0

সম্পাদকীয়

Posted in

একুশে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ইতিহাসের কথা বলার প্রয়োজন নেই। মাতামাতি অনেক হবে, জানি। আজ কিছু অন্য কথা হোক। অবশ্যই আমাদের মাতৃভাষা - বাংলা-কে নিয়েই...

প্রতিবার যখনই কিছু লিখি, শেষকালে লিখি - সচেতন থাকুন, সৃজনে থাকুন। এই শব্দবন্ধগুলি যখন আওড়াই, মনে মনে মাতৃভাষার কথাই ভাবি, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। অর্থাৎ কিনা, সৃজনশীলতায় যেন সচেতনতার অভাব না থাকে, সেই কামনাই করি। এমনিতেই বাংলা ভাষার মতো এত প্রাঞ্জল এবং সুমধুর একটি ভাষা প্রতিদিন সমৃদ্ধ হচ্ছে বিজাতীয় অজস্র শব্দের আত্মীকরণে, যা কিনা প্রমাণ করে ভাষাটির বহমানতাকেই। আশ্চর্যজনকভাবে, বহুজনকথিত এই ভাষাটির নিজস্ব পূর্ণাঙ্গ ব্যকরণ তৈরি হয়ে ওঠেনি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখনও সংস্কৃত ব্যকরণের উপরেই তার নির্ভরশীলতা। এহেন পরিস্থিতিতে এ ভাষার ব্যবহার ও বিস্তারে বিশেষ সচেতনতার প্রয়োজন আছেই, একথা অনস্বীকার্য। নয়তো নবীনা ভাষা-সুন্দরী নির্দয় প্রয়োগকারীর যথেচ্ছ ব্যবহারে ম্রিয়মাণ হয়ে পড়তে পারেন! অতএব, সুধী, সময় থাকতে সজাগ হোন!

আজ থেকে ঠিক এক সপ্তাহ পরেই শুরু কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা। যদিও ইন্টারন্যাশানাল ক্যালেন্ডার মেনে এবারের বইমেলার আয়োজন করা যায়নি, তবুও উৎসাহ উদ্দীপনায় টানটান পুস্তকপ্রেমী মানুষজন এখন আর দিন নয়, ক্ষণ গুণছেন! চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সকলেই। ঋতবাকের প্রস্তুতিও প্রায় শেষের পর্যায়েই। দেখা হবে মেলার মাঠে, স্টল নম্বর ৩৭৭এ।

মাতৃভাষার সচেতন চর্চায় ডুবে থাকুন

শুভেচ্ছা নিরন্তর...

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in



রামবল্লভী---এক লোকায়ত সম্প্রদায়
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
.
লোকমুখে শোনা ছিল, বাঁশবেড়িয়া ও তৎপার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলিতে একদা রামবল্লভী সম্প্রদায় নামে একটি গৌণধর্মের শাখার এখনও কিছু মানুষজন আছেন। সেই উৎসাহেই বাঁশবেড়িয়া ও তার আশেপাশে খুঁজে দেখার চেষ্টা করি। আমাদের সঙ্গী ছিলেন আমার ‘রামায়ণ—লোকায়ত গানে’ গ্রন্থটির ( প্রকাশক—ঋতবাক,কলকাতা) সহ-লেখক শ্রী নিলয় সরকার। নিলয়দার কাছে প্রাচীন ও লোকায়ত নানা ধরনের গানের সংগ্রহ আছে। ‘রামায়ণ—লোকায়ত গানে’ বইটির প্রায় সব গানই তাঁর সংগ্রহের। রামবল্লভী গানেরও কয়েকটি তিনি আমায় দিয়েছেন। তাই খুব উৎসাহভরে এই খোঁজাখুঁজি শুরু করি। গানগুলির জন্য আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু খুবই দুঃখের কথা, রামবল্লভী সম্প্রদায় সম্বন্ধে সেখানকার মানুষজনের কাছ থেকে বিশেষ কিছুই সংগ্রহ করা যায়নি সেদিনের খোঁজাখুঁজিতে। অতি সামান্য কিছু তথ্য ও নানান বই এবং নানাজনের লেখা থেকে যা তথ্য পাওয়া গেছে, সেগুলি অবলম্বন করেই এই লেখাটি লিপিবদ্ধ করা গেল। সঙ্গে রইলো রামবল্লভী সম্প্রদায়ের ভক্তদের কিছু গান।
খোঁজ চলছে, চলা উচিত। বাংলার ধর্মীয় আন্দোলনের ইতিহাসের একটি বড় পরিচ্ছেদ হল এই গৌণধর্মগুলি।
.
অক্ষয়কুমার দত্ত, উপেন ভট্টাচার্য, সুধীর কুমার চক্রবর্তী প্রভৃতির রচনা থেকে জানতে পারি, বাংলার লোকায়ত বা গৌণধর্মগুলির উত্থান প্রায় সমসাময়িক। সব গৌণধর্মগুলিরই বয়স প্রায় দুশো থেকে আড়াইশো বছর। এই সময়ের মধ্যেই ধর্মগুলির উৎপত্তি ও বিকাশ। যেহেতু এই লৌকিক ধর্মগুলির উত্থানের কারণ বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম তথা উচ্চবর্ণের বিরোধ, তাই বিভিন্ন লোকায়ত ধর্মগুলির মধ্যে জীবনযাপন, সাধনা পদ্ধতির কিছু অমিল থাকা সত্ত্বেও পারস্পরিক কিছু মিল লক্ষ্য করা যায়। সাহেবধনী, কর্তাভজা, বলাহাড়ি প্রভৃতি বিভিন্ন গৌণধর্মগুলির জেগে ওঠা সমাজে ও জীবনে এক আশ্চর্য মাত্রা যোগ করে। এই সব গৌণ ধর্মগুলি কিন্তু পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে অদ্ভুত এক বন্ধনে জড়িত। তাই এক ধর্মের মানুষের কাছে শোনা যায় আর এক ধর্মের মানুষের গান। আবার আউল-বাউল বলতে আমরা যা বুঝি, তাঁদের গানও অনেকেই ব্যবহার করেন। আসলে, এই সব গৌণ ধর্মগুলির মূল লক্ষ্য হল মানব ভজনা। অর্থাৎ মানুষের নিজের মধ্যে যে সর্বশক্তিমান এক সত্ত্বা বিরাজমান, তাঁকে জাগানো, সে সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠা এবং মানুষের নিজেকে জানা, নিজেকে চেনা। তাই বলাহাড়ি সম্প্রদায়ের মানুষও গান করেন সাহেবধনী সম্প্রদায়ের কুবীর গোঁসাই, লালশশীর গান; রামবল্লভী কিংবা কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মানুষও গান করেন সাহেবধনী বা বলাহাড়ি সম্প্রদায়ের। এ এক আশ্চর্য মিলমিশের জগত। মূল লক্ষ্য যদি এক হয় মানুষকে জানা ও চেনা, মানুষকে ভালোবাসা অর্থাৎ মানবতাবাদই যদি মূল লক্ষ্য হয়, সেখানে সম্প্রদায় বা ধর্ম কোন বাধা হতে পারে না। সুধীর চক্রবর্তী যেমন বলেছেন—‘ সংকীর্ণ শাস্ত্র ব্যাখ্যা করে নয়, উদার মানবতা নিয়ে সহজ করে বাঁচা।‘ তাই বাংলার এই গৌণধর্মগুলি ভিন্ন হয়েও পরস্পর একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত, মানবতাবাদ আর সহজ জীবনই ছিল যাদের উদ্দেশ্য।
.
আছে মানুষে মানুষে যার ভেদাভেদ জ্ঞান,
সে রাজ্য গমনে তার মিলবে না সন্ধান।
---দুলালচাঁদ (ভাবের গীত)
আঠারো শতকে বৈষ্ণববাদ ও সুফীবাদের মিলন হল কর্তাভজা ধর্মীয় সম্প্রদায়। এই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের গুরু হলেন আউলচাঁদ। আউলচাঁদের আটজন প্রধান শিষ্যের মধ্যে একজন ছিলেন রামশরণ পাল, যিনি নদীয়া জেলার ঘোষপাড়ায় প্রতিষ্ঠা করেন কর্তাভজা সম্প্রদায়ের অন্যতম পীঠস্থান এবং সেখানে প্রতিষ্ঠা হয় সতীমায়ের মন্দির। মন্দিরটির নামকরণ পরে করা হয়েছিল, রামশরণের স্ত্রীর নাম অনুসারে, যিনি রামশরণের পর এই ধর্মীয় সম্প্রদায়টির সর্বময় কর্ত্রী হয়ে ওঠেন। রামশরণের স্ত্রীর নাম ছিল সরস্বতী। তাঁর নামের প্রথম ও শেষ অক্ষর দুটি নিয়ে নামকরণ হয় ‘সতী’ এবং মন্দিরটি সতী মায়ের মন্দির নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করে।
এই সম্প্রদায় মূর্তিপূজা, ও সমস্তরকম আনুষ্ঠানিক যাগযজ্ঞের বিরোধী। এখানে ‘কর্তা’ অর্থে ঈশ্বর। আউলচাঁদ ঈশ্বরকে ‘কর্তা’ নামে অভিহিত করতেন। সেই থেকে তাঁর সম্প্রদায় কর্তাভজা সম্প্রদায় নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করে। এই সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান দুই ধর্মেরই মানুষ শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। হিন্দুর গুরু মুসলমান আবার মুসলমানের গুরু হিন্দু তাও দেখা যায়। কোন রকম ধর্মীয়, জাতি এমন কি নারী-পুরুষের ভেদাভেদও ছিল না এই ধর্মীয় সম্প্রদায়টির মধ্যে।
আল্লা আলজিহবায় থাকেন
কৃষ্ণ থাকেন টাগরাতে।
আল্লা আর কৃষ্ণ নিয়ে আলাদা করে কোন মাথাব্যথা তাদের ছিল না। আঠারো শতকে এবং উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যথেষ্ট প্রভাবশালী থাকলেও বিশ শতকের শুরুতে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মের সংষ্কার আন্দোলনের ফলে এই ধর্মীয় সম্প্রদায়টি দুর্বল হয়ে পড়ে ও নানাভাগে বিভক্ত হয়। প্রসঙ্গত, একথা ঐতিহাসিক ভাবে সত্য যে, আউলচাঁদের নেতৃত্বে কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে, কৃষক, মুচি, হিন্দু, মুসলমান অর্থাৎ সমাজের উচ্চ থেকে নিম্নবর্গ—অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ –সকলেই এই সম্প্রদায়ের অধীনে শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। যেহেতু কর্তাভজা সম্প্রদায় সকল প্রকার মূর্তিপূজা ও যাগযজ্ঞের বিরোধী ছিল, স্বাভাবিক অর্থেই এটি ছিল মহামিলনের স্থান। হয়ত সেকারণেই কর্তাভজা সম্প্রদায়টি জনসাধারণের মধ্যে যথেষ্ট সম্প্রসার লাভ করেছিল এবং গ্রহণযোগ্যও হয়েছিল।
.
কর্তাভজা সম্প্রদায়ের ইতিহাস থেকে জানা যাচ্ছে যে, গৌণধর্মটির স্ফুরণের কিছু পরে হিন্দু- মুসলমান ধর্ম আন্দোলনের প্রভাবে কর্তাভজা ধর্মটি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দলের মধ্যে নানান মতবিরোধ দেখা যায়। মনে করা যায়, আনুমানিক উনিশ শতকের শেষভাগে রামবল্লভ নন্দন নামে এক ব্যক্তি যিনি নিজেও কর্তাভজা সম্প্রদায়ের একজন প্রধান ছিলেন তাঁর নেতৃত্বে সম্প্রদায়ের একটি শাখা হুগলীর বাঁশবেড়িয়া অঞ্চলে আবার নতুন করে ধর্মীয় সম্প্রদায়টির স্থাপনা করেন। বস্তুতঃ, রামবল্লভী সম্প্রদায়টিকে কর্তাভজা দলেরই একটি উপদল বলা যায়। কর্তাভজা দলের একাধিপত্য এই সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ মেনে নিতে পারেননি, ফলস্বরূপ তাঁরা একটি নতুন দল তৈরি করেন, যেটির মূলে ছিলেন রামবল্লভ নন্দন। এছাড়া হুগলীর শ্রীনাথ মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণকিঙ্কর ও মতিলাল নামে তিনজন ব্যক্তির নামও জানা যায়, যাঁরা ছিলেন রামবল্লভী সম্প্রদায়ের মূল হোতা। হুগলীর এক মতিলাল রায়ের কথা জানা যায়, যিনি ছিলেন বিখ্যাত ব্যক্তি। তাঁর জন্ম, চন্দননগর, বোড়াইচন্ডীতলায়। একমাত্র কন্যার মৃত্যুতে সংসারের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে মতিলাল রায় সস্ত্রীক বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন। পরে তিনি প্রবর্তক সংঘের প্রতিষ্ঠা করেন। যদিও পরবর্তীকালে এই মতিলালের সঙ্গে স্বদেশীদের যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল, ওঁর বাসভবন থেকে স্বদেশীদের নানাভাবে সাহায্য করা হত বলেই জানা যায়। হুগলীর এই মতিলাল রায় ও বাঁশবেড়িয়ার রামবল্লভী সম্প্রদায়ের উল্লেখিত মতিলাল রায় এক ব্যক্তি কিনা সেটি ঠিক জানা যায়নি।
শোনা যায়, বর্তমান বাঁশবেড়িয়া পাবলিক লাইব্রেরীর কাছে গঙ্গার তীরে রামবল্লভী সম্প্রদায় একটি আখড়া নির্মাণ করেছিলেন। যদিও সেসব আজ গঙ্গার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়াও জানা যায় যে, কাঁচড়াপাড়ার কাছে পাঁচঘরা গ্রামেও রামবল্লভীদের একটি আখড়া ছিল। এবং আখড়া বা বেদী প্রতিষ্ঠার সময় জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রায় পাঁচহাজার মানুষের একসাথে অন্নসেবা করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে ব্রাহ্মণদের গীতা পাঠ, খ্রীষ্টানদের বাইবেল ও মুসলিমদের কোরাণ গ্রন্থ একসাথে পঠিত হয়েছিল। এমন একটী জাতি-ধর্ম বিরোধী ধর্ম যে জনপ্রিয়তা লাভ করবে এবং করেছিল সেকথা বলাই বাহুল্য।
রামবল্লভী সম্প্রদায়ের একটি গান ছিল --
কালী গাড (গড) খোদা, কোন নামে নাহি বাধা।
বাদীর বিবাদ দ্বিধা তাতে নাহি টলো রে।
মন কালীকৃষ্ণ গাড খোদা বল রে।।
আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশের এই নিভৃত পল্লিতে আজ থেকে প্রায় দুশো বছরেরও অধিক আগে এইধরনের একটি সর্বধর্ম সম্প্রদায় গড়ে তোলা কম কৃতিত্ব নয়। পরবর্তীকালে ‘হুগলীর ইতিহাস’ থেকে জানা গেছে, বাঁশবেড়িয়া বা বংশবাটিতে রামবল্লভী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা সম্বন্ধে ১৬ই ফাল্গুন, ১২৩৭ সালের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকায় তার একটি বিবরণ প্রকাশিত হয়। সেখানে উপরোক্ত যে তিনজন বাবুর কথা বলা হয়েছে যাঁদের দ্বারা সেদিন ‘রামবল্লভী’ নামে যে সম্প্রদায়টির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তাঁরা হলেন বংশবাটির মথুরানাথ মুখোপাধ্যায়ের পুত্র শ্রীনাথ মুখোপাধ্যায়, রামলোচন গুণাকরের পুত্র কৃষ্ণকিঙ্কর গুণাকর এবং নবকিশোর বাবুর পুত্র মতিলাল বাবু। মতিলাল সম্বন্ধে আগেই বলা হয়েছে। তার বেশি কিছু আজ আর জানা যায় না। এই সম্প্রদায়ের প্রার্থনা ছিল---
‘হে পরমেশ্বর, তোমার দাসের এই প্রার্থনা যে তোমার আজ্ঞা পালনে সকলে যেন সক্ষম হয়; ইহাতে আপনার যেমন ইচ্ছা তাহাই হউক।‘
কর্তাভজা ধর্মটির নিম্নবর্গ ও অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা তো ছিলই, ফলে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে যে মৎসজীবিরা বাস করতেন ও জীবিকা নির্বাহ করতেন তার একটি বড় অংশ এবং রামবল্লভের নিজস্ব সম্প্রদায় সুবর্ণবণিক সমাজ (অর্থাৎ কাঁসারি সমাজ) এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়ে রইলেন। তাঁর নেতৃত্বেই শাখাটি পরে উৎকর্ষতা বৃদ্ধি ও বিকাশ লাভ করে।
পরে রামবল্লভের নামানুসারেই সম্প্রদায়টির নাম হয় রামবল্লভী সম্প্রদায়। যদিও পরবর্তীকালে রামবল্লভী সম্প্রদায়ে উপযুক্ত নেতার অভাবে সম্প্রদায়টি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। কৃষ্ণকিঙ্করের পৌত্র গোপীরমণ গুণাকরই ছিলেন এই সম্প্রদায়ের শেষ সভ্য।
একথা অনস্বসীকার্য যে চৈতন্য পরবর্তী বাংলায় ইসলামধর্মের বেগ সামালানোর জন্য এসব উপধর্মের প্রয়োজন এবং অনেকাংশে তা প্রতিরোধের সহায়ক হয়েছিল। ইসলাম ধর্মগ্রহণের আবেগ ও বাধ্যতা অনেকাংশেই মানুষ এই গৌধর্মগুলিতে আকৃষ্ট হওয়ার জন্য কমে যায়। তাই এইসব গৌণধর্মগুলি চৈতন্য পরবর্তীকালে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
.
গৌণধর্মগুলির প্রকাশ, প্রচার ও ভজনার একটি বড় মাধ্যম হল সঙ্গীত। আগেই বলেছি, যেহেতু গৌণধর্মগুলির কোন কোনটির জন্ম একই ধর্ম থেকে কিংবা একই ধর্মের উপদল অথবা একটি বিশেষ স্থানে বিশেষ কোন ব্যক্তির দ্বারা অনুরূপ একটি ধর্মের উদ্ভব এবং গৌণধর্মগুলির প্রায় সকলের মূল লক্ষ্য ছিল মানব ভজনা, তাই তাদের ভাবের আদানপ্রদানও অনেকাংশে এক -- যা হল সঙ্গীত। রামবল্লভী সম্প্রদায়ের সঙ্গীত হিসাবে কিছু গান পাওয়া গেছে, যা আদতে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতার দ্বারা রচিত এবং রামবল্লভী সম্প্রদায় যেহেতু এই ধর্মেরই একটি উপদল, সুতরাং এই গান তাদের পক্ষেও গাওয়া স্বাভাবিক।
মানুষ চিন, মানুষ ভজ, মানুষ কর সার
সকলি মানুষের খেলা, মানুষ বিনে নাই আর।
মানব ভজনার এটি একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মানবসেবার প্রসঙ্গটি এখানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
কর্তাভজা সম্প্রদায়ের আরো একটি শাখা হল সাহেবধনী সম্প্রদায়। রামশরণ পালের উত্তরপুরুষদের আধিপত্যের জন্য দলের মধ্যে বিবাদ উপস্থিত হয় এবং ফলে ভাগাভাগি। পরে তা মিটে গেলেও, ভক্তরা মীমাংসা মেনে নেননি। ফলে একদল সম্প্রদায়ের আদি পদকর্তাদের গানগুলিই মাধ্যম হিসাবে মেনে নেন, অপর দল সহজিয়াদের সংকীর্তনে মন দেন। পরবর্তীকালে সাধনা নিভৃতে চলতে থাকে এবং প্রায় সকলেই মূল স্রোতে মিশে যান। মানুষ ভজনাই সকল গৌণধর্মগুলির মূল লক্ষ্য হওয়ার জন্য পদকর্তাদের সাধনসঙ্গীতগুলি সকলের ক্ষেত্রেই গৃহীত হয়। আবার গৌণধর্মগুলির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী হিন্দু-মুসলমান এই দুয়েরও কোন পার্থক্য ছিল না। তাই যখন শোনা যায় এই গান--
এই ব্রজধামের কর্তা যিনি
সেই ধনী এইসাহেবধনী
রাই এই সাহেবধনী।
তখন খুব বিস্ময়বোধ হয় না। কারণ ব্রজধামের কৃষ্ণ এবং রাই উভয়ই পুজিত হতেন সম্প্রদায়ের মুসলমান ভক্তদের দ্বারাও।
কত দেবতা গ’নে, সাধন করে মানব রূপ করিয়ে ধারণ
এই ভবে এসে মানুষ বেশে মানুষের করতেছে সাধন
ধন্য কলি মানুষ ধন্য
কলিতে মানুষ অবতার, পাইয়া মানবদেহ এ মানুষ চিনিলি নাকো
ভেবে দেখ মানুষ বিনে গতি নাইকো আর।
---বাঁকাচাঁদ

আরো একটি পদ--
যে ভাবেতে রাখেন গোঁসাই
সেই ভাবেতেই থাকি
অধিক আর বলব কি?
তুমি খাও তুমি খিলাও
তুমি দাও তুমি বিলাও
তোমার ভাবভঙ্গি বোঝা ঠকঠকি!
গানগুলির অর্থ পরিস্কার, বুঝে নিতে কোন অসুবিধা হয় না। লালশশীর একটি পদ আছে এইরকম---
যদি জানতে পারো কোথায় সহজ মানুষ হয়ে
হুঁশ ধরবি আপন জোরে, জীবিত কি আছে
জ্যান্তে মরে, লোকে সেই মানুষকে খুঁজে বেড়ায় যুগে যুগেতে
গুপ্ত ছিল প্রকাশ হল কলির সন্ধেতে
দেখলাম এই মানুষেতে মানুষ মিশিয়াছে
বৃন্দাবনে বাকি ছিল সাহেবধনীতে পূর্ণ হলো
জীবের দশা মলিন দেখে মা ঠাকুর প্রেমের বস্তা খুলেছে... ইত্যাদি।
একথা সত্যি, লোকমুখে শুনে শুনে গানগুলি হয়ত অনেকাংশেই আজ পরিবর্তিত। সকলের কাছে গানের কোন লিপিবদ্ধ খাতা বা তথ্য নেই। কিন্তু তবুও এই গানগুলিই সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে সাধনা ও উদ্দীপনার আশ্রয়।
বাংলার সামাজিক ইতিহাসে এই সকল গৌণধর্মগুলির সমাজের তথাকথিত ব্রাত্যজনগোষ্ঠীকে একত্রিত করা এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঠাঁই দেওয়ার জন্য চৈতন্য পরবর্তী যুগে এক প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বাংলার গৌণধর্মগুলির এখানেই সার্থকতা।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in



প্রবন্ধগুচ্ছ 
অনিন্দিতা মণ্ডল 



ভূমিকা

প্রবন্ধ বা নিবন্ধ বলতে যে অর্থে একজন মানুষের প্রজ্ঞা ও বোধির বিস্তৃত পরিসর থেকে উত্তীর্ণ ভাষাস্রোতকে আমরা বুঝে থাকি, বলতে দ্বিধা নেই যে বর্তমান গদ্যকার তার থেকে শত যোজন দূরে। চর্চা অবিরত চলছে প্রজ্ঞাবান মানুষের চিন্তার প্রকাশকে যাতে ধারণা করতে পারা যায়।

এই চর্চা থেকেই কখনও কখনও কিছু গদ্যের জন্ম হয়েছে। প্রায় সবই প্রকাশিত। সম্পাদকের অকারণ বিশ্বাস থেকে একরকম আত্মনির্ভরতা এই গদ্যগুলির কারণ।

ঋতবাক সম্পাদক অশেষ ভালোবাসা দিয়েছেন। তাঁর মনে হয়েছে এগুলি মুদ্রিত থাকা দরকার। অন্তত লেখকের অপরিণামদর্শিতার একটি দলিল তো রইল! তবে বিভিন্ন লেখায় ছড়িয়ে থাকা মহাজনের উক্তি ও চিন্তা হয়ত পাঠককে মূল চিন্তায় প্রবেশ করতে উদবুদ্ধ করবে, এই আশায় সম্পাদকের হাতে পাণ্ডুলিপিটি দিলাম। মোট বারোটি প্রবন্ধ রইল।

অবশেষে, সম্পদে বিপদে যাঁদের স্মরণ করেছি চিরকাল তাঁদেরকেই স্মরণ করি।

মা ও মামনকে, যারা মুদ্রিত আকারে লেখা দেখতে পেল না।


সূচীপত্র

কথামৃত ও কমল কুমার, এবং বৈজু চাঁড়াল ও যশোবতী—একটি কাল্পনিক সংলাপ
দেহপিঞ্জরে বন্দী শুক, কমলকুমারের আত্মানুসন্ধান
শূন্যরূপা
গার্গী যাজ্ঞবল্ক্য ও মৈত্রেয়ী সংবাদঃ সত্যের সংঘাত
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসঃ পটভূমি, প্রভাব ও মর্ম
রঙ যেন মোর মর্মে লাগে
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস ও ঈশ্বরত্ব
চেতনরূপিণী
আলো অন্ধকারে যাই
রুদ্র যত্তে দক্ষিণ মুখম
মৈত্রীর মূর্তপ্রতীক বুদ্ধ
ঋতু মধুমতী


কথামৃত ও কমল কুমার, এবং বৈজু চাঁড়াল ও যশোবতী—একটি কাল্পনিক সংলাপ


সদ্য প্রলয়োত্থিত ব্রহ্মাণ্ড যেমত, পুণ্যসলিলা হইতে উদ্ভূত একটি মুহূর্ত, এক্ষণে ক্ষিতি অদৃশ্য হইতে দৃশ্য হইবে। ব্রহ্মাণ্ড ব্যাক্ত হইয়া পুনর্বার প্রলয়বিস্মৃত হইবে। কেননা উহাই জীবনের স্বভাব। প্রলয় ভুলিয়া যায়। জন্ম স্মৃতিতে ধরে। স্থিতি বলিয়া যে কিছুই নাই, মুহূর্তের প্রতি পল মৃত্যু যে নির্দিষ্ট, এমত ভুলিয়া থাকে। একটি বিভ্রম মাত্র স্মৃতিতে রাখিয়া পুনর্বার কপালে করাঘাতজনিত সুখের সন্ধানে পতিতপাবনীর তীরে আসিবে। প্রত্যহ ঘটিয়া থাকে যাহা দেখিয়া পুনরায় ক্রন্দনের সুখ অনুভব করিবে। হায় কি হলো! কোথায় গেলো গো!

একটি বিরল মুহূর্ত আসিয়া সহসা দিক পরিবর্তন করে। হাহাকারের মধ্যে যে স্তনছিন্ন শিশুর আর্তি থাকে তাহা যেন আদিমাতার ক্রোড় হইতে টানিয়া আনিল এই মুহূর্তটিকে। এ পৃথিবীর ঘড়ির নিয়ম তাহার নীতি হইলনা।

ধীর পদসন্চারে একটি পূতজন্ম ঘটিল। কিছুকাল পূর্বের সেই অভ্যাসজনিত অসহায়তা এবং হৃতজীবনের অনুরাগজনিত দুঃখ ও ক্ষোভ এক্ষণে প্রশমিত হইল। মহামানব যেন সমাধির পরে ব্যূত্থিত হইয়াছেন।

ভেড়ী পথের সুউচ্চ আল হইতে তিনি দৃষ্টি সম্মুখে প্রসারিত করিয়াছেন। সম্মুখে কুলপ্লাবিনী, পাপনিবারিনী গঙ্গা। একটি দগ্ধচিতার উপরে জলের উচ্ছ্বসিত আবেগ ধূম্রজালের সৃষ্টি করিয়াছে। তিনি দক্ষিণেশ্বরে ঐভাবে অপর পাড়ের শ্মশানের গন্ধ নাসিকায় টানিতেন। ভারী মিষ্ট লাগিত। সে কি পিশাচ সাধনার সময় ? এই দেহের পরিণতি যে কি অপূর্ব উপায়ে জগন্মাতা স্থির করিয়া থাকেন তাহা জানিলে মৃত্যু একটি মহৎ উপলব্ধি মাত্র মনে হইবে। দূরে একটি চাঁদোয়া ভাসিতেছে। ঢেউয়ের উপর নৃত্য করিতে করিতে অগ্রসর হইতেছে। তাঁর অধর তির্যক হাস্যে বঙ্কিম। বামুন বেশ গঙ্গা লাভ করেছে। দোসর চাই। শালা! সীতারামের জন্য তাঁহার অনুকম্পা জাগিল। সচরাচর যে অবস্থায় বৈরাগ্য কেন, মানুষ নিজশরীরের প্রতি নির্লিপ্ত হইয়া পড়ে, এ উন্মাদ সেই অবস্থায় দোসর কামনা করিয়াছে। তিনি বিরক্তিতে অধর কুঞ্চিত করিলেন। বলিলেন – মা, একী! মরতে বসেছে তাও দেহবুদ্ধি যায়না ? শুধু তাহাই নহে, এ উন্মাদ স্মশানে পরিণীত বধূর প্রতি নিজ অধিকার বলবৎ করিতে চাহিয়াছে। তাহার স্বর্গযাত্রার তরণীটি যেন একটি নবীনসুন্দর দেহতরণী, যশোবতী। দৃষ্টি আরো প্রসারিত হইল। এবার দেখিলেন একটি কাঠামো। দেবী বিসর্জন হইয়াছে। এ পোড়া দেশে দেবী আরাধনা বিসর্জনের পরিণতিই পাইয়া থাকে। যশোবতী এই কাঠামোটিকে অবলম্বন করিয়াই ভাসিতে ও বাঁচিতে চাহিয়া ছিলেন। বুঝেন নাই, সেই এক, যাহার হস্তপদ নাই, ইন্দ্রিয় নাই, অথচ যিনি নিয়ন্তা, তিনিই একালে যশোবতী নাম্নী প্রকৃতিকে অব্যক্তে লইয়াছেন। তিনি বিচলিত হইলেন না। উপরন্তু, প্রাণী মাত্রই এককালে মহাপ্রাণে মিলিবে। পঞ্চভূতাত্মক সৃষ্টি পঞ্চভূতেই মিলিবে। ইহাতে সন্দেহ নাই। গতরাত্রের রক্তিম চন্দ্রালোক মনে পড়িল। এমন ক্ষণ দুর্লভ। তিনি ভাবিতেছেন। এই স্থান অতি পবিত্র। শিব শব হইয়া পড়িয়া আছেন। শিবানী তাঁহাকে মুক্তি দিতেছেন। তিনি স্বগতোক্তি করিলেন। আহা, মা কোম্পানী। বাপের ক্ষমতা কি ? মা সগুণ। ত্রিগুণময়ী। বাপ নির্গুণ। তাই শব। মা অন্নপূর্ণা হয়ে মুক্তি দিতেছেন। তাঁর ভাঁড়ারে গুণত্রয় অফুরান ঐশ্বর্য লইয়া উপস্থিত। তবে ক্ষুদ্র প্রাণী মায়ের গুণগুলি গুলাইয়া ফ্যালে। তমোকে সত্ত্ব প্রতীতি হয়। সত্ত্বকে তমো। তাঁহার অধর প্রসারিত হইল। যেমত বৈজুনাথ। এসময় আলের উপর দ্বিতীয় উপস্থিতি অনুভব করিলেন। যদু মল্লিকের বাগানে পূর্বে তিনি বহু অশরীরী দেখিয়াছেন। মায়ের কৃপায় উদ্ধার হইয়াছে তারা। কিন্তু এ উপস্থিতি অশরীরী নহে। একটি জড়িত কণ্ঠস্বর শুনিলেন। ঠাকুর, মদ খাওয়া খারাপ নয়। মদ সৎ করেছে আমায়। তিনি দেখিলেন অদূরে উল্টানো নৌকার ন্যায় একটি খড় ও বাঁশের আড়া ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। সেই আড়ার পাশে কর্দমাক্ত বৈজু গড়াগড়ি যাইতেছে। তাহার শয়নাধার ভূমিটি অশ্রুতে নাকি গঙ্গার উচ্ছ্বাসে কাদা হইয়াছে তাহা সুস্পষ্ট ভাবে অনির্ণেয়। সুতরাং তিনি নির্লিপ্ত। এই স্থানটি তাঁর অতি প্রিয়। মা এভাবেই সব বন্ধন মোচন করেন।


পর্ব ২
আলো ক্রমে আসিতেছে। তিনি দেখিতেছেন নীল হিমাভ নভোমণ্ডল মুক্তাফলের ন্যায় মনোরম। শান্ত। মৃত্যুর অব্যবহিত পরে দেহমন অধিকার করিয়া রাখে যে বোধ, তাহা শোক বলিয়া জ্ঞাত বটে তবে শুচী শব্দের সহিত তাহা ওতপ্রোত। এক্ষণে শোকস্তব্ধ নির্জনতা অদ্ভুত শান্তভাব ধরিয়াছে। জাহ্নবী এক্ষণে স্থির ও ধীরগতিসম্পন্না। দেখিলে কেহ বলিবেনা যে মাত্র কয়েক প্রহর পূর্বে উহার প্রলয়নৃত্য ভাসাইয়া নিয়াছে এই শ্মশান। কিছুকাল পূর্বের সেই রক্তিম উচ্ছ্বাস আর নাই। ওই একটি শুভ্র পাতের উপর একটি পুষ্পাভ রশ্মি আসিয়া পড়িতেছে।মৃত্যুর পরেই জন্ম যেন অবশ্যম্ভাবী। একটি ঝর্ণা কলমের ডগা হইতে অবিরাম শব্দস্রোত আসিয়া তাহাকে মসীলিপ্ত করিল। তিনি উচ্চভূমিতে আরোহণ করিলেন। পদ্মে পদ্মে তাঁহার চেতনময়ী উত্থিত হইলেন। তিনি সেই ভগবতীর পদসঞ্চার শুনিলেন। কারণ শব্দই ব্রহ্ম। বাক, এই শব্দে আরাধ্য দেবী ব্রহ্মাণী। তিনি বলিলেন, কমল, আলো এসেছে। ওই একটা আলো আসছে। কিন্তু কোথা হতে আসছে বুঝতে পারছিনা। কমল, যিনি এক্ষণে শব্দের নির্ভুল শরীর খুঁজিয়া খুঁজিয়া কিছু আত্মস্থ। এই আহ্বানে আমূল কাঁপিয়া উঠিলেন। তিনি শুভ্র পাত খুঁজিয়া পত্রের অবতারণা করিলেন। " এই গ্রন্থের ভাববিগ্রহ রামকৃষ্ণের, ইহার কাব্যবিগ্রহ রামপ্রসাদের। " তাঁহার দক্ষিণ হস্তটি উর্ধে উৎক্ষিপ্ত হইল। আপনার অগোচরে তিনি গগনবিহারী হইলেন। চিদাকাশ এক্ষণে জগৎব্যপ্ত হইল। শরীর ভুলিলেন। দেহবোধ নাই। তাঁহার পরনের ধুতিটি খসিয়া পড়িল। নগ্ন দেহে গঙ্গার সম্মুখে তিনি দাঁড়াইলেন। মা মা, এই আর্তস্বরে ব্রহ্মাণ্ড টলিয়া উঠিল। এমত স্বর অব্যক্ত হইতে ব্যক্ত হয়, সচরাচর সেই মুহূর্ত দৃষ্ট হয়না। তিনি পুনরায় বলিলেন, মা মা তুই আমাকে এখানে আনলি কেন ? আমি কি এদের খাঁচার মধ্যে থেকে উদ্ধার করতে পারব ? জড়িত স্বরে বৈজু বলিল, ঠাকুর, খাঁচা কও ক্যানে ? খাঁচাটার মধ্যে যে প্রাণী ধুকপুক করে তাকে যে বড্ড মায়া হয়। আমি মাটি বড় ভালোবাসি ঠাকুর। আকাশ ভালোবাসি না। স্বগ্গ দেখি নাই। তিনি দৃষ্টি বৈজুতে স্থাপন করিলেন। প্রবৃত্তি আর নিবৃত্তি, দুটি আছে। এ ভৈরব দুটিতে টাল খায়। ধীরে ধীরে হস্ত দ্বারা কপাল স্পর্শ করিলেন। বৈজু স্পর্শে উঠিয়া বসিল। মদের নেশা বিলুপ্ত। তিনি চাহিয়া হাসিলেন। কহিলেন, মদ খেয়েছিস ? তা বেশ তা বেশ। মদ মানে আমি রে! মন মদমত্ত করী। মদ খেলে তোর আমি থাকবেনা। বৈজুর অবিশ্বাস হয়না। সে চাহিয়া থাকে। তিনি স্নেহপ্রশ্রয়ে বলিতে থাকেন। তবে তোর একটি ভাগবতী তনু হয়েছে বাবা। বৈজু অনুভব করে। সে শরীরটি যে কি, তাহা কেহ বুঝিবেনা। তাহারও সাধ্য নাই বুঝায়। যদি বুঝিতেই পারিত তবে যশোবতী ভুল বুঝিতনা। পান্না ভৈরবীর নগ্ন শরীরে যেমত লিঙ্গচিহ্ন ছিলোনা, একটি শুভ্র উপবীত দেহকে ঘিরিয়া রাখিয়া ছিল, সেইমত যশোবতীর নগ্ন দেহে সে উপবীত দেখিয়াছিল। তাহার মনে সঙ্গীত বাজিয়াছিল। "জানো না মন পরম কারণ, শ্যামা কেবল মেয়ে নয়। মেঘের বরণ করিয়া ধারণ মাঝে মাঝে সে পুরুষ হয় "। মহামানব লক্ষ করিলেন। বৈজু প্রকৃতির রূপে মোহগ্রস্ত হইয়াছে। তিনি অপেক্ষা করিলেন। বৈজু পুনরায় বলিল, ঠাকুর, কনে বৌ বড় সুন্দর। এমন সুন্দর দেখি নাই। এ শ্মশানে কতশত সতীদাহ হয়েছে। কতশত জ্যান্ত মানুষকে বাউনেরা সোনার লোভে পুড়িয়েছে, কিন্তু এমন সোনার প্রতিমা আগে দেখি নাই। মহামানব হাসিলেন। এ জগৎ তাঁর মায়া। তাঁর ভুবনমোহিনী মায়া। মায়াতে পড়েছিস বৈজু। বৈজু দুর্বল স্বরে কহিল – উপায় ? মহামানব পুনর্বার হাসিলেন। উপায় তাঁর নাম। যিনি মায়ায় বদ্ধ করেন তিনিই মুক্ত করবেন। এ সংসার তাঁর খেলা। কে বুঝবে ? বৈজুর নেশা কাটে নাই। এ মুহূর্তগুলি তাহার কাছে একপ্রকার অস্পষ্ট ও আচ্ছন্ন লাগিল। যশোবতীকে মনে পড়িলে কষ্ট হইতেছে বটে তবে ইহা মনে করিয়া শান্তি হইতেছে যে চিতা সাজাইতে হয় নাই। অগ্নি তাহাকে গ্রাস করে নাই।


পর্ব ৩
শান্ত প্রকৃতির মধ্যে বৈজু দেখিল মহামানব তাঁহার সম্মুখে বসিয়া। তাঁহার দুইটি অঞ্জলিবদ্ধ কর মৃদু উচ্চারণে থরথর। কি বলিতেছেন ? বৈজুর শ্রবণেন্দ্রিয় যেন বিস্তৃত হইয়া দেহকে অতিক্রম করিল। এ জগতে পূর্বাপর সকল উচ্চার সে শুনিতে পাইল। সেই গভীর গম্ভীর উচ্চারণ হইতে প্রতিভাত হইল সৃষ্টির আদিতে শব্দ হইয়াছিল। এক্ষণে মৃত্যুবৎ নীল অন্তরীক্ষ ভেদ করিয়া যে রক্তিম পুষ্পাভ আলোটি আসিয়া ঊষার আগমনবার্তা ঘোষণা করিতেছিল তাহারই খানিক মহামানবের মুখে পড়িয়া ছিল। তিনি কহিলেন – বৈজু, তুই কে ? বৈজু বলিল, ঠাকুর আমি চাঁড়াল। বামুন ত ছাড়, কোনও উঁচু জাত আমার ছায়া মাড়ায় না। কোথা থাকি আর ? এই শ্মশানই ভালো। মরা পোড়াতে বেশ লাগে আমার। ইহার পরই নিম্নকণ্ঠে বলিল – কিন্তু জ্যান্ত মানুষ পোড়াতে কি কষ্ট ঠাকুর! বৈজুর মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত হইল। মহামানব গভীর দৃষ্টিতে চাহিলেন। বলিলেন – এমন প্রলয় কালে মা তাঁর সৃষ্টির বীজসকল কুড়িয়ে রাখেন। ঠিক যেমন গিন্নিদের একটি ন্যাতা কাঁতার হাঁড়ি থাকে। তাইতে শশাবীচি নীলবড়ি তোলা থাকে। তারপর আবার সৃষ্টির সময় মা সব বের করেন। এই কথায় বৈজুর দিব্য দর্শন হইল। সে দেখিতে পাইল, অকস্মাৎ ভূ ভূব স্ব ব্যাপিয়া একটি বিশাল জরায়ু যেন। জরায়ুস্থিত এক নবীন বিশ্বপ্রাণ ক্রন্দন জুড়িয়াছে। আকুল ক্রন্দনে মাতৃজঠরের হিমনীল তরল ছিন্ন করিয়া ফুটিতে চায়। নাড়ি ছিঁড়িয়া ভূমিষ্ঠ হইবার কালে রক্তের স্রোত ভুবন ভাসাইল। সেই স্রোত পুষ্পাভ বর্ণে গগন রাঙ্গাইলো। ধরায় নামিয়া পতিতপাবনী হইল। সে বিষ্ময়ে হতবাক হইল। এ কী! ঠাকুর হাসিলেন। বলিলেন – বাবা, ওই একই ভাবে আমরাও জন্মেছি। বৈজু প্রবল বেগে মাথা নাড়িলো। না না ঠাকুর, যশোবতী নিষ্পাপ। ফুল ফুটে নাই ভাবিয়া ঠাকুর পুনরায় হাসিলেন। আশ্বাসহস্তটি না সরাইয়া কহিলেন, বাবু মেয়েমানুষে টানে কেন গা ? বৈজু এক্ষণে স্থির। বাতাহত। ঠাকুর তাহার মনের পাতাল সন্ধান পাইয়াছেন। আকাশ নহে। পাইলে জানিতেন। বৈজু তাহাকে নরকরোটি পাদস্পর্শে পূত করিতে অনুরোধ করিয়া ছিল। সে নাকি সতী হইবে, সুতরাং দেবী। দেবীর পাদস্পর্শে করোটিতে মাংস মজ্জা ত্বক জন্মিবে। সে মূর্তি সিঁদুর পরিবে। ছেলে কোলে করিবে। বৈজু শ্মশানবাসী হইয়াও সংসারী হইবে। গৃহে তাহার স্ত্রী সন্তান থাকিবে। কিন্তু যশোবতী ভয় পাইয়াছে। আপনাকে বিশ্বাস করে নাই। নিজের দেবীত্বে তাহার নির্ভরতা ছিলোনা। করোটি দেখিয়া ভীত হইয়াছে। বৈজূকে কামনা করিয়াছে। প্রাণসংশয়কালে বৈজূকে আশ্রয় মানিয়াছে। অথচ নিকটবর্তী হইলে চণ্ডাল বলিয়া ঘৃণা করিয়াছে। যদিও বৈজু এ শ্মশানে নিত্য কতশত শাস্ত্র শুনিয়াছে। তাহার মার্গ দর্শন হইয়াছে। নিজ অন্তরে সে আত্মদর্শন করিয়াছে। আজ মহামানবের নিকট বৈজু কহিল – কনে বৌ হলে আমি আয়ান হবো, ওই সীতারাম কেলে ছোঁড়া হয়ে লীলে করবে গো ঠাকুর। কনে বৌ তাই পাথ্থনা করেছে। তাঁহার অধর প্রসারিত হইল। পুনর্বার এক অলৌকিক অপার্থিব আলোক দেখিতে পাইলেন। সমাহিতমূর্তি অস্ফুটে কহিলেন – বৈজু তুই চণ্ডাল নোস। তুই নেতি নেতি শুদ্ধাত্মা। এ শ্মশান তোর ঘর। তোর বাসনায় আগুন। তুই সনাতনী জননীর ভিতরের থাম। এক্ষণে আলো আসিয়া আছাড় খাইল। কমল কুমার কলম বন্ধ করিলেন। মনে গীত উঠিতেছে। তাহা শুনিবেন। সে অনাহত গীত তাঁহাকে সাজুয্য দিতেছে। তিনি আলোকে জড়াইয়া ধরিলেন।

[মাতৃশক্তি কল্পতরু সংখ্যা ২০১৯]

চলবে

0 comments:

0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in



হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট, নন্টে ফন্টের অমর স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথকে প্রণতি
মনোজিৎকুমার দাস

শিশু-কিশোর ও বড়দের অতি প্রিয় শিল্পী ১৮ জানুয়ারি ২০২২ প্রয়াত হয়েছেন। তার আকস্মিক মৃত্যুতে সবাই শোকাহত।
নারায়ণ দেবনাথ (২৫ নভেম্বর ১৯২৫ ― ১৮ জানুয়ারি ২০২২। একজন বিখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কমিক্স শিল্পী। তিনি হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট, নন্টে ফন্টে, বাহাদুর বেড়াল, ডানপিটে খাঁদু আর তার কেমিক্যাল দাদু, কৌশিক রায় প্রভৃতি বিখ্যাত কার্টুন চরিত্রের স্রষ্টা। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তার লেখা ও আঁকা কমিকস ছোট-বড় বাঙালিকে মাতিয়ে রেখেছে। কমিক-স্ট্রিপ ছাড়াও তিনি শিশু-কিশোরদের উপন্যাস অলঙ্করণ করেছেন। শুকতারা, কিশোর ভারতী প্রভৃতি কলকাতা ভিত্তিক শিশু-কিশোরদের পত্রিকায় কমিকসগুলোকো ছোট ছোট খণ্ডে প্রকাশ করা হয়েছে। ২০২১ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী পুরস্কারে সম্মানিত করেছেন।
নারায়ণ দেবনাথের জন্ম ২৫ নভেম্বর ১৯২৫
শিবপুর, হাওড়া, বেঙ্গল, ব্রিটিশ ভারত।
প্রেসিডেন্ট বিশেষ স্বীকৃতি পুরস্কার (২০০৭), সাহিত্য অকাদেমী (২০১৩) , বঙ্গবিভূষণ (২০১৩), পদ্মশ্রী পুরস্কার (২০২১)
নারায়ন দেবনাথের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া জেলার শিবপুরে। পারিবারিক আদি বাসস্থান বাংলাদেশের বিক্রমপুর অঞ্চলে হলেও তার জন্মের আগেই পরিবার শিবপুরে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস করা শুরু করে। অল্প বয়স থেকেই শিল্পের প্রতি তার ঝোঁক ছিল। পারিবারিক পেশা স্বর্ণকার হওয়ায় অলঙ্কার প্রভৃতির নক্সা করার সুযোগ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি আর্ট কলেজে পাঁচ বছরের ডিগ্রীর জন্য লেখাপড়া শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত তা চালিয়ে যাননি, শেষ বর্ষে এসে পড়া ছেড়ে দেন। এরপরে কিছু বছর বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থার জন্য কাজ করেন।
নিজের বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে - কলকাতা বইমেলা ২০১৪
বাংলা কমিকসের জগতে নারায়ন দেবনাথের আগমন ঘটে দেব সাহিত্য কুটিরের সম্পাদক মন্ডলীর উৎসাহে। তার প্রথম কমিকস হাঁদা ভোঁদা নামটিও তাদের প্রস্তাবিত। সেসময় বাংলা কমিকস বলতে ছিল একমাত্র প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ি বা কাফি খাঁ'র আঁকা শেয়াল পণ্ডিত, যা তখন যুগান্তরে প্রকাশিত হত। হাঁদা ভোঁদা প্রকাশের সাথে সাথেই পাঠকদের সমাদর পায় এবং শুকতারা থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। শুরুতে দেবনাথ নিজেই হাঁদা ভোঁদায় অঙ্কন ও কালি বসানোর কাজ করতেন। পরবর্তীতে তা গ্রেস্কেলে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা হয়। হাঁদাভোদা ৫৩ সপ্তাহ ধরে শুকতারা পত্রিকায় চলেছিল।


নারায়ণ দেবনাথের প্রথম রঙীন কমিক স্ট্রিপ ছিল বাঁটুল দি গ্রেট। ১৯৬৫ সালে বাঁটুল দি গ্রেটের সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। নারায়ণবাবুর কথায়, কলকাতার কলেজস্ট্রিট থেকে ফেরার পথে তিনি বাঁটুলের কল্পনা করেন ও তৎক্ষণাৎ তার প্রতিকৃতি (figure) এঁকে ফেলেন। যদিও তিনি শুরুতে বাঁটুলকে কোনো অলৌকিক শক্তি (superpower) দেন নি।


পরবর্তীকালে কিশোর ভারতী পত্রিকা দল নারায়ণবাবুর কাছে বিশেষ পুজোসংখ্যার ব্যাপারে এসে পৌঁছয়। তখন সম্পাদক ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। পরে দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদক হিসেবে নারায়নবাবুকে গোয়েন্দা-গল্প (স্ট্রিপের) প্রস্তাব দেন যা পরে পরিণত হয় 'ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায়' চরিত্রে। ১৯৬৯ সালে নন্টে-ফন্টের সৃষ্টি করেন নারায়ণ দেবনাথ। কিশোর ভারতীতে তার আঁকা প্রথম ধারাবাহিক কমিক স্ট্রিপ হলো 'ম্যাজিশিয়ান পটলচাঁদ', যার একটি সংখ্যা বেরোয়। ২০১১ সালে লালমাটি প্রকাশন তার বিরল কাজগুলি পুনরায় প্রকাশ করে নারায়ণ দেবনাথ সমগ্র ১ম ও ২ খন্ড হিসেবে। ২০১২ সালে বাঁটুল প্রথমবার ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়।


নারায়ণ দেবনাথ
বাঁটুল দি গ্রেট (প্রথম প্রকাশ ১৯৬৫)
হাঁদা ভোঁদা (প্রথম প্রকাশ ১৯৬২)
নন্টে ফন্টে (প্রথম প্রকাশ ১৯৬৯)
বাহাদুর বেড়াল (প্রথম প্রকাশ ১৯৮২)
ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায়
ম্যাজিশিয়ান পটলচাঁদ
ডানপিটে খাঁদু আর তার কেমিক্যাল দাদু
গোয়েন্দা কৌশিক র১৯৬৯ সালের ডিসেম্বরে ‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায় ‘নন্টে-ফন্টে’-র আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। ইতিমধ্যেই সবার মন জিতে নেওয়া দুই চরিত্র হাঁদা এবং ভোঁদার আদলেই নন্টে এবং ফন্টেকে গড়ে তুলেছিলেন নারায়ণ দেবনাথ। তিনি ১৯৭২ সালে ‘পরিবর্তন’ নামের একটি বই অলংকরণ করেছিলেন। মনোরঞ্জন ঘোষের লেখা এই বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫০ সালে। সেটির থেকে বাংলা এবং হিন্দি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। বইটি পুনর্মুদ্রণের সময়ে অলংকরণ করতে গিয়ে তিনি সেখানে পান কয়েকটি ছেলের হোস্টেল জীবনের গল্প। এরপর থেকে তাঁর কমিকসেও নন্টে আর ফন্টের হোস্টেলবাস শুরু হয়, এসে যায় সুপারিনটেনডেন্ট স্যার হাতিরাম পাতি, দুষ্টু ছাত্র কেল্টুরাম, রাঁধুনির মতো চরিত্ররা।


‘নন্টে-ফন্টে’ সিরিজের কমিকসে দেখা যায়, নন্টে আর ফন্টে কোনো এক মফস্ব
লের স্কুল হোস্টেলে থাকে। দু’জনে সহপাঠী এবং অভিন্নহৃদয় বন্ধু। কেল্টুরাম এই দু’জনের থেকে বয়সে বড়ো। অন্য ছাত্রদের মতো সে হাফ প্যান্ট পরে না, ফুল প্যান্ট পরিধান করে। অল্পবয়সী ছাত্রদের দিয়ে নিজের কাজকর্ম করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, কখনও ভয় দেখয়, কখনও বা অন্যভাবে কাজ হাসিলের পরিকল্পনা করে। তবে, নন্টে আর ফন্টের কাছে বারবার জব্দ হয়। কেল্টু সব সময়ে বিশালবপু, খাদ্যরসিক সুপারিনটেনডেন্ট স্যারের সুনজরে থাকার চেষ্টা করে, তবে অনেক ক্ষেত্রেই স্যারের প্রহারই তার ভাগ্যে জোটে। কমিকস স্ট্রিপে ল্যাংচা, বোঁচার মতো আরও বেশ কিছু চরিত্রের নাম পাওয়া যায়।


১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে প্রথম বই হয়ে পাঠকের হাতে আসে ‘নন্টে-ফন্টে’-র কমিকস। প্রথম দিকে সাদাকালো কমিকস থাকত, পরে কম্পিউটারের জাদুতে রঙিন কমিকস প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। টেলিভিশনের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি অ্যানিমেটেড ভিডিও সিরিজ। পঞ্চাশ বছরও পেরিয়ে গেলেও, একইভাবে কচিকাঁচাদের মনোরঞ্জন করছে ‘নন্টে-ফন্টে’। শুধু কঁচিকাচা বললে ভুল হবে, বড়োরাও এই কমিকস পড়ে একই রকম মজা পান, উপভোগ করেন। ফেলে আসা শৈশবকে তাঁরা খুঁজে পান এই কমিকসে। এমন এক নির্মল ছাত্রজীবনের গল্প বলা থাকে এই সিরিজে, যেখানে মোবাইল ফোন নেই, কেরিয়ারের জন্য ইঁদুর দৌড় নেই – নন্টে-ফন্টের হোস্টেল যেন এক রূপকথা। তেমন মিষ্টি কৈশোর এখনকার ছেলেমেয়েরা আর পাবে না, ‘নন্টে-ফন্টে’-র কমিকস তাই চিরকালীন হয়ে থাকবে বাঙালির জীবন।
বাঁটুল দ্য গ্রেট বাঙালি কমিকস শিল্পী নারায়ন দেবনাথের সৃষ্ট একটি কাল্পনিক কমিকস চরিত্রইংরেজি কার্টুন চরিত্র ডেসপারেট ড্যান-এর আদলে তৈরি বাঁটুলের কমিকস গত পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে (১৯৬৫ থেকে) প্রকাশিত হয়ে আসছে শুকতারা পত্রিকায়। বাঁটুল দি গ্রেটকে একমাত্র বাঙালি সুপারহীরো (অতিমানব) বলা যায়। নারায়ান দেবনাথ অসাধারণ সৃজনশীলতায় বাটুল দি গ্রেট চরিত্র সৃষ্টি করেছেন।


বাঁটুল দি গ্রেট প্রচন্ড শক্তিশালী এক মানুষ। বাঁটুলের গায়ে গুলি লেগে গুলি ছিটকে যায়। মাথায় বিরাট হাতুড়ি মারলে তার মনে হয় মাথায় একফোঁটা জল পড়ল। কিন্তু তার পোশাক আশাক মোটেও সুপারহীরোর মত নয়। গোলাপী বা কমলা স্যান্ডো গেঞ্জী, কালো হাফপ্যান্ট তার একমাত্র পোশাক। বাঁটুল সবসময়ে খালি পায়েই থাকে। কারণ জুতো পরলেই নাকি ছিঁড়ে যায়। তার আছে দুই স্যাঙাত যাদের নাম বিচ্ছু ও বাচ্ছু, কখনো কখনো তাদের নাম গজা ও ভজা বলেও বর্ণিত হয়েছে। তারা সবসমকে কিভাবে বাঁটুলকে জব্দ করবে, কিন্তু শেষে তারাই জব্দ হয়। বাঁটুলের প্রতিবেশী হলেন বটব্যাল বাবু ও তার চাকর। স্থানীয় পুলিশ আধিকারিকের সঙ্গেও বাঁটুলের বন্ধুত্ব। বাঁটুলের আরেক অনুগত স্যাঙাত আছে যার নাম লম্বকর্ণ। লম্বকর্ণের শ্রবণশক্তি প্রখর। বাঁটুলের পো্ষা কুকুরের নাম ভেদো আর পোষা উটপাখির নাম উটো। মাঝে মাঝেই সমসাময়িক বাস্তব ঘটনায় বাঁটুলকে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। বাঁটুলকে দেখা গেছে অলিম্পিকে ভারতের জন্য সোনার মেডেল জিততে। বাঁটুল বেড়াতে ভালবাসে। একবার মিশর বেড়াতে গিয়ে সে একটি যান্ত্রিক স্ফিংসকে জব্দ করেছিল। বাঁটুল সৎ ও দেশপ্রেমিক।
হাঁদা ভোঁদা , নন্টে ফন্টে, বাটুল দি গ্রেট ইত্যাদি কমিক সিরিজ গুলি জি বাংলা সহ বিভিন্ন টিভি সিরিয়াল হয়ে আসছে যার দর্শকপ্রিয়তা ছোট-বড় সব মানুষের কাছেই মনমুগ্ধকর।


অসাধারণ প্রতিভাধর কার্টুনিস্ট ও কমিক গল্পের স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথের সামান্য কথায় প্রকাশ করা যয় না। তিনি তার অমর সৃষ্টি মাঝে চিরভাস্বর থাকবেন।তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।

0 comments:

0

পথে প্রবাসে - শিবাংশু দে

Posted in

টোটো কোম্পানি
শিবাংশু দে



আমার ভারতবর্ষ- ১০

রত্নগিরি

---------



দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়াই বৌদ্ধ ঐতিহ্যের পদচিহ্ন খুঁজে খুঁজে। ব্যক্তিগত পঠনপাঠন বেড়ে ওঠে, গৃহস্থের লাইব্রেরি উপচে পড়ে। দেশের উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম সব প্রান্তে তো বটেই, বিদেশেও সে খোঁজ ফুরোয় না। গত আড়াই হাজার বছরের আমাদের যে ইতিহাস ওতোপ্রোত বুদ্ধের নামে, সেখান থেকে কী করে তাঁর নাম একেবারে লোপ পেয়ে গেলো চার-পাঁচশো বছর আগে। আবার তিনি ফিরে এলেন ইংরেজের হাত ধরে। ভারতবর্ষ আবার খুঁজে পেলো তার সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম সন্তানকে নতুন করে।

গুপ্তযুগের মধ্যপথে, অর্থাৎ ষষ্ঠ শতকের শুরুতে রাজা নরসিংহ বালাদিত্যের সময় ব্রাহ্মণী আর বিরূপা নদীর ব-দ্বীপে গড়ে ওঠে এক অতি উন্নত বৌদ্ধ মেধার প্রতিষ্ঠান। আজকের যাজপুর, কেন্দ্রাপাড়া,জগৎসিংপুর জুড়ে গড়ে ওঠা পুষ্পগিরি মহাবিহার। যার অংশ ললিতগিরি, উদয়গিরি, রত্নগিরি, পুষ্পগিরি। যার বিপুলত্ব ও মহিমা চ্যালেঞ্জ করতো নালন্দা মহাবিহারকে। মহাযানী বৌদ্ধদর্শন ও তন্ত্রচর্চার প্রধানতম কেন্দ্র হয়ে, বিস্তৃত ভূগোল জুড়ে গড়ে ওঠা এই সব সারস্বত সংস্থান, আমাকে গর্বিত করে ভারতীয় হিসেবে।



আবিষ্কার হয়েছে এই সেদিন, ষাটের দশকে উৎখনন হবার পর। ষষ্ঠ শতকের শুরু থেকে দ্বাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত চলেছিলো তার জয়যাত্রা। ঐতিহাসিক, পণ্ডিত দেবলা মিত্র'র গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য আমাদের অবাক করে দেয়। খননে পাওয়া সিলমোহর থেকে জানা যায় জায়গাটার নাম ছিলো ' শ্রী রত্নগিরি মহাবিহারায় আর্য ভিক্ষু সঙ্ঘস' । ৬৩৯ সালে হিউ এন সাং এসে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন রত্নগিরির আকার, আয়তন, গরিমা দেখে। বারবার লিখে গেছেন পঞ্চমুখ হয়ে। আমরা খোঁজ পেলুম এই অর্ধশতক আগে।
একটি মহাস্তূপ। তার সামনে দু'টি মহাবিহার, আর ছোটোবড়ো অসংখ্য স্তূপ, চৈত্য, নানারকম নির্মাণ। চমকে দেয়। এর বহুবিচিত্র স্থাপত্য, তার সূক্ষ্মতা, বিশালত্ব, সৌন্দর্য, দেশে-বিদেশে অনেক দেখার পরেও আমি দাবি করতে পারি অপরূপ, অনন্য। অসংখ্য বৌদ্ধ দেবদেবী, অবলোকিতেশ্বর, বজ্রপাণি বা পদ্মপাণি, তারা, লোকেশ্বর, অপরাজিতা, হারীতি, হেরুকা, সম্ভর অথবা গজলক্ষ্মী ছড়িয়ে আছে চারদিকে, নানা রকম শাক্যমুনির
মূর্তির সঙ্গে সঙ্গে। বুদ্ধের এই সব মূর্তির সঙ্গে পণ্ডিতেরা সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন বরোবুদুর আর অনুরাধাপুরার ভাস্কর্যের নমুনাগুলির। সত্যি কথা বলতে কি, এই ভাবে শব্দ দিয়ে তাদের ঠিক বর্ণনা করা যায় না। চোখে দেখতে হয়। যাঁরা নিজে পৌঁছোতে পারবেন না বা পারলে এই মূহুর্তে হয়তো সম্ভব নয়, তাঁদের জন্য কিছু ছবি রেখে দিই আমার স্বপ্নের ভারতবর্ষের ইতিহাস থেকে কয়েকটি প্রতিবিম্ব। 


0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in



















১৪


বুড়ি নিজের গাড়িতে রাখা ফলের ঝুড়ির দিকে একবার তাকাল।

তারপর আবার তার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে বলে উঠল … ‘থলি? কী ভাবে দেব?’

গ্রেক মাথা নাড়ল।

বুড়ি মহিলার কণ্ঠস্বর গম্ভীর এবং একটা উষ্ণতা আছে। গ্রেক তাকিয়ে দেখতে থাকে মহিলা তার গাড়ির পাদানিতে দাঁড়িয়ে গোড়ালি উঁচু করে গাড়ির মাথায় ফলের ঝুড়ির দিকে হাত বাড়াল। মহিলার পা দুটো বেশ লম্বা, ভাবতে লাগল গ্রেক। গ্রেকের জিভে জল চলে এল অ্যাপ্রিকটগুলো দেখে। ইসস, মা যদি এরকম অ্যাপ্রিকট পেত! অথচ এখানে বাজারে ফেলে ছড়িয়ে রয়েছে এই ফল। শশাও। গ্রেক গাড়ি থেকে একটা ফল তুলে মুখে দিল। বেশ ডাঁটো অথচ মিঠে। আবার নরম, একটু উষ্ণ।

- ‘দারুণ!’ বলে উঠল সে।

বুড়ি মহিলা আবার তার দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। আলগা কাগজের টুকরো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে একটা ঠোঙার মত বানিয়ে সাবধানে ফলগুলো রাখল সে। বুড়ির চোখের দৃষ্টিটা একটু অদ্ভুত।

-‘আর দেব?’ জিজ্ঞেস করল বুড়ি।

মাথা নাড়ল গ্রেক। বুড়ি কাগজটা সাবধানে পেঁচিয়ে একটা পুলিন্দার মত বানিয়ে তার হাতে দিল।

সে পকেট থেকে বড় অঙ্কের কাগজের নোটটা বের করল। ‘এই যে!’

‘ওহহো হো… নাহ!’ বুড়ির চোখের দৃষ্টি বিস্ফারিত হল। বুড়ি মাথা নাড়তে লাগল। কিন্তু সে নিয়ে নিল নোটটা। এক মুহূর্তের জন্য গ্রেকের কব্জি শক্ত করে ধরে রইল বুড়ি। যদিও কব্জিটা ধরে রাখার সেরকম কোনো প্রয়োজন ছিল না, তবুও। গ্রেকের কব্জিটা ধরে বুড়ি নিজের ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরে রইল একশ’র নোটটা। তারপর নিজের স্কার্টের নিচ থেকে পয়সার থলিটা বের করে সাবধানে।

‘না’… নরম ভাবে বলে গ্রেক। … ‘রেখে দাও, রেখে দাও টাকাটা’… ত্রস্ত চোখে সে তাকায় চারিদিকে। সবাই কি তাকিয়ে আছে তার দিকে?

ব্যস্ত রাস্তা। একটা ট্রাম বেরিয়ে গেল। ‘ছেড়ে দাও’ সে চেঁচিয়ে ওঠে… ‘ছেড়ে দাও’… সে নোটটা আবার নিয়ে নেয়।

বুড়ি ঠোঁট কামড়ে ধরে। সে জানে না বুড়ি মহিলা রেগে যাচ্ছে, নাকি মজা পাচ্ছে।

সে রাগতভঙ্গিতে দ্বিতীয় একটা অ্যাপ্রিকটে কামড় দেয়। অপেক্ষা করে। মোটা মোটা ঘামের ফোঁটা জমতে থাকে তার কপালে। কাগজের ঠোঙায় সামলে ধরতে থাকে ফলগুলি। তার মনে হয় বুড়ি মহিলা ইচ্ছে করে সময় নষ্ট করছে।

দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় তার।

কিন্তু বুড়িটা যদি পাগলের মত চেঁচিয়ে ওঠে। লোক জড়ো হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া হাঙ্গেরি ওদের মিত্রশক্তি। শত্রু নয়। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অপেক্ষা করে। একজন সৈন্য বেরিয়ে আসে সরাইখানাটা থেকে। এ আরেকজন। যে একটু আগে ঢুকেছে, সে নয়। এর বুকে মেডেল ঝোলানো আছে; তিনটে … তার উপরে হাতেও শিল্ড আছে। গ্রেককে অভিবাদন করল এই সৈনিক। গ্রেক মাথা নাড়ল।

আবার একটা ট্রাম চলে গেল। পথের আরেক দিক দিয়ে লোকজন চলাফেরা করছে। অনেক লোকজন যাচ্ছে আসছে। তার পেছনে কাঠের বেড়ার ওপাশে নৌকা নাগরদোলাটা আবার হাল্কা হাল্কা দুলতে শুরু করেছে।

বুড়ি বোধ হয় তার থলেতে যত নোট আছে, সব গুছিয়ে বের করছে। তার পর কয়েনগুলো। গাড়ির বাক্সের সামনে কয়েনের স্তুপ হয়ে গেছে।

বুড়ি তারপর গ্রেকের হাত থেকে নোটটা নেয়। তারপর খুচরো নোটগুলো প্রথমে গুছিয়ে পাটপাট করে ফেরত দেয়। তারপর কয়েনগুলো প্যাকেট করে দেয়।

‘আটানব্বই’… বলে বুড়ি। গ্রেক চলে যাবে, এমন সময় আবার বুড়ি তার কব্জিটা চেপে ধরে। বুড়ির হাতটা বেশ চওড়া, গরম আর শুকনো। মুহূর্তে বুড়ি তার মুখটা গ্রেকের কানের কাছে নিয়ে আসে।

‘মেয়েছেলে?’ ফিসফিস করে ওঠে বুড়ি… ‘লাগবে নাকি? সুন্দরী মেয়েছেলে?’

-‘ন্‌না… সত্যিই না’… গ্রেক ছিটকে সরে যেতে চায়। বুড়ি স্কার্টের তলা থেকে হাতড়ে একটা কাগজের টুকরো বের করে তার হাতে গুঁজে দেয়।

‘আছে’… বুড়ি আবার ফিসফিস করে… ‘সব লেখা আছে।‘

গ্রেক টাকার নোটগুলোর সঙ্গে রেখে দেয় কাগজের টুকরোটা।

বুড়ি ঘোড়ার লাগাম হাতে নিয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দেয়। গ্রেক ফলের পুলিন্দা সামলে রাস্তা পেরিয়ে ফিরে আসে সরাইখানার খাবার ঘরে।

যে টেবিলে ওই প্রেমিকযুগল বসে আছে, সেটা এখনও পরিষ্কার করা হয়নি। গ্রেক এই দেশের লোকজনকে একেবারেই বুঝতে পারে না। প্লেটের উপর, গ্লাসের কিনারাতে ঝাঁক বেঁধে মাছি বসে আছে; তারি মধ্যে তরুণ প্রেমিক তার প্রেমিকার কানে ফিসফিস করে উদ্দাম প্রেমালাপ চালিয়ে যাচ্ছে।

সরাইখানার মালিক গ্রেকের দিকে এগিয়ে এলো। গ্রেক ফলের পুলিন্দাটা টেবিলে রাখল। সরাইখানার মালিক আরেকটু কাছে এগিয়ে আসবার পর গ্রেক বলে উঠল,

‘একটু হাতমুখ ধোবার ব্যবস্থা আছে?’

লোকটা চোখ বড় বড় করে তাকাল। গ্রেক বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে বলে উঠল… ‘হাতমুখ ধোয়া… দুত্তোর… হাত ধোব’… সে নিজের হাত ঘষে ঘষে হাত ধোয়ার ভঙ্গি করে।

লোকটা হঠাৎ বুঝতে পেরে মাথা নাড়ে, ঘুরে দাঁড়িয়ে গ্রেককে পিছনে আসবার জন্য ইশারা করে। গ্রেক লোকটাকে অনুসরণ করে। সামনে একটা সবুজ পর্দা ফেলা। লোকটার চাহনি একটু অন্যরকম ঠেকছে এখন। লোকটা কি কিছু বলতে চায়?

সরু, লম্বা একটা করিডোর পেরিয়ে লোকটা একটা দরজা খুলে দেয়।

-‘আসুন’ লোকটা বলে। জায়গাটার পরিচ্ছন্নতা দেখে গ্রেক অবাক হয়। সিমেন্টের বাঁধানো বেসিন। দরজাগুলো সাদা রঙ করা। বেসিনের পাশে সাদা তোয়ালে রাখা। লোকটা সঙ্গে করে সবুজ একফালি সাবান নিয়ে এসেছে।

-‘আসুন’ লোকটা আবার বলে। গ্রেক ধন্দে পড়ে যায়। লোকটা বেরিয়ে যায়। গ্রেক তোয়ালেটা একবার শুঁকে দেখে। পরিষ্কার মনে হচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি জ্যাকেটটা খুলে ঘাড়ে, গলায়, মুখে জল দেয়, ধুয়ে নেয়। ভালোভাবে পরিষ্কার করে নেয় কনুই অবধি দুই হাত। তারপর জ্যাকেটটা পরে। ধীরে ধীরে একটু সময় নিয়ে হাত ধোয়।

আগের সেই সৈনিকটি ঢোকে। মেডেল ছাড়া সেই লোকটা। গ্রেক একটু সরে যায়, যাতে লোকটা ভেতরে টয়লেটে যেতে পারে। গ্রেক পোশাকের বোতাম আটকে সাবানটা তুলে নিয়ে কাউন্‌টারে ফিরে যায়, সেখানে ফেরত দেয় সাবানটা।

‘ধন্যবাদ!’ বলে সে আবার বসে টেবিলে।

সরাইখানার মালিকের মুখটা কেমন যেন কঠিন দেখায়। গ্রেক অবাক হয়ে ভাবে ওই সৈনিকটা কোথায় ছিল! কোণের ওই প্রেমিকযুগল চলে গেছে। টেবিলটা এখনও অপরিষ্কার। গ্রেক ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া কফিটা শেষ করে। ব্র্যান্ডিতে চুমুক দেয়। তারপর ফলে কামড় বসায়। রসালো, ডাঁটো ফলের জন্য তার ভেতরে একটা পাগলের মত খিদে জেগে উঠেছে। সে পর পর ছটা অ্যাপ্রিকট খেয়ে ফেলে। খাওয়ার পরে তার হঠাৎ বিরক্তি ধরে। ফলগুলো খুব গরম। সে ব্র্যান্ডিতে চুমুক দেয়। ব্র্যান্ডিও গরম।


সরাইখানার মালিক কাউনটারের পেছনে দাঁড়িয়ে ঝিমোয়, ধোঁয়া ছাড়ে। আরেকজন সৈনিক ঢুকে আসে। মনে হয় সরাইখানার মালিকের চেনা। দুজনে গুজগুজ করে। সৈনিকটা বিয়ার পান করে। মেডেল আছে একটা। ওয়ার মেরিট ক্রস। যে সৈনিকটা টয়লেটে ঢুকেছিল, সে এখন বেরিয়ে আসে। কাউনটারে পয়সা মিটিয়ে যাবার সময় দরজায় দাঁড়িয়ে অভিবাদন করে। গ্রেক অভিবাদন ফিরিয়ে দেয়। তারপর শেষে যে সৈনিক এসেছিল, সে বেরিয়ে যায়।

বাইরে নাগরদোলাটা দুলছে। নাগরদোলার ধীর অথচ বন্য গতির ছন্দে গ্রেকের মন বিষণ্ণ হয়ে যায়। সে কোনোদিন ভুলবে না আজ নাগরদোলায় উঠবার স্মৃতি। যদিও সে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল; সেটা অবশ্য একটা বিশ্রী ব্যাপার। সেটা বাদ দিলে ব্যাপারটা স্মরণীয়।

বাইরে যানবাহনের সংখ্যা আর গতিবেগ বেড়ে চলেছে। আরও জীবন্ত হয়ে উঠছে চারপাশ। বাইরে একটা আইসক্রিম পার্লারের সামনে লাইন দিচ্ছে মানুষ। পাশের সিগারেটের দোকানটা খালি ছিল, সেখানেও লোকজন যাতায়াত করছে।

কোণের নোংরা সবুজ পর্দাটা সরে গেল। একটা মেয়ে বেরিয়ে এল। সরাইখানার মালিক সঙ্গে সঙ্গে গ্রেকের দিকে তাকাল। মেয়েটাও তাকাল গ্রেকের দিকে। গ্রেক মেয়েটাকে আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছে চোখের কোণ দিয়ে। মেয়েটা বোধ হয় লাল পোশাক পরেছে। গাঢ়, সবজেটে আলোয় পোশাকটা বর্ণহীন দেখাচ্ছে। গ্রেক শুধু মেয়েটার সাদাটে মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেল; ভারি মেকাপ করা, ঝকঝকে লাল রঙের লিপস্টিকে এঁকে ঠোঁটদুটো আকর্ষণীয় করবার চেষ্টা করেছে।

(চলবে)

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in



















১৮

স্মৃতির শহর - ৪

রান্নার জগতে প্রবেশের ছাড়পত্র পেতে গেলে একটি জরুরি শর্ত আছে। তা হলো বাজার চিনতে হবে, উপকরণ বুঝতে হবে আর বিক্রেতাদের সঙ্গে গড়ে তুলতে হবে সখ্যতা। এই শিক্ষাটি একেবারে ছেলেবেলার। বাবার সঙ্গে নেহাতই কৌতূহলবশে বাজারে আনাগোনার সুবাদে। কিন্তু এমনই সেই শেখা, যার তাৎপর্য উপলব্ধি করলাম পরিণত বয়সে এসে। এবং এও অনুভব করলাম, শুধু বিক্রেতারা নয়, এক অনির্বচনীয় যোগসূত্র তৈরি হয়ে যায় আনাজ-ফলমূল-মাছ- মাংসের সঙ্গে। প্রকৃত হেঁশেল যাত্রার সেই শুরু।

শীতের কুয়াশামাখা ভোরে বাজারগুলি যখন আনাজের সম্ভারে সেজে ওঠে, অপূর্ব সেই দৃশ্য ক্রেতার মনে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, তা ভাষায় প্রকাশ করা খুব কঠিন। কিন্তু অন্তর্লিন সেই প্রক্রিয়া একজনকে রান্নাঘরের দিকে টেনে নিয়ে যাবে কিনা, সেটাই হলো মূল প্রশ্ন। আর এ বিষয়ে সেই মানুষটির কিছুই করার থাকে বলে মনে হয়না। মোহাবিষ্টের মতো সে এগিয়ে যায় সেই গন্তব্যের দিকে। একথাও অবশ্যই ঠিক, সবার এমন ঘটে না, কারও কারও ঘটে। আর সেই কারও কারও জীবনটা যে বদলে যায় অনেকাংশেই, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। পাড়ার বাজারে তাই থরে থরে যখন কচি ফুলকপি দেখা যায়, চকচক করে ওঠে রন্ধনবিলাসী মানুষটির চোখ। মস্তিষ্কের মধ্যে পাকটি শুরু হয়ে যায় তখন থেকেই। ফলত হেঁশেলের খুঁটিনাটিতে তেমন দড় না হয়েও জিভের অনু-পরমাণুর সঙ্গে আজন্ম একাত্ম হয়ে থাকা একটি স্বাদ নির্মাণ করা সম্ভব হয় শুধুমাত্র অনুমানক্ষমতার সঠিক প্রয়োগে। গুহামানবের যুগ থেকে এই আধুনিক কাল পর্যন্ত হেঁশেল সংস্কৃতির বিপুল বিবর্তনের পিছনে লুকিয়ে আছে এই অনুমানক্ষমতা আর সাধারণকে অনন্য সাধারণে বদলে নেওয়ার প্রতিভা। তাই আগুন আবিষ্কারের পর যখন মানুষ আহার্য তৈরিতে তার ব্যবহার শিখল, আমূল পরিবর্তন ঘটলো এই বিষয়টির – একদিন যা ছিল নিছক বন্য পশুর মাংস ভক্ষণের উপায়, কালক্রমে তাই হয়ে উঠল বারবিকিউ।

বারবিকিউ। অসীম আগ্রহ, উত্তেজনা আর ভালো-লাগা ভর করে এই বিষয়টির অনুসঙ্গে। আসলে বারবিকিউ তো শুধু রান্না নয় একটা উদযাপন। দলবদ্ধভাবে খাওয়ার উদ্দ্যেশ্য নিয়ে যে ব্যাপারটার সূত্রপাত, শেষ পর্যন্ত সর্বদাই তা পরিণত হয় একটা পার্টিতে। বারবিকিউ-এর কথা উঠলেই প্রথম যে স্মৃতি ভেসে ওঠে, তা হলো ডালহৌসি ইন্সটিটিউট ক্লাবে অশোকদার সঙ্গে, বছরে অন্তত দুবার সেই উৎসবে যাওয়া। সে অনেকদিন আগের কথা। কাঠ-কয়লার আঁচের ওপর একটা লোহার জাল বিছানো আর তার ওপর নানান ধরনের মাংসের টুকরো পুড়ছে আর লাইনবদ্ধ ক্ষুধার্ত মানুষের দল প্লেটে তুলে নিচ্ছে স্যালাড এবং পছন্দসই মাংস। ততক্ষণে মাংস পোড়ার গন্ধে পেট অর্ধেক ভরে এসেছে। এইরকম অনেক বছর চলার পর বারবিকিউ-এর যে অসামান্য অভিজ্ঞতাটি হয়েছিল, তা স্বদেশ থেকে বহুদূরে বিভুঁইয়ে, উত্তর জার্মানির টোডেনহফ নামক একটি ছোট্ট জনপদে। জার্মান ভূখণ্ড ওখানেই শেষ। সমুদ্রের ধারে, পাহাড়ের ওপরে দাঁড়ালে অপর প্রান্তে দেখা যায় ডেনমার্কের তটরেখা। সেবার আমি একটু বেশি দিনের জন্য ওদেশে। হামবুর্গ শহরের কাছে আহরেনস্‌বুর্গ নামের একটি ছোটো শহরের এক বৃহৎ মুদ্রণালয়ে প্রশিক্ষণের সূত্রে। এক সপ্তাহান্তে বন্ধুনি কারিনের পাল্লায় পড়ে গাড়ি বোঝাই নানান সামগ্রী নিয়ে আমরা রওনা হলাম সেই টোডেনহফের উদ্দেশে। এই পথ দিয়ে বারবার যাওয়া-আসা করে চলেছি সেই নব্বই সাল থেকে। সেই কারণেই জানা ছিল আমাদের যেতে হবে ল্যুবেকের ওপর দিয়ে। ল্যুবেক। প্রাচীন এই শহরটির ইতিহাস ব্যপক এবং সমৃদ্ধ। প্রায় একহাজার বছর আগে তৈরি হওয়া ইউরোপীয় ব্যবসায়িক গোষ্ঠী ‘হান্সিয়াটিক লীগ’- এর মূল কেন্দ্র ল্যুবেক বল্টিক সমুদ্রের উপকুলে আজও জার্মানির একটি প্রধান বন্দর শহর। লাল ইঁটের তৈরি এই শহরের প্রধান প্রবেশপথ, যা ‘হলস্টেনটোর’ (Holstentor) নামে সুপরিচিত এক অসাধারণ স্থাপত্য নিদর্শন। মধ্যযুগে যার কাজ ছিল শত্রুর আক্রমণ থেকে পুরনো শহরকে রক্ষা করা। এই শহর অবশ্য বিখ্যাত একাধিক কারণে। বরেণ্য সাহিত্যিক টোমাস মানের জন্ম উত্তরের এই ‘ভেনিস’-এ আর অন্য যে বিষয়টি ল্যুবেককে করে তুলেছে পৃথিবীবিখ্যাত, তা হচ্ছে ‘মারৎসিপান’ (Marzipan)। যাঁরা এ বস্তুটি খাননি, তাঁদের কাছে এর স্বাদ ব্যাখ্যা করা খুব মুশকিল আর যাঁরা খেয়েছেন, তাঁরা আশাকরি বলবেন ‘এ স্বাদের ভাগ হবেনা’। খুব ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে এমনও দেখেছি যে কেউ কামড় মেরে যখন বুঝতে পারছেন, তা মারৎসিপান, ফিরিয়ে দিচ্ছেন। বিচিত্র এর অতীত। সপ্তম শতক নাগাদ চিনে জন্ম। ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে পৌঁছল মধ্যপ্রাচ্যে। শেষ পর্যন্ত ইউরোপ। স্পেন, ইতালি, এস্তোনিয়া আর জার্মানি – এই দেশগুলিতেই মারৎসিপানের জনপ্রিয়তা। মূল উপাদান যদিও সব ক্ষেত্রেই সেই চিনি আর বাদামের মিহিগুঁড়ো, যাকে বাদাম ময়দাও বলা যেতে পারে। এর একটি ফরাসি অবতার আছে, যার নাম ‘ফন্দান্ত’ (Fondant) – যেখানে চিনি আর বাদাম ময়দা ছাড়াও ব্যবহার হয় কর্ন সিরাপ, ফলে মণ্ডটির চরিত্র বদলে যায় অনেকটাই। তাই ‘ফন্দান্ত’ ‘মারৎসিপান’ হলেও ‘মারৎসিপান’ ‘ফন্দান্ত’ নয়। যাই হোক, যা বলছিলাম। দুশো বছরেরও আগে, ১৮০৬ সালে ইয়োহান গেওর্গ নিডারেগার ল্যুবেক শহরে প্রতিষ্ঠা করলেন যে কোম্পানি, আজ তা একটি সোনায় মোড়া ব্র্যান্ড। এই বস্তুটি নিয়ে উন্মাদনা কেমন হতে পারে, ল্যুবেক শহরে অন্তত একবার না গেলে অনুমান করা খুব মুশকিল। যতদূর জানি, প্রায় তিরিশ রকমের মারৎসিপান পাওয়া যায় ল্যুবেক –এ। তার মধ্যে এই নিডারেগার (Niederegger) ব্র্যান্ডটির খ্যাতি ভুবনজোড়া। এঁদের যে ক্যাফেটি আছে, সেখানে বসার জায়গা পাওয়াই কঠিন হয় অনেকসময়। তাহলে কী সেই রহস্য, যে কারণে ল্যুবেক-এর মারৎসিপান এর অন্য সংস্করণগুলির থেকে আলাদা? এর উত্তর লুকিয়ে আছে বাদাম-ময়দা আর চিনির আনুপাতিক ব্যবহারের মধ্যে, যেখানে বাদাম-ময়দা থাকে প্রায় সত্তর ভাগ। বাকিটা চিনি। যদিও এই তথ্যগুলি ‘অতি সযত্নে রক্ষিত’ এবং কোনও পরিস্থিতিতেই সরকারিভাবে এর কোনও সমর্থন পাওয়া যাবে না। আরেকটি জরুরি বিষয়। মারৎসিপান হচ্ছে এই মিষ্টান্নটির অভ্যন্তর। বাইরের খোলসটি সাধারণত চকলেট। সেই চকলেট আবার নানারকম হতে পারে। সাদা, কালো (dark), অতি-কালো (extra-dark) বা যা-খুশি। লিখতে লিখতেই আমি অনুভব করার চেষ্টা করছি, চকলেটের পাতলা অথচ মুচমুচে আস্তরণটি দাঁতের আলতো চাপে ভেঙে গিয়ে ভিতরের নরম মারৎসিপানের স্বাদ যখন জিভে লাগে আর চকলেট-মিশ্রিত সেই স্বাদ ছড়িয়ে যায় সমগ্র মুখগহ্বরে, তার অনুভূতি অতীন্দ্রিয়।

সেবার যখন কারিন, উহ্বে আর আমি দুপুর নাগাদ ল্যুবেক-এ গিয়ে পৌঁছলাম, পেট তখন চুঁইচুঁই। সেটা মোটেই মারৎসিপান খাওয়ার সময় নয়, কিন্তু দিনটা ছিল আন্তর্জাতিক মাতৃদিবস। সারা শহর জুড়ে সেদিন শুধুই মারৎসিপান আর মারৎসিপান। উপহার দেওয়ার জন্য ওই বিশেষ দিনে মারৎসিপান সত্যিই অতুলনীয়! আমরা সেদিন দুপুরের খাওয়া সারলাম এরবসেনসুপ্পে বা কড়াইশুঁটির স্যুপ দিয়ে। যেটি ওদেশের আরেকটি জনপ্রিয় খাবার। সে আলোচনা বিশদে, অন্যসময়। তা সেদিন আমরা কিছুক্ষণের বিরতি নিয়ে আবার রওনা দিলাম আমাদের গন্তব্যের দিকে। বিকেল নাগাদ পৌঁছলাম টোডেনহফে। জায়গাটি এতই ছোটো, আধঘণ্টা এদিক ওদিক হাঁটলেই শেষ হয়ে যায়। কারিনদের যে বন্ধুর বাড়িতে আমরা অতিথি হয়ে উঠেছিলাম, সেই বাড়িটি অপূর্ব! বাড়িটির দুটি অংশ – একটি দোতলা আর অন্যটি একটা আউটহাউস মতো, যেখানে একটি লম্বা ঘর আর তার লাগোয়া একটি অপেক্ষাকৃত ছোটো ঘর – যেখানে দুতিনটি বাঙ্ক বিছানা। তারই একটিতে শোয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল আমার। কিন্তু সে তো পরের কথা। তার আগে তো বাকি অনেক হুল্লোড়! বিকেল – সন্ধে নাগাদ একটু ঘোরাঘুরির পর আমরা জড়ো হলাম বাগানে। সাজানো হলো বারবিকিউ –এর সরঞ্জাম। এল নানাধরণের মাংস। আগে থেকেই যেগুলি ম্যারিনেট করা ছিল। এল প্রচুর বিয়ার আর ওয়াইন। শুরু হলো পার্টি। অন্ধকার ঘন হয়ে এল। বাতাসে তখন মাংস পোড়ানোর গন্ধ। তাপমাত্রা নেমে আসছে দ্রুত। একটু ওম টেনে নিতে আমরা আরও আগুনের কাছাকাছি। বিয়ার আর ওয়াইন ততক্ষণে আমাদের রক্তস্রোতের মধ্যে খেলা করছে। শেষরাতে বিছানার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল আমাদের শ্রান্ত শরীরগুলি।

বারবিকিউ-এর আরেকটি স্মরণীয় অভিজ্ঞতা শান্তিনিকেতনে। আমাদের পরম বন্ধু গুগলির অতিথিশালায়। যার অন্য নাম ‘ছোটা কোঠি’। সেবার বর্ষশেষে আমরা জমায়েত হয়েছিলাম সেখানে। কলকাতা থেকেই সব প্রস্তুতি নিয়ে আমরা পৌঁছেছিলাম সেখানে। দেবস্মিতাদি – শ্রীধরদা নিয়ে গিয়েছিল মুরগির টুকরো। গুগলির দায়িত্বে ছিল বিফ আর মাটন। ইয়ান জাকারিয়া নিয়েছিলেন সল্ট বিফ। আর আমাদের সঙ্গে ছিল কিছু মাছ। এসব তো হলো। আসল কাজ? বাড়ির পিছনদিকের বাগানে আবিষ্কার করা গেল এক বিশালাকার উনুন। সারাদিন অনেক কসরতের পর সেটিকে বারবিকিউ-এর জন্য প্রস্তুত করা গেল। এও ঠিক হলো এর মূল দায়িত্বে থাকবো আমি। সন্ধে থেকে শুরু হয়ে গেল মাংস পোড়ানোর কাজ। এই বিষয়টিকে রসসিক্ত করে রাখার জন্য গুগলি একটু পর পরই দিয়ে যাচ্ছিল পানীয়। চিমটে দিয়ে আগুনের ওপর পুড়তে থাকা মাংস বা মাছের টুকরোগুলি ওলট পালট করার মধ্যে যে অনির্বচনীয় আনন্দ আছে, তা একমাত্র যে সেই স্বাদ পেয়েছে, তার পক্ষেই অনুভব করা সম্ভব। সেবারের সেই বারবিকিউ অ্যাডভেঞ্চার গড়িয়ে গিয়েছিল ভোরের দিকে, অনেক আড্ডা, খাওয়া-দাওয়ার পর দেবস্মিতাদির মুখে শোনা ভূতের গল্প দিয়ে।

এ লেখার শিরোনাম ছিল স্মৃতির শহর। লেখার শেষদিকে এসে নিজেকেই প্রশ্ন করছি, সে কোন শহর? কলকাতা, হামবুর্গ, ল্যুবেক, টোডেনহফ না শান্তিনিকেতন? এক অর্থে সবগুলি শহরই কি স্মৃতির শহর নয়? স্মৃতির ওপর আমাদের কি কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে? কোন স্মৃতির সঙ্গে সরল অথবা বক্র রেখায় মিলে যাবে অন্য কোন স্মৃতি, আমরা কি আগেভাগে তা আন্দাজ করতে পারি?

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in


পুজোর ছুটির পরে হোস্টেল ফিরতে দেরি হল। ঠান্ডা লেগে বুকে সর্দি বসে ঘুসঘুসে জ্বর হয়ে সে এক কেলো!
সপ্তমীর দিন ঠিক সকালে বেরিয়ে পায়ে হেঁটে পার্কসার্কাস থেকে যোধপুর পার্ক , আনোয়ার শা রোড পোদ্দার নগর ঘুরে বিকেলের দিকে সন্ধ্যে হয় হয়, তখন বাড়ি ফিরলাম। দুপুরে খাবার বলতে খালি বাদামভাজা, ঝালমুড়ি আর বুড়ির চুল।
অনভ্যাসে এতটা একদিনে পায়ে হেঁটে যা ব্যথা, তারপরেই জ্বর। কিন্তু আনন্দে ছিলাম। পোদ্দারনগর কলোনীর ভেতরে রাস্তায় টিউকল থেকে জল ভরছিলেন জনাকয় মহিলা। পাশেই পুজোর প্যান্ডেল থেকে তারস্বরে বাজছে নতুন হিন্দি সিনেমার গান---" বোল রাধা বোল সঙ্গম হোগা কি নহীঁ? "
ত্যক্ত বিরক্ত নায়িকা হার মেনে বলে ওঠে--হোগা, হোগা হোগা!
জল ভরতে ব্যস্ত একজন মহিলা সঙ্গিনীদের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে বাঙাল উচ্চারণে বলে ওঠেন-- হগা, হগা, হগা!
সবাই সমস্বরে হেসে ওঠে।
যোধপুর পার্কের পুজো প্যান্ডেলের কাছে দাঁড়িয়ে পড়লাম। বাজছে-- " ত্রিবেণী তীর্থ পথে কে গাহিল গান?"
আশ্রমে রামকানাই মহারাজ একবার বলেছিলেন-- ওই গানটা পটদীপ রাগিণীতে।

কিন্তু ছবিঘর সিনেমার সামনে মিতার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া হল না। সিনেমার সামনে বন্ধু অপেক্ষা করছে শুনেই মায়ের চেহারা কেমন কঠিন কঠিন হয়ে গেছেল আর মাত্র জ্বরে ভূগে উঠেছি-- এই ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে মা আমার বেরনোর প্রস্তাব খারিজ করে দিলেন।
কিন্তু বিপ্লব মানে মিতা নাকি দুঘন্টা ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল লাকি আসবে এই ভরসায়। তবে লাকির বদলে দেখা হয়ে গেল টিউটোরিয়ালের রথীন স্যার ও ক্লাস টেনের অসিতদার সঙ্গে। ওরা ছবিঘর সিনেমাহলে পুজোয় রিলীজ হওয়া ফিল্ম দেখতে গেছল। জেরায় জেরায় লাকি কবুল করল যে প্রদ্যুম্নের জন্যে দাঁড়িয়েছিল।
ও সময়মত হোস্টেলে ফিরল। আমি সেদিন অ্যাপো ফেইল করা ও হস্টেলে ফিরে যেতে দেরির কথা লিখে ওকে একটা পোস্টকার্ড ছাড়লাম। সেটা ওর মা হোস্টেলের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলেন।
চিঠিটা ওর হাতে সোজাসুজি যায় নি, গেল সেই অসীমদার মাধ্যমে। অসীমদা মহা ছোটলোক-- চিঠিটা পড়ে তবে ওকে দিল। খোলা পো্স্টকার্ড বলেই কি অন্যের চিঠি পড়া যায়?
ব্যস-, অসীমদা হোস্টেলে পুরো গল্পটা আদা নুন মাখিয়ে ছাড়ল।
দশদিন পরে হোস্টেলে ফিরে দেখলাম আমরা দু'জন বিরাট খোরাক হয়ে গেছি। আর তদ্দিন গোটা তামাশা শুধু বিপ্লবকে নিয়েই হয়ে্ছে।
রাত্তিরে ও আমাকে চেপে ধরল, বলল-- কে তোকে বলেছিল পোস্টকার্ডে লাকি-মিতা লিখতে?
এবার ছুটির পর আবার রুম অ্যালটমেন্ট পাল্টেছে। একই ঘরে আমরা চারজন ক্লাস নাইন, শুধু একজন ক্লাস সেভেন, এবছর নতুন ভর্তি হয়েছে। হোস্টেল খুললেও স্কুল খোলেনি, খুলবে সোজা ভাইফোঁটার পর। এবার আমাদের রুমের ক্যাপ্টেন বিপ্লব। সকালবেলা প্রেয়ার ও ড্রিলের পর জলখাবার, দুঘন্টা পড়া, একঘন্টা ক্রিকেট। তারপর স্নান করে সাঁটিয়ে খেয়ে কষে ঘুম। বিকেল চারটেয় উঠে জলখাবার খেয়ে খেলার মাঠ, তারপরে প্রেয়ার, টিউটোরিয়ল, খাওয়া-- শেষে সাড়ে দশটায় লাইট অফ।
কিন্তু প্রথম দিন দুপুরে খালি চোখ লেগেছে এমন সময় দরজায় খটখট। অতিকষ্টে চোখ খুলে দেখি কেউ ডাকছে-- বিপ্লবদা, অ বিপ্লবদা! দরজা খোলো।
বিপ্লব উঠল, কাঁচাঘুমে লাল চোখ।
দরজা খুলতেই সেই নতুন ছেলেটা হুড়মুড়িয়ে ঢুকল। বিপ্লব কোন কথা না বলে ঠাঁটিয়ে দুটো চড় মারল। তারপর আবার নিজের বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ক্লাস সেভেনের ছেলেটা গালে হাত বুলোতে বুলোতে শুতে গেল।
বিকেলে ওকে বললাম--অমন করে মারলি কেন?
-- দু'দিন দেখ! বুঝে যাবি।
পরের দিন দুপুরে আমরা সবাই গাঢ় ঘুমে কাদা-- অনেক দূর থেকে কেউ যেন আমার নাম ধরে ডাকছে-- প্রদ্যুম্নদা, ও প্রদুম্নদা!
আমার খাটের কাছেই দরজা। উঠে খুলে দিতেই সেই ছেলেটা !একইরকম ভাবে হুড়্মুড়িয়ে ঢুকল। আমিও সোজা দুটো চড় কষিয়ে নিজের বিছানায় ফিরে গেলাম।
বিপ্লব উঠে লাল চোখ দিয়ে দুজনকে দেখে ফিক করে হাসল, তারপর শুয়ে পড়ল।

কিন্তু স্কুল খোলার আগে নতুন বাওয়াল শুরু হোল যার মাথামুন্ডু বোঝা কঠিন।
ক্লাস সিক্সের নবারুণ বলে একটা বাচ্ছা ছেলে পাগল হয়ে গেছে!
ফুটফুটে ছেলেটা, এবছরই নতুন এসেছে। ১৫ই অগাস্টের ক্যাম্পফায়ারে একটা মজার কবিতা বলেছিল, সঙ্গে সুন্দর অ্যাক্টিং।
" ওই রাবণ আসিল যুদ্ধে পড়ি বুটজুতা,
হনুমান মারে তারে লাথি-চড়-গুঁতা।
লাথি খেয়ে রাবণরাজা যান গড়াগড়ি,
হনুমান করে তারে দন্ত কিড়িমিড়ি।"
জুরিদের সর্বসম্মতিতে ওকে একটা প্রাইজ দেওয়া হল। ও একটা আধুনিক গানও গেয়েছিল--"সূর্যমুখী সূর্যে খোঁজে সূর্য খোঁজে বিনা,
বল তো গো-- আমি তোমার মনের মত কি না?"

ভালই গেয়েছিল, কিন্তু অনিল মহারাজ নাক কোঁচকালেন। ফলে কোন প্রাইজ দেওয়া গেল না।
সেই সবার প্রিয় ছটফটে হাসিমুখ ছেলেটা পাগল হয়ে গেছে?
হুড়মুড়িয়ে ছুটলাম অফিসের দিকে।
লম্বা বারান্দায় একটা থামের সামনে ছোট কাঠের টুল, তাতে বসে ছোট্ট নবারুণ, কোমরের হাতদুটো পিছমোড়া করে থামের সঙ্গে গরু বাঁধার দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা। ঘোলাটে চোখে ও সবাইকে দেখছে অথবা কাউকে দেখছে না।
কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠছে-- পোকা! পোকা!
তারপর নিঃস্তেজ হয়ে পড়ছে। একটু পরে আবার শুরু হল সেই পোকা পোকা চিৎকার। দেখতে দেখতে ভীড় জমে গেছে। কারো কারো চোখ গোল্লা হয়ে গেছে আর ছোট বাচ্চারা মজা পেয়ে হেসে উঠছে।
এবার নবারুণও হাসতে শুরু করল।
--- পোকা! পোকা! চারদিকে পোকা। পোকার বাড়ি। ছোট পোকা দুধ খাবে, বড় পোকা বাজারে যাবে।মা্ছ কিনে আনবে।

আমার দমবন্ধ লাগছে। দেখলাম বড় মহারাজ সুনীল মহারাজকে ডেকে কিছু বললেন, উনি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন।
আমার কানের কাছে ক্লাস টেনের অমিয়দা ফিসফিস করল-- ওর বাড়িতে খবর দেওয়া হয়েছে। বাড়ি থেকে লোক আসছে, ওকে নিয়ে যাবে।
কিন্তু এই তামাশা বেশিক্ষণ চলল না। আমাদের আশ্রমের এল এম এফ ডাক্তারবাবু ওঁর কালো ব্যাগ নিয়ে রিকশা থেকে নামলেন। নবারুণকে মন দিয়ে দেখে সুনীল মহারাজকে ওইরকম ফিসফিসিয়ে কিছু বললেন, মহারাজও আগের মত মাথা নাড়লেন।
তারপর উনি একটা ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ বের করে কাউকে ইশারা করলেন। বাচ্চাটার বাঁধন খুলে দিয়ে দুজন চৌকিদার শক্ত করে ওর দুটো হাত চেপে ধরল। উনি স্পিরিট লাগানো তুলো দিয়ে বাচ্চাটার হাতে একটু ঘষে সুঁচটা পট করে বিঁধিয়ে দিলেন। একটা ওষুধ আস্তে আস্তে ঢুকছে।
সুঁচ দেখেই নবারুণ পরিত্রাহি চিৎকার জুড়েছিল। এবার আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়ল। তারপর ওর মাথাটা বুকের কাছে ঝুঁকে পড়ল। সিক রুমের বড়দা এসে এবার ওকে কোলে করে সিক বেডে নিয়ে গেলেন।





নবারুণ চলে গেছে। ওর বাবা-কাকা এসে ওকে নিয়ে গেছেন। মহারাজ টিসি দিয়ে দিয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্নগুলো রয়ে গেল।
কেন? কী হয়েছিল?
কোন উত্তর নেই। একমাস হয়ে গেল।
মন মানে না; জানতে হবে। গুরুর কাছে হত্যে দিতে হবে।
ইদানীং আমাদের এক গুরু হয়েছে-- ক্লাস টেনের অমিয়দা। কোলকাতার উপকন্ঠে কোন পুরনো জনপদের বাসিন্দে। খেলাধূলো আর ফচকেমি--দুটোতেই চৌকস, শুধু পড়াশুনোটা মোটামুটি। তবে বুককীপিং এ ভাল নম্বর পায়। আমি হলাম ওঁর বাঁহাত, ডান হাত প্রশান্ত।
অমিয়দা খবর আনল--শোন, নবারুণ রোজ সকালে বা সন্ধ্যেয় ফাঁক পেলে বলাইদার কাছে যেত। বলাইদার থাই ম্যাসেজ জানিস তো? উনি ছোট ছোট বাচ্চাদের ওনার কোয়ার্টারের বারান্দায় ব্যায়াম করাতেন; তারপর কুল ডাউন করাতে করাতে ওদের থাই ম্যাসাজ করতেন।
অমিয়দা অর্থপূর্ণ ভাবে চোখ টিপল।
--- ধেত্তেরি! ওসব আমাদের জানা আছে। কবে ঠোঙা হয়ে যাওয়া গল্পগুলো ছাড়ছ। নবারুণের ব্যাপারটা যদি জান তো বল। নইলে?
-- নইলে কী রে শ্লা? ঘোড়ায় জিন চড়িয়ে এসেছিস? আগে শোন তো!
--- আরে, নবারুণ গিয়েছিল সেক্রেটারি মহারাজের কাছে কমপ্লেন করতে।
--কী কম্প্লেন?
--বাচ্চাছেলে; বলল --আমাকে হুল ফুটিয়ে দিয়েছে!
--- কী ? সেটা কী কেস?
--বল্লাম তো, বাচ্চারা ওইভাবেই বলে অনেকসময়। বুঝলি না?
--হ্যাঁ, হ্যাঁ; কিন্তু কে?
--- কে আবার আমাদের বলাইদা! ব্রহ্মচারী বলাই!
--- কী ফালতু বকছ? বলাইদা!
-- এ শর্মা ফালতু বকে না; খামোকা কারো কুচ্ছো করে বেড়ায় না।
-- তারপর?
--তারপর তো পুরো কেলো! বলাইদা হলেন আমাদের ফেবারিট মেজো মহারাজ কানাইদার ছোট ভাই। এখনো গেরুয়া পান নি, সাদা পরে ব্রহ্মচারী মানে সন্ন্যাসী হওয়ার অ্যাপ্রেন্টিস হয়ে আছেন।
তো সেক্রেটারি মহারাজ-- আমাদের সেজ'দা--- কানাইদা মানে স্বামী শান্তিময়ানন্দ ও ব্রহ্মচারী বলাইদা , দুজনকেই ডেকে পাঠালেন। বলাইদা পুরো ব্যাপরাটা অস্বীকার করে বললেন বাচ্চাটা ওনার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সেই সময় কিছু ঘটেছে। উনি ঘরে ছিলেন না। হয়ত ক্লাস এইটের বিভাস কিছু করে থাকতে পারে। ও সেই সময় ঘরে ছিল।
--- কী ডেঞ্জারাস !
--আরে শোন না! ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয় নি। নবারুণদের পরিবারের কেউ লালবাজারে অফিসার। ওঁর বাবা-কাকারা স্বামীজিকে বলে গিয়েছিলেন যে ওঁরা ছেড়ে দেবেন না।
-- কী করলেন?
-- সে জানি না। তবে এই একমাসের মধ্যে কোথাও কেউ কলকাঠি নেড়েছে। গতকাল বলাইদাকে আমাদের আশ্রম থেকে সন্ধ্যেবেলা বিদেয় করে দেওয়া হয়েছে। ওঁর আর এ জীবনে বেলুড়ে গিয়ে গেরুয়া ল্যাঙোট পাওয়া হবে না।


আস্তে আস্তে ব্যাপারটা থিতিয়ে যায়। শুধু রাত্তিরের আডডায় বলাইদার থাই ম্যাসাজ একটা ছ্যাবলা জোক হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
কিন্তু অমিয়দাকে ঘটনাটা বোধহয় আমাদের থেকে বেশি নাড়া দিয়েছিল।
ও একদিন ওর ঘরে আমাদের পাঁচজনের মিটিং ডাকে। সবার আগে হাজির হই আমরা তিনজন। ডানহাত প্রশান্ত, বাঁ-হাত আমি ও আমার মিতা মানে বিপ্লব। বাকি দুজন --নিখিলেশ ও বিশু-এল একটু দেরি করে। ওদের অনিলদা, স্বামী আত্মানন্দ প্রেয়ারে যারা ঘুমোয় তাদের নাম লেখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ওদের খাতা খালি ছিল, তাই একরাউন্ড বকুনি।
অমিয়দা বুড়োদের মত গলা খাঁকারি দিয়ে শুরু করতেই আমরা হেসে ফেললাম। ও এত মজার এ হাসি পেয়েই যায়। শেষে মাথা চুলকোতে লাগল।
--- কী ? কী জন্যে ডেকেছ নিজেই ভুলে গেছ? এই তোমার জরুরি মিটিং?
--- বালের মিটিং!
-- দাঁড়া, দাঁড়া; এক্ষুণি মুখ খারাপ করিস না। আসলে কোত্থেকে যে শুরু করি?
-- ল্যাজা মুড়ো যেখান থেকে ইচ্ছে! শুরু তো কর, গুরু!
--- শোন, নবারুণের কেসটা তো দেখলি! এটাই প্রথম না, শেষও না। এখানে বহুদিন ধরে কচি কচি ছেলেদের সঙ্গে জোরজবরদস্তি করে এইসব করা চলছে। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।
--- কী করবে? কেউ যদি কম্প্লেন না করে তো ? তোমার এই ফোঁপরদালালি স্বভাব নিয়ে না? আমি এসব ফালতু ঝামেলায় নেই বাবা!
-- বিশু, তুই কী বলিস?
-- একই কথা; নিজ নিজ পশ্চাদদেশ নিজ দায়িত্বে রক্ষা করিবেন। ইহার দায়িত্ব লইতে আশ্রম অপারগ।
--- আশ্রমের কথা আসছে কী করে? আমরা আমাদের নিজেদের মধ্যে স্টেপ নেওয়ার কথা বলছি।
--- আর কম্প্লেন হলে আশ্রম স্টেপ নেয় না এমন তো নয়! বলাইদাকে , মানে ব্রহ্মচারী বালচৈতন্যকে বের করে দিল তো।
-- দূর বাল! কতগুলো ঘটনা ঘটে চলেছে আর তুই একটা স্টেপ নেওয়ার কথা বলছিস। আজকাল স্বামীজিদের দালালি করছিস নাকি?
---তোকে কালীকীর্তনের দলে কানাই মহারাজ নিয়ে নিয়েছেন তাই?
হাতাহাতি হতে যাচ্ছিল, অমিয়দার কড়া ধমকে সব থেমে গেল।
ওর ইশারায় প্রশান্ত বলতে শুরু করলঃ
দেখ, সব হোস্টেলেই এক অবস্থা। কোন উৎসবে বা ফুটবলের ময়দানে বহড়া , বীরেন্দ্রপুর বা কাঠালিয়া আশ্রমের ছেলেদের সঙ্গে দেখা হলেই একবার শুরু হয়-- কী দাদা? আপনাদের ওখানে চলে? আমাদের ওখানে তো চলছে।
আমি আর থাকতে পারি না। সোৎসাহে দোহার দিইঃ
হ্যাঁ, দাদা। গত সপ্তাহে একটা দারুণ বই পড়েছি, 'ফর হুম দি বেল টোলস্‌', অশোক গুহের বাংলা অনুবাদে। তাতে লেখক হেমিংওয়ে বলছেন--স্প্যানিশ ভাষায় নাকি গালাগালি সাংকেতিকতার চরমে পৌঁছেচে। সেখানে অশ্লীল ক্রিয়ার নামটি না বলে শুধু 'করেছে' এমন বলা হয়।
--- ধ্যেৎ, এই প্রদ্যুম্নটা মহা ক্যালানে। কোথায় আমাদের মিশন আর কোথায় হেমিংওয়ে?
-- আরে সম্বন্ধ আছে; বলছি যে হেমিংওয়ে আমাদের আশ্রমে আসেন নি। তাহলে দেখতেন আমরাও অমনি করি। খালি 'করেছে'র জায়গায় বলি 'দিয়েছে'। যেমন অমুক্দা তমুক ছেলেটাকে না 'দিয়েছে'।
এবার অমিয়দা নিজে হাসতে হাসতে বিছানা থেকে গড়িয়ে যায়।
তারপর জল খেয়ে বলে--আমার কথাটা শোন। আমি একটা সল্যুশন ভেবেছি। আমরা এই পাঁচজন কাজটা শুরু করব। কান খোলা রাখলেই টের পাওয়া যাবে কোন কোন বাচ্চা কার শিকার হতে চলেছে।
আমরাই সিনিয়র। ইলেভেনের মাত্র সাতজন, আর তারা বোর্ডের ফাইনাল পরীক্ষার চিন্তায় হিমসিম খাচ্ছে। আমি টেন, তোরা নাইন। আমরা রাত্তিরে তক্কে তক্কে থাকব। শিকারী ও শিকারদের হাতে নাতে ধরতে হবে।
-- কিন্তু যদি ওরা বলে যে আমরা যাই করি তোদের বাপের কি? তখন?
--- হাতেব নাতে ধরলে ফিফটি-ফিফটি ধোলাই খাবে। আশ্রমে এসব নোংরামি চলবে না। আর যেগুলো ছোট বাচ্চাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে করে তাদের মহারাজদের কাছে নিয়ে যাব।
--- বেশ, আমি তোমার সঙ্গে আছি। কিন্তু তোমার ক্লাসের বন্ধুরা? বা যারা বিমানদা-- রাজকুমারদার মত জোড়া বেঁধেছে? ভালবাসাবাসি না কী যেন?
আমাদের গুরুর কপালে ঘাম জমল।

নাঃ, গুরুর সল্যুশন নেহাৎ রাবার সল্যুশন , তাও হট নয়, কোল্ড। বিশেষ কাজে এল না।
ওভাবে পুলিশগিরি হয় না। আর রাত্তির জেগে দুটো ফ্লোরের বারান্দায় ঘুরে বেড়ানো? জানলার কাছে আড়ি পাতা? কদিন সম্ভব? উল্টে একদিন মহারাজের কাছে ডাক পড়ল।
ইতিমধ্যে সেজ'দা মানে সর্বজ্যেষ্ঠ বৃদ্ধ মহারাজ অনেক দিন ধরে অসুখে ভুগে গত হয়েছেন।
এখন কানাইদা মানে আমাদের ফেবারিট রাজসিক রুচির স্বামী শান্তিময়ানন্দ সেক্রেটারি মহারাজ ।

সেজ'দার চলে যাওয়াটা অদ্ভূত। দুপুর থেকেই শুনছি ডাক্তারবাবুরা জবাব দিয়েছেন, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। সেই সময় এল রাত সাড়ে আটটায়। হটাৎ হাঁউমাঁউ কান্না ও চিৎকারে আমরা ছেলের দল দৌড়ে গেলাম।
খাটের উপর শুয়ে সেজ'দা; চোখ তুলসীপাতা দিয়ে বোজানো। খাটের চারদিকে ভীড় করে অনেক লোকজন, সবাই কাঁদছে।
একজন সাদাচুলের মহিলা ঢুকলেন। বেশ এলিট চেহারা। উনি শায়িত দেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিলাপ করে কাঁদতে লাগলেন।
-- আমি কতদূর থেকে তোমাকে দেখব বলে এসেছি, সেই সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, কিন্তু ঠাকুর আমার ইচ্ছে পূরণ করলেন না!
কান্নার রোল বেড়ে গেল। ইতিমধ্যে বিবাদী সুর বেজে উঠল। আশ্রমের কার্পেন্টারি বিভাগের মানিক মিস্ত্রী ভেতরে ঢুকে সরু মোটা নানান স্বরে সমবেত কান্না শুনে হটাৎ হোঃ-হোঃ করে হেসে উঠল।
কান্না থেমে গেল। সবার লাল চোখ ওর দিকে ফিরেছে। ও লজ্জা পেয়ে হুড়মুড়িয়ে পালিয়ে গেল।
আমরা জানতে পারলাম যে শোকাকুল মহিলাটি সেজ'দার পূর্বাশ্রমের আপন বৌদি।

উনি নাকি একসময় নেতাজির সহকর্মী ছিলেন। এ নিয়ে অনেক গল্প আছে। আমাদের ওয়ার্ডেন বীরুদা ও আরো দু'একজন আশ্রমকর্মী বলতেন-- শৌলমারীর সাধুটি আসলে নেতাজী!
সে যাকগে, শোনা গেল যে ক্লাস সেভেনের রুদ্রাংশু ও প্রতুল নাকি সেজ'দার প্রয়াণ নিয়ে প্যারডি গান বেঁধেছে, শাম্মী কাপুরের চায়না টাউনের 'হিট সং "বার বার দেখো, হাজার বার দেখো"র 'সুরে।
গুরু অমিয়দা বলল-ওই বাঁদর দুটোকে রোববার আমাদের ঘরে নিয়ে আয় তো! কী কী সব গান বেঁধেছে শুনব।
--- শুনে? বাঁদরামির জন্যে ক্যালাবে?
--- আমি এর মধ্যে নেই, ওরা নেহাৎ বাচ্চা ছেলে। যাদের ক্যালানো উচিৎ তাদের এক আঁটি কলমীশাকও ছিঁড়তে পারলে না ? এবার বাচ্চাদের ওপর হাতের সুখ করবে?
--- এই প্রদ্যুম্নটা কে নিয়ে আর পারি না। ওরা বাচ্চা, আর তোরা বুড়োর বাপ? আরে ডেকে আন, মারব কেন? যদি গান ভাল হয় তো দুপুর বেলা দু'পিস মাছ বেশি দেব।

ওরা কাঁদো কাঁদো মুখে এল। কিছুতেই গাইবে না। অনেক করে সাধ্যসাধনা এবং ভয় দেখানোর পর ডুয়েট শুরু হলঃ
" বল হরি বল,
এ সেজ 'দা মারা গেল,
সেজ সেজ’দাকে ধরে নিয়ে টানাটানি কর সেজ 'দা গো-ও-ও!
ও সেজো, তোমাকে ছাড়া আর চলছে না,
মাঠে মাঠে দিনগুলো কাটছে না।
--"।
এমন সময় দরজায় কড়া নড়ে উঠল। আমরা হাসতে হাসতে উঠে দরজাখুলে ফ্রিজ! চৌকাঠে দাঁড়িয়ে স্বামী আত্মানন্দ, মানে সুনীলদা।


সুনীলদা বিদ্যেসাগরী চটি পরে দ্রুতপায়ে বারান্দার একমুড়ো থেকে অন্য মুড়োয় পৌঁছে যেতেন, প্রায় নিঃশব্দে। এই বিরল দক্ষতার গুণে ছেলেরা ওঁর নামকরণ করেছিল--প্রাইভেট বাস।

ওনার অনেক দায়িত্ব, কারণ উনি জুনিয়র স্বামীজি। সকালে কেউ প্রেয়ারে না গিয়ে ঘরেই ঘুমুচ্ছে কি না, বা প্রেয়ার হলে প্রার্থনার সময় চোখ বুঁজে ঢুলছে কি না--সব উনি সুপারভাইজ করতেন। সন্ধ্যের টিউটোরিয়লে কোন রুমে পড়াশুনো হচ্ছে আর কোন রুমে স্থানীয় মাস্টারমশাই নাক দিয়ে গিটারে সন্ধ্যা মুখার্জির লেটেস্ট গান শোনাচ্ছেন এসব দিকে ওঁর ছিল তীক্ষ্ণ নজর। আর রোববার বিকেলের দিকে ঘরে ঘরে ঢুকে ইন্স্পেকশন, অর্থাৎ ঘর পরিষ্কার করা, বিছানার চাদর ধোয়া, হাত ও পায়ের নখ কাটা এগুলো দেখাও ওঁর ডিউটির মধ্যে।


-- কী হচ্ছে এখানে?
আমরা চুপ, কথা জোগাচ্ছে না।
-- জুনিয়র ছেলে দুটো এখানে কী করছে,? বড়দের ঘরে? বল।
ওরা চুপ, ভয়ে কাঁপছে। করুণ মুখে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। আমরা কি ওদের ফাঁসিয়ে দেব? চোখে নিঃশব্দ বিনতি--- প্রভূ মোরে, অবগুণ চিত ন ধরো!
-- কী হল? প্রদ্যুম্ন? বিপ্লব? গলায় কিছু আটকেছে কি? দরজা বন্ধ ছিল কেন? সিগ্রেট খাচ্ছিলে?
উঃ! সুনীলদাকে নিয়ে পারা গেল না। বাচ্চাদের সঙ্গে সিগ্রেট খাব?
--অমিয়? তুমি হলে সিনিয়র। তুমিই বল। দরজা বন্ধ করে এখানে কী হছিল? কোন মহৎ কর্ম?
অমিয়দা থতমত খেয়ে বলে-- রিহার্সাল।
সুনীলদার ভুরু কুঁচকে যায়।
--কিসের রিহার্সাল?
-- গানের।
--মানে?
এবার আমাদের সম্মিলিত টিউবলাইট জ্বলে ওঠে।
--হ্যাঁ মহারাজ গানের,-- গানের রিহার্সাল!
--আসলে প্রেয়ারে একটা ছোট গানের দল সামনে বসবে, সুর ধরবে।
মানে, ইদানীং প্রেয়ার বড্ড বেসুরো হচ্ছিল।
-- কে বলেছে বেসুরো?
--কানাইদা মানে বড় মহারাজ। উনিই তো বললেন কিছু গাইতে পারে ছেলে জোগাড় করে ওদের রিহার্সাল দিয়ে তৈরি করতে। উনি পরীক্ষা নেবেন। তারপর ওরা নিয়মিত সামনের সারিতে বসে গাইবে।

গুরু এটা তুরুপের তাস খেলল। সবাই জানে সুনীল মহারাজ বেসুরো, তাই ধ্রুপদ রাগপ্রধান পারঙ্গম বড় মহারাজ কানাইদা ওনাকে বেশ কৃপার চোখে দেখেন। আর অমিয়দা মহারাজের গানের দলের-- বিশেষ করে কালীকীর্তনের-- স্থায়ী সদস্য। সুনীলদার সাহস নেই গান নিয়ে কানাইদার সামনে গিয়ে কিছু বলার।
কিন্তু উনি ভাঙবেন তবু মচকাবেন না।
--বেশ, কী রিহার্সাল হচ্ছিল শুনি।
অমিয়দার ইশারায় আমি গম্ভীর হয়ে ঘোষণা করিঃ
রাগ--মালকোষ, তাল--তেওড়া।
তারপর সবাই মিলে উঁচু গলায় চেঁচিয়ে উঠিঃ
' ক্ষাত্রবীর্য ব্রহ্মতেজ মূর্তি ধরিয়া এল এবার,
গগনে পবনে উঠিল রে ঐ মাভৈঃ মাভৈঃ হুহুংকার"।
সুনীলদা কনফিউজড! সবাইকে একবার দেখে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন-- চালিয়ে যাও। কিন্তু ডাইনিং হলে আসতে দেরি কর না। এক্ষুণি বেল পড়বে।
ও হ্যাঁ, অমিয়! তোমাদের তিনজনকে কানাইদা খাওয়ার পরে দেখা করতে বলেছেন। তোমরা কিসব রাতপাহারা শুরু করেছ করছ নাকি ?

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in
১১

মেনকা গ্রাম থেকে এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হয়েছে।এম.এ পড়ছে।লেডিস হোষ্টেলে থাকে।অনেক বান্ধবী আছে।ঠিকমত সময়ে খেয়ে নিয়ে একসাথে যাওয়া আসা করে।মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়ি যায়।ছুটি থাকলে গ্রামে যায়।একদিন সকলে চিড়িয়াখানা গেলো।সেখানে পশু পাখিদের দেখে খুব আনন্দ পেলো সবাই।মেনকা খাবারের জোগাড় করলো।ডিম টোষ্ট আর শস,সঙ্গে স্যালাড।মেনকা বললো বান্ধবী সোমাকে,জানিস আমাদের গ্রামের বাড়ি মাটির ছোটো বাড়ি।বাবা বলেন যতই ছোটো হোক বাড়ি হলো মন্দির।জানিস আমার মা ছোটোবেলা থেকে আমাকে শেখাতেন, একটা পাখির বাসাও ছোটো। কিন্তু অবহেলার নয়।কত পরিশ্রম করে তিলে তিলে একটা বাসা তৈরি হয়। কোনো মন্দির,মসজিদ,গির্জা ছোটোবড় হয় না।সবখানেই সেই একই মালিকের বাস। সোমা বললো,তোর কথা শুনতে ভালোলাগে।আমদের ভারতবর্ষ মহান।

চিড়িয়াখানা থেকে ফিরে রাতে ভাত, তরকারী আর মাছের ঝোল খেলো ওরা।তারপর ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে উঠে সকলে প্রাতঃরাশের পরে গল্প করতে বসলো।আজ ছুটির দিন।মেনকা তার গ্রামের মেলা যাবার বর্ণনা করলো।সবাই মন দিয়ে শোনে তার সত্যি গল্প,তার জীবনের গল্প।বুঝলি সোমা একবার গ্রাম থেকে

গোরুর গাড়ি চেপে দধিয়া বৈরাগ্যতলার মেলা যাচ্ছি। পিছনে বাঁধা রান্না করার সরঞ্জাম। মেলা গিয়ে রান্না হবে। বনভোজন। সঙ্গে মুড়ি আছে। বড়দা বললেন,গিয়ে প্রথমে মেলা ঘোরা হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। মা বললেন,তোরা ঘুরবি আমি আর মানা রান্নাবান্না করবো। তারপর দুপুরে মেলা ঘুরবো। গাড়ি চলেছে ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দে। গোপাল কাকা বললেন,আরে, দেখ দেখ জিম চলে এসেছে। বড়দার ভয়ে ব্যাটা গাড়ির তলায় হাঁটছে।

জিম নেড়ি কুকুর হলেও, আমরা ওকে জিম বলেই ডাকি। কুকুর ভাবি না। অনেক মানুষের থেকেও ওর ভব্যতা অনেক বেশি।

আর একটা মেলায় যেতাম। পঞ্চাননতলার মেলা যেতে একটা আল রাস্তা ছিলো। আমরা ছোটোবেলায় বারবার ওই রাস্তা ধরে আসা যাওয়া করতাম। দুপাশে কাদা ভরতি ধানের জমি। কি করে কাউকে ওই কাদায় ফেলা যায়, এই কুবুদ্ধি আমাদের মাথায় খেলা করতো। আর তাই হতো। ধপাধপ কাদায় পরে যেতো অনেকেই। আর আমরা কি মজা, কি মজা করে চিৎকার করতাম। মার খেয়েছি খুব। বদ বুদ্ধির জন্য। যাইহোক, গোরুর গাড়ি একবার থামলো। তামালদা আর আমি জমি দিয়ে হেঁটে গেলাম। দেখলাম আখের জমি। বললাম,একটা আখ খাবো। তামালদা বললো, না পরের জমি।

--- একটা তো, কিছু হবে না।

--- যাও, তাড়াতাড়ি আসবা।

তারপর একগাছা সরালো আখ ভেঙ্গে খেতে খেতে চলে এলাম।

গোরুর গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। দিগি দিগি, পা পা, করে গোরুর সঙ্গে কথা বলে চলেছে প্রিয় তামালদা।

মন্থর গতিতে পৌঁছে গেলাম সকালের টাটকা মেলায়। ভোরবেলায় বেরিয়েছি বাড়ি থেকে। প্রায় কুড়ি কিমি রাস্তা চার ঘন্টা লাগলো। তবু ক্লান্তি নেই। মা বললেন,প্রথমে জল এনে এই ড্রাম ভরে ফেল।

জল ভরার পরে আমরা মেলা ঘুরতে চলে গেলাম। কাঁচের চুড়ির দোকান পার করে নাগরদোল্লা। চাপলাম। ভয় নেই। মনে মজা।

তারপর ঘুরে ঘুরে দেখার পালা। একই জিনিস ঘুরে এসে দেখে নতুন লাগছে। চির নতুন। কেউ বিরক্ত নয়। সবাই অনুরক্ত মানুষের ভিড়ে। এই প্রবাহ পুরোনো হবে না কোনোকালে।

বড়দা বললেন,অনেক হয়েছে। এবার খাবে চলো। মায়ের কাছে গিয়ে দেখলাম, মুড়ি, তেলেভাজা, আর রসগোল্লা রেডি। ঘুরে ঘুরে খিদে পেয়েছে। খেয়ে নিলাম। জল খেয়ে ধড়ে প্রাণ এলো। এলো আনন্দ।

মানা পিসি বললেন,চল আমি আর তুই একবার মেলা ঘুরে আসি। পিসি প্রথমেই চিতার কাছে গিয়ে বললেন,সব থেকে সত্য, এই চিতা। পিসি খুব তাড়াতাড়ি এই সত্যের সন্ধান কিছুদিন পরেই পেয়ে গিয়েছিলেন।

তামাল দা মাকে বললো,দিদিমুণি, ত্যাল দিন তো। আর ওই খোলের বাটিটা। গরুগোলাকে খেতে দি ভালো করে। ত্যাল মাকিয়ে দোবো। ওরাও তো মেলায় এয়েচে। অবিচার করলে হবে না।

মা বললেন,যাও, দাও গা। ভালো করে খেতে দাও।

মা রান্না সারার পরে একবার মেলায় গেলেন। আমার ঘুরে ঘুরে পায়ের ডিমিতে লাগছে

তবু মেলা না দেখে মন মানছে না। ক্লান্তি ভুলে অবাক চোখ চালানো সারা মেলা জুড়ে। কোনো কিছু দেখা বাকি থাকলো না তো? তাহলে বন্ধুদের কাছে হেরে যাবো। বন্ধুরা বলবে, কেমন মেলা দেখলি। আমরা সব দেখেছি।

আর দেখলাম মানুষের আবেগের রঙীন খেলা। কেউ নাগরদোল্লায়।কেউ খাবার দোকানে। আর অনেকে শুধু ভবঘুরের মতো চরকী পাক খাচ্ছে ভিড়ের মাঝে। মেলায় মিলন মানুষে মানুষে।জাতিতে জাতিতে,বললেন গোপাল কাকা।

এই মেলায় হরিনাম এক প্রধান আকর্ষণ। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক ভক্তের মায়া।

আমার ঈশ্বর,আমার অনুভব,ভালোবাসা একান্তই নিজস্ব অনুভূতি। আমার জ্যান্ত ঈশ্বরের পরম করুণাময়ের সঙ্গে মিলিত হবার শেষ আয়োজনের শুরু হয়েছে। মনে পরছে, আমার সামনে থেকেও রকেটের দাগের মতো মিলিয়ে গেলো বন্ধু। গঙ্গার জলে ডুব দিয়ে আর উঠলো না নীলমণি। রোজ আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বল জ্বল করে আমার অশ্রু আয়নায়। হাওয়ায় ওড়া আমার বেহিসাবী মন আজও দেখতে পায় অনন্ত আকাশে তার বিচরণ।

দুপুর ঠিক দুটোর সময় মা খাওয়ার জন্য ডাকলেন। মা বললেন,থালাগুলো জল বুলিয়ে নিয়ে এসো সবাই।

তারপর গোল হয়ে সবাই বসে পরলাম খেতে। মাটিতে বসে খেতে শুরু করলাম। আমি কলাপাতায় খেতে ভালোবাসি। এতো খাওয়া নয়,স্বপ্ন জগতে বিচরণ। এই ভালোলাগা বার বার আসে না। অকৃত্রিম আনন্দের জগৎ এই মেলা।

সবার খাওয়া হয়ে গেলে মা ও মানা পিসি বসলেন খেতে। সবাইকে প্রথমে খাইয়ে তারপর নিজের খাওয়া। তাই ভারতমাতার সন্তানরা দেশের দশের জন্য সব ত্যাগ করতেও কুন্ঠিত হয় না। মায়ের কাছে এই শিক্ষা তারা পায় ছোটো থেকেই।

তারপর বাড়ি ফেরার পালা। অনেক মৃতদেহ আসছে শ্মশানে। বলো হরি, হরিবোল ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত। তারা ফিরছে আপন ঘরে। আমরা ফিরছি গ্রীনরুমে।


সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মা চিন্তা করছেন। তামালদাকে বললেন,তাড়াতাড়ি ডাকাও। গোরু দুটোকে তামালদা বলছে,হুট্ হুট্,চ,চ দিগি দিগি। গোরু দুটো ছুটতে শুরু করলো। খুব তাড়াতাড়ি চললাম। টর্চের আলোয় রাস্তা দেখছি সবাই। হঠাৎ রে রে করে দশজন ডাকাত পথ আগলে দাঁড়ালো। দে যা আছে বার কর। হাতে তাদের বড় বড় লাঠি। মা বললেন,বললাম তাড়াতাড়ি করে বাড়ি চলে যায় চ, তোরা শুনলি না আমার কথা।
হঠাৎ তামালদা আর বড়দা নেমে লাঠি কেড়ে নিয়ে বনবন করে ঘোরাতে লাগলো। আমরা গাড়িতে বসেই দেখতে লাগলাম লাঠির ঘায়ে ডাকাতগুলোর মাথা ফেটে রক্ত পরছে। সবগুলো শুয়ে পরে হাত জোড়া করে ক্ষমা চাইছে। মা বললেন,ছেড়ে দে। উচিত শিক্ষা পেয়েছে বাঁদরগুলো। খেটে খাগা যা, পালা।

তারপর তামালদা ও বড়দা লাঠি দুটো নিয়ে সামনে বসলো। বড়দা বলছে,আয় কে আসবি আয়। সেই কেড়ে নেওয়া লাঠি আজও আছে। মা বলতেন,অন্যায় করবি না,আর অন্যায়ের সাথে আপোষও করবি না।

মনমতো পছন্দের মামা আমাদের খুব প্রিয় ছিলেন। যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ,ডিম,মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া,সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল,ডাল,মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকর টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল,ডাল,গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে মামা নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা,মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর,গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো।আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিসটার্ব হতো।একদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ছেলেধরার গুজব উঠেছিলো। আমরা দুপুরে খেলছি। দাদু বার বার বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,আজ কিন্তু ছেলেধরা আসতে পারে। আমি খুব ভিতু ছিলাম। আমার মামার ছেলে বাঁটুলদা,হোবলো,ক্যাবলা,লেবু। সবাইকে বললাম। তখন বারো থেকে পনেরো বছরের পালোয়ান আমরা। সকলের ভয় হলো। মামা কোনোদিন মিথ্যা বলেন না। কথার মধ্যে কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,এই অঙ্কটা পারবি। পড়ে দেখ। আমি বললাম,বোধহয় পারবো। তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কি? হয় বল না, কিংবা হ্যাঁ। নো অর ইয়েস। ধমকের চোটে কেঁদে ফেলেছিলাম। এই সেই মামা বলেছেন, আজ ছেলেধরা আসবে। সাবধান। সবাই ঘুমোবি। দুপুরের রোদে বেরোবি না। বাধ্য হয়ে শুলাম। দাদুর নাক ডাকা শুরু হলেই সবাই দে ছুট। একেবারে বাদাম তলায়। চিনে বাদামের একটা গাছ ছিলো। ঢিল মেরে পারছি। এমন সময়ে মুখ বেঁধে ছেলেধরা হাজির। হাতে বস্তা। বস্তা ছুড়ে ঢাকা দিতে চাইছে আমাদের। আমরা সকলেই প্রাণপণে বক্রেশ্বর নদীর ধারে ধারে গিয়ে মাঝিপাড়ায় গিয়ে বলতেই বিষ মাখানো তীর আর ধনুক কাঁধে বেড়িয়ে পড়লো। বীর মুর্মু। সাঁওতাল বন্ধু। ছেলেধরা তখন পগাড় পাড়। আর দেখা নেই। বড়ো হয়ে সত্য কথাগুলি জানতে পেরেছি। মামা ওই সাঁওতাল বন্ধুকে বকেছিলেন,ছেলেগুলোকে ভয় দেখাতে নাটক করছিলাম। আর তুই এক নম্বরের বোঙা। একবারে অস্ত্র হাতে। যদি মরে যেতো ছেল অনেক গল্প শুনেছিলাম দাদুর বীরত্বের গল্প। মা তার নিজের গল্পও বলেছিলেন অনেক।আমার মনে পরে সেইসব কথা।

গল্প বলতে বলতে কখন যেনো মেনকার চোখে জল এসে গিয়েছিলো।সোমা জল মুছে দিলো।বললো,আর পনের দিন পরেই পুজোর ছুটি।সবাই বাড়ি যাবো।কি মজা বল।মেনকা বললো,ঠিক বলেছিস।

0 comments: