0

প্রবন্ধ - অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in






(চতুর্থ ও শেষ পর্ব) 

পাকিস্তান সরকার নানাবিধ ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে থাকল বাঙালিদের বিরুদ্ধে। এসব ষড়যন্ত্রের মধ্যে অন্যতম হল, আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রচলন। পাকিস্তানের শিক্ষা সচিব ফজলুর রহমান ইসলামি আদর্শের দোহাই দিয়ে বাংলা ভাষার জন্য আরবি হরফের প্রস্তাব করেন। আসলে তাঁরা ধর্মের দোহাই দিয়ে বাংলা ও বাঙালিকে তাঁর অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখে। ১৯৪৮ সালে করাচিতে নিখিল পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে শিক্ষা সচিবের এমন প্রস্তাবে বাঙালি হতবাক হয়। ১৯৪৯ সালের পেশোয়ারে কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডের সভায়ও আরবিকে পাকিস্তানের ভাষাসমূহের একমাত্র হরফ করার জোর সুপারিশ করা হয়। বাংলা ও বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতেই মূলত তাঁরা এ প্রকল্প হাতে নেয়। 

ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের বাংলায় পবিত্র কোরানের হরফ প্রচলনের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়। এতে করে প্রকারান্তরে তাঁরা চেয়েছিলেন উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্টভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। এ লক্ষ্যে একটি বর্ণমালা বিশেষজ্ঞ কমিটিও গঠন করা হয়। এ দলে দেশবরেণ্য অনেক শিক্ষাবিদকে ভেড়ানোর চেষ্টা করে সরকার। কিন্তু বাংলা ও বাঙালির পক্ষের কোনো শিক্ষাবিদ এতে অংশগ্রহণ করেনি। 

বাংলার বিরুদ্ধে উপরোক্ত ষড়যন্ত্র প্রকল্পের অংশ হিসেবে তারা ১৯৫০ সালে পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলায় আরবি হরফে বাংলা শিক্ষার কুড়িটি কেন্দ্র স্থাপন করে। অর্থাৎ নীল নকশা বাস্তবায়ন করতে তাঁরা বাস্তবে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ অবাস্তব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সরকার লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে। তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানে আরবি সংঘ নামে একটি সংঘও গঠন করে। অতি উৎসাহী একটি গ্রুপ আবার আরবিকে রাষ্ট্রভাষা করারও প্রস্তাব করে। আসলে তাঁরা ভাষার সঙ্গে ধর্মকে গুলিয়ে ফেলেছিল। করাচিতে বিশ্ব মুসলিম সম্মেলনে আরবি হরফবাদীরা এই অভিনব প্রস্তাব করেন। তাঁরা আরবিকে রাষ্ট্রভাষা, নয়তো বাংলাকে আরবিতে রূপান্তর করে মুসলমানের ভাষা হিসাবে নতুনরূপে প্রচলন করতে চায়। ভাষা রূপান্তরের এ প্রকল্প বিশ্বে শুধু পাকিস্তানিরাই নিয়েছিল। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তারা ‘পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি’ নামে একটি কমিটিও গঠন করে দেয়। তাঁদের উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয় বাংলা ভাষাকে মুসলমানি করার। বাংলাকে মুসলমানিকরণের কাজে উৎসাহ জুগিয়েছেন মিজানুর রহমান ও জুলফিকার আলি নামে দুই ব্যক্তি। বাংলা ভাষা কোথায় কতটুকু থাকবে বা থাকবে না, তার দায়িত্ব দেওয়া হয় এই উর্দু কমিটির। পরবর্তীতে সরকার ‘Bureau of National Reconstruction’ নামে একটি সংস্থা গঠন করে। তাঁদের কাজ ছিল বাংলাকে আরবি বা উর্দুতে রূপান্তর করা। বাংলাকে কেটে ছেঁটে উর্দুকরণই ছিল তাঁদের দায়িত্ব। সে সময়ে বাঙালি ছাত্ররা এই সংস্থাকে বঙ্গ সংস্কৃতির গোয়েন্দা বিভাগ বলে অবিহিত করতেন। একইভাবে তাঁরা একটি ‘ভাষা সংস্থা কমিটি’ গঠন করেছে। বাঙালিরা একে বলত ‘ভাষা সংহার কমিটি’। পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুভাষীরা বোঝানোর চেষ্টা করল -- “হাজার হাজার মাইল দূরের হলেও সিন্ধি, বেলুচি, পাঞ্জাবি, পেশোয়ারিরাই তোমার ভাই-ব্রাদার, বাড়ির পাশের অমুসলমানরা তোমার কেউ না। তাঁদের কৃষ্টি-কালচারের স্পর্শে তোমরা না পাক হইও না’। ভাষাকে তারা হিন্দু মুসলমান হিসাবে আখ্যায়িত করল। 

কলমযোদ্ধাদের অন্যতম সৈয়দ মুজতবা আলি তাঁর এক নিবন্ধে লিখলেন -- “বাংলাকে যারা ‘নাপাক’ ‘অপাক’ বলে কটাক্ষ করে তাঁদের একটা কথা স্পষ্ট বলতে চাই ‘ছুৎমার্গ ইসলামে নাই’; বন্ধুরা, ‘ভাষার ছুৎমার্গ নাই’। ‘নাপাক’ পার্সির সঙ্গে ‘নাপাক’ হিন্দি মিলে উর্দু হইল। সে আজ এত পাক হইলে কীভাবে? হিন্দুয়ানি ভাষা বাংলা ব্যবহার করে এতদিনে পূর্ব পাকিস্তানি মুলমানরা কি নাপাক হইয়াছিল? এই নাপাকরা কি পাকিস্তানের জন্য লড়ে নাই? পাকিস্তানের স্বপ্ন কি সফল হইয়াছে শুধু লাহোর-লক্ষ্ণৌর কৃপায়?” আবদুল গফুর সাহেব বলেছিলেন, “স্ত্রীবিদ্যা-স্ত্রীবুদ্ধির তিন মহারথী শিক্ষামন্ত্রী এবং তার সেক্রেটারি করিম ও ডেপুটি সেক্রেটারি মিজানুর রহমানকে জানিয়ে দিচ্ছি, বাংলা হরফের উপর কোনো শয়তানি হামলা বরদাস্ত করা হবে না। এদেশ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দেশ। তাঁরা অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ, কিন্তু তাই বলে ধর্মের নামে ভাষা বিভক্তি মেনে নিতে পারেনি। ভাষা আল্লাহর অন্যতম সৃষ্টি বৈচিত্র্যের একটি। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করে তাঁর মুখে কথা দিয়েছেন। সব ভাষাই তার সৃষ্টি। কিন্তু পাকিস্তানিদের বোঝাবে কে?” 

না, বাংলা ভাষাকে রক্ষা করা যায়নি। বাংলা ভাষাকে ইসলামিকরণে সব আয়োজনই জারি আছে। যে ভাষাকে এত রক্তপাত, এত মৃত্যু, এত ধর্ষণ – সেই বাংলা ভাষা ক্রমশই আরবি-নির্ভর হয়ে ওঠছে। তার প্রভাব পড়ছে কথাবার্তায়, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে। মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এক শ্রেণির মুসলিমরা চায় তাঁদের বাংলা ভাষায় আরবিতে গিজগিজ করুক। হুজুরদের ওয়াজ অনুষ্ঠান প্রচারের জন্য পোস্টার-বিজ্ঞাপনে যে বাংলা ভাষা ব্যবহার করা হয়, তার একটি বর্ণও উদ্ধার করা যায় না। এত আরবির দাপট! আর-এক শ্রেণির মুসলমান চায় বাংলা ভাষা বাংলা ভাষার মতোই হোক। তাঁরা শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলেন, বানানে ণত্ব-বিধান ও ষত্ব-বিধান কঠোরভাবে অনুসরণ করেন এবং শুদ্ধ বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেন। যে মুসলমানরা চায় তাঁদের ভাষা আরবিতে গিজগিজ করুক, তাঁরা বাংলা বানানের ণত্ব-বিধান ও ষত্ব-বিধান মানেন না। সাহিত্যিক মাহবুব লীলেন, যিনি নিজের ধর্ম-পরিচয়ের ঊর্ধ্বে বাংলা ভাষাকে রাখেন। যিনি নিজেকে মুসলিম বলার চেয়ে বাঙালি বলতেই বেশি পছন্দ করেন। তাঁর লেখা সম্পূর্ণ শুদ্ধ বাংলা ভাষায় রচিত। আরবির কোনো চিহ্নমাত্র নেই। তাঁর লেখার একটি নমুনা আপনাদের পড়াই – “ভগদত্ত নামে একখান চরিত্র আছে মহাভারতে। তিনি দুর্যোধনের স্ত্রী ভানুমতির বাপ। প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা নরক-এর পোলা। তার বাহিনীর মূল শক্তি হইল হাতি আর তার সৈনিকরা হইল চীনা আর কিরাত। দাবি করা হয় মহাভারতের প্রাগজ্যোতিষপুর হইল পরবর্তীকালের কামরূপ রাজ্য, যার সীমানা পড়ছে বর্তমান সময়ের আসাম এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চল……”। উদ্ধৃতিটি মাহবুব লীলেন রচিত ‘অভাজনের মহাভারত’ গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে। শুধু মাহমুদ লীলেনকে উল্লেখ করি কেন! বাংলাদেশের বাংলা ভাষার সাহিত্যসাধক তসলিমা নাসরিন, শামসুর রহমান, হুমায়ুন আহমেদ, হুমায়ুন আজাদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আল মাহমুদ, আহমেদ ছফা, ইমদাদুল হক মিলন, বেলাল চৌধুরী, মোহম্মদ জাফর ইকবাল, মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, সেলিনা পারভীন প্রমুখদের বাংলা ভাষা কখনোই মুসলমানি বাংলা ভাষা হয়নি। রীতিমতো ষত্ব-বিধান ও ণত্ব-বিধান নিয়ম মেনেই বানানরীতি অনুসরণ করা হয়েছে। আবুল বাশার, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, নজরুল ইসলাম, হোসেনুর রহমান, শামীম আহমেদ, কাজী আবদুল ওদুদ, আরজু আলি মাতুব্বর প্রমুখ পশ্চিমবঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্যিকদের বাংলা ভাষাও মুসলমানি বাংলা ভাষা নয়। শুধু লেখা ভাষা নয়, উভয় বাংলার বেশির মুসলমানের মুখের ভাষাতেও মুসলমানি বাংলা ভাষা পাওয়া যায় না। 

কিন্তু বাংলাদেশের এক শ্রেণির মুসলমান ফল্গুনদীর ধারার মতো বাংলা ভাষাকে মুসলমানিকরণ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাঁরা তাঁদের বাংলা ভাষা মুক্ত করতে বদ্ধপরিকর। তাঁদের বাংলা ভাষায় আরবি আধিক্য তো থাকেই, এমনকি বাংলা বানানে পানিণীয় রীতি একেবারেই বর্জন করেছে। তাঁদের বাংলা বানানে মূর্ধন্য-ণ আর মূর্ধষ্য-ষ ব্যবহার একেবারেই করে না এবং তা সচেতনভাবেই। বাংলাদেশের আমার এক মুসলমান বন্ধুর ইনবক্সে চ্যাটে কথা বলছিলাম। ও অনেকক্ষণ ধরে আমাকে অনির্বানদা বলে সম্বোধন করছিল। তখন আমি বললাম, “তুমি আমার নামের বানানটা বারবার ভুল লিখছ। কেন?” ও বলল – “কেন স্যার, আমি তো ঠিকই লিখছি।” আমি বললাম – “না ঠিক লিখছ না। আমার নামের শেষটা মূর্ধন্য-ণ লিখতে হবে – লিখতে হবে ‘অনির্বাণ’। প্রতিটি নামের অর্থ থাকে। বানান ভুল হলে শব্দ অর্থহীন হয়ে পড়ে।” সে বলল – “আমি মূর্ধন্য-ণ লিখি না। মূর্ধন্য-ণ লিখব না।” তারপর থেকে ছেলেটা আর কোনোদিন আমার সঙ্গে কথা বলতে আসেনি। আমাকে পরিত্যাগ করল। এই হল ঘটনা। মনে হয় ছেলেটা কওমি মাদ্রাসাতেই পড়াশোনা করেই পণ্ডিত হয়েছে। কারণ সেখানে মুসলমানি বাংলাই শেখানো হয়। সমস্ত মনপ্রাণ আরবি ভাষশিক্ষার উপর অর্পণ করা হয়। বাংলা ব্যাকরণের নিয়মরীতি পড়ানো হয় না। উদ্দেশ্য, তথাকথিত ‘হিন্দুয়ানি’ বাংলাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। এই শ্রেণির মুসলমানরা ভুলে যান বাংলা ভাষা ভারতের ভাষা, আরবের ভাষা নয়। এই শ্রেণির মুসলমানরা ভুলে যান বাংলাদেশ ভারত ভূখণ্ড থেকে খণ্ডিত অংশ, আরবের খণ্ডিত অংশ নয়। চিন্তা করি, যে ভাষাকে ভালোবেসে প্রাণ দিল রফিক, সালাম, বরকত, আব্দুল জব্বার সহ আরও অনেকে, সেই ভাষা তো বাঙালির খাঁটি বাংলা ভাষার জন্যে – আরবি প্রেমের জন্য নয়। উর্দুকে প্রত্যাখ্যান করে একটি স্বাধীন বাংলা ভাষার দেশ তৈরি হল, সেই দেশের এক শ্রেণির বাংলা ভাষার মুসলমানিকরণে সদা তৎপর। ভাষা তো ভাষাই। ভাষা আবার ধর্ম কী! ভারত অসংখ্য ভাষার দেশ। প্রত্যেকটি প্রদেশ ভাষাভিত্তিক। কিন্তু প্রত্যেকটি প্রদেশ সেই প্রদেশের ভাষাকে অক্ষুণ্ণ রাখে হিন্দি আগ্রাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। প্রত্যেকটি ভাষা সেই ভাষার স্বাতন্ত্রতা বজায় রাখতে সর্বদা সতর্ক থাকে। প্রত্যেক ভাষাভাষীরা তাঁদের নিজের ভাষায় সাহিত্য রচনা করে। হিন্দির মিশেল দেয় না। যদিও হিন্দিও ভারতীয় ভাষা, বিদেশি ভাষা নয়। কিন্তু বাংলাদেশে এক শ্রেণির মুসলমান আরবি ভাষা চর্চা করেন ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই। এই শ্রেণির বাঙালি মুসলমানদের বাংলা ভাষার সামান্য নমুনা পেশ করি – “হযরত মুনশী জালালুদ্দীন বালানূরী (রাযি আল্লাহ আনহু) লিখিত এক বর্ণনায় আছে যে, হুযুর আলায়হেস সালাম বলিয়াছিলেন : ‘আমি এই সন্দর্ভের ছত্রে ছত্রে দোয়া করিয়াছি।, আল্লাহতা’লা পূর্বাহ্নে এলহাম যোগে জানাইয়াছিলেন : ইহা সেই সন্দর্ভ, যাহা সকলের উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিবে।’ বস্তুত সম্মেলন শুরু হইবার অনেক পূর্বেই এক ইশতিহার দ্বারা হুযুর (আঃ) এই সংবাদ ঘোষণা করিয়াছিলেন এবং বাস্তবেও তাহাই ঘটিয়াছিল।” উদ্ধৃতিটি হযরত মির্যা গোলাম আহমদ াদিয়ানী রচিত ‘ইসলামী নীতি-দর্শন’ গ্রন্থের ভাষান্তর এ. এইচ. এম. আলী আনওয়ার।লক্ষ করুন এই লেখক যথাসম্ভব চেয়ষ্টা করেছেন আরবির বাহুল্যে বাংলা ভাষাকে মুসলমানি বাংলা ভাষা করার। কিন্তু সেই চেষ্টায় যে সম্পূর্ণ সফল হয়েছেন, তা বলা যায় না।লক্ষ করুন – (১) ভাষারীতি সাধু। সাধুভাষা বর্ণহিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদীদের সৃষ্ট রীতি। গ্রন্থটি অনূদিত হয়েছে ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে। এই নয় যে চলিতরীতি ততদিনে প্রচলন হয়ে গেছে। এই নয় যে এ সময় সাধুরীতির বিকল্প ছিল না। (২) আরবি শব্দ-বাহুল্য থাকলেও সংস্কৃত তথা তৎসম শব্দের ব্যবহার তিনি এড়াতে পারেনি। যেমন – সন্দর্ভ। (৩) বানান পানিণীয় নিয়ম মানা হয়নি। বাংলা ভাষায় যেসব জায়গায় ‘জ’ ব্যবহার করাই রীতি, সেখানে ‘য’ ব্যবহার করা হয়েছে। আজও এই রীতিতে বানান অনুসরণ করে থাকে। ‘জ’-এর পরিবর্তে ‘য’-এর ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। শুদ্ধ বানান ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ বাংলা একাডেমির জামিল চৌধুরী সম্পাদিত ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’ নামে একটি বানানরীতির গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এই অভিধান নিয়ে খুব বিতর্ক। কারণ এই অভিধানটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত একাদেমি বানান বিধি অনুসারে সংকলিত হয়েছে। অনুসরণ করা হয়েছে আধুনিক বানানরীতি। সংকলনের জন্য যে সহায়ক গ্রন্থের নাম উল্লেখ আছে, তার শতকরা ৯৯ ভাগ কলকাতার বাংলা অভিধান। এই অভিধানে ‘জল’ শব্দটি স্বমহিমায় বিরাজ করছে। শুধু ‘জল’ নয়, জল সংক্রান্ত সব শব্দই সংযোজিত হয়েছে। যেমন – জলকেলি, জলক্রীড়া, জলকুন্তল, জলকূর্ম, জলকুক্কুট, জলকাদা, জলকন্যা, জলকর, জলকণা, জলোচ্ছ্বাস, জলীয় প্রভৃতি। তেমনি আছে পানি, পানিপড়া, পানিভাঙা, পানিভাত। পানির এই চারটি মাত্র শব্দই সংযোজিত হয়েছে। ই-কারে ইদজজোহা, ইদুল-আজহা, ইদুলফিতর শব্দগুলি। আরবিপ্রেমীরা মুসলমানরা বাংলা একাদেমির ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’ নির্দেশিত ই-কার একদম পছন্দ করছেন না। তাঁরা বলছেন এগুলি আরবি শব্দ। আরবি মতে ঈ-কারই দিতে হবে। হিন্দুয়ানি চলবে না। তাঁরা একাডেমির বানানরীতি না মেনে ঈদজজোহা, ঈদুল-আজহা, ঈদুলফিতর লেখেন। ‘আধুনিক বাংলা অভিধান’ হজরত, হুজুর ইত্যাদি বানান নির্দেশ দিলেও তাঁরা আরবি সমর্থনে হযরত, হুযুর বানান লিখে থাকেন। 

আগেই উল্লেখ করেছি আদিকালে বাংলা ভাষায় জল এবং পানি দুটোই সমানভাবে ব্যবহার করা হত। হিন্দুরা কোনোদিনই বিশ্বাস করেনা বা মনে করে না যে ‘পানি’ বললে মুসলমান হয়ে যাব। কারন অসংখ্য হিন্দীভাষীরা পানিই বলে। কিন্তু বাংলা ভাষার মান্যরূপ স্থির করার সময় কলকাতা তথা পূর্ববঙ্গের পণ্ডিতগণ জলটাকে গ্রহণ করেছিলেন, তবে সেটা হিন্দু-মুসলমানের কারণে নয়। নিজেদের মুখের ভাষাটাকে মান্যরূপ বলে চালানোর গর্ব থেকে। কিন্তু এতেই মুসলিম পণ্ডিতরা মানসিকভাবে আহত হলেন। তা ছাড়া মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষরা সবসময়ই চাইত হিন্দুদের থেকে পৃথক প্রমাণ করতে। মুসলিম শাসনকালে যখন মানুষ বর্ণহিন্দুদের কাছ থেকে মুক্তি পেতে দলে দলে যখন নিন্মবর্ণের মানুষেরা ধর্মান্তরিত হয়েছে, তখন তাঁরা প্রাণপণ চেষ্টা করত নিজেদের হিন্দু নয় তা কীভাবে প্রমাণ করা যায়। এই মানসিকতা সেইসময় থেকেই চলে আসছে। তাই তারা সচেতনভাবেই সেইসব শব্দ বেশি ব্যাবহার করতে লাগল, যা হিন্দুরা ব্যবহার করে না। পানির উপর জোর দেওয়ার উপর এই দুটোই কারণ – এক : হিন্দুদের থেকে আলাদা হওয়া, দুই : ইগো। তাই শুধু বাংলাদেশেই নয়, পশ্চিমবাংলার মুসলমানরাও জলকে পানি বলেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সঙ্গে থেকেও যেমন পশ্চিমবাংলার মুসলমানরা জল বলে না, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সঙ্গে থেকেও হিন্দুরা পানি বলে না। কেন বলে না? ধর্মচ্যুত হওয়ার ভয়? নাকি পৃথকীকরণের প্রচেষ্টা? ভারতে গোমাংস খাওয়া প্রচলনও কিন্তু হিন্দু নই তা প্রমাণ করার জন্যই চালু হয়েছিল। তারপর থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাঙালি মুসলমানেরা ভাবল এবার আমরাও সুযোগ পেয়েছি। বাংলা ভাষাকে মুসলমানি করেই ছাড়ব। যার ফল বাংলা ভাষার মুসলিম সংস্করণ তৈরি করেছেন। কিন্তু ক্ষমতা থাকলে কেন করবে না। সংখ্যাগিরষ্ঠরাই শেষ কথা বলে। যাই হোক, এই ধর্মীয় দ্বন্দ্ব থেকেই মুসলমান পণ্ডিতেরা জল বর্জন করে পানি করে নিল, স্নান বর্জন করে গোসল করে নিল, মাংস বর্জন করে গোস্ত, নিমন্ত্রণ বর্জন করে দাওয়াত, প্রাতঃরাশ বর্জন করে নাস্তা, বাড়ি বর্জন করে বাসা, আরও কতকিছু। অথচ শব্দের তো কোনো ধর্ম থাকা উচিত নয়। এমনকি বাঙালি সম্পর্কেও পৃথকীকরণ হয়েছে। যেমন – হিন্দু বাঙালির বাবা, মা, কাকা, ভাইপো, কাকি, মাসি, মাসতুতো ভাই, পিসি, বড়ো দিদি, দাদা, কাজের লোক পরিবর্তিত হয়ে মুসলমান বাঙালিদের সম্পর্কের নাম যথাক্রমে আব্বু, আম্মা, চাচা, ভাতিজা, চাচী, ফুফু, খালা, খালাতো ভাই, আপু, বুয়া ইত্যাদি হয়েছে। 

শুধু ভাষার ক্ষেত্রেই নয়, বাঙালি সংস্কৃতিতেও ঘোর আপত্তি। সমস্ত বাংলা সংস্কৃতির মধ্যে হিন্দুয়ানি খুঁজে পায়। প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে বাংলাদেশে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা উদযাপিত হয়। যদিও শুরুতে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম ছিল না, ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। যাই হোক, এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে যে বার্তা দেওয়া হয়, তা হল, অশুভ শক্তিকে তাড়িত করে একটি শুভাগমন ঘটাতে চাওয়া। এর একটা রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতও ছিল। তবে নিঃসন্দেহে এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ অনুষ্ঠান। প্রতি বছর নানা ধরনের বাঁশ-কাগজের তৈরি ভাস্কর্য, মুখোশ হাতে বের হয় এই বর্ণাঢ্য মিছিল। তবে মঙ্গল শোভাযাত্রা বিতর্কের ঊর্দ্ধে থাকতে পারেনি। এই আয়োজন নিয়ে অনেক আগে থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছিল বিভিন্ন ইসলামপন্থী সংগঠনগুলি। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের বক্তব্য হল – “এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তির সঙ্গে পেঁচার মূর্তিও বহন করা হয়। আমরা মনে করি এটি নিছক একটি হিন্দু ধর্মীয় রীতি এবং এটি মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক করার অধিকার কারও নেই। লক্ষ্মীপেঁচা যেহেতু হিন্দুর দেবী লক্ষ্মীর বাহন, সেহেতু পেঁচার কোনও প্রতিকৃতি বষর্বরণে মঙ্গল শোভাযাত্রায় বহন করা যাবে না।” বিশেষ একটি পাখিকে আমরা পেঁচা বলে ডাকি, সে বেচারাও জানে না হিন্দুরা তার নামের সামনে লক্ষ্মী জুড়ে দিয়েছে। লক্ষ্মী মানে কেবল দেবীর নাম নয়। লক্ষ্মী মানে শুভ বা সুন্দর। লক্ষ্মী ছেলে, লক্ষ্মী মেয়ে ইত্যাদি। এখন যেহেতু হিন্দুরা লক্ষ্মী জুড়েছে, তাই পেঁচা হিন্দুর পাখি। হিন্দু পাখি, কাজেই বর্ষবরণের মিছিলকে অসাম্প্রদায়িক করতে পেঁচাকে বাদ দিতে হবে। 

না, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। মুষ্টিমেয় আরবপ্রেমী বাঙালি বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করতে পারবে না। তাই বাংলাদেশে বিশুদ্ধ বাংলা ভাষাতেই সাহিত্য রচিত হয়, বাংলা গান লেখা হয়, সিনেমা-নাটকের সংলাপ লেখা হয়, সংবাদ পাঠ করা হয়। যদি বিশুদ্ধ বাংলা ভাষা ধ্বংস হয়ে যেত, তাহলে বাঙালি মুসলমানের হাতে ১৯৫২ তৈরি হত না, ১৯৭১ও হত না। তারও আগে বাংলাদেশের আশরাফ মুসলমানদের হাতে বাংলা ভাষারই কবর রচনা হত। 

কলকাতা কিংবা পশ্চিমবাংলায় যে বাংলা ভাষার প্রতি আন্তরিকতা আছে, তেমন বলা যায় না। অনেকে মনে করেন দৈবাৎ বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটি হারিয়ে গেলে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির অস্তিত্ব থাকবেই না। পশ্চিমবাংলা তথা কলকাতা ক্রমশই কর্পোরেট কালচারের দিকে দ্রুত হচ্ছে। হিন্দি আগ্রাসনে বাঙালি আর বাংলা ভাষা বিরল হয়ে যাচ্ছে।বাঙালি এখন বাংলা ভাষায় কথা বলতে লজ্জা বোধ করে। বাঙালির বাংলা না-জানাটা কোনো লজ্জার বিষয় নয়। হিন্দি বা ইংরেজি ভাষা না-জানার লজ্জার। নিজের প্রদেশেই প্রাদেশিক ভাষা প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। প্রদেশজুড়ে বাংলা ভাষায় কথা বলার পর্যন্ত উপায় নেই। বিকল্পে হিন্দি ভাষার দাপট। বাঙালিদের প্রদেশ পশ্চিমবাংলার রাজধানী কলকাতা নগরীতে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা আনুপাতিক হারে কমে সংখ্যালঘুতে দাঁড়িয়েছে। বাঙালিও বাংলা বলে না। হিন্দির আগ্রাসনে কলকাতায় বাংলা ভাষার প্রচলন মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। নবীন প্রজন্মের মুখে মুখে আজ উদভ্রান্তের মতো ধাক্কা খেয়ে ফিরছে হিন্দি, ইংরেজি মেশানো এক জগাখিচুড়ি বাংলা ভাষা। বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলা বাঙালি দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হবে হয়তো। তবে এখনও মৃত্যু না-হলেও বাংলা ভাষা যে ক্রমে রক্তহীন হয়ে পড়ছে, সেটা চারপাশে একটু সজাগ দৃষ্টিপাত করলেই টের পাওয়া যায়। পশ্চিমবাংলার জন্ম বাংলাদেশের মতো কোনো রক্তক্ষয়ী ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে হয়নি। রাজ্যবাসীদের কাছে বাংলা ভাষা যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা। তাই তাকে নিয়ে পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের কোনো আবেগ নেই। বরং যা রয়েছে তা হল অনেকটা অবজ্ঞা মিশ্রিত অবহেলা। পশ্চিমবাংলার বহু বাঙালিই আড্ডায়, আলোচনায়, এমনকি নিজেদের বাড়িতেও বিশুদ্ধ বাংলায় নয়, ইংরেজি বা বিজাতীয় ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করে। বাংলা ভাষা সম্পর্কে এই অবজ্ঞাই নবীন ছেলেমেয়ে মাতৃভাষা বাংলা সম্পর্কে এত অনীহা, অনাগ্রহী। অভিভাবকরাও মনে করেন বাংলা না জানলেও চলে। আর এই অনাগ্রহ আর অবহেলার মধ্যে ভাষার মৃত্যুবীজ লুকিয়ে থাকে। 

পরিশেষে বলব, এই বাংলা ভাষাকেই কেন্দ্র করে দুই ধর্মের বাঙালির দূরত্ব বেড়েছে। দুই ধর্মের ভাষাচিন্তা পৃথক করে দিয়েছে বাঙালিকে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলা ভাষাকে মুসলমান বানানোর জন্য প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। একদল প্রস্তাব করেছিলেন আরবি হরফে বাংলা লেখার জন্য, আর-এক দল বলেছিলেন রোমান হরফে বাংলা লেখার জন্য। একদল চেষ্টা করেছিলেন ভাষায় আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দ ঢোকানোর জন্য। আবার আরেক দল চেষ্টা করেছিলো সংস্কৃত শব্দ ঢোকানোর জন্য। একদল চেষ্টা করেছিল ভাষাটাকে টুপি পরিয়ে মোল্লা বানানো যাক, আর-এক দল চেষ্টা করেছিল পৈতা পরিয়ে ঠাকুর বানানো যাক। ভাষা নদীর স্রোতের মতো। তাই আপন খেয়ালেই চলে এবং চলবে। প্রয়োজন হলে গ্রহণ করবে, আবার অপ্রয়োজনীয় মনে হলে বর্জন করবে। বাংলা ভাষাভাষী লোক মূলত দুই সম্প্রদায় ভুক্ত – বাঙালি হিন্দু এবং বাঙালি মুসলমান। পূর্ব বাংলার (অধুনা বাংলাদেশ) বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান এবং পশ্চিমবাংলার (ভারত) বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমান। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের বাঙালি, অপরটি বহুভাষিক সংযুক্ত রাষ্ট্র ভারতের অঙ্গরাজ্য। বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষা। পশ্চিমবাংলায় বাংলা ভাষাটা ভারতের সংবিধান স্বীকৃত ২১টি ভাষার মধ্যে একটি অন্যতম ভাষা। 

দেশভাগের পর থেকে আশরাফ মুসলিমরা বাংলা ভাষাকে নীচু শ্রেণির ও ‘হিন্দুয়ানি’ ভাষা মনে করে উর্দুর চর্চাকে যথার্থ মনে করত। কিন্তু আতরাফদের কারণে এবং অনেক বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিকদের প্রতিবাদে বাঙালিদের মধ্যে বিশুদ্ধ বাংলা ভাষাই কিন্তু টিকে যায়। পাকিস্তান হওয়ার পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের একই যুক্তিতে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল। পাকিস্তানিদের কাছেও বাংলা হিন্দুয়ানি ভাষা, রবীন্দ্রসংগীত হিন্দুয়ানি সংগীত -- এই সব ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করেই বাঙালি মুসলমান ভাষা আন্দোলন করেছে। ফলে বাঙালি মুসলমানের কাছে একমাত্র মুসলমানিত্বই প্রধান পরিচয় হয়ে দাঁড়ায়নি। এই ভাষা আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমান উভয়েই অংশ নিয়েছিল। কিন্তু বুঝতে হবে মুসলমানদের জন্যে একটা আলাদা আত্মপরিচয়গত প্রশ্নকে ওভারকাম করতে হয়েছিল। অর্থাৎ হিন্দুদের জন্যে উর্দুর আহ্বান উপেক্ষা করার কিছু ছিল না। কেন-না উর্দু মুসলমানের ভাষা, বাংলা হিন্দুদের ভাষা। ফলে হিন্দুরা স্বাভাবিকভাবেই উর্দুকে গ্রহণ করবে না; কিন্তু বাঙালি মুসলমানকে এই জায়গায় নিজেকে বুঝে নিতে হয়েছে যে, বাংলা ভাষাও বাঙালি মুসলমানেরও ভাষা, এটা মোটেই হিন্দুয়ানি নয় – সব মিলিয়ে এটা বাঙালির ভাষা। সময় বলবে বাংলা ভাষায় আশরাফদের রাজত্ব কায়েম হবে, না আতরাফদের রাজত্ব কায়েম হবে। 

অপরদিকে এপার বাংলা, অর্থাৎ পশ্চিমবাংলার বাঙালিরা বাংলা ভাষায় হিন্দি আগ্রাসন মেনে নিয়েছে। বাংলা সাহিত্য ছাড়া বাংলা এখন মুমূর্ষু-প্রায়। হিন্দির দাসত্ব করেই বাঙালির তৃপ্তি। বাংলায় বসে বাঙালিরা অবাঙালিদের সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলতেই বেশি পছন্দ করে। সেই অবাঙালি বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারলেও, বুঝতে পারলেও বাঙালি ভাঙা ভাঙা ভুলভাল হিন্দি বলবেই। পশ্চিমবাংলার বাঙালি বাংলা ভাষাকে মরণযাত্রা প্রস্তুত করে ফেলেছে। বাংলা ভাষাকে রক্ষা করতে পশ্চিমবাংলায় রফিক, সালাম, বরকত, আব্দুল জব্বারদের মতো ভাষাপ্রেমীদের জন্ম হয়নি এখনও। পশ্চিমবাংলার বাঙালির বুকে একটা বাহান্ন আসুক নেমে। 

‘হিন্দুয়ানি বাংলা’ এবং ‘মুসলমানি বাংলা’ তকমা দুটি আসলেই সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার পরিচায়ক। একই ভাষা স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পৃথক হবেই। এটাই ভাষার স্বাভাবিক চলন। শুধু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেই নয়, হিন্দি ভাষার ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। বিহারের হিন্দি ভাষা আর উত্তরপ্রদেশের হিন্দি ভাষা এক নয়। আবার বিহারে উত্তরপ্রদেশের ভিতরেও পৃথক হিন্দি ভাষা বর্তমান। হিন্দি চলচ্চিত্র বা সাহিত্যে বা দূরদর্শনে যে হিন্দি ভাষা ব্যবহৃত হয়, সেটা কোনো প্রদেশের হিন্দি ভাষা নয়। এটাকে বলে মান্য বা প্রমিত (মান্য বা প্রমিত ভাষা বলতে সেই ভাষাবৈচিত্রকে বোঝানো হয়ে থাকে, যা সমস্ত ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে একই ভাষার ভাব বিনিময়ের ব্যবহারের জন্য একটি অভিন্ন ভাষা। কোনো ভাষার সর্বজনীন স্বীকৃত রূপ হল সেই ভাষার মান্য বা প্রমিত রূপ। একটি নির্দিষ্ট গদ্যরীতি, বানানরীতি এবং ব্যাকরণের ভিত্তিতে একটি ভাষার মান্যকরণ করা হয়। ইংরেজি, ফরাসি, চাইনিজ, হিন্দুস্তানি ভাষার মতো বহুকেন্দ্রীক ভাষাসমূহের একাধিক মান্যরূপও দেখা যায়।) হিন্দি ভাষা। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও চলচ্চিত্র বা সাহিত্যে বা দূরদর্শনে বা বেতারে যে ভাষা ব্যবহৃত হয়, সেটাও কোনো দেশের বা অঞ্চলের ভাষা নয়। এই বাংলা ভাষাকে বলা হয় মান্য ভাষা। অনেকে কলকাতার ভাষাও বলে থাকে। এই মান্য বাংলা ভাষাই কলকাতা সহ বাংলাদেশের মাধ্যমগুলিতেও ব্যবহৃত হয়। ‘কলকাতার ভাষা শুদ্ধ বাংলা’ -- এই অহমিকা নিরর্থক। কলকাতার লব্জ বললে কিছু মানে হয়। কলকাতার বুলি কবেই লুপ্ত। কলকাতা কথা বলে শান্তিপুর নবদ্বীপ কুষ্ঠিয়ার ভাষায়।এই প্রমিতায়ন প্রমথ চৌধুরীর সবুজপত্রের হাত ধরে। তাতে কলকাতাও নিজস্বতা হারিয়েছে। কলকাতার ভাষাও আঞ্চলিক। উন্নাসিকতা আত্মঘাতী। দুই বাংলার প্রায় শতখানেক জেলার শব্দসম্ভার বাংলা ভাষার সম্পদ। মানুষের মুখের ভাষা পৃথক হলেও মাধ্যমের এক। ভারত-বাংলাদেশের বাইরে আমেরিকা আর ব্রিটেনের ধর্মও এক, ভাষাও এক। তবুও সবাই জানেন ইংরেজি সাহিত্য আর মার্কিন সাহিত্যে একটা ভাব ও ভঙ্গির প্রভেদ স্পষ্ট। ভাষা ও ধর্ম এক হলেও তথাপি ভেদাভেদ প্রকৃতি ভেদে ঘটেছে। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার ভাষা সাহিত্যেও অনুরূপ একটা ভেদাভেদ বিদ্যমান। 

বিশেষ করে বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার মতো জায়গার মানুষেরা যখন কলকাতার মানুষের সঙ্গে মিলিত হয়, তখন তাঁদেরকে অনেক সময় হাস্যকর পরিস্হিতির সামনে পড়তে হয়। যেমন বাঁকুড়ার লোকেরা বলে ‘ভাদর মাগের খাটো বিলা’, সেখানে কলকাতার ভাষা অনুযায়ী ‘ভাদ্র মাসে ছোট বেলা’ অথবা ‘ও বিলা সবুর করো’, অর্থাৎ ‘ওই বেলা অপেক্ষা করো’। ‘আইজক্যে বড় জাড় পড়েছে’, অর্থাৎ ‘আজ বেশ শীত পড়েছে’। আবার এই অঞ্চলের ভাষাভাষির মানুষেরা ক্রিয়ার শেষে ‘ছু’ শব্দের ব্যাবহার আছে। যেমন -- খাইছু, যাচ্ছু ইত্যাদি। কিন্তু তাই বলে অন্য অঞ্চলের মানুষেরা অন্য অঞ্চলের ভাষাভাষী মানুষদের কখনোই নিচু প্রতিপন্ন করতে পারে না। কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষেরাও ভিন্নভাষায় কথা বলে থাকে। তাঁদের সকলের ভাষা তেমন উন্নত নয়। তবুও দেখা যায় কলকাতার কিছু মানুষ সিলেট, ঢাকা, বরিশাল, নোয়াখালি, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ, পুরুলিয়ার মানুষের ভাষাকে উপহাস করে। 

প্রকৃতপক্ষে কোনো ভাষাই নির্দিষ্ট একটি ভাষা না। ভাষা হল ভাষার সমষ্টি, ‘ভাষাগুচ্ছ’ বলতে পারেন। তার মধ্যে একটি থাকে মান্য ভাষা’। যেমন -- আমি পুরোপুরি প্রমিত ভাষায় কথা বলতে পারি না, পুরোপুরি প্রমিত ভাষায় লিখতে পারি না। তাই বলে আমি বাঙালি নই? প্রমিত ভাষা আমার মাতৃভাষা নয়। ‘প্রমিত’ কনসেপ্টটাই আমার কাছে ভুয়ো মনে হয়। সবারই স্বকীয়তা আছে। এটা মেনে নেওয়া শিখতে হবে। ভাষার কোনো জাত হয় না, ধর্ম হয় না, দেশ হয় না, অঞ্চল হয় না। (শেষ) 



তথ্যসূত্র : (১) আমাদের ভাষা সংকট – প্রমথ চৌধুরী, (২) বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা – সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, (৩) বাঙ্গালা ভাষা-প্রসঙ্গে -- সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, (৪) বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি ফারসি উর্দু শব্দের অভিধান – মোহাম্মদ হারুন রসিদ, (৫) আঠারো শতকের বাঙলা ও বাঙালী – ড. অতুল সুর, (৬) আমরা বাঙ্গালী – শ্রীহরিসাধন চট্টোপাধ্যায়. (৭) বঙ্গদর্শন নির্বাচিত রচনাসংগ্রহ – ড. রবীন্দ্র গুপ্ত (সম্পাদিত) (৮) বাংলা ভাষায় আরবী ফারসী তুর্কী হিন্দী উর্দু শব্দের অভিধান – কাজী রফিকুল হক (সম্পাদিত), (৯) বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত – ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।

0 comments: