0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


জলরেখা
 নন্দিনী সেনগুপ্ত


১৬ 

‘না, না... আর আমার ঘর পরিষ্কার করার দরকার নেই, দেবলাদি! আমি নয়নের ঘরেই রাতে ঘুমাবো।’ হাত নাড়ে নিরূপ।

‘ঠিক আচে, দেদাবাবু। কিন্তুক বেশিক্ষণ লাইগবে না। যদি বল’... কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়ায় দেবলা। 

‘না, একদম না। কোনও দরকার নেই। কিন্তু বউমা, মানে সোনা কবে গেল বাপের বাড়ি? নয়ন কি মাঝে মধ্যে আসছে? আজ কি নয়ন আসবে না? ওর সঙ্গে তো দেখা হবে না তাহলে। আমি তো দু'দিন পরেই হুগলী চলে যাব।’ সুটকেসের ঢাকনা খুলতে খুলতে বলে নিরূপ। 

‘তুমার ছাড়া জামাকাপড় থাকলে আমারে দাও দেদাবাবু। আমি কাচি রাখি দেবা’নে।’ হাত বাড়ায় দেবলা। 

‘না, আমি সব কাপড় কাচিয়ে এনেছি। যেটা পরে এলাম, সেটা নাহয় কাল দেবো। আর এক দুটো জমুক। কিন্তু তুমি আমার কথার জবাব দিলে না? সোনা কবে গেল?’ আবার বলে সে।

এবার দেবলা একটু এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলে, ‘সে অনেক কতা। পরে বলব। একন বলা যাবে নে। তুমার জানা দরকার। তুমি তো এখেনে ছেলে না। অনেক মহাভারত।’

এবার নিরূপ ফিক করে হেসে ফেলে, ‘বল কি? মহাভারত?’ 

দেবলা চোখ বড় বড় করে বলে, ‘হেসোনি দেদাবাবু! হেসোনি। তুমার কানে কোনও কতা বড়মা দিবেন না, সে আমি জানি। কিন্তুক বড়মা কত মনোকষ্ট নিয়ে এবাড়ি ছেড়ে হুগলী গেচে সে তুমার জানা দরকার।’ ফিসফিস করে বললেও ‘দরকার’ শব্দটির উপরে দেবলা বেশ জোর দেয়... ‘একন না। তুমি তো দু'দিন আচো। আর দেকো না, আমারে ঝদি একবার হুগলী লয়ে যাতি পারো, খুব ভালো হয়। সেইখেনে যেয়ে সব বলব। নিরুটারে কদ্দিন চোকে দেকি নি গো’। দেবলার চোখ ছলছল করে ওঠে। 

নিরূপ ভেবে পায় না কি বলবে। এরই মধ্যে বসার ঘরে চলে আসেন কমল, কমলকিশোর মুখোপাধ্যায়। সম্পর্কে নিরূপের বড়কাকা। কমল এসে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই দেবলা তড়িঘড়ি বলে ওঠে, ‘তাহলে তোমার সুটকেস একন নয়নবাবার ঘরে নিয়ে রেকে দিই?’ নিরূপ মাথা নাড়ে। কমল গলা খাঁকারি দিয়ে চোখে চশমা এঁটে বেশ জাঁকিয়ে বসেন একটা চেয়ারে। তারপর বেশ ধীরে ধীরে বলেন অনুচ্চ স্বরে, ‘ভালই হয়েছে, বুঝলি, তুই এখানে আসাতে। তুই হুগলী যাবি তো? তার আগে আমার সঙ্গে বসে ভালো ভাবে বুঝে নিবি আমি কি বলতে চাই। মানে আমার একজ্যাক্ট বক্তব্যটা কি... সেটা তুই দাদাকে গিয়ে একটু বোঝাবি’। 

নিরূপ চোখ পিটপিট করে বলে, ‘হ্যাঁ, কাকা, নিশ্চয়ই। ইয়ে... বাড়ির আর সবাই কোথায়? নিবিড় ফেরেনি অফিস থেকে? নীলবাবুকে দেখতে পাচ্ছি না। কাকিমা, অঞ্জনা ওরা কোথায়?’

কমল বলেন, ‘তোর কাকিমা বোধহয় সন্ধ্যা দিতে ঠাকুর ঘরে গেল। নিবিড় অফিস থেকে ফিরে অঞ্জনা আর নীলকে নিয়ে একটু বেরোল। হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম...’ 

নিরূপ কথার মাঝেই থামিয়ে দেয় কমলকে, ‘হ্যাঁ, কথা বলব একদিন তোমার সঙ্গে বসে। আজ নয়। খুব ক্লান্ত লাগছে আসলে। ট্রেন ভীষণ লেট করল তো। এখন একটু স্নান করব। তারপর খাওয়া-দাওয়া করে একদম ঘুমিয়ে পড়ব। হ্যাঁ, দু'দিন আছি তো! কথা হবে। নিশ্চয়ই হবে...। এতদূর বলে নিরূপ গলা চড়িয়ে ডাকে, ‘দেবলাদি-ই-ই, আমাকে স্নানের জন্য একটু গরম জল দাও না।’ 

দেবলা ছুটে আসে, ‘হ্যাঁ, দেদাবাবু, এই যে চল না। নয়নবাবার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া চানঘরে গরমজলের মেশিন আচে। ব্যস। কল খোলো আর গরম জল। যত খুশি চান কর। আর গ্যাসে ওই কেতলি বসিয়ে জল গরম করতে হবে নে। চল, তুমায় দেইকে দি। আর হ্যাঁ, তুমি রেতে ভাত খাবে, নাকি রুটি?’ 

দেবলা নয়নের ঘরের আলো জ্বেলে, স্নানঘরের আলো জ্বেলে, গিজারের সুইচ দেখিয়ে দেয় নিরূপকে। যাবার আগে আবার ফিসফিসিয়ে বলে, ‘আমারে হুগলী নে যাবার কতাটা এটটুস মাতায় রেকো দেদাবাবু।’ 

নিরূপ ফ্যান চালিয়ে জানালা খুলে দেয়। চাপা গুমোট এই ঘরে। বড় গরম পড়েছে কলকাতায়। একটু ঝড়-বৃষ্টি হলে হয়ত ভালো হতো। কিন্তু... সবাই কি এত কথা বলতে চায় তার সঙ্গে? ভাবতে ভাবতে ভ্রু কুঁচকে ওঠে তার। বড়কাকার দরকারি কথা আছে। দেবলাদির তো মহাভারত জমে আছে। সত্যিই... কি এমন ঘটেছিল যে মা এবাড়ি ছেড়ে চলে গেল হুগলী? সংসারের বাইরে থাকে বলে সে কোনওদিন তলিয়ে ভাবেনি সেভাবে! সোনা কি শুধুই অসুস্থতার জন্য এবাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়িতে থাকছে? 

স্নানঘরে জলের ধারার নিচে দাঁড়িয়ে সে এই ভাবনাগুলো মন থেকে সরিয়ে মনে মনে হিসেব করতে থাকে আগামীকাল কখন যাবে ল্যাবে তার জলের স্যাম্পলগুলো নিয়ে। হিসেব করতে থাকে কদিন লাগতে পারে রিপোর্ট পেতে আর রিপোর্ট পেলে সে কি কি করতে পারে? একজ্যাক্টলি কি করা সম্ভব তার পক্ষে? যদি পজিটিভ আসে, মানে সে যা ভাবছে, তাইই হয়, তাহলে কি আরও রিসার্চ করবে ব্যাপারটা নিয়ে? মানে কনট্যামিনেশনের সোর্সটা কি, কোন পাথর থেকে ফ্লুওরাইড চুইয়ে এসে মাটির নিচে জলে মিশে যাচ্ছে- সেটা নিয়ে আরও ফিল্ডওয়ার্ক করে, আরও ডেটা কালেক্ট করে সেটা পাবলিশ করবে, নাকি তার আগে হেলথ ইস্যুর ব্যাপারটা নিয়ে উপরমহলে জানাবে? কিন্তু তার কথা সেখানে কে শুনবে? ওসব জায়গায় খাদানের পাথর নিয়ে দিনের পর দিন অবৈধ ব্যবসা, মাফিয়ারাজ চলে প্রশাসনের নাকের ডগায়। এমনকি তলায় তলায় প্রশাসনের লোকও জড়িত থাকে। উপরমহল থেকে পরিষ্কার বলা আছে, তাদের না ঘাঁটিয়ে চুপচাপ নিজের দরকারি একআধটা পাথর তুলে নিয়ে চলে আসবার কথা। সেসব জায়গায় কোন গ্রামে কে জল খেয়ে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে, এসব নিয়ে কে মাথা ঘামাবে? প্রশাসন কান না দিয়ে এক্কেবারে উড়িয়ে দিতে পারে পুরো ব্যাপারটা। 

কিন্তু পেপার পাবলিশ হতেও তো সময় লাগবে। পেপার পাবলিশ হলে, মানে খাতায় কলমে ব্যাপারটা প্রমাণ করে চুপ করে বসেও থাকতে পারে সে। এর বেশি কিছু তার করার কথাও নয়। কিন্তু তদ্দিনে আরও কিছু মানুষ পঙ্গু হয়ে যাবে। ‘কি করবে তুমি? কি করবে নিরূপ?’ স্নানঘরের আয়নায় নগ্ন মানুষটা ফের প্রশ্ন করতে শুরু করে।

0 comments: