0

সম্পাদকীয়

Posted in

করোনারূপী অতিমারী মনুষ্যজাতীর ‘একান্ত নিজস্ব’ রাজ্যপাটে আঘাত হেনেছে অতি বিক্রমে, সন্দেহ নেই। আমাদের স্বেচ্ছাচারের নির্বিঘ্ন অধিকারে ব্যাঘাত ঘটিয়ে জীবনের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষাটাই মনে হয় দিয়ে যাচ্ছে করোনা। 

খুব ছোটোবেলায় মনে আছে, একবার ছেলেমানুষী অতিস্পর্ধায় অতি ক্ষীণতোয়া এক পাহাড়ি ঝোরার গতিপথ রোধ করার চেষ্টা করেছিলাম তার চলার পথের উপর বসে পড়ে। আমাকে অবাক করে দিয়ে সে তখন নাচতে নাচতে অপ্রত্যাশিত অতর্কিত বাধাটার পাশ কাটিয়ে আমাকে জীবনের এক চরম শিক্ষা দিয়ে অবলীলায় এগিয়ে গিয়েছিলো নিজের গন্তব্যে। 

আসলে তাইই হয়। জীবনপ্রবাহ থেমে থাকে না। পথ করে নেয়। নতুন পথ। আমরাও নেবো করে নতুন পথ। নিচ্ছিও। শিখছি অনেক কিছু। মনে পড়ে যাচ্ছে অনেক ফেলে আসা পুরনো সুঅভ্যাস। যেমন, আমার অবস্থাপন্ন সুপ্রতিষ্ঠিত বাবার ব্যবস্থাপনায় ছোটোবেলায় আমরা কখনও একসঙ্গে দুটো ডিম খাইনি। বলতেন - খাওয়াই যায়, কিন্তু প্রয়োজন আছে কিনা, সেটাই আসল বিবেচ্য। অনেকের মতোই আমারও মনে পড়ে যাচ্ছে, আধখানা ডিম খাওয়ার সেইসব ভোরের কাঁচা আলোর মতন নরম দিনগুলির গল্পগাথা।  

এত ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি একটাই কারণে। বিশ্বের এই দারুণ অসুখের দিনেও ‘খাদ্যরসিক বাঙালি’ নিজের জাতিবৈশিষ্ট অক্ষুণ্ণ রাখার গুরু দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে রোজ রোজ কাঁড়ি কাঁড়ি বাজার করে দারুণ দারুণ সব পদ রান্না করে ছবি তুলে রেসিপিসহ সেই ছবি পোস্ট করছেন স্যোশাল মিডিয়ায়… তাতে ৯৮৭ রিঅ্যাকশন্স, ৫৬৪ কমেন্টস আর ৮২ শেয়ার! একাধারে অসাংবিধানিক ও অত্যন্ত অমানবিক। অসাংবিধানিক বলছি, তার কারণ নিজের শখ আহ্লাদ পূরণের জন্য নির্জন বাসের নির্দেশ একটা খেলো ছুতোয় অমান্য করে সামগ্রিকভাবে সমাজের ক্ষতি করার অধিকার সংবিধান আমাদের দেয়নি। আর অমানবিক তো বটেই। যে দেশের কোটি কোটি মানুষ এমনিতেই অর্ধভুক্ত, অভুক্ত থাকে, পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে তো আরও কথাই নেই, সেই দেশের সম্পন্ন মানুষের এই নির্লজ্জ ‘দেখো কত ভালো আছি’ প্রদর্শন শুধু অমানবিকই নয়, অন্যায়ও। অনেকেই বলবেন, আমরা কাউকে বারণ করেছি নাকি? ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে কিছু নেই বুঝি? … বলতেই পারেন। বলুনও। আমি তর্ক করি না। বাস্তবে পরিস্থিতি যে চতুর্থ শ্রেণির সরল অংকের মতো সহজ নয়, মুখে মানতে মানে লাগলেও, সে কথা আপনি আমি সকলেই জানি। মূল প্রশ্নটা ওই - খাওয়াই যায়, কিন্তু প্রয়োজন আছে কিনা, সেটাই আসল বিবেচ্য! 

 বিজ্ঞাপনটি দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৬ জুন, ১৯৪৫।
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষে বিপর্যস্ত বৃটিশ ভারত।
আজ আবার প্রসঙ্গিক। [সূত্র - ইন্টারনেট]
মিতব্যয়ী হওয়ার যে অভ্যাস বহুকাল পূর্বে ছিন্ন বস্ত্রের মতো ত্যাগ করেছিলাম আমরা, তাকে আবার রপ্ত করতে হবে অনতিবিলম্বেই। মনে পড়ে যায়, ক্লাসে বসে খাতা ফোল্ড করে লিখলে আমাদের স্কুলের ইংরিজি দিদিমণি প্রতিমাদি যত্ন করে খাতাটা খুলে দিয়ে বলতেন- খাতা ভাঁজ করে লিখো না, ভাঁজ করে লিখলে ডান দিকে অনেকটা জায়গা নষ্ট হয়। ভাবা যায়? মিতব্যয়ীতার এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর কি হতে পারে! অরণ্যের সে পুরনো প্রবাদ তো সেই কবেই ভুলেছি আমরা – ওয়েস্ট নট ওয়ান্ট নট! 

জানি, বিলাসিতা একটি অভ্যাস; বলা সহজ, কিন্তু বর্জন করা অতি শক্ত কাজ। তবুও উপায় নেই। এবারে সত্যিই দুরূহ কাজেই নিজের কঠিন পরিচয় দিতে হবে। সমগ্র বিশ্বের রাজনৈতিক নীতিপ্রকরণে, ব্যবহারবিজ্ঞানের প্রচলন ভাবনায়, অর্থনৈতিক পরিকাঠামো বিন্যাসে, সমাজনৈতিক প্রণালী প্রণয়নে আসতে চলেছে আমূল পরিবর্তন। টোটাল সিস্টেম রিবুট। এই নিভৃতিযাপনের দিনগুলিতে বেসিকগুলো রেখে দিয়ে অপ্রয়োজনীয় স্টোরড মেমারি ডিলিট করে নিজেকে একটা কোর প্ল্যাটফর্ম বানিয়ে ফেলার মস্ত সুযোগ পাওয়া গেছে। পরিস্থিতি যাই হোক, অ্যাডাপ্ট করতে বেগ পেতে হবে না হয়তো। আমরা তখন প্রস্তুত পুরোমাত্রায়। 

এবারের ঋতবাক সংখ্যায় নিয়মিত বিভাগগুলি তো রয়েছেই, আরও রয়েছে বিশ্বের ২৯টি শহর থেকে পাঠানো সেখানকার যুদ্ধ পরিস্থিতির বিবরণ। লেখকদের নিজেদের কলমে। প্রায় অসম্পাদিত। [বিভাগ – someপ্রতীক]। এই সংখ্যায় শুরু হলো নতুন বিভাগ ‘ইতিহাসের কথা ইতিহাসের কাহিনি’, লেখনী ধরেছেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক অভীক মুখোপাধ্যায়। অভিনন্দন, অভীকবাবু। 

এবারে এ পর্যন্তই...

নির্দেশিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন 

শুভেচ্ছা নিরন্তর

0 comments:

1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - নীলোৎপল বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in

আমরা বিশ্বযুদ্ধ দেখিনি, ৭৬ এর মন্বন্তর দেখিনি, ৪৭ এর দেশভাগ বা ভারত-চিন যুদ্ধ দেখিনি। দেখিনি ১৯৭১ এর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। দেখেছি কার্গিল যুদ্ধ, দেখেছি টুইন টাওয়ার-পেন্টাগন আক্রমণ, দেখেছি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা। দেখেছি সারদা-রোজভ্যালি কাণ্ডের পর বাংলায় অর্থনৈতিক ডামাডোল। আমরা সার্স, বার্ড-ফ্লু, ইবোলা এগুলোও দেখেছি, শুনেছি, পড়েছি কিন্তু গায়ে মাখিনি। বার্ড ফ্লুতে মুরগি সস্তা হওয়াতে নতুন ওটিজি কিনে চিকেন কাবাব বানানোতে হাত পাকিয়েছি। চিনে বা মধ্যপ্রাচ্যে সার্স বা মার্স হওয়াতে নিশ্চিন্ত থেকেছি। গালমন্দ করেছি ‘ওদের’ বৃহস্পতি-শনি নিরামিষ খাওয়া ‘মহান’ আমরা। ভাগাড় কাণ্ডেও একইরকম আচরণ করেছি। 

এবার আর ছাড় নেই। নিজের ঘরে আগুন লেগে গেছে। আমরা চলছি মানব ইতিহাসের এক অন্যতম অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে যার কথা মনে রাখবে মানুষ চিরকাল, যেমন রেখেছে ব্ল্যাক ডেথের কথা! মানুষের সামাজিক পরিস্থিতির পাশাপাশি বিবেচিত হবে অর্থনৈতিক তথা মানসিক পরিস্থিতিও। ব্ল্যাক ডেথের সময় মানুষগুলোর মানসিক টানাপোড়েনের কথা কতটুকু জানতে পারি আমরা! কিন্তু মানবসৃষ্ট তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে, আজকের এই পরিস্থিতিতে আমাদের ছোট ছোট মুহূর্তের ইমোশনগুলোও স্মৃতি হয়ে দেখা দেবে ফেসবুক মেমোরিতে এক বছর পরে। লেখাজোখা সবই থেকে যাবে হাজার বছর পরেও। গবেষকরা গবেষণা করবেন এই পরিস্থিতি নিয়ে আগামী বহু বছর। কত থিসিসে লেখা থাকবে আজকের দিনপঞ্জির যোগভাগগুলো। 

আজকে আমরা ক্ষণিকতার প্রভাবে দুষ্ট সকলেই। চণ্ডীমণ্ডপ যেমন উঠে এসেছে ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে, আমরাও সকালে মনকেমন নিয়ে পোস্ট দিয়ে, বিকেলেই নেচে গেয়ে ভিডিও আপলোড করে দিচ্ছি। এইসবের মাঝে একটা জিনিস খুব চোখে পড়ছে, যে কারণে সরকার থেকে নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে যে গুজব ছড়ানো চলবে না, ছড়ালে উপযুক্ত শাস্তি হবে। সেই গুজবের অনেকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রকট হল, এই কোরোনা ভাইরাস ডিজিজ-২০১৯ বা সংক্ষেপে কোভিড-১৯ একটি জৈব-সন্ত্রাস। চিন এর মূল হোতা, কেউ কেউ আমেরিকাকেও দুষছেন সমানভাবেই। কেউ কেউ আরো একধাপ এগিয়ে বলছেন যে এই রোগটাই আসলে ভুয়ো এবং চিন নিজের একচ্ছত্র অধিকার স্থাপন করতে এই রোগ ছড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বময়। এর পেছনে অকাট্য যুক্তি খানিকটা এইরকম যে চিন নিজে ওষুধ আবিষ্কার করে ফেলেছে, অথচ বাকি বিশ্বকে সেটা জানাচ্ছে না, চিন এত তাড়াতাড়ি উহান প্রদেশকে রোগমুক্ত করে ফেলল কী করে যেখানে সেখান থেকে সারা দুনিয়ায় সার্স-কোরোনা ভাইরাস-২০১৯ ছড়িয়ে পড়েছে, ইত্যাদি আরও অনেক কিছু।

আমাদের এই চণ্ডীমণ্ডপের আলোচনা মজ্জাগত। ফেসবুক-হোয়াটসএপের তাৎক্ষণিকতায় তাকে ছড়িয়ে দেওয়া আরো সহজ হয়েছে। সেই ছাগল-চোর-ব্রাহ্মণের গল্পের মতন অনেক যুক্তিবাদীও টানা মিথ্যা শুনতে শুনতে ‘যা রটে তা কিছু বটে’ ভেবে টেবে এগুলো বিশ্বাস করতেও শুরু করে দিয়েছেন। মুশকিল হচ্ছে, যারা যুক্তিবাদী বা বিজ্ঞানচর্চা করেন তারাও এগুলো শেয়ার করে সাধারণ মানুষের ভয় বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আমেরিকার এক আইনজীবী তো নানা যুক্তি সাজিয়ে প্রমাণ করেই ফেলেছেন যে এই ভাইরাস প্রকৃতির ‘স্পিলওভার ইভেন্ট’ নয়, চিনের ল্যাবে জৈব মারণাস্ত্র হিসেবে বানানো। সবথেকে ভয়ানক হলো চিকিৎসকরা পর্যন্ত গুজব শেয়ার করছেন। এর একটা কারণ হল, ভাইরাস সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাব। অন্য ক্ষেত্রের মানুষের কথা বাদই দিলাম, চিকিৎসকরা অবধি বাস্তবে ভাইরাস সম্পর্কে খুবই কম ধারণা রাখেন। ভাইরাল রোগগুলির চিকিৎসা প্রায় সবক্ষেত্রেই উপসর্গভিত্তিক এবং চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য উপসর্গের উপশম। তাই খোদ কলকাতা শহরের খুব খুব বিখ্যাত ও সিনিয়র শিশুরোগবিশেষজ্ঞ র‌্যাশ নিয়ে দুদিনের জ্বরে ভোগা শিশুকে ডেঙ্গির আইজিএম এলাইজা পরীক্ষা করতে দেন। যেখানে দেওয়ার কথা এনএসওয়ান, কারণ ডেঙ্গির ক্ষেত্রে শরীরে আইজিএম তৈরিই হয় সংক্রমণের পাঁচদিনের মাথায়। অতএব চিকিৎসকদেরও এবিষয়ে কতখানি সম্যক জ্ঞান রয়েছে সেটাও ভেবে দেখার মতন। আবার মহাভারতের মতন এমবিবিএস পাঠ্যক্রমে মাইক্রোবাইয়োলজিতে ভাইরোলজির জায়গাটা খুবই সীমিত। প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে আশির দশক থেকে ভাইরোলজিতে ক্লিনিক্যাল এমফিল ও এমডি পাঠক্রম চালু হলেও ভারতে এমসিআই কেন সে বিষয়ে দৃষ্টি দেন নি, সে কারণ আমার অজানা। একই যুক্তি খাটবে ইমিউনোলজিতে স্নাতকোত্তর পাঠক্রমের ক্ষেত্রেও। মলিক্যুলার বায়োলজি ত সেদিনের বিষয় এবং এমবিবিএসের নতুন পাঠক্রমে অল্পদিন হল অল্পভাবে সেটাও ঢুকেছে। কিন্তু আজকের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এই তিনটি বিষয়ের ওপর প্রকৃত বিশেষজ্ঞের অভাব মালুম হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা রয়েছেন। তাঁরা বহুদিন ধরেই উচ্চমানের গবেষণা করে চলেছেন এই বিষয়গুলো নিয়ে। কিন্তু এরকম নতুন ভাইরাল মহামারির ক্ষেত্রে, যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক-পুল দেশের প্রয়োজন, তা সংখ্যায় অপ্রতুল। উপযুক্ত ‘ক্লিনিক্যাল-আই’ এবং গবেষণার অভিজ্ঞতা থাকলেই এইরকম ক্ষেত্রে দ্রুত সঠিক দিশা দেখানো সম্ভব।

এই প্রতিবেদনে আমি ২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত দুটি গবেষণাপত্রের মূল নির্যাস সাধারোনের উপযোগী করে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। একটি কোভিড-১৯ এর ডায়াগনোসিস, যেটি চিন-হংকং ও ইউরোপের নেতৃত্বস্থানীয় ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা সমন্বিতভাবে লিখেছেন তাঁদের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে, আরেকটি চিনের দুইজন বিজ্ঞানীর গবেষণাপত্র, যেখানে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় কি কি ওষুধ প্রয়োগ করা যেতে পারে তা নিয়ে নির্দেশাবলী রয়েছে উপযুক্ত গবেষণালব্ধফল সহ। আর দুটিই ‘ওপেন এক্সেস’ অর্থাৎ পৃথিবীর সকলের জন্য উন্মুক্ত, এটি পড়তে পয়সা লাগে না, যে যন্ত্রে আপনারা গুজব ছড়াচ্ছেন বা মিম শেয়ার করছেন সেখানে এই দুটি গবেষণাপত্র পড়ে দেখতে পারেন। ইংরেজি না জানলেও ক্ষতি নেই, ট্রান্সলেশনের সুবিধা গুগুল বিনামূল্যেই দেয়। সেই অনুবাদ সর্বথা সঠিক ও যথাযথ না হলেও মূল বিষয়টি বুঝে নেওয়া যায়। ইংরেজি না বুঝলে, যারা বোঝেন তাদের থেকে বুঝে নিতে পারেন। দয়া করে গুজব ছড়াবেন না। ডাক্তারবাবুদের বলব, একটু পড়াশোনা করে নিন এই সুযোগে। একটু পেপার টেপার ঘাঁটুন। যাবৎ বাঁচি তাবৎ শিখি। 

এবারে সরাসরি আসব ডায়াগনোসিস প্রসঙ্গে। বিজ্ঞানীরা কি উপায়ে, কোন বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে কোভিড-১৯ এর ডায়াগোনস্টিক কিট বানিয়েছেন এবং দুনিয়ার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ‘মলিক্যুলার ডায়াগোনস্টিক’ কোম্পানি ‘কায়াজেন’ আর ‘থার্মো ফিশার’ চটজলদি বানিয়ে ফেলে বাজারে বিক্রি করছে; সেই প্রযুক্তিকে সহজ ভাষায় বোঝানোর চেষ্টা করছি। 


কোরোনা ভাইরাস হল একধরনের ভাইরাস যাদের দেখতে সূর্যের চারপাশের কোরোনা স্তরের মতন (এ বিষয়ে বিশদে জানতে আমার লেখা আর একটি প্রবন্ধ পড়তে পারেন, লিংক দেওয়া রইল একদম শেষে)। এই ভাইরাস এই প্রথম নয়, আগেও হানা দিয়েছে মানব সমাজে, ২০০২ আর ২০১২ সালে। তবে সে সময় সারা পৃথিবীতে এইভাবে ছড়িয়ে পড়ল না কেন? এর পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে, তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, বিশ্বময় বিমান পরিষেবার উন্নতি ও বিমান ভাড়া মধ্যবিত্তের নাগালে চলে আসার কারণে গত দশ বছরে মানুষের বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ ভয়ানকভাবে বেড়ে গিয়েছে। আগেও তো উন্নত দেশের মানুষ বিশ্ব ভ্রমণ করত। কিন্তু এখন কর্পোরেট ক্ষেত্রে শুধু বড় কর্তা বা সিনিয়র ম্যানেজাররাই নন, জুনিয়র বা মিড লেভেল ম্যানেজাররাও চট করে ট্রেনিং দিতে বা নিতে, বা মিটিং কন্ডাক্ট করতে পাড়ি দিচ্ছেন বিদেশে। কলকাতা থেকে কুনমিং উইকএন্ডে ছুটি কাটিয়ে আসছেন লোকজন। দুনিয়াব্যাপী ট্র্যাভেল বেড়ে গিয়েছে এই দশ বছরে ভয়ানকভাবে, যার কারণে ভাইরাল রোগগুলিও ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। ডেঙ্গি যেভাবে ইউরোপ ও আমেরিকার শীতপ্রধান অঞ্চলে ছড়িয়ে গেছে, সেটা এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

এই ভাইরাসটির পুরো নামকরণ হয়েছে সার্স-কোরোনা ভাইরাস-২০১৯। এটি সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯, তাদের চিনের ‘কান্ট্রি অফিস’এ হুবেই প্রদেশের উহান শহরে অজানা কারণের ফ্লু আক্রমণের কথা নথিভুক্ত হয়। অজানা কারণ চিহ্নিত করে ৭ই জানুয়ারি ঘোষণা করা হয় যে একটি ‘নোভেল কোরোনা ভাইরাস’ এই ফ্লু-এর কারণ। এর নভেলটি বিষয়ে বিশদে জানতে শুরু হয় গবেষণা। তার তিনদিন পরে, ১০ই জানুয়ারি চিন সরকার তাদের কমিউনিটি অনলাইন রিসোর্স ‘ভাইরোলজিকাল ডট অআরজি’তে চটজলদি প্রকাশ করে এই নতুন ভাইরাসের একটি জিন সিকোয়েন্স। ঠিক দুদিন পরে অর্থাৎ ১২ই জানুয়ারি প্রকাশিত হয় আরো চারটি সিকোয়েন্স। মূলত আক্রান্ত রোগীদের লালা থেকে ভাইরাল আরএনএ এক্সট্র্যাক্ট করে তার সিকোয়েন্সিং করে এই জিনোম রিলিজ করা হয়। এটুকু কাজ করতে নতুন পুরোনো ভাইরাসের বিষয় আসে না। যে প্রযুক্তি আমরা এখন ব্যবহার করি, তাতে যেকোনো জীব কোষেরই আরএনএ বার করে তার সিকোয়েন্স করা সম্ভব। এর পরেই শুরু আসল খেলা। ভাইরাসের জিনোম তো চেনা হল। কিন্তু নতুন নতুন রোগী যে আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের দ্রুত ও বিশ্বাসযোগ্য ডায়াগনোসিস হবে কিভাবে? কেমন করে সাধারণ ফ্লু থেকে চটজলদি আলাদা করা যাবে এই রগক, যাতে রোগীকে প্রথম থেকেই ইন্টেন্সিভ কেয়ার দেওয়া যায়!!

এবার আসরে নেমে পড়ল ‘গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটা’। তারা নতুন সিকোয়েন্সগুলোকে কিউরেট করা শুরু করে। তারাই প্রথম জানায় যে, এই নতুন ভাইরাসটি ২০০২/০৩ এ হওয়া সার্স ভাইরাসের একটি তুতো ভাই এবং এশিয়া-ইউরোপের রাইনোলোফিড বাদুড়ের শরীরে যেসব কোরোনা ভাইরাস বাসা বাঁধে, এটি তারই অন্যতম। কিভাবে জানা গেল? খুব সহজ। আগের ভাইরাসগুলির সিকোয়েন্স তো জানাই ছিল। তাদের পাশাপাশি নতুনটিকে রাখা হল। বেশিরভাগ জায়গাতেই মিল। দু-একটা জায়গায় মিউটেশন পাওয়া গেল মাত্র। হুবেই প্রদেশের উহান শহরে তো বাদুড় থেকেই ভাইরাসটি এসেছে বলে বোঝা গেল। কিন্তু শুরুর দিনগুলিতে তখনো মানুষ-মানুষ ট্রান্সমিশন টের পাওয়া যায়নি। গেল, আরো আটদিন পরে। সর্বমোট ২৮২ জন ল্যাবরেটরি-কনফার্মড নোভেল কোরোনা ভাইরাস আক্রান্ত রুগীর খবর নিশ্চিত করল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০ জানুয়ারি ২০২০। এর মধ্যে দেশের বাইরেও ছড়াতে শুরু করেছিল এই ভাইরাস। উহান ফেরত দুই থাইল্যান্ডের নাগরিকের দেহে পাওয়া গেল এই ভাইরাস ১৩ আর ১৫ জানুয়ারি। জাপানে ওই একই শহর থেকে আসা মানুষ আক্রান্ত হল ১৫ জানুয়ারি এবং ১৯ জানুয়ারি দক্ষিণ কোরিয়াতেও একই ঘটনা ঘটল। উহান শহর থেকে আস্তে আস্তে ছড়াতে শুরু করল এই ভাইরাস। মানুষ-মানুষ সংক্রমণ শুরু হয়ে গেল।

ডায়াগোনসিস এর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল একাডেমিক আর পাবলিক হেলথ ল্যাবরেটরিগুলো। অন্যান্য ফ্লু-র ক্ষেত্রে, নাকের রস নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হয় ভাইরাল জিনের উপস্থিতি রিয়াল টাইম পিসিআর করে। এই প্রযুক্তি খুব কম সময়ে মানব শরীরের নমুনাতে ভাইরাসের কটি জিন উপস্থিত রয়েছে, অর্থাৎ ভাইরাল লোড কত সেটি গুণে বলতে পারে। এই ভাইরাল লোডের ওপরেই নির্ভর করে চিকিৎসাপদ্ধতি। অন্যান্য অজস্র রোগে এই পদ্ধতি গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড। কিন্তু গোল বাধল অন্য জায়গায়। অন্যান্য ক্ষেত্রে মূল জীবাণুটির নমুনা থাকে বিজ্ঞানীদের কাছে। অর্থাৎ পজিটিভ কন্ট্রোল থাকে। যার প্রেক্ষিতে রোগীর নমুনাকে পজিটিভ বা নেগেটিভ বলা হবে। ভাইরাল কালচার থাকে। সেখান থেকে জিন নিয়ে তাকে পজিটিভ কন্ট্রোল বানানো হয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে তো কিছুই নেই। কি করে কি হবে!! বুদ্ধি খাটিয়ে অন্য উপায় বার করা হল। ২০০২/০৩ এর সার্স কোরোনা ভাইরাসের সঙ্গে এই নোভেল কোরোনা ভাইরাসের মিলের কথা আগেই বলেছি। সেটাকেই কাজে লাগিয়ে আর সিন্থেটিক নিউক্লিক এসিড প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বানিয়ে ফেলা হল পজিটিভ কন্ট্রোল। চ্যারিটি এন্ড ইউনিভার্সিটি অব হংকং তাদের কাছে থাকা এযাবৎকালের সব কোরোনা আর ইনফ্লুএঞ্জা ভাইরাসের সেল কালচার স্যুপ পাঠালো ইউরোপে। চ্যারিটি মেডিক্যাল সেন্টার, হংকং-এ ২০১৯ আক্রমণের যা যতটুকু স্যাম্পল ছিল, তা পাঠানো হল। এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বায়োব্যাংক থেকে পুরোনো যত এ জাতীয় ভাইরাস কালচার ছিল ক্রায়োপ্রিজার্ভ করে, তাদেরও পুনরুজ্জীবিত করা হল। এই ব্যাংকগুলো পাঁচটি জায়গায় ছিল, তাদের নাম একে একে, নেদারল্যান্ডের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর পাব্লিক হেলথ এন্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট, একই দেশের রটারড্যামের ইরাসমাস ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টার, লণ্ডনের পাব্লিক হেলথ ইংল্যান্ড ল্যাবরেটরি আর হংকং বিশ্ববিদ্যালয়। নমুনাগুলো সবই থুতু, নাক ও গলার সোয়াব থেকে নেওয়া হয়েছিল। সব স্যাম্পল এসে জমা হল জর্মনির চ্যারিটি ইউনিভার্সিটি বার্লিনের ইন্সটিটিউট অব ভাইরোলজিতে।এইবার কাজ শুরু।

এর ফাঁকে ভাইরাসটিতে কিরকমের মিউটেশন বা অদলবদল ঘটেছে সেইটা নিয়ে একটু বলি। ভাইরাসটির গঠন সম্পর্কে একটু জ্ঞান থাকলে ভালো। খুব সহজে ছবির সাহায্যে সেটা বুঝতে গেলে আগে উল্লেখ করা আমার বঙ্গদর্শনে প্রকাশিত লেখাটি নিচের লিংকে গিয়ে পড়লে সুবিধে হবে। গোলাকার ভাইরাসটির মধ্যে তার জিন। এই জিন সমন্বিত হয়েছে কেবল আরএনএ নিয়ে। এখানে কোন ডিএনএ নেই। একে ঘিরে মেমব্রেন রয়েছে। তার চারিপাশে বহিরাবরণ বা এনভেলপ, সেই এনভেলপে আছে স্পাইক প্রোটিন। ভেতরে আছে নিউক্লিওক্যাপসিড প্রোটিন।এইসবগুলোই প্রোটিন। ভাইরাসটা তৈরিই হয়েছে প্রোটিন দিয়ে। তাই সাবান দিয়ে বারবার হাত ধোবার গুরুত্ব নিশ্চয়ই বুঝছেন। এছাড়া আছে আরএনএ-ডিপেন্ডেন্ট আরএনএ পলিমারেজ প্রোটিন। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ডায়াগোনসিস আর চিকিৎসায়। কেন? এই প্রোটিনটি শুধুমাত্র আরএনএ ভাইরাসেই থাকে। উন্নত প্রাণী বা মানুষে এই প্রোটিন থাকেনা। তাই এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ড্রাগ টার্গেট। ডায়াগনোসিস এও এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। এখন এতসব প্রোটিনের মধ্যে, ২০০২/০৩ এর সার্স কোরোনা ভাইরাসের সঙ্গে ২০১৯ নোভেল কোরোনা ভাইরাসের মিল থাকলেও এনভেলপ প্রোটিনের জিন্‌ নিউক্লিওক্যাপসিড প্রোটিনের জিন আর আরএনএ-ডিপেন্ডেন্ট আরএনএ পলিমারেজ প্রোটিন জিনে মিউটেশন দেখা গেছে। এই পরিবর্তিত জায়গাগুলোই নোভেল। 

পদ্ধতিতে ফিরে আসি আবার। ওই যে ন্যাজাল সোয়াব ক্লিনিক্যাল স্যাম্পল নেওয়া হল, সেগুলো থেকে আরএনএ এক্সট্র্যাক্ট করে নেওয়া হল রস, জর্মনির ম্যাগ্না পিওর ৯৬ সিস্টেমে। ম্যাগনেটিক বিড প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে আরএনএ বার করা হল। এই প্রযুক্তি রোবোটিক আর্ম নির্ভর, তাই ব্যবহারকারীর সংক্রমণের ঝুঁকি কম। বায়োব্যাংক থেকে পুনরুদ্ধার করা সেল কালচারগুলো থেকে আরএনএ বার করা হল কায়াজেন, জর্মনির ভাইরাল আরএনএ মিনি কিট ব্যবহার করে। এই আরএনএকে সরাসরি রিয়াল টাইম পিসিআর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। এর জন্য ইনভিট্রোজেন, জর্মনির সুপারস্ক্রিপ্ট ৩ ওয়ান স্টেপ রিভার্সট্রান্সক্রিপ্টেজ সিস্টেম আর প্ল্যাটিনাম ট্যাক পলিমারেজ ব্যবহার করা হল। এগুলো খুবই উন্নত ধরণের উৎসেচক। প্রথমে আরএনএকে ডিএনএতে রূপান্তরিত করবার জন্য এই পদ্ধতি। এবার যদি স্যাম্পলে একটাও আরএনএ থাকে, তার থেকে একটা ডিএনএ হবে। সেই ডিএনএই গুণিতকে বেড়ে কোটি সংখ্যক হবে। এই সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে প্রাইমার-প্রোব সিগ্ন্যাল পাঠাবে মেশিনকে। গোনা হয়ে যাবে ভাইরাল লোড। এটিই রিয়াল টাইম পিসিআর প্রযুক্তি। পিসিআর প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন বিজ্ঞানী ক্যারি মুলিস।

এই রিয়াল টাইম পিসিআর করে ভাইরাল লোড জানার পাশাপাশি নতুন ক্লিনিক্যাল স্যাম্পলে পাওয়া ভাইরাল আরএনএর সিকোয়েন্সও জানা গেল। তাকেই এবার পজিটিভ কন্ট্রোল বানিয়ে কিট তৈরি করতে লাগল। যে কিট দিয়ে সারা দুনিয়ায় এখন ডায়াগনোসিস হচ্ছে কোভিড-২০১৯। এর পরেও এই পরীক্ষার সেন্সিটিভিটি, স্পেসিফিসিটি নির্ণয় করবার জন্য আরো কিছু পরীক্ষা, স্ট্যাটিস্টিকাল এনালিসিস এসব করা হয়। সেগুলো আর লিখলাম না। 

শুধু এটুকু বুঝুন, একটি ডায়াগনোসিস কিট তৈরি হয়ে বাজারে আসতে দীর্ঘ সময় লাগে। ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড, আমেরিকাল ফুড এন্ড ড্রাগ কন্ট্রোল এর ছাড়পত্র পেতে বা ইন ভিট্রো ডায়াগনোসিসের তকমা পেতে বহু সময় লাগে। আছে আইনি জটিলতাও। কিন্তু ২১ জানুয়ারির মধ্যে এতসব কাজ অতি দ্রুত সম্পন্ন করে মানুষের জন্য যে ডায়াগনোসিসের পদ্ধতি উদ্ভাবন করে সকল দেশের বিজ্ঞানীদের জন্য ফ্রি এক্সেস করে দিয়েছেন এই বিজ্ঞানীরা, তাদের সেলাম। আবারও বলছি, চিন নিজের কাছে কিছু গচ্ছিত রাখেনি, আমেরিকাও না। ইউরোপ তো নয়ই। সব তথ্য উন্মুক্ত। এখন আপনার দেশে সেই তথ্য কাজে লাগানোর মতন পরিকাঠামো সরকার করে রেখেছে কিনা, সেটা জানতে আপনার প্রশাসককে প্রশ্ন করুন। গুজব ছড়াবেন না। পড়াশোনা করুন।

এবার আসব চিকিৎসায় প্রযুক্ত ওষুধ নিয়ে। আগের গবেষণাটি চিনের দেওয়া তথ্যের সহায়তায় ইউরোপীয় বিজ্ঞানীরা করেছেন। এবার যেটির কথা বলব, সেটি সরাসরি চিনের বিজ্ঞানীরা লিখেছেন। আবারও বলছি, সব তথ্য উন্মুক্ত। 

চিনের শানডং প্রদেশের কিংডাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি এবং প্যাথলজি বিভাগের তিন বিজ্ঞানী একসাথে ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ এই গবেষণাপত্রটি লিখে জমা করেন ওপেন এক্সেস আর্টিকল হিসেবে একটি জর্নলে। শেষে সবকিছুর লিংক দেওয়া আছে। কোভিড-২০১৯ এর মোকাবিলায় তারা পাঁচটি ওষুধের প্রয়োগের কথা বলেছেন। কি কি পাঁচটি এবং কেন, সেটিই বিশদে জানাচ্ছি আমি। 

প্রথমেই বলছেন, পরপর দশদিন আইএফএন আলফা ভেপার হিসেবে ইনহেল করাতে দিনে দুইবার। সেই ভেপারে যেন পাঁচ মিলিয়ন আন্তর্জাতিক এককে আইএফএন আলফা থাকে। এটি কি? এটি একটি ইন্টারফেরন, যা আমাদের শরীরের কিছু শ্বেতকণিকা ভাইরাস আক্রমণ ঠেকাতে তৈরি করে। কিন্তু রোগীর ইমিউনিটি উপযুক্ত পরিমাণ আইএফএন আলফা তৈরি নাই করতে পারে। সে কারণে বাইরে থেকে প্রয়োগ করতে হবে। ভেপার ইনহেল করলে সরাসরি ফুসফসের ভাইরাস আক্রান্ত কোশগুলিকে ভাইরাস সহ মেরে রোগীর শরীরে ভাইরাসের পরিমাণ কমাতে পারবে। বহু ভাইরাল রোগে আইএফএন আলফার প্রয়োগ আছে। এর আগে ২০০২/০৩ এর সার্স কোরোনা ভাইরাস আক্রমণের সময়ও এর প্রয়োগে সুফল পাওয়া গিয়েছিল। 

দ্বিতীয় ওষুধ লোপিনাভির বা রিটোনাভির। এগুলো এন্টিরেট্রোভাইরাল ড্রাগ হিসেবে প্রচলিত/ একথা শুনেই চণ্ডীমণ্ডপের জ্ঞানীরা রে রে করে ওঠেন। আরে বাবা এইচআইভিও আরএনএ ভাইরাস, কোরোনাও, ডেঙ্গিও। এত ভাবার কিছু নেই। এই ওষুধ ২০০ মিলিগ্রাম করে মুখ দিয়ে জলের সাথে দিনে দুইবার খেতে হবে দশদিন। এরা ভাইরাসের সংখ্যা বাড়াতে বাধা দেবে। আগের ২০০২/০৩ এর ক্ষেত্রে এর প্রয়োগে প্রমাণিত সুফল পাওয়া গেছে।

এরপর বলছেন, ৫০০ মিলিগ্রাম করে দিনে দুই থেকে তিনবার রাইবাভিরিন শিরায় ইঞ্জেকশন দিতে হবে রোগীর অবস্থা বুঝে। এটি একটি নিউক্লিওসাইড এনালগ যৌগ। এ কি করবে? ভাইরাসকে বোকা বানাবে। একে পেয়ে ভাইরাস একে দিয়ে নিজের প্রতিলিপি বানাতে চেষ্টা করবে। যেই না একে ব্যবহার করবে, অমনি তার কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। অতেব দ্রুত ভাইরাল লোড কমাতে এর ব্যবহারের কারণ বুঝতেই পারছেন।

আর বলছেন, আর্বিডোল ব্যবহার করতে। দিনে দুইবার করে ২০০ মিলিগ্রাম মুখে জলের সাথে খেতে হবে। এটি ইনফ্লুএঞ্জার বিখ্যাত ওষুধ। ফ্লু এবং ফ্লুলাইক সিম্পটমের চিকিৎসায় এর ব্যবহার প্রমাণিত। তাই কোভিড-২০১৯ এও এর ব্যবহার করতে হবে। 

এর পরে শেষে বলছেন, বিখ্যাত ওষুধ ক্লোরোকুইন ব্যবহারের কথা। কেমোথেরাপির এইটা মজা। এক রোগের ওষুধ অন্য অনেক রোগে খুব ভালো কাজ দেয়। হয়তো তাদের আপাতভাবে কোনো মিলই নেই। আমার শিক্ষক বলেন, প্রকৃতি যে রোগ দেয়, তার ওষুধও সেখানেই দিয়ে দেয়। ক্লোরোকুইন ম্যালেরিয়ার ওষুধ। এটি ২০০৬ সালে এন্টিভাইরাল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। চিনের শেষ চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার নিয়ে একটু পড়ুন। খুব আনন্দ পাবেন। সেই রহস্যের কথা এখানে আর বলছি না। ক্লোরোকুইন ৩০০ মিলিগ্রাম দিনে দুবার মুখ দিয়ে খেতে হবে জলের সাথে। 

এই সমস্ত ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা চলবে দশদিন।


মজার কথা হল, সব ওষুধগুলোই পুরোনো। চণ্ডীমণ্ডপের বিজ্ঞানীরা বলছেন চিন এই মারণাস্ত্র বানিয়েছে। তাদের কাছে নাকি এর এন্টিডোট আছে। এই এন্টিডোট বলতে যে কি বলছেন তা তারাই জানেন। বাস্তব হল, চিনেও এই পুরোনো ও সর্বজনবিদিত ওষুধগুলো দিয়ে চিকিৎসা হচ্ছে। প্রকৃতিতে বানানো ভাইরাস নয় বলেই নাকি এইভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। আসলে স্প্যানিশ ফ্লু, ব্ল্যাকডেথ বা হালের বার্ড ফ্লু নিয়ে এদের কোনো ধারণা নেই। আসলে তখনো তো স্মার্টফোন মুঠোয় আসেনি আর তারাও ফেসবুক-হোয়াটস্যাপ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হননি।

যাক গে। একটু পড়াশোনা করুন। মানুষের ওপর ভরসা রাখুন। মানুষেই সব করেছে। মানুষেই সব ঠিক করবে। গুজব ছড়িয়ে আতঙ্ক বাড়াবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। 

লেখক মাইক্রোবায়োলজিতে সাম্মানিক স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষে কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন থেকে মেডিক্যাল বায়োটেকনোলজি নিয়ে মাস্টার্স করেছেন। পরে নেট, গেট পাশ করে ওই প্রতিষ্ঠানেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চিকুনগুনিয়া ইমিউনোলজি নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য গবেষণা করেছেন। তারপর বাংলাদেশে কিছুদিন প্রয়োগ-বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছেন। এখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গবেষণার সাথে যুক্ত। পাঁচটির মতন আন্তর্জাতিক জর্নলে গবেষণাপত্রের পাশাপাশি নিয়মিত সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালিখি করেন। 

দুটি গবেষণাপত্রের লিংক




লেখকের আগে প্রকাশিত লেখার লিংক


পাদটীকা – গবেষণাপত্রগুলি আমেরিকার ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফর্মেশন এর পাবমেড ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত। সারা পৃথিবীতে এটিই সর্বজনগ্রাহ্য বিজ্ঞান গবেষণার অন্যতম আর্কাইভ বলে স্বীকৃত। এই দুটি গবেষণাপত্র উন্মুক্ত। যে কেউই পড়তে পারেন নাগরিকতা নির্বিশেষে।

কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন হলে আমায় ইমেল করতে পারেন – nilotpal.medmicro@yahoo.co.in

1 comments:

0

প্রবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in

মুখড়া 

ঘরে একুশদিনের স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে রোজ রোজ ওই এক বা দুটি চেহারা দেখে খিটখিটে হয়ে পড়েছেন? নো আড্ডা! নো গসিপ! সিগ্রেটের আকাল!

বুড়ো মানুষের কথাটা শুনুন, পড়ে ফেলুন “হাজার বছরের প্রেমের কবিতা” – একটি আনকাট ডায়মন্ড। এতে আছে খ্রীষ্টপূর্ব ষোড়শ শতাব্দী থেকে খ্রীষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দী পর্য্যন্ত প্রেমের কবিতার সংগ্রহ। কোন ভাষায়? বাঙলা ভাষায়, কিন্তু সংস্কৃত, পালি, প্রাকৃত, মিশরীয়, হিব্রু, চীনা, গ্রীক, লাতিন, আরবী, জাপানী এবং ফারসী থেকে। সম্পাদনা করেছেন অবন্তী সান্যাল ১৩৬৬ বঙ্গাব্দে, প্রচ্ছদ পূর্ণেন্দু পত্রী।

আরে ঘাবড়ে যাবেন না, কোনো গবেষণা বা পণ্ডিতি ফলাচ্ছি না । এ একেবারে প্রেমের কবিতা। নবরসের শ্রেষ্ঠ রস শৃঙ্গাররসের ছড়াছড়ি, মাঝে মাঝে ঢাকনা খুলে উপচে পড়ছে।

অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, হেমেন রায় থেকে শুরু করে বিষ্ণু দে, মঙ্গলা চরণ চট্টো, সিদ্ধেশ্বর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, অবন্তী সান্যাল নিজে এবং কিছু অধ্যাপককুল। সব অনুবাদ হয়তো তেমন উতরোয়নি, কিন্তু এহ বাহ্য। আসল কথা সে যুগে আমরা ভিক্টোরীয় রুচির বেড়ি পরে প্রেম ও কামের মধ্যে পাঁচিল তুলে দিইনি, দেহের পাঁক ছাড়া প্রেমের পদ্ম ফোটে না বলেই মনে করা হত। তাই ঘরবন্দী অবস্থায় এই কবিতাগুলি যে শিলাজিতের কাজ করবে তার গ্যারান্টি দিচ্ছি।

বিশ্বাস হচ্ছে না? আসুন, সংস্কৃত সাহিত্যে। মূল ভাষাটি আপনিও জানেন না, আম্মো না। কিন্তু চৌরশতক, অমরুশতক এবং ভট্টিকাব্যের নাম তো সবারই জানা। নিন কিছু হাতে গরম উদাহরণ।

প্রথম অন্তরা

জানতেন কি সে যুগে মেয়েরা নিজেদের কামনার কথা অসংকোচে প্রকাশ করতেন? আমি শুধু টিজার হিসেবে নারীকবিদের লেখা তুলে দিচ্ছি। যেমন লোপামুদ্রা, শীলা ভট্টারিকা, মারুকা, মোরিকা, বিজ্জকা, বিকটনিতম্বা, ভাবক দেবী এবং কিছু অজ্ঞাত।


শীলা ভট্টারিকাঃ

কৌমার মোর হরেছিল যেই, সেই বর, সেই চৈত্ররাতি;
তেমনি ফুল্ল মালতীগন্ধ, কদম্ব-বায়ু বহিছে মাতি;
আমিও তো সেই!—তবু সেদিনের সে- সুরতলীলা কিসের তরে
রেবাতটে সেই বেতসীর মূলে আজিও চিত্ত আকুল করে?

--- চৈতন্যদেবের নাকি এই শ্লোকটি – যঃ মম কৌমারহর স মম বর—শুনে ভাব হত, মূচ্ছো যেতেন!

এক অজ্ঞাতনামাঃ

“ আকারে চন্দ্র, কূজনে কোকিল, পারাবত চুম্বনে,
গতির ভঙ্গে হংস, হস্তী বিলাস-বিমর্দনে;
যুবতিকাম্য সব গুণ আছে – কী আর বলিব আমি—
না থাকিত যদি দোষটুকু--- সে যে মোর বিবাহিত স্বামী”।
-- হে ভগবান! উনি অজ্ঞাতনামাই থাকুন।

মোরিকাঃ

বিরহের শ্বাসে কত না তাহার কাঁচুলি নিত্য ছিঁড়িয়া পড়ে
একবার তুমি এস ওগো, -- আর সেলাইয়ের সুতো নাই যে ঘরে।।
---ক্লাস টেনে পড়ার সময় বইটার পাতা উলটে ছিলাম!

অবন্তীসুন্দরীঃ

যাত্রাসময়ে গুরুজন মাঝে তেয়াগি লজ্জা ভয়,
স্রস্তবসনা ধরিনু তোমায় ভুলে গেছ নির্দয়!

ভাবক দেবী

“আগে সে মোদের ছিল একদেহ, ছিল না তো ছাড়াছাড়ি,
তারপর তুমি নহ আর প্রিয়, আমি আশাহত নারী।
এখন আমি যে শুধুই গৃহিণী, তুমি শুধু মোর স্বামী,
প্রাণ ছিল মোর কুলিশ-কঠিন, তারি ফল লভি আমি।

অজ্ঞাতঃ

“কাল যে কন্ঠে চলেছিল মোর বাণীর মহোৎসব—
অয়ি প্রিয়া! অয়ি মানসী! কান্তা! নিরুপমা! মধুময়ী!
সে-কন্ঠে শুধু ধূসর গদ্য ‘ওগো, হ্যাঁগো’ আজ জয়ী—
এই তো জীবন; স্বপ্ন কবিতা নিছক মিথ্যা সব”।

--- খাঁটি কথা কালীদা!

বিজ্জকাঃ

“ধন্য তোমরা সখী তোমাদের এত কথা থাকে মনে?
--পটু চাটু যত নর্মবিলাস হয়েছিল প্রিয় সনে।
কটিবসনের বন্ধন যবে টুটাল সে প্রিয় কর,
শপথ আমার, যদি কিছু আর, মনে থাকে তারপর”?

এবার একটু অমরুশতক হয়ে যাক ।

“লাজে মরে যাই, কি আর বলিব, 
প্রিয়তম মোর অতুলনীয়,
যখন যেমন, তখন তেমন
বিধিমতে লাজ হরিল প্রিয়”।।

“মিথ্যাবাদিনী! স্নানে গিয়েছিলি? নদীজলে সব ধুয়ে এলি,
আমি কি জানিনা প্রসাধন যত কাহার অঙ্গে থুয়ে এলি”!

“শয্যায় মোর এল যবে প্রিয়তম,
নীবীবন্ধন আপনি খসিল মম,
নিতম্বতটে লুটালো শিথিল শাড়ি,
এইটুকু শুধু স্মরণ করিতে পারি”।।

---- এ হে, বড্ড বেশি ইয়ে হয়ে গেছে। সেন্সার কেস দেবে নাতো!

এবার বিশুদ্ধ প্রেমের চৌপদীটি দেখুন।


রাজহস্তীঃ

তোমার মুখের আদল পায়নি চাঁদ,
তাইতো বিধাতা গড়বার বাসনায়,
মণ্ডলী-চাঁদ টুকরো টুকরো করে
যুগ-যুগান্ত ধরে।।

--- এ’নিয়ে আর কোন কথা হবে না।


সঞ্চারী

বিশাল সংস্কৃত সাহিত্য ভান্ডারে মাত্র বুড়ি ছুঁয়ে গেলাম। রয়ে গেল অথর্ববেদ, ভট্টিকাব্য,চৌরশতক, রঘুবংশ, মেঘদূত। পাতা ওল্টালাম না গীতগোবিন্দমের-- গোস্বামী জয়দেব যার ভূমিকায় বলছেন এ কাব্য দু’ধরণের পাঠকের জন্যে -- যারা হরিনামের রসাস্বাদন করতে চান আর যারা বিলাসকলায় পারঙ্গম হতে চান। এতসব করলে খর্চা আছে।

কিন্তু এবার একটু দম নিয়ে রবীন্দ্রনাথে ফিরছি। “অভিজ্ঞান শকুন্তলম” এ শকুন্তলা দুষ্যন্তের রাজদরবারে এসে প্রতীক্ষা করছেন। গান গাইছে হংসপদিকা, কবির অনুবাদে ফুটে উঠেছে নারীমৃগয়ায় অভ্যস্ত রাজার স্বভাব।

“নবমধুলোভী ওগো মধুকর, চ্যূতমঞ্জরী চুমি,
কমল আসনে যে প্রীতি পেয়েছ, কেমনে ভুলিলে তুমি”?

বৌদ্ধসাহিত্য বড় কট্টর, বড় নাক উঁচু। অবন্তী সান্যাল মশাই খুঁজে-টুজে মাত্র দু’জায়গায় শৃঙ্গাররসের সন্ধান পেয়েছেন। এক, ‘পঞ্চশিখ গন্ধর্বের গান’; যেখানে গন্ধর্বটি গান গেয়ে পথে পথে ফিরছে এক অপ্সরাকে—‘কোথায় গেল পাপাঙ্গুলের মেয়ে’? নির্বাণ তুচ্ছ, তার আলিঙ্গন কাম্য।

কিন্তু একী! বিখ্যাত বৌদ্ধ দার্শনিক ‘প্রমাণবার্তিক’ রচয়িতা ধর্মকীর্তি এ কি লিখেছেন?

“বুঝিনা এহেন রূপটি স্রষ্টা নয়ন মেলিয়া কেমনে গড়ে;
নয়নে পড়িলে মুগ্ধ বিধাতা ছাড়িত কি তারে ক্ষণেক তরে?
নিমীলিত-চোখে এ রূপ সৃষ্টি সম্ভব নয় , বুঝেছি তাই 
--বুদ্ধের এই কথাটি সত্য, জগতের কোন স্রষ্টা নাই”।।

---মাইরি! অতবড় দার্শনিক, নারীর রূপ দেখে বুদ্ধবচনে নিশ্চিত হলেন যে এই দুনিয়ার স্রষ্টা কোন ঈশ্বর বলে কিছু নেই। কারণ, ঈশ্বর থাকলে নারীকেও তিনিই সৃষ্টি করতেন, কিন্তু তারপরে তাকে ছেড়ে কি করে থাকতেন? 

আমিও এই চৌপদীটি পড়ে প্রাকযৌবনে নাস্তিক হয়ে গেছলাম, আজও তাই আছি ।


দ্বিতীয় অন্তরা

যাদের উপরের পদ্যগুলো একটু গুরুপাক লাগছে তারা এই বইয়ে সংস্কৃত, হিব্রু , পালি বা ফারসি ছেড়ে চিনা বা জাপানী কবিতায় গিয়ে মুখ বদলাতে পারেন। একেবারে সূক্ষ্ম তুলির টানে আঁকা দ্বিমাত্রিক ল্যান্ডস্কেপ উপভোগের আনন্দ পাবেন। 

আমি ওল্টাচ্ছি প্যাপিরাসের পাতা। আটকে গেলাম নায়িকার রূপ-বর্ণনায়ঃ

“দীর্ঘগ্রীবা দ্যুতিময় স্তনবৃন্ত দুটি,
পদ্মের কলিকা যেন অঙ্গুলির যথার্থ উপমা,
ক্ষীণমধ্য, নিবিড় নিতম্ব,
কী লাস্যে লীলায় হাঁটে ধরণীর বুকে,
বিমোহিত পুরুষেরা সম্বিত হারায়।
যাকে সে আশ্লেষ দেয়
তার কী উল্লাস!
কামতপ্ত তরুণের দলে
সবচেয়ে ধন্য সেই, সেই তো নায়ক”।

আর একটি গীতিকবিতার আমেজ আনা পদ্য দেখুন।

নেক্রোপলিসের লিপিকারঃ নাখৎ -সেবেক

“প্রিয়ার প্রমোদ-কক্ষে তোমার সঙ্গে এনো প্রেম,
হে হৃদয়! এস একা, সঙ্গী ছাড়াই—
লীলাসঙ্গিনীকে যদি একান্ত ঘনিষ্ঠ পেতে চাও।
ঝড়ে ওড়ে তো উড়ুক নলখাগড়ার ছাউনি বারান্দার
হাওয়ার পাখায় ভর দিয়ে মাথায় নামুক সর্বনাশ।
তবু ঝড়ে উড়বে না , পুড়বে না –আমার প্রেম”।।

আর এ’দুটোকে কী বলা যায়?

“আমার বঁধুর দেহ যেন এক পদ্মকুড়ির দীঘি,
স্তন ও তো নয়, রসে ডগোমগো যমজ ডালিম দুটি,
ভুরূ দুটো যেন মেরুবনে পাতা শিকারী মেয়ের ফাঁদ,
আর আমি এক বুনোহাঁস দেখ ধরা পড়ে গেছি ফাঁদে”।

এবং

“উরুযুগলের আশ্লেষ মাগ’ যদি
স্তনযুগ মরে কেঁদে।
ক্ষুধায় পীড়িত বলে কি বন্ধু
এখনই যাবে চলে?
--তুমি কি ঔদরিক”?

---- তা একটু পেটুক ছিলাম বটে!

এবার একটু অন্যরকম। সে যুগেও প্রেম এবং রাজনীতি মিলেমিশে যেত।

“ওরা আমায় যতই মারুক ধরুক,
লাঠিসোঁটায় তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যাক প্যালেস্টাইন-ভূমি,
তালপাতার ডাঁটার ঘায়ে ইথিওপিয়া পার করুক,
সড়কি উঁচিয়ে পার করুক,
বল্লম দিয়ে পেড়ে ফেলুক মাটিতে-
ফাঁদে ওদের পা দেব না, কিছুতেই না,
ভুলবো না তোমাকে, ভুলবো না তোমার প্রেম”।।

ঢের হয়েছে। এভাবে চললে সারারাত পুইয়ে যাবে । মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে খাঁড়িটা পেরিয়ে গ্রীস দেশে ঘুরে এযাত্রা সবাইকে রেহাই দেওয়া যাক, নইলে চোঁয়া ঢেঁকুর উঠবে।

গ্রীক কাব্য, সমপ্রেম এবং সাফো

‘সমপ্রেম’ শব্দে নাক সিঁটকালে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গীতিকবি সাফো’র রচনার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবেন। বিষ্ণুদের লাইনটি মনে করুনঃ “সাফোর ঝর্ণা-কলকল্লোলে হোমারের ষটমাত্রা”। আর এখন তো পেনাল কোডের ৩৭৭ ধারায় সমপ্রেম অপরাধ নয়। কাজেই আদিযুগের মহিলা কবি সাফো’র দুটো কথা শুনেই নিন।

প্রেম

প্রেম সে পাহাড়ী ঝড় ওকের চূড়ায়,
বিকম্পিত শাখাপত্র করেছে আমায়।
একক শয়নে
চাঁদ চলে গেছে,
কৃত্তিকা গেল, 
মধ্যরাতি।
প্রহর যায়
প্রহর যায়
একলা কাটাই সঙ্গীহীন।।

সঙ্গিনীর প্রতি

“আহা, কত কাছ থেকে শোনে সে রূপালী
তোমার বচন, প্রেমে গদগদ হাসি।

তাইতে হৃৎপিণ্ডে বন্য আমার হৃদয়ে—
মুহুর্তেও যদি দেখা পাই,
কন্ঠ অবরূদ্ধ আর রসনা ভঙ্গুর,
সমগ্র শরীর ব্যাপ্ত মজ্জামাংস নিচে
লেলিহান অদৃশ্য অনল”।।

এবার একটি অন্য স্বাদের কবিতা, ফিলোদেমসের লেখাঃ

তিরস্কার
তোমার চুমো বলে, তুমি জান তুমি কি চাও,
আমি আরও বিভ্রান্ত হই।
তাই যখন ফিসফিসিয়ে বলি, ‘এই তো আমি, গ্রহণ কর, এসো’,
তুমি ইতিউতি চাও, কাশো এবং অধিবেশন স্থগিত রাখো
অনির্দিষ্ট কালের জন্যে।
তুমি কি প্রেমিক, না রাষ্ট্রসভার সদস্য?

শেষ পাতে আমার পরিবেশন অধ্যাপিকা বাণী রায়ের অনুবাদে দেবরাজের সমপ্রেমের বিষয়ে এই চমৎকার রচনাটি।

কালিমাক্ষাস এর কবিতা প্রেমিক জিউসঃ

“ঘৃণা করে যদি সে আমাকে,
তবে তুমি হে জিউস, ঘৃণা কোর তাকে।
থিওক্রেতাস, থিওক্রেতাস আমার!
অপরূপ শ্যাম কিবা দেহ
ঘৃণা কোরো তাকে
ঘৃণা করে যত সে আমাকে
চতুর্গুণ ঘৃণা কোরো তাকে।
দেবতা জিউস আমি করেছি শপথ
স্বর্ণকেশ গানুমেদে- নামে,
তোমারও যৌবনে তুমি করেছ প্রণয়,
--আর কথা নয়”।।

বাদ পড়ে গেল ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে কিং সলোমনের গানের ডালি যার সামান্য উল্লেখ মুজতবা আলীর ‘শবনম’ উপন্যাসের শেষের দিকে রয়েছে। বাদ পড়ল আরও অনেক কিছু। তিনহাজার বছরের রত্নভাণ্ডারে আমি শুধু জানলা দিয়ে একটু উঁকি মেরেছি মাত্র, বাকিটা আপনারা করুন।

তেহাই

করোনা -১৯ ভাইরাসটি যেমন আমাদের অনেক দূরকে নিকট করেছে, তেমনই নতুন করে ভালবাসতে শিখিয়েছে, খুঁজে খুঁজে ফোন করছি—কেমন আছ? ভালো থেকো; আকাশের ঠিকানায় নামটি যেন লিখতে না হয় ।

আমাদের জন্যে সমস্ত মন্দির-মসজিদ-গির্জাঘর-গুরুদ্বারার দরজা বন্ধ; আর্তের আর্তনাদ কোন দেবতার কাছে পৌঁছচ্ছে না। আমাদের বাঁচাতে পারে ভালবাসা, মানুষের জন্য মানুষের নির্বিচার ভালবাসা। আশা করি তিনহাজার বছরের এই প্রেমের কবিতাগুলো আমাদের ভালোবাসার প্রত্যয়ে বিশ্বাসী করবে।

পুঃ ১

এই বইটি এখন আউট অফ প্রিন্ট, কারও কারও ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছেঁড়াখোঁড়া অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু পিডিএফ ডাউনলোড করা যাচ্ছে। অতএব, বুঝ লোক যে জান সন্ধান।।

পুঃ ২

আর তিনহাজার বছরের প্রেমের কবিতা যদি মহায়দের একেবারেই না পোষায় তো গদ্য পড়ুন গে’; যান “ভারত প্রেমকথা”য়; ষাট -সত্তর বছর আগের বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক সুবোধ ঘোষের লেখা। আমাদের বাবা-কাকাদের বিয়ের সময় নববধূদের ভাগ্যে উপহার হিসেবে এর এক বা একাধিক কপি জুটতো।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী

Posted in

১৯৭১ সালের বসন্তে বিখ্যাত আন্তর্জাতিক নাট্যপত্রিকা 'দ্য ড্রামা রিভিউ'-য়ের পক্ষ থেকে এ.জে. গুনবর্ধন একটি সাক্ষাৎকার নেন নাট্যব্যক্তিত্ব, তৎকালে স্বমহিমায় বিরাজমান, উৎপল দত্তের। প্রায় পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে আজ হঠাৎ এই সাক্ষাৎকারের উল্লেখ করা এই কারণেই, যে সাধারণ জনমানসে উৎপল দত্ত আমাদের কাছে এক কিংবদন্তী অভিনেতা, যাঁকে ভিলেন হিসেবে বা কৌতুকে দেখে আমরা আনন্দ পেতে অভ্যস্ত বহুকাল। এর বাইরে তিনি একজন ক্ষুরধার নাট্যকার, মঞ্চ অভিনেতা এবং রাজনৈতিকভাবে প্রো-একটিভ একজন শিল্পী। কিন্তু এই সরলীকৃত পরিচয়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকে অনেকসময়ই তাঁর বিশদ বিপ্লবচেতনা, অভিসন্ধি এবং ক্রিয়াকর্মের অভিমুখ। যেমনটা হয়ে থাকে অনেকের ক্ষেত্রেই -- আমরা জানি খোলসটাকে। খোলস যে ভুল এমন নয়, কিন্তু খোলসের কাজই হলো অণু-পরমাণুকে সমগ্রতায় দেখানো। সমগ্রতার আড়ালেই লুকিয়ে থাকে সঠিক পাঠ।

কিছুটা এসব কথা ভেবেই ফিরে যাওয়া সেই সাক্ষাৎকারে, যেখানে উৎপল দত্ত নিজের নাট্যদর্শন, নাট্য-আদর্শের কথা সরাসরি তুলে আনছেন সময় ও সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে। মূলস্রোতের নাট্যব্যক্তিত্বই ছিলেন তিনি; এবং সে কারণেই, আজকের মূলস্রোত-শিল্পের এই আদর্শগত দৈন্যের দিনে প্রয়োজন অনুভব করছি তাঁর কথাগুলিকে আবার স্মরণ করার। তাঁর আদর্শের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ আমরা করতেই পারি; ভিন্নতায় শিল্পই সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু মূলস্রোতেও যে দর্শন ও দায় থাকতে পারে, সেটুকু অন্ততঃ আজকের দিনে যদি আবার অনুভব করা যায়, সে-ই বা কম কী! সাক্ষাৎকারটির কিছু বিশেষ প্রশ্ন ও তার বিশ্লেষণ ধরেই নিচের আলোচনাটি এগোবে মূলতঃ চারটি খুঁটির সন্ধানে।

১। Weapon আর Revolution

প্রশ্নের আগে অবশ্য খেয়াল করা যাক সাক্ষাৎকারের শিরোনামটি: "Revolution: Calcutta/ Theatre as a Weapon"। দুটি শব্দ এখানে খেয়াল করার মতো। প্রথমেই, weapon -- অস্ত্র -- এক ধরণের সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলার আভাস। সাক্ষাৎকারে বারবারই উৎপল দত্ত ব্যবহার করছেন একটি নির্দিষ্ট শব্দবন্ধ "cultural front" -- যা কমিউনিস্ট পার্টিরই সাংস্কৃতিক শাখা, প্রয়োজনে পার্টি যাঁদের নিয়োগ করছে আন্দোলনে, বা সংস্কারে। অ-সাংস্কৃতিক আঙ্গিকের অস্ত্রের চেয়ে ভিন্ন এই সাংস্কৃতিক পন্থার অস্ত্র -- থিয়েটার। অনুমেয়, এই ধারণার ভিত্তিতেই weapon শব্দটির একেবারে পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক ব্যবহার থিয়েটারের পাশে। 

Revolution কথাটি সরাসরিই আমাদের নিয়ে যায় উৎপল দত্তের দর্শনে। হয়তো অনেকেরই মনে থাকবে তাঁর লেখা একটি বিখ্যাত বইয়ের কথা, 'Towards a Revolutionary Theatre'। রেভলিউশনারি থিয়েটার বলতে তিনি কী বোঝেন, গুণবর্ধনেরও প্রশ্ন ছিল এটিই। সংক্ষিপ্ত চার-পাঁচ লাইনের উত্তরে উৎপল দত্ত বলেন, এটি মূলতঃ জননাট্য; জনসমাবেশে অভিনয়ের জন্যই এর জন্ম। শুধুমাত্র শহুরে বুদ্ধিবিত্তদের সামনে এই নাটকের অভিনয় অসঙ্গত, কারণ বৈপ্লবিক থিয়েটার যে বদলের কামনা করে, তা শহুরে এই মানুষদের মধ্যে আসবে না, বা তারা এই পরিবর্তনের সক্রিয় অংশও হবেন না। আরও নির্দিষ্ট করে দত্তমশায় বলছেন, মূলতঃ শ্রমিক ও কৃষকদের জন্য এই থিয়েটার। এর কাজ শুধুমাত্র সিস্টেমের গলদ ধরা নয়, তার তীব্র সমালোচনা করাও বটে।

২। রেভলিউশনারি থিয়েটারের বাস্তব উপযোগিতা

স্বাভাবিকভাবেই সংজ্ঞার পাশাপাশি উঠে আসে অবশ্যম্ভাবী আরেক প্রশ্ন। যে থিয়েটার স্টেট মেশিনারির এমন কঠোর সমালোচক হিসেবে জন্ম নেয়, এবং একমাত্র সেই অবস্থাই তার সঠিক গুরুত্ব নির্ণয় করতে পারে, সে থিয়েটার কি স্থান-কাল নির্বিশেষে সবসময়ই একইরকম উপযোগী? উত্তরে উৎপল দত্ত অবশ্য এর কার্যকারিতা বিচারে দুটি 'fixed parameter' নিয়ে আসছেন -- নির্দিষ্ট দেশ, এবং নির্দিষ্ট সময়বৃত্ত। ১৯৭০-এর ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বুকে রেভলিউশনারি থিয়েটারের ভূমিকা একরকম। তার মূল লক্ষ্য তৎকালীন সেট-আপকে প্রশ্ন করা এবং ভেঙে দেওয়া। কিন্তু উৎপল দত্ত এ বিষয়ে সচেতন, যে বিপ্লব-পরবর্তী অধ্যায়ে এর ভূমিকা সম্পূর্ণ বদলে যাবে, এবং তাই-ই কাম্য।

সাক্ষাৎকার থেকে বেরিয়ে এসে একটা ছোট অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমরা যে সময়ে বসবাস করছি, পূর্ণাঙ্গ রাজনীতি ও ছাত্র রাজনীতি, উভয়েই বেশ দোলাচল খেয়াল করা যায়। বিপ্লব প্রায় সকলেই চাইছেন; সে নিয়ে সভা, মিছিল, ভাষণ হয়েই চলেছে, এবং সঙ্গে থাকছে যুগ-যুগান্তরের স্লোগান: "বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক! লং লিভ রেভলিউশন!" এই স্লোগানটি শুনলে আমার ভারী মজা লাগে। বিপ্লবীরা নিজেদের, সাথীদের উদ্বুদ্ধ করার খাতিরে বলেন বটে এসব, কিন্তু এটা কি কখনও তারা ভেবে দেখেছেন, বিপ্লবই আসলে সবচেয়ে ক্ষীণজীবী/ ক্ষণস্থায়ী? ব্যর্থ বিপ্লবের ব্যাটন তবু কালানুক্রমে পরবর্তী বিপ্লবীদের হাতে তুলে দেওয়া যায় সাফল্যের আশায়। কিন্তু বিপ্লব সফল হলে তখন তা সবচেয়ে কষ্টের! কারণ, বিপ্লব এসে গেলে তার পর কী, এই প্রশ্নে বিশেষ কেউ যায় না। বিপ্লবের আশু লক্ষ্য এবং তৎসম্বন্ধীয় স্বপ্ন এমনই মোহময়, যে বিপ্লবের দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল বা উদ্দেশ্য অব্দি আর বড় একটা যাওয়া হয়ে ওঠে না। কিন্তু বিপ্লব যে পরিবর্তন আনে, তার ফলে সমাজে, সময়ে যে বদল আসে, বিপ্লবের পরবর্তী পদক্ষেপগুলি তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেদের বদলে নিতে পারে না বলেই রেভলিউশন "লং লিভ" আর হয় না কখনই। একেবারে সেই ফরাসী বিপ্লব থেকে শুরু করে হাল আমলের সামাজিক রদবদল -- সবই এই একই সত্যের আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। অতএব, শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক জগতে নয়, ঘোর রাজনীতিতেও উৎপল দত্তের এই সচেতনতা অনুসরণীয়।

৩। প্রগতিশীলতা বৈপ্লবিক নয়

সাক্ষাৎকারে আলোচনা এগোতে এগোতে উঠে আসে উৎপল দত্তের বহুচর্চিত নাটক 'অঙ্গার'-এর কথা। দত্তমশায় এই নাটকটিকে সমালোচনার দৃষ্টিতেই দেখেছেন বেশিরভাগ সময়ে। সে প্রশ্ন উঠতে নিজেই বলেন তাঁর অসন্তোষের কারণ: অঙ্গার একটা সিস্টেমের বর্বরতাকে এক্সপোজ করেছিল, কিন্তু সেই সিস্টেমকে প্রতিহত করার পথ দেখায় নি। পাঠকেরা খেয়াল করুন, উৎপল দত্তের রেভলিউশনারি থিয়েটারের সংজ্ঞা অনুযায়ী 'অঙ্গার' কেবলমাত্র প্রথম ধাপেই সীমিত থাকছে -- দোষ নির্ণয় করা। তার চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে শোধন বা প্রতিহত করার পন্থা সে নিচ্ছে না। এই আদর্শগত স্থান থেকে 'অঙ্গার' তাঁর কাছে হয়ে উঠছে বড়জোর একটি "প্রগতিশীল" নাটক। 'প্রগতিশীল' শব্দটির মর্ম বোঝাতে দত্তমশায় তিনটি বিশেষণ ব্যবহার করছেন -- "damaging", "derogatory", এবং "abusive" -- ক্ষতিকর, মর্যাদাহানিকর, এবং অবমাননাকর। প্রগতিশীলদের দ্বিচারিতা তুলে ধরছেন উৎপল দত্ত তাঁর বিশ্লেষণে -- যারা কখনও বিপ্লবের কথা সক্রিয়ভাবে বলে না, কেবলমাত্র দূর থেকে, গা বাঁচিয়ে বিপ্লবের প্রতি সহানুভূতি জানায়। মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদেরই চিহ্নিত করছেন তিনি প্রগতিশীল হিসাবে, যারা বিপ্লবের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা "struggle"-কে কাব্যমধুর করে তোলেন, কিন্তু বিপ্লবের মূল সুরে সুরে মেলান না। ফলতঃ, সাধারণ জনমানসে প্রগতিশীলতা এবং বিপ্লব -- উভয় সম্বন্ধেই যে একধরনের সমভাব দেখা যায়, তার বিরুদ্ধে এই অবস্থানটি উল্লেখযোগ্য।

৪। পথনাটিকা

শেষ এই বিষয়টিই আলোচ্য। যাকে আমরা অন্য নামে চিনি street theatre বা streetcorner plays বলে, সেই পথনাটিকার ঘরেও উৎপল দত্ত আসেন একেবারে নির্দিষ্ট কিছু এজেন্ডা নিয়েই। মঞ্চনাটকের খ্যাতি ও আড়ম্বরের সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে অবস্থিত পথনাটিকার মূল লক্ষ্য সাধারণ মানুষের কাছে সহজে পৌঁছনো। বাদল সরকার তাঁর তৃতীয় থিয়েটারের আলোচনায় বলেছিলেন, থিয়েটারের হওয়া portable (সহজে যে কোনো স্থানে বহন করে নিয়ে যাওয়া যাবে সেই থিয়েটার), flexible (প্রয়োজন অনুসারে যে-কোনো স্পেসে বা ফর্মে সে সহজেই ভেঙেচুরে গড়ে তুলতে পারে নিজেকে), এবং inexpensive (সহজলভ্য)। প্রায় এই একই মাপকাঠিতে পথনাটিকাকে বিচার করেন উৎপল দত্তও। মঞ্চের বাইরে, জনবহুল বাজারে, বা কোনো রাস্তার মোড়ে গড়ে ওঠে এই নাটক, সেট ছাড়া, লাইট ছাড়া, কম সংখ্যক অভিনেতা নিয়ে। এর উদ্দেশ্য আদ্যন্তই রাজনৈতিক। যেখানে অভিনীত হচ্ছে, সেখানকার সামাজিক কোনো বিষয় নিয়েই মুখে মুখে বেশিরভাগ সময় তৈরি হয় এই নাটকের তাৎক্ষণিক সংলাপ। বদলে যায় এক অভিনয় থেকে অন্য অভিনয়ে।

১৯৫০-এর দশকে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির হাত ধরেই শুরু হয় পথনাটিকার প্রচলন, রাজনৈতিক বক্তব্যকে সাংস্কৃতিক একটি রূপ দেওয়ার তাগিদে। পার্টির সাংস্কৃতিক শাখা বলে উৎপল দত্ত যে সংগঠনকে চিহ্নিত করেছেন বাড়বে তাঁর নিজের লেখায়, সেই সংগঠনের সূত্রপাত কিছুটা পথনাটিকার কারণেই। অত্যন্ত জরুরি সময়েই ডাক পড়তো এই সংগঠনের, বিকল্প ভাষ্যের সন্ধানে; যেভাবে উৎপল দত্তের লেখা 'চার্জশীট' নাটকটি অভিনয়ের প্রচার করে সেই সমাবেশে নাটক শুরুর আগে, এবং নাটকের মধ্য দিয়ে পার্টি প্রয়োজনীয় বক্তব্য রেখেছে সাধারণের কাছে।

পরিশেষে, যে চারটি খুঁটির সন্ধান পাওয়া গেল এই সাক্ষাৎকারের সীমিত পরিসরে, সেগুলির প্রয়োজনীয়তা কী আজকের দিনে? না, রাজনৈতিক আদর্শ, অবস্থান, কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন উদ্দেশ্য -- এ কোনোটিই আমার আলোচ্য বিষয় নয় এখানে। আমি নিজে শুধু খুঁজে চলেছি এমন একজন বা কিছু শিল্পীকে আমার আজকের দিনে, যাঁদের শিল্পের সঙ্গে তাঁদের বাস্তব অবস্থান এবং সেই অবস্থানকে উল্লেখ করা বা পরিবর্তনের দায় জড়িয়ে আছে। বলতে গেলে, শুরুর সেই হতাশার কথাই আবার বলতে হয়। আধুনিক শিল্পের মূলস্রোতে আদর্শ, অবস্থান, দায়বদ্ধতা বড় সেকেলে, কাগুজে কথা মনে হয়। উচ্চারণে এবং সৃজনে কোথায় একটা ফারাক রয়ে যায়, বুঝি। বিকল্প ভাষ্যের শিল্পীরা মূলস্রোতের থেকে আলাদা হয়েও যে চর্চা করছেন, তা কিছুটা অনবধানে, কিছুটা কর্তৃত্বাভিমানে আড়াল হয়ে যাচ্ছে। শিল্পের দায় শুধুমাত্র বিনোদন নয়, বা অনান্দনিক, কুশ্রী বিরুদ্ধতাও নয়। শিল্প দায়বদ্ধ এক মধ্যপথের প্রতি, যে পথে অন্তর্দৃষ্টি আছে, শিল্প এবং শিল্পী কার্যকারণে যুক্ত যেখানে। সেটুকু নিজে বুঝতে, এবং সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতেই এই প্রসঙ্গের উত্থাপন, এই সাক্ষাৎকার, এবং উৎপল দত্তের মতো এমন এক সক্রিয় রাজনৈতিক শিল্পীর মধ্য দিয়ে শৈল্পিক চেতনা ও তার প্রতি সৎ থাকার ঐকান্তিক চেষ্টাকে ফিরে দেখা।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - মলয় রায়চৌধুরী

Posted in

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর, আয়ওয়া পোয়েট্রি ওয়র্কশপ থেকে সদ্য ঘুরে-আসা, ইউরোপীয় সাহিত্যের নিবিষ্ট পাঠক, ‘জনসেবক’ সংবাদপত্রের সাহিত্য বিভাগের প্রাক্তন সম্পাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর প্রথম উপন্যাসের নাম “আত্মপ্রকাশ” কেন রেখেছিলেন, তা এক রহস্য হয়ে থেকে গেছে সুনীলের বন্ধুর ভাই ও ‘আত্মপ্রকাশ’-এর নগণ্য চরিত্র পরিতোষের কাছে। যখন উপন্যাসটি ‘দেশ’ পত্রিকার জন্য লেখেন, তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বয়স ছিল একত্রিশ বছর। বই হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৬ সালে, আমার সামনে রয়েছে বইটির ষষ্ঠদশ মুদ্রণ, ২০১৭ সালে প্রকাশিত। অর্থাৎ বইটি বেশ জনপ্রিয়। 

‘আত্মপ্রকাশ’ নাম হলেও, উপন্যাসটি কিন্তু ‘কিউনৎসেলরোমান’  নয়, যে অর্থে পঁচিশ বছর বয়সে লেখা জেমস জয়েসের উপন্যাস ‘পোরট্রেট অফ দি আর্টিস্ট অ্যাজ এ ইয়াং ম্যান, পঁচিশ বছর বয়সে লেখা টমাস মানের ‘টোনিও ক্রোগার’, পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে লেখা রাইনের মারিয়া রিলকের ‘দি নোটবুকস, আটত্রিশ বছর বয়সে লেখা স্যামুয়েল বাটলারের ‘দি ওয়ে অফ অল ফ্লেশ’ কিংবা ছেচল্লিশ বছর বয়সে লেখা গ্যেটের ‘উইলহেল্ম মিয়েস্টার্স অ্যাপ্রেন্টিসশিপ, যে বইগুলোর বিষয়বস্তু একজন লেখক বা কবির আত্মপ্রকাশ সংক্রান্ত, অর্থাৎ বইগুলো কিউনৎসেলরোমান সাব-জনারের (মূল জনার বিলডুংসরোমান) অন্তর্গত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই বইগুলোর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন বলেই মনে করে পরিতোষ। 

আত্মপ্রকাশ উপন্যাসের ভাষাবিন্যাস ও কাঠামো সম্পর্কে ভেবেছে পরিতোষ; তার মনে পড়েছে যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাস লিখেছিলেন ছাব্বিশ বছর বয়সে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পথের পাঁচালি’ পাঁচ বছর সময় নিয়ে লিখেছিলেন, কিন্তু আরম্ভ করেছিলেন উনত্রিশ বছর বয়সে। ভাষার কাজ যে অত্যন্ত জরুরি এবং বাংলা সাহিত্যকে উচ্চতর মানে নিয়ে যেতে হবে, তা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উপন্যাসগুলো থেকে স্পষ্ট। ‘আত্মপ্রকাশ’ লেখার সময়ে এই উপন্যাসগুলোর ভাষা-নির্মাণ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মরণে ছিল না, তা বিশ্বাস করে না পরিতোষ। 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস ‘কুয়োতলা’র পাণ্ডুলিপি পড়েছিল পরিতোষ, পাণ্ডুলিপিতে মাঝে-মাঝে জায়গা ছাড়া ছিল এবং সে-বিষয়ে প্রশ্ন করলে শক্তি চট্টোপাধ্যায় পরিতোষকে বলেছিলেন, ‘এখানে ভাষার খেলা দেখাবো’। তিনি ‘কুয়োতলা’ লিখছিলেন ১৯৫৬-১৯৫৭ সালে, যখন তাঁর বয়স তেইশ বছর, উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬১ সালে। নিজের কবিতাকে তিনি যেমন ‘পদ্য’ বলতেন, তেমনই উপন্যাসকে বলতেন গদ্য। ‘কুয়োতলা’ তাঁর আত্মজীবনী, এবং এই বই থেকে পরের পর একাধিক উপন্যাসে নিরুপম অর্থাৎ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশের সঙ্গে আমরা পরিচিত হই। ‘কুয়োতলা’ উপন্যাসের গদ্যবিন্যাসই কেবল নয়, বিভিন্ন চরিত্রচিত্রণ, ও উপন্যাসের কাঠামোয় প্রতিফলিত হয় তাঁর সাহিত্যনির্মাণের জন্য পরিশ্রম, একাগ্রতা ও সততা। পরিতোষ জানে যে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘কুয়োতলা’ উপন্যাসের ভাষানির্মাণের পরিশ্রমের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আরেক বন্ধু সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, যাঁর সঙ্গে পরিতোষের ভালো পরিচয় ছিল, ১৯৬১ সালে আঠাশ বছর বয়সে ‘ক্রীতদাস ক্রীতদাসী’ গল্প লিখে সাড়া ফ্যালেন, প্রধানত তাঁর লিখনভাষার কারণে। তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি একটি নিজস্ব ভাষাশৈলী আয়ত্ব করেছিলেন এবং তা আজও অননুকরণীয় হয়ে আছে; নিজস্ব গদ্যবিন্যাস নির্মাণের জন্য প্রায় তিন বছর অবিরাম পরিশ্রম করেছিলেন তিনি। তাঁর নাম না থাকলেও বোঝা যায় রচনাটি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের। 

কয়েকজন বিদেশি ঔপন্যাসিকের প্রথম বই পড়ে মুগ্ধ হয়েছিল পরিতোষ, যেমন গুন্টার গ্রাসের ‘দি টিন ড্রাম, মার্গারেট মিচেলের ‘গন উইথ দি উইণ্ড’, চার্লস ডিকেন্সের ‘দি পিকউইক পেপার্স, জেন অস্টেনের ‘সেন্স অ্যাণ্ড সেনসিবিলিটি’, এই জি ওয়েল্সের ‘দি টাইম মেশিন’, জে ডি স্যালিঞ্জারের ‘দি ক্যাচার ইন দি রাই’, কুর্ট ভনেগাটের ‘প্লেয়ার পিয়ানো’, সিলভিয়া প্লাথের ‘দি বেল জার, উমের্তো একোর ‘দি নেম অফ রোজ’, খালেদ হুসেইনির ‘দি কাইট রানার, জোসেফ হেলারের ‘ক্যাচ-২২’ ইত্যাদি। তাই পরিতোষ, যে কিনা তার দাদার বন্ধু সুনীল গাঙ্গুলির সঙ্গে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই পরিচিত ছিল, আশা করেছিল যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস নিশ্চয়ই ওই পর্যায়ের হবে। হয়নি বলে খারাপ লেগেছিল পরিতোষের। 

আমেরিকার আয়ওয়া পোয়েট্রি ওয়র্কশপের জন্য সেখানে থাকাকালীন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটি চিঠিতে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, “গদ্য লিখে আপনাকে খুশি করতে পারব এমন দুরাশা আমার নেই। সত্যি নেই। কারণ, আপনি গ্রেট গদ্য লিখেছেন একসময়, এখন আর তেমন না। কিন্তু যা লিখেছেন, তার ধারে-কাছে আর কেউ পৌঁছোতে পারেনি। আমি ওরকম গদ্য লিখতে পারি না। লিখব না। কিন্তু ওই গদ্যই আমার প্রিয় পাঠ্য। আপনি পড়বেন, এই ভয়ে আমি সহজে গদ্য লিখতে চাই না। তবু কখনও লিখি, হয়তো টাকার জন্য, টাকার জন্য ছাড়া কখনও গদ্য লিখেছি বলে মনে পড়ে না, লিখেছিলুম একটা উপন্যাস, সেটা ছাপার সম্ভাবনা নেই।” ওই চিঠিতে তিনি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে আরও লিখেছিলেন, “লেখক হিসেবে, ‘প্রতিভাবান’ এই শব্দটা যদি ব্যবহার করতে হয় -- তবে আমাদের পুরো জেনারেশনে তন্ময় দত্ত ছাড়া -- শুধু আপনার সম্বন্ধেই আমি ও কথা ভাবি।” 

পরিতোষের মনে হয়েছে, এ কেমনধারা যুক্তি, টাকার জন্য যেমন-তেমন একটা উপন্যাস খাড়া করার চেষ্টা! টাকার অভাব শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আরও বেশি ছিল, তিনি উল্টোডাঙার একটা বস্তিতে থাকতেন, কিন্তু নিজের কবিতা ও উপন্যাসের প্রতি তাঁর ভালাবাসাবোধকে টাকার ক্ষয়রোগ থেকে দূরে রেখেছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যদি টাকার জন্য ‘আত্মপ্রকাশ’ লিখেও থাকেন, তিনি কিছুটা সময় সাগরময় ঘোষের কাছে চেয়ে নিতে পারতেন যাতে উপন্যাসটি সত্যিই তাঁর ‘আত্মপ্রকাশ’ হয়ে ওঠে; টাকার প্রয়োজনের কথা সাগরময় ঘোষকে বললে তিনি উপন্যাসের জন্য অগ্রিমের ব্যবস্থা করে দিতেন বলেই মনে হয় । 

সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লেখা উপরোক্ত চিঠিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজের ও সন্দীপনের সাহিত্যিক লোভ সম্পর্কে এই কথাগুলো লিখেছিলেন, “আমি জানতুম, আপনি লোভী নন। আপনার সঙ্গে বহুদিন বিছানায় শুয়েছি, পাশাপাশি রোদ্দুরে হাঁটার সময় একই ছায়ায় দাঁড়িয়েছি। সেই জন্য আমি জানতুম। আমি আমার লোভের কথা জানতুম। সেই জন্যেই বুঝেছিলুম, আপনার লোভ আমার চেয়ে বেশি নয়।” দেশ পত্রিকার পাতায় তাঁর উপন্যাস প্রকাশের লোভে তিনি যে আক্রান্ত হয়েছিলেন, এই বিষয়ে সুনীল গাঙ্গুলির বন্ধুর ছোটো ভাই পরিতোষের কোনো সন্দেহ নেই। 

পরিতোষ জানে যে সাগরময় ঘোষের প্রস্তাবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লোভ জেগে ওঠে, আর তিনি বেশ তাড়াতাড়ি একটা উপন্যাস নামিয়ে ফ্যালেন। তাড়াতাড়ি উপন্যাস নামিয়ে ফেলার এই কর্মপ্রক্রিয়ায় তিনি সারাজীবনের জন্য নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন, যে-কারণে তাঁর সঙ্গে বহুপ্রসু ঔপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদের তুলনা করা হয়, গদ্যশিল্পী ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জমান ইলিয়াসের তুলনা করা হয় না। এখানে ‘নির্বাস’ উপন্যাসের শুরুতে অমিয়ভূষণ মজুমদার যে মতামতটা প্রসঙ্গক্রমে দিয়েছেন তা উল্লেখ্য; তিনি লিখেছেন, “চেতনায় অন্য কারো জীবনের ছায়া যদি মুহূর্তের জন্যও পড়ে তবে সে বাইরের বিষয় থেকে নিষ্কৃতি পাবার একমাত্র উপায়ই হচ্ছে ছায়াটাকে বিশ্লেষণ করে দেখা, তা নিয়ে আলোচনা করা, অন্য কথায় গল্পটা বলে ফেলা।” ‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাসে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় গল্পটা বলে ফেলার বদলে ‘বয় মিটস গার্ল’ ধরণের এনটারটেনার ও জ্যাক কেরুয়াকের ‘অন দি রোড’ উপন্যাসে বন্ধুবান্ধবদের উচ্ছৃঙ্খল জীবন কাটানো নিয়ে লেখার দোটানায় ভুগেছেন; ছায়াগুলো বিশ্লেষণের প্রয়াস করেননি। ফলে তা মিলস বুনও যেমন হয়নি, তেমন কেরুয়াকও হয়নি। 

উল্লখ্য যে আমেরিকায় থাকাকালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পরিতোষকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “বালজাকের মতো আমি আমার ভোকাবুলারি তৈরি করে নিয়েছি কবিতা ও গদ্যে।” ‘আত্মপ্রকাশ’ পাঠান্তে পরিতোষের সন্দেহ জেগেছে যে তিনি অমন ভোকাবুলারি তৈরি করে প্রয়োগ করার কথা সত্যিই তাঁর প্রথম উপন্যাসটি রচনার সময়ে মনে রেখেছিলেন কিনা। বালজাক চেয়ারে বসে লিখতেন না, দাঁড়িয়ে একটি উঁচু ডেস্কে লিখতেন এবং ঘরে পায়চারি করার সময়ে আলমারিতে রাখা বই ঘাঁটতে তাঁর অসুবিধা হতো না, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতন তাঁরও মুখ গোল এবং চেহারা ছিল গোলগাল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একের পর এক রচনা লিখে গেছেন বসে থাকা অবস্হায়। লাগাতার বসে থাকলে প্রস্টেট এবং প্রস্টেটের ক্যানসারের সম্ভাবনা দেখা দেয়। যাঁরা বসে লেখেন, তাঁরা তাই উঠে একটু পায়চারি করে নেন মাঝে-মধ্যে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তা করতেন না বলেই মনে হয়। 

অনরে দ্য বালজাককে বাস্তববাদী সাহিত্যের জনক বলে মনে করা হয়। একশোটি উপন্যাসে, নেপোলিয়ানের পতনের পর জনগণের বাস্তব জীবনযাত্রা ধরে রেখেছেন বালজাক। তিনিও টাকা রোজগারের জন্য সতেরো-আঠারো ঘণ্টা লিখতেন। এই দিক থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বালজাকের মিল আছে; সুনীলও শতাধিক উপন্যাস লিখেছেন। ক্রমশ উচ্চবর্গ সমাজের অন্তর্গত হবার দরুন সুনীল পরবর্তীকালের উপন্যাসে সেই সমাজের চরিত্রদের আনার প্রয়াস করেছেন। বালজাকের মতনই তাঁরও মনে হয়ে থাকবে অমরত্বের জন্য তাঁর পাঠবস্তুগুলো ধারে না কাটলেও ভারে তো কাটবে। 

‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাসে প্রধান চরিত্রের নাম সুনীল গাঙ্গুলি, কিন্তু উপন্যাসের সুনীল গাঙ্গুলির বন্ধুরা সকলেই ফিকটিশাস বন্ধু (শেখর, তাপস, অবিনাশ, পরীক্ষীৎ, সুবিমল, অরুণ, নুরুল প্রমুখ। একমাত্র পরিতোষ চরিত্রটি বাস্তব, তাই শুরুতেই চরিত্রটিকে আক্রমণ করেছেন), তাঁর ফিকশান রচনার জন্য গড়ে নেয়া বন্ধু, চরিত্রচিত্রণের জন্য তাদের সম্পর্কে বিশেষ চিন্তা করেননি লেখক, তারা কেউই শক্তি, সন্দীপন, সমীর, শরৎ, তারাপদ, শংকর, দীপক, উৎপল, পার্বতী মুখার্জি নয়। 

লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘আত্মপ্রকাশ’ লেখার পর নিজের বন্ধুদের নিয়ে আসেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রী’ উপন্যাসে, কেননা ততোদিনে তিনি টের পেয়ে গিয়েছিলেন যে ফিকটিশাস বন্ধুদের কাউকেই তিনি ‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাসে দাঁড় করাতে পারেননি, তারা সকলেই ভাসা-ভাসা। বস্তুত ‘অরণ্যের দিনরাত্রী’ উপন্যাসই তাঁর সত্যকার ‘আত্মআবিষ্কার’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে কথাবার্তায় গালমন্দ প্রয়োগ করতেন না, কিন্তু তাঁর বন্ধুরা, বিশেষ করে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় বাঞ্চোৎ ও বাইনচোৎ শব্দটি প্রয়োগ করতেন, দীপক মজুমদারও কথাবার্তায় গালমন্দ প্রয়োগ করতেন, অথচ ‘আত্মপ্রকাশ’ আর ‘অরণ্যের দিনরাত্রী’ উপন্যাসগুলোয় বন্ধুরা তা নিজেদের মধ্যে প্রয়োগ করেন না; করলে অবশ্য ব্রাহ্মবাড়ির মানুষ সত্যজিৎ রায় উপন্যাসটি নিয়ে ফিল্ম করতেন না। অগোছালো জীবনযাত্রার চিত্রণ করলেও, চরিত্রগুলো মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ-কাঠামো ভেঙে বেরোতে পারেনি। ‘অরণ্যের দিনরাত্রী’ উপন্যাসে দেখা যায়, যে চরিত্রটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আদলে তৈরি, সে যুবতীদের সামনে খালি গায়ে স্নান করতে লজ্জা পায়, অথচ ‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাসে সে বেশ্যালয়ে যেতো! 

তাঁর জীবনী ‘অর্ধেক জীবন’ গ্রন্থে ‘আত্মপ্রকাশ’ সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, “সাবলীল ও যথেচ্ছভাবে অনেকখানি লেখার পর হঠাৎ আমার মনে হল, এ যা লিখে যাচ্ছি, গল্পের মাথামুণ্ডু নেই, এ কী সত্যি পাঠযোগ্য? নাকি নিতান্তই ভাবালুতা? অথবা সৈয়দ মুজতবা আলির ভাষায় গর্ভস্রাব?” তিনি আরও লিখেছেন, “দেশ শারদীয় সংখ্যা প্রকাশের সময়ে আমি লজ্জায় ও আতঙ্কে কিছুদিন লুকিয়েছিলুম কলকাতার বাইরে। উপন্যাসটার জন্য নিন্দা ও প্রশংসা দুইই জুটেছিল। তবে, নিন্দা, বিরূপ সমালোচনা, এবং কটুক্তিই বেশি। পাঠক যদি বলেন এসব এলোমেলো গদ্যপ্রবাহের কী মানে হয়।” 

‘আত্মপ্রকাশ’ লেখার সময়ে তিনি যে সিরিয়াস ছিলেন না, তা ‘অর্ধেক জীবন’ বইয়ের এই কথাগুলো থেকে স্পষ্ট হয়, “জোর করে ঢুকিয়ে দিলুম একটা উপকাহিনি। পূর্ববঙ্গের এক অভিনেত্রীর ঘটনাটি অন্যের মুখে শোনা, আমার নিজের অভিজ্ঞতার নির্যাস নয় বলেই বেশ কৃত্রিম, এবং আত্মপ্রকাশ উপন্যাসের সেই অংশটিই সবচেয়ে দুর্বল।” প্রশ্ন হল, একত্রিশ বছর বয়সে তো তাঁর প্রচুর অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল, কলকাতার বন্ধুবান্ধবদের কেন্দ্র করেই কতো ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িয়েছিলেন, আমেরিকার কয়েকটি শহর, লণ্ডন ও ফ্রান্স ঘুরেছিলেন, এক বিদেশিনীর সঙ্গে প্রণয়সম্পর্ক গড়েছিলেন, অথচ উপন্যাস লেখার সময়ে লাফিয়ে-লাফিয়ে সুনীল গাঙ্গুলি নামের চরিত্রটিকে শেখর, তাপস, অবিনাশ, পরীক্ষীৎ, সুবিমল, অরুণ, নুরুল প্রমুখ চরিত্রদের সঙ্গে ঘটনাহীন সংলাপে জুড়তে-জুড়তে উপন্যাসটিকে তাড়াতাড়ি এগিয়ে নিয়ে যাবার প্রয়াস করলেন। 

উত্তম পুরুষে লেখা উপন্যাসটির লেখক, ‘অর্ধেক জীবন’ পড়ে স্পষ্ট হয়, নিজেই সন্দেহে ভুগছিলেন যখন, তখন সন্দেহ নিরসনের পর ঠাণ্ডা মাথায় বইটা লেখা উচিত ছিল না কি? ‘অর্ধেক জীবন’-এ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, “সুনীল নাম দিয়ে আমি বোঝাতে চেয়েছি যে এটা আমার জীবনের ঘটনা। কিন্তু আত্মজীবনী নয়।” জীবনের ঘটনায় দেশভাগে চার বছরের বাচ্চা তার বাবা-মা দিদির সঙ্গে বহরমপুরে চলে আসে, যুবাবস্থায় বাবার সঙ্গে মনোমালিন্যে ‘রিফিউজি ছোঁড়া’ কলকাতায় চলে যায়। 

এই ‘রিফিউজি ছোঁড়া’ নিজে বা তাঁর বাড়ির কেউই, অথবা বহরমপুরের রিফিউজি পরিবারের যুবতীটি, তাঁরা কেউই পূর্ববঙ্গের বুলিতে কথা বলে না; পূর্ববঙ্গের বুলি সর্বত্র এক নয়। সুনীল গাঙ্গুলি নামের ‘রিফিউজি ছোঁড়া’ আর তার পরিবার বিমূর্ত রয়ে গেল, পূর্ব পাকিস্তানের কোন গ্রাম বা শহর থেকে তারা এসেছিল তা টের পাওয়া গেল না। ‘আত্মপ্রকাশ’ লেখার সময়ে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে উত্তর কলকাতা নিবাসী লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আত্মিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন, এবং একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন কলকাতা মেট্রপলিসের কৈশোর-যৌবনের জীবনযাপনের সঙ্গে। সম্ভবত ‘রিফিউজি ছোঁড়া’ ভাবকল্পটি ব্যবহৃত হয়েছে গর্ববোধের উৎস হিসাবে, কেননা যে-সময়ে তিনি ‘আত্মপ্রকাশ’ লিখেছিলেন সেই সময়ে গরিব-হওয়া-ভালো, উদ্বাস্তু-হওয়া-ভালো, সর্বহারা-হওয়া-ভালো ইত্যাদি প্রয়োগ করা হচ্ছিল কলকাতা কসমোপলিসের বিপরীতে নবতম মূল্যবোধরূপে খাড়া করার জন্য। সুনীল গাঙ্গুলি নামের চরিত্রটিতে দেশভাগের ট্রমা কেন ছাপ ফেলেনি সে প্রশ্ন ওঠে। 

উপন্যাসটিতে লেখক নিজেকে এবং বন্ধুদের উপস্হাপন করতে চেয়েছেন ছন্নছাড়া জীবন, খেদ, যৌনতা, বেশ্যাগমন, হতাশা, সামাজিক সীমালঙ্ঘন, টাকাকড়ির অভাব এবং তা সত্বেও জুয়াখেলার প্রতি আসক্তি, ব্যর্থ প্রেমের ঘেরাটোপে আবদ্ধ জীবনের আঙ্গিকহীন কাহিনির মাধ্যমে। কিন্তু আগে থাকতে ভেবে লিখতে নামেননি বলে কাহিনি বা প্লট গড়ে ওঠেনি। ব্যাস, মধ্যবিত্ত যুবকের উদ্দেশ্যহীন দিনযাপন ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস করা হয়েছে। উপন্যাসের তিনটি নারী চরিত্র হলো যমুনা, সরস্বতী এবং মনীষা, যাদের ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস করেননি লেখক; তিনি যেভাবে উপস্হাপন করেছেন, যমুনা হলো দেবী, মনীষা ছলনাময়ী, সরস্বতীর চরিত্র ঘোলাটে। বস্তুত দেবী ব্যাপারটি যে ঠিক কী, তা ১৯৬৬ সালেও ব্যাখ্যা যোগ্য ছিল না, আর এখন তো হাস্যকর; কোনো তরুণীকে ছলনাময়ীর তকমা দেয়াটা বিশ শতকে আরও গোলমেলে নয় কি? 

সবশেষে বেশ্যা বীণার বোন নুরজাহান বেগমের উপকাহিনি ঢুকিয়ে দিলেন ফিল আপ দি ব্ল্যাংক করার জন্য, যার কোনো আগাপেছু নেই, অথচ তাকে দিয়েই ‘আত্মপ্রকাশ’ উপন্যাস আচমকা শেষ হয়েছে। বীণার ঘরের বর্ণনা পড়লে মনে হয়ে লেখক একটি বাঙালি বেশ্যার ঘর খুঁটিয়ে দেখেননি, যা আমরা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের বর্ণনায় পাই। 

পরিতোষের ধারণা, সাধারণ পাঠক-পাঠিকাদের সমাদর পেয়েছে ‘আত্মপ্রকাশ’, নয়তো পঞ্চাশ বছর যাবত বার-বার মুদ্রণ হতো না।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সোমব্রত সরকার

Posted in














দুই

তন্ত্রের মূল সাধন-কাঠামোই অনুসৃত করে নিয়েছেন বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকেরা। তাঁরা মানব দেহের পাঁচটি চক্রের মধ্যে এক-একটি চক্রের শক্তিকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করেছন। তবে খেয়াল করার বিষয় তাঁরা কিন্তু তন্ত্রবাহিত সব মাতৃকাশক্তি-ই। যেমন— চণ্ডালী। ইনি বৌদ্ধ সহজিয়া পঞ্চ মরমিয়া যৌগিক শক্তির এক শক্তি। মূলাধারের যে শক্তি বৌদ্ধ সহজিয়ারা তার নাম করেছেন ডোম্বি। স্বাধিষ্ঠান ও মণিপুর চক্রের শক্তির নাম দিয়েছেন নটী। মণিপুর ও অনাহত চক্রে একেবারে প্রান্তদেশস্থ শক্তির নাম করেছেন রজকী। অনাহত ও বিশুদ্ধ চক্রের শক্তির নাম চণ্ডালি। আর সহস্রারের শক্তির নাম ব্রাহ্মণী। একে আবার যোগিনী নামেও অভিহিত করা হয়। সমস্ত শক্তিই হিন্দু তন্ত্রের মতনই রক্ত-মাংসের কোনও নারী নয়— যোগ অভিজ্ঞতায় নারীকল্পের শক্তি। বৌদ্ধ দেহাচারে যোগবলে যে ভয়ঙ্কর শক্তি উঠে আসে সাধক শরীরে, তা হল চণ্ডালী। মণিপুর চক্রাঞ্চল ছেড়ে দিলে শক্তি হুম্-হুম্ শব্দে অনুভূত হয় সাধক মনে। এই শক্তি বলা হয়ে থাকে চন্দ্রকিরণ বর্ষণ করে। চণ্ডালী হয়ে ওঠেন রূপকল্পনায় দেবী নৈরাত্মা বা অবধূতিকা অথবা প্রজ্ঞা। চর্যাপদে এঁর অহরহ উল্লেখ আছে। চণ্ডালীর মিলন হচ্ছে বৌদ্ধতন্ত্রে বজ্রসত্ত্বের সঙ্গে। এখানেও খেয়াল করার মতো বিষয়, হিন্দুতন্ত্রের শিব বিগ্রহের প্রতীকটি-ই কিন্তু বৌদ্ধতন্ত্র আহরণ করেছে। চণ্ডাকে এখানে করা হয়েছে ইড়া নাড়ি। পিঙ্গলাকে চিহ্নিত করা হয়েছে বজ্রসত্ত্ব হিসেবে। নাম হয়েছে অলি। এই দুই নাড়িতে যখন প্রাণ ও অপান বায়ু একাকার হয়ে যায়, তখনই বৌদ্ধতন্ত্রমতে চণ্ডালি শক্তির উদয় হয়। সুষুম্না নাড়ি এ তন্ত্রে অবধূতিকা। চর্যাপদে চণ্ডালী, ডোম্বী, শবরী, যোগিনী, নৈরামণি— এই সব মহিলাত্মিকা শক্তির মিলনের কথা আছে— তিনটি নাড়ি অর্থাৎ চক্র অতিক্রম করার পর তোমাকে পেয়েছি। যোগিনী তোমাকে আলিঙ্গন করি। তোমাকে ছাড়া আমি এক মুহূর্ত বাঁচব না। তোমার ওষ্ঠ চুম্বন করে আমি পদ্মের মধু পান করব। 

এখানে স্পষ্ট কুলকুণ্ডলিনী শক্তি জাগার কথা বলা হচ্ছে। হিন্দুমতে, কুণ্ডলিনী মণিপুর চক্র পেরোলেই এই দশা দেখা দেবার কথা সাধক শরীরে। কিন্তু বৌদ্ধমতে, যোগিনীর সঙ্গে রাত্রে শয্যাবাসের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ কিনা কুলকুণ্ডলিনী যোগিনী পর্যন্ত উঠলেই অজ্ঞানতা রূপ রাত্রির অবসান হয়ে আসছে সাধক শরীরে। বৌদ্ধতন্ত্রকে সহজ সাধনা বলা হচ্ছে। সহজ এখানে কিন্তু যুগল দ্যোতক। স হল স্ত্রী-তত্ত্ব— প্রজ্ঞা বা শূন্যতা বলা যেতে পারে একে। হ হল পুং-তত্ত্ব— উপায়, পন্থা, করুণার নামান্তর। সহজ মহাসুখের কথা বলছে আমাদের চর্যাপদ। এই সুখ স্ত্রী-পুরুষ তত্ত্বের নিট যোগফল। উল্টো সাধনার ক্রম অনুসারে এখানে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যকে শূন্যতার (হিন্দু তন্ত্র মতে পরম) চারটি স্তর অতিক্রম করতে হয়। এক— শূন্য, দুই— অতিশূন্য, তিন— মহাশূন্য আর চার— সর্বশূন্য। প্রথম স্তরে ৩৩টি, দ্বিতীয় স্তরে ৪০টি, তৃতীয় স্তরে ৭টি প্রকৃতি দোষ (প্রবৃত্তি) থাকে। সর্বশূন্যে কোনও প্রবৃত্তি দোষ থাকে না। এটিকে তাঁরা প্রভাস্বরশূন্যতা বলে চিহ্নিত করেন। যেমন, হিন্দুতন্ত্র বলে শেষ পদ্মচক্রে ব্রহ্ম-সাক্ষাত্কার ঘটে। এখানেই পরমাত্মায় বিলীন হয়ে পড়ে সাধক সত্তা। এই সহস্রদল পদ্ম ধ্যান করলে জগদীশরত্ব প্রাপ্তি হয়। বৌদ্ধতন্ত্রের মতো হিন্দুতন্ত্র-ও শক্তির নামকরণ করেছে। যেগুলো স্ত্রী-শক্তিকেই চিহ্নিত করে। মূলাধারে চিৎ, স্বাধিষ্ঠানে রাকিনী, মণিপুরে লাকিনী, অনাহতে কাকিনী, বিশুদ্ধে শাকিনী, আজ্ঞায় হাকিনী— এ সবই স্ত্রী নামাঙ্কিতা শক্তিরূপ। সাধককে এঁদের সঙ্গে যোগক্রিয়ায় মিলিত হতেই হয়। 

নাথ ধর্মও খানিকটা হিন্দু-তন্ত্রজাত। নাথ সন্ন্যাসীরা কুলকুণ্ডলিনী শক্তিকে বলেন কুলটা। অর্থাৎ কিনা বেশ্যা। কারণ তাঁদের মত, আজ্ঞা চক্র পার হবের আগে এর ব্যবহার অত্যন্ত চটুল হয়ে পড়ে। কখনও স্থূল ইন্দ্রিয় সে আরও ইন্দ্রিয়াসক্ত করে দেয়, কখনও আবার ওপরে উঠে গিয়ে শিবকে আলিঙ্গন করে। তাই নাথপন্থীরা একে চিহ্নিত করেছেন কুলটা বা বেশ্যা হিসেবে। তবে নাথরা তাঁদের সাধনকে বলেন কায়া-সাধনা। নাথ সাহিত্যে রয়েছে: মধ্যযুগের বঙ্গদেশের রাজা গোপীচাঁদের মা ময়নামতি ছিলেন ডাইনি। তিনি সিদ্ধ যোগী গোরক্ষনাথের শিষ্যা ছিলেন। ডাইনির স্থূল অর্থ তুকতাককারিণী। আদতে কিন্তু তা একেবারেই নয়। ডাইনি হল ডাকিনীর অপভ্রংশ। ডাকিনীও স্থূল অর্থে ভূত-পেত্নীদের রূপকে স্পষ্ট করে। কিন্তু এই শব্দ এসেছে আসলে তিব্বতের ডাক শব্দ থেকে। যার স্ত্রী-লিঙ্গ ডাকিনী। ডাকের অর্থ হল জ্ঞান। ডাকিনীকে তাই বলতে পারি জ্ঞানী রমণী। তবে ডাকের আরেকটি অর্থ করা যায়— ড বা ডক্কানাদের মতো বিস্তারিত অবস্থায় কাম বা ইচ্ছে যুক্ত হয়ে ছুটে যাবার নামও ডাক। 

বৈষ্ণব সহজিয়া তত্ত্বেও নর-নারীর শরীর এবং দেহ-মিলনের মধ্যে দিয়ে পরমার্থ লাভের কথা বলা হয়েছে। তন্ত্রের মতোই এখানে বলা হয়েছও বলা হয়েছে: ব্রহ্মাণ্ডের সকল তত্ত্ব নিহিত আছে দেহভাণ্ডের মধ্যেই— বস্তু আছে দেহ বর্তমানে। বস্তু হল রসবস্তু। স্থূল অর্থের কাম। আর সূক্ষ্ণ অর্থে তা হল গিয়ে প্রেম। যাকে সহজ স্বরূপ হিসেবেও দেখানো হয়েছে। এঁদের মত, কাম ও প্রেম এক জিনিস কখনওই নয়। কাম প্রেমের প্রাকৃত রূপ মাত্র। আর এই প্রাকৃতকেই অবলম্বন করে অপ্রাকৃত সহজ প্রেমের দেশ নিত্য বৃন্দাবনে পৌঁছতে হবে। ‘রত্নসার’-এ যেন সেই কথাই ধ্বনিত হয়েছে। 

সেই ত উজ্জ্বল রহে রসে ঢাকা অঙ্গ ৷ 
কাম হৈতে জর্ম প্রেম নহে কাম সঙ্গ ৷ 
লৌহকে করয়ে সোনা লৌহ পরসিয়া ৷ 
তৈছে কাম হৈতে প্রেম দেখ বিচারিয়া॥ 

বৈষ্ণব সহজিয়া সাধকরাও শক্তি সাধনার উদ্দেশ্যে যুগল সাধনা করে থাকেন। তাঁরা বলেন নারীর মধ্যে শৃঙ্গার-ভাবোদ্দীপক অগ্নিকুণ্ড আছে। সহজিয়া মতে, লৌকিক পীরিত-ই অপ্রাকৃত প্রেম হবা সহজ রূপ ধারণ করে। সহজকে তাঁরা দ্বিধা বিভক্ত-ও করেন। এক, আস্বাদ্য— যাকে রতি বলে মানেন তাঁরা, রাধা রতি আর দুই, আস্বাদক— যেটা হল তাঁদের রস, কৃষ্ণ রস। তাঁদের মতে প্রত্যেক নারী-ই রাধা আর প্রত্যেক পুরুষ হল গিয়ে কৃষ্ণ। এই ভাবে রূপস্থ অবয়বে তাঁরা তাঁদের যুগল সাধনাকে ভাবে আরোপিত করে থাকেন। রাধাকৃষ্ণকে তাঁরা শারীরিক করে তোলেন এভাবেই তাঁদের এক্কেবারে নিজস্ব বিশ্বাস বা মতাদর্শের সাধন-তত্ত্বমালায়। বৈষ্ণব সহজিয়া সাধন তাই আরোপ সাধন। এক অর্থে বলতে গেলে তন্ত্র-সাধনাও শিব ও শক্তির-ই যথার্থ আরোপ সাধন। বৈষ্ণব সহজিয়াগণ বলে থাকেন রূপের মধ্যে দিয়েই তাঁরা অরূপের দিকে এগিয়ে যান। 

প্রাকৃত অপ্রাকৃত আর মহা প্রাকৃত ৷ 
বিহার করিছ তুমি নিজ স্বেচ্ছামত ৷ 
স্বয়ং কাম নিত্যবস্তু রস-রতিময় ৷ 
প্রাকৃত-অপ্রাকৃত আদি তুমি মহাত্রয় ৷ 
এক বস্তু পুরুষ প্রকৃতি রূপ হইয়া ৷ 
বিলাসহ বহুরূপ ধরি দুই কায়া॥ 

‘অমৃতরত্নাবলী’-তে রয়েছে শরীরের মধ্যেই কামনার কালসর্প বর্তমান। কামনা উদ্ভুত সেই কামকেই প্রেমে রূপান্তরিত করার কথা বলছে ‘বিবর্তবিলাস’-এ। 

প্রেম-অপ্রেম কাম রহে এক ঠাঁই ৷ 
মিলন একত্রে, সে স্বরূপ ভিন্ন নাই॥ 

সহজিয়া বৈষ্ণবরা কামকে কিন্তু ধ্বংস করার কথা কখনও বলেননি। বলেছেন সাধন-সঙ্গিনীর সাহায্যে কাম-সাধনার মধ্যে দিয়েই আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছেকে কৃষ্ণেদ্রিয় প্রীতি ইচ্ছেতে পরিণত করতে। তাঁদের মত হল: কামের পরিতৃপ্তি না এলে প্রেম জন্মায় না কখনও। ‘রসকদম্বকলিকা’-তে তাই লেখা হয়েছে তারই অনুশীলন। 

যখন সাধিয়া কাম পূর্ণ হয় মনে ৷ 
তবে তো স্বরূপ কামবস্তুতত্ত্ব জানে॥ 

আর উল্লেখিত সেই ‘অমৃতরত্নাবলী’-তে কামকে সাপের স্বর-তরঙ্গের প্রবল হিস্ হিস্ –ই দেওয়া হয়েছে। তন্ত্রে সাপ কুণ্ডলিনীস্থ শক্তি। যার আভ্যন্তরীণ রুদ্ধদলে সাধনার সংকল্পময়তার সুদৃঢ় সব ঘোষণা রয়েছে। সাধক তান্ত্রিক মানেন বীর্যের মধ্যে প্রাণশক্তি হিসেবে থাকে সাপ। সাপকে আবার কামশক্তির প্রতীক করেও দেখানো হয়। শক্তিকে সাপ বলা হয়ে থাকে তন্ত্রমতে। যা সুপ্ত অবস্থায় থাকে কুণ্ডলীতে। গুহ্যদ্বার ও লিঙ্গমূলে সাপ থাকার কথা বলেন দেহসাধক। ‘অমৃতরত্নাবলী’ তাকেই নির্দেশ করছে। 

শরীর ভিতরে জান আছে কালসর্প ৷ 
সেই সর্পে দিবানিশি করিছে দংশন ৷ 
কাম নিবারতে নারে জীব নরাধাম॥ 

এখানে সাপ কিন্তু কামনাদ্যোতকই। কামও তো আসলে এক উত্তেজিত ক্রিয়াকর্মের দ্বৈতশক্তি। এই শক্তিকেই বৈষ্ণব সহজিয়া সাধক প্রেমে রূপান্তরিত করে নেন। ‘অমৃতরত্নাবলী’-তে সে-কথাও বলা রয়েছে। 

প্রথম সাধন রতি সম্ভোগ শৃঙ্গার ৷ 
সাধিবে সম্ভোগ রতি পালাবে বিকার ৷ 
জীবরতি দূরে যাবে করিলে সাধন ৷ 
তারপর প্রেমরতি করি নিবেদন॥ 

সহজিয়া বৈষ্ণব মত হল— নারী সান্নিধ্যে না এলে, বাস্তব সম্ভোগের অভিজ্ঞতা না হলে প্রকৃত রসিক কখনও-ই হওয়া যাবে না। বস্তুগত দেহতত্ত্বের মধ্যে দিয়েই তাঁরা লোকায়ত সমাজে গ্রহণযোগ্য হয়েছিলেন। যেখানে সাধিকার সংস্পর্শে অন্তরঙ্গ ভাব-শৃঙ্গার ছিলই তন্ত্র-সাধনার সংযুক্ত ঐতিহ্যে। সহজিয়া বৈষ্ণবরা স্বকীয়া রতির চেয়ে পরকীয়া রতিকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন রাধা-কৃষ্ণের সেই আরোপিত ভাবানুষঙ্গেই। অপরদিকে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের ভাব স্বকীয়া হলেও বৃন্দাবনের গোস্বামীরা যে ধর্মতত্ত্ব প্রচার করে গেছেন তাতে রাধা এবং গোপীদের প্রেমকেই আদর্শায়িত করে দেখানো হয়েছে। তাহলে দাঁড়াল এই: সেখানেও পরকীয়া ভাবনা প্রতিভাত রয়েছে। শ্রীখণ্ডের নরহরি সরকার যে ‘গৌরনগরবাদ’ প্রচার করেছেন সেখানে দেখানো হয়েছে যে, গৌরাঙ্গের প্রেমে নবদ্বীপের নারীরা সব উন্মাদিনী হয়ে পড়েছিলেন। নরহরির শিষ্য লোচনদাস ঠাকুর তাঁর ‘চৈতন্যমঙ্গল’-এ গুরুর ভাবে প্রাণিত হয়েই বোধহয় গৌরাঙ্গ-বিষ্ণুপ্রিয়ার মিলনদৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন। যে বর্ণনা অনেকাংশেই সহজিয়া বৈষ্ণব মতের সাধক-সাধিকার প্রেম-শৃঙ্গারের বর্ণনাই হয়ে গিয়েছে। 

ইহা বলি গৌরহরি 
আশ্লেষে চুম্বন করি 
নানা রস কৌতুক বিহারে ৷ 
অনন্ত বিনোদ প্রেমা 
লালী লাবণ্যের সীমা 
বিষ্ণুপ্রিয়া তুলিল প্রকারে॥ 

এভাবেই বৈষ্ণব সহজিয়ায় শরীর বা যৌনতার নিরীখে সাধ্যবস্তু লাভের তত্ত্ব প্রচারিত হয়েছিল। যা যৌনতাকে প্রান্তবাসী প্রবহমানতার মধ্যেই ঠেলে দিয়েছিল। যৌনতা হয়ে উঠেছিল বৃহত্তর সমাজের অগোচরে ধর্মীয় আবেগ-আখরে বিস্ময়-মাধুর্যের স্বাদ। যা কামকে পরমে, শূন্যতায়, প্রেমে কতখানি অন্তর্গত করে রেখেছিল সে বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে এটা বলাই যায়, লোকায়ত সাধনায় শরীর সংযত-নিষ্ক্রিয়তার দাবি করলেও আসলে তা ভীষণভাবেই যৌথ উচ্চারণেই সক্রিয় ছিল। তারই সন্দর্ভ সব আচরণ ইঙ্গিতের কাব্যময় তত্কালীন ধ্বনিতরঙ্গের পটভূমি। 

চর্যার ভাষার দু’ রকম অর্থ রয়েছে। লৌকিক অর্থ আর গূঢ় অর্থ। বক্তব্যকে শব্দ ও উপমা-উৎপ্রেক্ষার সাহায্যেও আচ্ছন্ন করা হয়েছে। এর কারণ সাধন-প্রক্রিয়াকে সাধারণত আচার্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা। সহজ সাধনমালার মূল লক্ষ্যই কিন্তু ছিল তাই। এক বেষ্টিত আড়াল। যেখানে সাধক বা সাধনরত শিক্ষানবিশ ছাড়া অন্যের প্রবেশাধিকার অন্যের প্রবেশাধিকার একেবারেই নিষিদ্ধ। বাংলার সহজ সাধনাতেও তার বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখে থাকি। বাউল বলেন— আপন ভজন কথা না কহিবে যথা-তথা,/ আপনাতে আপনি হইবে সাবধান। এই সাবধান বাণী গুরুর উপদেশ শিষ্যের প্রতি। বাংলার বাউলের সহজ-সাধনা ও বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের যে মান্য সহজ-সাধনার প্রামাণিক মূল্যের দিকে আমরা চোখ ফেরাচ্ছি, যৌনতার রূপস্থ শিল্প-কর্মের সর্বদর্শী ছবিটি দেখার জন্যে, দুটোর ভরকেন্দ্র কিন্তু একই। দুটোর ভেতরেই ধর্মতত্ত্ব ও সাধনতত্ত্বের বিবিধ নির্দেশ-দান আছে। আর সেই নির্দেশের মূলমন্ত্র বা ধারক-বাহক হল কাম-নিয়ন্ত্রণ। আর দুই সাধনেই নারী অনিবার্য। প্রশ্ন হচ্ছে, নারীকে যৌনলক্ষ্যের বশীভূত করে যে ভাষারূপের ধর্মগত ভাবনা তৈরি করলেন সিদ্ধাচার্যরা ও বাউল সাধকেরা সেখানে অব্যর্থ শৃঙ্খলার শিল্পলক্ষ্য আছে ঠিকই— যে লক্ষ্য মূলত যৌনতা বা কামাচারকে জীবনের অনুষঙ্গ-সৃজনী-ক্ষমতার সার্বিক সব স্বাচ্ছন্দ্য থেকে অব্যাহতি দেওয়া, সেই লক্ষ্য কতখানি সাধকদের অভিজ্ঞতায় নিদর্শিত হচ্ছে? নর-নারী তাঁদের স্বাভাবিক মিলন প্রয়াসকে ধর্মের স্তবকে অস্তিত্ব-বোধের রূপময় প্রেরণায় অশেষ সাধনারয় সার্থকভাবে রূপায়িত করে নিচ্ছেন নায় বুঝলাম, কিন্তু কথা হচ্ছে যৌনতাকে, কামাচারকে কিছু শৃঙ্খলায় প্রাণবন্ত করে দিয়ে যে শূন্যতা বা সহজানন্দকে তাঁরা পেতে চাইছেন সেখানে সম্বৃত-শ্বাসবায়ু ও স্তব-আসনে দুই শরীরের ক্রিয়াশীল সৃজন বৃত্তে বস্তুরক্ষা বা বীর্যপাত ঠেকানো ছাড়া স্বাভাবিক-সাধারণ যৌনতার থেকে আলাদা ব্যঞ্জনা কি আপাতিক চোখে দেখা দিচ্ছে কিছু? বুঝলাম যৌনতাকে তাঁরা আসক্তিহীন করছেন। ভাব-প্রেরণার আকর্ষণে ডুবে কামকে আশ্রয় করেই কামকে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন শরীর থেকে। কিন্তু কাম কি অনুষঙ্গ সৃজনের প্রেমকে সৃষ্টি করতে পারছে আদৌ? প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। অনেকে হয়তো বলবেন, পথে না নামলে পথ জানা যায় না। কিন্তু যৌনতার আত্যন্তিক বিনষ্টি হচ্ছে যৌনতার সমস্ত রকম উপাচারকেই সাজিয়ে নিছক শান্তি-বাসনার প্রতিনিধি হিসেবে— সর্বক্ষেত্রে এ মত কখনও-ই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তবে এটা ঠিক, দেহ-সাধনার পথ ও পন্থা রস-লক্ষ্যের অধিগত অধ্যায়কে শিল্পীর তপস্যায় কাব্যের উত্কর্ষ সাধিত করবার জন্যই যে বেশ ভেবে-চিন্তে লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন সাধক পদকর্তারা সব— সেটা কাব্য-ধৃত অভিজ্ঞতার সংহত ভঙ্গিটির দিকে তাকালেই বেশ বোঝা যায়। আর এটাও চিহ্নিত করা যায় যে, শুধু কাব্য-রসামৃত পান করানো আগামী পাঠককে (শিষ্যকে), সাধকগণের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না, বরং যুগল লৌকিক কর্মময় জীবনকে অন্তরশায়ী কল্পনার পক্ষে নিয়ে গিয়ে অলৌকিক স্পর্শের স্বরূপ উপভোগ করাই তাঁদের লক্ষ্য ছিল। আর সেটার জন্যই যৌনতার অভিব্যক্তিকে তাঁরা শিল্পসম্মত রূপে ব্যবহার করেছিলেন ধর্মীয় গহন স্রোতে, সাধনার পরম প্রসন্নতায়। যেখানে নারী বা সাধন-সঙ্গিনী প্রথাসিদ্দ মান্য সংস্কারে অনিবার্য হয়ে আছে সাধনের পরম্পরায়। 

বাউল বলছেন: 

মেয়ের চরণ নেরে মাথায় করে 
মেয়ে বিনে এ ভুবনে গতি নাই রে। 
ত্যাজে নারী বনবাসী 
হলি রে মর্কট সন্ন্যাসী 
তার চরণে গয়া-কাশী 
দেখলিনে রে। 

অর্থাৎ, মেয়ের চরণ মাথায় করে রাখবার কথা বলছেন পদকর্তা। তিনি বলছেন মেয়ে ছাড়া পৃথিবীর গতি নেই। রমণীকে ত্যাগ করে বনবাসী হলে পর সে মর্কট সন্ন্যাসী। কেন না নারীর চরণ হল গয়া-কাশী। 

বাউল এক মরণে দুইবার মরার কথাও বলে থাকেন: 

যেমন চণ্ডীদাস আর রজকিনী হয় 
তারা এক মরণে দুইজন মরে— সাধুলোকে কয় ৷ 
আবার চণ্ডীদাস মরিয়া গেলে 
রজকিনী বাঁচায় তারে, 
যার যে আছে যার তার কাছে, 
লালন বলে আমার তো দিন যায় কাঁদিতে। 

বাউলের আরাধ্যা নারী প্রেমময়ী। নারী এখানে শক্তির আধার। ভারতীয় পুরাণও তো তাই-ই বলে এসেছে। দুর্গাকে তো আমরা শুভশক্তির সঙ্গেই তুলনা করতে পারি। আর অসুর হল আমাদের অশুভ বোধ বা অশুভ শক্তি। বাউল কল্পনার রাধা-কৃষ্ণকে নিজেদের ওপর আরোপ করে বসেন। তাঁদের কাছে তিন যুগলের প্রেম সাধনাই লক্ষ্য। সে জন্য পদগুলোতেও তাঁদের যুগল রূপের কথাই বলা হয়েছে। প্রথম যুগলের কথা এই গানেই রয়েছে। দ্বিতীয় যুগল হল জয়দেব-পদ্মাবতী। তৃতীয় যুগল বিল্বমঙ্গল-চিন্তামণি। 

তবে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সহজিয়া এবং বাউলের সহজিয়ার মূলগত পার্থক্য একটা আছে। সিদ্ধাচার্যরা তান্ত্রিকতায় ঝুঁকেছেন। সেজন্যই কাহ্ন কাপালিক হয়েছেন। আর বাউল সাধকরা বৈষ্ণব ভাবাপন্ন। তবে এরকম ভাবার কারণ নেই যে, বাউল আর বৈষ্ণব এক। তা কখনও কিন্তু নয়। যদিও দুই সম্প্রদায়ই সাধন সঙ্গিনীর কথা বলে থাকেন। মাধুকরী করেন। তথাপি এঁদের মূলগত পার্থক্য বাউল মূর্তিপূজোয় বিশ্বাসী নন একেবারেই। মানুষের মধ্যেই বাউলরা রাধা-কৃষ্ণের দ্বৈতসত্তাকে খুঁজে ফেরেন। মানুষকে তাঁরা সহজ মানুষ, মনের মানুষ, ভাবের মানুষ, রসের মানুষ, ইত্যাদি নানান অভিধায় ভূষিত করেন। তবে বলে রাখা ভালো, এইসব ভূষণ-শিরোপা সবই আসলে যৌন প্রাণস্পন্দনকে, উত্তেজনাকে গভীর বিস্তৃতির অন্তরশায়ী অনুভূতির মাধ্যমে দেখানো। সেই অনুভূতিতেই মানুষকে আধারভূমি করা হয়েছে সাধনাকে ঘোর দুর্যোগের রাত্রি দাবি করে রুদ্ধার্গল ঘরের সুখসুপ্তি ও শান্তির কামনা করে। তার জন্যই শরীরতত্ত্ব, দেবতত্ত্ব, মানুষতত্ত্ব, ইত্যাদি নানান সব সু-সার্থক অর্থ-সঞ্চারের পরিমণ্ডল গড়ে তোলা হয়েছে ভাবে-ভাষায় প্রতীক বা গুহ্য শব্দের মাদকতায়। মানুষ তাই হয়ে উঠেছে নির্দিষ্ট এই এলাকার রসসম্ভোগের মানুষ। 

মানুষতত্ত্ব যার সত্য হয় মনে 
সে কি অন্য তত্ত্ব মানে? 
মাটির ঢিবি কাঠের ছবি 
ভূত ভাবি সব দেব আর দেবী 
ভোলে না সে এসব বাণী 
ও যে মানুষরতন চেনে॥
ক্রমশ

0 comments: