প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার
Posted in প্রবন্ধ২৩শে জানুয়ারি দিনটি আমাদের কাছে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে রয়েছে ভারতমাতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর সন্তান নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু-র জন্মদিন হিসেবে। উড়িষ্যার কটক শহরে উক্তদিনে নেতাজী জন্মেছিলেন ১৮৯৭ সালে। আবার ঐ একই দিনে আরেক কিংবদন্তির জন্মদিন যিনি বিপ্লব আন্দোলনে না থাকলেও শিক্ষা আন্দোলনে তথা শিক্ষার ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। বলা যায় যে, তাঁর ‘ফার্স্ট বুক’ পড়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর বঙ্গসমাজ ইংরেজি শিখেছিল। তাঁর নাম প্যারীচরণ সরকার– অনেকের কাছে প্যারী সরকার। তিনি জন্মেছিলেন ১৮২৩ সালের ২৩শে জানুয়ারি। আর তাই এই বছর পালিত হয়েছে তাঁর দ্বিশততম জন্মবার্ষিকী। তাঁর জন্মস্থান কলকাতা শহরের চোরাবাগানে। তাঁর পিতার নাম ভৈরবচন্দ্র সরকার। কলকাতাতে জন্মালেও প্যারীচরণ সরকারদের আদি নিবাস ছিল হুগলী জেলার তড়াগ্রামে। প্যারীচরণ ডেভিড হেয়ার সাহেবের পটলডাঙ্গা স্কুলে পড়েছিলেন। পরে পড়েছিলেন হিন্দু কলেজে (যা বর্তমানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়)। ১৮৪৩ সালে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে হুগলী স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৮৪৬-১৮৫৪ এই আট বছরে তিনি বারাসাত স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন। বারাসাত স্কুলের প্রধান শিক্ষক থাকাকালীন প্যারীচরণ, নবীনকৃষ্ণ ও কালীকৃষ্ণ মিত্র একসাথে উদ্যোগী হয়ে ভারতীয়দের দ্বারা পরিচালিত প্রথম বেসরকারি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। তবে এই বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য তাঁদের অনেক বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল এমনকি দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, সমাজের থেকে নিন্দাও পেয়েছিলেন। তবুও তাঁরা উদ্যোগী হয়ে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে মাইলস্টোন স্থাপনের কাজ করে গেছেন। যাইহোক, এই উল্লেখযোগ্য কাজের পাশাপাশি প্যারীচরণ সরকার কৃষি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন আর তার সাথে কারিগরি শিক্ষার বন্দোবস্ত করেন। এভাবেই তিনি কৃষি ও
শিল্প দুইয়েরই পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিলেন আর সেই জন্যে এক শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদ হিসেবেও সুনাম অর্জন করেন। এরপরে, তিনি দীর্ঘ আট বছর ছিলেন কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তাঁরই প্রধান উদ্যোগে ওই স্কুলের নাম হয় ডেভিড হেয়ারের নামে ‘হেয়ার স্কুল’। ১৮৬৩ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে (পূর্বে যার নাম ছিল হিন্দু কলেজ) অস্থায়ী অধ্যাপকের কাজ পান। তার বছর চারেক পরে, ১৮৬৭ সালে স্থায়ী অধ্যাপকের কাজ পান যা তিনি আমৃত্যু পালন করে যান।
রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ইত্যাদি মনীষীর মতো প্যারীচরণ সরকারও ছিলেন বাংলা নবজাগরণের অন্যতম দূত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার যে নবজাগরণ ঘটেছিল বিশেষ করে শিল্প, শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে তাতে সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন প্যারীচরণ সরকার। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের থেকে বছর আড়াই ছোট হলেও তিনি ছিলেন যেন বিদ্যাসাগরের প্রকৃত সুহৃদ। এমনকি, বিধবা-বিবাহ প্রচারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরকে সাহায্যও করেছিলেন। বিদ্যাসাগরের মতোনই তিনিও স্ত্রী-শিক্ষা বিস্তারের জন্যে অনেক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বেথুন স্কুলে মেয়েদের যেন পাঠানো হয় সেই ব্যাপারে অভিভাবকদের তিনি বোঝাতেন বা প্রভাবিত করতেন। নারী শ্রমিদের সন্তানরা যাতে পড়তে বা শিখতে পারে সেজন্য তিনি করেছিলেন কারিগরি বিদ্যালয়। কৃষি বিদ্যালয়ে যাতে বিজ্ঞান-শিক্ষা ভালোভাবে বা সুষ্ঠুভাবে হয় তারও বন্দোবস্ত তিনি করেছিলেন।
১৮৬৬ সালে সরকারি সংবাদপত্র ‘এডুকেশন গেজেট’-এর সম্পাদক হন। কিন্তু এর মাত্র দুই বছর পরে অর্থাৎ ১৮৬৮ সালে পূর্ববঙ্গ রেলপথে ঘটে যাওয়া এক দুর্ঘটনার সত্যিকরের বিবরণ মন্তব্যসহ প্রকাশ করায় তৎকালীন পরাধীন ভারতের ইংরেজ সরকারের সাথে তাঁর মতনৈক্য হয়। আর এই মতনৈক্যের ফলস্বরূপ তিনি ঐ সরকারি সংবাদপত্রের সম্পাদকের পদ থেকে সরে যান। এতটাই আত্মমর্যাদবোধ ছিল তাঁর মধ্যে যা আজকের বাংলার তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও দেখা পাওয়া ভার। মাদকাসক্ত আজকের দিনের এক জ্বলন্ত সমস্যা। কত সংসার ভাঙছে,কতজন জীবন শেষ করার দিকে চলে যাচ্ছে, কতজনের সম্মানহানি হচ্ছে – সবই অতিরিক্ত মদ্যপানের জন্যে। ভাবতে অবাক লাগে যে, আজ থেকে প্রায় দেড়শো
বছর আগে প্যারীচরণ সরকার মাদকাসক্তের এই অতি করুণ পরিস্থিতি বা বলা ভালো করুণপরিণতির কথা ভেবেছিলেন। ১৮৭৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘বঙ্গীয় মাদক নিবারণী সমাজ’ যার নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে এর মূল উদ্দেশ্য ছিল মদ্যপান নিবারণের চেষ্টা করা। ভাবতে অবাক লাগে, আজ যখন মদ্যপানের হিড়িক দেখা যাচ্ছে সমাজে (এমনকি বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরকারি মদতেও), কত সংসার ভাঙছে, কত মানুষ মদের নেশায় তলিয়ে গিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে তখন কিন্তু কোনও বুদ্ধিজীবীকে দেখা যাচ্ছে না এর প্রতিবাদ করতে। বরং বড়োই দুঃখের বিষয় যে, অনেক বুদ্ধিজীবী আছেন যাঁরা এই মধ্যপানের আসক্তির গড্ডালিকা প্রবাহে তলিয়ে দিচ্ছেন নিজেদের। তাহলে, কতখানি ব্যতিক্রমী ও সচ্চরিত্রের মানুষ ছিলেন প্যারীচরণ, ভাবা যায়! হয়তো বাধাও এসেছিল কিন্তু তা কাটিয়ে নিজের লক্ষ্যে স্থির থেকেছেন।
সামাজিক কাজকর্মের পাশাপাশি প্রকাশ করেন দুটি পত্রিকা– ‘ওয়েল উইশার’ এবং ‘হিতসাধক’। ভারতীয় বিশেষ করে বাঙালি শিশুদের ইংরেজি শেখাতে হবে আর তার জন্য তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত ইংরেজি শেখানোর পাঠ্যপুস্তকের সিরিজ। ১৮৫০ সালে স্কুল বুক প্রেস; থেকে তাঁর লেখা প্রথম পাঠ্যপুস্তক ‘First Book Of Readings (পুরো নাম অবশ্য ;First Book of Reading for Native Children;)’ প্রকাশিত হয়। প্রথমটির পরের বই ‘Second Book Of Readings’। ১৮৫১ থেকে ১৮৭০ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয় তাঁর এই বুক অফ রিডিংস;-এর দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ খণ্ড। একসময় এই সিরিজের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে এমনকি ইংরেজি শেখার অপরিহার্য বই হিসেবে হয়ে উঠেছিল এই দুই বই। এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইংরেজি শেখার হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর এই বই পড়ে। উত্তর কলকাতাতে ছিল তাঁর বাড়ি ও ছাপাখানা। ‘The tree of intemperance’ নামক একটি বই তিনি লিখছিলেন কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তা শেষ করতে পারেননি। এই অসমাপ্ত বইটি ছিল তাঁর শেষ বই। বইপত্তর লেখা, মেয়েদের স্কুল স্থাপন, মাদক নিবারণী সমাজ গঠন, পত্রিকা প্রকাশনা ও সম্পাদনা করার পাশাপাশি তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব হল ‘ইডেন হিন্দু হোটেল’ স্থাপন করা। এই মহান শিক্ষাব্রতী, যাঁকে বাংলায় নারী শিক্ষার অগ্রদূত হিসেবে ‘The Arnold of the East’ বা প্রাচ্যের আর্নল্ড বলে সম্মানিত করা হত সেই তিনি ৩০শে সেপ্টেম্বর, ১৮৭৫ সালে মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে যান। ‘প্যারী সরকারের ইংরেজির ফাস্ট বুক’– এভাবেই দ্বিশততম জন্মবার্ষিকীতে এসেও বাঙালি তার এই আদি ও কিংবদন্তি ইংরেজি শিক্ষককে মনে রেখেছে।
তথ্যসূত্রঃ-
বাঙালি চরিতাভিধান, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা।
উইকিপিডিয়া
প্যারীচরণ সরকার এর জীবনী, আজ বাংলা.ইন ওয়েবসাইট
0 comments: