0

ছোটগল্প - ঝুমা সমাদ্দার

Posted in


ছোটগল্প



আপন ভিতর হতে
ঝুমা সমাদ্দার



“শুন, ফুলমনি, পঞ্চাত যাক্যে তু সিধ্যা বইলবি, বুধিয়া 'ট তুকে লস্টো কইরেছে। উ তুকে জঙ্গল 'ট্য তে এক্যা পায়্যেঁ, জোর কইরে, মাইরে ধইরে তুর ইজ্জত লিছ্যে। তুর কুন্যো দুষ'টো লাই। উয়ার সাতে তুর কুনো সম্পক্ক্যো 'টো ছিল্য লাই। কান্দে কাট্যে পঞ্চাত'ক্যে তু ইসব বইলব্যি ক্যেনে। তুর বুধিয়ার সনে সম্পোক্কো 'ট্য কেন্যে থাইকব্যে? তুর লিজ্যের সোমসার আছ্যে, জোয়ান মদ্দ স্বামী 'ট্য আছ্যে, ঘরে ছুট্যো ছিল্যা আছ্যে, তুর কিসের অভাব 'ট্য বট্যে? ই 'ট্য তো এ্যাকবার ভাইব্যে দেখ, ফুলমনি, তু জামাইয়ের মুখ'ট্যা পুড়্যালি, ত্য ফির সি তুকে ঘরে লিতে রাজী হইল্য, উয়ার টুকুন মান'ট্য আছ্যে ত, ন' কি? ” - ফুলমনি'র কানের কাছে একটানা বিড় বিড় করে বলে চলে ওর মা সুন্দরী সোরেন। মাথা নীচু করে গোঁজ হয়ে বসে থাকে ফুলমনি।

গতকাল সাঁঝের মুখে ঝুজকো আন্ধারে ফুলমনি আর বুধিয়াকে 'বেশরম মিল্যামিশা' করতে দেখেছে গাঁয়ের মোড়ল ভগবান মাহাতো। আগেও কানাঘুষো শুনেছে গাঁয়ের লোক। কাঠ কাটতে গিয়ে বুধিয়া আর ফুলমনিকে হাসাহাসি করতে দেখেছে কেউ কেউ। ওদের নিয়ে লোকের ফিসফিসানি কানে গেছে ফুলমনির মরদ বিশু মুড়্যা'র। পাত্তা দেয় নি তেমন। গত রাতে 'বাহা পরবের মিটিন' সেরে ফেরার পথে ভরত ধরেছিল বিশুকে।

“ফুলমনিকে টুক্যুন মান্যা করিস রে বিশু, বুধ্যিয়া'র সন্যে বেসি মাখ্যামাখ্যি 'ট্য লা কইরত্যে, উয়ার রঙঢঙ ঠিক লাগ্যে না রে। গিরাম্যের লোক মন্দকুথ্যা বইলছ্যে উয়াদ্যের লিয়ে। ভগমান মাহাতো ছাঁড়্যে দিব্যে লা। উয়াদের লাম্যে পঞ্চাত্যে লালিস কইরব্যে বইল্যেছিল। গিরামের আর সব মেয়েঁ-বউ লস্টো হঁই যাব্যেক ফুলমনি'কে দেইখল্যে, ই কুথ্যা 'ট্যো হাট্যে যায়েঁ গজর গজর কইরছিল লছমন সোরেনের সাত্যে।"

পেট ভরতি মদ আর মাথা ভরতি ধকধকে রাগ নিয়ে ফিরে এসেছিল বিশু। ফুলমনিকে কোনো প্রশ্ন না করেই চুলের মুঠি ধরে টেনে দাওয়ায় এনে এলোপাথারি মারধর, গালাগালি উগরে দিয়েছিল। বউটাও যেন তার তৈরীই ছিল মার খাওয়ার জন্য। কান্নাকাটি, চেঁচামেচি না করেই নির্বিবাদে মার খেয়ে যাচ্ছিল দাওয়ায় পড়ে। মারধর করে হাঁপাতে হাঁপাতে বিশু মুড়্যা দম নিতে উঠে বসেছিল উঠোনে উবু হয়ে। ফুলমনি কথাটি না বলে ঠোঁটের কষের রক্ত মুছে, চুল গুটিয়ে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে উঠে যায় ঘরে, কোলের ছেলেটাকে দুধ দিতে।

বিশু সেই রাতেই ছুটে গিয়েছিল পাশের গ্রামে শ্বশুরবাড়ি। খুলে বলে এসেছিল সব। এ দিকে, বিশু বেরিয়ে যেতেই ফুলমনির শাশুড়ি, মেজ দেওর পাশের ভিটের খড়ের চালার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে শাপ-শাপান্ত করে গেছে ফুলমনিকে। কিছু কানাঘুষো কানে গেছে তাদেরও। বিশুর চেয়ে ওদের অবস্থা খারাপ বলে এমনিতেই ফুলমনির চালচলনে অহংকার দেখতে পায় তারা অহর্নিশ। যদিও বিশুকে লুকিয়ে মুড়িটা, ছাতুটা শাশুড়ি বুড়ি'কে দিয়ে আসে ফুলমনিই।

“শুন, ফুলমনি, ভাল্য কুথ্যা 'ট্য শুন আম্যার। তু বুধিয়ার সাত 'ট্য ছাইড়্যেঁ দে, আমি তুকে ঘরে লুবঁ ফির। উয়ার ক্যি আছে ‘ট্য ক্যি, বল না।ঘর লাই, জমিন লাই, গরু লাই। উয়ার সাত্যে তু যাব্যি কেন্যে, যাঁয়ে কি পাব্যি 'ট্য, বল না? তু পঞ্চাত যাক্যে সিরিফ একট্যা কুথ্যা বইলব্যি, বুধিয়া তুক্যে জোর খাট্যায়েঁ ই সব কইরেছে। তুদ্যের মইধ্যে কুন্যো সম্পক্কো 'টো লাই। বাস, ই কুথ্যা 'ট্য বইললেই আমি ফির ঘরে লুবঁ তুক্যে।" - রাতে ঘরে ফিরে ফুলমনিকে ভাল কথায় বার বার বোঝাতে যায় বিশু। শ্বশুরের পরামর্শে, কিছুটা ধাতস্থ হয়ে রাতে ঘরে ফিরেছিল সে। ওর শ্বশুর বুঝিয়েছিল ওকে, "ফুলমনিকে তাড়াইঞঁ দিলে তুর বহুত বদনাম হবে রে, জামাই। উয়াকে বুঝ্যা কেন্যে, বল, পঞ্চাত যাক্যে যেন বলে, সব্ব দোষ বুধিয়ার। উ ফুলমনির ইজ্জত লিছ্যে। আমাদ্যের আদিবাসি ঘরে ইজ্জত লিলে বিটিছিল্যার কুন্যো দুষ 'ট্য হয় লা।"

ফুলমনি উত্তর দেয়নি। মেঝতে ছেঁড়া কাঁথাটা পেতে ফেলে শুধু একবার চোখ তুলে তাকিয়েছিল বিশুর দিকে। ঠোঁটের কোনে হাল্কা হাসির আভাস তার। বিশু নিশ্চিন্ত হয়েছিল খানিকটা। নাঃ, ফুলমনি ওর সম্মান নষ্ট করবে না গাঁয়ের পাঁচজনের সামনে। বউ অন্য পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করলে স্বামীর নিন্দে হয় বৈ কি। জোয়ান মদ্দ স্বামী সে, তার বউ কেন অন্য পুরুষের কাছে যাবে? কিসের লোভে? সে কি অক্ষম? লোকে কি বলবে?

সকাল না হতেই ফুলমনির মা জামাইবাড়িতে এসে হাজির হয়। সেই থেকে সমানে বুঝিয়ে চলেছে সে ফুলমনিকে। জামাই মাঝেসাঝে এক আধটু মারধর করে বটে, তা সে আর গাঁ-ঘরে কোন বেটাছেলেটা না করে? তাই বলে সে লোক খারাপ নয়। অন্য মেয়েমানুষ নেই তার। সর্বোপরি, সে মোটামুটি অবস্থাপন্ন। বিশখানা গরু আছে তার, ছাগল আছে, মুরগী আছে, জমি আছে পাঁচ বিঘা, তার নিজের ঘর আছে টিনের চালের। ফুলমনির সন্তান রয়েছে চারজন। প্রায় দশ বছর বিয়ে হয়েছে তার। যদিও মাত্র তেরো বছরেই তার বিয়ে হয়েছিল। এখন বয়স তার তেইশের কোঠায়। তবু, এত কিছুর পরও কি তার পরপুরুষের নজরে পড়ার মত পাপ সইবে?

অথচ, কাউকেই বোঝাতে পারে না ফুলমনি, সে কারও নজরে পড়ে নি, বরং বুধিয়াই ওর নজরে পড়েছিল প্রথম থেকেই। গরু নিয়ে জঙ্গলে যেত সে, ফেরার সময় কাঠ কেটে নিয়ে ফিরত। গতবছর বাহা পরবের আগুতে প্রথম দেখেছিল বুধিয়াকে, পাথর কোঁদা কালো মিশমিশে চেহারায় সাদা ধুতি মালকোচা দিয়ে পরা। মাথায় গামছাখানা বাঁধা। ঘাড়ে একখানা কুড়ুল নিয়ে আপনমনে এগিয়ে চলেছে সে ঘন জঙ্গলের দিকে। মাথাটা সামনে ঝোঁকানো। একরাশ কোঁকড়ানো চুল কপালের সামনে এসে পড়েছে। গাছের আড়াল থেকে একমনে দেখেছিল ফুলমনি। যদিও ওদের সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে তেমন আড়াল রাখার প্রয়োজন হয় না। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে ওরা। অপরিচিত পুরুষের দিকে দেখা, কথা বলা তেমন দোষের নয়। তবু, কি যেন হয়ে গিয়েছিল ওর। লজ্জায় তাকাতে পারছিল না, অথচ কেমন এক অদম্য টানে চোখ ফেরাতেও পারছিল না। বসন্তের শুরুতে পাহাড় জঙ্গল জুড়ে লাল হলুদ ফুলের মেলা। নিঃশব্দ বনাঞ্চলে মাঝে মাঝে পাখির ডাকে জীবনের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। মাতাল করা গন্ধ মহুয়া ফুলের। কেমন আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল যেন সে। খেয়াল ছিল না সময়ের, খেয়াল ছিল না অন্য কোনো প্রাণের উপস্থিতির।

হঠাৎই চোখ তুলে তাকিয়েই ফুলমনির দিকে এক লাফে এগিয়ে এসে ফুলমনির মাথার উপর ঝুলে থাকা চন্দ্রবোড়াটিকে এক কোপে দু'টুকরো করে ফেলেছিল বুধিয়া। টাল সামলাতে না পেরে বুধিয়ার গায়ের উপরেই কাত হয়ে পড়েছিল সে। শক্ত হাতে তাকে তুলে দাঁড় করায় বুধিয়া। সেই থেকে কি যেন হয়ে গিয়েছিল ফুলমনির। জঙ্গল থেকে ফিরেছিল কেমন এক নেশায় ভর করে। হাওয়ায় উড়তে উড়তে। সারাক্ষণ বুনো গন্ধের খোঁজে উড়ে চলে ওর মন, ঠিক যেমনটা ছিল বুধিয়ার শরীরে। শক্ত পাথরের মত হাত দু'খানা, অথচ, কত নরম করে তুলে ধরা ওকে, সে স্পর্শ খুঁজে বেড়াত নিজের শরীরে নিজেই হাত বুলিয়ে। ঠিক যেমন ভাবে যেখানটায় হাত দিয়ে ওকে তুলে ধরেছিল বুধিয়া, সে ভাবেই নিজেকে নিজে স্পর্শ করতে চাইত।

রাতে বিছানায় বিশু জাপটাতে এলে কখনও মাটির মত পড়ে থেকে টিনের চাল দেখত, কখনও মনে মনে বুধিয়াকে ভাবতে চাইত। ভুল ভাঙত খানিক পরেই। বিশুর আঁচড় কামড়ে ওর মন থেকে সব নরম অনুভূতি চলে যেত। মনটাকে শক্ত করে ফেলত পরক্ষণেই। মনে মনে ভাবত, এসব পুরুষ মানুষ কেন এমন হয়? বিটিছিল্যাকে ব্যথা যন্ত্রণা দিয়ে কেমন করে সুখ পায় এরা? বুধিয়ার স্পর্শ তো কই এমন নয়!

মনে পড়ে সেই প্রথম রাতের অভিজ্ঞতা। কচি বয়স, নরম তুলতুলে শরীর, যেন খুবলে খেয়েছিল পশুটা।

যন্ত্রণায় কঁকিয়ে কেঁদে উঠতেই এক চড়ে শান্ত করে দিয়েছিল তাকে বিশু। মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল ফুলমনির। “চুয়াড় শালী, চুপ যা, বিলকুল।" হিসহিসিয়ে বলে উঠেছিল বছর তিরিশের লোটা। পরদিন সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারছিল না সে। বিকেল হতেই আবার রাতের আতঙ্ক তাড়া করত ওকে। এভাবেই কেটেছে রাতের পর রাত। এভাবেই চার ছেলেমেয়ের মা হয়েছে সে।

সেদিনের পর আবারও দেখা হয়েছে তার বুধিয়ার সঙ্গে। কথা হয়েছে, আলাপ হয়েছে। "বিয়াত্যে যায়্যেঁ বউ 'ট্য মইরে গেল্যেক গত বারিষে,বিটা 'ট্য ও বাঁইচল্য লাই।" সেই থেকে একা সে। কাঠ বেচে যা আয় হয় তার। জমি জিরেত, ঘর বাড়ি কিছুই নেই। এক বুড়ি মাসির উঠোনে পাতায় ছাওয়া ঘরে থাকে সে। পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদ উঁকি মারে তার ঘরে। আপন মনে গান গায় সে। "বাহা বোঙ্গা পিরিল পিরিল চান্দোয় মোলোঃএন/ বাহা জতে পুরুই পুরুই দিশৌম পুলুকএন/ হালায় দালায় বাহাএনা সারি সারজম/ দারে পেরেচ গেলেএনা খোদে মাতকম (ফুলের দেবী উঠলো চাঁদ উঠলো/ ফুলে ফুলে দেশ ভরে উঠলো/ থোকা থোকা শাল ফুল ফুটলো/ মহুয়ার ফলে গাছ ভরে উঠলো)।" মুগ্ধ হয়ে শোনে ফুলমনি।

'পুরুষ' শব্দটার মানেটাই তার কাছে নতুন হয়ে ধরা দেয় যেন। কেমন একটা মায়া হয় তার নিঃসঙ্গ, লাজুক পুরুষমানুষটার জন্য। বুকের মধ্যেটা আনচান করে ওঠে তার। লম্বা, হিলহিলে শরীরটা শিউরে ওঠে তার, কাঁপন লাগে শরীরে। মাথা নীচু করে বুকে চেপে ধরে সে চরাতে আনা ছাগলছানাটিকে। একমাথা কালো চুলের খোঁপা ভেঙে পড়ে ফুলমনির পিঠের উপর, যেন মেঘ করে আসে বুধিয়ার মনেও। যেন এখনই বৃষ্টি নামবে। ভারী মিষ্টি, ভারী মায়াবী মুখখানা ফুলমনির। একদৃষ্টে দেখে সে।

সে বার বাহা পরবের শেষে খোঁপায় সারজম বাহা(শাল ফুল) গুঁজে হাঁড়িয়া খেয়ে নাচ-গানে মেতে উঠেছিল ফুলমনি। নাইকের(পুরোহিত) পিছু পিছু জাহের থানে গিয়ে মনে মনে বলে এসেছিল মারাঙবুরুকে, আর কিছু নয়, কেবল বুধিয়া যেন ভাল থাকে, ওর যেন কোনো ক্ষতি না হয়, ব্যস, এইটুকুই। কাঁড়বাঁশ, টাঙ্গি নিয়ে বুধিয়া গ্রামের যুবকদের সঙ্গে শিকারে গিয়েছিল। ফিরে এসে একগোছা মুরুপ বাহা গুঁজে দিয়েছিল ফুলমনির খোঁপায়। “কিম্যন সুন্দর লাইগছ্যে রে তুকে ফুলমনি।" - এক দৃষ্টে তার দিকে চেয়ে থেকে যেন নেশা ধরা গলায় বলেছিল বুধিয়া। লজ্জায় আর ভাললাগায় ফুলমনির কান দুটো থেকে যেন আগুনের হল্কা বেরোচ্ছিল তখন।

কথাটা কানাকানি হতে দেরী হয় নি। নাইকের ঘর থেকে ফিরেই আবার মার খেতে হয়েছিল ওকে। আনন্দের রেশ ঠোঁট থেকে মুছে গিয়েছিল, তবে এখন আর মার খেলেও যেন গায়ে লাগে না ওর। ভেতরে ভেতরে কেমন এক আবেশ ঘিরে রাখে ওকে সারাক্ষণ। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের আকথা কুকথাও গায়ে লাগছিল না ওর। ফুলমনির মা মাথা নীচু করে বসেছিল সারাক্ষণ। জামাই সরে যেতেই সেও সমানে গালাগালি করতে থাকে মেয়েকে।

“কি হঁইঞছে রে তুর? বিলকুল পাগলা গেঁইলছ্যিস, ন’ কি? ন' ডাইন্যে ধইরেছ্যে তুকে রে? ই দেখ, তুর বড়্য বিট্যা 'ট্য'র মুখ্যের পান্যে চায়্যেঁ দেখ। বিটিছ্যানা দুটার মুখ্যের পান্যে চায়্যেঁ দেখ। ইত্ত বড়্য ছিল্যা বট্যে তুর, আর তু কিন্যা ইখ্যন! আরে ছি! ছি! ছি! কি কইরছ্যিস তু রে ফুলমনি! লাজ শরম লাই তুর? আমরা সক্যলে গিরামে মুখ দিখ্যাব কিম্যন কইরে রে! উ হারামীর পো, বুধিয়া 'ট ই লিচ্চয় কিছ্যু কইরেছে তুক্যে।" গঞ্জনা দেয় সুন্দরী।

কিছুতেই বুঝতে পারে না ফুলমনি, তাকে লজ্জা পেতে হবে কেন? বিশু যখন ছেলেপুলের সামনেই তার কাপড় টেনে খুলে ফেলে, তাকে আঁচড়ে কামড়ে ক্ষত বিক্ষত করে সম্ভোগ করে, কোলের বাচ্চাটা কেঁদে উঠলেও তাকে ছাড়ে না বিশু, বছর আষ্টেকের ছেলে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে পাশেই কাঠ হয়ে, বুঝতে পারে ফুলমনি, ভারী লজ্জা হয় তার, তখন তো কই কারও কিছু বলার থাকে না, অথচ সে নিজের ইচ্ছেয় কারও সঙ্গে মেলামেশা করলেই তাকে লজ্জা পেতে হবে কেন?

এ শরীরটা তো তারই। মনটাও তার নিজের। জীবনটাও তার নিজের। তবে নিজের শরীর, নিজের মন, তার নিজের জীবনের পাহারাদার সে নয়? অন্য সকলে? তার শরীর নিয়ে যত চিন্তা তার সোয়ামীর, তার মা-বাপের, তার গ্রামের মোড়লের, সমাজের আর সবার। তার নিজের শরীরের, মনের অধিকার নেই কেবল তারই, তার জীবন নিয়ে যা খুশী করতে পারে অন্য সকলে। পারেনা কেবল সে নিজে।

তার বোধ হওয়ার আগেই বাপ-মা তার বিয়ে দিয়ে দিল অপরিচিত একজনের সঙ্গে, সেই থেকে সেই অপরিচিত লোকটিকেই তার শরীর, মনের, তার জীবনের পাহারাদার মেনে নেবে সে কিসের জন্য? তার সন্তানের মা হয়েছে বলে? তাও তো সে নিজের ইচ্ছেয় হয় নি। তার কি মন বলে কিছু থাকতে নেই?

পঞ্চায়েতের সভায় ভগবান মাহাতো, বুধন মাঝি, হরিয়া মুন্ডা তার দিকে চেয়ে রয়েছে একদৃষ্টে। নোংরা দৃষ্টি তাদের। বিশু, ওর মা, ফুলমনির মা, সবাই সাক্ষী দিয়েছে, ফুলমনিকে জোর করে ভোগ করেছে বুধিয়া। ফুলমনির মুখ থেকে তারা শুনতে চায় আসল সত্যিটা কি, কেমন করে বুধিয়া তাকে জোর করে ভোগ করেছে। "বল না কেন্যে" - সুন্দরী তাকে ঠেলতে থাকে। উত্তর দেয় না ফুলমনি। গোঁজ হয়ে বসে থাকে। আসলে সবাই বুধিয়ার ওকে জোর করে সম্ভোগ করার মূহূর্তটির দৃশ্য কল্পনা করে, ফুলমনির নগ্ন শরীরটার কথা ভেবে আনন্দ পেতে চাইছে, বুঝতে পারে ফুলমনি। বুধিয়া বসে রয়েছে এক কোনে, দু'হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে। সওয়াল জবাবের মধ্যে একবারও মুখ তোলেনি ও। যেন একরকম মেনেই নিয়েছে, জোর করেই ভোগ করেছে ফুলমনির শরীরটা সে। এর জন্য যে কোনো রকম শাস্তি পেতে প্রস্তুত ও।

“শুন সক্যলে,” এতক্ষণের নীরবতা ভেঙে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট গলায় বলে ওঠে ফুলমনি, “মোর শরীল 'ট্য তে যি মনিষ্যি 'ট্য কাঁপন ধরাইঞঁ দিল বট্যে, উয়াকে আমি বইলব্য, 'উ আমাক্যে জোর কইরল্য'? যি মনিষ্যি আমার কাছ্যে কিবল বিট্যাছিল্যা লয়, 'মনিষ্যি' 'ট হইয়েঁ আইসল্য, উয়াক্যে আমি বইলব্য, 'ভোগ' কইরল্য আম্যাকে? আর যি জানোয়ারটা ইত্তগুলা বচ্ছর আমাক্যে 'ভোগ' কইরল্য, 'জোর' কইরল্য, মোর সাধ টুকুন কখ্যনও জানতে চাইল্য লাই, উয়াক্যে বইলব্য, ‘সোয়ামী'? উয়ার কুন্যো দুষ 'ট্য লাই, কিম্যন? আমি বুধিয়াকে ভালবাইস্যে উয়াকে আমার শরীল 'ট্য দিয়্যাঁছি। বুধিয়া আমাক্যে ল্যেয় লাই, আমি উয়াক্যে লিয়্যেছি। ইখ্যন কি সাজ্যা 'ট্য দিবে দাও।"

সারা গ্রামের জ্বলজ্বলে চোখগুলোর সামনে থেকে ধীরে ধীরে উঠে মাঠের একধারে সরে গিয়ে, পেছন ফিরে বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে বসে ফুলমনি।

0 comments: