0

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়


সমিদ্ধম্ অগ্নিং সমিধা গিরা গৃণে। 

আমার বাণীর সমিধে যে অগ্নি জ্বলে তাকে বন্দনা করি। 

এই বন্দনাই সেই তপ যা ঘনীভূত হয়ে হৃদয়ে জন্ম নেয় আলোকবিহগী বাক্। তারপর তার যাত্রা আরম্ভ। আলো থেকে আলোতে, লৌকিক চেতনা থেকে লোকোত্তর চেতনায়, বৈখরী থেকে পশ্যন্তীতে। মাতৃভাষার ধ্বনি স্রোত থেকে জেগে ওঠে বিশ্বভাষা পরাবাক্। তাই ঋতবাক অর্চনা করে তার মাতৃভাষাকে। 

আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে একবার আপনার, আমার মাতৃভাষা বাংলার দিকে তাকাই আসুন। আমরা বাংলা গদ্যকে নিয়ে ভাবছি এই মুহূর্তে। কারণ, আমরা গদ্যেই ভাব বিনিময় করে থাকি। ১৫৫৫ সালে অহোমরাজকে রাজা নরনারায়ণ মল্লদেবের লেখা পত্রটি লিখিত বাংলা গদ্যের আদিতম নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত। এবং এর ভাষা বোধগম্যও : 'লেখনং কার্যঞ্চ [।] এথা আমার কুশল [।] তোমার কুশল নিরন্তরে বাঞ্ছা করি [।]...' 

তবু, আমরা ১৮০১ সালটিকে বেশী গুরুত্ব দেব। কারণ ঐ বছরই বাঙালীর লেখা প্রথম বাংলা বই প্রকাশ পায়। মিশনারী বাংলাকে আলোচনায় না আনার কারণ তাঁদের বাঙলা যতটা না ধর্মপ্রচারের মাধ্যম ততটা ভাষা বা সাহিত্য চর্চার নয়। উইলিয়ম কেরির বিচিত্র বাংলা যে তৎকালীন বঙ্গীয় খ্রিস্টান সম্প্রদায়েরও অস্বস্তির কারণ হয়েছিল এবং কোনওভাবেই যে তা বাংলা ভাষার বহমানতার অংশ বলে পরিগণিত হতে পারে না, ঋতবাকের এই সংখ্যার প্রচ্ছদ নিবন্ধে তা নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা করেছেন রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। অতএব, রামরাম বসু বা মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের বাংলা গদ্য দিয়েই বাংলা গদ্যের পথচলা শুরু। দুটি উদাহরণ দিই। 

১) পরে রাজা বিক্রমাদিত্য ও বসন্তরায় ও প্রতাপাদিত্য তিনজন এক নিভৃত স্থানে যাইয়া বসিলে রাজা বসন্তরায় জিজ্ঞাসা করিলেন পুত্র কি সমাচার আসিবামাত্রেই কিমার্থে এমত ২ আচরণ করিলা। (রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র। রামরাম বসু। ১৮০১) 

২) যদি কাহারও কোন দ্রব্য হারায়, তাহা হইলে তৎক্ষণাৎ তাহাকে দেওয়া উচিত; আপনার হইল মনে করিয়া লুকাইয়া রাখিলে চুরি করা হয়। (বোধোদয়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ১৮৫১) 

ঠিক পঞ্চাশ বছরের ব্যবধান। কোথা থেকে কোথায় এসেছে বাংলা গদ্য! অন্য যে কোনও ভাষায় যে পরিবর্তন আসতে সময় লাগে দু'তিন শতাব্দী, বাঙলায় তা এসেছে মাত্র অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে। বাংলা ভাষা তাই বিশিষ্ট। ২১শে ফেব্রুয়ারীতে ঝরা রক্তের তিলক কপালে এভাষা সযত্ন পরিচর্যার দাবী রাখে। ঋতবাক এ দাবী মানে। আপনারাও। 

সকলে ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। মাতৃভাষাকে যাপনে এনে স্বস্থ থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


উইলিয়াম কেরি ও বাঙলা গদ্য : একটি অতিকথা
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য


অধ্যাপক জনার্দন চক্রবর্তী তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন চট্টগ্রামের সরকারি মহাবিদ্যালয়ে। তখন বাঙলা পরীক্ষারও প্রশ্ন হতো ইংরেজিতে। কলেজের পরীক্ষায় জনার্দনবাবু একটি প্রশ্ন দিয়েছিলেন। তার বিষয়: বাঙলা গদ্যর বিকাশে ইওরোপীয় মিশনারিদের দান। প্রশ্নটি পড়ে সায়েব অধ্যক্ষ, রিচার্ড কেরি ব্যাম্‌স্‌বটম ঐ বিষয়ে জনার্দনবাবুর কাছে আরও জানতে চান (৯১)।

বাঙলা গদ্যে উইলিয়াম কেরি প্রমুখ মিশনারিদের স্থান ও দানের ব্যাপারে বাঙলা সাহিত্যর প্রায় সব ইতিহাসকারই মোটের ওপর একমত। প্রায় সকলেই বলেন: মিশনারিদের ভাষা যতই অস্থির হোক, বাঙলা গদ্যের গোড়াপত্তন হয়েছিল তাঁদেরই উদ্যোগে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত ও মুন্‌শিদের দিয়ে তাঁরা অনেককটি বই লিখিয়েছিলেন। ছাপাখানাও চালু হলো তাঁদেরই হাতে। আর তার ফলেই বাঙলা গদ্যরচনার প্রকাশ ও প্রচারের পথ খুলে গেল! রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার, কালীপ্রসন্ন, প্যারীচাঁদ, বঙ্কিম, -এঁরা তারই ধারক।

এখন এর উল্‌টো কথা শুনলে কেউ কেউ নিশ্চয়ই অবাক হবেন।তবু সবিনয়ে, কিন্ত অবিচলভাবে, বলব : কেরি ও তাঁর পরিজনদের সম্পর্কে প্রচলিত মতটি ভুল; অপাত্রে গৌরব অর্পণ করা হচ্ছে। ঘটনা এই যে, বাঙলা গদ্যরঐতিহাসিক বিকাশে ইওরোপীয় মিশনারি ও তাঁদের আশ্রিত বাঙালি লেখকের দান একেবারেই শূন্য। অবশ্যই বাঙলা গদ্যর কালপঞ্জিতে তাঁদের নাম থাকবে- তথ্যকে অস্বীকার করব কেন? কিন্ত ঐতিহাসিক বিচারে গোটা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ পর্বটি -(১৮০১-৫৪) একটি প্রক্ষিপ্ত অধ্যায় মাত্র। ইংরেজ- পূর্ব বাংলাতেও গদ্য লেখা হতো, শুধু গৌড়বঙ্গে নয়, অসমে, এমনকি ভুটানেও (সুরেন্দ্রনাথ সেন ৮৪)। উনিশ শতকের গোড়া থেকে বাঙলা লেখার এক নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহ দেখা দেয়, এখনও সেটিই বহাল। শুধু পশ্চিমবঙ্গে বা সাধারণভাবে ভারতে নয়, পূর্ব পাকিস্তান (পরে বাংলাদেশ) সমেত পৃথিবীর সব প্রান্তে বাঙলা লেখকদের হাতে সেই গদ্যরই অনুবর্তন ও বির্বতন হয়ে চলেছে। ব্যাকরণগত বিচারে সাধু ও চলিত এই দুটি লিখিত রূপ এখনও পাশাপাশি রয়েছে, দুই রূপেই উঁচু, মাঝারি ও নিচু রীতিতে লেখা যায় ও হয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বাঙলা গদ্যর এই অভিব্যক্তিতে মিশনারিদের গরহাজিরাই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে।

কেন একথা বলছি? সে-উত্তরে যাওয়ার আগে ঐতিহাসিক আর প্রাচীনত্বর কারবারি (অ্যান্টিক্যুয়ারিয়ান)-র তফাতটা বুঝে নেওয়া দরকার।

তত্বকথার বদলে বরং একটি গল্প বলি। ফরাসি মধ্যযুগ-বিশারদ আঁরি পিরেন একবার সুইডেন-এর রাজধানী স্টকহোল্‌ম-এ গিয়েছিলেন। সেখানে পৌঁছেই তিনি চললেন নতুন পৌরভবনটি দেখতে। কেন? তাঁর উত্তর: ‘আমি যদি প্রাচীনত্বর কারবারি হতুম তবে আমার নজর থাকত শুধুই পুরনো জিনিসের দিকে; কিন্তু আমি ঐতিহাসিক, জীবনকে আমি তাই ভালোবাসি। যে সব বিশেষজ্ঞ ‘মধ্যযুগ’ ছাড়া আর কিছুই বুঝতেন না তাঁদের কাছে মার্ক ব্লশ তাঁর মাস্টারমশাই-এর এই গল্পটি বলতেন। ঐতিহাসিক অতীতকে দেখেন বর্তমানের চোখ দিয়ে। তাঁকে ঠিকমতো ঘটনা-বাছাই শিখতে হ্য়। কিসের বাছাই? অতীতে রোজ কত কিছু ঘটছে। তার সবই ইতিহাসের উপাদান নয়। তাই যদি হতো তাহলে যে-কোনো এক বছরের খবরের কাগজ আগাপাশতালা ছেপে দিলেই সেটি ইতিহাস হয়ে যেত। কিন্তু তা হয় না। নির্বিচারে সব ঘটনাকেই ‘ঐতিহাসিক’ বলা যায় না। ঘটার পরে যে ঘটনার বিশেষ তাৎপর্য ধরা পড়েছে সেই ঘটনাই ইতিহাস লেখকের কাঁচামাল। তেমন ঘটনা বাছাই করে তিনি তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস লেখেন। ইতিহাস অনেকটাই ঐতিহাসিকের সৃষ্টি- আগাগোড়া পক্ষপাত শূন্য বিষয়মুখী ইতিহাস বলে কিছু হয় না। ঘটনার বাছাই, শব্দ প্রয়োগ ইত্যাদি দিয়েই বিষয়ীর ঝোঁক ধরা পড়ে যায়।(কার-১৪-২১)

ইংরেজিতে ক্রসিং দ্য রুবিকন (রুবিকন বলে জলধারা পেরনো) একটি চালু প্রবাদ। মানে হলো যে সিদ্ধান্ত নিলে আর ফেরা যায় না। ইতালি আর গল-এর মধ্যে এই জলধারাটি ছিল দু দেশের সীমানা। জুলিয়াস সিজার খ্রিপূ ৪৯-এর একদিন সেটি পেরোলেন। ফলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠল। সিজার-এর আগে ও পরে হাজার হাজার মানুষ ঐ জলধারা এপার ওপার করেছেন। কিন্তু তার কোনোটিই ইতিহাসের তথ্য নয়। সিজার যখন ঐ জলধারা পেরোলেন তখনই সেটি ইতিহাসের তথ্য হয়ে উঠল। (কার৫)

হাজার হাজার লোকের রুবিকন পেরনোর মতোই কেরি প্রমুখ মিশনারিদের বাঙলা গদ্যচর্চা কথাটি তাৎপর্যহীন ঘটনা।তাঁর আগে ও পরে অনেকেই গদ্য লিখেছেন, কমবেশি নিষ্ঠাভরেই তাঁরা সে কাজ করেছেন, কিন্তু বাঙলা গদ্যর কাঠামো তাতে গড়ে ওঠেনি। তাঁদের রচনাভঙ্গি কেউ অনুসরণ করেননি। কেউ তাঁদের গদ্য নিয়ে চড়া ব্যঙ্গও করেননি। উলটে বলা যায় কেরি ও তাঁর উত্তরসূরিদের বাইবেল- অনুবাদ ও অন্যান্য পুস্তিকা নিয়ে লোকমুখে কিছু কৌতুক চালু হয়েছিল। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাই লিখতে পেরেছিলেন : ‘মহাপ্রভু পাদ্রি কেরী প্রভৃতি শ্বেতাবতারেরা ঐ সময় বঙ্গভাষায় খ্রীষ্টধর্ম বিষয়ক কয়েকখানা পুস্তক প্রকটন করেন, তাহাতে কেবল সাহেব গন্ধই নির্গত হইত’। (অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ৪৮-এ ঊদ্ধৃত)

শুধু ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কেন, ব্যাপ্টিস্ট অনুবাদক জন ওয়েঙ্গার, ক্যাথলিক মিশনারি আবে দুবোয়া ও রামমোহন রায় থকে শুরু করে একালে সুকুমার সেন ও মিনতি মিত্রও একই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন।১ তবু কেউ কেউ বলে থাকেন: প্রথম সংস্করণে (১৮০১) বাইবেল- অনুবাদ যেমনই হোক, পরের সংস্করণগুলিতে বারবার শোধন করার ফলে তার ভাষা তুলনায় অনেক প্রাঞ্জল হয়েছে। কেরির কোনো কোনো অনুরাগী তাঁকে বাঙলা বাইবেল-এর উইলিয়াম টিণ্ডাল (১৪৯৪?-১৫৩৬) ও জন উইক্লিফ (আনুঃ১৩৩০-৮৪) বলে দাবি করেছেন। (মিনতি মিত্র ৫৯-এ উল্লিখিত)

এমন সুখ্যাতির মধ্যে সত্য কতটুকু? টিণ্ডাল -এর অনুবাদ ইংরিজি গদ্যর ইতিহাসে দিক্‌চিহ্ন হয়ে আছে। ১৬১১-য় বহু অনুবাদক ও ভাষাবিদের যৌথ প্রচেষ্টায় যে- অনুবাদ বেরিয়েছিল তার দশভাগের ন ভাগইটিণ্ডাল -এর প্রতিধ্বনি (ব্রুস ৪৪০)। চরম প্রতিকূল পরিবেশে একাটিণ্ডাল যে কাজ করেছিলেন, সতেরো শতকের গোড়ায় অতজন মিলেও তাঁকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি। ১৬১১-র সেই ‘অনুমোদিত অনুবাদ’ (যাকে ‘রাজা জেমস-এর অনুবাদ’ কিং জেমস ভারসন-ও বলা হয়, যদিও দুটি নামই তথ্যর দিক দিয়ে অসত্য) সাধারণভাবে ইংরিজি ভাষার বিকাশকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। কেরি-র অনুবাদ-একা কেরি অবশ্য সব অনুবাদ করেননি, তাঁর সহযোগীও ছিলেন অনেক-এমনকি বাঙালি খ্রিস্টান মহলেও অস্বস্তির কারণ হয়েছিল। বাঙলা গদ্যর বিকাশে কেরি তথা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত ও মুন্‌শিদের রচনার কোনো ছাপই পড়েনি। রামমোহন তাঁর নিজের মতো করে বাঙলা গদ্যর ছাঁদ তৈরি করেছিলেন। বিষয়বস্তুর দিকেই তাঁর নজর ছিল পুরোপুরি। প্রসাদগুণ নিয়ে তিনি মাথা ঘামাননি। বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমারই প্রথম বাঙলা গদ্যর অন্বয় ধরতে পেরেছিলেন। সেই বোধ তাঁদের আগেকার কোনো লেখকের মধ্যেই দেখা যায় না । প্রমথ চৌধুরী সঠিকভাবেই বিদ্যাসাগরের দিকটিকে শনাক্ত করেছেন (১:৩২৪)।তিনি অবশ্য অক্ষয়কুমারের কথা বলেননি, কিন্তু বিষয় বৈচিত্র্যর কারণে অক্ষয়কুমারও সমান স্মরণীয়।

হালে কেরি সম্পর্কে যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য :‘কেরি বাঙলা ভাষার যত বড়ো সেবক ছিলেন, তত বড়ো লেখক ছিলেন না’ (৯৭)। এমন বলার কারণ কী? প্রদ্যুম্নবাবু দেখিয়েছেনঃ ‘কেরির মৃত্যুর মাত্র বছর খানেক আগে তাঁর অনূদিত বাইবেলের যে শেষ সংস্করণটি (1833)বেরোয়, সেটা পড়লে বুঝতে পারি, নিখাদ বাঙলা বাগ্‌ভঙ্গি আর বাকস্পন্দ এই শেষ বয়সেও তাঁর ঠিক দখলে আসেনি।’ (৯৮)

কথাটি তার আগে সুকুমার সেনও বলেছিলেন। কেরির নামে ছাপা কথোপকথন প্রসঙ্গে তাঁর মন্তব্য : ‘নাই অর্থে “নহে” পদের অপপ্রয়োগও কেরির সন্দেহ নাই, কেননা কোন দেশীয় লেখক এই ভুল করিতে পারেন না’ (২০)। বাইবেল অনুবাদ প্রথম সংস্করণের (১৮০১) একটি অংশ ও কেরির জীবিতকালের শেষ সংস্করণ (১৮৩২-৩৩)-এ সেই অংশর পাঠ উদ্ধৃত করে তাঁর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য : ‘ইহা হইতে বোঝা যাইবে যে রচনা রীতির আশানুরূপ উন্নতি হয় নাই’। (১৬)

প্রদ্যুম্নবাবু একটি উদাহরণ দিয়েছেন ইংরিজিতে কেরির বাঙলা ব্যাকরণ (চতুর্থ সংস্করণ, ১৮১৮)থেকে। সেখানে একটি বাক্য আছে :‘আমার কিছু টাকা নয়’, তার ইংরিজি অনুবাদ : ‘I have no money’।প্রদ্যুম্নবাবু লক্ষ্য করতে বলেন :‘অর্থাৎ “নয়” আর “নেই”-এর তফাত তিনি বুঝতেন না। তাঁর ব্যাকরণের মরণোত্তর পঞ্চম সংস্করণেও (1843) এই একই ভুল পুনরাবৃত্ত’।(৯৮ টি.৯)

শুধু ‘নয়’-ই নয়। ঐ বাক্যে ‘কিছু’ শব্দটির দিকেও নজর দিতে বলি। এই বিশেষণটি পুরোপুরি বেদরকারি। কথিত বাংলার বাগ্‌ভঙ্গির সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না, ইংরিজি বাক্যটিতেও এমন কোনো শব্দ নেই।

দু-চারটি উদাহরণ দিলে কেউকেউ আপত্তি করতে পারেন। কিন্তু কেরি-র বাইবেল খুলে পাতা উল্‌টে চললেই এমন অনেক বিচিত্র নমুনা পাওয়া যাবে। ফাদার দ্যতিয়েন অবশ্য এর জন্যে ব্যক্তি কেরি-র চেয়ে বেশি দায়ী করেছেন তাঁর সম্প্রদায়কে :

কেরী যে-ব্যাপ্টিস্ট সম্প্রদায়ের সভ্য ছিলেন, তার মতানুসারে বাইবেলের প্রতিটি শব্দ যেন ঈশ্বরের মুখ থেকে নিঃসৃত বাণী।।....তাই তাঁর কাছে আক্ষরিকতার এত মূল্য! (৩০) 

ফাদার দ্যতিয়েন উদাহরণ দিয়েছেন বাইবেল অনুবাদের প্রথম সংস্করণ থেকে : ‘ফারোঙা স্বপ্ন দেখিল দেখ সে ডাণ্ডাইয়া আছে নদীর কিনারায় দেখ নদী হইতে উঠিল সুন্দর হিষ্টপুষ্ট [অবিকল] সাতটা গাভী ও চরিতে লাগিল ধারের উপর দেখ তাহার পরে আর সাতটা গাভী...।’ দ্যতিয়েন বলেছেন : ‘ এই “দেখ” শব্দটির অপপ্রয়োগ নিছক হিব্রুয়ানা-কিং জেমস-এর অনুবাদেও যা রক্ষিত হয়েছেঃ “ and behold he stood by the river… and behold there came out of the river… and behold several other kine…”।'(৩০)

এতে ‘দেখ’-র ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কিন্তু বাক্যটি অন্বয়ঘটিত দোষও কি হিব্রুয়ানা কারণে? ‘দেখ’ শব্দটি তুলে দিলেও বাক্যগুলির কি অণুমাত্র উন্নতি হয়? টিন্ডাল থেকে শুরু করে কোনো ইংরিজি অনুবাদকের রচনায় এই দোষ পাওয়া যায় না।

দ্বিতীয়উদাহরণটি ফাদার দ্যতিয়েন দিয়েছেন বাইবেলে-এর প্রথম দুটি পদ (ভার্স অর্থে) থেকে(আদিপুস্তক ১.১-২):

প্রথম ঈশ্বর সৃজন করিলেন স্বর্গ ও পৃথিবী, পৃথিবী শূন্য ও অস্থিরাকার হইল এবং গভীরের উপর অন্ধকার ও ঈশ্বরের আত্মা দোলায়মান হইলেন জলের উপর....।

ফাদার দ্যতিয়েন –এর মতে :‘এই অদ্ভুত শব্দবিন্যাস হিব্রু-অনুযায়ী;সে যে কত অ-বাংলা,কেরী তা অবশ্যই জানতেন, বাইবেলের ভাষার ইতরতা স্বেচ্ছাকৃত’। (৩০)

কথাটা মানতে একটু অসুবিধা আছে। এর পরে তো কেরি-র ধর্ম্মপুস্তক বারবার ছাপা হয়েছে; কয়েক বছর অন্তর অন্তরসংস্করণও হয়েছে। ১৮৩২এর সংস্করণে দেখি : শব্দবিন্যাস আগাগোড়া পাল্‌টে গেছে, কর্তার পরে ক্রিয়ার বদলে এসেছে কর্ম (বাঙলার পক্ষে যা স্বাভাবিক), অতিরিক্ত বিভক্তি, ক্রিয়া ও বিশেষণে লিঙ্গভেদ যোগ হয়েছে।

প্রথম ঈশ্বর স্বর্গ ও পৃথিবী সৃষ্টি করিলেন। পৃথিবী অস্থিরাকারা এবং শূন্যা এবং গভীরে স্থলের উপরে অন্ধকার ছিল এবং ঈশ্বরের আত্মা জলের উপর দোলায়মান হইলেন। (গোলাম মুরশিদ ১৮৩)

দেখা যাচ্ছে শব্দবিন্যাসের হিব্রুয়ানা ত্যাগ করলেও অ-বাঙলা ভাবটা কাটেনি। হালের একটি অনুবাদের সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে ব্যাপারটি আরও স্পষ্ট হবে :

সেই সূচনা-লগ্নে ঈশ্বর আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি করেছিলেন। পৃথিবী তখন ছিল নিরাকার, শূন্যময়। অতলে ওপর প্রসারিত ছিল অন্ধকার আচ্ছাদন, জলরাশির ওপর বইত ঈশ্বরের প্রাণবায়ু। (মঙ্গল বার্তা, ২৯)

দুটি অনুবাদের তুলনা করা অনুচিত। কেরি-র কোনো পূর্বসূরি ছিলেন না আর মিংঙো বন্ধ্যোপাধ্যায়ের পেছনে আছেন বিদ্যাসাগর-বঙ্কিম থেকে রবীন্দ্রনাথ-প্রমথ চৌধুরী পর্যন্ত ব্যাপ্ত এক গদ্য-ঐতিহ্য। দেখবার শুধু এই যে, টীকা-টিপ্পনী ছাড়াই দ্বিতীয় অনুবাদটির মানে করা যায়, কেরির অনুবাদ বড়ই অস্বচ্ছ।

আরও একটি কথা। আদি পুস্তক ১।৩-৪-এর হালের অনুবাদ এই রকম :

ঈশ্বর বললেন : “আলো হোক!” আলো হল। ঈশ্বর দেখলেন, আলো ভালই হয়েছে। ঈশ্বর অন্ধকার থেকে আলকে আলাদা ক’রে রাখলেন।

কেরি-র অনুবাদ ছিল :

পরে ঈশ্বর বলিলেন দীপ্তি হউক তাহাতে দীপ্তি হইল তখন ঈশ্বর সে দীপ্তি বিলক্ষণ দেখিলেন।(১৮০১ সং)

একতিরিশ বছর ধরে নানা সংস্কারের পর এই অংশটি দাঁড়িয়েছিল :

পরে ঈশ্বর বলিলেন যে দীপ্তি হউক তাহাতে দীপ্তি হইল।তখন ঈশ্বর দেখিলেন যে দীপ্তি উত্তম তৎপরে ঈশ্বর দীপ্তি ও অন্ধকার বিভিন্ন করিলেন। (১৮৩২ সং)

মিংঙো-বন্ধ্যোপাধ্যায়ের অনুবাদে যে ছন্দঃস্পন্দ, তার পেছনে ছায়া ফেলেছে রবীন্দ্রনাথের লিপিকা, কেরি-র কাছে অবশ্যই তা আশা করা বৃথা। তাঁর সে- কানই ছিল না; আর কথিত শব্দ ব্যবহারের চেষ্টা বা ইচ্ছেরও অভাব ছিল, ফলে ‘বিলক্ষণ’ ছেড়ে তিনি ‘উত্তম’-এ আসতে পারেন, কিন্তু ‘দীপ্তি হইতে অন্ধকারকে বিভিন্ন করিলেন’ এমন বাক্য লিখতে পারেন না।

ফাদার দ্যতিয়েন মনে করেন :কেরি ইচ্ছে করলেই অ-বাইবেলীয় ভাষায় লিখতে পারতেন। তাঁর যুক্তি এই রকম, 

যিনি বাংলা অভিধান সম্পাদন [সম্পাদন] করেছেন, বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেছেন, যিনি স্বভাবসিদ্ধ বিনয় ও নম্রতা সত্বেও –সরলভাবে স্বীকার করেছেন বাংলা ভাষা তিনি ভালোই আয়ত্ত করেছেন, তিনি কি ইচ্ছা করলেই, অ-বাইবেলীয় ভাষায় লিখতে পারতেন না?... (৩০)

ইচ্ছে করলেই যদি উপায় বেরুত তবে দুনিয়াটা অনেক সুখের জায়গা হতো, সন্দেহ নেই। কিন্তু ঘটনা এই যে, সবক্ষেত্রে তা হয় না। এছাড়া পরের অনুচ্ছদেই দ্যতিয়েন লিখেছেন :

এদিকে স্বীকার করতে হয়, কেরী তাঁর ব্যাকরণে উদাহরণ স্বরূপ যে-সমস্ত বাক্য উদ্ধৃত করেছেন সেগুলোর মধ্যে ইতিহাসমালার প্রাঞ্জলতা পাওয়া যায় না। তাহলে? (৩১)

শেষ পর্যন্ত ফাদার দ্যতিয়েনকেও তাই মানতে হয় : ‘কেরী সাহিত্যিক ছিলেন না, ইতিহাসমালা রচিত হয়েছে শুধু ভাষা শেখাবার জন্যে, সাহিত্য সৃষ্টি করার জন্যে নয়।’ তিনি এও স্বীকার করেছেন ইতিহাসমালা -র লেখক আসলে একা কেরি নন, একজন ‘অচেনা বাঙালী সন্তান’-এর সাহায্য তিনি পেয়েছিলেন।

এক-এক করেবিষয়গুলি দেখা যাক; কেরি একটি বাঙলা অভিধান সম্পাদন করেছেন ঠিকই। কিন্তু তার কতটা কেরি আর কতটা ফরস্টার-এর? গোলাম মুরশিদ দেখিয়েছেন :

সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, তাঁর অভিধানে ফরস্টার পথিকৃৎ হিসেবে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন, বস্তুত, তিনি যে-কাঠামো নির্মাণ করেছিলেন, অতঃপর তারই ওপর নির্ভর করে অধিকতর সফল অভিধানগুলো রচিত হয়েছিলো। অন্তত কেরীর বিখ্যাত অভিধানতো [হুবহু] বটেই। বিশেষ করে বাংলা ইংরেজি অংশেই এই সাদৃশ্য বেশি করে চোখে পড়ে। ফরস্টার ইংরেজির যে- প্রতিশব্দ দিয়েছেন, কেরী সামান্য পরিবর্তন করে তাই রেখেছিলেন, তবু ফরস্টারের কাছে তাঁর ঋণ সর্বত্রই স্পষ্ট। (১১৯)

কেরি-র অভিধানে শব্দ অনেক বেশি আছে, কিন্তু কেমন শব্দ? সরস্বতী মিশ্র জানিয়েছেন : তাঁর সংগৃহীত সংস্কৃত শব্দের মধ্যে কিছু শব্দ অবশ্যই বাংলায় প্রচলিত, কিন্তু অধিকাংশ শব্দই কখনও বাংলায় ব্যবহৃত হয়নি। (৫৬)

যেমন, অব্যথা The absence of pain, অমৎস্য not a fish, অমদ not wine। এছাড়া আছে অসাধারণ সব সমাসবদ্ধ পদ : ইতিকর্ত্তব্যতাকলাপ the whole of what ought to be done in a given case, এতচ্ছত্রানুসন্ধানী searching for this umbrella, এতচ্ছায়োৎপাদক producing this shade।শারীরবৃত্তের পারিভাষিক শব্দ কেন এমন অভিধানে আসবে? বিশেষ করে এই ধরণের শব্দ, যেমন, আমাশয়মূর্দ্ধাক্ত রক্তবাহকনাড়ি The coronary stomachic Arteries, নাবাকুত্যাস্থিছিদ্র one of the cavities of the ear, পাদবৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠনমনকারিদীর্ঘ The name of the one of muscles which assists in moving the great toe। (মিশ্র ৫৬)

এছাড়া আছে ব্যবহারিক প্রয়োগ না-জানায় আক্ষরিক অর্থ করার ভুল, যেমন, গলগ্রহ seizing of anyone by the throat, ‘মনস্ত; [মনঃস্থ] situated in the mind or heart, (মিশ্র ৫৮) 

অভিধানের আয়তন বাড়ানোর জন্যে কেরি আরও একটি পথ ধরেছিলেন। সেটি হলো : একটি পদ দেওয়ার পর অজস্র সমাসবদ্ধ পদের উল্লেখ। ‘নিয়ম; শব্দটির সঙ্গে আরও ১১৪ টি পদ আছে, তার অনেকগুলিই সে যুগের কোনো বই-এ ব্যবহার হয়নি, তার পরের ১৯৫ বছরেও নয়। যেমন, নিয়মাতি ক্রমার্জিত, নিয়মোল্লঙ্ঘনমিত্তিক, নিয়মোল্লঙ্ঘনসহেতুক।(মুরশিদ ১২১)

আর ব্যুৎপত্তির ক্ষেত্রে তো কেরি প্রায় লাগামছাড়া উৎকল্পনাশক্তির পরিচয় দিয়েছেন।যেমন, গৃহ from গ, a name of Ganesh and ঈহ to desire, কন্দল from কন্দ a root and লাto take (মিশ্র ৫৭)।সরস্বতী মিশ্র এগুলির দায় কেরি-র পণ্ডিতদের ঘাড়ে চাপিয়েছেন। এতে কিন্তু তাঁদের প্রতি অবিচার করা হয়। পর পর এতগুলি লোক-নিরুক্তি (ফোক ইটিমোলজি)জন্মসূত্রে বাঙলাজানা লোকের কীর্তি হতে পারে না।

স্রেফ খুঁত ধারার জন্যে এত কথা বলছি না, বাঙলা ব্যাকরণ নিয়ে কেরি-র কাজটি অনেকটাই হ্যালহেড-নির্ভর। স্ত্রী- প্রত্যয় প্রসঙ্গে তিনি হ্যালহেডকেই অনুসরণ করেছেন, কিন্তু যেখানেই দৃষ্টান্ত দিয়েছেন সেখানে খটকা লাগে, যেমন, বিড়ালের স্ত্রীলিঙ্গ বিড়ালা, মৃগ-মৃগা।বিশেষণ থেকে বিশেষ্য করার ব্যাপারেও তাঁর দৃষ্টান্তগুলি সমান ভুল : মিথ্যা false- মিথ্যতা falsehood। এছাড়া এমন সব শব্দ আছে যেগুলি কেরি-র সংস্কৃত জ্ঞান সম্পর্কে সন্দেহ জাগায় : স্থৈর্যতা, ধৈর্যতা, সৌন্দর্যতা (নির্মল দাশ ৯৭-৯৮)। পরের সংস্করণে কিছু কিছু সংশোধন হলেও সব দোষ দূর হয়নি।

২০ সেপ্টেম্বর ১৮০৪-এ সংস্কৃতয় কেরি যে বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন (অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ৫৭-য়ঊদ্ধৃত) তার অন্বয় পুরোপুরি ইংরিজি অন্বয়ের নকলে। ব্যাকরণে ভুল নেই বটে কিন্তু তার ভাষা প্রথম শিক্ষার্থীর অনুবাদের মতো। কেরি-র সমকালীন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুই কর্মচারী, হেনরি টমাস কোলব্রুক ও হোরেস হেমান উইলসন ছিলেন সত্যিকারের সংস্কৃতবিদ; কেরি তাঁদের ধারে-কাছেও আসেন না। আর তাঁর বাঙলা জ্ঞানের ব্যাপারে বলতে হয়ঃ বারবার সংস্কার করার পরেও তাঁর ভাষা কখনোই সুখপাঠ্য হয়নি, এমন কি সুবোধ্যও নয়। ধর্ম্মপুস্তক-এর ১৮৩২-এর সংস্করণে দেখা যাচ্ছে : সংস্কৃত ও ফার্সি শব্দর মধ্যে সঠিক শব্দটি বেছে নেওয়ার ক্ষমতা তাঁর কোনোদিনই হয়নি, এর আগেও তিনি একই সংস্করণে কোথাও ‘মেহেরবানী’ কেটে ‘অনুগ্রহ’ করেছেন, আবার কোথাও বা ‘অনুগ্রহ’ কেটে ‘মেহেরবানী’। (মুরশিদ ১৮৪)

তাহলে দেখা গেল কেরি-র বাঙলা অভিধান-ব্যাকরণ ইত্যাদি সম্পদনা ও রচনার কৃতিত্ব নিয়ে পঞ্চমুখ হওয়ার কিছু নেই। তাঁর অনেক আগে থেকেই এসব কাজ হচ্ছিল, পরে যোগ্যতর লোকে সে-কাজ করেছেন। চেষ্টার ত্রুটি তিনি করেননি, নিষ্ঠারও অভাব ছিল না, প্রেরণা তো ছিলই (বিধর্মীকে সদ্‌ধর্মে দীক্ষিত করার অভিলাষ)২। ছিল না একটিই গুণ, আর তার অভাবে সবই মাটি হয়ে যায়। সেটি হলো: যে ভাষার চর্চা করছেন সেই ভাষার স্বভাব বোঝার ক্ষমতা। কেরি একসঙ্গে অনেক ভারতীয় ভাষা শিখেছিলেন একটিই লক্ষ্য নিয়ে : সেই ভাষায় বাইবেল অনুবাদ ও খ্রিস্টীয় প্রচারপুস্তিকা রচনা, মিশনারি জিল (zeal) বলতে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা বোঝায়, কেরি ও তাঁর পরিজনদের সেটি ছিল শতকরা একশ পাঁচ ভাগ, কিন্তু ঐ যে বললুম, ছিল না কোনো ভারতীয় ভাষার স্বভাব সম্পর্কে সত্যিকারের বোধ।ভাষা কেরি-র কাছে মাধ্যম মাত্র; যেমন-তেমন করে স্বধর্ম প্রচার করতে পারাই ভাষা শেখার প্রথম ও শেষ উদ্দেশ্য।এমন মনোভাব নিয়ে কোনো ভাষায় সাহিত্যসৃষ্টি কারা যায় না, লেখক হিসেবে কেউ অনুসরণীয় হতে পারেন না। কাশীপ্রসাদ ঘোষ নাকি ঠাট্টা করে মিশনারিদের ভাষাকে ‘শ্রীরামপুরী বাঙলা’ বলতেন (সুনীলকুমার চট্টোপাধ্যায় ১০৭)। অক্ষয় দত্ত ও বিদ্যাসাগরের অভ্যুদয়ের পর কেরি-র বাঙলা এমনকি বঙ্গীয় খ্রিস্টান সমাজেও গ্রাহ্য হলো না; তাঁরাও মূলস্রোতের বাঙলা গদ্যর রীতিনীতি মেনে নিলেন, ‘শ্রীরামপুরী বাঙলা’ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

আমার বক্তব্যর সমর্থনে আরও একটি প্রমাণ দিচ্ছি। ধরা যাক, বাঙলা গদ্যসাহিত্যর প্রতিনিধিস্থানীয়দের রচনায় একটি নির্বাচিত সঙ্কলন বার করা হবে। তার সম্পাদকের যদি বিন্দুমাত্র কাণ্ডজ্ঞান থাকে তাহলে কেরি ও তাঁর পরিজন রচনাবলির একটি পাতাও সেখানে ঠাঁই পাবে না। অবশ্যই ভূমিকায় তাঁদের কথা থাকেবে, কিন্তু মূল বই-এ নয়, সম্পাদকের পছন্দ অনুযায়ী রামরাম বসু, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের অন্যান্য পণ্ডিত-মুনশি্‌রা সেই সঙ্কলনে জায়গা পেতে পারেন, না- ও পেতে পারেন, রামমোহন রায় সম্পর্কেও একই কথা খাটবে।৩ কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করুন আর না-ই করুন, অক্ষয়কুমার দত্ত ও বিদ্যাসাগকে তিনি কিছুতেই বাদ দিতে পারবেন না, প্রাচীনত্বর কারবারি-র কাছে উনিশ শতকের আগের বাংলায় লেখা চিঠি ও দলিল-দস্তাবেজের যেটুকু মূল্য, সায়েবদের করা আইনের বই ও কোম্পানির নির্দেশনামার অনুবাদ তার চেয়ে বেশি কিছু নয়, কেরি ও তাঁর পরিজনদের বাইবেল- অনুবাদ আর খ্রিস্টীয় পুস্তিকাগুলিও বাঙলা গদ্যর ‘প্রাগ্‌ইতিহাস’-এর উপাদান।

শেষে একটি প্রশ্ন উঠতে পারে। কেরি ও তাঁর পরিজনদের ভূমিকা যদি এতি নগণ্য হয় তবে সজনীকান্ত দাস তাঁকে নিয়ে এত উচ্ছ্বাস করেছেন কেন?(সজনীকান্ত ৫৩-৫৫)। এর সহজ উত্তর : একা সজনীকান্ত নন, শনিমণ্ডলী (অর্থাৎ শনিবারের চিঠি-র লেখকগোষ্ঠী)-র অনেকই ছিলেন রামমোহন-বিদ্বেষী (শুধু বিরোধী বললে কম বলা হয়)। তাই যে-কোনো উপায়ে রামমোহনকে খর্ব করে অন্য কাউকে নিয়ে গর্ব করার দায় ছিল তাঁদের। তার জন্যেই কেরি তথা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে-এর পণ্ডিত-মুনশি্‌দের কৃতিত্ব প্রমাণ করতে তাঁরা কোমর বেঁধে নামলেন, (গোপাল হালদার ৩১-৩৩)। তেমনি কোনো কোনো বিদ্যাসাগর- বিদ্বেষী মাঠে নেমে সজনীকান্তদের ব্যাটনই হাতে তুলে নিয়েছিলেন (রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ২০-২৩)। ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’।কিন্তু কৌশলে কি আর না-কে হ্যাঁ করা যায়? রামমোহন- বিদ্যাসাগর স্বমহিমায় বিরাজ করছেন : কেরি ও তাঁর পরিজনরা, তাঁদের ভক্তদের শত চেষ্টা সত্বেও কোথায় হারিয়ে গেছেন।



টীকাঃ

১. আবে দুবোয়া-র মন্তব্যটি মনে রাখার মতোঃ

Behold The Baptist Missionaries at Serampore; inquire what are their scriptural successes on the shores of the Ganges. ask them whether those extremely incorrect versions, already obtained at an immense expense, have produced the sincere conversion of a single pagan….. রামমোহন রায় ইংরিজি রচনাসমগ্র ৪:৪৭-এ উদ্ধৃত। বাঁকা হরফ যোগ করা হয়েছে)। 

রামমোহন রায়ের কাছে এক মার্কিন পাদ্রি লিখিতভাবেজানতে চেয়েছিলেন বাঙলায় বাইবেল-অনুবাদগুলি কি মূলের প্রতি বিশ্বস্ত ও খ্রিস্টান মতবাদ বিষয়ে সম্প্রদায়গত প্রভাব থেকে মুক্ত?উত্তরে রামমোহন জানান :

To both parts of this query my reply must be in the negative. I at the same time acquit these translators of willful neglect or international perversion; They were, I think, too hasty to engage themselves in so difficult an undertaking.(ঐ, ৫১)

এর পরেরামমোহন বাঙলায় ‘নতুন নিয়ম’ অনুবাদ অভিজ্ঞতা নিয়ে মন্তব্য করেন :‘I beg to assure you, that I (though a native of this country) do not recollect having engaged myself once during my life, in so difficult a task (ঐ,৫২)।

২. শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায় লিখেছেনঃ

বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক বাণিজ্য প্রায় সমকালেই এ দেশে প্রসার লাভ করিয়াছিল। এই ধর্ম-যাজকদের ধর্মানুরাগের আন্তরিকতায় সংশয় করিবার কোন হেতু নাই। হতভাগ্য পৌত্তলিকদের মধ্যে সত্যধর্মপ্রচারের কল্যাণময়তায় ইহাদের যে দৃঢ় প্রত্যয় ছিল, তাহা কতকটা স্বার্থবুদ্ধি ও হীন চাতুরীর দ্বারা কলুষিত হইলেও, মোটের ওপর আন্তরিক নিষ্ঠাসঞ্জাত।(৯)

কিন্তু নিষ্ঠা দিয়ে কি অক্ষমতা পূরণ হয়? 

৩. যেমন, সুশীলকুমার দে মনে করতেন :‘ Rammohan was the father, not of Bengali prose, but of the particular kind of stilted prose, which he created and which now remains isolated as a mere curiosity.’(545)

ইওরোপীয় মিশনারি ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত-মুনশি্‌দের গদ্য সম্পর্কে কথাগুলি আরও বেশি প্রযোজ্য।



রচনাপঞ্জি 

অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধ ও বাংলা সাহিত্য, বুকল্যাণ্ড,১৯৫৯।

কার,ই, এইচ। কাকে বলে ইতিহাস: কে পি বাগচী অ্যাণ্ড কোম্পানী, ২০০৬। 

গোপাল হালদার, বনচাঁড়ালের কড়চা। ন্যাশনাল পাবলিশার্স, ১৩৬৭। 

গোলাম মুরশিদ। কালান্তরে বাংলা গদ্য, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৩৯৯।

জনার্দন চক্রবর্তী। স্মৃতিভারে। জেনারেল প্রিন্টার্স য়্যাণ্ড পাবলিশার্স, ১৩৯৯।

নির্মল দাশ। বাংলা ভাষার ব্যাকারণ ও তার ক্রমবিকাশ, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়,১৩৯৪।

প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য। টীকা টিপ্পনী। প্যাপিরাস, ১৯৯৮।

প্রমথ চৌধুরী। প্রবন্ধসংগ্রহ, খণ্ড ১, বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ১৯৫৭।

ফাদার দ্যতিয়েন সম্পা। কেরী সাহেবের ইতিহাসমালা, ফাদার দ্যতিয়েন, তাং নেই।

মঙ্গলবার্তা। বাইবেল, ভাগ ১, প্রাক্তন সন্ধি, খ্রীস্তিয়াঁ মিংঙো, এস.জে.ও সজল বন্দোপাধ্যায় অনুঃ জেভিয়ার প্রকাশনী.২০০৩

মিনতি মিত্র। বাংলা সাহিত্যের খ্রীস্টীয় রচনা। সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৪। 

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। ‘বাংলা ভাষার ভূত-ভবিষ্যৎ’, অবভাস, ২:১ এপ্রিল ২০০২।

শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায়। বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা, খণ্ড ২। ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, ১৯৬৪।

সজনীকান্ত দাস, উইলিয়াম কেরী (সাহিত্য-সাধক-চরিতমালা ১৫, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, ১৩৬৩।

সরস্বতী মিশ্র, বাংলা অভিধানের ক্রমবিকাশ। পুস্তক বিপণি, ২০০০।

সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের গদ্য। ইস্টার্ণ পাবলিশার্স, ১৩৭৩।

সুধাংশুশেখর তুঙ্গ সম্পা.। বাংলার বাইরে বাংলা গদ্যের চর্চাঃ ষোড়শ-অষ্টাদশ শতক। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮৫।

সুনীল কুমার চট্টোপাধ্যায়। বাংলার নবজাগরণে উইলিয়াম কেরী ও তাঁর পরিজন। রত্না প্রকাশন, ১৯৭৪।

সুরেন্দ্রনাথ সেন সম্পা.। প্রাচীন বাঙ্গালা পত্রসঙ্কলন,কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৪২।

Bhattacharya , Pranab Kumar. Was “ Bengali” the state language of the former Cooch Behar Kingdom? Journal of tyhe Asiatic Society, VOL LIV No.3,2012

Bloch, Marc . Land and Work in Medieval Europe. New York : Harpen Torchbooks,1967.

Bruce . FF .TheEnglish Bible: AHistory of Translations. London: Methuen, 1963. 

De, Sushil Kumar. Bengali Litreture in the Nineteenth Century. Firma K.L.M 1962. 

Roy Rammohun, The English Works. Eds Kalidas Nag and Debajyoti Burman ( One Volume ed.). Part IV. Sadharan Brahmo Samaj, 1965,47-55.


কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ পার্থ মিত্র, বিকাশ রায়, সনৎকুমার মিত্র, সিদ্ধার্থ দত্ত 







0 comments:

1

প্রবন্ধ - সুজন ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ


বাঙালির পারিবারিক সম্পর্কের ডাক ও ভাষা-রাজনীতি (১ম পর্ব)
সুজন ভট্টাচার্য



সম্প্রতি বাঙালী মুসলিমদের পারিবারিক সম্পর্ক কিংবা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত শব্দাবলী নিয়ে নানান মহলে বিতর্ক শুরু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৃতীয় শ্রেণীর সমাজবিদ্যার পাঠ্যবইয়ের একটি পাতাকে কেন্দ্র করেই এই বিতর্ক মাথাচাড়া দেয়। কেউ কেউ বইটা আদ্যোপান্ত না পড়েই বলতে শুরু করে দেন – মা, বাবার বদলে আম্মা/আব্বা শেখানো হচ্ছে। অথচ ঠিক আগের পাতাটা দেখলেই বুঝতে পারতেন যে এটা আসলে বাঙালীর দুই প্রধান ধর্মসম্প্রদায়েরই পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে শিশুকে অবহিত করার প্রয়াস মাত্র। সেই হিসাবে এতে আপত্তি বা নিন্দার কিছু নেই। কিন্তু সে সময় আমাদের ব্যস্ত জীবনে কোথায়? বিভিন্ন বিষয়ে অজ্ঞানতা আগেও ছিল; কিন্তু সেই নিয়ে লজ্জাবোধও ছিল। এখন হয়েছে উলটো। অজ্ঞানতা এখন গর্ব করে বলার মতো গুণ। শিখবো না, এই ধনুর্ভঙ্গ পণ করেই যেন কেউ কেউ বসে আছেন। এর পাশাপাশিই আছে স্বজ্ঞানে বা অজ্ঞানে একটা সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে ফেলা। অবস্থান যদি নিয়েই ফেলি, তাহলে সবকিছুই সেই মাপকাঠিতেই দেখবো। এটাই স্বাভাবিক। এখানে সবথেকে হাস্যকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে কতিপয় স্বঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ উদারপন্থীর অবস্থান। বাংলা ভাষার শুচিতা নাকি ইচ্ছাকৃত আরবি/ফার্সি শব্দের অনুপ্রবেশে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। এবং হিন্দু-অবস্থানকারীদের থেকে এরা নিজেদের আলাদা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন বাংলাভাষাপ্রেমের নামে। তাহলে আসুন, এখান থেকেই শুরু করা যাক।

যত পণ্ডিত বাংলা ভাষা ও তার ব্যাকরণ নিয়ে বই লিখেছেন, তারা সকলেই ধরে নিয়েছেন সংস্কৃতই বাংলা ভাষার জননী। এই ধারণার জন্মদাতা অবশ্যই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অন্যান্য রচয়িতাগণ। বর্ণ পরিচয় লিখতে গিয়ে তাই বিদ্যাসাগর একদিকে যেমন ইংরেজি বা অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষা থেকে আগত শব্দাবলীকে বাদ রাখলেন, তেমনই সরিয়ে রাখলেন আরবী বা ফার্সি থেকে আগত শব্দগুলোকে। প্রাথমিকভাবে মনেই করিয়ে দেওয়া হলো, তোমার ব্যবহার্য শব্দাবলী আসলে সংস্কৃত থেকেই ধার নেওয়া; কাজেই তোমার সংস্কৃতির শিকড় সেই“দেবভাষা”র মধ্যেই নিহিত হয়ে আছে। সেটা কি ঐতিহাসিক বা বাস্তবিক সত্য? যথেষ্ট সন্দেহ আছে। প্রথমে সেই সন্দেহের প্রেক্ষাপটটাই আলোচনা করা যাক। সংস্কৃত যদি ভারতের আদি ভাষা হয় – যা থেকেই বাংলা, হিন্দি, মরাঠী ইত্যাদি ভাষাগুলো বিকশিত হয়েছে – তাহলে হয় সংস্কৃতভাষী জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ভারতেই সেটা মেনে নিতে হবে,অথবা সংস্কৃত ভাষা যদি ভারতে আগত আর্যদের ভাষা হয়, তাহলে প্রাগার্য ভারতীয়রা কথা বলতে পারতো না, এমনটাই ধরে নিতে হবে।

নৃতত্ত্ববিদদের সাধারণ ধারণা ভারতের আদি অধিবাসী হলো প্রোটো-অস্ট্রলয়েড (কোল, ভিল, সাঁওতাল ইত্যাদি) ও মঙ্গোলয়েড (উত্তরের পাহাড়ের জনগোষ্ঠী) জাতি। সামান্য নেগ্রিটো বাস ছিল দাক্ষিণাত্য ও আন্দামানে। প্রোটো-অস্ট্রলয়েড ও নেগ্রিটো মিশ্রণেই দ্রাবিড় জাতির উৎপত্তি। আর্যরা এসেছিল অনেক পরে, ককেশাস পর্বতমালার সন্নিহিত অঞ্চল থেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারাই ভারতবর্ষ অধিকার করে বসল। এই তত্ত্বের সবথেকে বড় প্রমাণ হলো ল্যাটিন ও সংস্কৃত ভাষার অজস্র শব্দের সাদৃশ্য। এর থেকেই ভাষাতাত্ত্বিকরা মনে করেন এই দুই ভাষাগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষেরা একদা একসাথেই ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁরা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যান। সময় ও আঞ্চলিকতার সূত্রে তাঁদের ভাষা মূল থেকে খানিকটা পরিবর্তিত হয়ে যায়। তাহলে আর্যদের আগে থেকেই ভারতে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর বাস ছিল, এটা বোঝা যাচ্ছে। তাহলে তারা কি মূক ছিল সবাই? আর্যরা এসে তাদের কণ্ঠে ভাষা তুলে দিল? বিবর্তনবাদ এমন ধারণাকে সমর্থন করবে না। তাহলে একটাই উত্তর পড়ে রইল। আর্যদের যেমন নিজস্ব ভাষা ছিল, এইসব জনগোষ্ঠীরও নিজস্ব-নিজস্ব ভাষা ছিল। সাঁওতালি বা তামিল ভাষাকে সংস্কৃতের পাশাপাশি রেখে যে কেউই এর প্রমাণ পেয়ে যাবেন।

আবার ভারতে আগত আর্যদের মুখের ভাষাও যে সংস্কৃত ছিল না, সেটাও পণ্ডিতেরা মানেন। বেদের ভাষাকে বলা হয় ছান্দস বা প্রাক-সংস্কৃত ভাষা। তাহলে সংস্কৃত এল কোথা থেকে? ভারতে আসার পর স্থানীয় আদি-অধিবাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার খাতিরে আর্যদের ভাষা বদলে যাচ্ছিল। এটা খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সেই পরিবর্তিত ভাষাকে সংস্কার করে কঠোর নিয়মের ভিত্তিতে নতুন ভাষার প্রচলন করা হলো। সেই সংস্কার হওয়া ভাষাই হলো সংস্কৃত। সংস্কৃত বৈয়াকরণ পাণিনিকেই এই কাজের কাণ্ডারী বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আর্যদের ভাষা যেমন বদলালো, তেমনি অনার্যদের ভাষাও নিশ্চিতভাবেই বদলে গেল। সম্রাট অশোকের শিলালিপির ভাষা প্রাকৃত। সেখানে “দেবান পিয় পিয়দসি” শব্দ যে আসলে “দেবাণামপ্রিয় প্রিয়দর্শী”, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু বাকিটা সংস্কৃতের আদলে অবোধ্য। আবার এটাও ঘটনা, রাজভাষাই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়। তাই লাতিন আমেরিকা থেকে স্থানীয় পুরোনো ভাষাগুলো অবলুপ্ত হয়ে পর্তুগিজ ও স্প্যানিশের প্রচলন হয়েছে। ভারতেও এমনটাই খানিক খানিক ঘটে গেল।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসকে মূলত আর্য ইতিহাস হিসাবেই আমরা ভেবে থাকি। বাস্তবত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও দয়ারাম সাহনী সিন্ধু উপত্যকায় খননকার্য না চালালে আমরা জানতেই পারতাম না প্রথম যুগের আর্যদের কৃষিনির্ভর সভ্যতার অন্তত দু হাজার বছর আগেই ভারতে উন্নত নগর সভ্যতার পত্তন হয়েছিল। হরপ্পা ও মোহেঞ্জোদাড়োর ধ্বংসাবশেষের কথা জানার পর প্রথম সবাই জানতে পারলো, ব্যবিলনের নগর সভ্যতার সাথে তুলনীয় একটি নগর সভ্যতার বিকাশ ভারতবর্ষেও হয়েছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদদের সাধারণ ধারণা সিন্ধু সভ্যতার সময়সীমা খ্রীষ্টপূর্ব ৩৩০০ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ১৩০০ পর্যন্ত। খ্রীষ্টপূর্ব ২৬০০ থেকে ১৬০০ পর্যন্ত এই সভ্যতার চরম বিকাশের পর্যায়। প্রাথমিকভাবে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদরা একমত ছিলেন, এই সভ্যতা চরিত্রগতভাবে একটি অনার্য সভ্যতা। দ্রাবিড় সভ্যতা হিসাবেই একে চিহ্নিত করা হয়। কেউ কেউ মনে করেন আর্যরাই সিন্ধু সভ্যতাকে ধ্বংস করে। আবার একাংশ মনে করেন, প্রাকৃতিক কারণেই এই সভ্যতার পতন শুরু হয়; পরবর্তীকালে আর্যরা তাকে ধ্বংস করে। যাই হোক না কেন, আর্যদের হাতেই যে সিন্ধু সভ্যতার শেষ বিনাশ হয়েছিল, সেই বিষয়ে এঁরা একমত।

বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে একটা বিকল্প মত উঠে আসতে শুরু করল যে আর্যরা ভারতেরই আদি অধিবাসী এবং সিন্ধু সভ্যতা আসলে আর্য সভ্যতা। কেউ কেউ এমনও দাবী করেন যে সিন্ধু সভ্যতার সূচনা হয় খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০০ অব্দে। সেই হিসাবে সিন্ধু সভ্যতা ব্যবিলন বা মিশরীয় সভ্যতারও অগ্রজ। এই মতে বিশ্বাসীরা বলেন, সিন্ধু সভ্যতায় পশুবলির নিদর্শন থেকেই বোঝা যায় যে এই সভ্যতা আসলে আর্য সভ্যতাই। কেননা যজ্ঞে পশুবলি দেওয়া ছিল আর্যপ্রথা। এঁরা এমনও বলেন, খ্রীষ্টপূর্ব ১৬০০ অব্দে ব্যাপক খরার কারণেই সিন্ধু সভ্যতা পরিত্যক্ত হয়। এবং আর্যদের হাতে বিধ্বস্ত হওয়া তো দূরের কথা, সিন্ধু সভ্যতার পতনের সঙ্গে সঙ্গেই বৈদিক যুগেরও অবসান ঘটে। এই চিন্তার মধ্যে কয়েকটি ভারসাম্যের অভাব আছে। সবথেকে বড় কথা বৈদিক সভ্যতা ছিল কৃষিনির্ভর সভ্যতা। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতা আদ্যন্ত উন্নত নগর সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতা যদি বৈদিক সভ্যতাই হবে, তাহলে বেদে নগর সভ্যতার বিবরণ নেই কেন? আবার যজ্ঞে পশু, বিশেষত ঘোড়া বলি দেওয়া আর্যদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় একটাও ঘোড়ার মূর্তি পাওয়া গেল না কেন?

সবথেকে বড় সমস্যা হলো বেদের ভাষা ও সিন্ধু সভ্যতার লিপিকে কেন্দ্র করে। এখনো পাঠোদ্ধার করা সম্ভব না হলেও সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা যে লিপি ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কেউ কেউ দাবী করেন ঋকবেদ খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে রচিত হয়। যদিও অধিকাংশ ঐতিহাসিকই খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১২০০ অব্দের মধ্যে ঋকবেদ রচিত হয়েছিল বলে মনে করেন। সেই হিসাবে ঋকবেদ লৌহযুগের রচনা। অথচ সিন্ধু সভ্যতা ছিল তাম্র সভ্যতা। যদি ৫০০০ বা অন্ততপক্ষে ২৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দকে ঋকবেদের রচনাকাল বলে ধরেও নেওয়া যায়, তাহলে সেটিকে লিপিবদ্ধ করা হলো না কেন? কেন শুধু মুখে মুখেই সেই স্তোত্রগুলোকে প্রচার করা হতো? সিন্ধু সভ্যতা যদি আর্য সভ্যতাই হবে, তাহলে ঋকবেদকে লিপিবদ্ধ করাই কি যুক্তিযুক্ত হতো না?আরো একটা জটিল সমস্যা আছে সিন্ধু সভ্যতার প্রতীক ও মূর্তিপূজাকে নিয়ে। বেদের ধর্মাচরণ কিন্তু আদ্যন্ত যজ্ঞকেন্দ্রিক এবং মূর্তি বা প্রতীকপূজার কোনও স্থান সেখানে ছিল না। তাহলে কি এটাই ধরে নিতে হবে, নগরে প্রতীকপূজা ও গ্রামে যজ্ঞ, এটাই ছিল আর্য ধর্মাচরণ? এমন গোঁজামিল দিয়ে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যেতে পারে, সত্যের ধারেকাছে পৌঁছানো যায় না।

বেদের অন্যতম প্রধান দেবতা হলেন ইন্দ্র, পরবর্তীকালে যাকে দেবরাজ বলে চিহ্নিত করা হয়। ইন্দ্রের একটি নাম হলো পুরন্দর, অর্থাৎ নগর ধ্বংসকারী। কোন নগর তিনি ধ্বংস করেছিলেন? তার কোনও তালিকা বৈদিক সাহিত্যে নেই। তাহলে কি তিনি সামগ্রিকভাবে নগর সভ্যতাকেই উচ্ছেদ করেছিলেন? তিনিই আবার প্রতিস্পর্ধী বৃত্রাসুরের হনক। তাই তাঁর নাম বৃত্রাঘ্ন বা বৃত্রারি। বৃত্ত ও বৃত্র দুটি শব্দই বৃত ধাতু থেকে উৎপন্ন, যার অর্থ আবেষ্টন বা ঘিরে রাখা। সাধারণভাবে প্রাচীন যুগে নগরের চারিপাশ পাঁচিল দিয়ে ঘিরে রাখা হতো প্রতিরক্ষার কারণে। নগরপ্রাকারই ছিল এমনসব নগরের প্রাথমিক প্রতিরক্ষা-শক্তি। নগর ধ্বংস করতে হলে আগে তার প্রাকার ধ্বংস করতেই হয়। ইন্দ্র এই কাজে সফল হয়েছিলেন বলেই কি বেদে তাঁর প্রতি স্তুতির এত আয়োজন? আর যদি এই যুক্তি মেনে নিতে হয়, তাহলে এটাও মেনে নিতে হবে যে আর্য আক্রমণেই সিন্ধু সভ্যতার বিলুপ্তি ঘটেছিল।

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে বাংলা ভাষা নিয়ে আলোচনায় এই প্রসঙ্গ তোলার কী প্রয়োজন? প্রয়োজন অবশ্যই আছে। ভাষা একটি জনসমাজের সামগ্রিক সৃজন, যা ইতিহাসের ধারার পথে আপনা থেকেই বিবর্তিত হয়। কাজেই সমাজের চলনের আলোচনা না করে ভাষার গতিপথ বোঝা সম্ভব নয়। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ যদি পরষ্পরের দৈনন্দিন সান্নিধ্যে আসেন, তাহলে সহজ সংযোগের প্রয়োজনে উভয়ের ভাষাই বদলে যেতে বাধ্য। তবে এক্ষেত্রে সাধারণভাবে পাল্লাটা যে পক্ষ অধিকতর শক্তিশালী, তার দিকেই ঝুঁকে যায়। প্রশ্ন হলো এটাই, সংস্কৃত বা তার আদিরূপ ছান্দসই কি ভারতের আদি ভাষা? যদি বৈদিক সভ্যতাই ভারতের আদিতম সভ্যতা হয়, তাহলেই এটা সত্যি। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার আলোচনায় আমরা দেখেছি বৈদিক সভ্যতার অনেক আগেই ভারতে উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল এবং চরিত্রগত বিচারে তা আর্য নয়। পরবর্তীকালীন খননকার্যের ফলে দেখা যায় সিন্ধু সভ্যতার পরিসর অনেক ব্যাপ্ত ছিল। গুজরাটের লোথালে আবিষ্কৃত হয়েছে সমকালীন সমুদ্রবন্দর,যা প্রমাণ করে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে বহির্জগতেরও সম্পর্ক ছিল। বালুচিস্তানের মেহরগড়ে খ্রীষ্টপূর্ব ২২০০০ অব্দের প্রস্তরযুগের জনবসতির সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়াও পাওয়া গেছে গুজরাটের শ্রাবস্তী উপত্যকার নগর সভ্যতার প্রমাণ, যা সিন্ধু সভ্যতারই সমকালীন। এমনকি এই পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার চন্দ্রকেতুগড়েও প্রাচীন সভ্যতার হদিশ পাওয়া গেছে যা খ্রীষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দের। দক্ষিণবঙ্গের এই সমুদ্রসন্নিহিত অঞ্চলের এই সভ্যতা আর যাই হোক আর্য হওয়া সম্ভব নয়।

ভারতের জনসত্তার এই বৈচিত্রকে স্বীকার না করলে ইতিহাসকে প্রত্যাখ্যান করা হবে। আর্য সভ্যতা যেমন তার বহুচর্চিত একটি আঙ্গিক, তেমনি অনার্য আঙ্গিক তুলনায় কম আলোচিত হলেও অস্তিত্বহীন নয়। এইসব উন্নত নগর সভ্যতার অধিবাসীরা কি মূক ছিলেন? তাঁরা কি ভাষার ব্যবহার জানতেন না? এমনটা হওয়া সম্ভবই নয়। কাজেই এইসব সভ্যতারও নিজস্ব ভাষা ছিল। কিন্তু আর্য আধিপত্যের প্রভাবে ভারতবর্ষের তদানীন্তন এইসব ভাষাগুলির উপর সংস্কৃতের প্রভাব পড়ল। যে সব জনগোষ্ঠী আর্যদের প্রভাবের বাইরে থেকে যেতে সমর্থ হলেন, তাঁদের ভাষা প্রায় প্রভাবহীন রইল। যেমন সাঁওতালি, মুন্ডারী বা গোঁদ ভাষা। আবার কোন কোন ভাষা নিশ্চয়ই অবলুপ্তও হয়ে গেল। বুদ্ধদেব ছিলেন তরাই অঞ্চলের সন্তান। উত্তর বৈদিক যুগের প্রধানতম মহাজনপদ মগধকে কেন্দ্র করেই তাঁর কর্মকাণ্ড ব্যাপৃত হয়। বুদ্ধদেব কিন্তু তাঁর বাণীচয়ন করলেন সংস্কৃতে নয়, পালি ভাষাতে। পালি একটি প্রাকৃত ভাষা যা সম্ভবত খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সৃষ্টি হয়। কোনও কোনও ভাষাতাত্ত্বিকের মতে প্রাচীন কথ্যভাষা পৈশাচী থেকেই পালির জন্ম হয়েছিল সংস্কৃতের প্রভাবে। আবার কেউ কেউ মনে করেন পৈশাচী ভাষাই পালি ভাষা। সপ্তম শতাব্দীতে বৈয়াকরণ দণ্ডিণ পৈশাচী ভাষাকে বলেছিলেন ভূতভাষা অর্থাৎ মৃত ভাষা, যে ভাষায় আর কেউ কথা বলে না। এই আখ্যাকে মাথায় রাখলে পালি পৈশাচী থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল বলে মনে হয়। 

ঋকবেদের সূচনাকাল খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ বলেই ঐতিহাসিকদের অধিকাংশই একমত। আবার গৌতম বুদ্ধের জন্ম ৫৬৭ খ্রীষ্টপূর্বাদে। সংস্কৃত নয়, তিনি তাঁর বাণী প্রচার করলেন প্রাকৃত ভাষায় অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ভাষায়। বুদ্ধ ছিলেন চরম বেদবিরোধী, ব্রাহ্মণ্যসংস্কারের বিরোধী, এবং চরম নাস্তিক। সৎ চিন্তা, সৎ বাক্য ও সৎ আচরণের মাধ্যমে জীবনকে সত্যসম্পৃক্ত করে রাখাই ছিল তাঁর মৌলিক উপদেশ। স্বভাবতই বৈদিক ধ্যানধারণার চরম বিরোধী বুদ্ধ যে বৈদিক ভাষাকে পরিহার করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তাহলে তিনি যে প্রাকৃত ভাষায় মানুষের সঙ্গে কথা বললেন, তাঁর বাণী প্রচার করলেন, সেটি কি সংস্কৃতের গর্ভ থেকে সঞ্জাত হতে পারে? সাধারণ বোধবুদ্ধি বলে, না, তেমনটা না হওয়াটাই উচিৎ। তাহলে সেই প্রাকৃত ভাষা কোথা থেকে এল? আবার বুদ্ধের প্রায় সমসাময়িক মহাবীরের জন্ম ৫৯৯ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। বুদ্ধের জন্মের দু বছর আগেই তিনি গৃহত্যাগ করেন। মহাবীরও তাঁর বাণী প্রচার করেন প্রাকৃত ভাষাতেই। বুদ্ধ ও মহাবীর, দুজনেই বৈদিক যাগযজ্ঞের ও পশুবলির বিরোধী; অহিংসার প্রচারক। বৈদিক ধারণাকে যাঁরাই বিরোধিতা করতে গেলেন, তাঁরাই সংস্কৃতের পরিবর্তে লোকভাষাকে তাঁদের মাধ্যম করে নিলেন কেন?

ভারতের উত্তর পশ্চিমাংশে বিকশিত বৈদিক সভ্যতা ইতিমধ্যেই পূর্বদিকে আরো বিস্তৃত হয়েছে। এবং এই বিস্তারে ক্ষত্রিয় অর্থাৎ যোদ্ধাদের ভূমিকাই ছিল সবথেকে প্রধান। কিন্তু আর্য সংস্কৃতি ও ধর্মচেতনার আধার ছিল ব্রাহ্মণরা। স্বভাবতই নতুন অধিকৃত অঞ্চলে তারাই ছিল প্রাধান্যজনক অবস্থানে। ইতিমধ্যে কৃষিভিত্তিক বৈদিক সভ্যতা নগর সভ্যতার রূপ নিতে আরম্ভ করেছে। এইসব নগরের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে কোনও কোনও নগরের ক্ষমতা বাড়তে থাকে এবং সেগুলো ছোট ছোট রাজ্যের ভ্রূণ হয়ে ওঠে। এদের বলা হয় মহাজনপদ। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতেই মগধ,কোশল, কুরু, পাঞ্চাল, মল্লসহ ষোলটি মহাজনপদ যে প্রধান হয়ে ওঠে, তার উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে মল্ল বাদে বাকিগুলো ছিল রাজতন্ত্র। মহাবীর ছিলেন বৈশালীর লিচ্ছবী প্রজাতন্ত্রের সন্তান। আবার বুদ্ধের পিতা শুদ্ধোদন কপিলাবস্তুর রাজা হলেও ষোড়শ মহাজনপদের তালিকায় সেই রাজ্যের নাম পাওয়া যায় না। কাজেই বুঝে নিতে কষ্ট হয় না যে আর্য আগ্রাসণ ও ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় আধিপত্য নিয়ে চিন্তিত হবার কারণ তাঁদের ছিল।

নগর সভ্যতা গড়ে তুলতে শুধু যোদ্ধা ও পণ্ডিত থাকলেই হয় না, বণিক ও কারিগর প্রয়োজন। এই কারিগররাই ছিলেন তদানীন্তন সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই এঁরা যে এইসব জনপদের আদি অধিবাসী ছিলেন, এমনটা বুঝে নিতে কষ্ট হয় না। এঁদের ভাষা নিশ্চিতভাবেই সংস্কৃত ছিল না। কিন্তু বিজয়ী আর্যদের সামাজিক ও সামরিক প্রভাবে তাঁদের ভাষার উপর সংস্কৃতের প্রভাব পড়তে বাধ্য ছিল। বিপরীতটাও অবশ্যই সত্য। এইভাবেই তদানীন্তন সমাজে আধিপত্যকারীর সংস্কৃত ভাষা এবং নিম্নবর্গের প্রাকৃত ভাষা – এই বিভাজন ঘটে যায়। আমরা আগেই পৈশাচী ভাষার নাম শুনেছি। পৈশাচী মানে পিশাচসুলভ অর্থাৎ যা কিছু মানুষের মতো নয়। বিজয়ী আর্য সংস্কৃতি যে পরাজিত আদি অধিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে এভাবেই অবজ্ঞা করবে, এটাই স্বাভাবিক। মহাবীর ও বুদ্ধদেব সম্ভবত প্রাকৃতকে অবলম্বন করেছিলেন অতিদ্রুত সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যাবার জন্য। পাশাপাশি ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় আধিপত্যের ভাষাকে খারিজ করে দিয়ে তাঁরা সেই সংস্কৃতিরও বিরোধিতা করতে চেয়েছিলেন। উভয়েই যাগযজ্ঞ ও পশুবলির বিরোধী ছিলেন, যা সরাসরি ব্রাহ্মণ্য আচরণকে আঘাত করেছিল। দুজনেই ছিলেন পরম অহিংসার পক্ষপাতী যা ক্ষত্রিয় যোদ্ধাদের স্বার্থের পরিপন্থী।

এইভাবে সেই আদি যুগেই ভাষা হয়ে উঠেছিল কর্তৃত্ব বা বিরোধিতার অস্ত্র। ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির আধার হলো বেদ, যা ছান্দস বা সংস্কৃতের আদি চেহারায় রচিত। সেই বেদ পাঠের অধিকার ব্রাহ্মণের একচেটিয়া। আর সেই একচেটিয়া অধিকারের সূত্রেই তারা সমাজের শীর্ষস্থানীয়। ক্ষত্রিয়রাও তাদের পৃষ্ঠপোষক। উল্টোদিকে সাধারণ মানুষের ভাষাকে তারা অবজ্ঞা করে, ভূতপ্রেতের ভাষা বলে অপমান করে। আর এইভাবেই প্রতিনিয়ত প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে মানুষ হিসাবে তারা অনেক উন্নত। কাজেই তাদের অধীনস্থ হয়ে থাকাটাই সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক নিয়তি। মহাবীর বা বুদ্ধদেব যখন প্রাকৃতে তাদের উপদেশ দিলেন, তাঁরা এটাই প্রমাণ করতে চাইলেন, অনন্ত জ্ঞান এই ভাষাতেও আলোচনা করা সম্ভব। অর্থাৎ বেদের ভাষা আয়ত্ত না করেও জীবনের মৌলিক সমস্ত প্রশ্ন নিয়ে গভীর আলোচনা করা যায়। এক্ষেত্রে প্রাকৃত ভাষা হয়ে উঠল বৈদিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ অস্ত্র।

বৌদ্ধধর্মের যাবতীয় আদিগ্রন্থ রচিত হয়েছিল পালি ভাষায়। বুদ্ধের প্রায় তিনশো বছর পরে সম্রাট অশোকের জন্ম। বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার পর অশোক যে সব শিলালিপি স্থাপন করেন, তার ভাষা মূলত পালি। আদি জৈন গ্রন্থগুলোর তুলনায় পালি ভাষার উপর সংস্কৃতের প্রভাব অনেক স্পষ্ট। মাঝের তিনশো বছরে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় জোটের ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে; মগধে স্থাপিত হয়েছে নন্দ বংশের সাম্রাজ্য। স্বভাবতই রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় সংস্কৃতের প্রভাব জনজীবনে পড়তে বাধ্য। নন্দ বংশের রাজত্বের শেষভাগে আলেকসান্দার ভারত আক্রমণ করেন। গ্রীক বাহিনীর একটি অংশ ভারতের উত্তর পশ্চিমাংশে স্থায়ীভাবেই বসবাস শুরু করেন। এই অঞ্চলে ব্যবিলনের অ্যারামেইক ভাষার প্রচলন ছিল। কান্দাহার বা তারো পশ্চিমের অশোকের শিলালিপির ভাষা তাই হয়ে গেল গ্রীক ও অ্যারামেইক। এখানেও অশোকের তাগিদ ছিল যাতে বেশিসংখ্যক সাধারণ মানুষ তাঁর বক্তব্য বুঝতে পারেন। গুপ্তযুগের তীব্র ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির প্রভাবে বৌদ্ধধর্ম মূল ভূখণ্ড থেকে অনেকটাই প্রান্তের দিকে সরে যেতে বাধ্য হয়। জৈনধর্মও সংকুচিত হয়ে যায় একটা গোষ্ঠীর মধ্যে। স্বভাবতই প্রচারের বা রচনার ভাষা হিসাবে ভারতে পালি ভাষার গুরুত্ব হ্রাস পায়। যেহেতু তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম পৃষ্ঠপোষকতা পায়, তাই পালি ভাষায় গ্রন্থ রচনা এখানে অব্যাহত থাকে। কিন্তু জৈনধর্মে সংস্কৃতে রচনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। হর্ষবর্ধন ধর্মে বৌদ্ধ হলেও কাব্য রচনা করলেন সংস্কৃতে। 

প্রাকৃত শব্দের অর্থ হলো প্রকৃতি অর্থাৎ মূল থেকে উৎপন্ন। এই নাম থেকেই বোঝা যায় প্রাকৃত ভাষা আসলে তৃণমূলস্তরের মানুষদের ভাষা বা দেশজ ভাষা। কিন্তু আর্য ও অনার্যদের পারষ্পরিক সংস্পর্শে উভয়ের ভাষাই প্রভাবিত হয়েছিল। আর্যদের আদি ভাষার সংস্কার সাধন করে সংস্কৃত ভাষার সৃষ্টির মধ্যে এই প্রেক্ষাপটই উঠে আসে। নিজস্ব ভাষা যাতে আর বিকৃত না হয়, জটিল নিয়মের বাঁধনে তাই তাকে বেঁধে ফেলা হয়। সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম না জেনে সেই ভাষায় বাক্যালাপ করা আর সম্ভব ছিল না। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে চতুর্থ অব্দের মধ্যে পাণিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ী রচনা করেন। প্রায় চার হাজার স্তোত্র সম্বলিত এই বইটি না পড়ে সংস্কৃতে লেখা বা কথা বলা আর সম্ভব ছিল না। আবার পাণিনির স্তোত্রগুলোও এমন সমস্ত অলঙ্কারের মাধ্যমে লিখিত হয়েছিল যে ছাত্রের উপযোগী করে সেগুলোকে ব্যাখ্যা করতে হতো। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীর একের পর এক ভাষ্য বা ব্যাখ্যা রচিত হতে শুরু করলো। এদের মধ্যে সম্ভবত দ্বিতীয় খ্রীষ্টপূর্বাব্দে রচিত পতঞ্জলির মহাভাষ্য সবথেকে প্রামাণিক বলে স্বীকৃতি পায়।

বোঝাই যাচ্ছে এমন জটিল ও বিপুল শাস্ত্রের পাঠ নেওয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এমনিতেই বেদের পাঠ নেবার অধিকার ছিল শুধু ব্রাহ্মণদের। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা আনুসঙ্গিক শিক্ষা পেলেও অন্ত্যজদের তেমন কোনও সুযোগ বা অধিকার ছিল না। স্বভাবতই উচ্চ শ্রেণীর ভাষা হয়ে গেল সংস্কৃত আর নিম্নশ্রেণীর জন্য পড়ে রইল দেশজ ভাষা। আবার সংস্কৃতর মাধ্যমেই বেদানুশীলন করতে হতো। স্বভাবতই সংস্কৃত হয়ে গেল ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ভাষা। এই ভাষায় অধিকার মানেই উন্নতির সোপানের কাছে পৌঁছে যাওয়া। কিন্তু এই প্রক্রিয়া আদৌ সরল বা একপাক্ষিক প্রক্রিয়া ছিল না। ভারতে আগমনের পর থেকে আর্যরা যেমন আদি অধিবাসীদের ক্রমাগত বিধ্বস্ত করে নিজেদের অধিকার প্রসারিত করছিল, তেমনি একইসাথে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় তাদের সংস্পর্শেও আসছিল। ফলে বৈদিক ভাষার প্রভাব যেমন দেশজ ভাষার উপর পড়ছিল, তেমনি দেশজ ভাষার শব্দও চলে আসছিল বৈদিক ভাষায়। একটা উদাহরণেই বিষয়টা বোঝা যাবে। উত্তর বৈদিক সাহিত্যে চাল অর্থে ব্রীহি শব্দ ব্যাপক প্রচলিত হলেও ঋকবেদে তার উল্লেখ নেই। বরং চালের পিঠে অর্থে পুরলস শব্দ পাওয়া যায়। এই ব্রীহি শব্দটি হয় পরবর্তীকালে কোন কবির সৃষ্টি অথবা দেশজ ভাষা থেকেই চলে আসা।

এটা হওয়াটাই খুব স্বাভাবিক। দেশজ ভাষাতেও বৈদিক ভাষার শব্দ একইভাবে চলে এল। বুদ্ধদেবের বাণীতে প্রাধান্য পেল মজ্ঝিমাপতিপদা। পতিপদা সংস্কৃতের প্রতিপদ বলে ধরা যায় অর্থাৎ পন্থা বা পথ। একইভাবে মজ্ঝিমা শব্দকে সংস্কৃত মধ্যম শব্দের বিকৃত রূপ বলেও ধরে নেওয়া হয়। বস্তুত উত্তর ভারতের বর্তমানের ভাষাতেও মধ্য অর্থে মাঝ, মাঝেলা, মেজো শব্দই বেশি প্রচলিত। ধ্য অর্থাৎ ধিয় উচ্চারণ কেন ঝ-উচ্চারণের চেহারা নিল, ব্যাখ্যা করা মুশকিল। যদি সমস্থানীয় বিকৃতির সম্ভাবনা ধরা যায়, তাহলে বধ্য শব্দ হওয়া উচিৎ ছিল বঝ বা বজ, কিংবা সাধ্য শব্দের চেহারা হতে পারতো সাঝ বা সাজো। কোনটাই হয়নি। বধ্য বা সাধ্য হয় অবিকৃতরূপেই ব্যবহার হয়েছে, অথবা আদৌ হয়নি। তাহলে কি এমনটা ধরে নেওয়া যায় যে দেশজ মাঝ শব্দটিই প্রাকৃত থেকে সংস্কৃতে চলে গেছে যথেষ্ট পরিবর্তিত হয়ে? এখানে আমরা জরথ্রুষ্টিয় অগ্নিপূজক ধর্মের দেবতা “আহুর মাজদা”র প্রসঙ্গ একবার টেনে আনতে পারি। ব্যবিলনীয় ভাষা ও বৈদিক ভাষায় হ আর স রূপান্তর যোগ্য। তাই বেদের সপ্তসিন্ধু জিন্দাবেস্তায় ছিল হেপ্তা হিন্দু, দাস ছিল দাহা কিংবা অসুর ছিল আহুর। আহুর মাজদা ছিলেন ব্যাবিলনের প্রধান দেবতা; কালক্রমে পারস্যের জরথ্রুষ্টিয় আর্যদেরও প্রধান দেবতা হয়ে ওঠেন।

পারস্যের আহুর মানে বৈদিক সভ্যতার অসুর। আবার বৈদিক সাহিত্যে অসুর নিন্দিত অপশক্তি হিসাবে। যাই হোক না কেন, আহুর মাজদা যদি পারস্যের আর্যদের প্রধান দেবতা হন, তাহলে মাজদা শব্দের অর্থ নিশ্চিতভাবেই প্রধানসূচক। বৈদিক সাহিত্যে এর কাছাকাছি শব্দ হলো মহৎ যা প্রধান অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। মাজদা থেকে মধ্যবর্তী অর্থে মধ্য শব্দের উদ্ভব হলেও তার অর্থ প্রধানের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট থাকা উচিৎ। বর্তমান অর্থে শব্দটির ব্যবহার বৈদিক রীতির সঙ্গে মেলে না। বরং সেক্ষেত্রে দেশজ মাঝ বা মাজ শব্দটি কিঞ্চিৎ গ্রামভারী হয়ে মধ্যম চেহারায় সংস্কৃতে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে, এমনটা হওয়া বরং অনেক যৌক্তিক। আবার আঘাত ও আহত শব্দের সংস্কৃত ব্যুৎপত্তির হিসাবটাও একদমই মেলে না। দুটি শব্দই নাকি হন্ ধাতু থেকে উৎপন্ন। দুটিতেই আ উপসর্গ রয়েছে। তাহলে প্রথম শব্দে হ কেন ঘ হয়ে গেল, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। আঘাতের কাছাকাছি প্রচলিত শব্দ হলো ঘা বা ঘাও। তাহলে কি সেই দেশজ শব্দটাই সংস্কৃতায়িত হয়ে গেল পাণিনির সংস্কারে? মাথায় রাখতে হবে, মহাবীর, বুদ্ধদেব ও পাণিনি প্রায়-সমসাময়িক। তাই বুঝেই নেওয়া যায় প্রায় একই সময়ে দমনকারীর ভাষা ও অবদমিতের ভাষাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দুই প্রতিস্পর্ধী প্রয়াসের সূত্রপাত হয়।

সংস্কৃত বৈয়াকরণেরা মূলত চার ধরণের প্রাকৃতের উল্লেখ করেছেন – সৌরসেনী প্রাকৃত, মগধী প্রাকৃত, অর্ধমগধী প্রাকৃত ও মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত। মগধ মানে মূলত উত্তর ও মধ্য বিহার। এখানেই উত্তর বৈদিক যুগের সবথেকে বড় সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল নন্দ বংশের মাধ্যমে খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে। নন্দ বংশের রাজা ধননন্দকে হত্যা করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ৩২১ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মৌর্য সাম্রাজ্যের সূচনা করেন। সুঙ্গ বংশ হয়ে গুপ্ত সাম্রাজ্য পর্যন্ত মগধের সাম্রাজ্যসীমা ছিল বিশাল। সৌরসেন ছিল মথুরাকেন্দ্রিক মহাজনপদ। অর্ধমগধী প্রাকৃত সৌরসেন ও মগধের মধ্যবর্তী অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। আবার মহারাষ্ট্র অঞ্চল বলে কোন মহাজনপদের নাম পাওয়া যায় না। তবে সন্নিহিত মহাজনপদ ছিল রাজস্থানের মৎস্য। নিশ্চিতভাবেই এইসব অঞ্চলের আদি অধিবাসীদের মধ্যে পার্থক্য ছিল। স্বভাবতই সেই পার্থক্যই তাদের ভাষার মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছিল। প্রাকৃত ভাষার প্রথম নিদর্শন অবশ্যই সম্রাট অশোকের শিলালিপি, যা খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের রচনা। পরবর্তীকালে সিংহলেও প্রাকৃত সাহিত্যের নিদর্শন পাওয়া যায়, যদিও উত্তর ভারতীয় প্রাকৃতের থেকে তা বেশ খানিকটাই আলাদা। 

এই হিসাবে ভারতের পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃত হলো মগধী প্রাকৃত। পূর্ব ভারতের যাবতীয় প্রধান ভাষা, যেমন বিহারী, বাংলা, অসমীয়া, উড়িয়া ভাষাগুলো মগধী প্রাকৃত থেকেই জন্ম নিয়েছে বলে ভাষাতাত্ত্বিকরা মনে করেন। বিহারী ভাষা বলতে মৈথিল, ভোজপুরী, অঙ্গিকা বা ছ্যাছা, বজ্জিকা বা ছেনি ভাষাগুলিকে একত্রে বোঝায়। বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর নিজস্বতা অনুযায়ী একেকটি স্থানে ভাষার চেহারা একেকরকম হয়ে গেল। অবশ্য এমনটা ভাবারও কোন কারণ নেই যে মগধী বা অন্যান্য প্রাকৃত ভাষাগুলোর কোনও সুনির্দিষ্ট শব্দভাণ্ডার বা বিন্যাসপ্রণালী ছিল। বরং এমন একেকটি মৌলিক প্রাকৃত ভাষা আসলে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক রূপের বৈচিত্রের মধ্যে ন্যূনতম মৌলিকত্বের ভিত্তিতে একেকটি ভাষাগোষ্ঠী ছিল বলে ধরে নেওয়াটাই ঠিক হবে। বাংলা ভাষার জন্মসূত্র খুঁজতে গেলে এই অঞ্চলের ইতিহাসটাকেও স্মরণে রাখতে হবে। পরবর্তী পর্বে আমরা সেখান থেকেই শুরু করবো।

1 comments:

2

প্রবন্ধ - মলয় রায়চৌধুরী

Posted in


প্রবন্ধ


আমার পরমহংসত্ব : অপসামান্য দর্শনশক্তি
মলয় রায়চৌধুরী


অতিপ্রাকৃত, অলৌকিক, প্যারানরমাল, সুপারন্যাচারাল বলে সত্যিই কি কিছু হয়?

মালয়েশিয়ার জেনটিং হাইটসে যখন ভূতের আর দানবের থ্রিডি, মার্কিন ওয়েস্টার্নের ঘোড়সওয়ারদের ফোরডি ফিলম দেখছিলুম, তখন আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়া ভূতের বা দানবের হাত আর হাঁমুখ, ওয়েস্টার্ন ডুয়েলের গুলি থেকে বাঁচার জন্য নিজের শরীরকে বার-বার সরিয়ে নিচ্ছিলুম, ছিটিয়ে-দেয়া থুতু মুখের ওপর এসে পড়লে পুঁছে নিচ্ছিলুম, একথা জেনে যে সবই বিজ্ঞানের কারসাজি।

এক পলকের বোকামি, নিঃসন্দেহে। তার মানে যাকিছু ঘটে তা আমার বা অতিপ্রাকৃতে বা অলৌকিকে বিশ্বাসকারীর মগজে ঘটে, যা পি সি সরকার করে দেখাতেন আর দর্শকরা বিস্ময়ে অবাক হয়ে যেতো, জেনে যে ব্যাপারটা হাতের খেলা। সত্য সাইবাবা হাওয়ায় হাত বাড়িয়ে পি সি সরকার (জুনিয়রকে) এক চিমটি বিভূতি দিলে, পি সি সরকার (জুনিয় ) হাওয়া থেকে দুটো রসগোল্লা পেড়ে ওনাকে দিয়েছিলেন এবং বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, কেননা রসাক্ত জিনিসের ম্যাজিক সবাই দেখাতে পারে না। নিজেকে বোকা প্রতিপন্ন করার একটা ইচ্ছে আর অজানার আশঙ্কা মানুষের মধ্যে কাজ করে, তাই সে ম্যাজিক দেখতে যায়, পোড়ো বাড়িতে ঢুকে ভূত দেখতে যায়, অন্ধকার জঙ্গলে অজানা কিছুর আশঙ্কায় গা ছমছম করে, পাড়ার মোড়ে শনির মন্দিরে প্রণাম করে অফিস যায়, চারিদিকে পক্স দেখা দিলে হাতে ডাব নিয়ে শেতলার পুজো করে, বিশ্বভারতীর ছাত্র পিএচডি পাবার আগে কঙ্কালিতলায় পাঁঠা বলি দেয়, কিংবা তারাপীঠে গিয়ে ইঁট বেঁধে আসে। মার্কসবাদী নেতা সুভাষ চক্রবর্তীও তারাপীঠে গিয়ে মানত করে এসেছিলেন, কিন্তু তাঁর অনিশ্বরবাদী দল জিততে পারেনি।

শৈশবে আমি যে পাড়ায় থাকতুম, পাটনার ইমলিতলায়, সেই পাড়ার অন্ত্যজ নিবাসীরা সকলেই অতিপ্রাকৃতে আর অলৌকিকে বিশ্বাস করতো, প্রত্যেকের বাড়ির সদর-দরোজার চৌকাঠের ওপরে কালো ঘোড়ার নাল উল্টো করে ঠোকা, যাতে কেউ না ‘কালা জাদু’ করে, বা বাড়ির লোকেদের বিপদআপদ হয়, আমাদের বাড়ির চৌকাঠেও অমন একটা নাল ঠোকা ছিল, তার কারণ বড়ো জেঠা, যদিও বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু অবিশ্বাস করতে ভয় পেতেন। দাদা সমীর রায়চৌধুরীর ‘টিনিদির হাত’ নামে একটা গল্প আছে, পাড়ার হুলাসচাচাকে নিয়ে, যিনি তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’ নিয়ে একটা খেলা খেলতেন, যে খেলছে তার ভবিষ্যৎ বলার জন্য, সেই খেলায় পাড়ার সকলেই অংশ নিত, বিশ্বাস করতো যে ব্যাপারটা রামের নির্দেশে ঘটছে, অতএব তা ভুল হতে পারে না, আর যদি ভুল হয়ও, তাহলে যে খেলছে সে খেলার সময়ে পবিত্র ছিল না।

পাড়ার কুলসুম আপার বাড়ির সকলে বিশ্বাস করতেন যে ফেরশতা সত্যিকারের। তিন রকমের ফেরেশতা হয়, বৃষ্টি আর খাবারের,বিশ্বপ্রলয়ের আর মৃত্যুর। এই বিষয়ে তর্ক করার যেটুকু পরিসর ছিল তাকে ওঁরা ব্যাখ্যা করতেন, তুই কাফের বলে দেখতে পাস না।

আমার ঠাকুমা নব্বুই বছর বয়স পর্যন্ত উত্তরপাড়ার বারো ঘর চার সিঁড়ির খণ্ডহরে একা থাকতেন, বিজলি বাতি ছিল না, কিন্তু কখনও অপসামান্যে বিশ্বাস করেননি। কিন্তু ওই খণ্ডহরের একটা ঘরে আমার খুড়তুতো বোন পুটি বরগা থেকে ঝুলে আত্মহত্যা করলে, ঠাকুমা মারা যাবার পর, সেই ঘর আর সংলগ্ন ঘর কেউ ভাড়া নিতে চাইতো না, বস্তুত সেই কারণেই ‘সাবর্ণ ভিলা’ খণ্ডহর ভেঙে আবাসন উঠেছে। প্রথম যারা ভাড়া নিয়েছিল তারা পূটির ভূত দেখতে পেয়েছিল, লালপাড় শাড়ি পরে চুল খুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

ইমলিতলার বাড়িতে আমার মেজদা অত্যন্ত কম বয়সে মারা যান। মেজদাকে এক বেশ্যার কাছ থেকে বড়োজেঠা দেড়শো টাকায় কিনেছিলেন, মেজদা নিজের জন্মরহস্য জানার পর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যান, আর তাঁকে বশ করার জন্যে বড়োজেঠিমার এক বান্ধবীর এনে দেয়া বশীকরণের বিভূতি ঘুগনির সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ানো হতো; শুকনো ধুতরোর গুঁড়ো মেশানো বিভূতির স্লো পয়জনে মারা যান মেজদা। বাবা ইমলিতলার বাড়ি ছেড়ে নিজে দরিয়াপুরে বাড়ি তৈরি করে আলাদা হয়ে যাবার পর, ইমলিতলায় একদিন রান্নার গ্যাসস্টোভ ফেটে বড়োজেঠিমা আগুনে পুড়ে যান আর কিছুকাল পরে মারা যান। কেউ সহজে ইমলিতলার বাড়ি ভাড়া নিত না, বলতো ওই বাড়িতে ভস্মাসুর বা ভস্মলোচন রাক্ষস থাকে, যারা ওই বাড়ি ভাড়া নেবে তারা জ্বলে পুড়ে মরে যাবে, মেজদার অভিশাপে। বিহারি দুঘর ভাড়াটে ছিল, তারা মেজদার সঙ্গে বড়োজেঠিমার অশরীরি ঝগড়া দেখে আর শুনে ভয়ে পরের দিনই উঠে গিয়েছিল। জেঠার নাতিরা, মানে বড়দি-ছোড়দির ছেলেরা, তাই বাড়িটা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়।

ইমলিতলা পাড়ায় জাদুটোনার অভিযোগে ঝগড়াঝাঁটি হতো আর ফয়সালার জন্য হুলাসচাচার শরণাপন্ন হতো অভিযুক্ত আর অভিযোগকারী। হুলাসচাচা উকিল ছিলেন আর ব্যাপারটা সামলে দিতেন, বা পাড়ায় রামজির পুজোর ব্যবস্থা করতেন। ডাইনির অভিযোগ এখনও ভারতের বিভিন্ন গ্রামে ওঠে, তার প্রকৃত কারণ ঈর্ষা, জমিদখল, জাতপাত, লিঙ্গবৈষম্য, প্রতিশোধস্পৃহা বা নারীঘটিত হয়। কিছু-কিছু উপজাতির মধ্যে প্রথাটা এখনও থেকে গেছে আর জানগুরুর নির্দেশে হত্যার ঘটনাও ঘটছে। আমাদের দেশে ডাক থেকে ডাকিনি শব্দটা এসেছে। ডাক হল শিবের অনুচর একজন পিশাচ আর ডাকিনি বা ডাইনি হল পিশাচিনী। শিবের পিশাচ কেমন করে উপজাতি সংস্কৃতিতে ঢুকে গেছে জানি না। ডাইনি অভিযোগ উঠলে অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে গণনৈতিক আতঙ্ক বা গণহিস্টিরিয়া দেখা দেয়। ২০০১ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ভারতে দুহাজার মানুষকে ডাইনি বা জাদুটোনা করার অভিযোগে হত্যা করা হয়েছে। গত বছর আসামে তেষট্টি বছরের এক বৃদ্ধাকে দেড়শো লোক গলা কেটে খুন করেছিল, কেননা স্থানীয় ওঝার মতে বৃদ্ধার কুদৃষ্টির কারণে গ্রামে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল।

অন্যান্য সংস্কৃতিতেও জাদুটোনা আর ডাইনির অভিযোগ উঠেছে। খৃষ্টপূর্ব আঠারো শতকে মিশর এবং ব্যবিলনে জাদুটোনা-ডাইনিবিদ্যা প্রতিরোধের জন্য হামুরাবি নামে একটা আইন ছিল। সেই আইন অনুযায়ী জাদুটোনাকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে অভিযোগকারী নদীতে গিয়ে স্নান করার সময়ে ডুবে গেলে জাদুটোনাকারীকে অভিযোগমুক্ত করা হতো আর অভিযোগকারীর সম্পত্তি সে পেতো। অভিযোগকারী ডুবে না গেলে, জাদুটোনাকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো আর তার সম্পত্তি অভিযোগকারী পেতো। বলা বাহুল্য যে এই আইনের ফলে জাদুটোনা আর ডাইনিবিদ্যার প্রসার কমে গিয়েছিল।

এখন ইসলামি দেশগুলোয় দেখা দিয়েছে ‘অবিশ্বাসী’ এবং ‘বিশ্বাসী’ কারা তা প্রমাণ করার জন্য খুনোখুনি, নারী ধর্ষণ, গণহত্যা, বোমায় উড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি। যারা হত্যা আর অত্যাচার চালাচ্ছে, ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব তারা নিজেরা নিজেদের দিয়েছে।

ইউরোপে প্রোটেস্ট্যাণ্ট এবং ক্যাথলিকদের মধ্যে তর্কাতর্কি ক্রমে পিশাচ পিশাচিনীর জাদুটোনা পর্যন্ত পৌঁছোয়, এবং এক পক্ষ আরেক পক্ষের অবিশ্বাসকারীকে পুড়িয়ে মারার ব্যবস্থা করে। প্রোটেস্ট্যাণ্টরা আরম্ভ করেছিল ‘রিফর্মেশান’ এবং তার বিরুদ্ধে ক্যাথলিকরা আরম্ভ করেছিল ‘কাউন্টার রিফর্মেশান’। প্রাচীন ইউরোপ এবং ঔপনিবেশিক আমেরিকায় প্রায় এক লক্ষ মানুষকে ডাইনিগিরি আর জাদুটোনার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। খৃষ্টধর্মের বিকৃতির কারণে গোপনে শয়তানের আরাধনা আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল, যারা ক্ষমতাবৃদ্ধির উদ্দেশে মানুষের মাংস খেতো। ইউরোপে ৭৮৫ সালে প্যাডেরবর্ন চার্চ ডাইনিবিদ্যা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তা সত্ত্বেও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ‘অবিশ্বাসীদের’ ফাঁসি দেওয়া হয়েছে বা পুড়িয়ে মারা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি মানুষের শাস্তি হয়েছে সেই দেশগুলোয় যাকে বলা হতো‘হোলি রোমান এমপায়ার’। সেকুলার নেশান স্টেটের ধারণার পর ডাইনিবিদ্যা আর জাদুটোনায় ইউরোপের মানুষ আর আগের মতন বিশ্বাস করে না; ধর্ম সম্পর্কে আগ্রহও সেকারণে কমে চলেছে।

অনেকে অলৌকিক আর অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করে, যে কারণে আমাদের দেশে একটি’ ইন্ডিয়ান প্যারানরমাল সোসাইটি’ আছে, যাদের কাজ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অলৌকিক ঘটনা ব্লগে বয়ান করা, আর তার ভিডিও দেখানো, যেমন ভূত, প্রেত, অশরীরী আত্মা, পুনর্জন্ম,মৃত্যুর পরও আবির্ভাব, মাথার পেছনে অথবা পুরো দেহ জুড়ে জ্যোতি, হাত বুলিয়ে রোগ সারানো, প্ল্যানচেটে মৃতকে ডেকে এনে কথা বলা,একদৃষ্টে তাকিয়ে লোহার রড বেঁকানো, মানুষের দেহে বিদ্যুৎপ্রবাহের উপস্থিতি, দেহের চৌম্বকক্ষমতার মাধ্যমে লোহার নানা বস্তুকে গায়ের দিকে টেনে নেওয়া, ইত্যাদি। ইউটিউবেও আছে অমন অলৌকিক ঘটনার ফিল্ম। সোনি কোম্পানি সাড়ে তিন হাজার টাকায় ডিজিটাল ভূতের কন্ঠস্বর রেকর্ডার বিক্রি করে, সাত হাজার নশো টাকায় বিক্রি করে ভূত শিকারের যন্ত্র। এতো দাম দিয়ে যারা কিনছে তারা ভূত-প্রেতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে বলেই কিনছে।

প্রশ্ন হলো, আমি কি নিজেকে অপসামান্য দর্শনশক্তিসম্পন্ন পরমহংস মনে করি যে বিশ্বাস করি না? বিশ্বাস করার মতন আমার মস্তিষ্ক গড়ে ওঠেনি; আমার সংবেদন অতীন্দ্রিয় নয়, যদিও শৈশবে বড়োজেঠিমা আমাদের তাঁর চারিপাশে বসিয়ে পৌরাণিক কাহিনি, পঞ্চতন্ত্র, ঠাকুমার ঝুলি, ইশপের গল্প, আরব্য রজনীর কাহিনি মিলিয়ে মিশিয়ে লন্ঠনের আলোয় শোনাতেন, দাদার অনুরোধে অনেকসময়ে লন্ঠন নিভিয়ে দেয়া হতো, কেননা দাদা বলত ‘আলোয় গল্পটা দেখতে পাবো না’। সেইন্ট জোসেফ’স কনভেন্টে সিসটার আইরিন শোনাতেন গালিভার্স ট্র্যাভেলস, অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের গল্প। স্কুল সংলগ্ন চার্চে প্রতি বৃহস্পতিবার ফাদার হিলম্যান শোনাতেন ওল্ড টেস্টামেন্টের ঘটনাবলী। ছোটোবেলা থেকেই জানতুম এগুলো বানানো গল্প, বাস্তব জগতের ঘটনা নয়।

গ্রামোন্নয়নের চাকরিতে ঢুকে হিমালয়ের তরাইতে একটা মরা বাঘিনীর পোস্টমর্টেমের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমার অধস্তন একজন ভেটেরিনারি অফিসারকে, জেলায় ভেটেরিনারি সার্জেন ছিল না বলে। জেলা কর্তৃপক্ষ ছালটা নিলেও বাঘের মাংস আর হাড় নেবার জন্য হিন্দু গ্রামবাসীদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল। তারা বিশ্বাস করতো বাঘের মাংস খেলে যৌনক্ষমতা বাড়ে। অনেকে নিয়েছিল রোদ্দুরে শুকিয়ে রেখে দেবার জন্য, মেয়ের বিয়েতে জামাইকে দেবার উদ্দেশে। বংশ পরম্পরায় এই বিশ্বাস চলে আসছে। ভেটেরিনারি ডাক্তারের তাতে বিশ্বাস নেই, তাঁর মতে বাঘের মাংসের কোনো বিশেষ গুণ নেই। আমিও একটুকরো রাঁধা মাংস খেয়েছিলুম; লোকে বলতো বোঁটকা গন্ধ হয়, আমি তা পাইনি, বয়স্ক পাঁঠার মাংসের মতন খেতে।

লোককথায়, গণসংস্কৃতিতে নানা ঘটনা আর গল্প পাওয়া যাবে যাকে বিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়নি। আমি দাবি করছি না যে আমি বিজ্ঞানের সবই বুঝি। অ্যাটমের ভেতরে বোমাটা কোথায় লুকিয়ে থাকে জানি না, মাধ্যাকর্ষণ ফুঁড়ে রকেট কীভাবে নির্দিষ্ট পথে যায় জানি না, আইনস্টাইনের ফরমুলা কয়েকবার পড়েও বুঝতে পারি না, শুক্রের সঙ্গে স্ত্রীডিম্বের মিলনে ভ্রুণ কোন রহস্যে তৈরি হয় জানি না। কিন্তু আমি কখনও ভূত, প্রেত, শাঁকচুন্নি, বহির্জগতের প্রাণী, ইউ এফ ও দেখিনি; রবীন্দ্রনাথ প্ল্যানচেট করেছিলেন জেনেও ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হয়েছিল। হিমালয়ের ইয়েতি, স্কটল্যাণ্ডের লক নেস, মার্কিন দেশের সাসকোয়াচ, লাতিন আমেরিকার চুপাকাব্রা দেখিনি। এগুলোকে মনে হয় গ্রিক কিংবদন্তির ইউনিকর্ন বা চিনা সংস্কৃতির ড্র্যাগনের মতন প্রাণী, যা ওইসব দেশের লোকেরা কখনও প্রত্যক্ষ করেনি।

ইউরোপের নানা দেশে ক্ষেত্রসমীক্ষা করে আলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতার ঘটনা সংগ্রহ করেছিলেন চার্লস ফোর্ট (১৮৭৪ - ১৯৩২) নামে এক লেখক, এবং তিনি সাতটি বইতে সেই গল্পগুলো অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ‘টেলিপোর্টেশান’ শব্দটির তিনি উদ্ভাবক, যে অনুমিত প্রক্রিয়ায় একটি বস্তু বা প্রাণী নিজের জায়গা থেকে না নড়েই আরেক জায়গায় পৌঁছে যায়; ‘পোলটারগেইস্ট’ ঘটনা, অর্থাৎ অদৃশ্য ভূত চিমটি কাটে, কামড়ে দ্যায়, পাশে এসে শুয়ে পড়ে, থাপ্পড় মারে, ঘরের জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলে দ্যায় --- বিজ্ঞানীরা একে বলেছেন মস্তিষ্কের বিভ্রম; আকাশ থেকে মাছ ব্যাঙ ছোটো কচ্ছপের বৃষ্টি --- বিজ্ঞানীরা বলেছেন সমুদ্রে জলস্তম্ভের সাথে এই প্রাণীরা আকাশের মেঘে উঠে যায় আর বৃষ্টির সঙ্গে পড়ে; আপনা থেকে যেখানে-সেখানে আগুন জ্বলে ওঠা --- বিজ্ঞানীরা বলেছেন এটা হয় মিথেন গ্যাস আর ফসফরাসের কারণে; জলের ওপরে হাঁটা, বিশেষ করে যাঁরা আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পন্ন --- বিজ্ঞানীরা বলেছেন এটা ম্যাজিকের চোখধাঁধানো ব্যাপার বা হিপনোটাইজ করার ব্যাপার; হাওয়ায় ওপরে উঠে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকা, বিশেষ করে যাঁরা সাধু বা সিদ্ধ --- বিজ্ঞানীরা ওই একই কারণ বলেছেন; ভুতে পাওয়া কিংবা কোনো মৃতের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে আচরণ করা, মৃগিরোগে মূর্চ্ছা যাওয়া --- বিজ্ঞানীরা বলেছেন এইসব অভিজ্ঞতা মানসিক ভারসাম্যে আচমকা রদবদলের কারণে হয়, স্কিৎসোফ্রেনিয়া অসুখের জন্য হয়, হিস্টিরিয়া রোগের জন্য হয়, এর জন্য মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন। চার্লস ফোর্টের সংগ্রহের ঘটনাগুলো বিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যাখ্যাযোগ্য নয়, বিজ্ঞানের সাহায্যে প্রমাণ করা যায়নি। অতিপ্রাকৃত নিয়ে বাণিজ্যও ভালো চলে, যেমন আমেরিকায় ‘প্যারানরম্যাল আন্ডারগ্রাউন্ড ম্যাগাজিন’ নামে একটি পত্রিকা আছে, যার বাৎসরিক গ্রাহকচাঁদা কুড়ি ডলার।

অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত ঘটনা প্রমাণের জন্য ১৯২২ সাল থেকে ‘সাইনটিফিক আমেরিকান’, ‘ইনডিপেন্ডেন্ট ইনভেস্টিগেশান গ্রুপ’ এবং‘জেমস আর এজুকেশানাল ফাউন্ডেশান’ যৌথভাবে আড়াই কোটি ডলারের পুরস্কার ঘোষণা করে রেখেছে। অনেকেই দাবি জানিয়ে পৌঁছেছে, কিন্তু প্রমাণ করতে পারেনি, ধরা পড়ে গেছে বৈজ্ঞানিক আর ম্যাজিশিয়ান সদস্যদের কাছে। টেরেন্স হাইনস তাঁর ‘সিউডোসায়েন্স অ্যাণ্ড প্যারানরম্যাল’ গ্রন্থে বলেছেন যে, মানুষ দুটি কারণে অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিকে বিশ্বাস করে। প্রথমটি হল, অজ্ঞতা বা মূর্খতা।দ্বিতীয়টি হল, তাদের মস্তিষ্কের বিকার সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল নয়, তারা সমালোচনামূলক চিন্তা করতে পারে না, এবং বহুক্ষেত্রে তাদের বুদ্ধিবৃত্তি নিচু স্তরের।

2 comments:

3

প্রবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in
প্রবন্ধ


বাংলার গান : বাঙালির গান৪র্থ ও শেষ পর্ব
লোকগান : শিকড়ের গান
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়




‘বাংলার গান : বাঙালির গান’ লেখাটির আগের তিনটি পর্বে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগের বিপণনের গান পর্যন্ত আলোচনা করেছি। কিন্তু লোক-জীবনের চলার ছন্দে যে গান, তাকে সেই আলোচনায় রাখিনি। আধুনিক যুগে বাংলা গান যখন বিনোদনের উপাচার হয়ে উঠলো, তখন তার পণ্যমূল্য স্থির হয়ে গেল। এর বাইরে যে গান, লোক-জীবনের চলার ছন্দই যার উৎস, বিনোদন বা পণ্যমূল্যের নিরিখে সে গানের বিচার হয় না। বাঙালির লোকগানকেই বুঝতে চেয়েছি এই পর্বে।

কৈশোরে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে পড়া আচার্য জগদীশচন্দ্রের ‘ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে’ রচনায় জগদীশচন্দ্র জানতে চেয়েছিলেন ‘নদী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ’? সেই অনুকরণে যদি জিজ্ঞাসা করি, ‘গান, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? জবাব পাওয়া যাবে - “সৃষ্টির আদিমতম কালখণ্ডে মানুষের কর্মকালীন ঐকতানই আমার উৎস”। যূথবদ্ধ মানুষের শ্রম আর স্বতঃস্ফূর্ততায়, প্রকৃতির নানান উপাদান আর তার সৃষ্টির বৈভবে, মানুষের এগিয়ে চলার ভঙ্গিমাতেই গানের জন্ম। এখনও তো ‘হেঁইও মারি হেঁইও’র সুর, ছাদ পেটানো শ্রমিকদের একতালে কোলাহল, কিংবা নলকূপ স্থাপনের সময় শ্রমিকদের তালবদ্ধ কোলাহল আমাদের পরিচিত সুর। যে ‘টপ্পা’ গান বাঙ্গালির কাব্য-সংগীতে বিশিষ্ট হয়ে আছে তার উৎপত্তি মরুভূমির উট চালকদের মুখ থেকে । জনহীন রুক্ষ-ঊষর মরুপ্রান্তর পেরনোর সময় তারা যে সম্মিলিত কোলাহল করতো তাইই ‘টপ্পা’।

· এইভাবে প্রকৃতির সৃষ্টির মধ্য থেকে, নদীর তরঙ্গ থেকে, ঝড়ের গর্জন থেকে, পাখির কলতান থেকে, মানুষ তার নিজের সুর সৃষ্টি করেছে।শিক্ষিত সমাজ লিখিত সাহিত্য সাধনার মধ্য দিয়ে তার সাহিত্যের রূপ-বৈচিত্রের প্রকাশ ঘটিয়েছে একথা যেমন সত্য, তেমনই নিরক্ষর গ্রামীণসমাজের মৌখিক সাহিত্য উৎসারিত হয়েছে লোকসঙ্গীত ধারার মধ্য দিয়ে যুগে যুগে। আধুনিক যুগের শিক্ষিত সমাজের পরিশীলিত গীতি-কাব্যেরবীজ সেই মৌখিক সাহিত্য-সঙ্গীত ধারার মধ্যেই রয়েছে। মানব-জীবনের, পল্লী-মানুষের যাপনের সব বৃত্তান্তই রয়েছে আমাদের লোকসঙ্গীতে।জগৎ সম্পর্কে তাদের ভাবনা, তাদের লোকাচার, অধ্যাত্ম ভাবনা, তাদের বিশ্বাস, সংস্কার এবং জীবনযুদ্ধ আর তার চলার ছন্দ, সব কিছুরই আশ্রয়তার গানে – আমাদের লোকসঙ্গীতে। জীবনের এমন কোন পর্যায় নেই যা আমাদের লোকসঙ্গীতে ধরা পড়েনি।

বাংলার লোকসঙ্গীত ধারাটি বৈচিত্রময়। কিছু একক কন্ঠে গীত আবার কিছু গান সমবেত কন্ঠে গীত হয়। বাউল, ভাটিয়ালি, দেহতত্বের গান, মুর্শিদি একক কন্ঠের গান, আবার গম্ভীরা, আলকাপ, কবিগান ভাদু, টুসু, সারিগান যূথবদ্ধভাবে গীত হয়। তেমনই কিছু গান আঞ্চলিক ও কিছু গান সর্বাঞ্চলীয়।

আধুনিক যুগে গানের পণ্যমূল্য বিচার করে বিনোদনের উপাচার হয়ে ওঠার পরে লোকসঙ্গীতের সুরের ঐশ্বর্য আত্মস্থ করে নিয়েছে এযুগের পরিশীলিত গায়ন শিল্পীরা। এমনই বহু পরিচিত কিছু লোক-সঙ্গীত ধারার গানের পরিচিতি দেওয়া যেতে পারে, যেমন ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাউল, ঝুমুর, গম্ভীরা, আলকাপ,ভাদু, সারিগান, টুসুগান। গ্রামোফোন রেকর্ড ও ক্যাসেট ব্যবস্থা চালু হবার পর, ব্যবসায়িক ভাবে এই সব লোকধারার গান মানুষের ঘরে ঘরে পৌছেছে।

লোকসঙ্গীত ধারায় ভাটিয়ালি সুরই প্রাচীনতম বলে মনে করা হয়, নদীমাতৃক বাংলায় ভাটিয়ালির সুরকে লোকগান ধারায় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপাও দেওয়া হয়।'ভাটিয়ালি' সঙ্গীত শাস্ত্রের একটি রাগিণীরও নাম। পণ্ডিত দীনেশচন্দ্র সেন তার ‘বৃহৎবঙ্গ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন … ‘এই সুর হিন্দি মনসামঙ্গলে বাঙ্গাল রাগ বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। ইহা আমাদের চিরপরিচিত ভাটিয়াল রাগ। এই সুর কোন প্রচলিত রাগ-রাগিনীর ধার ধারে না, উহা খাঁটি পল্লীহৃদয়ের সমস্ত করুণ রস নিংড়াইয়া লইয়া আত্মপ্রকাশ করিত। এই সুর পদ্মা, ধলেশ্বরী,ভৈরব, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি নদ-নদীর গর্ভে যিনি শুনিয়াছেন, তিনি বুঝিবেন এই নদীমাতৃক দেশের উহা নিজস্ব সুর’।নদীতে ভাটির স্রোতের সঙ্গে নৌকা ভাসিয়ে মাঝি-মাল্লারা যে গান করেন সেগুলোই ভাটিয়ালি গান। লোকসাহিত্য গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন‘ভাটিয়ালি' পূর্ববঙ্গের ঢাকা, ময়মনসিংহ এবং সিলেট ও ত্রিপুরার পশ্চিমাংশের অর্থাৎ ভাটি অঞ্চল নামে পরিচিত বিশেষ অঞ্চলের গান। '...একদিকে নদী কিংবা জলাভূমির বিস্তার আর এক দিক দিয়া উহার অলস মন্থর গতি, এই উভয়ের সহযোগেই ভাটিয়ালির উদ্ভব হইয়া থাকে; এই অবস্থার মধ্য দিয়াই মাঝি কর্মে যথার্থ অবসর লাভ করিতে পারে, এই অবসরের মুহূর্তই ভাটিয়ালির পক্ষে অনুকূল মুহূর্ত। সেই জন্য নদীর ভাটিতে নৌকা ছাড়িয়া দিয়া অলস বৈঠাটি এক হাতে স্থির ধরিয়া রাখিয়া মাঝি এই গান গাহে বলিয়াই ইহা ভাটিয়ালি গান”। ভাটিয়ালি গানের মুখ্য বিষয় প্রেম-বিরহ। এ ছাড়াও মাঝি-মাল্লাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা,ভালোবাসা, প্রকৃতি ও তাদের হতাশা-নৈরাশ্যের প্রতিচ্ছবিও উঠে আসে এই গানে । লৌকিক চেতনা ও আধ্যাত্মিক ভাবনা এই দুইই প্রতিফলিত হয় ভাটিয়ালি গানে। আশুতোষ ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন “অন্তরের সুগভীর ভাব ও সূক্ষ্মতম অনুভূতি প্রকাশ করিবার ভাটিয়ালির যে শক্তি,তাহা বাংলার আর কোন লোকসঙ্গীতে নাই। জীবন-দর্শনের সুগভীর বিষয়সমূহ অতি সহজেই ইহার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে...” ।(বাংলার লোক-সাহিত্য ২য় খণ্ড )।

ভাটিয়ালির মত সারিগানও আবহমান কালের কর্মকালীন গান বা শ্রমসঙ্গীত। ভাটিয়ালি্র মত মাঝি-মাল্লারা এ গান গায়, তবে ভাটিয়ালি যেমন এককের গান, সারি তেমন নয়। সারি যূথবদ্ধ শ্রমজীবির গান। মাঝি-মাল্লারা যূথবদ্ধভাবে নদীতে যাওয়ার সময় এ গান গায়। কর্মজীবি মানুষ দলবদ্ধভাবে ছাদ পেটানো,ফসল কাটা, ফসল তোলা, ক্ষেত নিড়ান, গাছ কাটা ইত্যাদি শ্রমনির্ভর কাজের সময় এ গান গায়। শ্রমজীবি মানুষের কাছে সারিগানের বিশেষ মূল্য রয়েছে। এই গানের মধ্যে তারা যেমন কর্মশক্তি ও উদ্যম অর্জন করে তেমনই কর্মের ক্লান্তিও দূর করে। সারি পূর্ব ও নিম্নবঙ্গের ভাটি অঞ্চলের গান। সিলেট,ময়মনসিংহ,পাবনা,রাজশাহী রংপুর,ফরিদপুর, দিনাজপুর,যশোর,খুলনা,বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চলেও সারিগান বিশেষ জনপ্রিয়। 

ভাটিয়ালির মত ‘ভাওয়াইয়া’ মাঝি-মাল্লাদের গান নয়। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার,পশ্চিম দিনাজপুর,অসমের গোয়ালপাড়া ও ধুবড়ি জেলার বিস্তীর্ণ জনপদে রাজবংশী ও কামরূপী ভাষায় গীত সঙ্গীতধারাই ভাওয়াইয়া নামে পরিচিত। হলকর্ষণরত চাষী, রাখাল বালক, মোষপালকদের কন্ঠে স্বতোৎসারিত গানই ভাওয়াইয়া সঙ্গীত।

ঝুমুর বাংলার রাঢ় অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন লোকসঙ্গীত ধারা। আদিবাসী লোকজীবন ঝুমুর গানের উৎস। চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’এ ঝুমুর গানের উল্লেখ পাওয়া যায় । নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আদিবাসী জনজাতির এই প্রাচীন কর্মসঙ্গীতধারা এখন শহুরে শিক্ষিত সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছেও লোকপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আদিবাসী সঙ্গীতধারা ঝুমুরের বিবর্তন প্রসঙ্গে আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর ‘বাঙ্গালার লোকসাহিত্য (২য় খণ্ড)’ গ্রন্থে আঞ্চলিক সঙ্গীত প্রসঙ্গে লিখেছেন“ছোটনাগপুর হইতে আরম্ভ করিয়া সমগ্র মধ্যভারত ব্যাপিয়া গুজরাট সীমান্ত পর্যন্ত যে আদিবাসী বসতি-সীমা তাহার সর্বত্র যে আদিবাসী সঙ্গীত প্রচলিত আছে তাহা সাধারণ ভাবে ঝুমুর নামে পরিচিত। ... ক্রমে বাংলাভাষার সান্নিধ্যে আসিয়া আদিবাসীর ঝুমুর বাংলাভাষায় রূপান্তরিত হইতে আরম্ভ করিয়াছে। ... ভাষার পরিবর্তন হইলেও আঙ্গিকের দিক হইতে তাহার কোন পরিবর্তন হয় নাই। ক্রমে বাঙ্গালির বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত এবং উচ্চতর সঙ্গীতের প্রভাব তাহার উপর বিস্তার লাভ করিবার ফলে তাহার রূপ, সুর ও ভাব পরিবর্তিত হইয়াছে”। লোক সংগীতের সাধারণ ধর্ম অনুসারে এই যুগের ঝুমুরে মানবিক আকুতিরই প্রাধান্য ঘটেছে এবং বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে সমাজভূমির জীবন সংগীতের গৌরব লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলাম সহ অনেক সঙ্গীত পরিচালকই ঝুমুর সঙ্গীতের সুর আত্তীকরণ করে অনেক গানের সুর রচনা করেছেন। ঝুমুর পালা-পার্বণেও গীত হয়, তেমনই ভাদু ও টুসুগানও পালা-পার্বণের গান।

ঝুমুরের মত ভাদু গানও বাংলার রাঢ় অঞ্চলের গান । ভাদুগান আদিবাসী জনজাতির বর্ষাকালীন সঙ্গীত। মানভূম অঞ্চল, বাঁকুড়া, পশ্চিম বর্ধমান ও বীরভূম পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভাদ্রমাস ব্যাপী ভাদু গান গীত হয়। প্রধাণত কুমারী মেয়েদের মধ্যেই এ গান সীমাবদ্ধ। ভাদু কুমারী মেয়েদের জীবনের গান, তাদের জীবন-স্বপ্ন এ গানের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। এ গানে ধর্মের কথা থাকে না, থাকে কুমারী জীবনের আশা-আকাঙ্খার কথা, তাদের অভিজ্ঞতা আর বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করার আগে সে সম্পর্কে তাদের আশা-আকাঙ্খার কথা। ভাদ্রমাসের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত প্রতি রাত্রে পরিবারের কুমারী মেয়েরা সমবেত হয়ে ভাদু গান গেয়ে থাকে। গানের পর গান মুখে মুখে বেঁধে ফেলে মেয়েরা। কোনও নিয়ম-শৃঙ্খলা থাকে না, থাকে কুমারী হৃদয়ের নানান টুকরো টুকরো স্বপ্ন।

ভাদুর পাশাপাশি টুসু যেন যমজ বোন। ভাদুর মত এটিও বাংলার রাঢ় অঞ্চলের গান। ভাদু কুমারী মেয়েদের বর্ষাকালীন পার্বণের গান আর টুসু শস্যোৎসবের গান । অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে ধান পাকার পর যখন কৃষকের ঘরে শস্য ওঠে, তখনই শুরু হয় টুসু পার্বণ। টুসুগানের সুর ভাদু গানের মতোই,কোনওকোনও অঞ্চলে সুরে সামান্য আঞ্চলিক ভিন্নতাও দেখা যায় । ভাদুগানের অবলম্বন কুমারী হৃদয়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর টুসুগানে প্রতিফলিত হয় সমগ্র সমাজের ছবি, এমনকি সমকালীন রাজনীতির কথাও উঠে আসে টুসু গানে।

বাংলার লোকসঙ্গীতে এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের দাবি করে মুর্শিদি গান। মুর্শিদি আধ্যাত্মিক লোকসঙ্গীত। সুফি সাধকদের দ্বারা এ গানের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। মুর্শিদ ভক্তের আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা বা পথপ্রদর্শক। হিন্দুর আধ্যাত্মিক যোগ সাধনায় গুরুর যে স্থান মুর্শিদ তেমনই, এমনই তাদের বিশ্বাস। দয়াল মুর্শিদের কাছে আত্মসমর্পণ ও তাঁর আশ্রয় কামনাই মুর্শিদি গানের ভাবতত্ব। তিনি জগৎ ও জীবনের মোহবন্ধনে আবদ্ধ ভক্তকে মুক্তির পথ দেখান । মুর্শিদি গানে তাই ভক্তহৃদয়ের আকুতির সুর প্রকাশ পায়। ভক্তের দুঃখ-বেদনার কথা, তার হৃদয়ের আর্তি ফুটে ওঠে মুর্শিদি গানে। দয়াল মুর্শিদের স্তুতি, ভক্তিভাব ও প্রেম ছাড়া এগানে অন্য কোনও জটিল তত্ব থাকে না। তবে মুর্শিদি গানে যে করুণ কান্নাভরা সুর (যা এ গানের বৈশিষ্ট্য) তার উৎস ভক্ত হৃদয়ের অক্ষমতা, অজ্ঞানতা ও অপ্রাপ্তির বেদনা।

বাংলা লোকগানের আর এক উল্লেখযোগ্য সঙ্গীত ধারা গম্ভীরা। মালদহ জেলার হিন্দু সমাজে গম্ভীরা গানের উৎপত্তি। পরে দেশ বিভাগের পরে অধুনাবাংলাদেশের রাজশাহি জেলার কয়েকটি অংশে মুসলমান সমাজের পৃষ্ঠপোষকতায় এ গান জনপ্রিয় হয় এবং তার আঙ্গিকে কিছু পরিবর্তন ঘটে। গম্ভীরা পরিবেশিত হয় গানের মধ্য দিয়ে।তবে এতে নাট্য উপাদানও থাকে।কৌতুক ও অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয় সমাজের নানা অসংগতি।গানে গানে রচিত হয় নানা-নাতির সংলাপ।নাতির সঙ্গে নাচে- গানে, রঙ্গে কৌতুকে নানা সমাজজীবনের গরমিল গুলির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন।

· বাংলার লোকগানের একটি বিশেষ ধারা ‘কবিগান’। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে প্রচলিত নানান সাঙ্গীতিক ধারার মিলনে কবি গানের জন্ম। এর নিজস্ব কোন সুর নেই।তরজা, পাঁচালি, কীর্তন, খেউড়, আখড়াই, হাফ আখড়াই, কৃষ্ণযাত্রা, টপ্পা প্রভৃতি গানের সুর অবলম্বন করে কবিগান রচনা করা হত মুখে মুখে। উনিশ শতকের শুরুতে যে নতুনবিত্তশালী বাবু শ্রেণীর উদ্ভব হয় তাদের বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে সেই সময় কবিগান ঐতিহাসিক তাৎপর্য লাভ করে। কবিয়াল হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন হরু ঠাকুর , ভোলা ময়রা,রাম বসু, নিতাই বৈরাগী, এন্টনি কবিয়াল প্রমুখ । উনিশ শতকের শেষ থেকেই কলকাতায় কবিগান গুরুত্ব হারাতে শুরু করে ঠিকই, কিন্তু বাংলার গ্রামাঞ্চলে বিশেষত পূর্ব বাংলারগ্রামাঞ্চলে কবিগানের লোকপ্রিয়তা অব্যাহত থাকে। উনিশ শতকের প্রখ্যাত কবিয়াল ছিলেন নিতাই সরকার, রমেশ শীল, শেখ গুমানি দেওয়ান প্রমুখ। লোকসাহিত্য গবেষকড.সুশীল কুমার দের মতে “এঁরা ছিলেন সমাজের নিচু তলার মানুষ। সমাজের নিচু তলার মানুষদের মধ্যেই ছিল এঁদের জন্ম ও বিচরণ। তাই এই সমাজের চিন্তাভাবনা অনুভূতিগুলিতাঁরা ভালই বুঝতেন। আধুনিক সাহিত্যকার সমাজের যে অংশকে অশিক্ষিত মনে করে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, সেই অংশে এঁদের জনপ্রিয়তা ছিল অবিসংবাদী”।

এইসব নানান ধারার কর্ম-সঙ্গীত ও পার্বণী গান বাংলার মৌখিক সাহিত্যের অনন্য সম্পদ যা আমাদের লোকসঙ্গীত ভাণ্ডারকে ঐশ্বর্যশালী করেছে। সংশয়াতীতভাবে বাংলার লোকসঙ্গীতে সেই ঐশ্বর্যের মধ্যমণি রূপে বিরাজ করছে ‘বাউল গান’। খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে কীর্তন গানের উদ্ভবের সমকালে বা তারও আগে বাউল সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। অবশ্য বাউলগান লোকপ্রিয় হয়ে ওঠে লালন শাহ বা লালন ফকিরের সৃষ্টিগুণে। ১৯ শতকের মাঝামাঝি হরিনাথ মজুমদার বা কাঙ্গাল হরিনাথও (১৮৩৩) এই গানের সার্থক প্রচারক ছিলেন। বাউল দর্শন মানবমুখী ও জীবন নির্ভর। বাউলদের সাধনবস্তু হল ‘মনের মানুষ’। মনের মানুষই পরম সত্য, আবার ব্যক্তিক প্রেমের আধার । বাউলদের মনের মানুষ আছে দেহসীমার মধ্যে, প্রেমের দ্বারা তার সঙ্গে সমন্বিত হতে হবে – এটাই বাউল দর্শনের মূল সত্য। বাউলগানে আছে ধর্মীয় ভেদাভেদহীন এক সার্বজনীনতা। রবীন্দ্রনাথই প্রথম বাউল সঙ্গীতকে শিক্ষিত অভিজাত মহলে তুলে ধরেন। ‘সঙ্গীতচিন্তা’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগ-রাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিলন ঘটেছে। ...লোকসাহিত্যে এমন অপূর্বতা আর কোথাও পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করিনে”। শিলাইদহে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ বাউল গগন হরকরার কাছে বাউল গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁর কাছ থেকে বাউল গান সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছিলেন। শিলাইদহের এক গ্রামীণ ডাকঘরের হরকরা গগন দাস (জন্ম ১৮৪৫) কে লালনের গানই প্রাণিত করেছিল। বাউল সঙ্গীতধারার প্রতি রবীন্দ্রনাথ অনুরক্ত ছিলেন, তাঁর অনেক লেখায় লালনের উল্লেখ আছে। এখন বাউল গান বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্বের ৪৩টি বাক ও বিমূর্ত ঐতিহ্য চিহ্নিত করতে গিয়ে বিশ্ব সংস্থা ইউনেসকো বাংলার বাউল গানকে অসাধারণ সৃষ্টি বলে আখ্যা দিয়ে একে বিশ্ব সভ্যতার সম্পদ বলে ঘোষণা করেছে। বাউল গানকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’-এর তালিকাভুক্ত করে ইউনেসকো সদর দপ্তর ২০০৫ সালের ২৭ নভেম্বর এই স্বীকৃতি ঘোষণা করে।

লালন সঙ্গীত রচনা করেছিলেন প্রধানত বাউল সুরের আদর্শে, কিন্তু তিনি বাউল সাধক ছিলেন না। তাঁর সহস্রাধিক সঙ্গীতরচনা ‘লালন-গীতি’ নামে পরিচিত । লালন তাঁর গানে সমকালীন সমাজের নানান কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক বিভেদ ইত্যাদির কথা তুলে ধরেছেন।লালন তাঁর সমগ্র জীবনচর্যার মধ্য দিয়ে জাত-ধর্মের বিরুদ্ধে তীব্র জেহাদ বজায় রেখেছিলেন তাঁর গানে। লালন ছিলেন ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রামমোহন রায়ের সমসাময়িক। একই সময়ে দুজনের জন্ম। রামমোহনের আধুনিক চিন্তা আঘাত করেছিল সমাজের অন্ধত্ব, কু-প্রথা ও কুসংস্কারে।রামমোহন প্রজ্জ্বলিত আলোকবর্তিকা বাংলার নবজাগরণের সেই ঊষালগ্নে গ্রামীণ লোকচিত্তে কি আলোড়ন তুলেছিল তার কোনও লেখাজোখা নেই। লালনের বাউলগানে গ্রামীণ লোকচিত্তের আলোড়নের কিছু আভাস নিশ্চিতভাবেই পাওয়া যায়।

বিশ শতকের লোকগানের এক খ্যাতকীর্তি সঙ্গীতকার শাহ আবদুল করিম (জন্ম১৯১৬) লালনের দর্শনের আদর্শে প্রায় দেড় হাজার সঙ্গীত রচনা করেন। শাহ আবদুল করিম শুধু বাউল গানই রচনা করেননি, ভাটিয়ালি, দেহতত্ব, মারফতি, ধামাইল প্রভৃতি লোকধারার এবং অনেক গণচেতনার সঙ্গীতও রচনা করেন। একালের নবীন প্রজন্মের শিল্পীরাও শাহ আবদুল করিমের গান গেয়ে লোকপ্রিয়তা অর্জন করছেন।

উপসংহারে আবার রবীন্দ্রনাথের কথা “আত্ম প্রকাশের জন্য বাঙালি স্বভাবতই গানকে অত্যন্ত আপন করে চেয়েছে...গানকে ভালোবেসেছে বলেই সে গানকে আপন হাতে, আপন মনের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করতে চেয়েছে”। বিশ শতকের শুরুতে গ্রামোফোন বাহিত যে ধ্বনিবদ্ধ গান বাঙালির ঘরে ঘরে পৌছানো শুরু হয়েছিল, যার গালভরা নাম দিয়েছিলাম ‘আধুনিক বাংলা গান’, আজএকুশশতকের প্রথম দশকের শেষভাগে তার সব শক্তিরই ক্ষয় দেখছি । কিন্তু এই ক্ষয়ের মধ্যেও আশার আলোকরেখা দেখছি না এমন নয়। নবীন প্রজন্মের শিল্পীরা রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলান,অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তর গানের কাছে যাচ্ছেন, তাঁরা লালনের গান, শাহ আবদুল করিমের গান গাইছেন, প্রচার করছেন,লোকসঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। আমার বিশ্বাস নবীনকালের শিল্পী,সুরকাররা শিকড়ের কাছে ফিরতে চাইছেন। শিকড়ের কাছে – শিকড়ের গানের কাছে গানশোনা বাঙালিকে ফিরতেই হবে ।

3 comments:

0

বইঘর - চয়ন

Posted in


বইঘর


পুরাণ কোষ : নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী
চয়ন


পুরাণ কথার অর্থ পুরাতন। আবার পুরাণের অর্থ যা চিরন্তন : "পুনঃ পুনর্জায়মানা পুরাণী।" পুরাণ তাই পুরাতন হয়েও চিরনবীন। ভারতের আঠারোটি পুরাণে ধরা আছে তার কৃষ্টি -সংস্কৃতি, তার ঐতিহ্য, তার স্পন্দিত জীবন। শুধু পুরাণ কেন? স্মৃতি, সংহিতা, রামায়ণ ও বিশেষ করে মহাভারত যে প্রাণের চলচ্ছবিকে ধারণ করে রয়েছে তা চিরশাশ্বত। যে আলোকস্বপ্ন চেতনায় ধরে অন্ধকারের মধ্যে পথ কেটে কেটে এগিয়ে চলেছে সভ্যতা, সেই আলো উজলে ওঠে এই মহাগ্রন্থ গুলিতে। প্রাচীন ছাড়া নবীনের অস্তিত্বও নেই। 'কী ছিলাম' এর সঙ্গে তুলনা না করলে 'কী হইয়াছির' বোধ আসে না। এই তুলনা করব কী করে? শব্দের সাহায্যে। শব্দের ত্রিবিধ শক্তি : অভিধা, লক্ষণা ও ব্যঞ্জনা। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'শব্দকোষ' বলে: 'শব্দের যে শক্তিতে তাহার মুখ্যার্থ বা বাচ্যার্থ প্রতীত হয়, অর্থাৎ শব্দের উচ্চারণ মাত্রেই তাহার ...অনায়াসলভ্য সহজ মুখ্য অর্থের বোধ হয়, তাহা 'অভিধা' শক্তি। অর্থাৎ, অভিহিত করে, নাম ধরে ডেকে, আখ্যায়িত করে আমরা চিনে নিই আমাদের অতীত ও বর্তমানকে। তাই আমাদের প্রয়োজন এমন এক কোষগ্রন্থ যা পুরাণ বিধৃত জীবনকে কথনে ধরার সহায়ক হয়। খুব সহজ করে বলতে গেলে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ, মহাকাব্য, পুরাণ প্রভৃতিতে নানা বিষয়ের যে বিপুল সমাবেশ আমাদের দৈনন্দিন যাপনে আজও প্রাসঙ্গিক; যে জ্ঞানতত্ত্ব আমাদের আজও বড় প্রয়োজন; আমাদের সাহিত্যে যে পুরাণ অনুষঙ্গ ফিরে ফিরে আসে তাদের জানতে গেলে এমন একটি গ্রন্থ আমাদের নিতান্ত প্রয়োজন যেখানে দুমলাটের মধ্যে আমরা এদের প্রাথমিক পরিচয় লাভ করতে পারি। অভিহিত করতে পারি এদের। উদাহরণ হিসেবে পরশুরামের কচিসংসদে পুরাণোক্ত হৈহয় ক্ষত্রিয়দের উল্লেখ আমরা স্মরণ করতে পারি। কোথায় পাব এদের সন্ধান? অষ্টাদশ পুরাণের কোনটির মধ্যে? প্রাথমিক পরিচিতিই বা পাব কোথায়? এর সবকটির উত্তরই যদি একটি পৌরাণিক অভিধান বা পুরাণ কোষের মধ্যে পাওয়া যায় তবে তার মূল্য আমাদের কাছে কী হতে পারে তা অনুমান করার জন্য কোনও অলৌকিক মেধার প্রয়োজন নেই। 

এরকম গ্রন্থ আমাদের বাংলা ভাষায় যে নেই তা নয়। রয়েছে শশীভূষণ বিদ্যালঙ্কারের 'জীবনী কোষ' বা সুধীর চন্দ্র সরকার সংকলিত 'পৌরাণিক অভিধান'। তবে, সমস্যা একটাই। বর্তমানে প্রথম গ্রন্থটি নিঃশেষিত, কবে পুনঃমুদ্রিত হবে ঠিক নেই। আর দ্বিতীয়টিতে যথেষ্ট অযত্নের ছাপ। একটি উদাহরণই যথেষ্ট। হিন্দ্রলিনী নামটি গ্রন্থবদ্ধ করে তাঁকে ব্রহ্মর্ষি জাবালির পত্নী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সমস্ত রামায়ণ খুঁজেও এ নামের কোনও হদিশ মেলে না। সংকলক কোনও আকরগ্রন্থের নামও করেননি। আসলে তাঁর পক্ষেও কাজটি অসম্ভব ছিল। কারণ, এই নাম কোনও প্রাচীন গ্রন্থে নেই। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে দৌহিত্রী আশার সৃষ্টি করা এই নাম নিজের 'জাবালি' গল্পে ব্যবহার করেন পরশুরাম। আশা দেবীর পুত্র দীপংকর বসু জানাচ্ছেন : "মা সাত আট বছর বয়স থেকেই খাতায় গপ্প লিখতেন। সপ্তাহান্তে দাদুর কাছে গেলেই -- এবার কি লিখেছ পড় শুনি। এমনই একবার -- 'এক রাজা তার রাণী হিন্দ্রলিনী...' শুনেই দাদু চমকে উঠলেন -- ও নাম কোথায় পেলে? -- আমি বানিয়েছি...। চমৎকার হয়েছে; ও নাম কিন্তু আমি নেব। কিছুকালের মধ্যেই কোথাও অনুক্ত 'জাবালি-জায়া' এক বালিকা কল্পিত নাম আরোপণে হয়ে গেলেন 'হিন্দ্রলিনী।'" (দ্রষ্টব্য 'শশিশেখর -রাজশেখর যা দেখেছি যা শুনেছি' -- দীপংকর বসু; যা দেখেছি যা শুনেছি -- শশিশেখর বসু : মিত্র ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ) 

অতএব এমন কোনও কোষগ্রন্থ বড় প্রয়োজন যেখানে শুধু যে পুরাণ ও মহাকাব্যে উল্লিখিত অসংখ্য চরিত্র, স্থান ও বিবরণের উৎসমুখের সন্ধান মিলবে তাই নয়; বর্ণানুক্রমিকভাবে প্রসঙ্গ উল্লেখ সহ মৌল আকর গ্রন্থেরও খোঁজ আমরা সেখানে পাব। আমাদের সৌভাগ্য যে গতবছরের অগাস্ট মাস থেকে এরকম একটি গ্রন্থ আমরা হাতের কাছে পাচ্ছি। সাহিত্য সংসদ থেকে প্রকাশিত এই বইয়ের নাম 'পুরাণ কোষ : (মহাভারত - রামায়ণ - মুখ্য পুরাণ), প্রথম খণ্ড ( অ - ঔ)।' সম্পাদক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী। চার কিংবা পাঁচ খণ্ডে এই গ্রন্থ সম্পূর্ণ হবে। 

ঠিক কোনখানে এই গ্রন্থ পৃথক স্থান দাবী করে তা বোঝানোর জন্য আমি একটি তুলনামূলক উদাহরণ দিতে চাই। একই শব্দ এক পুরাণ বিষয়ক অভিধান এবং 'পুরাণ কোষে' কিভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তা আপনারা নিজেরাই দেখে নিন

অংশ --- কশ্যপ মুনির পুত্র। অদিতির গর্ভে এঁর জন্ম। ইনি দ্বাদশ আদিত্যের অন্যতম। আদিত্যরা চাক্ষুষ মন্বন্তরে তুষিত নামে খ্যাত ছিলেন, পরে বৈবস্বত মন্বন্তরে আদিত্য নামে খ্যাত হন। (বিষ্ণুপুরাণ) 

******************************************************************************************************* 

অংশ(১) ঋগবেদে আদিত্যদের উদ্দেশ্যে আহুতি দেওয়ার সময় আদিত্যগণের একতম হিসেবে অংশ -এর নাম করা হয়েছে -- ইমা গির আদিত্যেভ্যো ঘৃতস্নুঃ শৃণোতু মিত্রো অর্যমা ভগো ন স্তুবিজাতো বরুণো দক্ষো অংশঃ। [ঋগবেদ ২.২৭.১]

# বিবস্বান সূর্যের মুখরাগ থেকে বিচ্যুত হয়ে দ্বাদশ আদিত্যের সৃষ্টি হয় -- মুখরাগং তু যৎ পূর্বং মার্তণ্ডস্য মুখচ্যুতম।

অংশ এই দ্বাদশ আদিত্যের মধ্যে অন্যতম। [দ্র. আদিত্য] [ হরিবংশ পু. ১.৯. ৪৬ --৪৭]

# সৃষ্টির আদিতে জয় নামে যে দ্বাদশ দেবতা ব্রহ্মার দ্বারা অভিশপ্ত হন, এবং প্রতি মন্বন্তরে দ্বাদশ দেবতা রূপে জন্মগ্রহণ করেন তাঁরাই বৈবস্বত মনুর সময়ে কশ্যপ প্রজাপতির পত্নী অদিতির গর্ভে প্রবেশ করে দ্বাদশ আদিত্য নামে জন্মগ্রহণ করেন বলে পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। অংশ এই আদিত্যদের মধ্যে অন্যতম। [বিষ্ণু পু.১.১৫.১২৭ --১৩৩; বায়ু পু.৬৬.৬৬]

# দ্বাদশ আদিত্যের নামের যে তালিকা পুরাণে পাওয়া যায়, মহাভারতে প্রাপ্ত তালিকা তার থেকে কিছু ভিন্ন হলেও মহাভারতেও দ্বাদশ আদিত্যের নামের তালিকায় আমরা অংশকে পাই -- ভগোংশশ্চার্যমা চৈব মিত্রঃ। [মহা (k) ১২.২০৮.১৫; (হরি) ১২.২০২.১৫]

# কৃষ্ণার্জুন খাণ্ডব বন দহন করতে উদ্যত হলে ইন্দ্র তাঁদের প্রতিরোধ করতে এলেন। উভয় পক্ষে যুদ্ধ বাধল। এই সময় ইন্দ্রের সহায়তার জন্য অংশও এসেছিলেন এবং লক্ষণীয়, তাঁর প্রিয় অস্ত্র ছিল 'শক্তি' (javelin) ---- অংশস্তু শক্তিং জগাহ [মহা (k) ১.২২৭.৩৫; (হরি) ১.২২০.৩৫]

# দেবসেনাপতি পদে স্কন্দ কার্তিকেয়ের অভিষেকের পর দ্রব্যসম্ভার নিয়ে অন্যান্য আদিত্যগণ এবং বিবস্বানের সঙ্গে অংশও এসেছিলেন -- পূষ্ণা ভগেনার্যম্না চ অংশেন চ বিবস্বতা। 

স্কন্দকে তিনি তাঁর পাঁচটি অনুচরও দান করেন, যাদের নাম পরিঘ, বট,ভীম, দহতি এবং দহন ----

পরিঘঞ্চ বটঞ্চৈব ভীমঞ্চ সুমহাবলম্।
দহতিং দহনঞ্চৈব প্রচণ্ডৌ বীর্যসম্মতৌ।।
অংশো'প্যনুচরান্ পঞ্চ দদৌ স্কন্দায় ধীমতে।। [মহা (k) ৯.৪৫.৫, ৩৪ - ৩৫; (হরি) ৯.৪২.৫, ৩৩]

# আধুনিক পণ্ডিতদের মতে অংশ সৌর কুলের দেবতা বা Solar diety এবং অংশ শব্দটি হয়তো অংশু (সূর্যকিরণ) শব্দের সমপ্রকৃতির। এই জন্য হয়তো পুরাণে সূর্যের রথে অগ্রহায়ণ মাসে অংশ নামে এক রাক্ষসকে অবস্থান করতে দেখা যায়। [ব্রহ্মাণ্ড পু. (মহর্ষি) ১.২৩.১৬; বিষ্ণু পু. ২.১০.১৮] 

অংশ (২) স্বরোচিষ মন্বন্তরে দেবতারা যেসব গণে বিভক্ত ছিলেন তুষিত তার মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি গণ। এই গণের অন্তর্ভুক্ত দেবতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অংশ। [ ব্রহ্মাণ্ড পু. (মহর্ষি) ১.৩৬.১১]। 


বলুন তো কেন এ বই আলাদা সে সম্বন্ধে আর কি একটি শব্দও ব্যবহারের প্রয়োজন আছে! শুধু একটি তথ্যের উল্লেখ করতে চাই। পুরাণ বিষয়ক অভিধানটির প্রথম শব্দটি হলো 'অংশ'। 'পুরাণকোষ'এর এটি দ্বিতীয় শব্দ। প্রথম শব্দটি হলো 'অ'! 


এই গ্রন্থের আরেকটি বিশেষত্ব স্বয়ং সম্পাদকের কথায় প্রকাশ করা যাক : '...পুরাণকোষ আসলে মহাভারত - রামায়ণ - পুরাণের কোষগ্রন্থ। আমাদের এই গ্রন্থের বিষয়ভুক্তির একটা নতুন তাৎপর্য আছে এখানে, বস্তুত আমাদের একটা গভীর বিশ্বাস হল এই যে, প্রাচীন নাম, প্রাচীন মুনি - ঋষির নাম, তাঁদের চরিত্র, রাজা - রাজড়াদের নাম, তাঁদের চরিত্র, প্রত্যেকটির দেশ - নাম, এমনকী ধর্ম, সত্য, বা পাপ- পুণ্যের মতো দার্শনিক শব্দরাশিরও একটা পূর্বোত্তর পরম্পরা আছে। ফলত আমাদের মনে হয়েছে যে, পৌরাণিক অনেক শব্দই বড়ো বেশি ঐতিহাসিক এবং তার মধ্যে অনেক সময়ই সামাজিক সময়ের বিবর্তন লুকিয়ে থাকে। আর সেটা যদি খুঁজে বার করতে পারা যায়, তাহলে রামায়ণ - মহাভারত - পুরাণ, এমনকী বেদ - ব্রাহ্মণেরও অন্তর্ভুক্তি আমাদের পুরাণকোষের বিষয়গুলিকে অন্য একটি মাত্রায় নিয়ে যাবে যা এখনও এই বঙ্গভাষায় লিখিত কোনো পুরাণ অভিধানের মধ্যে নেই।' (পুরাণকোষ, পৃ. উনিশ) আটশ চল্লিশ পাতার এই বিপুলায়তন গ্রন্থের প্রতিটি শব্দ সেই ভিন্ন মাত্রার দ্যোতক। পৃষ্ঠা সংখ্যা প্রসঙ্গে আরেকটি তথ্য না উল্লেখ করলেই নয়। প্রকৃতপক্ষে, পুরাণকোষ, প্রথম খণ্ডের শেষ শব্দ 'ঔষ্ণীক' স্থান পেয়েছে আটশ ষোল পাতায়। আর আটশ সতের থেকে আটশ চল্লিশ পাতায় রয়েছে মৌল ও আনুষঙ্গিক গ্রন্থপঞ্জীর তালিকা। এই তালিকা এক বিশেষ প্রাপ্তি। এই বইয়ের পথনির্দেশনায় গ্রন্থলোকে অবাধ ভ্রমণ করতে পারেন পাঠক, শিক্ষার্থী, গবেষক। 

এই গ্রন্থ আমাদের আলোকপথযাত্রী হতে সহায়তা করে। জ্ঞানের পরমজ্যোতি লাভের রাস্তা খুলে দেয়। আমরা সেই পথের দিকে এগোতে পারি যে পথের শেষে অবাধ, অবারিত আলোকবন্যা। আমরা ইচ্ছে করলেই পুরাণকোষে উল্লিখিত পুণ্যআকর গ্রন্থগুলির সাহায্যে সেই মহাজীবনের কুলে গিয়ে উঠতে পারি যেখানে পৌঁছয় অক্লান্ত, জ্ঞানসন্ধিৎসু, সংগ্রামী মানুষেরা। এই বইয়ের কাছে ঋণ স্বীকার করে ঋষি কুত্স আঙ্গিরসের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে পারি : 

উদ্ ঈর্ধ্বং জীবো অসুর্ ন আগাদ্ 
অপপ্রাগাত্ তম আ জ্যোতির্ এতি।
আরৈক পন্থাং যাতবে সূর্যায়
অগন্ম যত্র প্রতিরম্ভে - আয়ুঃ। 

ওঠ্ রে সবাই, এল আমাদের প্রাণ জীবন;
হটল আঁধার, এল এল এল আলো - প্লাবন,
সূর্যকে ছেড়ে দিল নিঃশেষে যাওয়ার পথ ----
আমরা গেলাম যেখানে আলোর উত্তরণ। (অনু. গৌরী ধর্মপাল) 



ঋণস্বীকার : 
১) শব্দকোষ -- হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
২) বেদের কবিতা -- গৌরী ধর্মপাল।

0 comments: