1

প্রবন্ধ - সুজন ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ


বাঙালির পারিবারিক সম্পর্কের ডাক ও ভাষা-রাজনীতি (১ম পর্ব)
সুজন ভট্টাচার্য



সম্প্রতি বাঙালী মুসলিমদের পারিবারিক সম্পর্ক কিংবা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত শব্দাবলী নিয়ে নানান মহলে বিতর্ক শুরু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তৃতীয় শ্রেণীর সমাজবিদ্যার পাঠ্যবইয়ের একটি পাতাকে কেন্দ্র করেই এই বিতর্ক মাথাচাড়া দেয়। কেউ কেউ বইটা আদ্যোপান্ত না পড়েই বলতে শুরু করে দেন – মা, বাবার বদলে আম্মা/আব্বা শেখানো হচ্ছে। অথচ ঠিক আগের পাতাটা দেখলেই বুঝতে পারতেন যে এটা আসলে বাঙালীর দুই প্রধান ধর্মসম্প্রদায়েরই পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে শিশুকে অবহিত করার প্রয়াস মাত্র। সেই হিসাবে এতে আপত্তি বা নিন্দার কিছু নেই। কিন্তু সে সময় আমাদের ব্যস্ত জীবনে কোথায়? বিভিন্ন বিষয়ে অজ্ঞানতা আগেও ছিল; কিন্তু সেই নিয়ে লজ্জাবোধও ছিল। এখন হয়েছে উলটো। অজ্ঞানতা এখন গর্ব করে বলার মতো গুণ। শিখবো না, এই ধনুর্ভঙ্গ পণ করেই যেন কেউ কেউ বসে আছেন। এর পাশাপাশিই আছে স্বজ্ঞানে বা অজ্ঞানে একটা সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে ফেলা। অবস্থান যদি নিয়েই ফেলি, তাহলে সবকিছুই সেই মাপকাঠিতেই দেখবো। এটাই স্বাভাবিক। এখানে সবথেকে হাস্যকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে কতিপয় স্বঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ উদারপন্থীর অবস্থান। বাংলা ভাষার শুচিতা নাকি ইচ্ছাকৃত আরবি/ফার্সি শব্দের অনুপ্রবেশে নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে। এবং হিন্দু-অবস্থানকারীদের থেকে এরা নিজেদের আলাদা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন বাংলাভাষাপ্রেমের নামে। তাহলে আসুন, এখান থেকেই শুরু করা যাক।

যত পণ্ডিত বাংলা ভাষা ও তার ব্যাকরণ নিয়ে বই লিখেছেন, তারা সকলেই ধরে নিয়েছেন সংস্কৃতই বাংলা ভাষার জননী। এই ধারণার জন্মদাতা অবশ্যই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের অন্যান্য রচয়িতাগণ। বর্ণ পরিচয় লিখতে গিয়ে তাই বিদ্যাসাগর একদিকে যেমন ইংরেজি বা অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষা থেকে আগত শব্দাবলীকে বাদ রাখলেন, তেমনই সরিয়ে রাখলেন আরবী বা ফার্সি থেকে আগত শব্দগুলোকে। প্রাথমিকভাবে মনেই করিয়ে দেওয়া হলো, তোমার ব্যবহার্য শব্দাবলী আসলে সংস্কৃত থেকেই ধার নেওয়া; কাজেই তোমার সংস্কৃতির শিকড় সেই“দেবভাষা”র মধ্যেই নিহিত হয়ে আছে। সেটা কি ঐতিহাসিক বা বাস্তবিক সত্য? যথেষ্ট সন্দেহ আছে। প্রথমে সেই সন্দেহের প্রেক্ষাপটটাই আলোচনা করা যাক। সংস্কৃত যদি ভারতের আদি ভাষা হয় – যা থেকেই বাংলা, হিন্দি, মরাঠী ইত্যাদি ভাষাগুলো বিকশিত হয়েছে – তাহলে হয় সংস্কৃতভাষী জনগোষ্ঠীর উদ্ভব ভারতেই সেটা মেনে নিতে হবে,অথবা সংস্কৃত ভাষা যদি ভারতে আগত আর্যদের ভাষা হয়, তাহলে প্রাগার্য ভারতীয়রা কথা বলতে পারতো না, এমনটাই ধরে নিতে হবে।

নৃতত্ত্ববিদদের সাধারণ ধারণা ভারতের আদি অধিবাসী হলো প্রোটো-অস্ট্রলয়েড (কোল, ভিল, সাঁওতাল ইত্যাদি) ও মঙ্গোলয়েড (উত্তরের পাহাড়ের জনগোষ্ঠী) জাতি। সামান্য নেগ্রিটো বাস ছিল দাক্ষিণাত্য ও আন্দামানে। প্রোটো-অস্ট্রলয়েড ও নেগ্রিটো মিশ্রণেই দ্রাবিড় জাতির উৎপত্তি। আর্যরা এসেছিল অনেক পরে, ককেশাস পর্বতমালার সন্নিহিত অঞ্চল থেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারাই ভারতবর্ষ অধিকার করে বসল। এই তত্ত্বের সবথেকে বড় প্রমাণ হলো ল্যাটিন ও সংস্কৃত ভাষার অজস্র শব্দের সাদৃশ্য। এর থেকেই ভাষাতাত্ত্বিকরা মনে করেন এই দুই ভাষাগোষ্ঠীর পূর্বপুরুষেরা একদা একসাথেই ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁরা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যান। সময় ও আঞ্চলিকতার সূত্রে তাঁদের ভাষা মূল থেকে খানিকটা পরিবর্তিত হয়ে যায়। তাহলে আর্যদের আগে থেকেই ভারতে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর বাস ছিল, এটা বোঝা যাচ্ছে। তাহলে তারা কি মূক ছিল সবাই? আর্যরা এসে তাদের কণ্ঠে ভাষা তুলে দিল? বিবর্তনবাদ এমন ধারণাকে সমর্থন করবে না। তাহলে একটাই উত্তর পড়ে রইল। আর্যদের যেমন নিজস্ব ভাষা ছিল, এইসব জনগোষ্ঠীরও নিজস্ব-নিজস্ব ভাষা ছিল। সাঁওতালি বা তামিল ভাষাকে সংস্কৃতের পাশাপাশি রেখে যে কেউই এর প্রমাণ পেয়ে যাবেন।

আবার ভারতে আগত আর্যদের মুখের ভাষাও যে সংস্কৃত ছিল না, সেটাও পণ্ডিতেরা মানেন। বেদের ভাষাকে বলা হয় ছান্দস বা প্রাক-সংস্কৃত ভাষা। তাহলে সংস্কৃত এল কোথা থেকে? ভারতে আসার পর স্থানীয় আদি-অধিবাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার খাতিরে আর্যদের ভাষা বদলে যাচ্ছিল। এটা খুবই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। সেই পরিবর্তিত ভাষাকে সংস্কার করে কঠোর নিয়মের ভিত্তিতে নতুন ভাষার প্রচলন করা হলো। সেই সংস্কার হওয়া ভাষাই হলো সংস্কৃত। সংস্কৃত বৈয়াকরণ পাণিনিকেই এই কাজের কাণ্ডারী বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আর্যদের ভাষা যেমন বদলালো, তেমনি অনার্যদের ভাষাও নিশ্চিতভাবেই বদলে গেল। সম্রাট অশোকের শিলালিপির ভাষা প্রাকৃত। সেখানে “দেবান পিয় পিয়দসি” শব্দ যে আসলে “দেবাণামপ্রিয় প্রিয়দর্শী”, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু বাকিটা সংস্কৃতের আদলে অবোধ্য। আবার এটাও ঘটনা, রাজভাষাই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়। তাই লাতিন আমেরিকা থেকে স্থানীয় পুরোনো ভাষাগুলো অবলুপ্ত হয়ে পর্তুগিজ ও স্প্যানিশের প্রচলন হয়েছে। ভারতেও এমনটাই খানিক খানিক ঘটে গেল।

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসকে মূলত আর্য ইতিহাস হিসাবেই আমরা ভেবে থাকি। বাস্তবত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও দয়ারাম সাহনী সিন্ধু উপত্যকায় খননকার্য না চালালে আমরা জানতেই পারতাম না প্রথম যুগের আর্যদের কৃষিনির্ভর সভ্যতার অন্তত দু হাজার বছর আগেই ভারতে উন্নত নগর সভ্যতার পত্তন হয়েছিল। হরপ্পা ও মোহেঞ্জোদাড়োর ধ্বংসাবশেষের কথা জানার পর প্রথম সবাই জানতে পারলো, ব্যবিলনের নগর সভ্যতার সাথে তুলনীয় একটি নগর সভ্যতার বিকাশ ভারতবর্ষেও হয়েছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদদের সাধারণ ধারণা সিন্ধু সভ্যতার সময়সীমা খ্রীষ্টপূর্ব ৩৩০০ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ১৩০০ পর্যন্ত। খ্রীষ্টপূর্ব ২৬০০ থেকে ১৬০০ পর্যন্ত এই সভ্যতার চরম বিকাশের পর্যায়। প্রাথমিকভাবে ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদরা একমত ছিলেন, এই সভ্যতা চরিত্রগতভাবে একটি অনার্য সভ্যতা। দ্রাবিড় সভ্যতা হিসাবেই একে চিহ্নিত করা হয়। কেউ কেউ মনে করেন আর্যরাই সিন্ধু সভ্যতাকে ধ্বংস করে। আবার একাংশ মনে করেন, প্রাকৃতিক কারণেই এই সভ্যতার পতন শুরু হয়; পরবর্তীকালে আর্যরা তাকে ধ্বংস করে। যাই হোক না কেন, আর্যদের হাতেই যে সিন্ধু সভ্যতার শেষ বিনাশ হয়েছিল, সেই বিষয়ে এঁরা একমত।

বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে একটা বিকল্প মত উঠে আসতে শুরু করল যে আর্যরা ভারতেরই আদি অধিবাসী এবং সিন্ধু সভ্যতা আসলে আর্য সভ্যতা। কেউ কেউ এমনও দাবী করেন যে সিন্ধু সভ্যতার সূচনা হয় খ্রীষ্টপূর্ব ৮০০০ অব্দে। সেই হিসাবে সিন্ধু সভ্যতা ব্যবিলন বা মিশরীয় সভ্যতারও অগ্রজ। এই মতে বিশ্বাসীরা বলেন, সিন্ধু সভ্যতায় পশুবলির নিদর্শন থেকেই বোঝা যায় যে এই সভ্যতা আসলে আর্য সভ্যতাই। কেননা যজ্ঞে পশুবলি দেওয়া ছিল আর্যপ্রথা। এঁরা এমনও বলেন, খ্রীষ্টপূর্ব ১৬০০ অব্দে ব্যাপক খরার কারণেই সিন্ধু সভ্যতা পরিত্যক্ত হয়। এবং আর্যদের হাতে বিধ্বস্ত হওয়া তো দূরের কথা, সিন্ধু সভ্যতার পতনের সঙ্গে সঙ্গেই বৈদিক যুগেরও অবসান ঘটে। এই চিন্তার মধ্যে কয়েকটি ভারসাম্যের অভাব আছে। সবথেকে বড় কথা বৈদিক সভ্যতা ছিল কৃষিনির্ভর সভ্যতা। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতা আদ্যন্ত উন্নত নগর সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতা যদি বৈদিক সভ্যতাই হবে, তাহলে বেদে নগর সভ্যতার বিবরণ নেই কেন? আবার যজ্ঞে পশু, বিশেষত ঘোড়া বলি দেওয়া আর্যদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় একটাও ঘোড়ার মূর্তি পাওয়া গেল না কেন?

সবথেকে বড় সমস্যা হলো বেদের ভাষা ও সিন্ধু সভ্যতার লিপিকে কেন্দ্র করে। এখনো পাঠোদ্ধার করা সম্ভব না হলেও সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা যে লিপি ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কেউ কেউ দাবী করেন ঋকবেদ খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে রচিত হয়। যদিও অধিকাংশ ঐতিহাসিকই খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ১২০০ অব্দের মধ্যে ঋকবেদ রচিত হয়েছিল বলে মনে করেন। সেই হিসাবে ঋকবেদ লৌহযুগের রচনা। অথচ সিন্ধু সভ্যতা ছিল তাম্র সভ্যতা। যদি ৫০০০ বা অন্ততপক্ষে ২৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দকে ঋকবেদের রচনাকাল বলে ধরেও নেওয়া যায়, তাহলে সেটিকে লিপিবদ্ধ করা হলো না কেন? কেন শুধু মুখে মুখেই সেই স্তোত্রগুলোকে প্রচার করা হতো? সিন্ধু সভ্যতা যদি আর্য সভ্যতাই হবে, তাহলে ঋকবেদকে লিপিবদ্ধ করাই কি যুক্তিযুক্ত হতো না?আরো একটা জটিল সমস্যা আছে সিন্ধু সভ্যতার প্রতীক ও মূর্তিপূজাকে নিয়ে। বেদের ধর্মাচরণ কিন্তু আদ্যন্ত যজ্ঞকেন্দ্রিক এবং মূর্তি বা প্রতীকপূজার কোনও স্থান সেখানে ছিল না। তাহলে কি এটাই ধরে নিতে হবে, নগরে প্রতীকপূজা ও গ্রামে যজ্ঞ, এটাই ছিল আর্য ধর্মাচরণ? এমন গোঁজামিল দিয়ে আত্মতৃপ্তি পাওয়া যেতে পারে, সত্যের ধারেকাছে পৌঁছানো যায় না।

বেদের অন্যতম প্রধান দেবতা হলেন ইন্দ্র, পরবর্তীকালে যাকে দেবরাজ বলে চিহ্নিত করা হয়। ইন্দ্রের একটি নাম হলো পুরন্দর, অর্থাৎ নগর ধ্বংসকারী। কোন নগর তিনি ধ্বংস করেছিলেন? তার কোনও তালিকা বৈদিক সাহিত্যে নেই। তাহলে কি তিনি সামগ্রিকভাবে নগর সভ্যতাকেই উচ্ছেদ করেছিলেন? তিনিই আবার প্রতিস্পর্ধী বৃত্রাসুরের হনক। তাই তাঁর নাম বৃত্রাঘ্ন বা বৃত্রারি। বৃত্ত ও বৃত্র দুটি শব্দই বৃত ধাতু থেকে উৎপন্ন, যার অর্থ আবেষ্টন বা ঘিরে রাখা। সাধারণভাবে প্রাচীন যুগে নগরের চারিপাশ পাঁচিল দিয়ে ঘিরে রাখা হতো প্রতিরক্ষার কারণে। নগরপ্রাকারই ছিল এমনসব নগরের প্রাথমিক প্রতিরক্ষা-শক্তি। নগর ধ্বংস করতে হলে আগে তার প্রাকার ধ্বংস করতেই হয়। ইন্দ্র এই কাজে সফল হয়েছিলেন বলেই কি বেদে তাঁর প্রতি স্তুতির এত আয়োজন? আর যদি এই যুক্তি মেনে নিতে হয়, তাহলে এটাও মেনে নিতে হবে যে আর্য আক্রমণেই সিন্ধু সভ্যতার বিলুপ্তি ঘটেছিল।

প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে বাংলা ভাষা নিয়ে আলোচনায় এই প্রসঙ্গ তোলার কী প্রয়োজন? প্রয়োজন অবশ্যই আছে। ভাষা একটি জনসমাজের সামগ্রিক সৃজন, যা ইতিহাসের ধারার পথে আপনা থেকেই বিবর্তিত হয়। কাজেই সমাজের চলনের আলোচনা না করে ভাষার গতিপথ বোঝা সম্ভব নয়। বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ যদি পরষ্পরের দৈনন্দিন সান্নিধ্যে আসেন, তাহলে সহজ সংযোগের প্রয়োজনে উভয়ের ভাষাই বদলে যেতে বাধ্য। তবে এক্ষেত্রে সাধারণভাবে পাল্লাটা যে পক্ষ অধিকতর শক্তিশালী, তার দিকেই ঝুঁকে যায়। প্রশ্ন হলো এটাই, সংস্কৃত বা তার আদিরূপ ছান্দসই কি ভারতের আদি ভাষা? যদি বৈদিক সভ্যতাই ভারতের আদিতম সভ্যতা হয়, তাহলেই এটা সত্যি। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার আলোচনায় আমরা দেখেছি বৈদিক সভ্যতার অনেক আগেই ভারতে উন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব ছিল এবং চরিত্রগত বিচারে তা আর্য নয়। পরবর্তীকালীন খননকার্যের ফলে দেখা যায় সিন্ধু সভ্যতার পরিসর অনেক ব্যাপ্ত ছিল। গুজরাটের লোথালে আবিষ্কৃত হয়েছে সমকালীন সমুদ্রবন্দর,যা প্রমাণ করে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে বহির্জগতেরও সম্পর্ক ছিল। বালুচিস্তানের মেহরগড়ে খ্রীষ্টপূর্ব ২২০০০ অব্দের প্রস্তরযুগের জনবসতির সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়াও পাওয়া গেছে গুজরাটের শ্রাবস্তী উপত্যকার নগর সভ্যতার প্রমাণ, যা সিন্ধু সভ্যতারই সমকালীন। এমনকি এই পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার চন্দ্রকেতুগড়েও প্রাচীন সভ্যতার হদিশ পাওয়া গেছে যা খ্রীষ্টপূর্ব ২৫০০ অব্দের। দক্ষিণবঙ্গের এই সমুদ্রসন্নিহিত অঞ্চলের এই সভ্যতা আর যাই হোক আর্য হওয়া সম্ভব নয়।

ভারতের জনসত্তার এই বৈচিত্রকে স্বীকার না করলে ইতিহাসকে প্রত্যাখ্যান করা হবে। আর্য সভ্যতা যেমন তার বহুচর্চিত একটি আঙ্গিক, তেমনি অনার্য আঙ্গিক তুলনায় কম আলোচিত হলেও অস্তিত্বহীন নয়। এইসব উন্নত নগর সভ্যতার অধিবাসীরা কি মূক ছিলেন? তাঁরা কি ভাষার ব্যবহার জানতেন না? এমনটা হওয়া সম্ভবই নয়। কাজেই এইসব সভ্যতারও নিজস্ব ভাষা ছিল। কিন্তু আর্য আধিপত্যের প্রভাবে ভারতবর্ষের তদানীন্তন এইসব ভাষাগুলির উপর সংস্কৃতের প্রভাব পড়ল। যে সব জনগোষ্ঠী আর্যদের প্রভাবের বাইরে থেকে যেতে সমর্থ হলেন, তাঁদের ভাষা প্রায় প্রভাবহীন রইল। যেমন সাঁওতালি, মুন্ডারী বা গোঁদ ভাষা। আবার কোন কোন ভাষা নিশ্চয়ই অবলুপ্তও হয়ে গেল। বুদ্ধদেব ছিলেন তরাই অঞ্চলের সন্তান। উত্তর বৈদিক যুগের প্রধানতম মহাজনপদ মগধকে কেন্দ্র করেই তাঁর কর্মকাণ্ড ব্যাপৃত হয়। বুদ্ধদেব কিন্তু তাঁর বাণীচয়ন করলেন সংস্কৃতে নয়, পালি ভাষাতে। পালি একটি প্রাকৃত ভাষা যা সম্ভবত খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সৃষ্টি হয়। কোনও কোনও ভাষাতাত্ত্বিকের মতে প্রাচীন কথ্যভাষা পৈশাচী থেকেই পালির জন্ম হয়েছিল সংস্কৃতের প্রভাবে। আবার কেউ কেউ মনে করেন পৈশাচী ভাষাই পালি ভাষা। সপ্তম শতাব্দীতে বৈয়াকরণ দণ্ডিণ পৈশাচী ভাষাকে বলেছিলেন ভূতভাষা অর্থাৎ মৃত ভাষা, যে ভাষায় আর কেউ কথা বলে না। এই আখ্যাকে মাথায় রাখলে পালি পৈশাচী থেকেই উদ্ভূত হয়েছিল বলে মনে হয়। 

ঋকবেদের সূচনাকাল খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ বলেই ঐতিহাসিকদের অধিকাংশই একমত। আবার গৌতম বুদ্ধের জন্ম ৫৬৭ খ্রীষ্টপূর্বাদে। সংস্কৃত নয়, তিনি তাঁর বাণী প্রচার করলেন প্রাকৃত ভাষায় অর্থাৎ সাধারণ মানুষের ভাষায়। বুদ্ধ ছিলেন চরম বেদবিরোধী, ব্রাহ্মণ্যসংস্কারের বিরোধী, এবং চরম নাস্তিক। সৎ চিন্তা, সৎ বাক্য ও সৎ আচরণের মাধ্যমে জীবনকে সত্যসম্পৃক্ত করে রাখাই ছিল তাঁর মৌলিক উপদেশ। স্বভাবতই বৈদিক ধ্যানধারণার চরম বিরোধী বুদ্ধ যে বৈদিক ভাষাকে পরিহার করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তাহলে তিনি যে প্রাকৃত ভাষায় মানুষের সঙ্গে কথা বললেন, তাঁর বাণী প্রচার করলেন, সেটি কি সংস্কৃতের গর্ভ থেকে সঞ্জাত হতে পারে? সাধারণ বোধবুদ্ধি বলে, না, তেমনটা না হওয়াটাই উচিৎ। তাহলে সেই প্রাকৃত ভাষা কোথা থেকে এল? আবার বুদ্ধের প্রায় সমসাময়িক মহাবীরের জন্ম ৫৯৯ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। বুদ্ধের জন্মের দু বছর আগেই তিনি গৃহত্যাগ করেন। মহাবীরও তাঁর বাণী প্রচার করেন প্রাকৃত ভাষাতেই। বুদ্ধ ও মহাবীর, দুজনেই বৈদিক যাগযজ্ঞের ও পশুবলির বিরোধী; অহিংসার প্রচারক। বৈদিক ধারণাকে যাঁরাই বিরোধিতা করতে গেলেন, তাঁরাই সংস্কৃতের পরিবর্তে লোকভাষাকে তাঁদের মাধ্যম করে নিলেন কেন?

ভারতের উত্তর পশ্চিমাংশে বিকশিত বৈদিক সভ্যতা ইতিমধ্যেই পূর্বদিকে আরো বিস্তৃত হয়েছে। এবং এই বিস্তারে ক্ষত্রিয় অর্থাৎ যোদ্ধাদের ভূমিকাই ছিল সবথেকে প্রধান। কিন্তু আর্য সংস্কৃতি ও ধর্মচেতনার আধার ছিল ব্রাহ্মণরা। স্বভাবতই নতুন অধিকৃত অঞ্চলে তারাই ছিল প্রাধান্যজনক অবস্থানে। ইতিমধ্যে কৃষিভিত্তিক বৈদিক সভ্যতা নগর সভ্যতার রূপ নিতে আরম্ভ করেছে। এইসব নগরের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে কোনও কোনও নগরের ক্ষমতা বাড়তে থাকে এবং সেগুলো ছোট ছোট রাজ্যের ভ্রূণ হয়ে ওঠে। এদের বলা হয় মহাজনপদ। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতেই মগধ,কোশল, কুরু, পাঞ্চাল, মল্লসহ ষোলটি মহাজনপদ যে প্রধান হয়ে ওঠে, তার উল্লেখ পাওয়া যায়। এদের মধ্যে মল্ল বাদে বাকিগুলো ছিল রাজতন্ত্র। মহাবীর ছিলেন বৈশালীর লিচ্ছবী প্রজাতন্ত্রের সন্তান। আবার বুদ্ধের পিতা শুদ্ধোদন কপিলাবস্তুর রাজা হলেও ষোড়শ মহাজনপদের তালিকায় সেই রাজ্যের নাম পাওয়া যায় না। কাজেই বুঝে নিতে কষ্ট হয় না যে আর্য আগ্রাসণ ও ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় আধিপত্য নিয়ে চিন্তিত হবার কারণ তাঁদের ছিল।

নগর সভ্যতা গড়ে তুলতে শুধু যোদ্ধা ও পণ্ডিত থাকলেই হয় না, বণিক ও কারিগর প্রয়োজন। এই কারিগররাই ছিলেন তদানীন্তন সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই এঁরা যে এইসব জনপদের আদি অধিবাসী ছিলেন, এমনটা বুঝে নিতে কষ্ট হয় না। এঁদের ভাষা নিশ্চিতভাবেই সংস্কৃত ছিল না। কিন্তু বিজয়ী আর্যদের সামাজিক ও সামরিক প্রভাবে তাঁদের ভাষার উপর সংস্কৃতের প্রভাব পড়তে বাধ্য ছিল। বিপরীতটাও অবশ্যই সত্য। এইভাবেই তদানীন্তন সমাজে আধিপত্যকারীর সংস্কৃত ভাষা এবং নিম্নবর্গের প্রাকৃত ভাষা – এই বিভাজন ঘটে যায়। আমরা আগেই পৈশাচী ভাষার নাম শুনেছি। পৈশাচী মানে পিশাচসুলভ অর্থাৎ যা কিছু মানুষের মতো নয়। বিজয়ী আর্য সংস্কৃতি যে পরাজিত আদি অধিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে এভাবেই অবজ্ঞা করবে, এটাই স্বাভাবিক। মহাবীর ও বুদ্ধদেব সম্ভবত প্রাকৃতকে অবলম্বন করেছিলেন অতিদ্রুত সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যাবার জন্য। পাশাপাশি ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় আধিপত্যের ভাষাকে খারিজ করে দিয়ে তাঁরা সেই সংস্কৃতিরও বিরোধিতা করতে চেয়েছিলেন। উভয়েই যাগযজ্ঞ ও পশুবলির বিরোধী ছিলেন, যা সরাসরি ব্রাহ্মণ্য আচরণকে আঘাত করেছিল। দুজনেই ছিলেন পরম অহিংসার পক্ষপাতী যা ক্ষত্রিয় যোদ্ধাদের স্বার্থের পরিপন্থী।

এইভাবে সেই আদি যুগেই ভাষা হয়ে উঠেছিল কর্তৃত্ব বা বিরোধিতার অস্ত্র। ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির আধার হলো বেদ, যা ছান্দস বা সংস্কৃতের আদি চেহারায় রচিত। সেই বেদ পাঠের অধিকার ব্রাহ্মণের একচেটিয়া। আর সেই একচেটিয়া অধিকারের সূত্রেই তারা সমাজের শীর্ষস্থানীয়। ক্ষত্রিয়রাও তাদের পৃষ্ঠপোষক। উল্টোদিকে সাধারণ মানুষের ভাষাকে তারা অবজ্ঞা করে, ভূতপ্রেতের ভাষা বলে অপমান করে। আর এইভাবেই প্রতিনিয়ত প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে মানুষ হিসাবে তারা অনেক উন্নত। কাজেই তাদের অধীনস্থ হয়ে থাকাটাই সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক নিয়তি। মহাবীর বা বুদ্ধদেব যখন প্রাকৃতে তাদের উপদেশ দিলেন, তাঁরা এটাই প্রমাণ করতে চাইলেন, অনন্ত জ্ঞান এই ভাষাতেও আলোচনা করা সম্ভব। অর্থাৎ বেদের ভাষা আয়ত্ত না করেও জীবনের মৌলিক সমস্ত প্রশ্ন নিয়ে গভীর আলোচনা করা যায়। এক্ষেত্রে প্রাকৃত ভাষা হয়ে উঠল বৈদিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ অস্ত্র।

বৌদ্ধধর্মের যাবতীয় আদিগ্রন্থ রচিত হয়েছিল পালি ভাষায়। বুদ্ধের প্রায় তিনশো বছর পরে সম্রাট অশোকের জন্ম। বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার পর অশোক যে সব শিলালিপি স্থাপন করেন, তার ভাষা মূলত পালি। আদি জৈন গ্রন্থগুলোর তুলনায় পালি ভাষার উপর সংস্কৃতের প্রভাব অনেক স্পষ্ট। মাঝের তিনশো বছরে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় জোটের ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে; মগধে স্থাপিত হয়েছে নন্দ বংশের সাম্রাজ্য। স্বভাবতই রাজশক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় সংস্কৃতের প্রভাব জনজীবনে পড়তে বাধ্য। নন্দ বংশের রাজত্বের শেষভাগে আলেকসান্দার ভারত আক্রমণ করেন। গ্রীক বাহিনীর একটি অংশ ভারতের উত্তর পশ্চিমাংশে স্থায়ীভাবেই বসবাস শুরু করেন। এই অঞ্চলে ব্যবিলনের অ্যারামেইক ভাষার প্রচলন ছিল। কান্দাহার বা তারো পশ্চিমের অশোকের শিলালিপির ভাষা তাই হয়ে গেল গ্রীক ও অ্যারামেইক। এখানেও অশোকের তাগিদ ছিল যাতে বেশিসংখ্যক সাধারণ মানুষ তাঁর বক্তব্য বুঝতে পারেন। গুপ্তযুগের তীব্র ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির প্রভাবে বৌদ্ধধর্ম মূল ভূখণ্ড থেকে অনেকটাই প্রান্তের দিকে সরে যেতে বাধ্য হয়। জৈনধর্মও সংকুচিত হয়ে যায় একটা গোষ্ঠীর মধ্যে। স্বভাবতই প্রচারের বা রচনার ভাষা হিসাবে ভারতে পালি ভাষার গুরুত্ব হ্রাস পায়। যেহেতু তিব্বতে বৌদ্ধধর্ম পৃষ্ঠপোষকতা পায়, তাই পালি ভাষায় গ্রন্থ রচনা এখানে অব্যাহত থাকে। কিন্তু জৈনধর্মে সংস্কৃতে রচনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। হর্ষবর্ধন ধর্মে বৌদ্ধ হলেও কাব্য রচনা করলেন সংস্কৃতে। 

প্রাকৃত শব্দের অর্থ হলো প্রকৃতি অর্থাৎ মূল থেকে উৎপন্ন। এই নাম থেকেই বোঝা যায় প্রাকৃত ভাষা আসলে তৃণমূলস্তরের মানুষদের ভাষা বা দেশজ ভাষা। কিন্তু আর্য ও অনার্যদের পারষ্পরিক সংস্পর্শে উভয়ের ভাষাই প্রভাবিত হয়েছিল। আর্যদের আদি ভাষার সংস্কার সাধন করে সংস্কৃত ভাষার সৃষ্টির মধ্যে এই প্রেক্ষাপটই উঠে আসে। নিজস্ব ভাষা যাতে আর বিকৃত না হয়, জটিল নিয়মের বাঁধনে তাই তাকে বেঁধে ফেলা হয়। সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম না জেনে সেই ভাষায় বাক্যালাপ করা আর সম্ভব ছিল না। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে চতুর্থ অব্দের মধ্যে পাণিনি তাঁর অষ্টাধ্যায়ী রচনা করেন। প্রায় চার হাজার স্তোত্র সম্বলিত এই বইটি না পড়ে সংস্কৃতে লেখা বা কথা বলা আর সম্ভব ছিল না। আবার পাণিনির স্তোত্রগুলোও এমন সমস্ত অলঙ্কারের মাধ্যমে লিখিত হয়েছিল যে ছাত্রের উপযোগী করে সেগুলোকে ব্যাখ্যা করতে হতো। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীর একের পর এক ভাষ্য বা ব্যাখ্যা রচিত হতে শুরু করলো। এদের মধ্যে সম্ভবত দ্বিতীয় খ্রীষ্টপূর্বাব্দে রচিত পতঞ্জলির মহাভাষ্য সবথেকে প্রামাণিক বলে স্বীকৃতি পায়।

বোঝাই যাচ্ছে এমন জটিল ও বিপুল শাস্ত্রের পাঠ নেওয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এমনিতেই বেদের পাঠ নেবার অধিকার ছিল শুধু ব্রাহ্মণদের। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা আনুসঙ্গিক শিক্ষা পেলেও অন্ত্যজদের তেমন কোনও সুযোগ বা অধিকার ছিল না। স্বভাবতই উচ্চ শ্রেণীর ভাষা হয়ে গেল সংস্কৃত আর নিম্নশ্রেণীর জন্য পড়ে রইল দেশজ ভাষা। আবার সংস্কৃতর মাধ্যমেই বেদানুশীলন করতে হতো। স্বভাবতই সংস্কৃত হয়ে গেল ধর্মীয় ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ভাষা। এই ভাষায় অধিকার মানেই উন্নতির সোপানের কাছে পৌঁছে যাওয়া। কিন্তু এই প্রক্রিয়া আদৌ সরল বা একপাক্ষিক প্রক্রিয়া ছিল না। ভারতে আগমনের পর থেকে আর্যরা যেমন আদি অধিবাসীদের ক্রমাগত বিধ্বস্ত করে নিজেদের অধিকার প্রসারিত করছিল, তেমনি একইসাথে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় তাদের সংস্পর্শেও আসছিল। ফলে বৈদিক ভাষার প্রভাব যেমন দেশজ ভাষার উপর পড়ছিল, তেমনি দেশজ ভাষার শব্দও চলে আসছিল বৈদিক ভাষায়। একটা উদাহরণেই বিষয়টা বোঝা যাবে। উত্তর বৈদিক সাহিত্যে চাল অর্থে ব্রীহি শব্দ ব্যাপক প্রচলিত হলেও ঋকবেদে তার উল্লেখ নেই। বরং চালের পিঠে অর্থে পুরলস শব্দ পাওয়া যায়। এই ব্রীহি শব্দটি হয় পরবর্তীকালে কোন কবির সৃষ্টি অথবা দেশজ ভাষা থেকেই চলে আসা।

এটা হওয়াটাই খুব স্বাভাবিক। দেশজ ভাষাতেও বৈদিক ভাষার শব্দ একইভাবে চলে এল। বুদ্ধদেবের বাণীতে প্রাধান্য পেল মজ্ঝিমাপতিপদা। পতিপদা সংস্কৃতের প্রতিপদ বলে ধরা যায় অর্থাৎ পন্থা বা পথ। একইভাবে মজ্ঝিমা শব্দকে সংস্কৃত মধ্যম শব্দের বিকৃত রূপ বলেও ধরে নেওয়া হয়। বস্তুত উত্তর ভারতের বর্তমানের ভাষাতেও মধ্য অর্থে মাঝ, মাঝেলা, মেজো শব্দই বেশি প্রচলিত। ধ্য অর্থাৎ ধিয় উচ্চারণ কেন ঝ-উচ্চারণের চেহারা নিল, ব্যাখ্যা করা মুশকিল। যদি সমস্থানীয় বিকৃতির সম্ভাবনা ধরা যায়, তাহলে বধ্য শব্দ হওয়া উচিৎ ছিল বঝ বা বজ, কিংবা সাধ্য শব্দের চেহারা হতে পারতো সাঝ বা সাজো। কোনটাই হয়নি। বধ্য বা সাধ্য হয় অবিকৃতরূপেই ব্যবহার হয়েছে, অথবা আদৌ হয়নি। তাহলে কি এমনটা ধরে নেওয়া যায় যে দেশজ মাঝ শব্দটিই প্রাকৃত থেকে সংস্কৃতে চলে গেছে যথেষ্ট পরিবর্তিত হয়ে? এখানে আমরা জরথ্রুষ্টিয় অগ্নিপূজক ধর্মের দেবতা “আহুর মাজদা”র প্রসঙ্গ একবার টেনে আনতে পারি। ব্যবিলনীয় ভাষা ও বৈদিক ভাষায় হ আর স রূপান্তর যোগ্য। তাই বেদের সপ্তসিন্ধু জিন্দাবেস্তায় ছিল হেপ্তা হিন্দু, দাস ছিল দাহা কিংবা অসুর ছিল আহুর। আহুর মাজদা ছিলেন ব্যাবিলনের প্রধান দেবতা; কালক্রমে পারস্যের জরথ্রুষ্টিয় আর্যদেরও প্রধান দেবতা হয়ে ওঠেন।

পারস্যের আহুর মানে বৈদিক সভ্যতার অসুর। আবার বৈদিক সাহিত্যে অসুর নিন্দিত অপশক্তি হিসাবে। যাই হোক না কেন, আহুর মাজদা যদি পারস্যের আর্যদের প্রধান দেবতা হন, তাহলে মাজদা শব্দের অর্থ নিশ্চিতভাবেই প্রধানসূচক। বৈদিক সাহিত্যে এর কাছাকাছি শব্দ হলো মহৎ যা প্রধান অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। মাজদা থেকে মধ্যবর্তী অর্থে মধ্য শব্দের উদ্ভব হলেও তার অর্থ প্রধানের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট থাকা উচিৎ। বর্তমান অর্থে শব্দটির ব্যবহার বৈদিক রীতির সঙ্গে মেলে না। বরং সেক্ষেত্রে দেশজ মাঝ বা মাজ শব্দটি কিঞ্চিৎ গ্রামভারী হয়ে মধ্যম চেহারায় সংস্কৃতে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে, এমনটা হওয়া বরং অনেক যৌক্তিক। আবার আঘাত ও আহত শব্দের সংস্কৃত ব্যুৎপত্তির হিসাবটাও একদমই মেলে না। দুটি শব্দই নাকি হন্ ধাতু থেকে উৎপন্ন। দুটিতেই আ উপসর্গ রয়েছে। তাহলে প্রথম শব্দে হ কেন ঘ হয়ে গেল, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই। আঘাতের কাছাকাছি প্রচলিত শব্দ হলো ঘা বা ঘাও। তাহলে কি সেই দেশজ শব্দটাই সংস্কৃতায়িত হয়ে গেল পাণিনির সংস্কারে? মাথায় রাখতে হবে, মহাবীর, বুদ্ধদেব ও পাণিনি প্রায়-সমসাময়িক। তাই বুঝেই নেওয়া যায় প্রায় একই সময়ে দমনকারীর ভাষা ও অবদমিতের ভাষাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দুই প্রতিস্পর্ধী প্রয়াসের সূত্রপাত হয়।

সংস্কৃত বৈয়াকরণেরা মূলত চার ধরণের প্রাকৃতের উল্লেখ করেছেন – সৌরসেনী প্রাকৃত, মগধী প্রাকৃত, অর্ধমগধী প্রাকৃত ও মহারাষ্ট্রী প্রাকৃত। মগধ মানে মূলত উত্তর ও মধ্য বিহার। এখানেই উত্তর বৈদিক যুগের সবথেকে বড় সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল নন্দ বংশের মাধ্যমে খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে। নন্দ বংশের রাজা ধননন্দকে হত্যা করে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ৩২১ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মৌর্য সাম্রাজ্যের সূচনা করেন। সুঙ্গ বংশ হয়ে গুপ্ত সাম্রাজ্য পর্যন্ত মগধের সাম্রাজ্যসীমা ছিল বিশাল। সৌরসেন ছিল মথুরাকেন্দ্রিক মহাজনপদ। অর্ধমগধী প্রাকৃত সৌরসেন ও মগধের মধ্যবর্তী অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। আবার মহারাষ্ট্র অঞ্চল বলে কোন মহাজনপদের নাম পাওয়া যায় না। তবে সন্নিহিত মহাজনপদ ছিল রাজস্থানের মৎস্য। নিশ্চিতভাবেই এইসব অঞ্চলের আদি অধিবাসীদের মধ্যে পার্থক্য ছিল। স্বভাবতই সেই পার্থক্যই তাদের ভাষার মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছিল। প্রাকৃত ভাষার প্রথম নিদর্শন অবশ্যই সম্রাট অশোকের শিলালিপি, যা খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের রচনা। পরবর্তীকালে সিংহলেও প্রাকৃত সাহিত্যের নিদর্শন পাওয়া যায়, যদিও উত্তর ভারতীয় প্রাকৃতের থেকে তা বেশ খানিকটাই আলাদা। 

এই হিসাবে ভারতের পূর্বাঞ্চলের প্রাকৃত হলো মগধী প্রাকৃত। পূর্ব ভারতের যাবতীয় প্রধান ভাষা, যেমন বিহারী, বাংলা, অসমীয়া, উড়িয়া ভাষাগুলো মগধী প্রাকৃত থেকেই জন্ম নিয়েছে বলে ভাষাতাত্ত্বিকরা মনে করেন। বিহারী ভাষা বলতে মৈথিল, ভোজপুরী, অঙ্গিকা বা ছ্যাছা, বজ্জিকা বা ছেনি ভাষাগুলিকে একত্রে বোঝায়। বিস্তীর্ণ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর নিজস্বতা অনুযায়ী একেকটি স্থানে ভাষার চেহারা একেকরকম হয়ে গেল। অবশ্য এমনটা ভাবারও কোন কারণ নেই যে মগধী বা অন্যান্য প্রাকৃত ভাষাগুলোর কোনও সুনির্দিষ্ট শব্দভাণ্ডার বা বিন্যাসপ্রণালী ছিল। বরং এমন একেকটি মৌলিক প্রাকৃত ভাষা আসলে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক রূপের বৈচিত্রের মধ্যে ন্যূনতম মৌলিকত্বের ভিত্তিতে একেকটি ভাষাগোষ্ঠী ছিল বলে ধরে নেওয়াটাই ঠিক হবে। বাংলা ভাষার জন্মসূত্র খুঁজতে গেলে এই অঞ্চলের ইতিহাসটাকেও স্মরণে রাখতে হবে। পরবর্তী পর্বে আমরা সেখান থেকেই শুরু করবো।

1 comment:

  1. বিষয়টা জটিল। ব্যাখ্যাটাও তাই কিছুটা জটিল। তবুও আল লেগেছে। তবে আমার মনে হয়, কিছু উদাহরণ আমাদের মত, এবিষয়ে যারা অজ্ঞ, তাদের বুঝতে সাহায্য করত। পরের সংখ্যার জন্য অপেক্ষা করে থাকলাম।

    ReplyDelete