4

গল্প - অসিত কর্মকার

Posted in

ডাক্তারবাবু নানা ওষুধ লিখে দিলেন। খাওয়াদাওয়ায় ভীষণরকম রেস্ট্রিকশান। সেই সঙ্গে দু’বেলা হাঁটা মাস্ট। 

সুজাতা বলেছিল, কাল ভোর থেকেই শুরু করে দাও। পুরো এক ঘন্টা করে হাঁটবে। ঘড়িতে এ্যালার্ম দিয়ে রেখো। 

সুজাতার হাতে এক সেট পুরানো ট্রাক-স্যুট। ছেলে বিজিতের ছিল ওটা। মাধ্যমিক পাশ করার পর আমি ওকে কিনে দিয়েছিলাম। রোজ বিকেলে বিজিত স্টেডিয়ামে দৌড়োতে যেত। বন্ধুরা সবাই ওই পরে দৌড়োয়। সুতরাং ওরও চাই। বিজিত এখন বি.এসসি পড়ছে। লম্বায় আমার থেকে হাতখানেক বেশি। ওটা আমার গায়ে বেশ ফিট হয়। 

বিজিত বলেছিল, জোরে জোরে হাঁটতে হবে বাবা, যাতে ঘাম ঝরে।নয়তো সুগার পুড়বে না।’  

-‘ওই ঘাম বুকে বসিয়ে আমি আরেকটা অসুখ বাঁধাই আর কী!’ 

-‘ট্রাক-স্যুটটার কাপড়টা খুব ভাল, জলদি ঘাম সোক করে নেয়।’  বিজিত অভয় দিয়েছিল। 

সুজাতা বলেছিল, বেশি করে হেঁটেছো কিনা তা মাথার চুল দেখলেই বুঝে যাব। ঘামে একেবারে ঝোড়ো কাকের মতো হতে হবে। 

ঘন কুয়াশায় ঢাকা ভোর। চার হাত দূরের জিনিস দেখা যায় না। পাতা থেকে পাতায় কুয়াশা থিতানো জল টুপটাপ ঝরে পড়ার শব্দ।পায়ের কেডসজোড়া ভিজে যাচ্ছিল। দেখতে না পেলেও টের পাচ্ছিলাম শরীরচর্যার উদ্দশ্যে অনেকেই স্টেডিয়ামে এসেছে।বিশেষ করে লাফিং-ক্লাবের সদস্যরা যখন হেসে ওঠল হা-হা করে।পুরো মাঠের পররিস্থির সঙ্গে ধাতস্ত হতে প্রথম পাকটা ধীরেসুস্থে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বেশিরভাগ মানুষই একা বা দল বেঁধে জোরে জোরে হাঁটছে। নিজেদের মধ্যে হাঁপ ধরা গলায় কথা বলছে। বিষয় রাজনীতি, বেহাল শিক্ষা-স্বাস্থ ব্যবস্থা, প্রভিডেন্টফান্ড-গ্রাচ্যুইটি, ভি.আর.এস, প্র্রমোশান, দ্রব্যমূল্যের লাগামছাড়া বৃদ্ধি, পরমাণু চুক্তির সুফল-কুফল, সন্তানের কৃতিত্ব-ব্যর্থতা ইত্যাদি ইত্যাদি। দ্বিতীয় পাক থেকে গতি বাড়ালাম। পাকটা মেরে এনেছি প্রায়। আর বড়জোর পঞ্চাশ পা। শরীরটা কেমন হাল্কা লাগছে। সব জড়তা ধুয়েমুছে মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠছে। গতিটা আরও বাড়ালাম।হঠাৎই পায়ের পেশিতে টান ধরাতে যন্ত্রণায় একরকম চিৎকার করে ওঠলাম। ল্যাংচে ল্যাংচে হেঁটে একপাশে বসে পড়লাম। খিঁচটা আরও বেড়ে এমন একটা অবস্থা হল যে আমি কিছুতেই ডান পা-টা সোজা করতে পারছি না। সেইসঙ্গে আরও তীব্র যন্ত্রণা। ভয় হচ্ছিল সাংঘাতিক কিছু একটা না ঘটে যায়। 

-‘পেশিতে টান ধরল বুঝি?’ বড় আন্তরিক এক কন্ঠস্বর। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখি আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে একজন। কুয়াশামণ্ডিত দীর্ঘ চেহারা। যেন এইমাত্র মাটিফুঁড়ে উঠে দাঁড়ালেন। মুখমণ্ডল ভাল করে দেখতে পাচ্ছিলাম না। 

-‘হ্যাঁ, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, পা-টাকে কিছুতেই…।’ আমি যন্ত্রণাকাতর ভাঙ্গা কন্ঠে বললাম। 

-‘ওভাবে জোরাজুরি করলে ক্ষতি হতে পারে। শরীরটাকে যতদূর সম্ভব রিল্যাক্সড করে দিন। তারপর জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকুন। এতে রক্তে অক্সিজেনের চলাচল বাড়ে। ফলে হিলিংও তাড়াতাড়ি হয়।’ 

বলতে বলতে উনি হাঁটুমুড়ে বসে আমার আহত পা-টাকে পরম যত্নে কোলে তুলে নিয়ে কিছু পদ্ধতি-প্রকরণ প্রয়োগ করতে লাগলেন।আমি বুঝতে পারছিলাম উনি এ কাজে খুবই দক্ষ।আমি ওঁকে এখন অনেকটাই পরিস্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। এমন পরিতৃপ্ত আর প্রশান্তিভরা মুখমণ্ডল আগে কখনও দেখিনি। ঠোঁটের বাঁকে পবিত্র হাসির মিহি উদ্ভাস। ঘাসের ওপর কেমন অবলীলায় বসে পড়লেন! 

-‘এখন কেমন ফিল করছেন?’ 

-‘ভাল,বেশ ভাল। মনে হচ্ছে এখনই আবার হাঁটতে পারব। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ,যা উপকার করলেন!’ 

-‘না,আজ আর হাঁটবেন না। অন্তত দু’দিন তো নয়ই। পা-টাকে ফুল রেস্ট দিতে হবে। আজ কি আপনার প্রথম দিন?’ 

-‘কিসের?’ 

-‘হাঁটার?’ 

-‘ও,হ্যাঁ।’  

-‘দেখেই বুঝতে পেরেছি। সুগার?’ 

-‘হ্যাঁ,কী করে বুঝলেন?’ 

-‘অনুমান করে।সচরাচর তা ভুল হয় না।’  

ওঁর সম্পর্কে আমার কৌতূহল বাড়ছিল। জিজ্ঞেস করি, আপনাকে আমাদের এ এলাকায় এর আগে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। 

-‘আমি তো এদিকে থাকি না।ক’দিন ধরে এই স্টেডিয়ামে হাঁটতে আসছি। ভোরের বাস-ট্রামে চড়ার মজাই আলাদা, জানেন। গুটিকয় যাত্রী, চারপাশের পৃথিবীটা ফুটে ওঠছে নতুন একটা দিন হয়ে, সে এক অদ্ভুত সুন্দর ভাল লাগা। 

-‘বেশ চমৎকার ভাবতে পারেন তো আপনি! কোত্থেকে আসেন তাহলে?

-‘সে অনেক দূর থেকে।’ হেঁয়ালি হেসে ফের বললেন, নতুন নতুন হাঁটার জায়গা খুঁজি। মনের মতো রাস্তাও।সেসব রাস্তায় যেন হাঁটতে হয় না রাস্তাই বয়ে নিয়ে চলে। অনেক দিন হাঁটা হয়েছে এমন জায়গাও বহুদিন পরে মনের মধ্যে নতুন হয়ে ফুটে ওঠে। সেখনে আবার যেতে শুরু করি। এটা অনেকটা পুরানো জামাকাপড়ের ট্রাঙ্ক খুলে বসার মতো বলতে পারেন। সব আবার নতুন মনে হয়।যেন ওগুলোর আয়ু ফুরোনোর অনেক আগেই ট্রাঙ্কে বন্দি করে দমবন্ধ করে মারা হচ্ছিল। ডালাটা খুলে ফেলতেই নতুন করে বাঁচার আনন্দে ঝলমল করে ওঠে। শরীরে জড়িয়ে না নেওয়া পর্যন্ত আমাদেরও মনটায় শান্তি হয় না।

তখন আমার সুজাতা আর বিজিতের কথা মনে পড়ছিল। আচ্ছা, সুজাতা কি আমার কাছে পুরানো হয়ে গেছে! বিবাহিত জীবনের পাক্কা একুশটা বছর পেরিয়ে এসেছি আমরা। সাতচল্লিশের সুজাতা এখনও কি আমাকে সেভাবে টানে? যদিও সাজলে সুজাতাকে এখনও ভালই লাগে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। সুজাতার কাছেও কি আমি বুড়ো ঘোড়া হয়ে যাইনি? আমি যেমন আজকাল প্রায়ই সুজাতাকে বলি, তোমাকে এখন এটা মানায় না ওটা মানায় না, সুজাতাও তেমনি আমাকে এটা ওটা সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়। 

বছর সাতেক আগে আমরা দার্জিলিং বেড়াতে গিয়েছিলাম। কিছু গরমপোশাক কিনেছিলাম সবার জন্য। আমার জন্য ফুলস্লিভস হাইনেক একটা সোয়েটার। ভারি চমৎকার দেখতে। সুজাতা বলেছিল, দারুণ মানিয়েছে তোমাকে এটায়।’ এখন ওটা বিজিত পরে।সবার প্রশংসা পায়। যদিও ওর একটু শর্ট হয় কিন্তু এখন তো শর্ট পোশাকেরই চল। আমি পরার কথা বলাতে সুজাতা বলেছিল, আয়নায় নিজের চেহারাটা একবার ভাল করে দেখেছো? বয়স বাড়ছে না কমছে শুনি? ওই ভুড়িতে এই সোয়েটার মানায়! বিজিতের বান্ধবিরা বাড়িতে এলে কোনও প্রয়োজনে আমি বিজিতের ঘরে ঢুকলে সুজাতা আড়ালে ডেকে সাবধান করে দেয়, ও ঘরে কী ঘুরঘুর করছো শুনি!’ ওর কথার ইঙ্গিতে আমি কুঁকড়ে যাই। বিজিত আমাদের একমাত্র সন্তান। এই পৃথিবীতে ওরও উনিশটা বছর হয়ে গেল। কিন্তু ওকে কি পুরানো বলা যায়? বিশেষ করে আমাদের দু’জনের কাছে, যার শরীর-মন জুড়ে জীবনের ফুলগুলো এক এক করে ফুটে ওঠছে। না, বলা যায় না।ও এখনও পৃথিবীতে অনেক বছর নতুন থাকবে। 

-‘কী অত ভাবছেন? নিন আমার হাতটা ধরুন। চলুন ওই গ্যালারিতে বসে একটু গল্প করা যাক। তাড়া নেই তো?’ 

আমার সম্বিৎ ফেরে। বললাম, না,হাঁটার জন্য এক ঘন্টা বরাদ্দ ছিল কিন্তু এমন একটা ঘটনা ঘটল…। তাতে অবশ্য আমারই লাভ হল।আপনার মতো একজন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হলাম। এ আমার সৌভাগ্য।

আমার প্রশংসার বিনিময়ে ভদ্রলোক ভাবলেশহীন, নির্বিকার। আমরা দু’জনে পাশাপাশি বসে। আমার আহত পা-টা সামনের দিকে টানটান করে মেলে রাখা। তাতে আরাম পাচ্ছিলাম। 

-‘স্পোর্টস থেরাপিতে আপনার বেশ দক্ষতা আছে দেখছি।

-‘শিখেছি কিনা জানতে চাইছেন? না না, একটা সময় ফুটবল খেলা দেখতে খুব পছন্দ করতাম। পেশিতে টান পড়ে প্লেয়ারদের কাহিল অবস্থা হতে দেখতাম। ফিজিও তাদের সারিয়ে তুলত। ওই দেখে দেখেই আমার যেটুকু শেখা। 

ওঁর প্রফেশানের কথা জিজ্ঞেস করতে মৃদু হেসে একটু যেন বা আক্ষেপের সুরে বললেন, আমার কোনও কাজ নেই জানেন।এরকম বেকার লোক আর দুটি পাবেন না।

-‘রিটায়ার্ড?’ 

-‘চাকরি আমি কোনওদিনই করিনি।’  

-‘তাহলে ব্যবসা-টেবসা কিছু একটা করতেন নিশ্চয়ই?’ 

-‘সে তো এখনও আছে। বহু পুরানো সব। পৈত্রিক। রমরমিয়ে চলছে। 

-‘ছেলেরা দেখাশোনা করে নিশ্চয়ই?’ 

-‘বিয়ে আমি করিনি। আর নিজেও ওসব দেখভাল করি না। 

-‘অথচ রমরমিয়ে চলছে!’ 

-‘হ্যাঁ,চলছে। কর্মচারিরা চালাচ্ছে। একেবারে ঠিকঠাক করে। জানেন, আমার যুবক বয়সে আমার বাবা একদিন আমার হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে বললেন, এ টাকা তুমি তোমার ইচ্ছে মতো খরচ করতে পার,শুধু মনে রেখো এমন কিছু কোরো না যাতে তোমার রাতের ঘুম নষ্ট হয়। আমার কর্মচারিদেরও আমি ওই কথাটা বলি।ফলে কী হয়েছে জানেন, আমার হাতে অখণ্ড অবসর। আমি আমার ইচ্ছেমত জীবনযাপন করতে পারছি। এই বিশ্বপ্রকৃতি আর মানুষ, দু’ই-ই জানেন অপার রহস্যময়। রহস্যের পর্দা সরিয়ে সরিয়ে আমি শুধু ভেতরের আলোর সন্ধান করে যাই। তাতে করে মনের মধ্যে অদ্ভুত এক আনন্দের অনুভূতি হয়। পৃথিবীটাকে সব সময় বড় নতুন লাগে। তারপর একটু থেমে বললেন, আমার কথা তো অনেক হল, এবার আপনার কথা বলুন। 

আমার বলা যখন ফুরলো তখন কুয়াশা অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। কোথাও কোথাও ঘাসে এসে পড়েছে নরম সূর্য। বাতাসে হাল্কা উষ্ণতার ছোঁয়া। আমি হাত ঘড়িতে সময় দেখি। 

-‘যান, আপনাকে আর দেরি করাব না। বাজার করে ফিরবেন তো?তারপর অফিস যাওয়ার তাড়া। 

-‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। কিন্তু আপনাকে যে আমার খুব দরকার! ওই যে বলছিলেন না, পৃথিবীটা আপনার কাছে কখনো পুরানো মনে হয় না…’ 

উনি স্মিত হাসলেন, সে এক নিরন্তর খোঁজ, নিজের মধ্যে নিজেকেও। আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে।
 
-‘কাল ভোরে আপনি আসছেন তো? অনেক কথা ছিল।’ আমার কন্ঠস্বরে আকুতি। 

-‘আশা করছি। 

দুই 

আমাকে দেখে আঁৎকে উঠেছিল সুজাতা, প্রথম দিনেই কী অঘটন ঘটিয়ে এলে, আবার হাসছও দেখছি!’ বলতে বলতে সুজাতা বাজারের ব্যাগটা আমার হাত থেকে নেয়। 

-‘একজন আশ্চর্য ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হল জানো। এখন আর না।বিজুও পড়া থেকে ফিরুক। খেতে খেতে বলব।

-‘তা পায়ের এই হাল হল কী করে বললে না তো?’ 

-‘পেশির টান। তারপরই তো ওঁর সঙ্গে পরিচয়।

-‘অফিস যেতে পারবে তো? 

-‘খুব পারব।

-‘তা মাছ কুটিয়ে এনেছো তো?’ 

মুহূর্তে আমি যেন সংসার সীমান্তে আছড়ে পড়লাম। হেসে বললাম, আমার ঘাড়ে কটা মাথা আছে যে আস্ত মাছ নিয়ে ঘরে ঢুকি!’ 

-‘একদম বাজে কথা বলবে না! সুজাতা আমাকে কপট রাগে বিদ্ধ করে ব্যাগের ভেতরে উঁকি দিল, ‘ইলিশ, এই শীতকালে!’ 

-‘আজ খুব ইচ্ছে হল একটু ভাল মাছ কেনার। 

আমার দুগ্ধফেনিভ গালে তখন রেজার চলছিল দ্রুত। 


তিন 

ভদ্র্রলোককে চায়ের নিমন্ত্রণ করার কথা বলেছিল সুজাতা। উনি আসবেন কিনা জানি না। তাই সুজাতাকে বলেছিলাম আমার সঙ্গে মাঠে যেতে। বিজুও যদি যায়। ওখানেই পরিচয় হবে ওদের সঙ্গে। 

পরদিন পৃথিবীতে আরও গভীর কুয়াশা, যেন বরফের দেয়ালের পর দেয়াল। আমরা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এগিয়ে চলি। বিজিত আমাদের থেকে দু’কদম এগিয়ে। একটা-দুটো কাক ডেকে ওঠে। দু’পাশের গাছপালা থেকে ছোট পাখিরা। ওঁর সঙ্গে দেখা করার প্রবল উৎসাহ আমাদের। সুজাতা হঠাৎই ভদ্রলোকের কথা প্রসঙ্গে বিজিতের উদ্দেশ্যে বলল, হ্যাঁ রে বিজু,আমরা দু’জনে তোর কাছে অনেক পুরানো হয়ে গেছি না রে?’ সুজাতার কন্ঠে বিষাদ। 

থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বিজিত, যা!মা-বাবা কোনওদিন পুরানো হয় নাকি?’ 

-‘যেটুকু বা হয়েছি তাও থাকব না, দেখিস। আগে ওই ভদ্রলোকের দেখা পাই!’ হেসে বলল সুজাতা। 

লাফিং-ক্লাবের কৃত্রিম হাসি দমকে দমকে ছড়িয়ে পড়ছিল চারিদিকে। এমনই নিরেট কুয়াশা যে ওঁকে খুঁজে পাওয়া কঠিন।আমি প্রস্তাব দিই, চলো, আমরা পাক খেতে থাকি। সময়ের সঙ্গে কুয়াশা থিতিয়ে এলে ওঁকে আমরা ঠিক খুঁজে পাব।

আমরা হাঁটি আর হাঁটি। সময় গড়িয়ে যায়।আমাকে বাজার করতে হবে, অফিস যাওয়া আছে, বিজিত টুইশানিতে যাবে, সুজাতার রাজ্যের কাজ পড়ে। আশ্চর্য, কুয়াশা থিতানোর এতটুকু নামগন্ধ নেই আজ! যেন সূর্যই ওঠেনি। 

-‘তাহলে কি আজকেও আমাদের কাউকে কষ্ট পেতে হবে তবেই উনি দেখা দেবেন!’ আমি হতাশ হয়ে বলি। 

-‘কী যে বলো না! কালকের ব্য্যাপরটা জাস্ট কো-ইনসিডেন্ট।একবার ওঁর নাম ধরে জোরে ডাকোই না, এলে নিশ্চয়ই সাড়া দেবেন।’  

মুহূর্তে আমি বোকা হয়ে যাই,’ভদ্রলোকের নামটাই যে জানা হয়নি। 

-‘আশ্চর্য লোক বটে তুমি।তা তোমার নামটা উনি জিজ্ঞেস করেছিলেন তো?’ সুজাতা অবাক শুধু নয়,ক্ষুব্ধও। 

-‘না। 

-‘ঠিকানা নিয়েছিলে?’ 

-‘জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিন্তু উনি…। 

-‘বাবা,তুমি না সত্যি…!’ বিজিত মজা লোটার হাসি হাসে। 

নিজেকে এত অসহায় খুব কমই লেগেছে। 

চার 

এরও পরে আরও অনেকদিন ওঁকে আমরা খুঁজি। আজকাল আরও ভোরে উঠি। এক এক করে এই শহরের প্রাতঃভ্রমণের জায়গাগুলোতে যেতে শুরু করি। ওঁকে যে আমাদের খুব দরকার।আরও ভালভাবে বেঁচে থাকতে শিখতাম। এক জীবনের পক্ষে অনেক দেরি হয়ে গেছে, তাই ঠিক করেছি,আজ রাতেই সুজাতার কাছে আমি কনফেস করব। মীনাক্ষির সঙ্গে আমার গভীর প্রেমের কথা বলব। কেন ওকে বিয়ে করলাম না তাও বলব। মীনাক্ষির ইউটেরাসে টিউমার বাসা বাঁধে।ম্যালিগনেন্সির সম্ভাবনা প্রবল।অপারেশান মাস্ট। ইউটেরাস কেটে বাদ দিতে হবে। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল, মীনাক্ষিকেই বিয়ে করব। সন্তানহীন দম্পতির সংখ্যা পৃথিবীতে না হয় আরেকটি বাড়বে। তবুও প্রেমের জয় হোক।মা-বাবাকে বলতে মুহূর্তে দু’জনে পাথর। খানিক বাদে মা কেঁদে পড়ল, তুই আমাদের একমাত্র সন্তান,জেনেবুঝে এখানেই বংশ লোপ করবি!’ বাবা দীর্ঘদিন সুকঠিন নিরব থেকে মনের কথা বোঝাল। মীনাক্ষিকে মানাতে গিয়ে কষ্টে খান খান হয়েছি। একটু একটু করে ওর থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছিলাম। একদিন মীনাক্ষি বড় উদাস কন্ঠে বলল, আজকের পর থেকে আর নয়,ভাল থেকো!’ ওর পাশে আমি তখন এক পোকা। সুজাতাও কনফেস করুক। আমাদের বিয়ের ক’দিন পরেই সুজাতার এক ‘জাস্ট ভাল পরিচিত’ একজন সু্ইসাইড করতে গেল। বান্ধবির ফোনে খবরটা শুনে ভেঙ্গে পড়ে সুজাতা। দুঃখে কাতর, আনমনা, উদাসীন। লুকিয়ে কাঁদে। আমি সব বুঝেও জিজ্ঞেস করি, মন খারাপ কেন, বাড়ির কথা মনে পড়ছে?’ আমার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে সুজাতা।একটু একটু করে দু’চোখ জলে ভরে টলটল করে ওঠে। 

এক জীবনের পক্ষে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আজ দু’জনে একে অপরের কাছে সম্পূর্ণ নতুন হয়ে ধরা দেব। এই প্রথম! আর বিজু হবে সুজাতার গর্ভে সদ্য অঙ্কুরিত এক ভ্রূণ। 

রাত্রে বিছানায় সুজাতাকে মৃদু ছুঁই।সবে তন্দ্রা মত এসেছে ওর। 

-‘কী হল?’ 

-‘কনফেস।আমরা দু’জনেই করব। 

-‘কিসের?’ 

মুহূর্তে আমি কেমন সংশয়কাতর হয়ে পড়ি। আমি কোনও উত্তর করতে পারি না। কনফেস-এ কোনও কিছু গোপন রাখা অন্যায়। মীনাক্ষির বর্তমান অবস্থার কথা শুনে সুস্থ-স্বাভাবিক সংবেদনশীল মনের সুজাতা কি আমাকে একজন প্রকৃত পুরুষের মর্যাদা দেবে আর? আমার বন্ধু নিখিলেশের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই ফোনে কথা হয়।ওদের পাড়ারই মেয়ে মীনাক্ষি। ওর কথা তুলতে ভোলে না নিখিলেশ।সবার অভিযোগ, আমার জন্যই মীনাক্ষির আজ এই অবস্থা। ঘরে আটকে রাখতে হয়।জাগতিক কোনও কিছুতেই আর টান নেই ওর।আমার গলা শুকিয়ে ওঠে। 

-‘বললে না তো?’ 


আমি চুপ। 

সুজাতা আমাকে হাত দিয়ে জোরে জোরে ঠেলতে থাকে, এই বয়সে এসে এখন আবার কিসের কনফেস শুনি?’ কৈফিয়ত চাওয়ার মত কঠিন গলা তার। বলল, তোমার ওই ভদ্রলোক তো একজন অসংসারী মানুষ, ওঁকে এত গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই!’ সুজাতা যেন রাগে ফুঁসছে। 

আমি এখনও চুপ। কথা ফোটে না। সুজাতাকে বুঝবার চেষ্টা করছি! 

4 comments:

  1. অসাধারণ গল্প, লেখককে ধন্যবাদ এমন একটি গল্প উপহার দেওয়ার জন্য ।

    ReplyDelete
  2. নিপুণ হাতের কাজ।

    ReplyDelete