1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in

ভূমিকা

ইদানীং ভারতের ইতিহাসকে ‘নতুন’ করে দেখার এবং লেখার কথা শোনা যাচ্ছে। যেমন বলা হচ্ছে যে হলদিঘাটের যুদ্ধে রাণা প্রতাপ পরাজিত হননি , টিপু সুলতান অত্যাচারী মুসলিম শাসক ছিলেন, আদৌ ইংরেজবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামী ছিলেন না। আমরা কয়েক প্রজন্ম ধরে ইতিহাস বলে যা পড়েছি তা আসলে ‘বিদেশী’ বা ‘কলোনিয়াল’ লেখকদের তৈরি যারা ভারতের গৌরবময় ঐতিহ্যকে ছোট করে দেখাতে চাইতেন । 
এই ওলট-পালট প্রক্রিয়ায় আজকে আলোচনা চলছে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি প্রধান চরিত্রকে নিয়ে যিনি স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতবর্ষে দ্রুত নেপথ্যে চলে যান। তিনি হলেন দামোদর বিনায়ক সাভারকর যাঁকে আমাদের প্রজন্ম জানত ‘বীর’ সাভারকর নামে। আমরা ছোটবেলায় পড়েছিলাম উনি নাকি ইংরেজ রাজত্বে বন্দী অবস্থায় জাহাজ থেকে সমুদ্রে লাফিয়ে পড়ে সাঁতরে গিয়ে ফরাসী বন্দরে ওঠেন কিন্তু ধরা পড়ে যান। দশবছর আন্দামানের সেলুলার জেলে থাকার পর ভারতে ফেরেন। পরে জানলাম উনি নাকি গান্ধীহত্যা ষড়যন্ত্রের মস্তিষ্ক ছিলেন-- একবছর আটমাস জেলে থাকার পর প্রমাণাভাবে মুক্ত হন।

ধীরে ধীরে আমরা সাভারকরকে ভুলে গেছলাম। আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে সাভারকরের কথা শোনেনি। এখন আবার সাভারকরের নাম একেবারে সামনের সারিতে। প্রথমে তাঁর ছবি সংসদের দেয়ালে স্থান পেল। সেলুলার জেলের নাম পালটে তাঁর নামে রাখা হলো। নভেম্বর মাসে ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জন্মদিনটি এবার বর্তমান সরকার সাভারকরের নামে পালন করবে। আর বিভিন্ন মহলে দাবি উঠছে সাভারকরকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান ‘ভারতরত্ন’ দেওয়া হোক। প্রবল আপত্তি উঠছে – উনি তো ইংরেজ সরকারের কাছে মাফিনামা লিখে তবে ছাড়া পেয়েছিলেন; উনি কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্টের বিরোধিতা করেছিলেন। তাহলে উনি ইংরেজের দালাল! এবং উনি হিন্দুরাষ্ট্রের পক্ষধর, তাই হিন্দু মহাসভা গঠন করেছিলেন। এ তো আমাদের সেকুলার সমদর্শী বহুভাষাভাষী ভারত রাষ্ট্রের বিরোধী অবস্থান! এঁকে ‘ভারতরত্ন’ দেওয়া?

পক্ষে বলা হয় যে উনিই প্রথম ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ বা ‘সিপয় মিউটিনি’কে ‘ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’  আখ্যা দিয়ে বই লেখেন। বন্দে মাতরম গানের মতই এই বইটিও নাকি অনেককে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। উনি দুটো মামলায় মোট ৫০ বছরের কালাপানি’র শাস্তি পেয়েছিলেন। উনি ঠিক মাফিনামা দিতে চেয়ে পিটিশন দেননি। গান্ধীহত্যায় তাঁর সংলিপ্ত থাকার কোনও প্রমাণ আদালতে গ্রাহ্য হয়নি ।

এই সাদা-কালো বাইনারি বিতর্কে শুধু আংশিক তথ্য ও খণ্ডিত সত্যের চর্চা হয়। হারিয়ে যায় ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়ের জটিলতা ও টানাপোড়েনের ইতিহাস। কিন্তু বাস্তব সত্য কি অমন একরৈখিক? অমন লিনিয়ার? কেন আজ সাভারকরকে নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে?

এই স্বল্প পরিসরে আমরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন নিয়ে নাড়াচাড়া করে জানতে চাইব ঐতিহাসিক তথ্য ও দস্তাবেজ কী বলে। দেখব সত্যের রঙ কতটা ধূসর।


বিতর্কিত প্রশ্নগুলিঃ

সাভারকর কী কী অপরাধে শাস্তি পেয়েছিলেন এবং কী সেই শাস্তি?

সাভারকরের রাজনৈতিক কার্যকলাপের পৃষ্ঠভূমিঃ

১৯০৬ সালের মাঝামাঝি সাভারকর লন্ডনে গ্রে'স ইন এ ব্যারিস্টারি পড়তে এলেন। পুণের এই গরীব পরিবারের ছেলেটির তখন বয়েস ২৩; এর আগে পুণের ফার্গুসন কলেজে আইন পড়ার সময় ছাত্র আন্দোলন করে শাস্তি পেয়েছেন। কার্জনের বাংলা ভাগ নিয়ে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় তিনি বিদেশী বস্ত্র পোড়ানোর ডাক দিয়েছিলেন। সাভারকর পুণেতে ভারতের প্রথম গুপ্ত সমিতি 'অভিনব সমিতি' প্রতিষ্ঠা করেন। এই গুপ্ত সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিদেশে বসবাসকারী অনেক ভারতীয় ছাত্র ও বিপ্লবী।

শ্যামজী কৃষ্ণবর্মা, বিশিষ্ট ভারতীয় বিপ্লবী, তখন লন্ডনে ইন্ডিয়া হাউস বলে একটি হোস্টেল খুলে ভারতীয় ছাত্রদের নামমাত্র খরচায় থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। বৃত্তিও দিতেন। উনি ইন্ডিয়ান সোসিওলজিস্ট বলে একটি র‍্যাডিক্যাল পত্রিকাও প্রকাশ করতেন। ওখানে মাদাম ভিকাজী কামা, বিপিন চন্দ্র পাল এঁর বন্ধু ছিলেন।
তিলকের রেকমেন্ডেশনে সাভারকর ঠাঁই পেলেন। সেখানে যোগাযোগ হোল বীরেন চট্টো (সরোজিনী নাইডুর ছোট এবং পরবর্তী কালের কমিউনিস্ট এম পি এবং কবি হারীন্দ্রনাথ চট্টোর বড়ভাই), বিপিন পালের ছেলে নিরঞ্জন এদের সঙ্গে। অচিরেই সাভারকর এখানে স্বাধীনতা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা ছাত্রদের নেতা হয়ে উঠলেন।
ইন্ডিয়া হাউসের কার্যকলাপ নিয়ে লন্ডন টাইমস সমালোচনা করল এবং গোয়েন্দারা নজর রাখতে লাগল। ইন্ডিয়া হাউসের সদস্যদের প্রোফাইল দেখুন। অল্পদিন পরে লন্ডনে সাহেব হত্যা করে ফাঁসিতে চড়া মদন লাল ধিংরা তখন ইঞ্জিনিয়রিং পড়তে গেছেন। তিন সদস্য বাপট, হোরিলাল এবং হেমচন্দ্র দাস বোমা তৈরির রাশিয়ান ম্যানুয়ালের ইংরেজি অনুবাদের কয়েক কপি নিয়ে ভারতে ফিরে গেলেন। পরে আলিপুর বোমার মামলায় (১৯০৯) হোরিলাল ও হেমচন্দ্র অভিযুক্ত হলেন। বাপট আন্ডারগ্রাউন্ড রইলেন।
১০ মে ১৯০৮ সালে সিপাহী বিদ্রোহের শহীদদের ৫০ বছর স্মরণ অনুষ্ঠানে ইন্ডিয়া হাউস জমজমাট। মেয়েরা বন্দে মাতরম গাইলেন। সাভারকর তাঁর কবিতা 'ওহ মারটিয়ার্স' পড়লেন।
সেই বছর সাভারকর মারাঠিতে গারিবলদির আত্মজীবনী এবং সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস লিখে ফেললেন। মারাঠি বই দুটো গোয়েন্দাদের চোখ এড়িয়ে ভারতে বেশ কিছু কপি পৌঁছে গেল। পরের বইটি ইংরেজিতে 'The History of the War of Indian Independence' নামে অনূদিত হলো। 
এই বইয়ে সাভারকর স্বাধীনতার জন্যে হিন্দু-মুসলমানের সংযুক্ত আন্দোলনের প্রশংসা করেছিলেন। পরবর্তীকালের সমাজবাদী নেতা অরুণা আসফ আলি এই বইটি পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
এই বইটি পড়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন আরও অনেকে, যেমন রাসবিহারী বসু, সুভাষচন্দ্র বসু, ভগত সিং। শোনা যায়, ভগত সিং তাঁর দলে যুবক রিক্রুট করার সময় জিজ্ঞেস করতেন সেই যুবক সাভারকরের বইটি পড়েছে কিনা!
আই এন এর সোলজারের অধিকাংশই বলতেন, তাঁরা সাভারকরের বই পড়ে খুব ইন্সস্পায়ার্ড হয়েছিলেন। অনেকেই ছিলেন যারা বলেছিলেন I joined the INA only on the advice of Savarkar।

এই বইটি লিখতে সাভারকর ইন্ডিয়া হাউস লাইব্রেরিতে পড়াশুনো করেছিলেন।
কার্ল মার্ক্সও তাঁর ‘ইন্ডিয়াজ ফার্স্ট ওয়ার অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স’ লেখাটি লন্ডন প্রবাসের সময় একই লাইব্রেরিতে বসে পড়াশুনোর ভিত্তিতে লিখেছিলেন। যদিও প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে। সাভারকর কি এই লেখাটির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না?
এ নিয়ে কোনও তথ্য নেই, যদিও সেসময় সাভারকরের ওঠাবসা বেশ ক'জন বৃটিশ লেবার ও সোসালিস্ট নেতাদের সঙ্গে। অরুন্ধতী রায় কিন্তু বলেছেন, সাভারকর মার্ক্স-এর সিপাহি বিদ্রোহ নিয়ে লেখা তখনও পড়েননি।
ইতিমধ্যে ইন্ডিয়া হাউসের ম্যানেজমেন্ট সাভারকরের হাতে; উনি আইন পাশ করেছেন এবং উনি কৃষ্ণবর্মা, ভিকাজি কামা এবং বিপিন পালের মতোই হোম রুলের দাবির পক্ষে এবং নবোদিত কংগ্রেসের নরমপন্থার বিপক্ষে বক্তব্য রাখছেন।

তার প্রদর্শিত হিন্দুত্ব রাজনীতি পরবর্তীকালে কোনদিকে মোড় নিল, সে আলোচনা উঠে আসা অবশ্যম্ভাবি; কিন্তু ব্রিটিশের ট্রেটর, গান্ধী বিরোধী বলে যে ব্যক্তিটি পরবর্তীকালে সুপ্রসিদ্ধ হয়ে রইলেন, তাঁকে সে সব তকমা থেকে মুক্ত করে নূতন করে চর্চা হলে ব্যক্তিটি ও তাঁর রাজনীতি অনেক সুস্পষ্ট হবে।

এমন সময় পুণেতে বিপ্লবী কবিতা প্রকাশনের অপরাধে ওঁর বড়দা এবং পরিবারের কর্তা বাবারাও সাভারকরের যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা হলো। এর ঠিক ২৩ দিন পরে মদনলাল ধিঙড়া বৃটিশ প্রশাসক মর্লি'র এডিকং উইলিকে হত্যা করলেন।
পুলিশ ইন্ডিয়া হাউসে তালা ঝোলালো। সাভারকর বিপিএন পালের আশ্রয়ে গেলেন। গান্ধী তখন লন্ডনে, এই হত্যাকে কাপুরুষতা বলে নিন্দা করলেন। সাভারকর ধিংড়ার সমর্থনে বক্তৃতা দিলেন এবং লিখলেন। পুলিশ পেছনে লাগল, তদন্ত করল, স্পষ্ট প্রমাণ পেল না। কিন্তু এর ফলে সাভারকর গ্রে ইন কোর্টে আইন প্র্যাকটিস করার লাইসেন্স পেলেন না ।

সাভারকরের অপরাধঃ

১৯০৮ সালে সাভারকর ভারতে কুড়িটি ব্রাউনিং পিস্তল লন্ডন থেকে ইন্ডিয়া হাউসের রাঁধুনি চতুর্ভূজ আমিনের মাধ্যমে ভারতে পাঠিয়েছিলেন।
নভেম্বর ১৯০৯ এ আমেদাবাদ শহরে ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর উপর দুটো বোমা ছোঁড়া হয়, একটাও ফাটেনি। কিন্তু ২১ ডিসেম্বরে নাসিক শহরে কলেক্টর এবং ম্যাজিস্ট্রেট জ্যাকসনকে একটি থিয়েটার হলে অনন্ত কানহারে গুলি করে মারে। জ্যাকসন সংস্কৃত ও মারাঠি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন এবং মারাঠিতেই কথা বলতেন। উনিই সাভারকরের দাদা বাবুরাওকে রাষ্ট্রদ্রোহের কবিতা ছাপার অপরাধে আজীবন কারাবাসের শাস্তি দিয়েছিলেন।
সন্দেহ করা হয় যে, হত্যার পেছনে আসল মাথা হচ্ছে লন্ডনে বসে বদলা নিতে কলকাঠি নাড়া ছোটভাই বিনায়ক দামোদর সাভারকর। আমিন রাজসাক্ষী হলো, অভিযুক্তদের কাছ থেকে পাওয়া একটি পিস্তল যেটি সেই কুড়িটির একটি বলে প্রমাণিত হলো। সবাই বলল, এখান থেকে সরে যাও, তাই সাভারকর প্যারিসে গিয়ে মাদাম কামার আশ্রয়ে থেকে 'মদন'স তলওয়ার' নামে (মদনলাল ধিঙড়ার স্মরণে, নামটি বীরেন চট্টোর দেওয়া) ওঁর পত্রিকায় লিখতে থাকেন। সেখানে রাশিয়া, ইজিপ্ট এবং তুরস্কের বিপ্লবীদের সঙ্গে ওঁর মোলাকাত হতে থাকে। হঠাৎ উনি প্যারিসের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে সবাইকে অবাক করে লন্ডনে ফিরে গেলেন এবং ১৩ মার্চ ১৯১০ তারিখে ভিক্টোরিয়া রেল স্টেশনে নামামাত্র গ্রেফতার হলেন।
মনে হয়, পুলিশকে কেউ গোপনে খবর দিয়েছিল।
ধরা পড়বেন জেনেও উনি কারও কথা (বিশেষ করে মাদাম কামা এবং বীরেন চট্টোর) না শুনে লন্ডন ফিরে গেলেন? কেন?
এ নিয়ে অনেকগুলো থিওরি প্রচলিত।
যেমন, দলকে উজ্জীবিত করতে বা নিজের সাহস প্রমাণ করতে, কারণ দলের মধ্যে কথা উঠছিল যে উনি সবাইকে ফিল্ডে অ্যাকশনে এগিয়ে দেন, কিন্তু নিজে নিরাপদে পেছনে থাকেন।
তবে আর একটা ইন্টারেস্টিং থিওরি বৃটিশ প্রেসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাহল উনি মার্গারেট লরেন্স নামে এক ইংরেজ মহিলার প্রেমে পড়েছিলেন। তাঁর গোপন আমন্ত্রণে দেখা করতে গিয়ে পুলিশের ফাঁদে বন্দী হন।
কৃষ্ণবর্মা প্রেসে চিঠি লিখে জানিয়েদেন যে এটা -- পুলিশের দ্বারা প্রেমিকার বকলমে পাঠানো জাল চিঠি পেয়ে উনি ধরা পড়েন---গুজব মাত্র।
(আমার মনে পড়ে, সমারসেট মম'এর ছোটগল্পের দ্বিতীয় ভল্যুমে অ্যাশেন্ডেন সিরিজের ওই গল্পটি যাতে চন্দ্র নামের পাগড়ি পরা ভারতীয় বিপ্লবীকে বৃটিশ পুলিশ প্রেমিকার চিঠি পাঠিয়ে বন্দী করে।)

উপরের সাক্ষ্য, পিস্তল, চতুর্ভুজের বয়ান এবং সাভারকরের ট্রাংক থেকে বাজেয়াপ্ত করা সিপাহী বিদ্রোহের উপর বই, 'হাউ টু অরাগানাইজ রেভোলুশন' বিষয়ক লেখাপত্তর এবং লন্ডনে নিষিদ্ধ ইস্তেহার --এসব দেখে ১২/০৫/১৯১০ এ বৃটিশ ম্যাজিস্ট্রেট রায় দিলেন যে এই বন্দীর ভারতে ফিউজিটিভ অফেন্ডার্স অ্যাক্ট ১৮৮১ অনুযায়ী বিচার হওয়া উচিত। আপীল এবং হেবিয়াস কর্পাসের রিট ব্যর্থ হলো। ২১/০৬/১৯১০ তারিখে কোর্ট অফ আপীল আগের রায় বহাল রাখল।
ইতিমধ্যে বৃটিশ রাজ একটি অর্ডিনান্সের মাধ্যমে সাভারকরের ভারতে বিচারের জন্যে এক তিন সদস্যীয় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করল যাতে জুরি থাকবে না এবং যার রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা যাবে না ।
বন্ধুরা (যেমন, কৃষ্ণবর্মা, মাদাম কামা, আইয়ার এবং বীরেন চট্টো) ডিফেন্সের জন্যে ফান্ড সংগ্রহে নেমে পড়লেন। পুলিশ রেকর্ড অনুযায়ী বীরেন চট্টোপাধ্যায় রিস্ক নিয়ে প্যারিস থেকে লন্ডন এসে চোদ্দোবার ব্রিক্সটন জেলে সাভারকরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। লন্ডনে ভারত পাঠানোর বিরুদ্ধে বৃটিশ কোর্টে সেকন্ড আপীল ঢিমে তেতালায় চলল ।
নাসিকে জ্যাকসন হত্যার সময় সাভারকর লন্ডনে ছিলেন। তাই লন্ডনে বিচার হলে অধিকতম শাস্তি হবে দুই থেকে তিনবছর। সরকার চাইল পুণেতে সাক্ষী এবং কাগজপত্র যোগাড় করতে যাতে দেখানো যাবে সাভারকর অনেক আগে থেকেই ভারতে সশস্ত্র পন্থায় বৃটিশ শাসন উচ্ছেদের প্রচার করছিলেন।
আপীল খারিজ হলো এবং ১ জুলাই ১৯১০ তারিখে মুম্বাইগামী এস এস মোরিয়া জাহাজে একটি চারবার্থের কেবিনে হাতকড়া লাগানো অবস্থায় সাভারকরকে তোলা হলো। সঙ্গী স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ইন্সপেক্টর এডওয়ার্ড পার্কার এবং মুম্বাই পুলিসের ডিএসপি সি আই ডি ও দুজন কন্সটেবল।
জাহাজ ৭ জুলাই সকাল ১০টায় ফ্রান্সের মার্সাই বন্দরে নোঙর ফেলল।
৮ জুলাই সকাল সাড়ে ছ'টায় সাভারকর পায়খানায় যাবার অনুমতি চাওয়ায় পার্কার নিজে গিয়ে ক্লোজেট চেক করে এসে হাতকড়ি খুলিয়ে ভেতরে যাবার অনুমতি দিলেন। তারপর পাশের ক্লোজেটে নিজে গিয়ে তিন ইঞ্চি ফাঁকের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখলেন যে সাভারকরেরটি বন্ধই আছে। উনি বাইরে দু'জন হেড কন্সটেবলকে সতর্ক পাহারায় থাকতে বলে নিজের বাংকে ফিরে গেলেন। ওরা দরজার নিচের থেকে উঁকি মেরে দেখল যে বন্দীর চপ্পল দুটো ছেড়ে রাখা, মানে ও কাজকম্ম সারছে।
খানিকক্ষণ পরে অমর সিং দরজার উপরে মাথা গলিয়ে দেখল ছোট্ট পোর্ট হোলের মাঝখান দিয়ে সাভারকরের আদ্দেক শরীর গলে গেছে। ওর চিৎকারে বাকিরা এসে দরজা ভেঙে যখন ঢুকল তখন সাভারকর পুরো গলে গিয়ে সমুদ্রের জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ওরা প্রহরীদের সতর্ক করল। একজন গার্ড জলে সাঁতরানো সাভারকরকে দেখে গুলি চালাল।
পুলিশের বিবরণ অনুযায়ী প্রায় ১২ ফুট সাঁতরে উনি জেটিতে উঠে দৌড়তে লাগলেন। এরাও 'চোর! চোর! ধর! ধর!' চিৎকার করে তাড়া করল।
২০০ গজ দৌড়ে সাভারকর হাঁপিয়ে পড়লেন এবং ভারতীয় পুলিশ ও একজন ফ্রেঞ্চ ন্যাভাল সিকিউরিটি গার্ড ওঁকে চেপে ধরল।
সাভারকর ফ্রেঞ্চ পুলিশকে বললেন -তুমি আমাকে গ্রেফতার করে তোমাদের ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে পেশ কর।
ও ইংরেজি জানত না। কাজেই বন্দী সাভারকরকে আবার ওই 'মোরিয়া' জাহাজে তোলা হলো।

সাভারকরের মুক্ত হওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় একটা আন্তর্জাতিক আইনের প্রশ্ন সামনে এল।
হারীন্দ্রনাথ চট্টো জানিয়েছেন যে, প্যারিসে মাদাম কামা এবং বীরেন চট্টো এই প্রশ্নটি তুলেছিলেন। কামা কার্ল মার্ক্সের নাতি জাঁ লঙ্গে যিনি ফ্রান্সের প্রভাবশালী সোশ্যালিস্ট তরুণ নেতা এবং কলামনিস্টকে অনুরোধ করলেন সাভারকরের মুক্তির দাবিতে প্রচার আন্দোলন শুরু করতে। জাঁ লঙ্গে ল্যুমানিতের কলামনিস্ট ছিলেন। প্যারিসের ডেইলি মেইল পত্রিকায় ছাপা ছোট খবরটিকে ভিত্তি করে উনি সাভারকরের গ্রেফতারি নিয়ে প্রশ্ন তুললেন।
মার্সাই বন্দরে সাভারকরকে কে বন্দী করল?
বৃটিশ বা ভারতীয় পুলিশ? ওদের ফ্রান্সের জমিতে কাউকে গ্রেফতারের অধিকার কে দিয়েছে? এ তো আন্তর্জাতিক আইনের উল্লংঘন!
তবে কি ফ্রেঞ্চ নাভাল পুলিশ? তাহলে সে কি করে বন্দীকে বৃটিশ পুলিশের হাতে সমর্পণ করল? বিশেষ করে বন্দী যখন ফ্রেঞ্চ ম্যাজিস্ট্রেটের কোর্টে সারেন্ডার করতে চাইছে?
লঙ্গে ল্যুমানিতে পত্রিকায় একগাদা কড়া প্রবন্ধ লিখলেন। ফলে ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং ভারতের মধ্যে আইনি ক্যাচাল শুরু হলো।
মার্সাইয়ের সোশ্যালিস্ট মেয়র জাঁ জেরে এবং তাঁর ডেপুটি কাঁদেন্যা বললেও, বৃটিশ পুলিশ সাভারকরকে 'চোর' বলে ফরাসী পুলিশকে মিসগাইড করেছে। কাজেই এই প্রত্যর্পণ বেআইনী। সাভারকরের রাজনৈতিক আশ্রয়ের অধিকার নায্য।
ফ্রান্স মিডিয়া --ল্যুমানিতে, লিব্রে প্যারোল, সান্ধ্য টেম্প তথা জুর্নাল দ্য দেবাত-- বিদেশমন্ত্রীর উপর চাপ দিতে লাগল সাভারকরকে ফিরিয়ে আনতে।
বৃটিশ মিডিয়া-- অবজার্ভার ও টাইমস --বলল একজন খুনি ও রাষ্ট্রদ্রোহীকে নিয়ে ফ্রেঞ্চ সরকারের আতুপুতু করার দরকার নেই। বন্দী তো বৃটিশ কাস্টডিতেই ছিল।
আমেরিকার সাঁ লুই পোস্ট ডেস্প্যাচ লিখল বৃটিশ সরকার তো আগেও অনেককে আশ্রয় দিয়েছে। চিনের বিপ্লবী সুন ইয়াত সেন ইংল্যান্ডের মাটিতে আশ্রয় পেয়েছিলেন। চিন সরকারের শত অনুরোধেও ব্রিটিশ কান দেয়নি। এবার অন্যরকম কেন ?
বৃটিশ শাসকদের মধ্যেও মতদ্বৈধ ছিল।
লিবারেল লর্ড মোর্লি ( ভারতের সেক্রেটারি অফ স্টেট) সাভারকরের বিচার লন্ডনের বদলে মুম্বাই হওয়ার প্রস্তাবে প্রশ্ন তোলায় মুম্বাইয়ের গভর্নর লর্ড সিডেনহ্যাম লিখলেন-- আপনি কিছুই জানেন না। সাভারকর ওয়জ ওয়ান অফ দ্য মোস্ট ডেঞ্জারাস মেন দ্যাট ইন্ডিয়া হ্যাজ প্রডিউসড'।
স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এবং ইন্ডিয়া অফিস সাভারকরকে ফ্রেঞ্চ সরকারকে ফেরত দেওয়ার প্রস্তাবে রাজি নয়। উল্টোদিকে হোম সেক্রেটারি উইন্সটন চার্চিল বলছেন-- ইংল্যান্ডের আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলার ভাবমূর্তি যেন একটা অপরাধীর ভেগে যাওয়ার পেটি ঝামেলায় ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ফেরত দিয়ে দাও।
বৃটেনে বামপন্থীরা জোট বেঁধে সাভারকরের পক্ষে দাঁড়িয়ে 'রিলীজ সাভারকর কমিটি' বানিয়ে প্রচার অভিযানে নাবলেন। ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান লিখল, ফ্রান্সের মাটিতে পা রাখা মাত্র সাভারকরকে বৃটিশ আইনের ক্ষেত্রাধিকার থেকে মুক্ত মেনে নেওয়া উচিত। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির মুখপত্র 'জাস্টিস' পত্রিকা ভারতের কলোনিয়াল নাগপাশ থেকে মুক্তির প্রয়াসকে সমর্থন জানাল।
শেষে ফ্রেঞ্চ সরকার এ নিয়ে মধ্যস্থতা চেয়ে দি হেগ এ আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালে গেল। বৃটিশ রাজি হলো, কিন্তু চাল দিল যে মুম্বাই কোর্টে সাভারকর মামলার শুনানি শুরু হয়েছে, সেটা স্থগিত হবে না ।
ভারতের বাম এবং র‍্যাডিক্যালদের তথা ইংল্যান্ডের লিবারেলদের আপত্তিতে কান না দিয়ে তিন জজের ট্রাইব্যুনাল বিচার শুরু করল। মাদাম কামা ডিফেন্সের জন্যে পাঠালেন তিলকের পরিচিত জোসেফ ব্যাপটিস্টাকে।
মুখ্য প্রসিকিউটর ছিলেন এম জার্ডিন, ক্রিকেটে বডিলাইন বোলিঙয়ের জন্যে কুখ্যাত ইংল্যান্ড ক্যাপ্টেন ডগলাস জার্ডিনের বাবা।
বিচার শেষ হোল অস্বাভাবিক দ্রুততায়। জার্ডিন আদালতকে জানালেন যে, এই সাভারকরই হচ্ছে লন্ডনে ভারতীয় র‍্যাডিক্যালদের মাথা।
প্রথম মামলার-- রাষ্ট্রদ্রোহিতার (বিভিন্ন বক্তৃতা এবং লেখার ভিত্তিতে)-- রায় বেরোল ২৩ ডিসেম্বর ১৯১০ । যাবজ্জীবন কারাবাস এবং স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ। তখন এর মানে ছিল ২৫ বছর।
জ্যাকসন হত্যা মামলার রায় বেরোল ৩০ জানুয়ারি, ১৯১১। একই রায় --আজীবন কারাবাস, মানে ২৫ বছর সশ্রম জেল।
কিন্তু দুটো শাস্তি একসঙ্গে (কনকারেন্টলি) চলবে না; হবে একের পরে এক (কঞ্জিকিউটিভলি)। ফলে মোট কারাবাস ৫০ বছর, ওদিকে সাভারকর তখন ২৮ বছরের যুবক এবং ভারতীয়দের গড় আয়ু তখন ছিল ৪০ এর কম।
কিন্তু হেগ আন্তর্জাতিক আদালতের রায় না আসা পর্য্যন্ত সাজা মুলতুবি থাকবে।

সাভারকরের কারাবাস

উপরের রায় বেরোনোর এক পক্ষকাল পরে দি হেগ এ পার্মানেন্ট কোর্ট অফ আর্বিট্রেশন এ সাভারকর প্রত্যর্পণ মামলা শুনানি শুরু হোল এবং মাত্র ১০ দিনের মধ্যে রায় বেরোল।
পাঁচ সদস্যীয় ট্রাইবুনালে রাশিয়া বা জার্মানির কেউ ছিলেন না। ছিলেন বেলজিয়ামের প্রাক্তন প্রাইম মিনিস্টার, নরওয়ে এবং নেদারল্যান্ডের দুই প্রাক্তন মিনিস্টার, ইংল্যান্ডের প্রাক্তন এটর্নি জেনারেল, এবং ফ্রান্সের এক বিশিষ্ট আইনি পরামর্শদাতা।
রায়ে স্বীকার করা হলো যে, ফ্রান্সের মাটিতে (মার্সাই) ফরাসী পুলিশ অফিসার যে সাভারকরকে বন্দী করে বৃটিশ পুলিশের হাতে সঁপে দিলেন, তাতে আন্তর্জাতিক আইন স্পষ্টতঃ লঙ্ঘিত হয়েছে। কিন্তু এর ফলে আদৌ বৃটিশ সরকারের উপর বন্দীকে ফ্রান্স সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব বর্তায় না। কারণ ভুল তো বৃটিশ সরকারের লোক করেনি, বিদেশি সরকারের প্রতিনিধি করেছে। এই রায়ের তীব্র সমালোচনা করল ইউরোপের উদারনৈতিক ধারার প্রতিনিধিরা। ইংল্যান্ডের নিউক্যাসলের লেবার এম পি কড়া করে ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ানে চিঠি লিখলেন। সবার মোটামুটি কথা হলো ফ্রান্স বৃটেনের কাছে মাথা বিকিয়ে দিয়েছে এবং ইংল্যান্ডও তার চিরাচরিত উদারনীতি থেকে এখানে সরে এসেছে।
সাভারকর রায় বেরোনোর সময় সেন্ট্রাল মুম্বাইয়ের ডোংগরি জেলে ছিলেন। এবার আন্দামানে যেতে হবে। তার আগে বড় শালা এবং স্ত্রী যমুনা দেখা করতে এলেন। পাঁচ বছর আগে যমুনা এসেছিলেন মুম্বাই বন্দরে বিদায় দিতে। আশা ছিল, ফিরে আসবে এক সফল ব্যারিস্টার। তার জায়গায় দেখলেন হাতে পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি স্বামীকে, যে যাচ্ছে কালাপানি, ৫০ বছরের জন্যে, তাহলে এই বোধ হয় শেষ দেখা।
এস এস মহারাজা ছাড়ল মাদ্রাজ বন্দর থেকে। লোয়ার ডেকে গাদাগাদি করে কালাপানির সাজাপ্রাপ্ত বন্দীরা। কেউ খুনি, কেউ আরও কিছু। তিরিশজনের জায়গায় গাদাগাদি করে পঞ্চাশ জন। গন্তব্য পোর্ট ব্লেয়ার বন্দর, তারপর সেলুলার জেল।
এই জেলের খুপরিগুলোর কথা সবাই জানে। আগে এতে থাকত সিপাহীবিদ্রোহের বন্দীরা, এখন ৫০ বছর পরে অন্যেরা। জেলর ডেভিড ব্যারি আগেই বলে দেন যে, জেলের চারদেয়ালের মধ্যে ওঁর মর্জিই আইন। বৃটিশ আইনে রাজনৈতিক ও অন্যান্য বন্দীদের জন্যে যে ব্যবস্থা বা সুবিধেগুলো স্বীকৃত তার কিছুই এখানে খাটবে না। এবং তার চেলাচামুণ্ডারা (জমাদার, ওয়ার্ডার, পেটি অফিসার), যারা নিজেরাই দীর্ঘমেয়াদি জেল খাটছে-- তাদের ব্যবহার অত্যাচারের পর্যায়বাচী।
বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, উপেন্দ্রনাথের বিবরণ এবং ত্রৈলোক্য মহারাজের স্মৃতিচারণে এর বিস্তৃত বিবরণ আছে ।
সাভারকরকে আলাদা করে একটা ১৪ বাই ৮ ফুটের সেলে রাখা হলো। পাহারায় তিনজন-- দুই বালুচ মুসলিম এবং একজন পাঠান। তাঁর স্নানের ব্যবস্থার সময়েও ওই পাহারা।
রোজ খাটতে হবে সকাল ৬টা থেকে ১০টা, এবং দুপুরের খাওয়ার পরে বিকেল ৫টা পর্য্যন্ত। কাজ নারকোলের ছোবড়া মুগুর দিয়ে পিটিয়ে বিকেলের মধ্যে অন্ততঃ ১ থেকে ৩ পাউন্ডের মতো জাজিম গোছের বানানো।

রোজ গোটা কুড়ি নারকোলের ছোবড়া পেটানো? সাভারকর আপত্তি করায় শুনতে হলো যে তোমার কপাল ভালো যে অন্যদের চেয়ে একটু কম টার্গেট দেওয়া হয়েছে।

এরপর ১৬ আগস্ট ১৯১১ তারিখে সাভারকরের কপালে জুটল নেংটি পরে তেলঘানিতে সর্ষে পিষে তেল বের করার কাজ। বারীন ঘোষ এবং উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোর মতে এই কাজটা যেন কুস্তি করার মতো, অমানুষিক পরিশ্রম। তায় অপর্যাপ্ত খাবার (লপ্সি) এবং কথায় কথায় অশ্রাব্য গালাগাল ও টার্গেট পুরো হয়নি অজুহাতে পেটানো চাবকানো। রাজবন্দীদের কাগজ/কলম/বই কিছুই দেওয়া হতো না । নিজেদের মধ্যে কথা বলা বারণ। বড়ভাই বাবারাও এক বছর আগে থেকেই সেলুলার জেলে আছেন, কিন্তু দেখা করা কথা বলা যাচ্ছে না।
সাভারকর ডিসেম্বর ২০১৩ এবং ১৭ জানুয়ারি ২০১৪ ও ৮ জুন, ২০১৪ তে বেঁকে বসলেন -- কোন কাজ করবেন না ।
ফল হলো ক্রমশঃ নানারকম শাস্তি-- একমাস সলিটারি কনফাইনমেন্ট, এক সপ্তাহ হাতকড়ি, তারপর ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে দেয়ালে হাত তুলে পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে থাকা, এইসব। এরপরে উনি দড়ি পাকানোর কাজ করতে রাজি হলেন।
এই পরিবেশে উল্লাসকর দত্ত পাগল হয়ে গেলেন, ইন্দুভুষণ রায় আত্মহত্যা করলেন।
এবার রাজবন্দীদের প্রতিবাদ শুরু হলো। দাবি জেলের অন্যান্য বন্দীদের সমান সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। কাগজ-কলম-বইপত্র-পত্রিকা দিতে হবে। হালকা কাজ, ক্লার্কের কাজ দিতে হবে।
দুজন বন্দী-- স্বরাজ পত্রিকার সম্পাদক লাধারাম এবং সতের বছরের ননীগোপাল রায়-- ভুখ হরতালে বসলেন। অন্যেরা কাজ বন্ধ করল।
বিনায়ক সাভারকরের বড়দা বাবুরাও প্রথম দিন থেকেই হরতালে যোগ দিয়ে অত্যাচার সহ্য করলেন। কিন্তু সাভারকর যোগ দিলেন না।
সাভারকর তাঁর 'মাই ট্রান্সপোরটেশন ফর লাইফ' বইয়ে লিখেছেন যে ভুখ হরতাল তাঁর পছন্দ নয়। এটা লড়াইয়ের জন্যে ফালতু। ননীগোপাল রায়ের অবস্থা খারাপ হলে উনি তাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে হরতাল ভাঙালেন ও বললেন-
"ডু নট ডাই উইথ এ ফেমিনিন স্টাবর্ননেস; ইফ ইউ মাস্ট ডাই, ডাই ফাইটিং"।
তাঁর জীবনীকার বৈভব পুরন্দরের মতে বক্তব্যটি আজকের চোখে অবশ্যই পলিটিক্যালি ইনকরেক্ট মনে হবে।
এরপরে যতবার হরতাল হলো বা যখন লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার আসামী ভাই পরমানন্দ এবং আশুতোষ লাহিড়ী জেলার ব্যারিকে তুলে আছাড় দিলেন (পরে তিরিশ ঘা' করে বেত খেলেন), কর্তৃপক্ষ মনে করল এর পেছনে সাভারকরের মাথা কাজ করছে।
ত্রৈলোক্য মহারাজের 'থার্টি ইয়ার্স ইন জেল' এ পাচ্ছি সাভারকর আমাদের ক'জনকে হরতাল করতে ওসাকালো, কিন্তু নিজে টুক করে সরে গেল।
সাভারকর সেলের দেয়ালে নখ দিয়ে কবিতা লিখে মুখস্থ করে ঘষে মুছে দিতেন। এভাবে লেখা হলো 'বেড়ি', 'কোঠরি' এবং 'কমলা'। আবার ১৯১৩ সালে নোবেল প্রাইজ পাওয়ায় রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে একটি কবিতাও লেখা হলো।
ওঁর একটি দেশাত্মবোধক কবিতায় হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর সুর দিয়েছেন এবং লতা, আশা ও উষা কোরাসে গেয়েছেন।

সাভারকর আদৌ মাফিনামা লিখেছিলেন কিনা? লিখলে কবে এবং কতবার? তাঁর এবম্বিধ আচরণের ব্যাখ্যা কী?

সাভারকরের 'মার্জনা ভিক্ষা'
===================
সাভারকর কি সত্যিই বৃটিশ সরকারের কাছে 'মার্জনা ভিক্ষা' করে চিঠি লিখেছিলেন? লিখলে কতবার? এবং তাতে কি যেকোনও মূল্যে মুক্তি চেয়েছিলেন? এমনকি আজীবন বৃটিশ সাম্রাজ্যের সেবা করার এবং বিশ্বস্ত থাকার শর্তে?

সমর্থকরা এই অধ্যায়টি এড়িয়ে যেতে চান বা অস্বীকার করেন। যেমন, মারাঠি পত্রিকা 'লোকসত্তা'র ২৭ মে, ২০১৮ সংখ্যায় দাবি করা হয়েছে যে, উনি আদৌ কোনও পিটিশন পাঠান নই। বা, পাঠালেও তাতে 'মার্জনা ভিক্ষা' করেননি ।
বিরোধীরা বলেন -- সাভারকর নিজে এ নিয়ে কোথাও কিছু বলেননি বা লেখেননি। বরং আজীবন ব্যাপারটা চেপেচুপে রেখেছেন।
আমরা দেখাব যে দু'পক্ষই ভুল। সমস্ত দলিল ( বৃটিশ এবং ভারতীয়) আজ উপলব্ধ। এবং সাভারকর নিজে তাঁর এই 'এবাউট টার্ন' কে ডিফেন্ড করে সেসময় গুচ্ছের লেখা লিখেছেন, উকিলের মেধা দিয়ে এই স্ট্যান্ডকে থিওরাইজ করেছেন। কতদূর সফল হয়েছেন বা আদৌ হয়েছেন কি না, তা বিতর্কের বিষয়।

কতবার লিখেছিলেন? সাতবার।

প্রথমবার সেলুলার জেলে আসার দুমাসের মাথায়--৩০ অগাস্ট, ১৯১১, নির্জন কারাবাসের শাস্তির মাথায়। চারদিনে খারিজ হলো পিটিশন।
তারপর ২৯ অক্টোবর, ১৮১২; নভেম্বর ১৯১৩, সেপ্টেম্বর ১৯১৪। তারপর ১৯১৫ এবং ১৯১৭। শেষ দুটোতে আগের আগুনখেকো বিপ্লবী সাভারকর ওকালত করছেন হোমরুলের পক্ষে। তখন মন্টেগু -চেমসফোর্ড সংবিধান রিফর্মের কথা চলছে যা এলো ১৯১৯এ। সাভারকর লিখছেও, কোনও দেশপ্রেমিকই ভালো সংবিধানের আওতায় কাজ করার সুযোগ পেলে সহিংস পথে বিপ্লবের কথা ভাববে না। এও বললেন যে, আজ যখন ইংল্যান্ড ও আমেরিকার মতো প্রগতিশীল এবং নমনীয় (ইল্যাস্টিক) সংবিধান রয়েছে তখন বিপ্লবের কথা বলা 'অপরাধ' (!)।
তাহলে দশবছর আগে গোখলে গান্ধী এরা কি দোষ করেছিলেন?
লক্ষণীয়, সাভারকর ১৯১২ থেকে ১৯১৪ পর্য্যন্ত কাজ করতে অস্বীকার করা এবং নিষিদ্ধ কাগজপত্র রাখার অপরাধে আটবার শাস্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু পরের পাঁচবছর তাঁর আচার-আচরণ ছিল' ভেরি গুড'।
কন্সটিট্যুশনাল রিফর্মের মাথায় অনেক রাজবন্দীকে মুচলেকা লিখিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল 'রয়্যাল অ্যামনেস্টি' বলে। একই রকম মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পেলেন বারীন ঘোষ, হেমচন্দ্র দাস এবং ভাই পরমানন্দ। কিন্তু 'ম্মন্টেগু-চেমস্ফোর্ড রিফর্মের পর সাংবিধানিক পথেই থাকবেন' আশ্বাসন সত্ত্বেও বৃটিশ সরকার সাভারকর ভাইদের বিশ্বাস করতে পারছিল না। তাঁরা সম্রাজ্ঞীর মার্জনা পেলেন না ।
সাভারকরের শেষ পিটিশনের তারিখ ৩০ মার্চ, ১৯২০ যাতে উনি ছাড়া পাওয়ার পর সরকার যতদিন বলবে ততদিন কোনও রাজনৈতিক কাজকর্মে যুক্ত হবেন না, একটি এলাকার বাইরে পা রাখবেন না এবং থানায় হাজিরা দেবেন -- এই মর্মে মুচলেকা দিতে রাজি বলে জানালেন।
সাভারকর নিজের কারাবাসের অভিজ্ঞতার বর্ণনায় লিখছেন যে, উনি তখন জেলের মধ্যে অন্য বন্দীদের গোঁড়ামি ছেড়ে মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে এসে দেশের কাজ করতে বোঝাচ্ছেন। শিবাজী এবং কৃষ্ণের উদাহরণ দিচ্ছেন। অনেকে মানছে না। কিন্তু জেলের ভেতরে জীবন নষ্ট করে কি লাভ? এই ছিল ওঁর যুক্তি।
গান্ধীজি মে ১৯২০ এর ইয়ং ইন্ডিয়ায় লিখলেনঃ এত লোককে আম মাফি দেওয়া হলো, শুধু এই দুই ভাই বাদ! ওরা তো বিপ্লবের পথ ছেড়ে রিফর্ম অ্যাক্টের হিসেবে কাজ করবে বলে কথা দিয়েছে । ওদের অবিশ্বাস করার কি দরকার? বর্তমানে ভারতে সহিংস পথের অনুগামী নেই বলা যায় ।
লেবার এম পি ওয়েজউডের ডেইলি হেরাল্ডের প্রবন্ধে আন্দামান জেলের ভেতরের অবস্থা তুলে ধরা হলো। ওঁর ভাষায় সেলুলার জেল একটি নরক। পাবলিক ওপিনিয়ন বিচলিত। শান্তিনিকেতন থেকে সি এফ এন্ড্রুজ বোম্বে ক্রনিকল পত্রিকায় এ নিয়ে লিখলেন, যাতে বোম্বে গভর্নর জর্জ লয়েড সাভারকর ভাইদের ছেড়ে দেন। বৃটিশ রাজ এপ্রিল ১৯২১ এ বোম্বে গভর্নরকে একমাসের মধ্যে আগের সিদ্ধান্তের রিভিউ করতে বলল।
অবশেষে, মে ১৯২১এ দুই সাভারকর ভাইকে আন্দামান থেকে ভারতের জেলে নিয়ে আসা হলো। বড়দা বাবারাও সেপ্টেম্বর ১৯২২এ নিঃশর্ত মুক্তি পেলেন। তাঁর 'সিডিশন' বলতে ছিল কিছু জ্বালাময়ী কবিতা। তাতেই তিনি ১৫ বছর কালাপানি এবং একবছর ভারতের জেলে রইলেন।
জ্যাকসন হত্যা এবং পিস্তল সরবরাহের দায়ে অভিযুক্ত বিনায়ক সেলুলারে রইলেন ১০ বছর। ভগ্ন স্বাস্থ্য মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বিনায়ক সাভারকর জেল থেকে ছাড়া পেলেন ৬ জানুয়ারি, ১৯২৪। কিন্তু নিঃশর্ত নয়। সরকার জুড়ে দিল আরও দুটি ।
এক, ওঁকে স্বীকার করতে হবে যে ' হি হ্যাড এ ফেয়ার ট্রায়াল অ্যান্ড এ জাস্ট সেন্টেন্স' এবং দুই, ওঁকে সহিংস পদ্ধতির নিন্দা করে বিবৃতি দিতে হবে।
সাভারকর দুটি শর্তই মেনে নিয়ে মুচলেকা লিখে দিলেন। সরকার বলল পাঁচবছর উনি রত্নগিরি জেলার বাইরে যেতে পারবেন না। সাভারকর মেনে নিয়ে স্ত্রী-পুত্রকন্যা নিয়ে সংসার করতে এবং ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধারে মগ্ন রইলেন।
তাহলে লন্ডনে গ্রেফতারির দিন থেকে ধরলে ওঁর কারাবাস হলো প্রায় ১৪ বছর।
জনগণমনে বিতর্কের ঝড় বয়ে গেল। সাভারকর নিজের বন্দীজীবনের স্মৃতি ও মুচলেকার সাফাই নিয়ে কেশরী এবং মারাঠি সাপ্তাহিক 'শ্রদ্ধানন্দে' লিখতে লাগলেন। ওদিকে কেশরী , ইন্দুপ্রকাশ এবং অন্যান্য মারাঠি দৈনিকে বেরোল ওঁর মুচলেকার শর্তাবলি।


সাভারকরের মাফিনামা বিতর্ক
==================
সাভারকরের মাফিনামার শর্তগুলো প্রকাশ্যে আসায় অনেক হোমরুলের সমর্থক ক্ষুণ্ণ হলেন-- একজন খ্যাতনামা দেশপ্রেমিক চাপের মাথায় এমন সব শর্ত মেনে নিলেন!
রত্নাগিরি জেলার বাইরে যাওয়া পাঁচবছরের জন্যে নিষিদ্ধ, কিন্তু সাভারকর ঘরে বসে (তখন স্ত্রীও সঙ্গে থাকছেন) কেশরী এবং শ্রদ্ধানন্দ (বোম্বে থেকে ছোটভাই ডাক্তার নারায়ণ সাভারকরের সম্পাদিত মারাঠি পত্রিকা) পত্রিকায় সিরিয়ালি নিজের ১৪ বছর কালাপানির অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করছেন। এসব একটি বইয়ের আকারে মে, ১৯২৭ এ প্রকাশিত হয়। তাতে মাফিনামার ডিফেন্সও রয়েছে।
কিন্তু প্রখ্যাত রাজনৈতিক কর্মী এবং কানপুরের দৈনিক প্রতাপ পত্রিকার সম্পাদক গণেশ শংকর বিদ্যার্থী শ্রদ্ধানন্দ পত্রিকায় খোলাচিঠি লিখে অভিযোগ করলেন, যাঁরা দেশের জন্যে শহীদ হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন তাঁরা কী করে মার্জনা চেয়ে চিঠি লিখলেন? 'হোয়াই ডিডন্ট দে এমব্রেস ডেথ ইন প্রিজন'?
বিশেষ করে সাভারকর যে লিখেছিলেন, 'যদি পথভ্রষ্ট সন্তান (প্রডিগাল সন) নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসে তাহলে পিতার আশ্রয়লাভের করুণা থেকে নিশ্চয় বঞ্চিত হবে না !' -- এটা সবাইকে ঘা দিয়েছিল।
সাভারকরের জবাব বেরোল যার সারমর্ম হচ্ছে যে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনেক দেশপ্রেমিক ঘর ছেড়ে হোমের আগুনে নিজেকে আহুতি দিতে বেরিয়েছিল। তারা লড়ল, অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করে প্রায় মৃত্যুমুখে পৌঁছে গেল। তারপর তারা যদি ভবিষ্যৎ লড়াইয়ের জন্যে প্রাণ বাঁচাতে শত্রুর শর্ত মেনে সাময়িকভাবে যুদ্ধের ময়দান থেকে সরে আসে? এমনটি শিবাজি আগ্রা দুর্গে বন্দী অবস্থায় তাই করেননি? ঔরংজেবের শর্ত মেনে জান বাঁচিয়ে আবার যুদ্ধের ময়দানে ফিরে যাননি? যখন তিনি আফজল খাঁর সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়েছিলেন, তখন হাতে লুকনো ছিল বাঘনখ।
১৯২৮ সালে কাকোরি সরকারি ফান্ড লুঠের মামলায় রামপরসাদ বিসমিল এবং আরও তিনজনের ফাঁসি হয়, শচীন সান্যাল এবং আরও কয়েকজনের কালাপানি হয়। বিসমিল, শচীন সান্যাল এবং আরও দুয়েকজন প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিলেন, মঞ্জুর হয়নি।
উনি বারীন ঘোষ, হেমচন্দ্রের মাফিনামা দিয়ে বেরিয়ে আসার উল্লেখ করেন। এবং গণেশশংকর নিজে একটি আদালত অবমাননার কেসে জেলের সম্ভাবনায় আদালতে ভুল স্বীকার করেছিলেন --সেসব তুলে ধরেন। আরও বলেন, লড়াই না করে জেলে পচে মরার বীরত্বে ওঁর বিশ্বাস নে। তার চেয়ে যেভাবে হোক বেরিয়ে এস, তারপরে আবার লড়াই কর।
ঠিক আছে, তর্কের খাতিরে এসব যদি সাময়িক রণকৌশল বলে ধরে নিই, তবু প্রশ্ন ওঠে।
ওঁর উদাহরণের সবাই--- শ্রীকৃষ্ণ , শিবাজী, ওঁর গুরু তিলক এমনকি গান্ধী নেহেরু-- ছাড়া পাবার পরে আবার লড়াইয়ের ময়দানে ফিরে এসেছেন-- নিজের নিজের মতাদর্শ অনুযায়ী লড়াই করেছেন, দুশমনকে আঘাত হেনেছেন। কিন্তু সাভারকর?
ভারতে এসে বাকি জীবনে একবারও বৃটিশকে উচ্ছেদ করতে অস্ত্রধরা দূর কি বাত, শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনেও সামিল হননি। বৃটিশ সংবিধানের মধ্যেই দেশের উন্নতির সম্ভাবনা দেখেছেন। তাহলে লন্ডন প্রবাসের দিনগুলোয় গান্ধী-গোখলে ইত্যাদি কন্সটিট্যুশনালিস্টদের বিরোধ, সমালোচনা এবং তাচ্ছিল্যের যুক্তি কি? গান্ধীরা বরং এগিয়ে গেছেন। জেলে যাচ্ছেন কালাকানুনের প্রতিবাদে; মাস মোবিলাইজেশন করছেন, সত্যাগ্রহ শুরু করছেন। সাভারকর পিছিয়ে গেছেন তিরিশ বছর বা আরও বেশি। কারণ তাঁর শত্রু বদলে গেছে। খুঁজে পেয়েছেন তাঁর আসল শত্রু--মুসলমান।


উনি কি কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলেন?

বিয়াল্লিশের আন্দোলনে যোগ না দেওয়া
======================
গান্ধীজির 'কুইট ইন্ডিয়া' আন্দোলনে নানা কারণে যাঁরা যোগ দেননি তাঁদের লিস্টঃ
দলিত নেতা আম্বেদকর, মুসলিম লিগ নেতা জিন্না, অল ইন্ডিয়া স্টুদেন্ট কনফারেন্স, কমিউনিস্ট পার্টি, নেহেরুর আশীর্বাদ ধন্য কিছু কিসান সভা; এবং কিছু লিবেরাল জনতা যাঁরা মনে করতেন জাপান জিতলে ভারত স্বাধীনতা পাবে।
এরা কেউ বৃটিশের দালাল নন, কিন্তু কমিউনিস্ট সমেত অনেকের গায়ে কংগ্রেস এই তকমাটা সেঁটে দিয়েছিল।
প্রত্যেকের আলাদা আলাদা কারণ ছিল। যেমন কমিউনিস্ট পার্টির রাশিয়ার নেতৃত্বে জনযুদ্ধ।
সাভারকরের কাছে এটা ছিল হিন্দু যুবকদের বিশেষ সুযোগ-- বৃটিশ ফৌজে ঢুকে যুদ্ধবিদ্যা অস্ত্রচালনায় পারঙ্গম হয়ে আগামী দিনের মহাসমরের জন্যে (মুসলিম মুক্ত ভারত) প্রস্তুত হওয়া।


গান্ধীহত্যার সঙ্গে সাভারকরের আদৌ কোনও সম্পর্ক আছে কি?

গান্ধীহত্যা মামলা
==========

স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে এই সময়ের ইতিহাসটাকে যেভাবে দেখায় ব্যাপারটা একেবারে অমন সরলরৈখিক ছিল না। বিজয়ীর লেখা ইতিহাস অমনই হয়। স্তালিনের আমলে লেখা সোভিয়েত বিপ্লবের ইতিহাস পড়লে মনে হবে বলশেভিকরা গোড়া থেকেই বিপ্লবের সমস্ত সম্ভাব্য দিকবদল বাঁক দেখতে পেয়ে সচেতন শক্তি হিসেবে দ্বিধাহীন পদক্ষেপ নিয়ে জারতন্ত্রের অবসান এবং পরবর্তী বিপ্লব ঘটিয়েছে। চিনের মাওজমানায় লেখা আফিং যুদ্ধ থেকে সাংস্কৃতিক বিপ্লব পর্য্যন্ত ইতিহাসের একমাত্রিক বিবরণ মনে করুন ।
ভারতের ক্ষেত্রে তিরিশ এবং চল্লিশের দশক ছিল অনেকগুলো ক্রস কারেন্টের সমাহার।সেটা আদৌ মহাভারতের যুদ্ধের মত একদিকে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ অব্যদিকে গান্ধীজির নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ভারত--- এমন ছিল না ।
তখন অনেকগুলো প্রশ্ন উত্তরের অপেক্ষায় হাঁ করে দাঁড়িয়ে।
যেমন, বৃটিশ-উত্তর ভারতের চেহারা কেমন হবে? ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও ধার্মিক সমূহের মধ্যে ব্যবস্থার বাঁটোয়ারা কেমন হবে? বৃটিশের তৈরি বিভিন্ন ধার্মিক সমুদায়ের জন্যে আলাদা আলাদা ইলেক্টোরেটস এবং রিজার্ভ সীটের ভবিষ্যৎ কী হবে? ভোট দেওয়ার অধিকার কারা পাবে? বৃটিশ জমানায় শুধু করদাতা এবং জমির মালিকদের ভোটাধিকার ছিল। আর হিন্দু-মুসলিম আলাদা ইলেক্টোরেট হওয়ার ফলে মাইনরিটি মুসলমানের একটি ভোটের ওজন মেজরিটি হিন্দু ভোটের চেয়ে বেশি হয়ে গেছল।
সাভারকর, আম্বেদকর, দেশি লিব্যারেল, জিন্না, গান্ধী নেহরু সবাই এসব প্রশ্নে নিজের নিজের অবস্থান নিয়ে এনগেজ করছিলেন।
সাভারকর ব্যস্ত ইংরেজ তাড়াতে নয়, ভারতে লড়াকু হিন্দুসমাজ সংগঠিত করতে। গান্ধী এবং কংগ্রেসের সঙ্গে উতোর-চাপান চলতে লাগল।
দাঙ্গার গান্ধীর মুসলিম শরণাআর্থী এবং দাঙ্গাপীড়িতদের সাহায্যে হিন্দু যুবকদের এগিয়ে আসার আহ্বানে সাভারকর খেপে গেলেন। তাঁর হিন্দু মহাসভা এবং তাঁর দেওয়া ফান্ডিং নিয়ে নাথুরাম গোড়সের পত্রিকা --যার মাস্টহেডে সাভারকরের ছবি থাকত-- গান্ধী এবং মুসলিম সমাজের প্রতি আগুন উগরে চলল।
১৫ অগাস্টের ঠিক আগে সাভারকর গেরুয়া পতাকাকে স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রীয় ধ্বজ করার প্রস্তাব রাখলেন; সংবিধান সভার ফ্ল্যাগ কমিটি খারিজ করল। তখন উনি পতাকার কেন্দ্রে গান্ধীজির চরখার বদলে সারনাথের অশোক চক্র করার প্রস্তাব রাখলেন; সেটা গৃহীত হলো।
ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ১৪ অগাস্ট, ১৯৪৭ তারিখে ক্যাশ ব্যালান্স ছিল ২২০ কোটি টাকা। ঠিক হলো, দেশ স্বাধীন হলে বৃটিশের হাত থেকে আনুপাতিক হিসেবে পাকিস্তান পাবে ২৫%, মানে ৫৫ কোটি টাকা। কিন্তু অক্টোবরে পাঠান আদিবাসীরা মহারাজা হরি সিঙয়ের করদ রাজ্য কাশ্মীর আক্রমণ করল। নেহেরু- প্যাটেল টাকা দেওয়া স্থগিত রাখলেন। জানুয়ারি ১৯৪৮, অর্থাৎ যতদিন মহারাজা ভারতে যোগদানের সন্ধিপত্রে দস্তখত না করলেন, টাকা আটকে রইল। শেষে নেহেরু-প্যাটেলের বিরুদ্ধে গান্ধীর অনশনে ক্যাবিনেট হার মানল; টাকা দিল পাকিস্তানকে। এটা নিয়ে দেশের জনমানসে টেনশন বাড়ল।
এই প্রেক্ষিতে গান্ধীহত্যা মামলা দেখা যাক ।

গান্ধীর উপর হামলা হলো দু'বার। প্রথমবার ব্যর্থ, দ্বিতীয়বার সফল। প্রথমবার ১৯৪৮ সালের ২০ জানুয়ারিতে বিড়লা হাউসে; দ্বিতীয়বার ৩০ জানুয়ারিতে ।
প্রথমবারের হামলাকারী মদনলাল পাহওয়া, এক পাঞ্জাবী উদ্বাস্তু কিশোর। ওর ছোঁড়া সুতলি বোম গান্ধীজির থেকে ৭৫ ফুট দূরে ফাটল।
দ্বিতীয়বার তিন মারাঠি চিতপাবন ব্রাহ্মণ (সাভারকরও তাই)। এঁরা হলেন নাথুরাম গড়সে, নারায়ণ আপ্তে এবং বিষ্ণু কারকারে। তিনজনেই হিন্দু মহাসভার অগ্রণী সদস্য। গুলি চালালেন নাথুরাম পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে ।

নাথুরাম ১৯৩০ সালে আর এস এস এর সক্রিয় সদস্য হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৩৭ সালে সাভারকর সবরকম প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্ত হয়ে রাজনীতিতে নামতেই হিন্দু মহাসভায় যোগ দিলেন। ১৯৩৮এ হায়দরাবাদের নিজামের বিরুদ্ধে সাভারকরের সবিনয় প্রতিরোধ আন্দোলনে উনি প্রথম ব্যাচের সত্যাগ্রহী হয়ে এক বছর জেল খাটলেন। কারকারে ১৯৪৩ সালে হিন্দু মহাসভার টিকিটে সিভিক কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সাভারকরের থেকে ১৫০০০ টাকা ধার নিয়ে নাথুরাম ১৯৪৪ সালে শুরু করলেন 'অগ্রণী' পত্রিকার সম্পাদনা, বন্ধু আপ্তে হলেন ম্যানেজার। পত্রিকার মাস্টহেডে সাভারকরের ছবি। শুরুতেই পত্রিকায় গর্বের সঙ্গে লেখা হলো কীভাবে উনি পুণের কাছে হিল স্টেশন পঞ্চগণিতে একটি জাতীয়তাবাদী ছেলেদের দল নিয়ে গিয়ে গান্ধীজিকে হেনস্থা করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে প্রেস অ্যাক্ট ভংগের দায়ে সরকার জরিমানা করায় পত্রিকার নাম বদলে দিয়ে করা হলো 'দৈনিক হিন্দু জাগরণ'। সাভারকর পাবলিক অ্যাপিল করে বললেন, হিন্দুত্বে বিশ্বাসী সব পরিবার একটাকা করে দান দিয়ে পত্রিকাটির পাশে দাঁড়াক।
মামলায় সাভারকরকে করা হলো গান্ধীহত্যা চক্রান্তের মুখ্য মস্তিষ্ক। তবে গড়সে, আপ্তে এবং কারকারে এতে সাভারকরের হাত অস্বীকার করলেন।
কিন্তু জনৈক অস্ত্রব্যবসায়ী বাড়গে রাজসাক্ষী হয়ে বললেন, ঘটনার ক'দিন আগে ১৪ এবং ১৭ জানুয়ারি উনি গড়সে এবং আপ্তের সঙ্গে সাভারকরের শিবাজী পার্কের বাড়িতে গিয়েছিলেন। উনি নীচে ছিলেন, ওরা ওপরে গিয়ে সাভারকরের সঙ্গে বৈঠক করে একটু পরে একটা থলি নিয়ে নেমে আসে। একজন নামকরা অভিনেত্রী বিম্বা (যিনি নিজের গাড়ি করে ওদের স্টেশন থেকে সাভারকরের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়েছিলেন) এবং সাভারকরের বডিগার্ড ও সেক্রেটারি এর পক্ষে সাক্ষ্য দেন। কিন্তু আলোচনার সময় কি কথা হয়েছিল তার কোনও প্রত্যক্ষদর্শী নেই। সাভারকরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পুরোটাই সারকামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স বেসড। যেমন, তিন আসামীর সঙ্গে সাভারকরের ঘনিষ্ঠতা, কাজকর্ম এবং তিনজনেরই গান্ধীজির বিরুদ্ধে ঘৃণা এবং বিশ্বাস যে গান্ধীজির জিন্না তুষ্টিকরণ নীতির ফলে দেশভাগ হয়েছে।
লক্ষণীয় যে, প্রথম হামলাকারী মদনলালা পাহওয়া ওই তিনজনের চ্যালা ছিল এবং প্রথম হামলার দিন (২০ জানুয়ারি) গড়সে, আপ্তে, বাড়গে এবং পাহয়া একসঙ্গে দিল্লিতে ছিল এবং একসংগে ট্রেনে মুম্বাই হয়ে পুণে ফিরে এসেছিল।
সাভারকরের মৃত্যুর পর মনোহর মালগাঁওকর, যিনি 'মেন হু কিল্ড গান্ধী' বইটি লিখেছেন, কারকারে, পাহওয়া এবং গোপাল গড়সেকে প্রশ্ন করেন। ওরা সবাই গান্ধীহত্যার পেছনে সাভারকরের ভূমিকার কথা অস্বীকার করে।
নাথুরামকে গান্ধীহত্যার জন্যে ৯ এমেম ব্যারেটা পিস্তল দিয়েছিল গোয়ালিয়রের হিন্দু মহাসভার সেক্রেটারি সদাশিব পরচুরে।
বিচারের রায় বেরোল। জাস্টিস আত্মারাম আটজন অভিযুক্তের মধ্যে শুধু সাভারকরকে প্রমাণাভাবে মুক্তি দিলেন--কারণ রাজসাক্ষীর বয়ানের কোনও স্বতন্ত্র সাক্ষী বা দলিল পাওয়া যায়নি। নাথুরাম এবং নারায়ণ আপ্তের ফাঁসি, বাকি পাঁচজনের যাবজ্জীবন (তখন এর মানে ১৪ বছর)। সরকার এর বিরুদ্ধে আপীল করল না। সাভারকরের ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে তখন শ্যামাপ্রসাদ ছিলেন হিন্দু মহাসভার সেক্রেটারি। নেহেরু বললেন গান্ধীহত্যার পর ওঁর মন্ত্রিসভায় হিন্দু মহাসভার নেতা মন্ত্রী হবেন এটা উচিৎ নয়। শ্যামাপ্রসাদ মহাসভার সদস্যপদ ছাড়লেন।
কিন্তু উনি প্যাটেলকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেছিলেন যে, সাভারকরের বিচার যেন নিরপেক্ষভাবে হয়। প্যাটেল আশ্বাস দিয়েছিলেন। পরে উনি শ্যামাপ্রসাদকে লিখেছিলেন যে, আইনের নিক্তিতে সাভারকর ছাড়া পেলেও এই হত্যাকান্ডের নৈতিক দায় থেকে উনি মুক্ত হতে পারেন না।
প্যাটেল নেহেরুর আর এস এস নিয়ে আশংকার উত্তরে জানিয়েছিলেন যে, আর এস এসকে অন্য অনেক দোষে দায়ি করা যায় , কিন্তু গান্ধী হত্যার জন্যে নয়।
সাভারকর একবছর জেল খেটে ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে বেরিয়ে এলেন। কিন্তু বিতর্ক পিছু ছাড়ল না। ৬০ এর দশকে তিলকের নাতি জি ভি কেতকর পুণের এক সভায় বললেন যে, উনি গান্ধীহত্যার ব্যাপারে ঘটনার অনেক আগেই জানতেন। ১৯৬৬ সালে সরকার এ নিয়ে কাপুর জুডিশিয়াল কমিশন বসাল। কাপুর বললেন যে, সমস্ত তথ্যপ্রমাণ একসঙ্গে মিলিয়ে দেখলে সাভারকর এবং তার গ্রুপ মিলে যে ষড়যন্ত্র রচেছিলেন, তাই মনে হয় ।
মোদীজি ক্ষমতায় আসলে এক সাভারকর ভক্ত কাপুর কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে সুপ্রীম কোর্ট গেল। সবোর্চ্চ আদালত তার মে ২০১৮ রায়ে বলল যে, কমিশনের রিপোর্ট 'জেনারেল অবসার্ভেশন' মাত্র; তা কোনওভাবেই ক্রিমিনাল কোর্টের রায় ---সাভারকরের ভূমিকা অপ্রমাণিত -- উলটে দিতে পারে না ।
সবমিলিয়ে প্যাটেলের কথাটাই মাথায় আসে-- গান্ধীহত্যার নৈতিক দায় থেকে সাভারকরকে রেহাই দেওয়া কঠিন।

উনি সংঘ পরিবারের হিন্দুত্ব থিওরির প্রবক্তা কিনা?

সাভারকরের 'হিন্দুত্ব' অবধারণা এবং আজকের সংঘ পরিবারের এজেন্ডা
========================================

সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক এজেন্ডা যে হিন্দুত্ব,  তা অবশ্যই সাভারকরের অবদান। ওঁর রত্নগিরিতে সপরিবারে নজরবন্দী থাকার সময় লেখা ‘হিন্দুত্ব’ বইটি থেকেই ওদের মূল থিওরেটিক্যাল বই ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’ বইটি লেখা। দ্বিতীয়টির ছত্রে ছত্রে প্রথমটির ছাপ। কিন্তু সেসময় ঋণ স্বীকার না করায় সাভারকর মনে হয় অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তাই হিন্দু মহাসভার কর্মীদের একসময় আর এস এস এর সদস্যপদ ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। সঙ্ঘপরিবারের সাংস্কৃতিক ভারত নিয়ে ধারণার দুটো স্তম্ভ, ‘পূণ্যভু’ (হোলিল্যান্ড) এবং ‘পিতৃভু’ (ফাদারল্যান্ড) হুবহু ওঁর থেকে নেওয়া।সে ঋণ সংঘ পরিবার আজ সুদে আসলে ফিরিয়ে দিচ্ছে ওঁকে সামনের সারির স্বাধীনতা যোদ্ধা হিসেবে প্রজেক্ট করে ।

ওঁর হিন্দুত্ব কিন্তু শুধু ধার্মিক হিন্দুত্ব নয়। বরং সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক হিন্দুত্ব। ধর্ম, বিশেষ করে বৈদিক ধর্ম পালন এসেছে ভারতের 'মোনোলিথিক (সাভারকরের মতে) সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংগ' হিসেবে।
ওঁর কল্পনার অখণ্ড হিন্দুস্থান সিন্ধুনদের দু'পাশ থেকে কাশ্মীর হয়ে কন্যাকুমারিকা পর্য্যন্ত বিস্তৃত ।
ওঁর মতে, হিন্দু একটি সাংস্কৃতিক জাতি, যাদের শিরায় শিরায় বইছে একই শুদ্ধ রক্তধারা, যারা জন্মসূত্রে এই ঐতিহ্যের জন্যে গর্বিত।
ওঁর হিন্দুত্ব আইন করে এফিডেভিট করে নাগরিকত্ব পাওয়া নয়। তার জন্যে ভারতে জন্মাতে হবে। কেন?
কারণ যদি 'পিতৃভূমি' এবং 'পূণ্যভুমি' এক না হয়, তাহলে মানুষের মনে টানাপোড়েন থাকবে এবং তার আনুগত্য বিভক্ত হবে ।

উনি মনে করেন 'হিন্দু' একটি প্রাকৃত শব্দ, সংস্কৃত নয়, তাই বেদে উল্লেখ নেই। কিন্তু এটি প্রাচীন শব্দ। মধ্যপ্রাচ্যের জিভে 'স' কে 'হ' উচ্চারণ করা হতো। তাই 'সপ্তসিন্ধু' জেন্দাবেস্তায় 'হপ্তসিন্ধু' বলে উল্লিখিত। তাই সিন্ধুর এপারে সবাই হিন্দু। তাই ভারতে জন্মানো হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন সবাই রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক হিন্দু। কারণ তাদের জন্মভূমি (পিতৃভূমি) এবং 'পুণ্যভূমি ' হিন্দুস্তান। একই কারণে কোনও ক্রিশ্চান বা মুসলমান হিন্দুস্থানের নাগরিক বা সাংস্কৃতিক -রাজনৈতিক হিন্দু হতে পারে না। কারণ তার জন্মভূমি যদি ভারত হয়ও, এবং সে যদি দেশপ্রেমিক হয়ও, তার পূণ্যভূমি আলাদা (আরব ও প্যালেস্তাইন)। ফলে সেইসব দেশের সঙ্গে যুদ্ধ হলে বা স্বার্থের সংঘাত হলে 'কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট' কাজ করবে।(!)
অতএব সাভারকরের ভারতবর্ষে মুসলিম/ক্রিশ্চানদের স্থান নেই। আরএস এস এর গুরুজি গোলওয়ালকরের ‘এ বাঞ্চ অফ থট’ বইয়েও ‘দ্য এনিমিজ’ বলে একটি অধ্যায় আছে, যাতে শত্রু তিনজন—মুসলিম, ক্রিশ্চান এবং কম্যুনিস্ট। এদের পিতৃভূমি এবং পুণ্যভূমি আলাদা যে!
এবার দেখুন, কেন আজকাল কথায় কথায় সেকুলার বা লিবেরালদের পাকিস্তান চলে যেতে বলা হয় এবং কেন ক্ষমতাসীন দল নাগরিক রেজিস্টার এবং ছলেবলে কৌশলে মুসলিম বিতাড়নের ধুয়ো তুলেছে।
এখানে আমার দুটি প্রশ্নঃ
১ সমস্ত ইউরোপীয় নেশন স্টেট বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের (যাঁরা জন্মসূত্রে নাগরিক) তো পিতৃভূমি এবং পুণ্যভূমি আলাদা। তা বলে এতদিন ধরে তাঁদের আনুগত্য কি দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে? ইতিহাসের সাক্ষ্য কি বলে?
২ সিন্ধু এখন পাকিস্তানের প্রদেশ তাহলে কি আমাদের বর্তমান নাগরিকদের সাভারকরের অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্র গড়তে সেটা কেড়ে নিতে হবে? আমরা 'জনগণমন' গানে সিন্ধু শব্দটা বাদ দিইনি; কেন?
কিন্তু ইউটিউবে বন্দেমাতরম শুনে দেখুন 'সপ্তকোটি কন্ঠ কলকল নিনাদ করালে' বদলে 'কোটি কোটি কন্ঠ কলকল নিনাদ করালে, কোটি কোটি ভুজৈ ধৃতখরকরবালে' করা হয়েছে।
আসলে আনন্দমঠে বঙ্কিম এখানে দেশ বলতে অবিভক্ত বঙ্গকেই বুঝিয়েছেন, গোটা ভারতকে নয় ।

সাভারকর মনে করেন জাতিপ্রথা হিন্দুসমাজের এবং দেশের ক্ষতি করেছে। উনি অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে। একটা মন্দির বানালেন যাতে সব জাতের লোক ঢুকতে পারবে। একবার মুসলমানের ছোঁয়া লেগে গেলে আমরা বহু হিন্দু পুরুষ এবং বিশেষ করে নারীদের সমাজের বাইরে করে দিয়ে মুসলমান সমাজের সংখ্যা বাড়িয়েছি মাত্র। উনি তাই রিকনভার্সনের ডাক দিলেন। বর্তমান সংঘ পরিবার শুরু করেছে ঘর -ওয়াপ্সি আন্দোলন।
সাভারকরের মতে, বৌদ্ধধর্মের অহিংসা নীতি ভারতকে দুর্বল করে মুসলিম আগ্রাসনকে সহজ করে দিয়েছে। সিন্ধু আক্রমণের প্রসঙ্গে উনি বৌদ্ধদের বিশ্বাসঘাতক বলতে দ্বিধা করেননি। উনি খুশি, বৌদ্ধধর্মের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ভারতে প্রায় বিলুপ্ত এবং স্বয়ং বুদ্ধদেব হিন্দু দশাবতারের একজন হয়ে শোভা পাচ্ছেন।
ওঁর মতে হিন্দুদেরও দাঁতের বদলে দাঁত চোখের বদলে চোখ মেনে চলা উচিত ছিল। 'ক্ষমা বীরস্য ভূষণম' জাতীয় ফালতু স্তোকবাক্যে না ভুলে পরাজিত আত্মসমর্পণকারী মুসলিনদের হত্যা করা উচিত ছিল। এবং 'ওরা' যেমন পরাজিত হিন্দুদের বৌ-মেয়েদের লুটে নেয়, ধর্ষণ করে , বিয়ে করে বা রক্ষিতা বানায় আমাদেরও তাই করা উচিত ছিল । তাহলে আজ এত মুসলমান হতো না ।'
'শিবাজী যখন বিজাপুরের সুলতানের পরিবারের মেয়েদের সসম্মানে ফেরত দিলেন, তখন কি সেই সিন্ধুবিজয়ের দিন থেকে অগণিত লুন্ঠিত ধর্ষিত হিন্দুমেয়েদের কান্না তাঁর কানে প্রবেশ করেনি? হিন্দুসমাজ 'অহিংসা', শত্রুকে সম্মান, সহিষ্ণুতা --এসবকে গুণ মনে করে নিজের পায়ে কুড়ুল মেরেছে। সাপ দেখলে মেরে ফেলা উচিত, স্ত্রী-পুরুষ বিচার করা উচিত নয় ।
রামায়ণে রামচন্দ্র তাড়কা রাক্ষসীকে বধ করেছিলেন। লক্ষ্মণ শূর্পণখার নাক কেটে ভাগিয়ে দিয়েছিলেন। তাহলে?
--- ভারতরত্নের যোগ্য নায়ক বটে!

ফুটনোটঃ

একটা পর্যায়ে হিন্দু মহাসভা এবং আর এস এসের মধ্যে একটু আকচাআকচি ছিল। গান্ধীহত্যার কলঙ্কের দাগ যাতে না লাগে, তার জন্যে ওদের নেতারা সচেষ্ট ছিলেন । 
সাভারকর আর এস এস কে নিয়ে ব্যঙ্গ করে বলতেন যে 'দ্য এপিটাফ ফর দ্য অ্যার এস এস ভলান্টিয়ার উইল বি হি ওয়াজ বর্ন, হি জয়েন্ড দি অ্যার এস এস, অ্যান্ড হি ডায়েড উইদাউট অ্যাকমপ্লিশিং এনিথিং'। ওদের গোমাতা থিম উনি মানতেন না। কিন্তু আজ ওরা সাভারকরকে মাথায় তুলে রেখেছে। আন্দামান জেলের নামকরণ আজ ওঁর নামে। অথচ ওখানে ওঁর চেয়ে বেশি সময় জেল খেটেছে বা ওখানেই মারা গেছে, এমন বন্দীর নামও পাওয়া যাচ্ছে। আজ ওঁর ছবি সংসদে দেয়ালে ঝুলছে। কাল হয়তো ভারতরত্ন দেওয়া হবে।
এর পেছনে দুটি কারণ আছে বলে মনে হয় ।
এক, বিজেপির নেতাদের মধ্যে (আর এস এসএর) স্বাধীনতা সংগ্রামে জেল খেটেছেন, এমন নাম খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলীরাম হেড়গেওয়ার জেলে গেছেন কংগ্রেসি কার্যকর্তা হিসেবে। আর এস এস প্রতিষ্ঠার পরে নিজে যাননি, অন্যদেরও নিরুৎসাহিত করেছেন। অথচ কংগ্রেস এবং কম্যুনিস্ট পার্টিতে অনেক নাম, এমনকি সেলুলার জেল খেটেছেন তাদের মধ্যেও।
দুই, গান্ধীজির নরম হিন্দুত্বের জায়গায় এক এক্সক্লুসিভ আক্রামক হিন্দুত্বের তাত্ত্বিক প্রবক্তা উনি। এবং মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি জনিত প্যারানইয়ার রূপকার।
কিন্তু আজ এই তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত। গত ১৫ আগস্টে প্রধানমন্ত্রী জনসংখ্যা বিস্ফোটের আশঙ্কার কথা বলেছেন বটে, কিন্তু এটা ভিত্তিহীন। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ কোথাও হচ্ছে না, ভারতেও না, অন্য কোথাও নয়। সরকারী তথ্য অনুযায়ী ভারতের গড় প্রজনন রেশিও সূচক (অর্থাৎ, একটি সমাজে, রাজ্যে বা দেশে প্রজনন- ক্ষম বয়সে একজন নারী গড়ে কজনের জন্ম দিচ্ছে) ২.৩। এটা ২.২ হলেই বর্তমান জনসংখ্যা স্থির হয়ে যাবে। গড়ে এক বছরে যতজনের জন্ম হবে বা যতজনের মৃত্যু হবে তা প্রায় সমান সমান হয়ে কাটাকুটি হয়ে যাবে। মজার ব্যাপার এই রেশিও মুস্লিম প্রধান কাশ্মীরে মাত্র ১.৬ এবং এই বঙ্গেও তাই। অথচ হিন্দুপ্রধান গুজরাত এবং উত্তর প্রদেশে ক্রমশঃ ২.৬ এবং ৩। মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির দর হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির চেয়ে দ্রুতহারে কমছে।


উনি কট্টর মুসলিম বিরোধী কিনা?

আগেই বলেছি ওঁর ‘হিন্দু ভারত’ শুধু তাদের স্বীকার করে যারা ভারতে জন্মেছে (পিতৃভু) এবং যাদের ধার্মিক ও সাংস্কৃতিক শেকড় ভারতে; তাই হিন্দু-শিখ-বৌদ্ধ-জৈন স্বীকার্য, অন্যেরা নয়। মুসলমানেরা বহিরাগত, তায় ওদের পুণ্যভূমি মক্কায়। যারা এদেশে জন্মেছে তারা প্রথম শর্ত ‘পিতৃভু’ পাশ করলেও দ্বিতীয় শর্ত ‘পুণ্যভূ’ পাশ করবে কি করে !

(বর্তমান সরকারের প্রস্তাবিত বিলে ২০১২ থেকে অন্য দেশ থেকে আগত হিন্দু-শিখ-বৌদ্ধ-জৈন রিফিউজিদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে)।

বেয়াল্লিশের আন্দোলনের সময় কংগ্রেসি নেতা ও কর্মীরা জেলে। তখন হিন্দু মহাসভার কর্মীরা শ্যামাপ্রসাদ এবং সাভারকরের নেতৃত্বে বেশ কিছু এসেম্বলি ও অন্য সিভিক বডিতে ইলেকশন জেতে। কিন্তু কংগ্রেসের সবাই জেল থেকে ছাড়া পেলে ১৯৪৫-৪৬ এর সেন্ট্রাল এসেম্বলি এবং প্রাদেশিক নির্বাচনে সাভারকরের কংগ্রেসকে পরাজিত করার আহ্বান ব্যর্থ হয়। নভেম্বর ১৯৪৫ এর সেন্ট্রাল এসেম্বলিতে মহাসভা একটাও সিট পেল না। দেখা গেল রামরাজ্য এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা বলা কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলনের নেতা গান্ধীজিকেই বৃহত্তর হিন্দুসমাজ অবিসংবাদিত নেতা মেনেছে।
স্বাধীন ভারতে গান্ধীহত্যার কলংক লাগায় জনমানস থেকে মহাসভা এবং সাভারকর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন। ফলে উনি আরও উগ্র আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলেন। এইসময়ে লেখা বিভিন্ন চিঠিপত্র এবং প্রবন্ধ তার সাক্ষী। 'সিক্স গ্লোরিয়াস ইপোক্স অফ ইন্ডিয়ান হিস্টরি' বলে ওঁর বইটি পড়লে দেখা যাবে এমন এক অতীতমুখী মন যার চেতনা শুধু অতীতের হিন্দু-মুসলিম বাইনারিতে আবদ্ধ হয়ে হিন্দুর কথিত বিক্রমগাথায় সান্ত্বনা খোঁজে। শুধু তাই নয়, এই মানস একটি প্যারানইয়া--- শিগগিরই মুসলিমরা ভারতে মেজরিটি জনগোষ্ঠী হয়ে উঠবে --- থেকে আত্মসমর্পণকারী বন্দী মুসলিমদের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হত্যা তথা 'টু পে ইন দেয়ার ওন কয়েন' নীতিতে মুসলিম মেয়েদের ধর্ষণকে উচিৎ বা কর্তব্য বলে ওকালত করে।


ব্যক্তিগত আচার আচরণে উনি কতটা হিন্দু ছিলেন ?

আজ যে 'হিন্দুত্ব' রাজনীতির প্রাবল্য, সেই রাজনীতির জনক বিনায়ক সাভারকর।

১৯২৩ এ রত্নগিরির জেলে বসে তিনি ইংরেজিতে লিখেছিলেন 'এসেনশিলাস অব হিন্দুত্ব'। সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক'রা মনে করেন গান্ধীর পলিটিক্যাল ডিসকোর্সের সেটা ছিল কাউন্টার আর্গুমেন্ট। ইন্টারেস্টিংলি সাভারকরের 'হিন্দুত্ব' রাজনীতির সঙ্গে সনাতন হিন্দুধর্ম বা ধর্মীয় গোঁড়ামোর সম্পর্ক নেই। তাঁর কাছে 'হিন্দুত্ব' ছিল একটা জাতির সাংস্কৃতিক অস্মিতা।

ব্যক্তিগত জীবনে বিনায়ক সাভারকর ছিলেন নাস্তিক এবং সংস্কারমুক্ত। হিন্দু ধর্মের সংস্কার, ব্রাহ্মণ্যবাদ ও জাতপাতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। বর্ণাশ্রম ও ধর্মীয় সংস্কার যে হিন্দুধর্মকে বিভক্ত করে দিয়েছে এবং অনেক ক্ষতি করেছে, তা বারবার বলেছেন। রত্নগিরিতে থাকবার সময় তিনি দলিতদের জন্যে পতিতপাবন মন্দিরের দ্বার খুলে দেন এবং ছোঁয়াছুঁয়ি ও নানারকম সংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। তাঁর উপস্থিতিতে বেশ কিছু অসবর্ণ বিবাহও হয়।

সাভারকর মাসাহারী ছিলেন। মাছ খেতে খুব ভালবাসতেন। খাবার নিয়ে বাড়াবাড়ি ওঁর পছন্দ নয়। এসব হিন্দুদের দুর্বল করেছে বলে ওঁর ধারণা।
উনি জাতিব্যবস্থার কড়া সমালোচনা করেও বলেন যে, মুসলিম আমলে নিজেদের রক্তের বিশুদ্ধতা রক্ষার খাতিরে এই ব্যবস্থা বেশি আঁটোসাটো হয়েছে, আজ দরকার নেই ।

উনি গরুকে মাতা বলতে নারাজ। বলেন একটি চারপেয়ে পশু আমার মাতা নয়, বরং বাছুরের মাতা। তবে গরু খুব উপকারী জন্তু, তাই তার পালন জরুরি।
অসুস্থ সাভারকর ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ তারিখে ৮৩ বছর বয়সে মারা যান। পীড়ায় অস্থির হয়ে স্বেচ্ছামৃত্যু কামনা করেছিলেন, কিন্তু আইনে বাধে। তাই ধীরে ধীরে খাওয়াদাওয়া এমনকি জল পর্য্যন্ত ছেড়ে দিলেন।
তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তাঁর মরদেহ কোনও চিতায় তোলা হয়নি, মন্ত্রোচ্চারণ করা হয়নি, বিনা আড়ম্বরে ইনসিনারেটরে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। বাড়ির কাছে কাকেদেরও কিছু আহার বা পিণ্ড দেওয়া হলো না। ভদ্রলোকের কাছে হিন্দু ধর্ম ব্যক্তিগত আচরণ না হয়ে রাজনৈতিক স্তরেই সীমাবদ্ধ রইল।


উপসংহার

সাভারকর বনাম ভগত সিং, জিন্না এবং গান্ধীজি
=============================

ভগত সিং যদিও সাভারকরের সিপাহী বিদ্রোহের উপর লেখা বইটি পড়ে প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু শীগগিরই তিনি মার্ক্সবাদী সাহিত্যে প্রভাবিত হয়ে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের জন্যে লড়াইয়ের কথা বলতে থাকেন। তাঁর কল্পনার ভারতে শ্রমিক-কৃষক ছিল, হিন্দু-মুসলিম একে অন্যের 'অপর ' হিসেবে দেখা দেয়নি ।
ব্যক্তিহত্যার জায়গায় গণান্দোলনে বিশ্বাসী ভগত সিং স্যান্ডার্স হত্যায় অভিযুক্ত ছিলেন কিন্তু অ্যাসেম্বলিতে সাধারণ (লো-ইনটেনসিটি) বোমা ফাটিয়ে লিফলেট ছড়িয়ে দিয়েছিলেন শুধু প্রচারের উদ্দেশ্যে।
১৯১৯-২০ নাগাদ ব্যারিস্টার জিন্না ছিলেন নরমপন্থী স্বরাজী। উনি খিলাফত আন্দোলনে গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসের সমর্থনের বিরোধিতা করে বলেছিলেন যে, এর ফলে ভারতবাসীকে দুটো সম্প্রদায়ে ভাগ করে দেওয়া হবে। সংখ্যাগুরু গান্ধীর সমর্থকরা জিন্নাকে সমালোচনা করল। উনি রাওলাট অ্যাক্টের বিরোধিতায় গান্ধীকে সমর্থন করে আদালতে তাঁর পক্ষে মামলা লড়েছিলেন। ১৯২৯ শে নাগপুর কংগ্রেসে উনি গান্ধীজিকে মিঃ গান্ধী বলে সম্বোধন করায় লোকে প্যাঁক দিয়ে ওঁকে তাড়াল। তারপর উনি মুসলিম লিগে যোগ দিলেন।
জিন্না সম্ভবতঃ ১৯৩৭-৩৯ এ দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা প্রচার করেছিলেন। কিন্তু সাভারকর তার প্রায় দু'দশক আগেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, হিন্দু এবং মুসলমান দুটো আলাদা জাতি। তারা এক রাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারে না। এর ভিত্তিতে জিন্না আলাদা করে মুসলিমবহুল অঞ্চল নিয়ে আলাদা রাষ্ট্রের দাবিতে আন্দোলনে নামলেন। আর সাভারকরের স্পষ্ট মত, হিন্দুস্তানে মুসলমানদের মাথা তুলতে বা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রপরিচালনার পদে থাকতে দেওয়া উচিত হবে না। দুজনের মধ্যে দুটো মিল। দুজনেই ব্যক্তিগত আচার আচরণে ধার্মিক নন, কিন্তু দুজনেই ‘এক জাতি, এক রাষ্ট্র’ তত্ত্বে বিশ্বাসী। এঁদের রাষ্ট্র কল্পনায় অন্য ধর্মের মানুষ সমান অধিকার পাবে না ।

গান্ধীজি নিষ্ঠাবান ধার্মিক হিন্দু, রাজনৈতিক হিন্দু নন। উনি সমস্ত ধর্মের মানুষদের সমান নাগরিক অধিকারে বিশ্বাসী। মাইনরিটিকে রক্ষা করা, বিশেষ মর্যাদা দেওয়া উনি কর্তব্য মনে করেন। এদিকে উনি কট্টর শাকাহারী, প্রাকৃতিক চিকিৎসা এবং কৃষিভিত্তিক সমবায়িক অর্থনীতির পক্ষে। উনি শ্রেণীসংগ্রামের বিরুদ্ধে। ধনীদের গরীবদের জন্য ট্রাস্টি হতে বলেন। অধিকার আদায়ের প্রশ্নে অহিংস পন্থা, অসহযোগ এবং সবিনয় অবজ্ঞা আন্দোলনে বিশ্বাসী।উনি গোমাতার পূজায় বিশ্বাসী।
সাভারকর গান্ধীজির সঙ্গে সংঘর্ষে এলেন খিলাফত আন্দোলন এবং ধার্মিক ইলেক্টোরেটে গান্ধীজির অবস্থান দেখে। ভারতের স্বাধীনতার সময় উনি প্রবন্ধ লিখে (২৫/০৯/ ১৯৪৭) গান্ধীর মতো ছদ্ম-জাতীয়তাবাদী নেতাদের নাম করে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবার আহবান জানালেন।

সাভারকর মনে করতেন পুঁজিবাদী শিল্পই ভারতের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ, গান্ধীর গ্রামীণ সংস্কার নয়। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও এখন অনেকেই মনে করেন স্বাধীনোত্তর ভারত গান্ধীর নয়, সাভারকরের পথেই চলেছে।

=================

বইয়ের তালিকা 
১ সাভারকর--হিন্দুত্ব,
২ সাভারকর----সিক্স গ্লোরিয়াস ইপোক্স অফ ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি ।
৩ সাভারকর-- অ্যান ইকো ফ্রম আন্দামান।
৪ সাভারকর-- হোয়ার্লউইন্ড প্রোপাগান্ডা।
৫ সাভারকর-ঃ দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য ফাদার অফ হিন্দুত্ব--- ভি পুরন্দরে।
৬ সিডিশন কমিটি রিপোর্ট, ১৯১৮।
৭ গান্ধী বিফোর ইন্ডিয়া-- রামচন্দ্র গুহ
৮ বীর সাভারকর-- ধনঞ্জয় কীর।
৯ নেহরু, সিলেক্টেড ওয়ার্কস, ভলুম -৩।
১০ হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়-- লাইফ এন্ড মাইসেলফ, ভল্যুম ১
১১ উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যো -- নির্বাসিতের আত্মকথা।
১২ বারীন ঘোষ -- দ্য টেল অফ মাই এগজাইল।
১৩ আর সি মজুমদার-- হিস্ট্রি অফ দ্য ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া, ভল্যুম-৩
১৪ মালগাঁওকর-- মেন হু কিল্ড গান্ধী।
১৫ গুরুজী গোলওয়ালকর ---- উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড
১৬ গুরুজী গোলওয়ালকর--- এ বাঞ্চ অফ থটস। 
১৭ ইন্ডিয়াজ স্ট্রাগল ফর ইন্ডিপেন্ডেন্স --বিপান চন্দ্র এন্ড আদার্স।

1 comment:

  1. এযাবৎ কালের সেরা লেখা। সবচাইতে তথ‍্যসমৃদ্ধ।

    ReplyDelete