প্রবন্ধ - ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
বাংলার গান : বাঙালির গান – ৪র্থ ও শেষ পর্ব
লোকগান : শিকড়ের গান
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
‘বাংলার গান : বাঙালির গান’ লেখাটির আগের তিনটি পর্বে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগের বিপণনের গান পর্যন্ত আলোচনা করেছি। কিন্তু লোক-জীবনের চলার ছন্দে যে গান, তাকে সেই আলোচনায় রাখিনি। আধুনিক যুগে বাংলা গান যখন বিনোদনের উপাচার হয়ে উঠলো, তখন তার পণ্যমূল্য স্থির হয়ে গেল। এর বাইরে যে গান, লোক-জীবনের চলার ছন্দই যার উৎস, বিনোদন বা পণ্যমূল্যের নিরিখে সে গানের বিচার হয় না। বাঙালির লোকগানকেই বুঝতে চেয়েছি এই পর্বে।
কৈশোরে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে পড়া আচার্য জগদীশচন্দ্রের ‘ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে’ রচনায় জগদীশচন্দ্র জানতে চেয়েছিলেন ‘নদী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ’? সেই অনুকরণে যদি জিজ্ঞাসা করি, ‘গান, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? জবাব পাওয়া যাবে - “সৃষ্টির আদিমতম কালখণ্ডে মানুষের কর্মকালীন ঐকতানই আমার উৎস”। যূথবদ্ধ মানুষের শ্রম আর স্বতঃস্ফূর্ততায়, প্রকৃতির নানান উপাদান আর তার সৃষ্টির বৈভবে, মানুষের এগিয়ে চলার ভঙ্গিমাতেই গানের জন্ম। এখনও তো ‘হেঁইও মারি হেঁইও’র সুর, ছাদ পেটানো শ্রমিকদের একতালে কোলাহল, কিংবা নলকূপ স্থাপনের সময় শ্রমিকদের তালবদ্ধ কোলাহল আমাদের পরিচিত সুর। যে ‘টপ্পা’ গান বাঙ্গালির কাব্য-সংগীতে বিশিষ্ট হয়ে আছে তার উৎপত্তি মরুভূমির উট চালকদের মুখ থেকে । জনহীন রুক্ষ-ঊষর মরুপ্রান্তর পেরনোর সময় তারা যে সম্মিলিত কোলাহল করতো তাইই ‘টপ্পা’।
· এইভাবে প্রকৃতির সৃষ্টির মধ্য থেকে, নদীর তরঙ্গ থেকে, ঝড়ের গর্জন থেকে, পাখির কলতান থেকে, মানুষ তার নিজের সুর সৃষ্টি করেছে।শিক্ষিত সমাজ লিখিত সাহিত্য সাধনার মধ্য দিয়ে তার সাহিত্যের রূপ-বৈচিত্রের প্রকাশ ঘটিয়েছে একথা যেমন সত্য, তেমনই নিরক্ষর গ্রামীণসমাজের মৌখিক সাহিত্য উৎসারিত হয়েছে লোকসঙ্গীত ধারার মধ্য দিয়ে যুগে যুগে। আধুনিক যুগের শিক্ষিত সমাজের পরিশীলিত গীতি-কাব্যেরবীজ সেই মৌখিক সাহিত্য-সঙ্গীত ধারার মধ্যেই রয়েছে। মানব-জীবনের, পল্লী-মানুষের যাপনের সব বৃত্তান্তই রয়েছে আমাদের লোকসঙ্গীতে।জগৎ সম্পর্কে তাদের ভাবনা, তাদের লোকাচার, অধ্যাত্ম ভাবনা, তাদের বিশ্বাস, সংস্কার এবং জীবনযুদ্ধ আর তার চলার ছন্দ, সব কিছুরই আশ্রয়তার গানে – আমাদের লোকসঙ্গীতে। জীবনের এমন কোন পর্যায় নেই যা আমাদের লোকসঙ্গীতে ধরা পড়েনি।
বাংলার লোকসঙ্গীত ধারাটি বৈচিত্রময়। কিছু একক কন্ঠে গীত আবার কিছু গান সমবেত কন্ঠে গীত হয়। বাউল, ভাটিয়ালি, দেহতত্বের গান, মুর্শিদি একক কন্ঠের গান, আবার গম্ভীরা, আলকাপ, কবিগান ভাদু, টুসু, সারিগান যূথবদ্ধভাবে গীত হয়। তেমনই কিছু গান আঞ্চলিক ও কিছু গান সর্বাঞ্চলীয়।
আধুনিক যুগে গানের পণ্যমূল্য বিচার করে বিনোদনের উপাচার হয়ে ওঠার পরে লোকসঙ্গীতের সুরের ঐশ্বর্য আত্মস্থ করে নিয়েছে এযুগের পরিশীলিত গায়ন শিল্পীরা। এমনই বহু পরিচিত কিছু লোক-সঙ্গীত ধারার গানের পরিচিতি দেওয়া যেতে পারে, যেমন ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, বাউল, ঝুমুর, গম্ভীরা, আলকাপ,ভাদু, সারিগান, টুসুগান। গ্রামোফোন রেকর্ড ও ক্যাসেট ব্যবস্থা চালু হবার পর, ব্যবসায়িক ভাবে এই সব লোকধারার গান মানুষের ঘরে ঘরে পৌছেছে।
লোকসঙ্গীত ধারায় ভাটিয়ালি সুরই প্রাচীনতম বলে মনে করা হয়, নদীমাতৃক বাংলায় ভাটিয়ালির সুরকে লোকগান ধারায় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপাও দেওয়া হয়।'ভাটিয়ালি' সঙ্গীত শাস্ত্রের একটি রাগিণীরও নাম। পণ্ডিত দীনেশচন্দ্র সেন তার ‘বৃহৎবঙ্গ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন … ‘এই সুর হিন্দি মনসামঙ্গলে বাঙ্গাল রাগ বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। ইহা আমাদের চিরপরিচিত ভাটিয়াল রাগ। এই সুর কোন প্রচলিত রাগ-রাগিনীর ধার ধারে না, উহা খাঁটি পল্লীহৃদয়ের সমস্ত করুণ রস নিংড়াইয়া লইয়া আত্মপ্রকাশ করিত। এই সুর পদ্মা, ধলেশ্বরী,ভৈরব, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি নদ-নদীর গর্ভে যিনি শুনিয়াছেন, তিনি বুঝিবেন এই নদীমাতৃক দেশের উহা নিজস্ব সুর’।নদীতে ভাটির স্রোতের সঙ্গে নৌকা ভাসিয়ে মাঝি-মাল্লারা যে গান করেন সেগুলোই ভাটিয়ালি গান। লোকসাহিত্য গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন‘ভাটিয়ালি' পূর্ববঙ্গের ঢাকা, ময়মনসিংহ এবং সিলেট ও ত্রিপুরার পশ্চিমাংশের অর্থাৎ ভাটি অঞ্চল নামে পরিচিত বিশেষ অঞ্চলের গান। '...একদিকে নদী কিংবা জলাভূমির বিস্তার আর এক দিক দিয়া উহার অলস মন্থর গতি, এই উভয়ের সহযোগেই ভাটিয়ালির উদ্ভব হইয়া থাকে; এই অবস্থার মধ্য দিয়াই মাঝি কর্মে যথার্থ অবসর লাভ করিতে পারে, এই অবসরের মুহূর্তই ভাটিয়ালির পক্ষে অনুকূল মুহূর্ত। সেই জন্য নদীর ভাটিতে নৌকা ছাড়িয়া দিয়া অলস বৈঠাটি এক হাতে স্থির ধরিয়া রাখিয়া মাঝি এই গান গাহে বলিয়াই ইহা ভাটিয়ালি গান”। ভাটিয়ালি গানের মুখ্য বিষয় প্রেম-বিরহ। এ ছাড়াও মাঝি-মাল্লাদের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা,ভালোবাসা, প্রকৃতি ও তাদের হতাশা-নৈরাশ্যের প্রতিচ্ছবিও উঠে আসে এই গানে । লৌকিক চেতনা ও আধ্যাত্মিক ভাবনা এই দুইই প্রতিফলিত হয় ভাটিয়ালি গানে। আশুতোষ ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন “অন্তরের সুগভীর ভাব ও সূক্ষ্মতম অনুভূতি প্রকাশ করিবার ভাটিয়ালির যে শক্তি,তাহা বাংলার আর কোন লোকসঙ্গীতে নাই। জীবন-দর্শনের সুগভীর বিষয়সমূহ অতি সহজেই ইহার মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে...” ।(বাংলার লোক-সাহিত্য ২য় খণ্ড )।
ভাটিয়ালির মত সারিগানও আবহমান কালের কর্মকালীন গান বা শ্রমসঙ্গীত। ভাটিয়ালি্র মত মাঝি-মাল্লারা এ গান গায়, তবে ভাটিয়ালি যেমন এককের গান, সারি তেমন নয়। সারি যূথবদ্ধ শ্রমজীবির গান। মাঝি-মাল্লারা যূথবদ্ধভাবে নদীতে যাওয়ার সময় এ গান গায়। কর্মজীবি মানুষ দলবদ্ধভাবে ছাদ পেটানো,ফসল কাটা, ফসল তোলা, ক্ষেত নিড়ান, গাছ কাটা ইত্যাদি শ্রমনির্ভর কাজের সময় এ গান গায়। শ্রমজীবি মানুষের কাছে সারিগানের বিশেষ মূল্য রয়েছে। এই গানের মধ্যে তারা যেমন কর্মশক্তি ও উদ্যম অর্জন করে তেমনই কর্মের ক্লান্তিও দূর করে। সারি পূর্ব ও নিম্নবঙ্গের ভাটি অঞ্চলের গান। সিলেট,ময়মনসিংহ,পাবনা,রাজশাহী রংপুর,ফরিদপুর, দিনাজপুর,যশোর,খুলনা,বরিশাল প্রভৃতি অঞ্চলেও সারিগান বিশেষ জনপ্রিয়।
ভাটিয়ালির মত ‘ভাওয়াইয়া’ মাঝি-মাল্লাদের গান নয়। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার,পশ্চিম দিনাজপুর,অসমের গোয়ালপাড়া ও ধুবড়ি জেলার বিস্তীর্ণ জনপদে রাজবংশী ও কামরূপী ভাষায় গীত সঙ্গীতধারাই ভাওয়াইয়া নামে পরিচিত। হলকর্ষণরত চাষী, রাখাল বালক, মোষপালকদের কন্ঠে স্বতোৎসারিত গানই ভাওয়াইয়া সঙ্গীত।
ঝুমুর বাংলার রাঢ় অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন লোকসঙ্গীত ধারা। আদিবাসী লোকজীবন ঝুমুর গানের উৎস। চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’এ ঝুমুর গানের উল্লেখ পাওয়া যায় । নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে আদিবাসী জনজাতির এই প্রাচীন কর্মসঙ্গীতধারা এখন শহুরে শিক্ষিত সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছেও লোকপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আদিবাসী সঙ্গীতধারা ঝুমুরের বিবর্তন প্রসঙ্গে আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর ‘বাঙ্গালার লোকসাহিত্য (২য় খণ্ড)’ গ্রন্থে আঞ্চলিক সঙ্গীত প্রসঙ্গে লিখেছেন“ছোটনাগপুর হইতে আরম্ভ করিয়া সমগ্র মধ্যভারত ব্যাপিয়া গুজরাট সীমান্ত পর্যন্ত যে আদিবাসী বসতি-সীমা তাহার সর্বত্র যে আদিবাসী সঙ্গীত প্রচলিত আছে তাহা সাধারণ ভাবে ঝুমুর নামে পরিচিত। ... ক্রমে বাংলাভাষার সান্নিধ্যে আসিয়া আদিবাসীর ঝুমুর বাংলাভাষায় রূপান্তরিত হইতে আরম্ভ করিয়াছে। ... ভাষার পরিবর্তন হইলেও আঙ্গিকের দিক হইতে তাহার কোন পরিবর্তন হয় নাই। ক্রমে বাঙ্গালির বিশিষ্ট লোকসঙ্গীত এবং উচ্চতর সঙ্গীতের প্রভাব তাহার উপর বিস্তার লাভ করিবার ফলে তাহার রূপ, সুর ও ভাব পরিবর্তিত হইয়াছে”। লোক সংগীতের সাধারণ ধর্ম অনুসারে এই যুগের ঝুমুরে মানবিক আকুতিরই প্রাধান্য ঘটেছে এবং বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে সমাজভূমির জীবন সংগীতের গৌরব লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলাম সহ অনেক সঙ্গীত পরিচালকই ঝুমুর সঙ্গীতের সুর আত্তীকরণ করে অনেক গানের সুর রচনা করেছেন। ঝুমুর পালা-পার্বণেও গীত হয়, তেমনই ভাদু ও টুসুগানও পালা-পার্বণের গান।
ঝুমুরের মত ভাদু গানও বাংলার রাঢ় অঞ্চলের গান । ভাদুগান আদিবাসী জনজাতির বর্ষাকালীন সঙ্গীত। মানভূম অঞ্চল, বাঁকুড়া, পশ্চিম বর্ধমান ও বীরভূম পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভাদ্রমাস ব্যাপী ভাদু গান গীত হয়। প্রধাণত কুমারী মেয়েদের মধ্যেই এ গান সীমাবদ্ধ। ভাদু কুমারী মেয়েদের জীবনের গান, তাদের জীবন-স্বপ্ন এ গানের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়। এ গানে ধর্মের কথা থাকে না, থাকে কুমারী জীবনের আশা-আকাঙ্খার কথা, তাদের অভিজ্ঞতা আর বিবাহিত জীবনে প্রবেশ করার আগে সে সম্পর্কে তাদের আশা-আকাঙ্খার কথা। ভাদ্রমাসের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত প্রতি রাত্রে পরিবারের কুমারী মেয়েরা সমবেত হয়ে ভাদু গান গেয়ে থাকে। গানের পর গান মুখে মুখে বেঁধে ফেলে মেয়েরা। কোনও নিয়ম-শৃঙ্খলা থাকে না, থাকে কুমারী হৃদয়ের নানান টুকরো টুকরো স্বপ্ন।
ভাদুর পাশাপাশি টুসু যেন যমজ বোন। ভাদুর মত এটিও বাংলার রাঢ় অঞ্চলের গান। ভাদু কুমারী মেয়েদের বর্ষাকালীন পার্বণের গান আর টুসু শস্যোৎসবের গান । অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে ধান পাকার পর যখন কৃষকের ঘরে শস্য ওঠে, তখনই শুরু হয় টুসু পার্বণ। টুসুগানের সুর ভাদু গানের মতোই,কোনওকোনও অঞ্চলে সুরে সামান্য আঞ্চলিক ভিন্নতাও দেখা যায় । ভাদুগানের অবলম্বন কুমারী হৃদয়ের আশা-আকাঙ্ক্ষা আর টুসুগানে প্রতিফলিত হয় সমগ্র সমাজের ছবি, এমনকি সমকালীন রাজনীতির কথাও উঠে আসে টুসু গানে।
বাংলার লোকসঙ্গীতে এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের দাবি করে মুর্শিদি গান। মুর্শিদি আধ্যাত্মিক লোকসঙ্গীত। সুফি সাধকদের দ্বারা এ গানের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। মুর্শিদ ভক্তের আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা বা পথপ্রদর্শক। হিন্দুর আধ্যাত্মিক যোগ সাধনায় গুরুর যে স্থান মুর্শিদ তেমনই, এমনই তাদের বিশ্বাস। দয়াল মুর্শিদের কাছে আত্মসমর্পণ ও তাঁর আশ্রয় কামনাই মুর্শিদি গানের ভাবতত্ব। তিনি জগৎ ও জীবনের মোহবন্ধনে আবদ্ধ ভক্তকে মুক্তির পথ দেখান । মুর্শিদি গানে তাই ভক্তহৃদয়ের আকুতির সুর প্রকাশ পায়। ভক্তের দুঃখ-বেদনার কথা, তার হৃদয়ের আর্তি ফুটে ওঠে মুর্শিদি গানে। দয়াল মুর্শিদের স্তুতি, ভক্তিভাব ও প্রেম ছাড়া এগানে অন্য কোনও জটিল তত্ব থাকে না। তবে মুর্শিদি গানে যে করুণ কান্নাভরা সুর (যা এ গানের বৈশিষ্ট্য) তার উৎস ভক্ত হৃদয়ের অক্ষমতা, অজ্ঞানতা ও অপ্রাপ্তির বেদনা।
বাংলা লোকগানের আর এক উল্লেখযোগ্য সঙ্গীত ধারা গম্ভীরা। মালদহ জেলার হিন্দু সমাজে গম্ভীরা গানের উৎপত্তি। পরে দেশ বিভাগের পরে অধুনাবাংলাদেশের রাজশাহি জেলার কয়েকটি অংশে মুসলমান সমাজের পৃষ্ঠপোষকতায় এ গান জনপ্রিয় হয় এবং তার আঙ্গিকে কিছু পরিবর্তন ঘটে। গম্ভীরা পরিবেশিত হয় গানের মধ্য দিয়ে।তবে এতে নাট্য উপাদানও থাকে।কৌতুক ও অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয় সমাজের নানা অসংগতি।গানে গানে রচিত হয় নানা-নাতির সংলাপ।নাতির সঙ্গে নাচে- গানে, রঙ্গে কৌতুকে নানা সমাজজীবনের গরমিল গুলির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন।
· বাংলার লোকগানের একটি বিশেষ ধারা ‘কবিগান’। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে প্রচলিত নানান সাঙ্গীতিক ধারার মিলনে কবি গানের জন্ম। এর নিজস্ব কোন সুর নেই।তরজা, পাঁচালি, কীর্তন, খেউড়, আখড়াই, হাফ আখড়াই, কৃষ্ণযাত্রা, টপ্পা প্রভৃতি গানের সুর অবলম্বন করে কবিগান রচনা করা হত মুখে মুখে। উনিশ শতকের শুরুতে যে নতুনবিত্তশালী বাবু শ্রেণীর উদ্ভব হয় তাদের বিনোদনের মাধ্যম হিসাবে সেই সময় কবিগান ঐতিহাসিক তাৎপর্য লাভ করে। কবিয়াল হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন হরু ঠাকুর , ভোলা ময়রা,রাম বসু, নিতাই বৈরাগী, এন্টনি কবিয়াল প্রমুখ । উনিশ শতকের শেষ থেকেই কলকাতায় কবিগান গুরুত্ব হারাতে শুরু করে ঠিকই, কিন্তু বাংলার গ্রামাঞ্চলে বিশেষত পূর্ব বাংলারগ্রামাঞ্চলে কবিগানের লোকপ্রিয়তা অব্যাহত থাকে। উনিশ শতকের প্রখ্যাত কবিয়াল ছিলেন নিতাই সরকার, রমেশ শীল, শেখ গুমানি দেওয়ান প্রমুখ। লোকসাহিত্য গবেষকড.সুশীল কুমার দের মতে “এঁরা ছিলেন সমাজের নিচু তলার মানুষ। সমাজের নিচু তলার মানুষদের মধ্যেই ছিল এঁদের জন্ম ও বিচরণ। তাই এই সমাজের চিন্তাভাবনা অনুভূতিগুলিতাঁরা ভালই বুঝতেন। আধুনিক সাহিত্যকার সমাজের যে অংশকে অশিক্ষিত মনে করে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, সেই অংশে এঁদের জনপ্রিয়তা ছিল অবিসংবাদী”।
এইসব নানান ধারার কর্ম-সঙ্গীত ও পার্বণী গান বাংলার মৌখিক সাহিত্যের অনন্য সম্পদ যা আমাদের লোকসঙ্গীত ভাণ্ডারকে ঐশ্বর্যশালী করেছে। সংশয়াতীতভাবে বাংলার লোকসঙ্গীতে সেই ঐশ্বর্যের মধ্যমণি রূপে বিরাজ করছে ‘বাউল গান’। খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে কীর্তন গানের উদ্ভবের সমকালে বা তারও আগে বাউল সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল। অবশ্য বাউলগান লোকপ্রিয় হয়ে ওঠে লালন শাহ বা লালন ফকিরের সৃষ্টিগুণে। ১৯ শতকের মাঝামাঝি হরিনাথ মজুমদার বা কাঙ্গাল হরিনাথও (১৮৩৩) এই গানের সার্থক প্রচারক ছিলেন। বাউল দর্শন মানবমুখী ও জীবন নির্ভর। বাউলদের সাধনবস্তু হল ‘মনের মানুষ’। মনের মানুষই পরম সত্য, আবার ব্যক্তিক প্রেমের আধার । বাউলদের মনের মানুষ আছে দেহসীমার মধ্যে, প্রেমের দ্বারা তার সঙ্গে সমন্বিত হতে হবে – এটাই বাউল দর্শনের মূল সত্য। বাউলগানে আছে ধর্মীয় ভেদাভেদহীন এক সার্বজনীনতা। রবীন্দ্রনাথই প্রথম বাউল সঙ্গীতকে শিক্ষিত অভিজাত মহলে তুলে ধরেন। ‘সঙ্গীতচিন্তা’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগ-রাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিলন ঘটেছে। ...লোকসাহিত্যে এমন অপূর্বতা আর কোথাও পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করিনে”। শিলাইদহে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ বাউল গগন হরকরার কাছে বাউল গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তাঁর কাছ থেকে বাউল গান সংগ্রহ করে প্রকাশ করেছিলেন। শিলাইদহের এক গ্রামীণ ডাকঘরের হরকরা গগন দাস (জন্ম ১৮৪৫) কে লালনের গানই প্রাণিত করেছিল। বাউল সঙ্গীতধারার প্রতি রবীন্দ্রনাথ অনুরক্ত ছিলেন, তাঁর অনেক লেখায় লালনের উল্লেখ আছে। এখন বাউল গান বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিশ্বের ৪৩টি বাক ও বিমূর্ত ঐতিহ্য চিহ্নিত করতে গিয়ে বিশ্ব সংস্থা ইউনেসকো বাংলার বাউল গানকে অসাধারণ সৃষ্টি বলে আখ্যা দিয়ে একে বিশ্ব সভ্যতার সম্পদ বলে ঘোষণা করেছে। বাউল গানকে ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’-এর তালিকাভুক্ত করে ইউনেসকো সদর দপ্তর ২০০৫ সালের ২৭ নভেম্বর এই স্বীকৃতি ঘোষণা করে।
লালন সঙ্গীত রচনা করেছিলেন প্রধানত বাউল সুরের আদর্শে, কিন্তু তিনি বাউল সাধক ছিলেন না। তাঁর সহস্রাধিক সঙ্গীতরচনা ‘লালন-গীতি’ নামে পরিচিত । লালন তাঁর গানে সমকালীন সমাজের নানান কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, সামাজিক বিভেদ ইত্যাদির কথা তুলে ধরেছেন।লালন তাঁর সমগ্র জীবনচর্যার মধ্য দিয়ে জাত-ধর্মের বিরুদ্ধে তীব্র জেহাদ বজায় রেখেছিলেন তাঁর গানে। লালন ছিলেন ভারতের প্রথম আধুনিক মানুষ রামমোহন রায়ের সমসাময়িক। একই সময়ে দুজনের জন্ম। রামমোহনের আধুনিক চিন্তা আঘাত করেছিল সমাজের অন্ধত্ব, কু-প্রথা ও কুসংস্কারে।রামমোহন প্রজ্জ্বলিত আলোকবর্তিকা বাংলার নবজাগরণের সেই ঊষালগ্নে গ্রামীণ লোকচিত্তে কি আলোড়ন তুলেছিল তার কোনও লেখাজোখা নেই। লালনের বাউলগানে গ্রামীণ লোকচিত্তের আলোড়নের কিছু আভাস নিশ্চিতভাবেই পাওয়া যায়।
বিশ শতকের লোকগানের এক খ্যাতকীর্তি সঙ্গীতকার শাহ আবদুল করিম (জন্ম১৯১৬) লালনের দর্শনের আদর্শে প্রায় দেড় হাজার সঙ্গীত রচনা করেন। শাহ আবদুল করিম শুধু বাউল গানই রচনা করেননি, ভাটিয়ালি, দেহতত্ব, মারফতি, ধামাইল প্রভৃতি লোকধারার এবং অনেক গণচেতনার সঙ্গীতও রচনা করেন। একালের নবীন প্রজন্মের শিল্পীরাও শাহ আবদুল করিমের গান গেয়ে লোকপ্রিয়তা অর্জন করছেন।
উপসংহারে আবার রবীন্দ্রনাথের কথা “আত্ম প্রকাশের জন্য বাঙালি স্বভাবতই গানকে অত্যন্ত আপন করে চেয়েছে...গানকে ভালোবেসেছে বলেই সে গানকে আপন হাতে, আপন মনের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করতে চেয়েছে”। বিশ শতকের শুরুতে গ্রামোফোন বাহিত যে ধ্বনিবদ্ধ গান বাঙালির ঘরে ঘরে পৌছানো শুরু হয়েছিল, যার গালভরা নাম দিয়েছিলাম ‘আধুনিক বাংলা গান’, আজএকুশশতকের প্রথম দশকের শেষভাগে তার সব শক্তিরই ক্ষয় দেখছি । কিন্তু এই ক্ষয়ের মধ্যেও আশার আলোকরেখা দেখছি না এমন নয়। নবীন প্রজন্মের শিল্পীরা রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলান,অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তর গানের কাছে যাচ্ছেন, তাঁরা লালনের গান, শাহ আবদুল করিমের গান গাইছেন, প্রচার করছেন,লোকসঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। আমার বিশ্বাস নবীনকালের শিল্পী,সুরকাররা শিকড়ের কাছে ফিরতে চাইছেন। শিকড়ের কাছে – শিকড়ের গানের কাছে গানশোনা বাঙালিকে ফিরতেই হবে ।
অনেক অজানা জানা হল। বেশ সুন্দর আলোচনা।
ReplyDeleteগ্রাম বাংলার মানুষের জীবনের কথা, সুখ দুঃখের কথা ফুটে ওঠে এই সঙ্গীতে।
ReplyDeleteলুপ্তপ্রায় অথচ বাংলার লোকগানের মণিখণ্ডসম কিছু উদ্ধৃতি দিলে আরও ঋদ্ধ হতাম। শুভেচ্ছা সহ উত্তম
ReplyDelete