অণুগল্প - রাজা সিংহ
Posted in অণুগল্প
অণুগল্প
অনাবৃত
রাজা সিংহ
অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে থাঙ্গাম্মা। তারই বয়সী হবে হয়তো, অথচ কি সুন্দর টানটান গায়ের চামড়া। বিদেশিনী সে আগেও দেখেছে অনেক। কিন্ত এ যেন সূর্যের মতো উজ্জ্বল। চারপাশে তার কত পুরুষ। পেছনে হাঁটছে ইতস্তত। ফটো তুলছে খিচিক খিচিক। শ্রী ভেঙ্কটেশ্বর গারমেন্টস্ ফ্যাক্টারির মালিক বিনয়ে বিগলিত, পারলে গায়ের জামা খুলে বিছিয়ে দেয় মাটিতে।
তাই এত সাফসুতরো আজ। গেটে ঢোকার মুখে একটা প্যাকেটে দুটো ইডলি আর চাটনি। বাপের জন্মে হয়নি এমন।
‘কি কাজ করো এখানে?’ স্নিগ্ধ চোখে সেলভীর মুখ চেয়ে চারু হাসেন বিদেশিনী। দোভাষী অনুবাদ করে।
একশ পঞ্চাশটা মাল ঘণ্টা প্রতি। সবে সত্তর হয়েছে। মাথাটা পিছনে হেলিয়ে দিয়েছিল ক্লান্তিতে। ঘণ্টাখানেক বাকি বিরতির। সুপারভাইজার মঞ্জুনাথ কখন এসে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল পেছনে। খেয়াল করেনি সেলভী। সেলভীর পিঠের উপর কাপড় মাপার স্কেলটা বুলিয়ে বলে উঠল মঞ্জুনাথ 'কিরে ব্যথা করছে বুঝি? টিপে দেবো? চমকে উঠে তুরন্ত কাজে লেগেছিল সেলভী। এ তো নৈমিত্তিক ব্যপার। মাস গেলে তিনটি হাজার টাকা। গায়ে মাখলে কি সংসার চলে?
চোখ নামিয়ে বিড়বিড়ায় সেলভী। এগিয়ে যান বিদেশিনী।
লাল টুকটুকে লিপষ্টিক ঠোঁটে ফৌজিয়ার সেলাই পরীক্ষা করেন মেমসাহেব। চার বাচ্চার মা ফৌজিয়া, বর থাকে অন্য আওরাতের সাথে। ফৌজিয়া জোর করে হাসি টানে মুখে। যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে তলপেট। রক্তস্রাব ছাপিয়ে যাচ্ছে ন্যাকড়ার আস্তরণ। প্রায় দু-হাজার মহিলার জন্য এই কারখানায় মাত্র দুটো কলঘর। কদর্য, পূতিগন্ধময়। বাইরে পাহারাদার বসানো। পাঁচ মিনিটের বেশী অনুমতি নেই কলঘরে। নিয়ম নেই দুবারের বেশী কলঘরে যাবার। চারটে পেট তারস্বরে অপেক্ষা করছে বাড়িতে।
মুগ্ধ হয় থাঙ্গাম্মা। সোনালী চুল নেমেছে কাঁধ ছাপিয়ে। কেমন টানটান মাথা উঁচিয়ে হাটঁছেন মহিলা।
মেয়েদের অন্তর্বাস সেলাই করে তারা। বিদেশী মেমসাহেবদের জন্য। তুলোর মতো নরম আর দামী। একখানা স্তনবাঁধুনি নাকি তাদের এক বছরের রোজগারের চেয়েও বেশি। মোম পালিশ বুকে ওঠে এ অন্তর্বাস, এত দামী বুঝি ওদের বুক? তা তো হবেই।
ঋজু পায়ে মেমসাহেব ততক্ষণে থাঙ্গাম্মার টেবিলে। ঝকঝকে হাসিতে বড় আপন জনের মতো থাঙ্গাম্মার খরখরে হাতে হাত রাখলেন তিনি।
কত মাইনে পান এখানে?
থাঙ্গাম্মা ভূমিকে খোঁজে। আসেনি ভূমি। কোন রকমে শাড়ি দিয়ে দুপাশ টা একটু আড়াল করতে পেরেছিল মাত্র। ভূমি ছটপট করছে যন্ত্রণায়। হাঁফাতে হাঁফাতে থাঙ্গাম্মা মিনতি করেছিল,
‘সার হাসপাতাল...হাসপাতাল, বিয়োবে মেয়েটা।’
'তাতে তোর কি রে শালী। দরখাস্ত দিতে বল আগে। যন্ত্রণায় আকাশ ফাটানো চিৎকার কানে নিয়েও নির্বিকার মঞ্জুনাথ।
হাপড়ের মতো বুকটা ঠেলে একটা আকাশ ফাটানো চিৎকার ছেড়ে থেমে গিয়েছিল ভূমি। ছুটে এসেছিল হালিমা, ফৌজিয়ারা, পড়িমরি করে থাঙ্গাম্মা। রক্তস্রাবে শুয়ে ভূমি। বেহোঁশ। মাতৃজঠর থেকে পাথর হয়েই বেরিয়েছে শিশুটি। শক্ত মুঠি স্থির বুকের কাছে।
কি অপূর্ব সুবাস মেমসাহেবের গায়ে। টানটান শরীর। নিটোল বুক। অনেকটা দেখা যায় তার। তবু সাহস করে তাকাচ্ছে না কোনও পুরুষ। কেমন কেঁচোর মতো মাটিতে মুখ গুঁজে পাশে পাশে সব।
'এখানে কাজ করতে ভালো লাগে?'
পলিথিন মোড়া ঘরে শুয়ে কচিগুলো খিদের চোটে চিল চীৎকারে আকাশ ফাটায়। হেগে মুতে মাখামাখি করে। সদ্য মায়েদের দুধ ভরা বুক টনটন করে, দুধ ধারায় ভিজে যায় ব্লাউজ। তবু তারা ঘাড় গুঁজে মহার্ঘ অন্তর্বাস বুনে চলে।
‘কেমন লাগে এখানে?’ অকাতর হাসি বিলোন মেমসাহেব আবার।
সহসা সবাইকে হকচকিয়ে একটানে ব্লাউজটা খুলে ফেলল থাঙ্গাম্মা। উন্মুক্ত চল্লিশোত্তর ঝুলে যাওয়া স্তন। নারকোলের মালার আয়তনে কালো স্তন বৃন্তের চারপাশটা। কুঁচকানো, খড়ি ওঠা অনাবৃত মাংসপিন্ড।
থাঙ্গাম্মার দুচোখ আঁতিপাঁতি খুঁজল ভূমি, সেলভী, ফৌজিয়াদের।
তারপর পাথর হওয়া মেমসাহেবের ভয়ার্ত চোখে চেয়ে খসখসে কফ আটকানো গলায় বলে উঠল-
‘ল্যাংটো!… একদম ল্যাংটো’।
(সমাপ্ত)
বাকরূদ্ধ
ReplyDeleteকিছু কিছু গল্প সপাটে আমাদের চড় কষায়। খানিকক্ষণ মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে, কি পড়লাম, কি বুঝলাম সেসব বোঝার আগের একটা সান্দ্র অবস্থায় ছেড়ে দেয় সেই গল্প। এটাও প্রায় সেইরকম। ভীষণভাবে ঝাঁকিয়ে দেয় এ গল্প। টুপি খুলে রাখলাম, শুভেচ্ছা নিও !
ReplyDeleteআরো অনেক লেখা চাই. আবার মুগ্ধ হলাম,
ReplyDeleteJhNajhNalo!
ReplyDeleteবাস্তব সমাজের চোখেরপর্দা সরবে কি?
ReplyDelete