6

গল্প - সৌম্য ব্যানার্জী

Posted in
গল্প


অপৌরুষেয়
সৌম্য ব্যানার্জী 



অমৃতদার ওখানে গেছিলাম বিজয়া উপলক্ষ্যে। উপলক্ষ্যই, কারণ লক্ষ্য প্রধানত দু’টো – আড্ডা আর সুমিত্রাবৌদির ফিশ অমৃতলোকি। অমৃতসরি নয়, লোকিই। অমৃতদার বাড়ি ছাড়া আর কোথাও খাইনি। চীজ়, রসুন আর ওরেগ্যানো দিয়ে কর্নফ্লাওয়ারে মোড়া সে এক অমৃততুল্য বস্তু। তার সঙ্গে আমার গিন্নীর তৈরি ছানার পায়েস সহযোগে জোর আড্ডা চলছিলো। 

বিষয়বস্তুটা একটু স্পর্শকাতর দিকে মোড় নিচ্ছিলো। ইদানীং যে ‘‘মীটূ’’ অভিযান সারা দেশ জুড়ে তরঙ্গ তুলেছে, তার দোলা এই সুদূর বঙ্গের কোমল অঙ্গেও এসে লেগেছে, এবং সেই অভিঘাত অনেক বঙ্গপুঙ্গবের সিংহহৃদয়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে। আশপাশের অতিপরিচিত আটপৌরে মুখগুলোকেও হঠাৎ হঠাৎ কেমন যেন প্রতিবাদিনী রণচণ্ডী মনে হচ্ছিলো। আমার যদিও ব্যাপারটা মন্দ লাগছিলো না। এই প্রতিবাদটা অনেকদিন আগেই হওয়া উচিত ছিলো। সে কথা বলাতে আমাদের পণ্ডিতপ্রবর শুধু একটু মুচকি হাসলেন। 

কিন্তু সঞ্চয়িতা, মানে আমার গিন্নী, ছাড়ার পাত্রী নয়। বললো, ‘‘হাসছেন যে? ভুল বলছে নাকি?’’ 

অমৃতদা একটা মাছের টুকরো কাঁটায় বিঁধিয়ে তুলে খানিকক্ষণ মন দিয়ে নিরীক্ষণ করে বললো, ‘‘না। ভুল বলছে না। কিন্তু কত আগে হওয়া উচিত ছিলো বলে মনে হয় প্রতিবাদ?’’ বলে টুকরোটা মুখের ভিতর চালান করে দিয়ে চোখ বুজে চিবোতে লাগলো। 

আমি আর সঞ্চয়িতা একবার মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলাম। তারপর আমি বললাম, ‘‘সেই রামায়ণের যুগ থেকেই তো চলে আসছে এ জিনিস।’’ 

‘‘শিওর?’’ অমৃতদার যাকে বলে স্পাইন-চিলিং প্রশ্ন। কিন্তু ওই যেমন বললাম, সঞ্চয়িতা দেখলাম প্রায় সেইরকম ভাবেই ক্ষেপে উঠলো... 

‘‘শিওর মানে? সীতার অ্যাবডাকশনটা নারীত্বের অবমাননা নয় বলছেন নাকি?’’ 

অমৃতদা বোধহয় এতটা রণং দেহি আশা করেনি। একটু নড়েচড়ে বসে বললো, ‘‘একশোবার অবমাননা। কিন্তু আমি সে কথা বলছি না। বলছি, পুরুষতন্ত্রের এই গা-জোয়ারি রামায়ণের যুগ থেকেই চলে আসছে, তার আগে থেকে নয়, সেটা শিওর কি?’’ 

রামায়ণের আগে? চিন্তায় পড়লাম। চট করে কিছু মনে পড়লো না। সঞ্চয়িতাও দেখি ভুরু-টুরু কুঁচকে কি যেন ভেবে হঠাৎ বললো, ‘‘অহল্যা?’’ 

‘‘উঁহুঁ।’’ মাথা নাড়লো অমৃতদা। ‘‘ওতে মহিলারও কিছুটা সায় ছিলো। নাহলে গৌতম অভিশাপ দিতেন না, আর ইন্দ্রের ওই গৌতমের রূপ ধরে আসার গল্পটাও তৈরি হতো না।’’ ঠিক তখনই সুমিত্রাবৌদি কফির ট্রে নিয়ে রান্নাঘর থেকে ঢুকলো। ওর দিকে একবার আড়চোখে চেয়ে অমৃতদা বললো, ‘‘সায় থাকাটাই স্বাভাবিক। বেদ-আওড়ানো কাঠখোট্টা ঋষির সেবা করতে করতে যে কোনও সুন্দরী যুবতীরই বোর হয়ে যাওয়ার কথা। তার উপর যদি ইন্দ্রের মতন হ্যান্ডসাম, ক্যারিজ়ম্যাটিক রাজপুরুষ এসে প্রেম নিবেদন করে, তাহলে আর বেচারি অহল্যা কি করে সামলায়?’’ 

সুমিত্রাবৌদি ঠক করে ট্রেটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে কটমট করে তাকালো অমৃতদার দিকে। অমৃতদা শুধু একবার গলা খাঁকড়ানি দিয়ে আবার একটু নড়েচড়ে বসলো। এমনি সময় হলে হয়তো আমাদের কাঠখোট্টা অধ্যাপক আর তার নট-সো-যুবতী-এনিমোর স্ত্রীকে নিয়ে একটু মশকরা করা যেতো। কিন্তু তখন মাথায় ঘুরছে প্রাকপুরাণিক মীটূ। তাই ও ব্যাপারটা উপেক্ষা করে বললাম, ‘‘অহল্যা নয়? তাহলে কে? শকুন্তলা?’’ 

‘‘ন্যাহ!’’ কথাটা একেবারে নস্যাৎ করে দিলো অমৃতদা। ‘‘ছেলেকে নিয়ে রাজসভায় গিয়ে হাজির হবার পর দুষ্মন্তের রিফ়িউজ়ালটাকে যদি সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট বলতে চাও, তাহলে আলাদা কথা।’’ বৌদি, সঞ্চয়িতা দু’জনেই ভুরু কুঁচকে বসে আছে। কথাটা ঠিকই। দুষ্মন্তের রিফ়িউজ়াল চূড়ান্ত অসভ্যতা হলেও যৌন নিগ্রহের পর্যায়ে পড়ে না। ‘‘তা যদি না হয়, তাহলে কণ্ব মুনির আশ্রমে ওদের প্রেমে কোনও ঘাটতি ছিলো না। অন্তত শকুন্তলার দিক থেকে কোনও দ্বিধা-কুন্ঠা ছিলো না। গণ্ডগোলটা পাকিয়েছেন কালিদাস।’’ বলে অমৃতদা কফির মাগ তুললো। 

কালিদাস? তিনি আবার কি করলেন? ‘‘এটা সব ব্যাটাকে ছেড়ে দিয়ে বেঁড়ে ব্যাটাকে ধর হয়ে যাচ্ছে না?’’ বুক ঠুকে বলেই ফেললাম। আমি দেখেছি, বউ সঙ্গে থাকলে আমার সাহস সব সময় বেড়ে যায়। 

অমৃতদা একবার ভ্রূকুটি করে তাকালো আমার দিকে। তারপর স্বভাবসিদ্ধ খ্যাঁকখেঁকে গলায় বললো, ‘‘বেঁড়ে পাকামি করলে বেঁড়ে ব্যাটাকেই ধরতে হবে।’’ 

‘‘মানে?’’ সঞ্চয়িতার প্রশ্ন। জানতাম এটা অধ্যাপক সাহেব অ্যাভয়েড করতে পারবে না। 

‘‘মানে ওরিজিন্যাল শকুন্তলা, অর্থাৎ মহাভারতের শকুন্তলা আর কালিদাসের শকুন্তলার মধ্যে অনেক তফাৎ।’’ 

‘‘কি রকম?’’ 

অমৃ়তদা কফিতে লম্বা চুমুক দিয়ে মাগটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে একটা সিগারেট ধরালো। তারপর সিগারেটের প্যাকেট আর ওর জ়িপো লাইটার আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘‘বেদব্যাসের শকুন্তলা কালিদাসের নায়িকার মতন লজ্জাশীলা, ব্রীড়াবনতা ছিলেন না মোটেই। বিশ্বামিত্র আর মেনকার মেয়ের অমন হবার কথাও নয়। আশ্রমে দুষ্মন্তের প্রতি প্রেম প্রকাশে কোনও রকম কুন্ঠা ছিলো না শকুন্তলার। মহাভারতে ওসব অভিজ্ঞান আংটি-ফাংটির গল্পও নেই। ছেলেকে নিয়ে সোজা গিয়ে দুষ্মন্তের সভায় হাজির হয়েছিলেন মহিলা। দুষ্মন্ত তার পিতৃত্ব অস্বীকার করার পর রাজাকে তাঁর সভাসদদের সামনে রীতিমতন কড়া ভাষায় তিরস্কার করেছিলেন, এবং রাজ-আতিথ্য অস্বীকার করে ছেলের হাত ধরে বেরিয়েও গেছিলেন। সভাসদদের কথাতেই দুষ্মন্তকে বাধ্য হয়ে নিজের কথা গিলে ফেলে শকুন্তলাকে ফেরত ডেকে ভরতকে ছেলে বলে স্বীকার করতে হয়। মহাভারত সেইরকমই বলছে। কালিদাস আপন মনের মাধুরী মিশায়ে যে কাব্য রচনা করেছেন, তাতে মাধুর্য আছে, কিন্তু সত্যের অপলাপ ঘটেছে। মহাভারতকে রেফারেন্স ধরলে অন্তত তাই-ই।’’ 

খানিকক্ষণ নৈঃশব্দ। অমৃতদা ফুস ফুস করে সিগারেট টানছে। আমিও একটা ধরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘তাহলে কার কথা বলছো?’’ 

অমৃতদা একটু অদ্ভুতভাবে পর পর আমাদের তিনজনের উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললো, ‘‘সহ্য করতে পারবে তো?’’ 

আমরা থ! এ আবার কি নতুন স্টাইল অধ্যাপক সাহেবের? 

‘‘ব্যাপারটা নিতান্তই যাকে বলে ন্যক্কারজনক, এবং ব্যাপারটার সঙ্গে আমাদের, মানে এই বঙ্গদেশের ইতিহাস জড়িয়ে আছে।’’ 

‘‘কি রকম?’’ আমরা নড়েচড়ে বসলাম। সুমিত্রাবৌদির হাবভাব দেখে বুঝলাম, গল্পটা ওর কাছেও নতুন। পাগলা প্রোফেসরের সঙ্গে ঘর করতে করতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে – এমন একটা ভাব দেখালেও এই গল্পগুলোর আকর্ষণ ওর কাছে এখনও কমেনি। সুমিত্রাবৌদি প্রোফেসর অমৃত অধিকারীর অধ্যাপক জীবনের প্রথম দিককার ছাত্রী। ওই গল্পগুলো শুনেই সম্ভবত প্রেমে পড়েছিলো। কিন্তু সে যাক... এখন বঙ্গদেশের ইতিহাসের ন্যক্কারজনক গল্প। 

‘‘ঋষি উতথ্যের নাম শোনোনি তোমরা। বৈদিক ঋষি। তাঁর স্ত্রী মমতার তখন গর্ভাবস্থা। উতথ্য আশ্রমে ছিলেন না। সেই অবস্থায় তাঁর ভাই বৃহস্পতি এসে মমতার সঙ্গম কামনা করেন। মমতা ন্যাচারালি রিফ়িউজ় করেন। কিন্তু বৃহস্পতি মানার পাত্র নন। জবরদস্তি সঙ্গম করেন। সেই সময় নাকি মমতার গর্ভস্থ ভ্রূণ পা দিয়ে তাঁর শুক্রপ্রবেশের পথ বন্ধ করে দেয়। তাতে রাগ করে বৃহস্পতি সেই ভ্রূণকে দীর্ঘ তমসায় নিক্ষিপ্ত হবার, অর্থাৎ অন্ধত্বের অভিশাপ দেন। উতথ্যের সেই পুত্রের নাম দীর্ঘতমা। গর্ভবতী মায়ের উপর কাকার বলাৎকারের কারণে প্রাপ্ত অন্ধত্ব নিয়ে জন্ম। 

‘‘দীর্ঘতমাও বৈদিক ঋষি। মন্ত্রদ্রষ্টা হিসেবে ঋগ্বেদে তাঁর নাম আছে। কিন্তু জন্মের ওই গণ্ডগোলের কারণে অনিবার্যভাবে ভদ্রলোকের মনস্তত্ত্বটা একটু বেখাপ্পা রকমের হয়ে যায়। বেদ-বেদাঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নাকি বশিষ্ঠমুনিরকামধেনুর কাছ থেকে গোধর্মও শিক্ষা করেন।’’ অমৃতদা আমার দিকে তাকালো। ‘‘গোধর্ম মানে বোঝো?’’ 

‘‘কি? ওই যা এখন চলছে দেশ জুড়ে? গোরক্ষা-গোমূত্র জাতীয় ব্যাপা...’’ 

‘‘তোমার মুণ্ডু!’’ ছোট্ট করে বেঁড়ে ব্যাটার শোধটা নিয়ে নিলো অমৃতদা। ‘‘গোধর্ম হলো পশুদের মতন প্রকাশ্যে সঙ্গম করার ধর্ম। মানে, যেখানে সেখানে, যখন তখন। বুঝলে?’’ 

আমি বৌদি আর সঞ্চয়িতার দিকে তাকালাম, ব্যাপারটা ওদের জন্য ওভ়ারডোজ় হয়ে যাচ্ছে কি না বোঝার জন্য। মনে হলো দু’জনেই একটু অস্বস্তিতে পড়েছে। আসলে এই জাতীয় আলোচনা আমাদের এর আগে কখনও একসঙ্গে হয়নি।যাই হোক, কিছু করার নেই। অমৃতদা ডিসক্লেইমারটা দিয়েই রেখেছে। কিন্তু একেই কি ও ন্যক্কারজনক ঘটনা বলছে? ঘটনাটা বেশ খারাপ নিঃসন্দেহে, কিন্তু বঙ্গদেশের ইতিহাসের সঙ্গে এর কি সম্পর্ক? 

আমাকে কিছু বলতে হলো না। সঞ্চয়িতাই প্রশ্ন করলো... ‘‘তারপর?’’ 

‘‘তারপর একসময় দীর্ঘতমার ব্যবহারে তিতিবিরক্ত হয়ে পাড়ার লোকে মিলে তাঁকে মারধর করে তাড়িয়ে দিলো। তাঁর নিজের স্ত্রী, পুরাণ যাঁর নাম বলছে প্রদ্বেষী, তিনি এবং তাঁর ছেলেরাও এদের মধ্যে ছিলেন এবং তাঁরাওদীর্ঘতমার ব্যবহারেঅতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন। তাই এই সুযোগে তাঁরা সবাই মিলে তাঁকে ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দিলেন। 

‘‘আহত, প্রৌঢ়, অন্ধ দীর্ঘতমা ভাসতে ভাসতে নদীর পূর্ব পারে গিয়ে পৌঁছলেন। সেখানে অসুররাজ বলির রাজত্ব। শস্য-শ্যামলা সম্পন্ন দেশ। কিন্তু রানী সুদেষ্ণা নিঃসন্তান। অনার্যদের দেশ, ব্রাহ্মণ-টাহ্মণ বিশেষ যেতো না ওদিকে। তাই দীর্ঘতমাকে পেয়ে বলি হাতে চাঁদ পেলেন। নিয়োগপ্রথা তখন পুরোমাত্রায় সচল, এবং বীজী পিতা হিসেবে ব্রাহ্মণ ঋষিদের ডিমান্ডও বেশ হাই। বীজী পিতা জানো তো?’’ সঞ্চয়িতার দিকে তাকালো অমৃতদা। 

‘‘মানে, ব্যাস যেরকম ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুদের বাবা ছিলেন?’’ 

‘‘হুঁ। নারীর উর্বরতাকে বৈদিক যুগে ভূমির উর্বরতার সঙ্গে তুলনা করা হতো। সেই ক্ষেত্র কর্ষণ করে যিনি বীজ বপন করেন, তিনি বীজী পিতা। সেই সন্তানরা তাঁর ক্ষেত্রজ সন্তান। শুধু ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডু না, পাণ্ডবরাও সবাই দেবতাদের ক্ষেত্রজ সন্তান।সন্তানোৎপাদনে অক্ষম পুরুষরা সেযুগে নিয়োগপ্রথার আশ্রয় নিতেন। সেকালে মানুষের বিশ্বাস ছিলো, পুত্রের হাতের পিণ্ড না পেলে অনন্ত নরকবাস করতে হয়।’’ 

‘‘কিন্তু ওইভাবে যে পুত্রই হবে, কন্যা নয়, তার কি গ্যারান্টি ছিলো?’’ সুমিত্রাবৌদির মোক্ষম প্রশ্ন। 

‘‘সেটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার।’’ একটু থেমে অমৃতদা বললো, ‘‘ভারতীয় পুরাণ-মহাকাব্যে নিয়োগজাত সন্তানের যে এত ভূরিভূরি উদাহরণ আছে, তারা সবাই পুত্র। একজনও কন্যার কথা নেই। ব্যাপারটা কিভাবে সম্ভব হতো জানি না, কিন্তু এই সব ঋষিরা নাকি সঙ্গমকালেই সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করে দিতে পারতেন।’’ 

‘‘এবং সেটা সব সময়ই পুং হতো। বাঃ!’’ সঞ্চয়িতার গলায় শ্লেষটা রীতিমতন ধারালো শোনালো। 

‘‘গালাগাল দিতেই পারো। দেওয়াই উচিত।’’ অমৃতদা মুখটা একটু করুণ করে বললো, ‘‘কিন্তু ভেবে দ্যাখো, একটা কৃষিভিত্তিক, যুদ্ধবাজ সমাজ। খুব বেশিদিন হয়নি শিকারী-সংগ্রাহক অবস্থা থেকে উন্নীত হয়েছে। পুরুষের বাহুবলের উপর ভরসা করেই তার অগ্রগতি। তাই পুরুষের প্রাধান্যটা অন্যায় হলেও আশ্চর্য নয়। কিন্তু প্রাধান্য মানেই যে গা-জোয়ারির অসভ্যতা নয়, সেটাও অনস্বীকার্য।’’ 

সঞ্চয়িতা একটু উত্তেজিতভাবে কি যেন বলতে যাচ্ছিলো। কিন্তু এই বাদানুবাদে গল্পটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। সেটা এখনও শেষ হয়নি, কারণ বঙ্গদেশের ইতিহাসের প্রসঙ্গটা আসেনি এখনও। আর তা ছাড়া, এই একটা বিতর্কের কোনও অন্ত নেই। তাই সঞ্চয়িতাকে থামিয়ে দিয়ে আমি বললাম, ‘‘তারপর কি হলো? বঙ্গদেশের ইতিহাস কোথায় গেলো?’’ 

অমৃতদা আমার দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলো। কফিতে শেষ চুমুকটা দিয়ে মাগটা নামিয়ে রাখলো। তারপর আবার বলতে আরম্ভ করলো... ‘‘বলি ঋষিভাগ্যে পুত্রলাভের জন্য প্রস্তুত হলেন। রানী সুদেষ্ণাকে বললেন দীর্ঘতমার সঙ্গে সঙ্গম করতে। কিন্তু বৃদ্ধ, রুক্ষ এবং সম্ভবত অপরিস্কার মুনিকে দেখে সুদেষ্ণার প্রবৃত্তি হলো না।নিজে না গিয়ে তাই তিনি এক শূদ্রা দাসীকে পাঠিয়ে দিলেন।’’ 

একটা ছোট্ট বিরতি। বুঝলাম, আমাদের কথক ঠাকুর রেসপন্স চাইছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘মহাভারতের অম্বালিকার মতন?’’ 

‘‘এগ্জ্যাক্টলি।’’গল্প বলার সময় এই জাতীয় রেসপন্সে অমৃতদা সবসময় খুশি হয়। ‘‘দ্বৈপায়ন অন্ধ ছিলেন না। তিনি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু তিনি সহৃদয় মানুষ ছিলেন। দীর্ঘতমা তা ছিলেন না। তাই শূদ্রা দাসীর গর্ভসঞ্চার করার পর যখন তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর সঙ্গে ছলনা করা হয়েছে, তিনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বলিকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হলেন। বলি প্রচুর সাধ্যসাধনা করে তাঁকে নিরস্ত করলেন। সুদেষ্ণাকে বকাবকি করে তাঁর কাছে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন। সুদেষ্ণা বাধ্য হলেন যেতে। 

‘‘কিন্তু দীর্ঘতমা অত সহজে ছাড়ার পাত্র নন। সুদেষ্ণার উপর তাঁর রাগ হয়েছে, এবং তার ঝাল তিনি মিটিয়েই ছাড়বেন। তাই তিনি শর্ত রাখলেন...’’ 

অমৃতদা থেমে গিয়ে আড়চোখে একবার সঞ্চয়িতা আর একবার বৌদির দিকে চাইলো। সিগারেটে শেষ টানটা মেরে সেটাকে অ্যাশট্রেতে ঘষে নেভালো। তারপরও দেখি চুপ করে আছে। আমার আগেই সঞ্চয়িতা প্রশ্ন করলো, ‘‘কি শর্ত রাখলেন?’’ 

অমৃতদা দু’বার গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, ‘‘তাঁর সর্বাঙ্গে দই, ঘি, মধু ইত্যাদি মাখিয়ে সেটা সুদেষ্ণাকে চেটে খেতে হবে।’’ 

‘‘ইস্! ছিঃ!’’ সুমিত্রাবৌদি প্রায় আর্তনাদ করে উঠলো। সঞ্চয়িতা খানিকক্ষণ গোল গোল চোখ করে অমৃতদার দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর বললো, ‘‘এটা লিখেছে পুরাণে?’’ 

‘‘প্রমাণ চাই? বই বার করে দেখাবো?’’ 

‘‘না, না। মানে, এ তো জঘন্য ব্যাপার!’’ 

‘‘সেই জন্যই বলেছিলাম, সহ্য করতে পারবে তো?’’ 

খানিকক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর আমিই জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘তারপর? সুদেষ্ণা তাই করলেন?’’ 

‘‘না করে উপায় কি?’’ 

‘‘তারপর?’’ 

‘‘তারপর দীর্ঘতমার ঔরসে সুদেষ্ণার গর্ভে বলিরাজার পুত্রলাভ হলো। একাদিক্রমে পাঁচজন। তাদের নাম অঙ্গ, বঙ্গ, পুণ্ড্র, সুহ্ম আর কলিঙ্গ।’’ 

‘‘এগুলো তো সব রাজ্যের নাম।’’ 

‘‘হুঁ। পূর্ব ভারতের পাঁচটি প্রাচীন রাজ্য। অঙ্গদেশ হলো এখনকার বিহারের খানিকটা অংশ। পুণ্ড্র উত্তরবঙ্গ। সুহ্ম দক্ষিণবঙ্গের রাঢ় অঞ্চল। কলিঙ্গ তো জানোই।’’ 

‘‘মানে বলছো, এরা পাঁচ ভাই এই পাঁচটা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলো?’’ 

‘‘পুরাণকে ইতিহাসের ইঙ্গিত বলে মানতে হলে তো সেইরকমই মনে হয়।’’ 

‘‘কত বছর আগেকার ঘটনা হতে পারে এটা?’’ সঞ্চয়িতার প্রশ্ন। 

‘‘সেটা সঠিকভাবে বলা কঠিন। তবে মহাকাব্যিক যুগেরও অনেক আগের। আজ থেকে সাড়ে পাঁচ-ছ’ হাজার বছর আগেকার হলেও অবাক হওয়ার নেই।’’ 

খানিকক্ষণ নৈঃশব্দের পর সঞ্চয়িতা বললো, ‘‘এ জিনিস তাহলে এ দেশে চিরকাল হয়ে আসছে।’’ 

‘‘শুধু এ দেশে নয়, ম্যাডাম।’’অমৃতদা একটু হাসলো। ‘‘চিরকাল সর্বত্র হয়ে আসছে। ওটা আমাদের জেনেটিক কোডিং-এর অন্তর্গত। ইন ফ্যাক্ট, যে প্রজাতির যে জেন্ডার বেশি শক্তিশালী, সে-ই যে ডমিনেট করবে, শক্তির সুযোগ নেবে, সেটাই প্রকৃতির নিয়ম। বেশির ভাগ পোকামাকড়, সরীসৃপের ক্ষেত্রে সেটা মেয়েরা করে। জানো তো, মেয়ে ব্ল্যাক উইডো মাকড়শা বা প্রেয়িং ম্যান্টিসরা সঙ্গমের পর পুরুষদের খেয়ে ফেলে?’’ 

‘‘হ্যাঁ, জানি।’’ সঞ্চয়িতা ফোঁস করে উঠলো, ‘‘কিন্তু ওটা কোনও এক্সকিউজ় নয়।’’ 

‘‘এক্সকিউজ় দিচ্ছি না।’’ অমৃতদা একটু বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়লো। ‘‘প্রকৃতির নিয়মের কথা বলছি। কিন্তু এটাও অনস্বীকার্য যে, মানুষের এতদিনে এই সব নিয়মের বাইরে চলে আসা উচিত ছিলো। হিউম্যানকাইন্ড শুড হ্যাভ় ইভ়ল্ভ়ড আউট অফ় দীজ় ডিসক্রিমিনেটরি ল’জ় অফ় নেচার বাই নাও।’’ 

‘‘সেটা তাহলে হলো না কেন?’’ আবার মোক্ষম প্রশ্ন সুমিত্রাবৌদির। 

অমৃতদা বৌদির দিকে তাকালো। এবার একটু বেশি বিষণ্ণভাবে মাথা নাড়লো। ‘‘এর উত্তর আমার জানা নেই। সমাজতাত্ত্বিক বা জীনবিজ্ঞানীদের থাকলেও থাকতে পারে। আমি শুধু এইটুকু বলতে পারি যে, কোনও শিক্ষা, কোনও সংস্কার দিয়েই আজ পর্যন্ত এ জিনিসের সম্পূর্ণ নিরসন করা যায়নি। বেদজ্ঞ ঋষি থেকে আরম্ভ করে শৌর্যবান রাজা অবধি, সবাই এই ধরণের কাণ্ড করেছেন। নাহলে আর্য সংস্কৃতিরপীঠস্থান হস্তিনাপুরের রাজসভায় ওই ঘটনা ঘটে!’’ 

‘‘দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের কথা বলছেন?’’ সঞ্চয়িতা জিজ্ঞেস করলো। 

‘‘হুঁ। ওর থেকে বড়ো লজ্জাজনক ঘটনা পৃথিবীর কোনও ইতিহাস-পুরাণে আছে বলে আমার জানা নেই।’’ অমৃতদার ভুরু দু’টো অবিমিশ্র বিতৃষ্ণায় কুঁচকে উঠলো। ‘‘নিজেদের বাড়ির বউকে যে ওভাবে অপমান করা যায়, সেটা মহাভারত না পড়লে বিশ্বাস করা কঠিন।’’ 

‘‘কিন্তু... দ্রৌপদীও তো অপমান করেছিলো না? স্বয়ংবরসভায় কর্ণকে আর ইন্দ্রপ্রস্থে দুর্যোধনকে?’’ প্রশ্নটা করেই বুঝতে পারলাম কি প্রচণ্ড ভুল করে ফেলেছি। অমৃতদা কিছু বলার আগেই সঞ্চয়িতা আমার দিকে বিষদৃষ্টি হেনে বললো, ‘‘কেউ কাউকে বিয়ে করতে রিফিউজ় করলে তাকে রেপ করা বা তার মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারা তাহলে জাস্টিফ়ায়েড?’’ 

‘‘না না! আমি তাই মীন করিনি...’’ 

‘‘তাহলে কি মীন করেছো?’’ 

‘‘মানে, কর্ণকে ওভাবে সবার সামনে... সূতপুত্র বলে গালাগালি দেওয়াটা... মানে, অকারণে ওরকম...’’ আমি আমতা আমতা করতে করতে কোনওরকমে বললাম। 

‘‘অকারণে নাকি? তুমি শিওর?’’ 

অমৃতদার এই গলাটা আমার খুব চেনা। একেবারে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। সোজা আত্মসমর্পণ করাটাই সব থেকে নিরাপদ। ‘‘আমার ভুল হয়ে গেছে। এইবারটি ক্ষমা করে দাও। বেশ করেছিলো দ্রৌপদী কর্ণ আর দুর্যোধনকে অপমান করে।’’ 

‘‘এই জন্যই বলে অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী।’’ 

বুঝলাম, আজ আর সহজে নিষ্কৃতি নেই। যথাসম্ভব গোবেচারার মতন মুখ করে রইলাম। কিন্তু তাতেও রেহাই নেই। প্রশ্নবাণ ধেয়ে এলো... ‘‘দুর্যোধনকে অপমান করার কথাটা কোথায় পেয়েছো?’’ 

‘‘ম্... মহাভারতে।’’ আর কোথায় বলবো? 

‘‘কোন মহাভারতে?’’ 

‘‘রা... রাজশেখর বসু?’’ 

‘‘তাই নাকি? আনবো বইটা? বার করে দেখাতে পারবে কোথায় আছে?’’ 

‘‘নেই?’’ 

‘‘না, নেই। রাজশেখর বসু, কালীপ্রসন্ন সিংহ, কোত্থাও নেই। কারণ ওরকম কোনও ঘটনার কথা মহাভারতে নেই।’’ 

‘‘তাহলে?’’ 

‘‘ওটা কাশীদাসী কল্পনা। কাশীরাম বাঙালি ছিলেন, তাই তাঁর নায়িকাও বাঙালি।’’বলে অমৃতদা একবার সঞ্চয়িতার দিকে আড়চোখে তাকালো, আর আমিও বুঝলাম যে আমার ফাঁড়াটা এ যাত্রা কেটে গেলো। 

সঞ্চয়িতা কিছু বলার আগেই অমৃতদা আবার বলতে আরম্ভ করলো... ‘‘ইন্দ্রপ্রস্থের রাজসভার আর্কিটেকচরাল স্প্লেন্ডর-এ দুর্যোধনের নাকানিচোবানি খাওয়া দেখে ভীম-অর্জুন-নকুল-সহদেবরা হেসেছিলেন। রীতিমতন খ্যাঁকখ্যাঁক করেই হেসেছিলেন। সেকথা মহাভারতে আছে। কিন্তু দ্রৌপদীর হাসির কথা কোথাও নেই। আর কর্ণকে ওভাবে অপমান করা ছাড়া দ্রৌপদীর সামনে আর কোনও পথ ছিলো না।’’ 

‘‘কেন? এমনি রিফ়িউজ‌় করতে পারতো না?’’ 

‘‘না। বীর্যশুল্ক প্রদানকারীকে অত সহজে রিফ়িউজ় করা যায় না।’’ 

‘‘কিন্তু...’’ আমার ততক্ষণে আবার সাহস বেড়েছে। বহুদিনের একটা কনফ়িউশন দূর করার এমন সুযোগ বার বার আসবে না। ‘‘রিফ়িউজ় করাটাকি খুব দরকার ছিলো? কর্ণকে কি বিয়ে করা যেতো না? এমন তো নয় যে দ্রৌপদীর অর্জুনের সঙ্গে বিয়ের আগে থেকে প্রেম-ট্রেম...’’ 

‘‘তার চাইতেও অনেক বেশি কিছু ছিলো।’’ অমৃতদা আমায় থামিয়ে দিলো। ‘‘অবসেশন ছিলো। ব্রেইনওয়াশ করা হয়েছিলো দ্রৌপদীর ছোটোবেলা থেকে অর্জুনকে নিয়ে।’’ 

‘‘ব্রেইনওয়াশ? কে করেছিলো? কেন?’’ 

‘‘দ্রূপদ করেছিলেন। দ্রোণাচার্যকে গুরুদক্ষিণা দেওয়ার জন্য অর্জুন দ্রূপদকে ধরে এনেছিলেন... মনে আছে?’’ 

‘‘হ্যাঁ... কিন্তু, তাতে তো... মানে, উল্টোটাই হওয়ার কথা নয়?’’ 

‘‘না। ঘটনাক্রমগুলো মনে করো। দুর্যোধন-কর্ণরা প্রথমে গেলেন এবং দ্রূপদের আর্মির কাছে হেরে ফিরে এলেন। তারপর ভীম-অর্জুনরা গেলেন। সেটাও অর্জুনের ডিসিশন। তিনি পাঞ্চালবাহিনীর শক্তি মেপে নিতে চেয়েছিলেন। তাঁর লক্ষ্য, দ্রূপদকে ধরা। তিনি ভীমকে লিটেরালি পাঞ্চালদের উপর আনলীশ করে দিলেন। ভীমের যুদ্ধের স্টাইলই ওইরকম – বিধ্বংসী, ভয়াবহ। টেরিফ়ায়িং। দ্রূপদের সৈন্যদের সম্পূর্ণ মনোযোগ তাঁর দিকে চলে গেলো, এবং তারা তাঁকে সামলাতে সামলাতে অর্জুন দ্রূপদকে ধরে ফেললেন। ধরার সঙ্গে সঙ্গে কি করলেন? ভীমকে পাঞ্চালসৈন্য সংহার করা থেকে নিরস্ত করলেন। তাঁর লক্ষ্যপূরণ হয়ে গেছে। দ্রূপদের সঙ্গে তাঁর কোনও শত্রুতা নেই। তাঁর সঙ্গে নিজেদের আত্মীয়তার কথা ভীমকে মনে করিয়ে দিয়ে অর্জুন চট করে যুদ্ধ থামিয়ে দিলেন, এবং দ্রূপদকে নিয়ে সোজা দ্রোণাচার্যের কাছে হাজির করলেন। বুঝলে?’’ 

‘‘বুঝলাম। দ্রূপদ অল্পবয়সী অর্জুনের ম্যাচিওরিটি দেখে ইম্প্রেস্ড হয়ে গেলেন। তাই তো?’’ 

‘‘ইয়েস। ম্যাচিওরিটি অ্যান্ড প্রিসিশন। এবং সেই সঙ্গে অবিশ্বাস্য যুদ্ধক্ষমতা। সেই যে দ্রূপদ কালোপানা কুরুবংশীয় ছেলেটিকে মার্ক করে নিলেন, স্বয়ংবর সভার আগের রাত পর্যন্ত মেয়ের কানে তার গুণগান গেয়ে গেলেন। শুধু দ্রূপদ নন, আমার ধারণা ধৃষ্টদ্যুম্নও বোনের কাছে একইরকম প্রশংসা করে গেছেন অর্জুনের। সেই প্রশংসা শুনে শুনে বড়ো হয়েছিলেন দ্রৌপদী, এবং তাঁর মনে অর্জুনকে নিয়ে অবসেশন তৈরি হয়েছিলো। তাই স্বয়ংবরসভায় যখন তিনি বুঝলেন যে কর্ণ সম্ভবত লক্ষ্যভেদ করে ফেলবেন, এবং একবার সেটা করে ফেললে আর কিছু করার থাকবে না, তখন দ্রৌপদীর সামনে ওই কথা বলা ছাড়া আর কোনও অপশন রইলো না।’’ 

‘‘সূতপুত্র?’’ 

‘‘হুঁ। ওটা ছাড়া আর কোনও ভ়্যালিড গ্রাউন্ড ছিলো না কর্ণকে রিফ়িউজ় করার।’’ 

‘‘বুঝলাম। কিন্তু একটা কথা বলো, দ্রোণাচার্যের কাছে অপদস্থ হওয়ার পর দ্রূপদ যে যজ্ঞ করেছিলেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন আর দ্রৌপদীর জন্ম সেই যজ্ঞের আগুন থেকে না?’’ 

‘‘চাইলে বিশ্বাস করতে পারো। কিন্তু আমার মতন কাঠখোট্টা বেরসিকরা বলবে, ওসব মহাকবির আপন মনের মাধুরী। যজ্ঞ একটা দ্রূপদ করেছিলেন বটে, কিন্তু আমার ধারণা, সেটা ছিলো যাকে বলে সেরিমোনিয়াল ভ়াওয়িং অফ় রিভ়েঞ্জ। অগ্নিসাক্ষী করে কুরুবংশের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা। সেটা মূলত ধৃষ্টদ্যুম্নই করেছিলেন, কিন্তু আল্টিমেটলি যখন দেখা গেলো কুরুবংশ ধ্বংসে তাঁর থেকে তাঁর বোনের ভূমিকা অনেক বেশি, তখন দ্রৌপদীও সেই মিথ-এ শামিল হয়ে গেলেন।’’ 

‘‘হুঁ! ইন্টেরেস্টিং!’’সঞ্চয়িতা কফি শেষ করলো। ওর চিরকাল চা-কফি একটু ঠাণ্ডা করে খাওয়ার অভ্যাস। মাগটা রেখে বললো, ‘‘কিন্তু দ্রৌপদী কি জানতেন যে স্বয়ংবর সভায় অর্জুন আছেন? জতুগৃহে পাণ্ডবদের পুড়ে মরার কথা তার আগে রটে গেছে না?’’ 

‘‘গুড কোয়েশ্চেন।’’ অমৃতদা মাথা নাড়লো। ‘‘বিলক্ষণ রটে গিয়েছিলো, এবং বেশির ভাগ লোকে ধরে নিয়েছিলো কুন্তী শুদ্ধ পাণ্ডবরা বারণাবতে পুড়ে মারা গেছেন। কিন্তু একজন জানতেন, খবরটা ভুয়ো। তিনি একদম মডার্ন ফ়রেন্সিক ইনভ়েস্টিগেশনের স্টাইলে সরেজমিন তদন্ত করে বুঝেছিলেন যে, জতুগৃহে যে চার্ড বডিগুলো পাওয়া গেছিলো, সেগুলো পাণ্ডবদের নয়। এবং তিনি দ্রৌপদীর স্বয়ংবরসভায় উপস্থিত ছিলেন।’’ 

‘‘ও রাইট! কৃষ্ণ!’’ আমার মনে পড়ে গেলো। কৃষ্ণ স্বয়ংবরসভায় ছদ্মবেশী পাণ্ডবদের চিনতে পেরেছিলেন। কিন্তু... ‘‘কৃষ্ণ কি দ্রৌপদীকে পাণ্ডবদের বেঁচে থাকার কথা বলে দিয়েছিলেন?’’ 

‘‘সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? কৃষ্ণ দ্রৌপদীর সখা। দাদাকে নিয়ে স্বয়ংবরে এসেছিলেন ক্যান্ডিডেট হিসেবে নয়, দর্শক হিসেবে। ব্রাহ্মণবেশী অর্জুন লক্ষ্যভেদ করার পর কৃষ্ণা যখন হাসতে হাসতে উইদাউট এনি হেজ়িটেশন তাঁর গলায় মালা দিলেন, তখন এইটাই বুঝতে হয় যে তিনি জানতেন লক্ষ্যভেত্তা অর্জুনই, আর কেউ নয়।’’ 

ঠিক তো! লজিক তো তাই-ই বলে! এভাবে তো ভাবিনি কখনও। 

‘‘আপনি না, জিনিয়াস।’’ সঞ্চয়িতা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বললো। ‘‘এইবার একটা ফাইনাল প্রশ্নের জবাব দিন দেখি। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় ওই নেভারেন্ডিং সাপ্লাই অফ় শাড়িটা কি করে সম্ভব হয়েছিলো?’’ 

অমৃতদা মুচকি হাসলো। ‘‘কি মনে হয়? কি করে হয়েছিলো? রাদার, কি ঘটেছিলো?’’ 

‘‘একটা পসিবিলিটি হলো, বিপদ বুঝে দ্রৌপদী অনেকগুলো শাড়ি গায়ে জড়িয়ে এসেছিলেন।’’ সঞ্চয়িতা বললো। 

‘‘নাকচ।’’ অমৃতদা মাথা নাড়লো। ‘‘মহাভারত বলছে, দ্রৌপদী তখন একবস্ত্রা ছিলেন। সেযুগে, এবং এযুগেও এই কিছুদিন আগে পর্যন্তও এদেশের মহিলারা মেনস্ট্রুয়েশনের সময় একবস্ত্রে, অর্থাৎ শুধু একটা শাড়ি পরে থাকতেন। প্লাস, কুরুরাজসভায় যে ওইরকম কাণ্ড ঘটতে পারে, সেটা সম্ভবত দ্রৌপদীরও কল্পনার বাইরে ছিলো।’’ 

‘‘তাহলে? খুব টাফ় কোনও মেটিরিয়ালের শাড়ি ছিলো, যেটা দুঃশাসন ছিঁড়তে পারেনি?’’একটা চান্স নিলাম। 

‘‘কিরকম মেটিরিয়াল? টারপলিনের মতন?’’ 

চুপসে গেলাম। ‘‘না, মানে... দ্রৌপদীর গায়ে তো বেশ জোর ছিলো। দুঃশাসন হয়তো টেনে খুলতে পারেনি...’’ 

‘‘সেযুগে পশম, রেশম আর সূতি ছাড়া আর কোনও টেক্সটাইল ছিলো না হে। আর দুঃশাসনও খুব ফেলনা যোদ্ধা ছিলেন না। দ্রোণাচার্যের আর্মস স্কুলের গ্র্যাজুয়েটরা কেউই তা ছিলেন না।’’ 

‘‘ক’দিন আগে কোথায় যেন পড়ছিলাম,’’ অনেকক্ষণ পর সুমিত্রাবৌদি কথা বললো, ‘‘দ্যূৎসভায় উপস্থিত যে সব রাজা ব্যাপারটা পছন্দ করছিলেন না, তাঁরা নিজেদের গায়ের চাদর দ্রৌপদীকে ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন।’’ 

‘‘হুঁ, আমিও পড়েছি।’’ অমৃতদা বললো, ‘‘কিন্তু কুরুরাজসভায় বসে ওরকম প্রকাশ্যে দুর্যোধন-কর্ণদের বিরোধিতা করার সাহস কারও ছিলো কি? যাঁদের ছিলো, তাঁরা প্রতিবাদ করেছিলেন। বিকর্ণ আর বিদুর। কিছু লাভ হয়নি। আর কারও কোনওরকম প্রতিবাদের কথা মহাভারতে নেই। তাছাড়া, কোনও মহিলাকে কেউ অ্যাসল্ট করছে, জামাকাপড় খুলে নেওয়ার চেষ্টা করছে, তাকে না থামিয়ে মহিলাকে চাদর দিয়ে ঢাকতে যাওয়ার চেষ্টাটা কষ্টকল্পনা নয়?’’ 

‘‘হুঁ, তা বটে।’’ সঞ্চয়িতা মাথা নাড়লো। ‘‘তাহলে কি হয়েছিলো? কৃষ্ণ শাড়ি যোগাচ্ছিলেন কোথা থেকে?’’ 

‘‘ক্যাচটা ওইখানেই।’’ অমৃতদা নড়েচড়ে বসলো। ‘‘কৃষ্ণ সেখানে প্রেজ়েন্টই নেই। ধারেকাছেও কোথাও নেই। তবু তাঁর মহিমায় দ্রৌপদীর মানরক্ষা হলো। কিভাবে?’’ 

‘‘কিভাবে?’’ সঞ্চয়িতা প্রতিধ্বনি করলো। 

‘‘গেস করতে পারো না?’’ 

আমরা তিনজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। তারপর যথারীতি মাথা নাড়লাম। 

‘‘সময়টার কথা ভাবো।’’ অমৃতদা বললো। 

‘‘কোন সময়?’’ 

‘‘যখন দ্যূৎসভা হচ্ছে। তার ঠিক আগের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কি?’’ 

একটু ভাবতে হলো। ‘‘যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ?’’ 

‘‘রাইট। সেখানে কি হয়েছিলো?’’ 

‘‘কি হয়েছিলো? শিশুপাল বধ?’’ 

‘‘ওটা সাবসিডিয়ারি। আসল ঘটনাটা কি হয়েছিলো?’’ 

‘‘কিসের কথা বলছো বলো তো?’’ আবার আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। 

অমৃতদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ‘‘এই হলো সাধারণ পাঠকের সমস্যা। খালি স্টান্টগুলো মনে রাখবে। আসল ঘটনা আর তার ইমপ্লিকেশন স্রেফ ভুলে মেরে দেবে।’’ 

‘‘ঠিক আছে, আমরা সাধারণ পাঠকই। সবাই তোমার মতন জিনিয়াস নয়।’’ সুমিত্রাবৌদি প্রায় ঝাঁঝিয়ে উঠলো। ‘‘এবার বলো ঘটনাটা কি হয়েছিলো।’’ 

‘‘কৃষ্ণকে পুরুষোত্তমের অর্ঘ্য প্রদান করা হয়েছিলো।’’ 

‘‘ও হ্যাঁ! তাই নিয়েই তো শিশুপালের সঙ্গে ঝামেলা।’’ সঞ্চয়িতা বললো। ‘‘কিন্তু সেটা আসল ঘটনা কেন?’’ 

‘‘আবার বলছি, সময়টা ভাবো। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের ঠিক আগে, সেই যজ্ঞকে কেন্দ্র করেই একটা বিরাট ঘটনা ঘটেছিলো। কৃষ্ণই ঘটিয়েছিলেন। তার গুরুত্ব মহাভারতীয় রাজনীতিতে সাংঘাতিক।’’ 

হঠাৎ আমার স্ট্রাইক করলো... ‘‘জরাসন্ধবধের কথা বলছো কি?’’ 

‘‘ইয়েস। এই তো মাথা খুলেছে।’’ অধ্যাপক সাহেব খুশি। ‘‘যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের আগে পর্যন্ত আর্যাবর্তের একছত্র সম্রাট ছিলেন জরাসন্ধ, জানো তো?’’ 

‘‘হ্যাঁ। নিরানব্বই না ক’জন যেন রাজাকে বন্দী করে রেখেছিলো না? যজ্ঞে বলি দেবে বলে?’’ 

‘‘জরাসন্ধের অনেক ফ্যানফলোয়িং ছিলো, জানো তো? শিশুপাল তাদের মধ্যে একজন। পৌণ্ড্রক বাসুদেব, কংস, প্রাগজ্যোতিষের রাজা নরক, কৃষ্ণের শ্বশুর বিদর্ভরাজ ভীষ্মক এবং আরও অনেকে। রীতিমতন স্ট্রং একটা পোলিটিক্যাল লবি ছিলো জরাসন্ধের। জতুগৃহদাহের পর পাণ্ডবরা যখন লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন, সেই সময় কর্ণ-দুর্যোধনদেরও একবার যেতে হয়েছিলো জরাসন্ধের বাহিনীতে যুদ্ধ করার জন্য। রাজাদের ধরে ধরে বন্দী করে রাখলে কি এরকম হতো বলে মনে হয়? সেটা কি আদৌ সম্ভব?’’ 

‘‘তাহলে?’’ 

‘‘তাহলে ওটা কৃষ্ণের প্রধান শত্রুকে যতখানি সম্ভব ভ়িলেনাস প্রতিপন্ন করার চেষ্টা। সম্ভবত এঁরা সবাই জরাসন্ধের করদ রাজা ছিলেন। ভ়্যাসাল কিংস। রাজনৈতিক পাশে আবদ্ধ। কোনও না কোনওভাবে ওব্লাইজ্ড।’’ 

‘‘ওকে। বুঝলাম। কিন্তু তার সঙ্গে দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের কি সম্পর্ক?’’ সঞ্চয়িতা প্রশ্ন করলো। 

‘‘এই জন্যই বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দেওয়া জরুরি, বুঝলে ম্যাডাম?’’ অমৃতদা আরেকটা সিগারেট ধরালো। ‘‘জরাসন্ধকে মেরে ফেলাটা ছিলো কৃষ্ণের জন্য ক্রসিং দ্য ফ়াইনাল অ্যান্ড টাফ়েস্ট হার্ডল অফ় পলিটিক্স। সেটা হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণ আর্যাবর্তীয় রাজনীতির চূড়োয় উঠে গিয়েছিলেন। শুধু ক্ষুরধার রাজনৈতিক বুদ্ধি নয়, তার সঙ্গে কৃষ্ণের ছিলো একটা প্রায় ইনভ়িন্সিব্ল আর্মি অফ় ফ়র্মিডেব্ল যাদব ওয়ারিয়রস, যারা সেই সময়ের হায়েস্ট পেইড মার্সিনারি।সেই সব কিছু মিলিয়ে সবাই তাঁকে রীতিমতো ভয় পেতে আর সমীহ করতে আরম্ভ করেছিলো। 

‘‘দ্যূৎসভার তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় আর অপর্যাপ্ত মদ্যপানের ফলে দুর্যোধন, কর্ণ, দুঃশাসনরা কৃষ্ণের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। দ্রৌপদী অনেক কাকুতি মিনতি করলেন, নানারকম আইনি প্রশ্ন তুললেন। মহিলার নার্ভ়ের কথা ভাবলে অবাক হতে হয়! ভরা রাজসভার মাঝখানে ওরকম একটা অ্যাসল্ট চলছে, তার মধ্যে তিনি প্রশ্ন করছেন, যিনি আগেই নিজেকে পণ রেখে হেরে গেছেন, তিনি কি তারপর আর কাউকে পণ রাখতে পারেন? সেই অধিকার কি তাঁর আছে? ভাবো!’’ 

খানিকক্ষণ সবাই চুপ করে রইলাম। বাস্তবিক, এভাবে তো কখনও ভাবিনি। মহাকাব্যিক চরিত্রগুলোর ভিতরের মানুষগুলোকে কখনও ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করিনি। সত্যিই, কি অসহ্য অপমান... ভরা রাজসভার মাঝখানে... নিজেরই জ্যাঠতুতো দেওররা... 

‘‘বিকর্ণ, বিদুররাও চেঁচামেচি করলেন।’’ অমৃতদার কথায় মন দিলাম। ক্লাইম্যাক্সের দিকে এগোচ্ছে গল্প। এখন একটা শব্দও মিস করা যাবে না। ‘‘কারও কথায় কোনও ফল হলো না। ঈর্ষা, অসূয়া, লালসা সংস্কৃতিবান মানুষকেও কেমন পশুতে পরিণত করে, এ হলো তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অথবা পশু বলাও বোধহয় ভুল। পশুরা এরকম আচরণ করে না। 

‘‘সে যাই হোক, সব আবেদন, সব প্রতিবাদ বিফল হলো। ভীম-অর্জুন-‌সহদেবদের প্রতিজ্ঞাকেও পাত্তা দিলেন না কৌরবরা। দুঃশাসন শাড়ি ধরে টেনে চলেছেন। কর্ণ, দুর্যোধন অশালীন ইঙ্গিত করছেন। অসহায় পাণ্ডবরা রাগে ফুঁসছেন। ভীষ্ম-দ্রোণরা চুপ করে বসে আছেন। দ্রৌপদী বুঝলেন, আর উপায় নেই। তিনি ফ়াইনাল রিসর্ট নিলেন।’’ 

একটু থেমে অমৃতদা বললো, ‘‘কৃষ্ণের নাম করে থ্রেট দিলেন। বললেন, আমার স্বামীরা এখন অসহায়। কুরুবৃদ্ধরাও আশ্চর্যভাবে নীরব। তাঁরা সম্ভবত ভুলে গেছেন যে সেই মানুষটা কিন্তু আমার সখা। আমার এই অপমান কিন্তু সে মেনে নেবে না, এবং কুরুবংশের সম্মান বজায় রাখার কোনও দায়ও তার নেই। সে যখন আসবে, তাকে আটকানোর ক্ষমতা কারও হবে না। ধৃতরাষ্ট্রের এই অসভ্য অমানুষ ছেলেগুলোর কথা ছেড়েই দিলাম, ক্রুদ্ধ বাসুদেবকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা ওই সব বড়ো বড়ো বিখ্যাত নামের ভীষ্ম-দ্রোণাচার্যদেরও হবে না। তাই বলছি, আপনাদের সাধের কুরুরাজ্যের খুব শিগগিরি শ্মশানে পরিণত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হ’ন। 

‘‘এইবার ধৃতরাষ্ট্রের টনক নড়লো। কারণ, তিনি দেখলেন, দ্রৌপদীর এই কথার, কুরুসভার এই অপমানের কোনও রকম প্রতিবাদ ভীষ্ম-দ্রোণরা করলেন না। ধৃতরাষ্ট্র বুঝলেন, দ্রৌপদী হাওয়ায় কথা বলছেন না। বিশেষত, ইন্দ্রপ্রস্থের রাজসূয় যজ্ঞে কৃষ্ণের প্রতি ভীষ্মের মনোভাব তিনি ক’দিন আগেই দেখেছেন। দেখেছেন কিভাবে কৃষ্ণ সর্বসমক্ষে শিশুপালকে মেরে ফেলেছেন, কেউ টুঁ শব্দটিও করেনি। তিনি আক্রমণ করলে ভীষ্ম আদৌ যুদ্ধ করবেন কি না, তাই নিয়েও সন্দেহ আছে। তাই এবার তিনি ভয় পেলেন। তড়িঘড়ি ছেলেদের বকাবকি করে কুৎসিত ব্যাপারটা থামালেন। শুধু তাই না, পাশায় জিতে নেওয়া সব কিছু ফিরিয়ে দিয়ে পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে যাওয়ার অনুমতিও দিয়ে দিলেন। দ্রৌপদীর কাছে বারবার ক্ষমা চাইলেন এবং বললেন যে তাঁর জন্যই তাঁর স্বামীদের সম্মান ও রাজত্ব রক্ষা হলো। সুতরাং বোঝো, কৃষ্ণের নামে ধৃতরাষ্ট্র কতখানি ভয় পেয়েছিলেন।’’ 

অমৃতদা চুপ করলো। খানিকক্ষণ নীরবতার পর সঞ্চয়িতা বললো, ‘‘হুঁ। বুঝলাম। কিন্তু ঘটনা হলো, এখানেও সেই পৌরুষের ভয়ে... অ্যান্ড নট ফ়র দ্য বেয়ার মিনিমাম অনার অফ় আ উওম্যান।’’ 

অমৃতদা কাঁধ ঝাঁকিয়ে পুরো মার্কিনী অ্যাক্সেন্টে বললো, ‘‘অ্যাস্ক নেইচর।’’ 

6 comments:

  1. সৌম্য,
    বানরায়ন পড়ার পরে রামায়ণ এক অন্য আঙ্গিকে চিত্রিত হয়েছে আমার মনে। খুব ভালো লেগেছে বলব না। লেখক হিসেবে আপনার সব পাঠকদের মতামত জানলেও সব কিছু গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে তার কোন মানে নেই। তবে রাবনের প্রতি সীতার নীরব অভিব্যক্তি বা মৃত্যুর মুহূর্তে মেঘনাদের পৌরুষত্ব - এই সব কিছু এক নতুন আলোকে দেখলাম আপনার চোখ দিয়ে। এইখানে লেখক হিসেবে আপনি নিজের জায়গা করে নিয়েছেন। অভিনন্দন। আগামী দিনে আরো অনেক কিছু পাওয়ার আশায় রইলাম। হচ্ছিল মহাভারতের সময়ে মীটু নিয়ে আলোচনা আর চলে গেলাম বানরায়নের সমালোচনায়। সবই লেখকের গুনমাহাত্যে। ইংরেজিতে বলে না "Top of the mind recall", এই আর কি।

    ReplyDelete
  2. দুরন্ত যুক্তিজাল। মুগ্ধ করলেন আবারও॥

    ReplyDelete
  3. কোন কথা হবে না। এ'ধরণের আরো লেখার অপেক্ষায় রইলাম। এগুলো নিয়ে একটা সিরিজ বের করলে হয় না? মহাভারতের উপর?

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ। সেইরকম একটা ইচ্ছে আছে বটে।

      Delete