0

সম্পদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়



শূন্য এখন ফুলের বাগান
দোয়েল কোকিল গাহে না গান...

হেমন্তের বিষণ্ণতা গ্রাস করে সমস্ত কিছু। কাশ ঝরে যায়, খালি হয়ে যায় ভালোবাসার বারান্দাও... প্রথম যুগের ছাত্রী নবনীতার কথা লেখেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। বইতে থাকে মন্দির মসজিদের বড়ত্বের তর্ক-তুফান... জয় শুধুই ক্ষমতার। অর্থের। আর আত্মদম্ভের। সম্রাট নেবুচাদনেজার সম্রাজ্ঞীর আবদারে নির্মিত হয় ব্যাবিলনের শূন্য উদ্যান... মুক্তো বিন্দুর মতন শিশির নামে মন্দাক্রান্তা লয়ে... জীবনানন্দ লিখে যান...
লিপি কাছে রেখে ধূসর দ্বীপের কাছে আমি
নিস্তব্ধ ছিলাম ব’সে;
শিশির পড়িতেছিল ধীরে-ধীরে খ’সে;
নিমের শাখার থেকে একাকীতম কে পাখি নামি
উড়ে গেলো কুয়াশায়,-কুয়াশার থেকে দূর-কুয়াশায় আরও…

তবুও 'দ্য শো মাস্ট গো অন'...
প্রদর্শনী চলতে থাকে... চলতেই থাকে...
সৃজনে থাকুন, সুস্থ থাকুন,
শুভেচ্ছা নিরন্তর...

0 comments:

1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in

ভূমিকা

ইদানীং ভারতের ইতিহাসকে ‘নতুন’ করে দেখার এবং লেখার কথা শোনা যাচ্ছে। যেমন বলা হচ্ছে যে হলদিঘাটের যুদ্ধে রাণা প্রতাপ পরাজিত হননি , টিপু সুলতান অত্যাচারী মুসলিম শাসক ছিলেন, আদৌ ইংরেজবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামী ছিলেন না। আমরা কয়েক প্রজন্ম ধরে ইতিহাস বলে যা পড়েছি তা আসলে ‘বিদেশী’ বা ‘কলোনিয়াল’ লেখকদের তৈরি যারা ভারতের গৌরবময় ঐতিহ্যকে ছোট করে দেখাতে চাইতেন । 
এই ওলট-পালট প্রক্রিয়ায় আজকে আলোচনা চলছে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি প্রধান চরিত্রকে নিয়ে যিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতবর্ষে দ্রুত নেপথ্যে চলে যান। তিনি হলেন দামোদর বিনায়ক সাভারকর যাঁকে আমাদের প্রজন্ম জানত ‘বীর’ সাভারকর নামে। আমরা ছোটবেলায় পড়েছিলাম উনি নাকি ইংরেজ রাজত্বে বন্দী অবস্থায় জাহাজ থেকে সমুদ্রে লাফিয়ে পড়ে সাঁতরে গিয়ে ফরাসী বন্দরে ওঠেন কিন্তু ধরা পড়ে যান। দশবছর আন্দামানের সেলুলার জেলে থাকার পর ভারতে ফেরেন। পরে জানলাম উনি নাকি গান্ধীহত্যা ষড়যন্ত্রের মস্তিষ্ক ছিলেন-- একবছর আটমাস জেলে থাকার পর প্রমাণাভাবে মুক্ত হন।

ধীরে ধীরে আমরা সাভারকরকে ভুলে গেছলাম। আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে সাভারকরের কথা শোনেনি। এখন আবার সাভারকরের নাম একেবারে সামনের সারিতে। প্রথমে তাঁর ছবি সংসদের দেয়ালে স্থান পেল। সেলুলার জেলের নাম পালটে তাঁর নামে রাখা হলো। নভেম্বর মাসে ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জন্মদিনটি এবার বর্তমান সরকার সাভারকরের নামে পালন করবে। আর বিভিন্ন মহলে দাবি উঠছে সাভারকরকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘ভারতরত্ন’ দেওয়া হোক। প্রবল আপত্তি উঠছে – উনি তো ইংরেজ সরকারের কাছে মাফিনামা লিখে তবে ছাড়া পেয়েছিলেন; উনি কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্টের বিরোধিতা করেছিলেন। তাহলে উনি ইংরেজের দালাল! এবং উনি হিন্দুরাষ্ট্রের পক্ষধর, তাই হিন্দু মহাসভা গঠন করেছিলেন। এ তো আমাদের সেকুলার সমদর্শী বহুভাষাভাষী ভারত রাষ্ট্রের বিরোধী অবস্থান! এঁকে ‘ভারতরত্ন’ দেওয়া?

পক্ষে বলা হয় যে উনিই প্রথম ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ বা ‘সিপয় মিউটিনি’কে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’  আখ্যা দিয়ে বই লেখেন। বন্দে মাতরম গানের মতই এই বইটিও নাকি অনেককে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। উনি দুটো মামলায় মোট ৫০ বছরের কালাপানি’র শাস্তি পেয়েছিলেন। উনি ঠিক মাফিনামা দিতে চেয়ে পিটিশন দেননি। গান্ধীহত্যায় তাঁর সংলিপ্ত থাকার কোনও প্রমাণ আদালতে গ্রাহ্য হয়নি ।

এই সাদা-কালো বাইনারি বিতর্কে শুধু আংশিক তথ্য ও খণ্ডিত সত্যের চর্চা হয়। হারিয়ে যায় ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়ের জটিলতা ও টানাপোড়েনের ইতিহাস। কিন্তু বাস্তব সত্য কি অমন একরৈখিক? অমন লিনিয়ার? কেন আজ সাভারকরকে নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে?

এই স্বল্প পরিসরে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া করে জানতে চাইব ঐতিহাসিক তথ্য ও দস্তাবেজ কী বলে। দেখব সত্যের রঙ কতটা ধূসর।


বিতর্কিত প্রশ্নগুলিঃ

সাভারকর কী কী অপরাধে শাস্তি পেয়েছিলেন এবং কী সেই শাস্তি?

সাভারকরের রাজনৈতিক কার্যকলাপের পৃষ্ঠভূমিঃ

১৯০৬ সালের মাঝামাঝি সাভারকর লন্ডনে গ্রে'স ইন এ ব্যারিস্টারি পড়তে এলেন। পুণের এই গরীব পরিবারের ছেলেটির তখন বয়েস ২৩; এর আগে পুণের ফার্গুসন কলেজে আইন পড়ার সময় ছাত্র আন্দোলন করে শাস্তি পেয়েছেন। কার্জনের বাংলা ভাগ নিয়ে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় তিনি বিদেশী বস্ত্র পোড়ানোর ডাক দিয়েছিলেন। সাভারকর পুণেতে ভারতের প্রথম গুপ্ত সমিতি 'অভিনব সমিতি' প্রতিষ্ঠা করেন। এই গুপ্ত সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিদেশে বসবাসকারী অনেক ভারতীয় ছাত্র ও বিপ্লবী।

শ্যামজী কৃষ্ণবর্মা, বিশিষ্ট ভারতীয় বিপ্লবী, তখন লন্ডনে ইন্ডিয়া হাউস বলে একটি হোস্টেল খুলে ভারতীয় ছাত্রদের নামমাত্র খরচায় থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। বৃত্তিও দিতেন। উনি ইন্ডিয়ান সোসিওলজিস্ট বলে একটি র‍্যাডিক্যাল পত্রিকাও প্রকাশ করতেন। ওখানে মাদাম ভিকাজী কামা, বিপিন চন্দ্র পাল এঁর বন্ধু ছিলেন।
তিলকের রেকমেন্ডেশনে সাভারকর ঠাঁই পেলেন। সেখানে যোগাযোগ হোল বীরেন চট্টো (সরোজিনী নাইডুর ছোট এবং পরবর্তী কালের কমিউনিস্ট এম পি এবং কবি হারীন্দ্রনাথ চট্টোর বড়ভাই), বিপিন পালের ছেলে নিরঞ্জন এদের সঙ্গে। অচিরেই সাভারকর এখানে স্বাধীনতা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা ছাত্রদের নেতা হয়ে উঠলেন।
ইন্ডিয়া হাউসের কার্যকলাপ নিয়ে লন্ডন টাইমস সমালোচনা করল এবং গোয়েন্দারা নজর রাখতে লাগল। ইন্ডিয়া হাউসের সদস্যদের প্রোফাইল দেখুন। অল্পদিন পরে লন্ডনে সাহেব হত্যা করে ফাঁসিতে চড়া মদন লাল ধিংরা তখন ইঞ্জিনিয়রিং পড়তে গেছেন। তিন সদস্য বাপট, হোরিলাল এবং হেমচন্দ্র দাস বোমা তৈরির রাশিয়ান ম্যানুয়ালের ইংরেজি অনুবাদের কয়েক কপি নিয়ে ভারতে ফিরে গেলেন। পরে আলিপুর বোমার মামলায় (১৯০৯) হোরিলাল ও হেমচন্দ্র অভিযুক্ত হলেন। বাপট আন্ডারগ্রাউন্ড রইলেন।
১০ মে ১৯০৮ সালে সিপাহী বিদ্রোহের শহীদদের ৫০ বছর স্মরণ অনুষ্ঠানে ইন্ডিয়া হাউস জমজমাট। মেয়েরা বন্দে মাতরম গাইলেন। সাভারকর তাঁর কবিতা 'ওহ মারটিয়ার্স' পড়লেন।
সেই বছর সাভারকর মারাঠিতে গারিবলদির আত্মজীবনী এবং সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস লিখে ফেললেন। মারাঠি বই দুটো গোয়েন্দাদের চোখ এড়িয়ে ভারতে বেশ কিছু কপি পৌঁছে গেল। পরের বইটি ইংরেজিতে 'The History of the War of Indian Independence' নামে অনূদিত হলো। 
এই বইয়ে সাভারকর স্বাধীনতার জন্যে হিন্দু-মুসলমানের সংযুক্ত আন্দোলনের প্রশংসা করেছিলেন। পরবর্তীকালের সমাজবাদী নেতা অরুণা আসফ আলি এই বইটি পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
এই বইটি পড়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন আরও অনেকে, যেমন রাসবিহারী বসু, সুভাষচন্দ্র বসু, ভগত সিং। শোনা যায়, ভগত সিং তাঁর দলে যুবক রিক্রুট করার সময় জিজ্ঞেস করতেন সেই যুবক সাভারকরের বইটি পড়েছে কিনা!
আই এন এর সোলজারের অধিকাংশই বলতেন, তাঁরা সাভারকরের বই পড়ে খুব ইন্সস্পায়ার্ড হয়েছিলেন। অনেকেই ছিলেন যারা বলেছিলেন I joined the INA only on the advice of Savarkar।

এই বইটি লিখতে সাভারকর ইন্ডিয়া হাউস লাইব্রেরিতে পড়াশুনো করেছিলেন।
কার্ল মার্ক্সও তাঁর ‘ইন্ডিয়াজ ফার্স্ট ওয়ার অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স’ লেখাটি লন্ডন প্রবাসের সময় একই লাইব্রেরিতে বসে পড়াশুনোর ভিত্তিতে লিখেছিলেন। যদিও প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। সাভারকর কি এই লেখাটির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না?
এ নিয়ে কোনও তথ্য নেই, যদিও সেসময় সাভারকরের ওঠাবসা বেশ ক'জন বৃটিশ লেবার ও সোসালিস্ট নেতাদের সঙ্গে। অরুন্ধতী রায় কিন্তু বলেছেন, সাভারকর মার্ক্স-এর সিপাহি বিদ্রোহ নিয়ে লেখা তখনও পড়েননি।
ইতিমধ্যে ইন্ডিয়া হাউসের ম্যানেজমেন্ট সাভারকরের হাতে; উনি আইন পাশ করেছেন এবং উনি কৃষ্ণবর্মা, ভিকাজি কামা এবং বিপিন পালের মতোই হোম রুলের দাবির পক্ষে এবং নবোদিত কংগ্রেসের নরমপন্থার বিপক্ষে বক্তব্য রাখছেন।

তার প্রদর্শিত হিন্দুত্ব রাজনীতি পরবর্তীকালে কোনদিকে মোড় নিল, সে আলোচনা উঠে আসা অবশ্যম্ভাবি; কিন্তু ব্রিটিশের ট্রেটর, গান্ধী বিরোধী বলে যে ব্যক্তিটি পরবর্তীকালে সুপ্রসিদ্ধ হয়ে রইলেন, তাঁকে সে সব তকমা থেকে মুক্ত করে নূতন করে চর্চা হলে ব্যক্তিটি ও তাঁর রাজনীতি অনেক সুস্পষ্ট হবে।

এমন সময় পুণেতে বিপ্লবী কবিতা প্রকাশনের অপরাধে ওঁর বড়দা এবং পরিবারের কর্তা বাবারাও সাভারকরের যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা হলো। এর ঠিক ২৩ দিন পরে মদনলাল ধিঙড়া বৃটিশ প্রশাসক মর্লি'র এডিকং উইলিকে হত্যা করলেন।
পুলিশ ইন্ডিয়া হাউসে তালা ঝোলালো। সাভারকর বিপিএন পালের আশ্রয়ে গেলেন। গান্ধী তখন লন্ডনে, এই হত্যাকে কাপুরুষতা বলে নিন্দা করলেন। সাভারকর ধিংড়ার সমর্থনে বক্তৃতা দিলেন এবং লিখলেন। পুলিশ পেছনে লাগল, তদন্ত করল, স্পষ্ট প্রমাণ পেল না। কিন্তু এর ফলে সাভারকর গ্রে ইন কোর্টে আইন প্র্যাকটিস করার লাইসেন্স পেলেন না ।

সাভারকরের অপরাধঃ

১৯০৮ সালে সাভারকর ভারতে কুড়িটি ব্রাউনিং পিস্তল লন্ডন থেকে ইন্ডিয়া হাউসের রাঁধুনি চতুর্ভূজ আমিনের মাধ্যমে ভারতে পাঠিয়েছিলেন।
নভেম্বর ১৯০৯ এ আমেদাবাদ শহরে ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর উপর দুটো বোমা ছোঁড়া হয়, একটাও ফাটেনি। কিন্তু ২১ ডিসেম্বরে নাসিক শহরে কলেক্টর এবং ম্যাজিস্ট্রেট জ্যাকসনকে একটি থিয়েটার হলে অনন্ত কানহারে গুলি করে মারে। জ্যাকসন সংস্কৃত ও মারাঠি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন এবং মারাঠিতেই কথা বলতেন। উনিই সাভারকরের দাদা বাবুরাওকে রাষ্ট্রদ্রোহের কবিতা ছাপার অপরাধে আজীবন কারাবাসের শাস্তি দিয়েছিলেন।
সন্দেহ করা হয় যে, হত্যার পেছনে আসল মাথা হচ্ছে লন্ডনে বসে বদলা নিতে কলকাঠি নাড়া ছোটভাই বিনায়ক দামোদর সাভারকর। আমিন রাজসাক্ষী হলো, অভিযুক্তদের কাছ থেকে পাওয়া একটি পিস্তল যেটি সেই কুড়িটির একটি বলে প্রমাণিত হলো। সবাই বলল, এখান থেকে সরে যাও, তাই সাভারকর প্যারিসে গিয়ে মাদাম কামার আশ্রয়ে থেকে 'মদন'স তলওয়ার' নামে (মদনলাল ধিঙড়ার স্মরণে, নামটি বীরেন চট্টোর দেওয়া) ওঁর পত্রিকায় লিখতে থাকেন। সেখানে রাশিয়া, ইজিপ্ট এবং তুরস্কের বিপ্লবীদের সঙ্গে ওঁর মোলাকাত হতে থাকে। হঠাৎ উনি প্যারিসের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে সবাইকে অবাক করে লন্ডনে ফিরে গেলেন এবং ১৩ মার্চ ১৯১০ তারিখে ভিক্টোরিয়া রেল স্টেশনে নামামাত্র গ্রেফতার হলেন।
মনে হয়, পুলিশকে কেউ গোপনে খবর দিয়েছিল।
ধরা পড়বেন জেনেও উনি কারও কথা (বিশেষ করে মাদাম কামা এবং বীরেন চট্টোর) না শুনে লন্ডন ফিরে গেলেন? কেন?
এ নিয়ে অনেকগুলো থিওরি প্রচলিত।
যেমন, দলকে উজ্জীবিত করতে বা নিজের সাহস প্রমাণ করতে, কারণ দলের মধ্যে কথা উঠছিল যে উনি সবাইকে ফিল্ডে অ্যাকশনে এগিয়ে দেন, কিন্তু নিজে নিরাপদে পেছনে থাকেন।
তবে আর একটা ইন্টারেস্টিং থিওরি বৃটিশ প্রেসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাহল উনি মার্গারেট লরেন্স নামে এক ইংরেজ মহিলার প্রেমে পড়েছিলেন। তাঁর গোপন আমন্ত্রণে দেখা করতে গিয়ে পুলিশের ফাঁদে বন্দী হন।
কৃষ্ণবর্মা প্রেসে চিঠি লিখে জানিয়েদেন যে এটা -- পুলিশের দ্বারা প্রেমিকার বকলমে পাঠানো জাল চিঠি পেয়ে উনি ধরা পড়েন---গুজব মাত্র।
(আমার মনে পড়ে, সমারসেট মম'এর ছোটগল্পের দ্বিতীয় ভল্যুমে অ্যাশেন্ডেন সিরিজের ওই গল্পটি যাতে চন্দ্র নামের পাগড়ি পরা ভারতীয় বিপ্লবীকে বৃটিশ পুলিশ প্রেমিকার চিঠি পাঠিয়ে বন্দী করে।)

উপরের সাক্ষ্য, পিস্তল, চতুর্ভুজের বয়ান এবং সাভারকরের ট্রাংক থেকে বাজেয়াপ্ত করা সিপাহী বিদ্রোহের উপর বই, 'হাউ টু অরাগানাইজ রেভোলুশন' বিষয়ক লেখাপত্তর এবং লন্ডনে নিষিদ্ধ ইস্তেহার --এসব দেখে ১২/০৫/১৯১০ এ বৃটিশ ম্যাজিস্ট্রেট রায় দিলেন যে এই বন্দীর ভারতে ফিউজিটিভ অফেন্ডার্স অ্যাক্ট ১৮৮১ অনুযায়ী বিচার হওয়া উচিত। আপীল এবং হেবিয়াস কর্পাসের রিট ব্যর্থ হলো। ২১/০৬/১৯১০ তারিখে কোর্ট অফ আপীল আগের রায় বহাল রাখল।
ইতিমধ্যে বৃটিশ রাজ একটি অর্ডিনান্সের মাধ্যমে সাভারকরের ভারতে বিচারের জন্যে এক তিন সদস্যীয় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করল যাতে জুরি থাকবে না এবং যার রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা যাবে না ।
বন্ধুরা (যেমন, কৃষ্ণবর্মা, মাদাম কামা, আইয়ার এবং বীরেন চট্টো) ডিফেন্সের জন্যে ফান্ড সংগ্রহে নেমে পড়লেন। পুলিশ রেকর্ড অনুযায়ী বীরেন চট্টোপাধ্যায় রিস্ক নিয়ে প্যারিস থেকে লন্ডন এসে চোদ্দোবার ব্রিক্সটন জেলে সাভারকরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। লন্ডনে ভারত পাঠানোর বিরুদ্ধে বৃটিশ কোর্টে সেকন্ড আপীল ঢিমে তেতালায় চলল ।
নাসিকে জ্যাকসন হত্যার সময় সাভারকর লন্ডনে ছিলেন। তাই লন্ডনে বিচার হলে অধিকতম শাস্তি হবে দুই থেকে তিনবছর। সরকার চাইল পুণেতে সাক্ষী এবং কাগজপত্র যোগাড় করতে যাতে দেখানো যাবে সাভারকর অনেক আগে থেকেই ভারতে সশস্ত্র পন্থায় বৃটিশ শাসন উচ্ছেদের প্রচার করছিলেন।
আপীল খারিজ হলো এবং ১ জুলাই ১৯১০ তারিখে মুম্বাইগামী এস এস মোরিয়া জাহাজে একটি চারবার্থের কেবিনে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় সাভারকরকে তোলা হলো। সঙ্গী স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ইন্সপেক্টর এডওয়ার্ড পার্কার এবং মুম্বাই পুলিসের ডিএসপি সি আই ডি ও দুজন কন্সটেবল।
জাহাজ ৭ জুলাই সকাল ১০টায় ফ্রান্সের মার্সাই বন্দরে নোঙর ফেলল।
৮ জুলাই সকাল সাড়ে ছ'টায় সাভারকর পায়খানায় যাবার অনুমতি চাওয়ায় পার্কার নিজে গিয়ে ক্লোজেট চেক করে এসে হাতকড়ি খুলিয়ে ভেতরে যাবার অনুমতি দিলেন। তারপর পাশের ক্লোজেটে নিজে গিয়ে তিন ইঞ্চি ফাঁকের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখলেন যে সাভারকরেরটি বন্ধই আছে। উনি বাইরে দু'জন হেড কন্সটেবলকে সতর্ক পাহারায় থাকতে বলে নিজের বাংকে ফিরে গেলেন। ওরা দরজার নিচের থেকে উঁকি মেরে দেখল যে বন্দীর চপ্পল দুটো ছেড়ে রাখা, মানে ও কাজকম্ম সারছে।
খানিকক্ষণ পরে অমর সিং দরজার উপরে মাথা গলিয়ে দেখল ছোট্ট পোর্ট হোলের মাঝখান দিয়ে সাভারকরের আদ্দেক শরীর গলে গেছে। ওর চিৎকারে বাকিরা এসে দরজা ভেঙে যখন ঢুকল তখন সাভারকর পুরো গলে গিয়ে সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ওরা প্রহরীদের সতর্ক করল। একজন গার্ড জলে সাঁতরানো সাভারকরকে দেখে গুলি চালাল।
পুলিশের বিবরণ অনুযায়ী প্রায় ১২ ফুট সাঁতরে উনি জেটিতে উঠে দৌড়তে লাগলেন। এরাও 'চোর! চোর! ধর! ধর!' চিৎকার করে তাড়া করল।
২০০ গজ দৌড়ে সাভারকর হাঁপিয়ে পড়লেন এবং ভারতীয় পুলিশ ও একজন ফ্রেঞ্চ ন্যাভাল সিকিউরিটি গার্ড ওঁকে চেপে ধরল।
সাভারকর ফ্রেঞ্চ পুলিশকে বললেন -তুমি আমাকে গ্রেফতার করে তোমাদের ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে পেশ কর।
ও ইংরেজি জানত না। কাজেই বন্দী সাভারকরকে আবার ওই 'মোরিয়া' জাহাজে তোলা হলো।

সাভারকরের মুক্ত হওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় একটা আন্তর্জাতিক আইনের প্রশ্ন সামনে এল।
হারীন্দ্রনাথ চট্টো জানিয়েছেন যে, প্যারিসে মাদাম কামা এবং বীরেন চট্টো এই প্রশ্নটি তুলেছিলেন। কামা কার্ল মার্ক্সের নাতি জাঁ লঙ্গে যিনি ফ্রান্সের প্রভাবশালী সোশ্যালিস্ট তরুণ নেতা এবং কলামনিস্টকে অনুরোধ করলেন সাভারকরের মুক্তির দাবিতে প্রচার আন্দোলন শুরু করতে। জাঁ লঙ্গে ল্যুমানিতের কলামনিস্ট ছিলেন। প্যারিসের ডেইলি মেইল পত্রিকায় ছাপা ছোট খবরটিকে ভিত্তি করে উনি সাভারকরের গ্রেফতারি নিয়ে প্রশ্ন তুললেন।
মার্সাই বন্দরে সাভারকরকে কে বন্দী করল?
বৃটিশ বা ভারতীয় পুলিশ? ওদের ফ্রান্সের জমিতে কাউকে গ্রেফতারের অধিকার কে দিয়েছে? এ তো আন্তর্জাতিক আইনের উল্লংঘন!
তবে কি ফ্রেঞ্চ নাভাল পুলিশ? তাহলে সে কি করে বন্দীকে বৃটিশ পুলিশের হাতে সমর্পণ করল? বিশেষ করে বন্দী যখন ফ্রেঞ্চ ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে সারেন্ডার করতে চাইছে?
লঙ্গে ল্যুমানিতে পত্রিকায় একগাদা কড়া প্রবন্ধ লিখলেন। ফলে ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং ভারতের মধ্যে আইনি ক্যাচাল শুরু হলো।
মার্সাইয়ের সোশ্যালিস্ট মেয়র জাঁ জেরে এবং তাঁর ডেপুটি কাঁদেন্যা বললেও, বৃটিশ পুলিশ সাভারকরকে 'চোর' বলে ফরাসী পুলিশকে মিসগাইড করেছে। কাজেই এই প্রত্যর্পণ বেআইনী। সাভারকরের রাজনৈতিক আশ্রয়ের অধিকার নায্য।
ফ্রান্স মিডিয়া --ল্যুমানিতে, লিব্রে প্যারোল, সান্ধ্য টেম্প তথা জুর্নাল দ্য দেবাত-- বিদেশমন্ত্রীর উপর চাপ দিতে লাগল সাভারকরকে ফিরিয়ে আনতে।
বৃটিশ মিডিয়া-- অবজার্ভার ও টাইমস --বলল একজন খুনি ও রাষ্ট্রদ্রোহীকে নিয়ে ফ্রেঞ্চ সরকারের আতুপুতু করার দরকার নেই। বন্দী তো বৃটিশ কাস্টডিতেই ছিল।
আমেরিকার সাঁ লুই পোস্ট ডেস্প্যাচ লিখল বৃটিশ সরকার তো আগেও অনেককে আশ্রয় দিয়েছে। চিনের বিপ্লবী সুন ইয়াত সেন ইংল্যান্ডের মাটিতে আশ্রয় পেয়েছিলেন। চিন সরকারের শত অনুরোধেও ব্রিটিশ কান দেয়নি। এবার অন্যরকম কেন ?
বৃটিশ শাসকদের মধ্যেও মতদ্বৈধ ছিল।
লিবারেল লর্ড মোর্লি ( ভারতের সেক্রেটারি অফ স্টেট) সাভারকরের বিচার লন্ডনের বদলে মুম্বাই হওয়ার প্রস্তাবে প্রশ্ন তোলায় মুম্বাইয়ের গভর্নর লর্ড সিডেনহ্যাম লিখলেন-- আপনি কিছুই জানেন না। সাভারকর ওয়জ ওয়ান অফ দ্য মোস্ট ডেঞ্জারাস মেন দ্যাট ইন্ডিয়া হ্যাজ প্রডিউসড'।
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এবং ইন্ডিয়া অফিস সাভারকরকে ফ্রেঞ্চ সরকারকে ফেরত দেওয়ার প্রস্তাবে রাজি নয়। উল্টোদিকে হোম সেক্রেটারি উইন্সটন চার্চিল বলছেন-- ইংল্যান্ডের আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার ভাবমূর্তি যেন একটা অপরাধীর ভেগে যাওয়ার পেটি ঝামেলায় ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ফেরত দিয়ে দাও।
বৃটেনে বামপন্থীরা জোট বেঁধে সাভারকরের পক্ষে দাঁড়িয়ে 'রিলীজ সাভারকর কমিটি' বানিয়ে প্রচার অভিযানে নাবলেন। ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান লিখল, ফ্রান্সের মাটিতে পা রাখা মাত্র সাভারকরকে বৃটিশ আইনের ক্ষেত্রাধিকার থেকে মুক্ত মেনে নেওয়া উচিত। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির মুখপত্র 'জাস্টিস' পত্রিকা ভারতের কলোনিয়াল নাগপাশ থেকে মুক্তির প্রয়াসকে সমর্থন জানাল।
শেষে ফ্রেঞ্চ সরকার এ নিয়ে মধ্যস্থতা চেয়ে দি হেগ এ আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে গেল। বৃটিশ রাজি হলো, কিন্তু চাল দিল যে মুম্বাই কোর্টে সাভারকর মামলার শুনানি শুরু হয়েছে, সেটা স্থগিত হবে না ।
ভারতের বাম এবং র‍্যাডিক্যালদের তথা ইংল্যান্ডের লিবারেলদের আপত্তিতে কান না দিয়ে তিন জজের ট্রাইব্যুনাল বিচার শুরু করল। মাদাম কামা ডিফেন্সের জন্যে পাঠালেন তিলকের পরিচিত জোসেফ ব্যাপটিস্টাকে।
মুখ্য প্রসিকিউটর ছিলেন এম জার্ডিন, ক্রিকেটে বডিলাইন বোলিঙয়ের জন্যে কুখ্যাত ইংল্যান্ড ক্যাপ্টেন ডগলাস জার্ডিনের বাবা।
বিচার শেষ হোল অস্বাভাবিক দ্রুততায়। জার্ডিন আদালতকে জানালেন যে, এই সাভারকরই হচ্ছে লন্ডনে ভারতীয় র‍্যাডিক্যালদের মাথা।
প্রথম মামলার-- রাষ্ট্রদ্রোহিতার (বিভিন্ন বক্তৃতা এবং লেখার ভিত্তিতে)-- রায় বেরোল ২৩ ডিসেম্বর ১৯১০ । যাবজ্জীবন কারাবাস এবং স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ। তখন এর মানে ছিল ২৫ বছর।
জ্যাকসন হত্যা মামলার রায় বেরোল ৩০ জানুয়ারি, ১৯১১। একই রায় --আজীবন কারাবাস, মানে ২৫ বছর সশ্রম জেল।
কিন্তু দুটো শাস্তি একসঙ্গে (কনকারেন্টলি) চলবে না; হবে একের পরে এক (কঞ্জিকিউটিভলি)। ফলে মোট কারাবাস ৫০ বছর, ওদিকে সাভারকর তখন ২৮ বছরের যুবক এবং ভারতীয়দের গড় আয়ু তখন ছিল ৪০ এর কম।
কিন্তু হেগ আন্তর্জাতিক আদালতের রায় না আসা পর্য্যন্ত সাজা মুলতুবি থাকবে।

সাভারকরের কারাবাস

উপরের রায় বেরোনোর এক পক্ষকাল পরে দি হেগ এ পার্মানেন্ট কোর্ট অফ আর্বিট্রেশন এ সাভারকর প্রত্যর্পণ মামলা শুনানি শুরু হোল এবং মাত্র ১০ দিনের মধ্যে রায় বেরোল।
পাঁচ সদস্যীয় ট্রাইবুনালে রাশিয়া বা জার্মানির কেউ ছিলেন না। ছিলেন বেলজিয়ামের প্রাক্তন প্রাইম মিনিস্টার, নরওয়ে এবং নেদারল্যান্ডের দুই প্রাক্তন মিনিস্টার, ইংল্যান্ডের প্রাক্তন এটর্নি জেনারেল, এবং ফ্রান্সের এক বিশিষ্ট আইনি পরামর্শদাতা।
রায়ে স্বীকার করা হলো যে, ফ্রান্সের মাটিতে (মার্সাই) ফরাসী পুলিশ অফিসার যে সাভারকরকে বন্দী করে বৃটিশ পুলিশের হাতে সঁপে দিলেন, তাতে আন্তর্জাতিক আইন স্পষ্টতঃ লঙ্ঘিত হয়েছে। কিন্তু এর ফলে আদৌ বৃটিশ সরকারের উপর বন্দীকে ফ্রান্স সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব বর্তায় না। কারণ ভুল তো বৃটিশ সরকারের লোক করেনি, বিদেশি সরকারের প্রতিনিধি করেছে। এই রায়ের তীব্র সমালোচনা করল ইউরোপের উদারনৈতিক ধারার প্রতিনিধিরা। ইংল্যান্ডের নিউক্যাসলের লেবার এম পি কড়া করে ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ানে চিঠি লিখলেন। সবার মোটামুটি কথা হলো ফ্রান্স বৃটেনের কাছে মাথা বিকিয়ে দিয়েছে এবং ইংল্যান্ডও তার চিরাচরিত উদারনীতি থেকে এখানে সরে এসেছে।
সাভারকর রায় বেরোনোর সময় সেন্ট্রাল মুম্বাইয়ের ডোংগরি জেলে ছিলেন। এবার আন্দামানে যেতে হবে। তার আগে বড় শালা এবং স্ত্রী যমুনা দেখা করতে এলেন। পাঁচ বছর আগে যমুনা এসেছিলেন মুম্বাই বন্দরে বিদায় দিতে। আশা ছিল, ফিরে আসবে এক সফল ব্যারিস্টার। তার জায়গায় দেখলেন হাতে পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি স্বামীকে, যে যাচ্ছে কালাপানি, ৫০ বছরের জন্যে, তাহলে এই বোধ হয় শেষ দেখা।
এস এস মহারাজা ছাড়ল মাদ্রাজ বন্দর থেকে। লোয়ার ডেকে গাদাগাদি করে কালাপানির সাজাপ্রাপ্ত বন্দীরা। কেউ খুনি, কেউ আরও কিছু। তিরিশজনের জায়গায় গাদাগাদি করে পঞ্চাশ জন। গন্তব্য পোর্ট ব্লেয়ার বন্দর, তারপর সেলুলার জেল।
এই জেলের খুপরিগুলোর কথা সবাই জানে। আগে এতে থাকত সিপাহীবিদ্রোহের বন্দীরা, এখন ৫০ বছর পরে অন্যেরা। জেলর ডেভিড ব্যারি আগেই বলে দেন যে, জেলের চারদেয়ালের মধ্যে ওঁর মর্জিই আইন। বৃটিশ আইনে রাজনৈতিক ও অন্যান্য বন্দীদের জন্যে যে ব্যবস্থা বা সুবিধেগুলো স্বীকৃত তার কিছুই এখানে খাটবে না। এবং তার চেলাচামুণ্ডারা (জমাদার, ওয়ার্ডার, পেটি অফিসার), যারা নিজেরাই দীর্ঘমেয়াদি জেল খাটছে-- তাদের ব্যবহার অত্যাচারের পর্যায়বাচী।
বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, উপেন্দ্রনাথের বিবরণ এবং ত্রৈলোক্য মহারাজের স্মৃতিচারণে এর বিস্তৃত বিবরণ আছে ।
সাভারকরকে আলাদা করে একটা ১৪ বাই ৮ ফুটের সেলে রাখা হলো। পাহারায় তিনজন-- দুই বালুচ মুসলিম এবং একজন পাঠান। তাঁর স্নানের ব্যবস্থার সময়েও ওই পাহারা।
রোজ খাটতে হবে সকাল ৬টা থেকে ১০টা, এবং দুপুরের খাওয়ার পরে বিকেল ৫টা পর্য্যন্ত। কাজ নারকোলের ছোবড়া মুগুর দিয়ে পিটিয়ে বিকেলের মধ্যে অন্ততঃ ১ থেকে ৩ পাউন্ডের মতো জাজিম গোছের বানানো।

রোজ গোটা কুড়ি নারকোলের ছোবড়া পেটানো? সাভারকর আপত্তি করায় শুনতে হলো যে তোমার কপাল ভালো যে অন্যদের চেয়ে একটু কম টার্গেট দেওয়া হয়েছে।

এরপর ১৬ আগস্ট ১৯১১ তারিখে সাভারকরের কপালে জুটল নেংটি পরে তেলঘানিতে সর্ষে পিষে তেল বের করার কাজ। বারীন ঘোষ এবং উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোর মতে এই কাজটা যেন কুস্তি করার মতো, অমানুষিক পরিশ্রম। তায় অপর্যাপ্ত খাবার (লপ্সি) এবং কথায় কথায় অশ্রাব্য গালাগাল ও টার্গেট পুরো হয়নি অজুহাতে পেটানো চাবকানো। রাজবন্দীদের কাগজ/কলম/বই কিছুই দেওয়া হতো না । নিজেদের মধ্যে কথা বলা বারণ। বড়ভাই বাবারাও এক বছর আগে থেকেই সেলুলার জেলে আছেন, কিন্তু দেখা করা কথা বলা যাচ্ছে না।
সাভারকর ডিসেম্বর ২০১৩ এবং ১৭ জানুয়ারি ২০১৪ ও ৮ জুন, ২০১৪ তে বেঁকে বসলেন -- কোন কাজ করবেন না ।
ফল হলো ক্রমশঃ নানারকম শাস্তি-- একমাস সলিটারি কনফাইনমেন্ট, এক সপ্তাহ হাতকড়ি, তারপর ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে দেয়ালে হাত তুলে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে থাকা, এইসব। এরপরে উনি দড়ি পাকানোর কাজ করতে রাজি হলেন।
এই পরিবেশে উল্লাসকর দত্ত পাগল হয়ে গেলেন, ইন্দুভুষণ রায় আত্মহত্যা করলেন।
এবার রাজবন্দীদের প্রতিবাদ শুরু হলো। দাবি জেলের অন্যান্য বন্দীদের সমান সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। কাগজ-কলম-বইপত্র-পত্রিকা দিতে হবে। হালকা কাজ, ক্লার্কের কাজ দিতে হবে।
দুজন বন্দী-- স্বরাজ পত্রিকার সম্পাদক লাধারাম এবং সতের বছরের ননীগোপাল রায়-- ভুখ হরতালে বসলেন। অন্যেরা কাজ বন্ধ করল।
বিনায়ক সাভারকরের বড়দা বাবুরাও প্রথম দিন থেকেই হরতালে যোগ দিয়ে অত্যাচার সহ্য করলেন। কিন্তু সাভারকর যোগ দিলেন না।
সাভারকর তাঁর 'মাই ট্রান্সপোরটেশন ফর লাইফ' বইয়ে লিখেছেন যে ভুখ হরতাল তাঁর পছন্দ নয়। এটা লড়াইয়ের জন্যে ফালতু। ননীগোপাল রায়ের অবস্থা খারাপ হলে উনি তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে হরতাল ভাঙালেন ও বললেন-
"ডু নট ডাই উইথ এ ফেমিনিন স্টাবর্ননেস; ইফ ইউ মাস্ট ডাই, ডাই ফাইটিং"।
তাঁর জীবনীকার বৈভব পুরন্দরের মতে বক্তব্যটি আজকের চোখে অবশ্যই পলিটিক্যালি ইনকরেক্ট মনে হবে।
এরপরে যতবার হরতাল হলো বা যখন লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার আসামী ভাই পরমানন্দ এবং আশুতোষ লাহিড়ী জেলার ব্যারিকে তুলে আছাড় দিলেন (পরে তিরিশ ঘা' করে বেত খেলেন), কর্তৃপক্ষ মনে করল এর পেছনে সাভারকরের মাথা কাজ করছে।
ত্রৈলোক্য মহারাজের 'থার্টি ইয়ার্স ইন জেল' এ পাচ্ছি সাভারকর আমাদের ক'জনকে হরতাল করতে ওসাকালো, কিন্তু নিজে টুক করে সরে গেল।
সাভারকর সেলের দেয়ালে নখ দিয়ে কবিতা লিখে মুখস্থ করে ঘষে মুছে দিতেন। এভাবে লেখা হলো 'বেড়ি', 'কোঠরি' এবং 'কমলা'। আবার ১৯১৩ সালে নোবেল প্রাইজ পাওয়ায় রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে একটি কবিতাও লেখা হলো।
ওঁর একটি দেশাত্মবোধক কবিতায় হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর সুর দিয়েছেন এবং লতা, আশা ও উষা কোরাসে গেয়েছেন।

সাভারকর আদৌ মাফিনামা লিখেছিলেন কিনা? লিখলে কবে এবং কতবার? তাঁর এবম্বিধ আচরণের ব্যাখ্যা কী?

সাভারকরের 'মার্জনা ভিক্ষা'
===================
সাভারকর কি সত্যিই বৃটিশ সরকারের কাছে 'মার্জনা ভিক্ষা' করে চিঠি লিখেছিলেন? লিখলে কতবার? এবং তাতে কি যেকোনও মূল্যে মুক্তি চেয়েছিলেন? এমনকি আজীবন বৃটিশ সাম্রাজ্যের সেবা করার এবং বিশ্বস্ত থাকার শর্তে?

সমর্থকরা এই অধ্যায়টি এড়িয়ে যেতে চান বা অস্বীকার করেন। যেমন, মারাঠি পত্রিকা 'লোকসত্তা'র ২৭ মে, ২০১৮ সংখ্যায় দাবি করা হয়েছে যে, উনি আদৌ কোনও পিটিশন পাঠান নই। বা, পাঠালেও তাতে 'মার্জনা ভিক্ষা' করেননি ।
বিরোধীরা বলেন -- সাভারকর নিজে এ নিয়ে কোথাও কিছু বলেননি বা লেখেননি। বরং আজীবন ব্যাপারটা চেপেচুপে রেখেছেন।
আমরা দেখাব যে দু'পক্ষই ভুল। সমস্ত দলিল ( বৃটিশ এবং ভারতীয়) আজ উপলব্ধ। এবং সাভারকর নিজে তাঁর এই 'এবাউট টার্ন' কে ডিফেন্ড করে সেসময় গুচ্ছের লেখা লিখেছেন, উকিলের মেধা দিয়ে এই স্ট্যান্ডকে থিওরাইজ করেছেন। কতদূর সফল হয়েছেন বা আদৌ হয়েছেন কি না, তা বিতর্কের বিষয়।

কতবার লিখেছিলেন? সাতবার।

প্রথমবার সেলুলার জেলে আসার দুমাসের মাথায়--৩০ অগাস্ট, ১৯১১, নির্জন কারাবাসের শাস্তির মাথায়। চারদিনে খারিজ হলো পিটিশন।
তারপর ২৯ অক্টোবর, ১৮১২; নভেম্বর ১৯১৩, সেপ্টেম্বর ১৯১৪। তারপর ১৯১৫ এবং ১৯১৭। শেষ দুটোতে আগের আগুনখেকো বিপ্লবী সাভারকর ওকালত করছেন হোমরুলের পক্ষে। তখন মন্টেগু -চেমসফোর্ড সংবিধান রিফর্মের কথা চলছে যা এলো ১৯১৯এ। সাভারকর লিখছেও, কোনও দেশপ্রেমিকই ভালো সংবিধানের আওতায় কাজ করার সুযোগ পেলে সহিংস পথে বিপ্লবের কথা ভাববে না। এও বললেন যে, আজ যখন ইংল্যান্ড ও আমেরিকার মতো প্রগতিশীল এবং নমনীয় (ইল্যাস্টিক) সংবিধান রয়েছে তখন বিপ্লবের কথা বলা 'অপরাধ' (!)।
তাহলে দশবছর আগে গোখলে গান্ধী এরা কি দোষ করেছিলেন?
লক্ষণীয়, সাভারকর ১৯১২ থেকে ১৯১৪ পর্য্যন্ত কাজ করতে অস্বীকার করা এবং নিষিদ্ধ কাগজপত্র রাখার অপরাধে আটবার শাস্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু পরের পাঁচবছর তাঁর আচার-আচরণ ছিল' ভেরি গুড'।
কন্সটিট্যুশনাল রিফর্মের মাথায় অনেক রাজবন্দীকে মুচলেকা লিখিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল 'রয়্যাল অ্যামনেস্টি' বলে। একই রকম মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেলেন বারীন ঘোষ, হেমচন্দ্র দাস এবং ভাই পরমানন্দ। কিন্তু 'ম্মন্টেগু-চেমস্ফোর্ড রিফর্মের পর সাংবিধানিক পথেই থাকবেন' আশ্বাসন সত্ত্বেও বৃটিশ সরকার সাভারকর ভাইদের বিশ্বাস করতে পারছিল না। তাঁরা সম্রাজ্ঞীর মার্জনা পেলেন না ।
সাভারকরের শেষ পিটিশনের তারিখ ৩০ মার্চ, ১৯২০ যাতে উনি ছাড়া পাওয়ার পর সরকার যতদিন বলবে ততদিন কোনও রাজনৈতিক কাজকর্মে যুক্ত হবেন না, একটি এলাকার বাইরে পা রাখবেন না এবং থানায় হাজিরা দেবেন -- এই মর্মে মুচলেকা দিতে রাজি বলে জানালেন।
সাভারকর নিজের কারাবাসের অভিজ্ঞতার বর্ণনায় লিখছেন যে, উনি তখন জেলের মধ্যে অন্য বন্দীদের গোঁড়ামি ছেড়ে মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে এসে দেশের কাজ করতে বোঝাচ্ছেন। শিবাজী এবং কৃষ্ণের উদাহরণ দিচ্ছেন। অনেকে মানছে না। কিন্তু জেলের ভেতরে জীবন নষ্ট করে কি লাভ? এই ছিল ওঁর যুক্তি।
গান্ধীজি মে ১৯২০ এর ইয়ং ইন্ডিয়ায় লিখলেনঃ এত লোককে আম মাফি দেওয়া হলো, শুধু এই দুই ভাই বাদ! ওরা তো বিপ্লবের পথ ছেড়ে রিফর্ম অ্যাক্টের হিসেবে কাজ করবে বলে কথা দিয়েছে । ওদের অবিশ্বাস করার কি দরকার? বর্তমানে ভারতে সহিংস পথের অনুগামী নেই বলা যায় ।
লেবার এম পি ওয়েজউডের ডেইলি হেরাল্ডের প্রবন্ধে আন্দামান জেলের ভেতরের অবস্থা তুলে ধরা হলো। ওঁর ভাষায় সেলুলার জেল একটি নরক। পাবলিক ওপিনিয়ন বিচলিত। শান্তিনিকেতন থেকে সি এফ এন্ড্রুজ বোম্বে ক্রনিকল পত্রিকায় এ নিয়ে লিখলেন, যাতে বোম্বে গভর্নর জর্জ লয়েড সাভারকর ভাইদের ছেড়ে দেন। বৃটিশ রাজ এপ্রিল ১৯২১ এ বোম্বে গভর্নরকে একমাসের মধ্যে আগের সিদ্ধান্তের রিভিউ করতে বলল।
অবশেষে, মে ১৯২১এ দুই সাভারকর ভাইকে আন্দামান থেকে ভারতের জেলে নিয়ে আসা হলো। বড়দা বাবারাও সেপ্টেম্বর ১৯২২এ নিঃশর্ত মুক্তি পেলেন। তাঁর 'সিডিশন' বলতে ছিল কিছু জ্বালাময়ী কবিতা। তাতেই তিনি ১৫ বছর কালাপানি এবং একবছর ভারতের জেলে রইলেন।
জ্যাকসন হত্যা এবং পিস্তল সরবরাহের দায়ে অভিযুক্ত বিনায়ক সেলুলারে রইলেন ১০ বছর। ভগ্ন স্বাস্থ্য মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বিনায়ক সাভারকর জেল থেকে ছাড়া পেলেন ৬ জানুয়ারি, ১৯২৪। কিন্তু নিঃশর্ত নয়। সরকার জুড়ে দিল আরও দুটি ।
এক, ওঁকে স্বীকার করতে হবে যে ' হি হ্যাড এ ফেয়ার ট্রায়াল অ্যান্ড এ জাস্ট সেন্টেন্স' এবং দুই, ওঁকে সহিংস পদ্ধতির নিন্দা করে বিবৃতি দিতে হবে।
সাভারকর দুটি শর্তই মেনে নিয়ে মুচলেকা লিখে দিলেন। সরকার বলল পাঁচবছর উনি রত্নগিরি জেলার বাইরে যেতে পারবেন না। সাভারকর মেনে নিয়ে স্ত্রী-পুত্রকন্যা নিয়ে সংসার করতে এবং ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধারে মগ্ন রইলেন।
তাহলে লন্ডনে গ্রেফতারির দিন থেকে ধরলে ওঁর কারাবাস হলো প্রায় ১৪ বছর।
জনগণমনে বিতর্কের ঝড় বয়ে গেল। সাভারকর নিজের বন্দীজীবনের স্মৃতি ও মুচলেকার সাফাই নিয়ে কেশরী এবং মারাঠি সাপ্তাহিক 'শ্রদ্ধানন্দে' লিখতে লাগলেন। ওদিকে কেশরী , ইন্দুপ্রকাশ এবং অন্যান্য মারাঠি দৈনিকে বেরোল ওঁর মুচলেকার শর্তাবলি।


সাভারকরের মাফিনামা বিতর্ক
==================
সাভারকরের মাফিনামার শর্তগুলো প্রকাশ্যে আসায় অনেক হোমরুলের সমর্থক ক্ষুণ্ণ হলেন-- একজন খ্যাতনামা দেশপ্রেমিক চাপের মাথায় এমন সব শর্ত মেনে নিলেন!
রত্নাগিরি জেলার বাইরে যাওয়া পাঁচবছরের জন্যে নিষিদ্ধ, কিন্তু সাভারকর ঘরে বসে (তখন স্ত্রীও সঙ্গে থাকছেন) কেশরী এবং শ্রদ্ধানন্দ (বোম্বে থেকে ছোটভাই ডাক্তার নারায়ণ সাভারকরের সম্পাদিত মারাঠি পত্রিকা) পত্রিকায় সিরিয়ালি নিজের ১৪ বছর কালাপানির অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করছেন। এসব একটি বইয়ের আকারে মে, ১৯২৭ এ প্রকাশিত হয়। তাতে মাফিনামার ডিফেন্সও রয়েছে।
কিন্তু প্রখ্যাত রাজনৈতিক কর্মী এবং কানপুরের দৈনিক প্রতাপ পত্রিকার সম্পাদক গণেশ শংকর বিদ্যার্থী শ্রদ্ধানন্দ পত্রিকায় খোলাচিঠি লিখে অভিযোগ করলেন, যাঁরা দেশের জন্যে শহীদ হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন তাঁরা কী করে মার্জনা চেয়ে চিঠি লিখলেন? 'হোয়াই ডিডন্ট দে এমব্রেস ডেথ ইন প্রিজন'?
বিশেষ করে সাভারকর যে লিখেছিলেন, 'যদি পথভ্রষ্ট সন্তান (প্রডিগাল সন) নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসে তাহলে পিতার আশ্রয়লাভের করুণা থেকে নিশ্চয় বঞ্চিত হবে না !' -- এটা সবাইকে ঘা দিয়েছিল।
সাভারকরের জবাব বেরোল যার সারমর্ম হচ্ছে যে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনেক দেশপ্রেমিক ঘর ছেড়ে হোমের আগুনে নিজেকে আহুতি দিতে বেরিয়েছিল। তারা লড়ল, অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করে প্রায় মৃত্যুমুখে পৌঁছে গেল। তারপর তারা যদি ভবিষ্যৎ লড়াইয়ের জন্যে প্রাণ বাঁচাতে শত্রুর শর্ত মেনে সাময়িকভাবে যুদ্ধের ময়দান থেকে সরে আসে? এমনটি শিবাজি আগ্রা দুর্গে বন্দী অবস্থায় তাই করেননি? ঔরংজেবের শর্ত মেনে জান বাঁচিয়ে আবার যুদ্ধের ময়দানে ফিরে যাননি? যখন তিনি আফজল খাঁর সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন হাতে লুকনো ছিল বাঘনখ।
১৯২৮ সালে কাকোরি সরকারি ফান্ড লুঠের মামলায় রামপরসাদ বিসমিল এবং আরও তিনজনের ফাঁসি হয়, শচীন সান্যাল এবং আরও কয়েকজনের কালাপানি হয়। বিসমিল, শচীন সান্যাল এবং আরও দুয়েকজন প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিলেন, মঞ্জুর হয়নি।
উনি বারীন ঘোষ, হেমচন্দ্রের মাফিনামা দিয়ে বেরিয়ে আসার উল্লেখ করেন। এবং গণেশশংকর নিজে একটি আদালত অবমাননার কেসে জেলের সম্ভাবনায় আদালতে ভুল স্বীকার করেছিলেন --সেসব তুলে ধরেন। আরও বলেন, লড়াই না করে জেলে পচে মরার বীরত্বে ওঁর বিশ্বাস নে। তার চেয়ে যেভাবে হোক বেরিয়ে এস, তারপরে আবার লড়াই কর।
ঠিক আছে, তর্কের খাতিরে এসব যদি সাময়িক রণকৌশল বলে ধরে নিই, তবু প্রশ্ন ওঠে।
ওঁর উদাহরণের সবাই--- শ্রীকৃষ্ণ , শিবাজী, ওঁর গুরু তিলক এমনকি গান্ধী নেহেরু-- ছাড়া পাবার পরে আবার লড়াইয়ের ময়দানে ফিরে এসেছেন-- নিজের নিজের মতাদর্শ অনুযায়ী লড়াই করেছেন, দুশমনকে আঘাত হেনেছেন। কিন্তু সাভারকর?
ভারতে এসে বাকি জীবনে একবারও বৃটিশকে উচ্ছেদ করতে অস্ত্রধরা দূর কি বাত, শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনেও সামিল হননি। বৃটিশ সংবিধানের মধ্যেই দেশের উন্নতির সম্ভাবনা দেখেছেন। তাহলে লন্ডন প্রবাসের দিনগুলোয় গান্ধী-গোখলে ইত্যাদি কন্সটিট্যুশনালিস্টদের বিরোধ, সমালোচনা এবং তাচ্ছিল্যের যুক্তি কি? গান্ধীরা বরং এগিয়ে গেছেন। জেলে যাচ্ছেন কালাকানুনের প্রতিবাদে; মাস মোবিলাইজেশন করছেন, সত্যাগ্রহ শুরু করছেন। সাভারকর পিছিয়ে গেছেন তিরিশ বছর বা আরও বেশি। কারণ তাঁর শত্রু বদলে গেছে। খুঁজে পেয়েছেন তাঁর আসল শত্রু--মুসলমান।


উনি কি কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন?

বিয়াল্লিশের আন্দোলনে যোগ না দেওয়া
======================
গান্ধীজির 'কুইট ইন্ডিয়া' আন্দোলনে নানা কারণে যাঁরা যোগ দেননি তাঁদের লিস্টঃ
দলিত নেতা আম্বেদকর, মুসলিম লিগ নেতা জিন্না, অল ইন্ডিয়া স্টুদেন্ট কনফারেন্স, কমিউনিস্ট পার্টি, নেহেরুর আশীর্বাদ ধন্য কিছু কিসান সভা; এবং কিছু লিবেরাল জনতা যাঁরা মনে করতেন জাপান জিতলে ভারত স্বাধীনতা পাবে।
এরা কেউ বৃটিশের দালাল নন, কিন্তু কমিউনিস্ট সমেত অনেকের গায়ে কংগ্রেস এই তকমাটা সেঁটে দিয়েছিল।
প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কারণ ছিল। যেমন কমিউনিস্ট পার্টির রাশিয়ার নেতৃত্বে জনযুদ্ধ।
সাভারকরের কাছে এটা ছিল হিন্দু যুবকদের বিশেষ সুযোগ-- বৃটিশ ফৌজে ঢুকে যুদ্ধবিদ্যা অস্ত্রচালনায় পারঙ্গম হয়ে আগামী দিনের মহাসমরের জন্যে (মুসলিম মুক্ত ভারত) প্রস্তুত হওয়া।


গান্ধীহত্যার সঙ্গে সাভারকরের আদৌ কোনও সম্পর্ক আছে কি?

গান্ধীহত্যা মামলা
==========

স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে এই সময়ের ইতিহাসটাকে যেভাবে দেখায় ব্যাপারটা একেবারে অমন সরলরৈখিক ছিল না। বিজয়ীর লেখা ইতিহাস অমনই হয়। স্তালিনের আমলে লেখা সোভিয়েত বিপ্লবের ইতিহাস পড়লে মনে হবে বলশেভিকরা গোড়া থেকেই বিপ্লবের সমস্ত সম্ভাব্য দিকবদল বাঁক দেখতে পেয়ে সচেতন শক্তি হিসেবে দ্বিধাহীন পদক্ষেপ নিয়ে জারতন্ত্রের অবসান এবং পরবর্তী বিপ্লব ঘটিয়েছে। চিনের মাওজমানায় লেখা আফিং যুদ্ধ থেকে সাংস্কৃতিক বিপ্লব পর্য্যন্ত ইতিহাসের একমাত্রিক বিবরণ মনে করুন ।
ভারতের ক্ষেত্রে তিরিশ এবং চল্লিশের দশক ছিল অনেকগুলো ক্রস কারেন্টের সমাহার।সেটা আদৌ মহাভারতের যুদ্ধের মত একদিকে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ অব্যদিকে গান্ধীজির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ভারত--- এমন ছিল না ।
তখন অনেকগুলো প্রশ্ন উত্তরের অপেক্ষায় হাঁ করে দাঁড়িয়ে।
যেমন, বৃটিশ-উত্তর ভারতের চেহারা কেমন হবে? ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও ধার্মিক সমূহের মধ্যে ব্যবস্থার বাঁটোয়ারা কেমন হবে? বৃটিশের তৈরি বিভিন্ন ধার্মিক সমুদায়ের জন্যে আলাদা আলাদা ইলেক্টোরেটস এবং রিজার্ভ সীটের ভবিষ্যৎ কী হবে? ভোট দেওয়ার অধিকার কারা পাবে? বৃটিশ জমানায় শুধু করদাতা এবং জমির মালিকদের ভোটাধিকার ছিল। আর হিন্দু-মুসলিম আলাদা ইলেক্টোরেট হওয়ার ফলে মাইনরিটি মুসলমানের একটি ভোটের ওজন মেজরিটি হিন্দু ভোটের চেয়ে বেশি হয়ে গেছল।
সাভারকর, আম্বেদকর, দেশি লিব্যারেল, জিন্না, গান্ধী নেহরু সবাই এসব প্রশ্নে নিজের নিজের অবস্থান নিয়ে এনগেজ করছিলেন।
সাভারকর ব্যস্ত ইংরেজ তাড়াতে নয়, ভারতে লড়াকু হিন্দুসমাজ সংগঠিত করতে। গান্ধী এবং কংগ্রেসের সঙ্গে উতোর-চাপান চলতে লাগল।
দাঙ্গার গান্ধীর মুসলিম শরণাআর্থী এবং দাঙ্গাপীড়িতদের সাহায্যে হিন্দু যুবকদের এগিয়ে আসার আহ্বানে সাভারকর খেপে গেলেন। তাঁর হিন্দু মহাসভা এবং তাঁর দেওয়া ফান্ডিং নিয়ে নাথুরাম গোড়সের পত্রিকা --যার মাস্টহেডে সাভারকরের ছবি থাকত-- গান্ধী এবং মুসলিম সমাজের প্রতি আগুন উগরে চলল।
১৫ অগাস্টের ঠিক আগে সাভারকর গেরুয়া পতাকাকে স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রীয় ধ্বজ করার প্রস্তাব রাখলেন; সংবিধান সভার ফ্ল্যাগ কমিটি খারিজ করল। তখন উনি পতাকার কেন্দ্রে গান্ধীজির চরখার বদলে সারনাথের অশোক চক্র করার প্রস্তাব রাখলেন; সেটা গৃহীত হলো।
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ১৪ অগাস্ট, ১৯৪৭ তারিখে ক্যাশ ব্যালান্স ছিল ২২০ কোটি টাকা। ঠিক হলো, দেশ স্বাধীন হলে বৃটিশের হাত থেকে আনুপাতিক হিসেবে পাকিস্তান পাবে ২৫%, মানে ৫৫ কোটি টাকা। কিন্তু অক্টোবরে পাঠান আদিবাসীরা মহারাজা হরি সিঙয়ের করদ রাজ্য কাশ্মীর আক্রমণ করল। নেহেরু- প্যাটেল টাকা দেওয়া স্থগিত রাখলেন। জানুয়ারি ১৯৪৮, অর্থাৎ যতদিন মহারাজা ভারতে যোগদানের সন্ধিপত্রে দস্তখত না করলেন, টাকা আটকে রইল। শেষে নেহেরু-প্যাটেলের বিরুদ্ধে গান্ধীর অনশনে ক্যাবিনেট হার মানল; টাকা দিল পাকিস্তানকে। এটা নিয়ে দেশের জনমানসে টেনশন বাড়ল।
এই প্রেক্ষিতে গান্ধীহত্যা মামলা দেখা যাক ।

গান্ধীর উপর হামলা হলো দু'বার। প্রথমবার ব্যর্থ, দ্বিতীয়বার সফল। প্রথমবার ১৯৪৮ সালের ২০ জানুয়ারিতে বিড়লা হাউসে; দ্বিতীয়বার ৩০ জানুয়ারিতে ।
প্রথমবারের হামলাকারী মদনলাল পাহওয়া, এক পাঞ্জাবী উদ্বাস্তু কিশোর। ওর ছোঁড়া সুতলি বোম গান্ধীজির থেকে ৭৫ ফুট দূরে ফাটল।
দ্বিতীয়বার তিন মারাঠি চিতপাবন ব্রাহ্মণ (সাভারকরও তাই)। এঁরা হলেন নাথুরাম গড়সে, নারায়ণ আপ্তে এবং বিষ্ণু কারকারে। তিনজনেই হিন্দু মহাসভার অগ্রণী সদস্য। গুলি চালালেন নাথুরাম পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে ।

নাথুরাম ১৯৩০ সালে আর এস এস এর সক্রিয় সদস্য হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৩৭ সালে সাভারকর সবরকম প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্ত হয়ে রাজনীতিতে নামতেই হিন্দু মহাসভায় যোগ দিলেন। ১৯৩৮এ হায়দরাবাদের নিজামের বিরুদ্ধে সাভারকরের সবিনয় প্রতিরোধ আন্দোলনে উনি প্রথম ব্যাচের সত্যাগ্রহী হয়ে এক বছর জেল খাটলেন। কারকারে ১৯৪৩ সালে হিন্দু মহাসভার টিকিটে সিভিক কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সাভারকরের থেকে ১৫০০০ টাকা ধার নিয়ে নাথুরাম ১৯৪৪ সালে শুরু করলেন 'অগ্রণী' পত্রিকার সম্পাদনা, বন্ধু আপ্তে হলেন ম্যানেজার। পত্রিকার মাস্টহেডে সাভারকরের ছবি। শুরুতেই পত্রিকায় গর্বের সঙ্গে লেখা হলো কীভাবে উনি পুণের কাছে হিল স্টেশন পঞ্চগণিতে একটি জাতীয়তাবাদী ছেলেদের দল নিয়ে গিয়ে গান্ধীজিকে হেনস্থা করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে প্রেস অ্যাক্ট ভংগের দায়ে সরকার জরিমানা করায় পত্রিকার নাম বদলে দিয়ে করা হলো 'দৈনিক হিন্দু জাগরণ'। সাভারকর পাবলিক অ্যাপিল করে বললেন, হিন্দুত্বে বিশ্বাসী সব পরিবার একটাকা করে দান দিয়ে পত্রিকাটির পাশে দাঁড়াক।
মামলায় সাভারকরকে করা হলো গান্ধীহত্যা চক্রান্তের মুখ্য মস্তিষ্ক। তবে গড়সে, আপ্তে এবং কারকারে এতে সাভারকরের হাত অস্বীকার করলেন।
কিন্তু জনৈক অস্ত্রব্যবসায়ী বাড়গে রাজসাক্ষী হয়ে বললেন, ঘটনার ক'দিন আগে ১৪ এবং ১৭ জানুয়ারি উনি গড়সে এবং আপ্তের সঙ্গে সাভারকরের শিবাজী পার্কের বাড়িতে গিয়েছিলেন। উনি নীচে ছিলেন, ওরা ওপরে গিয়ে সাভারকরের সঙ্গে বৈঠক করে একটু পরে একটা থলি নিয়ে নেমে আসে। একজন নামকরা অভিনেত্রী বিম্বা (যিনি নিজের গাড়ি করে ওদের স্টেশন থেকে সাভারকরের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়েছিলেন) এবং সাভারকরের বডিগার্ড ও সেক্রেটারি এর পক্ষে সাক্ষ্য দেন। কিন্তু আলোচনার সময় কি কথা হয়েছিল তার কোনও প্রত্যক্ষদর্শী নেই। সাভারকরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পুরোটাই সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স বেসড। যেমন, তিন আসামীর সঙ্গে সাভারকরের ঘনিষ্ঠতা, কাজকর্ম এবং তিনজনেরই গান্ধীজির বিরুদ্ধে ঘৃণা এবং বিশ্বাস যে গান্ধীজির জিন্না তুষ্টিকরণ নীতির ফলে দেশভাগ হয়েছে।
লক্ষণীয় যে, প্রথম হামলাকারী মদনলালা পাহওয়া ওই তিনজনের চ্যালা ছিল এবং প্রথম হামলার দিন (২০ জানুয়ারি) গড়সে, আপ্তে, বাড়গে এবং পাহয়া একসঙ্গে দিল্লিতে ছিল এবং একসংগে ট্রেনে মুম্বাই হয়ে পুণে ফিরে এসেছিল।
সাভারকরের মৃত্যুর পর মনোহর মালগাঁওকর, যিনি 'মেন হু কিল্ড গান্ধী' বইটি লিখেছেন, কারকারে, পাহওয়া এবং গোপাল গড়সেকে প্রশ্ন করেন। ওরা সবাই গান্ধীহত্যার পেছনে সাভারকরের ভূমিকার কথা অস্বীকার করে।
নাথুরামকে গান্ধীহত্যার জন্যে ৯ এমেম ব্যারেটা পিস্তল দিয়েছিল গোয়ালিয়রের হিন্দু মহাসভার সেক্রেটারি সদাশিব পরচুরে।
বিচারের রায় বেরোল। জাস্টিস আত্মারাম আটজন অভিযুক্তের মধ্যে শুধু সাভারকরকে প্রমাণাভাবে মুক্তি দিলেন--কারণ রাজসাক্ষীর বয়ানের কোনও স্বতন্ত্র সাক্ষী বা দলিল পাওয়া যায়নি। নাথুরাম এবং নারায়ণ আপ্তের ফাঁসি, বাকি পাঁচজনের যাবজ্জীবন (তখন এর মানে ১৪ বছর)। সরকার এর বিরুদ্ধে আপীল করল না। সাভারকরের ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে তখন শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন হিন্দু মহাসভার সেক্রেটারি। নেহেরু বললেন গান্ধীহত্যার পর ওঁর মন্ত্রিসভায় হিন্দু মহাসভার নেতা মন্ত্রী হবেন এটা উচিৎ নয়। শ্যামাপ্রসাদ মহাসভার সদস্যপদ ছাড়লেন।
কিন্তু উনি প্যাটেলকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন যে, সাভারকরের বিচার যেন নিরপেক্ষভাবে হয়। প্যাটেল আশ্বাস দিয়েছিলেন। পরে উনি শ্যামাপ্রসাদকে লিখেছিলেন যে, আইনের নিক্তিতে সাভারকর ছাড়া পেলেও এই হত্যাকান্ডের নৈতিক দায় থেকে উনি মুক্ত হতে পারেন না।
প্যাটেল নেহেরুর আর এস এস নিয়ে আশংকার উত্তরে জানিয়েছিলেন যে, আর এস এসকে অন্য অনেক দোষে দায়ি করা যায় , কিন্তু গান্ধী হত্যার জন্যে নয়।
সাভারকর একবছর জেল খেটে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু বিতর্ক পিছু ছাড়ল না। ৬০ এর দশকে তিলকের নাতি জি ভি কেতকর পুণের এক সভায় বললেন যে, উনি গান্ধীহত্যার ব্যাপারে ঘটনার অনেক আগেই জানতেন। ১৯৬৬ সালে সরকার এ নিয়ে কাপুর জুডিশিয়াল কমিশন বসাল। কাপুর বললেন যে, সমস্ত তথ্যপ্রমাণ একসঙ্গে মিলিয়ে দেখলে সাভারকর এবং তার গ্রুপ মিলে যে ষড়যন্ত্র রচেছিলেন, তাই মনে হয় ।
মোদীজি ক্ষমতায় আসলে এক সাভারকর ভক্ত কাপুর কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে সুপ্রীম কোর্ট গেল। সবোর্চ্চ আদালত তার মে ২০১৮ রায়ে বলল যে, কমিশনের রিপোর্ট 'জেনারেল অবসার্ভেশন' মাত্র; তা কোনওভাবেই ক্রিমিনাল কোর্টের রায় ---সাভারকরের ভূমিকা অপ্রমাণিত -- উলটে দিতে পারে না ।
সবমিলিয়ে প্যাটেলের কথাটাই মাথায় আসে-- গান্ধীহত্যার নৈতিক দায় থেকে সাভারকরকে রেহাই দেওয়া কঠিন।

উনি সংঘ পরিবারের হিন্দুত্ব থিওরির প্রবক্তা কিনা?

সাভারকরের 'হিন্দুত্ব' অবধারণা এবং আজকের সংঘ পরিবারের এজেন্ডা
========================================

সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক এজেন্ডা যে হিন্দুত্ব,  তা অবশ্যই সাভারকরের অবদান। ওঁর রত্নগিরিতে সপরিবারে নজরবন্দী থাকার সময় লেখা ‘হিন্দুত্ব’ বইটি থেকেই ওদের মূল থিওরেটিক্যাল বই ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’ বইটি লেখা। দ্বিতীয়টির ছত্রে ছত্রে প্রথমটির ছাপ। কিন্তু সেসময় ঋণ স্বীকার না করায় সাভারকর মনে হয় অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তাই হিন্দু মহাসভার কর্মীদের একসময় আর এস এস এর সদস্যপদ ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। সঙ্ঘপরিবারের সাংস্কৃতিক ভারত নিয়ে ধারণার দুটো স্তম্ভ, ‘পূণ্যভু’ (হোলিল্যান্ড) এবং ‘পিতৃভু’ (ফাদারল্যান্ড) হুবহু ওঁর থেকে নেওয়া।সে ঋণ সংঘ পরিবার আজ সুদে আসলে ফিরিয়ে দিচ্ছে ওঁকে সামনের সারির স্বাধীনতা যোদ্ধা হিসেবে প্রজেক্ট করে ।

ওঁর হিন্দুত্ব কিন্তু শুধু ধার্মিক হিন্দুত্ব নয়। বরং সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক হিন্দুত্ব। ধর্ম, বিশেষ করে বৈদিক ধর্ম পালন এসেছে ভারতের 'মোনোলিথিক (সাভারকরের মতে) সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংগ' হিসেবে।
ওঁর কল্পনার অখণ্ড হিন্দুস্থান সিন্ধুনদের দু'পাশ থেকে কাশ্মীর হয়ে কন্যাকুমারিকা পর্য্যন্ত বিস্তৃত ।
ওঁর মতে, হিন্দু একটি সাংস্কৃতিক জাতি, যাদের শিরায় শিরায় বইছে একই শুদ্ধ রক্তধারা, যারা জন্মসূত্রে এই ঐতিহ্যের জন্যে গর্বিত।
ওঁর হিন্দুত্ব আইন করে এফিডেভিট করে নাগরিকত্ব পাওয়া নয়। তার জন্যে ভারতে জন্মাতে হবে। কেন?
কারণ যদি 'পিতৃভূমি' এবং 'পূণ্যভুমি' এক না হয়, তাহলে মানুষের মনে টানাপোড়েন থাকবে এবং তার আনুগত্য বিভক্ত হবে ।

উনি মনে করেন 'হিন্দু' একটি প্রাকৃত শব্দ, সংস্কৃত নয়, তাই বেদে উল্লেখ নেই। কিন্তু এটি প্রাচীন শব্দ। মধ্যপ্রাচ্যের জিভে 'স' কে 'হ' উচ্চারণ করা হতো। তাই 'সপ্তসিন্ধু' জেন্দাবেস্তায় 'হপ্তসিন্ধু' বলে উল্লিখিত। তাই সিন্ধুর এপারে সবাই হিন্দু। তাই ভারতে জন্মানো হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন সবাই রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক হিন্দু। কারণ তাদের জন্মভূমি (পিতৃভূমি) এবং 'পুণ্যভূমি ' হিন্দুস্তান। একই কারণে কোনও ক্রিশ্চান বা মুসলমান হিন্দুস্থানের নাগরিক বা সাংস্কৃতিক -রাজনৈতিক হিন্দু হতে পারে না। কারণ তার জন্মভূমি যদি ভারত হয়ও, এবং সে যদি দেশপ্রেমিক হয়ও, তার পূণ্যভূমি আলাদা (আরব ও প্যালেস্তাইন)। ফলে সেইসব দেশের সঙ্গে যুদ্ধ হলে বা স্বার্থের সংঘাত হলে 'কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট' কাজ করবে।(!)
অতএব সাভারকরের ভারতবর্ষে মুসলিম/ক্রিশ্চানদের স্থান নেই। আরএস এস এর গুরুজি গোলওয়ালকরের ‘এ বাঞ্চ অফ থট’ বইয়েও ‘দ্য এনিমিজ’ বলে একটি অধ্যায় আছে, যাতে শত্রু তিনজন—মুসলিম, ক্রিশ্চান এবং কম্যুনিস্ট। এদের পিতৃভূমি এবং পুণ্যভূমি আলাদা যে!
এবার দেখুন, কেন আজকাল কথায় কথায় সেকুলার বা লিবেরালদের পাকিস্তান চলে যেতে বলা হয় এবং কেন ক্ষমতাসীন দল নাগরিক রেজিস্টার এবং ছলেবলে কৌশলে মুসলিম বিতাড়নের ধুয়ো তুলেছে।
এখানে আমার দুটি প্রশ্নঃ
১ সমস্ত ইউরোপীয় নেশন স্টেট বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের (যাঁরা জন্মসূত্রে নাগরিক) তো পিতৃভূমি এবং পুণ্যভূমি আলাদা। তা বলে এতদিন ধরে তাঁদের আনুগত্য কি দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে? ইতিহাসের সাক্ষ্য কি বলে?
২ সিন্ধু এখন পাকিস্তানের প্রদেশ তাহলে কি আমাদের বর্তমান নাগরিকদের সাভারকরের অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্র গড়তে সেটা কেড়ে নিতে হবে? আমরা 'জনগণমন' গানে সিন্ধু শব্দটা বাদ দিইনি; কেন?
কিন্তু ইউটিউবে বন্দেমাতরম শুনে দেখুন 'সপ্তকোটি কন্ঠ কলকল নিনাদ করালে' বদলে 'কোটি কোটি কন্ঠ কলকল নিনাদ করালে, কোটি কোটি ভুজৈ ধৃতখরকরবালে' করা হয়েছে।
আসলে আনন্দমঠে বঙ্কিম এখানে দেশ বলতে অবিভক্ত বঙ্গকেই বুঝিয়েছেন, গোটা ভারতকে নয় ।

সাভারকর মনে করেন জাতিপ্রথা হিন্দুসমাজের এবং দেশের ক্ষতি করেছে। উনি অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে। একটা মন্দির বানালেন যাতে সব জাতের লোক ঢুকতে পারবে। একবার মুসলমানের ছোঁয়া লেগে গেলে আমরা বহু হিন্দু পুরুষ এবং বিশেষ করে নারীদের সমাজের বাইরে করে দিয়ে মুসলমান সমাজের সংখ্যা বাড়িয়েছি মাত্র। উনি তাই রিকনভার্সনের ডাক দিলেন। বর্তমান সংঘ পরিবার শুরু করেছে ঘর -ওয়াপ্সি আন্দোলন।
সাভারকরের মতে, বৌদ্ধধর্মের অহিংসা নীতি ভারতকে দুর্বল করে মুসলিম আগ্রাসনকে সহজ করে দিয়েছে। সিন্ধু আক্রমণের প্রসঙ্গে উনি বৌদ্ধদের বিশ্বাসঘাতক বলতে দ্বিধা করেননি। উনি খুশি, বৌদ্ধধর্মের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ভারতে প্রায় বিলুপ্ত এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব হিন্দু দশাবতারের একজন হয়ে শোভা পাচ্ছেন।
ওঁর মতে হিন্দুদেরও দাঁতের বদলে দাঁত চোখের বদলে চোখ মেনে চলা উচিত ছিল। 'ক্ষমা বীরস্য ভূষণম' জাতীয় ফালতু স্তোকবাক্যে না ভুলে পরাজিত আত্মসমর্পণকারী মুসলিনদের হত্যা করা উচিত ছিল। এবং 'ওরা' যেমন পরাজিত হিন্দুদের বৌ-মেয়েদের লুটে নেয়, ধর্ষণ করে , বিয়ে করে বা রক্ষিতা বানায় আমাদেরও তাই করা উচিত ছিল । তাহলে আজ এত মুসলমান হতো না ।'
'শিবাজী যখন বিজাপুরের সুলতানের পরিবারের মেয়েদের সসম্মানে ফেরত দিলেন, তখন কি সেই সিন্ধুবিজয়ের দিন থেকে অগণিত লুন্ঠিত ধর্ষিত হিন্দুমেয়েদের কান্না তাঁর কানে প্রবেশ করেনি? হিন্দুসমাজ 'অহিংসা', শত্রুকে সম্মান, সহিষ্ণুতা --এসবকে গুণ মনে করে নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছে। সাপ দেখলে মেরে ফেলা উচিত, স্ত্রী-পুরুষ বিচার করা উচিত নয় ।
রামায়ণে রামচন্দ্র তাড়কা রাক্ষসীকে বধ করেছিলেন। লক্ষ্মণ শূর্পণখার নাক কেটে ভাগিয়ে দিয়েছিলেন। তাহলে?
--- ভারতরত্নের যোগ্য নায়ক বটে!

ফুটনোটঃ

একটা পর্যায়ে হিন্দু মহাসভা এবং আর এস এসের মধ্যে একটু আকচাআকচি ছিল। গান্ধীহত্যার কলঙ্কের দাগ যাতে না লাগে, তার জন্যে ওদের নেতারা সচেষ্ট ছিলেন । 
সাভারকর আর এস এস কে নিয়ে ব্যঙ্গ করে বলতেন যে 'দ্য এপিটাফ ফর দ্য অ্যার এস এস ভলান্টিয়ার উইল বি হি ওয়াজ বর্ন, হি জয়েন্ড দি অ্যার এস এস, অ্যান্ড হি ডায়েড উইদাউট অ্যাকমপ্লিশিং এনিথিং'। ওদের গোমাতা থিম উনি মানতেন না। কিন্তু আজ ওরা সাভারকরকে মাথায় তুলে রেখেছে। আন্দামান জেলের নামকরণ আজ ওঁর নামে। অথচ ওখানে ওঁর চেয়ে বেশি সময় জেল খেটেছে বা ওখানেই মারা গেছে, এমন বন্দীর নামও পাওয়া যাচ্ছে। আজ ওঁর ছবি সংসদে দেয়ালে ঝুলছে। কাল হয়তো ভারতরত্ন দেওয়া হবে।
এর পেছনে দুটি কারণ আছে বলে মনে হয় ।
এক, বিজেপির নেতাদের মধ্যে (আর এস এসএর) স্বাধীনতা সংগ্রামে জেল খেটেছেন, এমন নাম খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলীরাম হেড়গেওয়ার জেলে গেছেন কংগ্রেসি কার্যকর্তা হিসেবে। আর এস এস প্রতিষ্ঠার পরে নিজে যাননি, অন্যদেরও নিরুৎসাহিত করেছেন। অথচ কংগ্রেস এবং কম্যুনিস্ট পার্টিতে অনেক নাম, এমনকি সেলুলার জেল খেটেছেন তাদের মধ্যেও।
দুই, গান্ধীজির নরম হিন্দুত্বের জায়গায় এক এক্সক্লুসিভ আক্রামক হিন্দুত্বের তাত্ত্বিক প্রবক্তা উনি। এবং মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি জনিত প্যারানইয়ার রূপকার।
কিন্তু আজ এই তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত। গত ১৫ আগস্টে প্রধানমন্ত্রী জনসংখ্যা বিস্ফোটের আশঙ্কার কথা বলেছেন বটে, কিন্তু এটা ভিত্তিহীন। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ কোথাও হচ্ছে না, ভারতেও না, অন্য কোথাও নয়। সরকারী তথ্য অনুযায়ী ভারতের গড় প্রজনন রেশিও সূচক (অর্থাৎ, একটি সমাজে, রাজ্যে বা দেশে প্রজনন- ক্ষম বয়সে একজন নারী গড়ে কজনের জন্ম দিচ্ছে) ২.৩। এটা ২.২ হলেই বর্তমান জনসংখ্যা স্থির হয়ে যাবে। গড়ে এক বছরে যতজনের জন্ম হবে বা যতজনের মৃত্যু হবে তা প্রায় সমান সমান হয়ে কাটাকুটি হয়ে যাবে। মজার ব্যাপার এই রেশিও মুস্লিম প্রধান কাশ্মীরে মাত্র ১.৬ এবং এই বঙ্গেও তাই। অথচ হিন্দুপ্রধান গুজরাত এবং উত্তর প্রদেশে ক্রমশঃ ২.৬ এবং ৩। মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির দর হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির চেয়ে দ্রুতহারে কমছে।


উনি কট্টর মুসলিম বিরোধী কিনা?

আগেই বলেছি ওঁর ‘হিন্দু ভারত’ শুধু তাদের স্বীকার করে যারা ভারতে জন্মেছে (পিতৃভু) এবং যাদের ধার্মিক ও সাংস্কৃতিক শেকড় ভারতে; তাই হিন্দু-শিখ-বৌদ্ধ-জৈন স্বীকার্য, অন্যেরা নয়। মুসলমানেরা বহিরাগত, তায় ওদের পুণ্যভূমি মক্কায়। যারা এদেশে জন্মেছে তারা প্রথম শর্ত ‘পিতৃভু’ পাশ করলেও দ্বিতীয় শর্ত ‘পুণ্যভূ’ পাশ করবে কি করে !

(বর্তমান সরকারের প্রস্তাবিত বিলে ২০১২ থেকে অন্য দেশ থেকে আগত হিন্দু-শিখ-বৌদ্ধ-জৈন রিফিউজিদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে)।

বেয়াল্লিশের আন্দোলনের সময় কংগ্রেসি নেতা ও কর্মীরা জেলে। তখন হিন্দু মহাসভার কর্মীরা শ্যামাপ্রসাদ এবং সাভারকরের নেতৃত্বে বেশ কিছু এসেম্বলি ও অন্য সিভিক বডিতে ইলেকশন জেতে। কিন্তু কংগ্রেসের সবাই জেল থেকে ছাড়া পেলে ১৯৪৫-৪৬ এর সেন্ট্রাল এসেম্বলি এবং প্রাদেশিক নির্বাচনে সাভারকরের কংগ্রেসকে পরাজিত করার আহ্বান ব্যর্থ হয়। নভেম্বর ১৯৪৫ এর সেন্ট্রাল এসেম্বলিতে মহাসভা একটাও সিট পেল না। দেখা গেল রামরাজ্য এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা বলা কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলনের নেতা গান্ধীজিকেই বৃহত্তর হিন্দুসমাজ অবিসংবাদিত নেতা মেনেছে।
স্বাধীন ভারতে গান্ধীহত্যার কলংক লাগায় জনমানস থেকে মহাসভা এবং সাভারকর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। ফলে উনি আরও উগ্র আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলেন। এইসময়ে লেখা বিভিন্ন চিঠিপত্র এবং প্রবন্ধ তার সাক্ষী। 'সিক্স গ্লোরিয়াস ইপোক্স অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি' বলে ওঁর বইটি পড়লে দেখা যাবে এমন এক অতীতমুখী মন যার চেতনা শুধু অতীতের হিন্দু-মুসলিম বাইনারিতে আবদ্ধ হয়ে হিন্দুর কথিত বিক্রমগাথায় সান্ত্বনা খোঁজে। শুধু তাই নয়, এই মানস একটি প্যারানইয়া--- শিগগিরই মুসলিমরা ভারতে মেজরিটি জনগোষ্ঠী হয়ে উঠবে --- থেকে আত্মসমর্পণকারী বন্দী মুসলিমদের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হত্যা তথা 'টু পে ইন দেয়ার ওন কয়েন' নীতিতে মুসলিম মেয়েদের ধর্ষণকে উচিৎ বা কর্তব্য বলে ওকালত করে।


ব্যক্তিগত আচার আচরণে উনি কতটা হিন্দু ছিলেন ?

আজ যে 'হিন্দুত্ব' রাজনীতির প্রাবল্য, সেই রাজনীতির জনক বিনায়ক সাভারকর।

১৯২৩ এ রত্নগিরির জেলে বসে তিনি ইংরেজিতে লিখেছিলেন 'এসেনশিলাস অব হিন্দুত্ব'। সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক'রা মনে করেন গান্ধীর পলিটিক্যাল ডিসকোর্সের সেটা ছিল কাউন্টার আর্গুমেন্ট। ইন্টারেস্টিংলি সাভারকরের 'হিন্দুত্ব' রাজনীতির সঙ্গে সনাতন হিন্দুধর্ম বা ধর্মীয় গোঁড়ামোর সম্পর্ক নেই। তাঁর কাছে 'হিন্দুত্ব' ছিল একটা জাতির সাংস্কৃতিক অস্মিতা।

ব্যক্তিগত জীবনে বিনায়ক সাভারকর ছিলেন নাস্তিক এবং সংস্কারমুক্ত। হিন্দু ধর্মের সংস্কার, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও জাতপাতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। বর্ণাশ্রম ও ধর্মীয় সংস্কার যে হিন্দুধর্মকে বিভক্ত করে দিয়েছে এবং অনেক ক্ষতি করেছে, তা বারবার বলেছেন। রত্নগিরিতে থাকবার সময় তিনি দলিতদের জন্যে পতিতপাবন মন্দিরের দ্বার খুলে দেন এবং ছোঁয়াছুঁয়ি ও নানারকম সংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। তাঁর উপস্থিতিতে বেশ কিছু অসবর্ণ বিবাহও হয়।

সাভারকর মাসাহারী ছিলেন। মাছ খেতে খুব ভালবাসতেন। খাবার নিয়ে বাড়াবাড়ি ওঁর পছন্দ নয়। এসব হিন্দুদের দুর্বল করেছে বলে ওঁর ধারণা।
উনি জাতিব্যবস্থার কড়া সমালোচনা করেও বলেন যে, মুসলিম আমলে নিজেদের রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার খাতিরে এই ব্যবস্থা বেশি আঁটোসাটো হয়েছে, আজ দরকার নেই ।

উনি গরুকে মাতা বলতে নারাজ। বলেন একটি চারপেয়ে পশু আমার মাতা নয়, বরং বাছুরের মাতা। তবে গরু খুব উপকারী জন্তু, তাই তার পালন জরুরি।
অসুস্থ সাভারকর ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ তারিখে ৮৩ বছর বয়সে মারা যান। পীড়ায় অস্থির হয়ে স্বেচ্ছামৃত্যু কামনা করেছিলেন, কিন্তু আইনে বাধে। তাই ধীরে ধীরে খাওয়াদাওয়া এমনকি জল পর্য্যন্ত ছেড়ে দিলেন।
তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তাঁর মরদেহ কোনও চিতায় তোলা হয়নি, মন্ত্রোচ্চারণ করা হয়নি, বিনা আড়ম্বরে ইনসিনারেটরে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। বাড়ির কাছে কাকেদেরও কিছু আহার বা পিণ্ড দেওয়া হলো না। ভদ্রলোকের কাছে হিন্দু ধর্ম ব্যক্তিগত আচরণ না হয়ে রাজনৈতিক স্তরেই সীমাবদ্ধ রইল।


উপসংহার

সাভারকর বনাম ভগত সিং, জিন্না এবং গান্ধীজি
=============================

ভগত সিং যদিও সাভারকরের সিপাহী বিদ্রোহের উপর লেখা বইটি পড়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু শীগগিরই তিনি মার্ক্সবাদী সাহিত্যে প্রভাবিত হয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের জন্যে লড়াইয়ের কথা বলতে থাকেন। তাঁর কল্পনার ভারতে শ্রমিক-কৃষক ছিল, হিন্দু-মুসলিম একে অন্যের 'অপর ' হিসেবে দেখা দেয়নি ।
ব্যক্তিহত্যার জায়গায় গণান্দোলনে বিশ্বাসী ভগত সিং স্যান্ডার্স হত্যায় অভিযুক্ত ছিলেন কিন্তু অ্যাসেম্বলিতে সাধারণ (লো-ইনটেনসিটি) বোমা ফাটিয়ে লিফলেট ছড়িয়ে দিয়েছিলেন শুধু প্রচারের উদ্দেশ্যে।
১৯১৯-২০ নাগাদ ব্যারিস্টার জিন্না ছিলেন নরমপন্থী স্বরাজী। উনি খিলাফত আন্দোলনে গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের সমর্থনের বিরোধিতা করে বলেছিলেন যে, এর ফলে ভারতবাসীকে দুটো সম্প্রদায়ে ভাগ করে দেওয়া হবে। সংখ্যাগুরু গান্ধীর সমর্থকরা জিন্নাকে সমালোচনা করল। উনি রাওলাট অ্যাক্টের বিরোধিতায় গান্ধীকে সমর্থন করে আদালতে তাঁর পক্ষে মামলা লড়েছিলেন। ১৯২৯ শে নাগপুর কংগ্রেসে উনি গান্ধীজিকে মিঃ গান্ধী বলে সম্বোধন করায় লোকে প্যাঁক দিয়ে ওঁকে তাড়াল। তারপর উনি মুসলিম লিগে যোগ দিলেন।
জিন্না সম্ভবতঃ ১৯৩৭-৩৯ এ দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা প্রচার করেছিলেন। কিন্তু সাভারকর তার প্রায় দু'দশক আগেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, হিন্দু এবং মুসলমান দুটো আলাদা জাতি। তারা এক রাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারে না। এর ভিত্তিতে জিন্না আলাদা করে মুসলিমবহুল অঞ্চল নিয়ে আলাদা রাষ্ট্রের দাবিতে আন্দোলনে নামলেন। আর সাভারকরের স্পষ্ট মত, হিন্দুস্তানে মুসলমানদের মাথা তুলতে বা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রপরিচালনার পদে থাকতে দেওয়া উচিত হবে না। দুজনের মধ্যে দুটো মিল। দুজনেই ব্যক্তিগত আচার আচরণে ধার্মিক নন, কিন্তু দুজনেই ‘এক জাতি, এক রাষ্ট্র’ তত্ত্বে বিশ্বাসী। এঁদের রাষ্ট্র কল্পনায় অন্য ধর্মের মানুষ সমান অধিকার পাবে না ।

গান্ধীজি নিষ্ঠাবান ধার্মিক হিন্দু, রাজনৈতিক হিন্দু নন। উনি সমস্ত ধর্মের মানুষদের সমান নাগরিক অধিকারে বিশ্বাসী। মাইনরিটিকে রক্ষা করা, বিশেষ মর্যাদা দেওয়া উনি কর্তব্য মনে করেন। এদিকে উনি কট্টর শাকাহারী, প্রাকৃতিক চিকিৎসা এবং কৃষিভিত্তিক সমবায়িক অর্থনীতির পক্ষে। উনি শ্রেণীসংগ্রামের বিরুদ্ধে। ধনীদের গরীবদের জন্য ট্রাস্টি হতে বলেন। অধিকার আদায়ের প্রশ্নে অহিংস পন্থা, অসহযোগ এবং সবিনয় অবজ্ঞা আন্দোলনে বিশ্বাসী।উনি গোমাতার পূজায় বিশ্বাসী।
সাভারকর গান্ধীজির সঙ্গে সংঘর্ষে এলেন খিলাফত আন্দোলন এবং ধার্মিক ইলেক্টোরেটে গান্ধীজির অবস্থান দেখে। ভারতের স্বাধীনতার সময় উনি প্রবন্ধ লিখে (২৫/০৯/ ১৯৪৭) গান্ধীর মতো ছদ্ম-জাতীয়তাবাদী নেতাদের নাম করে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবার আহবান জানালেন।

সাভারকর মনে করতেন পুঁজিবাদী শিল্পই ভারতের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ, গান্ধীর গ্রামীণ সংস্কার নয়। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এখন অনেকেই মনে করেন স্বাধীনোত্তর ভারত গান্ধীর নয়, সাভারকরের পথেই চলেছে।

=================

বইয়ের তালিকা 
১ সাভারকর--হিন্দুত্ব,
২ সাভারকর----সিক্স গ্লোরিয়াস ইপোক্স অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি ।
৩ সাভারকর-- অ্যান ইকো ফ্রম আন্দামান।
৪ সাভারকর-- হোয়ার্লউইন্ড প্রোপাগান্ডা।
৫ সাভারকর-ঃ দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব--- ভি পুরন্দরে।
৬ সিডিশন কমিটি রিপোর্ট, ১৯১৮।
৭ গান্ধী বিফোর ইন্ডিয়া-- রামচন্দ্র গুহ
৮ বীর সাভারকর-- ধনঞ্জয় কীর।
৯ নেহরু, সিলেক্টেড ওয়ার্কস, ভলুম -৩।
১০ হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়-- লাইফ এন্ড মাইসেলফ, ভল্যুম ১
১১ উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যো -- নির্বাসিতের আত্মকথা।
১২ বারীন ঘোষ -- দ্য টেল অফ মাই এগজাইল।
১৩ আর সি মজুমদার-- হিস্ট্রি অফ দ্য ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া, ভল্যুম-৩
১৪ মালগাঁওকর-- মেন হু কিল্ড গান্ধী।
১৫ গুরুজী গোলওয়ালকর ---- উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড
১৬ গুরুজী গোলওয়ালকর--- এ বাঞ্চ অফ থটস। 
১৭ ইন্ডিয়াজ স্ট্রাগল ফর ইন্ডিপেন্ডেন্স --বিপান চন্দ্র এন্ড আদার্স।

1 comments:

1

প্রবন্ধ - অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in

ছোটোবেলায়, মানে আশির দশকের শেষ ভাগে এক ধরনের দেয়াল ক্যালেন্ডার বিক্রি হতো দেখতাম। আমাদের বাড়িতেও একটা ছিল।ক্যালেন্ডারটির ঠিক মাঝখান ছিল সিংহাসনে উপবিষ্ট ঘন নীল রঙের যমরাজ এবং সিংহাসনের নীচে চিত্রগুপ্ত, যিনি বিশাল সাইজের একটা খাতা খুলে বসে দেখে নিচ্ছেন কোন্ মানুষ কী পাপ করেছে কী পুণ্য করেছে। সেই ক্যালেন্ডারে উপর, নীচ, ডান ও বামদিকে ছিল প্রায় চোদ্দটি উলঙ্গ নরনারীর ছবি। তাঁদের জহ্লাদরা অপরাধভেদে নিষ্ঠুরভাবে শাস্তি দিচ্ছেন। যেমন পরকীয়া শাস্তি দুদিকে দাঁতবিশিষ্ট দাঁড় করানো করাতে দু-দিকে নর ও নারীর শরীরের মাঝবরাবর চিরে দেওয়া হচ্ছে বা মিথ্যা কথা বলার অপরাধে বিশাল একটা সাঁড়াশি দিয়ে কারোর জিভ টেনে ছিঁড়ে দেওয়া হচ্ছে বা চুরি করার অপরাধে কারোর ডান হাত দেওয়া হচ্ছে ভয়ংকর এক চাপাতি দিয়ে ইত্যাদি। এইসব ক্যালেন্ডার এখন আর চোখে পড়ে না। 

এখন কথা হলো, এই শাস্তিটা কোথায় হয়? নরকে, আরবি ভাষায় ইসলামীদের কাছে যা দোজখ বা জাহান্নম। নরকের ঠিকানা কী? এই ঠিকানা কেউ জানে না। কোনও ধর্মগ্রন্থেও সেই ভয়াল ভয়ংকর ঠিকানার সন্ধান পাওয়া যায় না। যেহেতু মানুষের মৃত্যুর পর পাপীরা শাস্তি ভোগ করে, সেহেতু কোনো মানুষের পক্ষেই ঠিকানা জানা সম্ভব হয়নি। তবে হিন্দুশাস্ত্র মতে নরক মৃত্যুদেবতা যমরাজেরই বাসস্থান। বলা হয়েছে এটি মহাবিশ্বের দক্ষিণে এবং পৃথিবীর নীচে অবস্থিত। বিষ্ণু পুরাণে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নরক মহাবিশ্বের নীচে অবস্থিত মহাজাগতিক সাগরের নীচে অবস্থিত। দেবীভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে যে, নরক মহাবিশ্বের দক্ষিণে, পৃথিবীর নিচে কিন্তু পাতালের উপরে অবস্থিত। ভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে নরক পৃথিবীর নীচে। পাতালের সাতটি স্তর এবং মহাবিশ্বের তল গর্ভোদক সাগরের মাঝামাঝি অবস্থিত। এটি মহাবিশ্বের দক্ষিণে অবস্থিত। পিতৃলোক, যেখানে অগ্নিকুভের নেতৃত্বে মৃত পূর্বপুরুষ (পিতৃগণ) বাস করে, এই অঞ্চলে অবস্থিত। নরকরাজ যম তাঁর সহকারীদের সঙ্গে বসবাস করেন। বিভিন্ন হিন্দু মহাকাব্যও একমত যে, নরক দক্ষিণদিকে অবস্থিত। পিতৃলোককে যমের রাজধানী হিসাবে ভাবা হয়েছে।

মানুষের মৃত্যুর পর যমদূত নামক যমরাজের দূতেরা তাঁদেরকে যমরাজের রাজসভায় নিয়ে আসে। যেখানে তাদের পাপ-পুণ্যের হিসাব করা হয় এবং দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। পুণ্যবানদের স্বর্গে এবং পাপীদের যে-কোনো একটি নরকে পাঠানো হয়, যেখানে যম তাঁর ন্যায়বিচার প্রদান করেন।

নরক হলো জনৈক অসুর। পৌরাণিক কাহিনিতে নরকাসুর নামে অভিহিত হয়ে থাকে। হিন্দুধর্মের একাধিক ধর্মগ্রন্থ। তাই বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্ন নামের ও সংখ্যার পাশাপাশি কোন্ প্রকারের পাপীকে কোন্ নরকে পাঠানো হবে তার ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। অগ্নি পুরাণে মাত্র ৪টি নরকের উল্লেখ আছে। মনুস্মৃতি ২১ প্রকার নরকের উল্লেখ করে। তবে ভাগবত পুরাণ, দেবী- ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ এবং গরুড় পুরাণ গ্রন্থগুলিতে ২৮ ধরনের ভয়ংকর নরকের কথা বলে। তাই এই ২৮ নরককেই মূল নরক হিসাবে গণ্য করা হয়। অপরাধভেদে নরকগুলোর নাম হলো – 

(১) তামিস্র (অন্ধকার), (২) অন্ধতামিস্র (অন্ধত্বের অন্ধকার), (৩) রৌরব (রুরু নামক হিংস্র জন্তুর নরক), (৪) মহারৌরব (অতি হিংস্র), (৫) কুম্ভিপাক (পাত্রে ঝলসানো), (৬) কালসূত্র (সময়ের ধাগা বা মৃত্যু), (৭) অসিপত্রবন/অসিপত্রকানন (যে বনের পাতাগুলি তলোয়ারের মতো), (৮) শুকরমুখা (শুয়োরের মুখে), (৯) অন্ধকূপ (অন্ধকারময় কুয়ো, যার মুখটি লুকানো), (১০) কৃমিভোজন/কৃমিভক্ষণ (কৃমিদের আহার্য হওয়া), (১১) সন্দংশন/সন্দম্স (চিমটার নরক), (১২) তপ্তসুর্মি/তপ্তমূর্তি (তপ্ত লাল লৌহ মূর্তি), (১৩) বজ্রকণ্টকশাল্মলী (সুতির মতো মলিন বৃক্ষ, যা ধারণ করে বজ্রের মতো কাঁটা), (১৪) বৈতরণী (অতিক্রম), (১৫) পূয়োদা (পুঁজ মিশ্রিত জল), (১৬) প্রাণরোধা (জীবনের রোধ), (১৭) বিশসনা (হত্যাপ্রবণ), (১৮) লালাভক্ষ্য (লালা খাদ্য রূপে), (১৯) সারমেয়দান (সরমার হিংস্র পুত্রদের নরক), (২০) অভিশ্চি/অভিশ্চিমত (প্রবাহহীন, জলহীন), (২১) অয়হপান (লৌহ-পান), (২২) ক্ষারকর্দম (আম্লিক, লবণাক্ত কাদা), (২৩) রক্ষোগণভোজন (রাক্ষসদের খাদ্যে পরিণত), (২৪) শূলপ্রোত (তীক্ষ্ণ শূল বা বাণে বিদ্ধ), (২৫) দণ্ডসুক (সর্প), (২৬) অবাত-নিরোধনা (গহ্বরে আবদ্ধ), (২৭) পরয়াবর্তন (ফিরে যাওয়া), (২৮) সূচিমুখা (সূচবিদ্ধ মুখমণ্ডল)

এই ২৮ নরককেই মূল নরক হিসাবে গণ্য করা হয় হিন্দু শাস্ত্রে। এই প্রধান নরকগুলি ছাড়াও বিভিন্ন গ্রন্থে সহস্রাধিক অন্যান্য নরকের কথাও স্বীকার করা হয়েছে। নরকের শাস্তিগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শুধু মানুষদেরই শাস্তির কথা বলা হয়েছে। পৃথিবীতে মানুষ ছাড়াও যে কোটি কোটি প্রাণী বসবাস করে, তাদের কারোর শাস্তির ব্যবস্থা নেই। হয় সেইসব প্রাণীদের কথা শাস্তিদাতারা জানতেন না, নয়তো তাদের শাস্তির বিধান রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি। দুটো ধারণাই সঠিক। প্রথমত, ধর্মগ্রন্থগুলিতে গুটিকয়েক প্রাণীদেরই উল্লেখ পাওয়া যায়। ইসলামীয় ধর্মগ্রন্থগুলিতে যে প্রাণীদের কথা জানা যায়, সেই প্রাণীগুলি হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলিতে পাওয়া যায় না। অনুরূপ অন্য ধর্মগ্রন্থগুলিতেও সেইসব প্রাণীগুলি সম্বন্ধে জানা যায় না। কারণ ধর্মগ্রন্থগুলি অঞ্চলভিত্তিক। তাই কতিপয় প্রাণীর যা উল্লেখ আছে, তাও অঞ্চলভিত্তিক। দ্বিতীয়ত, মানুষ ছাড়া অন্য মানবেতর প্রাণীদের ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শোষণ করা সম্ভব নয়, যেটা মানুষের ক্ষেত্রে সম্ভব। আর শাস্তির যে বর্ণনাগুলি দেওয়া হয়েছে, সেগুলিও বড্ড বোকা বোকা। গঞ্জিকা সেবন না করে এই ধরনের যুক্তিহীন বর্ণনা করা সম্ভব নয়। চার্বাক বা অন্যান্য নাস্তিকবাদীরা স্বর্গ-নরকের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে, দেহ ভস্ম হলে স্বর্গ-নরকভোগ অসম্ভব।

যিনি এত স্বর্গ-নরকে এত কাণ্ডকারখানা করেন, সেই নরকরাজা যমের পরিচয় কী? যম হলো মৃত্যুর প্রতিশব্দ। হিন্দুদের তেত্রিশ দেবতাদের মধ্যে একমাত্র যমকেই প্রত্যক্ষ করতে পারে মানুষ। যদিও মৃত্যু হলো জৈব-রাসায়নিক বিক্রিয়ার পরিসমাপ্তি। তারপর আর কিছুই নেই। যে পাঞ্চভৌতিক উপাদানে প্রাণের সৃষ্টি, তার বিনিঃশেষ মিশ্রণ ঘটে গেছে পার্থিব ভৌত উপকরণ। 

এ তো গেল বিজ্ঞান। কিন্তু বিশ্বাস যে যমের মূর্তি গড়ে তুলেছে! পশু প্রবৃত্তির মানুষই সমাজ-শৃঙ্খলা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যই পশুত্বের সংযমকে নির্দেশিত ও নিয়ন্ত্রিত করার জন্য একটি ‘সমাজ-শাসন কমিশন’ তৈরি করে নিয়েছে, যার মহাপরিচালক হলেন যম। অর্থাৎ, মানুষ নিজেরাই নিজেদের বিচারশালা তৈরি করেছে। ঋগ্বেদে ‘যম’ শব্দটি প্রায় ৫০ বার উল্লেখ আছে। ইনি দেবতাদের সঙ্গে একত্রে বসে সোমরস পান করলেও কোথাও দেবতা হিসাবে স্বীকৃত নন। ইনি মৃতদের পাপপুণ্যের বিচারক। পুরাণগুলিতেও যমের কথা উল্লেখ আছে। প্রসঙ্গত বলি, ঋগ্বেদের যম আর পুরাণের যম এক নয়। সভ্যতার বিবর্তনের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছে যম নামক ধারণা, সেইসঙ্গে গড়ে উঠেছে নরক ও শাস্তির কল্পিত পুরাকথা। ঋগ্বেদে আমরা যম ও যমী নামের যমজ ভাইবোনের কবিতাকারে কাহিনি পাই। যম-যমী বৃত্তান্ত বেদে বিবৃত হলেও এর উৎস ইন্দো-ইরানীয় ভাষায় মিথ বা লোকপুরাণে যিম ও যিমেহর (Yima and Yimeh) কাহিনিতে। সেখানে যিম ছিল স্বর্ণযুগের চন্দ্রদেবতা। পরে আবেস্তা এবং বেদের আমলে যথাক্রমে পৃথিবীর রাজা এবং ভূস্বর্গের অধিপতি বলে পরিচিত হল ইন্দো-ইরানীয় যিম এবং বৈদিক যম। ইন্দো-ইরানীয় লোকপুরাণে যিম এবং যিমেহ যমজ ভাইবোন। বেদের যম ও যমী বাবা ও মা গন্ধর্ব এবং জলের অপ্সরা অপ্যাযোষা। নরসিংহপুরাণের ১৩ অধ্যায়ে ব্যাস বলেছেন, বিবস্বতের পুত্র আর তাঁর অনুজা যমী। তাঁদের মা অদিতি। যমীর ভাষায় – “যম একমাত্র মরণশীল মানুষ”। ঋগ্বেদের এক মন্ত্রে (১০.১৩.৪) বলা হয়েছে – যম মরণ বরণ করে দেহত্যাগ করেছে। অথর্ব বেদের মন্ত্রেও (১৮.৩.১৩) বলা হয়েছে – “যমই প্রথম মর্ত্যবাসী, যাঁর মৃত্যু হয়েছিল”। এ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, যম বেদের সময়ে মৃত্যুর দেবতা হয়ে ওঠেননি। তাঁকে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে ভারতীয় লোকপুরাণে প্রথম ‘মানুষ’ হিসাবে। 

মহাভারত ও পুরাণে মৃত্যুর দেবতা যম ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, রক্তবসন পরিহিত এবং মহিষারূঢ় রূপে বর্ণিত। হিন্দুর ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে যম অশুভ দেবতা। কারণ মৃতব্যক্তিকে তিনি কেবল নরকেই আহ্বান করেন, স্বর্গে নয়। পিতৃলোকের আনন্দপূর্ণ বাসস্থানেও যম অবস্থান করে না। তাঁর একমাত্র কর্মস্থল নরক, যেখানে পাপীদের চরম শাস্তি প্রদান করা হয়। তিনি যেমন মৃত্যুর দেবতা, তেমনই আবার মৃত্যুর অন্ধকারাচ্ছন্নও ভয়াবহ দক্ষিণদিকেরও দিকপাল। ঋগবেদে যমের প্রশংসা করে বলা হয়েছে – “যিনি কী পুণ্যবান কী পাপী সকলেরই গন্তব্য মার্গের পরম সহায়, যিনি বিবস্বানের প্রশংসনীয় পুত্র। যিনি পক্ষপাতহীন হৃদয়ে কর্মফল অনুসারে জীবগণ এ-লোক হইতে লোকান্তরে যাইবার উপযুক্ত শরীর দান করিয়া থাকেন, যিনি প্রাণধারী জীবমাত্রেরই রাজা বলিয়া বিখ্যাত সেই যম নামক দেবতাকে হবিঃ প্রদান দ্বারা পূজা করো।” (দশম মণ্ডল) তবে যম কেবল ভারতে তথা হিন্দুদের বিশ্বাসেই আছে, তা কিন্তু নয়। যমদেবতাকে ‘যমরাজ’ বলেও সম্ভাষণ করা হয়। কৃষ্ণের অষ্টোত্তর নামের মতো যমেরও অনেক নাম। কয়েকটা নাম এখানে উল্লেখ করি। যেমন – কালান্তক, অন্তক, কৃতান্ত, শমন, সংযম, দণ্ডধর, কাল ইত্যাদি। বিভিন্ন দেশে বা সভ্যতায় বিভিন্ন নামে পাওয়া যায়। যেমন – মিশরের মৃত্যুদেবতা সেকের এবং মিশরীয় মৃত্যুলোক বারোটি প্রদেশে বিভক্ত, কেলটীয় সংস্কৃতিতে যমদেবতা হলেন বেলি এবং যমলোকের নাম অ্যানয়্যফন, উত্তর ইউরোপের যমদেবী হেল, প্রাচীন গ্রিসের মৃত্যুদেবতা হলেন হেদিস, মায়া সভ্যতায় মৃত্যুদেবতার নাম ড্রেসডেনকোডেক্সে ‘A’, আজটেক পুরাণে মৃত্যুদেবতার নাম মিকটল্যান, প্রাচীন সভ্যতা ইনকাদের প্রেতলোকের অধিষ্ঠাতার নাম সুপেঈ ইত্যাদি।

ফিরে আসি আমাদের সেই কষ্টকল্পিত নরকে। “কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর।” মানুষ পার্থিব জগতের বাইরেও মৃত্যুর পরে এক নতুন জগৎ কল্পনা করে, যা স্বর্গ ও নরকের সমন্বয়ে গঠিত। ধর্মীয় চিন্তা থেকে মানুষ পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়ের হিসাব করে থাকে। আর এই অনুভূতি থেকেই স্বর্গ ও নরক লাভের কথা ভাবে। মৃত্যুর পরে স্বয়ং যম, অথবা যমদূতেরা এসে পরলোকে নিয়ে যান মৃত ব্যক্তির আত্মাকে। জীবদ্দশায় সেই ব্যক্তির কৃতকর্মের উপর ভিত্তি করে মৃত্যুর পরে তাঁর স্থান নরকে হবে, নাকি স্বর্গে তা স্থির করেন যমরাজ। 

মৃত্যুর আগেই যমরাজ মানুষকে চারটি চিঠি পাঠান, যেগুলোতে নিহিত থাকে ব্যক্তির আসন্ন মৃত্যুর লক্ষণ। পুরাণের সেই যম-অমৃতের কাহিনি বলছে -- একদা যমুনা তীরবর্তী একটি গ্রামে থাকতেন অমৃত নামের এক ঈশ্বরভক্ত মানুষ। তিনি ছিলেন মৃত্যুভয়ে ভীত। তাঁর পরিকল্পনা ছিল, যমকে খুশি করে তিনি অমর হবেন। যমকে সন্তুষ্ট করার জন্য কঠোর তপস্যা শুরু করেন তিনি। যম তাঁর তপস্যায় খুশি হয়ে দেখা দিলেন অমৃতকে। যম বললেন -- ‘‘শোনো, জীবদ্দশায় আমার দেখা কেউ পায় না। তুমি পেয়েছ। বলো, কী চাও?’’ অমৃত বললেন, ‘‘ঠাকুর, আমি অমর হতে চাই।’’ যম বললেন, ‘‘মৃত্যু থেকে কারও মুক্তি নেই। যে জন্মেছে তাকে মরতে হবেই। তবে তোমার ইচ্ছার কথা মাথায় রেখে আমি তোমাকে একটি প্রতিশ্রুতি দিলাম। তোমার মৃত্যু যে আসন্ন তা বোঝাতে তোমাকে চারটি চিঠি আমি পাঠাব। সেই চিঠিগুলি পাওয়ার পর তুমি নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করো।’’ অমৃত নিশ্চিন্ত হয়ে ধর্মকর্ম সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে বিলাসব্যসনে মত্ত জীবনযাপন শুরু করলেন। তাঁর কোনও চিন্তাই রইল না মৃত্যু নিয়ে। তিনি নিশ্চিন্ত রইলেন যে, মৃত্যুর আগাম ইঙ্গিত যমরাজের কাছ থেকে তিনি নিশ্চয়ই পাবেন। বয়স বাড়তে থাকল তাঁর। একসময় তাঁর মাথার চুল পেকে গেল। আরও পরে দাঁত পড়ে গেল তাঁর। তারপর চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসা শুরু হলো। একসময় বয়সের ভারে একেবারে নিশ্চল হয়ে গেলেন তিনি। তখনও তাঁর কাছে যমরাজের চিঠি এসে পৌঁছল না কোনও। নিশ্চিন্ত হয়ে দিনযাপন করতে লাগলেন অমৃত। কিন্তু একদিন রাত্রে হঠাৎ যমদূত এসে হাজির হলো অমৃতের সামনে। তিনি বুঝলেন, তাঁর মৃত্যুর সময় হয়ে গিয়েছে। যমদূতের সঙ্গে তিনি চললেন পরলোকে। মনে তখন যমরাজের প্রতি একরাশ ক্ষোভ তাঁর। যমরাজ তাঁকে কথা দিয়েছিলেন, মৃত্যুর আগে চারটি চিঠি পাঠাবেন তাঁকে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটি চিঠিও পাঠাননি। যমরাজের সামনে উপনীত হওয়ার পর তিনি উগরে দিলেন তাঁর ক্ষোভ — ‘‘আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন, মৃত্যুর আগে চারটি চিঠি পাঠাবেন। কিন্তু আপনি তা করেননি। কথা রাখেননি আপনি।’’ যমরাজ হেসে বললেন, ‘‘তুমি কি ভেবেছিলে, আমি কাগজের উপরে নিজে হাতে চিঠি লিখে তোমাকে পাঠাব? মূর্খ তুমি। শোনো, তোমার শরীরই ছিল আমার কাগজ, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তোমার শারীরিক পরিবর্তনগুলো ছিল আমার কলম, আর সময় ছিল আমার বার্তাবাহক। আমি তোমাকে আমার কথামতো চারটি চিঠিই পাঠিয়েছিলাম। তোমার চুল পেকে যাওয়ার ঘটনা ছিল আমার প্রথম চিঠি। তোমার দাঁত পড়ে যাওয়ার ঘটনা আমার দ্বিতীয় চিঠি। যখন তোমার দৃষ্টিশক্তি কমে আসা শুরু হলো, তখন তুমি পেলে আমার তৃতীয় চিঠি। আর চতুর্থ চিঠিটি তুমি পেয়েছিলে, যখন তুমি পঙ্গু হয়ে গেলে। কিন্তু তোমার দুর্ভাগ্য, তুমি আমার পাঠানো একটি চিঠিরও পাঠোদ্ধার করতে পারোনি।’’

শুধু হিন্দুধর্মেই নয়, নরকের ব্যবস্থা সব ধর্মেই বলা হয়েছে। নরকে কঠিন শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে বাইবেলেও। বাইবের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বাইবেল পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। বাইবেল অনুসারে, স্বর্গের মতো নরকও একটি বাস্তব বিষয়। বাইবেল সম্পূর্ণভাবে ও সুস্পষ্টভাবে শিক্ষা দেয় যে, নরক হচ্ছে একটি বাস্তব বা অকৃত্রিম জায়গা, যেখানে খারাপ বা অবিশ্বাসীদের মৃত্যুর পরে পাঠানো হবে। আমরা সকলেই ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পাপ করেছি (রোমীয় ৩:২৩ পদ)। এই পাপের একমাত্র শাস্তি হলো মৃত্যু (রোমীয় ৬:২৩ পদ)। যেহেতু চূড়ান্তভাবে আমাদের সমস্ত পাপ ঈশ্বরের বিরুদ্ধে (গীতসংহিতা ৫১:৪ পদ) এবং যেহেতু ঈশ্বর হলেন অসীম ও অনন্ত, সেহেতু তাঁর বিরুদ্ধে করা পাপের শাস্তিও হবে অসীম ও অনন্ত। নরক হল এই অসীম এবং অনন্ত মৃত্যু, যা আমরা আমাদের পাপের কারণে পেয়ে থাকি।

খারাপ বা মন্দ লোকদের জন্য নির্ধারিত একমাত্র শাস্তি যে নরক-মৃত্যু সেটিকে বাইবেলের সমস্ত অংশ জুড়ে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে – ‘অনন্ত আগুন’ (মথি ২৫ : ৪১ পদ), ‘অনির্বাণ আগুন’ (মথি ৩ : ১২ পদ), ‘লজ্জা ও অনন্ত ঘৃণা’ (দানিয়েল ১২ : ২ পদ)। নরক এমন একটি স্থান যেখানে ‘আগুন কখনও নিভানো যায় না’ (মার্ক ৯ : ৪৪-৪৯ পদ), ‘যন্ত্রণা এবং অগ্নিশিখা’ (লুক ১৬ : ২৩-২৪ পদ)-র একটি স্থান, ‘অনন্তকালস্থায়ী বিনাশ’ (থিষলনীকীয় ১ : ৯ পদ), এমন একটি স্থান যেখানে ‘যাতনার ধূম যুগপর্যায়ের যুগে যুগে ওঠে’ (প্রকাশিত বাক্য ১৪ : ১০-১১ পদ) এবং ‘অগ্নি ও গন্ধকের হ্রদ’ যেখানে দুষ্ট লোকেরা ‘চিরকাল ধরে দিনরাত যন্ত্রণা ভোগ করবে’ (প্রকাশিত বাক্য ২০ : ১০ পদ)।

পাপীদের আত্মা শেষ বিচারের দণ্ডের জন্য প্রস্তুত হয় এবং শেষে একদিন তাদের বিচার হয়৷ বিচারের দিন পবিত্র আত্মা জিশুখ্রিস্ট স্বর্গ থেকে মর্ত্যে অবতরণ করবেন। স্বর্গীয় বেশে সুসজ্জিত হয়ে এবং স্বর্গীয় দূত ও পরিষদবর্গের দ্বারা পরিবৃত হয়ে একপর্যায়ে তিনি বিচারাসনে উপবিষ্ট হবেন৷ সেদিন মৃতগণ কবর থেকে উত্থিত হবে বিচারের সম্মূখীন হতে হবে৷ বিচারে দণ্ডপ্রাপ্ত পাপীগণ চিরপ্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হবে। খ্রিস্ট মতে, বিচারকর্তা স্বয়ং ঈশ্বর নয়, জিশুই হবেন শেষ বিচারের বিচারকর্তা। 

ইহুদি ধর্মেও নরকের উল্লেখ আছে। ইহুদিদের জুডাইজম ধর্মমতেও খ্রিস্টধর্মের মতো মানুষের মৃত্যুর পর বিচারের একটি শেষদিন নির্দিষ্ট করা আছে৷ সেই দিন মৃতদের আত্মার পুনরুত্থান ঘটবে এবং তাদের জীবিতকালের পাপ-পূণ্যের বিচার করা হবে৷ ইহুদিদের আত্মাকে একটি নির্দিষ্ট সেতু পার হতে হবে এবং তুলাদণ্ডে পরিমাপ করে তার পাপ-পূণ্যের বিচার৷ সেতু অতিক্রমে ব্যর্থরা নিচের নরক নদীতে পতিত হবে এবং শাস্তি ভোগ করবে। তবে ইহুদিদের মতে মানুষের পাপ-পুণ্যের পরিমান দুটি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ থাকে এবং তা তুলাদণ্ডের দুদিকে স্থাপন করে প্রতিজনের পাপ-পুণ্যের পরিমাণ নির্ধারণ করে যে দিকে পাল্লা ভারি হবে, সেঈ অনুযায়ী পাপীদের শাস্তি ব্যবস্থা হবে। ভোগ করতে হবে নরক-যন্ত্রণা, অনন্তকাল৷ ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ ইসাইয়া, এজিকিল, ডেনিয়েল ও যব ইত্যাদিতেও মৃত্যুর পরে পুনরুত্থানের বিষয়ের উল্লেখ আছে৷ 

চিন দেশেও কনফুসিয়াস বা অন্যান্য ধর্মমতেও নরকের কথা বলা হয়েছে। চিনের ধর্মমতানুসারে ন্যায়-অন্যায় ও পাপ-পূণ্যের বিচারের ব্যাপার, পুরস্কারের ও শাস্তির কথাসহ অনেক কিছুর উল্লেখ ছিল। ‘সু কিং’ নামক গ্রন্থটি চিনদেশের প্রাচীন গ্রন্থ বলে পরিচিত, যা কনফুসিয়াস সংকলন করেন৷ সেই গ্রন্থে মৃত্যুর পরে স্বর্গ-নরকের ব্যাপারে সুষ্পষ্ট কোনও কিছুর উল্লেখ নেই৷ তবে কনফুসিয়াস এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যেখানে বর্তমান জীবনের বিষয়েই আমরা অবগত নই, তাই মৃত্যুর পরে কী হবে, তা কে বলতে পারবে’? তাঁর দর্শনানুসারে দেহাংশ পঞ্চভূত, পঞ্চভূতে মিশে যাবে এবং অশরীরী আত্মা সংসারে অদৃশ্য আকারে উপস্থিত থেকে আপন সংসার ও জগতের মঙ্গল সাধন করতে থাকবে। মানে মানুষের শারীরিক মৃত্যু হবে, তবে তার আত্মার মৃত্যু নেই, তাই কনফুসিয়াস প্রলয়ান্তে পুনরায় সৃষ্টি বা পরলোক বিষয়ে কোনও স্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে যাননি তার প্রবর্তিত ধর্মে৷

কনফুসিয়ান ধর্মের মতো বৌদ্ধধর্মও অনুরূপ স্বর্গ-নরকের কোনো ধারণা আমরা পাচ্ছি না। বৌদ্ধ ধর্মমতে পৃথিবীর কোনও সৃষ্টিকর্তা নেই৷ অতএব কোনও অনস্তিত্ব কর্তৃক শাস্তি-পুরস্কারের দায়িত্বভার অর্পণ হয়নি। তাই নেই স্বর্গের আরাম, নেই নরকের যন্ত্রণা। বৌদ্ধমতে জগত অনন্তকাল থেকে বিদ্যমান আছে এবং অনন্তকাল এভাবেই থাকবে৷ বৌদ্ধধর্ম অনুসারে বিশ্বের আকৃতি চিরকালই এক রূপ আছে এবং আগামীতেও একই রূপে থাকবে৷ কর্ম অনুসারে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী সংসারে ঘুরে বেড়াচ্ছে মাত্র৷ বৌদ্ধ ধর্মে স্বর্গ, নরক, দেবদূত, ফেরেসতা, নবি বা পয়গম্বর, শয়তান, ইবলিস এবং শেষ বিচার, শেষের সে দিন -- কোনও বিষয়ই উল্লেখ নেই। তবে বুদ্ধ পরকাল সম্বন্ধে অনেক কিছুই বলে গেছেন। বলেছেন -- পরকাল নির্ভর করে মানুষের ইহজন্মের কর্মের উপর। মৃত্যুর পর মানুষ ৩১ লোকভুমির যে-কোনও একটিতে গমন করে। এই ৩১ লোকভুমি হল চার প্রকার অপায় : তীর্যক (পশু-পাখি কুল), প্রেতলোক (প্রেত-পেত্নী), অসুর (অনাচারী দেবকুল), নরক (নিরয়)। সাত প্রকার স্বর্গ : মনুষ্যলোক, চতুর্মহারাজিক স্বর্গ, তাবতিংশ স্বর্গ, যাম স্বর্গ, তুষিত স্বর্গ, নির্মাণরতি স্বর্গ, পরনির্মিত বসবতি স্বর্গ। রূপব্রহ্মভূমি ষোলো প্রকার, অরূপব্রহ্মভূমি চার প্রকার। যেমন -- (১) আকাশানন্তায়তন, (২) বিজ্ঞানান্তায়ন, (৩) আকিষ্ণনায়তন, (৪) নৈবসংজ্ঞা-না-সংজ্ঞায়তন = মোট ৩১ প্রকার। এই ৩১ প্রকার লোকভুমির উপরে সর্বশেষ স্তর হচ্ছে নির্বাণ (পরম মুক্তি ) যেমন -- ইহজন্মে মানুষ যদি মাতৃহত্যা, পিতৃহত্যা, গুরুজনের রক্তপাত ঘটায় তাহলে মৃত্যুর পর সেই মানুষ চার অপায়ে ( তীর্যক, প্রেতলোক, অসুর, নরক) জন্মগ্রহণ করে, আর ইহজন্মে মানুষ যদি ভালো কাজ করে তাহলে মৃত্যুর পর সেই মানুষ বাকি ২৭ লোকভুমিতে গমন করে। নরক বলতে লোকন্তরিক নরক। তিন চক্রবাল পর্বতের মধ্যস্থলে ত্রিকোণাকৃতি ৬৮ হাজার যোজন বিস্তৃত নরককে লোকন্তরিক নরক বলে। এই নরক ঘন অন্ধকারে আবৃত। নিম্নদেশ তীব্র ক্ষার জলে পূর্ণ। এই নরকে উপর আচ্ছাদনহীন এবং তলদেশ বর্জিত। সুতরাং এর উপরে এবং এর নীচে পৃথিবীর সন্ধারক শীতলতর তীব্র ক্ষারজল। এই নরকে সূর্যালোক না-থাকাতে নারকীয় প্রাণীদের চক্ষু নেই। তাদের হাতে-পায়ে সুতীক্ষ্ণ নখ আছে। নখ দিয়ে প্রাণী সকল চক্রবাল পৃষ্ঠে বাদুরের ন্যায় অবস্থান করে। নখ দিয়ে একে অপরকে আক্রমণ করে। যারা আনন্তরিক কর্ম করে, তারা এই নরক ভোগী হয়ে থাকেন।

প্রাচীন ইরানীয় ধর্মমতে, ঋষি বা ধর্মগুরু জরাথুস্ট্র ‘জেন্দ আবেস্তা’ নামক গ্রন্থটি পেয়েছিলেন ইরানীয় দেবতা অহুর মাজদার কাছ থেকে। ইরানীয় দেবতা অহুর মজদা একেবারে নিরাকার ব্রহ্ম ছিলেন না, তকে ব্যক্তিসত্তার অধিকারী এক স্বর্গবাসী দেবতা মনে করা হত৷ জেন্দ আবেস্তা অনুসারে মানুষের মৃত্যুর পর জীবিতকালের পাপ ও পূণ্যের দণ্ড ও পুরস্কারের বিধান ছিল৷ তবে তার আগে প্রথমে মৃতের দেহকে এক দানব অধিকার করে নেবে, আর আত্মাকে বিভিন্ন পরীক্ষার পরে এক পর্যায়ে এসে আত্মার মাঝে জ্ঞানের সঞ্চার হবে, তখন আত্মাকে ‘চিন্দভাদ’ নামক এক পুল (ব্রিজ) পার হতে হবে৷ পুণ্যবানরা সেই পুল পার হয়ে গিয়ে দেবতার কাছে পৌঁছে যাবে। আর যারা পুল পার হতে ব্যর্থ হবে, তারা পাপী। অর্থাৎ যে জীবিতকালে পাপ কার্য করেছে, সে নরককুণ্ডে পতিত হয়ে অনন্তকালের শাস্তি ভোগ করতে থাকবে৷ তবে উপাসনা দ্বারা এবং স্বর্গ লাভপ্রাপ্ত বন্ধু-বান্ধবের মধ্যস্থতায় কারও কারও নরকভোগের সময় হ্রাসপ্রাপ্তের বিধানেরও ছিল৷ 

প্রাচীন মিশরীয়রা প্যাপিরাস বা সমাধিগাত্রে মৃত ব্যক্তিদের জীবন সংক্রান্ত বিভিন্ন কথা লিখে রাখার প্রচলন ছিল৷ পরে একসময় সেই সব লেখা সংকলন করে ‘আমদুয়াত গ্রন্থ’, ‘ফটকের গ্রন্থ’ এবং ‘মৃতের গ্রন্থ’ নামে তিনটি গ্রন্থ রচিত হয়৷ মৃতের গ্রন্থের বর্ণনায় দেখা যায় যে, প্রত্যেক মৃতকে পরমেশ্বরের কাছে একটা শপথ বা এফিডেভিট দিয়ে জীবিত কালে তার পাপ পূণ্য কাজের হিসেব দিতে হবে৷ পরে ঐ সত্যপাঠের সত্য মিথ্যা যাচাই করবেন জ্ঞানের দেবতা ‘থৎ’ এবং ‘হোরাস’ ৷ মৃতের হৃৎপিণ্ড দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা হবে ৷ বিচারের বর্ণনায় দেখা যায় যে, দুইটি দ্বার দিয়ে স্বর্গ ও নরককুণ্ডে প্রবেশ করতে হবে৷ পাপাত্মাদের নরককুণ্ডে পাঠিয়ে পিলারের সঙ্গে বেঁধে জ্বলন্ত আগুনে পোড়ানো বা গভীর সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হবে৷

স্বর্গে যেমন ধার্মিকদের পরম সুখভোগ যেমন কখনই শেষ হবে না, তেমনি পাপী মানুষদের জন্য শাস্তিস্বরূপ অনন্ত নরক যন্ত্রণাও কখনও শেষ হবে না। জিশু নিজেই ওই নরক-যন্ত্রণা ভোগের শাস্তিকে যেভাবে বর্ণনা করেছেন -- স্বর্গে ঈশ্বরভক্ত লোকেরা যেমন অনন্ত জীবন ভোগ করবে, ঠিক একইভাবে পাপী মানুষরাও নরকে অনন্ত শাস্তি ভোগ করবে (মথি ২৫:৪৬ পদ)। পাপী মানুষরা চিরকালই ঈশ্বরের প্রচণ্ড ক্রোধ এবং রোষের পাত্র হিসাবেই বিবেচিত। নরকে নিক্ষিপ্ত ওই পাপী লোকেরা ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের কথা স্বীকার করবে (গীতসংহিতা ৭৬:১০ পদ)। যাদের নরকে নিক্ষিপ্ত করা হবে, তারা জানবে যে, তাদের কাজের ফলস্বরূপ এই শাস্তি পাওয়াটা সঠিক, তাই তাদের দোষী করে এখানে নিক্ষেপ করা হয়েছে (দ্বিতীয় বিবরণ ৩৫:৩-৫ পদ)। অবশ্য কারণ জিশুর মধ্য দিয়ে আমরা এই অনন্ত ভাগ্য বা নিয়তি অর্থাৎ অনন্ত নরক-যন্ত্রণা ভোগ করা থেকে রক্ষা পেতে পারি (যোহন ৩:১৬, ১৮, ৩৬ পদ)।

হিন্দুধর্মে যেটা নরক, ইসলাম ধর্মে সেটাই জাহান্নাম বা দোজখ। জাহান্নাম সেই আগুনের বাসস্থানকে বলে, যেখানে রেখে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাঁর অবাধ্যদের শাস্তি দেবেন। ফারসি ভাষায় যাকে ‘দোজখ’ বলা হয়। নবি বললেন, “একদা জান্নাত ও জাহান্নামের বিবাদ হলো। জাহান্নাম বলল, “আমার মধ্যে উদ্ধত ও অহংকারী লোকেরা থাকবে।”আর জান্নাত বলল, “দুর্বল ও দরিদ্র ব্যক্তিরা আমার ভিতরে বসবাস করবে।” অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদের মধ্যে ফায়সালা করলেন যে. “তুমি জান্নাত আমার রহমত, তোমার দ্বারা আমি যার প্রতি ইচ্ছা অনুগ্রহ করব। আর তুমি জাহান্নাম আমার শাস্তি, তোমার দ্বারা আমি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেব। আর তোমাদের উভয়কেই পরিপূর্ণ করা আমার দায়িত্ব” 

ইসলাম ধর্মে জান্নাত একটি, সেই জান্নাতের দরজা আটখানি (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৯৫৭)। আটটি জান্নাতের নাম হলো –(১) জান্নাতুল ফেরদাউস (২) দারুসসালাম (৩) দারুল খোলাদ (৪) দারুল মোকাত (৫) জান্নাতুল মাওয়া (৬) জান্নাতুন নায়ীম (৭) জান্নাতের আদন (৮) দারুল আকার। জাহান্নামও একটি, যার দরজা সাতখানি (হিজর ১৫/৪৩)। সাতটি জাহান্নামের নাম হলো – (১) জাহান্নাম (২) লাজা (৩) হুত্বামাহ (৪) সাঈর (৫) সাক্বার (৬) জাহিম (৭) হাবিয়াহ। দোজখের প্রথম স্তরে থাকবে গোনারগার মুসলিমরা, দ্বিতীয় স্তরে ইহুদিরা, তৃতীয় স্তরে খ্রিস্টানরা, চতুর্থ স্তরে সাবায়ীরা, পঞ্চম স্তরে মজুসি বা অগ্নিপূজকরা, ষষ্ঠ স্তরে পৌত্তলিকরা এবং সর্বনিম্ন সপ্তম স্তরে থাকবে মুনাফিকরা। কী আছে এই স্তরগুলিতে? দোজখের শাস্তিগুলি কতটা যন্ত্রণাদায়ক তার উপর ভিত্তি করেই স্তরবিন্যাস। অর্থাৎ প্রথম স্তরে তুলনামূলক কম যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে ধাপে ধাপে যন্ত্রণা বৃদ্ধি করা হয়েছে যথাক্রমে সপ্তম স্তর পর্যন্ত। গোনাহগারী মুসলমান হলে আল্লাহ তাদের জন্য তুলনামূলক কম যন্ত্রণাদায়ক দোজখ নির্দিষ্ট করেছেন। কিন্তু অমুসলিম বা বিধর্মীদের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কঠিনতম যন্ত্রণাদায়ক দোজখ। তবে নির্দিষ্টভাবে কোনও স্তরের নাম কোরান বা হাদিসে বর্ণিত হয়নি। তবে অন্যভাবে তো উল্লেখ আছেই। যেমন ‘জাহান্নাম’ শব্দটি কোরানে ৭৭টি স্থানে উল্লেখ আছে। জাহান্নামের এই স্তরবিন্যাসগুলি কোরান-হাদিসে উল্লেখ না-থাকলেও যিনি এগুলি করেছেন, তিনি যে কতটা দুষ্টবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি, তা স্তরবিন্যাসের ধরন দেখলেই অনুধাবন হয়। অর্থাৎ এই ধরনের স্তরবিন্যাসই প্রমাণ করে অমুসলিম বা বিধর্মী হলে তার শাস্তি হবে কঠিন থেকে কঠিনতম। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে বা মুসলমান হয়ে গেলে তার শাস্তি লঘু হয়ে যাবে। এটা হলো এক ধরনের প্যান-ইসলামিক চক্রান্ত।

দোজখ বা জাহান্নামে ফেরেস্তাদের সংখ্যা ১৯, যাঁরা জাহান্নামের তত্ত্বাবধানে আছেন। জাহান্নামের আয়তন কত? বিশাল, সবটাই অগ্নিকুণ্ড। জাহান্নামের আগুনের রং হলুদ বা লাল নয়, কুচকুচে কালো। জাহান্নামবাসীদের গায়ের রংও বীভৎস কৃষ্ণকায় হবে। জিন ও মানুষ মিলিয়ে অগণিত কোটি সংখ্যক জাহান্নামে স্থান পাবে।আবার কোনো কোনো জাহান্নামির দেহ এত বিরাট হবে যে, তার দাঁতটাই হবে উহুদ পাহাড়ের সমান। দুই কাঁধের ব্যবধান হবে তিনদিনের পথ। উহুদ পাহাড়ের দৈর্ঘ্য প্রায় ৭ কিলোমিটার, প্রস্থ প্রায় ২ থেকে ৩ কিলোমিটার এবং উচ্চতা ৩৫০ মিটার। জাহান্নামের দরজা সাতটি। সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীদের জাহান্নামের দিকে দলে দলে নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর জাহান্নামে ঢুকিয়ে দিয়ে সমস্ত দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। সেখান থেকে বাইরে বেরনোর কোনো পথই থাকবে না। জাহান্নামের ইন্ধন হবে এক শ্রেণির মানুষ ও এক শ্রেণির পাথর।

জাহান্নামের আগুন কত গরম ও জ্বালাময় হবে, সে কথা কোরানের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ আছে। অপরাধের পাল্লা যার বেশি হবে, তার স্থান হবে হাবিয়াহ জাহান্নামে।যাদের বাঁ হাতে আমলনামা দেওয়া হবে, তারা থাকবে অতি গরম বায়ু ও উত্তপ্ত জলে। যারা কিয়ামতকে মিথ্যা মনে করে, তাদের জন্য “আমি জ্বলন্ত জাহান্নাম প্রস্তুত রেখেছি। দূর থেকে জাহান্নাম যখন ওদের দেখবে, তখন ওরা তার ক্রুদ্ধ গর্জন ও চিৎকার শুনতে পাবে।(ফুরক্বান ১১-১২) প্রতিপালককে অস্বীকার করলেও তার স্থান হবে জাহান্নামে। তাদের জন্য জাহান্নামের শাস্তি। যখন তারা সেই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে, তখন শুনতে পাবে জাহান্নামের গর্জন, আর তা উদ্বেলিত হবে। রোষে জাহান্নাম ফেটে পড়বে। “যারা (কাফের) অবিশ্বাস করে ও আমার নিদর্শনকে মিথ্যাজ্ঞান করে, তারা জাহান্নামের অগ্নিবাসী, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। প্রত্যেক কাফের মুশরিক নাও হতে পারে। তবে প্রত্যেক মুশরিক অবশ্যই কাফের। সাধারণভাবে কুফরি এমন এক অপরাধ, যার জন্য চিরস্থায়ী জাহান্নাম ভোগ করতে হবে। কুফরি মানে অস্বীকার, অবিশ্বাস -- আল্লাহকে অবিশ্বাস অথবা আল্লাহর কিছুকে অবিশ্বাস। কোরানে আল্লাহ বলছেন – “নিশ্চয় যারা আমার আয়াতসমূহকে অবিশ্বাস করে, তাদেরকে আমি অচিরেই আগুনে প্রবিষ্ট করব। যখনই তাদের চামড়া দগ্ধ হবে, তখনই ওর স্থলে নতুন চামড়া সৃষ্টি করব, যাতে তারা শাস্তি ভোগ করতে থাকে। (নিসা ৫৬) কপটতা বা মুনাফিকির কুফরি. আদেশ-নিষেধ অমান্য করার কুফরি ইত্যাদি। অর্থাৎ, এই বিধানের বলে ইসলামী আল্লাহ অমুসলমানদেরও জাহান্নামে পাঠানোর অনধিকার প্রবেশ করে ফেলেছেন। কারণ অমুসলমানরা আল্লাহ বা আল্লাহর যা কিছু অবিশ্বাস করে, কুফরি। তবে ইসলাম দাবি করেছে, জাহান্নামে অধিকাংশ বাসিন্দাই নারী। নবি বলছেন, “আমি বেহেস্তের মধ্যে তাকিয়ে দেখলাম অধিকাংশ বাসিন্দাই গরিব। আর জাহান্নামের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার অধিকাংশই নারী। (বুখারি ও মুসলিম) অপরাধ কুফরি। ইসলাম এটাও দাবি করেছে যে, জান্নাতের তুলনায় জাহান্নামে কয়েকশো গুণ বেশি জাহান্নামি বাসিন্দা থাকে। তার কারণ বেশিরভাগ মানুষের কাছে ইসলাম পৌঁছায়নি। বরং বেশিরভাগ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেনি। যেহেতু যে মানুষের কাছে ইসলামের কথা মহান আল্লাহ তাদের শাস্তি দেবেন না। অর্থাৎ শাস্তি না-হলেও জাহান্নামবাসী হতেই হবে অমুসলিমদের।সেই কারণেই বোধহয় মুসলমানরা সারা পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে উৎসুক, যাতে অমুসলমানরা আল্লাহ ও ইসলাম গ্রহণ করে জান্নাতের ঠিকানা পৌঁছে যেতে পারে !

জাহান্নামে পাপীদের লেলিহান আগুনে শুধু দগ্ধ করাই হয় না, তাদের জন্য খাদ্য-আবাস-শয়নাগারের ব্যবস্থাও আছে।তবে সবই অতি নিকৃষ্ট মানের। খাদ্য বলতে যাক্কুম বৃক্ষ। এই বৃক্ষ জাহান্নামের তলদেশ উদগত হয়। এর মোচা শয়তানের মাথার মতো। এর সঙ্গে ফুটন্ত জলের মিশ্রণ। গলিত তামার তা পেটের মধ্যে ফুটতে থাকবে। যাক্কুম বৃক্ষের ফল খুবই দুর্গন্ধময়, ভয়ানক তিক্ত স্বাদের। জাহান্নামবাসীদের এই ফলও খেতে হবে।(স্বা-ফফাত ৬২-৬৮) যারি নামে একটি কণ্টকময় বিষাক্ত গুল্মও খেতে দেওয়া হয়। এই খাদ্য শরীরকে পুষ্টও করে না, ক্ষুধাও নিবারণ করে না।(গাশিয়াহ ৬-৭) এমনকি এমন খাদ্যও খাওয়ানো হয়, যা গলায় আটকে যাবে এবং যন্ত্রণাদায়ক হবে।(মুযযাম্মিল ১২-১৩) খাওয়ানো হবে গিসলিন নামে এক ধরনের ক্ষতনিঃসৃত রস, পুঁজ।(হা-ক্বাহ ৩৫-৩৭) যারা আল্লাহর কালাম বিক্রি করে খায়, তাদেরকে আগুনের অঙ্গার খাওয়ানো হবে।(বাক্বারাহ ১৭৪) পান করানো হবে হামিম নামে ফুটন্ত জল, যা পান করলে জাহান্নামিদের নাড়িভুঁড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। (ওয়াক্বিআহ ৫৪-৫৫) গাসসাক নামে আর-এক ধরনের পানীয়ও পান করানো হবে, যা অতিশয় দুর্গন্ধময় তিক্ত অথবা অতিশয় শীতল ইত্যাদি।জাহান্নামে জাহান্নামিদের নগ্ন বা উলঙ্গ করে রাখা হয় না, তাদেরও পোশাক পরানো হয়। সেই পোশাক হবে আলকাতরার অথবা গলিত পিতলের এবং আগুনের।“সেদিন তুমি অপরাধীদের দেখবে শিকল দ্বারা বাঁধা অবস্থায়। তাদের জামা হবে আলকাতরার (বা গলিত পিতলের) এবং অগ্নি আচ্ছন্ন করবে তাদের মুখমণ্ডল।”(ইব্রাহিম ৪৯-৫০)

পাপী বা গোনাহগার বেঈমানদের সমুচিত শাস্তি দেওয়ার জন্য আল্লাহ যে কঠিন আজাবের স্থান নির্দিষ্ট করে রেখেছেন সেটাই দোজখ। এটা অতিশয় কষ্টের স্থান এবং বিভিন্ন বিভীষিকাময় জিনিসে পরিপূর্ণ। সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ বলতে সেখানে কিছুই নেই। দোজখ আল্লাহপাকে গজবের আগুনে প্রজ্জ্বলিত। যারা আল্লাহর নাফরমানি করে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হয়ে (তওবা না করে)_ মরে যাবে, তারা আখেরাতে অনন্তকাল দোজখের কঠোর শাস্তি ভোগ করবে। কোরান ও হাদিস শরিফে দোজখ সমন্ধে যেরকম বিবরণ পাওয়া যায়, তা শুনিলে শরীর শিহরিয়া উঠতে হয়। দোজখের সমান্যতম আগুন পৃথিবীতে এনে সাত সমুদ্রের জলে ৭০ বার ধুয়ে তার উহার উত্তাপ পৃথিবীর আগুনের তুলনায় সহস্রগুণ বেশি থাকবে। দুনিয়ার সমস্ত কাঠ একত্র করে প্রজ্জ্বলিত করলে যে পরিমাণ উত্তাপ সৃষ্টি হবে, দোজখের আগুনের উত্তাপ তা থেকেও সহস্রগুণ বেশি হবে ।

আল্লাহ কোরান মজিদে নির্দেশ দিয়েছেন – “পাপীদিগকে বলা হইবে, তোমরা এখন দোজখের আগুনের স্বাদ গ্রহণ করো। অর্থাৎ, আল্লাহ ও রাসুলের কথায় বিশ্বাস করো নাই, কোরান ও হাদিসকে মিথ্যা জানিয়াছিলে, দোজখের আজাবকে তখন মিথ্যা জানিয়াছিলে, এখন তাহার শাস্তি ভোগ করো; দেখো কে তোমাদিগকে সাহায্য করিতে আসে।

হজরত নবি করিম বলেছেন -- দোজখীদের জকুম নামক এক প্রকার বৃক্ষের ফল আহার করতে দেওয়া হবে । এটা এত তিক্ত যে, যদি তার এক টুকরো পৃথিবীর জলে ফেলে দেওয়া হয়, তবে পৃথিবীর সমস্ত জল তিক্ত হয়ে যাবে। একসময়ে হজরত জিব্রাইল যখন হজরত নবি করিমের কাছে এলেন, তখন তাহার চেহারা অত্যন্ত খারাপ দেখাচ্ছিল। হজরত নবি করিম তার কারণ জিজ্ঞাসা করায় জিব্রাইল বললেন -- দোজখের অগ্নিভয়ে আমার অন্তঃকরণ থরথর করে কাঁপছে। হজরত নবি করিম বললেন -- দোজখীদের যে কাপড় পরানো করানো হবে, তার এক ইঞ্চি পরিমাণ যদি দুনিয়ার এক প্রান্তে লটকে দেওয়া হয়, তবে তার দুর্গন্ধে দুনিয়ার সমস্ত প্রাণীর মৃত্যু হবে। আর দোজখীদের যে জিঞ্জির দিয়ে বাঁধা হবে, তার একতলা পরিমাণ যদি পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতের উপর স্থাপন করা যায়, তবে পর্বত ভষ্ম হয়ে সপ্তস্তর জমি ভেদ করে দোজখের জিঞ্জির দোজখে গিয়া পৌঁছবে।দোজখীদের গরম জল ও দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ পান করতে দেওয়া হবে, যাতে তাদের নাড়ি-ভুড়ি সব খসে পড়ে। আর তাদের শরীর দুর্গন্ধে ভরে যাবে। প্রতিদিন তাদেরকে ৭০ বার করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হবে, যতবার পোড়ানো হবে ততবারই সেই মূহুর্তেই আবার পুর্বের মতো শরীর হয়ে যাবে। আল্লাহ বলছেন –“সেখানে তাহারা মরিবেও না, বাঁচিবেও না।’ সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়াল জন্য তারা আল্লাহর কাছে এবং শাস্তি প্রদানকারী ফেরেশতাদের কাছে অনেক কাকুতিমিনতি করবে। কিন্তু কেউই তাদের কথায় কর্ণপাত করবে না; বরং আল্লাহ তাদেরকে বলবেন -- হে গোনাহগারগণ! তোমরা দোজখের স্বাদ গ্রহণ করো, দোজখের শাস্তি ভোগ করিতে থাক। আমি তোমাদের আজাব শুধু বর্ধিতই করিব। দুনিয়াতে আমার কথা শুনো নাই, কোরান হাদিস মানো নাই, আজ তাহার ফল ভোগ করো।”

দোজখের উত্তাপে অস্থির হয়ে বৃষ্টি প্রার্থনা করলে আকাশে কালো মেঘ দেখা দেবে এবং সেখান থেকে অসংখ্য সাপ ও বিছে দোজখীদের দেহে পতিত হতে থাকবে। ওই সমস্ত সাপ বিছে একবার দংশন করলে হাজার বছর পর্যন্ত তার যন্ত্রণা থাকবে, অনবরতই এসব প্রাণীরা তাদেরকে দংশন করতে থাকবে।দোজখের সাতটি স্তর। এর একটির নীচে অপরটি অবস্থিত। যে স্তর যত বেশি নীচে তার উত্তাপ ও শাস্তির পরিমাণ তত বেশি। একটি থেকে অপরটির উত্তাপ ৭০ গুণ বেশি।

মৃত্যু কী? মৃত্যু (Death) বলতে জীবনের সমাপ্তি বোঝায়। জীববিজ্ঞানের ভাষায় প্রাণ আছে এমন কোনো জৈব পদার্থের (বা জীবের) জীবনের সমাপ্তিকে মৃত্যু বলে। অন্য কথায়, মৃত্যু হচ্ছে এমন একটি অবস্থা যখন সকল শারিরীক কর্মকাণ্ড যেমন শ্বসন, খাদ্যগ্রহণ, পরিচলন, ইত্যাদি থেমে যায়। কোনও জীবের মৃত্যু হলে তাকে মৃত বলা হয়। মৃত্যু বিভিন্ন স্তরে ঘটে থাকে। সোমাটিক মৃত্যু হল সামগ্রিকভাবে কোনও জীবের মৃত্যু। নির্দিষ্ট অঙ্গ, কোশ বা কোশাংশের মৃত্যুর আগেই এটি ঘটে। এতে হৃৎস্পন্দন, শ্বসন, চলন, নড়াচড়া, প্রতিবর্ত ক্রিয়া ও মস্তিষ্কের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। সোমাটিক মৃত্যু ঠিক কখন ঘটে তা নির্ণয় করা দুরূহ, কেন-না কোমা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, এবং ঘোর বা ট্রান্সের মধ্যে থাকা ব্যক্তিও একই ধরনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে থাকেন। সোমাটিক মৃত্যুর পর অনেকগুলি পরিবর্তন ঘটে যা থেকে মৃত্যুর সময় ও কারণ নির্ণয় করা যায়। মারা যাওয়ার পরপরই পার্শ্ববর্তী পরিবেশের প্রভাবে দেহ ঠান্ডা হয়ে যায়, যাকে বলে Algor mortis। মারা যাওয়ার পাঁচ থেকে দশ ঘণ্টা পরে কংকালের পেশিগুলি শক্ত হয়ে যায়, যাকে বলে Rigor mortis এবং এটি তিন-চার দিন পরে শেষ হয়ে যায়। রেখে দেওয়া দেহের নীচের অংশে যে লাল-নীল রং দেখা যায়, তাকে বলে Livor mortis; রক্ত জমা হওয়ার কারণে এমন হয়। মৃত্যুর খানিক বাদেই রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে। আর তারপরে দেহের যে পচন শুরু হয়, তার জন্য দায়ী এনজাইম ও ব্যাক্টেরিয়া। দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিভিন্ন হারে মারা যায়। সোমাটিক মৃত্যুর ৫ মিনিটের মধ্যেই মস্তিষ্কের কোশগুলির মৃত্যু ঘটে। অন্যদিকে হৃৎপিণ্ডের কোশগুলি ১৫ মিনিট এবং বৃক্কেরগুলি প্রায় ৩০ মিনিট বেঁচে থাকতে পারে। 

মৃত্যুর পরে শরীরে ধীরে ধীরে পচন ধরতে শুরু করে-- এ কথা সবাই জানেন। কিন্তু মৃত্যুর পর মুহূর্ত থেকে পচন ধরা পর্যন্ত কী কী শারীরিক পরিবর্তন হয় বা কোন্ কোন্ পথ ধরে শরীর পচতে শুরু করে, তা কি জানা আছে? চিকিৎসাশাস্ত্র মতে মৃত ঘোষণার অর্থ এই নয় যে, শরীরের প্রতিটি কোশের মৃত্যু হয়েছে। হৃদযন্ত্র পাম্প করা বন্ধ করলে, কোশগুলি অক্সিজেন পায় না। মস্তিষ্কে শেষ মুহূর্তে সক্রিয়তার ঢেউ খেলে যায়, এর পরই 'সবকিছু অন্ধকার'। অক্সিজেন পাওয়া বন্ধ হলে পেশিগুলি শিথিল হতে শুরু করে। পাশাপাশি অন্ত্র এবং মূত্রস্থলী খালি হতে শুরু হয়। শরীরের মৃত্যু ঘটলেও, অন্ত্র, ত্বক বা অন্য কোনো অংশে বসবাসকারী ১০০ ট্রিলিয়ন ব্যাক্টিরিয়া তখনও জীবিত থাকে। মৃত্যুর পর শরীরের অভ্যন্তরে যা ঘটে, সে সবের পিছনেই এই ১০০ ট্রিলিয়ন ব্যাক্টিরিয়ার যোগদান থাকে। মৃত্যুর পর সর্বপ্রথম শরীরে কোনো পরিবর্তন আসে? প্রথমেই হয় অ্যালগর মরসিট ঘরের তাপমাত্রায় না-আসা পর্যন্ত শরীরের তাপমাত্রা প্রতি ঘণ্টায় ১.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট কমতে থাকে। লিভোর মরটিস বা লিভিডিটির ক্ষেত্রে শরীরের নিম্নাংশে রক্ত এবং তরল পদার্থ জমা হয়। ব্যক্তির ত্বকের আসল রঙের ভিত্তিতে তা ধীরে ধীরে গাঢ় বেগুনি-নীল রঙে পরিবর্তিত হতে শুরু করে। রিগর মরটিস শেষে শরীরে রিগর মরটিস হয়, এ ক্ষেত্রে অত্যধিক ক্যালসিয়াম ক্ষরণের ফলে পেশিগুলি শক্ত হয়ে যায়। ২৪-৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত এই অবস্থা থাকে। রিগর মরটিসের সময় চোখ খোলা থাকলে, বেশ কিছু ক্ষণের জন্য মৃতের চোখ খোলাই থাকে। এর পর শরীরে পচন ধরতে শুরু করে। রক্ত চলাচল বন্ধ হলে কার্বন-ডাই অক্সাইডের গঠন শুরু হয়, অম্লের মাত্রা বাড়তে থাকে। এর ফলে কোশগুলিতে ভাঙন ধরে। ২-৩ দিনে শরীর পচতে থাকে। পরিপাক নালিতে থাকা ব্যাক্টেরিয়া এবং আণুবীক্ষণিক প্রাণীরা শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় তলপেট সবুজ বর্ণ ধারণ করে এবং তাতে গ্যাস তৈরি হয়। তার চাপে শরীরের মল-মূত্র নিষ্কাশিত হয়। পিউট্রেসিন এবং ক্যাডাভেরিনের মতো জৈবিক যৌগ শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়লে, দুর্গন্ধ বের হতে শুরু করে। এই গন্ধই মৃতদেহের অন্যতম বৈশিষ্ট। নেক্রোসিস পদ্ধতিতে এরপর শরীরের রং সবজেটে থেকে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে। মৃতদেহের দুর্গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ভিড় জমায় উচ্ছিষ্টভোগী পোকামাকড়। মৃত শরীরকে খাদ্যভাণ্ডার হিসাবে ব্যবহার করা ছাড়াও, এই সমস্ত পরজীবী কীট সেখানে ডিমও পাড়ে। ডিম ফুটে বেরোনো শূককীট মাত্র এক সপ্তাহে শরীরের ৬০ শতাংশ নিকেশ করতে পারে।

সে স্বর্গ হোক কিংবা নরক, জান্নাত বা বেহেস্ত হোক কিংবা দোজখ বা জাহান্নাম – এ সবই মানুষের মৃত্যু-পরবর্তী অধ্যায়। বিচার-টিচার যা হবে তা সবই মৃত্যুর পর, তা সে জন্মেই মরুক কিংবা ১০০ বছর বেঁচেই মরুক। এ থেকে এটা প্রমাণ হয়, জীবদ্দশায় মানুষের নরক বা স্বর্গদর্শন কিছুতেই হচ্ছে না। বাস্তবে তা কিন্তু হয় না, হয়নি। যদি তাইই হতো, তাহলে জীবদ্দশায় বিভিন্ন অপরাধের জন্য শাস্তি ভোগ করার ব্যবস্থা থাকত না রাষ্ট্রে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে অপরাধীদের কী ভয়ানক শাস্তি দেওয়া হতো, সেখানে নরকের শাস্তিব্যবস্থা কিচ্ছু না। একজন অপরাধী কতবার শাস্তি হয়! অপরাধের শাস্তি হিসাবে আজীবন কারাগারবাস কি নরকবাস নয়? জীবদ্দশাতেও তাঁর ছাল-চামড়া তুলে নেওয়া নেওয়া হবে, মুণ্ডু কেটে নেওয়া হবে, পাথর ছুঁড়ে মারা হবে, গুলিবিদ্ধ করে মারা হবে – আবার নরকেও তাঁকে শাস্তি দেওয়া হবে! এটা বাস্তব, না কষ্টকল্পিত রূপকথা? নরক বা জাহান্নামের শাস্তিই যদি নির্দিষ্ট ও বাস্তব হত, তাহলে রাষ্ট্রগুলিতে আইন-বিচার-শাস্তির ব্যবস্থা থাকার প্রয়োজন হত না। তাই নরক বা জাহান্নামের শাস্তির ভয়ে মানুষ কুঁকড়ে থাকে না। কারণ মানুষ জানে অপরাধ করলে তাঁর শাস্তি পেতেই হবে। আইনের হাত অনেক লম্বা। তাই সুস্থ মানুষরা অপরাধ থাকে। নরক বা জাহান্নামের ভয়ে নয়, দেশের আইনের ভয়ে। মানুষ জানে মৃত্যুতেই জীবন শেষ, জীবন শেষ মানে অস্তিত্বও শেষ। মৃত্যুর পর আর কিছু নেই। স্বর্গ, নরক, পাপ, পুণ্য, কর্মফল, জন্মান্তরবাদ, জাতিস্মর ইত্যাদি যা আছে সবই কাল্পনিক, মনগড়া। যা আছে, তা সব এ পৃথিবীতেই আছে। পৃথিবীর বাইরে বা জীবদ্দশার বাইরে কোথাও কিছু নেই।

1 comments: