প্রবন্ধ - অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধ
ছোটোবেলায়, মানে আশির দশকের শেষ ভাগে এক ধরনের দেয়াল ক্যালেন্ডার বিক্রি হতো দেখতাম। আমাদের বাড়িতেও একটা ছিল।ক্যালেন্ডারটির ঠিক মাঝখান ছিল সিংহাসনে উপবিষ্ট ঘন নীল রঙের যমরাজ এবং সিংহাসনের নীচে চিত্রগুপ্ত, যিনি বিশাল সাইজের একটা খাতা খুলে বসে দেখে নিচ্ছেন কোন্ মানুষ কী পাপ করেছে কী পুণ্য করেছে। সেই ক্যালেন্ডারে উপর, নীচ, ডান ও বামদিকে ছিল প্রায় চোদ্দটি উলঙ্গ নরনারীর ছবি। তাঁদের জহ্লাদরা অপরাধভেদে নিষ্ঠুরভাবে শাস্তি দিচ্ছেন। যেমন পরকীয়া শাস্তি দুদিকে দাঁতবিশিষ্ট দাঁড় করানো করাতে দু-দিকে নর ও নারীর শরীরের মাঝবরাবর চিরে দেওয়া হচ্ছে বা মিথ্যা কথা বলার অপরাধে বিশাল একটা সাঁড়াশি দিয়ে কারোর জিভ টেনে ছিঁড়ে দেওয়া হচ্ছে বা চুরি করার অপরাধে কারোর ডান হাত দেওয়া হচ্ছে ভয়ংকর এক চাপাতি দিয়ে ইত্যাদি। এইসব ক্যালেন্ডার এখন আর চোখে পড়ে না।
এখন কথা হলো, এই শাস্তিটা কোথায় হয়? নরকে, আরবি ভাষায় ইসলামীদের কাছে যা দোজখ বা জাহান্নম। নরকের ঠিকানা কী? এই ঠিকানা কেউ জানে না। কোনও ধর্মগ্রন্থেও সেই ভয়াল ভয়ংকর ঠিকানার সন্ধান পাওয়া যায় না। যেহেতু মানুষের মৃত্যুর পর পাপীরা শাস্তি ভোগ করে, সেহেতু কোনো মানুষের পক্ষেই ঠিকানা জানা সম্ভব হয়নি। তবে হিন্দুশাস্ত্র মতে নরক মৃত্যুদেবতা যমরাজেরই বাসস্থান। বলা হয়েছে এটি মহাবিশ্বের দক্ষিণে এবং পৃথিবীর নীচে অবস্থিত। বিষ্ণু পুরাণে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নরক মহাবিশ্বের নীচে অবস্থিত মহাজাগতিক সাগরের নীচে অবস্থিত। দেবীভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে যে, নরক মহাবিশ্বের দক্ষিণে, পৃথিবীর নিচে কিন্তু পাতালের উপরে অবস্থিত। ভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে নরক পৃথিবীর নীচে। পাতালের সাতটি স্তর এবং মহাবিশ্বের তল গর্ভোদক সাগরের মাঝামাঝি অবস্থিত। এটি মহাবিশ্বের দক্ষিণে অবস্থিত। পিতৃলোক, যেখানে অগ্নিকুভের নেতৃত্বে মৃত পূর্বপুরুষ (পিতৃগণ) বাস করে, এই অঞ্চলে অবস্থিত। নরকরাজ যম তাঁর সহকারীদের সঙ্গে বসবাস করেন। বিভিন্ন হিন্দু মহাকাব্যও একমত যে, নরক দক্ষিণদিকে অবস্থিত। পিতৃলোককে যমের রাজধানী হিসাবে ভাবা হয়েছে।
মানুষের মৃত্যুর পর যমদূত নামক যমরাজের দূতেরা তাঁদেরকে যমরাজের রাজসভায় নিয়ে আসে। যেখানে তাদের পাপ-পুণ্যের হিসাব করা হয় এবং দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। পুণ্যবানদের স্বর্গে এবং পাপীদের যে-কোনো একটি নরকে পাঠানো হয়, যেখানে যম তাঁর ন্যায়বিচার প্রদান করেন।
নরক হলো জনৈক অসুর। পৌরাণিক কাহিনিতে নরকাসুর নামে অভিহিত হয়ে থাকে। হিন্দুধর্মের একাধিক ধর্মগ্রন্থ। তাই বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্ন নামের ও সংখ্যার পাশাপাশি কোন্ প্রকারের পাপীকে কোন্ নরকে পাঠানো হবে তার ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। অগ্নি পুরাণে মাত্র ৪টি নরকের উল্লেখ আছে। মনুস্মৃতি ২১ প্রকার নরকের উল্লেখ করে। তবে ভাগবত পুরাণ, দেবী- ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ এবং গরুড় পুরাণ গ্রন্থগুলিতে ২৮ ধরনের ভয়ংকর নরকের কথা বলে। তাই এই ২৮ নরককেই মূল নরক হিসাবে গণ্য করা হয়। অপরাধভেদে নরকগুলোর নাম হলো –
(১) তামিস্র (অন্ধকার), (২) অন্ধতামিস্র (অন্ধত্বের অন্ধকার), (৩) রৌরব (রুরু নামক হিংস্র জন্তুর নরক), (৪) মহারৌরব (অতি হিংস্র), (৫) কুম্ভিপাক (পাত্রে ঝলসানো), (৬) কালসূত্র (সময়ের ধাগা বা মৃত্যু), (৭) অসিপত্রবন/অসিপত্রকানন (যে বনের পাতাগুলি তলোয়ারের মতো), (৮) শুকরমুখা (শুয়োরের মুখে), (৯) অন্ধকূপ (অন্ধকারময় কুয়ো, যার মুখটি লুকানো), (১০) কৃমিভোজন/কৃমিভক্ষণ (কৃমিদের আহার্য হওয়া), (১১) সন্দংশন/সন্দম্স (চিমটার নরক), (১২) তপ্তসুর্মি/তপ্তমূর্তি (তপ্ত লাল লৌহ মূর্তি), (১৩) বজ্রকণ্টকশাল্মলী (সুতির মতো মলিন বৃক্ষ, যা ধারণ করে বজ্রের মতো কাঁটা), (১৪) বৈতরণী (অতিক্রম), (১৫) পূয়োদা (পুঁজ মিশ্রিত জল), (১৬) প্রাণরোধা (জীবনের রোধ), (১৭) বিশসনা (হত্যাপ্রবণ), (১৮) লালাভক্ষ্য (লালা খাদ্য রূপে), (১৯) সারমেয়দান (সরমার হিংস্র পুত্রদের নরক), (২০) অভিশ্চি/অভিশ্চিমত (প্রবাহহীন, জলহীন), (২১) অয়হপান (লৌহ-পান), (২২) ক্ষারকর্দম (আম্লিক, লবণাক্ত কাদা), (২৩) রক্ষোগণভোজন (রাক্ষসদের খাদ্যে পরিণত), (২৪) শূলপ্রোত (তীক্ষ্ণ শূল বা বাণে বিদ্ধ), (২৫) দণ্ডসুক (সর্প), (২৬) অবাত-নিরোধনা (গহ্বরে আবদ্ধ), (২৭) পরয়াবর্তন (ফিরে যাওয়া), (২৮) সূচিমুখা (সূচবিদ্ধ মুখমণ্ডল)
এই ২৮ নরককেই মূল নরক হিসাবে গণ্য করা হয় হিন্দু শাস্ত্রে। এই প্রধান নরকগুলি ছাড়াও বিভিন্ন গ্রন্থে সহস্রাধিক অন্যান্য নরকের কথাও স্বীকার করা হয়েছে। নরকের শাস্তিগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শুধু মানুষদেরই শাস্তির কথা বলা হয়েছে। পৃথিবীতে মানুষ ছাড়াও যে কোটি কোটি প্রাণী বসবাস করে, তাদের কারোর শাস্তির ব্যবস্থা নেই। হয় সেইসব প্রাণীদের কথা শাস্তিদাতারা জানতেন না, নয়তো তাদের শাস্তির বিধান রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি। দুটো ধারণাই সঠিক। প্রথমত, ধর্মগ্রন্থগুলিতে গুটিকয়েক প্রাণীদেরই উল্লেখ পাওয়া যায়। ইসলামীয় ধর্মগ্রন্থগুলিতে যে প্রাণীদের কথা জানা যায়, সেই প্রাণীগুলি হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলিতে পাওয়া যায় না। অনুরূপ অন্য ধর্মগ্রন্থগুলিতেও সেইসব প্রাণীগুলি সম্বন্ধে জানা যায় না। কারণ ধর্মগ্রন্থগুলি অঞ্চলভিত্তিক। তাই কতিপয় প্রাণীর যা উল্লেখ আছে, তাও অঞ্চলভিত্তিক। দ্বিতীয়ত, মানুষ ছাড়া অন্য মানবেতর প্রাণীদের ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শোষণ করা সম্ভব নয়, যেটা মানুষের ক্ষেত্রে সম্ভব। আর শাস্তির যে বর্ণনাগুলি দেওয়া হয়েছে, সেগুলিও বড্ড বোকা বোকা। গঞ্জিকা সেবন না করে এই ধরনের যুক্তিহীন বর্ণনা করা সম্ভব নয়। চার্বাক বা অন্যান্য নাস্তিকবাদীরা স্বর্গ-নরকের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে, দেহ ভস্ম হলে স্বর্গ-নরকভোগ অসম্ভব।
যিনি এত স্বর্গ-নরকে এত কাণ্ডকারখানা করেন, সেই নরকরাজা যমের পরিচয় কী? যম হলো মৃত্যুর প্রতিশব্দ। হিন্দুদের তেত্রিশ দেবতাদের মধ্যে একমাত্র যমকেই প্রত্যক্ষ করতে পারে মানুষ। যদিও মৃত্যু হলো জৈব-রাসায়নিক বিক্রিয়ার পরিসমাপ্তি। তারপর আর কিছুই নেই। যে পাঞ্চভৌতিক উপাদানে প্রাণের সৃষ্টি, তার বিনিঃশেষ মিশ্রণ ঘটে গেছে পার্থিব ভৌত উপকরণ।
এ তো গেল বিজ্ঞান। কিন্তু বিশ্বাস যে যমের মূর্তি গড়ে তুলেছে! পশু প্রবৃত্তির মানুষই সমাজ-শৃঙ্খলা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যই পশুত্বের সংযমকে নির্দেশিত ও নিয়ন্ত্রিত করার জন্য একটি ‘সমাজ-শাসন কমিশন’ তৈরি করে নিয়েছে, যার মহাপরিচালক হলেন যম। অর্থাৎ, মানুষ নিজেরাই নিজেদের বিচারশালা তৈরি করেছে। ঋগ্বেদে ‘যম’ শব্দটি প্রায় ৫০ বার উল্লেখ আছে। ইনি দেবতাদের সঙ্গে একত্রে বসে সোমরস পান করলেও কোথাও দেবতা হিসাবে স্বীকৃত নন। ইনি মৃতদের পাপপুণ্যের বিচারক। পুরাণগুলিতেও যমের কথা উল্লেখ আছে। প্রসঙ্গত বলি, ঋগ্বেদের যম আর পুরাণের যম এক নয়। সভ্যতার বিবর্তনের সিঁড়ি বেয়ে উঠে এসেছে যম নামক ধারণা, সেইসঙ্গে গড়ে উঠেছে নরক ও শাস্তির কল্পিত পুরাকথা। ঋগ্বেদে আমরা যম ও যমী নামের যমজ ভাইবোনের কবিতাকারে কাহিনি পাই। যম-যমী বৃত্তান্ত বেদে বিবৃত হলেও এর উৎস ইন্দো-ইরানীয় ভাষায় মিথ বা লোকপুরাণে যিম ও যিমেহর (Yima and Yimeh) কাহিনিতে। সেখানে যিম ছিল স্বর্ণযুগের চন্দ্রদেবতা। পরে আবেস্তা এবং বেদের আমলে যথাক্রমে পৃথিবীর রাজা এবং ভূস্বর্গের অধিপতি বলে পরিচিত হল ইন্দো-ইরানীয় যিম এবং বৈদিক যম। ইন্দো-ইরানীয় লোকপুরাণে যিম এবং যিমেহ যমজ ভাইবোন। বেদের যম ও যমী বাবা ও মা গন্ধর্ব এবং জলের অপ্সরা অপ্যাযোষা। নরসিংহপুরাণের ১৩ অধ্যায়ে ব্যাস বলেছেন, বিবস্বতের পুত্র আর তাঁর অনুজা যমী। তাঁদের মা অদিতি। যমীর ভাষায় – “যম একমাত্র মরণশীল মানুষ”। ঋগ্বেদের এক মন্ত্রে (১০.১৩.৪) বলা হয়েছে – যম মরণ বরণ করে দেহত্যাগ করেছে। অথর্ব বেদের মন্ত্রেও (১৮.৩.১৩) বলা হয়েছে – “যমই প্রথম মর্ত্যবাসী, যাঁর মৃত্যু হয়েছিল”। এ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, যম বেদের সময়ে মৃত্যুর দেবতা হয়ে ওঠেননি। তাঁকে মর্যাদা দেওয়া হয়েছে ভারতীয় লোকপুরাণে প্রথম ‘মানুষ’ হিসাবে।
মহাভারত ও পুরাণে মৃত্যুর দেবতা যম ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, রক্তবসন পরিহিত এবং মহিষারূঢ় রূপে বর্ণিত। হিন্দুর ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে যম অশুভ দেবতা। কারণ মৃতব্যক্তিকে তিনি কেবল নরকেই আহ্বান করেন, স্বর্গে নয়। পিতৃলোকের আনন্দপূর্ণ বাসস্থানেও যম অবস্থান করে না। তাঁর একমাত্র কর্মস্থল নরক, যেখানে পাপীদের চরম শাস্তি প্রদান করা হয়। তিনি যেমন মৃত্যুর দেবতা, তেমনই আবার মৃত্যুর অন্ধকারাচ্ছন্নও ভয়াবহ দক্ষিণদিকেরও দিকপাল। ঋগবেদে যমের প্রশংসা করে বলা হয়েছে – “যিনি কী পুণ্যবান কী পাপী সকলেরই গন্তব্য মার্গের পরম সহায়, যিনি বিবস্বানের প্রশংসনীয় পুত্র। যিনি পক্ষপাতহীন হৃদয়ে কর্মফল অনুসারে জীবগণ এ-লোক হইতে লোকান্তরে যাইবার উপযুক্ত শরীর দান করিয়া থাকেন, যিনি প্রাণধারী জীবমাত্রেরই রাজা বলিয়া বিখ্যাত সেই যম নামক দেবতাকে হবিঃ প্রদান দ্বারা পূজা করো।” (দশম মণ্ডল) তবে যম কেবল ভারতে তথা হিন্দুদের বিশ্বাসেই আছে, তা কিন্তু নয়। যমদেবতাকে ‘যমরাজ’ বলেও সম্ভাষণ করা হয়। কৃষ্ণের অষ্টোত্তর নামের মতো যমেরও অনেক নাম। কয়েকটা নাম এখানে উল্লেখ করি। যেমন – কালান্তক, অন্তক, কৃতান্ত, শমন, সংযম, দণ্ডধর, কাল ইত্যাদি। বিভিন্ন দেশে বা সভ্যতায় বিভিন্ন নামে পাওয়া যায়। যেমন – মিশরের মৃত্যুদেবতা সেকের এবং মিশরীয় মৃত্যুলোক বারোটি প্রদেশে বিভক্ত, কেলটীয় সংস্কৃতিতে যমদেবতা হলেন বেলি এবং যমলোকের নাম অ্যানয়্যফন, উত্তর ইউরোপের যমদেবী হেল, প্রাচীন গ্রিসের মৃত্যুদেবতা হলেন হেদিস, মায়া সভ্যতায় মৃত্যুদেবতার নাম ড্রেসডেনকোডেক্সে ‘A’, আজটেক পুরাণে মৃত্যুদেবতার নাম মিকটল্যান, প্রাচীন সভ্যতা ইনকাদের প্রেতলোকের অধিষ্ঠাতার নাম সুপেঈ ইত্যাদি।
ফিরে আসি আমাদের সেই কষ্টকল্পিত নরকে। “কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর মানুষের মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর।” মানুষ পার্থিব জগতের বাইরেও মৃত্যুর পরে এক নতুন জগৎ কল্পনা করে, যা স্বর্গ ও নরকের সমন্বয়ে গঠিত। ধর্মীয় চিন্তা থেকে মানুষ পাপ-পুণ্য, ন্যায়-অন্যায়ের হিসাব করে থাকে। আর এই অনুভূতি থেকেই স্বর্গ ও নরক লাভের কথা ভাবে। মৃত্যুর পরে স্বয়ং যম, অথবা যমদূতেরা এসে পরলোকে নিয়ে যান মৃত ব্যক্তির আত্মাকে। জীবদ্দশায় সেই ব্যক্তির কৃতকর্মের উপর ভিত্তি করে মৃত্যুর পরে তাঁর স্থান নরকে হবে, নাকি স্বর্গে তা স্থির করেন যমরাজ।
মৃত্যুর আগেই যমরাজ মানুষকে চারটি চিঠি পাঠান, যেগুলোতে নিহিত থাকে ব্যক্তির আসন্ন মৃত্যুর লক্ষণ। পুরাণের সেই যম-অমৃতের কাহিনি বলছে -- একদা যমুনা তীরবর্তী একটি গ্রামে থাকতেন অমৃত নামের এক ঈশ্বরভক্ত মানুষ। তিনি ছিলেন মৃত্যুভয়ে ভীত। তাঁর পরিকল্পনা ছিল, যমকে খুশি করে তিনি অমর হবেন। যমকে সন্তুষ্ট করার জন্য কঠোর তপস্যা শুরু করেন তিনি। যম তাঁর তপস্যায় খুশি হয়ে দেখা দিলেন অমৃতকে। যম বললেন -- ‘‘শোনো, জীবদ্দশায় আমার দেখা কেউ পায় না। তুমি পেয়েছ। বলো, কী চাও?’’ অমৃত বললেন, ‘‘ঠাকুর, আমি অমর হতে চাই।’’ যম বললেন, ‘‘মৃত্যু থেকে কারও মুক্তি নেই। যে জন্মেছে তাকে মরতে হবেই। তবে তোমার ইচ্ছার কথা মাথায় রেখে আমি তোমাকে একটি প্রতিশ্রুতি দিলাম। তোমার মৃত্যু যে আসন্ন তা বোঝাতে তোমাকে চারটি চিঠি আমি পাঠাব। সেই চিঠিগুলি পাওয়ার পর তুমি নিজেকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করো।’’ অমৃত নিশ্চিন্ত হয়ে ধর্মকর্ম সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে বিলাসব্যসনে মত্ত জীবনযাপন শুরু করলেন। তাঁর কোনও চিন্তাই রইল না মৃত্যু নিয়ে। তিনি নিশ্চিন্ত রইলেন যে, মৃত্যুর আগাম ইঙ্গিত যমরাজের কাছ থেকে তিনি নিশ্চয়ই পাবেন। বয়স বাড়তে থাকল তাঁর। একসময় তাঁর মাথার চুল পেকে গেল। আরও পরে দাঁত পড়ে গেল তাঁর। তারপর চোখের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসা শুরু হলো। একসময় বয়সের ভারে একেবারে নিশ্চল হয়ে গেলেন তিনি। তখনও তাঁর কাছে যমরাজের চিঠি এসে পৌঁছল না কোনও। নিশ্চিন্ত হয়ে দিনযাপন করতে লাগলেন অমৃত। কিন্তু একদিন রাত্রে হঠাৎ যমদূত এসে হাজির হলো অমৃতের সামনে। তিনি বুঝলেন, তাঁর মৃত্যুর সময় হয়ে গিয়েছে। যমদূতের সঙ্গে তিনি চললেন পরলোকে। মনে তখন যমরাজের প্রতি একরাশ ক্ষোভ তাঁর। যমরাজ তাঁকে কথা দিয়েছিলেন, মৃত্যুর আগে চারটি চিঠি পাঠাবেন তাঁকে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটি চিঠিও পাঠাননি। যমরাজের সামনে উপনীত হওয়ার পর তিনি উগরে দিলেন তাঁর ক্ষোভ — ‘‘আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন, মৃত্যুর আগে চারটি চিঠি পাঠাবেন। কিন্তু আপনি তা করেননি। কথা রাখেননি আপনি।’’ যমরাজ হেসে বললেন, ‘‘তুমি কি ভেবেছিলে, আমি কাগজের উপরে নিজে হাতে চিঠি লিখে তোমাকে পাঠাব? মূর্খ তুমি। শোনো, তোমার শরীরই ছিল আমার কাগজ, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তোমার শারীরিক পরিবর্তনগুলো ছিল আমার কলম, আর সময় ছিল আমার বার্তাবাহক। আমি তোমাকে আমার কথামতো চারটি চিঠিই পাঠিয়েছিলাম। তোমার চুল পেকে যাওয়ার ঘটনা ছিল আমার প্রথম চিঠি। তোমার দাঁত পড়ে যাওয়ার ঘটনা আমার দ্বিতীয় চিঠি। যখন তোমার দৃষ্টিশক্তি কমে আসা শুরু হলো, তখন তুমি পেলে আমার তৃতীয় চিঠি। আর চতুর্থ চিঠিটি তুমি পেয়েছিলে, যখন তুমি পঙ্গু হয়ে গেলে। কিন্তু তোমার দুর্ভাগ্য, তুমি আমার পাঠানো একটি চিঠিরও পাঠোদ্ধার করতে পারোনি।’’
শুধু হিন্দুধর্মেই নয়, নরকের ব্যবস্থা সব ধর্মেই বলা হয়েছে। নরকে কঠিন শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে বাইবেলেও। বাইবের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বাইবেল পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। বাইবেল অনুসারে, স্বর্গের মতো নরকও একটি বাস্তব বিষয়। বাইবেল সম্পূর্ণভাবে ও সুস্পষ্টভাবে শিক্ষা দেয় যে, নরক হচ্ছে একটি বাস্তব বা অকৃত্রিম জায়গা, যেখানে খারাপ বা অবিশ্বাসীদের মৃত্যুর পরে পাঠানো হবে। আমরা সকলেই ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পাপ করেছি (রোমীয় ৩:২৩ পদ)। এই পাপের একমাত্র শাস্তি হলো মৃত্যু (রোমীয় ৬:২৩ পদ)। যেহেতু চূড়ান্তভাবে আমাদের সমস্ত পাপ ঈশ্বরের বিরুদ্ধে (গীতসংহিতা ৫১:৪ পদ) এবং যেহেতু ঈশ্বর হলেন অসীম ও অনন্ত, সেহেতু তাঁর বিরুদ্ধে করা পাপের শাস্তিও হবে অসীম ও অনন্ত। নরক হল এই অসীম এবং অনন্ত মৃত্যু, যা আমরা আমাদের পাপের কারণে পেয়ে থাকি।
খারাপ বা মন্দ লোকদের জন্য নির্ধারিত একমাত্র শাস্তি যে নরক-মৃত্যু সেটিকে বাইবেলের সমস্ত অংশ জুড়ে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে – ‘অনন্ত আগুন’ (মথি ২৫ : ৪১ পদ), ‘অনির্বাণ আগুন’ (মথি ৩ : ১২ পদ), ‘লজ্জা ও অনন্ত ঘৃণা’ (দানিয়েল ১২ : ২ পদ)। নরক এমন একটি স্থান যেখানে ‘আগুন কখনও নিভানো যায় না’ (মার্ক ৯ : ৪৪-৪৯ পদ), ‘যন্ত্রণা এবং অগ্নিশিখা’ (লুক ১৬ : ২৩-২৪ পদ)-র একটি স্থান, ‘অনন্তকালস্থায়ী বিনাশ’ (থিষলনীকীয় ১ : ৯ পদ), এমন একটি স্থান যেখানে ‘যাতনার ধূম যুগপর্যায়ের যুগে যুগে ওঠে’ (প্রকাশিত বাক্য ১৪ : ১০-১১ পদ) এবং ‘অগ্নি ও গন্ধকের হ্রদ’ যেখানে দুষ্ট লোকেরা ‘চিরকাল ধরে দিনরাত যন্ত্রণা ভোগ করবে’ (প্রকাশিত বাক্য ২০ : ১০ পদ)।
পাপীদের আত্মা শেষ বিচারের দণ্ডের জন্য প্রস্তুত হয় এবং শেষে একদিন তাদের বিচার হয়৷ বিচারের দিন পবিত্র আত্মা জিশুখ্রিস্ট স্বর্গ থেকে মর্ত্যে অবতরণ করবেন। স্বর্গীয় বেশে সুসজ্জিত হয়ে এবং স্বর্গীয় দূত ও পরিষদবর্গের দ্বারা পরিবৃত হয়ে একপর্যায়ে তিনি বিচারাসনে উপবিষ্ট হবেন৷ সেদিন মৃতগণ কবর থেকে উত্থিত হবে বিচারের সম্মূখীন হতে হবে৷ বিচারে দণ্ডপ্রাপ্ত পাপীগণ চিরপ্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হবে। খ্রিস্ট মতে, বিচারকর্তা স্বয়ং ঈশ্বর নয়, জিশুই হবেন শেষ বিচারের বিচারকর্তা।
ইহুদি ধর্মেও নরকের উল্লেখ আছে। ইহুদিদের জুডাইজম ধর্মমতেও খ্রিস্টধর্মের মতো মানুষের মৃত্যুর পর বিচারের একটি শেষদিন নির্দিষ্ট করা আছে৷ সেই দিন মৃতদের আত্মার পুনরুত্থান ঘটবে এবং তাদের জীবিতকালের পাপ-পূণ্যের বিচার করা হবে৷ ইহুদিদের আত্মাকে একটি নির্দিষ্ট সেতু পার হতে হবে এবং তুলাদণ্ডে পরিমাপ করে তার পাপ-পূণ্যের বিচার৷ সেতু অতিক্রমে ব্যর্থরা নিচের নরক নদীতে পতিত হবে এবং শাস্তি ভোগ করবে। তবে ইহুদিদের মতে মানুষের পাপ-পুণ্যের পরিমান দুটি গ্রন্থে লিপিবদ্ধ থাকে এবং তা তুলাদণ্ডের দুদিকে স্থাপন করে প্রতিজনের পাপ-পুণ্যের পরিমাণ নির্ধারণ করে যে দিকে পাল্লা ভারি হবে, সেঈ অনুযায়ী পাপীদের শাস্তি ব্যবস্থা হবে। ভোগ করতে হবে নরক-যন্ত্রণা, অনন্তকাল৷ ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ ইসাইয়া, এজিকিল, ডেনিয়েল ও যব ইত্যাদিতেও মৃত্যুর পরে পুনরুত্থানের বিষয়ের উল্লেখ আছে৷
চিন দেশেও কনফুসিয়াস বা অন্যান্য ধর্মমতেও নরকের কথা বলা হয়েছে। চিনের ধর্মমতানুসারে ন্যায়-অন্যায় ও পাপ-পূণ্যের বিচারের ব্যাপার, পুরস্কারের ও শাস্তির কথাসহ অনেক কিছুর উল্লেখ ছিল। ‘সু কিং’ নামক গ্রন্থটি চিনদেশের প্রাচীন গ্রন্থ বলে পরিচিত, যা কনফুসিয়াস সংকলন করেন৷ সেই গ্রন্থে মৃত্যুর পরে স্বর্গ-নরকের ব্যাপারে সুষ্পষ্ট কোনও কিছুর উল্লেখ নেই৷ তবে কনফুসিয়াস এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘যেখানে বর্তমান জীবনের বিষয়েই আমরা অবগত নই, তাই মৃত্যুর পরে কী হবে, তা কে বলতে পারবে’? তাঁর দর্শনানুসারে দেহাংশ পঞ্চভূত, পঞ্চভূতে মিশে যাবে এবং অশরীরী আত্মা সংসারে অদৃশ্য আকারে উপস্থিত থেকে আপন সংসার ও জগতের মঙ্গল সাধন করতে থাকবে। মানে মানুষের শারীরিক মৃত্যু হবে, তবে তার আত্মার মৃত্যু নেই, তাই কনফুসিয়াস প্রলয়ান্তে পুনরায় সৃষ্টি বা পরলোক বিষয়ে কোনও স্পষ্ট বক্তব্য দিয়ে যাননি তার প্রবর্তিত ধর্মে৷
কনফুসিয়ান ধর্মের মতো বৌদ্ধধর্মও অনুরূপ স্বর্গ-নরকের কোনো ধারণা আমরা পাচ্ছি না। বৌদ্ধ ধর্মমতে পৃথিবীর কোনও সৃষ্টিকর্তা নেই৷ অতএব কোনও অনস্তিত্ব কর্তৃক শাস্তি-পুরস্কারের দায়িত্বভার অর্পণ হয়নি। তাই নেই স্বর্গের আরাম, নেই নরকের যন্ত্রণা। বৌদ্ধমতে জগত অনন্তকাল থেকে বিদ্যমান আছে এবং অনন্তকাল এভাবেই থাকবে৷ বৌদ্ধধর্ম অনুসারে বিশ্বের আকৃতি চিরকালই এক রূপ আছে এবং আগামীতেও একই রূপে থাকবে৷ কর্ম অনুসারে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী সংসারে ঘুরে বেড়াচ্ছে মাত্র৷ বৌদ্ধ ধর্মে স্বর্গ, নরক, দেবদূত, ফেরেসতা, নবি বা পয়গম্বর, শয়তান, ইবলিস এবং শেষ বিচার, শেষের সে দিন -- কোনও বিষয়ই উল্লেখ নেই। তবে বুদ্ধ পরকাল সম্বন্ধে অনেক কিছুই বলে গেছেন। বলেছেন -- পরকাল নির্ভর করে মানুষের ইহজন্মের কর্মের উপর। মৃত্যুর পর মানুষ ৩১ লোকভুমির যে-কোনও একটিতে গমন করে। এই ৩১ লোকভুমি হল চার প্রকার অপায় : তীর্যক (পশু-পাখি কুল), প্রেতলোক (প্রেত-পেত্নী), অসুর (অনাচারী দেবকুল), নরক (নিরয়)। সাত প্রকার স্বর্গ : মনুষ্যলোক, চতুর্মহারাজিক স্বর্গ, তাবতিংশ স্বর্গ, যাম স্বর্গ, তুষিত স্বর্গ, নির্মাণরতি স্বর্গ, পরনির্মিত বসবতি স্বর্গ। রূপব্রহ্মভূমি ষোলো প্রকার, অরূপব্রহ্মভূমি চার প্রকার। যেমন -- (১) আকাশানন্তায়তন, (২) বিজ্ঞানান্তায়ন, (৩) আকিষ্ণনায়তন, (৪) নৈবসংজ্ঞা-না-সংজ্ঞায়তন = মোট ৩১ প্রকার। এই ৩১ প্রকার লোকভুমির উপরে সর্বশেষ স্তর হচ্ছে নির্বাণ (পরম মুক্তি ) যেমন -- ইহজন্মে মানুষ যদি মাতৃহত্যা, পিতৃহত্যা, গুরুজনের রক্তপাত ঘটায় তাহলে মৃত্যুর পর সেই মানুষ চার অপায়ে ( তীর্যক, প্রেতলোক, অসুর, নরক) জন্মগ্রহণ করে, আর ইহজন্মে মানুষ যদি ভালো কাজ করে তাহলে মৃত্যুর পর সেই মানুষ বাকি ২৭ লোকভুমিতে গমন করে। নরক বলতে লোকন্তরিক নরক। তিন চক্রবাল পর্বতের মধ্যস্থলে ত্রিকোণাকৃতি ৬৮ হাজার যোজন বিস্তৃত নরককে লোকন্তরিক নরক বলে। এই নরক ঘন অন্ধকারে আবৃত। নিম্নদেশ তীব্র ক্ষার জলে পূর্ণ। এই নরকে উপর আচ্ছাদনহীন এবং তলদেশ বর্জিত। সুতরাং এর উপরে এবং এর নীচে পৃথিবীর সন্ধারক শীতলতর তীব্র ক্ষারজল। এই নরকে সূর্যালোক না-থাকাতে নারকীয় প্রাণীদের চক্ষু নেই। তাদের হাতে-পায়ে সুতীক্ষ্ণ নখ আছে। নখ দিয়ে প্রাণী সকল চক্রবাল পৃষ্ঠে বাদুরের ন্যায় অবস্থান করে। নখ দিয়ে একে অপরকে আক্রমণ করে। যারা আনন্তরিক কর্ম করে, তারা এই নরক ভোগী হয়ে থাকেন।
প্রাচীন ইরানীয় ধর্মমতে, ঋষি বা ধর্মগুরু জরাথুস্ট্র ‘জেন্দ আবেস্তা’ নামক গ্রন্থটি পেয়েছিলেন ইরানীয় দেবতা অহুর মাজদার কাছ থেকে। ইরানীয় দেবতা অহুর মজদা একেবারে নিরাকার ব্রহ্ম ছিলেন না, তকে ব্যক্তিসত্তার অধিকারী এক স্বর্গবাসী দেবতা মনে করা হত৷ জেন্দ আবেস্তা অনুসারে মানুষের মৃত্যুর পর জীবিতকালের পাপ ও পূণ্যের দণ্ড ও পুরস্কারের বিধান ছিল৷ তবে তার আগে প্রথমে মৃতের দেহকে এক দানব অধিকার করে নেবে, আর আত্মাকে বিভিন্ন পরীক্ষার পরে এক পর্যায়ে এসে আত্মার মাঝে জ্ঞানের সঞ্চার হবে, তখন আত্মাকে ‘চিন্দভাদ’ নামক এক পুল (ব্রিজ) পার হতে হবে৷ পুণ্যবানরা সেই পুল পার হয়ে গিয়ে দেবতার কাছে পৌঁছে যাবে। আর যারা পুল পার হতে ব্যর্থ হবে, তারা পাপী। অর্থাৎ যে জীবিতকালে পাপ কার্য করেছে, সে নরককুণ্ডে পতিত হয়ে অনন্তকালের শাস্তি ভোগ করতে থাকবে৷ তবে উপাসনা দ্বারা এবং স্বর্গ লাভপ্রাপ্ত বন্ধু-বান্ধবের মধ্যস্থতায় কারও কারও নরকভোগের সময় হ্রাসপ্রাপ্তের বিধানেরও ছিল৷
প্রাচীন মিশরীয়রা প্যাপিরাস বা সমাধিগাত্রে মৃত ব্যক্তিদের জীবন সংক্রান্ত বিভিন্ন কথা লিখে রাখার প্রচলন ছিল৷ পরে একসময় সেই সব লেখা সংকলন করে ‘আমদুয়াত গ্রন্থ’, ‘ফটকের গ্রন্থ’ এবং ‘মৃতের গ্রন্থ’ নামে তিনটি গ্রন্থ রচিত হয়৷ মৃতের গ্রন্থের বর্ণনায় দেখা যায় যে, প্রত্যেক মৃতকে পরমেশ্বরের কাছে একটা শপথ বা এফিডেভিট দিয়ে জীবিত কালে তার পাপ পূণ্য কাজের হিসেব দিতে হবে৷ পরে ঐ সত্যপাঠের সত্য মিথ্যা যাচাই করবেন জ্ঞানের দেবতা ‘থৎ’ এবং ‘হোরাস’ ৷ মৃতের হৃৎপিণ্ড দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা হবে ৷ বিচারের বর্ণনায় দেখা যায় যে, দুইটি দ্বার দিয়ে স্বর্গ ও নরককুণ্ডে প্রবেশ করতে হবে৷ পাপাত্মাদের নরককুণ্ডে পাঠিয়ে পিলারের সঙ্গে বেঁধে জ্বলন্ত আগুনে পোড়ানো বা গভীর সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হবে৷
স্বর্গে যেমন ধার্মিকদের পরম সুখভোগ যেমন কখনই শেষ হবে না, তেমনি পাপী মানুষদের জন্য শাস্তিস্বরূপ অনন্ত নরক যন্ত্রণাও কখনও শেষ হবে না। জিশু নিজেই ওই নরক-যন্ত্রণা ভোগের শাস্তিকে যেভাবে বর্ণনা করেছেন -- স্বর্গে ঈশ্বরভক্ত লোকেরা যেমন অনন্ত জীবন ভোগ করবে, ঠিক একইভাবে পাপী মানুষরাও নরকে অনন্ত শাস্তি ভোগ করবে (মথি ২৫:৪৬ পদ)। পাপী মানুষরা চিরকালই ঈশ্বরের প্রচণ্ড ক্রোধ এবং রোষের পাত্র হিসাবেই বিবেচিত। নরকে নিক্ষিপ্ত ওই পাপী লোকেরা ঈশ্বরের ন্যায়বিচারের কথা স্বীকার করবে (গীতসংহিতা ৭৬:১০ পদ)। যাদের নরকে নিক্ষিপ্ত করা হবে, তারা জানবে যে, তাদের কাজের ফলস্বরূপ এই শাস্তি পাওয়াটা সঠিক, তাই তাদের দোষী করে এখানে নিক্ষেপ করা হয়েছে (দ্বিতীয় বিবরণ ৩৫:৩-৫ পদ)। অবশ্য কারণ জিশুর মধ্য দিয়ে আমরা এই অনন্ত ভাগ্য বা নিয়তি অর্থাৎ অনন্ত নরক-যন্ত্রণা ভোগ করা থেকে রক্ষা পেতে পারি (যোহন ৩:১৬, ১৮, ৩৬ পদ)।
হিন্দুধর্মে যেটা নরক, ইসলাম ধর্মে সেটাই জাহান্নাম বা দোজখ। জাহান্নাম সেই আগুনের বাসস্থানকে বলে, যেখানে রেখে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাঁর অবাধ্যদের শাস্তি দেবেন। ফারসি ভাষায় যাকে ‘দোজখ’ বলা হয়। নবি বললেন, “একদা জান্নাত ও জাহান্নামের বিবাদ হলো। জাহান্নাম বলল, “আমার মধ্যে উদ্ধত ও অহংকারী লোকেরা থাকবে।”আর জান্নাত বলল, “দুর্বল ও দরিদ্র ব্যক্তিরা আমার ভিতরে বসবাস করবে।” অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাদের মধ্যে ফায়সালা করলেন যে. “তুমি জান্নাত আমার রহমত, তোমার দ্বারা আমি যার প্রতি ইচ্ছা অনুগ্রহ করব। আর তুমি জাহান্নাম আমার শাস্তি, তোমার দ্বারা আমি যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেব। আর তোমাদের উভয়কেই পরিপূর্ণ করা আমার দায়িত্ব”
ইসলাম ধর্মে জান্নাত একটি, সেই জান্নাতের দরজা আটখানি (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৯৫৭)। আটটি জান্নাতের নাম হলো –(১) জান্নাতুল ফেরদাউস (২) দারুসসালাম (৩) দারুল খোলাদ (৪) দারুল মোকাত (৫) জান্নাতুল মাওয়া (৬) জান্নাতুন নায়ীম (৭) জান্নাতের আদন (৮) দারুল আকার। জাহান্নামও একটি, যার দরজা সাতখানি (হিজর ১৫/৪৩)। সাতটি জাহান্নামের নাম হলো – (১) জাহান্নাম (২) লাজা (৩) হুত্বামাহ (৪) সাঈর (৫) সাক্বার (৬) জাহিম (৭) হাবিয়াহ। দোজখের প্রথম স্তরে থাকবে গোনারগার মুসলিমরা, দ্বিতীয় স্তরে ইহুদিরা, তৃতীয় স্তরে খ্রিস্টানরা, চতুর্থ স্তরে সাবায়ীরা, পঞ্চম স্তরে মজুসি বা অগ্নিপূজকরা, ষষ্ঠ স্তরে পৌত্তলিকরা এবং সর্বনিম্ন সপ্তম স্তরে থাকবে মুনাফিকরা। কী আছে এই স্তরগুলিতে? দোজখের শাস্তিগুলি কতটা যন্ত্রণাদায়ক তার উপর ভিত্তি করেই স্তরবিন্যাস। অর্থাৎ প্রথম স্তরে তুলনামূলক কম যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি থেকে ধাপে ধাপে যন্ত্রণা বৃদ্ধি করা হয়েছে যথাক্রমে সপ্তম স্তর পর্যন্ত। গোনাহগারী মুসলমান হলে আল্লাহ তাদের জন্য তুলনামূলক কম যন্ত্রণাদায়ক দোজখ নির্দিষ্ট করেছেন। কিন্তু অমুসলিম বা বিধর্মীদের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কঠিনতম যন্ত্রণাদায়ক দোজখ। তবে নির্দিষ্টভাবে কোনও স্তরের নাম কোরান বা হাদিসে বর্ণিত হয়নি। তবে অন্যভাবে তো উল্লেখ আছেই। যেমন ‘জাহান্নাম’ শব্দটি কোরানে ৭৭টি স্থানে উল্লেখ আছে। জাহান্নামের এই স্তরবিন্যাসগুলি কোরান-হাদিসে উল্লেখ না-থাকলেও যিনি এগুলি করেছেন, তিনি যে কতটা দুষ্টবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি, তা স্তরবিন্যাসের ধরন দেখলেই অনুধাবন হয়। অর্থাৎ এই ধরনের স্তরবিন্যাসই প্রমাণ করে অমুসলিম বা বিধর্মী হলে তার শাস্তি হবে কঠিন থেকে কঠিনতম। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে বা মুসলমান হয়ে গেলে তার শাস্তি লঘু হয়ে যাবে। এটা হলো এক ধরনের প্যান-ইসলামিক চক্রান্ত।
দোজখ বা জাহান্নামে ফেরেস্তাদের সংখ্যা ১৯, যাঁরা জাহান্নামের তত্ত্বাবধানে আছেন। জাহান্নামের আয়তন কত? বিশাল, সবটাই অগ্নিকুণ্ড। জাহান্নামের আগুনের রং হলুদ বা লাল নয়, কুচকুচে কালো। জাহান্নামবাসীদের গায়ের রংও বীভৎস কৃষ্ণকায় হবে। জিন ও মানুষ মিলিয়ে অগণিত কোটি সংখ্যক জাহান্নামে স্থান পাবে।আবার কোনো কোনো জাহান্নামির দেহ এত বিরাট হবে যে, তার দাঁতটাই হবে উহুদ পাহাড়ের সমান। দুই কাঁধের ব্যবধান হবে তিনদিনের পথ। উহুদ পাহাড়ের দৈর্ঘ্য প্রায় ৭ কিলোমিটার, প্রস্থ প্রায় ২ থেকে ৩ কিলোমিটার এবং উচ্চতা ৩৫০ মিটার। জাহান্নামের দরজা সাতটি। সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীদের জাহান্নামের দিকে দলে দলে নিয়ে যাওয়া হবে। তারপর জাহান্নামে ঢুকিয়ে দিয়ে সমস্ত দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। সেখান থেকে বাইরে বেরনোর কোনো পথই থাকবে না। জাহান্নামের ইন্ধন হবে এক শ্রেণির মানুষ ও এক শ্রেণির পাথর।
জাহান্নামের আগুন কত গরম ও জ্বালাময় হবে, সে কথা কোরানের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ আছে। অপরাধের পাল্লা যার বেশি হবে, তার স্থান হবে হাবিয়াহ জাহান্নামে।যাদের বাঁ হাতে আমলনামা দেওয়া হবে, তারা থাকবে অতি গরম বায়ু ও উত্তপ্ত জলে। যারা কিয়ামতকে মিথ্যা মনে করে, তাদের জন্য “আমি জ্বলন্ত জাহান্নাম প্রস্তুত রেখেছি। দূর থেকে জাহান্নাম যখন ওদের দেখবে, তখন ওরা তার ক্রুদ্ধ গর্জন ও চিৎকার শুনতে পাবে।(ফুরক্বান ১১-১২) প্রতিপালককে অস্বীকার করলেও তার স্থান হবে জাহান্নামে। তাদের জন্য জাহান্নামের শাস্তি। যখন তারা সেই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে, তখন শুনতে পাবে জাহান্নামের গর্জন, আর তা উদ্বেলিত হবে। রোষে জাহান্নাম ফেটে পড়বে। “যারা (কাফের) অবিশ্বাস করে ও আমার নিদর্শনকে মিথ্যাজ্ঞান করে, তারা জাহান্নামের অগ্নিবাসী, সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। প্রত্যেক কাফের মুশরিক নাও হতে পারে। তবে প্রত্যেক মুশরিক অবশ্যই কাফের। সাধারণভাবে কুফরি এমন এক অপরাধ, যার জন্য চিরস্থায়ী জাহান্নাম ভোগ করতে হবে। কুফরি মানে অস্বীকার, অবিশ্বাস -- আল্লাহকে অবিশ্বাস অথবা আল্লাহর কিছুকে অবিশ্বাস। কোরানে আল্লাহ বলছেন – “নিশ্চয় যারা আমার আয়াতসমূহকে অবিশ্বাস করে, তাদেরকে আমি অচিরেই আগুনে প্রবিষ্ট করব। যখনই তাদের চামড়া দগ্ধ হবে, তখনই ওর স্থলে নতুন চামড়া সৃষ্টি করব, যাতে তারা শাস্তি ভোগ করতে থাকে। (নিসা ৫৬) কপটতা বা মুনাফিকির কুফরি. আদেশ-নিষেধ অমান্য করার কুফরি ইত্যাদি। অর্থাৎ, এই বিধানের বলে ইসলামী আল্লাহ অমুসলমানদেরও জাহান্নামে পাঠানোর অনধিকার প্রবেশ করে ফেলেছেন। কারণ অমুসলমানরা আল্লাহ বা আল্লাহর যা কিছু অবিশ্বাস করে, কুফরি। তবে ইসলাম দাবি করেছে, জাহান্নামে অধিকাংশ বাসিন্দাই নারী। নবি বলছেন, “আমি বেহেস্তের মধ্যে তাকিয়ে দেখলাম অধিকাংশ বাসিন্দাই গরিব। আর জাহান্নামের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার অধিকাংশই নারী। (বুখারি ও মুসলিম) অপরাধ কুফরি। ইসলাম এটাও দাবি করেছে যে, জান্নাতের তুলনায় জাহান্নামে কয়েকশো গুণ বেশি জাহান্নামি বাসিন্দা থাকে। তার কারণ বেশিরভাগ মানুষের কাছে ইসলাম পৌঁছায়নি। বরং বেশিরভাগ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেনি। যেহেতু যে মানুষের কাছে ইসলামের কথা মহান আল্লাহ তাদের শাস্তি দেবেন না। অর্থাৎ শাস্তি না-হলেও জাহান্নামবাসী হতেই হবে অমুসলিমদের।সেই কারণেই বোধহয় মুসলমানরা সারা পৃথিবীতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে উৎসুক, যাতে অমুসলমানরা আল্লাহ ও ইসলাম গ্রহণ করে জান্নাতের ঠিকানা পৌঁছে যেতে পারে !
জাহান্নামে পাপীদের লেলিহান আগুনে শুধু দগ্ধ করাই হয় না, তাদের জন্য খাদ্য-আবাস-শয়নাগারের ব্যবস্থাও আছে।তবে সবই অতি নিকৃষ্ট মানের। খাদ্য বলতে যাক্কুম বৃক্ষ। এই বৃক্ষ জাহান্নামের তলদেশ উদগত হয়। এর মোচা শয়তানের মাথার মতো। এর সঙ্গে ফুটন্ত জলের মিশ্রণ। গলিত তামার তা পেটের মধ্যে ফুটতে থাকবে। যাক্কুম বৃক্ষের ফল খুবই দুর্গন্ধময়, ভয়ানক তিক্ত স্বাদের। জাহান্নামবাসীদের এই ফলও খেতে হবে।(স্বা-ফফাত ৬২-৬৮) যারি নামে একটি কণ্টকময় বিষাক্ত গুল্মও খেতে দেওয়া হয়। এই খাদ্য শরীরকে পুষ্টও করে না, ক্ষুধাও নিবারণ করে না।(গাশিয়াহ ৬-৭) এমনকি এমন খাদ্যও খাওয়ানো হয়, যা গলায় আটকে যাবে এবং যন্ত্রণাদায়ক হবে।(মুযযাম্মিল ১২-১৩) খাওয়ানো হবে গিসলিন নামে এক ধরনের ক্ষতনিঃসৃত রস, পুঁজ।(হা-ক্বাহ ৩৫-৩৭) যারা আল্লাহর কালাম বিক্রি করে খায়, তাদেরকে আগুনের অঙ্গার খাওয়ানো হবে।(বাক্বারাহ ১৭৪) পান করানো হবে হামিম নামে ফুটন্ত জল, যা পান করলে জাহান্নামিদের নাড়িভুঁড়ি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। (ওয়াক্বিআহ ৫৪-৫৫) গাসসাক নামে আর-এক ধরনের পানীয়ও পান করানো হবে, যা অতিশয় দুর্গন্ধময় তিক্ত অথবা অতিশয় শীতল ইত্যাদি।জাহান্নামে জাহান্নামিদের নগ্ন বা উলঙ্গ করে রাখা হয় না, তাদেরও পোশাক পরানো হয়। সেই পোশাক হবে আলকাতরার অথবা গলিত পিতলের এবং আগুনের।“সেদিন তুমি অপরাধীদের দেখবে শিকল দ্বারা বাঁধা অবস্থায়। তাদের জামা হবে আলকাতরার (বা গলিত পিতলের) এবং অগ্নি আচ্ছন্ন করবে তাদের মুখমণ্ডল।”(ইব্রাহিম ৪৯-৫০)
পাপী বা গোনাহগার বেঈমানদের সমুচিত শাস্তি দেওয়ার জন্য আল্লাহ যে কঠিন আজাবের স্থান নির্দিষ্ট করে রেখেছেন সেটাই দোজখ। এটা অতিশয় কষ্টের স্থান এবং বিভিন্ন বিভীষিকাময় জিনিসে পরিপূর্ণ। সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ বলতে সেখানে কিছুই নেই। দোজখ আল্লাহপাকে গজবের আগুনে প্রজ্জ্বলিত। যারা আল্লাহর নাফরমানি করে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত না হয়ে (তওবা না করে)_ মরে যাবে, তারা আখেরাতে অনন্তকাল দোজখের কঠোর শাস্তি ভোগ করবে। কোরান ও হাদিস শরিফে দোজখ সমন্ধে যেরকম বিবরণ পাওয়া যায়, তা শুনিলে শরীর শিহরিয়া উঠতে হয়। দোজখের সমান্যতম আগুন পৃথিবীতে এনে সাত সমুদ্রের জলে ৭০ বার ধুয়ে তার উহার উত্তাপ পৃথিবীর আগুনের তুলনায় সহস্রগুণ বেশি থাকবে। দুনিয়ার সমস্ত কাঠ একত্র করে প্রজ্জ্বলিত করলে যে পরিমাণ উত্তাপ সৃষ্টি হবে, দোজখের আগুনের উত্তাপ তা থেকেও সহস্রগুণ বেশি হবে ।
আল্লাহ কোরান মজিদে নির্দেশ দিয়েছেন – “পাপীদিগকে বলা হইবে, তোমরা এখন দোজখের আগুনের স্বাদ গ্রহণ করো। অর্থাৎ, আল্লাহ ও রাসুলের কথায় বিশ্বাস করো নাই, কোরান ও হাদিসকে মিথ্যা জানিয়াছিলে, দোজখের আজাবকে তখন মিথ্যা জানিয়াছিলে, এখন তাহার শাস্তি ভোগ করো; দেখো কে তোমাদিগকে সাহায্য করিতে আসে।
হজরত নবি করিম বলেছেন -- দোজখীদের জকুম নামক এক প্রকার বৃক্ষের ফল আহার করতে দেওয়া হবে । এটা এত তিক্ত যে, যদি তার এক টুকরো পৃথিবীর জলে ফেলে দেওয়া হয়, তবে পৃথিবীর সমস্ত জল তিক্ত হয়ে যাবে। একসময়ে হজরত জিব্রাইল যখন হজরত নবি করিমের কাছে এলেন, তখন তাহার চেহারা অত্যন্ত খারাপ দেখাচ্ছিল। হজরত নবি করিম তার কারণ জিজ্ঞাসা করায় জিব্রাইল বললেন -- দোজখের অগ্নিভয়ে আমার অন্তঃকরণ থরথর করে কাঁপছে। হজরত নবি করিম বললেন -- দোজখীদের যে কাপড় পরানো করানো হবে, তার এক ইঞ্চি পরিমাণ যদি দুনিয়ার এক প্রান্তে লটকে দেওয়া হয়, তবে তার দুর্গন্ধে দুনিয়ার সমস্ত প্রাণীর মৃত্যু হবে। আর দোজখীদের যে জিঞ্জির দিয়ে বাঁধা হবে, তার একতলা পরিমাণ যদি পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতের উপর স্থাপন করা যায়, তবে পর্বত ভষ্ম হয়ে সপ্তস্তর জমি ভেদ করে দোজখের জিঞ্জির দোজখে গিয়া পৌঁছবে।দোজখীদের গরম জল ও দুর্গন্ধযুক্ত পুঁজ পান করতে দেওয়া হবে, যাতে তাদের নাড়ি-ভুড়ি সব খসে পড়ে। আর তাদের শরীর দুর্গন্ধে ভরে যাবে। প্রতিদিন তাদেরকে ৭০ বার করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হবে, যতবার পোড়ানো হবে ততবারই সেই মূহুর্তেই আবার পুর্বের মতো শরীর হয়ে যাবে। আল্লাহ বলছেন –“সেখানে তাহারা মরিবেও না, বাঁচিবেও না।’ সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়াল জন্য তারা আল্লাহর কাছে এবং শাস্তি প্রদানকারী ফেরেশতাদের কাছে অনেক কাকুতিমিনতি করবে। কিন্তু কেউই তাদের কথায় কর্ণপাত করবে না; বরং আল্লাহ তাদেরকে বলবেন -- হে গোনাহগারগণ! তোমরা দোজখের স্বাদ গ্রহণ করো, দোজখের শাস্তি ভোগ করিতে থাক। আমি তোমাদের আজাব শুধু বর্ধিতই করিব। দুনিয়াতে আমার কথা শুনো নাই, কোরান হাদিস মানো নাই, আজ তাহার ফল ভোগ করো।”
দোজখের উত্তাপে অস্থির হয়ে বৃষ্টি প্রার্থনা করলে আকাশে কালো মেঘ দেখা দেবে এবং সেখান থেকে অসংখ্য সাপ ও বিছে দোজখীদের দেহে পতিত হতে থাকবে। ওই সমস্ত সাপ বিছে একবার দংশন করলে হাজার বছর পর্যন্ত তার যন্ত্রণা থাকবে, অনবরতই এসব প্রাণীরা তাদেরকে দংশন করতে থাকবে।দোজখের সাতটি স্তর। এর একটির নীচে অপরটি অবস্থিত। যে স্তর যত বেশি নীচে তার উত্তাপ ও শাস্তির পরিমাণ তত বেশি। একটি থেকে অপরটির উত্তাপ ৭০ গুণ বেশি।
মৃত্যু কী? মৃত্যু (Death) বলতে জীবনের সমাপ্তি বোঝায়। জীববিজ্ঞানের ভাষায় প্রাণ আছে এমন কোনো জৈব পদার্থের (বা জীবের) জীবনের সমাপ্তিকে মৃত্যু বলে। অন্য কথায়, মৃত্যু হচ্ছে এমন একটি অবস্থা যখন সকল শারিরীক কর্মকাণ্ড যেমন শ্বসন, খাদ্যগ্রহণ, পরিচলন, ইত্যাদি থেমে যায়। কোনও জীবের মৃত্যু হলে তাকে মৃত বলা হয়। মৃত্যু বিভিন্ন স্তরে ঘটে থাকে। সোমাটিক মৃত্যু হল সামগ্রিকভাবে কোনও জীবের মৃত্যু। নির্দিষ্ট অঙ্গ, কোশ বা কোশাংশের মৃত্যুর আগেই এটি ঘটে। এতে হৃৎস্পন্দন, শ্বসন, চলন, নড়াচড়া, প্রতিবর্ত ক্রিয়া ও মস্তিষ্কের কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। সোমাটিক মৃত্যু ঠিক কখন ঘটে তা নির্ণয় করা দুরূহ, কেন-না কোমা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, এবং ঘোর বা ট্রান্সের মধ্যে থাকা ব্যক্তিও একই ধরনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে থাকেন। সোমাটিক মৃত্যুর পর অনেকগুলি পরিবর্তন ঘটে যা থেকে মৃত্যুর সময় ও কারণ নির্ণয় করা যায়। মারা যাওয়ার পরপরই পার্শ্ববর্তী পরিবেশের প্রভাবে দেহ ঠান্ডা হয়ে যায়, যাকে বলে Algor mortis। মারা যাওয়ার পাঁচ থেকে দশ ঘণ্টা পরে কংকালের পেশিগুলি শক্ত হয়ে যায়, যাকে বলে Rigor mortis এবং এটি তিন-চার দিন পরে শেষ হয়ে যায়। রেখে দেওয়া দেহের নীচের অংশে যে লাল-নীল রং দেখা যায়, তাকে বলে Livor mortis; রক্ত জমা হওয়ার কারণে এমন হয়। মৃত্যুর খানিক বাদেই রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে। আর তারপরে দেহের যে পচন শুরু হয়, তার জন্য দায়ী এনজাইম ও ব্যাক্টেরিয়া। দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিভিন্ন হারে মারা যায়। সোমাটিক মৃত্যুর ৫ মিনিটের মধ্যেই মস্তিষ্কের কোশগুলির মৃত্যু ঘটে। অন্যদিকে হৃৎপিণ্ডের কোশগুলি ১৫ মিনিট এবং বৃক্কেরগুলি প্রায় ৩০ মিনিট বেঁচে থাকতে পারে।
মৃত্যুর পরে শরীরে ধীরে ধীরে পচন ধরতে শুরু করে-- এ কথা সবাই জানেন। কিন্তু মৃত্যুর পর মুহূর্ত থেকে পচন ধরা পর্যন্ত কী কী শারীরিক পরিবর্তন হয় বা কোন্ কোন্ পথ ধরে শরীর পচতে শুরু করে, তা কি জানা আছে? চিকিৎসাশাস্ত্র মতে মৃত ঘোষণার অর্থ এই নয় যে, শরীরের প্রতিটি কোশের মৃত্যু হয়েছে। হৃদযন্ত্র পাম্প করা বন্ধ করলে, কোশগুলি অক্সিজেন পায় না। মস্তিষ্কে শেষ মুহূর্তে সক্রিয়তার ঢেউ খেলে যায়, এর পরই 'সবকিছু অন্ধকার'। অক্সিজেন পাওয়া বন্ধ হলে পেশিগুলি শিথিল হতে শুরু করে। পাশাপাশি অন্ত্র এবং মূত্রস্থলী খালি হতে শুরু হয়। শরীরের মৃত্যু ঘটলেও, অন্ত্র, ত্বক বা অন্য কোনো অংশে বসবাসকারী ১০০ ট্রিলিয়ন ব্যাক্টিরিয়া তখনও জীবিত থাকে। মৃত্যুর পর শরীরের অভ্যন্তরে যা ঘটে, সে সবের পিছনেই এই ১০০ ট্রিলিয়ন ব্যাক্টিরিয়ার যোগদান থাকে। মৃত্যুর পর সর্বপ্রথম শরীরে কোনো পরিবর্তন আসে? প্রথমেই হয় অ্যালগর মরসিট ঘরের তাপমাত্রায় না-আসা পর্যন্ত শরীরের তাপমাত্রা প্রতি ঘণ্টায় ১.৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট কমতে থাকে। লিভোর মরটিস বা লিভিডিটির ক্ষেত্রে শরীরের নিম্নাংশে রক্ত এবং তরল পদার্থ জমা হয়। ব্যক্তির ত্বকের আসল রঙের ভিত্তিতে তা ধীরে ধীরে গাঢ় বেগুনি-নীল রঙে পরিবর্তিত হতে শুরু করে। রিগর মরটিস শেষে শরীরে রিগর মরটিস হয়, এ ক্ষেত্রে অত্যধিক ক্যালসিয়াম ক্ষরণের ফলে পেশিগুলি শক্ত হয়ে যায়। ২৪-৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত এই অবস্থা থাকে। রিগর মরটিসের সময় চোখ খোলা থাকলে, বেশ কিছু ক্ষণের জন্য মৃতের চোখ খোলাই থাকে। এর পর শরীরে পচন ধরতে শুরু করে। রক্ত চলাচল বন্ধ হলে কার্বন-ডাই অক্সাইডের গঠন শুরু হয়, অম্লের মাত্রা বাড়তে থাকে। এর ফলে কোশগুলিতে ভাঙন ধরে। ২-৩ দিনে শরীর পচতে থাকে। পরিপাক নালিতে থাকা ব্যাক্টেরিয়া এবং আণুবীক্ষণিক প্রাণীরা শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় তলপেট সবুজ বর্ণ ধারণ করে এবং তাতে গ্যাস তৈরি হয়। তার চাপে শরীরের মল-মূত্র নিষ্কাশিত হয়। পিউট্রেসিন এবং ক্যাডাভেরিনের মতো জৈবিক যৌগ শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়লে, দুর্গন্ধ বের হতে শুরু করে। এই গন্ধই মৃতদেহের অন্যতম বৈশিষ্ট। নেক্রোসিস পদ্ধতিতে এরপর শরীরের রং সবজেটে থেকে কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করে। মৃতদেহের দুর্গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ভিড় জমায় উচ্ছিষ্টভোগী পোকামাকড়। মৃত শরীরকে খাদ্যভাণ্ডার হিসাবে ব্যবহার করা ছাড়াও, এই সমস্ত পরজীবী কীট সেখানে ডিমও পাড়ে। ডিম ফুটে বেরোনো শূককীট মাত্র এক সপ্তাহে শরীরের ৬০ শতাংশ নিকেশ করতে পারে।
সে স্বর্গ হোক কিংবা নরক, জান্নাত বা বেহেস্ত হোক কিংবা দোজখ বা জাহান্নাম – এ সবই মানুষের মৃত্যু-পরবর্তী অধ্যায়। বিচার-টিচার যা হবে তা সবই মৃত্যুর পর, তা সে জন্মেই মরুক কিংবা ১০০ বছর বেঁচেই মরুক। এ থেকে এটা প্রমাণ হয়, জীবদ্দশায় মানুষের নরক বা স্বর্গদর্শন কিছুতেই হচ্ছে না। বাস্তবে তা কিন্তু হয় না, হয়নি। যদি তাইই হতো, তাহলে জীবদ্দশায় বিভিন্ন অপরাধের জন্য শাস্তি ভোগ করার ব্যবস্থা থাকত না রাষ্ট্রে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে অপরাধীদের কী ভয়ানক শাস্তি দেওয়া হতো, সেখানে নরকের শাস্তিব্যবস্থা কিচ্ছু না। একজন অপরাধী কতবার শাস্তি হয়! অপরাধের শাস্তি হিসাবে আজীবন কারাগারবাস কি নরকবাস নয়? জীবদ্দশাতেও তাঁর ছাল-চামড়া তুলে নেওয়া নেওয়া হবে, মুণ্ডু কেটে নেওয়া হবে, পাথর ছুঁড়ে মারা হবে, গুলিবিদ্ধ করে মারা হবে – আবার নরকেও তাঁকে শাস্তি দেওয়া হবে! এটা বাস্তব, না কষ্টকল্পিত রূপকথা? নরক বা জাহান্নামের শাস্তিই যদি নির্দিষ্ট ও বাস্তব হত, তাহলে রাষ্ট্রগুলিতে আইন-বিচার-শাস্তির ব্যবস্থা থাকার প্রয়োজন হত না। তাই নরক বা জাহান্নামের শাস্তির ভয়ে মানুষ কুঁকড়ে থাকে না। কারণ মানুষ জানে অপরাধ করলে তাঁর শাস্তি পেতেই হবে। আইনের হাত অনেক লম্বা। তাই সুস্থ মানুষরা অপরাধ থাকে। নরক বা জাহান্নামের ভয়ে নয়, দেশের আইনের ভয়ে। মানুষ জানে মৃত্যুতেই জীবন শেষ, জীবন শেষ মানে অস্তিত্বও শেষ। মৃত্যুর পর আর কিছু নেই। স্বর্গ, নরক, পাপ, পুণ্য, কর্মফল, জন্মান্তরবাদ, জাতিস্মর ইত্যাদি যা আছে সবই কাল্পনিক, মনগড়া। যা আছে, তা সব এ পৃথিবীতেই আছে। পৃথিবীর বাইরে বা জীবদ্দশার বাইরে কোথাও কিছু নেই।
সহমত হলাম।
ReplyDelete