0

সম্পাদকীয়

Posted in







আশ্চর্য সমাপতন! শিলচর শহর। মে মাস। বাষট্টি বছর আগে তারিখটা ছিল ১৯ আর এবার সেই ঘটনার বর্ষপূর্তির আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভেসে উঠলো ছোট্ট একটি খবর। শিলচরের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে এক ছাত্রকে বাংলা বলার অপরাধে আড়াইশো টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এই সেই শিলচর, যেখানে একদিন বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন এগারো জন। 

বাংলা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনভাষা হওয়া সত্ত্বেও বাধ্যতামূলকভাবে সেদিন অহমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে, তাতেই অসংখ্য বাঙালির সঙ্গে সামিল হয়েছিলেন ওই এগারো জনও। স্বাধীন ভারতের সশস্ত্র পুলিশ বিনা প্ররোচনায় হত্যা করেছিল তাদের। রক্তে ভেসে গিয়েছিল শিলচর রেলওয়ে স্টেশন। 

ওয়াকিবহাল মানুষ এ ইতিহাস জানেন। এই আলোয় সাম্প্রতিক ঘটনাটিকে খুব আলাদা করে দেখা যাবে কি? একটি বালককে তার মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য জরিমানা করে তার মৌলিক এক অধিকার হরণ কি অন্যতর এক হত্যা নয়? এখন কি আর আমাদের কিছুতেই কিছু যায় আসেনা? একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া আর তারপর business as usual - এটিই সম্ভবত প্রকৃত বিশ্বায়ন। আমাদের সমগ্র যাপন শৈলী আসলে এক ভান!

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা অফুরান

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in






মানবসভ্যতার জাগরণের পর থেকেই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিতে মানুষ চিরকাল প্রাথমিকভাবে প্রাকৃতিক বৈচিত্র, যা তার জীবন যাপনের সঙ্গে মেলেনা, তাকে অস্বীকার করেছে। এর একটা প্রধান কারণ, যে কোনও জীবের চেয়ে মানুষ প্রকৃতিকে যেভাবে পরিচালনা করতে চেষ্টা করেছে ও কিয়দংশে সফল হয়েছে, তা থেকেই তার একটা অহমিকা জন্মেছে। সে চাইলে সব পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে যে সমস্ত সাফল্যের কাহিনী আমরা দেখতে পাই তার উৎস মানুষের এই ধরণের জয় থেকেই জন্মেছে। কখনও সে প্রকৃতিকে নিজের কাজে লাগিয়েছে, কখনও স্বৈরাচারীর মতো তার শক্তিকে সংহত করেছে। আমাদের এই নিবন্ধের বিষয় এমনই এক প্রাকৃতিক বৈচিত্র, যা সংখ্যাগুরু মানুষ একটি প্রাকৃতিক বিকৃতি হিসেবেই ভাবতে অভ্যস্ত। মানবিক চিন্তাধারার এই প্রস্তরীভূত বৈশিষ্ট্যকে আমূল বদলে দেওয়া শক্ত ব্যাপার। তবু আলোচনা হওয়া দরকার। একমাত্র সুস্থ ও স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গিই পারে আমাদের চিন্তার সীমাবদ্ধতাকে মুক্তি দিতে।

আসুন বিষয়ে প্রবেশ করি। আজ আমরা আলোচনা করতে চলেছি একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে। স্পর্শকাতর, কেননা, বিষয়টির সঙ্গে আমাদের নিকট দূর, প্রিয়জন ও বন্ধুও এই শিরোনামে যুক্ত হয়ে যায়। আর তখন তাদের এই একটিই পরিচয় আর সব কিছুকে ছাপিয়ে আমাদের দৃষ্টিকে অস্বচ্ছ করে তোলে। সেই পরিচয় হলো তার যৌনচেতনা। আমাদের অনেককালের সঞ্চিত শ্রেষ্ঠত্বের মানসিকতা দিয়ে আমরা ভিন্ন যৌনচেতনার মানুষকে প্রান্তিক করে তুলি। তাদের আর সব পরিচয়, সমাজে তাদের অবদান, সব ভুলে তাকে অপরাধী করে ফেলি। অপরাধ? সে প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে এক ধরণের পরিচয় বহন করে, এমনটিই আমরা মনে করি। সমকাম বলে প্রকৃতিতে কিছু নেই। যা আছে তা হলো বিকৃতি। অসুস্থতা। অনেকেই মুক্তকণ্ঠে বলেন, কেউ কেউ বা নিজের মনে এরকম ধারণা পোষণ করেন, মুখে বলেন না। সেরকম পরিস্থিতি তৈরি হলে তখন তাঁর প্রতিক্রিয়া থেকেই তাঁর অবস্থান পরিষ্কার হয়। কিন্তু সত্যি বলতে আমরা নিজেরা কতটুকু জানি? প্রাকৃতিক নিয়মে কি কি বলে? জানিনা। সমাজ ও রাষ্ট্র আমাদের নির্দিষ্ট মাপকাঠি দিয়ে চিনিয়ে রেখেছে। পারিবারিক গণ্ডীর মধ্যে, নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলা ভাবনা আমাদের সীমিত করেছে। এইটুকু প্রাকৃতিকভাবে সম্ভব। বাকিটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ। কেন? কারণ, প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী বিষম লিঙ্গের প্রাণীর মিলনেই প্রাণ উৎপাদন সম্ভব। সমলিঙ্গের মিলন বলে কিছু নেই, ওটা বিকৃতি। আর প্রকৃতির রাজ্যে নিয়মই হলো, সৃষ্টির ধারাকে অব্যাহত রাখা। সেখানে সমকাম একধরণের অপরাধ বৈকি!

কিন্তু আমাদের ঐতিহ্য তা বলেনা। ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস বলে, আমরা চিরকালই সহিষ্ণু উন্নতমনের মানুষ। সেভাবে সমকামী মানুষকে কখনও চরম শাস্তি মাথা পেতে নিতে হয়নি। যেসব ক্ষেত্রে শাস্তি নিদারুন, সেখানে দেখা যাবে সমকাম নয়, সঙ্গে অন্য কোনও অপরাধ লুকিয়ে ছিল। হ্যাঁ, সেভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হতোনা ঠিকই, কিন্তু এমন মানুষদের আলাদা করে চিহ্নিত করে তাদের সমাজের মূল স্রোতে মিলতে না দেওয়ার ইতিহাস আমাদের নেই। পরিস্থিতি বদলেছে ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকে।

দেখি সমকাম সম্পর্কে অন্তত ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস বা পুরাণ কি বলে। রামায়ণের উত্তরকাণ্ডে, যেখানে রাম ও রাবণের জন্মান্তরের কাহিনী বলছেন বাল্মীকি, সেখানে একটি কাহিনী আছে। সেই কাহিনীর রাজা দিলীপ। তিনি তাঁর দুই স্ত্রীকে রেখে মারা যান। তিনি অপুত্রক অবস্থায় মারা যেতে রাজ্যে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সংকট উপস্থিত হলো। তখন শিব রাণীদের স্বপ্নে আবির্ভূত হলেন এবং আজ্ঞা দিলেন, তারা যেন দুজনে মিলিত হন। এই আজ্ঞা পেয়ে তারা মিলিত হলেন এবং একজন স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হলেন। তাঁর পুত্র হলেন ভগীরথ। যিনি গঙ্গাকে মর্ত্যে এনেছিলেন। কাহিনীটির একটু বিশ্লেষণ হোক। শিবের আজ্ঞা দুই রাণী যুগপৎ স্বপ্নে দেখলেন। সেই সময় কিন্তু উত্তরাধিকারের সংকট থেকে রক্ষা পেতে নিয়োগ প্রথা সামাজিক ভাবে গ্রহণীয় ছিল। অথচ কোনও ঋষি বা মুনির দ্বারস্থ না হয়ে দুই রাণী এভাবে মিলিত হবার স্বপ্ন দেখলেন? আবার দুজনে একসাথে? আবার একজন গর্ভধারণও করলেন! কী বিস্ময়! বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে এ জিনিস অসম্ভব। তবে কি হয়েছিল? যে রাণী গর্ভধারণ করলেন তাঁর নিশ্চয় কোনও পুং সংসর্গ ঘটেছিল। সে থেকে রাজ্যের সংকট মিটেছিল। কিন্তু দুই নারী, যারা একে অপরের প্রতি আসক্ত ছিলেন বোঝাই যাচ্ছে, নাহলে এরকম স্বপ্নকাহিনীর অবতারণার কোনও জাগতিক প্রয়োজন ছিলোনা, তারা এই স্বপ্নের দ্বারা পুত্রার্থে মিলনের পবিত্রতা বাদে আপন খুশিতে মিলনকে সামাজিক স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিলেন। এবং সমাজ তাতে সীলমোহর দিয়েছিল। যদিও বুদ্ধিমান লোকেরা বুঝেই ছিলেন রাণীদের গোপন কথা।

এবার আসি মহাভারতে। মহাভারতের অত্যন্ত বিখ্যাত কাহিনী শিখণ্ডীর কাহিনীটি। যদিও বলা হয়, পিতামহ ভীষ্মর কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তাঁর প্রতি ক্রুদ্ধ অম্বা আত্মহত্যা করেন। এবং জন্মান্তরে অম্বা রাজা দ্রুপদের ঘরে পুত্র হয়ে জন্মান। সে যাই হোক, পুত্র শিখণ্ডী বীর ছিলেন। বহু বছর শিক্ষা ও তপস্যার কারণে রাজ্যের বাইরে ছিলেন। কিন্তু দ্রুপদ তাঁকে পাঞ্চালে বেশিদিন রাখেননি। মোট কথা, পাঞ্চাল রাজ্যে আমরা যাজ্ঞসেনী আর ধৃষ্টদ্যুম্নকে যেভাবে উপস্থিত থাকতে দেখি, শিখণ্ডীকে সেভাবে দেখিনা। কারণ কি তবে তাঁর লিঙ্গের অস্পষ্টতা? দ্রুপদ হয়ত মানসিক ভাবে রক্ষণশীল ছিলেন, কিংবা, সেসময় রাজারা যেমন প্রজারা কি বলবে তাই নিয়ে ভাবিত থাকতেন সেই চিন্তায় শিখণ্ডীকে দূরে রেখেছেন। প্রথমে রাজা দ্রুপদ কিন্তু সমাজ মেনে তাঁর বিবাহ দেন। তখনও শিখণ্ডী পাঞ্চাল ছেড়ে যাননি। এবং যা ঘটার তাইই ঘটে। পত্নী তাঁকে নপুংসক বলে ঘোষণা করেন ও পরিত্যাগ করেন। লোকচক্ষুর আড়ালে, কোনও নির্জন স্থানে, শিখণ্ডী তাঁর লিঙ্গ পরিবর্তন করেন। স্পষ্টতই রাজা দ্রুপদের এতে সায় ছিল। তিনি পুরুষ থেকে নারীতে পরিবর্তিত হন। এবং সেই নারী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্মর সঙ্গে সম্মুখ সমরে আসেন। যেহেতু ভীষ্ম আজীবন ব্রহ্মচারী, তাই তিনি শিখণ্ডীর সঙ্গে যুদ্ধ করলেন না। এইই ভীষ্মর পতনের কারণ। কাহিনীর আড়ালে কি আছে দেখা যাক। শিখণ্ডীকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। নারীর সঙ্গে তাঁর সমর অসম্ভব জেনে ভীষ্মর সম্মুখে শিখণ্ডীকে আনার চক্রান্ত যুদ্ধের অন্যতম পরিকল্পনা ছিল। এবং সেভাবেই তাঁকে ক্রমাগত মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে, শিখণ্ডী যে একটি মহৎ কর্তব্যে মর্ত্যে এসেছেন, সেটি হাতুড়ি দিয়ে মাথায় ঢোকানো হয়। তাঁর ব্যক্তিগত আবেগ ছিল এই, যে, তাঁর লিঙ্গ অস্পষ্টতা তাঁকে সমাজে সাধারণের সঙ্গে মিশবার স্বাধীনতা হরণ করেছিল। তিনি শরীরে পুরুষ হয়েও মনে নারী। এবং তাঁকে বিশ্বাস করানো হয়েছিল পূর্বজন্মে তিনি অপরূপা অম্বা ছিলেন। ভীষ্ম তাঁকে ব্রহ্মচর্যের দোহাই দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর মনের ক্ষোভকে জাগিয়ে দেয় এই কাহিনী। তিনি নিজের অজ্ঞাতেই ভীষ্মর প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁর রুদ্ধ আবেগ তাঁকে কুরুক্ষেত্রে টেনে আনে নারীসত্ত্বাকে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়েছে বলে। আর যুদ্ধ পরিকল্পকরা এই অবসরে তাঁকে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করেন।

আরেকটি কাহিনী বলি। বৈবস্বত মনুর কন্যা ইলা। ইক্ষ্বাকুর ভগ্নী। যদিও বায়ুপুরাণ ও ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে ইলাকে মেয়েই বলেছে, বিষ্ণুপুরাণ কিন্তু জানাচ্ছে, ইলা প্রথমে পুরুষ হয়েই জন্মেছিলেন। পরে নারী হন। বা কিম্পুরুষ। যার নাম সুদ্যুম্ন। এই সুদ্যুম্ন চন্দ্র বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তার প্রতিষ্ঠিত বংশ ঐল বংশ নামেও পরিচিত। রামায়ণে আছে, ইলা নাকি মৃগয়াতে গিয়ে ভুলবশত সহ্যাদ্রি পর্বতে অবস্থিত পার্বতীর শরবনকুঞ্জে ঢুকে পড়েছিলেন। সেখানে শিব ছাড়া অন্য পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। তাই পার্বতীর অভিশাপে তিনি নারী হয়ে যান। ওই কুঞ্জে নাকি বৃক্ষলতা পর্যন্ত নারী। এই অভিশাপের ফলে ইলার সঙ্গের পারিষদেরাও নারী হয়ে যান। বা কিম্পুরুষ। ইলা বাধ্য হয়েই বনে রয়ে গেলেন। এখন নারী ইলাকে দেখে বনে তপস্যারত চন্দ্রপুত্র বুধ মোহিত হয়ে পড়েন। তিনি নাকি প্রগাঢ় তপস্বী। তবুও সংযমের বাঁধ ভাঙছে। তিনি ইলাকে প্রেম নিবেদন করলেন। সম্ভবত ইলারও এছাড়া কোনও উপায় ছিলনা সমাজে ফেরবার। তাই তিনি বিবাহ করলেন বুধকে। এরপর নাকি একমাস অন্তর অন্তর ইলার লিঙ্গ পরিবর্তিত হতে থাকে। যেসব মাসে তিনি নারী সেসব মাসে তিনি বুধের সঙ্গে দাম্পত্যে মেতে থাকতেন। আর যখন তিনি পুরুষ তখন তিনি ব্রহ্মচর্যে কাল কাটাতেন। কিন্তু শেষরক্ষা হলনা। কিম্পুরুষ রূপে ইলার অস্তিত্ব সিদ্ধ হলনা। কারণ ন মাস পর তার একটি পুত্র হল। নাম পুরুরবা। তাহলে কাহিনীর আড়ালে কি আছে? ইলা জন্মেছেন পুরুষ হয়ে। কিন্তু অন্তরে নারী তিনি। হয়ত তাঁর দৈহিক কিছু স্ত্রীচিহ্নও ছিল। রাজা তাঁকে সিংহাসনে বসাবার জন্য যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেন। কিন্তু শেষরক্ষা হয়না। তিনি সহ্যাদ্রি পর্বতের নিভৃতে কোনও চিকিৎসকের দ্বারা নারীতে পরিবর্তিত হন। এবং বুধ তাঁর প্রেমে পড়েন। দুজনে সেই অরণ্যে সংসার পাতেন। এবং তাঁদের পুত্রসন্তান জন্মায়। এর প্রত্যক্ষ ফল, রাজা সুদ্যুম্ন বা ইলাকে রাজ্য থেকে বঞ্চিত করেন। সে কিম্পুরুষ বলে নয়, সে নারী বলে। কিন্তু ইলা সুখে বুধের সঙ্গে ঘরকন্না করতে থাকেন।

প্রাচীন ভারতে তাহলে সামাজিক নিয়ম অনুযায়ী সমকামীদের কি কোনও শাস্তি ছিল? ছিল, কারণ মনুস্মৃতি বলছেন, দুই নারী যদি মিলিত হয় তবে শাস্তিস্বরূপ দশটি চাবুক এবং দুশত দিনার দিতে হবে। কিন্তু যদি দুজনের মধ্যে একজন বয়স্কা হন, তবে তার মাথা নেড়া করে গাধায় বসিয়ে নগর প্রদক্ষিণ করানো হবে। এবং দুটি আঙুল কেটে নেওয়া হবে। এই আইনটি পড়লে একটু অবাক হতে হয়। কেন একই অপরাধে দুরকম শাস্তি? লক্ষ করলে দেখব, প্রথম ক্ষেত্রে শাস্তি খুবই নগণ্য। যেন সেভাবে শাস্তিই নয়। কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তা এমন অপমানকর কেন? এখানে একটি কথা। প্রথম ক্ষেত্রে সম্ভবত দুই নারী প্রেমেই মিলিত হয়েছে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে দুই নারীর একজন বয়স্কা। তবে কি দ্বিতীয়জন কুমারী? সে কি নিজের যৌনচেতনা সম্পর্কে অজ্ঞান? তাকে সেই নারী তার সম্পূর্ণ অজান্ত্বে প্রায় ধর্ষণ করছে? আর তাই বয়স্কা নারীটিকে এমন শাস্তি দেওয়া হচ্ছে যা একজন পুরুষকেও অনুরূপ অপরাধে দেওয়া হয়। অর্থাৎ সমকামে উৎসাহ দেওয়া হতোনা বটে তবে সমাজ একে এত ঘৃণার চোখেও দেখতনা।

এই ছোট্ট পরিসরে একটি বিষয় স্পষ্ট। সমকাম সেসময় বেশ পরিচিত ও চর্চিত ছিল। সমাজে এটি একটি ছোটখাট অপরাধ হিসেবে গন্য হয়েছে। কখনও কখনও বৃহত্তর স্বার্থে একে স্বীকৃতিও দেওয়া হয়েছে। বাৎস্যায়নের কামসূত্রে, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে, মনুস্মৃতিতে একে নিরুৎসাহ করা হয়েছে। বুদ্ধের সংঘে, বুদ্ধ নিজে দুই বালকের এমন মিলনকথা শুনে তাদের কেবল পিতামাতার কাছে ফেরত পাঠিয়েছিলেন এবং ভিক্ষুদের একটির অধিক শ্রাবক রাখতে নিষেধ করেছিলেন। অতএব এটি লঘুপাপ। কিন্তু সমাজে বহুল প্রচলিত বিষয় বলেই, এবং কখনও কখনও দেবের কাম্য বলেও খাজুরাহো সহ বেশ কিছু মন্দিরের গায়ের ভাস্কর্যে আমরা সমকামের মিলনদৃশ্য খোদিত আছে দেখতে পাই। দেবের কাম্য কারণ, কথিত আছে, সমুদ্র মন্থনকালে বিষ্ণু এক মোহিনী নারীর রূপ ধরে উঠে আসেন। আর শিব তাই দেখে এমন আকৃষ্ট হয়ে পড়েন যে দুজনের মিলন ঘটে। তা থেকে আয়াপ্পা নামের পুত্র জন্ম নেয়। কাহিনীর আড়ালে কি এজাতীয় যৌনমিলনকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়াস? দেবতা স্বয়ং যখন আকৃষ্ট হন তখন কুতো মানব!

অথচ এই ভারতবর্ষের এমন ঐতিহ্যের অধিকারী আমরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে আইনের ৩৭৭ ধারাকে বাঁচিয়ে রেখেছি। ভয়াবহ শাস্তির ব্যবস্থা রেখেছি দুটি প্রেমাসক্ত মানুষের জন্য। সমাজ তো তাদের পরিত্যাগ করেই, নিজের ঘরে পরিবারেও তারা ব্রাত্য। কখনও চিকিৎসার নামে, কখনও স্বাভাবিক প্রবৃত্তি ফিরিয়ে দেবার নামে অকথ্য অত্যাচার চলে। সমকামী বোনের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি জাগিয়ে তোলার তাগিদে নিজের দাদা তার বন্ধুদের দিয়ে বোনকে ধর্ষণ করায়, খবরে দেখেছি। বেশ কিছু চিকিৎসক আধুনিক বিজ্ঞানে শিক্ষিত হয়েও মনে করেন সমকাম একধরণের বিকৃতি। কেন এরকম মনে করেন? মনে করেন কারণ, পিতৃতন্ত্রের বদ্ধমুল ধারনাই হলো, নারী পুত্রের জন্ম দেয়। সেই পুত্র আসে পুরুষের বীজ থেকে। সুতরাং যে মিলন পুত্রার্থে নয় তা অপবিত্র। এখানে ধর্মের সীলমোহর লাগিয়ে দেওয়া হয়। কে না জানে সব ধরমেই দৈহিক আনন্দ পাওয়ার জন্য মিলনকে অপরাধ বলা হয়েছে! শুধু পুত্রার্থে মিলনকেই পবিত্র বলা হয়েছে। তা সে ধর্ম নব্য হিন্দুধর্মই হোক বা খৃষ্ট ধর্মই হোক বা ইসলাম হোক। তবু মনে রাখতে হবে উপনিবেশের প্রভুদের গোঁড়া ক্যাথলিক ধর্মই সবচেয়ে বেশি এর বিরোধিতা করেছে। আর এই বিখ্যাত আইনটি তাদেরই প্রচলন।

এবার দেখি প্রকৃতির ভাঁড়ার। প্রকৃতির রাজ্যে কোন কোন প্রাণী সমকামী আচরণ করে। এটি প্রয়োজনীয়। কারণ সৃষ্টি অব্যাহত রাখার জৈবিক তাগিদ তাদেরও কম নয়। দেখা যাচ্ছে, জিরাফ সিংহ কুকুর সহ, পাখিদের মধ্যে বহুল প্রচলিত এটি। হাতী বা গণ্ডার পর্যন্ত এমন আচরণে অভ্যস্ত। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন পেঙ্গুইন আফ্রিকান ডাক ইত্যাদি পাখিরা সমকামী আচরণ করে থাকে। বহু ক্ষেত্রে শুধু মাত্র সন্ততিজন্মের কারণে তারা স্ত্রী পাখিটির সঙ্গে মিলিত হয়। ডিম দেওয়া হয়ে গেলে তারা তাকে ছেড়ে অন্য পুরুষসঙ্গীকে গ্রহণ করে ও বাসা বাঁধে। সেখানেই ডিম ফুটে বের হওয়া ছানাদের বড় করে। তাহলে এটি প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়! এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি প্রবৃত্তি। আর তার জন্য লজ্জার কিছুই নেই। ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়েছে, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই নারীসুলভ এবং পুরুষসুলভ গুনাগুণ ও চিহ্ন বর্তমান। কোনটি প্রকট থাকে তার ওপরেই নির্ভর করে সেই মানুষটির লিঙ্গপরিচয়। কখনও প্রকট গুণের সঙ্গে সঙ্গে দুএকটি প্রচ্ছন্ন গুণ ভেসে ওঠে। তখনই মানুষটি নিজের যৌনচেতনা নিয়ে বিহ্বল হয়। অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি বিশয়কে তাই অকারণে জটিল করা হয়েছে এতকাল।

এই সামাজিক ও পারিবারিক চাপের ফলে আমরা সেভাবে সমকামী মানুষের অস্তিত্ব টেরই পাইনা। কখনও, যখন তার পক্ষে নিজের পরিচয় গোপন করে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছেনা তখনই আমরা জানতে পারি, এই মানুষটি সমকামী। তাই এভাবে সামগ্রিক চিত্র আঁকা অসম্ভব বটে, তবে আমি যে তথাকথিত শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সমাজের একজন, তার দুটি খণ্ডচিত্র হাজির করি।

সে কেন জলের মতো একা একা ঘুরে ঘুরে কথা কয়?এক নির্জনতার কবি এরকমই একটি লাইন লিখেছিলেন মনে পড়ে। একা কৈশোর যখন নিজের সঙ্গে নিজে একা কথা বলে। আত্মমগ্ন বিষাদে কাল কাটায় তখন আমরা যে নির্দিষ্ট ছাঁচে তাকে ফেলি, তা হলো অন্তর্মুখ স্বভাব। সে একা থাকতে ভালোবাসে। মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালবাসেনা। নিজেকে নিয়ে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই একা কিশোর বা কিশোরী হয়ত নিজেকে নিয়ে শঙ্কিত। কি একটা সে আবিষ্কার করে ফেলেছে যা পরিচিত গণ্ডীতে নজরে পরেনা। এমন এক আলোছায়ার মধ্যে সে বাঁচছে যে সে কথা খুলে কাউকেই বলা যায়না।

এই গল্প কিছুকাল আগের। এই ধরা যাক পঁচিশ বছর আগের। তখনও পৃথিবী একটি মাত্র গ্রামে পরিণত হয়নি। তখনও বিদেশের সংবাদ পেতে টেলিভিশন এবং খবরের কাগজই ভরসা। বিদেশী সাহিত্যের আনাচে কানাচে পৌঁছে যাওয়াও সহজ ছিলোনা। সেই সময়ের কথা। এক কিশোরী, যার পরিবার মধ্যবিত্ত আর পাঁচটা পরিবারেরই মতন। যার বড় হবার পর সৎপাত্রে পাত্রস্থ হওয়াই একমাত্র গতি ছিল। বিয়ে যথাসময়ে হলো। কলেজ স্কুলে কখনও ছেলেদের সঙ্গে সেইভাবে না মেশার ফলে প্রেম করে সে বাবা মায়ের অস্বস্তি তৈরি করেনি বলে পরিচিত মহলে বেশ সুনাম ছিল। আহা, কি ভালো মেয়ে। কারোর দিকে চোখ তুলে তাকায়না। স্বভাবটাও কি ভালো। বাচাল নয়। শান্ত চুপচাপ। এমন মেয়ের পাত্র জুটতে দেরি হয়নি। তার বিয়ের পর সে যথানিয়মে মা হলো। কিন্তু আপাতসুখের আড়ালে তার ক্রমশ ম্রিয়মাণ ক্লান্ত চেহারা দেখে আত্মীয়রা অবাক হয়েছে। ‘কেন রে? তুই এমন হয়েছিস কেন? কেমন সুন্দর স্বামী সন্তান নিয়ে সংসার!’ তরুণী তো নম্র চাপা। সে ম্লান হেসেছে। মেয়েকে এরকম শুকিয়ে যেতে দেখে তার আলোকপ্রাপ্তা অধ্যাপিকা মা তাকে কাছে বসিয়ে অন্তরঙ্গ জীবনের খেদ নিয়েও প্রশ্ন করেছেন। এবং জেনেছেন স্বামীটি অত্যন্ত ভদ্র। তার দিক থেকে কোনও নিরানন্দের কারণ ঘটেনি। তবে? তিনি তাকে কাছে এনে রেখেছেন। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চেয়েছেন দুঃখ কেন। তার একা ঘরে তাকে তো যন্ত্রণা দেবার কেউ নেই? অবশেষে আদরে নরম হয়ে মেয়েটি বলেছে তার যন্ত্রণার কথা। স্বামী সংসর্গ তার ভালো লাগেনা। পুরুষের সঙ্গে দৈহিক সংসর্গে তার বিরক্তি জাগে। জন্ত্রনা হয়। দিনের পর দিন বছরের পর বছর এরকম যন্ত্রণা সে সহ্য করে চলেছে। বলা বাহুল্য স্বামীটি তার এসব কিছুই জানেনা। সে ছেলে নিজেও তো বোঝেনা। সে ভেবেই নিয়েছে তার স্ত্রী হয়ত তত আগ্রহী নয়। শরীর ভালবাসেনা। কখনও ঠাট্টা করে বলেছে- দেখো সন্ন্যাসী হয়ে যেওনা। মেয়েটিও যে তাকে ভালোবাসেনি তা নয়। এ সংসারে ভালোবাসা আছে, প্রেম নেই। অগত্যা মা তাকে মনোবিদের কাছে নিয়ে গেলেন। এমন স্বামী তার! অথচ তাকে ভালো লাগেনা? অন্য কাউকে ভালোবেসে থাক্লেও তো কথা ছিল! এমন বৈরাগ্য কেন? সেই প্রথম মেয়েটি বন্ধু পেলো। মনোবিদের কাছে সে নিজেকে মেলে ধরল। তিনি তাকে চিকিৎসা করেছিলেন মুলত দুটি কারণে। প্রথম, তার বাস্তব পরিস্থিতি সহনীয় করতে। দ্বিতীয়, মেয়েটি যাতে তার ব্যক্তিগত প্রবৃত্তিকে মেনে নিতে পারে, নিজেকেই ঘেন্না না করে, সেই কারণে। নানা আলোচনার মধ্যে থেকে মনোবিদ বুঝেছিলেন সে চিরকাল সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছে। আর সেই কারণে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। তার ওপরে নিত্যকার দাম্পত্যের যন্ত্রণা মুখ বন্ধ করে সহ্য করে এসেছে এতকাল। চিকিৎসায় উপকার হয়েছিল। মেয়েটি নিজের দিকে তাকিয়ে আর ঘেন্না করেনি। মনোবিদের নিভৃত ঘরের বাইরে আমরা গুটিকয় ভাইবোন তার এই কষ্টের কথা জেনেছিলাম। কিন্তু এতকাল পর, তার কষ্টের কথা ভেবেই কোনোদিন তাকে প্রশ্ন করতে পারিনি যে কে সেই মেয়ে যার প্রেমে সেই কিশোরী প্রথম ডুবেছিল। তবে তার পারিবারিক পরিস্থিতি অন্য অনেকের চেয়ে অনুকুল ছিল। সেও নিজেকে বিষাদ থেকে বের করে আনতে পেরেছিল। মনোবিদের পরামর্শে সে সৃষ্টিশীল কাজে জড়িয়েছিল। কারণ, তখন তার আর সেই নিরাপদ সাংসারিক পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব ছিলোনা। অর্থনৈতিক নিরাপত্তাও তো আমাদের মানসিক বিকাশে প্রয়োজন!

এসময়ের একটি ঘটনা বলি। এক চিত্রশিল্পী বাবা মায়ের আদরের সন্তান। ছেলেটিও প্রতিভাবান। মেধাবী। ভারী মিষ্টি চেহারার ছেলে সে। মায়ের সঙ্গেই বেশি ভাব তার। সুন্দরী মায়ের সাজের সময় সে মুগ্ধ হয়ে মাকে দেখত। মা কখনও হেসে একটা টিপ পরিয়ে দিয়েছেন। সেই ছেলেটি বড় হবার সময়ে তার বন্ধুবৃত্তের মধ্যেই একজনকে ভালোবেসে ফেলে। এখন দিন বদলেছে। নিজের ভালো লাগা বা ভালোবাসার কথা বলতে ইতস্তত করার কিছু নেই। এই ছেলেটিও চুপচাপ। বন্ধুবৃত্তটি ছোট। তাই তার ভালোলাগার কথাটি ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগলনা। বন্ধুদের একজন তার মনের কথাটি সেই ভালোবাসার পাত্রটিকে জানিয়ে দিলো। কিন্তু বিপদ অন্যভাবে দেখা দিলো। ভালোবাসার পাত্রটি হতবাক হয়ে গেলো। সে স্বপ্নেও ভাবেনি যে কোনও ছেলে তাকে প্রেম নিবেদন করতে পারে। সে কি তবে যথেষ্ট পুরুষালি নয়? প্রত্যাখ্যানের পর সে স্বাভাবিক ভাবেই সেই কিশোরের সঙ্গ এড়িয়ে চলতে লাগল। সমানে অনুরোধ, কান্নাকাটি, দেখাকরার আবদার চললেও সে ছেলে পাত্তা দিলনা। সে স্পষ্ট জানিয়ে দিলো, তাকে বন্ধু হিসেবেই দেখেছে এতকাল। সে একটি মেয়েকে ভালোবাসে। তাকে নয়। এরপর বন্ধুদের মধ্যে সবাই যে তার প্রতি সহানুভূতিশীল রইল তা নয়। অনেকেই আড়ালে বলতে লাগল- ও যে এরকম তা তো জানতাম না? হাসিঠাট্টা তির্যক মন্তব্য শুরু হয়ে গেলো। এই ছেলেটি শেষ পর্যন্ত অন্য স্কুলে ভর্তি হলো। মনোবিদের কাছেও গেল মায়ের হাত ধরে। মা সেখানে বললেন- ও ছোট থেকে আমার শাড়ি নিয়ে খেলতে ভালবাসত। কিন্তু ভেবেছিলাম মনের মধ্যে হয়ত একটা মেয়েও বাস করে। এমন তো কতই হয়। মেয়েলি পুরুষেরা দারুন ভালো মনের হয়। মনোবিদ খুব খুশি হয়েছিলেন। মা নিজে শিল্পী বলেই হয়ত এতটা ভাবতে পেরেছিলেন। ছেলেটিকে তিনি বুঝিয়েছিলেন, একজন নিশ্চয় আছে যে তাকে ভালবাসবে। তার সেই সঙ্গীর জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

এই দুটি ঘটনা বলে দিচ্ছে আপাত স্বাভাবিক জীবন যাপনের অন্তরালে প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালে কিছু কিছু এমন বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। আর ঘটনা দুটির মধ্যে পার্থক্য এই, যে সমাজ এখন এই তৃতীয় চেতনাটিকে মান্যতা দিচ্ছে। তাই বা কম কি? এই মানুষগুলো আমাদেরই প্রিয়জন। এদের জন্য আরও অনেক ভালোবাসা প্রয়োজন। ঠিক যেমন দেখতে পাচ্ছি মিস ট্রান্সজেন্ডার ইন্ডিয়া অ্যানি দত্ত চক্রবর্তী একজন প্রেমিক স্বামী পেয়েছেন। পরিবারের সহানুভূতি পেয়েছেন। তাঁর মতো স্বপ্নের জীবন যদি সবার হয় তার চেষ্টাই করা উচিত। নিছক একটা বিরুদ্ধ মিথ্যে ধারণার বশবর্তী হয়ে সহদেশবাসী বা পৃথিবীবাসীকে বিষাদে ঠেলে দেওয়া অপরাধ।



[শারদীয়া আত্মজা ২০১৯]

0 comments:

0

প্রবন্ধ - দিলীপ মজুমদার

Posted in




















-“ আমি তখন পড়ছিলাম । ছেলে হিকারি শুনছিল মিউজিক । আমার অন্য ছেলে যে টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ো-কেমিস্ট্রির ছাত্র এবং আমার মেয়ে সোফিয়া ছিল ডাইনিং টেবিলে । এরা কোনদিন আশা করে নি যে আমি নোবেল প্রাইজ পাব । তখন রাত পৌনে ন’টা । একটা ফোন কল এল। ফোনটা ধরল হিকারি । বাড়িতে ফোন এলে হিকারই ফোনটা ধরে । ফোনে কথা বলা , উত্তর দেওয়া তার শখ । ‘হ্যালো , কেমন আছেন ? ‘ ওদিক থেকে কেউ বলছেন । ফরাসি , রাশিয়ান , জার্মান , চিনা ও কোরিয়ান ভাষায় । হিকারি ইংরেজি ভাষায় শুধু বলল ‘নো’ , একটু পরে সে ‘নো’ শব্দটার পুনরাবৃত্তি করল । এরপর সে ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিল । যিনি ফোন করেছেন , তিনি সুইডিশ অ্যাডেমির একজন সদস্য । তিনি প্রশ্ন করলেন , ‘আপনি কি কেনজাবুরো ওয়ি ? আপনি নোবেল পেয়েছেন । ‘ আমি জানতে চাইলাম হিকারি কি বলেছে , সে নোবেল প্রত্যাখ্যান করেছে কি না । যখন জানলাম এ ব্যাপারে হিকারি কিছুই বলে নি , তখন আমি পুরস্কার গ্রহণের সম্মতি জানালাম । ফোন রেখে আমি ডাইনিংএর চেয়ারে বসলাম । আমার ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে বললাম নোবেল পাওয়ার কথা । আমার স্ত্রী রুদ্ধশ্বাসে বলল . ‘ঠিক তো ?’

এসব ১৯৯৪ সালের কথা । জাপানের দ্বিতীয় নোবেল প্রাপ্তি । ১৯৬৮ সালে ইয়াসুনারি কাওয়াবাতা পেয়েছিলেন নোবেল , ১৯৯৪ তে পেলেন কেনজাবুরো । ‘আ পার্সোনাল ম্যাটার’এর জন্য এই বিশ্বখ্যাত পুরস্কার । না, কোন গোল , মজাদার গল্প নেই উপন্যাসটিতে । কাওয়াবাতার রচনাভঙ্গির সঙ্গে মিল নেই কেনজাবুরোর । একজন হতাশ , বিষণ্ণ , বিক্ষুব্ধ মানুষের বিহ্বল অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে উপন্যাসটিতে।

জাঁ পল সাত্রে , আলবের ক্যামুর মতো কেনজাবুরো বেছে নিয়েছেন চেতনাপ্রবাহ রীতিকে । উপন্যাসের নায়ক বার্ড নামে একটি মানুষ । এই বার্ড তো কেনজাবুরো নিজে্ই । বার্ড এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন । এক বিকলাঙ্গ পুত্র জন্মেছে তার । মাথায় হার্নিয়ার জন্য তার মাথার খুলি অস্বাভাবিক স্ফীত। অথচ অবাক কাণ্ড সে ছেলের বুদ্ধিবৃত্তি ও সংবেদনশীলতা কম নয় । এই বিকলাঙ্গ সন্তানকে নিয়ে হতাশা জাগে বার্ডের মনে । সে কখনও ভাবে পালিয়ে যাবে সংসার ছেড়ে । পালিয়ে যাবে সুদূর আফ্রিকায় ।

আবার কখনও ভাবে মেরে ফেলবে পঙ্গু ছেলেটাকে । শেষ পর্যন্ত সে কিছুই করতে পারে না । বিক্ষত হতে থাকে অন্তর্দ্বন্দ্বে । আমরা জানি কেনজাবুরোর ছেলে হিকারিও প্রতিবন্ধী । উপন্যাসের নায়ক যেন এই যুগের প্রতিনিধি । যাকে প্রতিদিন প্রতিকারহীন পরাভবের মধ্যে দিয়ে চলতে হয় । হিকারি আর হিরোশিমার বোমা , তাঁর লেখার প্রধান প্রেরণা । ১৯৩৫ সালে জাপানের সবচেয়ে ছোট দ্বীপ শিকোকুতে কেনজাবোরোর জন্ম । হিরোশিমাতে যখন পারমাণবিক বোমা পড়ে তখন তিনি শিশু । কিন্তু বোমাবিধ্বস্ত হিরোশিমার আর্তনাদ গেঁথে যায় তাঁর সত্তায় । তিনি নিজেই বলেছেন যে তাঁর জীবনে দুটি ঘটনার প্রভাব গভীর – হিরোশিমার বোমা আর হিকারির যন্ত্রণা ।

কানজাবুরো উচ্চশিক্ষা লাভ করেন টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে । তাঁর বিষয় ছিল ফরাসি সাহিত্য । সেই সূত্রে তিনি পরিচিত হলেন ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে । জাপানি সাহিত্যে তিনি নিয়ে এলেন আধুনিকতা নতুন প্রকাশভঙ্গির ব্যাপারে সজাগ ছিলেন তিনি । কানজাবুরো বলেছেন , ‘আমি জাপানি ভাষায় নতুন এক লিটারারি স্টাইল তৈরি করতে চেয়েছিলাম সচেতনভাবে । জাপানি লেখকদের মধ্যে তানিজাকি ও কাওয়াবাতা ক্ল্যাসিকাল ঐতিহ্য অনুসরণ করেছিলেন , আমি আলাদা কিছু লিখতে চেয়েছিলাম । ‘

কালানুযায়ী তাঁর রচনার তালিকা এই রকম : আ পার্সোনাল ম্যাটার ( ১৯৬৪) , দ্য সাইলেন্ট ক্রাই (১৯৬৭), দ্য ওয়াটার্স কাম ইন আনটু মাই সোল ( ১৯৭৩) , দ্য পিঞ্চ-রানার মেমোরেণ্ডাম (১৯৭৬) , দ্য গেম অব কনটেমপোরারিটি (১৯৭৯) , ‘আ কালেকশন অব গ্রটেস্ক স্টোরিজ’ (১৯৮১) , ‘ওম্যান হু লিশন টু রেইন ট্রি ( ১৯৮৩), ‘রাইজ আপ ও ইয়ং মেন অব নিউ এজ” ( ১৯৯০) ।

আত্মমগ্ন লেখক ছিলেন কেনজাবুরো । কিন্তু গজদন্তমিনারবাসী ছিলেন না কদাচ । তাঁর দৃষ্টি উন্মোচিত করে দিয়েছিল হিরোশিমার বোমা । পরে লিখেছিলেন ‘হিরোশিমা নোটস’ । যেমন ওকিনাওয়ারের গণহত্যা নিয়ে লিখেছিলেন ‘ওকিনাওয়া নোটস’ । গুন্টার গ্রাস , অ্যালান গিনসবার্গ. কুট ভনে গার্ট , কিম চি হা-র মতো ঠাণ্ডা যুদ্ধ ও পারমানবিক যুদ্ধের হাত থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে চেয়েছেন । সামিল হয়েছেন পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে । আওয়াজ তুলেছেন , ‘ রক্ষা করো আমাদের পৃথিবীকে , রক্ষা করো গাছপালা আর মানুষকে’ ।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in




















২৩শে জানুয়ারি দিনটি আমাদের কাছে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে ভারতমাতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর সন্তান নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু-র জন্মদিন হিসেবে। উড়িষ্যার কটক শহরে উক্তদিনে নেতাজী জন্মেছিলেন ১৮৯৭ সালে। আবার ঐ একই দিনে আরেক কিংবদন্তির জন্মদিন যিনি বিপ্লব আন্দোলনে না থাকলেও শিক্ষা আন্দোলনে তথা শিক্ষার ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। বলা যায় যে, তাঁর ‘ফার্স্ট বুক’ পড়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গসমাজ ইংরেজি শিখেছিল। তাঁর নাম প্যারীচরণ সরকার– অনেকের কাছে প্যারী সরকার। তিনি জন্মেছিলেন ১৮২৩ সালের ২৩শে জানুয়ারি। আর তাই এই বছর পালিত হয়েছে তাঁর দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী। তাঁর জন্মস্থান কলকাতা শহরের চোরাবাগানে। তাঁর পিতার নাম ভৈরবচন্দ্র সরকার। কলকাতাতে জন্মালেও প্যারীচরণ সরকারদের আদি নিবাস ছিল হুগলী জেলার তড়াগ্রামে। প্যারীচরণ ডেভিড হেয়ার সাহেবের পটলডাঙ্গা স্কুলে পড়েছিলেন। পরে পড়েছিলেন হিন্দু কলেজে (যা বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়)। ১৮৪৩ সালে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে হুগলী স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৮৪৬-১৮৫৪ এই আট বছরে তিনি বারাসাত স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন। বারাসাত স্কুলের প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন প্যারীচরণ, নবীনকৃষ্ণ ও কালীকৃষ্ণ মিত্র একসাথে উদ্যোগী হয়ে ভারতীয়দের দ্বারা পরিচালিত প্রথম বেসরকারি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তবে এই বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য তাঁদের অনেক বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল এমনকি দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, সমাজের থেকে নিন্দাও পেয়েছিলেন। তবুও তাঁরা উদ্যোগী হয়ে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে মাইলস্টোন স্থাপনের কাজ করে গেছেন। যাইহোক, এই উল্লেখযোগ্য কাজের পাশাপাশি প্যারীচরণ সরকার কৃষি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন আর তার সাথে কারিগরি শিক্ষার বন্দোবস্ত করেন। এভাবেই তিনি কৃষি ও


শিল্প দুইয়েরই পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিলেন আর সেই জন্যে এক শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদ হিসেবেও সুনাম অর্জন করেন। এরপরে, তিনি দীর্ঘ আট বছর ছিলেন কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তাঁরই প্রধান উদ্যোগে ওই স্কুলের নাম হয় ডেভিড হেয়ারের নামে ‘হেয়ার স্কুল’। ১৮৬৩ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে (পূর্বে যার নাম ছিল হিন্দু কলেজ) অস্থায়ী অধ্যাপকের কাজ পান। তার বছর চারেক পরে, ১৮৬৭ সালে স্থায়ী অধ্যাপকের কাজ পান যা তিনি আমৃত্যু পালন করে যান।

রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ইত্যাদি মনীষীর মতো প্যারীচরণ সরকারও ছিলেন বাংলা নবজাগরণের অন্যতম দূত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার যে নবজাগরণ ঘটেছিল বিশেষ করে শিল্প, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে তাতে সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন প্যারীচরণ সরকার‌‌‌। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের থেকে বছর আড়াই ছোট হলেও তিনি ছিলেন যেন বিদ্যাসাগরের প্রকৃত সুহৃদ। এমনকি, বিধবা-বিবাহ প্রচারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরকে সাহায্যও করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের মতোনই তিনিও স্ত্রী-শিক্ষা বিস্তারের জন্যে অনেক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বেথুন স্কুলে মেয়েদের যেন পাঠানো হয় সেই ব্যাপারে অভিভাবকদের তিনি বোঝাতেন বা প্রভাবিত করতেন। নারী শ্রমিদের সন্তানরা যাতে পড়তে বা শিখতে পারে সেজন্য তিনি করেছিলেন কারিগরি বিদ্যালয়। কৃষি বিদ্যালয়ে যাতে বিজ্ঞান-শিক্ষা ভালোভাবে বা‌ সুষ্ঠুভাবে হয় তারও বন্দোবস্ত তিনি করেছিলেন।

১৮৬৬ সালে সরকারি সংবাদপত্র ‘এডুকেশন গেজেট’-এর সম্পাদক হন। কিন্তু এর মাত্র দুই বছর পরে অর্থাৎ ১৮৬৮ সালে পূর্ববঙ্গ রেলপথে ঘটে যাওয়া এক দুর্ঘটনার সত্যিকরের বিবরণ মন্তব্যসহ প্রকাশ করায় তৎকালীন পরাধীন ভারতের ইংরেজ সরকারের সাথে তাঁর মতনৈক্য হয়। আর এই মতনৈক্যের ফলস্বরূপ তিনি ঐ সরকারি সংবাদপত্রের সম্পাদকের পদ থেকে সরে যান। এতটাই আত্মমর্যাদবোধ ছিল তাঁর মধ্যে যা আজকের বাংলার তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও দেখা পাওয়া ভার। মাদকাসক্ত আজকের দিনের এক জ্বলন্ত সমস্যা। কত সংসার ভাঙছে,কতজন জীবন শেষ করার দিকে চলে যাচ্ছে, কতজনের সম্মানহানি হচ্ছে – সবই অতিরিক্ত মদ্যপানের জন্যে। ভাবতে অবাক লাগে যে, আজ থেকে প্রায় দেড়শো

বছর আগে প্যারীচরণ সরকার‌‌‌ মাদকাসক্তের এই অতি করুণ পরিস্থিতি বা বলা ভালো করুণপরিণতির কথা ভেবেছিলেন। ১৮৭৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘বঙ্গীয় মাদক নিবারণী সমাজ’ যার নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে এর মূল উদ্দেশ্য ছিল মদ্যপান নিবারণের চেষ্টা করা। ভাবতে অবাক লাগে, আজ যখন মদ্যপানের হিড়িক দেখা যাচ্ছে সমাজে (এমনকি বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরকারি মদতেও), কত সংসার ভাঙছে, কত মানুষ মদের নেশায় তলিয়ে গিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে তখন কিন্তু কোনও বুদ্ধিজীবীকে দেখা যাচ্ছে না এর প্রতিবাদ করতে। বরং বড়োই দুঃখের বিষয় যে, অনেক বুদ্ধিজীবী আছেন যাঁরা এই মধ্যপানের আসক্তির গড্ডালিকা প্রবাহে তলিয়ে দিচ্ছেন নিজেদের। তাহলে, কতখানি ব্যতিক্রমী ও সচ্চরিত্রের মানুষ ছিলেন প্যারীচরণ, ভাবা যায়! হয়তো বাধাও এসেছিল কিন্তু তা কাটিয়ে নিজের লক্ষ্যে স্থির থেকেছেন।

সামাজিক কাজকর্মের পাশাপাশি প্রকাশ করেন দুটি পত্রিকা– ‘ওয়েল উইশার’ এবং ‘হিতসাধক’। ভারতীয় বিশেষ করে বাঙালি শিশুদের ইংরেজি শেখাতে হবে আর তার জন্য তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত ইংরেজি শেখানোর পাঠ্যপুস্তকের সিরিজ। ১৮৫০ সালে স্কুল বুক প্রেস; থেকে তাঁর লেখা প্রথম পাঠ্যপুস্তক ‘First Book Of Readings (পুরো নাম অবশ্য ;First Book of Reading for Native Children;)’ প্রকাশিত হয়। প্রথমটির পরের বই ‘Second Book Of Readings’। ১৮৫১ থেকে ১৮৭০ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয় তাঁর এই বুক অফ রিডিংস;-এর দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ খণ্ড। একসময় এই সিরিজের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে এমনকি ইংরেজি শেখার অপরিহার্য বই হিসেবে হয়ে উঠেছিল এই দুই বই। এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইংরেজি শেখার হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর এই বই পড়ে। উত্তর কলকাতাতে ছিল তাঁর বাড়ি ও ছাপাখানা। ‘The tree of intemperance’ নামক একটি বই তিনি লিখছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তা শেষ করতে পারেননি। এই অসমাপ্ত বইটি ছিল তাঁর শেষ বই। বইপত্তর লেখা, মেয়েদের স্কুল স্থাপন, মাদক নিবারণী সমাজ গঠন, পত্রিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনা করার পাশাপাশি তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব হল ‘ইডেন হিন্দু হোটেল’ স্থাপন করা। এই মহান শিক্ষাব্রতী, যাঁকে বাংলায় নারী শিক্ষার অগ্রদূত হিসেবে ‘The Arnold of the East’ বা প্রাচ্যের আর্নল্ড বলে সম্মানিত করা হত সেই তিনি ৩০শে সেপ্টেম্বর, ১৮৭৫ সালে মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যান। ‘প্যারী সরকারের ইংরেজির ফাস্ট বুক’– এভাবেই দ্বিশততম জন্মবার্ষিকীতে এসেও বাঙালি তার এই আদি ও কিংবদন্তি ইংরেজি শিক্ষককে মনে রেখেছে।




তথ্যসূত্রঃ-

বাঙালি চরিতাভিধান, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা।
উইকিপিডিয়া
প্যারীচরণ সরকার এর জীবনী, আজ বাংলা.ইন ওয়েবসাইট

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in







এক

রবিবাবু ও গরুর হাটের কথা



গ্রামের নাম পাঁচুন্দি। সামনে একটা গরুর হাট আছে। সেই গরুর হাটকে কেন্দ্র করে এখানে নানা রকমের ব্যবসা গজিয়ে উঠেছে। বিভিন্ন দোকান পাসারি আছে। হাট বসে প্রতি বুধবার। রবিবাবু এখানকার গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। তিনি খুব দয়ালু এবং ভদ্রলোক বলে পরিচিত।

পাঁচুন্দি কাউ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বিরু শেখ জানান, গত বছর অনলাইনে ২৭ হাজার গরু বিক্রি হয়েছিল৷ এবার টার্গেট করা হয়েছে এক লাখের মতো৷ তবে পরিস্থিতি দেখে তারা মনে করছেন বিক্রি আরো বেশি হবে৷ করোনা এবং ব্যাপক প্রচারের কারণে অনলাইন হাটের প্রতি আগ্রহ এবার বাড়ছে৷অনলাইনে ছবি ও ভিডিও দেখেই গরু কিনতে হবে৷ তবে খামার বা হাটের পাশে কারো বাড়ি হলে দেখার সুযোগ থাকবে৷ আর তা না হলে গরুটি সরবরাহের সময়ই দেখা যাবে৷ তবে অনলাইনে দেখা গরু আর বাস্তবের গরুর মিল না থাকলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গাইড লাইন অনুযায়ী সমাধান হবে৷ এবার অনলাইনে গরু কিনে কোরবানির দায়িত্বও দেয়া যাবে৷ অনলাইন হাট থেকে একদম কোরবানি করে বাড়িতে মাংস পৌঁছে দেওয়া হবে।করোনার মধ্যে নির্ধারিত সময়ের আগেই এবার গেরামসহ সারাদেশে কোরবানির গরুর হাট বসেছে৷ হাটের জন্য রয়েছে কয়েকটি শর্ত৷ প্রথম শর্ত দুমাসের আগে গরুর হাট বসানো যাবে না৷ কিন্তু হাটে গরু আনা শুরু হয়েছে ১০ দিন আগে৷শর্তে বলা হয়েছে, হাট বসার দু দিনের বেশি আগে গরু আনা যাবে না৷আবাসিক এলাকায় গরুর হাট বসানোতেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে৷ অথচ রেলওয়ে কলোনির আবাসিক এলাকার মাঠ গরুর হাটের জন্য ইজারা দিয়েছে সিটি কর্পোরেশন নিজেই৷ সারাদেশে নানা জায়গাতেই যেখানেসেখানে বসছে হাট৷ ইজারা দেয়াও শেষ৷ কিন্তু নির্ধারিত সময়ের আগে গ্রামে এই এলাকায় গরুর হাট বসে গেছে৷ ক্রেতারাও যাচ্ছেন কোরবানির জন্য গবাদি পশু কিনতে৷ এই করোনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনেই গরুর হাটের কথা বলছে পঞ্চায়েত৷ তবে পুরোপুরি হাট শুরু হলে বাস্তব অবস্থা আরো স্পষ্ট বোঝা যাবে৷বিক্রেতা ও ক্রেতাদের জন্য যে অনেকগুলি শর্ত দেয়া হয়েছে তার বড় একটি অংশ করোনায় স্বাস্থ্যবিধি, সামাজিক দূরত্ব ও মাস্ক সংক্রান্ত৷বলা হচ্ছে, গরুর হাটে পুরো স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে ৷ গরুগুলোকে এমনভাবে রাখতে হবে যাতে ক্রেতারা নিজেদের মধ্যে তিন ফুট দূরত্ব বজায় রেখে হাটে অবস্থান করতে পারেন৷ সেভাবেই হাটে গবাদি পশু তুলতে হবে৷ এর বেশি পশু রাখা যাবে না৷হাটে ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইকে মাস্ক পরতে হবে৷ আর গরু কিনতে দুই জনের বেশি হাটে যেতে পারবেন না৷ হাটের আয়তন অনুযায়ী সামাজিক দূরত্ব রেখে যত জন ক্রেতা এক সঙ্গে প্রবেশ করতে পারেন, ততজন প্রবেশ করবেন৷ বাকিরা বাইরে অপেক্ষা করে পর্যায়ক্রমে প্রবেশ করবেন৷হাটে প্রবেশের পথে শরীরের তাপমাত্রা মাপা ও সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকবে৷ হাটের ভিতরেও হাতধোয়ার ব্যবস্থা৷হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থাও রাখতে হবে প্রতিটি হাটে৷ এছাড়া হাটে আইসোলেশন সেন্টার ও মেডিকেল টিম থাকবে৷ তারা প্রয়োজন হলে কাউকে দ্রুত আইসোলেশন সেন্টারে নিয়ে যাবেন৷ থাকবে ভ্রাম্যমাণ আদালত, সিটি কর্পোরেশনের টিম এবং জাল টাকা চিহ্নিত করার বুথ৷ কোনো হাটে জোর করে গরু নেয়া যাবে না৷রবিবাবু সব্জিহাটে গিয়ে শিবপদকে বলেন,কি হে লেখকমশাই কেমন আছো? মুখে মাস্ক পর নাই কেন হে?বিজয় বলেন,পকেটে আছে।পুলিশ দেখলেই পরে নেব।আগে গরুদের মুখে মাস্কের মত জাল পরানো হত আর এখন দেখুন আমরাই গরু হয়ে বসে আছি।

রবিবাবু বললেন,তোমরা লেখক মানুষ। কল্পনাশক্তি বটে।ঠিক বলেছ কথাটা, একদম ঠিক।

বিজয় বলল,করোনার আগে আপনি আর আমি ঘুরে এলাম বেলুন থেকে।আর একবার যাবেন নাকি?

রবিবাবু বললেন,তোমাকে বলা হয় নি। গতকাল ঘুরে এলাম আবার।তুমি তো জানো, আমি দূর দূরান্তে না গিয়ে কাছাকাছি না দেখা গ্রাম দেখতে ভালোবাসি।এবার গেলাম পাশের ইকো ভিলেজ পরিদর্শনে।হাওড়া আজিমগঞ্জ লোকাল ধরে শিবলুন হল্টে নামলাম। সেখান থেকে অম্বলগ্রাম পাশে রেখে দু কিলোমিটার টোটো রিক্সায় গেলে গ্রামটি পাবে। একদম অজ পাড়াগাঁ। মাটির রাস্তা ধরে বাবলার বন পেরিয়ে তন্ময়বাবুর স্বপ্নের জগতে প্রবেশ করলাম।তন্ময়বাবু ঘুরিয়ে দেখালেন। তার জগৎ।প্রায় একশো প্রজাতির গাছ।পশু,প্রাণীদের উন্মুক্ত অঞ্চল।বিভিন্ন প্রজাতির সাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে, সেখানে।তার নিজের হাতে বানানো মা কালীর মূর্তি দেখলাম। কাঁচের ঘরে ইকো সিষ্টেমের জগৎ।কেউটে সাপ, ব্যাঙ থেকে শুরু করে নানারকমের পতঙ্গ যা একটা গ্রামের জমিতে থাকে। বিরাট এক ক্যামেরায় ছবি তুলছেন তন্ময় হয়ে।আমি ঘুরে দেখলাম প্রায় দু কোটি টাকা খরচ করে বানানো রিসর্ট।ওপেন টয়লেট কাম বাথরুম।পাশেই ঈশানী নদী।এই নদীপথে একান্ন সতীপীঠের অন্যতম সতীপীঠ অট্টহাসে যাওয়া যায় নৌকায়। তন্ময়বাবু হাতে সাপ ধরে দেখালেন। শিয়াল,বেজি,সাপ,ভ্যাম আছে। তাছাড়া পাখির প্রজাতি শ খানেক।একটা পুকুর আছে। তার তলায় তৈরি হচ্ছে গ্রন্হাগার।শীতকালে বহু বিদেশী পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন। তন্ময়বাবু বললেন,স্নেক বাইটের কথা ভেবে সমস্ত ব্যবস্থা এখানে করা আছে। ঔষধপত্র সবসময় মজুত থাকে।তারপর গ্রামটা ঘুরে দেখলাম। এখানকার চাষিরা সার,কীটনাশক ব্যবহার করেন না। তারপর বিকেলে নৌকাপথে চলে গেলাম অট্টহাস সতীপীঠ।এখানে মা মহামায়ার ওষ্ঠ পতিত হয়েছিলো। সোনা মহারাজ এই সতীপীঠের প্রধান। তারপর দেখলাম পঞ্চমুন্ডির আসন।ঘন বনের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। মন্দিরে মা কালীর মূর্তি। রাতে ওখানেই থাকলাম।রবিবাবু বলেন,তার পরের দিন সকালে হাঁটাপথে চলে এলাম কেতুগ্রাম বাহুলক্ষীতলা। কথিত আছে এখানে মায়ের বাহু পতিত হয়েছিলো। এটিও একান্ন সতীপীঠের এক পীঠ।তীর্থস্থান। সুন্দর মানুষের সুন্দর ব্যবহারে মন ভালো হয়ে যায়।এর পাশেই আছে মরাঘাট। সেখান থেকে বাসে চেপে চলে এলাম উদ্ধারণপুর।এখানে লেখক অবধূতের স্মৃতি জড়িয়ে আছে।গঙ্গার ঘাটে তৈরি হয়েছে গেট,বাথরুম সমস্তকিছু।শ্মশানে পুড়ছে মৃতদেহ।উদ্ধারণপুর থেকে নৌকায় গঙ্গা পেরিয়ে চলে এলাম কাটোয়া। এখানে শ্রীচৈতন্যদেব সন্ন্যাস নেবার পরে মাথা মুন্ডন করেছিলেন। মাধাইতলা গেলাম। বহুবছর ব্যাপি এখানে দিনরাত হরিনাম সংকীর্তন হয় বিরামহীনভাবে। বহু মন্দির,মসজিদ বেষ্টিত কাটোয়া শহর ভালো লাগলো।বিজয় বলল,এবার গেলে আমাকে বলবেন।এখন আসি।

রবিবাবু বললেন,চলো আমিও যাই।স্কুলে যেতে হনে মিড ডে মিল আর সাইকেল দিতে।

আবার পরের সপ্তাহে রবিবাবু ও বিজয় মুখোমুখি হলেন।

রবিবাবুর গ্রামের পুজো আর কদিন পরেই।তাই সকলের মন খুশিতে ভরপুর।লেখক বিজয় বলে এই পুজোর ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলবেন আমাকে।রবিবাবু বলেন,নিশ্চয়ই। তবে তো তুমি লিখতে পারবে।

রবিবাবু বললেন,নদীর ধারে আমাদের গ্রাম।তাই এখানে কুমিরের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কুমিরদেবতা কালু রায়ের পুজো করা হয়। তাঁর পোশাক পৌরাণিক যুদ্ধ-দেবতার মতো।আরণ্যক দেবতার প্রাচীন পুজোপদ্ধতি মেনে কালু রায়ের পুজোয় বনঝাউ ফুলের নৈবেদ্য দেওয়া হয়।ধর্মঠাকুর কেবলমাত্র রাঢের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বান্দরা গ্রামের ধর্মঠাকুর, কালু রায় নামে পরিচিত। বন্ধুর সুবাদেই ঐ গ্রামের ধর্মরাজের পুজো দেখার সুযোগ হয়েছিল। বাহন-সাদা ঘোড়া। জনসাধারণের পূজার পর দুটি পালকিতে সারা গ্রাম এবং আশেপাশের গ্রামে ঘোরানো হয়। কিন্তু কূর্ম মূর্তি যেহেতু গ্রামের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় না, তাই প্রতীকি কালাচাঁদকে পালকি করে অন্যান্য গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। নিয়ম হল, যেখানে যেখানে কালাচাঁদের পালকি বাহকরা গ্রামের বাইরে পালকি নামান, সেখানে সেই পালকিকে আটকানো হয়। সেই সব গ্রামের লোকেরা নানারকম প্রশ্ন করেন। এ যেন সেই আদিকালের অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া আটকানো। তখন যুদ্ধ হত, যুদ্ধে পরাস্ত করতে পারলে ঘোড়া মুক্তি পেত। এখানে হয় প্রশ্নোত্তরের খেলা। যারা দেবতার পালকিকে আটকে দেন তারা প্রশ্ন করেন। আর সন্ন্যাসীরা, যারা সঙ্গে থাকেন তাদের এর উত্তর দিতে হয়। গ্রাম্য জীবনের এও এক আনন্দের উৎস। প্রথাগতভাবে সেগুলি যে খুব উচ্চমানের , তা হয়ত নয়। কিন্তু মন্দ লাগে না। গ্রাম্য জীবন, পুরাণ, ইতিহাস , মহাকাব্য অনেক কিছু মিশে আছে এগুলির সঙ্গে। ধর্মরাজের পূজার অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসাবে গ্রামের মানুষের গীত কয়েকটি প্রশ্নোত্তর এখানে উল্লেখ করা যেতেই পারে।স্থানীয় কিংবদন্তি অনুসারে, দক্ষিণরায়ের রাজত্বের সীমা দক্ষিণে কাকদ্বীপ, উত্তরে ভাগীরথী নদী, পশ্চিমে ঘাটাল ও পূর্বে বাকলা জেলা। প্রত্যেক অমাবস্যায় দক্ষিণরায় মন্দিরে পশুবলি হয়। লোকবিশ্বাস অনুসারে দক্ষিণরায় গানবাজনা পছন্দ করেন। তাই স্থানীয় লোকেরা রাতে তার মন্দিরে নাচগানের আসর বসান। দক্ষিণ রায়ের বার্ষিক পূজা উপলক্ষে গায়েনরা পালাক্রমে কবি কৃষ্ণরাম দাস রচিত রায়মঙ্গল পরিবেশন করে এবং বাউল্যা, মউল্যা, মলঙ্গি প্রভৃতি শ্রমজীবী মানুষেরা হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে এ গান ভক্তিভরে শ্রবণ করেন। সুন্দরবনের অধিবাসীরা ম্যানগ্রোভ জঙ্গলে মাছধরা, কাষ্ঠ বা মধু আহরণের মতো কোনো কাজে যাওয়ার আগে দক্ষিণরায়ের মন্দিরে পূজা দেন। কেউ কেউ মাথার পিছন দিকে দক্ষিণরায়ের মুখোশ পরে জঙ্গলে ঢোকেন যাতে বাঘ সেই মুখোশ দেখে ভয় পেয়ে তার কাছে না আসে।কলকাতার গড়িয়া রেলস্টেশনের কাছে লক্ষ্মীকান্তপুর ও ধপধপির কয়েক মেইল দূরে একটি দক্ষিণরায় মন্দির আছে। এই অঞ্চলটি এক সময়ে সুন্দরবনের অন্তর্গত ছিল। এখনও এই অঞ্চলের অধিবাসীরা দক্ষিণরায় মন্দিরে পূজা দেন। দক্ষিণরায়ের মূর্তিতে একটি বিরাট গোঁফ দেখা যায়। তার শরীর শীর্ণ, চকচকে এবং হলদেটে। গায়ে বাঘের মতো ডোরাকাটা দাগ দেখা যায়। মুখের দুদিক থেকেই লালা ঝরে। তার একটি ছয় মিটার দীর্ঘ লেজও আছে।বারা ঠাকুর হলেন পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশের বাঙালি হিন্দুসমাজে পূজিত এক অশাস্ত্রীয় লৌকিক দেবতা। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলি প্রভৃতি জেলার গ্রামাঞ্চলে এই দেবতার পূজা প্রচলিত; তবে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় এই বারাঠাকুরের পূজার প্রচলন অত্যধিক। 'বারা' শব্দের লোকায়ত অর্থ বাধা দেওয়া বা নিবারণ করা। মূলত ব্যাঘ্র-ভীতি নিবারণ ও সাংসারিক মঙ্গলকামনায় এই দেবতার পূজা করা হয়। ১লা মাঘ বা তার কাছাকাছি সময়ে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়।তাঁর সাথে (বিশেষত মাথার চালির অবয়বে) মিশরের ফারাওদের আঁকা ছবিগুলির (যাদের মাথা অনেক লম্বা — বিশাল দেহ — রাজা বা দেবতা) মিল আছে বলে ধারণা করা হয়।উল্টানো ঘট ও মাথায় লতা-পাতা আঁকা চ্যাপ্টা মুকুট — এটিই বারা ঠাকুরের মূর্তি। ঘটের উপর নানা রঙে আঁকা চোখ, মুখ, গোঁফ অঙ্কিত ধাকে। এই মূর্তিযুগলের গোঁফওয়ালা পুরুষমূর্তিটিকে দক্ষিণরায়-এর কাটা মুণ্ডু বলে মনে করা হয়, অপরটি তার মা নারায়ণী বা কালু রায়।খোলা মাঠে গাছতলায় গাছের গুঁড়ি বা শাখায় মূর্তি স্থাপন করে এঁর পূজা করা হয়। পূজায় বর্ণ ব্রাহ্মণ পৌরোহিত্য করেন; মূর্তির বিসর্জন হয় না। যে গাছে বারা ঠাকুর রাখা হয় তার সবচেয়ে উঁচু শাখায় একটি লালনিশান টাঙিয়ে দেওয়া হয়। শাস্ত্রীয় হিন্দু নিয়ম বহির্ভূতভাবে আগুনে পুড়িয়ে 'বারা' তৈরী হয় এবং পূজার পর সারাবছর খোলা আকাশের নিচে রেখে দেওয়া হয়।বারাঠাকুর পূজায় আদিমত্বের পরিচয় পাওয়া যায়, তবে অশাস্ত্রীয় হলেও ব্রাহ্মণ-শাসিত বর্ণহিন্দু সমাজ এঁকে স্বীকার করে নিয়েছেন।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(৪)

নবাবহাটে সম্প্রতি একটি দ্বাদশ শিবলিঙ্গের প্রতিষ্ঠা হয়েছে বলে এদিকটায় এখন বেশ জনসমাগম দেখা যায়। এর কাছেই একটা খই-বাতাসার চালা নিয়ে বসেছে এক বৃদ্ধ, এর নাম দাশু বিশ্বাস। লোকটি দেখতে আপাত নিরীহ হলেও আসলে সে রাণীমার হয়ে এই জনপদের অনেক গোপন খবরাখবর অন্দরমহলে সরবরাহ করে থাকে। দোকান ঘরটা তার বাইরের খোলসমাত্র।

" কে বাপ! এ মুক্ তো আগে দেখিনিকো! মনে হচ্চে বাইরে থেকে আসা হল! তা বেশ! রাণীমার তৈরী এই শিবক্ষেত্তর কালে কালে গয়া- কাশী'কেও ছাড়িয়ে যাবে...তা আমি এখুনি বলে রাখতেছি ! " এই বলে লম্বা শ্বাস টেনে সানুনাসিক সেই বৃদ্ধটি একটু থামলে পর, গোলকপতি অতি বিনয়ে বলে ওঠে , " আজ্ঞে খুড়ো! আমি সেই পূর্বদেশ থেকে আসচি। সাথে আবার আমার পরিবারটিও এসেচেন। দু' পয়সার দই- চিঁড়ে- বাতাসা এইসব দুটো আলাদা আলাদা দোনায় এখন মিলবে কি?...এ-এই য‍্যা...ধরুন দিকি!..." -

এই বলে সে নগদ দুটি পয়সা দোকানী দাশু বিশ্বাসের দিকে বাড়িয়ে দেয়।

যদিও গোলকপতির কাছে খবর আছে যে তার পরিচিত চকমাণিকপুরের নিবাসী সেই আড়তদারটিও এর কাছেপিঠেই থাকে, তবে সবার আগে আপাতত একটু জলযোগ সেবা করে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই যোগাড় করতে হবে। স্থলপথ ও জলপথ মিলিয়ে রাঢ়বঙ্গের এই জনপদটিতে আসতে অনেকটা পথ পার হতে হয়েছে!

লক্ষ্মীমণি কিছু মুখে না বললেও গোলকপতি বোঝে তারা দুজনেই পথশ্রমে এখন সমানভাবে কাহিল। তাই সে ভাবল, এই দোকানী খুড়োটিকে তো বেশ চটপটে বলেই তো মনে হচ্ছে, এর কাছে আস্তানাটার যদি একটা কোন উপায় হয় তো আপাতত বেশ শান্তি পাওয়া যাবে।

........

দাশু বিশ্বাস খুব সহজেই তার নিজের একটা একটা অর্ধপরিত‍্যক্ত চালাঘর সামান‍্য কিছু তঙ্কার বিনিময়ে গোলকপতি ও তার পত্নী লক্ষ্মীমণিকে ভাড়া দিয়ে দিল। কিছুদিন আগেও এই ঘরগুলি তীর্থযাত্রীদের মধ‍্যে কোনও বৃদ্ধ আ বৃদ্ধার অন্তর্জলি যাত্রায়র জন‍্য আসা আত্মীয়স্বজনের উদ্দেশ‍্যে এই ব‍্যবহৃত হত

এখন অবশ‍্য ইংরেজ পত্তনে সেসব অনেকদিন উঠে গেছে।

এইরকমের একটা কুটিরেই ওরা এসে আপাতত উঠল। কুটিরটি আসলে শিব মন্দিরের অদূরেই। জনশ্রুতি আছে পাঠান আমলে শাহী সড়ক নির্মাণকালে স্বয়ং শেরশাহের নিযুক্ত ঠিকাদারেরা অস্থায়ীভাবে এই এলাকাটিতে এসে থাকা জন‍্য সর্বপ‍্রথম ঘরগুলি বেঁধেছিল।

তারপরে দিনবদলের পালায় এখন যদিও ইংরেজ আমল, তবে দিগন্ত বিস্তৃত সেই শাহী সড়কটি আজও বহাল তবিয়তে শুধু যে টিকে আছে তাই নয় বরং সাহেবরা এটিকে গ্র‍্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নাম সহ মান‍্যতা দিয়েছে ও অনেকাংশে আধুনিকীকরণও করেছে।

তবে যে ভাগ‍্যবিপর্যয়কে পুঁজি করে গোলকপতি দেশ ছেড়ে রাঢ়ভূমিতে এসে এখন অবতীর্ণ তারই অবিশ্রান্ত পক্ষবিস্তারের সূচনা যে ইতিমধ‍্যেই শুরু হয়ে গেছে তার জন‍্য বোধকরি সে নিজেও প্রস্তুত ছিলনা।

এখানে এসে পৌঁছনোর পরের ভোর রাত্রি থেকে ক্রমাগত বমি ও দাস্তে লক্ষ্মীমণি ক্রমে দূর্বল থেকে দূর্বলতর হয়ে উঠতে লাগল। একে নতুন জায়গা তায় অসুস্থ রোগিণীর শূশ্রূষা করাটাই গোলকপতির কাছে ভীষণ সমস‍্যার বিষয়। তবু গার্হস্থ‍্যধর্মের রীতি অনুসারে সে পত্নীকে ছেড়ে পলায়ন করতে পারেনা। তাই সে একাই রোগীণীর সেবায় সে যথাবিহিত চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকল।

তখন রাত বেশ গভীর। দু একটা ইতস্ততঃ শিবারব ছাড়া প্রায় এই জঙ্গলাকীর্ণ এলাকাটিতে জীবনের কোনও চিহ্নমাত্র এখন নেই।

হঠাৎ নারীকন্ঠে একটি গোঙানির মত শব্দে গোলকপতির ঘুমটা এখন ভেঙে গেল। সে বুঝল যে এই আওয়াজটির উৎস লক্ষ্মীমণির শয‍্যা।

সে ঝটিতে উঠে একটি কূপি জ্বালিয়ে পত্নীর শয‍্যার কাছে তক্ষুণি ছুটে গেল ঠিকই কিন্তু যে দৃশ‍্য তথা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন সে হল এ যেন অবধারিত ও নিয়তিতাড়িত। পত্নীর হঠাৎ অসুস্থতা হেতু সে লক্ষ্মীমণির শয‍্যার কাছেই একটি মাদুর বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

সে অস্ফূট শব্দটির উৎসসন্ধানে দেখল যে পান্ডুরবর্ণা ও কৃশকায়া লক্ষ্মীমণি তার সমস্ত প্রাণশক্তি উজাড় করে শেষবারের জন‍্য বিদেশবিভুঁইএ ভাগ‍্যাণ্বেষণে আসা তার একান্তজনের হাতটা নিজের কম্পিত অঙ্গুলীতে ধরবার জন‍্য অতিমাত্রায় ব‍্যস্ত হয়ে উঠেছে।

এখন তার মুখের কষ বেয়ে রক্তমিশ্রিত একধরণের ফেনিল তরল ক্রমশ বেরিয়ে আসতে দেখে গোলকপতি বুঝে গেল যে এ ক্রমাগত দাস্ত ও বমনের জন‍্য তার এখন এই ভীষণ পরিণতি।

যদিও জায়গাটির নামমাত্র পরিচয় নবাবহাট, তাও জনপদটিতে এত রাতে কোন কোবরেজ বা ওষুধ পাওয়াটাও একটা অসুবিধা। ১০৮ শিব মন্দির সংলগ্ন জনজীবন এখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। কাজেই সে নিজের চেষ্টায় একটু নুন-চিনি মিশ্রিত জল লক্ষ্মীমণিকে খাওয়াতে গেল করলো বটে, তবে তার আর শেষরক্ষা হলনা। একটুখানি সেই পানীয়জলের অংশ তার গলায় যেতে না যেতেই সে তার স্বামীর কব্জিটি অতি করুণ ভঙ্গিমায় ধরে থাকল শক্ত করে। এর অল্পক্ষণ পরেই তার প্রাণবায়ুটিও দেহছাড়া হয়ে গেল।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১২

উপসংহার

সে রাত্তিরটা ভোলা কঠিন।

কখন বারোটা বেজে গেছে, কিন্তু স্বামীজিদের বিবেকানন্দ আবাসে তিনজন মহারাজই জেগে রয়েছেন। আমাদের দু’জনকে আলাদা আলাদা করে জেরা করা হয়েছে। আগে ডাকা হয়েছিল প্রেমাংশুকে।

আমি প্রেমাংশুকে বলে দিয়েছিলাম—আমাদের কেউ সিনেমা হলে দেখতে পায় নি, হাতে নাতে ধরেনি। বাকি সব অন্যের চুগলি নির্ভর। কিছুতেই স্বীকার করবি না যে আমরা সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম।

--কিন্তু ওরা যে ডাইনিং হলে রোল কল করেছিল, আমাদের ঘরে গিয়ে মশারি তুলে দেখেছিল!

--তাতে কী হয়েছে? সত্যি কথা, আমরা খাবার সময় ডাইনিং হলে বা নিজেদের ঘরে ছিলাম না, কোথায় ছিলাম কেউ জানে না। তার মানে কি সিনেমা হলেই গিয়েছিলাম?

--বেশ, তাহলে কোথায় ছিলাম?

--আমরা ছিলাম স্কুল বিল্ডিং এর ছাদে। কেউ বলুক যে ছিলাম না! ওরা কি স্কুলের ছাদে চেক করেছিল? সিনেমা হলে তো কেউ আমাদের দেখে নি।

--আচ্ছা, তাহলে আমরা খেতে যাই নি কেন? আর রাত্তিরে স্কুলের ছাদে গিয়ে কী করছিলাম?

--আমরা বাড়ি ফিরে যাব, হোস্টেল ছেড়ে দেব। দুজনে ছাদে বসে ফিউচার প্ল্যানিং করছিলাম, সেটা কি অপরাধ না অস্বাভাবিক? আর আজ আমাদের খিদে মরে গেছল, ব্যস্‌।

--তাহলে আমরা কেউই স্বীকার করব না যে পাঁচিল টপকে সিনেমা দেখতে গেছলাম?

--প্রশ্নই ওঠেনা। কোশ্চেন ডাজ নট অ্যারাইজ। ওরা কেউ আমাদের হলে দেখে নি, স্কুলের ছাদে গিয়ে দেখে নি। কাজেই আমরা যা বলব সেটাই ট্রুথ।

খানিকক্ষণ পরে প্রেমাংশু এল, একটু অসহজ, একটু থতমত খাওয়া ভাবভঙ্গি ।

বলল ওকে বড় দুই মহারাজ খুব গ্রিল করেছে, জানতে চেয়েছে গেট পেরোলাম কী করে? দারোয়ানকে পয়সা দিয়ে, নাকি পাঁচিল টপকে?

ছোট মহারাজ সুনীলদা জানতে চেয়েছিলেন কার গান বেশি ভাল লেগেছে? কিশোরকুমার নাকি হেমন্ত?

--আমি কিচ্ছু স্বীকার করিনি পোদোদা, শুধু ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে, পরে হাউমাউ করে কেঁদেছি। কোথায় ছিলাম তাও বলিনি। শেষে যেই বলেছি—আমার কী হবে মহারাজ? অমনি কেশব মহারাজ বললেন—এই প্রশ্নটা তোমার গুরু প্রদ্যুম্নকে জিজ্ঞেস কর গে।

এরপর আমার পালা।

পায়ে পায়ে গিয়ে স্বামীজিদের সামনে দাঁড়াই, কোন কথা বলি না। বড় ও মেজো মহারাজ দুটো চেয়ারে বসে, কিন্তু ছোট মহারাজ সুনীলদা দাঁড়িয়ে। উনি কি কোনদিন বড় হবেন না?

কেশব মহারাজ আমাকে সাদর অভ্যর্থনা করলেনঃ

--এই যে, এস এস। একে আর কী বলব? দেখ, মাথা নীচু করে দু’হাত জড়ো করে কেমন দাঁড়িয়ে আছে, যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। গুড বয়! লাইক এ গুড বয়!

এ আশ্রমের ভাল চায়! সারাক্ষণ কোথাও কোন বেচাল দেখলে এসে নালিশ করে—মহারাজ এই হয়েছে, মহারাজ ওই হয়েছে। ওতে আশ্রমের সুনাম চলে যাবে, একটা বিহিত করুন।

বাঃ , এখন সেই ভাল ছেলেটি রাত্তিরে পাঁচিল টপকে নাইট শোতে সিনেমা দেখতে গেছিলেন। শুধু যে নিজে বখেছেন তাই নয়, একটি জুনিয়র ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন, ওকেও বখামিতে দীক্ষা দিয়েছেন।

--না মহারাজ!

--মানে?

--সিনেমা দেখতে যাই নি। স্কুল বিল্ডিঙয়ের দোতলার ছাদে আমি আর প্রেমাংশু কথা বলছিলাম।

--খাওয়ার সময় চলে গেলেও? কী সেই প্রাণের কথা?

--মহারাজ, আমরা দুজনেই ইন্ডাস্ট্রিয়াল শহরের ছেলে। ও আসানসোল, আমি ভিলাই। আমরা আগামী বছর হোস্টেল ছেড়ে অন্য স্কুলে যাব, নিজেদের শহরে। ভাল করে পড়াশুনো করব, এই সব।

--আচ্ছা! ভালকরে পড়াশুনো? আশ্রমের নামকরা স্কুলে পোষাল না, অন্য স্কুলে? ক্লাস ইলেভেনে? শুনলেন আপনি, বড় মহারাজ!

--হুঁ; বেড়াল বলে মাছ খাব না, কাশী যাব?

--শোন, আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি—তুমি উচ্চমাধ্যমিকের বেড়া ডিঙোতে পারবে না। এখান থেকে রাস্টিকেট হবে, কোথাও ভর্তি হতে পারবে না। শেষে কোলকাতার পথে পথে পকেট মেরে উঞ্ছবৃত্তি করে পেট চালাবে।

--না, মহারাজ।

--বিশ্বাস হচ্ছে না? পাঁচ বছর পরে আমার কথা মিলিয়ে নিও।

--হ্যাঁ মহারাজ।

--দুত্তোর নিকুচি করেছে তোর ‘হ্যাঁ মহারাজ’ আর ‘না মহারাজের’। দূর হ’ আমার চোখের সামনে থেকে।

বড় মহারাজ বললেন—তোকে আর কী শাস্তি দেব? পরীক্ষা হয়ে গেছে, যেদিন গার্জেন নিতে আসবে সেদিন তোর কীর্তিকাহিনী বলে হাতে টিসি ধরিয়ে দেব। তদ্দিন আমাদের আশ্রমের অন্নধ্বংস কর।

--হ্যাঁ মহারাজ।



পরের দিন। দুপুরের খাওয়ার ঘন্টার আগেই গুরু অমিয়দা এবং প্রশান্তের বাড়ি থেকে লোক এল, বিছানা বাঁধা আর ট্রাঙ্ক গোছানো চটপট হয়ে গেল। যাবার আগে আমরা সবাই একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলাম, ঠিকানা নিলাম। কিন্তু, জানি যে হয়ত আর দেখা হবে না।

গুহ্যপক্ক পোদো কোথাও পাঠ করিয়াছিল যে এক নদীতে দ্বিতীয়বার অবগাহন সম্ভব নহে। ঘড়ির কাঁটা জোর করিয়া পিছনপানে ঘোরানো যায় না।

গুরু অমিয়দা আগামী মার্চ মাসে বাড়ি থেকে এসে হায়ার সেকেন্ডারি দেবে, তারপর কলেজ। আমি টিসি পাচ্ছি, তায় ‘হোমোসেক্সুয়ালিটি’ হয় জেনে বাবা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যে আমাকে নানুকাকুর ওখানে হোস্টেলে দেবেন। বিপ্লবও আশ্রম এবং স্কুল ছেড়ে দেবে। রইল প্রশান্ত, নিখিলেশ ও বিশু।

কীর্তনিয়া পরিবারের ছেলে বিশু বড্ড সেন্টিমেন্টাল। বলল—দূর, তোমরা সবাই চলে যাচ্ছ-- আমিও থাকব না।

গুরু বলল—দূর পাগলা! লাইফ ইজ লাইক দ্যাট। কেউ কারও জন্যে বসে থাকে না, এগিয়ে যাওয়াই নিয়তি। একটা ভাল দেখে চার লাইন কীর্তন শোনা দেখি।

--পদকর্তা জ্ঞান দাসের একটা শোনাই?

--বেশ, আমাদের মত অজ্ঞান দাসের তাই সই।

বিশু গলা খাঁকরে একটু গুনগুন করে সুরু করলঃ

“সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল,

অমিয় সাগরে সিনান করিতে সকলি গরল ভেল।

সখী, কী মোর করমে লেখি!

শীতল বলিয়া ও চাঁদে সেবিনু ভানুর উদয় দেখি”।

ওর গলা ধরে গেল, আর গাইতে পারল না।

আমার রাগ হয়ে গেল। এসময় আর গান খুঁজে পেল না? ভোঁদাই কোথাকার! রমেন একটা হিন্দি গান শোনাক দেখি। কোন মনখারাপের গান হলে চলবে না।

--আচ্ছা, প্যারডি শোনাই? শাম্মী কাপুরের হিট ফিল্মের গানের?

আমরা মহাউৎসাহে মাথা নেড়ে সায় দিই।

--ইয়াহু! ‘দাদা ধরে দিল যে এক জংলি মেয়ে,

দিয়ে দিল তার সাথে আমার বিয়ে,

আজ বিশ বছর ধরে সংসার করেও সুখ পেলাম না।

পোড়ে রান্না, ধরে কান্না,

সারাদিন কিছু খায় না।

আমার মাংস, করে ধ্বংস,

বলে স্বামীর কাছে থাকব না।

ভাই রে, বল না,

সত্যি কি থাকবে না”?



আশ্রমে আমার অদ্যই শেষ রজনী। আশ্রম প্রায় খালি। রাত্তিরে খাওয়ার সময় ডাইনিং হলে দু’শোর জায়গায় পঞ্চাশ জনের পাত পড়েছে। মাছের সাইজ যেন একটু বড়, নাকি আমারই মনের ভুল। খাওয়া শুরুর আগে সবাইকে চমকে দিয়ে জোর গলায় সুর করে বলে উঠিঃ

“ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্মহবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণাহুতম্‌,

ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্ম সমাধিনা।।

হরি ওঁ তৎ সৎ”।।



পরের দিন। বিকেলে আমাকে নিতে নানুকাকা আসবে, মহারাজ টিসি দেবেন, সে না হয় দেখা যাবে। আমি নিজেই তো হোস্টেল ছেড়ে দিচ্ছি। আসানসোলে নানুকাকার চেনা রেলওয়ে স্কুলে ভর্তি হব।

ভাল করে সাবান মেখে স্নান করলাম। পুকুরপাড়ে বেড়িয়ে এলাম। তারপর বেডিং, বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে সাজগোজ শুরু। আসানসোলের ছেলেমেয়েগুলোকে ইম্প্রেস করতে হবে না!

বাবার দেওয়া মাখন জিনের সাদা প্যান্ট, বাইশ ইঞ্চি ঘেরের। স্থানীয় টেলরিং শপ থেকে সেটা কাটিয়ে সাড়ে চোদ্দ ইঞ্চি করেছি, তাতে আবার খানিকটা চেন লাগানো। একটা ফুলহাতা শার্টের উপর রঙচঙে সোয়েটার। ‘বিশ সাল বাদ’ সিনেমায় বিশ্বজিৎ যেমন পরেছিল। স্বামী বিবেকানন্দের স্টাইলে মাঝখানে সিঁথি কেটে ঢেউতোলা বাবরি চুল। আয়নায় নিজেকে ভাল করে দেখলাম।

নাঃ; গুরু অমিয়দার কথা মেনে হামাম সাবান মেখে চান করেছি বটে, কিন্তু গায়ের রঙ সেই আলকাতরার মত রয়ে গেছে। এক পোঁচও ফিকে হয় নি।

অবশেষে অফিস থেকে খবর এল , প্রদ্যুম্নের বাড়ি থেকে নিতে এসেছে। হাসি হাসি মুখে মালপত্র নিয়ে অফিসে হাজির হলাম। ঐ তো, অফিসের বাইরে নানুকাকার অ্যাম্বাসাডার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। চেনা ড্রাইভার পরেশদা হেসে হাত নাড়ল। তারপর মালপত্র ডিকিতে তুলতে লাগল। আমি অফিসের ভেতরে গেলাম।

একী! বিশ হাজার ভোল্টের শক। নানুকাকা আসেন নি। ওঁর গাড়ি নিয়ে আমাকে নিতে এসেছেন আমার বাবা-মা। ওঁদের চেহারায় আষাঢ়ের মেঘ ঘনিয়েছে। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন না। গম্ভীর মুখে খসখসিয়ে টিসির দরখাস্ত লিখতে লাগলেন।

সুনীল মহারাজ বললেন— টিসি চাইছেন কেন? ও ছাত্র ভাল, কুসঙ্গে থেকে একটু ভুল করে ফেলেছে। সিনেমা-টিনেমা দেখেছে। অনশন করেছে। একবার ক্ষমা চাইলে আমরা ছেড়ে দেব।

বাবা উদারার মধ্যমে বললেন—না, ও ক্ষমা চাইবে না। ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দিয়ে দিন।

গাড়ি রওনা দিল। গেট খুলে দিয়ে দারোয়ান হাসিমুখে হাত কচলে বকশিস চাইল। বাবা ধমকে উঠলেন। বেচারা হতভম্ব, ছুটিতে বাড়ি যাবার সময় সবাই ওকে বখশিস দেয় যে! বাবা এর আগে দিয়েছেন তো।

নিজের রূঢ়তায় লজ্জা পেয়ে বাবা মাকে বললেন—বখশিস চাইবে না কেন? রাত্তিরে গেটের তালা খুলে দেয় যে।

বলতে পারলাম না—কথাটা সত্যি নয়। বলতে পারলাম না যে পাঁচিল টপকানোর অনেক ক্রিয়েটিভ কায়দায় আমি পারঙ্গম।

আশ্রম থেকে আসানসোল, কয়েক ঘন্টার মোটরগাড়ির যাত্রা। শাল্বন, কুয়াশা। ঘোর শীত, অন্ধকার গাঢ়। আমি ঘুমে ঢুলতে থাকি, স্বপ্নে শুনতে পাই সন্ধ্যেবেলার আরাত্রিক—“খণ্ডন- ভববন্ধন -জগবন্দন বন্দি তোমায়”।

বাবা ঠেলা মেরে জাগিয়ে দেন, বিরক্ত মুখে বলেন—জোয়ান ছেলে, অবেলায় ঢুলছ কেন? সোজা হয়ে বস।

নানুকাকার বাড়ি এসে গেল। কাকু-কাকিমা হৈ হৈ করে অভ্যর্থনা করে ভেতরে নিয়ে গেলেন। জুতো-জামা ছাড়ার পর বাবা ডাকলেন।

--শোন, তোমার পেছনে পাঁচ বছর যে টাকা খরচ করেছি সেটা ভস্মে ঘি ঢালা হয়েছে। তুমি আশ্রম থেকে এসেছ টেরিকাটা বাবরি চুলে যাত্রাপার্টির ললিতা সখী হয়ে। বাট ইউ আর দ্য সন অফ এ সোলজার। ডোন্ট য়ু ফরগেট দ্যাট।

দাঁতে দাঁত পিষে বললেন—চোরের মতন হোস্টেল পালিয়ে সিনেমা দেখা! ছিঃ ! আমার একটা থাপ্পড় নেবার মত ক্ষমতা তোর রোগাপ্যাটকা শরীরে নেই, নইলে-- ।

এই প্রথম আমি আমার রোগাটে চেহারার জন্যে গর্বিত হলাম। কিন্তু সেই সুখ বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। উনি বললেন যে নানুকাকা নতুন স্কুলের ফর্ম এনেছেন। সাতদিন পরে অ্যাডমিশন টেস্ট। কাজেই ঠেসে প্রিপারেশন করতে হবে। ইংরেজি আর অংক। টাইমপিস ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে ভোর চারটেয় উঠে পড়তে বস। রাত দশটায় লাইট অফ্‌। কাকিমারা খেতে ডাকলে যাবে। দুপুরে একঘন্টা বিশ্রাম। বিকেলে আধঘন্টা বাগানে বেড়ানো, ব্যাস।

এই ক’দিন ক্রিকেট খেলা বা খুড়তুতো ভাইবোনের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া ভুলে যাও।

ছ’দিন কেটে গেল। কাল সকালে পরীক্ষা দিতে নতুন স্কুলে যাব। নানুকাকা ভরসা দিচ্ছেন—তুই ঠিক পারবি, ঘাবড়াস না।

বিকেলের দিকে বাবা বাগানে গার্ডেন চেয়ারে বসে নানুকাকার সঙ্গে চা খাচ্ছিলেন আর আসানসোলের কোল মাফিয়ার গল্প শুনছিলেন। পিওন এসে একটা বন্ধ ইনল্যান্ড লেটার বাবার হাতে দিয়ে গেল। আমার নামে চিঠি এসেছে টাটানগর থেকে। বাবা ভুরূ কুঁচকে ঠিকানা পড়ছেন। কিন্তু প্রদ্যুম্নের পাশে ব্র্যাকেটে লাকি লেখা কেন? আর পাঠিয়েছে কোন বিপ্লব (মিতা)।

--এসব কী? তুমি লাকি? আর মিতা কোন ব্যাটাছেলের নাম হয়?

--না, মানে আশ্রমে সবাই বলত আমার লাক্‌ খুব ভাল। পরীক্ষায় খুব কমন প্রশ্ন পাই, তাই নাম লাকি। আর বিপ্লব আমার আশ্রমের বন্ধু। মিতা ওর বাড়ি থেকে দেওয়া ডাক নাম।

--শোন, আমি কক্ষণো অন্যের চিঠি খুলে পড়ি না, নিজের ছেলেরটাও না। কিন্তু— এই চিঠি তুমিও পড়বে না। আশ্রমের বন্ধুদের ভুলে যাও। পেছনের ব্রিজ পুড়িয়ে ফেলে এগিয়ে যাও, নতুন জীবন শুরু কর।

বন্ধ চিঠিটা উনি কুচিকুচি করে ছিঁড়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলেন।

আজও ভাবি, কী লিখেছিল বিপ্লব?

হ্যাঁ, স্বপ্নে মিতা আসে, লাকির সঙ্গে কত গল্প করে। প্রথমেই বলে—কী রে লাকি, তোর খবর কী?

আমি সত্যিই লাকি, কারণ আমার স্বপ্ন রয়েছে। দুর্ভাগা সে, যার কোন স্বপ্নই নেই।

(সমাপ্ত)

0 comments:

0

গল্প - মনোজ কর

Posted in






















প্রথম পর্ব 
মার্চ সংখ্যায় 
https://rritobak.blogspot.com/2023/03/blog-post_51.html 



রাজা হল সিরাজ

অন্য সবদিনের মতই সেদিনও আলিবর্দি খান রাত্রি তৃতীয় প্রহরের শেষে প্রায় অন্ধকার থাকতে থাকতে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে, কোরান পাঠ করে সকাল সাতটায় বন্ধুদের সঙ্গে কফি-পান সেরে রাজদরবারে গিয়ে বসলেন। প্রতিদিনকার মত প্রায় দু’ঘন্টা সেনাবাহিনীর অধ্যক্ষ ও বিভিন্ন বিভাগের আধিকারিকদের সঙ্গে জরুরি আলোচনা সেরে বৈঠকখানায় যাবার আগে অন্দরমহলে খবর পাঠালেন যে আজ সন্ধ্যায় প্রাসাদের সকলে যেন বৈঠকখানায় আসে। আফসার রাজপরিবারের প্রত্যেক সদস্য যেন অবশ্যই হাজির থাকে। আগুনের গতিতে খবর ছড়িয়ে পড়ল রাজপ্রাসাদের সর্বত্র। সকলে চিন্তিত এবং উৎসুক হয়ে উঠল। সকলের মনে একই প্রশ্ন, কী ঘোষণা করতে চলেছেন নবাব আলিবর্দি খান? আবার কোনও দুঃসংবাদ নয় তো? আবার কোনও আসন্ন মারাঠা আক্রমনের প্রস্তুতি নয় তো? প্রাসাদ ছেড়ে কোনও গোপন আস্তানায় চলে যেতে হবে না তো? মারাঠারাজ রঘুজি ভোঁসলের আক্রমনে বারবার কেঁপে উঠেছে বাংলার মসনদ। এই বৃদ্ধ বয়সেও নিজের লোকেদের বিরোধিতা সত্ত্বেও নিজের বুদ্ধি আর নিপুণ রণকুশলতায় বাংলা , বিহার, উড়িষ্যার নবাব আলিবর্দি খান নিজের সাম্রাজ্য এবং পরিবারকে বারবার রক্ষা করেছেন শত্রুদের হাত থেকে বিশেষ করে রঘুজি ভোঁসলের হাত থেকে। বিগত পাঁচ বছর ধরে রঘুজির সৈন্য ক্রমাগত আক্রমন করেছে আলিবর্দির সাম্রাজ্য। সেবার যখন মারাঠা সৈন্যরা উড়িষ্যা আক্রমন করল নিজের ভাগ্নে মিরজাফর উড়িষ্যার সুবেদার হওয়া সত্ত্বেও হাত-পা গুটিয়ে বসে রইল যতক্ষণ পর্যন্ত না মিরজাফরকে সরিয়ে এই বৃদ্ধ বয়সে সত্তরোর্দ্ধ আলিবর্দি নিজে মোগলরাজের সাহায্য নিয়ে রণক্ষেত্রে পৌঁছলেন। শেষ অবধি ফল খুব একটা আশাপ্রদ হয়নি। অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌল্লার সহায়তা সত্ত্বেও উড়িষ্যা হাতছাড়া হয়ে গেল। গতবছর মোগলরাজ আহমেদ শা বাহাদুর উড়িষ্যার বিনিময়ে ত্রিপাক্ষিক যুদ্ধবিরোধি চুক্তিতে রাজি করালেন রঘুজিকে। আহমেদ শা, আলিবর্দি আর রঘুজির স্বাক্ষরসম্বলিত এই শান্তিচুক্তি সত্ত্বেও রাজপরিবারের সকলের মন থেকে সন্দেহ সম্পূর্ণ দূর হয়নি। মারাঠারা তো শত্রু, নিজের বাড়ির লোকেরাই তো বারবার বিব্রত করেছে আলিবর্দিকে। এই দু’বছর আগে মাত্র সতের বছর বয়সের আদরের নাতি সেনাবিহিনীর কিছু লোককে ভয় দেখিয়ে জোর করে পাটনা দখল করে নিল। আলিবর্দির অত্যন্ত স্নেহের পাত্র এই ছোট নাতি। খেলাচ্ছলে এমন কান্ড করে ফেলেছে এই সব বলে বুঝিয়ে সুজিয়ে সে যাত্রায় সিরাজকে নিরস্ত করে শান্তি বজায় রেখেছিলেন আলিবর্দি। বাইরে তো শত্রুর অভাব নেই। তার ওপর নিজের নাতি এসব কান্ড করলে শত্রুরা যে তার সুযোগ নেবে সে কথা বলে নাতিকে ফিরিয়ে আনেন আলিবর্দি। কিন্তু দাদুর প্রশ্রয়ে দিন দিন অনাচারী হয়ে উঠছে সে। বিশেষ করে নারীদের প্রতি তার আসক্তি দিন দিন বেড়েই চলেছে। মাঝে মাঝে চিন্তাও হয় আলিবর্দির। এই একই আসক্তিতে আক্রান্ত আলিবর্দির পূর্বসুরী নাসিরি বংশের শেষ নবাব সরফরাজের পরিণতির কথা তো সবাই জানে। তবুও এই নাতির মধ্যে কী যে দেখেন আলিবর্দি কে জানে? শুধুই কি অন্ধ দৌহিত্রস্নেহ না আরও কিছু?

বৈঠকখানায় একঘন্টা ধরে একটু হাসিমজা, একটু সাহিত্যচর্চা সেরে মধ্যাহ্নভোজের মেনুতে মনোনিবেশ করলেন আলিবর্দি। মধ্যাহ্নভোজ আলিবর্দির একটা বড় দুর্বলতার জায়গা। কিসের মাংস আর কী মশলা দিয়ে তৈরি হবে প্রতিটি ব্যঞ্জন তা নিজেই প্রতিদিন ঠিক করেন আলিবর্দি। তারপর তাঁর নিজের তত্ত্বাবধানে সেইসব পদ রান্না করেন দেশ বিদেশ থেকে আগত রন্ধনকুশলীরা। সুবিস্তৃত খাদ্যসম্ভার যখন নবাবের সামনে পরিবেশিত হত সুগন্ধে মাতোয়ারা হয়ে উঠত সমস্ত রাজপ্রাসাদ। নবাব আলিবর্দি তাঁর তত্ত্বাবধানে তৈরি পদগুলি একটু একটু করে মুখে দেন আর রন্ধনকুশলীরা দমবন্ধ করে অপেক্ষা করে থাকেন নবাব কী বলবেন তা শোনার জন্য। প্রতিটি পদের স্বাদ এবং গন্ধের বিশ্লেষণ এবং ব্যাখ্যায় আলিবর্দির দক্ষতা অনবদ্য। সে ব্যাখ্যা অনেক কবিতাকেও হার মানায়। এই সময় কেমন একটা ঘোরের মধ্যে থাকেন আলিবর্দি। দীর্ঘ মধ্যাহ্নভোজপর্বের পর একঘন্টাব্যাপী দিবানিদ্রা আলিবর্দির অভ্যাস। এই নিদ্রা সহজে আসে না। পেশাদার গল্পকথকের গল্প শুনতে শুনতে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে যান আলিবর্দি প্রতিদিন। গল্পকথকের বড় অভাব । একে তো হাজারজনে একজন পড়তে পারে। দশলক্ষে একজনের প্রতিদিন পড়ার অভ্যাস আছে। তাই গল্পকথকের বড় আদর রাজপরিবারে। কিন্তু কেন? জ্ঞান আহরণের জন্য? না, ঘুম পাড়ানোর জন্য। নবাবকে ঘুম পাড়ানোর জন্য তাই দুর্লভ নিত্যনতুন গল্পকথকদের খুঁজে নিয়ে আসা হত রাজপ্রাসাদে। এই মহামূল্যবান রাজকীয় দিবানিদ্রার পর প্রক্ষালনের পর্ব। প্রক্ষালন ও পোশাক পরিবর্তনের পর নিয়মমাফিক প্রার্থনা এবং কোরানপাঠ সম্পূর্ণ করে আলিবর্দি এক পাত্র সোরামিশ্রিত জল পান করেন। এই সোরামিশ্রিত পানীয়জল বিশেষ পদ্ধতিতে দুইফুট গভীর মৃৎপাত্রে নির্মল শীতল বাতাসে জারিত করে প্রস্তুত করা হয় প্রতিদিন। মৃৎপাত্রের মধ্যভাগ থেকে এই পানীয় একটি পানপাত্রে পরিবেশন করা হয় নবাববাহাদুরকে। এরপর শুরু হয় রাজদরবারের দ্বিতীয় পর্ব। এই পর্বে রাজদরবারে উপস্থিত থাকেন আমন্ত্রিত শিক্ষিতজনেরা। কবি, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, চিকিৎসক, কোরানবিশারদ ইত্যাদি নক্ষত্র সমাগমে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রাজদরবার। ধূমপায়ীরা নানাবিধ হুকা থেকে ধূমপান করেন। আলিবর্দির ধূমপানের অভ্যাস নেই তাই বিলাতি কফির বিশেষ ব্যবস্থা আলিবর্দির জন্য। নানা বিষয়ে আলোচনা বিশেষ করে কোরানের ব্যাখ্যা চলতে থাকে যতক্ষণ না সকলে গাত্রোত্থান করেন। তারপর সারাদিনের প্রশাসনিক কাজকর্মের হিসাব নিকাশ,গুপ্তচরদের কাছ থেকে শত্রুদের গতিবিধি, জগৎশেঠের কাছ থেকে আর্থিক খবরাখবর এবং নবাবের বেতনভোগী সাংবাদিকদের কাছ থেকে সাম্রাজ্যের বিভিন্নপ্রান্তের খবর শুনে সেদিনের মত দরবারের কাজ শেষ হয় আলিবর্দির। এই দরবারের কাজ রাজপরিবারের পক্ষ থেকে প্রধানত একাই করেন আলিবর্দি। মাঝে মধ্যে আসে বড় জামাই নওয়াজিস মহম্মদ খান। এই বড় জামাই হচ্ছে আবার আলিবর্দির বড় ভাই হাজি আহমেদের ছেলে। আলিবর্দির তিন কন্যার মধ্যে দুই কন্যার বিবাহ হয় আলিবর্দির বড় ভাই হাজি আহমেদের দুই পুত্রের সঙ্গে। আলিবর্দির কোনও পুত্রসন্তান ছিল না। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র তথা জামাতারাই ছিল তাঁর পুত্রসম। বড় মেয়ে মেহেরুন্নিসা বা ঘসেটি বেগমের সঙ্গে বিবাহ হয় নওয়াজিসের। সেই সুবাদে রাজদরবারে অবাধে আসার অধিকার অর্জন করেছিল নওয়াজিস। নবাব বড় আদরের মেহেরুন্নিসা এবং নওয়াজিশের জন্য তৈরি করে দিয়েছিলেন এক অপূর্ব সুন্দর প্রাসাদ। এই প্রাসাদের নাম ছিল সঙ্গ-ই- দালান। কিন্তু মতিঝিলের তীরে অবস্থিত বলে এই প্রাসাদকে সকলে মতিঝিল প্রাসাদ বলেই জানে। নবাবের স্নেহ , নিজস্ব রাজপ্রাসাদের মালিকানা এবং রাজদরবারে অবাধ প্রবেশের অধিকার অর্জন করে নিজেকে মুকুটহীন নবাব বলেই মনে করে নওয়াজিস। রাজপরিবারে আর একজনের অবাধ প্রবেশের অনুমতি ছিল নিজের ইচ্ছেমত রাজদরবারে আসার। সে হচ্ছে আলিবর্দির অত্যন্ত স্নেহের নাতি সিরাজ, আলিবর্দির দ্বিতীয় কন্যা আমিনা বেগমের সন্তান। তার বয়স এখন উনিশ। সিরাজের প্রতি আলিবর্দির দুর্বলতার কথা সর্বজনবিদিত। আলিবর্দির নিজে ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ, দূরদর্শী এবং সংবেদনশীল। শিল্প এবং শিল্পীর প্রতি তাঁর অনুরাগ এবং সম্মান ছিল আন্তরিক এবং গভীর। দক্ষ প্রশাসক এবং সেনাপ্রধান হিসাবে সেই সময়ে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে কোনও বিতর্কের অবকাশ নেই। প্রয়োজনে ঘোড়ায় চড়ে, অস্ত্রহাতে নিজেও সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পিছপা হতেন না আলিবর্দি। পরিবারের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা ছিল অপরিসীম। তাঁর স্ত্রী এবং তিন কন্যার মাতা সারফুন্নিসাকে আজীবন আগলে রেখেছিলেন সব শক্তি এবং ভালোবাসা দিয়ে। অন্য নবাবদের মতো বহুবিবাহে আবদ্ধ হননি আলিবর্দি। তাঁর উত্থানের পথে যারা তাঁর প্রতি সাহায্য এবং সহায়তার হাত বাড়িয়েছিল তাদের হাত ভরে দিয়েছেন আলিবর্দি। তারা রাজপ্রাসাদের দাস-দাসীই হোক বা কোনও দপ্তরের সাধারণ কর্মচারি বা সামান্য কোনও মদ্য পরিবেশক। তারা আজও আলিবর্দিকে পিতার মত শ্রদ্ধা করে। আলিবর্দির আশ্রয় তাদের কাছে মাতৃক্রোড়ের চেয়েও নিরাপদ।আসলে এই মানুষগুলির প্রতি তাঁর দুর্বলতার প্রধান কারণ এই যে তিনি নিজেও একসময় এই শ্রেণীর মানুষদের অন্তর্গতই ছিলেন। তাঁর বাবা মির্জা মহম্মদ মাদানি ছিলেন মোগলরাজ আওরঙ্গজেবের পিতা শাহজাহানের এক পালিত পুত্রের সন্তান। কর্মসূত্রে তিনি ছিলেন আওরঙ্গজেবের ছেলে আজম শাহের অত্যন্ত বিশ্বাসী মদ্য পরিবেশক। আজম শাহের অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিল মাদানির দুই সন্তান মহম্মদ আলি এবং মির্জা আহমেদ। মহম্মদ আলি থেকে নবাব আলিবর্দি খান হয়ে ওঠার গল্প এক কঠিন জীবনসংগ্রামের কাহিনী। অনেক পথ পেরিয়ে , অজস্র বাধা অতিক্রম করে আলিবর্দি যখন বাঙলার নবাবিয়ানা দখল করলেন তখন তাঁর বয়স প্রায় সত্তর। সেও আজ থেকে বারো তেরো বছর আগেকার কথা।

নবাব আজম শাহ মহম্মদ আলিকে হাতিশালা এবং অপরূপ সূচীকার্যে অলঙ্কৃত রাজপোশাক ভান্ডারের রক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করেন। অত্যন্ত দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করে অচিরেই আজম শাহের কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন মহম্মদ আলি। কিন্তু আজম শাহের অকস্মাৎ মৃত্যুতে মহম্মদ আলির জীবনে নেমে এল প্রচন্ড আঘাত এবং দারিদ্র। বেশ কিছুদিন চরম দারিদ্রের মধ্যে কাটিয়ে কটকে এক পারিবারিক আত্মীয় সুজাউদ্দিনের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করে সস্ত্রীক মির্জা মহম্মদ মাদানি এবং তার দুই সন্তান মহম্মদ আলি , মির্জা আহমেদ এবং তাদের পরিবার। মির্জা মহম্মদের স্ত্রী এবং সুজাউদ্দিনের স্ত্রী দুজনেই ছিল আফসার সম্প্রদায়ভুক্ত। মোগলসম্রট আওরঙ্গজেবের অত্যন্ত প্রিয় পাত্র বাঙলা ,বিহার এবং উড়িষ্যার স্বঘোষিত প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খানের জামাতা সুজাউদ্দিন তখন উড়িষ্যার ডেপুটি গভর্নর। নবাবের সঙ্গে নানা কারণে সুজাউদ্দিনের সম্পর্ক খুব একটা ভালো ছিল না। নারী এবং সুরায় আসক্ত সুজাউদ্দিনকে রাজধানী থেকে দূরে রাখার জন্য নবাব তাকে উড়িষ্যার দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দেন। সুজাউদ্দিনের দপ্তরে নিজেদের কর্মদক্ষতা এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের জন্য মহম্মদ আলির ভাগ্য খুলতে থাকে ক্রমশ। বেশ কাটছিল সময় কিন্তু অকস্মাৎ সুজাউদ্দিনের জীবনে নেমে আসে বিপদ। নবাব মুর্শিদকুলি খানের দুই কন্যা আজমউন্নিসা এবং জিনাতুন্নিসাকে বিবাহ করেছিল সুজাউদ্দিন। সুতরাং মুর্শিদকুলি খানের মৃত্যুর পর রাজসিংহাসনের একমাত্র অধিকার যে তারই সে বিষয়ে নিঃসংশয় ছিল সুজাউদ্দিন। নবাব মুর্শিদকুলি খানের বড় মেয়ে আজমুন্নিসা ছিল মানসিক বিকারগ্রস্ত। কথিত আছে মৃত মানুষের বিশেষত পুরুষমানুষের কলিজা ছিল তার অত্যন্ত প্রিয় খাদ্য। লোকে তাকে কলজেখাকি বেগম বলে ডাকত। এক অজ্ঞাত অসুখে অত্যন্ত অল্পবয়সে কোনও সন্তানের জন্ম না দিয়েই মারা যায় আজমুন্নিসা। মুর্শিদাবাদের দেওয়ালে কান পাতলে শোনা যায় যে আজমুন্নিসাকে জীবন্ত কবর দিয়েছিল ক্রোধান্ধ সুজাউদ্দিন। এরপর নবাবের ছোট মেয়ে জিনাতুন্নিসাকে বিবাহ করে সুজাউদ্দিন এবং তাদের একটি পুত্রসন্তান হয় যার নাম সরফরাজ। মুর্শিদাবাদের রাজপ্রাসাদে পিতামহ পিতামহীর কাছেই বড় হতে থাকে সরফরাজ। জিনাতুন্নিসাও রয়ে গেল মুর্শিদাবাদে। এরপর অনেকটা সময় কেটে গেল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুর্শিদকুলি খানের সঙ্গে দূরত্ব আরও বাড়তে থাকল সুজাউদ্দিনের। ইতিমধ্যে জিনাতুন্নিসার সঙ্গেও সম্পর্কও খারাপ হতে থাকল সুজাউদ্দিনের। মহম্মদ আলি নিজের কর্মদক্ষতা ও বুদ্ধিতে সুজাউদ্দিনের কাছের মানুষ হয়ে উঠল। প্রশাসন এবং রাজস্ব আদায়ের জন্য মহম্মদ আলির ওপর সুজাউদ্দিনের নির্ভরতা ক্রমাগত বেড়েই চলল। সে কথা রাজপরিবারের কারও অজানা ছিল না। এদিকে মুর্শিদকুলির শরীর আস্তে আস্তে খারাপ হতে হতে এমন অবস্থায় এসে পৌঁছল যে তিনি সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। সুজাউদ্দিনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যখন রাজধানী থেকে খবর এল যে মৃত্যুশয্যায় শায়িত নবাব মুর্শিদকুলি জামাতাকে রাজ্যভার সমর্পণ না করে সাতাশ বছরের দৌহিত্র এবং সুজাউদ্দিনের পুত্র সরফরাজকে পরবর্তী নবাব হিসাবে ঘোষণা করেছেন। রাগে দুঃখে কাতর সুজাউদ্দিন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। সেই সময় তার পাশে এসে দাঁড়াল মহম্মদ আলি। এই বিপদের দিনে মহম্মদ আলি আর হাজি মহম্মদ এই দুই ভাই ছাড়া তার কাছে আর কেউ নেই। মহম্মদ আলি সুজাউদ্দিনকে বোঝাল যে নবাবের এই সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক এবং কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। পুত্রের অধীনস্থ কর্মচারী হয়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব। সুজাউদ্দিনের উচিৎ এই মুহূর্তে উড়িষ্যার দায়িত্ব টাকি খানের হাতে সমর্পণ করে সসৈন্যে মুর্শিদাবাদের দিকে এগিয়ে যাওয়া।জিনাতুন্নিসার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর আরও একবার বিবাহ করে সুজাউদ্দিন। টাকি খান সেই তৃতীয় স্ত্রীর সন্তান। মহম্মদ আলি বোঝাল যে বাঙলার মসনদ সুজাউদ্দিনের অধিকার এবং সে অধিকার ছিনিয়ে নেবার জন্য নিজের সন্তানের সাথে যুদ্ধে পিছপা হওয়া উচিৎ হবে না সুজাউদ্দিনের। এই ব্যাপারে দিল্লির সমর্থন সংগ্রহ করার জন্য যা করার তা করবে মহম্মদ আলি। মহম্মদ আলির ভরসায় মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দিল সুজাউদ্দিন। ওদিকে মাতামহের ইচ্ছা অনুযায়ী কাতরা মসজিদের সিঁড়ির নিচে নবাবের দেহ সমাধিস্থ করে এসে সিংহাসনে আরোহণের প্রস্তুতি শুরু করে দিল সরফরাজ। সুজাউদ্দিনের রক্ত বইছে সরফরাজের ধমনীতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পিতার মতই সুরা ও নারীর প্রতি সরফরাজের আসক্তি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। সুজাউদ্দিন মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করতে আসছে শুনে পিতৃহত্যার পরিকল্পনা শুরু করে দিল সরফরাজ। সুজাউদ্দিনের সেনাবাহিনী মেদিনীপুর পৌঁছবার আগেই দিল্লির সম্মতিপত্র নিয়ে পৌঁছে গেল মহম্মদ আলি। দ্বিগুন উৎসাহে মুর্শিদাবাদের দিকে ধেয়ে চলল সুজাউদ্দিনের বাহিনী। সরফরাজ ঠিক করল মুর্শিদাবাদের অনেক আগে কাটোয়াতেই প্রতিহত করতে হবে সুজাউদ্দিনের বাহিনীকে। সবকিছু দেখেশুনে প্রমাদ গুনলেন মুর্শিদকুলির স্ত্রী সদ্যবিধবা নাসিরি বানু বেগম। নাতি সরফরাজকে ডেকে বললেন হাজার হলেও সুজাউদ্দিন সরফরাজের জন্মদাতা পিতা। পিতৃহত্যা পাপ এবং তার ফল কখনই ভাল হতে পারে না। তাছাড়া সুজাউদ্দিনের কাছে দিল্লির অনুমতিপত্র আছে। রাজপরিবারের আস্থাভাজন কর্মচারি এবং সুজাউদ্দিনের একান্ত অনুচর মহম্মদ আলি নিজে এ কথা জানিয়েছে তাকে। সুজাউদ্দিনের বয়স পঞ্চাশ পার হয়েছে। উশৃঙ্খল জীবনযাপনের ফলে তার আয়ুও হয়ত খুব একটা বেশি নয়। খুব বেশি হলে হয়ত আর দশ বারো বছর। তারপর সরফরাজের নবাব হওয়ার আর কোনও বাধা থাকবে না। শত্রুর সাথে লড়াই আর নিজের জন্মদাতা পিতার সঙ্গে লড়াই এক নয়। শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় সম্মানের কিন্তু পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় সম্মানের নয়। আর তাছাড়া কে বলতে পারে যুদ্ধে কী ঘটে। যদি সরফরাজের কোনও অঘটন ঘটে তবে সমস্ত রাজপরিবার বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই এই কঠিন সময়ে যুদ্ধের পথ থেকে সরে এসে সুজাউদ্দিনকে নবাব হিসাবে মেনে নেওয়া অনেক বেশি দূরদর্শিতার কাজ হবে। এই সিদ্ধান্তের ফল হবে সুদূরপ্রসারী। পিতা পুত্রের সুসম্পর্ক রাজ্যচালনার ক্ষেত্রেও অনেক বেশি সহায়ক হবে। প্রথমে কিছুটা আপত্তি করলেও মাতামহীর পরামর্শ মেনে নিল সরফরাজ। বাঙলার সিংহাসনে বিনা বাধায় আসীন হল সুজাউদ্দিন। আর তার প্রধান পরামর্শদাতা হিসাবে মুর্শিদাবাদে এল মহম্মদ আলি। নবাবিয়ানা দখল করেই মহম্মদ আলিকে রাজমহলের ফৌজদার পদে নিযুক্ত করল সুজাউদ্দিন। মহম্মদ আলির নতুন নাম হল আলিবর্দি খান। এর পরে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি আলিবর্দিকে। পাঁচ বছর যেতে না যেতেই সুজাউদ্দিন আলিবর্দিকে বিহারের নায়েব নাজিম বা ডেপুটি গভর্নর পদে নিযুক্ত করল। কথিত আছে সুজাউদ্দিন তার প্রতিদ্বন্দী পুত্র সরফরাজকে বিহারের নাবিব নাজিম হিসাবে নিযুক্ত করে পাটনা পাঠিয়ে দেবার পরিকল্পনা করে। এই খবর মুর্শিদকুলির কন্যা সরফরাজের মা জিনাতুন্নিসার কানে পৌঁছতেই তিনি আলিবর্দিকে রাজপ্রাসাদে ডেকে পাঠান এবং ফটকের বাইরে দাঁড় করিয়ে তাকে বিহারের নায়েব নাজিম পদে নিযুক্ত করেন। আদরের সরফরাজকে পিতা সুজাউদ্দিনের প্রতিশোধস্পৃহার হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই দ্রুত এই সিদ্ধান্ত নেন জিনাতুন্নিসা।

যে বছর আলিবর্দি বিহারের নায়েব নাজিম পদে নিযুক্ত হন সে বছরেই জন্ম হয় সিরাজের। তাই সিরাজের প্রতি এক অন্ধ ভালোবাসা জন্মায় আলিবর্দির। শত অপরাধ সত্ত্বেও সিরাজ ছিল স্নেহান্ধ আলিবর্দির চোখের মণি। আলিবর্দি কিন্তু এতেই সন্তুষ্ট রইলেন না। তাঁর চোখ ছিল বাংলার মসনদের প্রতি দৃঢ়নিবদ্ধ। ছয় বছর কেটে গেল। সত্তর বছর বয়সী সুজাউদ্দিন দেহত্যাগ করল। স্বাভাবিকভাবেই বাংলার মসনদে বসল সুজাউদ্দিনের ছেলে সরফরাজ। তখন তার বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুঁই। মা আর দিদিমার আদরে সরফরাজ দিনে দিনে দুশ্চরিত্র এবং লম্পট হয়ে উঠেছিল। মসনদে বসার পর তার লাম্পট্য সীমাহীন হয়ে উঠল। রাজসভার গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও ছাড় পেল না সরফরাজের হাত থেকে। যে বছর সরফরাজ নবাব হল সেই বছরেই ধনকুবের জগৎশেঠ ফতেচাঁদ তার নাতি ভাবী জগৎশেঠ মাধব রাই এর বিবাহ স্থির করেন একাদশবর্ষীয়া এক অসাধারণ রূপসী কন্যার সঙ্গে।এই খবর সরফরাজের কাছে পৌঁছনোমাত্রই সরফরাজ সেই সুন্দরীকে দেখার জন্য পাগল হয়ে উঠল। জগৎশেঠের কাছে লোক পাঠিয়ে সেই রূপসীকে তার কাছে পাঠানোর আদেশ জানাল। অশীতিপর জগৎশেঠ সরফরাজকে বিরত করার জন্য কাতর অনুরোধ জানিয়ে বলল যে শেষবয়সে এই ভয়ঙ্কর লজ্জার হাত থেকে বাঁচার একমাত্র পথ মৃত্যু। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরফরাজ কোনো অনুনয় বিনয়ে কান না দিয়ে রাতের অন্ধকারে সৈন্য পাঠিয়ে সেই রূপসীকে নিজের প্রাসাদে তুলে নিয়ে আসে। যদিও সরফরাজ কথা দিয়েছিল যে সে জগৎশেঠের ভাবী পৌত্রবধূকে অক্ষত অবস্থায় ফেরত পাঠাবে কিন্তু আসলে কী ঘটেছিল তা কেউ জানে না। এই ঘটনার পর ক্ষমতাশীল জগৎশেঠের পরিবার সরফরাজকে মসনদ থেকে সরানো এবং হত্যা করার গভীর চক্রান্তে মেতে উঠল। এই সুযোগে তার সঙ্গে হাত মেলাল আলিবর্দির বড় ভাই হাজি আহমেদ। আলিবর্দিও কিন্তু চুপচাপ বসেছিল না। উড়িষ্যার ডেপুটি গভর্নর থাকার সময় টাকি খান এবং সরফরাজের মধ্যে তুমুল গন্ডগোল বাধে। দুই বৈমাত্রেয় ভাই এর মধ্যে বিরোধ এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে যুদ্ধ লাগার পরিস্থিতি তৈরি হয়। শোনা যায় এই বিরোধ সৃষ্টির নেপথ্যনায়ক ছিল আলিবর্দি। যুদ্ধ শুরু হবার আগেই সুজাউদ্দিনের হস্তক্ষেপে সে যাত্রায় রক্তপাত হয়নি। টাকি খানকে তীব্র ভর্ৎসনা করে কটকে ফেরত পাঠায় সুজাউদ্দিন। এর কিছুদিন পরে অজ্ঞাত কারণে মৃত্যু হয় টাকি খানের। এদিকে রাজদরবারের অভ্যন্তরে চক্রান্ত ঘনীভূত হতে থাকে। কিছু ক্ষমতালোভী পার্শ্বচরের বদমতলবে সরফরাজ তার প্রয়াত পিতার খুব কাছের মানুষ বিশ্বাসী পরামর্শদাতা হাজি আহমেদকে মুখ্য উপদেষ্টার পদ থেকে সরিয়ে মির মুর্তাজাকে তার স্থলিভিষিক্ত করে। হাজি আহমেদের জামাতা আতাউল্লা খানকে রাজমহলের সেনাধ্যক্ষের পদ থেকে সরিয়ে নিজের জামাতা হাসান মহম্মদ খানকে সেই পদে বসায় সরফরাজ। সুজাউদ্দিনের আর এক ঘনিষ্ট সভাসদ এবং বাংলার দেওয়ান রায় রায়ান আলমচাঁদকেও সরিয়ে দেয় সরফরাজ। বাইরে নবাবের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করলেও ভিতরে ভিতরে জগৎশেঠ ফতেচাঁদ, রায় রায়ান আলমচাঁদ আর হাজি আহমেদ সরফরাজকে গদিচ্যুত করার গোপন চক্রান্তে লিপ্ত হয়। এই ত্রিমূর্তি গোপনে সিদ্ধান্ত নিল যে সরফরাজকে সরিয়ে আলিবর্দিকে নবাব হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলে দেশের এবং তাদের নিজেদের মঙ্গল।

এদিকে আলিবর্দি তার এক বন্ধু মোগল দরবারের সভাসদ ইশাক খানের সহযোগিতায় মোগলসম্রাটের সঙ্গে পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে তুলল। সরফরাজের দৌরাত্মের কথা সর্বজনবিদিত হলেও রাজকোষে নিয়মিত অর্থসমাগমের জন্য মোগলসম্রাট চোখ বুজে ছিল। সুযোগ বুঝে আলিবর্দি মোগলরাজকে প্রস্তাব পাঠাল যে তাকে যদি সরফরাজের জায়গায় নবাবের পদে বসানো হয় তাহলে নগদ এক কোটি টাকা নজরানা ছাড়াও সরফরাজের বিপুল বেআইনি লুটের সম্পত্তি দিল্লিসম্রাটের হাতে তুলে দেবে। এই প্রস্তাব শুনে নড়ে বসল মোগলরাজ মহম্মদ শাহ। অন্যদিকে ত্রিমূর্তির চক্রান্তে ঘটল আর এক ঘটনা যা সরফরাজের কফিনে পুঁতে দিল শেষ পেরেক। সরফরাজ নবাবের গদিতে বসার কিছুদিন আগে ইরানের নবাব নাদির শাহ ভারত আক্রমণ করে। নাদির শাহের সৈন্যদের হাতে প্রায় তিরিশহাজার দিল্লিবাসীর মৃত্যু হয়। মোগলরাজের রাজসভা এবং কোষাগার থেকে লুন্ঠিত হয় প্রচুর ধনসম্পদ । এর মধ্যে ছিল হীরকখচিত স্বর্ণসিংহাসন যার নাম ছিল ময়ূরসিংহাসন এবং মহামূল্যবান কোহিনূর। নাদির শাহের ভয়ে সারা দেশজুড়ে ত্রাহি ত্রাহি রব। আতঙ্কগ্রস্থ নবাব সরফরাজ অন্য কোনও উপায় না দেখে রাজদরবারে ত্রিমূর্তির কাছে পরামর্শ চাইল। ত্রিমূর্তি এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। তাদের পরামর্শে সরফরাজ নাদির শাহের নামাঙ্কিত স্বর্ণমুদ্রা প্রস্তুত করার জন্য ট্যাঁকশালে আদেশ জারি করল। মসজিদে মসজিদে হুকুমনামা জারি হল যে নাদির শাহের নামে বিশেষ প্রার্থনার আয়োজন করা হয়। যে কোনও ভাবেই হোক নাদির শাহের স্তুতি এবং তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনে যেন কোনও ত্রুটি না থাকে। এ ছাড়া নাদির শাহের হাত থেকে বাঁচার কোনও উপায় নেই। প্রচুর ধনসম্পদ এবং দাসীর বিনিময়ে সে যাত্রা প্রাণে বাঁচে গেল মোগলসম্রাট মহম্মদ শাহ। নাদির শাহ দিল্লি ছেড়ে চলে যাবার অব্যবহিত পরেই মহম্মদ শাহের সঙ্গে দেখা করে সরফরাজের কর্মকান্ডের কথা জানালেন আলিবর্দি। প্রমাণ হিসাবে নাদির শাহের নামাঙ্কিত স্বর্ণমুদ্রা মহম্মদ শাহকে দেখায় আলিবর্দি। প্রকারান্তরে এর অর্থ যে নাদির শাহকে নবাব হিসাবে মেনে নেওয়া সে কথা বুঝতে অসুবিধে হয় না নবাব মহম্মদ শাহের। রাজদরবারের অনুমতিক্রমে আলিবর্দি খানকে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার নবাব নিযুক্ত করে জারি হল আদেশনামা এবং ঘোষিত হল সরফরাজের মৃত্যুদন্ড।

নানাবিধ বিলাসব্যসনে এবং দুষ্কর্মে ব্যস্ত সরফরাজ এর বিন্দুবিসর্গ টের পেল না। ত্রিমূর্তি পরামর্শ দিল যে এই অর্থনৈতিক দুরাবস্থার সময় সেনাবাহিনীতে এত সৈন্য রাখার কোনও প্রয়োজন নেই। অর্থলোভী সরফরাজ এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। নবাবের সৈন্যসংখ্যা প্রায় অর্ধেক করে দেওয়া হল। যে সমস্ত সৈন্যদের বরখাস্ত করা হল আলিবর্দি তাদের বিহারের সৈন্যবাহিনীতে নিযুক্ত করে নিজের সৈন্যসংখ্যা অনেকগুন বাড়িয়ে নিলেন। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে আলিবর্দি ঘোষণা করলেন যে ভোজপুরের বিদ্রোহ দমনের জন্য কিছুদিনের মধ্যেই সৈন্যবাহিনী নিয়ে তিনি ভোজপুরের দিকে রওনা দেবেন। সরফরাজের রাজদরবারের সমস্ত খবর ত্রিমূর্তির প্রতিনিধি হয়ে হাজি আহমেদ পাঠাতে থাকল আলিবর্দিকে। আস্তে আস্তে কয়েকদিনের মধ্যে মুর্শিদাবাদ প্রবেশের সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হল এবং পত্রবিনিময়ের ওপর কড়া নজরদারি চালু করা হল গোপনে। আলিবর্দি নিজের সেনাধ্যক্ষদের কাছেও এই অভিযানের আসল কারণ জানালেন না। অত্যন্ত কুশলতার সঙ্গে অভিযানের মাঝপথে আসল সত্য জানিয়ে সেনাবাহিনীর আনুগত্য আদায় করে নিলেন আলিবর্দি। ওদিকে সরফরাজের সৈন্যবাহিনীর মধ্যে আসল সত্য জানিয়ে গোপনে নাশকতা চালিয়ে যেতে লাগল ত্রিমূর্তির গুপ্তচরেরা। সরফরাজের কাছে যখন খবর পৌঁছলো ততক্ষণে আলিবর্দি রাজমহলের পাহাড় অতিক্রম করে প্রায় বাংলার সীমান্তে পৌঁছে গিয়েছেন। সরফরাজ আর কোনও উপায় না দেখে আলবর্দির বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে একটি ছোট্ট গ্রাম গিরিয়াতে ছাউনি পাতল। পরের দিন শুভক্ষণ দেখে সরফরাজের সৈন্য আলিবর্দির সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাল। প্রথম দফায় ঘাউস খান এবং এবং রাজপুত বাজি সিং-এর নেতৃত্বে আলিবর্দির সৈন্যদের ছত্রভঙ্গ করে দিল সরফরাজের সেনাবিহিনী। অবস্থা বেগতিক দেখে রায় রায়ান আলমচাঁদ সরফরাজকে পরামর্শ দিল যে এই প্রচন্ড গরমে যুদ্ধ চালিয়ে গেলে সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে পড়বে। সুতরাং প্রয়োজন সাময়িক বিরতির। সরফরাজ এই পরামর্শ মেনে নিল। সেই সুযোগে আলিবর্দি নিজের পরিকল্পনা বদল করে অন্য পথে আক্রমণের আয়োজন সম্পূর্ণ করে ফেলল। সরফরাজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রভূত দুর্বলতা ছিল। সেই কারণে হাজি মহম্মদের উদ্দেশ্যের কথা জেনেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বা তাকে রাজদরবার থেকে সরাতে পারেনি সরফরাজ। এমনকি হাজি মহম্মদের আত্মীয় এবং খুব কাছের লোক শারিয়ার খানকে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরানোর সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি করে ফেলেছিল সরফরাজ। যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার পর সরফরাজ দেখতে পেল কামানের মধ্যে গোলার বদলে ইটপাটকেল আর বারুদের বদলে সুরকি ভরা আছে।

ঠিক এই সময়ে চতুর আলিবর্দি সরফরাজকে খবর পাঠালেন যে তার এই অভিযানকে যুদ্ধ ভেবে ভুল করেছে সরফরাজ। তিনি আসলে এসেছিলেন নবাব সরফরাজকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিনন্দন ও সম্মান প্রদর্শন করতে। সরফরাজের মনে তখন গভীর সন্দেহ। এই খবরে বিশ্বাস না করে সরফরাজ নিজের দুই বিশ্বস্ত অনুচর সুজাকুলি খান এবং খোজা বসন্তকে পাঠাল আলিবর্দির কাছে। আলিবর্দি কোরানে হাত রেখে শপথ করলেন যে তাঁর উদ্দেশ্য অসৎ নয়। তিনি সত্যিই নবাব সরফরাজকে অভিনন্দন জানাতে এসেছেন। আলিবর্দির কথায় সন্তুষ্ট হয়ে দুই অনুচর ফিরে গিয়ে সরফরাজকে জানাল আলিবর্দির কোরান স্পর্শ করে শপথের কথা। নবাব বা তার অনুচরেরা কেউই ভাবতেও পারেনি যে সুদৃশ্য মোড়কটি স্পর্শ করে আলিবর্দি শপথ নিয়েছিলেন তার ভিতরে কোরান ছিলনা, ছিল একটি ইট। আনন্দে উদ্বেল হয়ে সরফরাজ সবাইকে ডেকে খানপিনা নাচগানের ব্যবস্থা করতে হুকুম করল। আলিবর্দির সৈন্যরাও এসে হাজির হল। জমে উঠল খানাপিনা নাচগানের আসর। রাত যখন গভীর আলিবর্দির সৈন্যরা দুভাগে বিভক্ত হয়ে সরফরাজের ছাউনিতে হাজির হল। একদলের সঙ্গে চলল আলিবর্দির হাতি আর একটি ছোটদল গোপনে সরফরাজের তাঁবুকে পিছন দিক থেকে ঘিরে ফেলল। ভোরের আলো দেখা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই সরফরাজের দেহরক্ষীদের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল আলিবর্দির সেনা। চলল হত্যালীলা আর আগুনের গোলাবর্ষণ। তাড়াতাড়ি কোরানপাঠ সেরে সরফরাজ হাতির পিঠে চেপে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে রওনা দিল কিন্তু হঠাৎ এক বন্দুকের গোলা এসে সরফরাজের কপালের ঠিক মাঝখানে আঘাত করল। হাতির পিঠেই লুটিয়ে পড়ল সরফরাজের মৃতদেহ। সরফরাজের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই দাঙ্গা লেগে গেল মুর্শিদাবাদে। গিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্রেও শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। কিন্তু দিশাহীন সৈন্যবাহিনী অল্পসময়ের মধ্যেই পরাজয় স্বীকার করে নিল। কেউ লক্ষ্য করল না যে সরফরাজের বিশ্বাসী মাহুত হাতির পিঠে প্রভুর মৃতদেহ সারাদিন ধরে বহন করে মধ্যরাতে মুর্শিদাবাদে পৌঁছল। সরফরাজের ছেলে হাফিজুল্লাহ এবং জামাতা ইয়াসিন খান তড়িঘড়ি সরফরাজের দেহ কবরস্থ করে রাজধানী রক্ষার জন্য পথে নেমে পড়ল। কিন্তু ভাগ্যের এমনই নির্মম পরিহাস যে সরফরাজের বিশ্বস্ত সেনাবাহিনী হাফিজুল্লাহ এবং ইয়াসিন খানকে কোনওরকম সাহায্য করলনা। আলিবর্দি খান দু’দিন দু’রাত গিরিয়াতে তাঁবু পেতে বসে রইলেন। হাজি মহম্মদ শহরে এসে সকলকে শান্তির জন্য আবেদন জানানোর পর যখন শহর মোটামুটি শান্ত হল তখন আলিবর্দির বিজয়রথ মুর্শিদাবাদ এসে পৌঁছল। সরফরাজের বোন নাফিসা বেগমের সঙ্গে দেখা করার জন্য এত্তেলা পাঠাল আলিবর্দি। অনুরোধ জানাল যে পূর্বতন রাজপরিবারের কাছে সরফরাজের মৃত্যুর জন্য দুঃখপ্রকাশ এবং সমবেদনা জানাতে চায় সে । কিন্তু নাফিসা বেগম রাজি না হওয়ায় গেটের সামনে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে সরফরাজের মৃত্যুর জন্য দুঃখপ্রকাশ এবং সমবেদনা জানিয়ে আলিবর্দি চেহেল সেতুন অর্থাৎ রাজপ্রাসাদের চল্লিশ স্তম্ভশোভিত সভাগৃহে নিজেই নিজেকে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার নবাবপদে অভিষিক্ত করল।আলিবর্দির বয়স তখন প্রায় সত্তর। অপরিবর্তিত রইল বিশ্বাসঘাতকতা, অন্তর্ঘাত আর চক্রান্তের পথ ধরে ক্ষমতা দখলের ইতিহাস। সেদিন আলিবর্দি নিজেও জানতেন না যে তার উত্তরাধিকারীর জন্য অপেক্ষা করে আছে এই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। তারপর আজ দীর্ঘ বারোবছরের পর শুধুমাত্র রাজপরিবারের সদস্যদের এই একান্ত পারিবারিক সান্ধ্যবৈঠকে আলিবর্দি কেন জগৎশেঠ মোহতাবচাঁদ রাইকে ডেকে পাঠালেন সে কথা জানতে গেলে আর একটু পিছন ফিরে তাকাবার প্রয়োজন আছে।

জগৎশেঠ কোনও ব্যক্তির নাম নয়। এটি একটি পারিবারিক উপাধি যার অর্থ আন্তর্জাতিক অর্থব্যবসায়ী। হীরানন্দ সাহু নামে এক রাজস্থানী হীরক ব্যবসায়ী সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি দেশ ছেড়ে পাটনায় এসে হীরা এবং সুদের ব্যবসা শুরু করে। হীরানন্দ নিজের ছেলেদের বিভিন্ন শহরে ব্যবসাবিস্তারের জন্য পাঠায়। তারই এক ছেলে মানিকচাঁদ ঢাকায় এসে ব্যবসা শুরু করে। ঢাকা তখন অবিভক্ত বাংলার রাজধানী। ঢাকায় এসে তার ব্যবসা ক্রমশ ফুলে ফেঁপে ওঠে এবং ঘটনাচক্রে নবাব মুর্শিদকুলির কাছে এই নতুন ধনকুবেরের খবর পৌঁছয়। ধীরে ধীরে নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে মানিকচাঁদের। মুর্শিদকুলি যখন রাজধানী ঢাকা থেকে মুকুসুদুবাদে সরিয়ে নিয়ে এসে নিজের নাম অনুসারে শহরের নাম মুর্শিদাবাদে পরিবর্তন করল তখন তার সঙ্গে মানিকচাঁদও মুর্শিদাবাদে এসে মহিমাপুরে প্রাসাদোপম অট্টালিকা তৈরি করে বসবাস করতে শুরু করে দিল। নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা যত বাড়তে থাকল ততই তার প্রতি নবাবের নির্ভরতা বৃদ্ধি পেতে লাগল। দেখতে দেখতে মানিকচাঁদ নবাবের খাজনা সংগ্রাহক এবং রাজকোষাধ্যক্ষ হয়ে উঠল। রাজপরিবারের অর্থ ব্যবসায় নিয়োগ করে বহুগুন বাড়িয়ে রাজকোষাগারে ফিরিয়ে দিয়ে নবাবের পরিবারের প্রায় একজন হয়ে উঠল মানিকচাঁদ। কালক্রমে পৃথিবীর বড় বড় ধনকুবেরদের মধ্যে একজন হয়ে উঠল মানিকচাঁদ। মানিকচাঁদের পালিতপুত্র ফতেচাঁদ এই ব্যবসাকে নিয়ে গেল এক অকল্পনীয় উচ্চতায়। সেই সময়ের যত রাজা জমিদার সবাই পরম বিশ্বাসে তাদের অর্থ গচ্ছিত রাখত ফতেচাঁদের কাছে আর ফতেচাঁদও তাদের অর্থ সুদের ব্যবসায় খাটিয়ে অনেকগুন করে ফিরিয়ে দিত তাদের। সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে খাজনা সংগ্রহ, অর্থ বিনিয়োগ, বিদেশি মুদ্রা আমদানি এবং রাজা জমিদারদের কোষাগার পরিচালনার একচ্ছত্র অধিকার অর্জন করল ফতেচাঁদ। দিল্লির নবাব মহম্মদ শাহ ফতেচাঁদকে জগৎশেঠ উপাধিতে ভূষিত করল। আলিবর্দির নবাব হওয়ার পিছনে ত্রিমূর্তির এক মূর্তি জগৎশেঠ ফতেচাঁদের অবদানের কথা আমরা আগেই জেনেছি। আলিবর্দি নবাব হওয়ার চার বছর পরে দেহত্যাগ করল ফতেচাঁদ। মোহতাবচাঁদ রাই হল নতুন জগৎশেঠ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মোহতাবচাঁদও হয়ে উঠল নবাবদরবার এবং নবাবপরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

আজ সন্ধ্যাবেলায় প্রতিদিনের মত রাজপ্রাসাদে এসে হাজির হল চাটুকার, কৌতুক অভিনেতা এবং খোজারা। তারা প্রতিদিন এই সময়ে আসে নবাবের চিত্তবিনোদনের জন্য। কোনওদিন আসেন ওস্তাদ আর বাইজিরা। তাদের নাচে গানে বাজনায় জমে ওঠে সন্ধ্যার আসর। নবাবকে খুশি করে কে পুরস্কার পাবে তারই প্রতিযোগিতা চলে এই আসরে। কিন্তু আজ দ্বাররক্ষক তাদের ফিরিয়ে দিল। সারাদিনের কাজ সেরে অশিতিপর বৃদ্ধ আলিবর্দি বৈঠকখানায় প্রবেশ করে সকলকে আসন গ্রহণ করতে বলে নিজের জায়গায় বসতে বসতে বললেন,’ তোমরা নিশ্চয় খুব অবাক হয়েছ এই কথা ভেবে কেন আমি তোমাদের এখানে ডেকেছি। ভয়ের কিছু নেই। কোনও বিপদ হয়নি। কোনও আক্রমণের মুখোমুখি হইনি আমরা। আমার শত্রুবিড়ম্বিত শাসনকাল এখন একটু শান্তির মুখ দেখেছে। আমার জন্য তোমাদের অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। হারাতে হয়েছে প্রিয়জনদের। তার জন্য আমার কষ্ট কিছু কম হয়নি তোমাদের থেকে। এখন আমি বৃদ্ধ হয়েছি। হয়ত আর বেশিদিন রাজ্যপাট সামলানো সম্ভব হবে না। তাই এই সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর নাম ঘোষণা করার জন্য আজ এই সভায় তোমাদের ডেকেছি। আমি আশা করব আমার মৃত্যুর পর তার মসনদে বসার ক্ষেত্রে যেন কোনও বাধার সৃষ্টি না হয়। আজকের এই সভায় তোমরা প্রত্যেকে এই শপথ গ্রহণ করবে যে তার রাজত্বকালে তোমরা সবাই তার পাশে থাকবে এবং সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। কোনও অবস্থাতেই তোমরা কেউ তার বিরুদ্ধাচরণ করবে না।‘ নবাবের কথা শেষ হতে না হতেই জগৎশেঠ মোহতাবচাঁদ রাই বললেন,’ নবাববাহাদুর , যাকেই আপনি আপনার উত্তরাধিকারীর স্থলাভিষিক্ত করুন না কেন রাজসিংহাসনের প্রতি আমার আনুগত্য অবিচল থাকবে চিরকাল । আমার পূর্বপুরুষেরাও চিরকাল তাই করে এসেছেন।‘ আলিবর্দি বলল,’ ধন্যবাদ, জগৎশেঠ। আপনার আচরণ সত্যই শিক্ষণীয়। আপনি প্রকৃতই একজন শুভাকাঙ্খী পার্ষদ। আপনার নিঃশর্ত সমর্থন আমাকে মুগ্ধ করেছে।‘

আলিবর্দির জ্যেষ্ঠাকন্যা মেহেরুন্নিসা ওরফে ঘসেটি বেগম নিজেকে স্থির রাখতে পারল না। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেল তার। বলে উঠল,’ আমার আর তর সইছে না। কাকে আপনি ভাবী নবাবের পদে অভিষিক্ত করতে চান জানতে আমার মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।‘ আলিবর্দি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। সভায় এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। কান পাতলে সকলের হৃৎস্পন্দন শুনতে পাওয়া যাবে এমন গভীর সেই শব্দহীনতা। তারই মাঝে বেজে উঠল নবাব আলিবর্দির জলদ্গম্ভীর কন্ঠস্বর ,’ সিরাজদৌল্লা।‘ সে কন্ঠস্বর যেন রুদ্ধদ্বার সভাকক্ষ অতিক্রম করে মুর্শিদাবাদের আকাশ বাতাস আলোড়িত করে তুলল। ঘোষণা শোনামাত্র ঘসেটি বেগমের ফর্সা সুন্দর মুখ রক্তের মত লাল হয়ে উঠল। চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গেছে তার। কী যেন বলতে চাইছে সে কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। সভাসুদ্ধ সকলে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। বেশ খানিকক্ষণ পরে চিৎকার করে বলে উঠল,’ এ অন্যায় , ভয়ঙ্কর অন্যায়। এ হতে পারে না। আপনি সিরাজের প্রতি স্নেহে অন্ধ হয়ে গেছেন। সিরাজের মত একজন দুশ্চরিত্র মদ্যপ লম্পটকে আপনি রাজ্যভার অর্পণ করে শুধু রাজপরিবারের নয় সমস্ত দেশের বিপদ ডেকে আনছেন। তার বয়স এখনও কুড়ি পার হয়নি। এর মধ্যেই সে সুরা এবং নারীতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। কাউকে তোয়াক্কা না করে প্রজাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। সিরাজ নবাবের আসনে বসলে দেশসুদ্ধ লোক রাজপরিবারের বিরুদ্ধে চলে যাবে। একাজ আপনি করবেন না।‘

আলিবর্দি বললেন,’ তুমি আমার জ্যেষ্ঠাকন্যা। সেই জন্য তোমার কুকথা আমি এতক্ষণ সহ্য করছি। কান খুলে শুনে রাখ, অনেক ভেবে আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মসনদে বসতে গেলে একজন মানুষের যা যা গুন থাকা দরকার সবই আছে সিরাজের মধ্যে। যারা মূর্খ তারা বিশ্বাস করে একজন রাজার প্রধান গুন প্রজাবাৎসল্য। প্রজাবাৎসল্য নয় প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা এবং কর আদায় করার সমস্ত উপায় যার জানা আছে সেই নবাবের আসনে বসার যোগ্য। প্রয়োজনে অধীনস্থ জমিদার এবং প্রজাদের প্রতি অত্যাচার রাজধর্মবিরোধী নয়। রাজকোষাগারে অর্থ এবং সম্পদ বৃদ্ধি করাই রাজার মুখ্য কাজ। তার জন্য প্রয়োজন হলে কঠোর থেকে কঠোরতম পথ অনুসরণ করতে হবে। নিজের সাম্রাজ্যকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার অর্থ সম্পদবৃদ্ধি অব্যাহত রাখা। তাই যে কোনও উপায়ে সাম্রাজ্যরক্ষা এবং সাম্রাজ্যবিস্তার রাজকর্তব্য বলে বিবেচিত হয়। তাই যখন আমাদের সেনাবাহিনীর আফগান বিদ্রোহীরা আহমাদ শাহের উস্কানিতে পাটনা আক্রমণ করেছিল তখন আমি নিজে আমার বেতনভোগী সেই সমস্ত বিদ্রোহীদের নির্দ্ধিধায় হত্যা করেছিলাম। সিরাজের পিতা, আমার শ্রেষ্ঠ জামাতা জইনুদ্দিন আহমেদকে আমি ওদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারিনি। সিরাজের শরীরেও জইনুদ্দিনের রক্ত প্রবহমান। সে তার পিতার মতই নির্ভীক এবং সাহসী। অতি অল্প বয়সেই আমাকে বন্দি করে পাটনা দখল করে নেবার মত বুদ্ধি এবং সাহসের প্রমাণ সে দিয়েছে। জইনুদ্দিনের অবর্তমানে সিরাজ ছাড়া আর কাকে আমি এই গুরুদায়িত্ব অর্পণ করতে পারি?’

ঘসেটি বেগম দমবার পাত্রী নয়। বলল,’ কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনি কি আমাকে বঞ্চিত করলেন না? আপনার জামাতা নওয়াজিস এখনও জীবিত।‘

আলিবর্দি – ‘ঈর্ষা তোমার স্বাভবিক বুদ্ধিকে গ্রাস করেছে। দেশশুদ্ধু সমস্ত লোক জানে সিরাজের আপন ভাই এবং তোমাদের পালিতপুত্র ইক্রমের অকালমৃত্যুর পর থেকে নওয়াজিস শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে। দুঃখের হলেও সত্যি তার জীবনকাল সীমিত হয়ে আসছে। তার আচরণ পুরুষোচিত নয়। অনেক বিশ্বাস করে ঢাকার দায়িত্ব আমি তাকে দিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে কোনও রাজস্ব রাজকোষাগারে আসে না আজ অনেকদিন হল। আদায়ের টাকা কোথাইয় যাচ্ছে তাও আমি জানিনা। সে নিজেও মুর্শিদাবাদ ছেড়ে ঢাকা যেতে চায় না। এক লোভী বহিরাগতকে সব দায়িত্ব দিয়ে বিলাসব্যসনে মত্ত থাকে সে। সব জেনেও তাকে এই দেশের দায়িত্বভার আমি কী করে দিয়ে যেতে পারি?’

ঘসেটি- ‘তার সমস্ত কাজ তো আমিই এখন করছি। আমি কি তার রাজত্বভার চালনা করতে পারব না বলে আপনার মনে হয়?’

আলিবর্দি –‘জমিদারি চালানো আর দেশ চালানো এক নয়। তুমি মূর্খ এবং লোভী। তোমার সঙ্গে অযথা বাক্যব্যয় করে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আর একটা কথা শুনে রাখ সাময়িক শান্তি দেখে একথা ভেবে বিভ্রান্ত হয়ো না যে আমরা নিরাপদ। কোম্পানির লোকেরা অচিরেই দেশের শাসনভার নিজেদের হাতে নেবার জন্য প্রস্তুতি চালাচ্ছে। কোম্পানির সঙ্গে আপস করে আর তাদের হাতে প্রভূত অর্থ তুলে দিয়ে যে ভাবে এতদিন চলেছে সে ভাবে আর চলবে না। কোম্পানি এখন মসনদে বসতে চায়। এই ভয়ঙ্কর সময়ে মসনদ রক্ষা করার মত সাহস একমাত্র সিরাজের আছে। ইংরেজদের কাছে বারবার অপমানিত হয়ে সিরাজ ঘোরতর ইংরেজবিদ্বেষী হয়ে উঠেছে। সিরাজের এই তীব্র প্রতিশোধস্পৃহা ওর যুদ্ধজয়ের পথে ওকে সাহায্য করবে।

ঘসেটি- কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন না সিরাজ নবাব হলে আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবে না। আমাদের ধনসম্পত্তি, প্রাসাদ সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে পথের ভিখারি করে দেবে।

আলিবর্দি- তুমি ক্রোধে আর বিরোধিতায় অন্ধ হয়ে উঠেছ। সিংহাসনের প্রতি তোমার লোভ যে কতদূর সে কথা আমার চেয়ে বেশি আর কে জানে? সিরাজের ভাই ইক্রমকে দত্তক নেওয়ার পিছনে তোমার অভিসন্ধির কথা সর্বজনবিদিত। ইক্রমের অকালমৃত্যু তোমার অভিসন্ধিকে বাস্তব হতে দেয়নি। অক্ষম নওয়াজিস তোমাকে নিজের সন্তানধারণ থেকে বঞ্চিত করেছে। তাই ইক্রমকে দত্তক নিয়ে তুমি ভেবেছিলে সেই হবে মসনদের দাবিদার। সে পথ বন্ধ হয়ে গেছে বলে তুমি পাগলের মত অন্য পথের সন্ধান করছ আর নওয়াজিস শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে। সিরাজই রাজপরিবারের সন্তান এবং নবাব হবার উত্তরাধিকারী। এই সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আমি যতদিন বেঁচে আছি তুমি এবং নওয়াজিস সম্মান এবং মর্যাদার সঙ্গে মতিঝিল প্রাসাদে বাস করবে। আমার মৃত্যুর পর কী হবে তা তোমাদেরই ঠিক করতে হবে। রাজকার্যে নাক না গলানোই তোমাদের পক্ষে শুভ হবে।

প্রচণ্ড ক্রোধে এবং দুঃখে নিজেকে আর স্থির রাখতে না পেরে একদৌড়ে রাজসভা ত্যাগ করল ঘসেটি বেগম। কিন্তু সেদিন ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরে গেলেও সিরাজকে যেভাবেই হোক রাজসিংহাসন থেকে বঞ্চিত করার গভীর চক্রান্তে মেতে উঠল ঘসেটি বেগম। শয্যাশায়ী নওয়াজিস অনেক দিন আগে থেকেই ঢাকার দায়িত্ব সহকারী এবং বন্ধু হুসেন কুলি খানের হাতে ছেড়ে মতিঝিল প্রাসাদে নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছিল। ঢাকা থেকে খাজনা আর উৎকোচের টাকা আলিবর্দির কোষাগারের বদলে পৌঁছে যাচ্ছিল মতিঝিল প্রাসাদে। অভিজ্ঞ নবাব আলিবর্দির সে কথা বুঝতে কোনও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরের এই কথা বাইরে যেতে পারে এবং নিজের মেয়ে-জামাইয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সমীচিন হবে না ভেবে চুপ করেই ছিল আলিবর্দি। শোনা যায় এই সময় হুসেন কুলির সঙ্গে ঘসেটি বেগমের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। মতিঝিল প্রাসাদে বন্ধুকে দেখতে আসার আছিলায় হুসেন কুলির যাতায়াত বাড়তে থাকে। অক্ষম নওয়াজিসের নানাবিধ বিকৃত চাহিদা পূরন করে তাকে একেবারে বশ করে ফেলেছিল হুসেন কুলি। আলিবর্দির আমলে ঢাকাতে আরও একজন অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠেছিল । তার নাম রাজবল্লভ। রাজবল্লভের সম্বন্ধে জানতে হলে একটু পিছনে ফিরে যেতে হবে। মুর্শিদকুলি যখন নবাব তখন নিজের দৌহিত্র সরফরাজকে ঢাকার নায়েব নাজিম হিসাবে নিযুক্ত করে। সরফরাজ তার বোন নাফিসা বেগমের অনুরোধে তার ভাগ্নে মুরাদ আলির সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দেয় এবং মুরাদ আলিকে ঢাকার কেয়ারটেকার হিসাবে নিযুক্ত করে। মুরাদ আলির দপ্তরে মুন্সির কাজ করত রাজবল্লভ। অর্থলোভী মুরাদ আলিকে রাজকোষ থেকে অর্থ সরাতে সাহায্য করত রাজবল্লভ। চুরির টাকা ভাগ করে নিত দু’জনে। কিছুদিনের মধ্যেই পদোন্নতি হল রাজবল্লভের। বিক্রমপুরের রাজবল্লভ হল মুরাদ আলির পেশকার। এরপর রাজবল্লভকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ঢাকার খাজনা আর বিদেশি ব্যবসায়ীদের ঘুষের টাকা আত্মসাৎ করে প্রভূত ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে গেল রাজবল্লভ। ইতিমধ্যে সরফরাজকে হত্যা করে আলিবর্দি নবাব হয়েছেন বাংলার। আলিবর্দির আনুকূল্যে একদিকে ঢাকায় ফুলে ফেঁপে উঠল রাজবল্লভ আর অন্যদিকে মুর্শিদাবাদে বেড়ে উঠল ফতেচাঁদ জগৎশেঠ আর আলমচাঁদ। নওয়াজিসের বকলমে ঢাকায় রাজত্ব করছিল হুসেন কুলি। কিছুদিন পর হুসেন কুলিকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসে আলিবর্দি আর হুসেন কুলির জায়গায় ঢাকার দায়িত্ব সামলাতে থাকে হুসেন কুলির ভাইপো এবং জামাই হুসেনুদ্দিন। কাকা-ভাইপো অথবা শ্বশুর-জামাই মিলে রাজবল্লভের সঙ্গে একজোট হয়ে সমস্ত খাজনার টাকা ভাগ করে নিতে থাকল নওয়াজিস আর ঘসেটির সঙ্গে। আলিবর্দির ঘোষণার কথা জানার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের রক্ষার জন্য নওয়াজিস, ঘসেটি, হুসেন কুলি, হুসেনুদ্দিন আর রাজবল্লভের মধ্যে গড়ে উঠল অশুভ আঁতাত। লক্ষ্য সিরাজকে যে ভাবেই হোক সরাতে হবে।

এদিকে মসনদে বসা নিশ্চিত জেনে সিরাজ হয়ে উঠল আরও ভয়ঙ্কর। জাতি,ধর্ম,‌বয়স, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সিরাজের অত্যাচার বেড়েই চলল।কঠোর পরিশ্রমে তিলতিল করে যে সাম্রাজ্য সৃষ্টি করেছিলেন আলিবর্দি তাকে নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে আস্তে আস্তে ঠেলে দিতে লাগল সে। অত্যাচার এবং হত্যার মধ্যে পাশবিক আনন্দের সন্ধান পেত সিরাজ। মানুষের প্রতি অত্যাচার এবং নির্মম হত্যালীলা ক্রমশ তার কাছে প্রতিদিনকার খেলা হয়ে উঠল। স্নেহান্ধ আলিবর্দি সিরাজের এই অস্বাভাবিক মানসিকতার কথা জানতেন নিশ্চয়ই । তাহলে কি বহু অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ বৃদ্ধ আলিবর্দি বিশ্বাস করতেন যে মানুষের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণে বা প্রয়োজনে হত্যা করতে যার হৃদয় এতটুকু বিচলিত হয়না সেই রাজসিংহাসনের যোগ্য উত্তরাধিকারী? সিরাজের অনুচর আর সাঙ্গপাঙ্গরাও ছিল সিরাজের মতই। একবার সিরাজের বিশ্বাসী অনুচর মোহনলাল সিরাজের অনুরোধে তার বোন সুন্দরী আলেয়াকে পাঠিয়েছিল সিরাজের কাছে। আলেয়া ছিল পরমা সুন্দরী এবং সুন্দরী হিসাবে তার খ্যাতি ছিল যথেষ্ট । মাত্র ২২সের ওজনের এই বালিকা নিজের রূপকে অর্থ উপার্জনের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠেছিল। এমনই ফর্সা ছিল তার গায়ের রঙ আর এমনই মসৃণ আর পাতলা ছিল তার গাত্রচর্ম যে সে যখন পান খেত আর পানের লাল রস তার গলা দিয়ে নামত তা পরিস্কার দেখা যেত বাইরে থেকে। সিরাজ আলেয়াকে তার নিজের প্রাসাদের নর্তকী করে রাখে। সিরাজের কাছে থাকতে থাকতেই সিরাজের সুদর্শন শ্যালকের সঙ্গে তার গোপন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সিরাজের কানে একথা পৌঁছতেই ক্রোধান্ধ সিরাজ আলেয়াকে সকলের সামনে কটুভাষায় দেহোপজিবিনী বলে সম্বোধন করে। উদ্ধত আলেয়াও পরিস্কার জানিয়ে দেয় যে সত্যিই দেহোপজিবিনী আর সে জন্যেই সে সিরাজের অঙ্কশায়িনী হতে রাজি হয়েছে। তার মানে এই নয় যে সিরাজের কোনও অধিকার জন্মে গেছে তার শরীরের প্রতি। তার শরীর সে যাকে খুশি বিক্রী করতে পারে। সিরাজ আর তার মায়ের তাতে কোনও আপত্তি থাকলে তার কিছু করার নেই। প্রত্যাশিতভাবেই আলেয়ার জায়গা হয় কারাপ্রাচীরের অন্তরালে। তারপর আর আলেয়ার খোঁজ কেউ পায়নি। সিরাজের অমানবিক ক্রূরতার আরও অনেক গল্প ছড়িয়ে আছে মুর্শিদাবাদের পথে প্রান্তরে নদীতে। মুর্শিদাবাদের হিন্দু মহিলাদের রীতি ছিল ভাগিরথীতে স্নান করবার। সিরাজের গুপ্তচরেরা লক্ষ্য রাখত তাদের মধ্যে যারা সুন্দরী এবং অল্পবয়সী তাদের প্রতি। তারপর সময় বুঝে অতর্কিতে ছোট ছোট নৌকায় জোর করে তুলে নিয়ে চালান করে দিত সিরাজের প্রাসাদে। বর্ষায় যখন ভাগিরথী ভয়ঙ্কর হয়ে উঠত তখন নদীতে মাঝে মাঝেই ঘটত নৌকাডুবি। নৌকাডুবিতে একসঙ্গে শ’য়ে শ’য়ে অসহায় নারী, শিশু, পুরুষের সলিল সমাধির দৃশ্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করত নররূপী রাক্ষস সিরাজ। যখন কোনও অবাধ্য জমিদার জোর করে খাজনার টাকা আদায়ে রাজি হত না অথবা যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ রাজকোষে সময়ে জমা দিত না অথবা গোপনে বিপ্লবের কাজে মদত দিত তখন তাকে হত্যা করতে পিছপা হতোনা সিরাজ। আলিবর্দি যখন বিশ্রামের জন্য মুর্শিদাবাদের বাইরে কোনও বাগানবাড়িতে আমোদপ্রমোদে দিন কাটাতেন তখন তার অতি প্রিয় বিশ্বস্ত নাতি সিরাজ একা কোনও গোপন কক্ষে এই হত্যাকান্ড সংঘটিত করত যাতে আর্তনাদের স্বর পরম ধার্মিক নবাব আলিবর্দির কানে না পোঁছয়। সুতরাং কেবলমাত্র অন্ধ স্নেহের বশবর্তী হয়ে আলিবর্দি যে সিরাজকে রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী করেছিলেন এবং নিজে জীবিত থাকতে থাকতেই সিরাজের সমস্ত পথের কাঁটা নির্মূল করেছিলেন সে কথা ভাবা অন্যায় হবে। সিরাজকে নবাবের পদে বসানোর পিছনে ছিল আলিবর্দির সুচিন্তিত পরিকল্পনা। যে নিষ্ঠুরতা, ক্রূরতা এবং নির্মমতা একজন রাজাকে সাফল্য এনে দিতে পারে সেই সব রাজকীয় গুনাবলীতে সিরাজকে সমৃদ্ধ করে তবেই তাকে পরবর্তী নবাব হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন আলিবর্দি। ভেবেছিলেন রাজ্যের সীমা আর রাজকোষাগারের অর্থ বৃদ্ধি করার ক্ষমতা আছে একমাত্র তাঁর নিজের প্রশিক্ষণে বেড়ে ওঠা দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌল্লার। আফসার সাম্রাজ্যের একাধিপত্য এবং উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধির জন্য সিরাজের বিকল্প আর কেউ নেই। নিষ্ঠুরতা এবং ক্রূরতায় আলিবর্দিও কম ছিলেন না। কেবলমাত্র সরফরাজকে হত্যা করে নবাব হওয়াই নয় যে কঠোর নির্মমতার সঙ্গে মারাঠা সেনাপতি ভাস্কর পন্ডিত আর তার সেনাপ্রধানদের আলোচনা বৈঠকে ডেকে এনে হত্যা করেছিলেন ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার।

আলিবর্দি জানতেন যে সেদিন আসতে আর বেশি দেরি নেই যেদিন বণিকের মানদণ্ড দেখা দেবে রাজদণ্ড রূপে। ইংরেজরা যে বাংলার মসনদ দখলের জন্য ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেছে বিচক্ষণ আলিবর্দির তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। ব্রিটিশদের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ না থাকলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে রাজকোষাগার আর মসনদ রক্ষা করা সম্ভব নয়। সিরাজের সঙ্গে ব্রিটিশদের সম্পর্ক অনেকদিন থেকেই খারাপ। ব্যবসার সুবিধার জন্য নানা বিষয়ে রাজসভার সম্মতির প্রয়োজন হত ব্রিটিশদের। সেইজন্য ইংরেজদের বেতনভুক উকিলেরা কোনও রাজসভাসদ বা নবাবের কোনও নিকট আত্মীয়ের শরণাপন্ন হত। প্রয়োজনে তাদের ঘুষ দিয়ে হাত করত নিজেদের কার্যসিদ্ধির জন্য। কিন্তু ব্রিটিশ ব্যবসায়ী বা তাদের উকিলেরা কোনওদিন সিরাজের শরণাপন্ন হতনা। সিরাজের প্রতি আলিবর্দির দুর্বলতার কথা জেনেও ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা অনেক সময় সিরাজকে তাদের কারখানায় বা বাড়িতে ঢুকতে দিতনা। সবাই ভয়ে ভয়ে থাকত কখন সিরাজ কোনও তুচ্ছ কারণে বাড়াবাড়ি শুরু করবে। আসবাবপত্র ভাঙচুর করবে বা ইচ্ছে হলে কোনও দামি আসবাব তুলে নিয়ে চলে যাবে। এই অপমানের আগুনে সিরাজ জ্বলে পুড়ে মরত সবসময় আর অপেক্ষায় থাকত প্রতিশোধের। নবাব হয়ে সে যে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাবে সে কথা সবাই জানত। কিন্তু অন্য বিদেশি ব্যবসায়ী যেমন ফরাসি বা ড্যানিসদের সঙ্গে তার সম্পর্ক খারাপ ছিলনা। ফরাসি এবং ড্যানিস ব্যবসায়ীরা ব্রিটিশদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য সিরাজকে তোয়াজ করত, নানারকম উপঢৌকন দিত এমনকি আলিবর্দির কাছ থেকে সম্মতি আদায়ের জন্য তাকে ব্যবসার লভ্যাংশও দিত। সব জেনেশুনেও আলিবর্দি কিছু বলতেন না উপরন্তু নানা বিষয়ে মধ্যস্থতা করার জন্য সিরাজের প্রশংসা করতেন। রাজকোষাগারের অর্থবৃদ্ধি করার নতুন নতুন পদ্ধতি অবলম্বনের জন্য সিরাজকে উৎসাহিত করতেন।

আলিবর্দি নিজে কিন্তু ব্রিটিশদের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতেন। মারাঠা আক্রমণে বিধ্বস্ত এবং বয়সের ভারে ক্লান্ত আলিবর্দি অযথা ব্রিটিশদের সঙ্গে ঝামেলায় যেতে চাইতেন না। যতটা সম্ভব ব্রিটিশদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলতেই চাইতেন। একবার আলিবর্দির খুব আস্থাভাজন এক সেনাপতি মুস্তাফা খান আলিবর্দির কাছে ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করে কলকাতায় তাদের সবকিছু দখল করার পরামর্শ দেয়। সিরাজ তখন খুব ছোট। দশ-এগার বছরের হবে। আলিবর্দির দুই জামাই সেখানে উপস্থিত ছিল এবং তারা মুস্তাফার কথায় সায় দিচ্ছিল। আলিবর্দি কোনও কথা না বলে মুস্তাফার প্রস্তাব শুনলেন কিন্তু কিছু বললেন না। মুস্তাফা চলে যাবার পর জামাইদের উদ্দেশ্যে গম্ভীরভাবে বললেন,’ শোন, আমি নিজের কোনও পুত্রসন্তান নেই এবং তোমরাই আমার পুত্র। মুস্তাফা একজন বেতনভোগী সৈনিক। সে প্রয়োজনে আমাদের হয়ে যুদ্ধ করেছে এবং অনেক সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। এটা তার পেশা এবং চাকরি। নিজের যোগ্যতার পরিচয় যখনই সে দিয়েছে তখনই সে পুরস্কৃত হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ হবে কি হবে না সে সিদ্ধান্ত নেব আমরা। যদি যুদ্ধ হয় তাহলে মুস্তাফা আমাদের হয়ে যুদ্ধ করবে। সেটাই মুস্তাফার কাজ। তোমাদের মনে রাখা উচিৎ তোমরা রাজপরিবারের সদস্য। এই সাম্রাজ্যের ভাবী কর্ণধার তোমরা। সামান্য এক বেতনভুক সেনাপ্রধানের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া তোমাদের মানায় না। মুস্তাফা কী মনে করে কী করে না তাতে আমাদের কিছু এসে যায় না। এর আগেও সে মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধ জিতে বিহারের গভর্নর হওয়ার জন্য আমার কাছে দরবার করেছিল। আমি রাজি হইনি। একটা কথা মনে রাখ যুদ্ধ বাধানোর পিছনে মুস্তাফার যে স্বার্থ আছে তা আমাদের স্বার্থের বিরোধী। মুস্তাফা চায় তার প্রতি আমাদের নির্ভরতা বৃদ্ধি পাক।যুদ্ধ লাগলে তার লাভ আমাদের নয়। উপরন্তু আমরা আরও বেশি করে তার প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়ব। কিন্তু ওকে আমাদের প্রয়োজন, তাই ওর মুখের ওপর আমি কিছু বলতে চাইনি। চুপ করে থাকাই ঠিক মনে করেছি। তোমরা বল ব্রিটিশরা আমাদের কী করেছে যে তাদের ওপর এখনি আক্রমণ করতে হবে। সে সময় যখন আসবে তখন দেখা যাবে। বিনা কারণে আগুন জ্বালালে সেই আগুনে নিজেদের পুড়তে হবে।আমাদের নিজেদের মাঠে ঘাটের আগুন নিয়েই আমরা ব্যতিব্যস্ত আর তোমরা সমুদ্রে আগুন জ্বালাতে চাইছ? ‘ তবে একথা মনে করা ঠিক হবে না যে আলিবর্দি ব্রিটিশদের অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন যা খুশি করার। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ব্রিটিশদের নিজের জায়গা দেখিয়ে দিতে ছাড়তেন না। একবার এক ব্রিটিশ সৈনিক নিজেকে অত্যন্ত ক্ষমতাবান মনে করে হুগলি অভিমুখী একটা বাণিজ্য জাহাজে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে মুসলমান এবং আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ীদের অনেক মূল্যবান সামগ্রী লুঠ করে পালায়। সেই লুঠের জিনিসের মধ্যে নবাবেরও কিছু মূল্যবান সামগ্রী ছিল। খবর আলিবর্দির কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নরকে পরোয়ানা জারি করে নিজের শুধু নিজের বিরক্তির কথাই জানালেন না ,কলকাতা এবং ঢাকায় কোম্পানির কাজকর্ম প্রায় বন্ধ করে দেবার ব্যবস্থা করলেন।পরোয়ানাতে লিখলেন,’ সিয়াদ,মোগল এবং আর্মেনিয়ান ব্যবসায়ীরা আমার কাছে অভিযোগ জানিয়েছে যে আপনারা তাদের লক্ষাধিক মূল্যের সামগ্রী এবং অলঙ্কার লুন্ঠন করেছেন।এর মধ্যে বিদেশ থেকে আমাকে প্রেরিত বেশ কিছু মূল্যবান উপহারসামগ্রীও আছে। আপনাদের ব্যবসা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে , জলদস্যুবৃত্তির নয়।এই ব্যবসায়ীরা আমাদের বিশিষ্ট নাগরিক এবং এনাদের অর্থে এই রাজ্যের অনেকে প্রতিপালিত হয়। সুতরাং এনাদের অভিযোগ শোনবার এবং তার চিরস্থায়ী সমাধানের জন্য আমি দায়বদ্ধ। আমার এই পরোয়ানা আপনার হাতে পৌছনোর সঙ্গে সঙ্গে আপনি সমস্ত লুন্ঠিত সামগ্রী ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবেন অন্যথায় আপনাদের সামনে এমন বিপদ অপেক্ষা করে আছে যা আপনারা কল্পনাও করতে পারছেন না। ‘ পরোয়ানা পাবার সঙ্গে সঙ্গেই একটি সুন্দর আরবি ঘোড়া উপঢৌকন হিসাবে আলিবর্দির কাছে পৌছে দিল ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর। কিন্তু তাতে আলিবর্দির শান্ত হওয়াতো দূরের কথা আরও ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলেন তিনি। ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের সমস্ত জলযান স্তব্ধ করে দেওয়া হল। কাশিমবাজারের ফ্যাক্টরি ঘিরে রইল নবাবের সৈন্যবাহিনী এবং ফ্যাক্টরির ভিতর এবং বাইরে থেকে যাতে কোনও সামগ্রী বেরুতে এবং ঢুকতে না পারে তার দিকে কড়া দৃষ্টি রইল তাদের। বারো লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে অবস্থা স্বাভাবিক করল ব্রিটিশরা সেযাত্রা। এরমধ্যে চার লক্ষ টাকা দেওয়া হল কেবল আলিবর্দিকেই। তবে নরমে গরমে ব্রিটিশদের যে বেশিদিন আটকে রাখা যাবে না সে কথা নিজে জানলেও সিরাজকে বলেননি। সিরাজের তীব্র ব্রিটিশবিরোধিতাতে তিনি ইন্ধন জুগিয়েছেন যাতে তাঁর শেষবয়সে এবং তাঁর অবর্তমানে নিজের হাতে তৈরি করা সাম্রাজ্য এবং বিপুল অর্থ সিরাজের হাতে সুরক্ষিত থাকে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় অন্যকিছু।

এদিকে ঘসেটি বেগম তার প্রেমিক হুসেন কুলিকে বোঝায় যে তার নবাব হবার পথে একমাত্র অন্তরায় সিরাজ এবং সিরাজকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারলে হুসেন কুলির নবাব হবার পথ পরিস্কার। ঘসেটি আর হুসেন কুলির এই গোপন প্রেমের কথা আস্তে আস্তে প্রকাশ্যে চলে এল। হুসেন কুলিকে নিয়ে ঘসেটি আর নওয়াজিসের বিবাদ চরমে পৌঁছল। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে ঘসেটির মা অর্থাৎ সিরাজের দিদা সারফুন্নিসা তাঁর স্বামী আলিবর্দির কাছে রাজবংশের সম্মান রক্ষার জন্য বহিরাগত হুসেন কুলি খান আর তার ভাই হায়দর আলি খানকে হত্যা করার অনুরোধ জানালেন। সুযোগের অপেক্ষায় ছিল আলিবর্দি। আলিবর্দি বলল,’ হুসেন কুলি আর তার ভাই নওয়াজিসের কর্মচারী।সুতরাং এ ব্যাপারে নওয়াজিসের মতামত জানা প্রয়োজন।‘ আলিবর্দির উত্তর শুনে সারফুন্নিসা ঘসেটি আর নওয়াজিসের কাছে এলেন। হুসেন কুলির স্পর্ধা এবং লোভ নওয়াজিস এবং ঘসেটির প্রশ্রয়ে ততদিনে আরও বেড়ে গেছে। হুসেন কুলির নজর ঘসেটির থেকে সরে এখন পড়েছে সিরাজের মা, আলিবর্দির বিধবা কন্যা আমিনার দিকে। এ কথা ঘসেটির কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে হুসেন কুলির প্রতি ক্রোধে অন্ধ হয়ে উঠল ঘসেটি। নওয়াজিস এবং ঘসেটি ভাবল যে আমিনার সঙ্গে হসেন কুলির সম্পর্ক তৈরি হলে তাদের বিপদ। ঘসেটি এতদিনের প্রেমিক বিশ্বাসঘাতক হুসেন কুলিকে হত্যার ছক কষা শুরু করে দিল। এদিকে সিরাজের কানে একথা যেতেই সে একেবারে সৈন্য সামন্ত নিয়ে আলিবর্দির দরবারে হাজির হয়ে গেল সেখানেই এবং সেইক্ষণেই হুসেন কুলিকে হত্যা করবে বলে। সিরাজের আসার কারণ বুঝতে পেরে বিচক্ষণ আলিবর্দি সিরাজকে আলাদা করে ডেকে হুসেন কুলি আর হুসেনুদ্দিনকে মারার পরিকল্পনা বাতলে দিল। রাজদরবারে হত্যাকাণ্ড ঘটলে তা যে আখেরে সিরাজের পক্ষে ভাল হবেনা সে কথা বুঝিয়ে বলে সেযাত্রা সিরাজকে শান্ত করে ফেরাল আলিবর্দি।

ওদিকে ঢাকায় হুসেনুদ্দিনের দরবারের দুই সদস্য বরিশালের জমিদার আগা বকর আর তার ছেলে মন্ত্রী আগা সাদেকের সঙ্গে হুসেন কুলির মনোমালিন্য ক্রমশই বেড়ে চলছিল। বাবা আর ছেলে অনেক ভেবে ঠিক করল মুর্শিদাবাদে গিয়ে নওয়াজিসের কাছে হুসেন কুলির অপকীর্তির কথা ফাঁস করে দেবে। তারা বুঝতেও পারেনি এই অপকীর্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে নওয়াজিস এবং হুসেনুদ্দিন দু’জনেই। মুর্শিদাবাদে এসে নওয়াজিসকে একথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই বন্দি করা হল আগা বকর আর আগা সাদেককে। সিরাজের মধ্যস্থতায় ছাড়া পেয়ে বাবা-ছেলে সিরাজের হয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঢাকা ফিরে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই সিরাজের নির্দেশে হুসেনুদ্দিনের প্রাসাদে ঢুকে তাকে হত্যা করল আগা বকর আর আগা সাদেক। এই খবর ছড়িয়ে পড়তে না পড়তেই উত্তেজিত জনতা শ’য়ে শ’য়ে প্রাসাদে ঢুকে জানতে চাইল কোন অধিকারে আগা বকর আর তার ছেলে হুসেনুদ্দিনের প্রাসাদে ঢুকে তাকে হত্যা করেছে। হুসেনুদ্দিনের রক্তমাখা তরোয়াল হাতে জনতার দিকে তেড়ে আসে আগা সাদেক। উল্টে জনতা তাড়া করে বাবা আর ছেলেকে। আগা সাদেক কোনক্রমে পালিয়ে বাঁচলেও জনতার রোষে প্রাণ হারায় আগা বকর। এই ঘটনার কিছুদিন পরে দূর্ভাগ্য নেমে আসে হুসেম কুলির জীবনেও। বিচক্ষণ আলিবর্দি এর কিছুদিনের মধ্যে রাজমহলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল শিকারের আছিলায়। আসল উদ্দেশ্য মুর্শিদাবাদ থেকে কিছুদিন দূরে থাকা যাতে হুসেন কুলির হত্যাকাণ্ড তার অনুপস্থিতিতে ঘটে। আলিবর্দির বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গেই সিরাজ এসে পৌঁছল মতিঝিলে নওয়াজিসের কাছে। নওয়াজিসের কাছে অনুমতি নিয়ে ফেরার পথে সিরাজের ঘোড়া আর সৈন্যসামন্ত এসে দাঁড়াল হুসেন কুলির বাড়ির সামনে। হতভাগ্য হুসেন কুলি তখন বাড়িতেই ছিল। বাড়ির বাইরে সিরাজের উপস্থিতির খবর পেয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকল হুসেন কুলির সমস্ত শরীর। হুসেন কুলির বাড়ির পাশেই থাকত নওয়াজিসের একান্ত বিশ্বস্ত সহকারি হাজি মেহেদি। যা হোক করে পাশের বাড়িতে হাজি মেহেদির কাছে গিয়ে হুসেন কুলি তাকে বলল নওয়াজিসকে যে ভাবেই হোক তার বিপদের কথা জানাতে। হাজি মেহেদি পিছনের রাস্তা দিয়ে লুকিয়ে নওয়াজিসের কাছে গিয়ে সব জানানো সত্ত্বেও কোনও লাভ হল না। ইতিমধ্যে সিরাজের বাহিনী সমস্ত চত্বরে তল্লাশি চালিয়ে হুসেন কুলিকে হাজির করল সিরাজের কাছে। হত্যা না করার জন্য হুসেন কুলির অশ্রুসজল কাতর আবেদন উপেক্ষা করে নিষ্ঠুর ভয়ঙ্কর দানব সিরাজ তার শরীর টুকরো টুকরো করে রাস্তায় ছড়িয়ে দিল। এর পরে সিরাজের অনুচরেরা ধরে নিয়ে এল হুসেন কুলির ভাই জন্মান্ধ হায়দর আলিকে। ভ্রাতৃহত্যায় ক্রোধান্ধ হায়দর আলি অকথ্য ভাষায় সিরাজকে এবং তার বাবা মাকে গালি দিতে শুরু করল। পাশবিক উল্লাসে মত্ত সিরাজ তলোয়ারের এক কোপে চিরকালের মত স্তব্ধ করে দিল তাকে। একেই ইক্রমের মৃত্যুর পর থেকে নওয়াজিস প্রায় শয্যাশায়ী তার ওপর এই ভয়ঙ্কর ঘটনা নওয়াজিসকে আরও দুর্বল করে তুলল। এদিকে আলিবর্দি এবং সিরাজ দু’জনেই খাজনার টাকা আত্মসাৎকারী নওয়াজিসকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৃথিবী থেকে সরিয়ে ঘসেটির কাছে সঠিক বার্তা পৌঁছে দেবার মনস্থ করল। খাদ্যরসিক আলিবর্দি জামাতা নওয়াজিসকে মধ্যাহ্ণভোজে আমন্ত্রণ জানাল। আলিবর্দি নিজের হাতে বানানো স্যুপ পরিবেশন করল নওয়াজিসকে। নওয়াজিস পরম তৃপ্তিতে স্যুপসহ মধ্যাহ্ণভোজ সেরে ফিরে গেল মতিঝিলে। তার কয়েকদিনের মধ্যেই নওয়াজিসের দেহে আসন্ন মৃত্যুর লক্ষণ প্রকট হয়ে উঠল। আলিবর্দি নওয়াজিস, ঘসেটি, তাদের সমস্ত পরিচারক , পরিচারিকা এবং নওয়াজিসের প্রিয় এক অভিনেত্রীকে মতিঝিল থেকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে এল। ঘসেটি নিজের বাবার বাড়িতে এসেও স্থির থাকতে পারল না। সিরাজের অতর্কিত আক্রমণের ভয়ে কাঁটা হয়ে রইল সবসময়। অবশেষে সিরাজের কাছ থেকে তার কোনও রকম ক্ষতি না করার কথা আদায় করে সকলের অগোচরে মৃত্যুপথযাত্রী নওয়াজিসকে নিয়ে মতিঝিলে নিজের বাড়িতে ফিরে এল ঘসেটি। তার কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু হল নওয়াজিসের। পালিতপুত্র ইক্রমের সমাধির পাশেই সমাধিস্থ করা হল নওয়াজিসকে।

আতঙ্কিত ঘসেটি নিজেকে মতিঝিলে বন্দি করে রাখল বেশ কিছুদিন। তারপর গোপনে নওয়াজিসের সেনাপ্রধানদের হাতিশাল থেকে হাতি আর নিজের কোষাগার থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে আলিবর্দির অবর্তমানে সিরাজের হাত থেকে তাকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিল। আস্তে আস্তে আলিবর্দির শরীর ভেঙ্গে পড়তে লাগল। আলিবর্দির কাছের লোকেরা তার সঙ্গে দেখা করে সিরাজের কাছে তাদের সম্বন্ধে বলে যাওয়ার অনুরোধ জানাল। আলিবর্দির অবর্তমানে নিজেদের অবস্থা নিয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়ল সবাই। সিরাজের হাতে তাদের কার যে কী দশা হবে সে কথা ভেবে রাতের ঘুম চলে গেল সবার। আলিবর্দি তার কাছের লোকেদের বলল তার মৃত্যুর পর তারা যেন সারফুন্নিসার সঙ্গে সিরাজের সম্পর্কের দিকে নজর রাখে। যদি সারফুন্নিসা আর সিরাজের সম্পর্ক ভাল থাকে তাহলে তাদের ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। কয়েকদিনের মধ্যেই দেহ রাখলেন আলিবর্দি খান। তার বয়স তখন ছিয়াশি।

ঘসেটি আশা করেছিল আলিবর্দির মৃত্যুর পর মুর্শিদাবাদের সাধারণ মানুষ সিরাজের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামবে। জনরোষে নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাবে অত্যাচারী সিরাজ এবং তার দলবল। যে সব সেনাপ্রধানদের দুহাতে টাকা বিলিয়ে আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি আদায় করেছিল সে তারা সবাই ঝাঁপিয়ে পড়বে সিরাজের বিরুদ্ধে। কিন্তু বিল্পব দূরের কথা বিন্দুমাত্র বাধা এবং বিরোধিতার মুখোমুখি না হয়ে আলিবর্দির মৃত্যুর পর মহাসমারোহে মসনদে বসল নবাব সিরাজদৌল্লা। সিরাজের বয়স তখন তেইশ।

0 comments: