গল্প - উত্তম বিশ্বাস
Posted in গল্প
শীতের বেলা। লোকটি পাঁচমাথার মোড়ে পাতলা পলেস্টারের ফিনফিনে একটা ফতুয়া গায়ে দিয়ে খেলা দেখাচ্ছিল। কাঁধে ময়লা ঝুলি, একহাতে শিকলে বাঁধা চামচিকের মতো একটা বাচ্চাবাঁদর, আর অন্যহাতে চামাটে গন্ধযুক্ত একটা ডুগডুগি। এমনিতেই খাটো বেলা…খেটেখাওয়া মানুষের বিনোদন বিলাসীতার সুযোগ কম। যদিও বা দুয়েকজন ব্যতিক্রম থাকে, তাদের মধ্যে নাইনটি পার্সেন্টই নেটিজান। এমন নেশাতুর নেট জমানায় এসব হাস্যকর প্রাণীবাচক খ্যালা দেখিয়ে কতটাই বা লোক টানা যায়! পাশেই একটি ধানকল। ওখান থেকে যদিও বা একজন দুজন করে তুষকুঁড়োমাখা মুখ নিয়ে বেরিয়ে আসছিল, কিন্তু ওরা কেউই পয়সা ছুড়ছিল না। পয়সা কেউ ছুড়ুক না ছুড়ুক, লোকটি আপাতত এতেই খুশি।
লোকটি মুখে আধা বাংলায় আধা হিন্দিতে অদ্ভুদ শব্দ সৃষ্টি করে ডুগডুগি বাজিয়ে বাঁদরটাকে আচ্ছারকম ভোল খাইয়ে ক্লান্ত করে তুলছিল, “হেই জামাইবাবা, স্কুল যাবে?...নেহি যাবে। আচ্ছা জামাইকো বংগলা আতি হ্যাঁয়?...নেহি আতি। আচ্ছা আব বোল, জামাইকো শ্বশুরাল কাঁহা থে?...বংগলাদেশে!” লোকটি একাই বলছে…. একাই উত্তর দিচ্ছে। বাঁদরটি শুধুমাত্র ওর শেখানো বুলির সূত্র ধরে অদ্ভুত সব অঙ্গভঙ্গি করে লোকরঞ্জনের চেষ্টা করছে।
“আব বোল, বংগাল্মে শাশলোগ ক্যায়সে শরম আতি হ্যাঁয়?” বাঁদরটি তার নিজের খাটো ঘাগরা পেছন থেকে উল্টিয়ে ঘোমটা করে দেখিয়ে দেয়। লোকটি ময়লা দাঁতে একা একাই হেসে লুটিয়ে পড়ে।
একসময় সূর্য ঢিমি আঁচের মতো ঘোলা হয়ে পশ্চিম আকাশের কোলে ঢলে পড়ে। শূন্য অ্যানামেলের ডিশখানি তপ্ত হতে হতেও কখন যেন তার খোলে হতাশার মিহিধুলোর আস্তরণ উড়ে এসে লাগে! হঠাৎ একটি রাশভারী লোক গাড়ি থেকে নেমে, তাঁর জামার পকেট থেকে অনেকগুলো খুচরো কয়েন খেলাস্থলে ছুড়ে দিলেন। মুহূর্তে ধনশ্রীরাগে শূন্য ডিশটিও যেন ঝনঝন করে বেজে উঠল। আদিম আবেশে বাঁদরটিও বারকয়েক ভোল খেয়ে মনিবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তখনও বাঁদরওয়ালা ব্যপারটা বুঝে উঠতে পারল না, ‘ইতনে সারে সিক্কে বাবুজি কিসলিয়ে ফ্যাইকে?’
পেছন থেকে অদৃষ্টের দৈববাণীর মতো কে যেন চাপা ভৎর্সনার সুরে বলে উঠল, “আরে কুড়িয়ে নে বোকা! উনি খুব প্রভাবশালী লোক। এসব সিকি আদুলি… ছূটকোছাটকা ওঁর কাছে কিছুই না!” দর্শনার্থীদের পায়ের ফাঁকেও অনেকগুলো কয়েন ছিটিয়ে পড়েছিল। ধুলোর মধ্যে ওগুলো চকচক করছিল। কয়েনগুলো কুড়িয়ে নিতে বাচ্চা বাঁদরটিও ওকে সাহায্য করল। মনের আনন্দে ডুগডুগি বগলদাবায় নিয়ে সন্ধ্যায় সে বাসার দিকে রওনা দিল। অর্ধেক রাস্তা যেতে না যেতেই লোকটির মনে কেমন যেন খটকা লাগল, ‘আরে! এ থ্যালি আচানাকসে ভারী কিউ হোনে লাগি?’ সামনেই একটি চায়ের দোকান দেখে সে তার ভারী বোঝাটাকে চাটনার ওপর নামাল। ঝোলাটাকে খুলতে গিয়েও কিছু একটা ভেবে খুলল না। এরপর হাতেমুখে জল দেবার জন্যে কিছুক্ষণের জন্যে পেছনের কুয়োয় নামল। উঠে এসে দেখল, চালার নিচে লোক গিজগিজ করছে। আর দোকানদারও রেগে টং, “আরে মশায়, একসাথে এতোগুলো বে-অরিশ লোক….বাঁদর কোত্থেকে এসে হাজির করলেন? ...হটান বলছি ...হটান!”
-“মানে?” বাঁদরওয়ালা আকাশ থেকে পড়ল। ততক্ষণে লোকগুলোও তৃষ্ণার্ত কাকের মতো চা চা করে যাচ্ছেনাতাই রকম চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে!
-“কী হে, হাঁ করে রইলে যে!.....তোমার বাঁদরটিই তো ঝুলি থেকে ওদের টেনে টেনে বার করল!”
মুহূর্তের মধ্যে ওখানে হাটের জটলা শুরু হয়ে গেল। কেউ বলল,“এরা তো রীতিমত আসামী!”
কেউ বলল, “আসামী না। বলো আসামীজ…..মানে অসমীয়া! শুনছ না বাংলাটা ক্যামন টেনে টেনে বলছে!”
কথার ঘূর্ণিপাকে একসময় ধৈরযেরও শালীনতা ছাড়িয়ে গেল, ‘ধর শালাকে। ধুড় পাচারকারী।’
-“কোত্থেকে বাগাল এত লোক?”
-“আরে শোননি, ডিটেনশান ক্যাম্পেও কত কী সস্তায় নিলাম হচ্ছে!”
-“ব্যাটা নিশ্চয়ই কিডনি কারবারি!”
একজন গায়ে গুঁতো দিয়ে জানতে চাইল, “তোমরা কোত্থেকে এসেছ?” লোকগুলোর ভাবলেশহীন চোখমুখ দেখে মনেহল, যে ভাষায় প্রশ্ন করা হয়েছে,… তারা আদৌ এসব বোঝে না।
-“তোমাদের কাগজপত্তর নেই?” বোঝাই যাচ্ছে এটাও এদের কাছে আরও এক জটীল প্রশ্ন!
একজন অবজ্ঞায় ঠোঁট চিতিয়ে জিজ্ঞেস করল,“তোমার নাম কী?”
এইবার রাক্ষুসী চেহারার একজন বৃদ্ধা খেকিয়ে উঠল, “দেখছ না দুই!”
কেউ বা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, “দু পিঠেই পাঁচ!”
-“আরে! এই তো বোঝে। তাহলে…..?”
এবার ক্ষুধায় তৃষ্ণায় বাঁদর ওয়ালা লোকটির মেজাজ বারুদ হয়ে উঠল। সমবেত জনতাও মারমুখী হয়ে উঠল। এবার সে বাঁদরকে ক্ষেপিয়ে দিতে জোর ডুগডুগিতে ঘা দিল। মুহূর্তে লোকগুলি আবার পূর্বের মতো কয়েন হয়ে ঝনঝন করে বেজে উঠল। দোকানদার সহ আরো অনেকেই তাজ্জব বনে গেল! কৌতূহলী জনতার মধ্যে থেকে কেউ কেউ আজব কয়েনগুলি নেড়েচেড়ে দেখবার জন্যে দোকানঘরের ছোট্ট চালার নিচে একপ্রকার হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিল। কিন্তু দোকানদার আর রিস্ক নিতে রাজি নয়। সে তাড়াতাড়ি ঝাঁপ ফেলে দিয়ে লোকটিকে ওখান থেকে ভাগিয়ে দিল।
ঝোলাকাঁধে লোকটি তার পোষ্য বাঁদরটাকে টানতে টানতে আবার উল্টোপথে পাঁচমাথার দিকে হাঁটা শুরু করল। এই বিপজ্জনক কয়েনগুলো তাঁকে ফেরৎ দিতেই হবে। এবার সে তার ডুগডুগি আরও জোরে বাজাতে লাগল,“ইতনে সারে পয়সা কৌন দিয়া?... বাবুজি দিয়া। ইয়াদসে বোল, উস বাবুজিকা সকল ক্যায়সা থা? ….বড়ে ইমানদার জ্যায়সা!”
লোকটির মুখের ওপর দুর্বোধ্য অন্ধকার ক্রমশ গাঢ হয়ে আসছিল। কেননা সে জানে,- দেশের সমস্ত পাওয়ারফুল মানুষের মুখের আদল একই রকম হলেও, তাঁদের আসল আইডেনটিটি থাকে অন্য জিনিসে। তাই তো এবার সে ব্যগ্রস্বরে জিজ্ঞাসা করল,“বাবুজিনে জিস কামিজসে প্যাইসা দিয়ে, উস কামিজকা রং ক্যায়সা থা?”
কিন্তু বাচ্চাবাঁদরটি মাথাখুড়ে কিছুতেই সে আর মনে করতে পারল না….পয়সাওয়ালা বাবুজির গায়ে তখন কোন কালারের কামিজ ছিল।
ভাল লেখা। ভাল রূপকল্প।
ReplyDelete