0

ওবাড়ির চিঠি - শতরূপা দত্ত

Posted in

পেঁয়াজের ঝাঁঝে কাঁপছে উন্নয়নমুখী বাংলাদেশ

একমণ ধানের দামে দুই কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গায়। এখানকার বাজারগুলোতে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৬০-২৪০ টাকায়। আর হাটগুলোতে আমন ধান মণ প্রতি বিক্রি হচ্ছে ৪৮০-৫৪০ টাকায়। “বাজারের যে হাল তাতে পরিবার নিয়ে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকায় দায়।”- চুয়াডাঙ্গা নতুন ভান্ডারদহ গ্রামের কৃষক হাশেম আলী সরোজগঞ্জ বাজারে এসে এভাবেই নিজের মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

রান্নায় পেঁয়াজের ব্যবহার নেই - বাংলাদেশের মানুষ এ কথা ভাবতেই পারে না। বহুদিন ধরে প্রচলিত ব্যবহারের কারণে পেঁয়াজ আমাদের রান্নার একটি বাধ্যতামূলক উপাদানে, আমাদের খাদ্য-সংস্কৃতির একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে।

অথচ সম্প্রতি পেঁয়াজের ঝাঁঝে চোখে সর্ষেফুল দেখছে বাংলাদেশের মানুষ। আগস্ট থেকেই ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করেছিল পেঁয়াজের দামের পারদ। নভেম্বরের মাঝামাঝিতে এসে তা যেন পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটে বিশ্ব রেকর্ড করতে চাইছে প্রতিদিন। সরকারের নানা পদক্ষেপেও নিয়ন্ত্রণে আসছে না পেঁয়াজের বাজার। যে পেঁয়াজ আগে পাওয়া যেতো ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজিতে, সেই পেঁয়াজই নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ শেষে খুচরা বাজারে বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ২৫০ টাকা পর্যন্ত। আর পাইকারি বাজারে তা বিক্রি হয়েছে ২২০ থেকে ২৩০ টাকায়। 

অবশ্য, বাজারে পেঁয়াজের আকাশ ছোঁয়া দাম থাকলেও মাঠ পর্যায়ে কৃষকরা সেই দাম পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। এজন্য ব্যবসায়ীদের মজুদ ও সিন্ডিকেটকেই দায়ী করেছেন পেঁয়াজচাষিরা। এছাড়া মৌসুমের শুরুতেই বৃষ্টি হওয়ায় পেঁয়াজের উৎপাদন এবার কিছুটা কম হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তারা।

সম্প্রতি রপ্তানি নীতি সংশোধন করে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পেঁয়াজ রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের একটি সমিতি জানিয়েছে, বাংলাদেশে পেঁয়াজের চাহিদার ৬০ শতাংশ মেটানো হয় দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ থেকে। বাকি ৪০ শতাংশ আমদানি করা হয়। আর এই আমদানির সিংহভাগই আসে ভারত থেকে। 

অবশ্য, পেঁয়াজের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এমন অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র দেখছেন কেউ কেউ। তারা বলছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি ও হ্রাস দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। বর্তমান সরকারের কৃতিত্বকে ম্লান করে দেওয়ার জন্য কোনো অসাধু চক্র এই সংকট তৈরি করেছে কিনা তা খুঁজে দেখার বিষয়ে জোর দিতে বলছেন তারা। মনে করিয়ে দিয়েছেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বড় বড় কৃতিত্ব ম্লান করে দেওয়া হয়েছিল লবণ ও মরিচের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে, লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি করে। পেঁয়াজের পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও মজুদদার ও ফড়িয়ারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজারকে অস্থিতিশীল করে রেখেছে। পরিস্থিতি মোকাবেলা না করলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না বলেও মত প্রকাশ করেন তারা।

আরেকটি পক্ষ অবশ্য মনে করছেন, সরকারের অদক্ষতা এবং আইনের কঠিন প্রয়োগ না থাকাই পেঁয়াজের দাম বাড়ার মূল কারণ। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট, আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেট ও প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারসাজির কারণে পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে বলে মত দিয়েছেন তারা।

পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও নৈরাজ্যের পেছনে অসাধু ব্যবসায়ীরা জড়িত থাকতে পারে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তেমন অভিযোগ বরাবরই যেকোনো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পর করা হয়। কিন্তু এবার সরকারের প্রতিষ্ঠান ‘প্রতিযোগিতা কমিশন’-এর এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাজারে পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে একটি সিন্ডিকেট থাকতে পারে। বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, পেঁয়াজের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়েছে। আমদানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের ধীরে চলা নীতির সমালোচনা করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করার পর এ পর্যন্ত সাতটি দেশ থেকে ৬৬ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। পাঁচ হাজার টন বন্দর থেকে খালাস করা হয়েছে। মিসর ও তুরস্ক থেকে কিছুদিনের মধ্যে ৫০ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ আসবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন, আমদানি করা পেঁয়াজ জেলায় জেলায় পাঠানো হবে। টিসিবি ট্রাকে করে তা বিক্রি করবে।

কিন্তু সাধারণের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাওয়া পেঁয়াজের বাজারের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরার কৌশল বের করতে হবে। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছন, দুইভাবে খুব দ্রুত বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। প্রথমত, ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানিতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা দেওয়া। দ্বিতীয়ত, বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘোষিত বড় চালান দ্রুত দেশে পৌঁছানো এবং ছোট আমদানিকারকদের ব্যাংকের ঋণসুবিধা নিশ্চিত করা।

পেঁয়াজের দাম নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংসদ সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে, পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র কিনা তা খুঁজে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।

কৃত্রিম সংকট তৈরির বিষয়টি যে মিথ্যে নয় তা বোঝা যায়, বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পচে যাওয়া বস্তা বস্তা পেঁয়াজ যখন ফেলে দেয়া হয় কর্ণফুলী নদীতে, যখন জানা যায়, খাতুনগঞ্জে বিভিন্ন গুদামে পড়ে আছে বিপুল পরিমাণ পচা পেঁয়াজ।

পেঁয়াজ নিয়ে এই হাহাকারের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের মানুষকে কয়েকদিন পেঁয়াজ না খেতেও অনুরোধ করেছেন। বলেছেন, আমি নিজেও রান্নায় পেঁয়াজ ব্যবহার করতে মানা করেছি রাঁধুনিকে। পেঁয়াজ ছাড়াও অনেক মজার রান্না করা যায়। 

তবে সাধারণ মানুষ পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার বিষয়টি সহজভাবে নিতে পারেননি। রন্ধন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এর মূল কারণটি লুকিয়ে রয়েছে আমাদের মনে। ইউটিউবে জনপ্রিয় একটি রান্নার চ্যানেল আছে রুমানা আজাদের। তিনি বলেন, পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার কথা বাঙালি চিন্তাও করতে পারেন না। মা-খালাদের রান্না দেখে দেখে আমাদের মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছে যে পেঁয়াজ ছাড়া কোন তরকারি রান্না সম্ভব না। বিশেষভাবে মাংস ও মাছ। আদা, রসুন হয়তো বাদ দেয়া চলে, কিন্তু পেঁয়াজ থাকতেই হবে। এই রন্ধনশিল্পী মনে করেন, বাঙালিরা ঐতিহ্যগতভাবে যেসব রান্না জানে, তাতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন মেনে নিতে চায় না।

এই রন্ধনশিল্পী জানিয়েছেন, পেঁয়াজ ছাড়া বেশ কয়েকটি রান্না তিনি তৈরি করেছেন, এমনকি মাছ-মাংসের পদও, সেগুলো খেতেও খুবই ভালো হয়েছে।

রন্ধন শিল্পীরা বলেন, তরকারিতে পেঁয়াজ ব্যবহার করা হয়নি, এটা বলে না দিলে কেউ সহজে টেরও পাবেন না। কিন্তু মনের মধ্যে এমনভাবে পেঁয়াজের ব্যবহার গেঁথে গেছে যে, যে মুহূর্তে মানুষ জানতে পারে রান্নায় পেঁয়াজ ব্যবহার করা হয়নি, তখন আর তরকারিটি আগের মতো মজা লাগে না।

পেঁয়াজ কোন সবজি নয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘অ্যালিয়াম সেপা’। গোত্র হচ্ছে লিলি। এটি মূলত একটি মসলা জাতীয় উদ্ভিদ। উপমহাদেশে কবে থেকে রান্নায় পেঁয়াজের ব্যবহার শুরু হলো তা জানা যায় না। তবে, বাঙালির হেঁশেলে যে পেঁয়াজ ছাড়াও সুস্বাদু রান্নার রেসিপি সেই প্রাচীন কাল থেকেই আছে, ব্যবহারের অভাবে সেটাই ভুলে গেছে মানুষ। সুস্বাদু নিরামিশ রান্নার পাশাপাশি পেঁয়াজ-রসুন ছাড়া রান্না করা মাছ-মাংসের মজাদার রেসিপিও আছে বাঙালির ভাণ্ডারে। অপেক্ষা শুধু সেই মানিক-রতন খুঁজে আনার।

বাঙালিকে খাদ্যরসিক জাতি বলা হলেও, পেঁয়াজ নিয়ে কান্নাকাটি দেখে মনে হচ্ছে খাবারে নতুন কিছু এক্সপেরিমেন্ট করতে বড় ভয় তাদের। পেঁয়াজ ছাড়া রান্না হবে না বা রান্না ভালো হবে না- এই যে ধারণাটা আমাদের মাথায় তৈরি হয়েছে, এর সঙ্গে বাস্তবতার আসলে কোনো সম্পর্ক নেই। পেঁয়াজ দেশি-বিদেশি কোনও রান্নার জন্যই অতীব জরুরি কোনও দ্রব্য নয়। 

বাংলাদেশের একজন ক্রেতা বলেন, “দেশি পেঁয়াজের দাম ২৬০ টাকা, আর আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ২৩০ টাকা। এই দামে পেঁয়াজ না খেলে কী হয়! যতদিন আগের দামে না ফিরবে, ততদিন পেঁয়াজ ছাড়াই তরকারি খাব।”- এই সিদ্ধান্তে যদি দৃঢ় হয়ে দাঁড়াতে পারতো দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ, তবে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দুষ্টচক্র হয়তো সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ভেঙে পড়তো। অথচ, তা না করে, পেঁয়াজকে দৈনন্দিন জীবনে এমনই আঁকড়ে ধরেছে মানুষ, যে এটি এখন রাজনীতির পণ্য হয়ে উঠেছে।

0 comments: