প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার
Posted in প্রবন্ধসে বহুকাল আগের কথা। একজন পর্তুগীজ এই বাংলাকে ভালোবেসে হয়ে উঠেছিলেন বাংলারই এক বিখ্যাত কবিয়াল। কবিয়ালরা কবিগান পরিবেশনা করে থাকে। কবিগান হল বাংলা লোকসঙ্গীতের একটি বিশেষ ধারা যেখানে গায়ককে কবি হতে হয়। সেই গায়ককে মুখে মুখে পদ রচনা করে তাৎক্ষণিকভাবে সুরারোপ করে গেয়ে থাকতে হয়। কবিগানের লোককবিরা প্রতিযোগিতামূলক গানের আসরে অংশগ্রহণ করে থাকেন। এক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় মূলত কবিগানের একাধিক দলের মধ্যে এবং এই প্রতিযোগিতার নাম হল 'বাদাবাদি'। এই বাদাবাদির নিয়ম হল একদল গান গেয়ে প্রশ্ন করবে যাকে বলা হয় 'চাপান'। আর সেই প্রশ্নমূলক গান শেষ হলে অপর দলটি সেই গানের জবাব গান গাইবে যাকে বলা হয় 'উতোর' (যা চাপানো প্রশ্নের উত্তরই বটে)। প্রতিযোগীতার শেষ পর্যন্ত গানের এই প্রশ্নোত্তরের টক্করে যে দল সবচেয়ে ভালো হিসেবে বিবেচিত হবে সেই দলই জয়লাভ করবে। তা এরকম কবিগানের এক বাদাবাদিতে বাংলার আরেক বিখ্যাত কবিয়াল রাম বসু সেই পর্তুগীজ কবিয়ালের প্রতি চাপান—
“সাহেব! মিথ্যে তুই কৃষ্ণপদে মাথা মুড়ালি
ও তোর পাদরি সাহেব শুনতে পেলে গালে দেবে চূণ কালি।”
এবার সেই পর্তুগীজ সাহেব, যিনি ধর্মে খ্রিস্টান ছিলেন, যা উতোর দেন সেটি হয়ে ওঠে বাংলার তথা দেশের সম্প্রীতির এক সুন্দর অমর বার্তা। তিনি উতোর দেন—
“খৃষ্ট আর কৃষ্টে কিছু ভিন্ন নাইরে ভাই।
শুধু নামের ফেরে মানুষ ফেরে এও কোথা শুনি নাই।।
আমার খোদা যে হিন্দুর হরি সে
ঐ দেখ শ্যাম দাঁড়িয়ে আছে
আমার মানব জনম সফল হবে যদি ঐ রাঙ্গা চরণ পাই।”
সত্যি তো, খৃষ্ট আর কৃষ্টে কিছু ভিন্ন বা তফাৎ তো নেই। মিছে ভেদাভেদ তো মানুষেই করে থাকে। আর কেই বা এই সম্প্রীতির সাধক? তিনি হলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর সেই বিখ্যাত কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি (অনেকে অবশ্য লেখেন এন্টনি ফিরিঙ্গি)। ওঁর প্রকৃত নাম ছিল হেন্সম্যান অ্যান্টনি (Hensman Anthony)। তখনকার দিনে সাধারণত পর্তুগীজ সহ ইউরোপীয়দেরও 'ফিরিঙ্গি' বলা ডাকা হত। তাই, হেন্সম্যান অ্যান্টনি হয়ে উঠেছিলেন তাঁর গাওয়া অসাধারণ কবিগানের জন্য আমাদের প্রিয় 'অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি' হিসেবে। ১৭৮৬ সালে পর্তুগালে তাঁর জন্ম হয়।
আমরা জানি যে ইংরেজরা আসার বহু যুগ আগে এখানে পর্তুগীজরা এসেছিল ব্যবসার খাতিরে। আমরা খ্রীস্টানদের উপাসনালয় 'চার্চ'-কে বাংলায় বলি 'গীর্জা'। এই গীর্জা কথাটা এসেছে পর্তুগীজ শব্দ 'ইগরেজা' থেকে। পর্তুগীজরা চার্চকে ইগরেজা বলে। সেখান থেকে অপভ্রংশ হয়ে গীর্জা শব্দটি এসেছে। তাঁর পিতা ছিলেন একজন পর্তুগীজ ব্যবসায়ী যিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কলকাতার কাছে হুগলীর চন্দননগরের ফরাসডাঙায় থাকতে শুরু করেন। তখন চন্দননগর ফরাসি বা ফ্রেঞ্চদের দখলে ছিল। তাই তো নাম ফরাসডাঙা। সে যাই হোক, অ্যান্টনি অল্পবয়স থেকেই কবিগানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কবিগান গাইতে শুরু করেছিলেন। আজ কবিগান বিলুপ্তপ্রায় সংস্কৃতি হলেও তাঁর আমলে কলকাতা ও তার আশেপাশে কবিয়ালদের বেশ প্রভাব ও খ্যাতি ছিল বলে জানা যায়। বিখ্যাত কবিয়ালরা যেমন হরু ঠাকুর, ভোলা ময়রা, দাশরথি রায়, রাম বসু প্রমুখ ছিলেন তাঁর সমসাময়িক। অ্যান্টনি অনেক কবিয়ালের সাথে বাদাবাদিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ভোলা ময়রা, রাম বসু, ঠাকুর সিংহ প্রমুখ কবিয়ালেরা তাঁর প্রতিপক্ষ ছিলেন। তাঁর গানের বাঁধনদার বা গান-রচয়িতা ছিলেন একজন বাঙালি যাঁর নাম গোরক্ষনাথ। এই গোরক্ষনাথের কোনো কবিগানের দল ছিল না। তিনি প্রধানত অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি সাহেবের দলে গান বেঁধে দিতেন। একবার দুর্গা পুজোর সময় চুঁচুড়ার কোনো এক বিশিষ্ট ব্যক্তির বাড়িতে অ্যান্টনি সাহেবের কবি গানের আয়োজন হয়। তখন অ্যান্টনির থেকে গোরক্ষনাথের অনেক বেতন পাওনা ছিল। গোরক্ষনাথ অ্যান্টনিকে বলেন যে, তাঁর সমস্ত বেতন পরিশোধ করে না দিলে তিনি আর নতুন আগমনি গান বেঁধে দেবেন না। এ কথা শুনে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি খুব রেগে যান। গোরক্ষনাথ ছাড়াই তিনি নিজে আগমনি গান রচনা করে সে আসর রক্ষা করেন। এর পরে তিনি তাঁর পারদর্শীতায় নিজেই গান বাঁধতেন বা রচনা করতেন।
অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির একটি বিখ্যাত বা জনপ্রিয় গান যা তিনি চাপান হিসেবে ব্যবহার করেন তা হল—
“আমি সাধন ভজন জানি নে মা জাতিতে ফিরিঙ্গি।
দয়া করে তরাও মোরে হে শিবে মাতঙ্গী।।” অনেক জায়গায় এই গানটি অবশ্য এইভাবে আছে—
“আমি ভজন সাধন জানিনে মা, নিজে ত ফিরিঙ্গি।
যদি দয়া করে কৃপা কর, হে শিবে মাতঙ্গী।”
এই গানে তাঁর হিন্দুধর্মের প্রতি বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটেছে। কিন্তু সেযুগের গোঁড়া হিন্দুরা একজন ফিরিঙ্গির হিন্দু ধর্মের প্রতি বিশ্বাসকে মেনে নেয়নি। কেননা, এই চাপানের উতোর বিখ্যাত কবিয়াল ভোলা ময়রা দেন এভাবে—
“আমি পারব নারে তরাতে, আমি পারব নারে তরাতে
যীশু খৃষ্ট ভজগে তুই শ্রীরামপুরের গীর্জাতে।”
তাঁর মতো একজন ইউরোপীয়র এই উদারতা ও হিন্দু ধর্মের প্রতি প্রেম, ভালোবাসা ও বিশ্বাস সে যুগের অনেকেই হয়তো বাঁকা চোখে দেখেছেন। তাঁর "জয় যোগেন্দ্রজায়া মহামায়া মহিমা অসীম তোমার" আগমনী পর্যায়ের গানেও তিনি হিন্দুধর্মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা দেখিয়েছিলেন। তিনি সৌদামিনি (অনেকের মতে প্রমীলাদেবী) নামে এক হিন্দু বিধবা বাঙালি ব্রাহ্মণ-কন্যাকে সতীদাহ হওয়ার থেকে উদ্ধার করে বিবাহ করেছিলেন। যা সেযুগের এক বিস্ময়কর ঘটনা। বলতে গেলে তখন বিধবা বিবাহের তেমন প্রচলনই ছিল না। তার ওপর তখনকার জঘন্য প্রথা সতীদাহ থেকে এক অসহায় বৃদ্ধাকে উদ্ধার করে তাঁকে বিবাহ করা— সত্যি এক অসম সাহস ও মানবিকতার পরিচয়। অনেকের মতে কলকাতার বহুবাজার (জনশ্রুতিতে বৌবাজার) এলাকায় তিনি একটি কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা 'ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি' হিসেবে পরিচিত। এই মন্দির প্রতিষ্ঠার ফলে হিন্দুধর্মের প্রতি তাঁর ভালোবাসা, অনুরাগ ও বিশ্বাস আরও ভালোভাবে প্রকাশ পায়। আবার অনেকের মতে বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটে অবস্থিত এই মন্দিরটি পাঁচশো বছরের পুরনো আর অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি এই মন্দিরে আসতেন বলে কালীমূর্তিটি 'ফিরিঙ্গি কালী' আর মন্দিরটি 'ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি' নামে পরিচিত হয়। অনেকের মতে উক্ত মন্দিরের দেখাশোনা করতেন প্রমীলাদেবী নামক একজন বিধবা নারী। কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি হিন্দুধর্মের প্রতি অনুরাগের ফলে এই মন্দিরে যাতায়াত করতেন এবং প্রমীলাদেবীর সঙ্গে তিনি প্রণয়ে আবদ্ধ হন।
অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে (১২৪৩ বঙ্গাব্দে)-র অক্টোবর মাসে ৫০ বছর বয়সে মারা যান। তিনি জন্মসূত্র ইউরোপীয় হয়েও বাংলা ভাষা সুন্দরভাবে আয়ত্ত করে বাংলাতেই কবিগান রচনা করতেন। তিনি বাঙালির সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে যে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তা সেযুগে কোনো বিদেশীর ক্ষেত্রে খুবই বিরল ছিল। এদেশকে ও এদেশের সাংস্কৃতিক জগতকে অকৃত্রিম ভালোবাসার বন্ধনীতে বেঁধেছিলেন। তিনি ভালোবেসে কবিগান গাইতেন। তাঁর গান জাতি, ধর্ম ও বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ ও মানবতার কথা মেলে ধরেছিল। তাঁর পরে অনেক বিদেশী ও বিদেশিনী আমাদের এই বঙ্গদেশে এসে এখানকার সংস্কৃতিকে নানাভাবে সমৃদ্ধ করে গেছেন ঠিকই কিন্তু প্রথম ইউরোপীয় বাংলা ভাষার কবিয়াল হিসেবে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি এই বাংলায় অমর হয়ে রয়েছেন। তাঁর জীবন নিয়ে চলচ্চিত্র বা ফিল্মও নির্মাণ করা হয়েছে। ১৯৬৭ সালে তাঁর জীবন নিয়ে নির্মিত 'অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি' মুক্তি পায়। যেখানে তাঁর ভূমিকায় অভিনয় করেন মহানায়ক উত্তম কুমার। আর এই সিনেমায় কবিয়াল ভোলা ময়রার সাথে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির কবিগানের লড়াই দেখানো হয়েছিল। এর বহু বছর পর, ২০১৪ সালে বিখ্যাত পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় মুক্তি পায় তাঁর জীবন ও বর্তমান প্রজন্মে তাঁর পুনর্জন্ম মিলিয়ে একটি চলচ্চিত্র যার নাম 'জাতিস্মর'। এখানে তাঁর চরিত্রে অভিনয় করেন বাংলার বিখ্যাত সুপারস্টার প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়।
আজ যখন কিছু খ্রিস্টান মিশনারিদের বিরুদ্ধে আদিবাসী, গ্রাম্য মানুষদের অন্যায়ভাবে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত করার অভিযোগ ওঠে এবং তাদের বিরুদ্ধে হিন্দু ধর্ম ও তার দেবদেবীদেরকে অপমান করার অভিযোগও ওঠে আবার অন্যদিকে গোঁড়া হিন্দুত্ববাদীদের চার্চ আক্রমণ করার ও খ্রিস্টান ধর্ম এবং যীশুকে অপমান করার নজির দেখা যায় তখন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির কথা বড়োই মনে পড়ে। ডিসেম্বর পবিত্র উৎসব ক্রিসমাসের মাস। সর্ব ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালির কাছে এ যেন এক আনন্দোৎসব। তাই, এই প্রিয় উৎসবের মাঝে, সান্তা ক্লজের গিফ্ট ও কেক খাওয়ার মাঝে দুই ধর্মের গোঁড়া ধার্মিকেরা ভেদাভেদের বিষাদ সুর বাজায় তখন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি সাহেবের কবিগান "খৃষ্ট আর কৃষ্টে কিছু ভিন্ন নাইরে ভাই" সেই বিষাদকে সরিয়ে দিয়ে আবার আনন্দে চারপাশ ভরিয়ে দেয়। সত্যি তো, দুই ধর্মের গোঁড়া ধার্মিকেরা তফাৎ করলেও কৃষ্ণে আর খৃষ্টে কোনও তফাৎ নেই। দুজনেই দয়া, ক্ষমা, ভালোবাসা, ন্যায়, স্নেহ-মমতা, প্রকৃত মনুষ্যত্বের প্রতীক।
তথ্যসূত্রঃ–
সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান (প্রথম খণ্ড), সাহিত্য সংসদ,
উইকিপিডিয়া,
বাংলাপিডিয়া,
মিলন সাগর ওয়েবসাইট।



0 comments: