0

সম্পাদকীয়

Posted in

সম্পাদকীয়


সন্দেহ নেই, খুব একটা অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি। দিন কয়েক আগে, একটা কাজে গিয়েছিলাম ভুবনেশ্বরে। ফনি তার দাপট দেখিয়ে চলে যাওয়ার ঠিক ক'দিন পরেই। শুনলাম, একদিনে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের ক্ষতির পরিমাণ ৪০০ কোটি টাকা। মন্দিরের ঐতিহ্যশালী ধ্বজা ছিঁড়ে গেছে হাওয়ার তোড়ে। গর্ভ মন্দিরের চূড়ার ফাটল দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছে জল। খারাপ লাগছিলো ছোটো ব্যবসায়ীদের কথা ভেবে। বাঙালীর সেই চির চেনা পুরোনো পুরী ফিরে পেতে বেশ কিছু দিন লাগবে বলেই স্থানীয় মানুষেরা মনে করছেন।

এদিকে আবার দুদিন আগেই ধুমধাম করে সারা দেশ জুড়ে সু(?)সম্পন্ন হয়ে গেল লোকসভা ভোট পুজো। যতটা অশান্তি ঝঞ্ঝাট হবে বলে আশা করেছিলাম, ততটা হলোনা... সেটাই বিশেষ সন্দেহজনক। মানুষের শুভবুদ্ধির ওপরে আস্থা হারানো অন্যায়, তবুও ইদানীং সবসময় সেই অন্যায় না করতে পারছি কই! 

এই প্রচণ্ড গরমে নিজেকে সুস্থ রাখুন, শীতল রাখুন...

শুভেচ্ছা নিরন্তর...

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - চিত্তরঞ্জন হীরা

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


কিছুটা বাস্তব, কিছুটা কল্পনা
চিত্তরঞ্জন হীরা 



#

ভাবছি, ভেবেই চলেছি। বোধ চেপে ধরছে বিবেককে, বিবেক সত্তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে - ইতিহাস তো থেমে থাকে না, তাহলে সমাজ-সভ‍্যতাকে যখন পাল্টে যেতে দেখি, তখন পুরোনো বাস্তবের সঙ্গে নতুন বাস্তবের সংঘাত নিয়ে আমাদের সংশয়টা কীসের! নতুনকে আমরা সহজে মেনে নিতে পারিনা কেন?

এই 'কেন'র দ্বন্দ্বমূলক বিস্ময়গুলিই আমাদের কিছুটা নতুন পথের সন্ধান দিতে পারে। কিন্তু আমরা কি সঠিকভাবে প্রশ্ন করতে শিখলাম! মাঝে মাঝে আমরা ভুলে যাই, অতীত মানেই সবটুকু ছেড়ে যাওয়া নয়। কালচেতনায় নিত্য বর্তমানের সঙ্গে কাছের অতীত এবং দূর ভবিষ্যতের একটা নিরন্তরের বন্ধন রয়েছে। কারণ মুহূর্তের বর্তমান যেমন মুহূর্তেই অতীতের দিকে ঢলে পড়ছে, তেমনি সময় তার চরাচর থেকে নাদেখা ভবিষ্যতকেই বর্তমানের হাতে তুলে দিচ্ছে। যা কিছু ঘটনা তার সবটুকুই এর মধ্যে ঘটছে, ঘটে চলেছে। এটা বিশ্বসংসারের আবহমান রীতি, এটাই সংস্কৃতি। আজ আবার নতুন করে সময়ের এক বিশেষ আবর্তে সে এসে দাঁড়ালো আর আমরা দুলে উঠলাম তার অন্তরের অন্তে স্থিত গভীর আলোড়ন নিয়ে। এই দুলে ওঠাটাই স্রষ্টার অনুভব।

# # #

এটা কোনও বিশেষ ভূমিকা নয়। শুধু ভাবছি আর ভাবা অভ‍্যেস করছি। ভাবতে ভাবতে প্রশ্ন জাগছে এই মুহূর্তে আমাদের অবস্থান নিয়ে। পুরোনো বাস্তবের সংঘাতটাকে আসলে দেখব কীভাবে! আমাদের বাইরের যাত্রার সঙ্গে ভেতরের অস্থিরতাকে মেলাবো কোন বিন্দুতে! কিছুটা দিশেহারা তো বটেই। এ কোথায় চলেছি আমরা! 

আরও একটা বড় কথা হল, এখন আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতার হাত ধরে ব‍্যক্তিবোধের বৃত্তটা বড় হতে হতে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেচে যে, কেউ কারো থেকে নিজেকে ছোট ভাবতে একটুও রাজি নই। এই ব‍্যক্তিবোধের নিরিখে বা ব‍্যক্তিস্বাতন্ত্রের আলোয় ইতিহাসকে বিচার করতে বসলে সে নিজেই তো বিবর্ণ হয়ে যাবে!

#

এতটা নেতিবাচক না হয়ে আমরা নাহয় একটু অন‍্যভাবেও ভাবি। এই যেমন সময়কে কি একেবারে নিরাবসানে দেখা সম্ভব! অর্থাৎ, যার কোনও শুরু নেই, শেষও নেই! আমরা দেখছি, চারপাশের বিন‍্যাস ভাঙছে,শাসন ভাঙছে, শাসনতন্ত্র ভাঙছে, এর কি কোনও দীর্ঘসূত্রতা নেই! নিশ্চয়ই আছে। আমরা যারা দেখতে চাইনি তাদের কথা আলাদা। কিন্তু প্রতিটি নতুন সৃষ্টির পেছনেও তো একটা ভাঙন থাকে। আলোড়ন থাকে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই একদিন একটা গোলাপের শিশুমুখ ঠিক জেগে উঠতেই পারে। জাগরণের জন্যেই আরেকটু বেশি জাগা। আরেকটু অপেক্ষার পা নয় সামনে বাড়িয়ে রাখা হল!

#

এভাবেই শুরু করা যেতে পারে এমন এক নতুনের খোঁজ, যার মধ্যে ব‍্যক্তিসুখের লালসা থাকবে না, উৎসমুখের দ্বারটি খুললেই জ্বলে উঠবে এমন একটি শিখা, যার আলোয় সীমার বাঁধন কেটে যাবে, শুরু হবে আত্মোৎসব। এ হল একটি সরলরেখার দুটি মুখ দুদিক থেকে টেনে বাড়িয়ে ধরা। অনিঃশেষের গন্তব্যে আর কোনও দুঃখ থাকবে না।

তাহলে আমাদের এটাও ভেবে দেখা দরকার, এই অনিঃশেষের প্রতিটি মুহূর্তকেই বা কীভাবে উপলব্ধি করতে চাই আমরা! শাশ্বত প্রাণ খেলছে ধুলোমাটিতে আপন শৈশব নিয়ে। হেসে খেলে সে যে ধুলোতেই লুটায়। এ কি প্রাণের মহিমা নয়!

#

একে যিনি গর্ভে ধারণ করতে পারেন, তিনিই স্রষ্টা। সে যখন গর্ভমুক্তি চায় তখন ভাষাই তার প্রধান অবলম্বন হয়ে ওঠে। ভাষাক্ষেত্র। এই ক্ষেত্রভূমির উপর দাঁড়িয়েই আগামীকে দেখার ইশারা আসে। একটা চলমান সিঁড়ি আমাদের নিয়ে চলেছে এমন এক গন্তব্যের দিকে, যেখানে কোনও বিষাদ নেই, অবিকল্প নেই। চলতে চলতে শববাহকেরা গাইছে পুনরুজ্জীবনের গান।

চলমানতার বিরুদ্ধে সবসময় একটা ষড়যন্ত্র করেই চলেছে অচলতা। কিন্তু একটু নিবিড় হলেই অনুভব করা যায়, সমস্ত স্থবিরতার মধ্যেই ঘুমিয়ে থাকে শিশুর পিতা। এখন আমরা বলতে চাই সেই-ই হল প্রাণের অস্তিত্ব। তাকে জাগাতে হবে। গাইতে হবে - "জাগাও পথিকেরে, ও যে ঘুমে অচেতন…"।

#

এর মধ্যে কি চেতনার প্রতিচ্ছায়া নেই! এও আমাদের ভাবতে হবে যে, সেখান থেকেই এক একটা অনিশ্চিত, এক একটা অসম্ভব এবং এক একটা অবাস্তবের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে চেতনার নতুন নতুন বাস্তবতা। যা তার অভিমুখ, অথচ ধরা দিচ্ছে না। তাকেই ধরতে হবে। 

যা ঠিক অবচেতনা থেকে উদ্ভূত নয়। পুরোনো বাস্তব এবং নতুন বাস্তবের মধ্যবর্তী এক আশ্চর্য কাল্পনিক অবস্থা। যেহেতু ভাবনা সত্য, সেইহেতু এই অবস্থাও বাস্তব। অবস্থার পুনরাবৃত্তি নয়, উজ্জীবনের হাত ধরে আরেকটি নতুন অবয়বের বাস্তবতাই সত্য হয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে একজন বিজ্ঞানীর সৃষ্টি এবং একজন কবির সৃষ্টির মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই।

#

ঘটনাটি কীভাবে ঘটছে! অন্তর্নিহিত শক্তির জাগরণের প্রভাবে। প্রতিটি কাল্পনিক বাস্তবতা প্রতি মুহূর্তে একটি নতুন কাঠামোর জন্ম দিতে চায়। এ তার স্বভাব অভ‍্যেস। এভাবেই অনিশ্চিতকে নিশ্চিত করে,অবাস্তবকে বাস্তবের সম্ভাবনা দেখায়। যেভাবে চাঁদের লাবণ্যে একটি নারীর মুখ বাস্তব হয়ে ওঠে, যেভাবে পূর্ণিমার গোটা চাঁদ ঝলসানো রুটির বাস্তবতাকে বোঝাতে সাহায্য করে। এভাবেই আরেকটি নতুন সম্ভাবনার জন‍্যে আবার একটা অনিশ্চয়তার দিকে হেঁটে যাই আমরা।

কিন্তু যখনই কোনও নতুন সম্ভাবনাকে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে কোথাও, তখনই বিরুদ্ধতার রব ওঠে। কেন? নতুনকে মেনে নেওয়ার ঔদার্য নেই বলে! নাকি অভ‍্যাসের চলনে আঘাত পড়ছে বলে? কে কিভাবে উস্কানি দেবেন বা বিবর্তনের ছাপ কোথা থেকে উঠছে, তার মধ্যে কোনও ঔপনিবেশিকতা রইলো কিনা, তাকে বুঝে ওঠার জন্যেও তো কিছুটা সময় চাই, অপেক্ষা চাই। কথা হল বিষয়টাকে দেখছেন কে কিভাবে!

#

বহুবারই একটি প্রসঙ্গ মনের দরজায় এসে টোকা মেরেছে যে, রবীন্দ্রনাথের lyricism-এর সঙ্গে সুধীন্দ্রনাথের intellectuality-র দ্বন্দ্বটি কি অবশ‍্যম্ভাবী ছিল না! এই সম্ভাবনাই বাস্তবে কবিতাকে নতুন বাঁকে এনে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। এবং আজ যদি আমরা অবচেতনার পরবর্তী স্তর খুঁজতে বসি, তাহলে কি বাংলা কবিতার খুব সর্বনাশ হয়ে যাবে! সময়ের চলমানতায় অবচেতনা বা পরাবাস্তবই শেষ কথা হতে পারে না। বা এখানেই থেমে থাকা সে অর্থে ইতিহাসের পক্ষেও খুব স্বাস্থ্যকর কি!

আরেকটু অন‍্যভাবেই নাহয় বিষয়টাকে ধরা যাক - বিষয়চেতনা বস্তুর রূপান্তরিত সত্তার গঠনকে বুঝতে ও চিনতে সাহায্য করে। এই চেতনা মনের এমন একটি অবস্থা যে প্রতি মুহূর্তের বর্তমানের মধ্যে আগামীর সম্ভাবনাকে খুঁজে চলেছে। বর্তমানের সঙ্গে আগত ভবিষ্যতের সংযোগ ঘটাতে অস্থির হয়ে উঠছে। স্রষ্টা এভাবে বিষয়চেতনার অস্থিরতার মধ্যে ছায়া ছায়া নতুন একটা অবয়বকে দেখতে পান। আবার কখনও কখনও ইতিহাসের পায়ের শব্দ শুনতে পান। যে ধ্বনি বাদ‍্যযন্ত্রের সমাহারও হতে পারে, নাহলে একাকী নৈঃশব্দ‍্যের কুহুতান হবে! একজন স্রষ্টার বিচিত্র অনুভূতি বিচিত্র সব দৃশ্যের অবতারণা করতে পারে। পাঠক যতক্ষণ না সেই অনুভূতির কাছাকাছি পৌঁছাতে পারছেন, ততক্ষণ তা অবাস্তব। যখনই ছুঁয়ে ফেললেন, তখনই তার মধ্যেও বেজে উঠল সেই সিম্ফোনিটা, যা থেকে তিনিও উপলব্ধি করতে পারছেন -

মগজ বাজছে মালকোষে।আর তুমি একাদশীর রাত
হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে যাচ্ছ আবাহন মুদ্রায় দাঁড়ানো
ঝাপসা এক ঘরের ভেতর।
(রামকিশোর ভট্টাচার্য)

একে আমরা ভাবনার সঙ্গে বোধের বা ধ্বনির সঙ্গে বাদ‍্যের সংযোগসাধন বলতে পারি, বা তার একটা দিশা …।

#

রবীন্দ্রনাথের lyricism-এর মধ্যে কি কোনও intellectuality ছিল না! বিষয়টা তা নয়, এর মধ্যে যে অতিক্রমণের আপ্রাণতা রয়েছে, তারই উদ্দেশ্যপ্রণোদনা। একদিকে স্বভাবসংযোগ অন‍্যদিকে ঐতিহ‍্যের প্রতিষ্ঠিত প্রবণতাগুলো থেকে বেরিয়ে এসে নতুন রূপকে শব্দকে বাজিয়ে তোলার সচেতন প্রক্রিয়া। এ হল টেকনিক বদলের পরিক্রমা। ইতিহাসে যা বারবার ঘটেছে।

আমরা আসলে একটা বৈজ্ঞানিকদর্শনের পথে হাঁটতে চাই, জীবনানন্দ যাকে বলেছিলেন 'বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিদিব‍্যতা'। এপথেই ধ্বনির আণবিক সত্তাকে উপলব্ধি করতে চাই। ধ্বনি থেকে শব্দ, শব্দ থেকে বস্তু, গোটা বিশ্ব এভাবে যখন বস্তু এবং অবস্তুর আণবিক সত্তায় একাত্মতা অনুভব করতে পারবে, তখন জীবন ও মৃত্যু নিয়ে আর কোনও কোলাহল থাকবে না। আমরা গেয়ে উঠতে পারবো -

এখনো তোমার চোখে আমার জীবন
এবং মৃত্যুর নড়াচড়া
যেভাবে আভোগ স্থায়ী বেঁধে রাখে সঞ্চারী অন্তরা।…
(মঞ্জুষ দাশগুপ্ত)

এখানে আরও একটু বলে রাখা ভালো, সত্যকে নতুন রূপে খুঁজে পাওয়া তখনই সম্ভব, যখন বস্তু-অবস্তুর কণাতরঙ্গে ধ্বনির প্রাধান্যকে অনুভব করা যেতে পারে। যার মধ্যে থেকে শব্দ আসছে নতুন ধ্বনিতরঙ্গ বেয়ে। ধ্বনিপ্রভাবেই সে বিশেষ হয়ে উঠছে।

#

বিশেষের বিশেষ‍্যও একটি চিহ্নমাত্র। বস্তুকে এবং অবস্তুকেও চেনা আমাদের এই চিহ্নায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। ভাষা যেমন সময়ভেদে, স্থানভেদে তার চিহ্ন বদলায়। বস্তুও ভাষাভেদে তার চিহ্ন বা নাম বদলায়। এই সরলসত‍্যটি বুঝে নিতে কেন যে আমাদের বিলম্ব ঘটে তা আজও উদ্ধার করা গেল না। আমরা শুধু অভিধানে অর্থ খুঁজে মরি। কিন্তু শব্দ কালে কালে অর্থের আধার বদলাচ্ছে, নতুন ধারকে সে নতুন নতুন বোধের জন্ম দিচ্ছে। স্বর, স্বরভূমি, স্বরক্ষেত্র তার বিস্তার ঘটাতে ঘটাতে পূর্ববর্তী চিহ্ন থেকে সরে আসছে। অর্থাৎ, আগের চেনা থেকে সরে আসছে। মুখের ভাষাও যেমন। আমরা একে তো 'বলাকথার বিবর্তন'হিসাবেও চিহ্নিত করতে পারি! অলৌকিক জ‍্যোৎস্নার ঘ্রাণ নিতে হলে আগে মধুচন্দ্রিমা চাই। চাই অনন্ত বাদাম ভেঙে ছড়িয়ে দেওয়া দানা দানা উপশম। আর তুলোর বিষাদ থেকে উত্থিত অনতিদূরত্বের সবুজবাগান গড়ে তোলা -

আপনার মণিবন্ধে কাঠবিড়ালির মত উঠছে, নামছে
আশৈশব স্বরবর্ণগুলি।
আপনার শাখায়, শিরায় দোল খাচ্ছে তাদের অজর নখর।
(ইন্দ্রনীল বিশ্বাস)

আপনার মানে আমার, আমাদের এবং অসংখ্য বহুবাচনিক ঘুলঘুলির প্রত‍্যাশা। যার মধ্যে বিবর্তিত কালের সেই উপশম, সেই শুশ্রূষা।

#

সময়ের কথা সময় বলবে। আমরা বলছি আমাদের একান্ত সহবাসের কথা, উপলব্ধির কথা। নিজেদের কথানদীর কথা। কিন্তু সময় কখনও পিছু ছাড়ে না। এই যে নিজের কথা বলব বলে সাতকাহন গাওনা বাজনা, সেও তো সময়ে দাঁড়িয়ে। অতএব দেখা যাচ্ছে সময় এবং কথা দুই-ই বহমান। সময় চলছে, শব্দও প্রবাহিত হচ্ছে নদীর মত। এক্ষেত্রে ছবিটা এমন, শব্দ=নদী, নদী=সময়, সময়=জল। অতএব জল=শব্দ। তাহলে কবিতা যেহেতু শব্দনির্ভর এবং শব্দ মূলত ধ্বনিনির্ভর, ফলে চলমান সময়ের ধ্বনিবৈচিত্রে কবিতার শব্দযোজনাও পাল্টে যেতে পারে। এই জলতরঙ্গে জীবনের ভাষাও বাজছে। প্রতিমুহূর্তে সুর পাল্টে পাল্টে পৌঁছে দিচ্ছে আমাদের কানে কানে।

এই বিজ্ঞান ও দর্শনকে আমরা গ্রহণও করতে পারি, আবার নস্যাৎও। জীবনকে যে যেভাবে দেখছে। শিল্প চলবে শিল্পের মত। আমাদের ব‍্যক্তিসত্তা এবং সৃষ্টিসত্তা এক নয়। ব‍্যক্তির ভেতরবাড়ি অস্থির না হলে সৃষ্টির আলোড়ন ঘটতে পারে না। এই আলোড়ন হল সত্তার জাগরণ। এই আলোড়ন একজন স্রষ্টাকে বাইরের সমস্ত টানাপোড়েন, অসঙ্গতি, হর্ষ-বিষাদ একেবারে অন‍্যভাবে দেখতে শেখায়। সবটা ভেতরে নিয়ে তিনি এবার খেলায় মাতবেন। অক্ষরের বীজ নিয়ে খেলা। নানা রহস্য তাঁকে টানছে-

ছবিতে যে সন্ধ্যামালতী পাঠিয়েছিলে
সে আমায় একা রাস্তায় ফেলে যায়,
রোবট পাখির দোয়া লাগা
সমানুপাতে।
(ধীমান চক্রবর্তী)

এই হল রহস‍্যের আরেক রূপ। ভাঙতে ভাঙতে অবাককেই দেখছি বাঙ্ময় হয়ে উঠতে, কখনও তরঙ্গ রূপে, কখনও তরঙ্গ-অভিভূত আলো রূপে, কখনও বুদবুদ-আভাসে। সে এক আশ্চর্য গর্ভমুক্তির খেলা। সমস্ত রহস‍্যই রয়েছে ঐ সৃষ্টির উৎসমুখে। আলোর অশ্বদল ছুটছে, ধাবিত হচ্ছে আসঙ্গ নিঃসঙ্গের অনুষঙ্গ নিয়ে।

# # #

এভাবে আমরা বারবার উৎসেই ফিরে যেতে চাই, আর উদ্ধার করতে চাই চিরনতুনের অপরূপ আত্মাকে। রূপ থেকে অরূপে, অরূপ থেকে অপরূপে যার নিরন্তর যাত্রা। এর মধ্যেই জীবন ও মৃত্যু, আলো ও অন্ধকারের জাগতিক লীলাখেলা। রাত্রির যখন প্রসব হল নাম রাখা হল নৈঃশব্দ্য।

#

যাহোক, বস্তু থেকেই বাস্তব। একটি বস্তুকে ভাঙতে ভাঙতে যা পাব, সেই এককেই তার প্রাণবিন্দু। ধরা যাক তাকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরে নিক্ষেপ করা হল, সেখানে তার রূপের স্বরূপ কি? আমরা কীভাবে জানব! এখানেই কল্পনার বাস্তবতা। বস্তু বা অবস্তুর ভিন্নবাস্তব। কল্পনাই পারে তাকে একেবারে কাছে এনে দিতে। আর সেটি পারেন একমাত্র কবিই -

এককোণে জন্মদিন পড়ে আছে। আজ এই মৃত্যুবার্ষিকীতে
হে শ্মশানপাড়ার বন্ধু, তুমি স্রোতমাঝে এই দেহখানি রাখলে -
এতে যদি হাসি পায়
সাক্ষী থাকো চন্দ্রালোক, শীতে
(অরুণাংশু ভট্টাচার্য)

দুটি প্রাণ তখন যেন অবাধে এপিটাফ ফেলে অবাধে গেয়ে উঠছে একই গান - 'আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে'।

#

তো সেই আনন্দ এবং ধ্বনির সংযোগে রচিত হল বিশ্বটি, সেখানে কেন্দ্রের আর নির্দিষ্ট কোনও অবস্থান নেই। বিকেন্দ্রিক বা বহুকেন্দ্রিক। যদিও শিল্প যখনই তার চলাচলের কেন্দ্রকে অচল হতে দেখে, নস্যাৎ করতে চায়, বাতিল ঘোষণা করতে চায়। সে নিজের মতই ঘুরতে ঘুরতে অনির্দিষ্টের দিকে চলে যেতে চায়। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিদিব‍্যতার অভাবে আমরা শুধু পেছন পানে টানি। কিন্তু এই চাওয়াটা তার অভীষ্ট। তা নাহলে শিল্প বা সভ‍্যতার ক্ষেত্রে বিবর্তন কখনোই সম্ভব হতো না। সে একটা সম্ভবকে প্রথমে অসম্ভব করে। তারপর অসম্ভবের সম্ভাব‍্য বাস্তবগুলো ছড়িয়ে রাখে আলোর অন্ধকারে।

আসলে শিল্পবোধ বা পাঠের ক্ষেত্রে আমরা বেশির ভাগ সময়েই প্রভাবের উস্কানিতেই আটকা পড়ে থাকি। এটা স্বভাব অভ‍্যাস। অভ‍্যাস থেকে স্বভাবে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডী কাটা রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে স্বভাব হল সংকটতাড়িত, এই সংকট জন্ম নেয় তলে তলে ভাবের বসত থেকে। মন এবং চরিত্রকে সে চালিত করে, নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু নিয়ন্ত্রণাধীন ভাবের মধ্যে অভাবই বেশি। একটা সীমাবদ্ধতা, একটা দৈন‍্য আমাদের পেয়ে বসছে, আমরা বুঝতে পারছি না। কেউ কেউ বুঝতে চাইছিও না। যখন বাঁধন কেটে খোলা হাওয়া প্রাণে লাগাবো, তখনই সংকটমুক্তি ঘটবে। আমাদের মনে রাখা বিশেষ জরুরি -

যেহেতু কবিতা শব্দশিল্প, সেহেতু শব্দের প্রচলিত দ‍্যুতি ব‍্যবহারে ব‍্যবহারে কমে আসতে থাকে এবং এই ক্রমক্ষীয়মান দ‍্যুতির উপর নির্ভরতা নতুন কবি যত দ্রুত কমিয়ে আনতে পারবেন ততই তার পক্ষে তা মর্যাদাব‍্যঞ্জক হবে।
(মঞ্জুষ দাশগুপ্ত)

এক্ষেত্রেও সেই ভাব - অভাবের কথা বলতে হয়। অভাবকে যতক্ষণ না আমরা সম‍্যক দেখি, ততক্ষণই নিজের ভেতর রচিত দৈন‍্যে বিচরণ করতে থাকি। আর ভাবি আপন আলোর ঐশ্বর্যে পৃথিবীকে কতই না আলোকিত করে চলেছি!

#

যেকোনও শিল্পকর্মে শোধন প্রক্রিয়াটি ভীষণই আবশ্যিক। প্রথমত আত্মসংশোধন। লেখকের বিশেষ চাতুর্যে তাঁর সৃষ্টির মধ্যে আবেগের তারতম্য থাকে, চোরাস্রোত থাকে। পাঠক যদি আবেগের ফাঁদে পড়েন বা অভ‍্যাসের ফাঁদে আটকা পড়ে থাকেন, তাহলে নতুন আলোর দ‍্যুতিকে স্পর্শ করতে পারবেন না। একজন লেখকের ক্ষেত্রেও যে কথা খাটে।

জীবন বড় একা। কবি তারচেয়ে আরও বেশি। একাকীত্ব কবির স্বপ্নভূমি। সেই ভূমিতে অষ্টচরণ ষোলো হাঁটু তিনি ছড়িয়ে দিয়ে আলোর পরত খুলবেন, এটাই বাস্তব। সমস্ত ঘোর কাটিয়ে তিনি নিজেকে টেনে নিয়ে যাবেন সেই অনির্দিষ্টের দিকে, যা হল একটা অতলগহ্বর, সেখানেই লুকিয়ে আছে যাবতীয় অসম্ভবের সম্ভবতা। বাকিটুকু নিছক কল্পনা…।

0 comments:

2

প্রবন্ধ - পল্লববরন পাল

Posted in

প্রবন্ধ


সুভাষ, ‘যত দূরেই যাই’ ও আমরা
পল্লববরন পাল



এক

স্টাইলটা কুড়ি বছর পুরনো
মেড্‌-ইন-মুম্বাইয়ের চেয়ে ঢের পুরনো,
দু’হাজার বছর ধরে নাগাড়
সুপারডুপার হিট নায়কের পেটেন্ট নেওয়া
সিক্সপ্যাক উলিডুলি মেষশাবক স্টাইলে
(মুম্বাইমার্কা কোমর ভাঙা ঝিংচ্যাক ছ’টা বাজতে পাঁচ নয়,
রীতিমতো খালি গা মেরুদণ্ড টানটান, ঋজু)
দু’হাত দু’দিকে প্রসারিত
শুয়েছিলো টেবিলের ওপর
সুভাষ মুখুজ্জের ‘যত দূরেই যাই’ – ১৯৬২
ত্রিবেণী প্রকাশন, দুই শ্যামাচরণ দে স্ট্রীট, কলকাতা বারো
উৎসর্গ – বন্ধু অশোক ঘোষকে
সাতান্ন পাতার বই - আটাশটা কবিতা
মলাটে পূর্ণেন্দু পত্রী – দাম তিন টাকা

যদিও দু’হাজার বছর বয়সী
সেই ছোকরা স্টারের কথা মনে হলেই
যে চার লাইন পেরেক ঠোকে
আজীবন
আমার মগজের ক্রুশকাঠে,
সেটা ১৯৬৬-তে প্রকাশিত ‘কাল মধুমাস’এর
খোলা দরজার ফ্রেমে –
ল্যাম্পপোস্টে ফাঁসি যাচ্ছে দেখ,
ল্যাম্পপোস্টে
দেখ, ফাঁসি যাচ্ছে
পুরোনো বিজ্ঞপ্তির ছেঁড়া চাটাই
ফাঁসিতে লটকে থাকা নয়
শুধু যাওয়া
তীব্র এক গতি
একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি 
আমাদের ডালভাতচচ্চড়ি বাঙালি স্মৃতিতে 
ক্ষুদিরাম দীনেশ গুপ্ত আর ওনার পরে
সেই প্রথম
সেই প্রথম অন্য কেউ, মানে অন্য কিছু ... মানে
এ ম্যাঁ –
শেষোব্দি ছেঁড়া চাটাই?
ঈশ্‌শ্‌

সে যাই হোক,
আসলে টেবিলের ওপর খালি চায়ের কাপের পাশে
‘যত দূরেই যাই’ খুলে রেখে
বাজারের ব্যাগ হাতে উঠে গিয়েছিলেন বাবা
ঠিক উল্টোদিকে খোলা পাতায়
ইস্কুলের হোমটাস্ক করাবেন বলে 
ভাঙনধরা অজয়নদীর বাঁকে
বাড়ির দাওয়ায় বেত হাতে রাগীরাগী কুমুদ মল্লিক,
কিন্তু গোঁফগজা বয়সের নিষিদ্ধ আকর্ষণে
কৌতূহলী ঘাড় রাজহাঁসের মতো বাড়িয়ে দেখি
উরিস্যাবাশ!
সামনের বইয়ের পৃষ্ঠায় আরও এক
পরমাসুন্দরী নদী
পায়ে তার ঘুঙুর বাঁধা
পরনে
উড়ু-উড়ু ঢেউয়ের
নীল ঘাগরা

সে নদীর দু’দিকে দুটো মুখ।

এক মুখে সে আমাকে আসছি ব’লে
দাঁড় করিয়ে রেখে
অন্য মুখে
ছুটতে ছুটতে চলে গেল। - [যেতে যেতে]

ব্যাস, এক ঝটকায়
ঝুলি উপচানো রূপকথার ব্যাঙ্গমা জলে 
মুহূর্তে ধুয়ে মুছে সাফ
অজয়, কুমুদ, রাঢ় বাঙলা, হোমটাস্কের টেবিল
আমার হাপ্প্যান্ট-ইশকুল
আমি যত দূরেই যাই
আমার সঙ্গে যায়
ঢেউয়ের মালা-গাঁথা
এক নদীর নাম –
আমি যত দূরেই যাই

আমার চোখের পাতায় লেগে থাকে
নিকোনো উঠোনে
সারি সারি
লক্ষ্মীর পা... - [যত দূরেই যাই]
নদীর সেই ‘আসছি’মুখে
লক্ষ্মীছেলের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই 
কার্ণিশ টপকে
পাঁচিল ডিঙিয়ে
একমুখ থেকে অন্যমুখ
উৎস থেকে মোহনা
বড়ো হয়ে যেতে যেতে
তারপর সেই রাজকন্যা
আমার আঙুলে আঙুল জড়ালো।
আমি তাকে আস্তে আস্তে বললাম -
তুমি আশা,
তুমি আমার জীবন।
গোঁফদাড়ি বীর্যপাতে গোবেচারী অভিজ্ঞতা -
সেই রাক্ষুসিই আমাকে খেলো - [যেতে যেতে]


দুই

ছোটোবেলায় ধোপাদের কাপড়কাচার শব্দ শুনতেন তিনি বাড়ির পিছনে, তাঁর কানে লেগে ছিল সেই তাল, আর ছিল লোকমুখের স্পন্দের উপর ভর করার সাহস, কথার চালগুলি ভালো করে লক্ষ করবার ইচ্ছে। ভেবেছিলেন, লিখতে হবে ঠিক তেমন করে, যেমনভাবে কথাবার্তা বলে লোকে, ছন্দকে তুলে আনতে হবে কেবল সেইখান থেকে। আর, ঠিক সেখান থেকে তুলতে পেরেছেন বলেই বাংলা অক্ষরবৃত্তে একটা স্বাভাবিক বাচন তৈরি হয়ে গেছে তাঁরই কবিতার পথ ধরে।’ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবি হয়ে ওঠার প্রস্তুতিপর্ব শুনিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ, কুড়ি বছর আগে তাঁর সময়ের জলছবিতে।বহরমপুরে এক সন্ধ্যার অন্ধকারে পথ হাঁটতে হাঁটতে সুভাষ আর শঙ্খ কথা বলছিলেন। অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মাত্রারীতিতে তিনি যে প্রায় বৈপ্লবিক এক বদল এনে দিয়েছেন, তা নিয়ে সুভাষ উত্তর দিচ্ছিলেন শঙ্খের প্রশ্নের, বলছিলেন, বিশ্লেষণ করা ছন্দজ্ঞানের দরকার হয় না কবির, দরকার হয় কেবল বোধময় ছন্দজ্ঞানের।

[কলকাতার কড়চা - আনন্দবাজার পত্রিকা - ১২ই ফেব্রুয়ারি ২০১৮]

বাঁদিকের বুক-পকেটটা সামলাতে সামলাতে
হায়-হায়
লোকটার ইহকাল পরকাল গেল।

অথচ
আর একটু নীচে
হাত দিলেই সে পেত
আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ
তার হৃদয়

লোকটা জানলই না। -[লোকটা জানলই না]

‘যত দূরেই যাই’ রচনাকাল সাতান্ন থেকে ষাট -
সুভাষের চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ।
এর আগে পদাতিকোত্তর
আটচল্লিশে ‘অগ্নিকোণ’ আর পঞ্চাশে ‘চিরকুট’।
মাঝখানের দীর্ঘ সাত-আট বছর

[যদিও এর মাঝখানে সাতান্নয় ‘ফুল ফুটুক’]
একসাথে হুমড়ি খেয়ে পড়লো এই গ্রন্থে।
কেমন ছিলো সেই পটভূমি?

পঞ্চাশের নভেম্বরে জেল থেকে বেরিয়ে
গভীর আর্থিক সংকট।

একান্নয় ‘পরিচয়’ – দ্বৈত অর্থে -
পত্রিকা ও গীতা
সম্পাদনা ও বিয়ে।

“বিয়ে বলতে কোন অনুষ্ঠান নয়, রেজিস্ট্রি। তখন সবে একটা নতুন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘বুক ওয়ার্ল্ড’-এ এডিটর হিসাবে হাফ চাকরী পেয়েছি। ৭৫ টাকা মাইনে। ধুতির ওপর বন্ধু রামকৃষ্ণর কাছ থেকে ধার করা একটা ডোরাকাটা সার্ট চড়িয়ে বিকেলে ছুটির পর হাঁটতে হাঁটতে সোজা চলে গিয়েছিলাম রেজিস্ট্রি আপিসে। সে রাত্রে বাড়ি ফিরিনি। ইউরোপ থেকে গীতা সদ্য দেশে ফিরে চৌরঙ্গীটেরাসে কুড়ি টাকায় চার তলায় একটা সিঁড়ির ঘর ভাড়া নিয়েছিল। তাতে ছিল শুধু একটা তক্তপোশ ফেলার জায়গা...”।

বিয়ে সম্পর্কে গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিজ্ঞতা –

“তারপর যেতে যেতে, যেতে যেতে এক কবির সঙ্গে দেখা। সেই কবির দুদিকে দুটো মুখ। এক মুখে কবিতা, অন্য মুখে মিছিলের শ্লোগান। সেই শ্লোগানের সুর ধরে ধরে মিছিল থেকে কবিকে পাকড়ানো গেল। কেননা, সত্যি বলতে কী, কবিতার দিকের মুখটা – যারা জানে তারাই জানে – একেবারে বদ্ধ উন্মাদের এবং কোনো চিকিৎসা নেই।”

পার্টির নির্দেশে বাহান্নয় বজবজ।
চটকল সংগঠনের দায়িত্ব নিয়ে
ব্যাঞ্জনহোড়িয়া গ্রামের এঁদো পুকুরপাড়ে
কুঁড়েঘরের ছেঁড়া ছাদের ফাঁকে আটকে থাকা
যেন মধুচাঁদের আলোয়
আস্তিন গুটিয়ে শুরু যৌথলড়াই - 

“সকালে চটকলের মজুরদের বোনাসের দাবিতে গেট মিটিং-এ সামিল, দুপুরে মেয়েদের নিরক্ষরতা দূর করতে সাজ্জাদার বাড়িতে দাওয়ায় মাদুর পাতা স্কুলে পড়ানো, বিকেলে পোল্ট্রি তৈরী করার তোড়জোড়।... চটকলে গেটমিটিং এ গেলাম। সুভাষ টেবিল বইছে, আমি চেয়ার। কিন্তু মজুর নেতারা এসব ছোটো কাজে হাত দেন না। শুধু ‘বোনাস চাই, বোনাস চাই!’ বলে লম্বা বক্তৃতা দেন।”

চুয়ান্নয় পুনর্মূষিক – ফের কলকাতা।
যাপনভঙ্গিতে যুক্ত হলো
বজবজের গদ্য অভিজ্ঞতা –
গদ্য লিখছেন একে একে
আমার বাঙলা(১৯৫১), ভূতের বেগার(১৯৫৩),
কত ক্ষুধা(১৯৫৩), যখন যেখানে(১৯৬০)।
মাঝখানে নিজস্ব কবিতার বই ফুল ফুটুক(১৯৫৭)।

কবিতাকে ভাঙতে শুরু করলেন
উন্মাদ পদাতিক
নতুন আঙ্গিকের অন্বেষণে –
অনুবাদ করছেন নাজিম হিকমতের কবিতা(১৯৫২) থেকে
নিকোলা ভাপ্‌ৎসারভ – দিন আসবে(১৯৬১) –
এই সময়ের সুভাষ প্রসঙ্গে
কবি-সমালোচক তরুণ স্যান্যাল –

সেতারের মা-পা তারে হৃদয়ের অসীম যেমন বেজে ওঠে, যা অনন্তের সঙ্গে সীমাবদ্ধ শব্দের সম্পর্ক রচনা করে, সেই আসল পরম, মানুষের সেই অনন্তকে অর্জন করেছিলেন সুভাষ বজবজে। পঞ্চাশের দশকের একেবারে গোড়ায়। ভাবছিলেন কবিতার কী গড়ন হবে, গড়ন দিলেন নাজিম হিকমতের কবিতা – নিজের মতো করে। বাবরালির চোখের আকাশ দেখে দেখে বাংলা কবিতাকে সুভাষ তখন খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছেন সালোমানের হাত ধরে। 

এই সালোমান বাবরালিরা
সুভাষের বজবজের সহযোদ্ধা।
চটকলের কাঁধেকাঁধ মজুরভাই -
অমরত্ব পেয়েছেন বিভিন্ন সময়ে
সুভাষের কবিতায় –
সে নিয়ে কথা হবে
অন্য কোথা অন্য কোনোখানে। 
এ তো গেলো কাঁধ ছুঁয়ে থাকা ঘরেলু ইতিহাস।
কিন্তু কবির তো সীমান্ত-কাঁটাতার নেই
আর সুভাষ তো আপামাথা আন্তর্জাতিক।

উনপঞ্চাশের চীন বিপ্লব
পাঁচের দশকে বাহান্নর ভাষা
তিপ্পান্নয় স্তালিনের মৃত্যু ও ক্রুশ্চভের উত্থান
পৃথিবীকে নতুন করে সাজাতে সাজাতে
ভবিষ্যৎ কথা বলছে, শোনো,
ক্রুশ্চভের গলায়।

নির্বিবাদে নয়, বিনা গৃহযুদ্ধে
এ মাটিতে
সমাজতন্ত্র দখল নেবে। [মুখুজ্জের সঙ্গে আলাপ]
‘যত দূরেই যাই’এর প্রেক্ষাপট
ঊনষাটের খাদ্য আন্দোলন অবধি বিস্তৃত –

কলকাতা সেই থেকে মুঠো-শ্লোগান
কলকাতা সেই থেকে মিছিলপথ
গুলি মৃত্যু ধর্মঘট প্রতিবাদ
রাস্তায় সারিবদ্ধ লাঠির শরশয্যা,
দু-নলের অনলে দুমদাম
মুখাগ্নি;
তারপর কাঁদুনে গ্যাসের মতো
ধোঁয়ার কালো গাড়ি
আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে...

হাতে হাতে ফিরছে একটা ফর্দ –
নিহতের
আহতের
নিখোঁজের। -[গণনা]

এই যে একটামাত্র শব্দকে
একটা আস্ত লাইন বিস্তৃতি ও সম্মান দেওয়া -
টানা গদ্যে লিখতে লিখতে
কোনো একটি শব্দকে উল্টো কমায় বাঁধা
বা বোল্ড হরফ নয়,
তার চেয়েও বড়ো
অনেক
এক একটা শব্দের পাশে অসংখ্য অদৃশ্য শব্দ
একটা মৃত্যুর পাশে নীরব আরো অনেক মৃত্যু

তাদের সংরক্ষণ

সেইসব হতদরিদ্র উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন
জানলায় বসা চড়াইটার ডানায় হঠাৎ
অসীম আকাশ বেঁধে দেওয়া

শরীর পেয়ে গেলো নব্য বাঙলা কবিতা
যে লড়াকু জীবনের ছবি আঁকতে চাইছিলেন সুভাষ
ঠিক সেই রকমই
মেদহীন
টানটান ধারালো
গদ্যময়
ঘামবৃষ্টিস্নাত 


তিন

এবং
এমনই এর তীব্র নেশা ও আকর্ষণ,
টানা গদ্যে কবি সুভাষকে লেখা অসম্ভব
মানে সুভাষের কবিতাপাঠের আসল আনন্দটাই মাটি -
তাই এই সুভাষিত স্টাইলেই আমার গঙ্গাপুজো।
গঙ্গা বলতেই মনে পড়লো
পশ্চিমের আকাশে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে
যেন কোনো দুর্ধর্ষ ডাকাতের মতো
রাস্তার মানুষদের চোখ রাঙাতে রাঙাতে
নিজের ডেরায় ফিরে গেল

সুর্য। - [ দিনান্তে]
গোধূলিকে এভাবে এর আগে আর কেউ এঁকেছেন কি?
বা আঁকতে পেরেছেন কি?
চতুর্থ ও পঞ্চম লাইনের
মাঝখানের ব্যবধানটা লক্ষ্য করুন
একটু বিরতি ও
স্পেস
গঙ্গার বহমানতা, ডাকাতের চোখ রাঙানি বা
ডেরায় ফেরার জন্য এক দুই তিন পা ফেলা
ঘড়ির কাঁটায় টিকটিক নিস্তব্ধতা
এবং সর্বোপরি
একটা আস্ত লাইন জুড়ে একটা শব্দ
যেন পর্দায় মহানায়কের এন্ট্রি

এইভাবে কবিতায় চিত্রনাট্য রচনা
সম্ভবত বাঙলা কবিতায় অভিনব ও প্রথম।

জগদীশ ভট্টাচার্য লিখেছেন –
‘যত দূরেই যাই’- গ্রন্থে কবি সুভাষের তৃতীয় জন্ম। শিল্পী হিসাবে এটি তাঁর নবতর অভ্যুদয়-দিগন্তের ইশারা বহন করে এনেছে। সুভাষের কবিভাষায় গদ্য যে কখন বিশুদ্ধ পদ্যের প্রাণধর্ম লাভ করে তা যেন স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়না। ধ্বনিকারদের ভাষায় তাঁর গদ্যে পদ্যধর্মের এই অভিব্যঞ্জনা অসংলক্ষ্যক্রম। মিতভাষণ সুভাষের স্বভাবধর্ম। ‘যত দূরেই যাই’ গ্রন্থে তাঁর এই পরিশীলিত কলাকৃতি যেন চারুশীলনের উচ্চশিখরে আরোহণ করেছে।

সেই থেকে সুভাষ মুখুজ্জে
আমাদের প্রজন্মের কাছে
উৎস থেকে মোহনা আর
মোহনা থেকে উৎসে
অনন্ত অনর্গল সন্ধান সফর –
কী সন্ধান, তাও কি ছাই জানি তখন?
সেই থেকে আমাদের বয়ঃসন্ধির
রক্তের রঙ লাল 
সেই থেকে আমাদের পিঠ-ব্যাগে
লী ফকের বেতালের সঙ্গে মার্ক্সের পুঁজির গলাগলি 
সেই থেকে
পৃথিবীতে গাঁক গাঁক করে ফিরছে
যে দাঁত-খিঁচোনো ভয়,
আমি তার গায়ের চামড়াটা
খুলে নিতে চাই।
সেই থেকে
হে বিষাদ,
হাতের কাছ থেকে সরে যাও
আগাছাগুলো নিড়োতে হবে। - [পায়ে পায়ে]
আগুনের ওপরে দড়ি বেয়ে হেঁটে যাওয়া সেই টলমল সময়
যখন এ বাঙলায় শাসকের মুখোমুখি
আস্তিনখোলা যুদ্ধে জয়স্বপ্নে উত্তাল শোষিতের দল
আর ও বাঙলায় নিপীড়িতরা
পশ্চিম থেকে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনবে বলে
হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে
সমস্ত জড় স্থবিরতাগুলো চোখের সামনে জলজ্যান্ত হয়ে উঠছে
এক একটা চিত্রকল্প চামড়ায় কাঁটা বাগিয়ে
রোজ রোজ আমাদের সজারু করে তুলছে –
... বাড়িগুলোর গায়ে
চাবুক মারছে বিদ্যুৎ
... গাছগুলোকে চুলের মুঠি ধরে
মাটিতে ফেলে দিতে চাইছে হাওয়া
... বন্ধ জানলায় নখ আঁচড়াচ্ছে
হিংস্র বৃষ্টি। - [দূর থেকে দেখো]

দাঁড়ানো মানুষগুলোকে বগলদাবা করে
তুলে নিয়ে
বেলা দশটার ট্রাম
ঝুলতে ঝুলতে চলে গেল। - [পোড়া শহরে]

উদাহরণ এ বইয়ের সর্বত্র

মুড়ি মুড়কি
আলোগুলোকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে
দরজা দেবার শব্দে
এখুনি ঘর অন্ধকার করবে
এই শহর। - [কে জাগে]

মাথায় লাঠির বাড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়া
গাঁয়ের হাড়-জিরজিরে বুড়োর মতো
রাস্তাটা
একদৃষ্টে তার মুখের দিকে চেয়ে রয়েছে - - [রাস্তার লোক]
তালিকা ল্যাম্পপোস্টের ছায়ার মতো
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েই চলেছে
কিছুতেই হাত টেনে ধরতে পারছিনা
...দরজায় পিঠ দিয়ে বাইরে গভীর রাত ...
চোখে রেখেছিল হাত টেবিলের বাতিদান - [ছাপ]

... ছেলেটা বই নিয়ে বসল মাদুরে
সামনে ইতিহাসের পাতা খোলা - ...
বাপের–আদরে-মাথা-খাওয়া ছেলের মতো
হিজিবিজি অক্ষরগুলো একগুঁয়ে
অবাধ্য –
যতক্ষণ পুজোর জামা কেনা না হচ্ছে
নড়বে না। - [কেন এল না]
এক সে বঢ়কর এক -
চিত্রকল্পের এই নাগরিক ম্যাজিকের
ভুরি ভুরি উদাহরণ
পৃথিবীটা যেন রাস্তার খেঁকি-কুকুরের মতো
পোকার জ্বালায়
নিজের ল্যাজ কামড়ে ধ’রে
কেবলি পাক খাচ্ছে;
আর একটা প্রকাণ্ড ফাঁকা প’ড়ো বাড়িতে
তার বিকট আর্তনাদই হল
জীবন - [পা রাখার জায়গা]

পশ্চিমের সব জানলাই
হাট করে খোলা।

গরাদের এপারে দেখো –
কয়েদির ডোরাকাটা পোশাকে
এক টুকরো রোদ
মেঝেতে মাথা ঠেকিয়ে
হাঁটু মুড়ে
যেন মগরেবের নমাজ পড়ছে। - [বারুদের মতো] 

কাকে বাদ দিই?
গোটা বইটাই টুকে দিতে ইচ্ছে করছে
আসলে
অবনঠাকুর ছবি লিখতেন
আর সুভাষ মুখুজ্জে কবিতা আঁকতেন
‘যত দূরেই যাই’ সেই জয়যাত্রার শুভমহরৎ

সেই থেকে সুভাষ মুখুজ্জে
বাঙলার অকালপক্ক লালবাদী উন্মাদ কৈশোরের
দিগদর্শক
স্বপ্নমলাট
সিংহকেশর
একচ্ছত্র উত্তমকুমার


চার

যত দূরেই যাই ১৯৬৪তে পেলো
সাহিত্য আকাদেমির স্বীকৃতি। 
সাতান্ন পাতার বই 
সাতান্ন হাজার পাতা টানা গদ্য লিখলেও
গলা শুকিয়ে কাঠ
তেষ্টা তীব্রতর 
প্রিয় নারীসঙ্গমের পরে যেমন

মনে হয় –

আরও কত দূরে পূর্ণতা?

এই গ্রন্থে কবিভাবনা গল্পরূপের রূপক ও রূপকথার মিশ্রশিল্প দিয়ে গড়া। তাতে ব্যক্তিচৈতন্যের সাধারণীকৃতি সহজতর হয়েছে। কিন্তু মিতভাষণে যাঁর সহজসিদ্ধি, তাঁর পক্ষে গল্পকবিতা লেখার যে বিপদ দেখা দিতে পারে, সেই বিপদ দেখা দিয়েছে কোনো কোনো দীর্ঘ-কবিতায়। ‘পা রাখার জায়গা’, ‘মেজাজ’, ‘ফলশ্রুতি’ প্রভৃতি কবিতা রসোত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও অতিকথন দোষদুষ্ট। [জগদীশ ভট্টাচার্য]

ভাপ্‌ৎসারভের অনুবাদ করতে গিয়ে
[দিন আসবে – ১৯৬১]
একাধিক কবিতার শরীরে গল্প বুনেছেন।
হয়তো হাত পাকানো সেখানেই।
‘যত দূরেই যাই’য়ে এরপর অসংখ্য - 

অমনি একটি কবিতা ‘পাথরের ফুল’। মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যু উপলক্ষে লেখা। রবিন্দ্রনাথের তিরোধানে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের লেখা ‘বাইশে শ্রাবণ’ কবিতাটি এই প্রসঙ্গে মনে পড়বে। দুটি কবিতার শিল্পরীতির মধ্যে একটা অলক্ষ্য যোগ কোথায় যেন রয়েছে। দুটিই অসামান্য কবিতা। [জগদীশ ভট্টাচার্য]

ফুলকে দিয়ে
মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই
ফুলের ওপর কোনোদিনই আমার টান নেই।
তার চেয়ে আমার পছন্দ
আগুনের ফুলকি-
যা দিয়ে কোনোদিন কারো মুখোশ হয় না। -[পাথরের ফুল]

সত্যি বলছি, বিশ্বাস করুন –
এই কবিতা পড়ার পরদিন থেকে
রমণীয় আগুনের ফুলকি
আমাকে ফুলের সমস্ত ব্যথা রাতারাতি ভুলিয়ে ছেড়েছে,
আমার বয়সী অর্থাৎ
ছয়দশকে স্কুল বা কলেজপড়া
আস্ত একটা জাতকে
এই কবি
টেনে এনেছেন অমোঘ বামপন্থী সমাধানে –
[পৃথিবীতে আর কোনো কবি এযাবৎ পেরেছেন কি?]
সেই থেকে আমি
ফুলবিরোধী
মুখোশহীন
একটা গোটা প্রজন্ম।
এখুনি
রক্তে রক্তে শোনা যাবে
জলদগম্ভীর মহাকালের হাঁক
‘কে জাগে?’

ভালোবাসার গা থেকে
ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে
তারস্বরে সগর্বে বলে উঠব
‘আমরা’।। -[কে জাগে]

গল্পকবিতার আরো ভুরি ভুরি জনপ্রিয় উদাহরণ আছে এ বইয়ে
‘রাস্তার লোক’ আর ‘কেন এল না’ পরপর দুটি –
কী সব অভিনব বিষয় –
মাথা উঁচু করে হাটতে চাওয়া একটি লোক
ও একটি রাস্তা –
সামনে পা ফেলতে গিয়ে
লোকটা হঠাৎ
শিউরে পিছিয়ে এল।
ইস্‌, আরেকটু হলেই সে মাড়িয়ে দিয়েছিল
মায়ের কোল-ছেঁড়া
একটা দুধের বাচ্চাকে।

তারপর ভালো ক’রে তাকিয়ে বুঝল
আসলে তার মনেরই ভুল;
আজ অন্তত –
এ রাস্তার কোথাও
কোনো লাশ
পড়ে নেই।
যে কোনো পাঠক পড়তে পড়তে
ঐ লোকটির
শরীরে ও সময়ে
মিশে যাবেন অজান্তেই।

... ব’লে গেল
মাইনে নিয়ে সকাল-সকাল ফিরবে।
পুজোর যা কেনাকাটা
এইবেলা সেরে ফেলতে হবে।

ব’লে গেল।
সেই মানুষ এখনও এল না।

কড়ার গায়ে খুন্তিটা
আজ একটু বেশি রকম নড়ছে।
ফ্যান গালতে গিয়ে
পা-টা পুড়ে গেল। ...
খুব ছোটোছোটো এক্কেবারে আটপৌরে
খেটে খাওয়া নুন আনতে পান্তা ফুরনো জীবনের
হাড়হিম করা ছবি আঁকতে আঁকতে
লম্ফের আলোয় ইয়াব্বড়ো ছায়া
কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে চললো
‘কেন এল না’র গল্প -
একটু এগিয়ে দেখবে ব’লে
ছেলেটা রাস্তায় পা দিল।
মোড়ে ভিড়;
একটা কালো গাড়ি;
আর খুব বাজি ফুটছে। ...

তারপর অনেক রাত্তিরে
বারুদের গন্ধে-ভরা রাস্তা দিয়ে
অনেক অলিগলি ঘুরে
মৃত্যুর পাশ কাটিয়ে ...
[‘রাত্তির’ শব্দটা লক্ষ্য করুন –
এই পরিবারের দৈনন্দিন জীবনে
কোথাও কোনো 
‘রাত্রি’র জ্যোৎস্না-টোৎস্না নেই
বরং আছে তেলকুপির কম্পমান
হাঁউমাঁউখাঁউ ছায়াময় অনেক বড়ো
ভয়ের
খিদের
‘রাত্তির’]

কবিতার শেষটুকু বলে দিয়ে অপরাধী হতে চাইনা।
অবশ্য এ কবিতা পড়েনি,
এ বাঙলায় এমন কেউ আর...
আছে? সত্যি অবিশ্বাস্য! 
যারা পড়েননি,
তারা এখনও কেন বেঁচে আছেন? ছিঃ!

পরপর তিনটি –
‘পা রাখার জায়গা’, ‘মেজাজ’ ও ‘ফলশ্রুতি’।

প্রথম ও তৃতীয়টিতে সেই নাগরিক পথচলতি চিত্রকাব্য,
দুটো ছোট্টো উদাহরণের লোভ সামলাতে পারছিনা
ছোকরার আক্কেল দেখে এক বুড়ো
ছানি-কাটা চোখের চশমাটা তার মুখের গোড়ায়
দূরবীনের মতো করে ধরে,
ডান হাতের লাঠিটা মাটি ছেড়ে ঈষৎ তুলে,
মুখ বুঁজে নাকের দুটো বড় ফুটো দিয়ে
আর হাতের লাঠিটা দিয়ে খুব জোরে
‘হুঃ’ আর ‘ঠকাস’
এই দুটো শব্দ বার ক’রে
যেদিক থেকে উজিয়ে এসেছিল সেই দিকেই ফের
চলে গেল। - [পা রাখার জায়গা]

বাসগুলো মোড় নিত হুমহাম শব্দে;
তাদের বন্ধ খাঁচায় গর্‌র্‌ গর্‌র্‌ করত
ছোট ছোট বাঘের বাচ্চা,
ট্রামগুলো চলে গেলেই
তারের খেলা দেখাতে দেখাতে যেত
ছুরিতে শান দেবার একটানা হিসহিস শব্দ।
ফুটপাথের কোলের কাছে কোথাও
তৃষ্ণার জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ত খাদে –
সামনে একটা থাম থাকায় দেখা যেত না। -[ফলশ্রুতি]
এর মধ্যে যদি কেউ ‘অতিকথন’এর অসুখ খুঁজে পান
দুঃখিত, আমি তাঁর সুস্থ কবিতাবোধ নিয়ে 
ভরপুর সংশয়ে আছি।
আর চিত্রকাব্যের এই সুক্ষ্ম কারুকার্য বিস্তারে কারুর কি
‘পথের পাঁচালী’ ‘মহানগর’ ‘পরশপাথর’-দের মনে পড়ছে?
সে প্রসঙ্গে বলি – বজবজ থেকে ফেরার পর কিন্তু
পাঁচের দশকের শেষ থেকে বেশ কিছুকাল 
সত্যজিতের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনা করেছেন
‘সন্দেশ’ পত্রিকার।
কে কার দ্বারা সমৃদ্ধ, কে জানে?

‘মেজাজ’?
সে তো ইতিহাস! 
থলির ভেতর হাত ঢেকে শাশুড়ির বিড়বিড়
আর কালো বউয়ের গটগট
দু’জনের পারস্পরিক আটপৌরে ঠোকাঠুকি
শেষ অবধি পৌঁছতে পারে
কোথায়, কোন উচ্চতায় -
শাশুড়ি-বৌমা নিয়ে ইদানিং
টিভিসিরিয়ালে হুড়োহুড়ি মারামারি –
এনারা কেউ কি ‘মেজাজ’ পড়েছেন?
বউ বলছে – ‘একটা সুখবর আছে’।
পরের কথাগুলো এত আস্তে যে শোনা গেল না।
খানিক পরে চকাস চকাস শব্দ,
মা হয়ে আর দাঁড়াতে লজ্জা করছিল।
কিন্তু তদন্তটা শেষ হওয়া দরকার –
বউয়ের গলা, মা কান খাড়া করলেন।
বলছে – ‘দেখো, ঠিক আমার মতো কালো হবে’।
এরপর একটা ঠাস ক’রে শব্দ হওয়া উচিৎ।
ওমা, ...
নাঃ, এটাও এরপর আর বলা যাবেনা।
যারা পড়েছেন, তাদের দাড়ি-কমা অবধি মুখস্থ
কাজেই বাকিটা স্মৃতি থেকে পড়ে নিন।
আর বাকিরা? দেরি করবেন না,
আর নতুন করে পড়ার ধৃষ্টতা না দেখিয়ে বরং
সোজা চুল্লিতে ঢুকুন।

আরে! মুখুজ্জে মশাই যে! নমস্কার, কী খবর?
আর এই লেখা-টেখা সংসার-টংসার এই নিয়েই ব্যস্ত।
তা বেশ। কিন্তু দেখো মুখুজ্জে, ...
এই শুরু।
‘মুখুজ্জের সঙ্গে আলাপ’।
কেউ একজন চায়ের দোকানে ডেকে নিয়ে গিয়ে
মুখুজ্জেকে বলছেন
নিতান্ত সাদামাটা গদ্যে – নিছকই আড্ডাধোঁয়া ভঙ্গি
...তার চেয়ে এসো, চেয়ারটা টেনে নিয়ে
জানলায় পা তুলে বসি।
এক কাপ চায়ে আর কতটা সময়ই বা যাবে?

দেশলাই? আছে।
ফুঃ, এখনও সেই চারমিনারেই রয়ে গেলে।
তোমার কপালে আর ক’রে খাওয়া হল না দেখছি
বুঝলে মুখুজ্জে, জীবনে কিছুই কিছু নয়
যদি কৃতকার্য না হলে।
নিপুণ হাতের ইঞ্জেকশনের মতো
কখন যেন অজান্তে ছুঁচ ঢুকে গেছে ভিতরে।
সিধেসাদা গদ্য সংহত হচ্ছে গম্ভীর ব্যাঞ্জনায় –
কে যেন ‘অতিকথন’এর অভিযোগ করেছিলেন,

দেখুন তো পরের ক’লাইন –

আকাশে গুড়গুড় করছে মেঘ –
ঢালবে।
কিন্তু খুব ভয়ের কিছু নেই;
যুদ্ধ না হওয়ার দিকে।
আমাদের মুঠোয় আকাশ;
চাঁদ হাতে এসে যাবে।
এর চেয়ে আর কত সংক্ষিপ্ত হবে?
ছ’লাইনেই তো সব কথাই বলা হয়ে গেলো
এবার তো শুধু বিস্তার -
ধ্বংসের চেয়ে সৃষ্টির,
অন্ধকারের চেয়ে আলোর দিকেই
পাল্লা ভারী হচ্ছে।
ঘৃণার হাত মুচড়ে দিচ্ছে ভালবাসা।
পৃথিবীর ঘর আলো ক’রে-
দেখো, আফ্রিকার কোলে
সাত রাজার ধন এক মাণিক
স্বাধীনতা।...

আড্ডার গোল-গোল নিরামিশ শব্দগুলো
কিছু বুঝে ওঠার আগেই শাণিত ছুরির মতো
লকলক করে উঠলো -
ধনতন্ত্রের বাঁচবার একটাই পথ
আত্মহত্যা।
দড়ি আর কলসি মজুত
এখন শুধু জলে ঝাঁপ দিলেই হয়। ...
রাজনৈতিক বক্তব্যের সঙ্গে আপনি
একমত না হতেই পারেন, কিন্তু
মেটাফর? কিকরে পাশ কাটাবেন?
কী সহজ বিশ্লেষণ আমাদের এই সমাজের?
যার হাত আছে তার কাজ নেই,
যার কাজ আছে তার ভাত নেই,
আর যার ভাত আছে তার হাত নেই। ...

গদিতে ওঠবস করাচ্ছে
টাকার থলি।
বন্ধ মুখগুলো খুলে দিতে হবে
হাতে হাতে ঝনঝন ক’রে ফিরুক।
বুঝলে মুখুজ্জে, সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না
আড় হয়ে লাগতে হবে।

এ এক অদ্ভুত সময়, কবি।
সারা পৃথিবী জুড়ে যখন
একসূত্রে সংহত হচ্ছে দুর্বিনীত মৌলবাদ।
ধ্বংস হচ্ছে বামিয়ান ব্যাবিলন সহ
মানুষের সমস্ত সুন্দর সম্ভ্রান্ত ইতিহাস।
মানুষের বোধ থেকে বিদায় নিয়েছে বিবেক
শিক্ষা বা মননে নয়
অর্থের অঙ্কে শ্রেণী নির্ধারণ হচ্ছে মানুষের।
মিথ্যার সন্ত্রাস ক্রমশ জিতে যাচ্ছে সব যুদ্ধে
ভেঙে নুয়ে পড়ছে
সভ্যতার সুস্থ শিরদাঁড়া
আগুনের আঁচ নিভে আসছে
তাকে খুঁচিয়ে গনগনে ক’রে তোলো।
উঁচু থেকে যদি না হয়
নীচে থেকে করো।

সহযোদ্ধার প্রতি যে ভালবাসা একদিন ছিল
আবার তাকে ফিরিয়ে আনো;
যে চক্রান্ত
ভেতর থেকে আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে
তাকে নখের ডগায় রেখে
পট্‌ ক’রে একটা শব্দ তোলো।।

দরজা খুলে দাও,
লোকে ভেতরে আসুক।

মুখুজ্জে, তুমি লেখো।।
সুস্থ সভ্যতার স্বার্থে
নিপীড়িত মানুষের স্বার্থে
মুক্তির লড়াইয়ের স্বার্থে

মুখুজ্জে, তুমি আবার লেখো 

2 comments:

0

প্রবন্ধ - মনোজ কর

Posted in

প্রবন্ধ


সমাজ প্রসঙ্গে
মনোজ কর


শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের দ্বারা চালিত যে সমাজ দর্শনের কথা কার্ল মার্ক্স বলেছেন তাঁর ঐতিহাসিক এবং দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ভিত্তিতে, আধ্যাত্মিক চিন্তার ভিত্তিতেও সেই একই সত্যের সন্ধান পেয়েছেন স্বামীজি। এই প্রবন্ধে সে কথাই বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো।

আমাদের ছোটবেলায় সমাজ বলতে আমরা বুঝতাম আত্মীয় পরিজন, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশী, বা খুব বেশী হলে শহরের যে অংশে আমরা থাকতাম সেখানকার অধিবাসীদের। বাবা শিক্ষক এবং জ্যাঠামশাই ডাক্তার হওয়ার সুবাদে আমাদের পরিচিতির গণ্ডী বা সমাজ একটু বিস্তৃত ছিল। শ্রেণীগত হিসাবে আমরা ছিলাম মধ্যবিত্ত। শহুরে সমাজ মূলত তিনটি অর্থনৈতিক শ্রেণীতে বিভক্ত। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত। অনেকে এই তিনটি শ্রেণীর প্রত্যেকটিকে আবার দুভাগে বিভক্ত করেন, যেমন উচ্চ মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ইত্যাদি। যাই হোক, এক্ষেত্রে আমার আলোচনা মূল তিনটি শ্রেণীতেই সীমাবদ্ধ রাখব। বলা যেতে পারে, যে পরিচিত গণ্ডীর মধ্যে আমাদের প্রতিদিনকার গতায়াত, সেই গণ্ডীর প্রত্যেকেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীভুক্ত। এই শ্রেণীর মানুষেরা সাধারণত চাকুরিজীবি বা কোনও পেশাগত বৃত্তিতে নিযুক্ত। ছোট বা মাঝারি মাপের ব্যবসাজীবিরাও এই শ্রেণীর মধ্যে পড়েন। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে। এই শ্রেণীর মানুষেরা নিম্নবিত্তদের প্রতি সহানুভূতিশীল। এদের অনেকেই বিগত বা বর্তমান প্রজন্মের পূর্ববর্তী সময়ে নিম্নবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত ছিলেন। কঠিন জীবনসংগ্রামের মধ্য দিয়ে এঁরা নিজেদের এই শ্রেণীতে উন্নীত করেছেন। আবার অনেকে হয়তো কয়েক প্রজন্ম ধরে এই শ্রেণীতেই অবস্থান করছেন। এই শ্রেণীভুক্ত মানুষেরা মেহনতি মানুষদের সরাসরি শোষণ করে মুনাফা অর্জন করেন না, কিন্তু অনেকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে এই শোষণ প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেন। মধ্যবিত্তদের স্বাভাবিক প্রবণতা উচ্চবিত্ত হওয়ার প্রতি। সমস্ত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের জীবনসংগ্রামের মূল লক্ষ্য অধিক অর্থ উপার্জন এবং অধিকতর বিত্তশালী সম্প্রদায় বা উচ্চবিত্ত শ্রেণীভুক্ত হওয়া। স্কুলজীবনের প্রায় শেষ অবধি এটাই ছিল আমার সমাজ সম্পর্কিত ধারণা।

কলেজে গিয়ে হাতে পেলাম সমাজ দর্শন এবং সমাজ বিজ্ঞান সংক্রান্ত নানান বই। পরিচয় হল মার্ক্সীয় দর্শনে সুপণ্ডিত কয়েকজন সিনিয়র দাদার সঙ্গে। সমাজ সম্বন্ধে ধারণা পরিবর্তিত হতে থাকল। সমাজকে অনেক বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে বুঝতে শুরু করলাম। অনুধাবন করলাম, যে কোনও সমাজের ভিত্তি হল তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বলতে প্রধানত উৎপাদন ব্যবস্থাকে বোঝায়। উৎপাদন ব্যবস্থা পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই সমাজ পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনই সমাজ বিকাশের মূল কারণ। উৎপাদন ব্যবস্থার উপাদান দুটি। প্রথম, উৎপাদিকা শক্তি বা উৎপাদন করার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী অর্থাৎ জমি, যন্ত্রপাতি, প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা, কারিগরি জ্ঞান ইত্যাদি। দ্বিতীয়, উৎপাদন সম্পর্ক অর্থাৎ কোনও একটি বিশেষ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সমাজে বিভিন্ন মানুষের ভূমিকা। কোনও উৎপাদন প্রক্রিয়াতেই মানুষ একক ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। তাকে সমাজবদ্ধভাবেই অংশগ্রহণ করতে হয়। বিভিন্ন মানুষের ভূমিকা যেমন ভিন্ন, তেমনি কিছু মানুষ অন্য মানুষের শ্রমের ফল ভোগ করে। কিছু মানুষের হাতে উৎপাদন সামগ্রীর মালিকানা থাকে আবার কেউ বা শুধুই শ্রম দেয়। উৎপাদিকা শক্তির বিবর্তন বা পরিবর্তনের সাথে উৎপাদন সম্পর্কেরও পরিবর্তন ঘটতে থাকে। উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই সমাজ পরিবর্তন হয়। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, সমাজ পরিবর্তন নিজের থেকে ঘটে না। সমাজ পরিবর্তনের জন্য বিপ্লবের প্রয়োজন হয়। একটি সমাজের মধ্যেই পরবর্তী সমাজের অংকুর সৃষ্টি হয়। পুরাতন সমাজের মধ্যেই প্রথমে পরিবর্তন হয় উৎপাদিকা শক্তির। তারপর একটা স্তরে উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্ব খুবই প্রকট হয়ে ওঠে। তখন উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন উৎপাদন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হয়। উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বই সমাজ বিকাশের মূল কারণ।

আগেই বলেছি উৎপাদন সম্পর্ক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা যতই অনুভূত হোক না কেন, তা আপনি পরিবর্তিত হয় না। প্রগতিশীল শ্রেণীগুলি, অর্থাৎ যে শ্রেণীগুলি সমাজ পরিবর্তনের তাগিদ অনুভব করে, তারা প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীগুলিকে, অর্থাৎ যারা ব্যক্তিগত স্বার্থে পুরনো উৎপাদন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চায়, তাদের রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করে নিজেরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নতুন উৎপাদন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে এবং সঙ্গে সঙ্গে নতুন আর্থ ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে তৈরী করে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা, সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদি অর্থাৎ উপরিকাঠামো। সমাজের আসল পরিবর্তন আসে শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে, যার চূড়ান্ত রূপ হল বিপ্লব। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বের প্রতিফলন ঘটে রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে শ্রেণী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে।

ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সমাজ বিকাশের ইতিহাসকে নতুনভাবে এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখতে শিখিয়েছে। সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা কি রকম, সেই ভিত্তিতে মানব সমাজের ইতিহাসকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়- (১) আদিম সাম্যবাদী যুগ, (২) দাস যুগ, (৩) সামন্ত যুগ, (৪) পুঁজিবাদী যুগ, (৫) সমাজতান্ত্রিক যুগ, (৬) সাম্যবাদী যুগ (ভবিষ্যতে আসবে)।

আদিম সাম্যবাদী যুগে উৎপাদন ছিল অতি অনুন্নত। পশু শিকার ও বন থেকে ফলমূল সংগ্রহ। উৎপাদিকা শক্তি অতি অনুন্নত, পাথরের হাতিয়ার ইত্যাদি। সকল পুরুষ একত্রে পশু শিকার করত, মেয়েরা ঘরে কাজ করত এবং সকলে একত্রে সমানভাবে শিকার ভাগ করে খেত। এই অবস্থায় সঞ্চয় সম্ভব ছিল না। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল না। শ্রেণী ও রাষ্ট্র ছিল না। নারী ও পুরুষের সমান মর্যাদা ছিল। সেই সময় উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের ঐ স্তরে এই ধরনের উৎপাদন সম্পর্কই স্বাভাবিক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।

কালক্রমে মানুষ অধিকতর উন্নত উৎপাদন করতে শিখল। কিছু কৃষি কাজ ও পশু পালন করতে শিখল। অর্থাৎ, উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটল। এই অবস্থায় এল নতুন উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নতুন উৎপাদন সম্পর্ক। মুষ্টিমেয় প্রভুরা সকল উৎপাদন যন্ত্র ও উৎপাদিত দ্রব্যের মালিক। কিন্তু তারা শ্রম প্রয়োগ করে না। প্রকৃত উৎপাদন করে দাসেরা। আদিম সাম্যবাদী যুগেও গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে যুদ্ধ হত, কিন্তু যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেওয়া হত অথবা মেরে ফেলা হত অথবা নিজেদের গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত করে নেয়া হত। তখন দাস করার কোন প্রয়োজন বা অবস্থাও ছিল না। পরবর্তী যুগে অধিকতর উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের স্তরেই এই দাস ব্যবস্থা এসেছে। এই দাস যুগের শুরুতে সমাজে কয়েকটি নতুন উপাদান দেখা দিল – ব্যক্তিগত সম্পত্তি, শ্রেণী, শোষণ, শ্রেণী সংগ্রাম ও রাষ্ট্র। নারীও এই সময় পুরুষের পদানত হল। উন্নততর উৎপাদিকা শক্তির যুগে ও অধিকতর উৎপাদনের যুগে সঞ্চয় সম্ভব হল। তাই এল ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং সঙ্গে সঙ্গে উত্তরাধিকার প্রথা। একই সঙ্গে দেখা দিল শ্রেণী বিভাগ, প্রভু ও দাস। আদিম সাম্যবাদী যুগেও পুরুষ নারীর চেয়ে বলশালী ছিল। কিন্তু পুরুষ নারীর উপর কর্তৃত্ব করত না। গৃহকার্যে বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলার নেতৃত্ব স্বেচ্ছায় মেনে নিত। শ্রেণী বৈষম্যের যুগে উত্তরাধিকার নিশ্চিত করার প্রয়োজনে নারীর উপর নানারকম বিধি-নিষেধ ও নিয়ন্ত্রণ দেখা দিল। নারী পুরুষের পদানত হল।

দাসযুগে সম্পত্তির পরিমাণ ও সামাজিক প্রতিপত্তি নির্ধারিত হতো দাসের সংখ্যা দ্বারা। দাসরা নিশ্চয়ই স্বেচ্ছায় শোষণ মেনে নিতে রাজী হয় নি। শ্রেণী শোষণ যেখানে থাকবে, শ্রেণী সংগ্রামও সেখানে থাকবে। শোষিত শ্রেণীকে দমন করে রাখার জন্য শোষক শ্রেণী বিভিন্ন ব্যবস্থার প্রবর্তন করে, তার মধ্যে আছে সেনাবাহিনী, প্রশাসন ব্যবস্থা, কয়েদখানা, বিচার ব্যবস্থা, ইত্যাদি। এগুলি মিলেই হচ্ছে রাষ্ট্র।

পরবর্তীকালে সামন্তযুগে কৃষি উৎপাদনের জন্য উন্নততর যন্ত্র ও কৌশল মানুষ আবিষ্কার ও আয়ত্ত করে। এই উন্নততর কৃষি উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে দাস উৎপাদন সম্পর্ক সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ, কিছুটা স্বাধীনতা ও অধিকার না দিলে ক্রীতদাস দিয়ে এই উন্নততর উৎপাদন পদ্ধতিকে কাজে লাগানো যায় না। এই অবস্থায় দাস প্রথার বিলোপের পক্ষে এসে দাঁড়ালো একদিকে দাসেরা ও অপরদিকে স্বাধীন কিছু নাগরিক। এরা প্রগতিশীল শ্রেণী। কিন্তু দাসের মালিকরা সমাজের সামগ্রিক উৎপাদন ও উন্নতির কথা না ভেবে দাস প্রথা টিকিয়ে রাখার পক্ষপাতি ছিল। এরা প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণী। তবে দাস ব্যবস্থা অসংখ্য দাস বিদ্রোহের জন্য ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে বিপ্লবের মাধ্যমে দাস প্রথা উঠে যায় এবং আরম্ভ হয় সামন্ত ব্যবস্থার যুগ।

পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় সামন্ত ব্যবস্থা বিভিন্ন রূপ নিয়েছে। আবার সামন্ত ব্যবস্থাও কালক্রমে বহু পরিবর্তিত হয়েছে। এই ব্যবস্থায় উৎপাদনের প্রধান উপাদান জমি ভূস্বামী বা সামন্ত প্রভুর দখলে। প্রকৃত উৎপাদন করে কৃষক বা ভূমিদাস। কৃষক শ্রম প্রয়োগ করে ও উৎপাদনের অন্যান্য উপকরণ জোগাড় করে উৎপাদন করে। কৃষক উৎপাদিত ফসলের মালিক, কিন্তু উৎপাদিত ফসলের বিশেষ অংশ অথবা নির্দিষ্ট অংকের অর্থ খাজনা হিসাবে জমির মালিককে দিতে বাধ্য। ভূমিদাস ব্যবস্থায় ভূস্বামী ভূমিদাসের জীবন ধারণের জন্য সামান্য কিছু জমি দিয়ে দিত, কিন্তু ভূমিদাসকে বেশীর ভাগ সময় ভূস্বামীর জমিতে বেগার খাটতে হত। ভূমিদাসরা জমি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে পারত না। ভূমিদাসরা দাসদের চেয়ে কিছুটা উন্নত ও স্বাধীন। ভূমিদাস প্রথার মূল কথা বেগার শ্রম। আর অন্য ধরনের জমিদারী প্রথার মূল কথা খাজনা। সামন্ত সমাজে সম্পত্তির পরিমাণ ও সামাজিক প্রতিপত্তি নির্ধারিত হয় জমির পরিমাণ দ্বারা।

সামন্ত সমাজের গর্ভেই পুঁজিবাদী সমাজের জন্ম হয় এবং যান্ত্রিক শিল্পের উদ্ভব হয়। বহু বিস্তৃত পণ্যের বাজার সৃষ্টি হয়। যে ব্যবসায়ী শ্রেণী পণ্যের বাজারকে বিস্তৃত করে, তাদের বলা হয় বুর্জোয়া। সামন্ত ব্যবস্থা থাকলেও বিভিন্ন কারণে এই উন্নততর যান্ত্রিক শিল্প কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছিল না। বুর্জোয়া শ্রেণী সামন্ত উৎপাদন সম্পর্ক খতম করার জন্য উদ্যোগী হয়ে ওঠে। এ ছাড়া ভূমিদাস ও কৃষকরাও ইতিপূর্বে সামন্তদের শোষণের বিরুদ্ধে বহুবার বিদ্রোহ করে আসছিল। বুর্জোয়ারা কয়েকটি কারণে সামন্ত ব্যবস্থাকে আধুনিক যন্ত্রশিল্পভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকাশের পথে বাধা হিসাবে দেখছিল।

প্রথমত, সামন্ত ব্যবস্থায় বেশীর ভাগ মানুষ কৃষক ও ভূমিদাস এবং এদের ক্রয় ক্ষমতা এত নীচে থাকে যে, পণ্যের বাজার বিস্তৃত হতে পারে না। আর আধুনিক যন্ত্রশিল্প যে লক্ষ লক্ষ পণ্য তৈরী করে, তার ক্রেতা তো সাধারণ মানুষই হবে, মুষ্টিমেয় ভূস্বামী নয়। দ্বিতীয়ত, সামন্ত শ্রেণী কর্তৃক ধার্য কর ও অন্যান্য বাধা-নিষেধ বুর্জোয়ার বিকাশের পক্ষে বাধা হচ্ছিল। তৃতীয়ত, ভূমিদাস প্রথা থাকলে কারখানার জন্য ‘স্বাধীন শ্রমিক’ পাওয়া যাবেনা। বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্বে কৃষক, ভূমিদাস ও অন্যান্য গরীব শ্রেণীগুলি সামন্ত প্রভুদের বিরুদ্ধে বিপ্লবে এগিয়ে আসে। এটাই বুর্জোয়া বিপ্লব। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সামন্ত সমাজের অবসান ঘটেছে, গড়ে উঠেছে পুঁজিবাদী সমাজ।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজিপতি অর্থ বিনিয়োগ করে কারখানা প্রতিষ্ঠা করে, কাঁচামাল জোগাড় করে, তারপর শ্রমিক নিয়োগ করে উৎপাদন করায়। উৎপাদিত দ্রব্য পুঁজিপতি বাজারে বিক্রি করে মুনাফা উঠিয়ে নিয়ে আসে। ‘স্বাধীন শ্রমিক’ নির্দিষ্ট বেতনে চাকুরি করে, অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শ্রমিক তার শ্রম শক্তি বিক্রি করে। প্রকৃত উৎপাদন করে শ্রমিক, কিন্তু উৎপাদনের পরিকল্পনা বা পরিচালনা করার দায়িত্ব তার নয়,পুঁজিপতির। উৎপাদিত দ্রব্যের মালিকও পুঁজিপতি। পুঁজিপতি বাজারে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে মুনাফা তুলে আনে। আসলে মুনাফা সৃষ্টি হয় উৎপাদনের প্রক্রিয়ার মধ্যেই, অর্থাৎ শ্রমিককে শোষণ করেই। শ্রমিক যে শ্রম প্রয়োগ করে, তার পুরো মূল্য সে পায় না। পুঁজিপতি শ্রমিকের শ্রম শক্তি ক্রয় করে, কিন্তু প্রদত্ত শ্রমের পুরো মূল্য সে শ্রমিককে দেয় না। পুঁজিপতি শ্রমিকের শ্রম শক্তি ক্রয় করে সস্তায়। এইখানেই সে ঠকায় শ্রমিককে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শোষণের মূল কথা হল এটাই।

এখানে একজন পুঁজিপতির সঙ্গে সামন্ত প্রভুর পার্থক্য লক্ষণীয়। পুঁজিপতি ও সামন্ত প্রভু উভয়ই শোষক এবং কেউই প্রকৃত উৎপাদন করে না। তবে পুঁজিপতি উৎপাদন পরিচালনা করে এবং উৎপাদিত পণ্য বাজারে বিক্রি করে তাকে মুনাফা তুলে আনতে হয়। সামন্ত প্রভু উৎপাদনের ব্যাপারে কোনও দায়িত্বই নেয় না। কৃষককেই উৎপাদনের সকল দায়িত্ব নিতে হয় (ভূমিদাসের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন)। জমিদার কেবল উৎপাদিত ফসলের উপর তার ভাগ বসায়। পুঁজিবাদী সমাজে সম্পত্তির পরিমাণ ও সামাজিক প্রতিপত্তি নির্ধারিত হয় টাকার অংকের দ্বারা।

পুঁজিবাদ তার প্রথম যুগে উৎপাদনকে ও উৎপাদিকা শক্তিকে বিপুল পরিমাণে বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু একটা পর্যায়ে দেখা গেল পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক উৎপাদনকে আর বাড়াতে পারছে না, উৎপাদিকা শক্তিকেও আর কাজে লাগাতে পারছে না, তার বিকাশের সম্ভাবনাকেও রুদ্ধ করে দিচ্ছে।

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উন্নততর স্তরে অতি উৎপাদনের সংকট দেখা যায়। ‘অতি উৎপাদন’ আসলে সঠিক নয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিভিন্ন পুঁজিপতি মুনাফার তাগিদে নিজ নিজ হিসাব অনুযায়ী উৎপাদন করায়। সমাজের প্রকৃত প্রয়োজন অনুযায়ী পরিকল্পনা মাফিক কোনও উৎপাদন হয় না। ফলে মাঝে মাঝে দেখা যায়, উৎপাদিত পণ্যের বাজার নেই। চাহিদা নিশ্চয়ই আছে, নেই ক্রেতা সাধারণের ক্রয় ক্ষমতা। এই অবস্থায় পণ্য অবিক্রিত অবস্থায় থাকে, পুঁজিপতিরা ভবিষ্যতে বাজারদর বৃদ্ধি পাবে এই আশায় তাদের মাল নষ্ট করে ফেলে, কল-কারখানাও বন্ধ করে দেয়। এটা সমাজের সম্পদের অপচয়। এতে এটা প্রমাণ করে যে, উৎপাদিকা শক্তিকে পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্ক আর কাজে লাগাতে পারছে না। কেন? কারণ, এই উৎপাদন সম্পর্কের মধ্যে রয়েছে যে বিষয়টি তা হল, উৎপাদন যন্ত্রের মালিক ব্যক্তি বিশেষ যার উদ্দেশ্য কেবলমাত্র মুনাফা, সমাজের চাহিদা পূরণ নয়। এই অবস্থায় উৎপাদন যন্ত্রের উপর ব্যক্তি মালিকানার বদলে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হলে সামাজিক সম্পদ ও শক্তির এই অপচয় হত না, উৎপাদিকা শক্তিকেও মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী পুরোপুরি কাজে লাগানো যেত। তাহলে পুঁজিবাদের একটা স্তরে উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী। এখন ব্যক্তি মালিকানার বদলে সমাজতান্ত্রিক মালিকানার প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে। নতুন উৎপাদন সম্পর্ক অর্থাৎ উৎপাদন যন্ত্রের উপর সামাজিক মালিকানা ভিত্তিক উৎপাদন সম্পর্কই (এটাই সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক) হচ্ছে অধিকতর উন্নত উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে সবচেয়ে সঙ্গতিপূর্ণ।

পুঁজিবাদী উৎপাদনের একটা স্তরে বেশীর ভাগ শিল্প, পুঁজি ও ব্যবসা মাত্র কয়েকজন পুঁজিপতির হাতে চলে আসে। একে বলে একচেটিয়াত্ব। এই অবস্থায় পুঁজিপতিদের নিজেদের মধ্যে আগের মতো অবাধ প্রতিযোগিতা থাকে না। ফলে অধিকতর উৎপাদন, উন্নততর উৎপাদন এবং তারই প্রয়োজনে টেকনোলজির বিকাশ ও বিজ্ঞানের প্রসারের জন্য পুঁজিপতিদের এক সময় যে আগ্রহ ছিল, এখন আর সে তাগিদ থাকছে না। কারণ তাদের উদ্দেশ্য কেবলমাত্র সর্বোচ্চ মুনাফা আদায়, অন্য কিছু নয়। ফলে এই অবস্থায় পুঁজিবাদ উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের জন্য আগ্রহী তো থাকেই না, বরং অনেক ক্ষেত্রেই তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে ব্যক্তি মালিকানার বদলে সামাজিক মালিকানা ভিত্তিক নতুন উৎপাদন সম্পর্কই উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের পক্ষে সহায়ক হবে।

কিন্তু পুঁজিপতিশ্রেণী নিশ্চয়ই নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে নতুন উৎপাদন সম্পর্কের পক্ষে দাঁড়াবে না। এই নতুন উৎপাদন সম্পর্কের পক্ষে দাঁড়িয়ে লড়ে শ্রমিকশ্রেণী। পুঁজিবাদ তার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমাগত আরও বড় বড় কারখানা তৈরী করতে বাধ্য হয়। আর এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই ক্রমে বেড়ে ওঠে, একত্রিত ও সংগঠিত হয় পুঁজিপতির বিরুদ্ধ শক্তি শ্রমিক শ্রেণী। পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিপতির সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রাম চলে। চূড়ান্ত পর্যায়ে শ্রমিকশ্রেণী পুঁজিপতিশ্রেণীকে ক্ষমতাচ্যূত করে ব্যক্তি মালিকানার বদলে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করে। এটাই সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্রে শ্রেণী শোষণ নেই, ব্যক্তিগত সম্পত্তিও নেই। নিজস্ব ব্যবহারের জন্য পার্সোনাল প্রপার্টি আছে, কিন্তু কারো মালিকানায় এমন কোনও সম্পত্তি (প্রাইভেট প্রপার্টি) নেই, যার দ্বারা অপরকে শোষণ করে মুনাফা আদায় করা যায়। অর্থাৎ উৎপাদন যন্ত্রের উপর ব্যক্তি মালিকানা নেই। এই সমাজে সকলেই সামাজিক উৎপাদনে অংশগ্রহণ করে। এবং প্রত্যেকে তার শ্রম ও যোগ্যতা অনুযায়ী নির্দিষ্ট মজুরী পায়।

শ্রমিকশ্রেণী পুঁজিপতিশ্রেণীকে ক্ষমতাচ্যূত করে পুরাতন রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে ফেলে এবং শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থ অনুযায়ী নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। সমাজতান্ত্রিক সমাজেও রাষ্ট্র থাকে, কিন্তু আগের তিন যুগের (দাস, সামন্ত ও পুঁজিবাদী) সঙ্গে পার্থক্য এই যে, এই রাষ্ট্র আর শোষক শ্রেণীর হাতিয়ার নয়। এটা শ্রমিকশ্রেণীর হাতিয়ার, তা ব্যবহৃত হয় নিজ দেশের পরাজিত পুঁজিপতিশ্রেণীর প্রতিরোধ প্রচেষ্টা ঠেকানো অথবা অন্যদেশের বুর্জোয়াদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য।

সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক ক্রমাগত উৎপাদিকা শক্তিকে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। সুদূর ভবিষ্যতে এমন এক সময় আসবে যখন উৎপাদন এত বিপুল হবে যে সেই অবস্থায় এ নীতি কার্যকরী হবে,‘প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করবে, আর প্রত্যেকে তার প্রয়োজন অনুযায়ী ভোগ করবে’। এই সমাজই সাম্যবাদী সমাজ। এই হচ্ছে শ্রেণীহীন সমাজ। এই সমাজে রাষ্ট্র থাকবে না। সমাজতন্ত্রের অগ্রগতির সাথে সাথে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গ অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। এইভাবে ধীরে ধীরে রাষ্ট্র নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

এই প্রসঙ্গে আরও কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন।

পৃথিবীতে সব জায়গায় একই সঙ্গে একই ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থা শুরু হয়নি। যেমন আজকের পৃথিবীতে কোথাও সমাজতান্ত্রিক সমাজ, কোথাও পুঁজিবাদী সমাজ আবার কোথাও বা আরও পিছনের কোনও সমাজ বর্তমান রয়েছে। কোনও দেশে একই সঙ্গে দুই বা ততোধিক উৎপাদন ব্যবস্থা দেখতে পাওয়া যায়। তার মধ্যে যে ব্যবস্থাটি প্রধান, তার দ্বারা সেই সমাজকে চিহ্নিত করা হয়।

কোনও সমাজই স্থায়ী নয়। প্রত্যেকটি সমাজের অভ্যুদয়, বিকাশ ও পতন (বা অন্য উন্নততর সমাজে রূপান্তর) আছে। সমাজ বিকাশের মূল কারণ নিহিত আছে উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনের মধ্যে। উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে প্রথম পরিবর্তন আসে উৎপাদিকা শক্তির। তারপর নতুন উৎপাদন সম্পর্কের প্রয়োজন অনুভূত হয়। এই ঘটনাটি ঘটে মানুষের সচেতন প্রচেষ্টা ছাড়াই এবং কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা শ্রেণীর ইচ্ছা নিরপেক্ষভাবে। এই কারণে জন্ম নেয় শ্রেণীসংগ্রাম। শ্রেণীসংগ্রাম প্রতিটি শ্রেণীবিভক্ত সমাজে থাকবেই। এটাই আসলে সমাজ বিকাশের মূল চালিকা শক্তি। শ্রেণীসংগ্রামের পরিণতি বিপ্লবে। বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজের গুণগত পরিবর্তন হয়, নতুন উৎপাদন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়।

একটি সমাজের ভিত্তি তার অর্থনীতি। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন দ্বারাই সমাজ পরিবর্তিত হয়, পরিবর্তন হয় তার উপরিকাঠামোতে, অর্থাৎ রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইত্যাদিতে – এটা যেমন সত্য, তেমনই উপরিকাঠামোও যে ভিত্তিকে প্রভাবিত করে, তাও সত্য। ভিত্তি ও উপরিকাঠামোর মধ্যে সম্পর্ক দ্বান্দ্বিক। যেমন, উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বই আপনাআপনি উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনে না। উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধিত হয় রাজনৈতিক বিপ্লবের মাধ্যমে। বিপ্লবের দ্বারা প্রথমে রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তন হয়, পরিবর্তন হয় রাষ্ট্র ব্যবস্থায়। তারপর উৎপাদন ব্যবস্থায় পরিবর্তন (যা ইতিমধ্যেই অনিবার্য ও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে) আনা হয়। উৎপাদন ব্যবস্থার এই পরিবর্তন সমাজের অন্যান্য দিকে সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রবলভাবে প্রভাব ফেলে এবং সেই সব ক্ষেত্রে দ্রুত পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে। বিষযটি বুঝতে হলে শ্রেণী, রাষ্ট্র ও বিপ্লব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়োজন।

শ্রেণী: নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক যুগে নির্দিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থায় যে জনসমষ্টি উৎপাদন যন্ত্রের (উপায়ের) সঙ্গে একই রকম সম্পর্কে থাকে, তারা একটা শ্রেণী। মানব সভ্যতার ইতিহাসে তিনটি শ্রেণী বিভক্ত যুগ দেখতে পাওয়া যায় – দাস, সামন্ত ও পুঁজিবাদী যুগ। প্রত্যেক যুগে দুটি প্রধান শ্রেণী আছে। একটি শোষক, অপরটি শোষিত। দাস যুগে দাসমালিক ও দাস, সামন্ত যুগে সামন্তপ্রভু ও কৃষক বা ভূমিদাস, পুঁজিবাদী যুগে পুঁজিপতি ও শ্রমিক। প্রত্যেক যুগে প্রধান দুটি শ্রেণীর মধ্যবর্তী আরও কিছু শ্রেণী থাকে, যেমন আজ পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় পেটি বুর্জোয়া।

একমাত্র আদিম সাম্যবাদী সমাজ ও ভবিষ্যতের সাম্যবাদী সমাজ বাদ দিলে প্রত্যেক যুগে সমাজের কোনও না কোনও শ্রেণী অধিপতি শ্রেণী হয়। তারাই হয় শাসকশ্রেণী। রাষ্ট্র ব্যবস্থা, সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি সেই শ্রেণীর স্বার্থানুযায়ী তৈরী হয়। দাস সমাজে দাসমালিক, সামন্ত সমাজে সামন্তপ্রভু, পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিপতিশ্রেণী এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজে শ্রমিকশ্রেণী অধিপতি ও শাসকশ্রেণী। যে কোনও সংস্কৃতি, দর্শন, সামাজিক রীতিনীতি বিশেষ যুগের চিহ্ন ও বিশেষ শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে।

শ্রেণী বিভক্ত সমাজে শ্রেণী সংগ্রাম থাকবেই। শ্রেণী সংগ্রাম পরিণতি লাভ করে বিপ্লবে। শ্রেণী সংগ্রাম যে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বা রাজনৈতিক অঙ্গনে চলে, তাই নয়। উপরিকাঠামোর বিভিন্ন জায়গায়ও শ্রেণী সংগ্রাম চলে। একটি সমাজে সংস্কৃতি বা সামাজিক রীতিনীতির প্রধান অংশ ঐ সমাজে অধিপতি শ্রেণীর স্বার্থের প্রতিফলন ঘটায়। কিন্তু সেখানেও বিরুদ্ধ শ্রেণীর সংস্কৃতি বা বিরুদ্ধ শ্রেণীর (শোষিত শ্রেণীর) চিন্তাভাবনার পরিচয় বা ছাপ পাওয়া যায়।

রাষ্ট্র: আদিম সাম্যবাদী সমাজের পর যখন প্রথম শ্রেণী বিভক্ত সমাজের উদ্ভব, তখনই রাষ্ট্রের জন্ম। রাষ্ট্র এমন একটা ব্যবস্থা, যার দ্বারা শোষিত শ্রেণীকে দমন করে রাখা হয়। এর প্রধান অঙ্গ পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং প্রশাসন ব্যবস্থা। বিচার বিভাগ, আইন, ইত্যাদিও এর অন্তর্ভূক্ত। দাস সমাজ, সামন্ত সমাজ ও পুঁজিবাদী সমাজ – এই তিন সমাজে শোষণের পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন এবং রাষ্ট্রের রূপও ভিন্ন ভিন্ন। যেমন সামন্ত যুগে রাজতন্ত্র ছিল রাষ্ট্রের প্রধান চেহারা, পুঁজিবাদী যুগে রাজতন্ত্রের জায়গা দখল করেছে বুর্জোয়া গণতন্ত্র। তবে সকল যুগেই সকল সমাজ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য একই, তা হল এই যে, রাষ্ট্র হচ্ছে দমন-পীড়নের যন্ত্র।

বিপ্লবের মাধ্যমে বিপ্লবীশ্রেণী পুরাতন রাষ্ট্র কাঠামোকে পরিবর্তন করে নিজের শ্রেণী স্বার্থ অনুযায়ী নতুনভাবে রাষ্ট্র কাঠামো তৈরী করে। যতদিন যাচ্ছে রাষ্ট্রের কাঠামো তত জটিল হচ্ছে। কিন্তু প্রত্যেকটি শ্রেণী বিভক্ত সমাজে রাষ্ট্র হচ্ছে শোষকশ্রেণীর শোষণ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার প্রধান হাতিয়ার। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হল গুণগতভাবে ভিন্ন চরিত্রের। এখানেও রাষ্ট্র দমন করার জন্যই লাগে। কিন্তু তা শোষণের হাতিয়ার নয়। শ্রমিকশ্রেণী পুরাতন রাষ্ট্র ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙ্গে তার নিজস্ব স্বার্থানুযায়ী একেবারে নতুন ধরনের রাষ্ট্রযন্ত্র তৈরী করে যার রাজনৈতিক রূপ হচ্ছে সর্বহারার একনায়কত্ব।

বিপ্লব:- সামাজিক বিপ্লব বলতে বোঝায় সমাজের গুণগত পরিবর্তন অর্থাৎ এক সমাজ থেকে আরেক সমাজ ব্যবস্থায় রূপান্তর অর্থাৎ উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন। উৎপাদন সম্পর্কের কোন পরিবর্তন হল না, কিন্তু কেবলমাত্র সরকার পরিবর্তন হল (তা যদি জনগণের সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়েও হয়) তবে তাকে বিপ্লব বলা যায় না। সমাজ প্রতিদিনই কিছু কিছু করে পরিবর্তিত হচ্ছে। উৎপাদিকা শক্তির কিছু না কিছু বিকাশ হচ্ছে। এর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব পড়ছে। ক্রমাগত নতুন উৎপাদন সম্পর্কের তাগিদ জাগছে জনগণের একটা বিরাট অংশের মধ্যে। শোষিত ও নির্যাতিত শ্রেণীগুলির সঙ্গে শাসক ও শোষকশ্রেণীর দ্বন্দ্ব ক্রমাগত বাড়ছে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য অঙ্গনে শ্রেণীসংগ্রাম বিকাশ লাভ করছে। শোষিত ও নির্যাতিত শ্রেণীগুলির মধ্যে শ্রেণী চেতনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ গুলি হচ্ছে সমাজের পরিমাণগত পরিবর্তন। এ পরিবর্তন প্রতিদিনই হচ্ছে, কিন্তু এত সামান্য যে তা চোখে ধরা পড়ে না। শেষে একটা পর্যায়ে পরিমাণগত পরিবর্তন গুণগত পরিবর্তনে রূপান্তরিত হয়, যখন শোষিত শ্রেণীগুলি ক্ষমতাসীন শ্রেণীকে ক্ষমতাচ্যুত করে। এটাই বিপ্লব।

বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন শ্রেণী রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে এবং তারপরে সেই শ্রেণী প্রথমে রাষ্ট্রকে নিজের স্বার্থানুযায়ী তৈরী করে এবং একই সঙ্গে পুরাতন উৎপাদন সম্পর্ক বাতিল করে নতুন উৎপাদন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করে। তাহলে যে কোন ধরনের সরকার পরিবর্তন বা যে কোন ধরনের বিদ্রোহ তা যত মহৎ হোক না কেন (এমনকি তা যদি গণবিস্ফোরণ বা গণঅভ্যুত্থানও হয়), তাকে বিপ্লব বলা যাবে না।

বিপ্লবে দুটি জিনিস থাকতে হবে- ১) রাষ্ট্র ক্ষমতায় নতুন শ্রেণীর অবস্থান নেয়া এবং সেই শ্রেণীর স্বার্থানুযায়ী নতুন রাষ্ট্রকাঠামো তৈরী হওয়া, ২) উৎপাদন ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন অর্থাৎ উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তন। যেহেতু, বিপ্লব মানে নতুন শ্রেণীর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল (সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে এই শ্রেণী হল শ্রমিকশ্রেণী), অতএব বিপ্লব হবে সশস্ত্র। কারণ, রাষ্ট্রের প্রধান অঙ্গই হচ্ছে সশস্ত্রবাহিনী। হয় এই বাহিনীকে পরাজিত করতে হবে, অথবা সশস্ত্র বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যকে দলত্যাগ করে বিপ্লবের পক্ষে যোগদান করতে হবে, অন্যথায় বিপ্লব জয়যুক্ত হতে পারে না।

বিপ্লব মানে ক্ষমতাসীন শোষকশ্রেণীকে পরাজিত করে ক্ষমতা বহির্ভূত শোষিত ও নির্যাতিত শ্রেণীর বা শ্রেণীসমূহের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল। অতএব, বিপ্লব মানে গণবিপ্লব। এতে অবশ্যই ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। নির্বাচন বা সাধারণ ক্যু’র মাধ্যমে কখনও বিপ্লবের কাজ সম্পন্ন হতে পারে না।

এই হলো মার্ক্সীয় দর্শন এবং ঐতিহাসিক ও দ্বন্দ্বমূলক বস্ত্তুবাদের আলোকে সমাজ বিকাশ সম্পর্কে আমার শিক্ষা।

এবারে আসি আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে স্বামী বিবেকানন্দ সমাজ বিকাশ সম্বন্ধে কি বলেছেন তার কথায়।

‘‘আমি সমাজতন্ত্রী, তার কারণ এই নয় যে সমাজতন্ত্রকে আমি একটা পরিপূর্ণ বিশুদ্ধ সমাজব্যবস্থা বলে মনে করি, কারণটা এই যে উপবাস করার চেয়ে আধখানা রুটি মেলাও ভাল।’’

‘‘অন্য সব সমাজব্যবস্থাই পরীক্ষা করে দেখা গেছে সেগুলি ত্রুটিপূর্ণ। এই অবস্থাটাকেও একবার পরীক্ষা করে দেখা যাক; আর কিছুর জন্য না হলেও অন্তত এর নূতনত্বের জন্যই একবার পরীক্ষা করা দরকার। একই মানুষের দল সব সময় সুখ বা দুঃখ ভোগ করে যাবে; তার চেয়ে বরং সুখদুঃখের একটা পুনর্বণ্টন হওয়াই ভাল! ভাল-মন্দের মোট পরিমাণ পৃথিবীতে সব সময় একই থাকে। নূতন নূতন ব্যবস্থার দ্বারা জোয়ালটা কাঁধ বদল করে মাত্র, আর কিছু নয়।

“সমাজের নীচেকার লোকটিও এই দুঃখময় পৃথিবীতে একটু সুদিনের মুখ দেখুক। এর ফলে এই তথাকথিত সুখাস্বাদের অভিজ্ঞতা পার হয়ে এরা সবাই এসে শেষ পৰ্য্ন্ত পরমেশ্বরের শরণ নেবে; এই পৃথিবী, তার গভর্ণমেণ্ট, তার আর যত সমস্যা সম্পর্কে এদের সকল মিথ্যা মায়ামোহ তখন কেটে যাবে।

এই উদ্ধৃতিগুলির ভিতরে বিবেকানন্দের মানসপরিধি এবং তার ভাবনার স্বরূপ সার্থকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বাস্তব সমাজ ব্যবস্থাটাকে উন্নত করার প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে একদিন আমাদের সকল দুঃখের অবসান ঘটবে, এই ধারণাটা যে ভুল, সে কথাটা প্রমাণ করাই নিম্নে উদ্ধৃত অংশটির মূল উদ্দেশ্য।

“আর একটা মস্ত বড় ভুল আমরা করে থাকি এই ভেবে যে পৃথিবীতে মঙ্গলের পরিমাণটা ক্রমবর্ধিষ্ণু এবং অমঙ্গলের পরিমাণটা ক্রমক্ষয়িষ্ণু। এর থেকে এটাই প্রমাণ করার চেষ্টা হয়ে থাকে যে, অমঙ্গলটা ক্রমশঃ ক্ষয় হয়ে লোপ পেয়ে যাবে, এবং শেষ পর্যন্ত মঙ্গলটাই শুধু থাকবে।…কিন্তু সমাজের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মঙ্গল যত বাড়ছে, অমঙ্গলও ততই বেড়ে চলেছে।” সমাজ-জীবনের ব্যবহারিক বা বস্তুতান্ত্রিক অগ্রগতির ধারা মানুষের সমস্যার শেষ সমাধান করতে পারে না। চিত্ত ও চেতনাকে ঈশ্বরভাবে ভাবিত করে তবেই মানুষের নিষ্কৃতি”।অথচ, একথা ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে এই রচনার মধ্যপথে বিবেকানন্দ ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়,বৈশ্য ও শূদ্রদের ক্রমিক আধিপত্যের ভিত্তিতে সমাজ বিবর্তনের কথা বলেছেন এবং একথা অকুষ্ঠিতভাবেই স্বীকার করা চলে যে উনবিংশ শতাব্দীর প্রান্তবাসী এই সাধক-সন্ন্যাসীই ভারতীয় মনীষীদের ভিতরে সর্বপ্রথম শ্রেণীস্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজ বিবর্তনের ধারা অনুধাবন করার মত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর বিশ্লেষণ-পদ্ধতি আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের দিক থেকে কতটা অসম্পূর্ণ সে কথা স্বতন্ত্র। কিন্তু সামাজিক পরিবর্তনের মূল সূত্রের ভিতরে তিনি যে শ্রেণীস্বার্থের সন্ধান পেয়েছেন এবং সে-কথা যে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করেছেন ভারতীয় সমাজদর্শনের ক্ষেত্রে তাঁর এই মৌলিকত্ব অনস্বীকার্য।

তিনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়,বৈশ্য ও শূদ্র এই চারিটি শব্দের ব্যঞ্জনগত ব্যাপক অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং এর দ্বারা সমগ্র মানবসমাজের ইতিহাস ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। শ্রেণীবিভক্ত সমাজের প্রথম স্তরটিকে ব্রাহ্মণ্য সভ্যতা বলে সামগ্রিক ভাবে চিহ্নিত করা যুক্তিযুক্ত কিনা সে বিষয়ে ন্যায়সঙ্গত সন্দেহ থাকলেও এবং ক্ষয়িষ্ণু ব্রাহ্মণ্য সভ্যতার সঙ্গে উন্মেষমুখী ক্ষাত্রসভ্যতার সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের দ্বিতীয় স্তরে পৌঁছবার ধারণাটিকে একটি অতিসরলীকৃত সূত্র বলে অগ্রাহ্য করলেও বৈশ্য ও শূদ্র সভ্যতা সম্পর্কে বিবেকানন্দ যা বলেছেন তা আধুনিক সভ্যতার মর্মভেদী এক সুগভীর অন্তদৃষ্টির পরিচায়ক।বৈশ্য শাসনের মূলগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিবেকানন্দ বলেছেন-“It is awful in its silent crushing and blood-sucking power.”বিবেকানন্দ মোটেই মার্কসবাদী ছিলেন না একথা মনে রাখলে এই বাক্যটির ব্যঞ্জনাময় বৈশিষ্ট্য আমাদের আরও বেশী বিস্মিত করে। মার্কসবাদী সমাজবিজ্ঞানী সমাজবাস্তবের আরও সুনিপুণ বিশ্লেষণ করে এই কথাই বলতেন। পণ্যপ্রধান পুঁজিবাদী সভ্যতায় শ্রমিকের শ্রমজাত উদ্বৃত্ত মূল্য মুনাফার আকারে নিঙড়ে নেয়ার এমন একটি কৌশল আছে যে শ্রমিকের মোট শ্রমের কত অংশ তার নিজের জন্য আর কত অংশ মালিকের মুনাফার জন্য বিনা পারিশ্রমিকে নিয়োজিত হচ্ছে সে হিসাব করা শ্রমিকের পক্ষে অসাধ্য হয়ে ওঠে। ভূমিপ্রধান ক্ষত্রিয়যুগে শ্রমজীবী মানুষের স্বাৰ্থমুখী শ্রম ও মালিকমুখী শ্রমের পরিমাণিক পার্থক্যটা যত সহজে চোখে পড়ে পণ্যপ্রধান বৈশ্য সভ্যতায় তত সহজে চোখে পড়ে না। পণ্যময়ী জুজুমূর্তির অন্তরালে শ্রমিকের শ্রমসঞ্জাত মূল্য-পরিমাণটা ঢাকা পড়ে যায়। পণ্যের বিনিময় যে মূলতঃ শ্রমশক্তির মূল্যের বিনিময়, আর সেই মূল্যের একটা বিরাট অংশ যে উদ্বৃত্ত হয়ে মুনাফার আকারে শোষণ করে নেয়া হয়—উৎপাদনের এই সামাজিক ইতিহাসটা চাপা পড়ে যায়।

এইজন্যই পুঁজিবাদী আমলে শোষণটা চলে নিঃশব্দে, কারণ শোষণকে শোষণ বলে চেনা যায় না, এবং এই শোষণের পরিমাণটাও নিঃশব্দে বেড়ে চলে। পণ্যের গায়ে তার মূল্যোৎপত্তির ইতিহাসটা ব্যাখ্যা করে লেখা থাকে না।এতটা বিশ্লেষণী চিন্তার ভিত্তিতে বিবেকানন্দ ও কথাটি বলেননি। কিন্তু একটা ব্যাপার তিনি পরিষ্কারভাবেই লক্ষ্য করেছেন, পণ্যবাহিনী বৈশ্যসভ্যতার আড়ালে মানুষের রক্ত শোষণ চলে নিঃশব্দে এবং এই শোষণ আরো বেশী ভয়ঙ্কর।বৈশ্য-সভ্যতার মূল্যনিরূপণে বিবেকানন্দ একদেশদর্শী ছিলেন না। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পৰ্যন্ত বিপুল পরিমাণ পণ্যসঞ্চালনের মারফত মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগসূত্র স্থাপন করেছে এই বৈশ্যসভ্যতা, এবং একই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন সীমাবদ্ধ জ্ঞান বিজ্ঞান কৃষি ও সভ্যতার অমূল্য সম্পদ ছড়িয়ে দিয়েছে সারা পৃথিবীতে।

কিন্তু ঠিক এর পরই তিনি প্রশ্ন করছেন, “যাদের শারীরিক শ্রমের ওপর নির্ভর করে ব্রাহ্মণের প্রভাব, ক্ষত্রিয়ের ক্ষমতা ও বৈশ্যের সম্পদ সম্ভব হয়েছে তারা কোথায়? সব দেশে সব যুগে যাদের নাম দেওয়া হয়েছে “নীচু জাতি,” “অন্ত্যজ,” অথচ যারাই হল আসলে সমাজের শরীর, তাদের ইতিহাসটা কি? উচ্চবর্ণের একচ্ছত্র অধিকারকবলিত জ্ঞানবিজ্ঞানের ভাণ্ডারে একটু ভাগ বসাবার অপরাধে ভারতবর্ষে যাদের জন্য জিহ্বা ও মাংস উপড়ে নেওয়ার মত কোমল শাস্তি বিধান করা হয়েছে ভারতের সেই চলন্ত শবগুলি, বিশ্বের সেই ভারবাহী পশুগুলি, সেই শূদ্র জনসাধারণ, তাদের ভাগ্যে কি লেখা আছে?” বৈশ্য সভ্যতার বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ্য করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এর এমন একটি সাধারণ চরিত্র লক্ষ্য করেছেন যা যে কেউ সমর্থন করবেন। তিনি বললেন, “ক্ষত্রিয়ের হাত থেকে ক্ষমতা করায়ত্ত করার সময়ে বৈশ্যদের এমন কোনও সদিচ্ছা ছিলনা যে ক্ষমতাটা শূদ্রশ্রেণীর হাতে পড়ুক।’’

এই একই প্রবন্ধের প্রারম্ভে তিনি দেখিয়েছেন যে শাসনক্ষমতায় জনসাধারণের প্রকৃত অধিকার ভারতবর্ষে কোনও দিন ছিল না, না ব্রাহ্মণযুগে, না ক্ষত্রিয়-বৌদ্ধযুগে। ইতস্ততঃ পরোক্ষভাবে, বিক্ষিপ্ত ও বিশৃঙ্খলভাবে জনসাধারণ আত্মপ্রকাশের জন্য সংগ্ৰাম করেছে। কিন্তু তারা নিজেদের ভিতরে কোনও সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তুলতে পারে নি। শিক্ষাদীক্ষা যখন সবই ছিল ঋষিদের হাতে তখন স্বভাবতই জনতার পক্ষে এমন কোনও শিক্ষালাভের সম্ভাবনা ছিল না যার দ্বারা তারা কোনও উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, মানুষের সামগ্রিক ও সাধারণ মঙ্গলের জন্য একতাবদ্ধ হতে পারে। এদিকে কিন্তু পারস্পরিক স্বার্থের খাতিরে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় শেষ পৰ্যন্ত ঐক্যবদ্ধ হলো। এই ধরণের ঐক্যের সহজাত পাপ হিসেবে এরা সবাই মিলে জনসাধারণের রক্তশোষণ, শক্রর উপর প্রতিহিংসা, অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন করার কাজগুলি চালিয়ে যেতে লাগল, এবং শেষ পর্যন্ত পশ্চিমাগত মুসলমান আক্রমণকারীদের হাতে সস্তা ও সহজ শিকারে পরিণত হল। শোষিত জনসাধারণের দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতীয় সমাজেতিহাসের এমন স্পষ্ট বিচার বিবেকানন্দের পূর্বে অন্য কোনও ভারতীয় মনীষী করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। অক্টোবরের রুশ বিপ্লবের সঙ্গে পূর্ববর্তী বিপ্লবগুলির মৌলিক পার্থক্য দেখাতে গিয়ে মাক্সবাদী দার্শনিকরা বলেছেন পূর্ববর্তী বিপ্লবগুলিতে একদল শোষকশ্রেণীর জায়গায় আর একদল শোষকশ্রেণী ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মাত্ৰ, শোষিত শ্রেণীর হাতে কোনও দিনই ক্ষমতা আসেনি। কিন্তু অক্টোবর বিপ্লবই হল পৃথিবীর প্রথম বিপ্লব যা শোষিত শ্রেণীকে ক্ষমতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিবেকানন্দ “শূদ্র-বিপ্লব” দেখে যাননি, কিন্তু প্রাক্-শূদ্র বিপ্লবগুলিতে শেষপৰ্যন্ত যে শোষকশ্রেণীর হাতেই সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা বহাল রয়েছে এ ঘটনা তাঁর সন্ধানী চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারেনি। সমকালীন পশ্চিমী সমাজের গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করে আসন্ন “শূদ্র-বিপ্লব সম্পর্কে বিবেকানন্দ নিঃসংশয় ছিলেন, “সোশ্যালিজম, এনার্কিজম, নিহিলিজম এবং এই জাতীয় অন্যান্য মতবাদগুলি আসন্ন সমাজবিপ্লবের অগ্রদূত, “শূদ্রের আধিপত্য অবশ্যম্ভাবী, কেউ একে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না

শ্রমিকশ্রেণীকে পঙ্গু করে রাখার জন্য পুঁজিপতি শ্রেণীর একটা চিরাচরিত অপকৌশল আছে। নিপীড়িত শ্রেণীর ভিতরে যদি কেউ বিদ্যাবুদ্ধি ও গুণগরিমায় প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন, চতুর পুঁজিপতিশ্রেণী তাকে ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধা ও ক্ষমতা দিয়ে নিজেদের দলে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করে, যার ফলে সে আপন শ্রেণীগত দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিচুত হয়ে শেষ পর্যন্ত পুঁজিবাদের সেবাতেই আত্মনিয়োগ করে, পুঁজিবাদের স্বার্থে নিজশ্রেণীর উপর নিজের বিস্তীর্ণ প্রভাবের অপব্যবহার করে এবং বিপ্লবের পথ থেকে শ্রমিক শ্রেণীকে প্রতিনিবৃত্ত করে। বিবেকানন্দ প্রাচীন ভারতীয় সমাজেও নিপীড়িত শ্রেণীর মানুষের এই স্বধৰ্মচুতি ও স্বশ্রেণীদ্রোহিতা দেখতে পেয়েছেন।

“শূদ্রকে ধন সঞ্চয়, জ্ঞানার্জন ও শিক্ষালাভের কোনও সুযোগই দেয়া হয়নি বললেও চলে। এই সামাজিক বঞ্চনার সঙ্গে আরও একটা অসুবিধা এনে যোগ করে দেয়া হল। শূদ্রশ্রেণীর ভিতরে অসাধারণ গুণাবলী ও প্রতিভা নিয়ে কেউ যদি জন্মগ্রহণ করত তখনই সমাজের উচ্চতর প্রভাবশালী শ্রেণীগুলি তার উপর সম্মান ও উপাধির পুষ্পবৃষ্টি করত, এবং তাকে তার আপনি শ্রেণীর পরিধি থেকে টেনে তুলে নিয়ে উচ্চতর গোষ্ঠীচক্রের মধ্যে স্থান করে দিত। তার সম্পদ ও প্রজ্ঞাশক্তি তখন নিয়োজিত হত একটি বিজাতীয় শ্রেণীর স্বার্থে। তার আপন শ্রেণীর জনসাধারণ তার বিদ্যাবুদ্ধি ও সম্পদ থেকে কোনও সাহায্যই পায় নি।” এই স্বধৰ্মচ্যুতি ও স্বশ্ৰেণীদ্রোহের দৃষ্টান্ত হিসাবে তিনি যাঁদের নাম বললেন তাঁরা হলেন বশিষ্ট, নারদ, জাবাল সত্যকাম, ব্যাস, কৃপ, দ্রোণ এবং কর্ণ। শ্রেণীআভিজাত্যের দিক থেকে এদের প্রত্যেকেরই জন্মকাহিনী,পিতৃপরিচয় বা মাতৃপরিচয় সন্দিগ্ধ রহস্যে আবৃত। “জ্ঞান বা বীরত্বের পুরস্কার স্বরূপ এঁরা কেউবা ব্রাহ্মণ সমাজে কেউবা ক্ষত্রিয় সমাজে উন্নীত হলেন।” বিবেকানন্দ মন্তব্য করেছেন-“এদের এই সামাজিক উর্ধ্বগতির ফলে গণিকা, দাসী, মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কি যে উপকার হল তা বোঝা দুষ্কর।”। ব্যাস, বিদুর ও জাবাল সত্যকামের উদাহরণ দেখিয়ে যখন আমরা প্ৰাচীন ভারতের উদার আদর্শের জয়গানে আবেগে আত্মহারা হই তখন বিবেকানন্দ দেখালেন যে উচ্চশ্রেণীর এই স্বার্থগন্ধী উদারতায় আত্মপ্রসাদের কোনও অবকাশ নেই। এই চমকপ্রদ ব্যাখ্যার ভিতরে অনেকটা কল্পনা ও অতিশয়োক্তির আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে এমন সন্দেহের অবকাশ থাকলেও প্রাচীন ভারতীয় সমাজ বাস্তবের বিশ্লেষণে সুপ্রযুক্ত এই বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গী ও বৈজ্ঞানিক প্রচেষ্টা এবং একটি সংস্কারমুক্ত সতর্ক চেতনা আমাদের আধুনিক মনকেও সচকিত করে তোলে, নূতন করে ভাববার রসদ যোগায়। আমরা সকলেই জানি দার্শনিক দিক থেকে বিবেকানন্দ ছিলেন শঙ্কর-বেদান্তের অনুগামী। তথাপি বলতে দ্বিধা করলেন না, “রামানুজ শঙ্কর, এরা শুধু পণ্ডিত মাত্রই ছিলেন, এদের হৃদয় ছিল অতি সঙ্কীর্ণ। কোথায় সেই ভালবাসা, পরের দুঃখে কাঁদে কোথায় সেই হৃদয়?

ভারতে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিবেকানন্দের ধিক্কারও কম জ্বালাময় ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে অবাক লাগে এই ভেবে যে অমন সুতীব্ৰ আবেগও তাঁর বুদ্ধির দীপ্তিকে কলুষিত করতে পারেনি। মিস মেরী হেলির কাছে লেখা একখানা চিঠিতে লিখলেন,"আধুনিক ভারতে বৃটিশ শাসনের কেবল একটা মাত্ৰই মাঙ্গলিক চরিত্র আছে যদিও এই চরিত্রটি এসে পড়েছে বৃটিশের অজ্ঞাতসারে। এই শাসন আর একবার ভারতবর্ষকে বিশ্বের রঙ্গমঞ্চে টেনে বার করেছে, বহির্জগতের সংস্পর্শে আসতে তাকে বাধ্য করেছে” “কিন্তু রক্ত শোষণ করাই যে শাসনের মূল উদ্দেশ্য সে শাসন দেশের মূলত কোনও মঙ্গল করতে পারে না … শিক্ষাবিস্তার আর বরদাস্ত করা হবেনা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা শেষ হয়ে গেছে, অবশ্য বহু আগেই আমাদের নিরস্ত্র করা হয়েছে। কয়েকটি নিরীহ সমালোচনামূলক কথা লেখার জন্য তৎক্ষণাৎ যাবজ্জীবন কারাবাসের ব্যবস্থা হয়েছে,অন্যদের বিনাবিচারে আটক করা হয়েছে, কেউ জানে না এদের মাথা কয়টা কখন কেটে ফেলা হবে। ইংরেজ সৈনিকরা আমাদের পুরুষদের হত্যা করেছে, নারীদের ইজ্জত কেড়ে নিচ্ছে। আর এরই পুরস্কার হিসাবে আমাদের পয়সায় এই সৈনিকদের পথ-খরচা ও পেন্সন দিয়ে বিলাতে পাঠানো হচ্ছে। মনে করো তুমি আমার এই চিঠিখানা প্রকাশ করে ফেলেছ, তাহলে ভারতবর্ষে এই মাত্ৰ যে আইন পাশ হয়েছে সেই আইনের বলে ভারতীয় ইংরেজ সরকার এখান থেকে আমাকে টেনে হিচড়ে ভারতে নিয়ে যেতে পারবে এবং বিনা বিচারে আমাকে হত্যা করতে পারবে। দরকার হলে রয়টারের প্রতিনিধি হুকুম মাফিক খবর তৈরী করে ঠিক উল্টা খবর প্রকাশ করবে। যে ঈশ্বর সকলের পিতা, দুৰ্বলের রক্ষার জন্য যিনি সবলকে ভয় করেন না, যাঁকে ঘুষ দিয়ে কেনা যায় না এমন একজন ঈশ্বর কি কোথাও আছেন?" এরই সঙ্গে আবার মিলিয়ে দেখুন, “যীশু আর বাইবেল দিয়ে ইংল্যাণ্ড ভারতবর্ষ জয় করেনি। ভারতবর্ষ জয় করেছে সেই ইংল্যাণ্ড ফ্যাক্টরির চিমনি যার রণপতাকা, পৃথিবীর বাজার যার রণক্ষেত্র।

বিবেকানন্দের ভাবনার ভিতরে স্বদেশচেতনা ও শ্রেণীচেতনা কিরূপ একাত্মতা লাভ করেছিল তার দৃষ্টান্ত হিসাবে আর একটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি। চিকাগো থেকে তিনি দেওয়ান হরিদাস বিহায়ীদাস দেশাইকে লিখেছেন-“ইতিহাসের কোনকালে কবে কোথায় তোমাদের ধনিক জমিদার পুরোহিত ও রাজরাজরার দল গরীবের জন্য একবার ও ভেবেছে? অথচ এদের মাথাগুলো গুঁড়ো করেই তো তাদের শক্তির জীবনশোণিত তৈরী হয়েছে। ভারতের দরিদ্রশ্রেণীর ভিতরে এত বেশী মুসলমান কেন বলতে পার? তরবারির জোরে তাদের ধর্মান্তরিত করা হয়েছে একথা অর্থহীন। জমিদার ও পুরোহিতের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার আশাতেই তারা মুসলমান হয়েছে। এরই ফলে দেখতে পাচ্ছ বাংলাদেশের কৃষকশ্রেণীর ভিতরে হিন্দুর চেয়ে মুসলমান অনেক বেশী কারণ বাংলাদেশে জমিদারের সংখ্যাটা অনেক বেশী।” এ ব্যাখ্যা সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করি বা না করি, সন্ন্যাসীর ইতিহাসচেতনায় শ্রেণীচেতনার প্রভাব এখানে সুস্পষ্ট। বিবেকানন্দ অন্যত্র একাধিকবার উল্লেখ করেছেন যে শোষিত শ্রমজীবী জনসাধারণ শোষকশ্রেণীর করায়ত্ত রাজশক্তির সমর্থনে দাঁড়াবার মত কোনও উৎসাহ অনুভব করেনি বলেই ভারতবর্ষ বারবার বিদেশীশক্তির পদানত হয়েছে।

কিন্তু এই চেতনার সঙ্গে সঙ্গে তার ভাবনার যে একটা সুনির্দিষ্ট সীমা ছিল সেদিকেও লক্ষ্য না রাখলে আমাদের আলোচনা পথভ্রষ্ট হতে বাধ্য। তিনি একথাও বলেছেন, “সবশেষে আসবে শ্রমজীবীর প্রভুত্ব। এর একটা সুফল ফলবে, পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পুনর্বণ্টন হবে, সঙ্গে সঙ্গে এর একটা কুফলও বোধ হয় দেখা দেবে, সংস্কৃতির মান নীচে নেমে যাবে। সাধারণ শিক্ষা বিপুলভাবে প্রসার লাভ করবে, কিন্তু অসাধারণ প্রতিভাশালীদের সংখ্যা ক্রমশঃ কমে যাবে।” যুগ থেকে যুগান্তব্যাপী একটানা বঞ্চনার প্রতিক্রিয়া হিসাবে “শূদ্র-বিপ্লব” অবশ্যম্ভাবী। বিবেকানন্দ তাঁর দিনে এই অনাগত ও আসন্ন বিপ্লবকে ভবিষ্যতের অভিনন্দন জানাতে কুণ্ঠা বোধ করেননি। ন্যায়নীতি ও সমাজনীতি উভয় দিক থেকেই এ বিপ্লব অপরিহার্য্য একথা তিনি বুঝেছিলেন। তবুও এ বিপ্লবের দ্বারা মানুষের মনুষ্যত্ব যে দুৰ্বার পদক্ষেপে অগ্রগামী হবে এমন বিশ্বাস তাঁর ছিল না, এ বিপ্লবের দ্বারা মনুষ্যত্ব লাভের সমস্যা সমাধান হবে এমন আশা তিনি পোষণ করতেন না। “শূদ্র-চরিত্র” সম্পর্কে একটা নিদারুণ বেদনাময় হতাশা এই অবিশ্বাসের মূলে কাজ করেছে। 

“বর্তমান ভারত” প্রবন্ধে তিনি বললেন “শূদ্র-শ্রেণীর” অভ্যুত্থান অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু শূদ্র জাগবে তার শূদ্রত্ব নিয়ে। “শূদ্রত্ব” বলতে তিনি কি বোঝাতে চেয়েছেন তাও ব্যাখ্যা করেছেন। “স্মরণাতীত কাল থেকে অত্যাচারের চাপে বিচূৰ্ণিত এই শূদ্র শ্রেণী দাসমনোবৃত্তি গ্রহণ করে কুকুরের মত উচ্চবর্ণের পদলেহন করে এসেছে আর না হয়ত অমানুষ নিষ্ঠুর পশুতে পরিণত হয়েছে। তাদের আশা ভরসা বার বার ধূলিসাৎ হয়েছে। লক্ষ্যানুসন্ধানের দৃঢ়তা ও কর্মক্ষেত্রে অবিচল অধ্যবসায় বলতে তাদের কিছুই নেই।” বিবেকানন্দ যে আদর্শ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছেন সে স্বপ্ন যে কোনওদিন বাস্তবে রূপায়িত হবে এমন ভরসা তার ছিল না। ব্রাহ্মণের প্রজ্ঞা, ক্ষত্রিয়ের শক্তি, বৈশ্যের সংগঠনী প্রতিভা ও শূদ্রের সাম্যনীতির সমন্বিত স্বরূপই ছিল তার আদর্শ রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি। কিন্তু এই বলিষ্ঠ কল্পনাকে তিনি একটি সন্দেহাকুল জিজ্ঞাসা চিহ্ন দিয়ে সমাপ্ত করলেন–“কিন্তু সে কি সম্ভব?”

তাঁর জীবনে এ জিজ্ঞাসার উত্তর মেলেনি। দ্বিধা-কণ্টকিত সমাজে জীবনের এই নিরুত্তর জিজ্ঞাসা, ব্যথিত আবেগের এই আশাহীন ব্যাকুলতাই বোধ হয় তাঁকে ব্রহ্ম-জিজ্ঞাসার পথে সকল সমস্যার চরম বিশ্রান্তি খুঁজতে বাধ্য করেছে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিতর দিয়ে মানুষকে যেতে হবে, শ্রমজীবীর আধিপত্যের ভিতর দিয়ে মানুষের সামাজিক অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হবে ইতিহাসের এই অমোঘ অনুশাসন লঙ্ঘন করার উপায় নেই। কিন্তু এই অভিজ্ঞতাই সব শেষে মানুষকে বুঝিয়ে দেবে এও যথেষ্ট নয়। আরও আগে চলতে হবে। সামাজিক ও ব্যবহারিক উন্নতির উত্তঙ্গ শিখরে আরোহণ করেও শেষ রক্ষা হবে না। তখন মানুষ বুঝতে পারবে আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য্যই সবচেয়ে বড় কথা। যাকে জানলে সব জানা হয়ে যায়, যাকে পেলে আর কিছু পাওয়ার বাকী থাকে না, যার আলোতে চন্দ্র-সূর্য আলো দেয়, সেই পরমেশ্বরের ঐকান্তিক আরাধনাই চরম মুক্তির পরম পন্থা। স্বচ্ছ দৃষ্টি, ক্ষুরধার বুদ্ধি, বিজ্ঞানীসুলভ বিশ্লেষণী শক্তি, নিপীড়িত মানুষের কল্যাণকামনায় উদ্বেলিত এক দুরন্ত আবেগ, এ সব কিছুই যেন কোনও এক অবসন্ন সন্ধ্যায় চূড়ান্ত অবসান খুঁজেছে বৈদান্তিক ব্রহ্মবাদের পরম প্রশান্তির মধ্যে। যে ঈশ্বর মানুষের মুখে রুটি যোগাতে পারে না সে ঈশ্বরে বিবেকানন্দ বিশ্বাস করেননি। কিন্তু রুটি যেদিন জুটবে সেদিন মানুষও বুঝবে রুটির চেয়ে ঈশ্বর অনেক বড়, এই ছিল সমাজবাদী বিবেকানন্দের অধ্যাত্মবাদী বিশ্বাস। 

কে ঠিক? কে ভুল? এ বিচার করার যোগ্যতা এবং ধৃষ্টতা আমার নেই। দূরদর্শী দার্শনিকদের তত্ত্ব এবং বিশ্বাসের সত্যতা কেবল সময়ই নিরূপণ করতে পারে। সাম্যবাদের যে প্রভাতে শ্রেণীহীন সমাজের সূর্যোদয় হবে সেই প্রভাতকে স্বাগত জানাবার জন্য হয়তো আমাদের প্রজন্মের কেউ থাকবে না। তবুও নিশ্চিত জানি সেই প্রভাত আসবেই। কিন্তু তার পরের সন্ধান আজও পাইনি। তারই খোঁজ করে চলেছি অবিরাম। তার খোঁজ পাওয়া কি সম্ভব, কোথায় পাবো তার খোঁজ?

0 comments: