের উপর এক ফর্সা ভিনদেশী যুবক ও একটি কমবয়েসি মেয়ে বসে রয়েছে। ওদের দুজনের শরীর ও মূখের গঠন মুণ্ডারী। ছেলেটা ওদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। ওদের মধ্যে কয়েকটি কমবয়েসি ছেলে এগিয়ে এসে কোমরে হাত দিয়ে ঝুঁকে দেখতে লাগলো। পেরোর মতো লাগছে না? কথাটা পরস্পরে আলোচনা করতে লাগল। কিন্তু পেরোর মত রাগী ও রুক্ষ স্বভাবের নয়। এ তো খুব শান্ত ভদ্র। ওরা খুব কাছে এসে মুখের কাছে মুখ এনে দেখতে লাগলো। একজন আঙুলে থুতু মেখে ওর গায়ে সেই আঙুল ঘষে দেখল রঙ ওঠে কি না। ওদের রকমসকম দেখে ওরা দুজন হেসে গড়াগড়ি। এরাও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বোকার মতো হাসতে লাগল। হাসি ক্রমে অট্টহাসি হতেই যুবকটি উঠে দাঁড়িয়ে একবার জোরে ওদের কয়েকজনের নাম ধরে ধমক দিতেই চূপ করে গেল সবাই। কেউ কেউ ফুপিয়ে ডুকরে কাঁদতে লাগল। এই তো তাদের পেরো। তাদের রক্ষাকারী। সবাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে।পেরো দেখলো জেরেকা ভিড়ের পিছনে দাঁড়িয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। পেরো ও জোঁহা পাথর আসন থেকে উঠে ভীড় সরিয়ে জেরেকার কাছে এগিয়ে এলো। জেরেকা পেরোর খুব কাছে এসে অবাক বিষ্ময়ে মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। পেরোর মুখে স্মিত হাসি। একটু ঝুঁকে জেরেকার হাত ধরে পাথরের আসনে নিয়ে এসে তার উপর বসালো। জেরেকার বিষ্ময় আর ধরে না। পেরোর শরীর মন দুইয়েরই আমূল পরিবর্তন। এও কি সম্ভব? যে পেরো জীবনে কোনদিন তার মায়ের ছায়া মাড়ায়নি চিরকাল ঘৃণা করে এসেছে সেই পেরো সুপুরুষ দেবদূত হয়ে তাকে এতো সম্মান দিচ্ছে? পেরো ও জোঁহা দুজনেই জেরেকার পায়ের কাছে মাটিতে বসে পড়ল। পেরো জেরেকার দুই পা জড়িয়ে ধরে ওর কোলে মুখ গুঁজে যখন কাঁদতে লাগল জেরেকা এই ভালোবাসার জোয়ারে নিজেকে সামলাতে পারলো না। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। দুজনের মুখে ভাষা নেই। দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে। চোখের জল আর বাধা মানে না। জেরেকা পেরোর চোখের জল আঁচল দিয়ে মুছে দিতে লাগলো। সবুজের মৌনমুখর পরিবেশে দীর্ঘ অতীত জীবনের সব কালো অভিযোগ অভিমান মুছে দিয়ে জেরেকা ও পেরো বেশ কিছুক্ষণ পর সহজ হলো।
সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ছে। পাহাড়ের ছায়া বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর ঢেকে ফেলছে। জেরেকা সবার দিকে চোখ বুলিয়ে পেরোকে ইশারা করল। পেরো বুঝল সবার খাবার ব্যবস্থা করতে হবে। পাহাড়ের খাঁজে এখনো আঁধার নামেনি। বাসা ফিরতি পাখি ও তৃণভোজি দু চারটে প্রানী দেখা যাচ্ছে। জোহা বলল এখানে এক একটা পাথরের খাঁজে এক একরকম প্রানীর বাস। ওই দূরে সাদা পাথরগুলির খাঁজে বুনো-শুয়োরের বাস।পেরো কয়েকজনকে পাঠালো এক দুটো মেরে আনতে। আরেক দলকে পাঠানো হলো একটু আগে একটা কালো পাথরের খাঁজে বন মোরগ ধরে আনতে। এখানথেকেই দেখা যায় বন মোরগের ঝাঁক। কি অপূর্ব রঙের বাহার। সেখানে গিয়ে প্রচুর ডিম আনা হল। কয়েকজন মহিলা একটু দূরের বন থেকে লতানো গাছ থেকে অনেক শতমূলী ছিঁড়ে এনেছে। আর কেউ কেউ ঝুড়ি ভরে জংলি মহুয়া কুড়িয়ে এনেছে। এইগুলো সিদ্ধ করে খেলে ভালো নেশা হয়। পেরো বলে দিয়েছে আজ রাতে এই উন্মুক্ত প্রান্তরে হবে বিশ্রাম। এখানেই হোক নতুন করে বাঁচার প্রথম নির্বিঘ্ন সোপান। আজ রাতে নাচ গান খাওয়া দাওয়া ও পান পর্ব।

0 comments: