0

প্রাচীন কথা - মিথিল ভট্টাচার্য্য

Posted in


প্রাচীন কথা


পরাহত ভাগ্যনায়ক - দ্বিতীয় পর্ব
মিথিল ভট্টাচার্য্য


মথুরার প্রভাবশালী মহাসামন্ত অক্রুরের অকস্মাৎ আগমন এক মুহূর্তে তার জীবনের গতিপথটাই সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। এক নিমেষে তাঁর এতদিনের চেনা জগৎটাই যেন এক অচেনা ভয়াল রূপ নিয়ে ধরা দিয়েছিলো তাঁর সামনে। তাঁর নিজের পিতা মাতা তার জন্মদাতা জন্মদাত্রী নয়! এই সত্য তাঁর বয়সী একটি কিশোরের পক্ষে কতটা কঠিন ছিল মেনে নেওয়া এটা এই বয়সেও ভাবলে শিউরে উঠতে হয় তাঁকে। কিন্তু সেই অভাগা কিশোর স্তম্ভিত হওয়ার সময়টুকুও পায়নি, নিজেকে সামলানোর আগে তাঁকে প্রথমে সামলাতে হয়েছিল তার জীবনের ধ্রুবতারা, মাতা যশোদাকে। সেই অসহায় মানুষটি কিছুতেই সেই দিন মেনে নিতে পারেননি এই নির্মম সত্য। কি ভাবেই বা তিনি মেনে নিতেন এই নিষ্ঠুর বাস্তবকে যে, তাঁর জীবনের সবথেকে বড় অবলম্বন, তাঁর একমাত্র প্রাণের পুতুল তাঁর নয়! নিজের কষ্ট, নিজের দিশেহারা হয়ে পড়া সম্পূর্ণ তুচ্ছ হয়ে গেছিল সেদিন সেই হতভাগ্য কিশোরের কাছে অভাগী মায়ের এই ভেঙে পড়া মূৰ্তি দেখে। সেদিন তাঁর কাছে সব থেকে বড় হয়ে উঠেছিল সেই অসহায় মানুষটিকে সামলানো। জন্মদাত্রী না হোক তিনিই তোতাঁর মা। তাঁর জীবনের পুরো ভিত্তি প্রস্তর দাঁড়িয়ে রয়েছে এই একটি মানুষের স্নেহ ছায়ায়, আর সেই মানুষটি প্রতারিত হয়েছিলেন সকলের দ্বারা এমনকি তাঁর নিজের স্বামীর দ্বারাও।নিজের বন্ধুর অনুরোধে, মথুরার ভবিষ্যতের জন্য এক বৃহত্তর স্বার্থে নিজের একমাত্র কন্যাকে বলিদান দিয়েছিলেন তিনি তাঁর অচেতন স্ত্রীর অজান্তে। 

সেইদিন নিজের মায়ের হাত দুটো ধরে তিনি বলে উঠেছিলেন, ‘জন্ম আমাকে যেই দিক, আমার কাছে মা তো শুধু তুমি। যেখানেই যেতে হোকনা না কেন, তোমার এই ছেলে সারা জীবন ধরে সবার আগে শুধু তোমার আদরের দুলাল হয়ে থাকবে, তার প্রথম পরিচয় সবার আগে হবে যশোদানন্দন। আর তোমাকে ছেড়ে তোমার এই দস্যিও কি কোনওদিন থাকতে পারবে? যদি মথুরায় যেতে হয়ও, আবার তোমার কাছেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবে তোমার এই দস্যি কানাই।’ আজ এই প্রতিশ্রুতির কথা মনে পড়লে এক বিষণ্ণ হাসি ফুটে ওঠে তাঁর মুখে।...নিয়তি দেবী বোধ করি সেদিন ঠোঁট টিপে হাসছিলেন তাঁর এই প্রতিশ্রুতি শুনে। বাকি প্রতিশ্রুতিগুলি হয়ত পরবর্তী জীবনে আংশিক সত্য তিনি করতে পেরেছিলেন; কিন্তু শেষ প্রতিশ্রুতি? জীবনে আর কোনদিনও তো তিনি ফিরে যেতে পারেননি তার শৈশব ও কৈশোরের সেই স্বর্গে, ফিরে যেতে পারেননি মাতা যশোদার স্নেহচ্ছায়ায়। তাঁর নিয়তি তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল এক অকল্পনীয় দিশায়। এত বৈচিত্র্য, এত দায়িত্ব, কর্মভার, রাজনীতির একের পর এক সুচিন্তিত পদক্ষেপ তাঁকে অনেক অনেক দূরে সরিয়ে নিয়েছিল সেই মায়াভরা স্বর্গভূমি থেকে। জীবনে তাঁকে অনেক অনেক কিছু দিয়েছে তাঁর নিয়তি : সম্মান, ক্ষমতা, ভক্তি, শ্রদ্ধা, একাধিক শ্রেষ্ঠ রাজন্যবর্গের ঈর্ষা। কিন্তু, তার মূল্যও তাঁকে দিতে হয়েছিল মারাত্মক, যার হদিশ শুধু জমে আছে তাঁর অন্তরের গোপনতম প্রকোষ্ঠে। 

...এই সুদূরবিস্তৃত চিন্তা স্রোত থেকে নিজের মনকে আবার সেই সময়টিতে ফিরিয়ে নিয়ে যান শ্রীকৃষ্ণ। সেই মুহুর্তে, যখন তাঁর জীবনের প্রকৃত সত্য একটু একটু করে তার সামনে উন্মোচিত হচ্ছিল। একটু একটু করে পরের ঘটনাগুলো একের পর এক ফুটে উঠছে তাঁর মানসপটে : অস্থির মুহূর্তগুলোকে একটু সামলে উঠতে না উঠতেই যে অদ্ভুত কাহিনী তাঁর সামনে তুলে ধরা হয়েছিল তাতে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়েছিল সেই পনেরো বছরের কিশোরকে। মথুরার মহারাজ উগ্রসেন এর দৌহিত্র তিনি, তাঁর পিতা যাদব বংশীয় রাজকুমার বসুদেব, মাতা রাজকুমারী দেবকী। তাঁর জীবনের এই বিচিত্র রূপের প্রধান কারণ যাদব বংশীয় এবং মগধের চিরন্তন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা। যাদবদের সবথেকে বড় শত্রু মগধ সম্রাট জরাসন্ধের উচ্চাকাঙ্খার যূপকাষ্ঠে বলি হয়েছে তাঁর সমস্ত পরিবার। সরাসরি সংগ্রাম এড়িয়ে যাদবদের প্রধান শক্তি কেন্দ্র মথুরা নগরীকে কেন্দ্র করে তাদের অন্তর্ঘাতে বিনাশ করার যে ভয়াবহ পরিকল্পনা সম্রাট জরাসন্ধ গ্রহণ করেছিলেন তারই ফলশ্রুতি তাঁর এই অদ্ভুত জীবনকাহিনী। 

আর নিয়তির পরিহাসে জরাসন্ধের এই রাজনৈতিক ক্রীড়ার প্রধানতম ক্রীড়নক হলেন তাঁর নিজের মামা, মথুরার তত্কালীন যুবরাজ ও বর্তমান রাজা কংসদেব। নিজের দুই কন্যার সঙ্গে যুবরাজ কংসের বিবাহ দিয়ে তাঁকে সবথেকে বড় অস্ত্রে পরিণত করেছেন ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ জরাসন্ধ। যুবরাজ কংস জরাসন্ধের ইশারায় যাদব গোষ্ঠীর অভ্যন্তর থেকে ক্রমাগত অন্তর্ঘাতে ধ্বংস করতে থাকেন তাদের অস্তিত্ব। মহারাজ উগ্রসেন এই নীতির বিরোধিতা করলে কৌশলে তাঁকেও নজরবন্দী করে রাখা হয়। সর্বত্র রটিয়ে দেওয়া হয় যে শারীরিক দুর্বলতার কারণে তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন। কোনও প্রমান ছাড়া এই মিথ্যার বিরোধিতা করার সুযোগও থাকেনা যাদব গোষ্ঠীর কোনও নেতৃবৃন্দের। এই অবস্থায় শুধুমাত্র একটি পন্থাই পড়ে থাকে যাদবদের সামনে: কংসকে সরিয়ে রাজকুমারী দেবকী ও বসুদেব এর পুত্র সন্তানকে মথুরার ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী করার।

এই পরিকল্পনার আঁচ পেতে ধূর্ত কংসেরও সময় লাগেনি, এই পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করতেই যাদবদের ইতিহাসের সব থেকে ঘৃণ্য পদক্ষেপ নেন তিনি। নিজের ছোটবোনের প্রতি ভালবাসার অজুহাতে বিয়ের পরেই নিজের বোন ও ভগ্নীপতিকে নিজের কাছে মথুরায় এনে তাদের গোপনে নজরবন্দী করে রাখেন। মথুরার প্রাসাদের বাইরে সকলের কাছে এই সংবাদই রটানো হয় যে নিজের একমাত্র বোন ও ভগ্নীপতিকে ভালোবেসেই মথুরার প্রাসাদে সম্মান ও আদরের সঙ্গে নিজের কাছে রেখেছেন মথুরাধিপতি। এই রটনার আড়ালে তাঁদের উপর চলে অমানুষিক নির্যাতন, কার্যত কারাগারে বন্দী করে রাখা হয় তাঁদের। দেবকী প্রতিটি সন্তানের জন্মের পরেই তাকে নিজে হাতে হত্যা করতে শুরু করেন কংস নারকীয়তার সকল সীমা লঙ্ঘণ করে। যাদব গোষ্ঠীর কাছে নিজের মিথ্যার আবরণ টিকিয়ে রাখতে বসুদেবকে দৈবাৎ কোনওদিন যদিও বা গোকুলে ঘোষগোষ্ঠীপ্রধান নন্দের আশ্রয়ে থাকা তাঁর প্রথমা পত্নী রোহিনীর কাছে আসার অনুমতি দেওয়া হয়, কিন্তু দেবকীকে নৈব নৈব চ। আর দেবকীর সুরক্ষার জন্য বাধ্য হয়েই বসুদেবকে এই মিথ্যাকে মেনে নিতে হয়। প্রকৃত সত্য অবশ্য যদুবংশীয়দের কাছ থেকে গোপন করে রাখা সম্ভব হয়নি, কিন্তু কোনও প্রমাণ ছাড়া তাদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি মথুরাধিপতির বিরুদ্ধাচরণ করা। এর সঙ্গে জড়িত ছিল বসুদেব ও দেবকীর সুরক্ষার প্রশ্নও। কংসের যুক্তি তো প্রস্তুতই ছিল। বৃদ্ধ পিতার শারীরিক দৌর্বল্যের কারণে তিনি বাধ্য হয়েই যুবরাজের কর্তব্য স্বরূপ নিজের কাঁধে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন এই গুরুদায়িত্ব। নিজের বোন ও ভগ্নীপতিকে যদি তিনি নিজের কাছে রাখেন তবে তাতে কী অন্যায় করেছেন তিনি? এ তো সম্পূর্ণভাবে তাঁদের পারিবারিক বন্ধন। এতে বাকীদের কী বলার থাকতে পারে? আর দেবকীর সন্তানের মৃত্যু? দেবকীর শারীরিক দুর্বলতার কারণেই এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা বার বার ঘটছে। এতে তিনি নিজেই সবথেকে বেশি দুঃখিত। কিন্তু বিধাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কে কিই বা করতে পারে ?

নিরুপায়ভাবে এই যুক্তির সামনে মৌন হয়ে থাকা ছাড়া আর কোনও পথ ছিল না যদুবংশীয়দের কাছে। কিন্তু এই মৌনতার আড়ালে তারাও মরিয়া হয়ে উপায় খুঁজছিল। যেন তেন প্রকারেণ এই জাল ছিঁড়ে বেরোনর, এবং ষড়যন্ত্রের উত্তর ষড়যন্ত্রের নীতিতেই দেওয়ার বাসনায় অবশেষে সুগোপনে এক দুঃসাহসিক পরিকল্পনার জন্ম দেওয়া হয় কংসের বিনাশের প্রথম পদক্ষেপ রূপে।.............

(ক্রমশ)

0 comments: