গল্প - সনাতন সিংহ
Posted in গল্প
শালা, ছোটলোকের বাচ্চা কিনা? তাই এমন কথা বলছে।
খবরদার বলছি, ছোটলোক বলবি না। ঐ কথাটা শুনলে না, মাথায় রক্ত চড়ে যায়। খুন করে ফেলবো।
মোড়লবাবা, শুনলে? কুত্তার বাচ্চার গরম গরম কথা শুনলে? বলে কিনা…
রাজেনের মুখের কথা শেষ হবার আগেই মোড়ল সীতাপতি দুজনকে সামাল দিতে ধমক দিলেন,
ওহ, তোরা থাম দিকি। বিচার সভায় বসে একি কথা?
পাড়া-গাঁর বিচারে কারো মুখে কেউ কোনোদিন কুলুপ লাগিয়ে রাখতে পারেনি, আজ সীতাপতিও পারল না। হল না তার ব্যতিক্রম .....
দূর থেকে হারু কামারের মেজাজি গলা সভার অন্যদের গলা ছাপিয়ে আসছে।বিশুকে শাসিয়ে বলেছ,
তোর চোরপুট্টি ভাঙবো দেখবি? গলার মধ্যে দকদকে লাল রড ঢুকিয়ে দেব।অন্যায় করে আবার বলে কিনা 'মাথায় খুন চড়ে যায়',খুন করবে? আয় শালা তোর মাথাটা নামিয়ে দেই।
বিশু রাগে আত্মহারা হয়ে গেল। চিৎকার করছে,
আমাকে এই শালা ফাঁসিয়েছে।এখন ওদের টাকা খাইয়ে আমাকে জব্দ করতে চাইছে।
বলতে বলতে প্রমোদ মাস্টারের দিকে তেড়ে গেল।
প্রমোদ পেশায় প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। পাটিও করে। ধরিবাজও বটে।
আর বছর পাঁচেক বাকি আছে রিটায়ার করতে।
কানাই সরদারের কাছেই বসে ছিল প্রমোদ মাস্টার।
প্রকাশ্য সভায় 'শালা' সম্বোধন শুনে চমকে ওঠে।এমনকি বিশুর ভাবগতিক দেখে কেমন ঘাবড়ে যায় সে।ধরফড়িয়ে উঠে পড়ে।ভয়ে তার মুখে কথা জড়িয়ে যেতে লাগল,
এ-এ-এ-এই।মু-মু-মু;মুখ সামলে কথা বল।অন্যায় করে আবার বড় বড় কথা।দেখলে কাকা,কে-কে-কেমন তেড়ে আসছে !
কানাই সরদার সভার সভাপতি।বেগতিক বুঝে সামাল দিতে চাইলো,
আহ বিশু,থাম না রে।আমরা তো আছি নাকি? কার দোষ সেটা আমরা দেখছি। এই প্রমোদ বস না দেখি। বস।
বিশু যেখানে ছিল সেখানে ফিরে গেল।কিন্তু সেখানে বসে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইল প্রমোদের দিকে।
সেই চাহনির মধ্যে কেমন একটা ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসা ঝরে পড়ছে।তা কার্যে পরিণত না হওয়ায় আরো আরো শাখা–প্রশাখা মেলে উত্তরোত্তর কলেবরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তা অনুধাবন করে প্ৰমোদ ভেতরে ভেতরে কেমন গুঁটিয়ে যাচ্ছে।তা প্রমোদের গুটিয়ে যাওয়ারই কথা।
আজ দিনের বেলায় ক্ষেতের সেই ঘটনা শুধু তার চোখের সামনে নয় যেন আমাদের সবার সামনে ভেসে উঠছে...
মদন দৌড়ে আসছে মাটির রাস্তা দিয়ে।পথেও লোকজন নেই। পড়ন্ত বিকেল।মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। শীত শীত ভাবটা বেশ অনুভূত হচ্ছে।ফুরফুরে উত্তুরে হাওয়া বইছে। সূর্যের সারাদিন খোঁজ ছিল না।এখনও নেই। চিৎকার করতে করতে মদন নামছে রাস্তা থেকে।
শালা, কে এমনটা করল রে? আমার সর্বনাশ করে ছাড়লি?
প্রমোদ প্রমাদ গুনে সুড় সুড় করে জমির আল ধরে পাড়ের দিকে সরে যেতে লাগলো।দেখলে মনে হবে যেন চোরের মত পালাচ্ছে।
বিশু মাথা নিচু করে আপন মনে জমির মধ্যে কাজ করছিল।আগাছায় ভরে গেছে তার কপির খেত।নিড়ানি দিয়ে সেই ঘাস তুলে তুলে জমিতেই ঢিবি করছিল। পরে বোঝা বোঝা করে রাস্তায় ফেলে দেবে।শুকিয়ে গেলে ভালো জ্বালানিও হবে। তার আসে পাশের জমিতেও আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। প্রমোদের পুকুর পাড় থেকে জল মেশিনের আওয়াজ আসছে বটে,তবে খুব জোরালো নয়।ফাঁকা মাঠb, শীতের হালকা আমেজে বিশুর গলায় গান ভেসে যাচ্ছে হিমেল হওয়ায়। কিন্তু হঠাৎ মদনের চিৎকারে তার গান গেল থেমে।অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। দৌড়ে আসছে সে।
আমার বাগানটা দিলি তো শেষ করে।
গরিবের পেটে এমন করে লাথি মারলি রে বিশু। তুই ,তুই কাজটা করতে পারলি?
বিশু হকচকিয়ে গেল,
এ তুই বলছিস কি?আমি তোর কি ক্ষতি করলাম?আর এ কি কথা বললি ...আমি তোর পেটে লাথি মেরেছি?
রাগে ফুঁসছে মদন। তার সংসার বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় এই বাগান।নগদ টাকায় জমি নিয়ে চাষ করে। গায়ের রক্ত জল করে সন্তান স্নেহে পালন করে বাগানের প্রতিটি গাছকে। আর সেই বাগানে কিনা জলের তলায় ডুবে গেছে। সবেমাত্র গাছগুলোয় কচি কচি ফল ধরেছে।তা দেখে তার চোখ খিলখিল করে হেসে উঠেছিল।
এখন তা জলে ডুবে গেছে সবটা।দু একটা ঝিঁয়ের ডগা সাঁতার কাটছে এখনও।সেদিকে তাকিয়ে তার চোখ রাগে যত না আগুন বর্ষণ করছে, তার চেয়ে চোখে কিনারা অতিক্রম করে বেদনাতুর চিবুক বেয়ে জল গড়াচ্ছে।
মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে সে খেত বানিয়েছে।
লোকের তার বাগানের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে অনেকেই আফসোস করে বলেছে,
এবছর তোর কপাল খুলে যাবে রে মদন। টাকায় লালে লাল হয়ে যাবি। আমরা তোর মতো বাগান করতে পারলাম না।
এসব শুনে মদনের বুক ভরে উঠত। চোখে আনন্দ ডগমগ করে খেলে বেড়াত। আর আজ কিনা তা জলের তলায়।সব সব শেষ করে দিল।
এখন সে করবে টা কি? কি করে বাঁচবে তাদের? সেখান থেকে জল তুলে ফেলার জায়গা যে নেই। পাশের খেত গুলোও বাগান। তার উপর তার জমিটাও অন্যদের তুলনায় একটু নিচুও বটে।হিমেল হওয়ায় সেই দুই বিঘে জমিতে জলের ঢেউ এখন আলতো করে ভাসছে। এমন বিপদ থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় তার মাথায় আসছে না। এই মুহূর্তে প্রমোদের কথা গুলো তাকে যেন উত্তপ্ত করে দিল,
এটাকে পেটে লাথি মারা বলে না তো কি? ঐ জমির আল তুই কাটিয়ে দিলি?
পাড় দিয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসছে আর বলছে,
মদনের এই ক্ষতিটা না করলে কি তোর দিন চলত না।
প্রমোদ দেখে বিশুর পিলে চমকে যায়।কি বলছে সে এসব?
আমি কেন কাটাতে যাব?আর কাটাবো বা কি দিয়ে?
মদন রাগে থরথর করে কাঁপছে।তীর বেগে এগিয়ে গেল সে বিশুর দিকে।তাদের দুজনের জমির আলের থেকে কোদালটা হাতে করে নিয়ে এসে তার সামনে ফেলে দিয়ে বলল,
এটা কি? এই আলের উপর বা এটা এল কেন?
আরে, এ তো কোদাল আমার !
কিন্তু আমি আল কাটিনি। এই, এই দেখ, এই নিড়ানি নিয়ে আমি জমির ভেতরে কাজ করেছিলুম।
কেন মিথ্যে বলছিস।আর কাউকে আছে এখানে? তুই না করলে এ কাজ কে করল? ভূতে?
বিশ্বাস কর, একটু আগে ঐ জমিতে প্রমোদ মাস্টারকে দেখেছি।
ওনার পুকুরের জল তো মেশিনে করে তুলে মাঠেই ফেলছে।
পাড়ের কোলেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রমোদ মাস্টার এসব শুনছিল।তার নাম উঠতেই সে হেন তেলে বেগুনে জ্বলে গেল।
মদনকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
দেখলি মদন, দেখলি তো।নিজের দোষ ঢাকতে এখন আমার দিকে আঙুল তুলছে। আমার কোদালে কি প্রয়োজন বল দেখি?
সন্দেহের আবর্তে মদন যেন পাক খেতে লাগল।তবুও সংশয়ের সুরে ক্ষোভ প্রকাশ করল।
মাস্টারদাদা তুমি এই আল কাটিয়ে দিয়েছ?
কেমন যেন বেকায়দায় পড়ে গেল প্রমোদ।
এ আআআমি, কেন এসব করব বল?
এএএ আমার কোদাল নয়?আমি কোদাল নিয়ে কি করব বল দেখি?পুকুরের তুলে দিচ্ছি বলে কারো জমির আল কাটিয়ে জল ঢুকিয়ে দেব? তুই ভাবলি কি করে মদন? তোর মাথা ঠিক আছে রে?
বিশু তার এই কথা শুনে চমকে ওঠে। একি, প্রমোদ মাস্টার এমন মিথ্যে কথা বলছে কেন? তার দিকে তাকিয়ে সে বলে ফেলল,
তুমি ঐ দিকে ঘুরছিলে যে তখন,মনে নেই?
ঘুরছিলাম ঠিকই।দেখছিলাম জল কারো জমিতে ঢুকছে কিনা?তাই বলে এমন কাজ করব?ওদিকে আমারও তো।পালং,টমেটোর খেত।আমি কি চাষের মর্ম বুঝি নারে?এ কোদাল তোর জমির আলেই ছিল,আমি দেখেছি।
কোদালটা নিয়ে তোকে কুপাতে দেখলাম। আহা রে, মদনের বাগানটা একদম ডুবে গেছে। তুই ওর এমন সর্বনাশ করলি বিশু?
খবরদার মাস্টার।মিছে কথা কইবে না।এ যে পাপ।
হ্যাঁ, তুই তো পাপ করেছিস বিশু। পরের ক্ষতি করতে তোর একটুও ভয় হল না।
জমিতে জলে ডুবন্ত গাছ গুলোকে দেখে মদন পাগলের মতো ছটফট করছিল।
তার ওপর ওদের কথাগুলো শুনে সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।
কার কথা বিশ্বাস করবে সে...বিশুর না মাস্টারের?
বিশু তার আপদে বিপদে পাশে থেকেছে দিনের পর দিন।মাস্টারের প্রতি তার শ্রদ্ধাও কম নয়। তাই বলে সে এমন ক্ষতি চুপচাপ মেনে নেবে? না, এ হতে পারে না।
যেই করুক। তার চরম ক্ষতি হয়েছে।সারারাত ডুবে থাকলে গাছ আর বাঁচাতে পারবে না। কিন্তু এত জল সে তুলবে কি করে? ফেলবেই বা কোথায়? মাথা ঝিম ঝিম করছে তার। এখন সুদখোর মহাজনের মুখটা যেন তার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে।যেন সেই লোলুপ দৃষ্টি পড়ছে তার সংসারে... থালাতে, ঘটিতে, গহনাগাটিতে। এসব নয় গেল! তারপর সে আর কি দিয়ে বাঁচবে গোটা পরিবার।
কিরে মদন চুপ করে রইলি যে?
প্রমোদ মাস্টার যে থামতে চাইছে না।মদনকে উদ্দেশ্য করে বলেই চলল,
মনে হচ্ছে, এবছর না খেয়ে মরবি মদন।বাচ্চা গুলোর মুখেই বা দিবি কি?
বিশু আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না।
শালা, মিথ্যেবাদী মাস্টার, কোদাল হাতে করে ঘুরছিলে এখন মিথ্যে করে বলা হচ্ছে, 'এ তোর কোদাল, আমি আল কাটাইনি?'
বিশ্বাসের বেড়া টপকাতে বিন্দুমাত্র সময় লাগে না। সামান্য উস্কানিতে যে কেউ ডিঙিয়ে যেতে পারে। মদন করলও তাই,
আলে থাকা কোদাল হাতে তুলে নিয়ে তার বাঁট দিয়ে কষিয়ে দিল বিশুর মাথায়।
বিশুর মাথায় যেন বজ্রপাত হল। চারপাশটা অন্ধকার দেখছে সে।মুখ থুবড়ে পড়ল সে আলের উপর।
তার কানে ভেসে আসছে,
ছাড়বি না মদন।ক্ষতি পূরণের টাকা আদায় করে ছাড়বি।আজই সন্ধ্যে পাড়ায় লোকজন ডাক।দেখি বেটা কি করে?
সন্ধ্যেও গড়িয়ে আসতেই গ্রামে বিচার সভা বসে গেল। বৃষ্টির ফোঁটা কয়েকটা ঝরে পড়লেও এখন আর ঝরছে না। সরকারি মাঠের বটের তলায় এই সভা বসেছে। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। হ্যারিকেনের আলো ছাড়া মাঝে মাঝে এদিক ওদিক বিড়ির আলো জ্বলে উঠছিল।
তারই মাঝে এই বাকবিতণ্ডা। বিশুকে কারা মাঠ থেকে তুলে এনেছিল তার মনে নেই। না, মাথা তার ফাটেনি, আলুর মতো ফুলে আছে মাথা। প্রমোদের কথায় চেঁচিয়ে উঠতে তার সেই ব্যথা জায়গায় ঢিব ঢিব করছে। তবুও নিজের জায়গায় ফিরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে,
কোদাল মাস্টারের হাতে আমি দেখেছি। আমি মাঠে কোদাল নিয়ে গিয়েছিলুম ঠিকই, কিন্তু কোদাল দিয়ে মদনের জমির আল কাটিয়ে দেয়নি। নিড়ানি আর কাস্তে নিয়ে আমার ক্ষেতের ভেতরে ছিলুম।আমার কোদাল নিয়ে ঐ প্রমোদ মাস্টার কেটে দিয়েছে।
কোদাল আলেই ছিল। প্রমোদ তার তার পুকুরের মাছ ধরার জন্য জলমেশিন দিয়ে জল তুলে মাঠে ফেলছিল। ঐ ওখানে ঘুরঘুর করছিল। ঐ কাটিয়েছে।
বিশুর কথা শুনে প্রমোদ কিছু বলেনি। মাথা নিচু করে কি যেন ভাবছে। বিশুর কথাগুলো শুনেছে বলে মনে হয়নি। সে যেন মাথা নিচু করে দেখছে...
কিন্তু পুকুরের জল প্রায় তলানিতে। মাছ দেখা যাচ্ছে। শিগগিরই মাছ ধরতেই হবে। নয়তো মাছগুলো কাদামাখা হয়ে মরে যাবে। এখনই না ধরলে তার ক্ষতি হবে অনেক। তাই মেশিন আর বন্ধ করেনি।আর একটু জল তুলে ফেললে মাছ ধরা যাবে। বিয়ের লগ্নর যোগ আছে। মাছ কটা বাজারে নিয়ে গেলে চড়া দাম পাবে। কিন্তু জল আর ফেলবে কোথায় পাড়ের পাশেই একটা আগাছাময় জমি জলে টলমল করছে। অনাবাদী বটে।সেটাতে জল ফেলছিল এতক্ষণ।যেটুকু জল পুকুরে আছে তা তুলে সেখানে ফেললে জল উপছে গিয়ে তার নিজের পালং ও টমেটো খেত ভরে যাবে। অগত্যা চুপিসাড়ে বিশুর কোদাল নিয়ে মদনের জমির আল কেটে দেয়।
মদনের নিচু জমি। হুহু করে জল ঢুকে গেল জমিতে। জলে ডুবে টইটুম্বুর। না, গাছ মরে যাবে নিশ্চিত। না, কেউ হয়তো দেখেনি!
তাই প্রমাদ গুনে প্রমোদ পাড়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেল।
ঠিক তখনই মদন রাস্তা দিয়ে দৌড়ে আসে।
সীতাপতি প্রমোদকে টোকা দিয়ে বলে,
আরে ও প্রমোদ, মাথা নিচু করে কি ভাবছো? কিছু বলো। তুমিই নাকি মদনের জমির আল কাটিয়ে দিয়েছো?
প্রমোদ ভাবের ঘোরে ছিল। তার গায়ে টোকা পড়তেই সে আমতা আমতা করছে,
না,মানে,...আমি ঐ...
বিশু চুপ করে থাকতে পারল না। রাগে গজগজ করছে সে। মুহূর্তে
ক্ষোভ উগরে দিল,
ও আর বলবে কি?আমাকে মারার জন্য ঐই মদনকে উস্কেছে।
হারু কামার একটু দূরেই ছিল। তার গায়ে যেন জ্বালা ধরে গেল বেশি।
চেঁচাচ্ছে সে,
মাস্টারের বদনাম করছিস তুই ?শালা,ছোটো লোকের জাত।
বিশুর ছোটো ভাই আশু সীতাপতির কাছেই বসেছিল। অনেক ক্ষণ ধরে হারু, পবন ও সভার অন্যদের কথা শুনছিল। বাবা-মাকে সে ছোটো বেলায় হারিয়েছে। এই দাদাই তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে। বিশুই তার কাছে বাবা, তার মা। আর সেই দাদাকে কিনা
ছোটো লোক বলা? কথাটা যেন রার গায়ে ফোঁসকা দিয়ে লাগল।
ছোটো লোক তো তোমরা হারুদা। প্রমোদ মাস্টারের টাকায় মদ গিলে এসে এখানে ওর হয়ে সাফাই গাইছ।লজ্জ্বা করে না? যত সব মাতালের দল।
ছোটো তো তোমরা আর ঐ তোমাদের প্রমোদ মাস্টার।
কি বললি, আমরা মাতাল?মাতলামি করছি? আমরা ছোটোলোক?
পবন হারুর পাশেই ছিল। হারুর কথার রেশ ধরে তোতলাতে তোতলাতে বলেই ফেলল,
মা-মা-মাল খেয়েছি , বেবেবেশ করেছি।
তোতোতোর, বা...পের কিকিকিরে?
বাপ তুলে কথা বলায় বিশুর মাথায়
সত্যিই যেন খুন চেপে বসল। উঠে পড়ল সবেগে। খালি গা। কাঁধের গামছাটা কোমরে সজোরে বেঁধে হুঙ্কার দিতে লাগলো,
কোন শালা রে? দূর থেকে হিক্কা দিচ্ছিস? বাপ তুলে কথা বলছিস?আয়,মরদের বাচ্চা হলে সামনে আয়?
কি রে শালা, প্রমোদ কি তোর মায়ের নাং হয় নাকি তোর মায়ের ভাতার হয় রে?
পবন হারুকে স্বাক্ষী করে তেড়ে ফেঁড়ে উঠল,
শুশুশুনলে, মামামায়ের নামে বাজে কথা শুশুনলে?
আর হারুকে পায় কে? লোহা পিটিয়ে পিটিয়ে তার হাতগুলো যেন পাথর হয়ে আছে। হাঁপরের আগুনের তাপে তার মাথা যেন সব সময় গরম হয়ে থাকে। পবনের কথায় সে কাছা সেটে তেড়ে গেল বিশুর দিকে।
সভাটা কেমন সরগরম হয়ে উঠল। কেউ কেউ হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। কেউ কেউ থাকল বসে।সীতাপতি, সভাপতি কানাইয়ের গা ঘেঁষে বসে রইল মাদুরে। হ্যারিকেনের আলোয় তাদের কেমন বিচলিত দেখাচ্ছে। এই মুহূর্তে সভাপতির অনুমতির জন্য তোয়াক্কা করল না। সবাই বলার রাস্তা নিজেরাই তৈরি করে নিল।সমাজে প্রভাবশালী লোকের প্রতি নিচু তলার একটা চাপা ক্ষোভ চাপা থাকে বরাবরি। মুখোমুখি হয়ে সব সময় সত্যি কথা বলার সাহস সবার হয়ে ওঠে না। কিন্তু ঝগড়া, বিবাদে, জনরোষে তা অনেক সময় প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
তাই আজ সেই ক্ষোভ এই রাতের আবছা অন্ধকারে বেরিয়ে এল লোকের মুখে।যে যার মতো পক্ষ নিয়ে উত্তপ্ত ক্ষোভ উগরে দিল নিমেষে,
এই কামারের বাচ্চা? কত টাকা খেয়েছিস পোমদ মাস্টারের কাছ থেকে?
প্ৰমোদ মন্ডল সীতাপতির পাশেই বসে ছিল।কথাটা শোনামাত্র ঝাঁঝিয়ে উঠল,
দেখলে সীতাপতিদা, ছোটলোকের কথা শুনলে?
সীতাপতি বিচলিত হয়ে অন্যদের গতিবিধি লক্ষ্য করছিল তাই কোনো উত্তর দিল না।কথার মাঝে কথা বলায় প্রমোদ মাস্টারের কথা তাদের কানে গেল না গেলেও তাদের কথা থেমে থাকেনি,
খেয়েছে খেয়েছে। নইলে ওর গায়ে এত জ্বালা ধরবে কেন?
সত্যিই তো, এমন করছে যেন ওর বাগানে জল ঢুকেছে?
কোদালটা তো তোর ঐ বাপ পোমদের হাতে ছিল রে? বিশুকে ফাসিয়েছে তোর ঐ বাপ রে?
প্রমোদ মাস্টার আর চুপ করে বসে থাকতে পারেনি।কানাই সরদারকে এক প্রকার ঠেলা দিয়ে বলেই উঠল,
কাকা, এসব আমি কিন্তু বরদাস্ত করব না। আমি ওদের বাপ?আমি ওদের মদ খাইয়েছি? আমি ওদের ঘুষ দিয়েছি?
পাড়ার যেকোনো বিচার সভার এক প্রকারের চিরস্থায়ী সভাপতি কানাই সরদার। হুঁকোতে টান দিচ্ছিল। এমন ঘটনায় স্থির থাকাই চিরন্তন স্বভাব হয়ে উঠেছে।প্রমোদের আলতো ধাক্কায় কলকের আগুন মাটিতে পড়ে গেলেও শান্ত গলায় শোনালো,
আহ প্রমোদ।বাদী-বিবাদীদের নিয়ে এমন একটু আধটু কথা হয়।স্থির হয়ে বস না।সেব কথায় কান দিলে চলে না।
প্রমোদ স্কুল মাস্টার। তার উপর দলের নেতা। নানান বিচার সভায় ডাক পায়ও বটে। সভাপতির কথায় আত্ম সংবরণ করে আবার বসে পড়ল।
কিন্তু অন্যদের হুল ফোঁটানো, ঝাঁঝালো এতগুলো কথা কামারের কানে প্রবেশ করেছে আগেই। শুনেই হারুর রক্ত গরম হয়ে গেল।কে যেন পাশ থেকে তার কানের কাছে বলল,
দল বেঁধে তোমাকে কেমন হেয় করছে দেখ! আমি হলে ঐ সমুন্দিদের মাথাটা ফাটিয়ে দিতাম। আমার গায়ের চামড়া এতো মোটা নয়।আমায় শোনালে ছাল খিঁচে নিতুম।
শোনামাত্র হারুর শরীর আলোড়িত হয়ে উঠল।পেশিবহুল হাতের শিরা-উপশিরা নেচে নেচে উঠছে বারবার,
বাপ তুলে কথা বলছিস?
এত সাহস তোদের? সব কটাকে আজকে এখানে ফেলে রাখবো!
বলেই তেড়ে ফুঁড়ে আসতে চাইলো।কারা যেন তাকে আটকে রাখছে।
বাধা পেয়ে সে যেন আরো ফুঁসছে।
একটা হুলুস্থুল বেধে গেল। কিছুক্ষণ চলল ধাক্কাধাক্কি ঠেলাঠেলি।কেউ কেউ পালাতে গিয়ে পড়ল সরকারি পুকুরে। কোথাও কোথাও দলে দলে হাতাহাতি শুরু হল।
হ্যারিকেন গেল নিভে। কেউ কেউ টুনটুনি আলো দিয়ে দিল দৌড় রাস্তা দিয়ে। দৌড়তে গিয়ে দপ দপ করে সেগুলোর নিভে গিয়ে অন্ধকার আরো বাড়িয়ে দিল। মাঠ থেকে সেই গণ্ডগোলের আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে ভয়ের শরীরে। সরকারি মাঠে বটগাছের তলায় আবছা অন্ধকারে পাড়ার সেই মানুষগুলোকে আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না।
কে লম্বা কিছু একটা নিয়ে দৌড়ে গেল ভিড়ের মধ্যে। মুহূর্তে সব আওয়াজ ছাপিয়ে একটা তীব্র আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ল,
আ আ আ আ আ... আমায় মেরে দিল রে...মেরে...
বিশুর গলা তো মনে হল। কে যেন ভয়ে আঁতকে বিল্বল হয়ে পড়েছে,
ওরে, হারু বিশুর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে রে? জল নিয়ে যায় কেউ।শিগগির আন।
হারু, পবন ও তাদের দলের হদিস মিলল না।
রাত গেল গড়িয়ে। ব্যান্ডেজ পড়ল বিশুর মাথায়। তাদের বাড়ির সবাই ফুঁসছে।প্রতিশোধ স্পৃহায় তারা মুখিয়া হয়ে উঠেছে।
হ্যাকিকেনের আলো নিয়ে সীতাপতি ও কানাই মোড়লকে কারা যেন সঙ্গে করে বাড়ি দিয়ে আসতে যাচ্ছে। বড় পুকুরের পাশ দিয়ে চেলেছে। বৃষ্টি পড়তে শুরু করল টিপটিপ করে।
বাঁশ ঝাড়ের নিচে হ্যাকিকেনের আলোয় লম্বা লম্বা পা গাছ গুলোয় ছায়া এঁকে দিচ্ছে গাঢ় কালো রঙে। বাঁশের পাতা থেকে শিশির ঝরে পড়ছে তাদের মাথায় টপাশ টপাশ করে।
পাড়ায় একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল ঠাণ্ডা রাতের অন্ধকারে।
শীতের রাত। বৃষ্টিও হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। ঠাণ্ডাটা এখন বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। সারা পাড়া ঘুমিয়ে আছে কাঁথা মুড়ি দিয়ে।অমাবশ্যার রাত হলেও কি হবে, অন্ধকার ততটা ঘন নয়। ফ্যাকাশে হয়ে রয়েছে। বিশুদের পুকুর পাড়ের কলা পাতা থেকে শিশিরের ফোঁটা টুপ টুপ করে ঝরে পড়ছে পুকুরে। সেই শব্দ অনুরণিত হয়ে হচ্ছে সাদাটে কুয়াশায়।
তিনটে শরীর পা টিপে টিপে ঢুকছে বিশুদের পাড়ায়। গা চাদরে মোড়া, মাথায় পাগড়ি বাঁধা। দুজনের হাতে দুটো ঝাঁকার মতো কিছু।সামনে যে চলেছে তারও হাতে কিছু একটা ঝোলানো আছে।কিন্তু স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে না।
বিশুর উঠোনে এসে তারা থমকে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।কি বলাবলি করে আবার বিশুর বারান্দায় উঠল।চাপা গলায় ডাকছে,
কাকা,কাকা, ও কাকা...
বিশুর বউ বিশুকে নাড়া দিয়ে বলছে,
শুনছ, কে যেন ডাকছে গো। কি গো শুনছ?
কাকি, আমি গো আমি, সুবল। একটু দরজাটা খোলো না। দরকার আছে।
বিশু ধড়ফড় করে উঠে বসে।বিশুর বউ শিউরে ওঠে,
কি গো, এই এত রাতে প্রমোদ মাস্টারের ছেলে কী করতে এসেছে?
বিশুর মাথার কাটা জায়গাটা টনটন করে উঠল। কাঁথা সরিয়ে ফেলে উঠতে গিয়ে মাথাটা টলে গেল। ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল।বিশুর বউ তাকে ধরে বসিয়ে দিল।
এত রাতে কিসের দরকার? আবার মারতে এসেছ নাকি? দেখা হবে না। যা দরকার সে সকালে আসবে। এখন যাও।
সুবল কেমন যেন নিরুপায় বোধ করল। না ফিরে গেলে হবে না। যা করার তা আজ রাতেই করতে হবে। বেশি চেঁচামেচি হলে আবার হিতে বিপরীত হবে। সবাই জেগে গেলে তার আর চারা থাকবে না।তাই চলে যাওয়ার আগে তবুও ফিসফিসিয়ে বলল,
না, কাকি একটিবার দরজাটা খোলা। বাবা পাঠিয়েছে। কাকা, একবার ভেতরে আসতে দাও, কাকা...
বিশুর কি মনে হল কে জানে? কাটা জায়গা চেপে ধরে ধীরে ধীরে বলল,
পুতুল, ওকে আসতে দাও।
কিন্তু? ছেলেরা তো আজ বাড়িতে কেউ নেই। তুমি একা। আমি মেয়ে মানুষ কি করব? ঠাকুরপো কে ডাকবো?
না, ডাকতে হবে না। ওকে আসতে দাও।
আগে আলোটা জ্বালি।
আলো জ্বেলে দরজাটা খুলতেই সুবল ঢুকলো ঘরের মধ্যে।
দড়াম করে একটা বড় কাতলা মাছ ঘরের মেঝে ফেলে দিল। চমকে উঠল বিশু ও পুতুল।
একি এটা কেন?
আরো কিছু বলার আগেই সুবল বিশুর পা জড়িয়ে ধরে বলল,
কাকা, তোমার দুটো পায়ে ধরি। বাবার জন্য তোমার এই দশা। বাবাই মদন কাকুর জমির আল কাটিয়েছে।
সমাজের কাছে, পার্টির কাছে ছোটো হয়ে যাবে… লোকে ছি ছি করবে। স্কুলে গেলে সবাই থুতু চিটাবে। লোকটা লজ্জায় মরে যাবে।তুমিই পারো বাবাকে বাঁচাতে।
বিশু, পুতুল চুপ করে তাকিয়ে রইল তার দিকে। কিছুক্ষণ পর বিশু মুখ ফিরিয়ে নিল। সুবল পা ছাড়ল না।বিশুর মুখ ফেরানো দেখে সে আবার বলল,
জরিমানা যা হয় তা সব সব আমি দিয়ে দেব। এমনকি তোমার ডাক্তারের পয়সা সেটাও।শুধু বাবার দোষটা তুমি...এই তোরা ভেতরে আয়।
সঙ্গে সঙ্গে দুজন ঘরে ঢুকল। তাদের সহাতে ঝাঁকা। মাছের আঁশটে গন্ধ ঘরে ভরে গেল।
বিশু তাদের দেখে অবাক হয়ে যায়।মনে মনে ভাবে তাহলে সুবল এক নয়।
স্বপন তোরা?
হ্যাঁ, দাদা। তুমি ওর প্রস্তাবটা মেনে নাও।
কেউ তো আর ওই সময় মাঠে ছিল না যে তোমার স্বাক্ষী দেবে?ওর বাবা চাইলে দু'একটা স্বাক্ষী জোগাড় করে নেবে। তুমি কিছু করতে পারবে না।
না না, তা কি করে হয় সুবল? তোর বাপের পাপের বোঝা, তোর কাকা কেন মাথা পেতে নেবে? লোক লাগিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিস।তাতে তোদের আশা মেটেনি? যা এখন যা, কাকা
অসুস্থ। যা বলছি, যা।
আমরা মাছ বেচে ফিরছি কাকা। এই থলেটা রেখে গেলাম, এতে অনেক টাকা আছে। ভেবে দেখো, এতে তোমার লাভই হবে। রাত শেষ হয়ে আসতে হয়তো আর বেশি দেরি নেই। সন্ধ্যায় আবার বিচার সভা ডাকা হয়েছে। পঞ্চায়েত প্রধানও আসবে। সে আবার বাবার খাস লোক। দেখো, আমরা চললাম। আয় তোরা।
বলেই চাদর গায়ে জড়িয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।
তার মানে তোরা সবাই মিলে আমাকে দোষী সাব্যস্ত করার ব্যবস্থা করেছিস।আমাকে দশের কাছে ছোটো করবি?আমি তা হতে দেব না।
স্বপন তার কাছে এগিয়ে গেল। শান্ত গলায় তাকে শোনালো,
সীতাপতি, কানাই মোড়ল কেউ তোমার হয়ে কথা বলবে না। ওদেরও অনেক টাকা দিয়েছে। দেখলে না হারু, পবন...
বিশুর বউ তাকে থামিয়ে দিল।
যা স্বপন তোরাও যা।
যাই বউদি।তবে ওরা রাঘব বোয়াল। টাকা দিয়ে সব কিছু করাতে পারে। আজ মাথা ফাটিয়েছে, কাল আবার তোমার ঘর পুড়বে। পরশু হয়তো খেতের সব গাছ উপড়ে দেবে। একদিন হয়তো বিশুদাকে...
কানে কাপড় চাপা দিয়ে পুতুল চাপা কান্নায় বলল,
তোরা যা, স্বপন যা। যা...
স্বপনরা চলে গেলেও বিশু,পুতুল কারো মুখে কোনো কথা নেই।পুতুল বিশুকে ধরে শুয়ে দিয়ে গায়ে কাঁথা চাপা দিয়ে দিল।
কি গো চুপ করে রইল? সারা দিচ্ছ না যে?
পুতুলের মনে হল, বিশু কাঁথার মধ্যে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। তারও চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আর কিছু বললেন সে।
মাছের আঁশটে গন্ধ ঘরের বাতাসে এখনও ভরাট হয়ে রয়েছে।সেই গন্ধে পুতুল যেন কেমন ষড়যন্ত্রের আভাস পাচ্ছে। ল্যাম্পের আলোয় কাতলা মাছের চোখটা যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে নীথর দৃষ্টিতে।
পুতুলের ভেতরটা কেমন যেন শিউরে উঠছে। ভেতরটা কেমন যেন শুকিয়ে আসছে। কিসের ভয়ে কাঁটা দিচ্ছে সারা শরীর। ধীরে ধীরে বিশুর মাথার পাশে বসল দেওয়ালে হেলান দিয়ে। ডান হাতটা দিয়ে বিশুর মাথায় বোলাতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরে তার চোখ জুড়ে এল। ল্যাম্পটা দপ করে নিভে গেল।
ঘরের দরজা খোলা দেখে বিশুর ভাই ঘরে ঢুকল।
বউদি দাদা কোথায়? একি, তুমি এভাবে দেওয়ালে হেলান দিয়েই বা ঘুমাচ্ছ কেন? দাদাকে দেখছি না তো? কত বেলা হয়ে গেল ! তুমি এখনো ঘুমাচ্ছ?
পুতুল হুড়মুড় করে উঠে পড়ে।
সেকি ক-ক-কত বেলা হল? তোমার দাদা শুয়ে ছিল যে! দেখ দেখি একবার এই অসুস্থ শরীর নিয়ে গেল কোথায়?
কাল রাতে কেউ এসে ছিল বলে মনে হল। দাদা কি...
তার মুখের কথা শেষ হবার আগেই পরান জ্যেঠু এসে দাঁড়াল তাদের উঠোনে।
বলি, পারুল তোর বাবা নাকি মাঠে পড়ে আছে? রাস্তায় কারা সব বলাবলি করছে। দেখ দেখি, বলি পারুল? ও বিশু?
শুনেই আশু একলাফে উঠোনে লাফিয়ে পড়ল,
কি বললে জ্যেঠু, দা-দা-দাদা মাঠে পড়ে আছে? মাঠে মানে কোন মাঠে?
আমি তা, জানি। ঐ তো শুনছি তোদের কপির খেতে।
শোনামাত্র গায়ের চাদর ছুঁড়ে ফেলে আশু রুদ্ধশ্বাসে দিল দৌড়।পুতুল কাঁদতে কাঁদতে তার পিছু নিল।
তার পরনের আঁচল লুটিয়ে লুটিয়ে চলেছে রাস্তা জুড়ে। পাড়ার বউ, ঝি,কচি-কাঁচা, বুড়ো,বুড়ি তার পিছু নিল।
পুতুলের কান্নার আওয়াজ সারা পাড়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। কেউ কেউ তা দেখে তা সুরে কান্নাও জুড়ে দিয়েছে।
সারা পাড়া এখন মাঠের দিকে চলেছে।
বিশুর কপির খেতে তখন বেশ কয়েকজন ঘিরে রয়েছে।আশুর কান্না তাদের ঘেরাটোপ ভেদ করে কুয়াশার শরীরে ভেসে আসছে।
পুতুল রাস্তা দিয়ে নামতে গিয়ে তার পা গেল পিছলে। শিশিরে জমা ঘাড়ের উপর দিয়ে গড়িয়ে পড়ল অন্যের খেতে। পাড়ার দুজন বউ মিলে পুতুলকে ধরে তুলে দিল। কান্নায় তার গলা ধরে আসছে। সে তাদের হাত ছাড়িয়ে আল ধরে দৌড়ে যেতে চাইল। আবার পিছলে পড়ল। কাদা লেপ্টে গেল তার সারা শরীরে।
কাছে গিয়ে বুক ফাটা কান্নায় আছড়ে পড়ল বিশুর শরীরের উপর।শরীর তার বরফের মতো ঠাণ্ডা। গায়ের চাদরটা পাশেই রয়েছে পড়ে। পরনের লুঙ্গিটা ভিজে জপজপ করছে। মুখ থেকে তার এখনো গাঁজা বেরুচ্ছে। আলের পাশেই পড়ে আছে মুখ খোলা বিষের বোতল।
বিশুর নির্লিপ্ত চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে আছে প্রমোদের পাড়ের দিকে।
0 comments: