প্রবন্ধ - মলয় রায়চৌধুরী
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
আমার পরমহংসত্ব : অপসামান্য দর্শনশক্তি
মলয় রায়চৌধুরী
অতিপ্রাকৃত, অলৌকিক, প্যারানরমাল, সুপারন্যাচারাল বলে সত্যিই কি কিছু হয়?
মালয়েশিয়ার জেনটিং হাইটসে যখন ভূতের আর দানবের থ্রিডি, মার্কিন ওয়েস্টার্নের ঘোড়সওয়ারদের ফোরডি ফিলম দেখছিলুম, তখন আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়া ভূতের বা দানবের হাত আর হাঁমুখ, ওয়েস্টার্ন ডুয়েলের গুলি থেকে বাঁচার জন্য নিজের শরীরকে বার-বার সরিয়ে নিচ্ছিলুম, ছিটিয়ে-দেয়া থুতু মুখের ওপর এসে পড়লে পুঁছে নিচ্ছিলুম, একথা জেনে যে সবই বিজ্ঞানের কারসাজি।
এক পলকের বোকামি, নিঃসন্দেহে। তার মানে যাকিছু ঘটে তা আমার বা অতিপ্রাকৃতে বা অলৌকিকে বিশ্বাসকারীর মগজে ঘটে, যা পি সি সরকার করে দেখাতেন আর দর্শকরা বিস্ময়ে অবাক হয়ে যেতো, জেনে যে ব্যাপারটা হাতের খেলা। সত্য সাইবাবা হাওয়ায় হাত বাড়িয়ে পি সি সরকার (জুনিয়রকে) এক চিমটি বিভূতি দিলে, পি সি সরকার (জুনিয় ) হাওয়া থেকে দুটো রসগোল্লা পেড়ে ওনাকে দিয়েছিলেন এবং বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, কেননা রসাক্ত জিনিসের ম্যাজিক সবাই দেখাতে পারে না। নিজেকে বোকা প্রতিপন্ন করার একটা ইচ্ছে আর অজানার আশঙ্কা মানুষের মধ্যে কাজ করে, তাই সে ম্যাজিক দেখতে যায়, পোড়ো বাড়িতে ঢুকে ভূত দেখতে যায়, অন্ধকার জঙ্গলে অজানা কিছুর আশঙ্কায় গা ছমছম করে, পাড়ার মোড়ে শনির মন্দিরে প্রণাম করে অফিস যায়, চারিদিকে পক্স দেখা দিলে হাতে ডাব নিয়ে শেতলার পুজো করে, বিশ্বভারতীর ছাত্র পিএচডি পাবার আগে কঙ্কালিতলায় পাঁঠা বলি দেয়, কিংবা তারাপীঠে গিয়ে ইঁট বেঁধে আসে। মার্কসবাদী নেতা সুভাষ চক্রবর্তীও তারাপীঠে গিয়ে মানত করে এসেছিলেন, কিন্তু তাঁর অনিশ্বরবাদী দল জিততে পারেনি।
শৈশবে আমি যে পাড়ায় থাকতুম, পাটনার ইমলিতলায়, সেই পাড়ার অন্ত্যজ নিবাসীরা সকলেই অতিপ্রাকৃতে আর অলৌকিকে বিশ্বাস করতো, প্রত্যেকের বাড়ির সদর-দরোজার চৌকাঠের ওপরে কালো ঘোড়ার নাল উল্টো করে ঠোকা, যাতে কেউ না ‘কালা জাদু’ করে, বা বাড়ির লোকেদের বিপদআপদ হয়, আমাদের বাড়ির চৌকাঠেও অমন একটা নাল ঠোকা ছিল, তার কারণ বড়ো জেঠা, যদিও বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু অবিশ্বাস করতে ভয় পেতেন। দাদা সমীর রায়চৌধুরীর ‘টিনিদির হাত’ নামে একটা গল্প আছে, পাড়ার হুলাসচাচাকে নিয়ে, যিনি তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’ নিয়ে একটা খেলা খেলতেন, যে খেলছে তার ভবিষ্যৎ বলার জন্য, সেই খেলায় পাড়ার সকলেই অংশ নিত, বিশ্বাস করতো যে ব্যাপারটা রামের নির্দেশে ঘটছে, অতএব তা ভুল হতে পারে না, আর যদি ভুল হয়ও, তাহলে যে খেলছে সে খেলার সময়ে পবিত্র ছিল না।
পাড়ার কুলসুম আপার বাড়ির সকলে বিশ্বাস করতেন যে ফেরশতা সত্যিকারের। তিন রকমের ফেরেশতা হয়, বৃষ্টি আর খাবারের,বিশ্বপ্রলয়ের আর মৃত্যুর। এই বিষয়ে তর্ক করার যেটুকু পরিসর ছিল তাকে ওঁরা ব্যাখ্যা করতেন, তুই কাফের বলে দেখতে পাস না।
আমার ঠাকুমা নব্বুই বছর বয়স পর্যন্ত উত্তরপাড়ার বারো ঘর চার সিঁড়ির খণ্ডহরে একা থাকতেন, বিজলি বাতি ছিল না, কিন্তু কখনও অপসামান্যে বিশ্বাস করেননি। কিন্তু ওই খণ্ডহরের একটা ঘরে আমার খুড়তুতো বোন পুটি বরগা থেকে ঝুলে আত্মহত্যা করলে, ঠাকুমা মারা যাবার পর, সেই ঘর আর সংলগ্ন ঘর কেউ ভাড়া নিতে চাইতো না, বস্তুত সেই কারণেই ‘সাবর্ণ ভিলা’ খণ্ডহর ভেঙে আবাসন উঠেছে। প্রথম যারা ভাড়া নিয়েছিল তারা পূটির ভূত দেখতে পেয়েছিল, লালপাড় শাড়ি পরে চুল খুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ইমলিতলার বাড়িতে আমার মেজদা অত্যন্ত কম বয়সে মারা যান। মেজদাকে এক বেশ্যার কাছ থেকে বড়োজেঠা দেড়শো টাকায় কিনেছিলেন, মেজদা নিজের জন্মরহস্য জানার পর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যান, আর তাঁকে বশ করার জন্যে বড়োজেঠিমার এক বান্ধবীর এনে দেয়া বশীকরণের বিভূতি ঘুগনির সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ানো হতো; শুকনো ধুতরোর গুঁড়ো মেশানো বিভূতির স্লো পয়জনে মারা যান মেজদা। বাবা ইমলিতলার বাড়ি ছেড়ে নিজে দরিয়াপুরে বাড়ি তৈরি করে আলাদা হয়ে যাবার পর, ইমলিতলায় একদিন রান্নার গ্যাসস্টোভ ফেটে বড়োজেঠিমা আগুনে পুড়ে যান আর কিছুকাল পরে মারা যান। কেউ সহজে ইমলিতলার বাড়ি ভাড়া নিত না, বলতো ওই বাড়িতে ভস্মাসুর বা ভস্মলোচন রাক্ষস থাকে, যারা ওই বাড়ি ভাড়া নেবে তারা জ্বলে পুড়ে মরে যাবে, মেজদার অভিশাপে। বিহারি দুঘর ভাড়াটে ছিল, তারা মেজদার সঙ্গে বড়োজেঠিমার অশরীরি ঝগড়া দেখে আর শুনে ভয়ে পরের দিনই উঠে গিয়েছিল। জেঠার নাতিরা, মানে বড়দি-ছোড়দির ছেলেরা, তাই বাড়িটা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়।
ইমলিতলা পাড়ায় জাদুটোনার অভিযোগে ঝগড়াঝাঁটি হতো আর ফয়সালার জন্য হুলাসচাচার শরণাপন্ন হতো অভিযুক্ত আর অভিযোগকারী। হুলাসচাচা উকিল ছিলেন আর ব্যাপারটা সামলে দিতেন, বা পাড়ায় রামজির পুজোর ব্যবস্থা করতেন। ডাইনির অভিযোগ এখনও ভারতের বিভিন্ন গ্রামে ওঠে, তার প্রকৃত কারণ ঈর্ষা, জমিদখল, জাতপাত, লিঙ্গবৈষম্য, প্রতিশোধস্পৃহা বা নারীঘটিত হয়। কিছু-কিছু উপজাতির মধ্যে প্রথাটা এখনও থেকে গেছে আর জানগুরুর নির্দেশে হত্যার ঘটনাও ঘটছে। আমাদের দেশে ডাক থেকে ডাকিনি শব্দটা এসেছে। ডাক হল শিবের অনুচর একজন পিশাচ আর ডাকিনি বা ডাইনি হল পিশাচিনী। শিবের পিশাচ কেমন করে উপজাতি সংস্কৃতিতে ঢুকে গেছে জানি না। ডাইনি অভিযোগ উঠলে অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে গণনৈতিক আতঙ্ক বা গণহিস্টিরিয়া দেখা দেয়। ২০০১ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ভারতে দুহাজার মানুষকে ডাইনি বা জাদুটোনা করার অভিযোগে হত্যা করা হয়েছে। গত বছর আসামে তেষট্টি বছরের এক বৃদ্ধাকে দেড়শো লোক গলা কেটে খুন করেছিল, কেননা স্থানীয় ওঝার মতে বৃদ্ধার কুদৃষ্টির কারণে গ্রামে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিল।
অন্যান্য সংস্কৃতিতেও জাদুটোনা আর ডাইনির অভিযোগ উঠেছে। খৃষ্টপূর্ব আঠারো শতকে মিশর এবং ব্যবিলনে জাদুটোনা-ডাইনিবিদ্যা প্রতিরোধের জন্য হামুরাবি নামে একটা আইন ছিল। সেই আইন অনুযায়ী জাদুটোনাকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে অভিযোগকারী নদীতে গিয়ে স্নান করার সময়ে ডুবে গেলে জাদুটোনাকারীকে অভিযোগমুক্ত করা হতো আর অভিযোগকারীর সম্পত্তি সে পেতো। অভিযোগকারী ডুবে না গেলে, জাদুটোনাকারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো আর তার সম্পত্তি অভিযোগকারী পেতো। বলা বাহুল্য যে এই আইনের ফলে জাদুটোনা আর ডাইনিবিদ্যার প্রসার কমে গিয়েছিল।
এখন ইসলামি দেশগুলোয় দেখা দিয়েছে ‘অবিশ্বাসী’ এবং ‘বিশ্বাসী’ কারা তা প্রমাণ করার জন্য খুনোখুনি, নারী ধর্ষণ, গণহত্যা, বোমায় উড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি। যারা হত্যা আর অত্যাচার চালাচ্ছে, ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব তারা নিজেরা নিজেদের দিয়েছে।
ইউরোপে প্রোটেস্ট্যাণ্ট এবং ক্যাথলিকদের মধ্যে তর্কাতর্কি ক্রমে পিশাচ পিশাচিনীর জাদুটোনা পর্যন্ত পৌঁছোয়, এবং এক পক্ষ আরেক পক্ষের অবিশ্বাসকারীকে পুড়িয়ে মারার ব্যবস্থা করে। প্রোটেস্ট্যাণ্টরা আরম্ভ করেছিল ‘রিফর্মেশান’ এবং তার বিরুদ্ধে ক্যাথলিকরা আরম্ভ করেছিল ‘কাউন্টার রিফর্মেশান’। প্রাচীন ইউরোপ এবং ঔপনিবেশিক আমেরিকায় প্রায় এক লক্ষ মানুষকে ডাইনিগিরি আর জাদুটোনার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। খৃষ্টধর্মের বিকৃতির কারণে গোপনে শয়তানের আরাধনা আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল, যারা ক্ষমতাবৃদ্ধির উদ্দেশে মানুষের মাংস খেতো। ইউরোপে ৭৮৫ সালে প্যাডেরবর্ন চার্চ ডাইনিবিদ্যা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তা সত্ত্বেও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ‘অবিশ্বাসীদের’ ফাঁসি দেওয়া হয়েছে বা পুড়িয়ে মারা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি মানুষের শাস্তি হয়েছে সেই দেশগুলোয় যাকে বলা হতো‘হোলি রোমান এমপায়ার’। সেকুলার নেশান স্টেটের ধারণার পর ডাইনিবিদ্যা আর জাদুটোনায় ইউরোপের মানুষ আর আগের মতন বিশ্বাস করে না; ধর্ম সম্পর্কে আগ্রহও সেকারণে কমে চলেছে।
অনেকে অলৌকিক আর অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করে, যে কারণে আমাদের দেশে একটি’ ইন্ডিয়ান প্যারানরমাল সোসাইটি’ আছে, যাদের কাজ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অলৌকিক ঘটনা ব্লগে বয়ান করা, আর তার ভিডিও দেখানো, যেমন ভূত, প্রেত, অশরীরী আত্মা, পুনর্জন্ম,মৃত্যুর পরও আবির্ভাব, মাথার পেছনে অথবা পুরো দেহ জুড়ে জ্যোতি, হাত বুলিয়ে রোগ সারানো, প্ল্যানচেটে মৃতকে ডেকে এনে কথা বলা,একদৃষ্টে তাকিয়ে লোহার রড বেঁকানো, মানুষের দেহে বিদ্যুৎপ্রবাহের উপস্থিতি, দেহের চৌম্বকক্ষমতার মাধ্যমে লোহার নানা বস্তুকে গায়ের দিকে টেনে নেওয়া, ইত্যাদি। ইউটিউবেও আছে অমন অলৌকিক ঘটনার ফিল্ম। সোনি কোম্পানি সাড়ে তিন হাজার টাকায় ডিজিটাল ভূতের কন্ঠস্বর রেকর্ডার বিক্রি করে, সাত হাজার নশো টাকায় বিক্রি করে ভূত শিকারের যন্ত্র। এতো দাম দিয়ে যারা কিনছে তারা ভূত-প্রেতের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে বলেই কিনছে।
প্রশ্ন হলো, আমি কি নিজেকে অপসামান্য দর্শনশক্তিসম্পন্ন পরমহংস মনে করি যে বিশ্বাস করি না? বিশ্বাস করার মতন আমার মস্তিষ্ক গড়ে ওঠেনি; আমার সংবেদন অতীন্দ্রিয় নয়, যদিও শৈশবে বড়োজেঠিমা আমাদের তাঁর চারিপাশে বসিয়ে পৌরাণিক কাহিনি, পঞ্চতন্ত্র, ঠাকুমার ঝুলি, ইশপের গল্প, আরব্য রজনীর কাহিনি মিলিয়ে মিশিয়ে লন্ঠনের আলোয় শোনাতেন, দাদার অনুরোধে অনেকসময়ে লন্ঠন নিভিয়ে দেয়া হতো, কেননা দাদা বলত ‘আলোয় গল্পটা দেখতে পাবো না’। সেইন্ট জোসেফ’স কনভেন্টে সিসটার আইরিন শোনাতেন গালিভার্স ট্র্যাভেলস, অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের গল্প। স্কুল সংলগ্ন চার্চে প্রতি বৃহস্পতিবার ফাদার হিলম্যান শোনাতেন ওল্ড টেস্টামেন্টের ঘটনাবলী। ছোটোবেলা থেকেই জানতুম এগুলো বানানো গল্প, বাস্তব জগতের ঘটনা নয়।
গ্রামোন্নয়নের চাকরিতে ঢুকে হিমালয়ের তরাইতে একটা মরা বাঘিনীর পোস্টমর্টেমের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমার অধস্তন একজন ভেটেরিনারি অফিসারকে, জেলায় ভেটেরিনারি সার্জেন ছিল না বলে। জেলা কর্তৃপক্ষ ছালটা নিলেও বাঘের মাংস আর হাড় নেবার জন্য হিন্দু গ্রামবাসীদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল। তারা বিশ্বাস করতো বাঘের মাংস খেলে যৌনক্ষমতা বাড়ে। অনেকে নিয়েছিল রোদ্দুরে শুকিয়ে রেখে দেবার জন্য, মেয়ের বিয়েতে জামাইকে দেবার উদ্দেশে। বংশ পরম্পরায় এই বিশ্বাস চলে আসছে। ভেটেরিনারি ডাক্তারের তাতে বিশ্বাস নেই, তাঁর মতে বাঘের মাংসের কোনো বিশেষ গুণ নেই। আমিও একটুকরো রাঁধা মাংস খেয়েছিলুম; লোকে বলতো বোঁটকা গন্ধ হয়, আমি তা পাইনি, বয়স্ক পাঁঠার মাংসের মতন খেতে।
লোককথায়, গণসংস্কৃতিতে নানা ঘটনা আর গল্প পাওয়া যাবে যাকে বিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যায়নি। আমি দাবি করছি না যে আমি বিজ্ঞানের সবই বুঝি। অ্যাটমের ভেতরে বোমাটা কোথায় লুকিয়ে থাকে জানি না, মাধ্যাকর্ষণ ফুঁড়ে রকেট কীভাবে নির্দিষ্ট পথে যায় জানি না, আইনস্টাইনের ফরমুলা কয়েকবার পড়েও বুঝতে পারি না, শুক্রের সঙ্গে স্ত্রীডিম্বের মিলনে ভ্রুণ কোন রহস্যে তৈরি হয় জানি না। কিন্তু আমি কখনও ভূত, প্রেত, শাঁকচুন্নি, বহির্জগতের প্রাণী, ইউ এফ ও দেখিনি; রবীন্দ্রনাথ প্ল্যানচেট করেছিলেন জেনেও ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হয়েছিল। হিমালয়ের ইয়েতি, স্কটল্যাণ্ডের লক নেস, মার্কিন দেশের সাসকোয়াচ, লাতিন আমেরিকার চুপাকাব্রা দেখিনি। এগুলোকে মনে হয় গ্রিক কিংবদন্তির ইউনিকর্ন বা চিনা সংস্কৃতির ড্র্যাগনের মতন প্রাণী, যা ওইসব দেশের লোকেরা কখনও প্রত্যক্ষ করেনি।
ইউরোপের নানা দেশে ক্ষেত্রসমীক্ষা করে আলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতার ঘটনা সংগ্রহ করেছিলেন চার্লস ফোর্ট (১৮৭৪ - ১৯৩২) নামে এক লেখক, এবং তিনি সাতটি বইতে সেই গল্পগুলো অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ‘টেলিপোর্টেশান’ শব্দটির তিনি উদ্ভাবক, যে অনুমিত প্রক্রিয়ায় একটি বস্তু বা প্রাণী নিজের জায়গা থেকে না নড়েই আরেক জায়গায় পৌঁছে যায়; ‘পোলটারগেইস্ট’ ঘটনা, অর্থাৎ অদৃশ্য ভূত চিমটি কাটে, কামড়ে দ্যায়, পাশে এসে শুয়ে পড়ে, থাপ্পড় মারে, ঘরের জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলে দ্যায় --- বিজ্ঞানীরা একে বলেছেন মস্তিষ্কের বিভ্রম; আকাশ থেকে মাছ ব্যাঙ ছোটো কচ্ছপের বৃষ্টি --- বিজ্ঞানীরা বলেছেন সমুদ্রে জলস্তম্ভের সাথে এই প্রাণীরা আকাশের মেঘে উঠে যায় আর বৃষ্টির সঙ্গে পড়ে; আপনা থেকে যেখানে-সেখানে আগুন জ্বলে ওঠা --- বিজ্ঞানীরা বলেছেন এটা হয় মিথেন গ্যাস আর ফসফরাসের কারণে; জলের ওপরে হাঁটা, বিশেষ করে যাঁরা আধ্যাত্মিক ক্ষমতা সম্পন্ন --- বিজ্ঞানীরা বলেছেন এটা ম্যাজিকের চোখধাঁধানো ব্যাপার বা হিপনোটাইজ করার ব্যাপার; হাওয়ায় ওপরে উঠে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকা, বিশেষ করে যাঁরা সাধু বা সিদ্ধ --- বিজ্ঞানীরা ওই একই কারণ বলেছেন; ভুতে পাওয়া কিংবা কোনো মৃতের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে আচরণ করা, মৃগিরোগে মূর্চ্ছা যাওয়া --- বিজ্ঞানীরা বলেছেন এইসব অভিজ্ঞতা মানসিক ভারসাম্যে আচমকা রদবদলের কারণে হয়, স্কিৎসোফ্রেনিয়া অসুখের জন্য হয়, হিস্টিরিয়া রোগের জন্য হয়, এর জন্য মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন। চার্লস ফোর্টের সংগ্রহের ঘটনাগুলো বিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যাখ্যাযোগ্য নয়, বিজ্ঞানের সাহায্যে প্রমাণ করা যায়নি। অতিপ্রাকৃত নিয়ে বাণিজ্যও ভালো চলে, যেমন আমেরিকায় ‘প্যারানরম্যাল আন্ডারগ্রাউন্ড ম্যাগাজিন’ নামে একটি পত্রিকা আছে, যার বাৎসরিক গ্রাহকচাঁদা কুড়ি ডলার।
অলৌকিক ও অতিপ্রাকৃত ঘটনা প্রমাণের জন্য ১৯২২ সাল থেকে ‘সাইনটিফিক আমেরিকান’, ‘ইনডিপেন্ডেন্ট ইনভেস্টিগেশান গ্রুপ’ এবং‘জেমস আর এজুকেশানাল ফাউন্ডেশান’ যৌথভাবে আড়াই কোটি ডলারের পুরস্কার ঘোষণা করে রেখেছে। অনেকেই দাবি জানিয়ে পৌঁছেছে, কিন্তু প্রমাণ করতে পারেনি, ধরা পড়ে গেছে বৈজ্ঞানিক আর ম্যাজিশিয়ান সদস্যদের কাছে। টেরেন্স হাইনস তাঁর ‘সিউডোসায়েন্স অ্যাণ্ড প্যারানরম্যাল’ গ্রন্থে বলেছেন যে, মানুষ দুটি কারণে অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিকে বিশ্বাস করে। প্রথমটি হল, অজ্ঞতা বা মূর্খতা।দ্বিতীয়টি হল, তাদের মস্তিষ্কের বিকার সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল নয়, তারা সমালোচনামূলক চিন্তা করতে পারে না, এবং বহুক্ষেত্রে তাদের বুদ্ধিবৃত্তি নিচু স্তরের।
কিছুটা ঢুকল, কিছুটা ভেসে গেল...
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো । যেমন যেমন অজ্ঞতা তেমনি তেমনি তার বিকার ও ভয় আর যেমন যেমন তার প্রাজ্ঞতা তেমনি তার যুক্তিবোধ ও নিডর হবার শক্তি।
ReplyDelete