ধারাবাহিক - সুবল দত্ত
Posted in ধারাবাহিক
৮
জেরেকা
এখানে আয়নার ব্যবহার নেই। কারো কাছে আয়না পাওয়া গেল না। আর যাবেই বা কি করে?সবাই তো সেই জঙ্গল এলাকার। অনেকেই নিজের মুখের সাথে পরিচিত নয়।জলে নিজের ছায়া দেখে যতটুকু বোঝা যায়। জেরেকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রাশিয়ান তাঁবুতে জ্ঞান ফেরার পর সেই যে নিজের মুখ দেখেছিল তারপর আর দেখা হয়নি। তখন সারা মুখে কাটা ছেড়া দাগ। এতো কাটা দাগ ছিল যে ওদের প্লাস্টিক সার্জারি করতে হয়েছিল। মুখের হুলিয়া বদলে গেছিল। এখন কি জানি কেমন দেখতে হয়েছি? জেরেকা ভাবে। কিন্তু একটা কথা স্বীকার করতেই হবে পেরো ও গোরাচাঁদ তাকে চিনতে ভুল করেনি। তাই যদি হয়,তবে তো আমি তেমনিই আছি? কিন্তু এখানে যারা এসেছে তাদের দেখে বোঝা যায় তাদের চেহারার পরিবর্তন। প্রত্যেকে সুন্দর দেখতে হয়ে গেছে। তেমনি তাদের গায়ের রঙ। ফর্সা ঈষত্ বাদামী। শুধু চেহারা নয়,চালচলন স্বভাব বদলে যাচ্ছে পরিষ্কার বোঝা যায়। ওদের দেখে যেকোনো মানুষের সম্ভ্রম হতে বাধ্য। একথা আমি জেরেকা আমার বিগত কঠোর অভিজ্ঞতা থেকে জোর গলায় বলতে পারি। এদের সবাইকে দেখে মনে হচ্ছে ওদের নিয়ে এক ভিন্ন উচ্চতর সভ্য মানব সমাজ গড়ে তুললে কেমন হয়? একটা দৃষ্টান্ত গড়ে তোলা যায়। পৃথিবীর তাবত শোষকশ্রেণীর সামনে এ এক উচিত অহিংস জবাব।এখানে আসার আগে এই স্বপ্ন গোরাচাঁদ দেখাতেন আমাকে। অবশ্য উনি বলতেন এই কল্পনা অবাস্তব। একটা ইউটোপিয়ার কল্পনা। একটা স্বপ্নের স্বর্গরাজ্য ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু এখন যা দেখছি যেখানে এখন দাঁড়িয়ে রয়েছি এ তো বাস্তব? এ তো বাস্তবই? কিন্তু যেন মনে ভয়। এই পরিবর্তন ক্ষণস্থায়ী। তার নমুনা তো এখনই দেখা যাচ্ছে। তবুও। প্রায় তিরিশ বছর ধরে সাঁওতাল আদিবাসী বিদ্রোহের ধিকিধিকি আগুনের জের টেনে চলেছি। ধানকাটিয়া মুভমেণ্টের পরই দলনেত্রী তিলকা মুর্মু খুন হয়। তারপর বহু আদিবাসী ভাই আমাকে তিলকা মুর্মু ভেবে কি জানি কেন আমাকে প্রতিনিধি করে নিল। এতো সহজে ও এতো তাড়াতাড়ি হলো যে ভাবার বিন্দুমাত্র অবকাশ ছিল না। মনের মধ্যে ছিল অহিংস আন্দোলনের তাগিদ কিন্তু কাজেকর্মে উগ্রবাদ। গোরাচাঁদ চাইতেন মাঝামাঝি নিয়ম। প্রতিবাদ হবে বুদ্ধি বিচার দিয়ে। শাসনতন্ত্রকে বোঝাতে হবে লোভী মালিকানার বেআইনি ভুল আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে আদিবাসীরা। যদি শাসনতন্ত্র না শোনে আর শোষক শ্রেণীর শোষন অবাধে চলে তো হাতে অস্ত্র নিতে হবে বৈকি। কিন্তু শুধু এই দোটানায় তো আমার জীবনযাপন ছিল না? ক্লান্ত জেরেকা দুহাতে মুখ ঢাকে। আরো দুই অন্তর্দন্দ্ব আমাকে রাতদিন কুরেকুরে খেত। গোরাচাঁদের নির্দেশমত রোজ প্রতিবাদের নতুন নতুন পদক্ষেপ নেওয়া জনজাতির সাথে গোপন মিটিং কার্যকারণী সভা ডাকা একশনের প্রস্তুতি প্রশিক্ষণ এইসব অহিংস আন্দোলনের উগ্র বিরোধীতা করত পেরো। খনি মালিকের দালাল ও দেহরক্ষী গুণ্ডাদের সাথে প্রায় খুনোখুনী লেগে থাকতো,সে যে কত বেআইনি পোচার ও জঙ্গলের কাঠ চোরদের মেরেছে তার হিসেব নেই। এইসবে বাধা দেবার জন্যে জেরেকার সাথে ছিল চির শত্রুতা। প্রতিদিন পেরোর দুর্ব্যবহারে আমার হৃদয় হাহাকারে ভরে থাকতো। প্রতিবছর সৌমেন শিমুলিয়াতে আসতো। সৌমেনের প্রতি আমার ছিল প্রচণ্ড অপত্য দুর্বলতা। শিশুকালেই ওর মা না থাকায় ওকে নিজের বুকের দুধ খাইয়ে বড় করেছি। কিন্তু স্বভাবে ও আমার প্রতি এত বিদ্বেষী,মেজর হওয়ার পর প্রতি বছর ও শিমুলিয়াতে এসে শুধুই ধ্বংসাত্মক কাজ করেছে,গোলাগুলিতে অনেক ঝোপড়ি উড়েছে পুড়েছে, ও এলেই পেরো ও আমি গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে আত্মরক্ষা করেছি। দেখতে পেলেই মেরে ফেলতো সে। আমাদের হত্যা করার জন্য সরকারের অনুমোদন বহু আগে থেকেই নিয়ে রেখেছে সে। তবু ওর জন্য আমার মন হুহু করে উঠতো। এইসব টানাপোড়েনে কখনো কখনো খুব জোর আত্মহত্যার ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু নিজের মুখ যখন জলের আয়নাতে দেখতে গিয়েই দেখতাম তিলকা মুর্মুর মুখ। জলের ওপর ভেসে উঠত প্রতিবাদী তিলকার মুখ। তখন বৃহত্তর শোষিত বর্গের উত্পীড়নের কথা মনে পড়তেই সব ভুলে যেতাম।
জেরেকা চিন্তামগ্ন হয়ে হাঁটতে হাঁটতে সরোবরের কিনারে এসে দাঁড়াল। ভোরের লালিমা আকাশে ছড়িয়ে গেছে। নিস্তরঙ্গ জলে তার প্রতিফলন। পাড় নেই। মখমলের মত মসৃণ ছোটো ঘাস ঢালু হয়ে জলে মিশেছে। পাখিরা বাসা ছেড়ে চরতে বেরোচ্ছে। তার ছায়া পড়ছে জলে। এখানে নানা রকমের নানা রঙের পাখিদের অদ্ভুদ একত্র সহবাস। নিজেদের প্রজাতি হিসেবে আশ্রয় খোঁজে না। মিলে মিশে থাকে। আর সবাই যখন ঝাঁক বেঁধে ওড়ে তখন আকাশে নানা ধরনের জ্যামিতিক নক্সা তৈরি করে। সত্যিই। স্বর্গ যদি কিছু থাকে তো এই বুঝি স্বর্গ। অবশ্য আমাদের ঘন অরণ্য তো স্বর্গই। কিন্তু সেখানে যে শয়তানের আগ্রাসন! সেখানেও এইরকম নিস্তরঙ্গ দিঘীর জলে বলাকা ছায়া ফেলে উড়ে যায়। কিন্তু সেই জলে শান্ত গোধুলিতে সরল সাধাসিধে পেরোর বাবার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ ভেসে থাকতে দেখেছি। শিমুলিয়ার একপ্রান্তে ছোটো জঙ্গল ঘেরা এক ভুট্টা ক্ষেত ছিল আমাদের। সেই ক্ষেত আর একটু বাড়ানোর জন্যে একদিন মাটিতে গাইতি চালাতে গিয়ে তিনটে ছোটো বড়ো পাথর টুকরো পেয়েছিল সে। চকচকে সোনা রঙ দেখে ঘরে না ফিরে সেগুলো নিয়ে গেছিলো একটু দূরেই একটা চুনা পাথর খনির মালিকের কাছে। সেগুলো তো সে ঠকিয়ে নিলোই, জোর জবরদস্তি সেখানে লোক ও মেশিন এনে খননকার্য শুরু করে দিল। শিক্ষিতা বুদ্ধিমতি জেরেকা কয়েকজন মুণ্ডারি ভাইদের সাথে নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে কানুনী প্যাঁচে জমির বেআইনি অধিকার সাব্যস্ত করে এবং তার সাথে ফৌজদারি মামলা করে জেলে ভরে দেওয়া হল। তারপর দীর্ঘদিন মানসিক অত্যাচার। জেরেকা তখনো আন্দোলনে নামেনি। জেলে আরো দুজন শিক্ষিত বিবাদী দুজনের সাথে আলাপ হতে জেরেকা সরাসরি আন্দোলনে নামতে উদ্বুদ্ধ হল।
জেরেকা সরোবরের কিনারায় ঝুঁকে নিজের মুখ দেখতে লাগলো। এখনো সকালের আলো ভালোকরে ফোটেনি। মুখের প্রতিচ্ছবি ছায়া ছায়া আঁধার। শনশন করে হওয়া বইছে। খোলাচুল উড়ছে। কেউ কোত্থাও নেই। জেরেকা একা। গোরাচাঁদ ভোরে ওঠেন। রোজ এই সরোবরের পাড়ে আসেন। কিজানি এখনো কেন আসেননি। জেরেকা তন্ময় হয়ে নিজের মুখছবি দেখতে লাগলো। এই মুখে আর তিলকা মুর্মুর আদল নেই। সুন্দরী ফর্সা মধ্যবয়েসী সৌম বুদ্ধিদীপ্ত এক মুখছায়া। আহা। এ যদি আমি হতাম? জেরেকা ভাবে। স্বচ্ছ স্থির জলতলে মুখের ছবির একটু গভীরে গোলগোল পাথরের নুড়ি। তার কোলে চারাপোনা মাছের রূপোলী ঝিলিক। জেরেকা ধ্যানমগ্ন হয়ে মিশে গেছিল ওই দৃশ্যে। হঠাত্ জলে আলোড়ন। কয়েকটা বড় বড় ঢেউ কিনারাতে আছড়ে পড়ে তার মুখবিম্ব ভেঙে গেল। জেরেকা চমকে যেন গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠে তরঙ্গের উত্স দেখার জন্য সামনে তাকালো। একটু দুরেই একটা কি যেন ভাসছে? ঠিকমত দেখে আতঙ্কে জেরেকার মুখ থেকে অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে এলো। একটা লাশ ভাসছে জলে।
0 comments: