0

ধারাবাহিক - সায়ন্তন ঠাকুর

Posted in

একেক সময় হিসেব ভুল হয়ে যায় দিবাকর ওঝার। আর জন্মের স্মৃতি হয়তো আচ্ছন্ন করে রাখে তাকে। ধূলায় ভরা যে রোগা পথ জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে হঠাৎ সেদিকে চেয়ে আনমনা হয়। কোথায় যেন যাওয়ার কথা ছিল! অথচ ভুলে গেছে বেমালুম। 
বামনডিহি গাঁ এখনও অনেকটা পথ। বুড়িবালাম নদীর চর পার হয়ে বিশোই-এর হাট ছাড়িয়ে আরও সাত আট মাইল দিবাকরের বাড়ি। পুরনো ইঁটের প্রায় পোড়ো বাড়ি,দরজা জানলার পাল্লায় ঘূণপোকার বসত। সারা রাত কটকট করে কাঠের আঁশ খায় তারা। ফাঁক বেয়ে হু হু ছুটে আসে জংলা বাতাস। শেয়াল আর হায়নার ডাকে কেঁপে ওঠে ঘন রাত্রি। উঠোনে ইঁটের চলকা উঠে মাটি বেরিয়ে পড়েছে। বন তুলসী আর কালকাসুন্দার ঝোপ চারপাশে। সন্ধ্যা বাতাসে উড়ে বেড়ায় তুলসী মঞ্জরী। বাড়ি থাকলে তখন অল্প সর্ষের তেল ঢেলে প্রদীপ জ্বালায় দিবাকর। শাঁখ বাজায়। কিছুক্ষণ পর সলতে ক্ষয়ে এলে হাতের দোলায় নিভিয়ে দেয় প্রদীপ,নাহলে প্রদীপের বুক পুড়ে যাবে,ছেলেবেলায় মা বলতো। তারপর কাঠের আখায় আঁচ দেয়। জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে আনা শুকনো কাঠ জ্বালানি । আগুন উসকে উঠলে ভাত বসায়। সাতকুলে কেউ নেই,একাই থাকে সে। লেখাপড়াও আট কেলাস অবধি। বিধবা মা মরায় পেটের ধান্দায় পড়া ছেড়ে দেয়। 

আজ কাঁধের ঝোলায় আলু পেঁয়াজ লঙ্কা সর্ষের তেল। অল্প আতপ চালও কিনেছে বাংরিপোসি বাজারে। শালপাতায় মোড়া দিশি মুরগীর মাংস। দিবাকর বহুরূপী। হাটে মাঠে রূপ দেখিয়ে দু চারটে পয়সা রোজগার করে। কোথাও হাত দেখে কিছু উপরি মেলে। আজ সেজেছিল কানু। ঘন নীল রঙ এখনও মুখে লেগে আছে। লাল ঠোঁট। চোখে কাজল। চুড়ো,বাঁশি ঝোলায়। শেষ প্রহরের বিষণ্ন আলো চেপে বসেছে মুখের রঙে। তেলের আড়তদার নায়েক বাবুর নাতি হয়েছে, মেয়ের দিকের। বাড়ির উঠোনে কানুকে দেখে সেই নাতি হাত পা ছুঁড়ে হেসেছে খুব। তাই দেখে নায়েকের মেয়ে লক্ষ্মী খুশি হয়ে একশো টাকা দিয়েছে দিবাকরকে! সেই কাঁচা পয়সা দিয়েই বাজার। কী ভাগ্যি আজ কানু সেজেছিল! কোনওদিন কালী সাজে,শিব, হনুমান। একবারই সন্নিসি সেজেছিল! সেদিন একপয়সাও দেয়নি কেউ! তারপর থেকে আর ভেক নেয়না সন্নিসির।

আমার সঙ্গে দিবাকরের দেখা হয়েছিল বাংরিপোসি বনবাংলোর হাতায়। টাটকা মহুয়ার মদ আর কাঁচা ছোলা খেতে খেতে কত আঁতের কথা! দূরে ঠাকুরাণি পাহাড়ের চুড়োয় তখন শেষ চৈত্র বেলার আলো ধরেছে। একটা দড়ির খাটিয়ার ওপর বসে আছি আমি আর শুখা ধুলার ওপর বাবু হয়ে বসেছে দিবাকর। সাদা ধুতি, সারা গায়ে নীল রঙ, মাথার বাবড়ি তখনও খোলেনি, কোলের ওপর আড়বাঁশিখান শুয়ে রেখেছে। হাত দেখিয়ে জিগ্যেস করলাম, বাজাতে পারো ? সে-কথা শুনে কী হাসি তার!

দিবাকরকে আমি মিঠুন টুডুর গল্প শোনাই। অল্পবয়সী মিঠুনের মুখখানি জুড়ে কী মায়া,চোখ বন্ধ করলে এখনও যেন দেখতে পাই। আমাদের আবাসনের কালীপুজোয় এসেছিল ঢাক বাজাতে, বাড়ি ডুয়ার্সে। অল্প বয়স। চকচকে কালো রঙ। পঁচিশ কি ছাব্বিশ বছর হবে। পুজোর ক’দিন এখানেই আছে। খুব কম কথা বলে। সিঁড়ির তলায় আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে কাল রাতে শুয়েছিল। পাশে ঢাকটিও শোয়ানো। অসংখ্য মশা রক্তের লোভে ছেঁকে ধরেছে। পুজোর খাওয়া দাওয়াও শেষ। মাংসের ঝোল,কাঁচা পেঁয়াজের গন্ধ আর বড় উজ্জ্বল সাদা বাল্বের আলো জেগে আছে প্যান্ডেলে। একাকী কৃষ্ণ বর্ণের দেবী প্রতিমা দাঁড়িয়ে আছেন। গতদিনের বাসি জবা,বেলপাতা আর গাঁদা ফুলের স্তূপ তাঁর চারপাশে। কার্ত্তিক মাসের রাত কিন্তু ধোঁয়া আর মেঘে ঘোলাটে আকাশ। মৃদু স্বরে ডাকলাম। অঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। ধুলোয় ভরা মেঝে। দোতলা তিনতলা চারতলায় যারা থাকে তাদের জুতোর ধুলো। ঘুমন্ত মানুষকে ডাকতে বড় মায়া হয়। হয়তো কোনও নিবিড় স্বপ্ন দেখছে। মানুষের ডাকে নষ্ট হয়ে যায় অন্য সেই জগত।

পরদিন সকালে কথা বলেছিলাম ছেলেটার সঙ্গে। মিঠুন টুডু । কোন দূর ডুয়ার্সে চাপড়ামারি জঙ্গলের ভেতর রামসাই গ্রামে তার বাড়ি। কোর এরিয়ার ধারে দু চার ঘর মানুষের বাস। মেটে দেওয়াল। শাল গামহার শিরীষ গাছ সারবেঁধে দৃষ্টিপথ আটকে রাখে সেখানে। শ্বাস নিলে ভেসে আসে বুনো জংলা পাতার গন্ধ। সরু রাস্তা নিজের মনেই রওনা দিয়েছে আরও গভীরে। মিঠুন মা, বউকে নিয়ে থাকে। পাতা কুড়োতে গিয়ে তিনবছর আগে হাতি পিষে দিয়েছিল তার বাপকে। বলছিল আমাকে এসব গল্প। নীচু স্বরে। একটা সিগারেট দিলাম। লজ্জা মুখে নিয়ে পকেটে রেখে দিল। সদ্য বিয়ে করেছে। নতুন বউএর আদর আর তেলের গন্ধ যেন লেগে আছে তার সারা মুখে! এই পুজোর মরশুমে দুটো টাকার লোভে ঢাক বাজায়। তারপর আবার পাতা কুড়োনো,রেঞ্জারবাবু-বিট অফিসারদের লুকিয়ে কাঠ কাটা। মহাজনের লোক এসে সামান্য টাকায় সেসব কিনে নিয়ে যায়। এসবের মাঝেই অরণ্যে শীতকাল আসে। শুকনো পাতায় ছেয়ে যায় বনতলী। হলুদ রোদ্দুরে ভর করে উড়ে বেড়ায় বাতাস। বলছিল আমাকে মিঠুন। বউএর জন্য একবাক্স পাউডার আর ঠোঁটের রঙ কেনার খুব ইচ্ছে তার।

আমি স্পষ্ট দেখছিলাম আমার রুক্ষ সংসারের প্রান্তে আলো হয়ে ফুটে উঠেছে নীল আকাশ। চালসা বাজার পার হয়ে ঢাক কাঁধে বাড়ি ফিরছে মিঠুন। কত হেমন্তকাল লুটোপুটি খাচ্ছে ওর পায়ে। শাল গাছের পাতা থেকে ছুটে আসছে বাতাস। খড়ি-ওঠা ত্বক,খসখসে মাথার চুল,পুরু ঠোঁট আর থ্যাবড়া নাকের মিঠুন টুডুর সামনে সরু সুঁড়িপথ। শুকনো শালপাতা মুকুটের মতো লেগে আছে মাথায়। আরও দূরে উঁচু গাছের ডাল থেকে তাকেই অনুসরণ করে উড়ে যাচ্ছে একাকী ধণেশ। হাতিদের ডাক শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। পিঠের ব্যাগে কি আছে সেই পাউডার,ঠোঁটের রঙ ?অল্প একটু শুয়োরের মাংস কিনেছে নাকি চালসা বাজার থেকে ? সর্ষের তেল ? লঙ্কা ? কতদিন পর আজ আবার রান্না হবে মাংস। রাতে নতুন বউ আদর করবে বিছানায়। চাঁদ উঠবে ? নরম কুয়াশা ভেদ করে অরণ্য চরাচর মৃদু আলোর ওড়না দিয়ে ঢেকে দেওয়া কার্ত্তিকের নীল চাঁদ ? কে জানে!

পরে ও-দিকে ঘুরতে গিয়ে খোঁজ করে মিঠুনের বাড়িও গেছিলাম। মিঠুন টুডুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে চাপরামারির গেট পার হলেই বড় পিচের রাস্তা। সন্ধের পর অতিকায় সরীসৃপের মতো এলিয়ে পড়ে থাকে। দুপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে শাল আর ইউক্যালিপটাস। দু একটা খয়ের আর অর্জুন গাছও আছে। এ ওর গায়ে তারা নিজেদের শরীরের পাতা ঠেকিয়ে আদর করে। কষাটে সুবাস বাতাসে। তার সঙ্গে হাতির গায়ের বুনো গন্ধ মিলেমিশে মাথা ভারী হয়ে আসে। এমন কার্ত্তিকের সন্ধেয় টুপটাপ হিম খসে পড়ে যেন কোন অনন্তলোক থেকে। সঙ্গে দু চারটে শুকনো মরে যাওয়া পাতা। রাস্তার ওপর নেমে আসে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে। কোনও সাফারি জিপের আলো আর ভারী চাকা তাদের পিষে দিয়ে চলে যায়। জিপে বসে থাকে হয়তো সদ্য বিবাহিত যুবক যুবতি। যুবতির গোলাপ-সুগন্ধি-গন্ধ ছড়িয়ে যায় বাতাসে। মানুষের তৈরি করা সেই গোলাপের সুবাস তছনছ করে দেয় মুহূর্তের জন্য সবকিছু। 

মিঠুন বারবার করে সাবধান করে দিয়েছিল আমাকে আলো থাকতে থাকতে এই রাস্তা পার হয়ে যেতে। কিন্তু হেমন্তের স্বল্পায়ু বিকেল ফুরিয়ে যায় চোখের পলকেই। মিঠুন আর তার বউ কুসুম টুডু হাত নেড়ে একমুখ ঝলমলে হাসি নিয়ে বিদায় জানাচ্ছে । বনান্ত লাল হলুদ রঙে মাখামাখি। অস্ত সূর্যের আলো সাক্ষী রেখে ফিরে আসছে পাখির দল। কোটরা হরিণের অতর্কিত ডাক সূচীত করছে আসন্ন সন্ধ্যার প্রহর। আমিও ফিরছিলাম মূর্তি বাংলোয়। বিটবাবু মানব দাসের একটি পুরনো সাইকেল নিয়ে। দুপাশে হাতির ভয়। সাইকেলের কেরিয়ারে বাঁধা আছে গামছার পুঁটলি। তার ভেতর কাঁচা শালপাতায় দুপুরে রাঁধা শুয়োরের মাংস ভরে দিয়েছে যত্ন করে কুসুম টুডু। 

তার আগে সারা দুপুর জুড়ে গল্প করেছি ওদের সঙ্গে! মিঠুন আর কুসুমকে শোনালাম আমার আরেক বন্ধু কাকসার কথা।

কাকসা ওঁরাও। লাতেহার থেকে যে বড় পিচ রাস্তা কেঁচকির দিকে চলে গেল, সেটা ধরে অনেকটা এগিয়ে পাটকি পার হলেই গোটাং অরণ্য খুব কাছে চলে আসবে। রাস্তা থেকে একটু দূরেই একটা নদী ঘোড়ার ক্ষুরের মতো জঙ্গলকে ঘিরে ধরেছে। সে নদীর নাম ঔরঙ্গা। তারপর আবার সোজা হয়ে কোয়েলের দিকে রওনা দিয়েছে। টলটলে পরিস্কার জল। কার্ত্তিকের শেষ সকালে মৃদু নীল কুয়াশা জড়িয়ে ধরে তাকে। শুকনো পাতা খসে পড়ে জলস্রোতে। আপনমনে ভেসে ভেসে কোথায় যেন যায়! ওদিকেই কাকসা ওঁরাওএর ঘর। 

ঔরঙ্গার পাশে পাশে চলা সরু বনপথ ধরে হেঁটে যেতে হবে। লাওগারা ঢোকার আগে তেমাথা,আরও একটু সোজা এগোলেই দুটো প্রকাণ্ড মহুয়াগাছ ওই বনপথের দুপাশে পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে আছে। চৈত মাসে গাছের তলা ফুলে ফুলে সাদা। পা জড়িয়ে ধরবে তারা। যেন আদর করে কুরুখ ভাষায় জিজ্ঞেস করে, “নিঘাই ইন্দার নিমে হিকে ?”—কী নাম তোমার ? 
তখন প্যাস্টেল রঙ-বাক্সের সেই ছেলেবেলার ড্রয়িং খাতার নীলরঙে ছাওয়া আকাশ। নিশ্চুপ হয়ে কোনও উঁচু গাছের ডালে হয়তো বসে আছে একাকী ঈগল। ডানায় সকালের নরম আলো। ঘন দমবন্ধ শালগাছ, বাঁশের ঝোঁপ, তারই মাঝে বয়ে গেছে সরু একফালি পথ। দিনের আলো পাতার ফাঁক দিয়ে এসে পড়েছে তার ওপর। সবুজ ছায়া। যেন কোনও অতিকায় মঞ্চ। কোন অদেখা আলোকশিল্পী তৈরি করেছেন এই অপরূপ আলোর অপেরা। বয়ে যাচ্ছে বাতাস। বারবার জিজ্ঞেস করছে, “ইকইয়া কালগাদিন ?” —কোথায় যাচ্ছ তুমি ? 

আমি রাতে বাড়ি ফেরার সময় রিক্সা করি একেকদিন। কদিন আগে দেখি শক্তপোক্ত এক বুড়ো রিক্সা নিয়ে বসে আছে স্ট্যান্ডে। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয়,ধোঁয়া আর ফ্যাকাশে রাতের আকাশের নীচে তাকে দেখেই ধক্ করে ওঠে বুকের ভেতর। কে এ ? দেখি জিজ্ঞেস করছে
—যাবেন লাকি ? 
কোনওরকমে ফ্যাসফেসে গলায় বলে উঠি
—তাঁতকল যাবে ?
—আসেন।
উঠে বসি রিক্সায়। একটু এগোতেই নিজেকে আটকাতে পারি না। ফের জিজ্ঞেস করি
—তুমি তো এখানকার নও! কী নাম তোমার ?
—কাকসা। কাকসা ওঁরাও।
যাক! আশ্বস্ত হই আমি! যদিও জানি এসব ওর ছদ্মবেশ। 
—ঘর কোথায় তোমার
—লাতেহার! 
নির্বিকার স্বরে উত্তর দেয় কাকসা। 
—লাতেহার ?! ঔরঙ্গা নদী! কোথায় লাতেহারের ? কেঁচকির দিকে ?
এবার রিক্সা থামায় কাকসা। পেছনে ঘুরে তাকায়। আলো-আঁধারি মফস্বলের ক্লান্ত গলি, ছায়া ছায়া আলো, অস্পষ্ট মাধবীলতার গন্ধ, ভাঙা প্যান্ডেল। ধকধক জ্বলে ওঠে কাকসার দুটো চোখ। কী মায়া জড়ানো গলায় বলে ওঠে
—তু চিনিস ?
—চিনি তো!
—তাইলে বুল দেখি, কোনঠি আমার ঘর ?
—কেঁচকি ?
—লাই লাই, পারলি লাই, কিছু চিনিস লাই তু!
খলখল করে হেসে ওঠে কাকসা ওঁরাও। সে হাসির শব্দে মহুয়া ফুল খসে পড়ে আমার গায়ে। বুনো শালপাতার গন্ধ ভেসে আসে। এক অচেনা বাজ ডানা ঝাপটে উড়ে এসে বসে ভাঙা রিক্সার মাস্তুলে।তারপর কত গল্প আমাদের! দুই উদ্বাস্তু চিনতে পারে নিজেদের। মহুয়ার গল্প,শিকারের গল্প,নদীর গল্প! শেষ হতেই চায় না তারা। রিকশা চালিয়ে যে কটা টাকা পায় সেসব নিয়ে কাকসা বছরে দুবার ঘর যায়। পেটের দায়ে পড়ে থাকে অচেনা দেশে। নোংরা বস্তির একফালি ঘরে শুয়ে থাকে রাতে। তখন কি আমারই মতো সে স্বপ্ন দ্যাখে? আমি যেমন সেই ভাঙা দালান, ক্ষেত ভরা নবান্নর হলুদ ধান, আগাছাময় বাগান, বুড়ো জামরুলগাছ, গিরিধারীর পাটবাড়ি ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখি! তারপর আবার প্রতি সকালে অর্থের চিন্তায় শুরু হয় নতুন দিন। শেষও হয় একসময়। 

কাকসা ওঁরাও কি তেমনই প্রতি রাতে ফিরে যায় ?

ওই তো দেখা যাচ্ছে ক’টা মেটে ঘরের আভাস। মহুয়া,শাল আর বাঁশ ঝোঁপে ঘেরা। মরুডিহা গ্রাম। কাকসা ওঁরাওএর বাড়ি। উঠোনে খেলা করছে কাকসার নাতি নাতনি। একপাশে বড় অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে সেদ্ধ হচ্ছে চাল। ঘুরে বেড়াচ্ছে লাল-কালো মোরগ। বাতাসে ভাতের গন্ধ। সব জংলা কষাটে গন্ধ ভেদ করে উঠে আসছে মানুষের ক্ষুধার অন্নের ঘ্রাণ। বাড়ি ফিরছে কাকসা। অনেকদিন পর কলকাতার গায়ে লাগা এক মফস্বল থেকে সে ফিরছে নিজের জগতে। একমুখ হাসি।তামার সরু তারের মতো সাদা চুল। থ্যাবড়া নাক। টানটান বুড়ো শরীর। মাথায় খসে পড়ছে দুএকটা শুকনো শালপাতা,মহুয়াপাতা! যেন অভিবাদন! কতদিন পর আমাদের মনে পড়েছে তোমার, তুমি এসো! তোমার জন্যই তো আগলে রেখেছি সব! পাশেই কলকলে ঔরঙ্গা,যেন এক উজ্জ্বল যুবতী। কাকসা স্নান করবে তার শরীরে নেমে! কী আনন্দ চারপাশে। নরম আলোর বন্যা আজ বনপাহাড়ে।

আমি এসব বিচিত্র কাহিনী শোনাই ওদের। দিবাকরকে বলি মিঠুনের গল্প, মিঠুনের কাছে ফেঁদে বসি কাকসা ওঁরাওএর আখ্যান। আর কাকসাকে আবার শোনাই দিবাকর বহুরূপীর কিসসা!

বাংরিপোসি বনবাংলোর ওধারে লাল মস্ত চাঁদ উঠেছে। চিকচিক করছে ঠাকুরাণি পাহাড়। রূপ খুলেছে আজ রাতের। গাঢ় জোসনার বান ডেকেছে। কী একটা মিষ্টি গন্ধ আসছে কোথা থেকে। বাতাসে ভাসছে শালের কুসুম। ঝিঁঝিঁ ডেকে চলেছে অবিরল। দূরে ঘন কালচে সবুজ জঙ্গলে সাদা আলোর ছোপ। শাল গাছদের লম্বা ছায়া পড়ে আছে মাটির বুকে। মনে হয় কে যেন দাঁড়িয়ে আছে ! মাঝেমাঝে কুবকুব করে ডেকে উঠছে কোনও রাতচরা পাখি।

রাতও আরও গভীর হবে। ফিনিক ফুটবে জোসনায়। একপাল হাতি নেমে আসবে ওই ঠাকুরাণি পাহাড়ের দিক থেকে। মটমট করে ডাল ভাঙবে গাছের। কচি বাচ্চাটা শুঁড়ে করে ধুলো ছেটাবে। হাতিদের গায়ের গন্ধে ভারী হবে বাতাস। সে শুধু দুচোখ মেলে দেখবে। আকাশের তারার দল আজ চাঁদের আলোয় ম্লান। রাতে কি বেরোয় হাতির পাল ? শুনিনি কখনও। তারা তখন ঘরে ফিরে যায়। 

এমন গহীন মায়ারাজ্য থেকে ফিরে যেতে নাই কাউকে। একেক সময় মনে হয় আমার, সেই তো ভালো! সবাই তো ফেরে,দু একজন না ফিরলে ক্ষতি কী!

0 comments: