বইঘর - চয়ন
Posted in বইঘর
বইঘর
পুরাণ কোষ : নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী
চয়ন
পুরাণ কথার অর্থ পুরাতন। আবার পুরাণের অর্থ যা চিরন্তন : "পুনঃ পুনর্জায়মানা পুরাণী।" পুরাণ তাই পুরাতন হয়েও চিরনবীন। ভারতের আঠারোটি পুরাণে ধরা আছে তার কৃষ্টি -সংস্কৃতি, তার ঐতিহ্য, তার স্পন্দিত জীবন। শুধু পুরাণ কেন? স্মৃতি, সংহিতা, রামায়ণ ও বিশেষ করে মহাভারত যে প্রাণের চলচ্ছবিকে ধারণ করে রয়েছে তা চিরশাশ্বত। যে আলোকস্বপ্ন চেতনায় ধরে অন্ধকারের মধ্যে পথ কেটে কেটে এগিয়ে চলেছে সভ্যতা, সেই আলো উজলে ওঠে এই মহাগ্রন্থ গুলিতে। প্রাচীন ছাড়া নবীনের অস্তিত্বও নেই। 'কী ছিলাম' এর সঙ্গে তুলনা না করলে 'কী হইয়াছির' বোধ আসে না। এই তুলনা করব কী করে? শব্দের সাহায্যে। শব্দের ত্রিবিধ শক্তি : অভিধা, লক্ষণা ও ব্যঞ্জনা। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'শব্দকোষ' বলে: 'শব্দের যে শক্তিতে তাহার মুখ্যার্থ বা বাচ্যার্থ প্রতীত হয়, অর্থাৎ শব্দের উচ্চারণ মাত্রেই তাহার ...অনায়াসলভ্য সহজ মুখ্য অর্থের বোধ হয়, তাহা 'অভিধা' শক্তি। অর্থাৎ, অভিহিত করে, নাম ধরে ডেকে, আখ্যায়িত করে আমরা চিনে নিই আমাদের অতীত ও বর্তমানকে। তাই আমাদের প্রয়োজন এমন এক কোষগ্রন্থ যা পুরাণ বিধৃত জীবনকে কথনে ধরার সহায়ক হয়। খুব সহজ করে বলতে গেলে প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ, মহাকাব্য, পুরাণ প্রভৃতিতে নানা বিষয়ের যে বিপুল সমাবেশ আমাদের দৈনন্দিন যাপনে আজও প্রাসঙ্গিক; যে জ্ঞানতত্ত্ব আমাদের আজও বড় প্রয়োজন; আমাদের সাহিত্যে যে পুরাণ অনুষঙ্গ ফিরে ফিরে আসে তাদের জানতে গেলে এমন একটি গ্রন্থ আমাদের নিতান্ত প্রয়োজন যেখানে দুমলাটের মধ্যে আমরা এদের প্রাথমিক পরিচয় লাভ করতে পারি। অভিহিত করতে পারি এদের। উদাহরণ হিসেবে পরশুরামের কচিসংসদে পুরাণোক্ত হৈহয় ক্ষত্রিয়দের উল্লেখ আমরা স্মরণ করতে পারি। কোথায় পাব এদের সন্ধান? অষ্টাদশ পুরাণের কোনটির মধ্যে? প্রাথমিক পরিচিতিই বা পাব কোথায়? এর সবকটির উত্তরই যদি একটি পৌরাণিক অভিধান বা পুরাণ কোষের মধ্যে পাওয়া যায় তবে তার মূল্য আমাদের কাছে কী হতে পারে তা অনুমান করার জন্য কোনও অলৌকিক মেধার প্রয়োজন নেই।
এরকম গ্রন্থ আমাদের বাংলা ভাষায় যে নেই তা নয়। রয়েছে শশীভূষণ বিদ্যালঙ্কারের 'জীবনী কোষ' বা সুধীর চন্দ্র সরকার সংকলিত 'পৌরাণিক অভিধান'। তবে, সমস্যা একটাই। বর্তমানে প্রথম গ্রন্থটি নিঃশেষিত, কবে পুনঃমুদ্রিত হবে ঠিক নেই। আর দ্বিতীয়টিতে যথেষ্ট অযত্নের ছাপ। একটি উদাহরণই যথেষ্ট। হিন্দ্রলিনী নামটি গ্রন্থবদ্ধ করে তাঁকে ব্রহ্মর্ষি জাবালির পত্নী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সমস্ত রামায়ণ খুঁজেও এ নামের কোনও হদিশ মেলে না। সংকলক কোনও আকরগ্রন্থের নামও করেননি। আসলে তাঁর পক্ষেও কাজটি অসম্ভব ছিল। কারণ, এই নাম কোনও প্রাচীন গ্রন্থে নেই। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে দৌহিত্রী আশার সৃষ্টি করা এই নাম নিজের 'জাবালি' গল্পে ব্যবহার করেন পরশুরাম। আশা দেবীর পুত্র দীপংকর বসু জানাচ্ছেন : "মা সাত আট বছর বয়স থেকেই খাতায় গপ্প লিখতেন। সপ্তাহান্তে দাদুর কাছে গেলেই -- এবার কি লিখেছ পড় শুনি। এমনই একবার -- 'এক রাজা তার রাণী হিন্দ্রলিনী...' শুনেই দাদু চমকে উঠলেন -- ও নাম কোথায় পেলে? -- আমি বানিয়েছি...। চমৎকার হয়েছে; ও নাম কিন্তু আমি নেব। কিছুকালের মধ্যেই কোথাও অনুক্ত 'জাবালি-জায়া' এক বালিকা কল্পিত নাম আরোপণে হয়ে গেলেন 'হিন্দ্রলিনী।'" (দ্রষ্টব্য 'শশিশেখর -রাজশেখর যা দেখেছি যা শুনেছি' -- দীপংকর বসু; যা দেখেছি যা শুনেছি -- শশিশেখর বসু : মিত্র ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ)
অতএব এমন কোনও কোষগ্রন্থ বড় প্রয়োজন যেখানে শুধু যে পুরাণ ও মহাকাব্যে উল্লিখিত অসংখ্য চরিত্র, স্থান ও বিবরণের উৎসমুখের সন্ধান মিলবে তাই নয়; বর্ণানুক্রমিকভাবে প্রসঙ্গ উল্লেখ সহ মৌল আকর গ্রন্থেরও খোঁজ আমরা সেখানে পাব। আমাদের সৌভাগ্য যে গতবছরের অগাস্ট মাস থেকে এরকম একটি গ্রন্থ আমরা হাতের কাছে পাচ্ছি। সাহিত্য সংসদ থেকে প্রকাশিত এই বইয়ের নাম 'পুরাণ কোষ : (মহাভারত - রামায়ণ - মুখ্য পুরাণ), প্রথম খণ্ড ( অ - ঔ)।' সম্পাদক নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী। চার কিংবা পাঁচ খণ্ডে এই গ্রন্থ সম্পূর্ণ হবে।
ঠিক কোনখানে এই গ্রন্থ পৃথক স্থান দাবী করে তা বোঝানোর জন্য আমি একটি তুলনামূলক উদাহরণ দিতে চাই। একই শব্দ এক পুরাণ বিষয়ক অভিধান এবং 'পুরাণ কোষে' কিভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তা আপনারা নিজেরাই দেখে নিন
অংশ --- কশ্যপ মুনির পুত্র। অদিতির গর্ভে এঁর জন্ম। ইনি দ্বাদশ আদিত্যের অন্যতম। আদিত্যরা চাক্ষুষ মন্বন্তরে তুষিত নামে খ্যাত ছিলেন, পরে বৈবস্বত মন্বন্তরে আদিত্য নামে খ্যাত হন। (বিষ্ণুপুরাণ)
*******************************************************************************************************
অংশ(১) ঋগবেদে আদিত্যদের উদ্দেশ্যে আহুতি দেওয়ার সময় আদিত্যগণের একতম হিসেবে অংশ -এর নাম করা হয়েছে -- ইমা গির আদিত্যেভ্যো ঘৃতস্নুঃ শৃণোতু মিত্রো অর্যমা ভগো ন স্তুবিজাতো বরুণো দক্ষো অংশঃ। [ঋগবেদ ২.২৭.১]
# বিবস্বান সূর্যের মুখরাগ থেকে বিচ্যুত হয়ে দ্বাদশ আদিত্যের সৃষ্টি হয় -- মুখরাগং তু যৎ পূর্বং মার্তণ্ডস্য মুখচ্যুতম।
অংশ এই দ্বাদশ আদিত্যের মধ্যে অন্যতম। [দ্র. আদিত্য] [ হরিবংশ পু. ১.৯. ৪৬ --৪৭]
# সৃষ্টির আদিতে জয় নামে যে দ্বাদশ দেবতা ব্রহ্মার দ্বারা অভিশপ্ত হন, এবং প্রতি মন্বন্তরে দ্বাদশ দেবতা রূপে জন্মগ্রহণ করেন তাঁরাই বৈবস্বত মনুর সময়ে কশ্যপ প্রজাপতির পত্নী অদিতির গর্ভে প্রবেশ করে দ্বাদশ আদিত্য নামে জন্মগ্রহণ করেন বলে পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। অংশ এই আদিত্যদের মধ্যে অন্যতম। [বিষ্ণু পু.১.১৫.১২৭ --১৩৩; বায়ু পু.৬৬.৬৬]
# দ্বাদশ আদিত্যের নামের যে তালিকা পুরাণে পাওয়া যায়, মহাভারতে প্রাপ্ত তালিকা তার থেকে কিছু ভিন্ন হলেও মহাভারতেও দ্বাদশ আদিত্যের নামের তালিকায় আমরা অংশকে পাই -- ভগোংশশ্চার্যমা চৈব মিত্রঃ। [মহা (k) ১২.২০৮.১৫; (হরি) ১২.২০২.১৫]
# কৃষ্ণার্জুন খাণ্ডব বন দহন করতে উদ্যত হলে ইন্দ্র তাঁদের প্রতিরোধ করতে এলেন। উভয় পক্ষে যুদ্ধ বাধল। এই সময় ইন্দ্রের সহায়তার জন্য অংশও এসেছিলেন এবং লক্ষণীয়, তাঁর প্রিয় অস্ত্র ছিল 'শক্তি' (javelin) ---- অংশস্তু শক্তিং জগাহ [মহা (k) ১.২২৭.৩৫; (হরি) ১.২২০.৩৫]
# দেবসেনাপতি পদে স্কন্দ কার্তিকেয়ের অভিষেকের পর দ্রব্যসম্ভার নিয়ে অন্যান্য আদিত্যগণ এবং বিবস্বানের সঙ্গে অংশও এসেছিলেন -- পূষ্ণা ভগেনার্যম্না চ অংশেন চ বিবস্বতা।
স্কন্দকে তিনি তাঁর পাঁচটি অনুচরও দান করেন, যাদের নাম পরিঘ, বট,ভীম, দহতি এবং দহন ----
পরিঘঞ্চ বটঞ্চৈব ভীমঞ্চ সুমহাবলম্।
দহতিং দহনঞ্চৈব প্রচণ্ডৌ বীর্যসম্মতৌ।।
অংশো'প্যনুচরান্ পঞ্চ দদৌ স্কন্দায় ধীমতে।। [মহা (k) ৯.৪৫.৫, ৩৪ - ৩৫; (হরি) ৯.৪২.৫, ৩৩]
# আধুনিক পণ্ডিতদের মতে অংশ সৌর কুলের দেবতা বা Solar diety এবং অংশ শব্দটি হয়তো অংশু (সূর্যকিরণ) শব্দের সমপ্রকৃতির। এই জন্য হয়তো পুরাণে সূর্যের রথে অগ্রহায়ণ মাসে অংশ নামে এক রাক্ষসকে অবস্থান করতে দেখা যায়। [ব্রহ্মাণ্ড পু. (মহর্ষি) ১.২৩.১৬; বিষ্ণু পু. ২.১০.১৮]
অংশ (২) স্বরোচিষ মন্বন্তরে দেবতারা যেসব গণে বিভক্ত ছিলেন তুষিত তার মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি গণ। এই গণের অন্তর্ভুক্ত দেবতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অংশ। [ ব্রহ্মাণ্ড পু. (মহর্ষি) ১.৩৬.১১]।
বলুন তো কেন এ বই আলাদা সে সম্বন্ধে আর কি একটি শব্দও ব্যবহারের প্রয়োজন আছে! শুধু একটি তথ্যের উল্লেখ করতে চাই। পুরাণ বিষয়ক অভিধানটির প্রথম শব্দটি হলো 'অংশ'। 'পুরাণকোষ'এর এটি দ্বিতীয় শব্দ। প্রথম শব্দটি হলো 'অ'!
এই গ্রন্থের আরেকটি বিশেষত্ব স্বয়ং সম্পাদকের কথায় প্রকাশ করা যাক : '...পুরাণকোষ আসলে মহাভারত - রামায়ণ - পুরাণের কোষগ্রন্থ। আমাদের এই গ্রন্থের বিষয়ভুক্তির একটা নতুন তাৎপর্য আছে এখানে, বস্তুত আমাদের একটা গভীর বিশ্বাস হল এই যে, প্রাচীন নাম, প্রাচীন মুনি - ঋষির নাম, তাঁদের চরিত্র, রাজা - রাজড়াদের নাম, তাঁদের চরিত্র, প্রত্যেকটির দেশ - নাম, এমনকী ধর্ম, সত্য, বা পাপ- পুণ্যের মতো দার্শনিক শব্দরাশিরও একটা পূর্বোত্তর পরম্পরা আছে। ফলত আমাদের মনে হয়েছে যে, পৌরাণিক অনেক শব্দই বড়ো বেশি ঐতিহাসিক এবং তার মধ্যে অনেক সময়ই সামাজিক সময়ের বিবর্তন লুকিয়ে থাকে। আর সেটা যদি খুঁজে বার করতে পারা যায়, তাহলে রামায়ণ - মহাভারত - পুরাণ, এমনকী বেদ - ব্রাহ্মণেরও অন্তর্ভুক্তি আমাদের পুরাণকোষের বিষয়গুলিকে অন্য একটি মাত্রায় নিয়ে যাবে যা এখনও এই বঙ্গভাষায় লিখিত কোনো পুরাণ অভিধানের মধ্যে নেই।' (পুরাণকোষ, পৃ. উনিশ) আটশ চল্লিশ পাতার এই বিপুলায়তন গ্রন্থের প্রতিটি শব্দ সেই ভিন্ন মাত্রার দ্যোতক। পৃষ্ঠা সংখ্যা প্রসঙ্গে আরেকটি তথ্য না উল্লেখ করলেই নয়। প্রকৃতপক্ষে, পুরাণকোষ, প্রথম খণ্ডের শেষ শব্দ 'ঔষ্ণীক' স্থান পেয়েছে আটশ ষোল পাতায়। আর আটশ সতের থেকে আটশ চল্লিশ পাতায় রয়েছে মৌল ও আনুষঙ্গিক গ্রন্থপঞ্জীর তালিকা। এই তালিকা এক বিশেষ প্রাপ্তি। এই বইয়ের পথনির্দেশনায় গ্রন্থলোকে অবাধ ভ্রমণ করতে পারেন পাঠক, শিক্ষার্থী, গবেষক।
এই গ্রন্থ আমাদের আলোকপথযাত্রী হতে সহায়তা করে। জ্ঞানের পরমজ্যোতি লাভের রাস্তা খুলে দেয়। আমরা সেই পথের দিকে এগোতে পারি যে পথের শেষে অবাধ, অবারিত আলোকবন্যা। আমরা ইচ্ছে করলেই পুরাণকোষে উল্লিখিত পুণ্যআকর গ্রন্থগুলির সাহায্যে সেই মহাজীবনের কুলে গিয়ে উঠতে পারি যেখানে পৌঁছয় অক্লান্ত, জ্ঞানসন্ধিৎসু, সংগ্রামী মানুষেরা। এই বইয়ের কাছে ঋণ স্বীকার করে ঋষি কুত্স আঙ্গিরসের কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে পারি :
উদ্ ঈর্ধ্বং জীবো অসুর্ ন আগাদ্
অপপ্রাগাত্ তম আ জ্যোতির্ এতি।
আরৈক পন্থাং যাতবে সূর্যায়
অগন্ম যত্র প্রতিরম্ভে - আয়ুঃ।
ওঠ্ রে সবাই, এল আমাদের প্রাণ জীবন;
হটল আঁধার, এল এল এল আলো - প্লাবন,
সূর্যকে ছেড়ে দিল নিঃশেষে যাওয়ার পথ ----
আমরা গেলাম যেখানে আলোর উত্তরণ। (অনু. গৌরী ধর্মপাল)
ঋণস্বীকার :
১) শব্দকোষ -- হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
২) বেদের কবিতা -- গৌরী ধর্মপাল।
0 comments: