0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in













১২

নির্বাসিত, অভাগা মানুষগুলির ডেরা থেকে ফিরে এসে ইস্তক, ফ্রান্সেস্কোর মনে শান্তি ছিলনা। ঐ যাত্রার আগের মুহূর্তে তরুণ যাজকের যেমন ধীরস্থির মানসিক অবস্থা ছিল, ফিরে এসে আর তেমনটি ছিলনা; কোথায় যেন একটা বিরাট ফারাক। প্রকৃতির যে ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপ সে দেখেছিল, মনের মধ্যে সেই ছবি প্রগাঢ় ছাপ ফেলেছিল। প্রকৃতির মোহময়ী সৌন্দর্য মানুষের পরিশীলিত আদবকায়দা, অর্জিত শিক্ষাকে সম্পূর্ণ অকিঞ্চিৎকর প্রমাণ করে দিতে পারে। এর অদ্ভুত বিশালতার সামনে নিজেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মনে হওয়া আশ্চর্য নয়। তাছাড়া নির্বাসিত মানুষগুলির অদ্ভুত জীবনযাপন, এসব দেখেও সে অবাক হয়েছিল। কিন্তু সেই দিনের স্মৃতি সেই দিনেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, এমনটি ভাবলে ভুল হবে। ঐ দিনটির স্মৃতি ফ্রান্সেস্কোকে স্বপ্নের মধ্যেও তাড়া করতে লাগলো। সে নিজে ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান, পেশাগত যাজক। তার কেবলই মনে হতে লাগলো, সেদিন ঐ পাগান দেবতার মূর্তি আঁকা কাঠের টুকরোটা সে ছুঁয়েছিল; শুধু তাই নয়, ছুঁয়ে দেখে প্রচণ্ড ঘৃণার সঙ্গে আগুনে ছুঁড়ে ফেলেছিল। লুসিনো আগুন থেকে তুলে এনেছিল এটা ঠিক! তবুও, তার মন থেকে খচখচানিটা সে মুছে ফেলতে পারছিলনা। সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিতে পারছিলনা পুরো ব্যাপারটা। যতই হোক, যিশুখ্রিস্টের জন্মের বহুযুগ আগে থেকেই মানুষ এসবের পূজা করত। যদিও খ্রিস্টধর্মের পবিত্র ধর্মযুদ্ধের পরে এসব একেবারে সমূলে উৎপাটিত হয়েছে বলা চলে। সবকিছুই এখন চার্চের আওতায়। আগে ওরা সব ঐ আদিম নগ্ন দেবদেবীদের পূজা করতো, লিঙ্গপূজা করতো, অসভ্য বর্বর এক ধর্মবিশ্বাস ছিল তাদের। এখন ওসব কিছু নেই। ফ্রান্সেস্কো নিজেকে বোঝাতে লাগলো; কিন্তু স্বপ্নের মধ্যে সে দেখলো ঐ পাগান দেবতার লিঙ্গচিহ্নিত কাঠের টুকরো নয়, সে যেন তার পবিত্র ক্রুশটিকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলছে। তার মনে হতে লাগলো যেন শয়তানের দৃষ্টি পড়েছে তার উপরে। নাহলে এমন বীভৎস ব্যাপার সে দেখবেই বা কেন? স্বপ্নের মধ্যেই বা এমন অনাসৃষ্টি কাণ্ড ঘটবে কেন? 

ফ্রান্সেস্কো তার এই যাত্রার ফলাফল সম্পর্কে সবিস্তারে লিখে শুধুমাত্র মেয়রকে নয়, উর্ধতন চার্চের বিশপকেও জানিয়েছিল। জানিয়েছিল যে তার এই প্রচেষ্টা কতখানি সফল। বিশপ অত্যন্ত প্রীত হয়েছিলেন, কারণ ফ্রান্সেস্কো নীরবে চুপি চুপি কেবলমাত্র অভাগা মানুষদের প্রয়োজনের কাজ, সেবার কাজটা সেরে আসবার জন্য অতখানি দুর্গম পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে গিয়েছিল। তিনি লিখে জানিয়েছিলেন যে তিনি চাননা এই বিষয়ে বিশেষ কোনো শোরগোল উঠুক। বিশপ প্রীত হলেও, ফ্রান্সেস্কো শান্তি পাচ্ছিলনা। বিশপের প্রশংসা পেয়েও তার মন থেকে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর হচ্ছিলো না। সে কেবলই ভাবছিল যে, হয়তো বা সে শয়তানের কবলে পড়েছে। নিশ্চয়ই কেউ তাকে তুকতাক করেছে, নাহলে তার মনের এমন অবস্থা হবে বা কেন! 

লিগর্নেত্তো, যেখানে ফ্রান্সেস্কোর জন্ম এবং শিশুকালে বেড়ে ওঠা, সে একবার সেখানে যেতে চাইছিল। লিগর্নেত্তো, সেখানে তার কাকা থাকেন গত দশ বছর ধরে। তিনি একজন প্রসিদ্ধ ভাস্কর। এ ছাড়াও তিনি একজন ধর্মযাজকও বটে! তিনিই প্রথম ফ্রান্সেস্কোকে ধর্ম এবং আধ্যাত্মিক বিষয়ে আগ্রহী করে তুলেছিলেন। ফ্রান্সেস্কোর হঠাৎ মনে হল যে ঈশ্বরের কাছে যদি তার নিজের সমস্যা নিয়ে স্বীকারোক্তি করতে হয়, তাহলে তার কাছেই যেতে হবে তাকে। এ কথা ভেবেই সে একদিন রওনা দিল। সোয়ানা থেকে লিগর্নেত্তো প্রায় তিন ঘণ্টার দীর্ঘ পথ। কাকা তাকে দেখে খুশি হলেন এবং অবশ্যই ঈশ্বরের কাছে তার স্বীকারোক্তির অনুষ্ঠানের পৌরোহিত্য করতে রাজি হলেন। 

ফ্রান্সেস্কো বৃদ্ধ যাজককে সাক্ষী রেখে শুরু করলো তার অনুতপ্ত স্বীকারোক্তি। সে বলতে লাগলো, ‘আমি যখন থেকে সেই অভাগা পাপীদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছি সান্টা ক্রোশে আল্পসে, ঠিক তখন থেকেই মনে হচ্ছে আমি যেন বদলে গিয়েছি। এই বদলটা ঠিক আলখাল্লা বা পোশাক বদলানোর মত নয়। মনে হচ্ছে যেন আমার শরীরের চামড়া, খোলসটাই পুরোপুরি বদলে গেছে। আমি যখনই সোয়ানার জলপ্রপাতের শব্দ শুনছি, মনে হচ্ছে সব কাজ ফেলে উপত্যকায় ছুটে যাই, খাদের ধারে দাঁড়িয়ে শুনি জলের শব্দ, একদৃষ্টিতে দেখি প্রকৃতির সৌন্দর্য! মনে হচ্ছে সেই দৃশ্য কত পবিত্র, কত স্বাস্থ্যকর, হ্যাঁ, শারীরিক এবং মানসিক দুই ভাবেই প্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে। গির্জায় যখন ক্রুশচিহ্ন দেখছি, যখন আমার বিছানার পাশে ঝুলছে পবিত্র ক্রুশ, তখন অদ্ভুতভাবে আমার হাসি পাচ্ছে, মনে হচ্ছে এরকম একটা জড়বস্তু আমার তত প্রয়োজনীয় কিছু নয়। ঈশ্বরের পুত্র, পরম পরিত্রাতার কষ্ট অনুভব করে কেঁদে উঠছেনা আমার মন আগের মত। আমি যীশু প্রভুর দুঃখে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে পারছিনা, যে দুঃখ আমার অনুভবের অন্তস্থলে ছিল চিরদিন। অথচ, ছোট একটা টুনটুনি পাখির দিকে আমার চোখ যাচ্ছে; ঠিক যেন সেই অবোধ অশিক্ষিত লুসিনো স্কারাবোটার মত আমার মন প্রবলবেগে এদিকে ওদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। এরকম অদ্ভুত অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসবার জন্য আমি জপে, ধ্যানে, আধ্যাত্মিক পড়াশুনার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। মোটা ভারি পর্দায় ঢেকে রেখেছি আমার ছোট্ট ঘরের জানালাগুলি, যাতে পাখির ডাক, ঝর্ণার কুলুকুলু ধ্বনি, আমার গির্জাঘরের পেছনের পাহাড়ে বরফ গলে যাবার দৃশ্য, ড্যাফোডিলের সুগন্ধ, এসবে আমার মন বিচলিত না হয়। তবুও আমি মাঝে মাঝে লোভীর মত আমি দরজার উপরের পাল্লাগুলো হাট করে খুলে দিয়ে এসব কিছু উপভোগ করতে থাকি।’ 

- ‘এই সবকিছুতে আমি উদ্বেল, অনুতপ্ত। কিন্তু এগুলো প্রধান সমস্যা নয়!’ ফ্রান্সেস্কো বলে যায়, ‘এর থেকেও খারাপ জিনিস ঘটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ আমার উপরে কালা যাদু কিংবা তুকতাক করেছে। শয়তানের ভর হয়েছে আমার উপরে। শয়তান যেন আমাকে চিমটি কাটছে, ধাক্কা দিচ্ছে, সুড়সুড়ি দিচ্ছে, উস্কানি দিচ্ছে পাপাচারের জন্য। দিন রাতের প্রতি মুহূর্ত অসহনীয় হয়ে উঠছে। জানালা খুললেই ফুলে ফুলে ঢাকা চেরি গাছে বসে থাকা পাখিদের গান কানে ঢুকে আমায় অন্যমনস্ক করে দিচ্ছে। বৃক্ষশাখার আন্দোলন, গাছের আকার, পর্বতচূড়ার উত্তুঙ্গ শিখর, এসব কিছুর সঙ্গে যে মানবশরীরের মিল আছে, সেটা চোখে পড়ছে। নারীদেহের সঙ্গে মিল পাচ্ছি আমি। ঈশ্বরের প্রতি এত ভক্তি থাকা সত্ত্বেও আমি যেন এক প্রতারক, ভয়ঙ্কর, কুৎসিত দৈত্যের কাছে আমি আত্মসমর্পণ করেছি। আমার এত প্রার্থনা, এত উপাসনা, সবকিছু মিথ্যে হয়ে যেতে বসেছে। রহস্যময়ী প্রকৃতি যেন প্রতি মুহূর্তে আমাকে ধাক্কা দিয়ে চলেছে, গর্জন করে চলেছে, এক অদ্ভুত আকর্ষণে আমাকে টেনে নিতে চাইছে সেই আদিম নগ্ন দেবতার সামনে। প্রকৃতিই যেন আমায় নির্দেশ দিচ্ছে এক অদ্ভুত আদিম সুরের সঙ্কেতে, যাতে আমি ভীষণমূর্তি সেই কাঠের টুকরোটার সামনে নত হয়ে দাঁড়াই, যাকে ঐ মূর্খ অবোধ মেষপালক দেবতাজ্ঞানে পুজো করে।’ 

‘এই সবকিছু’... তরুণ যাজক থামতে পারেনা, ‘আমার উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমার কর্তব্য আল্পসের ঐ অঞ্চলে মানুষদের সেবা করা। কিন্তু মনে হচ্ছে আমি এক অসম যুদ্ধে নেমেছি। তবে এটাও আমার স্বীকারোক্তির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অংশ নয়। আমার পেশার অন্যতম অঙ্গ পাপীতাপীদের উদ্ধার করা। পাপীকে নয়, পাপকে ঘৃণা করো। এই জিনিসই জানি আমি। প্রভুর নির্দেশে চলেছি এতদিন। কখনো ক্লান্তি আসেনি, কখনো মনে হয়নি, যা করছি, ভুল করেছি কোথাও। মনে হয়েছে এক পবিত্র কাজ করেছি। কিন্তু সেই কাজে মনে হচ্ছে কোথাও ফাঁকি রয়ে গেছে। কোথাও যেন বিষাক্ত হয়ে উঠেছে এই সেবার ব্রত! আমি প্রভু যীশুর সেই হারিয়ে যাওয়া ভেড়া আর মেষপালকের কথামালার শিক্ষায় বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু আদিম পবিত্রতার মধ্যে যে মানুষ অথবা বস্তু রয়েছে, সে কি সত্যিই পথভ্রষ্ট? সে কি নষ্ট? আমার সন্দেহ জাগছে এবং প্রচণ্ড উৎসাহে এই প্রশ্নগুলো আমার মনের মধ্যে শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে চলেছে। আমি মাঝরাতে ঘুম থেকে জেগে উঠি, কান্নায় ভেসে যায় আমার মুখ, কী প্রবল দ্বন্দ্ব! সত্যিই কী ওরা পতিত, পাপী? এই প্রশ্ন আমার মনে জেগেছে স্কারাবোটা আর তার বোনের পাপকর্মের ফল কন্যাটিকে দেখে। মনে হয়েছে যে সত্যিই কি তারা উদ্ধারের অপেক্ষায় বসে আছে? নাকি তাদের সাহায্য করতে গিয়ে ঈশ্বরের পথ থেকে আমার পতন ঘটবে? তাদের সাহায্য করা কি আদৌ আমার কর্তব্য, নাকি একধরণের অনধিকারচর্চা!’ 

(চলবে) 

গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা 

0 comments: