0

নাটক - সরিৎ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


 নাটক


পরশপাথর
সরিৎ চট্টোপাধ্যায় 



চরিত্র: ঝিলিক, মৌ, দীপাঞ্জন, জয়, উদ্ভুটেশ্বর ডায়োজিনিস, জিলি, কস্তুরী সেন

(পর্দা খুললে দেখা যায় একটি বছর পাঁচেকের মেয়ে অডিয়েন্স রাইট ডাউন স্টেজে একটা টেবিলে বসে পা দুলিয়ে গান গাইছে।)



ঝিলিক: আমার দিন কাটে না আমার রাত কাটে না
স্মৃতিগুলো কিছুতেই পিছু হাঁটে না
আমার দিন কাটে না আমার রাত কাটে না

(মৌয়ের রাইট উইংগ দিয়ে প্রবেশ। ঝিলিককে টেবিল থেকে নামিয়ে মা মেয়ে হাত ধরাধরি করে গান গায়)

যে আলো ছড়ালো এই দুটি চোখে
সে কেন এলো না তারই আলোকে।।
তাকে না আর দেখে মন ওঠে না
স্মৃতিগুলো কিছুতেই পিছু হাঁটে না
আমার দিন কাটে না আমার রাত কাটে না

মৌ: অনেক গান হয়েছে ঝিলিক, এইবার দুধটা খেয়ে নাও। 

ঝিলিক: দুধ বাজে!

মৌ: দুধ বাজে নয়, খাও! দাদা কী সুন্দর দুধ খেয়ে নেয় দেখনি?

ঝিলিক: দাদা বাজে!

মৌ: ছিঃ, দাদা বাজে কেন রে? নাও শেষ করো এটা। এবার পড়তে বস। 

ঝিলিক: উঁহ! পড়া বাজে!

মৌ: কী সাঙ্ঘাতিক মেয়ে! পড়া বাজে! বাবার সামনে বলতে পারবি?

ঝিলিক: আজ দাদা বাবার কাছে এইসসা খাবে না ... হিহি ... এখনো ফেরেনি। 

মৌ: সত্যি তো রে! জয়টা এখনো ফিরল না! তোর বাবা তো এই এল বলে। ছেলেটার কোনো ভয়ডরও নেই ... রোজ এত বকা খায় ... (বেল বেজে ওঠে) ... দেখলি! যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যে হয় ... আজ ওর কপালে দুঃখ আছে। ও, তুমি! আজ যে এত তাড়াতাড়ি চলে এলে?



(দীপাঞ্জনের লেফ্ট উইংগ থেকে প্রবেশ। ঝিলিক ছুটে আসে)

দীপ: তাড়াতাড়ি! কই মৌ, রোজ তো এই সময়ই ফিরি ...

ঝিলিক: বাবা, বাবা ...

দীপ: ইয়েস, মাই প্রিনসেস!

মৌ: আঃ ঝিলিক! বাবাকে একটু রেস্ট নিতে দাও। 

দীপ: আরে না না, ঠিক আছে। ইয়েস, মাই প্রিনসেস! হাই আর ইউ টুডে?

(মৌয়ের দীপাঞ্জনের অফিসের ব্যাগ হাতে রাইট উইংগ দিয়ে প্রস্থান)



ঝিলিক: আমি পুরো দুধ খেয়ে নিয়েছি! ফিনিশ!

দীপ: গুড গার্ল! কিন্তু ঢুকতেই বাবাকে আজ এত আদর? কী ব্যাপার! রাজকুমারী ঝিলিকদেবীর মুখে দুষ্টু দুষ্টু হাসি কেন?

ঝিলিক: বললে তুমি আমায় বকবে। 

দীপ: কেন বকব কেন?

ঝিলিক: আমি এখনো পড়তে বসিনি। 

দীপ: হুম! সেতো দেখতেই পাচ্ছি। পড়তে বসনি কেন?

ঝিলিক: আমার পড়তে বাজে লাগে। 

দীপ: পড়তে বাজে লাগে! কী সব্বোনাশ!

(গেলাসে জল নিয়ে মৌয়ের প্রবেশ)



মৌ: আজ রুনুমাসির ফোন এসেছিল। 

দীপ: কী বললেন? সব ভালো তো?

মৌ: এখন ভালোই আছেন। শনিবার ওঁর ওখানে যেতে বলছিলেন। যাবে?

দীপ: ওই শনি-রবি দুটোদিনই তো পাই মৌ। গেলে পরে জয়ের পুরো দিনটাই নষ্ট হবে। এমনকি টিউসানও। 

মৌ: ওই একজনই তো আছে এখনো মাথার ওপরে! কতদিন যাওয়া হয়নি বলোতো!

(মৌয়ের প্রস্থান)

দীপ: নেক্স্ট উইক ওর পরীক্ষাটা শেষ হোক মৌ, তারপর যাওয়া যাবে একদিন। তা ঝিলিকদেবী! পড়তে বাজে লাগে, তাই তো? তা কী করতে ভালো লাগে শুনি?

ঝিলিক: ফ্যাট ক্যাট স্যাট ম্যাট লুক অ্যাট ৱ্যাট প্যাটপ্যাট!

দীপ: ক্কী! কী বললি আবার বল?

ঝিলিক: ফ্যাট ক্যাট স্যাট ম্যাট লুক অ্যাট ৱ্যাট প্যাটপ্যাট!

দীপ: ফ্যাট ক্যাট স্যাট ম্যাট লুক অ্যাট ৱ্যাট প্যাটপ্যাট! এটা কী?

ঝিলিক: কবিতা। 

দীপ: কবিতা! কোথায় শিখলি?

ঝিলিক: দাদা লিখেছে। 

(মৌয়ের প্রবেশ)



দীপ: শুনছ! তোমার গুণধর ছেলে কবি হয়েছেন! আর ইনি হয়েছেন তার শিষ্যা! ওরে, কবি হলে খাবি কী? পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি। ওই ঝলসানো রুটিই শুধু জুটবে কপালে। পড়াশুনা কর মা, পড়াশুনো করে ওই কৌস্তভ সেনের মতো হ দেখি। কৌস্তভ সেন! ছেলেটা মাত্র দশবছর বয়সে মাধ্যমিক পাস করল, বারো বছরে গ্র্যাজুয়েশন। ভাবা যায়! গতবছর প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে নিজেরা ডেকে নিয়ে গেছে রিসার্চ করার জন্য। ওই, ওই হলো টার্গেট! ইউ মাস্ট এইম ফর দ টপ! দ ভেরি টপ! বুঝেছিস? (ঝিলিক ঘাড় নাড়ে)

আর বুঝেছিস! আরেকজনতো আবার কবিতা লিখছেন!

মৌ: কিছু খাবে?

দীপ: না। 

মৌ: একটু চা করি?

দীপ: বললাম তো না!

মৌ: কী হয়েছে বলোতো? আজ মুড অফ? অফিসে কিছু হয়েছে? 

দীপ: কী আর হবে? সেই রেষারেষি, পলিটিক্স ..., বসের ভুরু কোঁচকান। আর ভালো লাগে না মৌ এই চাকরি করতে। এত চেষ্টা করেও সেই মিডল ম্যানেজমেন্টেই পড়ে আছি। 

মৌ: তুমি কেন এরকম ভাবো বলোতো দীপাঞ্জন? আমরা তো বেশ আছি। 

দীপ: জয় কোথায়?

ঝিলিক: দাদা এখনো ফেরেনি। 

মৌ: আঃ ঝিলিক!

দীপ: জয় এখনো ফেরেনি! পৌনে সাতটা বাজে! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না! আমার পইপই করে বলা সত্ত্বেও .., মৌ, এরপর আমি যদি ওর ওপর হাত তুলি ...

মৌ: দীপাঞ্জন প্লিজ! ও এখনো ক্লাস সিক্সে পড়ে! স্কুলের পর রোজ দেড়ঘণ্টা টিউশান পড়ছে, একটু খেলবে না?

দীপ: না, খেলবে না! সময় নেই মৌ, তুমি বুঝতে পারছ না, সময় বড়ো কম। আমি ওঁকে নেক্সট ইয়ারেই আকাশের ফাউন্ডেশন কোর্সে ভর্তি করে দেব। হি হ্যাজ টু মেক ইট! হি হ্যাজ টু! প্রথমে আইআইটি, তারপর আইআইএম, আর তারপর ...

মৌ: তারপর? তারপর কী দীপাঞ্জন? তারপর ও খেলবে? গান গাইবে? আবৃত্তি করবে?

দীপ: ও হ্যাং ইওর আবৃত্তি! ঘরের ভেতর সীমাবদ্ধ হয়ে জীবন কাটাচ্ছ, জানো না তো বাইরের জগতটা কী! ইটস্ আ ডগ ইটস্ ডগ কম্পিটিশন আউট দেয়ার!

(জয় [ফুটবল হাতে], উদ্ভূটেশ্বর আর জিলির প্রবেশ)

ও বাব্বা! এটা কে? নেইমার না মেসি? তা লাটসাহেবের এতক্ষণে বাড়ি ফেরার সময় হলো? আর জিলি, তোমার পড়াশুনো নেই? এই অপগণ্ডদের সঙ্গে ফুটবল খেলছ? আর এটা কে?

জয়: আরে ওর জন্যই তো এত দেরি হয়ে গেল বাবা। কী যে সব আজগুবি কথাবার্তা বলে না!

জিলি: ওরা কালই এখানে শিফ্ট করেছে কাকু। সত্যি, কী যে মজার মজার কথা বলে কাকিমা, তুমি ভাবতেই পারবে না। 

জয়: হ্যাঁ মা। ফুটবল খেলা দেখতে দেখতে কী সব বলছিল, আরে বল না জিলি ... কী যেন? হ্যাঁ, কাইনেটিক ভেলোসিটি ইন কার্ভিলিনিয়ার মোশনের কী সব ফরমুলা ... ভিসি, ইকুয়াল টু ডিওয়াই বাই ডিটি। 

দীপ: সেকি, এতো অনেক বড়ো ক্লাসের অঙ্ক!

জিলি: ওকে ওর নামটা জিজ্ঞেস করুন কাকু। 

দীপ: কী নাম তোমার বাবা?

উদ্ভুটেশ্বর: আজ্ঞে, উদ্ভূটেশ্বর ডায়োজিনিস। 

দীপ: কী!

উদ্ভুটেশ্বর: উদ্ভূটেশ্বর ডায়োজিনিস। 

মৌ: এ আবার কী নাম!

জিলি: তোমরা এর আগে কোথায় থাকতে?

উদ্ভুটেশ্বর: ইউরোপাতে। 

দীপ: ইউরোপে? ইউরোপে কোথায়? 

উদ্ভুটেশ্বর: ইউরোপ না, ইউরোপা। জুপিটার বা বৃহস্পতির চাঁদ, ইন ফ্যাক্ট দ ফোর্থ লার্জেস্ট মুন অফ জুপিটার। 

দীপ: ওয়াট!

মৌ: তার মানে তুমি বলতে চাও যে তুমি একটা এলিয়েন?

উদ্ভুটেশ্বর: ইয়েস। আমি পৃথিবীতে এসেছি এখানকার সিমপ্লিসটিক লাইফ ফর্মস্, মানে তোমাদের স্টাডি করতে। 

দীপ: আরে, এ বেশ মজার ছেলেতো! তুমি বসো বাবা, কী যেন নাম বললে? ও হ্যাঁ, উদ্ভুটেশ্বর ডায়োজিনিস। 

জিলি: তুমি কোন ক্লাসে পড়?

উদ্ভুটেশ্বর: আমাদের গ্রহে তোমাদের মতো স্কুল হয় না। 

জয়: তাহলে তোমরা পড় কোথায়?

উদ্ভুটেশ্বর: পড়ি না। 

মৌ: দীপাঞ্জন, ও কি সত্যি ওই ইউরোপা থেকে এসেছে নাকি? 

দীপ: পাগল নাকি? দাঁড়াও, এর একটা মীমাংসা করা দরকার। আচ্ছা, বলোতো বাবা উদ্ভুটেশ্বর, পৃথিবী থেকে ইউরোপার দূরত্ব কত?

উদ্ভুটেশ্বর: তোমাদের হিসেবে বাষট্টি কোটি তিরাশি লক্ষ কিলোমিটার। 

জয়: তাহলে এতদূরে এলে কী করে?

উদ্ভুটেশ্বর: আমার স্পেসশিপে। আমাকে কালকেই এখানে বিম-ডাউন করা হয়েছে। আর স্পেসশিপটা চাঁদের ওই পাশে, যেদিকটা তোমরা দেখতে পাও না, সেখানে অপেক্ষা করছে। 

মৌ: তোমার বয়স কত?

উদ্ভুটেশ্বর: তোমাদের হিসেবে একান্ন। 

জিলি: একান্ন! 

উদ্ভুটেশ্বর: আমাদের আঠেরোঘণ্টায় দিন হয় যে। 

জিলি: কাকু, ও সব ঠিক বলছে?

দীপ: তাই তো দেখছি রে জিলি। হি ইজ ফ্যাকচুয়ালি অ্যাবসোলিউটলি কারেক্ট। কিন্তু ইউরোপাতে তো জল নেই, বাতাস নেই। তাহলে তোমরা কী করে ...

উদ্ভুটেশ্বর: ভুল। জল আছে, পৃথিবীর চেয়েও বেশি, কিন্তু মাটির তলায়। ওপরে বরফ, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, মাইনাস দুশো ডিগ্রী। বাতাসও আছে, কিন্তু বাতাসে অক্সিজেন কম, আমরা অবশ্য নাইট্রোজেন ব্যবহার করি। আর এখানে তো প্রায় আটাত্তর পারসেন্ট নাইট্রোজেন। বিন্দাস!

ঝিলিক: তুমি আমাদের ভাষা শিখলে কী করে?

উদ্ভুটেশ্বর: আমার কানের ভেতর একটা ট্রান্সলিটারেটর চিপ লাগানো আছে। আর একটা আমার গলায়। আমি যে কোনো ভাষা বুঝতেও পারি, বলতেও পারি। 

জয়: বস্, দু-একটা এক্সট্রা হবে? আমার আবার এই বছর থেকেই জার্মান শুরু হয়েছে। কিস্সু বুঝতে পারি না। 

দীপ: বুঝবে কী করে? সারাদিন তো শুধু টইটই করে পাড়া বেড়ানো হচ্ছে। 

উদ্ভুটেশ্বর: Nicht spielverderber sein. Ihr freude nicht verderben. 

দীপ: তার মানে?

মৌ: Nicht spielverderber sein. ডোন্ট বি আ স্পয়েলস্পোর্ট! Ihr freude nicht verderben. ডোন্ট স্পয়েল দেয়ার হ্যাপিনেস! কী দেখছিস? দুবছর জার্মান শিখেছিলাম, বুঝেছিস?

দীপ: কী বলতে চাইছ তুমি?

উদ্ভুটেশ্বর: টলবে যখন টলবে বুড়া, ঘুচবে তোমার ধরাচূড়া, মিছেই শুধু সাহেবসুবো সাজছ হে। পিছনপানে দেখবে যখন, স্বপনগুলি খুঁজবে তখন, জীবনটাকে চোখের জলে মাজিবে হে!

জয়: হাহাহাহা! কী সব বলছে, ধুস্!

দীপ: না, দাঁড়া জয়। ও বোধহয় কিছু বলতে চাইছে ..., কী এটা? কবিতা? কার লেখা?

উদ্ভুটেশ্বর: উদ্ভুটেশ্বর ডায়োজিনিসের। 

দীপ: এর মানে? টলবে যখন টলবে বুড়া ...

উদ্ভুটেশ্বর: বুড়ো হবে তো, একদিন?

দীপ: ঘুচবে তোমার ধরাচূড়া ...

উদ্ভুটেশ্বর: এই টাকা পয়সা, বাড়ি গাড়ি, সব কি সাথে করে নিয়ে যাবে?

দীপ: টলবে যখন টলবে বুড়া, ঘুচবে তোমার ধরাচূড়া, মিছেই শুধু সাহেবসুবো সাজছ হে। পিছনপানে দেখবে যখন, স্বপনগুলি খুঁজবে তখন, জীবনটাকে চোখের জলে মাজিবে হে! না মৌ, এ তো বাচ্চা ছেলের কথা নয়!

মৌ: ওর বয়েস একান্ন দীপাঞ্জন!

দীপ: তার মানে তুমি বিশ্বাস করছ যে ও একটা এলিয়েন? ইমপসিবল! কিন্তু আমার কেন কে জানে কোথাও একটা গোলমাল লাগছে। 

উদ্ভুটেশ্বর: ইতিহাসে পাতিহাঁস, ভূগোলেতে গোল। গোল গোল গোলকধাঁধা, রুবি শুধুই বোকাহাঁদা?

জিলি: তার মানে?

উদ্ভুটেশ্বর: ডোন্ট স্টাডি!

জয়: আমরা লেখাপড়া করব না!

উদ্ভুটেশ্বর: ডোন্ট স্টাডি ... লার্ন। শুধু পড়বে না, শিখবে। যেটাকে ভালোবেসে শিখতে চাও, শুধু সেটাই শিখবে। আর যে কাজটাকে ভালোবেসে সারা জীবন করতে চাও, সেটাই করবে। 

মৌ: তোমরা সত্যিই স্কুলে পড় না? তাহলে এত কিছু শিখলে কী করে?

উদ্ভুটেশ্বর: বললাম তো, যেটা ভালো লাগে, শিখে নিই। ধরো, তোমরা গাঙ্গুরামের দোকানে গেছ। সেখানে তোমরা নিজের পছন্দের মিষ্টি কিনবে না অন্যের পছন্দের?

জয়, জিলি: নিজের!

উদ্ভুটেশ্বর: একজ্যাক্টলি! নিজের .., শুধু নিজের পছন্দের জিনিস শেখো, দেখবে সেটা কত আনন্দের। কারোকে আর বলতে হবে না, পড় পড়। তোমরা নিজের ইচ্ছেতেই পড়বে, শিখবে, জানবে। অ্যান্ড দেন ইউ উড অলওয়েজ বি হ্যাপি। 

দীপ: ওভাবে পড়ে পরীক্ষায় পাস করবে? চাকরি পাবে? ওসব ওই ইউরোপাতেই সম্ভব, পৃথিবীতে না। 

উদ্ভুটেশ্বর: তাই কী? স্টিভ জবস্, বিল গেটস্, মার্ক জুকারবার্গ, সচিন তেন্দুলকর, অ্যাব্রাহাম লিংকন এরা সবাই কিন্তু স্কুল ড্রপআউটস। এরা যে শুধু কৃতি হয়েছেন তা না, সমাজের প্রতি এঁদের অবদানটাও দেখতে হবে। আরেকজন সেই দাড়িওলা ভদ্রলোক, তোমাদেরই দেশের, নোবেল পেয়েছিলেন, তিনি তো কোনদিন স্কুলেই যাননি। আহা! কী লিখে গেছেন! মাথায় বৃহৎ জটা, ধূলায় কাদায় কটা, মলিন ছায়ার মতো ক্ষীণ কলেবর, ক্ষেপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর! 

মৌ: রবিঠাকুর!

উদ্ভুটেশ্বর: জানো, আমার তো মনে হয় পরশপাথর মানে হলো জ্ঞান, নলেজ। 

জয়: আমি রবিঠাকুরের একটা গান বাজাতে পারি। বাজাই?

(জয় কি-বোর্ডে 'পুরানো সেই দিনের কথা' দুলাইন বাজায়)

দীপ: তুই কি-বোর্ড বাজাস! এ গান তোকে কে শেখাল! ও তুমি! তাই বলি। নে, সর দেখি। 

ঝিলিক: বাবা, তুমিও বাজাতে পার?

(দীপাঞ্জন হেসে বাজিয়ে গেয়ে ওঠে। বাকিরাও গলা মেলায়। মৌ, জিলি, ঝিলিক নাচে)

দীপ: পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।
আয় আর একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।
মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়--
বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়। 
হায় মাঝে হল ছাড়াছাড়ি, গেলেম কে কোথায়--
আবার দেখা যদি হল, সখা, প্রাণের মাঝে আয়॥


জয়: বাবা, তুমি এত ভালো বাজাও আর ...

দীপ: বাজাই না কেন? ছোটোবেলায় এই গানবাজনা নিয়েই থাকতাম জানিস। কিন্তু সংসারে তো ওই দিয়ে ভাত জোটে না। একটু ভালোভাবে বাঁচতে চাইলে অনেক কিছুই ছাড়তে হয়। তারপর আরেকটু ভালোভাবে বাঁচা .., আরেকটু সুখ! কখন যে সুখের চোরাবালিতে সুর তলিয়ে গেছে বুঝতেও পারিনি রে। 

জয়: বাবা!

মৌ: তোলো ছিন্ন বীণা, বাঁধো নতুন তারে,
ভরে নাও সুর গাও জীবনেরই জয়গান ...
আগামীদিনের আলো, দুচোখে মেখে নাও
আঁধার ঘুচিয়ে দাও ভোলো অভিমান।

দীপ: সত্যি কী করছি আমরা মৌ! এইভাবে বাঁচার জন্যই কি আমরা একসাথে পথ চলা শুরু করেছিলাম? আমাদের সেই ছোট্ট গ্রামের আকাশ, আজও আমায় ডাকে, আমায় হাতছানি দিয়ে বলে, আয় দীপ, পালিয়ে আয়! ওখানে আছিস কী করে? এতটুকু বাতাস নেই, খোলা আকাশ নেই, কী করে পড়ে আছিস ওখানে?

মৌ: সত্যি দীপাঞ্জন, আমিও আর পারছি না! একান্নবর্তী পরিবারে বড়ো হয়েছি, এই ইট-কাঠের জঙ্গলে আর কিছুই ভালো লাগে না। একটা বন্ধু নেই, পাশেরবাড়িতে কারা থাকে তাও আমরা খোঁজ নিই না। দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। সত্যিই আমি আর পারছি না!

(কান্নায় ভেঙে পড়ে মৌ)

উদ্ভুটেশ্বর: যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে,
সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া,
যদিও সঙ্গী নাহি অনন্ত অম্বরে,
যদিও ক্লান্তি আসিছে অঙ্গে নামিয়া,
মহা আশঙ্কা জপিছেমৌন মন্তরে,
দিক্‌-দিগন্ত অবগুণ্ঠনে ঢাকা--
তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।

দীপ: তুই আসলে কে বলতো বাবা? এই রুক্ষ শুষ্ক সংসারে আজ ভোরের বৃষ্টির পরশমাখা এক দমকা হাওয়ার মতো ছুটে এলি? তুই কি মানুষ, না দেবতা? না সত্যিই কোনো গ্রহান্তরের জীব?

উদ্ভুটেশ্বর: আমি সে ভোলানাথ নই গো, আমি সে ভোলানাথ নই। আমার নাম .., কৌস্তভ সেন। 

দীপ: কৌস্তভ সেন! মানে সেই কৌস্তভ সেন? প্রিন্সটন স্কলার? মাই গুডনেস!



(কস্তুরী সেনের গলা ভেসে আসে দরজা দিয়ে। পরমুহূর্তে প্রবেশ)

কস্তুরী: ঋজু! ঋজু! আচ্ছা আপনারা কোনো বছর চোদ্দর ছেলেকে দেখেছেন? 

উদ্ভুটেশ্বর: মা!

কস্তুরী: একি ঋজু! তুই এখানে! আর আমি কখন থেকে তোকে খুঁজছি। 

মৌ: আপনিই কৌস্তভের মা?

কস্তুরী: কৌস্তভ! আশ্চর্য! ও নিজের পরিচয় আপনাদের জানিয়েছে? সচরাচর তো ও ..! হ্যাঁ, আমিই কৌস্তভের মা। আমার নাম কস্তুরী সেন। নমস্কার। 

মৌ: নমস্কার। আচ্ছা ওই প্রিন্সটনে ছিল, না? 

কস্তুরী: হ্যাঁ। 

দীপ: তাহলে ..? 

কস্তুরী: ছোটো থেকেই ও ওর সমসাময়িক বাচ্চাদের থেকে অন্যের তীক্ষ্ণবুদ্ধি ছিল। আর সেটা বোঝার পর থেকেই আমি ওকে নিয়ে পাগলের মতো মেতে উঠেছিলাম। ওর ক্ষমতাও ছিল সবকিছু শুষে নেওয়ার। আমিও ওঁকে নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগ দিইনি। আরো, আরো পড়! আমার ছেলের ট্যালেন্ট যেন কোনোভাবেই নষ্ট না হয়। কোনো বাঁধা মানিনি, কারো কথা শুনিনি, এমনকি ওরও না। 

ও বলত, মা, আমার গান শুনতে ইচ্ছে করে; ইচ্ছে করে কবিতা পড়ি। আমি বলতাম, পাগল! ওসবের জন্য অনেক সময় পড়ে আছে জীবনে। পাগলামি করিস না ঋজু, তোকে অনেক ওপরে উঠতে হবে। ইউ মাস্ট রিচ দ টপ, দ টপ, দ ভেরি টপ!

প্রিন্সটনে যাওয়ার সময় ও বলল, মা, আমি ... আমি একা একা ওখানে থাকতে পারব না। প্লিজ আমায় পাঠিও না। আমি বললাম, ঋজু, একটু কষ্ট কর বাবা। তুই অন্যদের মতো নস! ইউ আর মেড ফর গ্রেট থিংগস্! 

ও চলে গেল। যাবার দিন একবারও কাঁদেনি। রোজ ফোন করতাম। ও বেশি কথা বলত না। ধীরে ধীরে ফোন ধরাও বন্ধ করে দিল। মাস চারেক পর ওখান থেকে একটা ফোন এল। বলল, ওর নাকি নার্ভাস ব্রেকডাউনের মতো কিছু একটা হয়েছে। এসে নিয়ে যান। 

আজ দেড়বছর ওকে নিয়ে এসেছি। কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারি না। ডাক্তার দেখিয়েছি, কোনো লাভ হয়নি। ওর অত সাধের বইগুলোর দিকে একবার ফিরেও তাকায় না। অসংলগ্ন কথা বলে, অদ্ভূত সব কবিতা আওড়ায়। একা ঘরে থাকলে জানা অজানা সব গানের সুর ভেসে আসে। 

ওর এই অবস্খার জন্যই পুরোনো পাড়া ছাড়তে হলো। সবাই বলতে শুরু করেছিল, ও পাগল! ওঁকে নিয়ে হাসাহাসি করত। আজ ওকে বাড়িতে না পেয়ে ভয় পেয়ে গেছিলাম। নতুন পাড়া, আর ওতো এখনো পনেরোও পেরোয়নি। 

মৌ: ও কিন্তু আজ দিদি আমাদের সাথে খুব আনন্দ করেছে। কত গল্প করেছে, আবৃত্তি করেছে। 

কস্তুরী: কী বলছেন আপনি! ঋজু আবৃত্তি করেছে?

জিলি: হ্যাঁ কাকিমা, ও আমাদের সঙ্গেই ছিল এতক্ষণ। আমাদের ওকে খুব ভালো লেগেছে। খুব মজার ছেলে। 

জয়: ও আমাদের কি বলেছে জানোতো কাকিমা? ও নাকি বৃহস্পতির চাঁদ ইউরোপা থেকে এখানে এসেছে! ও একটা এলিয়েন! হাহাহাহা!

জিলি: আর ওর নাম কি বলেছে জানো? উদ্ভূতেশ্বর ডায়োজিনিস!

কস্তুরী: ডায়োজিনিস! দ রেবেল গ্রীক ফিলোজফার। ঠিকই তো! ওর জগতটাই যে একদম আলাদা। ওর সমবয়স্কদের সঙ্গে তো ওর কোনদিনই মেশার বেশি সুযোগ হয়নি। ওপাড়ার বাচ্চাদের কাছে ও তো ছিল এক আজব বস্তু, হাসির খোরাক। এই প্রথম এরকম সুযোগ .., আচ্ছা, ও কী রোজ তোমাদের সাথে খেলতে আসতে পারে? 

মৌ: ওমা নিশ্চয়ই। আপনি বিশ্বাস করুন, ও আজকে যেন একটা খুশির জোয়ার নিয়ে এসেছে আমাদের এখানে। 

দীপ: কস্তুরী, আজ ও না এলে, আমিও হয়ত আমার ছেলেমেয়েদের ওই একই পথে ঠেলে দিতে থাকতাম। আর শুধু আমি কেন, হাজার হাজার মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবা-মায়েরাও তাই করছে। ভবিষ্যতের কল্পিত সুখের বদলে কেড়ে নিচ্ছে ওদের বর্তমান, ওদের শৈশব। আর ওদের দোষই বা দিই কী করে? আমাদের জীবনে আর কী লক্ষ্য আছে বলুন? একটা চাকরি, কোনরকমে গ্রাসাচ্ছাদন, ব্যস! আর তার জন্য প্রয়োজন একটাই মূলধন, ওই লেখাপড়া, আর একটা চাকরি। 

কস্তুরী: হ্যাঁ, আজ বুঝেছি কতটা অবিচার, কতটা অন্যায় আমি করেছি ওর সঙ্গে। 

মৌ: ও বলেছে, ডোন্ট স্টাডি, লার্ন। ঠিকই তো, আমরা পড়ি, শিখি না। শেষে শুধু থেকে যায় কাগজে ছাপা একটা ডিগ্রী। আর হারিয়ে যায় একটা গোটা শৈশব। 

দীপ: কস্তুরী, আজ আপনার ছেলের পরশ পেয়ে আমরা যেন এক নতুন আলো দেখতে পেয়েছি। ও যেন সত্যিই সেই পরশপাথর যার ছোঁয়ায় আমরা আবার আমাদের সেই সোনার সংসারটাকে খুঁজে পেলাম। 

কস্তুরী: আমার কিন্তু দৃঢ় বিশ্বাস জানেন, ও যদি একটা স্বাভাবিক পরিবেশ পায়, ওর সমবয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটায়, ও আবার ভালো হয়ে উঠবে। 

দীপ: অবশ্যই। আর তারই সঙ্গে আমাদেরও সঠিক পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। 

কস্তুরী: স্যরি, আপনাদের পরিচয়টা ...

দীপ: ওহো, দেখেছেন, বলাই হয়নি। আমি দীপাঞ্জন চৌধুরী, আমার স্ত্রী মৌ, জয়, ঝিলিক, জিলি। আর এঁকে তো অবশ্যই চেনেন, শ্রীমান উদ্ভূটেশ্বর ডায়োজিনিস ওরফে কৌস্তভ, ওরফে ঋজু! আরে মৌ, ওনাকে বসতে বলো। 

মৌ: ও স্যরি, আপনি বসুন প্লিজ। 

কস্তুরি: না না, আজ আমরা আসি। আবার আসছি তো ...

দীপ: দুমিনিট, জাস্ট দুটো মিনিট বসে যান। আজ বহুকাল পরে এই যন্ত্রটায় হাত দিয়েছি। আর একটা বাজাচ্ছি। ওয়ান ফর দ রোড, ওক্কে? মৌ, বাচ্চারা, কস্তুরী, গলা মেলাতে হবে কিন্তু। আর আপনাদেরও, কেমন? ওক্কে স্টার্ট!

সবাই: কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ
দিবারাত্রি নাচে মুক্তি নাচে বন্ধ--
সে তরঙ্গে ছুটি রঙ্গে পাছে পাছে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ॥

মম চিত্তে নৃতে নৃত্যে কে যে নাচে
তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।
তারি সঙ্গে কী মৃদঙ্গে সদা বাজে
তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ॥


।।যবনিকা।।



কৃতজ্ঞতা:
আমার দিন কাটে না: কথা ও সুর: সুধীন দাসগুপ্ত
পুরানো সেই দিনের কথা: কথা ও সুর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তোলো ছিন্ন বীণা: কথা: স্বপ্ন চক্রবর্তী; সুর: রাহুলদেব বর্মন
যদিও সন্ধ্যা আসিছে: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মম চিত্তে, নৃতে নৃত্যে: কথা ও সুর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

0 comments: