গল্প - দৃপ্ত বর্মন রায়
Posted in গল্প
গল্প
দায়
দৃপ্ত বর্মন রায়
১
ফ্রিজ থেকে দুপুরে রান্না হওয়া মাংসটা বের করে মাইক্রোওয়েভে ঢুকিয়ে গণেশ একবার উঁকি মেরে ড্রয়িং রুমের দেওয়াল ঘড়িটাতে সময় দেখে নিল। দশটা বাজতে তিন। এতক্ষণে তো দাদাবাবুর নীচে এসে যাবার কথা। প্রতিদিনই দাদাবাবু পৌনে দশটা নাগাদ নীচে চলে আসেন। কিছুক্ষণ টিভিতে খবর টবর দেখে দশটায় ডিনার করতে বসে যান। সাধারণত এই নিয়মের কোনও ব্যতিক্রম হয় না।
তবে আজকের কথা একটু আলাদা। সন্ধ্যায় যখন দাদাবাবু কাজ থেকে ফিরলেন, তখনই তাঁকে দেখে গণেশের মনে হয়েছিল ওঁর মেজাজটা আজ খুব একটা ভালো নেই। সবাইকে শুধুশুধু বকাবকি করলেন। তারপরে বললেন মদের বোতল আর গ্লাস দিয়ে যেতে। সেই থেকে হয়তো সমানে ড্রিঙ্ক করে যাচ্ছেন। তারপরে তো যা কাণ্ড হলো! প্রায় পনের বছর হয়ে গেল দাদাবাবুর এখানে কাজ করছে সে। কিন্তু কোনওদিনই দাদাবাবুকে এতটা রেগে যেতে দেখেনি। আজ হয়তো এসব কারণেই দাদাবাবুর দেরী হচ্ছে।
মাইক্রোওয়েভটার আওয়াজ শুনে আবার সম্বিত ফিরল গণেশের। মাংসটা বের করে ডাইনিং টেবিলে রাখতে এসে দেখল দশটা বেজে গেছে। রাখালের মা স্যালাড কাটছিল। গণেশ তাকে বলল, – দাও দিদি, আমি বাকিটা কেটে দিচ্ছি। তুমি বরং গিয়ে দাদাবাবুকে একবার ডাক দিয়ে এসো।
রাখালের মার আবার দোতলায় ওঠার ইচ্ছে ছিল না। বেজার মুখে বলল, – আবার ডাকতে হবে কেন, ও এমনিই এসে যাবে। ছাইপাঁশ গিলে রয়েছে এখন। আমি যেতে পারবনি। তুই যা।
গণেশ বলল, – তুমি যাও না। আমি এই ফাঁকে ডালটা গরম করে নিই।
রাখালের মা মাইক্রোওয়েভ চালাতে পারে না। কাজেই অনিচ্ছাসহকারে গেল ডাকতে। গণেশ ডালটা গরম করতে দিয়ে বাকী স্যালাড কাটতে শুরু করল।
হঠাৎ একটা তীব্র চিৎকার শুনে চমকে গিয়ে গণেশ আর একটু হলে নিজের আঙ্গুলটাই কেটে ফেলছিল। রাখালের মার গলা। কি হলো রে বাবা? দৌড়ে বেরল রান্নাঘর থেকে। দেখে নিজের ঘর থেকে কেশববাবুও চিৎকার শুনে বেরিয়ে এসেছে। ওপর থেকে এসেছে আওয়াজটা।একসাথে দুতিনটে করে সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলায় পৌঁছে দেখল দাদাবাবুর ঘরের দরজার সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে রাখালের মা।
তাকে ডিঙ্গিয়ে দাদাবাবুর ঘরের ভিতর ঢুকতেই একটা তীব্র মিষ্টি অথচ ঝাঁঝাল গন্ধে মাথাটা একটু টলে গেল গণেশের। কোনওভাবে নিজেকে সামলে সামনে তাকিয়ে যা দেখল তাতে তার বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল।
বিছানার ওপর দাদাবাবু চিত হয়ে শুয়ে আছে। গলার নলিটা কাটা, একেবারে হাঁ হয়ে রয়েছে। বিছানার সাদা চাদরটা চাপ চাপ রক্তে লাল হয়ে গেছে। সারাটা ঘর রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
অচিন্ত্য সরকার যে আর বেঁচে নেই সেটা বোঝার জন্যে কোনও ডাক্তারী ডিগ্রি থাকার দরকার নেই। খালি চোখে দেখেই বোঝা যাচ্ছে বহুক্ষণ হলো অচিন্ত্য মারা গেছে।
২
মর্নিং ওয়াক সেরে ফেরার সময় অনিকেত দেখলেন গেটের বাইরে একটা লাল রঙের টাটা ইন্ডিকা দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার মানে কেউ এসেছে দেখা করতে। একটু অবাকই হলেন তিনি। সবে সাড়ে সাতটা বাজে। এত সকালে আবার কে দেখা করতে এল?
দীর্ঘ ছত্রিশ বছর সিবিআই তথা সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনে দাপটের সাথে চাকরী করে সবে চার মাস আগে রিটায়ার করেছেন অনিকেত স্যান্যাল। জুনিয়র অফিসার হিসেবে জয়েন করে ধীরে ধীরে নিজের যোগ্যতায় উন্নতি করতে করতে অবসরের দেড় বছর আগে সিবিআই-এর ডিরেক্টর পদে প্রমোশন পেয়েছিলেন তিনি। অবসরের পর দিল্লী থেকে কলকাতায় ফিরে রিটায়ার্ড লাইফের বৈচিত্রহীন নিস্তরঙ্গ জীবনযাত্রায় এখনও সেইভাবে মানিয়ে উঠতে পারেননি। সেই সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃভ্রমণ, ফিরে এসে ব্রেকফাস্ট করে পত্রিকা পড়া, তারপরে চান সেরে কিছুক্ষণ টিভি দেখে দুপুরের খাওয়া, ভাতঘুম, আবার বিকেলে একটু ঘুরতে যাওয়া, ফিরে এসে আবার টিভি, ডিনার সেরে আবার ঘুমোতে যাওয়া – দিনগুলো যেন কাটতেই চায় না। একঘেয়ে জীবনটার প্রতি একরকম বিরক্তিই এসে গিয়েছিল তাঁর। এরকম অবস্থায় কেউ দেখা করতে এলে তাও কিছুটা সময় কাটে। তাই আগ্রহ সহকারে পা চালালেন তিনি।
ঘরে ঢুকে দেখলেন গৌতম এসেছে। সোফায় বসে আজকের পেপারটা নাড়াচাড়া করছে। তাকে দেখে মেজাজটা একটু খুশী হয়ে গেল অনিকেতের। এই ছেলেটাকে বেশ ভালো লাগে তাঁর। নিজের ছেলের মতই দেখেন। লালবাজারে হোমিসাইড স্কোয়াডের একজন সিনিয়র ইনস্পেক্টর গৌতম। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সেই কঠোর পরিশ্রম আর বুদ্ধির দৌলতে বেশ উন্নতি করে ফেলেছে। সৎ পুলিশ অফিসার হিসেবে অল্প বিস্তর নামডাকও হয়েছে। গৌতমের বাবাকেও এককালে চিনতেন তিনি। একই স্কুলে পড়তেন তাঁরা দুজন, যদিও ভিন্ন ক্লাসে। এখনও কাছাকাছিই থাকেন। বাজারে বা পাড়ার কোনও অনুষ্ঠানে দেখা সাক্ষাৎও হয়ে যায় কালে ভদ্রে।
তাঁকে ঘরে ঢুকতে দেখে গৌতম সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল। বলল, – গুড মর্নিং স্যার! কেমন আছেন?
– গুড মর্নিং! এই তো ফার্স্ট ক্লাস আছি। কিন্তু গৌতম, আমি তো তোমাকে অনেকবার বলেছি তুমি আমাকে স্যার নয়, জেঠু বলে ডাকবে। তুমি তো বাবলুরই বয়সী।
বাবলু অনিকেতের ছেলে। সে বেঙ্গালুরুতে চাকরী করে। বয়স গৌতমেরই মতো। গৌতমকে এত স্নেহ করার পিছনে এটাও একটা কারণ।
– ঠিক আছে, জেঠু। গৌতম হাসল।
– ভেরি গুড! যাই হোক এবার বলো তুমি কেমন আছ? বৌমা কেমন আছেন? বাবা মা ভালো আছেন তো?
– হ্যাঁ, আমরা সবাই ভালোই আছি।
– বলো এবার সাত সকালে কি মনে করে? দাঁড়াও, চা বলি। সোফায় বসে বললেন অনিকেত।
– চা এসে গেছে, ব্যস্ত হতে হবে না। ট্রে হাতে ঘরে ঢুকে বললেন দময়ন্তী, অনিকেতের অর্ধাঙ্গিনী। সপ্রশংস দৃষ্টিতে স্ত্রীকে দেখলেন অনিকেত। সত্যিই দময়ন্তীকে কিছু বলে দিতে হয় না। অনিকেতের মনের কথা ঠিক ম্যাজিকের মতো বুঝে যান তিনি। নয় নয় করে তেত্রিশটা বছর কেটে গেল বিয়ে হবার পর, অনিকেতকে কখনই কোনও জিনিসের অভাব বুঝতে দেননি দময়ন্তী। যখনই যে জিনিসটা চাই তাঁর, ঠিক হাতের কাছেই পেয়ে গেছেন। এমন স্ত্রী পাওয়াটা সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার।
টী–পট থেকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বললেন দময়ন্তী, – গৌতম অনেকদিন বাদে এসেছ। কোনও কথা শুনব না। ময়দা মাখতে বলে এসেছি। একেবারে ব্রেকফাস্ট করে তারপরে যাবে।
গৌতমের মৃদু আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে তার কাপে পরিমাণ মতো দুধ চিনি দিয়ে আর অনিকেতের জন্যে লিকার চা বানিয়ে দিয়ে দময়ন্তী বললেন, – নাও! এবার তোমরা কথা বলো। আমি গিয়ে লুচিগুলো ভাজতে শুরু করি।
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে গৌতম ইতস্তত করছে দেখে অনিকেত বললেন, – আমি বুঝতে পারছি তুমি কিছু একটা বলতে চাইছ, কিন্তু বলতে পারছ না। কি বলতে চাইছ, সেটাও হয়তো আন্দাজ করতে পারছি। কিন্তু আমি তোমার মুখ থেকেই শুনতে চাই। নাও চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলে ফেল, কি বলতে চাও।
একটু হেসে গৌতম বলল, – আপনি ঠিকই ধরেছেন, জেঠু। কথাটা কিভাবে আপনাকে বলব ভেবে পাচ্ছি না।
– ডোন্ট ওয়রি! মাই ডিয়ার বয়! নির্দ্বিধায় বলো।
গৌতম এবার একটু সহজ হলো, – আপনি নিশ্চয়ই পেপারে অচিন্ত্য সরকারের মৃত্যু সম্বন্ধে পড়েছেন। আমি সেই ব্যাপারে আপনার সাথে একটু কথা বলতে এসেছি।
– হুম্! তাহলে আমি ঠিকই গেস করেছিলাম। এত বড় একটা মার্ডার মিস্ট্রি যখন সব জায়গায় লোকের মুখে মুখে ঘুরছে, তখন লালবাজার হোমিসাইডের ডাকসাইটে অফিসার সাত সকালে এমনি এমনি জেঠুর সাথে কুশল বিনিময় করতে আসবে, এটা একটু অবাক করার মতো। তাই নয় কি? অনিকেত মিটিমিটি হাসলেন, – তবে আমি আগে থেকে কিছু বলতে চাইনি, কেন জান? গোয়েন্দার কাছে কেউ দেখা করতে এলে সে নিজে থেকে শার্লক হোমসের মতো সব বলে দেবে, এই ব্যাপারটা না একদম ক্লিশে হয়ে গেছে। ঠিক কি না, বলো?
তাঁর কথা বলার ধরণে গৌতমের মুখেও হাসি ফুটল, – আমিও বুঝেছিলাম আপনি আন্দাজ করে ফেলেছেন।
– যাই হোক। হ্যাঁ আমি পড়েছি খবরটা। কিন্তু পেপারে যে পড়লাম পুলিশ অলরেডি কাকে জানি গ্রেপ্তার করেছে।
– হ্যাঁ। অচিন্ত্য সরকারের ছেলে সৈকতকে বাবাকে হত্যার দায়ে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। আর এই জন্যেই আমি আপনার কাছে এসেছি, জেঠু।
অনিকেতের ভুরুতে ঈষৎ ভাঁজ পড়ল। – কেন? তুমি কি মনে করো সে খুনটা করেনি?
– হ্যাঁ, জেঠু। আমি মনে করি সে খুনটা করেনি। গৌতমের গলায় দৃঢ়তা, – ওর শিক্ষা, স্বভাব, চরিত্র এসব সম্বন্ধে জানলে আপনিও মেনে নিতে পারতেন না যে সে খুন করছে। আমি ছেলেটাকে পার্সোনালি চিনি। আমার এক মামাতো ভাই ওর ক্লাসমেট ছিল যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে। ওর কাছে শুনেছি যে সৈকত নাকি খুব ভালো কবিতাও লেখে। আপনিই বলুন জেঠু, যে ছেলে কবিতা লেখে, সে কি খুন করতে পারে?
– গৌতম, একথা ভুললে কিন্তু চলবে না যে তোমার আমার প্রোফেশনে কিন্তু ইমোশনের কোনও জায়গা নেই। অনিকেত বোঝাতে চাইলেন, – আমি আমার চাকরী জীবনে অনেক ভালো ভালো কবির সাথে পরিচিত হয়েছি যারা সন্ত্রাসবাদের মতো ঘৃণিত কাজের সাথেও যুক্ত।
– সে আমি জানি জেঠু! কিন্তু তাও আমার সিক্সথ সেন্স বলছে যে আমরা ভুল করছি।
– ছেলেটা কি বলছে?
– আরে, সেটাই তো মুশকিল হয়েছে। ছেলেটা মুখই খুলছে না। সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ ওর বিরুদ্ধে। এমনকি খুনটা যে ঘরে হয়েছে সেই ঘরে ওর লাইটার পাওয়া গেছে, সেটাতে ওর হাতের ছাপ স্পষ্ট। এত কিছু সত্বেও ও কিছুতেই সব কথা খুলে বলছে না। ওর বয়স কম। তাছাড়া ওর অ্যাকাডেমিক রেকর্ড বিচার করে এখনও ওকে থার্ড ডিগ্রি দেওয়া হচ্ছে না। একবার সেটা শুরু হয়ে গেলে ও আর সহ্য করতে পারবেনা। খুনটা না করলেও দোষ স্বীকার করে নিতে বাধ্য হবে। আমি সেটা চাইছি না।
– তুমি তাহলে কি চাইছ? প্রশ্ন করলেন অনিকেত।
– আমি চাইছি আপনি যদি এই কেসটাতে আনঅফিসিয়ালি আমাকে একটু গাইড করেন। কাতর আবেদন গৌতমের।
ভিতরে ভিতরে খুশী হলেও অনিকেত বাইরে সেটা প্রকাশ করলেন না। গলায় একটা মেকি চিন্তার ছাপ ফেলে বললেন, – কিন্তু আমি তো রিটায়ার করেছি। তাছাড়া এটা কলকাতা পুলিশের জুরিসডিকশনে পড়ে...
– ও নিয়ে আপনি একদম ভাববেন না জেঠু। আমি সব সামলে নেব। অনিকেতকে কথা শেষ করতে দিল না গৌতম। – আপনি এই কেসে একেবারে স্বাধীনভাবে তদন্ত করবেন। আপনার যা দরকার হবে, ফোর্স বা ইনফর্মেশন, সব আপনি আমাকে বলবেন। আমি যথাসাধ্য সাহায্য করব। আমি খালি চাইছি আপনি আপনার এক্সপার্টাইজ কাজে লাগিয়ে একবার তদন্ত করে দেখুন যে আমরা ভুল করছি না ঠিক। আমি চাইনা পুলিশের রুটিন ইনভেস্টিগেশনের জন্যে কোনও নিরপরাধ ব্যক্তি শাস্তি পাক।
– কিন্তু তোমার ডিপার্টমেন্ট কি মেনে নেবে, আমার মতো একজন আউটসাইডার...
আবার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল গৌতম, – আপনি যে এই কেসে তদন্ত করছেন, সেটা আমি ওপর মহলে জানাব না। আপনি তদন্ত করে সত্যিটা বের করলে আমি অ্যাকশন নেব। কোনও অসুবিধা হবে না।
হায় রে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট! তোরা আর বদলালি না। তদন্ত করে অপরাধীকে সনাক্ত করে দেব আমি, আর তোরা তাকে অ্যারেস্ট করে ফিতে কাটবি। মনে মনে ভাবলেও মুখে এসব প্রকাশ করলেন না অনিকেত। গৌতমকে তিনি ছোট থেকে চেনেন। সে হয়তো সরল মনেই কথাগুলো বলছে। তাছাড়া তিনি ভিতর ভিতর দারুণ উত্তেজিতও। অনেকদিন বাদে একটা কিছু করার সুযোগ এসেছে। নিজের কর্মজীবনে অনেক ধরণের কেসের তদন্ত করেছেন তিনি। করাপশন, টেররিজম এবং আরও অনেক রকম। ডিরেক্টর থাকাকালীন বেশ কিছু হাইপ্রোফাইল মার্ডার কেসেরও নিয়মিত আপডেট আসত তাঁর টেবিলে। কিন্তু সরাসরি হোমিসাইড বা খুনের তদন্ত করার ইচ্ছে থাকলেও কোনওদিন সেই সুযোগ তাঁর হয়নি। ছোটবেলা থেকেই ডিটেকটিভ গল্পের পোকা ছিলেন তিনি। হোমস, পোয়্যরো থেকে শুরু করে ব্যোমকেশ, ফেলুদা সবই তাঁর গুলে খাওয়া। তাই তাঁর বিশ্বাস তিনি পারবেন। ডিটেকশন এবং ডিডাকশনের ক্ষমতার জন্যে এককালে বেশ সুখ্যাতিও ছিল তাঁর।
এরকম সময়ে ঘরের হেল্পিং হ্যান্ড সহদেব এসে বলল যে ব্রেকফাস্ট রেডি। দময়ন্তী ডাকছেন।
অনিকেত বললেন, – চল গৌতম, ব্রেকফাস্ট সেরে কেসটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।
৩
লুচি আর আলুর দম দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে সোফায় ফিরে একটা ক্লাসিক আলট্রা মাইল্ডস ধরিয়ে অনিকেত বললেন, – নাও গৌতম। এবারশুরু করো তোমার কাহিনী।
একটু কেশে গলাটা পরিস্কার করে নিয়ে গৌতম শুরু করল, – ফিল্ম প্রোডিউসার অচিন্ত্য সরকারের নাম হয়তো আপনি শুনেছেন।টলিউডের অন্যতম বিখ্যাত প্রোডাকশন হাউস ‘সরকার ফিল্মস’ এর কর্ণধার অচিন্ত্য সরকার। ইদানীং কালের বেশ কিছু বিগ বাজেটের সুপারহিট সিনেমা ইনি প্রোডিউস করেছেন। এই অচিন্ত্য সরকারকে কেউ বা কারা পঁচিশে এপ্রিল মানে গত বৃহস্পতিবার তাঁর আলিপুরের বাসভবনে হত্যা করেছে। রাত দশটা নাগাদ মৃতদেহ প্রথম আবিষ্কার করে তাঁর বাড়ির মেড সারভেন্ট, রাখালের মা। তার আগে সন্ধ্যে সাতটায় অচিন্ত্য যখন অফিস থেকে বাড়ি ফেরেন, তখন তিনি খুবই উত্তেজিত ছিলেন। বাড়ি ফিরেই অহেতুক সবাইকে বকাবকি করেন। তারপরে মদ্যপান করতে শুরু করেন। আটটা নাগাদ তাঁর সাথে দেখা করতে আসে তাঁর ছেলে সৈকত। সৈকত অচিন্ত্যর প্রথম পক্ষের সন্তান। সৈকতের সাথে অচিন্ত্যর তুমুল বাদানুবাদ হয়। অচিন্ত্য রেগে ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। তারপরে তিনি দোতলায় নিজের শোবার ঘরে ফিরে যান। দশটা নাগাদ রাখালের মা তাঁকে ডিনারের জন্যে ডাকতে গিয়ে দেখে অচিন্ত্যকে কেউ গলার নলি কেটে খুন করে গেছে।
এতটুকু বলে গৌতম একটু থামল। অনিকেত একমনে শুনছিলেন। জিজ্ঞেস করলেন, – বাড়িতে তখন কে কে ছিল?
– বাড়িতে ছিল রাখালের মা, বাড়ির কুক গণেশ আর অচিন্ত্যর সেক্রেটারি কাম ম্যানেজার কেশব দেবনাথ। রাখালের মা আর গণেশ মণ্ডল অনেক পুরনো লোক। অত্যন্ত বিশ্বাসী। তারা একে অপরের সাথেই ছিল আটটা থেকে দশটা পর্যন্ত। ঘরের কাজকর্ম, রান্নাবান্না -এইসব করছিল। কেশব দেবনাথের বাড়ি আসানসোলে। কলকাতায় অচিন্ত্যর বাড়িতেই থাকে। খাওয়া দাওয়াও এখানেই। ঘটনার দিন কেশব অচিন্ত্যর সাথেই ফেরে অফিস থেকে। বাড়ি ফেরার পরে অচিন্ত্যর মেজাজ খারাপ ছিল। তাই কোনও কারণে কেশবকে খুব বকাঝকা করেন। তারপর তাকে কিছু ইম্পরট্যান্ট ডকুমেন্ট বানানোর কাজ দেন। সেই সব কাজই করছিল সে দশটা পর্যন্ত। রাখালের মার চিৎকারে ওপরে গিয়ে দেখে অচিন্ত্য মরে পড়ে আছে। সারা সন্ধ্যে সে বাড়িতেই ছিল। কিন্তু তার কোনও সাক্ষী নেই।
ধোঁয়ার একটা রিং ছেড়ে অনিকেত প্রশ্ন করলেন, – আর কে কে থাকে বাড়িতে?
একটু দম নিয়ে গৌতম বলল, – এরা ছাড়া অচিন্ত্যর সাথে থাকেন তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী নন্দিতা আর তাঁর সৎ বোন অরুণিমা। নন্দিতাও ফিল্ম লাইনেই আছেন। বয়স, তাঁর নিজের বয়ান অনুযায়ী, থার্টি ওয়ান। বেশ কয়েকটা ফিল্মে হিরোইনের রোলে অভিনয় করেছেন। আগে মধ্যবিত্ত পরিবারের বউ ছিলেন। থিয়েটারের সখ ছিল। থিয়েটার করতে করতে এক মেগা সিরিয়ালের ডিরেক্টরের চোখে পড়েন। সেই সূত্রে একটা মেগা সিরিয়ালে অভিনয়ের সুযোগ পান। সৌন্দর্য আর অভিনয় ক্ষমতার জোরে কিছুদিনের মধ্যেই ফিল্মে চান্স পেয়ে যান। প্রথম দু'তিনটে সিনেমা হিট করে যেতে অল্প সময়ের মধ্যেই ছোট পর্দা এবং বড় পর্দার খুবই পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। এরকম সময়ে অচিন্ত্যর সাথে পরিচয়। অচিন্ত্য তখন প্রথম স্ত্রীর সাথে ডিভোর্স করে সিঙ্গল ছিলেন। তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারপরে নন্দিতা তার প্রথম স্বামীকে ডিভোর্স করে দুই বছর আগে অচিন্ত্যকে বিয়ে করেন। গত বৃহস্পতিবার সকালে নন্দিতা বেরিয়ে যান শুটিং-এ। ফেরেন বিকেল সাড়ে ছটায়। তারপরে সাতটায় অচিন্ত্য ফেরার একটু আগে আবার বেরিয়ে যান একটা পার্টি অ্যাটেন্ড করতে। তাজ বেঙ্গলে। সেখান থেকে ফেরেন সাড়ে দশটায় স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে।
অনিকেত চোখ বন্ধ করে শুনছিলেন। চোখ না খুলেই বললেন, – আর অরুণিমা?
– অরুণিমা পেশায় ডাক্তার। গাইনোকলজিস্ট। কলকাতায় বেশ কয়েকটা নার্সিংহোমের সাথে যুক্ত। বয়স তেত্রিশ, অবিবাহিতা। অচিন্ত্যর সাথেই থাকেন। আসলে অচিন্ত্যর ফিল্ম প্রোডাকশনের ব্যবসা তাঁর বাবার আমলে শুরু। অচিন্ত্যর বাবা অমূল্য সরকারও ছিলেন বাংলা ছবির নামকরা প্রোডিউসার। বাড়িটা তাঁরই তৈরি। অরুণিমা অমূল্যবাবুর দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। অমূল্যবাবু মারা যাবার সময় তাঁর সমস্ত সম্পত্তি অচিন্ত্যকে দিয়ে যান এই শর্তে যে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত অরুণিমার সব দায়িত্বভার অচিন্ত্য নেবে। সে জন্যেই অরুণিমা এখন দাদার সাথে আলিপুরের বাড়িতেই থাকেন। যাই হোক, ঘটনার সময় তিনিও বাড়িতে ছিলেন না। ক্যামাক স্ট্রিটের নাইটিংগেল হসপিটালে ডিউটিতে ছিলেন। তার আগে দুপুর বেলা ডিউটিতে ছিলেন রুবি হসপিটালে। সেখান থেকে সাড়ে সাতটা নাগাদ বাড়ি ফেরেন। আবার আটটায় বেরিয়ে যান নাইটিংগেলে। বাড়ি ফেরেন দাদার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে।
অনিকেতের চোখ এখনও বন্ধ। ঘুমচ্ছেন না বোঝা যাচ্ছে, কারণ মাঝে মাঝে সিগারেটটা টেনে চোখ বন্ধ অবস্থাতেই নিখুঁত লক্ষ্যে ছাই ফেলছেন অ্যাশট্রেতে। গৌতম সামনে রাখা বোতলটা থেকে একটু জল খেয়ে আবার শুরু করল, – রাত আটটায় সৈকত আসে অচিন্ত্যর সাথে দেখা করতে। একতলায় স্টাডি-রুমে কথা বলতে বলতে বাপ ছেলেতে তুমুল ঝগড়া হয়। অচিন্ত্য অলরেডি নেশার ঘোরে ছিলেন। ধাক্কা দিয়ে ছেলেকে বের করে দেন ঘর থেকে। সৈকতও রেগেমেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। ঘড়িতে তখন বাজে সাড়ে আটটা। ঝগড়ার পর অচিন্ত্য চলে যান দোতলায় শোবার ঘরে। তখনই অচিন্ত্যকে শেষ বারের মতো জীবিত দেখা গেছে। সৈকত সাড়ে আটটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেও, মেইনগেটে সিকিউরিটি জগন্নাথ পাল জানায় যে সৈকত তখনই গেট থেকে বেরোয়নি। সে কম্পাউন্ডের ভিতরেই কোথাও একটা ছিল। তারপরে হঠাৎ নটা বাজার কয়েক মিনিট আগে পুরো বাড়ির পাওয়ার কাট হয়ে যায়। কিন্তু পাড়ায় বাকী সব বাড়ি বা দোকানপাটে কারেন্ট আছে দেখে জগন্নাথের সন্দেহ হয়। সে জেনারেটর কাম মিটার রুমে গিয়ে দেখে মেন ইলেকট্রিক লাইনের সার্কিটব্রেকারটা ট্রিপ করে গেছে। লাইন সারাই করে সিকিউরিটি রুমে ফেরার পথে জগন্নাথ দেখে সৈকত খুব তাড়াহড়ো করে গেট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। শুধু জগন্নাথই নয়, রাখালের মা আর গণেশও কারেন্ট আসার পরে সৈকতকে সিঁড়ি দিয়ে দোতলা থেকে নামতে দেখেছে।
এবার অনিকেত চোখ খুলে জিজ্ঞেস করলেন, – সৈকত এ ব্যাপারে কি বলছে?
– সৈকতের বক্তব্য, সে বাবার কাছে এসেছিল কিছু টাকা চাইতে। সে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে এবছর কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। মাস্টার্সের জন্যে বিদেশে পড়তে যেতে চায়। খুবই মেধাবী ছাত্র সে। কিন্তু বিদেশে পড়তে গেলে যে পরিমাণ খরচ, সেটা বহন করা তার মায়ের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সে বাবার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিল। কিন্তু তার বাবা মায়ের ডিভোর্সের সময় যে রকম তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছিল এবং সৈকত যে সে সময় মায়ের পক্ষ নিয়েছিল সেটা অচিন্ত্য ভোলেননি। ছেলেকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন। অপমানিত হয়ে সৈকতও বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে। তারপরে বাইরে এসে বাগানে দাঁড়িয়ে সিগারেট খায় কিছুক্ষণ। তার মাথা একটু ঠাণ্ডা হলে সে আবার বাবার সাথে কথা বলতে বাড়ির ভিতরে ঢোকে। এমন সময় পাওয়ার কাট হয়ে যায়। সে এই বাড়িতে অনেক বছর ছিল। তাই স্টাডিরুমে বাবাকে না পেয়ে দোতলায় ওঠে বাবাকে খুঁজতে। কিন্তু দোতলায় উঠে আবার তার মত পরিবর্তন হয়। সে বাবার সাথে দেখা না করেই আবার ফিরে যায়।
– লাইটারটা অচিন্ত্যর ঘরে কি করে পাওয়া গেল এই ব্যাপারে সে কি বলছে? অ্যাশট্রেতে শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেটটা গুঁজে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন অনিকেত। – সে কি ঘরে ঢুকেছিল?
– না। সৈকত বলছে ওটা প্ল্যান্টেড। সে নাকি দোতলার করিডোর থেকেই ফিরে গিয়েছিল। ঘরে ঢোকেনি। লাইটারটা সিগারেট ধরানোর সময় হয়তো বাগানে তার পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিল। কেউ সেটা তুলে নিয়ে তাকে ফাঁসানোর জন্যে ওই ঘরে রেখে এসেছে।
– হুম্, ইন্টারেস্টিং। আচ্ছা এই অচিন্ত্য লোকটা কেমন ছিল? মানে প্রথম স্ত্রী বা ছেলের সাথে কেমন সম্পর্ক ছিল? প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন অনিকেত।
–ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে লোকেরা যেমন হয়, সেরকমই। বাবা প্রোডিউসার ছিলেন। প্রচুর সম্পত্তি রেখে গেছিলেন। অল্প বয়সে প্রথম বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রী সুরমা মধ্যবিত্ত ভালো পরিবারের মেয়ে, কিন্তু খুব দৃঢ়চেতা। ফিল্ম লাইনের স্বামীর বেহিসাবি জীবনযাপন, রাতবিরেতেপার্টি, নিত্য নতুন মহিলাসঙ্গ... এইসব সহ্য করতে পারেননি। তা সত্ত্বেও ছেলের কথা ভেবে প্রায় পনের বছর বিয়েটা টিকিয়ে রেখেছিলেন। লাগামছাড়া হয়ে যাওয়ায় আট বছর আগে ডিভোর্সের জন্যে মামলা করেন। অচিন্ত্যও কন্টেস্ট করেন। ভীষণ তিক্ততার মধ্যে দিয়ে বিয়েটা শেষ হয়। এককালীন একটা মোটাসোটা অ্যালিমনি দিতে হয় অচিন্ত্যকে। সেই থেকে স্ত্রী আর ছেলের সাথে তিনি কোনও সম্পর্ক রাখতেন না।
– এখন সুরমা কোথায় থাকেন?
– সুরমা ছেলেকে নিয়ে গড়িয়ায় একটা ছোট ফ্ল্যাটে থাকেন। কাছাকাছি একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়ান।
– বৃহস্পতিবার সন্ধেবেলা কোথায় ছিলেন, কি করছিলেন খোঁজ নিয়েছ?
– হ্যাঁ! ওইদিন সারা সন্ধ্যে তিনি বাড়িতেই ছিলেন। তবে তার কোনও উইটনেস নেই। তিনি জানতেনই না যে সৈকত বাবার সাথে দেখা করতে গেছে।
অনিকেতের ভুরুতে চিন্তার ছাপ। কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। নীরবতা ভেঙ্গে অনিকেত বললেন, – এনি ওয়ে! তোমাদের ইনিশিয়াল ইনভেস্টিগেশনে কি কি পেলে বলো।
– হ্যাঁ বলছি। দশটার কিছুক্ষণ পরে কেশব দেবনাথ লোকাল থানায় ফোন করে প্রথম খবরটা জানায়। পুলিশ এসে দেখে দোতলায় নিজের বেডরুমের বিছানায় অচিন্ত্যর বডিটা পড়ে আছে। ক্ষুর জাতীয় কোনও প্রচণ্ড ধারাল অস্ত্র দিয়ে গলার নলিটা কাটা। ক্লিন সিঙ্গল কাট। দেখে মনে হয় কোনও পেশাদার হাতের কাজ। ও হ্যাঁ! মারার আগে অচিন্ত্যকে ক্লোরোফর্ম করা হয়েছিল। পোস্টমর্টেম রিপোর্টেও এটা কনফার্মড হয়েছে।
এবার অনিকেত একটু নড়েচড়ে বসলেন, – ক্লোরোফর্ম! স্ট্রেঞ্জ! তোমরা সৈকতকে সন্দেহ করছ। কিন্তু একবারও ভেবে দেখছ না যে সে ক্লোরোফর্ম পাবে কোথায়?
– জেঠু। সৈকত কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর স্টুডেন্ট। যে কোনও কেমিস্ট্রি ল্যাবেই ক্লোরোফর্ম পাওয়া যায়। তাই না?
– হ্যাঁ তা যায়। কিন্তু কেউ বাবার কাছে টাকা চাইতে আসার সময় ক্লোরোফর্ম নিয়ে আসে না। অনিকেতের গলায় শ্লেষ।
গৌতম শ্লেষটা গায়ে মাখল না। বলল, – কারেক্ট! আর ঠিক এই জন্যেই আমি মানতে পারছি না যে সৈকত খুনটা করেছে। কিন্তু কি জানেন, অচিন্ত্য সেলিব্রিটি। তাছাড়া বিভিন্ন সরকারী আমলা বা মন্ত্রীর সাথে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। তাই সরকারের তরফ থেকে তাড়াতাড়ি অচিন্ত্যর খুনিকে ধরার জন্যে প্রচুর চাপ আসছে। এরকম পরিস্থিতিতে তদন্ত প্রভাবিত হতে বাধ্য। সবাই এখন তাড়াতাড়ি করে একজনকে ধরে তাকে খুনি সাব্যস্ত করে দিয়ে হাত পা ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। তাই বলির পাঁঠা করা হচ্ছে সৈকতকে।
– হুম্! বাই দ্য ওয়ে, মার্ডার ওয়েপনটা পাওয়া গেছে?
– না। তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সেটা পাওয়া যায়নি।
এতক্ষণে অনিকেতকে দেখে মনে হচ্ছে যে তিনি কিছুটা উৎসাহ পেয়েছেন। বললেন, – যাই হোক। তারপরে বল।
– হ্যাঁ! তো পুলিশ এসে ডেডবডি পোস্টমর্টেমের জন্যে পাঠায়। পোস্টমর্টেম রিপোর্টেও জানা যায় যে অচিন্ত্যর মৃত্যু হয়েছে রাত আটটা থেকে দশটার মধ্যে। ঘরের ভিতর ধস্তাধস্তির তেমন কোনও চিহ্ন ছিল না। খালি অচিন্ত্যর গ্লাসটা ঘরের মেঝেতে ভাঙ্গা অবস্থায় পড়ে ছিল। ঘরের লাগোয়া ব্যালকনি গ্রিল দেওয়া। সেই গ্রিলে ফায়ার এস্কেপের জন্যে যে প্রভিশনটা আছে, সেটাও ভিতরের দিক থেকে তালা দেওয়া। চাবি ঘরের ড্রয়ারে পাওয়া গেছে। তার মানে খুনি সামনের দরজা দিয়েই ঘরে ঢুকেছে। ঘরে একটা হুইস্কির বোতল আর বরফের ট্রে পাওয়া গেছে। সেগুলোতে অচিন্ত্য ছাড়া আর কারও হাতের ছাপ নেই। আগেই বলেছি, সৈকতের লাইটারটা ঘরের ভিতরে পাওয়া গেছে। সেটা পড়ে ছিল মেঝেতে ওয়ার্ডরোবের সামনে।
– ওয়ার্ডরোবটা কি লক করা ছিল?
– হ্যাঁ। ওয়ার্ডরোবটা লক করা ছিল। চাবিটা ছিল সেম ড্রয়ারে। কিন্তু পরে নন্দিতা কনফার্ম করেন যে ওয়ার্ডরোবে আশি হাজার মতো ক্যাশ ছিল। আর ছিল কিছু সোনার গয়না। এক দেড় লাখের হবে। সেগুলো মিসিং।
– আশি হাজার টাকা ক্যাশ বাড়িতে ছিল?
– হ্যাঁ! ইন্ডাস্ট্রিতে সব লেনদেন তো আর সাদা টাকায় হয় না। প্রচুর কালো টাকা ওড়ে। এটা হয়তো সেরকমই কোনও কারণে রাখা ছিল।
– হুম্। কোয়াইট ন্যাচারাল। মাথা নাড়লেন অনিকেত, – এটা একটা মোটিভ হতে পারে। সৈকতের বাড়ি সার্চ করা হয়েছে?
– হ্যাঁ! কিন্তু কিছু পাওয়া যায়নি। না টাকা না গয়না!
– এক্সপেক্টেড! কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে কি জানি ভাবলেন অনিকেত। তারপরে বললেন, – নন্দিতা আর অরুণিমার অ্যালিবাই ক্রস চেক করেছ?
– হ্যাঁ! দুজনেরই অ্যালিবাই ফুলপ্রুফ। তাছাড়া দুজনেই বাড়ি থেকে যখন বেরিয়ে যায় তখন অচিন্ত্য জীবিত। আর বাড়ি ফেরে অচিন্ত্যর মৃত্যুর পরে। আর মেন গেটে ডিউটিতে থাকা জগন্নাথ নিশ্চিত ভাবে জানিয়েছে যে আপনাকে যা যা বললাম, এরা ছাড়া ওইদিন বাড়িতে আর কেউ ঢোকেনি বা বেরোয়নি। জগন্নাথের চোখ এড়িয়ে বাড়িতে ঢোকা বা বেরনো অসম্ভব, কারণ পুরো বাড়িটা সাত ফিট উঁচু দেওয়াল আর দেওয়ালের ওপরে কাঁটাতারের জাল দিয়ে ঘেরা। অতএব কোনও আউটসাইডার যে এই কাজ করেনি সে ব্যাপারে আমরা শিয়োর।
– আর কোনও উল্লেখযোগ্য ক্ল্যু?
কিছুক্ষণ চিন্তা করল গৌতম। তারপরে বলল, – ক্ল্যু বলতেও পারেন আবার নাও বলতে পারেন। তবে ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট একটা আছে। আমরা প্রত্যেকের মোবাইল কললিস্ট চেক করেছিলাম। সবারই মোর অর লেস নর্মাল। তবে নন্দিতার কললিস্টে দেখা গেছে নন্দিতা একটা নাম্বারে গত ত্রিশ দিনে তেইশটা কল করেছে। সেটা ওর এক্স-হাসব্যান্ড তন্ময় ঘোষের নাম্বার। নন্দিতাকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে বলছে তার এক্স-হাসব্যান্ডের সাথে আবার তার লাস্ট পাঁচ ছয় মাস হলো যোগাযোগ শুরু হয়েছিল। নন্দিতার সাথে অচিন্ত্যর বিয়েটা সাকসেসফুল হয়নি। দে ওয়্যার নট অ্যা হ্যাপি কাপল। এই ক্রাইসিসের মধ্যে তার আগের স্বামী তন্ময়ের সাথে তার যোগাযোগ হয়। তারা প্যাচ-আপ করে নেয়। দুজনে আবার বন্ধুর মতো একে অপরের সাথে মিশতে থাকে।
– বাঃ বেশ ভালো! তো এই তন্ময় করে কি?
– তন্ময় বজবজে একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফ্যান ম্যানুফ্যাকচারিং কম্পানির সেলস ম্যানেজার। নন্দিতার সাথে ডিভোর্সের পর থেকে সে একাই থাকে শ্যামবাজারের কাছে একটা ভাড়া বাড়িতে। ঘটনার দিন সরাইঘাট এক্সপ্রেসে করে গৌহাটি যাচ্ছিল। ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং ছিল সেখানে। বৃহস্পতিবার বিকেল চারটেয় ট্রেনে ওঠে। পরের দিন সকাল সাড়ে নটায় গৌহাটি পৌঁছয়। শুক্রবার মিটিং সেরে শনিবার ফেরার ট্রেনে উঠে রোববার, মানে গতকাল কলকাতা ব্যাক করে। গৌহাটিতে থাকাকালীন পেপারে সে অচিন্ত্যর মৃত্যুর খবরটা শোনে। গতকাল ফেরার পরেই আমরা তার সাথে কথা বলেছি।
– তার অ্যালিবাই ভেরিফাই করা হয়েছে? অনিকেত একটু সন্দিহান।
– হ্যাঁ। সে বৃহস্পতিবার অফিসে না গিয়ে সরাসরি বাড়ি থেকে হাওড়া স্টেশন যায়। সেখানে তাকে কিছু ডকুমেন্টস দেবার জন্যে তার অফিসের এক কলিগ গিয়েছিল। আমরা সেই কলিগকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে তন্ময়কে ট্রেনে সি-অফ করে তারপরে বাড়ি ফেরে।গৌহাটিতে ক্লায়েন্টের তরফ থেকে তন্ময়কে স্টেশন থেকে পিক-আপ করতে লোক গেছিল। সেও তন্ময়কে গাড়ী থেকে নামতে দেখে। তাছাড়া আমরা তন্ময়ের আশেপাশের যাত্রীদের সাথে যোগাযোগ করে তাদেরকেও জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাদের মধ্যে একটা ফ্যামিলি ছিল। স্বামী স্ত্রী আর একটা বাচ্চা। সেই ভদ্রলোকও আইডেন্টিফাই করেছেন তন্ময়কে।
– তার মানে অকাট্য অ্যালিবাই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন অনিকেত। – কোনও উইল করে গেছে কি অচিন্ত্য?
– না। এখনও পর্যন্ত কোনও উইলের সন্ধান আমরা পাইনি। সম্ভবত তিনি কোনও উইল করে যাননি।
– হুম্! সেক্ষেত্রে তার সমস্ত সম্পত্তি পাচ্ছে তার বর্তমান স্ত্রী নন্দিতা। শ্রাগ করলেন অনিকেত।
গৌতম নীরবে সম্মতি জানাল। কিছুক্ষণ দুজনে চুপ করে বসে রইল। ওয়ালক্লকটার টিক টিক ছাড়া ঘরে আর কোনও শব্দ নেই। গৌতম অপেক্ষা করতে লাগল অনিকেত কি বলেন সেটার জন্যে। উনি তার প্রস্তাবে রাজী হবেন এই আশা নিয়ে সে এত সকালে ছুটে এসেছে। একমাত্র উনিই পারেন সৈকতকে ফাঁসির দড়ি থেকে বাঁচাতে। তার নিজের হাত পা বাঁধা। পুলিশের চাকরী করা মানে একরকম নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে ওপরওয়ালার হাতের পুতুলের মতো তাদের হুকুম তামিল করা। ইচ্ছে থাকলেও সিস্টেমের বাইরে বেরতে পারবে না সে।
তানিয়াকে কথা দিয়েছে সে। সৈকতকে যেভাবেই হোক এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবে। তানিয়া গৌতমের স্ত্রী। তিনমাসও হয়নি বিয়ে হয়েছে তাদের। অনিকেতকে সব কথা সে বলতে পারেনি। সৈকত যে তানিয়ার মাসতুতো ভাই এই তথ্যটা সে চেপে গেছে। তানিয়ার মতো সেও অবাক হয়ে গেছে সৈকত এব্যাপারে জড়িয়ে পড়ায়। এই ক'দিনের পরিচয়ে সেও বুঝে গেছে মানুষ খুন করা তো দূরের কথা, সৈকতের মতো এত নরম স্বভাবের ছেলে একটা মশা মারার আগেও দশবার ভাববে। অথচ এত অভিমানী ছেলেটা যে প্রিয় গৌতমদার কাছেও সব কথা খুলে বলছে না। মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে।
– ওকে! আয়্যাম গেম। শেষ পর্যন্ত নীরবতা ভঙ্গ করে অনিকেত বললেন, – মনে হচ্ছে কেসটায় কিছু ম্যাটার রয়েছে। আমি দেখি তদন্ত করে সত্যিটা বের করতে পারি নাকি।
মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠল গৌতমের মুখ। জেঠুর ওপর তার অনেক ভরসা। ছোটবেলা থেকে অনিকেতের সুনাম, তাঁর সাফল্য, তাঁর বুদ্ধির প্রশংসা শুনে এসেছে সে। সে নিশ্চিত, এবার সৈকতের আর কোনও ভয় নেই। অনিকেত নিশ্চয়ই আসল হত্যাকারীকে খুঁজে বের করবেন। স্ত্রীর কাছে দেওয়া কথাটা রাখতে পারবে সে।
৪
কলকাতার রাস্তায় গাড়ী চালানোটা দিনকে দিন অসম্ভব হয়ে উঠছে। একে তো হকারদের জ্বালায় পথচারীরা ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তাটাকেই হাঁটার জন্যে ব্যবহার করছে। তার ওপর গাড়ীর সংখ্যাও ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সবথেকে বেপরোয়া হলো অটো চালকেরা। তাদের অটো চালানোর ধরণ দেখলে মিশন ইম্পসিবলের টম ক্রুজও বোধহয় লজ্জা পেয়ে যাবে। কলকাতার তুলনায় দিল্লীতে গাড়ী চালানো অনেক সহজ ছিল।
নিজের আই টোয়েন্টিটা গ্যারেজে ঢোকাতে ঢোকাতে ভাবছিলেন অনিকেত। দময়ন্তী আর তিনি আজ গিয়েছিলেন তাঁর এক প্রাক্তন কলিগের ছেলের বিয়ের রিসেপশনে। কিন্তু সারাদিন ধরে তাঁর মাথায় অচিন্ত্য সরকারের মৃত্যু রহস্যটাই ঘুরপাক খাচ্ছে। গৌতম চেয়েছিল আজকেই তাঁকে নিয়ে একবার অচিন্ত্যর বাড়িতে গিয়ে সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। কিন্তু সন্ধেবেলা নিমন্ত্রণ ছিল বলে তিনি আজকে যাননি। কথা দিয়েছেন কাল যাবেন। গৌতম সাথে করে প্রত্যেকের জবানবন্দীর কপি, আর অন্যান্য কিছু ডকুমেন্টস নিয়ে এসেছিল। সেগুলো দিয়ে গেছে তাঁকে পড়বার জন্যে। কিন্তু তিনি সময় পাননি চোখ বোলানোর। ঠিক করেছেন রাতে শোবার আগে ওগুলো নিয়ে বসবেন।
দময়ন্তী ঘরে ঢুকে গেছেন। তাঁর মেজাজটা আজ একটু চড়া। হওয়ারই কথা। একে একে তাঁদের পরিচিত সবার ছেলে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। বাবলুর বন্ধুবান্ধবরাও সবাই আস্তে আস্তে বিয়ে করে সংসারী হয়ে যাচ্ছে। শুধু তাঁর স্বামী আর পুত্রেরই টনক নড়ছে না। বহুদিন ধরে বলতে বলতে তিনি ক্লান্ত। যতগুলো সম্বন্ধ তিনি খুঁজে নিয়ে আসেন, বাবলুর সেগুলো পছন্দ হলে অনিকেত তাতে কোনও না কোনও খুঁত বের করেন। আর অনিকেত কোনওভাবে রাজী হলে বাবলু সেগুলো বাতিল করে দেয়। আর এই করতে করতে ছেলের বয়স বেড়ে বেড়ে ত্রিশে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ বাড়ি ফেরার পথে সারা রাস্তা এই নিয়ে তিনি গজ গজ করতে করতে এসেছেন। অনিকেত পাল্টা কোনও কথা বলেননি। কথা বললেই আগুনে ঘি পড়বে। তাই চুপ করে থাকাটাকেই বেছে নিয়েছেন। আসলে বাইরে অনিকেত যতই দোর্দণ্ডপ্রতাপ অফিসার হন না কেন, হোমফ্রন্টে সবসময় শেষ কথাটা দময়ন্তীই বলেন। মাঝে মাঝে তিনি অবাক হয়ে ভাবেন, তাঁর স্ত্রী দুনিয়ার সবকিছুকে ভয় পেলেও তাঁকে একেবারেই ভয় পান না। আর তিনি, পৃথিবীতে কাউকে ভয় পান না, কিন্তু নিজের স্ত্রীকে একটু সমঝে চলেন।
ঘরে ঢুকে দেখলেন, দময়ন্তীর মেজাজ কিছুটা ঠাণ্ডা হয়েছে। কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে দময়ন্তী চলে গেলেন শুতে। তিনি বসলেন গৌতমের রেখে যাওয়া জবানবন্দীর ফাইলটা নিয়ে।
একঘন্টা লাগল সবার জবানবন্দী পড়ে ফেলতে। যা যা গৌতম বলে গেছে তার থেকে নতুন কিছুই পেলেন না। সাথে রেখে যাওয়া অন্যান্য কাগজপত্রগুলো পরীক্ষা করে দেখলেন। তন্ময়ের ট্রেনের টিকিট, হোটেলের কাগজপত্রের ফটোকপি, আরও কিছু ডকুমেন্টস। তৎকালের টিকিট। হোটেল রিজার্ভেশনের কাগজগুলো দেখে দেখলেন সবই ঠিকঠাক। কোথাও কোনও গণ্ডগোল নেই। কিন্তু তাও তাঁর মনে একটা খটকা থেকে গেল। কি খটকা সেটা বুঝতে পারলেন না। কিন্তু কিছু একটা তাঁর মনে এসেও আসছে না। বয়স থাবা ফেলেছে তাঁর মনে। মাথাটা আগের মতো শার্প নেই আর, এই ভেবে মনে মনে একটা আক্ষেপ হতে লাগল তাঁর।
হঠাৎ কি মনে হওয়ায় ল্যাপটপটা টেনে নিয়ে গুগলে নন্দিতার নামে সার্চ করলেন। অনেকগুলো লিঙ্ক এলো। উইকিপিডিয়ায় গিয়ে পড়লেন তার সম্বন্ধে। গতানুগতিক লেখা, কবে জন্ম, কি কি ফিল্মে অভিনয় ইত্যাদি ইত্যাদি। আরও কিছু এদিক ওদিক ব্রাউজ করার পরে হঠাৎ নিউজ সেকশনে একটা খবর তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। আড়াই বছর আগেকার একটা খবর। নন্দিতা তখন লাগাতার তৃতীয় সুপারহিট ছবিটা করে আলোচনার তুঙ্গে। এইরকম সময় নন্দিতার তন্ময়ের সাথে ডিভোর্স আর অচিন্ত্যর সাথে সম্পর্কের মুখরোচক খবর নিয়ে মিডিয়া উত্তাল। সেই সময় কোর্টে ডিভোর্সের মামলা চলাকালীন উত্তেজিত হয়ে তন্ময় মিডিয়ার সামনে নন্দিতাকে মারবে বলে তেড়ে আসে। অকথ্য গালিগালাজের সাথে সে নন্দিতাকে খুন করে ফেলবে বলে হুমকিও দেয়। ডিভোর্স পাওয়ার জন্যে নন্দিতা তন্ময়ের বিরুদ্ধে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের অভিযোগ এনেছিল। হয়তো অভিযোগটা সর্বৈব মিথ্যে ছিল। কিন্তু এই ঘটনার পরে নন্দিতার পক্ষে রায় দিতে বিচারকরা আর কোনও সময় নষ্ট করেননি।
মানুষের মন কি বিচিত্র। সে আড়াই বছর আগে সর্বসমক্ষে যাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়, সময়ের সাথে সাথে তার সাথেই আবার বন্ধুত্ব করে নিতে বিন্দুমাত্র সময় নেয় না। অবাক হয়ে ভাবলেন অনিকেত।
এবার অচিন্ত্য সম্বন্ধে গুগল করলেন অনিকেত। তাঁর সম্বন্ধে বিভিন্ন আর্টিকল পড়লেন নেটে। নামকরা প্রোডিউসারের ছেলে। বাবার নাম ভাঙ্গিয়ে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশ। কয়েকটা ভালো সিনেমা বানালেও বাবার মতো সাফল্য পাননি। তাছাড়া অল্প বয়স থেকেই প্রচুর পয়সা হাতে আসায় তুমুল বোহেমিয়ান জীবনযাপন করেছেন। বিয়ে করা সত্ত্বেও বিভিন্ন অভিনেত্রীর সাথে বারবার স্ক্যান্ডালে জড়িয়েছেন। অন্যান্য প্রোডিউসারদের সাথেও যে খুব ভালো সম্পর্ক, তা নয়। রাজনৈতিক পালাবদলের পরে তড়িঘড়ি নিজের ভোল পাল্টে ক্ষমতাসীন দলের সুনজরে চলে আসেন। ইদানীং হাঁটুর একটা সমস্যায় ভুগছিলেন। ট্রিটমেন্টের জন্যে লন্ডন গিয়েছিলেন মাস তিনেক আগে। সেখানেই প্রায় দুমাস থেকে হাঁটুতে সার্জারি করিয়ে দিন পনের কুড়ি হলো দেশে ফিরেছিলেন।
ল্যাপটপটা বন্ধ করে একটা সিগারেট ধরালেন অনিকেত। আপাতদৃষ্টিতে খুব সহজ মনে হলেও আসলে কেসটা বেশ জটিল। তাঁরও মনে মনে বিশ্বাস সৈকত খুনটা করেনি। সে এসেছিল বাবার সাথে কথা বলতে। রাগের মাথায় খুন করলে সে ক্লোরোফর্ম পেল কোথায়? সে ছাড়া আর কেই বা খুনটা করতে পারে? কেশব? তার মোটিভ কি? যাঁর কাছে চাকরী করে, তাঁকে খুন কেন করবে সে? গণেশ, রাখালের মা? তারা তো অনেকদিন ধরে আছে এই বাড়িতে। অত্যন্ত বিশ্বাসী। তাহলে কি বাইরের কেউ? জগন্নাথ হলপ করে বলছে যে আর কেউই বাড়িতে ঢোকেনি বা বেরয়নি।
অনিকেত উঠে গিয়ে ডেস্ক থেকে একটা খালি ডাইরি নিয়ে এলেন। কর্মজীবনে তিনি যখনই কোনও কেসের অনুসন্ধান করতেন, যে সবতথ্য বা নোটস উল্লেখযোগ্য বলে মনে হতো, সেগুলো লিখে রাখতেন ডাইরিতে। এভাবে লিখে রাখলে পরে অনেক জট ছাড়াতে সুবিধে হয়। ডাইরিটা খুলে তিনি এখনও পর্যন্ত এই কেসে জড়িত প্রত্যেকের সম্বন্ধে যা যা জেনেছেন বা বুঝেছেন সব লিখতে শুরু করলেন।
অনেকক্ষণ ধরে ভেবেচিন্তে সবটা লেখার পরে প্রথম থেকে একবার পড়তে শুরু করলেন। লেখাটা এইরকম।
অচিন্ত্য সরকার – বয়স একান্ন বছর। প্রচুর সম্পত্তি। লোক হিসেবে সুবিধের নয়। মৃত্যুর দিন কোনও কারণে উত্তেজিত ছিল (কি কারণ?)।ছেলে টাকা চাইতে এলে রেগে মেগে বের করে দেয়। সাড়ে আটটায় শেষ বার জীবিত দেখা যায় তাকে। দশটার সময় তার ডেডবডি আবিষ্কার করে রাখালের মা। ক্লোরোফর্মড, গলার নলি কাটা। ক্লিন সিঙ্গল কাট। মার্ডার ওয়েপন পাওয়া যায়নি। আলমারি থেকে টাকা ও গয়না মিসিং (এটাই কি মোটিভ?)।
নন্দিতা সরকার – অচিন্ত্যর বর্তমান স্ত্রী। বয়স একত্রিশ বছর। ঘটনার সময় তাজ বেঙ্গলে পার্টিতে ছিল। স্ট্রং অ্যালিবাই। খুনের সুযোগ নেই। কিন্তু মোটিভ আছে। স্বামীর মৃত্যুতে সমস্ত সম্পত্তির মালিক।
সৈকত সরকার – অচিন্ত্যর ছেলে (প্রথম পক্ষের)। বয়স বাইশ বছর। মেধাবী ছাত্র, কবিতা লেখে। খুনের দিন বাবার কাছে টাকা চাইতে এসেছিল। সাড়ে আটটা থেকে নটা পর্যন্ত কোথায় ছিল বা কি করছিল তা পরিস্কার নয়। খুনের মোটিভ টাকাও হতে পারে। আবার রাগের মাথায় খুনও হতে পারে। ঘটনাস্থল থেকে হাতের ছাপ সমেত লাইটার পাওয়া গেছে। তার মানে বাবার শোবার ঘরে সে ঢুকেছিল। যদিও মুখে অস্বীকার করছে। অ্যালিবাই নেই।
অরুণিমা সরকার – অচিন্ত্যর সৎ বোন। বয়স তেত্রিশ। অবিবাহিতা, ডাক্তার। ঘটনার সময় বাড়িতে ছিল না। খুনের মোটিভ নেই। সুযোগও নেই। অ্যালিবাই পাক্কা।
কেশব দেবনাথ – অচিন্ত্যর ম্যানেজার কাম সেক্রেটারি। বয়স ছেচল্লিশ। অচিন্ত্যর বাড়িতেই থাকত। ঘটনার দিন অচিন্ত্য কোনও কারণে বকাঝকা করে। খুনের সময় বাড়িতেই ছিল, কিন্তু কোনও অ্যালিবাই নেই। খুনের সুযোগ আছে। মোটিভ তদন্ত সাপেক্ষ।
সুরমা সরকার – অচিন্ত্যর প্রথম স্ত্রী। বয়স সাতচল্লিশ। খুনের সময় গড়িয়ায় নিজের ফ্ল্যাটে ছিল। কোনও অ্যালিবাই নেই। মোটিভ স্বামীর প্রতি পুরনো রাগ হতে পারে। কিন্তু খুনের সুযোগ নেই।
তন্ময় ঘোষ – নন্দিতার প্রথম পক্ষের হাসব্যান্ড। বয়স চৌত্রিশ। নন্দিতাকে খুনের হুমকি দিয়েছিল। আবার এখন তার সাথেই বন্ধুত্ব। মাসে তেইশটা কল(?)। অ্যালিবাই পাক্কা। মোটিভ নেই। সুযোগ নেই।
রাখালের মা ও গণেশ – বাড়ির হেল্পিং হ্যান্ড আর কুক। বয়স যথাক্রমে আটান্ন আর একচল্লিশ। খুনের সময় বাড়িতেই ছিল। কিন্তু মোটিভ নেই। একে অপরের অ্যালিবাই।
সবটা পড়ে ফেলার পর হঠাৎ অনিকেত খেয়াল করলেন রাত দেড়টা বেজে গেছে। কাল আবার সকাল সাড়ে নটায় গৌতম চলে আসবে। অচিন্ত্যর বাড়িতে নিয়ে যাবে। বেশী রাত করলে সকালে উঠতে দেরী হয়ে যাবে। তাই আর দেরী না করে অনিকেত শুয়ে পড়লেন। গরমটাও পড়েছে প্রচণ্ড। এসির ঠাণ্ডায় আর সারাদিনের ক্লান্তিতে শুতে না শুতেই ঘুম এসে গেল।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলেন ঠিক নেই। অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখে ভোর রাতের দিকে তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল। স্বপ্নে তিনি দেখলেন কোনও একটা মস্ত বড় হলে সিনেমা দেখছেন। একজন সাদা পোশাক পরা লোক এসে তাঁর কাছে টিকিট দেখতে চাইল। তিনি তাঁর প্রত্যেকটা পকেটে মরিয়া হয়ে খুঁজছেন টিকিটটা। কিন্তু কোথাও পাচ্ছেন না। সারা জীবন নিয়ম মেনে চলে এসেছেন তিনি। টিকিটটা না পেয়ে লজ্জায় তাঁর মাথা কাটা যাচ্ছে। আশেপাশের লোকেরা অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সময় তিনি খেয়াল করলেন যারা যারা তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে তাদের প্রত্যেকের গলায় একটা মস্ত কাটা দাগ। রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে সেখান থেকে...
ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় উঠে ঢক ঢক করে এক গ্লাস জল খেলেন তিনি। পাশে দময়ন্তী তখনও গভীর ঘুমে। মোবাইলটাতে দেখলেন সবে পাঁচটা একুশ বাজে। কাল রাতে এত ভারী খাওয়া দাওয়া হয়েছে! নির্ঘাত পেট গরম হয়ে গেছে। তার ওপর সারাদিন অচিন্ত্যর মৃত্যু মাথায় ঘুরপাক খেয়েছে। সবকিছুর যোগফল এই বিদঘুটে স্বপ্নটা।
এসিটা একটু কমিয়ে দিয়ে আবার একবার ঘুমনোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু চেষ্টাটাই সার হলো। বাকী সময়টা খালি বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করেই কেটে গেল। ঘুম আর এল না।
৫
আলিপুর কম্যান্ড হসপিটালটা থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে প্রায় পঁচিশ কাঠা আয়তাকার জমির ওপরে তৈরি অচিন্ত্যর বাড়িটাকে বাড়ি না বলে বাংলো বা ভিলা বলাটাই বেশী উচিত হবে। তাঁকে নামিয়ে দিয়ে গৌতম যখন গাড়ীটা গ্যারেজে পার্ক করছে, অনিকেত তখন সেই সুযোগে চারপাশটা ভালো ভাবে জরিপ করে নিচ্ছিলেন। মস্ত বড় লোহার গেট পেরিয়ে ঢুকতে হয় কম্পাউন্ডটাতে। গেটের পরে বাঁদিকে সিকিউরিটি রুম রেখে পাশাপাশি দুটো গাড়ী যেতে পারে এমন চওড়া একটা রাস্তা চলে গেছে। সেই রাস্তার ওপর সাহেবি ডিজাইনের একটা পোর্টিকো। তারপরেও রাস্তাটা আরও কিছুদূর এগিয়ে ডানদিকে বাঁক নিয়ে আরও ত্রিশ মিটার মতো গিয়ে গ্যারাজে এসে শেষ হয়েছে। গ্যারাজটা বেশ বড়। প্রায় চার পাঁচটা গাড়ী অনায়াসে রাখা যায়। অনিকেত দেখলেন, সেখানে তাঁদের গাড়ীটা ছাড়াও আরও দুটো গাড়ী পার্ক করা। একটা কালো রঙের মার্সিডিজ বেঞ্জ আর একটা লাল রঙের মারুতি সুইফ্ট। কলকাতার রাস্তায় মার্সিডিজের দেখা খুব বেশী পাওয়া যায় না। অচিন্ত্যর বিত্তের যে কোনও অভাব ছিল না, তাঁর গ্যারাজে পার্ক করা এই মার্সিডিজটাই সেটার প্রমাণ। গ্যারাজের লাগোয়া আরও দুতিনটে ঘর। সেগুলোর দরজা বন্ধ। পুরো রাস্তাটার দুধারে নানা ধরণের ফুল আর পাতাবাহার গাছের বাগান। দেখলেই বোঝা যায়, নিয়মিত বাগানটার যত্ন নেওয়া হয়। গেট দিয়ে ঢোকার পরেই ডানদিকে সবুজ মখমলের মতো ঘাসে ঢাকা একটা লন। সেখানে একটাশেডের তলায় দু’তিনটে সাদা শৌখিন চেয়ার আর একটা সেন্টার টেবিল। শীতকালে মিঠেকড়া রোদে বাগানে বসে চা কিম্বা অন্য কোনও পানীয় পান করার জন্যে। পাশে একটা কাঠের বেঞ্চ আর একটা দুজন বসার মতন শৌখিন সুইং চেয়ারও চোখে পড়ল। লনের পিছনের দিকটাতে বড় গাছের সারি। আম, পেয়ারা, কাঁঠাল, লিচু ছাড়াও আরও নানা ধরণের গাছ। পুরো কম্পাউন্ডটা প্রায় সাত ফিট উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। পাঁচিলের ওপরে রয়েছে কাঁটাতারের ফেন্সিং। পাঁচিলের ধার ঘেঁষে রয়েছে বড় ছোট নানা ধরণের গাছগাছালি। সব মিলিয়ে এই বাড়িতে থাকলে অক্সিজেনের অভাব কোনওদিনই যে হবে না, একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
পোর্টিকোটার একদিকে দুই ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠে মূল বাড়িতে ঢোকার সদর দরজা। দরজাটা খোলাই রয়েছে। গৌতমের সাথে ঘরে ঢুকতেই অনিকেত দেখলেন ডানদিকে একটা ঘর থেকে একজন লোক বেরিয়ে এসে ঘরে তালা লাগাচ্ছে। ছিপছিপে চেহারা। মধ্যবয়স্ক। মাথায় কোঁকড়ানো কাঁচা পাকা চুল। ফর্মাল শার্ট প্যান্ট পরনে। পিঠে ব্যাকপ্যাক। পায়ে একটা চামড়ার চপ্পল। লোকটা তাঁদের লক্ষ্য না করে তালা লাগাতেই ব্যস্ত। অনিকেত আড়চোখে গৌতমের দিকে তাকাতে গৌতম অস্ফুট স্বরে বলল, – কেশব দেবনাথ।
কেশব তালাটা লাগিয়ে দু'একবার টেনে টেনে পরীক্ষা করে দেখল ঠিকঠাক লাগানো হয়েছে কিনা। তারপরে ঘুরে দাঁড়িয়ে তাঁদের দেখে যেন প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে একগাল হেসে তাঁদের দিকে এগিয়ে এসে বলল, – গুড মর্নিং স্যার! সকাল সকাল এখানে, কোনও বিশেষ দরকার ছিল নাকি?
– গুড মর্নিং কেশববাবু। গৌতম প্রত্যুত্তরে বলল। তারপর অনিকেতকে দেখিয়ে বলল, – এনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি হলেন মিঃ অনিকেত স্যান্যাল। দিল্লীতে সিবিআই এর ডিরেক্টর ছিলেন। সম্প্রতি রিটায়ার করেছেন। উনি এই কেসটার তদন্তে লালবাজারকে সাহায্য করছেন। তাই এঁকে একবার নিয়ে এলাম ঘটনাস্থলটা দেখাতে।
– অ্যাঁ! সিবিআই! চোখ কপালে উঠে গেল কেশবের। – স্যারের কেসটা কি এখন সিবিআই হ্যান্ডল করছে?
– আরে না না! একটু বিরক্তই হলো গৌতম। – আসলে উনি আমার পরিচিত। তাই একবার সবকিছু বুঝে শুনে, সবার সাথে কথাবার্তা বলে একটা এক্সপার্ট ওপিনিয়ন দেবেন বলেই উনি এসেছেন।
– আমি জানি এই সময়টা আপনাদের ওপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এতক্ষণে মুখ খুললেন অনিকেত। – আসলে খুনের তদন্ত তো। বুঝতেই পারছেন। একটু কষ্ট করতে হবে।
– না না! ছি ছি। লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে গেল কেশব, – একশ বার কথা বলবেন। কষ্ট কেন হবে? আমরা সবাই তো চাই স্যারের খুনি যেন উপযুক্ত শাস্তি পায়। কিন্তু মুশকিল হলো সবার সাথে তো কথা বলতে পারবেন না, কারণ নন্দিতা ম্যাডাম তো কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে গেলেন। আউটডোর শুটিং আছে বোধ হয়। ফিরতে রাত হয়ে যাবে।
– কি আর করা যাবে! যাঁরা বাড়িতে আছেন তাঁদের সাথেই পরিচয়টা সেরে নেই তাহলে। অনিকেত বললেন। – তা আপনি কোথাও বেরোচ্ছিলেন মনে হয়। আপনার সাথেই কথা বলে নেই প্রথমে?
– হেঁ হেঁ! ঠিকই ধরেছেন। আসলে এখানকার পাট তো চুকল। যিনি দানা যোগাতেন তিনিই আর রইলেন না। কিন্তু পেট তো আর মশাই সেকথা বুঝবে না। খোলসা করে বলল কেশব। – দেখি অন্য কোথাও কিছু অন্নসংস্থান করা যায় কিনা। মানে একটা ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছি।
– হুম্! বেশ বেশ! তো আপনি কি বরাবরই কোথাও বেরোলে দরজায় তালা লাগিয়ে যান? আচমকা প্রশ্ন ছুঁড়লেন অনিকেত।
– অ্যাঁ! না... মানে হ্যাঁ। থতমত খেয়ে গেল কেশব। – আসলে কি জানেন তো... এই কদিনে এত লোক আসছে তো বাড়িতে! কার মনে কি আছে কে বলতে পারে। তাই আর কি।
– হ্যাঁ, তা তো বটেই। চলুন সোফায় বসে কথা বলা যাক। বলে অনিকেত এগিয়ে গেলেন ঘরের মাঝে রাখা সোফাসেটটার দিকে।
সোফায় বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে অনিকেত প্রশ্ন করলেন, – তা কেশববাবু, কতদিন হলো অচিন্ত্যবাবুর এখানে কাজ করছিলেন?
– তা হয়ে গেল বেশ ক'দিন স্যার! কেশব যেন বিনয়ের অবতার। – এই তো সামনের জুলাই মাসে দু'বছর পুরো হতো!
– আপনার বাড়ি তো আসানসোলে। তাই না? কে কে থাকে ওখানে?
– আমার স্ত্রী আর ছেলে। সংক্ষিপ্ত জবাব কেশবের।
– তা ওদের নিয়ে আসেন না কেন কলকাতায়?
– কি করে নিয়ে আসব বলুন স্যার। এমন কি আর কাজ করি যে বউ ছেলেকে নিয়ে কলকাতায় বাড়িভাড়া করে থাকব? নেহাত স্যার থাকতে দিতেন তাই থাকা খাওয়ার খরচটা লাগত না। নাহলে এই সামান্য বারো হাজার টাকা মাস মাইনের চাকরীতে নিজের হাত খরচাটুকু বাদ দিয়ে প্রতিমাসে পাঁচ ছয় হাজার টাকাও হয়তো বাড়িতে পাঠাতে পারতাম না। কেশবের গলার স্বর ভারী হয়ে উঠল।
– আচ্ছা, অচিন্ত্যবাবু লোক হিসেবে কেমন ছিলেন? মানে ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর কোনও শত্রু টত্রু ছিল কি? সামনে রাখা অ্যাশট্রেতে ছাইটা ঝেড়ে বললেন অনিকেত।
– কেমন করে বলি বলুন, তিনি ছিলেন আমার অন্নদাতা। তিনি কেমন লোক ছিলেন এটা বিচার করা আমার পক্ষে ধৃষ্টতা হবে। তবে এটা বলতে পারি, ইন্ডাস্ট্রিতে কেউই কারোর বন্ধু হয় না। সবাই সবাইকে বাঁশ দেবার জন্যে সবসময় রেডি। বলে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে একটা অশ্লীল ইঙ্গিত করল কেশব।
– তার মানে বলতে চাইছেন বাইরের কেউও এই খুনটা করতে পারে...? ভুরু কুঁচকালেন অনিকেত।
– এমা ছি ছি! জিভ কাটল কেশব। – সে কথা কখন বললাম? তাছাড়া পুলিশ যখন ওঁর ছেলেকে গ্রেপ্তার করেছে, তখন বুঝেই করেছে নিশ্চয়ই। তবে...
– তবে?
– না মানে, ছেলেটাকে দেখে মনে তো হয় না যে সে এই কাজ করতে পারে। কিন্তু বলা যায় না, আজকালকার ছেলে তো। আবেগের বশে চলে সবসময়। তাছাড়া স্যার সেদিন এত রেগে ছিলেন, দিয়েছিলেন দু'চার কথা শুনিয়ে। তাই পাল্টা রেগে গিয়ে ঝোঁকের মাথায় হয়তো...। কথাটা শেষ করল না কেশব।
– অচিন্ত্যবাবু সেদিন এত রেগে ছিলেন কেন, কারণটা জানেন?
একটু ভেবে উত্তর দিল কেশব, – দেখুন, স্যারের এত বড় বড় লোকের সাথে মেলামেশা, কথাবার্তা। আমি সামান্য মানুষ। আমি কি করে জানব? আদার কারবারি কি আর জাহাজের খবর রাখে? তবে ছোট মুখে একটা বড় কথা বলি? মনে হয় রাগটার পিছনে কোনও পারিবারিক কারণ জড়িত।
– এরকম মনে হবার কারণ? তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন অনিকেত।
– বিষ্যুদবার বিকেলে স্যার আমাকে কয়েকটা চিঠি টাইপ করার জন্যে ডিকটেশন দিচ্ছিলেন। এমন সময় তাঁর কাছে একটা ফোন আসে। চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে গলার স্বরটাকে একদম খাদে নামিয়ে বলল কেশব, – ফোনে কথা বলতে বলতে স্যার বেশ কয়েকবার নন্দিতা ম্যাডামের নামটা উচ্চারণ করেন। ফোনটা রেখে দেবার পর থেকেই দেখি তাঁর মেজাজ খারাপ। অকারণে চেঁচামেচি করছেন। যাকে তাকে ঝাড়ছেন। ডিকটেশনটাও শেষ করলেন না। বললেন এক্ষুনি বাড়ি যাবেন। তাই মনে হলো, আর কি।
– এই কথাগুলো আপনি আগে বলেননি তো? আকাশ থেকে পড়ল গৌতম।
বিন্দুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে বলল কেশব, – আগে তো জিজ্ঞেস করেননি স্যার!
আবার রেগে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল গৌতম। কিন্তু তাকে ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বললেন অনিকেত, – সেদিন সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার পর ঠিক কি কি হয়েছিল একবার ডিটেলে বলুন তো।
একটু সময় নিয়ে চিন্তা করে জবাব দিল কেশব, – সেদিন বাড়ি ফেরার পর স্যার আমাকে চিঠিগুলো মেইল করে দিতে বলেন। গাদাগুচ্ছের মেইল। আরও বেশ কিছু কাজও দিলেন। আসলে বহুদিন তো স্যার দেশে ছিলেন না। অনেক কাজ পেন্ডিং হয়ে ছিল। তো যাই হোক, একমনে কাজগুলো করছিলাম, এদিক ওদিক তাকানোর ফুরসৎ ছিল না আমার। হঠাৎ চেঁচামেচি শুনে বাইরে এসে দেখি, স্যার চিৎকার করতে করতে তাঁর ছেলেকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিচ্ছেন।
– কি বলছিলেন তিনি।
– এই যেমন, ‘তোমরা মা ছেলে মিলে অনেক টাকা শুষেছ’, ‘আর এক পয়সাও দেব না’, ‘রাস্তায় ভিক্ষে কর গিয়ে’ এইসব আর কি।
অচিন্ত্যর স্বভাবচরিত্রটা একটু একটু করে পরিস্কার হচ্ছিল অনিকেতের কাছে। জানতে চাইলেন, – আর সৈকত, সে কি বলছিল?
– সত্যি বলতে কি, ছেলেটাকে দেখে আমার কষ্ট হচ্ছিল স্যার। এত মিষ্টি মুখটা। দুঃখে অপমানে লাল হয়ে গেছিল। মনে হচ্ছিল কেঁদেই ফেলবে। মুখটা করুণ হয়ে এল কেশবের। – বেচারা, মন খারাপ করে চুপ করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
– তারপর?
– তারপর আর কি? সৈকত বেরিয়ে যাবার পরে দাপাদাপি করতে করতে স্যার উঠে গেলেন দোতলায়। আমি ঘরে ফিরে আবার কাজগুলো নিয়ে বসলাম। সৈকত কখন আবার ঘরে ঢুকেছে বা বেরিয়েছে টের পাইনি। একদম দশটার সময় রাখালের মার চিৎকারে ওপরে উঠে দেখি এই কাণ্ড।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অনিকেত বললেন, – ঠিক আছে কেশববাবু, আপনাকে আর আটকে রাখব না। আপনার হয়তো দেরী হয়ে যাচ্ছে। আপনার কাছ থেকে যা জানার ছিল জেনে নিয়েছি। আপনি এবার আসতে পারেন।
গদগদ ভাবে উঠে দাঁড়াল কেশব। বলল, – ঠিক আছে স্যার। আমি যাই, একবার গণেশকে বলে দিই অরুণিমা ম্যাডামকে খবর দিতে।উনিও হয়তো বেরিয়ে যাবেন ডিউটিতে।
অনেকক্ষণ ধরেই একটা লোক দূর থেকে উঁকিঝুঁকি মারছিল। কেশব তার কাছে গিয়ে তাকে কিছু নির্দেশ দিতে শুরু করল। সেই দিকে তাকিয়ে গৌতম রাগত স্বরে বলল, – আচ্ছা ধড়িবাজ লোক তো! দিব্যি ডাহা মিথ্যে কথা বলে চলে গেল। বিশ্বাস করুন জেঠু, আমি নিজে ওকে এই প্রশ্নটা আগে করেছি। তখন ও বলেছে যে ও এব্যাপারে কিছুই জানে না। আর এখন বলছে ওকে নাকি আগে জিজ্ঞেসই করা হয়নি। কলকাতা পুলিশ যে এতটা অকর্মণ্য নয়, এটা প্রমাণ করতে যেন বদ্ধপরিকর গৌতম।
– রিল্যাক্স, গৌতম! আই ট্রাস্ট ইউ! আশ্বস্ত করলেন অনিকেত। – শোন! কেশব হলো গভীর জলের মাছ। আমি শিয়োর, ও আগে ইচ্ছে করেই তোমাদের এই কথাগুলো বলেনি। কেন বলতো? আমার মনে হয় ও এই কথাগুলো গিয়ে নন্দিতাকে বলেছিল। ওর ইচ্ছে ছিল নন্দিতাকে ভয় দেখিয়ে কিছু টাকা হাসিল করা। সিম্পল ব্ল্যাকমেলিং আর কি! কিন্তু নন্দিতা মনে হয় পাত্তা দেয়নি। তাই রেগে মেগে এখন আমাদের কাছে সবকথা উগড়ে দিল। দেখলে না কেমন কায়দা করে নিজে থেকে প্রসঙ্গটা তুলল। হাসতে হাসতে বললেন অনিকেত।
গৌতম চোখ দিয়ে তাঁকে থামতে ইশারা করল। কেশব ফিরে আসছে। অরুণিমাকে খবর দিতে গণেশ উঠে গেছে দোতলায়। কেশব এগিয়ে এসে তাঁদের বলল, – তাহলে আমি আসি স্যার! গণেশকে বলে দিয়েছি। ও ম্যাডামকে ডেকে দেবে। বলে হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
গৌতম সামনের সেন্টার টেবিলে রাখা একটা ফিল্মি ম্যাগাজিন তুলে পাতা ওলটাতে শুরু করল। অনিকেত এই অবসরে উঠে দাঁড়িয়ে সারা ঘরটাতে একবার চোখ বোলালেন। ঘরে ঢুকেই প্রথমেই একটা বিশাল লিভিং রুম। এত বড় যে অনায়াসে ফুটবল খেলা যাবে। সামনে থেকেই বড় ঘোরানো সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। ডানদিকে একটা বড় ঘর। খোলা দরজা দিয়ে ভিতরটা যতটুকু দেখা যাচ্ছে, মনে হয় সেটা স্টাডিরুম কাম লাইব্রেরী। বড় একটা মেহগনি কাঠের টেবিল আর কয়েকটা চেয়ার দেখা যাচ্ছে। পুরো ঘরের দেওয়াল জুড়ে বইয়ের র্যাক। তাতে সারি সারি বই সাজানো। পাশে আরও দু'একটা ঘর। এরমধ্যেই একটা ঘর কেশবের, যেটায় এখন তালা ঝুলছে। লিভিং রুমের সামনের দিকটায় রয়েছে একটা সুদৃশ্য সোফাসেট, যেখানে তাঁরা এখন বসে আছেন। সোফাসেটের সামনে একটা সেন্টার টেবিল। নীচে লাল রঙের টার্কিশ কার্পেট। মাথার ওপরে বিশাল একটা ঝাড়লণ্ঠন। তার সামনে একটা ওয়াল ইউনিটে অত্যাধুনিক এলইডি টিভি আর হোম থিয়েটার। পাশে একটা শোকেসে অনেকগুলো ট্রোফি, পদক ইত্যাদি সাজানো। সোফাসেটের পিছনের দিকে আবার দু'ধাপ সিঁড়ির পরে ডাইনিং স্পেস। সেখানে একটা মস্ত কাঠের তৈরি ডাইনিং টেবিল। তারও পিছনে মডিউলার কিচেন। ঘরের সব দেওয়ালেই ঝুলছে বিভিন্ন বাংলা ছবির বড় বড় পোস্টার। অধিকাংশই ‘সরকার ফিল্মস’-এর প্রযোজিত সিনেমা। ঘরের সবকিছুতেই বৈভবের ছাপ সুস্পষ্ট।
একটু বাদেই গণেশ নীচে নেমে এসে খবর দিল যে অরুণিমা তাঁদের ওপরে নিজের ঘরে ডাকছেন। অনিকেত গণেশকে ডেকে বললেন, –তুমি গণেশ, তাই তো? ম্যাডামের সাথে কথা বলার আগে তোমার সাথে আলাপটা সেরে নিই।
গণেশের মুখেচোখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। আতঙ্কিত স্বরে বলল, – আমি কিছুই জানি না বাবু!
কিছু লাভই হলো না গণেশকে প্রশ্ন করে। যাই প্রশ্ন করা হয়, গণেশের বাঁধাধরা একটাই জবাব। সে কিছুই জানে না। নতুন কিছুই জানা গেলনা তার কাছ থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হাল ছেড়ে দিয়ে অনিকেত বললেন গৌতমকে, – চল অরুণিমার সাথে দেখাটা সেরে আসি।
সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে ডানদিকে একটা করিডোর। করিডোরটার একপাশে সারিবদ্ধ কয়েকটা ঘর। তারই মধ্যে একটা ঘর অরুণিমার। অরুণিমা রেডি হয়ে ছিল কোথাও বেরোবে বলে। খাটের ওপরে একটা ল্যাপটপ খুলে কাজ করছিল। তাঁদের দেখে ল্যাপটপটা লক করে ঘুরে বসে দেওয়ালের ধারে রাখা ছোট বেতের সোফাসেটটায় তাঁদের বসতে বলে বলল, – আমি খুবই দুঃখিত, আপনাদের বেশীক্ষণ সময় হয়তো দিতে পারব না। আমার ডিউটির সময় হয়ে গেছে। আমি আসলে আমার ড্রাইভারের জন্যে ওয়েট করছি। সে যে কোনও সময় এসে গেলে আমাকে কিন্তু বেরিয়ে যেতে হবে।
অনিকেত ভালো করে লক্ষ করলেন অরুণিমাকে। মাঝবয়সী। খুব সুন্দরী হয়তো নন, কিন্তু চেহারায় একটা চটক রয়েছে। ধীর, স্থির।প্রসাধনহীন মুখে বুদ্ধিমত্তার ছাপ। কাঁধ পর্যন্ত স্টেপ কাট চুলে হালকা রঙের আভাস। গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলছে। দাদার মৃত্যুতে খুব একটা শোকাতুর বলে মনে হলো না।
প্রাথমিক পরিচয়পর্ব শেষ হলে অনিকেত প্রশ্ন করলেন, – আপনার কি মনে হয় মিস সরকার? আপনার দাদাকে কে হত্যা করেছে?
মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে উত্তর করল অরুণিমা, – দেখুন, সার্কামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স অনুযায়ী তো মনে হয় বাপ্পা, মানে সৈকতই কাজটা করেছে। কিন্তু তাও জানেন,, মন থেকে মেনে নিতে পারছি না। আসলে বাপ্পাকে তো ছোটবেলা থেকেই দেখছি। বাবাকে অসম্ভব ভালবাসত। দাদা যখন বৌদির সাথে, মানে ওর মার সাথে ডিভোর্স করল, ভিতরে ভিতরে ভীষণ মুষড়ে পড়েছিল ছেলেটা। হাসব্যান্ড বা বাবা হিসেবে দাদা তো কোনওকালেই খুব একটা আদর্শবান ছিল না। হয়তো এইসব ব্যাপারগুলো থেকে ওর মনে একটা চাপা ক্ষোভ বহুদিন ধরেই জমে ছিল। হঠাৎ করে সেটা আউটবার্স্ট করেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অরুণিমা।
– অচিন্ত্যবাবুর বর্তমান স্ত্রী, মানে নন্দিতার সাথে কেমন সম্পর্ক ছিল? অনিকেত জিজ্ঞাসা করলেন।
উত্তর দেবার আগে আবার সময় নিলেন অরুণিমা, – সাধারণত কারোর পার্সোনাল ব্যাপারে আমি নাক গলাই না, তাও বলছি, দাদামানুষটাই এমন ছিল যে ওর সাথে সুখে সংসার করাটা যে কোনও মহিলার পক্ষেই বেশ কঠিন ব্যাপার। বৌদি, মানে বাপ্পার মা, তাঁর মত ধৈর্যশীল মহিলাও যেখানে পারেননি, সেখানে নন্দিতা এত কম বয়সে কি করে সব সহ্য করবে? আমি নন্দিতাকে দোষ দিচ্ছি না। তবে আমার মনে হয় তারও আর একটু ম্যাচিওরিটি দেখানো উচিত ছিল।
– ঠিক কি বলতে চাইছেন একটু পরিস্কার করে বলবেন কি?
– স্যাঙ্গুইন না হয়ে কিছু বলাটা আমার প্রোফেশনাল এথিক্সের বিরুদ্ধে। একটু কেটে কেটে বললেন অরুণিমা, – তাও এইটুকু বলতে পারি, আমি ডাক্তার। আমার চোখে অনেক কিছুই ধরা পড়ে যা সাধারণ মানুষের পক্ষে চট করে বোঝা সম্ভব নয়। আয়্যাম সরি। এর থেকে বেশী আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।
এমন সময় খাটের ওপর রাখা অরুণিমার মোবাইলটা বেজে উঠল। সেটার কলার আইডিটার দিকে এক ঝলক দেখে নিয়ে অরুণিমা বললেন, – আমার ড্রাইভার। মনে হচ্ছে এসে গেছে। আমাকে এবার উঠতে হবে। আয়্যাম অলরেডি রানিং লেট। সো ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড...
অরুণিমার ঘর থেকে বেরিয়ে অনিকেত গৌতমকে কাছে ডেকে কিছু একটা নির্দেশ দিলেন। গৌতম ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। তারপরে অনিকেত প্রস্তাব করলেন, – দোতলায় উঠেই যখন পড়েছি, চল একসাথে অকুস্থলটাও ঘুরে আসা যাক।
অরুণিমার ঘরের দুটো ঘর পরেই অচিন্ত্যর বেডরুম। সেটা লালবাজার সীজ করে রেখেছিল। গৌতম চাবি এনেছিল সাথে। চাবি খুলে তাঁরা ভিতরে ঢুকলেন। ঘরে ঢুকে দেখা গেল বেশ সাজানো গোছানো একটা ঘর। একটা কিং সাইজের ডাবল বেড ঘরের মাঝখানে। দুপাশে বেডসাইড টেবিলে নাইটল্যাম্প। দরজার পাশেই একটা টেবিল। টেবিলে একটা ডেস্কটপ। একটা রাইটিং প্যাড। একটা পেনস্ট্যান্ডে কয়েকটা কলম রাখা। টেবিলের সাথে রিভলভিং চেয়ার। একদিকের দেওয়াল জুড়ে একটা মস্ত হালফ্যাশনের এমডিএফ ওয়ার্ডরোব। অন্যদিকের দেওয়ালে ছোট একটা এলসিডি। ঘরের একপাশে কাঁচের স্লাইডিং ডোরের পরে একটা ইস্ট ফেসিং ব্যালকনি। সূর্যের আলোয় গোটা ঘরটা উদ্ভাসিত।
অনিকেত তীক্ষ্ণ চোখে পুরো ঘরটায় চোখ বোলাচ্ছিলেন। হঠাৎ ঘরে ঢোকার মুখে রাখা পাপোশটার দিকে এগিয়ে গেলেন। উবু হয়ে বসে একদৃষ্টিতে কিছু একটা দেখতে শুরু করলেন। তাঁকে দেখে গৌতমও কৌতূহলী হয়ে একবার উঁকি মেরে দেখল। সাধারণ একটা পাপোশ। সবার ঘরেই যেরকম থাকে। উজ্জ্বল হলুদ রং। তার ওপরে কালো রঙে লেখা ‘ওয়েলকাম’। গৌতম অনিকেতের দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখল পাপোশের ওপরে একটা সরু লম্বাটে দাগ। কালচে মেরুন রঙের। খুব খেয়াল করে না দেখলে চোখে পড়ে না। দাগটার থেকে চোখ না সরিয়েই অনিকেত প্রশ্ন করলেন, – আচ্ছা গৌতম, অচিন্ত্যর পায়ে কি কোনও কাটা দাগ টাগ ছিল?
গৌতম একটু চিন্তা করে বলল, – না জেঠু। আমার যতদূর মনে পড়ছে, ছিল না। তাছাড়া অটপ্সি রিপোর্টে পরিস্কার বলা আছে যে একমাত্র গলার কাটা দাগটা ছাড়া অচিন্ত্যর শরীরে আর কোনও নতুন বা টাটকা ক্ষতচিহ্ন ছিল না।
অনিকেত মন দিয়ে শুনলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের এদিক ওদিক দেখতে লাগলেন। যেন কিছু একটা খুঁজছেন। একবার টেবিল আর খাটের তলাটাতেও উঁকি মেরে দেখলেন। কিছু খুঁজে না পেয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ালেন। করিডোরে একটা ওয়েস্ট পেপার বাস্কেট রাখা দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি সেটার কাছে গিয়ে উল্টে দিলেন সেটাকে। বেশ কিছু পুরনো কাগজ বেরিয়ে মাটিতে পড়ল। অধিকাংশই বিল জাতীয়। ইলেকট্রিসিটি, নিউজপেপার বা রেস্তোরাঁর বিল। এছাড়াও কিছু খালি হয়ে যাওয়া সিগারেটের প্যাকেট, একটা জেমস ক্লিপ, আরও কিছু জিনিস বেরিয়ে এল। সেগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে অনিকেত কিছু একটা দুই আঙ্গুলে ধরে বের করে আনলেন। মুখে একটা হারিয়ে যাওয়া অমূল্য রত্ন খুঁজে পাওয়ার হাসি। গৌতম অবাক হয়ে দেখল একটা চৌকোণা পাতলা কাঁচের টুকরো। ইঞ্চি খানেক লম্বা, আধ ইঞ্চি মত চওড়া। এবার পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে কাঁচের টুকরোটাকে রুমালে সাবধানে পেঁচিয়ে আবার রেখে দিলেন পকেটে।
অবাক হয়ে গৌতম জিজ্ঞেস করল, – ওটা কি পেলেন, জেঠু?
অনিকেত উত্তর করলেন, – বলছি, দাঁড়াও! আগে সবটা দেখে নিই। বলে আবার ঘরে ঢুকে সোজা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। গ্রিলের ঠিক ওপারেই একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। থোকা থোকা লাল ফুলে ভরে আছে। অনিকেত হাত বাড়িয়ে একটা ডাল ধরে তার ছোট ছোটপাতাগুলো ছিঁড়লেন। তারপরে হাতের তালুতে পাতাগুলো রেখে গ্রিলের বাইরে ফুঁ দিয়ে পাতাগুলো উড়িয়ে দিলেন। তাঁর মুখে ফুটে উঠল শিশুদের মত অকৃত্রিম এক হাসি। গৌতমকে ডেকে বললেন, – জান গৌতম, ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির কাছেই এরকম একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল। সেটার পাতাগুলো নিয়ে এরকম ফুঁ দিয়ে ওড়াতে আমার খুব ভালো লাগত। সেই থেকেই কৃষ্ণচূড়া গাছ আমার খুব প্রিয়। ফুলসমেত এই গাছটা দেখলেই আমার গীতা দত্তের ওই গানটা মনে পড়ে যায়। ওই যে ‘কৃষ্ণচূড়া আগুন তুমি’। তুমি শুনেছ গানটা, গৌতম?
কয়েকদিন আগে যে ঘরে একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ড হয়ে গেছে, সেই ঘরে দাঁড়িয়ে এরকম কাব্য করতে দেখে গৌতম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল অনিকেতের দিকে।
৬
কিছু কিছু লোক আছে যাদের সীতার পাতাল প্রবেশ নিয়ে প্রশ্ন করলে তারা হরধনু ভঙ্গ থেকে বলতে শুরু করে। জগন্নাথ পাল যে এদেরই মতো একজন সেটা একটু দেরীতে বুঝলেন অনিকেত। অচিন্ত্যর বাড়িতে ঢোকার সময়ই গেটের বাইরে বসে থাকা সিকিউরিটি গার্ডটাই যে জগন্নাথ, গৌতম সেটা তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিল। তখনই অনিকেত ঠিক করে নিয়েছিলেন ফেরার পথে ওর সাথে একটু কথা বলবেন। তাই গৌতমকে গাড়ীটা বের করতে বলে তিনি নিজে এগিয়ে গিয়েছিলেন জগন্নাথের সাথে আলাপ করতে। বছর ষাট বাষট্টির লোকটা তখন গেটের বাইরে ছায়ায় একটা টুলে বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে একমনে খৈনি ডলছিল। বয়সের ভারে একটু দুর্বল হলেও এখনও বেশ টানটান শরীর। মাথার কোঁকড়া চুলে পাক ধরেছে। মুখে একটা বলিষ্ঠ গোঁফ। গৌতম প্লেন ড্রেসে এসেছে বলে চিনতে না পারলেও তাঁদের গাড়ীতে লাল বাতি দেখে সে হয়তো আন্দাজ করে নিয়েছিল এরা বেশ কেউকেটা হবে। তাই তাঁকে হঠাৎ সামনে দেখে সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে একটা স্যালুট ঠুকে হাতের তর্জনী আর বুড়ো আঙ্গুলের ফাঁকে খৈনিটা নিয়েই দাঁড়িয়ে রইল। ভাবটা এমন যে খৈনিটা ফেলতেও পারছে না আবার মুখেও ঢোকাতে পারছে না।
দোষের মধ্যে অনিকেত ভুল করে তাকে জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলেন যে বৃহস্পতিবার রাতে সেই ডিউটিতে ছিল কিনা? এই প্রশ্নের উত্তরে সে জানাল যে সে, অশোক আর সজল বলে তিনজন অচিন্ত্যর বাড়ি পাহারা দেয়। দিনে আট ঘণ্টা করে ডিউটি। অশোক তার ভাইপো আর সজল অশোকের বন্ধু। দুই সপ্তাহ আগে সে বাজার থেকে কুড়ি টাকা কিলো দরে হিমসাগর আম পেয়েছিল। সেগুলো লোভে পড়ে বেশী খেয়ে ফেলায় তার পেট খারাপ হয়েছিল। তাই কেশববাবুকে বলে সে একবেলা ছুটি নিয়েছিল। তার জায়গায় সেদিন সজল ডিউটি দিয়েছিল। গত বৃহস্পতিবার তার ডিউটি ছিল সকাল ছটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত। কিন্তু সেদিন সন্ধ্যেবেলা সজলের বউকে নিয়ে সিনেমা দেখতে যাবার কথা ছিল। তাই সজল তাকে রিকোয়েস্ট করে সে যেন সেদিন সজলের হয়ে সন্ধ্যের ডিউটিটাও দিয়ে দেয়। ইচ্ছে না থাকলেও বাধ্য হয়ে সেদিন দুপুর দুটো থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ডিউটিটাও তাকেই করতে হয়। একে তো তার নিজের বয়স হয়েছে। তাছাড়া তার শরীরটাও পুরোপুরি সারেনি। কিন্তু আজকালকার ছেলেরা যে এসব বুঝতেই চায় না এই বলে সে যখন তার বক্তব্য শেষ করল ততক্ষণে গৌতম গাড়ী নিয়ে এসে গেছে।
লোকটাকে কথা বলার সুযোগ দিলে সে এক প্রশ্নের উত্তর দিতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল করে দেবে। তাই পরের প্রশ্নটা করার আগে অনিকেত সতর্ক হলেন। জিজ্ঞেস করলেন, – সেদিন সন্ধ্যেবেলা প্রথমে নন্দিতা ম্যাডাম এসেছিলেন, তাই না?
শেষ পর্যন্ত খৈনিটা ফেলেই দিয়ে জগন্নাথ বলল, – হ! সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টাই তাইনেই প্রথম আইলেন। আমি তো মেলা অবাক হইলাম তাঁরে দেইখ্যা। এমনিতে তো তাইন রোজ রাত নয়টা দশটার আগে আয়েনই না। পরে পল্টু কইল সেইদিন কোনও পার্টি আসিল নাকি। তাই এত সকাল সকাল...
– এক মিনিট! পল্টু কে? বাক্যস্রোতে আগল দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন অনিকেত।
– পল্টু হইল ম্যাডামের ড্রাইভার। এখানে হক্কলেরই ড্রাইভার আসে। স্যারের গাড়ী চালায় বিকাশ। পল্টুর কথা তো কইলামই। আর অরুণিমা ম্যাডামের গাড়ী চালায় শ্যামল।
– ও আচ্ছা। তা নন্দিতা ম্যাডাম তো কিছুক্ষণ পরেই আবার বেরিয়ে গেলেন, তাই না?
– হ! আধঘণ্টাও হইব না। পল্টু গাড়ী রাইখ্যা আইয়া টিফিন করতে আসিল। সেই টিফিনও তার শেষ হইল না, ম্যাডামের ফোন আইল।আবার বাইর হইতে লাগব। আমি তো কই, এই ফোন থাকনটা হইল মহা সমস্যার ব্যাপার, বুঝলেন না। ইটার জ্বালায় শান্তিতে একমিনিট শ্বাস ফালানো যায় না...
– হুম্! ঠিকই বলেছেন। যাই হোক, তারপরে অচিন্ত্যবাবু এলেন, তাই তো? অনিকেত যতটা সম্ভব নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছিলেন যাতে জগন্নাথকে দিয়ে কথা কিছু কম বলানো যায়।
– আইজ্ঞা! ম্যাডাম যাইবার লগে লগে তিন মিনিটও হইব না, স্যার আইলেন। আমি পরে ভাবলাম, আহা রে! স্যার যদি পাঁচ মিনিট আগে আইতেন, তাইলেই ম্যাডামের সাথে দেখাটা হইয়া যাইত। কে জানত পরে আর দেখাই হইব না। মুখটা দুঃখী দুঃখী করে লম্বা একটা শ্বাস ছাড়ল জগন্নাথ।
অধৈর্য হয়ে গৌতম নেমে এল গাড়ী থেকে। তাকে আড়চোখে একবার দেখে নিয়ে অনিকেত পরের প্রশ্ন করলেন, – এরপর অরুণিমা ম্যাডাম কখন এলেন?
– তা ধরেন আরও আধা ঘণ্টা বাদে। আমি তো শ্যামলরে দেইখ্যা প্রথমে চিনছিলামই না। পরে খেয়াল কইরা দেইখ্যা চিনলাম। তারে কইলাম, কিতা রে ব্যাটা। বেশ তো ছুটি কাটাইলে তিনদিন। কর, ভালা কইরা মজা কর।
– শ্যামল ছুটিতে ছিল কেন?
– ক্যান আবার? ম্যাডামের গাড়ী গ্যারাজে গেসল না? সারভিসিং-এ। ব্যাটা তিনদিন মাগনা ছুটি কাটাইল। হেইদিনই কাজে যোগ দিল।দিতে না দিতেই আবার ছুটি।
– আবার ছুটি?
– হ! ম্যাডাম হেইদিন তাড়াতাড়ি ছাইড়্যা দিসলেন তারে। নিজেই গাড়ী চালাইয়া বাইরইলেন পরে।
– হুম্! তারপর সৈকত কখন এল?
– অরুণিমা ম্যাডাম বাইর হইবার পাঁচ সাত মিনিট পরেই। আহা রে! বড় ভালা আসিল পোলাটা। ছোটবেলা, আমার কোলে আইয়া বইয়া থাকত। কি যে মাথার দোষ হইল, বাপরেই জানে মাইরা দিল। আপনারে আগেই কইলাম না, আজকালকার পোলাপানরা কিছুই বুঝতে চায়না। যেটা তারার মাথাত একবার ঢুকে...
– লোডশেডিংটা হলো কখন?
– আর কইয়েন না। কয়টা হইব তখন? রাত নয়টাও হয় নাই। সবে রাতের খাবারটা লইয়া বইসি। টিফিন বাক্স খুইল্যা দেখি সেই রুটি আর আলুর তরকারীই দিসে। সাথে দুইটা কাঁচালঙ্কা আর এক টুকরা পেঁয়াজ। মেজাজ গেল গরম হইয়া। কতবার কইসি বৌরে আমার পেট এখন ঠিক হইয়া গেসে। তাও কথা কানে লয় না। কন দেখি, রোজ রোজ রুটি খাইতে ভাল্লাগেনি কারুর? তো যাই হউক, সবে এক গ্রাস মুখে দিসি, সব বেবাক অন্ধকার হইয়া গেল। খাওয়া মাথাত উঠল। তার উপরে দেখি কি বাকী হক্কল জায়গায় লাইট জ্বলে। তাই জেনারেটর চালাইতে গিয়া ভাবলাম, দেখি তো একবার কি বিষয়। দেখি, যা ভাবসি তাই, লাইন টিরিপ হইসে।
– তাই নাকি? আচ্ছা জেনারেটর রুমটা কোথায় বলুন তো?
– ওই তো গ্যারেজের পাশেই। এইটা আরেক মুশকিল হইসে এখন। রাতবিরেতে কারেন্ট গেলেই ফোন আয়, ‘জগন্নাথ, জেনারেটর চালাও’। আর আমারে এতটা পথ হাইট্যা যাইতে লাগে। আগে যখন জেনারেটর আসিল না, এই ঝামেলাটা...
– আচ্ছা ঠিক আছে জগন্নাথ। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। আজ আসি, কেমন? পরে একদিন এসে তোমার সাথে অনেকক্ষণ গল্প করে যাব। কথাগুলো বলে তড়িঘড়ি পা চালালেন অনিকেত।
গাড়ীতে উঠে গৌতম বলল, – বাপরে বাপ। বকে বকে কানের পোকা বের করে দিল লোকটা। কি করে আপনি সহ্য করছিলেন?
অনিকেত স্মিত হেসে বললেন, – সহ্য করতে হয়, গৌতম। সহ্য করতে হয়। আমাদের অনেক সিনিয়র, একজন কিংবদন্তী বেলজিয়ান ডিটেকটিভ কি বলে গেছেন জান? বলেছেন এইসব অবান্তর কথাবার্তাকে ইগনোর করতে নেই। কারণ এর মধ্যে থেকেই এমন সব সূত্র বেরিয়ে আসে যেগুলো পরে রহস্য সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
– হুম্, তা কি এমন সুত্র বেরোল জগন্নাথের সাথে কথা বলে?
রহস্যময় হাসি হাসলেন অনিকেত, – জানা গেল যে বারবার বারণ করা সত্ত্বেও জগন্নাথের বৌ তাকে রাতের বেলা টিফিনে কেবল রুটি আর আলুর তরকারীই দেয়।
বহুদিন বাদে হা হা করে হেসে উঠল গৌতম। সত্যি পুলিশের চাকরীতে এমন অনাবিল হাসির মুহূর্ত খুব একটা সহজলভ্য নয়।
***
রাতে ভাল ঘুম হয়নি বলে দুপুরে একটা সলিড ঘুম দিয়ে উঠে অনিকেত দেখলেন মোবাইলে গৌতমের দুটো মিসড কল। সাধারণত ঘুমনোর সময় কোনও ব্যাঘাত পছন্দ করেন না বলে শোবার আগে নিজের মোবাইলটা সাইলেন্ট মোডে রাখাটা তাঁর বরাবরের অভ্যাস। এর ফলে গভীর রাতে সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানিগুলোর প্রমোশনাল কলের হাত থেকে রেহাই পেয়ে একটু নিশ্চিন্তে ঘুমোন যায়। এতে অবশ্য কিছু সমস্যাও আছে। অনেক সময়ই কোনও দরকারি ফোন এলে সেটা মিস হয়ে যায়। যেমন এখন গৌতমের কলগুলো ধরতে পারলেন না। সকালে দেখা হবার পরেও যখন দু'দুটো মিসড কল, তার মানে নিশ্চয়ই কোনও গুরুত্বপূর্ণ খবর রয়েছে। তাড়াতাড়ি চোখেমুখে একটু জল দিয়ে এসে কলব্যাক করলেন গৌতমকে।
যা ভেবেছিলেন ঠিক তাই। ফোন ধরেই উত্তেজিত গলায় বলল গৌতম, – জেঠু! এক্ষুনি আমি আবার ফোন করতে যাচ্ছিলাম। নতুন কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। খুব ইম্পরট্যান্ট। পুরো ব্যাপারটাই ঘেঁটে গেছে।
শান্ত গলায় বললেন অনিকেত, – তাই নাকি? বলো কি কি খবর।
– একটা নয়, তিন তিনটে নতুন ক্ল্যু। প্রথমটা হলো আপনার কথা মতো আমি নন্দিতার পার্সোনাল ডক্টরকে খুঁজে বের করে তাঁর কাছে খোঁজ নিয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছেন যে নন্দিতা প্রেগন্যান্ট। সেকেন্ড মান্থ চলছে। ব্যাপারটা প্রচণ্ড সিক্রেট। তিনি প্রথমে জানাতে চাননি। কিন্তু মার্ডার কেস বলে শেষ পর্যন্ত পুলিশকে হেল্প করতে সম্মত হয়েছেন।
– হুম্, অরুণিমা তাহলে ঠিকই নোটিস করেছিল। ওর কথাতে আমি এরকমই কিছু একটা আন্দাজ করেছিলাম। ওকে! নেক্সট ওয়ান?
– পরের খবরটা একটা রিউমার বা গসিপও হতে পারে। সত্যি কি মিথ্যে জানি না। ব্যাপারটা হলো বেশ কদিন ধরেই ইন্ডাস্ট্রিতে কানাঘুষোয় একটা খবর শোনা যাচ্ছে। নন্দিতা নাকি রিসেন্টলি শাক্যর সাথে একটা রিলেশনে জড়িয়ে পড়েছে।
– শাক্য! সে আবার কে?
– শাক্য হলো বাংলা সিনেমার একজন হিরো। টালিগঞ্জের উদীয়মান তারকা বলতে পারেন। ডেব্যুতেই মারকাটারি হিট দিয়ে সবার নজরে এসেছিল। পরের দুটো ছবি অতটা হিট না হলেও বক্স অফিসে ভালই বিজনেস করেছিল। এরই মধ্যেই প্রচুর ফ্যান ফলোয়িং ছেলেটার। তার কারেন্ট ছবির হিরোইন নন্দিতা। লাস্ট তিন চার মাস ধরেই ওদের মধ্যে বেশ ভাব ভালবাসা চলছিল। প্রথমে ব্যাপারটা গোপনই ছিল। কিন্তু আস্তে আস্তে ওদের নিয়ে লোকমুখে নানারকম চর্চা শুরু হয়েছে। এখন পুরো ব্যাপারটাই ফিল্মের একটা মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজিও হতে পারে। তবে যা রটে তার কিছুটা তো বটে। তাই না?
– ইন্টারেস্টিং! তার মানে মঞ্চে নতুন অভিনেতার আগমন। পান ইন্টেন্ডেড। হালকা হেসে বললেন অনিকেত।
– একদম তাই! গৌতমও সায় দিল। – তাছাড়া হয়তো সেইদিন এই রিউমারটাই অচিন্ত্যর কানে এসেছিল। তাই সে এত ক্ষেপে ছিল।
– অস্বাভাবিক নয়। অনিকেত সিরিয়াস। – এনিওয়ে! তৃতীয় খবরটা?
– তিন নম্বর খবরটাই সবচেয়ে হার্ডহিটিং। বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া খবর অনুযায়ী, নন্দিতা গত বৃহস্পতিবার তাজ বেঙ্গলের পার্টিতে গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সারাক্ষণ সেখানে ছিল না। সে সাতটার একটু পরে পার্টিতে ঢোকে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সবার অলক্ষ্যে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। আবার আন্দাজ নটা সাড়ে নটার ভিতরে ব্যাক করে। কোথায় গিয়েছিল কেউ জানে না। তার মানে ওইটুকু সময় তার কোনও সুনির্দিষ্ট অ্যালিবাই নেই।
– গ্রেট! কাহানি মে টুইস্ট। এখন পুরো জিনিসটা আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। অনিকেত একটু গম্ভীর। – বাই দ্যা ওয়ে! নন্দিতাকে এ ব্যাপারে ক্রস করেছ?
– না! এখনও করা হয়নি। আজ তো নন্দিতার ফিরতে রাত হয়ে যাবে। ভাবছি কাল একবার কথা বলব।
– ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, ক্যান আই টেক দিস রেস্পন্সিবিলিটি? ও জেনেশুনে আগে পুলিশকে বলেনি কথাগুলো। সেলিব্রিটি তো।হয়তো মিডিয়ার ভয়ে এবারও বলতে চাইবে না। তোমার জায়গায় আমি যদি গিয়ে কথা বলি তাহলে মনে হয় সে অনেক খোলা মনে কথা বলবে।
– ওহ শিয়োর। নো ইস্যুজ অ্যাট অল। গৌতম এককথায় রাজী। – আপনি ঠিক বলেছেন! আমার মনে হয় আপনি কথা বললেই বেটার হবে। আমি এক কাজ করছি। আমি কাল সকালে নটায় নন্দিতার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রাখছি। সাথে আপনার একটা ইন্ট্রোডাকশনও দিয়ে দিচ্ছি।
– দ্যাটস বেটার! বললেন অনিকেত। – সাথে একবার ওই শাক্য ছোকরাকেও বলে রেখো। দরকার পড়লে ওর সাথেও একবার কথা বলতে হতে পারে।
– নো প্রবলেম। নিশ্চিন্ত করল গৌতম। – তো আজকে সন্ধ্যেবেলা আপনার প্ল্যান কি? দুপুরে বলছিলেন সৈকতের সাথে কথা বলবেন।আসবেন নাকি একবার এদিকে?
– হ্যাঁ আসব। কিন্তু তার আগে একবার যাব গড়িয়ায়। বিশদ করলেন অনিকেত। – সুরমা সরকারের সাথে একবার কথা বলতে চাই। সেখান থেকে ফেরার পথে ঢুঁ মারব তোমার ওখানে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গৌতম বলল, – ওকে, আমিও আসছি তাহলে। মানে পরিচয় দেবার জন্যে...
– আরে না না! তোমাকে কষ্ট করে আসতে হবে না। বাধা দিয়ে বললেন অনিকেত। – ডোন্ট ওয়রি। আই উইল ম্যানেজ।
– ঠিক আছে! আমি তাহলে এক কাজ করছি, একবার ওঁকে ফোন করে আপনার আসার কথাটা বলে দিচ্ছি। নাছোড়বান্দা হয়ে বলল গৌতম। – ওকে জেঠু! ছাড়ছি তাহলে?
– অ্যাজ ইউ উইশ! চলো, সি ইউ লেটার!
অনিকেতের মনে হলো ফোনটা যেন একটু তাড়াহুড়ো করেই রেখে দিল গৌতম।
***
তৃপ্তি করে চা'টা শেষ করে কাপটা সামনের টেবিলে নামিয়ে রাখলেন অনিকেত। অনেকদিন এরকম ভাল চা খাননি তিনি। সুন্দর একটা ফ্লেভার ছিল সেটাতে। হয়তো এলাচের। কিন্তু শুধু এলাচের জন্যে নয়, বানানোর সময় দুধ, চিনি, চা পাতার সাথে আন্তরিকতা আর যত্নটাও উপযুক্ত পরিমাণে মিশেছে বলেই চায়ের স্বাদটা আরও বেড়ে গেছে।
তাঁর সোফার উল্টো দিকে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন সুরমা। মুখে বয়সের ছাপ পড়লেও লাবণ্য এখনও যায়নি। দেখেই বোঝা যায় যে এককালে বেশ সুন্দরী ছিলেন। তাঁকে দেখে অনিকেতের একটু খারাপই লাগল। কোথায় থাকতে পারতেন সাতমহলা রাজপ্রাসাদের রাজরানী হয়ে। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে আজ রয়েছেন গড়িয়ার ছোট্ট দুই বেডরুমের এই ফ্ল্যাটে। তবে ছোট হলেও পরিপাটি করে সাজানো এই ফ্ল্যাটটার সবকিছুতেই রুচির ছোঁয়া দেখতে পাওয়া যায়। খুবই ছোট ড্রয়িং কাম ডাইনিং রুমটায় একটা টু সিটার সোফা আর একটা ডাইনিং টেবিল রাখার পর জায়গা আর প্রায় নেই বললেই চলে। ফ্রিজটা একটা বেডরুমে যাবার দরজাকে আধাআধি ব্লক করে রাখা। একটা ছোট টি টেবিল। সেটার ওপর সুন্দর হাতে ফেব্রিক করা একটা টেবিলকভার। একটা র্যাকে একটা ফুলদানীর সাথে গীতবিতান, সঞ্চয়িতা আর কিছু অন্যান্য বই সাজিয়ে রাখা। দেওয়ালে ঝোলানো কয়েকটা ফটোফ্রেমে ফ্যামিলি মেম্বারদের কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত বন্দী করে রাখা। দরজার ঠিক ওপরে ঝুলছে একটা মানিপ্ল্যান্ট। সব মিলিয়ে দেখলে বোঝা যায় এই বাড়ির বাসিন্দাদের স্বাচ্ছন্দ্য খুব বেশী না থাকলেও সুখের কোনও অভাব নেই।
তবে অনিকেত যতটা ভেবেছিলেন, আচমকা বিপদে ততটা ভেঙ্গে পড়েননি সুরমা। আসলে আজীবনের এত ঝড়ঝাপটাই হয়তো তাঁর চরিত্রে এই বিপদে অটল থাকার মনোভাবটা এনে দিয়েছে। তাঁর স্থির বিশ্বাস, আগের মতন এই বিপদটাও তাঁরা সামলে নেবেন। এই কথাগুলোই বলছিলেন তিনি অনিকেতকে। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস তাঁর ছেলে এমন কাজ করতেই পারে না। এই শিক্ষা তিনি তাঁর সোনার টুকরো ছেলেকে দেননি। আর তাঁর ছেলে যখন এমন কাজ করেইনি, তখন ভগবান নিশ্চয়ই সৈকতকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করবেন। তিনি জানালেন, সৈকত তাঁকে ছেড়ে বাইরে পড়তে যেতে চায়নি। তিনিই জোর করেন, বলেন এত ভাল সুযোগটা হাতছাড়া করাটা ঠিক হবে না। কিন্তু তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি যে সৈকত মার ওপর যাতে চাপ না পড়ে সে জন্যে বাবার কাছে টাকা চাইতে যাবে। জানলে তিনি এমনটা কখনই হতে দিতেন না।
অনিকেত জিজ্ঞেস করলেন, – অচিন্ত্যর ওপর আপনার রাগ হতো না?
– নাহ! আগে খুব রাগ হতো। কিন্তু আজকাল আর হতো না, বিশ্বাস করুন। ওঁকে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুরমা বললেন, – খালি মনে মনে ভাবতাম এই একটা লোকের জন্যে কতগুলো মানুষ কষ্ট পেল। নিজের কথা বলছি না। আমার তো বয়স হয়েছে, আজ আছি কাল নেই। খারাপ লাগে বাপ্পার জন্যে। বাবা ছিল ওর হিরো। ও যে কতটা কষ্ট পেয়েছে সেটা কেবল আমিই জানি।খারাপ লাগে পিঙ্কির, মানে অরুণিমার জন্যে। কতটুকুই বা ছিল ও যখন আমি বিয়ে করে এসেছিলা!। নয় কি দশ হবে। সদ্য মা মরা মেয়েটা আমাকে মার মতনই দেখত। অচিন্ত্যর সাথে আমার বিচ্ছেদটা মনে মনে মেনে নিতে পারেনি। একটু থেমে আবার যোগ করলেন, – আর খারাপ লাগে তন্ময়ের জন্যে। তন্ময় ঘোষ। নন্দিতার আগের স্বামী। বেচারা। নিজে সাফার করেছি তো, তাই ঘর ভাঙ্গার যন্ত্রণাটা বুঝি। নন্দিতা তো ছিল বোকা। কম বয়স। ওকে দোষ দিই না। আমার মতনই কষ্ট পেয়েছিল তন্ময়। এখন অচিন্ত্য নেই। আশা করি এবার ওরা সুখী হবে।
তাঁর গলার স্বরে এমনই একটা বিষণ্ণতা ছিল যে ঘরে যেন একটা নিস্তব্ধতা নেমে এল।
৭
সকাল সকাল মেজাজটা তেতো হয়ে গেল। এসি মেকআপ ভ্যানে বসে একটা কোক খেতে খেতে এটাই ভাবছিলেন অনিকেত। তিনি এসেছেন টালিগঞ্জের স্টুডিও পাড়াতে শাক্যর সাথে দেখা করতে। শাক্য ছেলেটাকে আগে থেকে বলাই ছিল। তার এখন শুটিং চলছে বলে সে তাঁকে একটু অপেক্ষা করতে বলেছে। হঠাৎ অনিকেতের মনে হলো গৌতমকে একবার সকালে নন্দিতার সাথে যে কথাবার্তা হলো সেই সম্বন্ধে একটু আপডেট করা দরকার। তাই মোবাইলটা বের করে একটা টেক্সট করলেন গৌতমকে। – নন্দিতা টার্নড আপ হসটাইল! ওয়েটিং টু মিট শাক্য।
অথচ এরকমটা হবে আশা করেননি অনিকেত। নন্দিতার সাথে কথা বলার জন্যে পূর্বনির্ধারিত সময় অনুযায়ী পৌঁছে গিয়েছিলেন অচিন্ত্যর বাড়িতে। নন্দিতাও শুটিং পিছিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছিল তাঁর জন্যে। কফি, চানাচুর দিয়ে আপ্যায়নও করেছিল। কথাবার্তা শুরু হয়েছিল স্বাভাবিক সুরেই। নন্দিতাকে দেখে বেশ শোকসন্তপ্ত লাগলেও এর অনেকটাই যে অভিনয় সেটা ধরে ফেলতে অভিজ্ঞ অনিকেতের খুব বেশী সময় লাগেনি।
প্রাথমিক কিছু কথাবার্তার পরে অনিকেত প্রশ্ন করেছিলেন, – আচ্ছা মিসেস সরকার, মূলত যে কারণে আপনার সাথে দেখা করতে আসা, আপনি আপনার জবানবন্দীতে পুলিশকে জানিয়েছিলেন যে বৃহস্পতিবার রাত্রে আপনি সাতটা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত তাজ বেঙ্গলে একটা পার্টিতে ছিলেন। কিন্তু আমরা খবর পেয়েছি যে সেদিন আপনি কিন্তু সারাক্ষণ সেই পার্টিতে ছিলেন না। মাঝে প্রায় এক দেড় ঘণ্টার জন্যে আপনি পার্টি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। আমি জানতে চাই ওই সময়টা আপনি কোথায় ছিলেন?
শোনামাত্র একটু চমকে উঠেছিল নন্দিতা। এতক্ষণ মুখে একটা করুণ হাসি ফুটিয়ে রেখেছিল। নিমেষে সেটা মিলিয়ে গেল। একটু সময় নিয়ে বলল, – আমি জানি না কি করে আপনারা এই খবরটা পেলেন। কিন্তু পেয়েই যখন গেছেন, তখন আমি অস্বীকার করব না। সত্যিই আমি সেদিন পুরোটা সময় ওই পার্টিতে ছিলাম না। কিন্তু আমি বলতে বাধ্য নই সেদিন আমি কোথায় গেছিলাম। আয়্যাম সরি, মিঃ স্যান্যাল।
গম্ভীর গলায় বলেছিলেন অনিকেত, – কিন্তু মিসেস সরকার। আপনি বুঝতে পারছেন না, দিস ইজ আ মার্ডার ইনভেস্টিগেশন। এইব্যাপারে পুলিশকে সাহায্য করাটা আপনার কর্তব্য। অ্যাট লীস্ট আপনার নিজের স্বার্থে।
কোমল মুখটা পাথরের মতো হয়ে গেছিল নন্দিতার। – আমার পার্সোনাল ব্যাপারে কেউ ইন্টারফেয়ার করুক এটা আমি পছন্দ করি না।
– অ্যাজ অ্যা ওয়েল উইশার আপনাকে বলছি, পুলিশের কাছে কিন্তু কিছুই গোপন থাকে না, মিসেস সরকার। আজ না হোক কাল পুলিশ ঠিক খুঁজে বের করবেই সেই সময়টুকু আপনি কোথায় ছিলেন বা কি করছিলেন? ফর ইয়োর ইনফো, তাজ বেঙ্গল থেকে আপনার বাড়িতে আসতে কিন্তু দশ মিনিটও সময় লাগে না। আপনি যতটা সময় অনুপস্থিত ছিলেন, সেটুকু সময়ের মধ্যে খুব সহজেই পার্টি থেকে বেরিয়ে বাড়িতে এসে একটা মার্ডার করে আবার পার্টিতে ফিরে যাওয়া যায়। কঠিন স্বরে বলেছিলেন অনিকেত।
– আপনি এবার আসতে পারেন, মিঃ স্যান্যাল। কেটে কেটে উচ্চারণ করেছিল নন্দিতা।
– কাজটা আপনি ঠিক করলেন না, মিসেস সরকার। পুলিশের সন্দেহের তালিকায় কিন্তু আপনিও আছেন। শাক্যর সাথে আপনার মেলামেশার কথাটা পুলিশ জানে। তাছাড়া পুলিশ এটাও জানে যে আপনি প্রেগন্যান্ট। এবং সেটা এমন এক সময় যখন আপনার স্বামী দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে ছিলেন। দিস ক্যান বি আ পোটেনশিয়াল মোটিভ ফর দিস মার্ডার। গলাটা যথাসম্ভব নরম করে বলেছিলেন অনিকেত, – আমি আপনাকে সাহায্য করতেই এসেছিলাম। আমাকে সব কথা খুলে বললেই ভাল করতেন।
বলে গট গট করে অনিকেত বেরিয়ে এসেছিলেন। পিছনের দিকে আর ফিরেও তাকাননি। তাকালে দেখতে পেতেন দুহাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল নন্দিতা। সেটা ছিল সত্যিকারের কান্না। কোনও অভিনয় ছিল না তাতে।
অনিকেতের চিন্তাস্রোতে বাধা পড়ল। দরজা ঠেলে ভ্যানে ঢুকল একটি বছর সাতাশ আঠাশের ছেলে। ছ ফিটের কাছাকাছি হাইট।পেশীবহুল সুঠাম শরীরে একফোঁটা অতিরিক্ত মেদ নেই। দেখলেই বোঝা যায় নিয়মিত জিম করে। কালো রঙের একটা স্কিন টাইট টি-শার্ট আর ফেডেড জিনস পড়া। পায়ে সাদা স্নিকার্স। ঘাড় অব্দি লম্বা চুলে ভরা মাথায় একটা ব্যান্ডানা। গ্রীক দেবতাদের মত ফর্সা সুন্দর মুখে মিষ্টি একটা হাসি। হাত বাড়িয়ে দিয়ে করমর্দন করে বলল, – হাই মিঃ স্যান্যাল। আয়্যাম শাক্য। সরি আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হলো।
বেশী কথা বলার মুডে ছিলেন না অনিকেত। হ্যান্ডশেক করে ভণিতা ছেড়ে সরাসরি তাকে প্রশ্ন করলেন নন্দিতার সাথে তার সম্পর্কের ব্যাপারে। কিন্তু তাঁকে অবাক করে কোনও রকম লুকোছাপার মধ্যে দিয়ে গেল না শাক্য। গাঢ় স্বরে বলল, – ওহ ইয়েস! আপনি ঠিকই শুনেছেন। উই লাভ ইচ আদার! নন্দিতা আর আমি একে অপরকে ভালোবাসি। উই আর গোইং টু গেট ম্যারেড সুন।
আশ্চর্য হয়ে গেলেন অনিকেত ছেলেটার আত্মবিশ্বাস দেখে। বয়সে নন্দিতার থেকে ছোটই হবে, তার ওপরে নন্দিতা কয়েকদিন আগেও বিবাহিত ছিল। তাও কেমন অবলীলায় স্বীকার করে নিল সম্পর্কের কথাটা। অচিন্ত্য মারা গেছে বলেই কি সে এই সাহসটা দেখাতে পারছে? বাঁকা সুরে বললেন, – তাহলে তো অচিন্ত্যবাবু মারা যাওয়ায় আপনাদের বেশ সুবিধেই হলো। তাই না? তিনি বেঁচে থাকলে তো এই সম্পর্কটা মেনে নিতেন না।
– আই অ্যাম সরি স্যার! ইউ আর রং হিয়ার। মৃদু হেসে জবাব দিল শাক্য, – উনি বেঁচে থাকলেও আমাদের কিছু এসে যেত না।
– ওহ রিয়্যালি? আপনি কি বলতে চাইছেন অচিন্ত্যবাবু তাঁর স্ত্রীর এই অবৈধ সম্পর্কটা এক কথায় মেনে নিয়ে তাঁকে ডিভোর্স দিয়ে দিতেন যাতে আপনারা বিয়ে করে বাকী জীবনটা সুখে শান্তিতে কাটাতে পারেন? অনিকেতের গলায় ব্যঙ্গ ঝরে পড়ল।
– ডিভোর্স! বাট হোয়াই? শাক্যও কিছু কম যায় না। – ডিভোর্সের প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে? কোন অধিকারে অচিন্ত্য নন্দিতাকে ডিভোর্স দেবে?
ছেলেটার স্পর্ধা দেখে রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিল অনিকেতের। গলাটা সামান্য চড়ালেন তিনি – তার মানে?
– গেট ইয়োর ফ্যাক্টস স্ট্রেট, স্যার। অচিন্ত্য আর নন্দিতা কোনদিনই স্বামী স্ত্রী ছিল না। দে ওয়্যার জাস্ট লিভিং টুগেদার। শাক্য প্রাঞ্জল করল। – স্কাউন্ড্রেলটা নন্দিতাকে খালি ইউজ করত। আর কিছুই নয়।
প্রচণ্ড একটা ঝটকা খেলেন অনিকেত। ব্যাপারটা হজম করতে একটু সময় লাগল তাঁর। বললেন, – কি বলছেন কি আপনি? আর ইউ শিয়োর?
– ইয়েস স্যার। আই অ্যাম হান্ড্রেড পারসেন্ট শিয়োর। ওদের কোনওদিনই বিয়ে হয়নি। না আইনত না ধর্মীয়। এতক্ষণে খুলে বলল শাক্য। –স্রেফ মিডিয়া যাতে নতুন করে স্ক্যান্ডাল না করে, তাই চোখে ধুলো দেবার জন্যে ওরা এই নাটকটা চালাত। অবশ্য নন্দিতা বার বার রিকোয়েস্ট করত বিয়ে করে নেবার জন্যে। কিন্তু বুড়োটা কিছুতেই শুনত না। এই নিয়েই তো ওদের মধ্যে যত ঝামেলা।
– এই ব্যাপারটা আর কে কে জানে? গলার স্বরটা নরম হলো অনিকেতের।
– আমি যদ্দূর জানি, দিস ওয়াজ আ ওয়েল কেপ্ট সিক্রেট। এমনকি ওদের বাড়ির লোকেরাও জানে না। নন্দিতা খালি আমাকেই জানিয়েছে। বুঝতেই পারছেন...। কথাটা শেষ করল না শাক্য।
– কিছু মনে না করলে একবার বলবেন কি আপনার সাথে নন্দিতার সম্পর্কটা ঠিক কতদিন হলো শুরু হয়েছে?
একটু ভেবে উত্তর করল শাক্য, – হুম্... তিন মাস... না না চার মাস হবে। এই তো এই ছবিটার কন্ট্রাক্টে সাইন করার জাস্ট আগে।
তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন অনিকেত। তাঁর চোখদুটো উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। বললেন, – থ্যাঙ্কস অ্যা লট, শাক্য। আপনার সাথে আরও কিছু কথা ছিল। কিন্তু আমাকে একটা খুব জরুরী কাজে এক্ষুনি বেরোতে হবে। আমি আপনাকে পরে কল করে নেব। বলে হতভম্ব শাক্যকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সটান দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন ভ্যান থেকে।
***
পয়লা মে তে সব অফিস কাছারি বন্ধ থাকলেও পুলিশের কোনও ছুটি নেই। তার ওপর যাচ্ছেতাই গরমও পড়ে গেছে। এসিটা চলা সত্ত্বেও ঘাম হচ্ছিল গৌতমের। অচিন্ত্যর কেসটা যে কোন দিকে গড়াচ্ছে, ভেবে পাচ্ছিল না সে। ওপরমহল থেকে ক্রমাগত চাপ এসে যাচ্ছে। কাল অনিকেত এসেছিলেন সৈকতের সাথে দেখা করতে। সে চায় না অনিকেতের কাছে তার আর সৈকতের আত্মীয়তার সম্পর্কটা প্রকাশ হয়ে যাক। অনিকেত তাকে একজন বায়াস্ড পুলিশ অফিসার মনে করুন, এটা সে মেনে নিতে পারবে না। যদি মুখ ফস্কে সৈকত তার ব্যাপারে কিছু বলে দেয়, এই ভয়ে সে অনিকেতের সাথে সৈকতের সামনে যায়নি। একই কারণে কাল অনিকেত সুরমার সাথে দেখা করতে যাবার আগে সে তার মাসী শ্বাশুড়ীকে ফোন করে তার সম্বন্ধে কিছু বলতে বারণ করে দিয়েছিল। রাতে আবার ফোন করে নিঃসন্দেহ হয়েছে যে সুরমা অনিকেতের কাছে গৌতমের কথা চেপে গেছেন। কিন্তু সৈকতের সাথে কাল বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছেন অনিকেত। বেরনোর পর সে অনিকেতকে জিজ্ঞেস করেছিল, কিন্তু অনিকেত এড়িয়ে গেছেন। কি কথাবার্তা হলো কিছুই জানাননি। কি যে ওঁর মাথায় ঘুরছে খোলসা করে কিছুই বলছেন না। ফলে গৌতমের টেনশন আরও বাড়ছে। তার ওপর একটু আগে মেসেজ করলেন যে নন্দিতা নাকি তাঁর সাথে সহযোগিতা করেনি। তাহলে কি নন্দিতাকে একবার থানায় ডেকে পাঠাবে? থানায় এলে আর কোনও জারিজুরি খাটবে না ম্যাডামের। কথায় বলে না, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, কিন্তু পুলিশে ছুঁলে...
হঠাৎ বুকপকেটে রাখা মোবাইলটা বেজে উঠল। কে করছে একবার দেখে নিয়ে ফোনটা ধরে বলল, – হ্যাঁ জেঠু! বলুন। কথা হলো শাক্যর সাথে?
উল্টো দিকে অনিকেত এক নিঃশ্বাসে যা যা বলে গেলেন মন দিয়ে শুনল সে। কিন্তু কিছুই বুঝল না হঠাৎ করে এরকম নির্দেশ কেন দিলেন অনিকেত। কখন যে কি ওঁর মাথায় চাপে, ভগবানই বোধ হয় ভাল বলতে পারবেন। ফোনটা রেখে দিয়ে সাবঅর্ডিনেট প্রকাশকে ডেকে বলল, – প্রকাশ, তাড়াতাড়ি অচিন্ত্য সরকারের ফাইলটা নিয়ে এস। একটা ঠিকানা খুঁজে বের করতে হবে। আর হ্যাঁ, ইমরানকে বল গাড়ীটা বের করতে। এক্ষুনি বেরতে হবে। কুইক!
***
গৌতমের সাথে কথা শেষ করে পার্কিং লটে নিজের গাড়ীতে বসেই অনিকেত আরেকটা ফোন করলেন দিল্লীতে তাঁরই এক পুরনো সহকর্মীকে। খুব তাড়াতাড়ি একটা ইনফর্মেশন চাই তাঁর। আর তাড়াতাড়ি ইনফর্মেশন বের করতে ভারতবর্ষের যে কোনও পুলিশ ডিপার্টমেন্টের থেকে সিবিআই অনেক বেশী দক্ষ। খুব সংক্ষেপে দরকারি নির্দেশগুলো দিয়ে তিনি তাড়াতাড়ি গাড়ীটা বের করলেন। সময় একেবারেই বেশী নেই তাঁর হাতে। মোবাইলটায় একটা শব্দ হতে পকেট থেকে বের করে দেখলেন গৌতম নির্দেশমত টেক্সট করে পাঠিয়ে দিয়েছে ঠিকানাটা। ঠিকানার দিকে গাড়ী চালাতে চালাতে মনে মনে একবার ভেবে নিলেন সবটা। হ্যাঁ, সবই খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। শুধু বাকী রয়েছে একটাই তথ্য। যেটা জানার জন্যে তাঁর প্রাক্তন দপ্তরের সাহায্য নিতে হলো। এই খবরটা পেয়ে গেলেই জিগ্ স পাজলের শেষ টুকরোটা তাঁর হাতে এসে যাবে এবং যবনিকা পড়বে অচিন্ত্য সরকারের মৃত্যুরহস্যে।
তাঁর মনে এতদিন ধরে যে খটকাটা ছিল সেটা দূর হয়েছে। খটকা না বলে সম্ভাবনা বলাটাই বেশী ভাল। কিন্তু এই সম্ভাবনাটা আগেই তাঁর মাথায় আসা উচিত ছিল। তাঁর অবচেতন মন তাঁকে একটা হিন্টও দিয়েছিল স্বপ্নে। কিন্তু তখন তিনি সেটা ধরতে পারেননি। সত্যি ব্রেনে মরচে পড়ে যাচ্ছে। ব্রাহ্মীশাক খেতে হবে তাঁকে। কোথাও একটা পড়েছিলেন যে ব্রাহ্মীশাক খেলে নাকি মাথা পরিস্কার হয়।
সপ্তাহের মাঝে ছুটির দিন। রাস্তাঘাট তাই ফাঁকা। বেশীক্ষণ লাগার কথা নয় গন্তব্যে পৌঁছতে। ফাঁকা রাস্তায় আধঘণ্টাতেই পৌঁছে যাওয়া উচিত। বড়জোর পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে। কিন্তু রবীন্দ্র সদনের কাছে এসে দেখলেন কোনও একটা রাজনৈতিক দলের সভা ও মিছিলের জন্যে রাস্তা বন্ধ। মনে মনে প্রচণ্ড বিরক্ত হলেন অনিকেত। এখন গাড়ী ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা ধরে যেতে হবে। আরও মিনিট পনের সময় বেশী লাগবে পোঁছতে। তবে লালবাতি লাগানো গাড়ীতে করে গৌতম নিশ্চয়ই আগে পৌঁছে যাবে। এই ভেবে কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন।
আরও কিছুদূর এগোনোর পরে যে ফোনটার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন সেটা এসে গেল। গাড়ীটা একটু সাইড করে রেখে রিসিভ করলেন কলটা। হ্যাঁ! তিনি যা ভেবেছিলেন তাই। নিজেরই নিজের পিঠ চাপড়াতে ইচ্ছে করল তাঁর। কিন্তু সেটা না করে চাপ বাড়ালেন অ্যাক্সিলারেটরে।
গৌতমের পাঠানো ঠিকানা অনুযায়ী একতলা বাড়িটার সামনে এসে দেখলেন প্রচুর ভিড় বাইরে। কিছু পুলিশও নজরে এল। সবার দৃষ্টি বাড়ির দিকে। গাড়ীটা রাস্তার পাশে একটু ছায়ায় পার্ক করে ঢুকতে গেলেন বাড়িতে। কিন্তু গেটে পাহারারত পুলিশটা বাধা দিল তাঁকে। কি হয়েছে আবার এখানে? একটা অজানা আশঙ্কায় মনটা দুলতে লাগল। মোবাইলটা বের করে কল করলেন গৌতমকে। রিং হচ্ছে। কিন্তু সে ধরছে না। সে কি পৌঁছয়নি এখনও?
না! ওই তো ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে গৌতম। ফোনটা তার হাতে বেজেই চলেছে। অনিকেত কেটে দিলেন ফোনটা। গৌতমের মুখটা থমথমে। কাছে আসতেই তিনি উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, – কি হয়েছে গৌতম? এনিথিং রং?
হতাশ ভাবে উত্তর দিল গৌতম, – আই অ্যাম সরি জেঠু! আমাদের দেরী হয়ে গেছে।
– তার মানে? অনিকেতের গলাটা প্রায় চিৎকারের মতো শোনাল।
– তন্ময় ঘোষ কাল রাতে মারা গেছে। যতটা সম্ভব শান্ত গলায় বলল গৌতম, – হি ইজ ডেড!
৮
রিস্টওয়াচে আরেকবার সময়টা দেখল গৌতম। বারোটা বেজে সাত। এখনও এসে পৌঁছননি অনিকেত। বলেছিলেন বারোটার মধ্যে এসে যাবেন। দশ মিনিট আগে একবার ফোন করেছিল সে। তখন বলেছিলেন যে ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে পড়েছেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে চলে আসবেন। এদিকে সবাই অধৈর্য হয়ে উঠছে। অপেক্ষা করছে তাঁর জন্যে।
অনিকেতের কথামতো সবাইকে ডাকা হয়েছে আজ অচিন্ত্যর বাড়িতে। পুলিশের ডাক অগ্রাহ্য করতে না পেরে প্রত্যেকে আসতে বাধ্য হয়েছে বটে, কিন্তু তাদের হাবেভাবে অসন্তোষ প্রকাশ পাচ্ছে। নন্দিতা আর শাক্য তাদের শুটিং ফেলে উপস্থিত। সোফায় বসে সিগারেট ধরিয়ে একটা ম্যাগাজিন পড়ছে শাক্য। মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। পাশে বসে নন্দিতা। একটা রুমালে কিছুক্ষণ পরপর চোখ নাক মুছছে। সর্দি না কান্না বোঝা যাচ্ছে না। অরুণিমাও চলে এসেছে হাসপাতাল থেকে একবেলার ছুটি নিয়ে। কেশব বাড়িতেই ছিল। সৈকতকেও আনা হয়েছে। একটা চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে কি যেন ভাবছে। সুরমা সরকারকেও আসতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বলেছেন যে তিনি পুলিশকে সাহায্য করতে সবসময়ই রাজী। কিন্তু যে বাড়ি থেকে একদিন স্বেচ্ছায় বেড়িয়ে এসেছিলেন, সেখানে নিতান্ত বাধ্য না হলে আর ঢুকবেন না। এই শুনে অনিকেত তাঁকে অব্যাহতি দিয়েছেন। এরা ছাড়াও কয়েকজন লালবাজারের অফিসারও রয়েছেন। মুখে উদাসীনভাব দেখালেও বোঝা যাচ্ছে প্রত্যেকেই মনে মনে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন।
এমন সময় বাইরে একটা গাড়ীর শব্দ হতে গৌতম জানলা দিয়ে দেখল অনিকেত ঢুকছেন। আজ ড্রাইভার নিয়ে এসেছেন। পোর্টিকোতে গাড়ী থেকে নেমে ড্রাইভারকে কিছু নির্দেশ দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলেন বাড়ির ভিতরে। এসেই অপরাধীর মতো মুখ করে বললেন, – আই অ্যাম এক্সট্রীমলি সরি! ট্র্যাফিকে ফেঁসে গিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ আপনাদের অপেক্ষা করতে হলো।
প্রত্যেকে তেতো পাচন গেলা মুখে হাসল। তারপর গৌতম বলল, – আগেই বলা হয়েছে আপনাদের এখানে একসাথে ডাকা হয়েছে একটা গুরুত্বপূর্ণ অ্যানাউন্সমেন্ট করা হবে বলে। ধন্যবাদ সবাইকে আপনাদের মুল্যবান সময় ব্যয় করে আসার জন্যে। বলে অনিকেতের দিকে ফিরে বলল, – দ্যা স্টেজ ইজ ইয়োরস, স্যার! প্লিজ প্রসীড।
ঘরের মাঝখানে এসে একটা গলা খাঁকারি দিয়ে অনিকেত শুরু করলেন, – আপনারা সবাই জানেন, ঠিক এক সপ্তাহ আগে গত বৃহস্পতিবার এই বাড়িতে বাড়ির মালিক অচিন্ত্য সরকারকে হত্যা করা হয়। লালবাজার এই খুনের তদন্ত শুরু করে। তদন্ত চলাকালীন গতকাল আরেকটি আনফর্চুনেট ঘটনা ঘটে। আপনারা খবরের কাগজে হয়তো পড়ে থাকবেন, মিসেস নন্দিতা সরকারের প্রাক্তন স্বামী তন্ময় ঘোষ গতকাল তাঁর বাড়িতে আত্মহত্যা করেন। তাঁর হাতের শিরা কাটা ছিল। একটি সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে। নোট বলাটা হয়তো ঠিক হবে না, কারণ তাঁর মাথার কাছে ল্যাপটপে একটা ওয়ার্ড ডকুমেন্ট ওপেন অবস্থায় পাওয়া গেছে। তাতে তন্ময় লিখে গেছেন যে তাঁর মৃত্যুর জন্যে কেউই দায়ী নয়। জীবনের প্রতি হতাশা থেকে তিনি সুইসাইডের পথ বেছে নিচ্ছেন।
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে অনিকেত একটু থামলেন। একবার চোখ বোলালেন প্রত্যেকের মুখের দিকে। সবাই এক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে। খালি নন্দিতা দুটো আঙ্গুল দিয়ে চোখ দুটো চেপে বসে আছে। আবার শুরু করলেন অনিকেত, – যাই হোক, আপনারা জেনে খুশী হবেন যে পুলিশের তদন্ত শেষ হয়েছে এবং অচিন্ত্য সরকারের হত্যাকারীকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ঘরে একটা অস্ফুট গুঞ্জন শুরু হয়েই থেমে গেল। সেদিকে নজর না দিয়ে অনিকেত বলতে থাকলেন, – যে কোনও ইনভেস্টিগেশনে পুলিশের সবচেয়ে বেশী সুবিধে হয় যদি তদন্তের সাথে জড়িত প্রত্যেকে সত্যি কথা বলেন। সত্যি মানে ‘ট্রুথ, দ্যা হোল ট্রুথ অ্যান্ড নাথিং বাট দ্যা ট্রুথ’। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই ক্ষেত্রে কেউই ‘নাথিং বাট দ্যা ট্রুথ’ বলেননি। পুলিশের কাছে প্রত্যেকেই কিছু না কিছু সত্য গোপন করেছেন। কেউ করেছেন ইচ্ছাকৃত ভাবে, কেউ বা করেছেন পরিস্থিতির চাপে বা ভয়ে।
ঘরে তখন একটা পিন পড়লে তারও শব্দ শোনা যাবে এমন নিস্তব্ধতা। অনিকেত ফিরলেন সৈকতের দিকে, – সত্য গোপনকারীদের তালিকায় প্রথমেই আসছে সৈকতের কথা। সে পুলিশকে জানিয়েছিল যে সেদিন সে দ্বিতীয়বার বাড়িতে ঢুকেছিল। এমনকি সিঁড়ি দিয়ে দোতলাতেও উঠেছিল। কিন্তু অচিন্ত্যর শোবার ঘরে ঢোকেনি। এতে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় যে সে ক্ষেত্রে তার লাইটার অচিন্ত্যর শোবার ঘরে এল কি করে? পরশু আমি লক আপে সৈকতের সাথে দেখা করি। আমার মনে হয়েছিল সে ভয় পেয়ে রয়েছে। তাকে আমি অভয় দেই। সত্যি কথা বললে তাকে আমি বাঁচাব এমন প্রতিশ্রুতিও দেই। সৈকতকে ধন্যবাদ, সে তখন আমার কাছে সব কথা খুলে বলে। অ্যাম আই রাইট, সৈকত?
ঘরে সবার চোখ ঘুরে এখন সৈকতের দিকে। সৈকত নীরবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। অনিকেত আবার শুরু করলেন, – সৈকতের সাথে আমার কথাবার্তা অনুযায়ী সেদিন সৈকত কি কি করেছিল সেটা আমি নিজের বয়ানে বলছি। সৈকত, আমার কোথাও ভুল হলে শুধরে দিও। অচিন্ত্য সৈকতের সাথে দুর্ব্যবহার করে ওকে বের করে দেবার পর সৈকত বাগানে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সিগারেট খায়। তারপরে মাথা ঠাণ্ডা হলে বাবার সাথে আবার কথা বলবে বলে বাড়িতে ঢোকে। ঠিক এই সময় কারেন্ট চলে যায়। প্রথমে সে স্টাডিরুমে বাবাকে খোঁজে। সেখানে অচিন্ত্যকে না পেয়ে সে আন্দাজ করে নেয় বাবা দোতলায় নিজের শোবার ঘরে আছেন। তাই সে দোতলায় ওঠে। বাবার ঘর অব্দি এসে পৌঁছে দরজার সামনে সে একটা অদ্ভুত গন্ধ পায়। ক্লোরোফর্মের গন্ধ। তার সন্দেহ হয়। সে বাবাকে এক দুবার ডেকে সাড়া না পেয়ে নিজের মোবাইলটা বের করে পকেট থেকে এবং মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইটে দেখে তার বাবা প্রাণহীন অবস্থায় বিছানায় পড়ে। সে ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সে ভাবে এই অবস্থায় সবাইকে জানালে প্রত্যেকে তাকেই সন্দেহ করবে। সে ভেবেছিল তাকে দ্বিতীয়বার ঘরে ঢুকতে কেউ দেখেনি। তাই এখন চুপচাপ বাড়ি থেকে চলে গেলেই তার ওপরে আর কারোর সন্দেহ হবে না। এই ভেবে সে কাউকে কিছু না জানিয়ে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। সৈকতের সাথে কথা বলে আমি দুটো জিনিস জানতে পারি। প্রথমটা আমার আন্দাজ, বাবার ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যখন সে পকেট থেকে মোবাইল বের করছিল তখন অসতর্কতায় তার লাইটারটা মাটিতে পড়ে যায়। আর দুই নম্বরটা সৈকত আমাকে জানায় যে সে যখন বাবার মৃতদেহটা দেখে কি করবে ভাবছে, ঠিক তখনই কারেন্ট চলে আসে। বাকি সব ঘর বা করিডোরে আলো জ্বলে উঠলেও অচিন্ত্যর ঘর কিন্তু তখনও অন্ধকার ছিল। কি সৈকত ঠিক বললাম তো?
সৈকতের সম্মতি পেয়ে অনিকেত বলতে থাকলেন, – অথচ জবানবন্দীতে রাখালের মা জানিয়েছে যে রাত দশটার সময় সে ঘরে না ঢুকেই দরজার বাইরে থেকেই অচিন্ত্যর ডেডবডিটা দেখতে পায়। তার মানে যখন রাখালের মা অচিন্ত্যর মৃতদেহ আবিষ্কার করে, তখন অচিন্ত্যর ঘরে আলো জ্বলছিল। এই দুজনের বক্তব্য থেকে এটাই বোঝা যাচ্ছে যে সেদিন সৈকত আর রাখালের মার মাঝখানে আরেকজন কেউ অচিন্ত্যর ঘরে ঢুকেছিল।
ঘরে যেন একটা বোমা পড়ল। এক দুই সেকেন্ড প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের হতবাক অবস্থাটা যেন উপভোগ করলেন অনিকেত। তারপর হঠাৎ কেশবের দিকে ফিরে বললেন, – আচ্ছা কেশববাবু, আপনার পা যে কেটে গিয়েছিল, সেটা সেরে গেছে?
আচমকা এই প্রশ্নের জন্যে তৈরি ছিল না কেশব। নিজের অজান্তেই বাঁ পাটা একটু কাছে টেনে নিয়ে বলল, – অ্যাঁ! পা! মানে...কি, কি বলছেন ঠিক...
– না, মানে পরশু দিন যখন আপনার সাথে দেখা হলো, দেখলাম আপনি ফিট ফাট হয়ে ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছেন। ফরম্যাল শার্ট, ফরম্যাল প্যান্ট, অথচ পায়ে চামড়ার চটি। কৌতূহল হওয়ায় ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম আপনার বাঁ পায়ে একটা ব্যান্ড-এড লাগানো। আজ আবার দেখছি সেটা নেই। তাই জিজ্ঞেস করলাম যে, কাটাটা কি সেরে গেছে এখন? বিশদ করে বোঝালেন অনিকেত।
– ও... হ্যাঁ হ্যাঁ! সেরে গেছে। হড়বড় করে বলল কেশব।
– বাঃ খুব ভাল। তা কেশববাবু পরশুদিন আপনি তো ইন্টারভিউ দিতে যাননি। আপনি গিয়েছিলেন ব্যাঙ্কে। আপনার স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা করতে, ঠিক কিনা? আরেকটা বোমা ফাটালেন অনিকেত, – উঁহু! অস্বীকার করার চেষ্টা করবেন না। ব্যাঙ্কের সিসিটিভি ক্যামেরায় আপনাকে পরিস্কার ভাবে সনাক্ত করা হয়েছে। তা কেশববাবু, আপনি তো মাসে বারো হাজার টাকা মাইনে পেতেন। তাহলে পঞ্চাশ হাজার একসাথে... ঠিক বুঝলাম না। রিসেন্টলি কি আপনি কোনও লটারিতে টাকা পেয়েছিলেন?
কেশবের মুখটা ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আমতা আমতা করে কোনও মতে বলল, – আপনি কি বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
– বুঝতে পারছেন না! ওকে! আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। কঠিন স্বরে বললেন অনিকেত, – গত বৃহস্পতিবার, সৈকত দ্বিতীয়বার বাড়ি থেকে চলে যাবার পরে আপনি অচিন্ত্যর ঘরে ঢুকেছিলেন। আপনার ঘরটা অচিন্ত্যবাবুর ঘরের ঠিক নীচে। তার ঘরে গ্লাস ভাঙ্গার আওয়াজ আপনি পেয়েছিলেন। পরে কারেন্ট আসার পরে সৈকতকে সিঁড়ি দিয়ে নামতেও দেখেছিলেন। আপনার মনে কৌতূহল সৃষ্টি হয়। আপনি ওপরে যান কি হয়েছে দেখতে আর তখন অচিন্ত্যবাবুর মৃতদেহটা আবিষ্কার করেন। আপনার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি জেগে ওঠে। পার্সোনাল ম্যানেজার হিসেবে আপনি অচিন্ত্যর সব ট্র্যানজ্যাকশনের খবর রাখতেন। সেই সূত্রে বাড়িতে যে আশি হাজার টাকা রাখা আছে সেটা আপনার জানাছিল। আলমারির চাবি কোথায় রাখা থাকত, সেটাও আপনি জানতেন। লোভ সামলাতে না পেরে অচিন্ত্যর মৃত্যুর সুযোগ নিয়ে আপনি সেদিন টাকাগুলো চুরি করেন।
– কি উল্টোপাল্টা কথা বলছেন স্যার! আমি ওইদিন স্যারের ঘরে ঢুকিইনি! মিনমিনে শোনাল কেশবের গলাটা।
– আর একটাও মিথ্যে কথা বলবেন না, কেশববাবু। গর্জে উঠলেন অনিকেত, – সেদিন যদি আপনি অচিন্ত্যর ঘরে নাই ঢোকেন তাহলে ওঁর ঘরের পাপোশে আপনার রক্তের দাগ এল কি করে? শুধু সেটাই নয়, করিডোরে ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে অচিন্ত্যর গ্লাসের একটা ভাঙ্গাকাঁচের টুকরোও পাওয়া গেছে, যেটাতে আপনার রক্ত আর হাতের ছাপ রয়েছে। সেদিন আলমারি থেকে টাকা আর গয়না সরিয়ে ফেরার সময় অসতর্ক ভাবে একটা গ্লাসের টুকরোতে আপনার পা কেটে যায়। আপনি বেখেয়ালে সেই পা মোছেন পাপোশে এবং গ্লাসের টুকরোটি হাতে করে নিয়ে ফেলেন বাইরের ময়লা কাগজের বাস্কেটে। আর সেই কারণেই ইন্টারভিউ দিতে যাবার সময় শু না পরে চামড়ার চটি পড়তে বাধ্য হন। তারপরে সব থেকে বড় ভুলটা করেন চুরি করা আশি হাজার টাকার মধ্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা আপনার স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে ডিপোজিট করতে গিয়ে। আপনি হয়তো জানতেন না যে পুলিশ আপনার এবং আপনার সব ক্লোজ রিলেটিভদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট মনিটর করছে। তবে গয়নাগুলো মনে হয় এখনও সরাতে পারেননি। আমি শিয়োর যে আপনার ঘর সার্চ করলে গয়নাগুলো আপনার ঘরেই পাওয়া যাবে।
এবার ভেঙ্গে পড়ল কেশব। হাউ মাউ করে কেঁদে উঠে বলল, – আমার ভীষণ ভুল হয়ে গেছে স্যার। লোভে পড়ে পাপ করে ফেলেছি। আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমি স্বীকার করছি, আমি সেদিন স্যারের ঘরে ঢুকেছিলাম। চুরি আমিই করেছি। কিন্তু স্যার, মায়ের দিব্যি গেলে বলছি খুন আমি করিনি।
কড়া গলায় বললেন অনিকেত, – ক্ষমা করার আমি কেউ নই, কেশববাবু। খুন হয়তো আপনি করেননি, কিন্তু একটা মস্ত বড় অপরাধ আপনি করেছেন। শুধু তাই নয়, বেরোনোর সময় সৈকতের লাইটারটা দরজার বাইরে পড়ে থাকতে দেখে সেটা রুমালে চেপে আলমারির সামনে রেখে এসে জেনে শুনে একজন নিরপরাধীকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতেও আপনি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। আমার কাজ ছিল আপনাকে ধরিয়ে দেওয়া, এবার আপনার বিচার করবে মহামান্য আদালত।
গৌতমের ইশারায় একজন অফিসার এগিয়ে এসে কেশবকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ঘরে উপস্থিত সবার বিহ্বলতা কাটতে একটু সময় লাগলো। শেষ পর্যন্ত নীরবতা ভঙ্গ করে শাক্য বলল, – তাহলে অচিন্ত্যকে খুনটা করল কে?
শান্ত গলায় ঘোষণা করলেন অনিকেত, – অচিন্ত্যকে খুন করেছে তন্ময় ঘোষ।
এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনে যাচ্ছিল নন্দিতা। এবার ঝাঁঝিয়ে উঠল, – কি বলছেন যা তা? তন্ময় সেদিন গৌহাটি যাচ্ছিল। সে নিজে আমাকে বলেছে। তাছাড়া পুলিশ...
– যাচ্ছিল। কিন্তু যায়নি। নন্দিতা শেষ করার আগেই বাধা দিলেন অনিকেত। – দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে মিসেস সরকার। তন্ময় সেদিন গৌহাটি যাবে বলে ট্রেনে উঠেছিল। হাওড়া থেকে ট্রেন ছাড়ে বিকেল তিনটে পঞ্চাশ মিনিটে। ফার্স্ট স্টপেজ বর্ধমানে পৌঁছয় পাঁচটা চারে। তন্ময় বর্ধমানে ট্রেন থেকে নেমে পড়ে। তারপরে ন্যাশনাল হাইওয়ে টু ধরে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা লাগে তার কলকাতা ফিরতে। কলকাতায় ফিরে সে কৌশলে এই বাড়িতে ঢোকে। অচিন্ত্যর ঘরের পিছনে যে কৃষ্ণচূড়া গাছটা আছে সেটা বেয়ে দোতলার কার্নিশে ওঠে। তার কাছে অচিন্ত্যর ব্যালকনির ফায়ার এস্কেপে যে তালাটা লাগানো থাকে, সেই তালার ডুপ্লিকেট চাবি ছিল। তালা খুলে সে অন্ধকারে ব্যালকনিতে লুকিয়ে থাকে। তারপর অচিন্ত্য যখন সৈকতের সাথে ঝগড়া করে ওপরে চলে আসে, তখন সুযোগ বুঝে তাকে ক্লোরোফর্ম করে হত্যা করে। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললেন অনিকেত।
– কিসের ভিত্তিতে কথাগুলো বলছেন আপনি? এবার প্রশ্ন অরুণিমার। – সে যে কলকাতা ফিরে এসেছিল, এমন কোনও প্রমাণ আছে কি আপনাদের কাছে?
– একটা নয়, অনেকগুলো প্রমাণ আছে, মিস সরকার! অরুণিমার দিকে ফিরলেন অনিকেত। – যেমন সেদিন কলকাতায় ঢোকার সময় সন্ধ্যে ছটা তেত্রিশ নাগাদ ডানকুনি টোল প্লাজার সিসিটিভি ক্যামেরায় তাকে সনাক্ত করা গেছে। তাছাড়া প্রত্যেক দিন সকাল সাড়ে ছটায় ইন্ডিগোর একটা মর্নিং ফ্লাইট কোলকাতা থেকে গৌহাটি যায়। ছাব্বিশে এপ্রিল, মানে অচিন্ত্য সরকারের মৃত্যুর পরের দিন ওই ফ্লাইটে যে যে প্যাসেঞ্জার গৌহাটি গিয়েছিল, তাদের মধ্যে তন্ময় ঘোষের নামটাও পুলিশ খুঁজে বের করেছে।
– বেশ! মেনে নিলাম সে কোনও কারণে কলকাতায় ফিরে এসেছিল। সহজে মেনে নেবার পাত্রী নয় অরুণিমা। – কিন্তু এতে তো এটা প্রমাণ হয় না যে তন্ময়ই দাদাকে খুন করেছে।
– হ্যাঁ, তা ঠিক। অনিকেতের পাল্টা জবাব। – কিন্তু পুলিশ তন্ময়ের বাড়ি সার্চ করে অচিন্ত্যর ঘরের ব্যালকনির ফায়ার এস্কেপে যে তালাটা লাগানো ছিল, তার ডুপ্লিকেট চাবিটা খুঁজে পেয়েছে। এছাড়া যে ছুরিটা দিয়ে তন্ময় নিজের হাতের শিরা কেটেছে, সেই একই ছুরি দিয়ে সে অচিন্ত্যকে হত্যা করে। ছুরিতে অচিন্ত্যর ডিএনএ-র নমুনা পাওয়া গেছে।
– কিন্তু গেটে সিকিউরিটির নজর এড়িয়ে সে বাড়িতে ঢুকল বা বেরলো কি করে? শাক্যর বিস্ময় যেন কাটছেই না।
– ভাল প্রশ্ন! আগে বেরনোরটা বলি। অনিকেত বিশ্লেষণ করলেন, – অচিন্ত্যকে মারার পর তন্ময় আবার যে পথে ঘরে ঢুকেছিল সেই পথেই বেরিয়ে যায়। বেরনোর সময় খেয়াল করে ফায়ার এস্কেপের তালাটাও লাগায়। এরপরে সে জেনারেটর রুমে গিয়ে মেন লাইনের সার্কিট ব্রেকারটা ট্রিপ করে দেয়। ফলে সমস্ত বাড়ির কারেন্ট চলে যায় আর সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা জগন্নাথ জেনারেটর চালাতে গেট ছেড়ে জেনারেটর রুমে আসে। জেনারেটর রুম থেকে মেন গেটটা দেখা যায় না। আর সেই সুযোগে তন্ময় সবার অলক্ষ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
ব্যাপারটা হৃদয়াঙ্গম করতে সবারই একটু সময় লাগল। শাক্যই আবার মুখ খুলল, – আর ঢোকার সময়?
– আর ঢোকার সময় তন্ময়কে বাড়িতে ঢুকতে সাহায্য করে তার হত্যাকারী।
এবার আর ছোটখাটো বোমা নয়, ঘরে যেন একটা নিউক্লিয়ার এক্সপ্লোশন হলো। কারোর মুখে কোনও কথা সরছে না দেখে, অনিকেত নিজেই ব্যাখ্যা করলেন, – হ্যাঁ! কথাটা সত্যি। তন্ময় আত্মহত্যা করেনি। অচিন্ত্যর মতো তাকেও খুন করা হয়েছে। হত্যাকারী খুনটাকে একটা আত্মহত্যার চেহারা দিতে চেয়েছিল আর এই কারণেই একটা সুইসাইড নোট রেখে গিয়েছিল ল্যাপটপে। কিন্তু দুটো অনিচ্ছাকৃত ছোট ভুল তার চেষ্টাটা ব্যর্থ করে দিয়েছে। পুলিশের কাছে ধরা পড়ে গেছে যে এটা আত্মহত্যা নয়। এটা একটা প্রিপ্ল্যানড মার্ডার। প্রথমত হত্যাকারী দেখাতে চেয়েছিল তন্ময় নিজের হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু একজন লোক যখন তার নিজের ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের শিরা কাটে তখন স্বাভাবিকভাবে কাটমার্কের ডিরেকশন থাকে ডায়াগোন্যালি তালুর দিক থেকে কনুই-এর দিকে, মানে ওপর থেকে নীচের দিকে। কিন্তু যদি অন্য কেউ সেই কাজটা করে সেক্ষেত্রে এই ডিরেকশনটা হয় উল্টো। মানে কনুই-এর দিক থেকে তালুর দিকে অর্থাৎ হাতের নীচের দিক থেকে ওপরের দিকে। তন্ময়ের হাতের কাটমার্কটা এই দ্বিতীয় ধরণের ছিল। আর দুই নম্বর ভুলটা হলো, হত্যাকারী তন্ময়কে মারার আগে তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিল যাতে সে কোনওরকম বাধা না দিতে পারে। অটপ্সি রিপোর্টে তন্ময়ের পেটে ঘুমের ওষুধ নাইট্রাজেপাম বা এন টেনের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছে। মিডিয়াকে ইচ্ছে করেই প্রকৃত খবরটা দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছিল, তন্ময় আত্মহত্যা করেছে। কারণ আসল খবর প্রকাশ হয়ে পড়লে হত্যাকারী সতর্ক হয়ে যেতে পারত।
এতক্ষণ এক নাগাড়ে কথা বলে অনিকেত দম নেবার জন্যে একটু থামলেন। তারপরে অরুণিমার দিকে তাকিয়ে বললেন, – বাই দ্য ওয়ে, মিস সরকার। আপনি আপনার গাড়ীটা রিসেন্টলি সার্ভিসিং করতে দিয়েছিলেন, তাই না?
– অ্যাঁ? ও হ্যাঁ হ্যাঁ! প্রথমে একটু চমকালেও দ্রুত সামলে নিল অরুণিমা, – কেন বলুন তো?
– না এমনিই! মারুতি সুইফ্টটা তো আপনার। তাই না? তা কোন মারুতি সার্ভিস ষ্টেশনে দিয়েছিলেন সার্ভিস করাতে?
– আসলে কি হয়েছে, আমার এক পেশেন্ট রয়েছেন যার একটা সার্ভিস ষ্টেশন আছে। আমি মারুতি চালাই দেখে তিনিই একদিন কৃতজ্ঞতাবশত বলেছিলেন যে আমার গাড়ীটা সার্ভিসিং করাতে হলে তাঁকে যেন বলি। কম টাকায় করিয়ে দেবেন। অরুণিমার সপ্রতিভ উত্তর। – তাই গাড়ীটা ইদানীং ট্রাবল দিচ্ছিল দেখে তাঁকেই বলেছিলাম। তিনিই লোক পাঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আবার সার্ভিসিং হয়ে যাবার পরও তিনিই তাঁর লোক মারফৎ ফেরত দিয়ে গিয়েছিলেন। তাই আমি ঠিক জানি না তাঁর সার্ভিস ষ্টেশনটা ঠিক কোথায়।
মন দিয়ে কথাগুলো শুনে ওপরে নীচে মাথা নাড়লেন অনিকেত। কিছু একটা ভাবলেন এক দুই সেকেন্ড। তারপর আবার প্রশ্ন করলেন, –আপনি তো তন্ময়কে চিনতেন, তাই না?
কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিল অরুণিমা, – চিনতাম বলাটা ঠিক হবে না। মুখ চেনা ছিল, এটুকু বলতে পারি।
– চিনতেন না? কেন? অনিকেত অবাক হলো, – আমাদের কাছে তো খবর আছে যে আপনারা দুজন একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়তেন।
– তাই নাকি? হতে পারে। আসলে আমাদের স্কুলে এক একটা ক্লাসে চারটে করে সেকশন ছিল। আর প্রত্যেক সেকশনে পঞ্চাশজন করে স্টুডেন্ট পড়ত। এতজনের মধ্যে সবার সাথে তো আর সমান পরিচিতি থাকে না। তাই না? এবারও দমল না অরুণিমা।
– হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক। তার মানে আপনি ততটা চিনতেন না তন্ময়কে। অনিকেত সম্মত হলেন। কিন্তু পরক্ষণেই তীরের মতো প্রশ্ন ছুঁড়লেন,– তাহলে মিস সরকার, আপনার গাড়ী সার্ভিসিং-এর বিলটা তন্ময়ের কাছে এল কি করে?
– মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি? এবার অরুণিমার মুখে ঈষৎ ভয়ের ছাপ পড়ল।
অরুণিমার চোখে চোখ রেখে বললেন অনিকেত, – পুলিশ তন্ময়ের ঘর থেকে আপনার গাড়ীর সার্ভিসিং-এর বিলটা খুঁজে পেয়েছে, মিস সরকার, যেটাতে আপনার গাড়ীর নাম্বারটা স্পষ্ট ভাবে লেখা রয়েছে। আপনি আর তন্ময় দুজনে মিলে প্ল্যান করে অচিন্ত্যকে খুন করেছেন। আপনি বা তন্ময় কেউ একজন কয়েকদিন আগে আপনার গাড়ীটা সার্ভিসিং এর জন্যে বর্ধমানের একটা মারুতি সার্ভিস স্টেশনে রেখে আসেন। গত বৃহস্পতিবার তন্ময় বর্ধমানে ট্রেন থেকে নেমে প্রথমে সেখান থেকে আপনার গাড়ীটা কালেক্ট করে। তারপরে সেটাতে করে কলকাতা ফিরে তন্ময় আপনার গাড়ীর ডিকিতে লুকিয়ে থাকে। আর আপনি তাকে সিকিউরিটির চোখ এড়িয়ে বাড়িতে এন্ট্রি দেবার জন্যে সরাসরি রুবি থেকে নাইটিংগেল না গিয়ে, ঘুরপথে এসে একবার আলিপুরে নিজের বাড়িতে ফেরেন। বুদ্ধি করে উইটনেস হিসেবে আপনি আপনার ড্রাইভারকে ডাকেন আপনাকে নিয়ে বাড়িতে ফেরার জন্যে যাতে কারও মনে এই সন্দেহ না আসে যে সেদিন গাড়ীতে করে আপনার সাথে আরও কেউ এই বাড়িতে ঢুকেছিল। বাড়ি ফেরার পর আপনি আপনার ড্রাইভারকে ছুটি দিয়ে দেন, যাতে তন্ময় নির্বিঘ্নে সবার চোখের আড়ালে ডিকি থেকে বেরিয়ে সুবিধামত জায়গায় লুকিয়ে পড়তে পারে। শুধু এটুকু করেই কিন্তু আপনি ক্ষান্ত হননি। গতকাল রাতে আপনি আপনার এই কুকর্মের পার্টনার তন্ময়ের বাড়িতে যান। সেখানে গিয়ে হয়তো সাকসেস সেলিব্রেট করার অজুহাতে তন্ময়ের ড্রিঙ্কে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেন। পরে তন্ময় ঘুমিয়ে পড়লে, তার হাতের শিরা কেটে তাকে খুন করে আপনার অপরাধের একমাত্র সাক্ষীকে চিরতরে চুপ করিয়ে দেন।
কোণঠাসা বাঘিনীর মতো ফুঁসে উঠল অরুণিমা, – মিথ্যে কথা। তখন থেকে যা মনে আসছে তাই বলে চলেছেন। কোনও প্রমাণ ছাড়া যা ইচ্ছে তাই বলে আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন...
হিমশীতল কণ্ঠে বললেন অনিকেত, – আমি আপনাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছি না, মিস সরকার। আপনি নিজেই নিজেকে ফাঁসিয়েছেন। আপনার জ্ঞাতার্থে জানাই, মাইক্রোসফ্ট ওয়ার্ডে তৈরি যে কোনও ডকুমেন্টে দুটি প্রপার্টি থাকে। ‘অথার’ এবং ‘লাস্ট সেভ্ড বাই’। যে ব্যক্তি কম্প্যুটারে লগিন করে ডকুমেন্টটা তৈরি করছে, বাই ডিফল্ট তার ইউজার নেমটা এই দুটো প্রপার্টিতে স্টোর হয়ে যায়। পরে ডকুমেন্টটা এক কম্প্যুটার থেকে অন্য কম্প্যুটারে নিয়ে গেলেও এই ভ্যালুগুলো চেঞ্জ হয় না। আপনি মনে হয় সুইসাইড নোটটা আপনার নিজের ল্যাপটপে বানিয়ে পেন ড্রাইভে করে ট্র্যান্সফার করেছিলেন তন্ময়ের ল্যাপটপে। কারণ তন্ময়ের সুইসাইড নোটটাতে ‘অথার’ এবং ‘লাস্টসেভ্ড বাই’ প্রপার্টিতে যে নামটা দেখা যাচ্ছে সেটা হলো arunima.sarkar।
কিছু একটা বলার চেষ্টা করেও থেমে গেল অরুণিমা। ফ্যালফ্যাল করে অনিকেতের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। গলায় দুঃখের ভাব ফুটিয়ে অনিকেত আবার বললেন, – আয়্যাম সরি, মিস সরকার। আপনি ধরা পড়ে গেছেন। আমি জানি, আপনি আপনার ল্যাপটপ থেকে ফাইলটা শিফ্ট ডিলিট করে উড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ফরেন্সিক ল্যাবে আপনার ল্যাপটপের হার্ড ড্রাইভটা অ্যানালাইসিস করে সেই পার্মানেন্টলি ডিলিট করা ফাইলটাও উদ্ধার করা সম্ভব। আপনার বাঁচার আর কোনও উপায় নেই।
এক দুই সেকেন্ড চুপ করে বসে থেকে মাথাটা নিচু করে দুই হাতে নিজের মুখ ঢেকে নিল অরুণিমা। এতক্ষণ গৌতম নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল। এবার এগিয়ে এল অরুণিমার দিকে। বলল, – মিস সরকার! আপনাকে একবার আমাদের সাথে থানায় আসতে হবে। অচিন্ত্য সরকারের মৃত্যুর চক্রান্তে জড়িত থাকার আর তন্ময় ঘোষকে হত্যার দায়ে আপনাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।
অনিকেতকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। এই কদিন বেশ চাপ গেছে তাঁর ওপর দিয়ে। তাও তাঁর মুখ যুদ্ধ জয়ের আনন্দে উজ্জ্বল। অবসন্ন দেহে এগিয়ে গিয়ে ডাইনিং টেবিলে রাখা একটা জলের বোতল থেকে কয়েক ঢোঁক জল খেলেন। তারপর ফিরে এসে নন্দিতার দিকে ফিরে বললেন, – লাস্টে আর একটা কথা বলে আমার দীর্ঘ বক্তৃতা শেষ করব। সত্য গোপনকারীদের দলের শেষ সদস্য হিসেবে আপনার নামটাও আছে মিসেস সরকার। সেদিন পার্টি থেকে বেরিয়ে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন, এই কথাটা আপনি না বললেও, যার সাথে আপনি সেদিন ঝটিকা অভিসারে গিয়েছিলেন, সেই শাক্য কিন্তু পুলিশের কাছে কিছুই গোপন করেননি।
৯
বিকেলে আর কোথাও বেড়াতে না বেরিয়ে বাড়িতেই ছিলেন অনিকেত। সোফায় বসে আনন্দবাজার পত্রিকার পাত্রপাত্রী বিজ্ঞাপন দেখে ছেলের জন্যে উপযুক্ত পাত্রীদের বাছাই করে লাল কালি দিয়ে দাগ দিয়ে রাখছিলেন। দময়ন্তীর কড়া হুকুম। এবার থেকে খালি বনের মোষ না তাড়িয়ে ঘরের কাজও কিছু কিছু করতে হবে। এমন সময় কলিং বেলের শব্দ পেয়ে সহদেব এসে দরজা খুলে দিল। গৌতম এসেছে। তাকে দেখে অনিকেত পেপারটা ভাঁজ করে পাশে সরিয়ে রেখে হেসে বললেন, – আরে এস এস গৌতম, বলো কি খবর?
– খবর ভালই জেঠু। গৌতমও পাল্টা হেসে বলল, – অরুণিমা সরকার সব কনফেস করেছে। তাঁকে এখনও ইন্টারোগেট করা হচ্ছে। আরও অনেক ইনফরমেশন পাওয়া বাকী। আর সৈকতকে সসম্মানে সব দায় থেকে মুক্ত করা হয়েছে। সে ছাড়া পেয়ে বাড়ি গেছে।
– বাঃ! এ তো খুব ভাল খবর। কংগ্র্যাচুলেশনস।
– কংগ্র্যাচুলেশনস তো আপনার প্রাপ্য, জেঠু। মির্যাকলটা তো আপনিই করেছেন। আন্তরিক ভাবে বলল গৌতম। – আমি তো ভাবতেই পারছি না কি করে আপনি কেসটা ক্র্যাক করলেন?
হা হা করে হেসে উঠলেন অনিকেত, – গৌতম, এদেশের সব পুলিশ ডিপার্টমেন্টের মূল সমস্যাটা কি জান? আমরা সব কেসে খালি মেক্যানিকালি ইনভেস্টিগেট করি। তদন্তের সময় নিজের কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগাই না। এই ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কি এমন করেছিল তন্ময়? সিম্পলি একটা ইল্যুশন ক্রিয়েট করেছিল। ট্রেনে উঠেই প্রথমেই মার্ক করে নিয়েছিল ওই বাবা, মা আর বাচ্চাটাকে। কারণ বাচ্চাদের সাথে ভাব জমিয়ে নেওয়াটা সবচেয়ে সহজ। তারপর ধীরে ধীরে বাচ্চার থ্রুতে বাবা মার সাথে আলাপ জমায়। ও জানত পরে পুলিশ খোঁজ করলে আর কেউ না করুক অন্তত এরা তাকে আইডেন্টিফাই করবেই। এভাবে অকাট্য একটা অ্যালিবাই তৈরি করে সে বর্ধমানে নেমে যায়। পরের দিন সকালে প্লেনে গৌহাটি গিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা চলে আসে কামাখ্যা স্টেশনে। এই স্টেশনে সব ট্রেন দাঁড়ায়। ফের ট্রেনে উঠে পড়ে এমন একটা ভাব করে যেন রাতের বেলা কোনও বন্ধুর সাথে গল্প করে বা তাস খেলে কাটিয়েছে। ব্যাস, ট্রেনের সহযাত্রীরা আর গৌহাটিতে যে তাকে স্টেশনে রিসিভ করতে এসেছিল প্রত্যেকে তার হয়ে গলা ফাটায় যে সে ওইদিন ট্রেনেই ছিল। প্রথম দিন তোমার সাথে কথা বলে বা জবানবন্দীর ফাইলটা পড়ে আমার খালি মনে হচ্ছিল কোথাও যেন একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। কিন্তু নির্দিষ্ট করে কিছু ধরতে পারছিলাম না। পরে মাথায় আসে যে এক্ষেত্রে আসল তথ্য জানাতে পারে একমাত্র টিকিট চেকার। তাই তন্ময়কে সন্দেহ হতেই আমি সিবিআই-কে এই ইনফর্মেশনটা বের করতে বলি। তারা সেদিনের দায়িত্বে থাকা টিকিট চেকারের সাথে যোগাযোগ করে আমাকে জানায় যে সেইদিন সেই ট্রেনে টিটিই কোথাও তন্ময়ের দেখা পায়নি। ব্যাস, তন্ময়ের ম্যাজিকের রহস্য ফাঁস!
– হুঁ। ঠিকই, টিকিট চেকারের ব্যাপারটা আমাদের মাথায় আসেনি। গৌতম স্বীকার করল, – কিন্তু তন্ময়ের ওপর আপনার কি কারণে সন্দেহ হলো?
– দেখ, তোমরা তন্ময়কে প্রথমেই ক্লীনচিট দিয়ে দিলেও, আমি কিন্তু ওকে কখনই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিইনি। সুরাহা করলেন অনিকেত। – কোনও লোক যদি কাউকে সবার সামনে খুনের হুমকি দিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই আবার তার সাথে মিটমাট করে নেয়, তখন এর পিছনে কোনও অসৎ উদ্দেশ্য থাকার সম্ভাবনাটা এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তন্ময় নন্দিতার সাথে ঠিক এটাই করেছিল। তারপরে আমি সুরমা সরকারের কাছ থেকে আরেকটা ইম্পরট্যান্ট ক্ল্যু পাই। তিনি কথায় কথায় তন্ময় সম্বন্ধে বলেছিলেন যে অচিন্ত্য মারা যাওয়ায় এখন নিশ্চয়ই ‘ওরা’ সুখী হবে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যে উনি হয়তো শাক্যর ব্যাপারটা জানেন না, তাই ‘ওরা’ বলতেতন্ময় আর নন্দিতার কথা বলছেন। কিন্তু পরে উনি পরিস্কার করেন ব্যাপারটা। সৈকত একদিন একটা রেস্টুর্যান্টে তন্ময় আর অরুণিমাকে একসাথে দেখে মাকে এসে কথাটা জানিয়েছিল। তখন থেকে তন্ময়ের প্রতি আমার সন্দেহটা জোরদার হয়। কিন্তু অচিন্ত্যকে খুন করার পিছনে ওর মোটিভটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে শাক্যর সাথে কথা বলে জানতে পারি যে নন্দিতা আর অচিন্ত্যর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্কই ছিল না। ফলে অচিন্ত্যর মৃত্যুর পরে তার ‘ইমিডিয়েট নেক্সট অফ কিন’ হিসেবে সমস্ত সম্পত্তি পাবার কথা অরুণিমার, নন্দিতার নয়। তখনই পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে পরিস্কার হয়। তন্ময়ের সাথে মিটমাট হয়ে যাবার পরে শাক্য আসার আগে থেকেই তন্ময়ই ছিল নন্দিতার একমাত্র কাছের মানুষ। তাই আমি আন্দাজ করি যে শাক্য ছাড়াও এই তথ্যটা নন্দিতা নিশ্চয়ই তন্ময়কেও জানিয়েছিল। পরে আমার আন্দাজটাই সত্যি প্রমাণিত হলো। তবে একটা ভুল আমি করেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম এই প্ল্যানটা তন্ময়ের। পরে যখন বুঝতে পারি যে পুরো ব্যাপারটার মাস্টারমাইন্ড অরুণিমা আর তন্ময় ইজ নাথিং বাট অ্যা পন, তখন বড্ড দেরী হয়ে গেছে।
– ঠিকই বলেছেন। সায় দিল গৌতম। – অরুণিমা যে একাজে জড়িত থাকতে পারে, সেটা ভাবাই যায় না।
– দেখ গৌতম। মানুষের মন বড়ই দুর্বোধ্য। সে যে কখন কি পথে চলে সেটা বোঝা খুবই কঠিন। দার্শনিকের মতো উত্তর দিলেন অনিকেত, –অরুণিমাকে ইন্টারোগেট করলে আসল সত্যিটা জানা যাবে। তবে আমার যেটা মনে হয়, অরুণিমা কম বয়সে মা কে হারিয়ে সুরমাকে পেয়ে তাকেই নিজের মায়ের জায়গায় বসায়। অচিন্ত্য যখন সুরমাকে ডিভোর্স করে তখন থেকেই সে তার দাদাকে প্রাণপণে ঘৃণা করত। সরি, ভুল হলো, শুধু দাদাকে নয়, অরুণিমার এই ঘৃণাটা ছিল পুরো পুরুষ জাতটার প্রতি। তারপর যখন নন্দিতা এল, সে বুঝল যে অচিন্ত্যর সব সম্পত্তি একসময় নন্দিতা পাবে। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই সে তন্ময়কে চিনত। শত্রুর শত্রু মিত্র। তাই সে প্রেমের ফাঁদ পেতে তন্ময়কে দলে টানল। তন্ময় নন্দিতাকে প্রাণপণে ভালবাসত। নন্দিতার সাথে ডিভোর্স হওয়ার জন্যে সে অচিন্ত্যকেই দায়ী করত। আর সেইজন্যে অচিন্ত্য আর নন্দিতার ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্যে সে মরিয়া হয়ে ছিল। তাই অরুণিমার ডাকে তার সাথে হাত মেলাতে সে দেরী করেনি। অরুণিমা হয়তো তন্ময়কে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্রথমে তারা ঠিক করেছিল প্রথমে নন্দিতা আর তারপরে অচিন্ত্য, একেএকে দুজনকেই সরিয়ে দেবে। তারপরে সব গোলমাল মিটলে তারা বিয়ে করে নেবে। ফলে অরুণিমা আর তার দখলে সব সম্পত্তি চলে আসবে। কিন্তু পরে অরুণিমা যখন তন্ময়ের কাছ থেকে জানতে পারে যে অচিন্ত্য আর নন্দিতার বিয়েই হয়নি, তখন তারা প্ল্যান চেঞ্জ করে অচিন্ত্যকেই প্রথমে টার্গেট করে। তন্ময় আদতে ছিল বোকা। সে অরুণিমার আসল প্ল্যান ধরতেই পারেনি। অচিন্ত্যর মৃত্যুর পর অরুণিমার জীবনে তন্ময়ের আর কোনও প্রয়োজন ছিল না। তাই প্ল্যানের ফাইনাল স্টেপ অনুযায়ী অরুণিমা তন্ময়কেও পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়।
অনিকেতের ব্যাখ্যায় ঘরের পরিবেশটা ভারী হয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ দুজনেই কোনও কথা বললেন না। শেষ পর্যন্ত নীরবতা ভেঙ্গে উঠে দাঁড়াল গৌতম, – সত্যি জেঠু, ভাগ্যিস আপনি ছিলেন, না হলে হয়তো এই কেসের সমাধানই হতো না। এনিওয়ে, আজ উঠি। ওদিকে অনেক কাজ পড়ে আছে।
অনিকেতও উঠলেন গৌতমকে এগিয়ে দিতে। দরজার সামনে এসে বললেন, – চল, আবার দেখা হবে! একদিন সময় করে যাব তোমাদের বাড়িতে। বৌমাকে বলবে আমাকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতে হবে। ভাই ছাড়া পেয়ে গেছে। এখন নিশ্চয়ই জেঠুকে ভালমন্দ রান্না করে খাওয়াতে ওর আর কোনও আপত্তি থাকবে না?
যেতে যেতে পিছনে ফিরল গৌতম। হাঁ হয়ে গেছে কথাটা শুনে। কোনও মতে বলল, – মানে? আপনি কি করে...? ও মাসীমা তাহলে...
আবার ঘর কাঁপিয়ে উদাত্ত হাসি হাসলেন অনিকেত, – না গৌতম। তুমি ভুল করছ। আমি জানি আমি সুরমা দেবীর বাড়িতে যাবার আগে তুমি ওঁকে সতর্ক করে দিয়েছিলে। উনি তোমাকে দেওয়া কথা রেখেছেন। উনি কিন্তু আমাকে তোমাদের ব্যাপারে কিছুই বলেননি।
– তাহলে আপনি জানলেন কি করে? গৌতমের হতভম্ব ভাব কাটছেই না।
– গৌতম, তুমি হয়তো বিয়ের পর ওঁদের বাড়িতে যাওনি বা গেলেও খেয়াল করনি। ওঁর বাড়ির দেওয়ালে প্রচুর ফ্যামিলি ফটো টাঙ্গানো আছে। তার মধ্যে একটা ফটো আছে যেটায় সৈকতকে তার এক দিদি ভাইফোঁটা দিচ্ছে। যদিও বেশ কয়েক বছর আগের ছবি। তাও ওই ছবি দেখে বৌমাকে চিনে নিতে আমার খুব একটা অসুবিধা হয়নি।
সমাপ্ত
0 comments: