প্রবন্ধ - অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী
Posted in প্রবন্ধ
প্রবন্ধ
বিবেকানন্দ ও তাঁর অনুগামীদের বেদান্তপ্রচারঃ ব্রাহ্মসমাজ ও রবীন্দ্রনাথের চোখে
অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী
শিকাগোর ধর্মমহাসভায় ভারতের নানা ধর্মমতের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তৃতা করে ১৮৯৩ সালে সনাতন হিন্দুধর্মের প্রচারক স্বামী বিবেকানন্দ ছাড়া অন্য যাঁরা শ্রোতাদের আগ্রহ ও প্রশংসা অর্জন করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হলেন বৌদ্ধধর্মের অনাগারিক ধর্মপাল, জৈনধর্মের বীরচাঁদ গান্ধী, নববিধান বা ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের প্রতাপচন্দ্র মজুমদার। ভারতীয় বক্তাদের সাফল্যের এই সংবাদ ভারতবর্ষের জনমানসে স্বভাবতই প্রভূত উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিল। ভারতে, বিশেষত বাংলাদেশে এই গণ-উদ্দীপনার নায়ক ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। বিদেশপ্রত্যাগত এই সন্ন্যাসী যখন ১৮৯৭ সালে তাঁর জন্মভূমির তটে এসে অবতরণ করলেন তখন যেন আসমুদ্রবঙ্গভূমি ভারতবর্ষ তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে বলল, “তরুণ বীরের বেশে তুমি করলে বিশ্বজয়, একি গো বিস্ময়!” বিবেকানন্দের গণ-অভ্যর্থনার প্রথম ঢেউ যেন আছড়ে পড়ল সিংহলের সমুদ্রতটে, সেখানে এই যুবক সন্ন্যাসীর সম্বর্ধনার বিবরণ পড়ে আজ মনে হয়, তিনি যেন সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন আর এক ‘বাঙালির ছেলে বিজয়সিংহ রূপেই! ’ তারপর সেই ঢেউ কলোম্বো-রামনাদ- মাদ্রাজ- মহীশূর হয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গেল ভাগীরথীর ধারায় ধোয়া বাংলাদেশকেও ! কবির ভাষায় “জনমিল যেথা বিবেকানন্দ দেশ-আত্মার কুন্ঠা হরি’’ , স্বামীজির নিজের ভাষায় যে শহরের পথের ধূলোয় তিনি খেলা করেছেন, তাঁর সেই ‘শৈশবের শিশুশয্যা’ কলকাতা নগরীর পক্ষে তাঁকে প্রথম নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হল শোভাবাজারের রাজবাড়ির প্রাঙ্গণে। সে ইতিহাস আজ সুবিদিত।
কিন্তু বিবেকানন্দের ঐ “বিশ্ববিজয়ে’’র পরবর্তী উৎসাহপ্লাবন সত্যিই কি বাঙলাদেশের সকলকেই ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল? বা অভিভূত করেছিল সমভাবে? সাধারণ জনমনে বা শিক্ষিতমানসে এ-ঘটনা যে একধরনের আলোড়ন এনেছিল এ-নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই, কিন্তু এই ঘটনার গুরুত্ব সম্পর্কে সবাই কি একমত ছিলেন, বিশেষ করে সেই ব্রাহ্মসমাজের মানুষজন, যাঁরা বিবেকানন্দ ও তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণের প্রচারিত ধর্ম ও সাধনপদ্ধতির অনেক কিছুই অনুমোদন করতেননা? আমাদের মনে রাখতে হবে যে, তখনকার বাংলাদেশে ব্রাহ্মসমাজের তিনটি শাখা সক্রিয় ছিল - আদি, ভারতবর্ষীয় ও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ। নববিধান [বা ভারতবর্ষীয়] সমাজের নেতা কেশবচন্দ্র সেন কিন্তু ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের একজন অনুরাগী, বস্তুত তিনিই প্রথম এই গ্রাম্য সাধকের কথা সুধীসমাজে প্রচার করেন। আবার প্রাক্-সন্ন্যাস জীবনে বিবেকানন্দ নিজে একদা যুক্ত ছিলেন ব্রাহ্মদের সর্বাধুনিক শাখাটির অর্থাৎ সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে। আবার তারও আগে ঈশ্বরজিজ্ঞাসু তরুণ বিবেকানন্দ উপস্থিত হয়েছেন আদি ব্রাহ্মসমাজের নেতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে।
বিবেকানন্দের বিশ্বখ্যাতি ও সমকালের ব্রাহ্ম প্রতিক্রিয়া
এই পটভূমিটুকু মনে রেখে অগ্রসর হলে আমরা দেখতে পাই যে, আদিসমাজের প্রধান পুরুষ দেবেন্দ্রনাথ শিকাগোতে তাঁর পুর্বপরিচিত যুবকের সাফল্যসংবাদ শুনেই বিবেকানন্দের কলকাতার বাড়িতে এক অভিনন্দন বার্তা পাঠান, স্বামীজি তখনও দেশে ফেরেন নি। দেশে ফিরে আসার পর তিনি অবশ্য মহর্ষির সঙ্গে সৌজন্য-সাক্ষাৎ করে এসেছিলেন, কিন্তু তাতে যে ব্রাহ্মসমাজ ও রামকৃষ্ণ-অনুগামীদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব লোপ পায়নি, সে-কথা বলাই বাহুল্য। শ্রীরামকৃষ্ণ আদি ব্রাহ্মসমাজের দৃষ্টিতে ছিলেন একজন মূর্তি-উপাসক, যে-উপাসনাকে স্বীকার করা ঠাকুর-পরিবারের মানুষদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। এ-জন্যই হয়তো দেবেন্দ্রনাথের ঐ চিঠি পাঠানোর সমকালেই ১৮৯৪ সালে আদি ব্রাহ্মসমাজের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত [জ্যৈষ্ঠ, ১৮১৬] এই সমাজের উপাচার্য চিন্তামণি চট্টোপাধ্যায়ের ‘শিকাগো ধর্মমেলা’ নামে এক প্রবন্ধে এই ধর্মসভার গুরুত্বের কথা বলা হলেও বিবেকানন্দের [এমন কি প্রতাপ মজুমদারেরও] নামোল্লেখ পর্যন্ত করা হয়নি! আবার আর একটি ব্রাহ্ম পত্রিকা ‘বামাবোধিনী’-তে ‘আমেরিকায় বঙ্গের গৌরব’ শিরোনামে যে-মন্তব্য করা হয়েছিল, তাতে বিবেকানন্দের কথা অনুল্লিখিত থাকলেও এই পত্রিকাটির মতে ঐ সভায় প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের বক্তৃতাই নাকি ছিল ‘সর্বোৎকৃষ্ট’!
এ-সব সত্ত্বেও ‘বিশ্বখ্যাতি’ অর্জন করে এই রামকৃষ্ণ-শিষ্য যখন দেশে ফেরেন, তখন সাধারণ মানুষের বিবেকানন্দের প্রতি সপ্রশংস উন্মাদনা লক্ষ করেই হয়তো তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সাফল্যে সংযত ভাষায় আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। “খ্যাতনামা হিন্দুধর্ম প্রচারক বিবেকানন্দ স্বামী”র “সুদূর বিদেশে ব্রহ্মজ্ঞান প্রচারে”র গুরুত্ব অস্বীকার না করেও তিনি লিখেছিলেন, “তাঁহার সহিত কোনো কোনো বিষয়ে আমাদের অনৈক্য থাকিলেও মূলে তাঁহার মতের সহিত আমাদের সম্পূর্ণ ঐক্য আছে।“ [চৈত্র, ১৮১৮ শকাব্দ সংখ্যা] এই সময়েই ঠাকুর পরিবারের আরেক সদস্যা সরলা দেবীও তাঁর সম্পাদিত ‘ভারতী’ পত্রিকায় [চৈত্র ১৩০৩] একই ধরনের মতপ্রকাশ করেছিলেন অপেক্ষাকৃত আবেগপূর্ণ ভাষায়ঃ- “আমাদের একান্ত আশা, বঙ্গের সামাজিক জীবনে নবযুগ বুঝি সমাসন্ন। এই সম্ভাবিত যুগপ্রবর্তনকারীর সহিত আমাদের সবসময়ে সকল বিষয়ে মতে না মিলিতে পারে, তথাপি তিনি আমাদের শ্রদ্ধেয়। প্রতীচ্য সভ্যজগতে তিনি দীনা মাতৃভূমির যে-গৌরব প্রতিষ্ঠা করিয়া আসিয়াছেন, তাহার জন্য দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেরই কৃতজ্ঞতার পাত্র।…”
এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, ব্রাহ্মদের পূর্বপরিচিত এক ভিন্নমতানুসারী যুবক যখন সহসা বিবেকানন্দরূপে পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হলেন, তখন আর পাঁচজন ভারতবাসীর সমমাত্রায় আহ্লাদিত হওয়ায় ব্রাহ্মদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা বলেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বা সরলা তাঁর সঙ্গে “কোনো কোনো বিষয়ে” মতানৈক্যের কথা উল্লেখ না করে পারেন নি। এই সব সংবাদ থেকে অবশ্য বোঝা যায় না, সাগরপারে বিবেকানন্দের বেদান্তপ্রচারের সাফল্যসংবাদে রবীন্দ্রনাথের নিজের প্রতিক্রিয়া ঠিক কীরকম ছিল। সমকালের এক সজাগ বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি যে বিবেকানন্দের সম্প্রদায়গত পটভূমিটি সম্বন্ধে সচেতন থাকবেন আর আদি ব্রাহ্মসমাজের একজন সদস্য হিসেবে বিবেকানন্দের সেই অবস্থানটিকে পুরোপুরি সমর্থন করবেন না, এ-কথা অনুমান করা কঠিন নয়।
এ-সব সত্ত্বেও অবশ্য পরবর্তীকালে তিনি আদি ব্রাহ্মদের সঙ্গে নব্য ব্রাহ্ম ও বিবেকানন্দের মতো নব্য হিন্দুদের মতানৈক্যকে কিছুটা উদার দৃষ্টিতেই দেখেছিলেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ১৯১১ সালে সঙ্কলিত “রোমীয় বহুদেববাদের পরিণতি” নামে অন্যের এক রচনার পাদটীকায় রোমের পুরানো পৌত্তলিকতা ও আধুনিক খ্রিস্টধর্মের মধ্যে বিরোধ সত্ত্বেও নানা সাদৃশ্য প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, “বর্তমান ভারতে ব্রাহ্মধর্মের সহিত নবজাগ্রত হিন্দুধর্মেরও প্রায় এইরূপ সম্বন্ধ দেখা যায়। সেই জন্যই কেশবচন্দ্রের সহিত রামকৃষ্ণ পরমহংসের যোগ অথবা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর শেষ বয়সের মতের সহিত হিন্দুসমাজের মতের মিলন এইরূপ সম্ভব হইয়াছে। বিবেকানন্দ যে একসময় উৎসাহী ব্রাহ্ম ছিলেন তাহাতে তাঁহার পরবর্তী মতপরিবর্তনে কোনো গুরুতর বিঘ্ন ঘটায় নাই।“ [অগ্রহায়ণ, শক ১৮৩৩ সংখ্যা] লক্ষণীয় যে, এই প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ কেশবচন্দ্র বা বিবেকানন্দের পরবর্তী মতবাদ সমর্থন না করলেও তাঁদের মতপরিবর্তন বা রামকৃষ্ণ-অনুরক্তিকে কিন্তু সমালোচনা করেন নি, বরং ভারতের ধর্মক্ষেত্রে প্রাচীন ও নবীন মতের মধ্যে এই ‘আনাগোনা’-র ফলে এই সব ধর্মমতের “বিরুদ্ধতা ক্ষয় হইয়া ইহাদের ভেদচিহ্ন” ক্রমশ লুপ্ত হয়ে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেছিলেন।
ভারতের নানা ধর্মমতের মধ্যে এই আদানপ্রদানকে ১৯১১ সালে অনুমোদন করলেও ১৮৯৩ সালে আমেরিকায়এইসব ধর্মের প্রতিনিধিরা [যাঁদের মধ্যে আদি ব্রাহ্মসমাজের কেউ ছিলেন না] ধর্মপ্রচার করে প্রশংসিত হয়েছিলেন, তাঁদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠিক কেমন ধারণা পোষণ করেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের খোঁজ নিতে হবে বিবেকানন্দ ও তাঁর সহপ্রচারকদের আমেরিকা ও ইয়োরোপ অভিযানের সমসময়ে প্রকাশিত কোনো রচনায় বা চিঠিপত্রে রবীন্দ্রনাথ এই বেদান্তপ্রচার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেছেন কিনা। বিবেকানন্দ যেহেতু একটি সংঘস্থাপনা করে পরবর্তীকালে তাঁর নববেদান্ত আন্দোলনকে একটি সংগঠিত চেহারা দিয়েছিলেন এবং তাঁর দেহাবসানের পরেও দীর্ঘদিন ঐ আন্দোলনের প্রভাবকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন, তাই আমাদের এই অনুসন্ধানের আর একটি জরুরি অংশ হবে – বিবেকানন্দের অবর্তমানেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবর্তিত বেদান্তপ্রচার নিয়ে কোনো মতপ্রকাশ করেছিলেন কিনা।
বিবেকানন্দের বেদান্তপ্রচার সম্বন্ধে ঠাকুর-পরিবারের এই দু’জন সদস্যের [যাঁদের একজন রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ আর একজন তাঁর বয়ঃকনিষ্ঠা ভাগনি] যে মতামত আমরা দেখেছি, তার প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ তখন কোথায় দাঁড়িয়েছিলেন? ১৮৯৫ সালে [তখনও কিন্তু বিবেকানন্দ ও অন্যান্য ভারতীয় প্রচারকেরা মার্কিন দেশে ধর্মপ্রচার করছেন] রবীন্দ্রনাথের সম্পাদিত ‘সাধনা’ পত্রিকায় [ফাল্গুণ, ১৩০১ বঙ্গাব্দ] ‘ধর্মপ্রচার’ শীর্ষক এক বেনামী রচনা প্রকাশিত হয়, ‘রবিজীবনী’ র [ষষ্ঠ খন্ড] লেখক প্রশান্তকুমার পালের মতে এটি রবীন্দ্রনাথেরই রচনা । এই নিবন্ধটির অংশবিশেষ এ রকমঃ-“ ...সম্প্রতি আটলান্টিক পার হইয়া হিন্দু আপন ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করিয়া আসিয়াছে এবং সেই নবধরাতলবাসীগণ আমাদের প্রাচীন ধরাতলের পুরাতন কথা শুনিয়া পরিতৃপ্তি প্রকাশ করিয়াছে, ইহাতে উভয় জাতিরই গৌরবের কথা...।“ ধর্মের সত্যপ্রচারের জন্য হিন্দুদের এ ভাবে পল্লী ছেড়ে বের হওয়াকে এই লেখক ‘নবজীবনের লক্ষণ’ বলে সন্তোষপ্রকাশ করেও এর পরে হিন্দুধর্মের উদারতার দাবিকে কিছুটা কটাক্ষও করেছিলেনঃ-“ যখন নিজের ধর্মকে সকলের ধর্ম করিয়া তুলিতে পারিব, তখনই প্রকৃত উদারতা লাভ করিব, এখন আমরা যাহাকে উদারতা বলিয়া থাকি, তাহা ঔদাসীন্য, তাহা সকল অনুদারতার অধম।“ ইত্যাদি। এখানে উল্লেখ্য, সাগরপারে ও ভারতে নানা বক্তৃতায় বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মের ও হিন্দুদের উদারতা ও পরমতসহিষ্ণুতার কথা বহুবার বলেছেন। তাই এখানে বিবেকানন্দের নামোল্লেখ না করে তাঁর ঐ হিন্দুর উদারতার দাবিকেই কটাক্ষ করা হয়েছে, এমনটা হতেও পারে। আবার এমন দাবিও করা যেতে পারে যে, এখানে ‘হিন্দু’ বলতে ব্রাহ্ম সহ বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি সব ভারতীয় ধর্মের প্রতিনিধিদেরই বোঝানো হয়েছে। মোটের ওপর আমেরিকায় হিন্দু বক্তাদের সমাদর শুধু তাঁদের নয়, উভয় জাতিরই গৌরব, এবং এতে দেশের গণ্ডী অতিক্রম ছাড়া আর বিশেষ কোন গুরুত্ব নেই এই লেখকের এমন অনুচ্ছ্বসিত বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথ [যদি তিনিই লেখক হয়ে থাকেন] এ সময় তাঁর পরিবারের অপর দুই সদস্যের থেকে মানসিকভাবে কিছুটা দূরেই অবস্থান করছিলেন। অন্তত বিবেকানন্দের বেদান্তপ্রচারের গুরুত্বকে স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও সরলার যে অনেক বেশি সতর্ক ও সংযত, এ কথা বুঝতে অসুবিধা হয়না।
রবীন্দ্রনাথের ঐ মন্তব্যের দু’বছর পরে বিবেকানন্দ যখন স্বদেশে ফিরে এলেন ও ১৮৯৭ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি শোভাবাজার রাজবাটী-প্রাঙ্গনে তাঁকে সংবর্ধিত করা হল, তখন রবীন্দ্রনাথ সেই ঘটনাকে কোন্ দৃষ্টিতে দেখেছিলেন? প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর রবীন্দ্রজীবনীতে লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ স্বামীজির ঐ সম্বর্ধনাসভায় উপস্থিত ছিলেন, অমল হোমকে নাকি রবীন্দ্রনাথ নিজে সে-কথা জানিয়েছিলেন। এই দাবি যদি সত্যি হয়ে থাকে, তা’হলে এ-কথা মনে করার একটা কারণ পাওয়া যেত, যে তিনি বিবেকানন্দের ঐ বেদান্তপ্রচার অভিযানকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।প্রভাতকুমার এই দাবির সত্যতা যাচাইয়ের চেষ্টা না করলেও এ নিয়ে অল্পবিস্তর অনুসন্ধান করেছেন পরবর্তীকালের দুই গবেষক। শঙ্করীপ্রসাদ বসু তাঁর ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’ গ্রন্থে [চতুর্থ খণ্ড] জানিয়েছেন, ১৮৯৭ সালের ৩রা মার্চ ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকায় স্বামীজির ঐ সংবর্ধনাসভায় উপস্থিত ব্যক্তিদের তালিকায় ঠাকুরপরিবারের যে ক’জনের নাম পাওয়া যায়, তাঁরা হলেন ক্ষিতীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ ও সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ঐ পরিবারের জামাতা জানকীনাথ ঘোষাল। রবীন্দ্রনাথ সে-সময় কলকাতায় যথেষ্ট পরিচিতি ও খ্যাতির অধিকারী, তাই এই তালিকায় তাঁর নাম না থাকায় তিনি ঐ সভায় সত্যিই উপস্থিত ছিলেন কিনা, এ সন্দেহ থেকেই যায়। এই সংশয়ের নিরশন করে প্রশান্তকুমার পাল জানিয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিতভাবেই ঐ সভায় যান নি, কারণ তিনি সেদিন কলকাতায় ছিলেন না। [রবিজীবনী,চতুর্থ খন্ড] কাজেই রবীন্দ্রনাথ যে এই পর্বে [১৮৯৩-৯৭] বেদান্তপ্রচারক বিবেকানন্দকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, এর কোনও প্রমাণ পাওয়া গেল না। অবশ্য এ-কথাও স্বীকার্য যে, রবীন্দ্রনাথ সেদিন কলকাতার বাইরে থাকায় নিঃসংশয়ে এমন কথাও নিশ্চিতভাবে বলা যায়না যে, তাঁর ঐ সভায় অনুপস্থিতি বিবেকানন্দ সম্পর্কে অনাগ্রহেরই প্রমাণ।
এর পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ যে-মন্তব্যটিতে সর্বপ্রথম বিবেকানন্দের উল্লেখ সহ তাঁর ধর্মপ্রচার সম্পর্কে মত প্রকাশ করেছেন, সেটি অবশ্য তাঁর স্বনামেই প্রকাশিত ও তাঁর গ্রন্থাবলির অন্তর্ভুক্ত। ‘সমাজভেদ’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লেখেন, “......বিবেকানন্দ বিলাতে যদি বেদান্তপ্রচার করেন ও ধর্মপাল যদি সেখানে ইংরেজ বৌদ্ধসম্প্রদায় স্থাপন করেন, তাহাতে য়ুরোপের গায়ে বাজেনা, কারণ য়ুরোপের গা’ রাষ্ট্রতন্ত্র।“ [১৯০১] এই মন্তব্য সংক্ষিপ্ত হলেও এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রথমত এটি বিবেকানন্দের জীবনকালে রবীন্দ্ররচনায় তাঁর একমাত্র উল্লেখ এবং দ্বিতীয়ত বিবেকানন্দের একটি প্রধান কাজ বেদান্তপ্রচারের প্রভাব সম্পর্কে এখানে স্পষ্টভাষায় মতপ্রকাশ করা হয়েছে। বিদেশে হিন্দুদের ধর্মপ্রচার সংক্রান্ত যে দু’টি মন্তব্য আমরা দেখলাম, সেগুলিকে সম্মিলিত করলে যা দাঁড়ায় তা হল, আমেরিকায় বিবেকানন্দ প্রমুখের ধর্মপ্রচার অভিযানকে রবীন্দ্রনাথ তথা আদি ব্রাহ্মসমাজ একেবারে প্রথম দিকে কিছুটা উদার দৃষ্টিতে দেখলেও শিকাগো বক্তৃতার আট বছর পরে দেখা যাচ্ছে যে, রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দের ঐ কাজকে ততটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না বা পাশ্চাত্যসমাজে যে তার কোন উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়তে পারে,এমন কথা স্বীকার করছেন না। এ থেকে মনে হতে পারে, আমেরিকার প্রথম সাফল্যলাভের পর ইয়োরোপ-আমেরিকায় সাত-আট বছর বিবেকানন্দের প্রচার-অভিযানের প্রতিক্রিয়াতেই রবীন্দ্রনাথের মত পরিবর্তন হয়েছিল। কিংবা এমনও হতে পারে, আমেরিকায় বিবেকানন্দের সাফল্যকে তিনি লঘু করে দেখতে চাননি, শুধু ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রেই এ-জাতীয় কাজের গুরুত্ব বা প্রভাব তিনি স্বীকার করেন নি। এখানে উল্লেখ্য যে, এই মতের বিপরীতে বিবেকানন্দের নিজের অভিমত ছিল, আমেরিকার চেয়ে ইংল্যান্ডেই তাঁর কাজ বেশি সফল হবে।
ভারতে নববেদান্ত আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ
বিদেশে বিবেকানন্দের বেদান্তপ্রচার সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যা-ই বলতে চেয়ে থাকুন না কেন, আমরা লক্ষ করি যে, বিবেকানন্দের জীবনকালে বা জীবনাবসানের পর যে দীর্ঘ চার দশক ধরে তাঁর প্রবর্তিত আন্দোলনের নানা প্রতিক্রিয়া দেশে ও বিদেশে লক্ষ করার সুযোগ রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন, তার কোনো সময়েই কিন্তু স্বয়ং বিবেকানন্দের এই বেদান্তপ্রচার সম্বন্ধে তাঁর অভিমত স্পষ্ট ভাষায় আর কখনও প্রকাশ করেন নি। যদিও ভারতে ও বিদেশে বিবেকানন্দের অনুগামীদের বেদান্তপ্রচার সম্পর্কে তিনি কখনও কখনও মন্তব্য করেছেন। এই পর্বে অবশ্য বিবেকানন্দের অবদানের অন্যান্য দিকগুলি সম্পর্কে [যেমন যুবসমাজের ওপর তাঁর বাণীর শক্তি ও প্রেরণার প্রভাব, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ভাবসমন্বয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা বা তাঁর বাংলা গদ্যের গুণমান ইত্যাদি] রবীন্দ্রনাথ ইতিবাচক মতপ্রকাশে কুন্ঠিত হন নি। ১৯০৯-১০ সালে বোলপুর ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রকাশিত ভক্তবাণী সংকলনে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের বাণীও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু সেই সব দিকগুলি আমাদের বর্তমান আলোচনার পরিসরের বাইরে বলে আমরা শুধু এটুকু বলেই ক্ষান্ত হব যে, বেদান্তপ্রচারের অতিরিক্ত বিবেকানন্দের অন্যান্য অবদানের মূল্যায়নযখন রবীন্দ্রনাথ করেছেন, তখন তিনি ব্রাহ্মসমাজের গন্ডিতে আবদ্ধ থাকেননি।
বিবেকানন্দের অবর্তমানে ভারতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ সংঘের প্রচারকদের সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের কেমন ধারণা ছিল? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে আমাদের চোখে পড়েছে ১৯০২ সালে ‘সমালোচনী’ পত্রিকায় প্রকাশিত অপ্রকটচন্দ্র ভাস্কর ছদ্মনামে রবীন্দ্রনাথের একটি লঘুরচনা, যেখানে “হিন্দুধর্ম মহান্, জাগ্রত, শাশ্বত “ বলে যারা চারদিকে ছুটোছুটি করছেন, তাঁদের “কেশবচন্দ্র-বিবেকানন্দের অনুস্বর বিসর্গ” বলে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। কিছুটা লঘু ঢংয়ে লেখা হলেও এখানে কেশবচন্দ্রের নববিধান ব্রাহ্মসমাজের ও বিবেকানন্দের প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের প্রচারকদের ধর্মপ্রচার সম্বন্ধে এক ধরনের তাচ্ছিল্যই প্রকাশিত হয়েছে বলে মনে হয়। এখানে মনে রাখতে হবে এই পর্বে বিদেশে উপনিষদ ও বেদান্তভিত্তিক হিন্দুধর্ম বিষয়ে প্রধানত ঐ দুই সম্প্রদায়ের প্রচারকেরাই বক্তৃতা বিতর্ক, শিক্ষাদান ইত্যাদি চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
বিদেশে বিবেকানন্দপন্থীদের বেদান্তপ্রচারের সার্থকতা বা প্রভাব বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের কিছু সংশয় যদি থেকেও থাকে, স্বদেশে তাঁদের জনপ্রিয়তাকে তিনি যে একরকম স্বীকার করেই নিয়েছিলেন, তা বোঝা যায় জামাতা নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা তাঁর এক চিঠি থেকে। দেশে আদি ব্রাহ্মসমাজকে জনপ্রিয় করে তোলার প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে তিনি ঐ চিঠিতে লেখেন,” এখন সময় এসেছে ব্রাহ্মসমাজের যথার্থ পরিচয় প্রকাশ করবার। ......আমরা অবজ্ঞাপূর্বক আমাদের সেই স্থান ছেড়ে দিয়ে খৃস্টানের পোষ্যপুত্র হতে গিয়েছিলাম বলেই আজ বিবেকানন্দের দল ব্রাহ্মসমাজকে একপাশে সরিয়ে ফেলে দিয়ে দেশের হৃদয়ে সমস্ত জায়গা সম্পূর্ণ জুড়ে বসবার উপক্রম করচে...।“ [১৬-২-১৯১৩] এই মন্তব্য থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের ধর্মপ্রচার অভিযানকে রবীন্দ্রনাথ বস্তুত ব্রাহ্মসমাজের প্রতিদ্বন্দ্বিতার দৃষ্টিতেই দেখেছিলেন।
আমেরিকায় বেদান্ত প্রচার –ভারতের অবমাননা ?
১৯১২-১৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় দর্শন নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ভাষণ দিতে গিয়ে লক্ষ করেন, কিছু ভারতীয় ‘ স্বামী উপাধিধারী অযোগ্য লোক’ ভারত সম্পর্কে ‘’যা তা” বক্তৃতা করে সে দেশের চিন্তাশীল মানুষের কাছে “ভারতের স্থান অত্যন্ত নামিয়ে দিয়েছে”। এদের কখনও তিনি “বিবেকানন্দের পরবর্তীরা” বা কখনও “বিবেকানন্দের চেলা” বলে উল্লেখ করেছেন। এই চিঠিগুলি তিনি লেখেন তাঁর তিন ঘনিষ্ঠ মানুষকে যাঁরা হয় ব্রাহ্মসমাজের না হয় ভারতীয় দর্শনচর্চার সঙ্গে জড়িত। ৮ই ডিসেম্বর [১৯১২] তিনি তরুণ ব্রাহ্ম কর্মী অজিতকুমার চক্রবর্তীকে লেখেন, “এখানকার পশ্চিম আমেরিকা আমাদের অনেক ছেলেকে মাটি করে দিচ্চে। কত শিক্ষিত ছেলে স্বামী উপাধি ধারণ করে যা তা কথা বলে আসর গরম করে বেড়াচ্ছে…। দেখে দুঃখ হয়, লজ্জাও বোধ হয়।“ বস্টনে এসে তিনি তাঁকেই হার্ভার্ডে তাঁর ভারতীয় দর্শন বিষয়ে বক্তৃতার ও সেখানকার অধ্যাপক উডসের উল্লেখ করে লেখেন, “… তিনি বলছিলেন আজকাল বিস্তর স্বামী উপাধিধারী অযোগ্য লোক এসে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে যা তা বক্তৃতা করাতে ভারতবর্ষের প্রতি এ অঞ্চলের শ্রদ্ধা একেবারে চলে গেছে।“ তিনি আরও অভিযোগ করেন, “তারা আমাদের শাস্ত্র ও দর্শন কিছুই পড়েনি, কেবলমাত্র বিবেকানন্দের বুলি উল্টোপাল্টা করে আবৃত্তি করে কোনোমতে কাজ চালিয়ে দিচ্ছে।আমি এখানকার অনেক চিন্তাশীল লোকেদের মুখে এদের সম্বন্ধে আলোচনা শুনে বড়ই ধিক্কার অনুভব করেছি।“ [১৫-২-১৯১৩]
এই চিঠিটি লেখার কিছুদিন আগেই রবীন্দ্রনাথ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কেও লিখেছিলেন, “ ……দেখছি এখানে নিতান্ত শস্তা জিনিষও উচ্চমূল্যে বিকিয়ে যায়। আমাদের দেশের কত অযোগ্য লোক এখানে বক্তৃতা করে জীবিকা নির্বাহ করছে। তাদের দ্বারা দেশের গুরুতর অনিষ্ট হচ্ছে। বিবেকানন্দ এখানে যে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন তা তাঁর চেলার দল এসে একেবারে ধুয়ে মুছে নিঃশেষ করে দিলে।“ [১-২-১৯১৩] এই মাসেই একই ব্যক্তিকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি আবার লেখেন, “…… এখানকার ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক Dr. Woods আমাকে বলিতেছিলেন যে, ভারতবর্ষ হইতে অনেক অযোগ্য লোক আসিয়া ভারতবর্ষ সম্বন্ধে এখানে বক্তৃতা করিয়া থাকে – ইহাতে এমন অবস্থা হইয়াছে যে ভারতবর্ষের কেহ বক্তৃতা করিবে শুনিলে শ্রোতা দুর্লভ হইয়া ওঠে…।“
১৯১৩ সালে তিনি শান্তিনিকেতনের শিক্ষক পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রীকে এক তারিখহীন চিঠিতে লেখেন, “……আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কোনো উপলক্ষে একবার পশ্চিম সাগরকুল ঘুরিয়ে নিয়ে যাবার ইচ্ছে আমার আছে।……কিন্তু এ পর্যন্ত যাকেই বলেছি কেউ কর্ণপাত করেননি। তার প্রধান কারণ এই বুঝচি যে বিবেকানন্দের চেলারা এদেশে বেদান্ত প্রভৃতি সম্বন্ধে বক্তৃতা করে বেদান্ত এবং ভারতবর্ষের বিদ্যাবুদ্ধির উপর এদের শ্রদ্ধা একেবারে ঘুচিয়ে দিয়েছে।“
এই চিঠিগুলিতে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্যগুলি থেকে পরপর কিছু প্রশ্ন আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। রবীন্দ্রনাথ স্বামী উপাধিধারী যে সব অযোগ্য লোকদের ‘বিবেকানন্দের চেলা’ বলে উল্লেখ করেছেন, যাদের বক্তৃতা মার্কিন দেশে ভারতের অবমাননার কারণ হয়েছিল , তাঁরা আদতে কারা? তাঁরা কি বিবেকানন্দের প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী , না অন্য কোনও স্বামী উপাধিধারী? রবীন্দ্রনাথ কেনই বা তাঁদের নামোল্লেখ করলেন না? আর কেনই বা এইসব ন্যক্কারজনক কাজ যারা করছিলেন তাদের সঙ্গে বিবেকানন্দের নাম জুড়ে দিলেন? ভারতীয় বেদান্ত-প্রচারকদের সম্পর্কে আমেরিকার শিক্ষিতমহলে যে অশ্রদ্ধা ও অভিযোগের কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, তার কি সত্যিই কোনো ভিত্তি ছিল?
এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যেতে পারে দু’ভাবে - চিঠিগুলির ভেতরের আর বাইরের সাক্ষ্য থেকে। চিঠিগুলি রবীন্দ্রনাথ যাঁদের লিখেছিলেন, তাঁরা খুব সম্ভব তাঁর উদ্দিষ্ট এই অযোগ্য লোকেরা কারা, তা ভালোভাবেই জানতেন। এর প্রমাণ রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃত প্রথম চিঠিটির উত্তরে অজিত চক্রবর্তীর চিঠির [৭ই জানুয়ারি] এই মন্তব্যঃ- “...... বিবেকানন্দ movement এমেরিকাকে যেমন ছেয়ে ফেলেছে তার ধাক্কাটাকে একটু নরম করা দরকার। …… right viewটা আমেরিকানরা পেলে নিশ্চয় ঐ ঢেউয়ে নাচবেনা। অন্তত এটা বুঝবে যে সমস্ত ভারতবর্ষই বিবেকানন্দের চেলা নয়।“ ইত্যাদি। এটা একরকম নিশ্চিতভাবেই ইঙ্গিত দেয়, রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মসমাজের প্রতিদ্বন্দ্বিতার দৃষ্টি থেকেই খুব সম্ভব আমেরিকায় বিবেকানন্দের সংঘভুক্ত বেদান্তপ্রচারকদেরই ইঙ্গিত করেছেন। আমরা এর আগেও রবীন্দ্রনাথের এই মনোভাব লক্ষ করেছি।
এই চিঠিগুলির বাইরের সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। সংক্ষেপে শুধু এ-টুকু বলা যায়, ঐ সময়ে আমেরিকায় নানাশ্রেণীর ভারতীয় ধর্মপ্রচারকদের সম্বন্ধে ধর্মসংশ্লিষ্ট এবং অন্যান্য বিষয়ে নানাধরনের অভিযোগ ও বিরূপ ধারণা সত্যিই জমে উঠেছিল এবং তাঁদের মধ্যে শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের স্বামী উপাধিধারী কয়েকজন সাক্ষাৎ শিষ্য়, এমন কি, সেই শিষ্যদের দীক্ষিত কিছু প্রচারকও ছিলেন। সাধারণভাবে ভারতীয় ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার প্রচারকদের এই বদনামের ফলে তখন আমেরিকায় রামকৃষ্ণ সংঘ পরিচালিত কয়েকটি বেদান্তকেন্দ্রের জনপ্রিয়তা ও সদস্যসংখ্যা যে সত্যিই হ্রাস পেয়েছিল, তা ঐ সঙ্ঘের বেদান্তপ্রচারের নানা বিবরণেও স্বীকৃত হয়েছে। তাই এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের উত্থাপিত অভিযোগগুলো একেবারে মনগড়া বা রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের প্রতি ঈর্ষ্যাপ্রসূত নয় বলেই মনে হয়। এ ব্যাপারে আরও অনুসন্ধানের সুযোগ থাকলেও আপাতত প্রাথমিক ভাবে মনে করা যেতেই পারে যে, উদ্ধৃত চিঠিগুলিতে রবীন্দ্রনাথের উদ্দিষ্ট প্রচারকদের মধ্যে যেমন রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের কোনো কোনো সন্ন্যাসী বা তাঁদের শিষ্যভক্তদের থাকার যেমন সম্ভাবনা রয়েছে, সেই সঙ্গে এ-কথাও স্বীকার্য যে,ঢালাওভাবে ওই সঙ্ঘের বিবেকানন্দ-পরবর্তী সব বেদান্তপ্রচারকই রবীন্দ্রনাথের লক্ষ্য ছিলেন না। তাঁদের মধ্যে যে শাস্ত্রজ্ঞ, সুযোগ্য বেদান্তপ্রচারকেরাও ছিলেন, [ যাঁদের কেউ কেউ পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথেরও স্বীকৃতি পেয়েছিলেন], এমন সাক্ষ্যও পাওয়া যায়।
এই তথ্যগুলি মনে রেখে রবীন্দ্রনাথের এই ব্যক্তিগত মন্তব্যগুলিকে দেখলে বোঝা যায়, আমেরিকায় বিবেকানন্দের পরবর্তীদের বেদান্তপ্রচার ও তার প্রভাব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কিছু অভিযোগ থাকলেও বিবেকানন্দের নিজের যোগ্যতা বা শাস্ত্রজ্ঞানকে তিনি একবারও চ্যালেঞ্জ করেননি আর সেদেশে তাঁর প্রতিষ্ঠাকেও কখনও অস্বীকার করেননি। কাজেই এ-কথা বললে হয়তো খুব ভুল হবেনা যে, বিবেকানন্দের নববেদান্ত আন্দোলনের পতাকাবাহকদের বেদান্তপ্রচারকে অপছন্দ করে যিনি ভারতের সত্য পরিচয় সেখানে তুলে ধরার নিজস্ব পরিকল্পনা করেছিলেন,তিনি প্রধানত ব্রাহ্মসমাজের রবীন্দ্রনাথ, আর স্বয়ং বিবেকানন্দের মূল্যায়নের সময় তিনি সাম্প্রদায়িক গন্ডিমুক্ত ইতিহাসদ্রষ্টা ভাবুক রবীন্দ্রনাথ।
~ ~ ~
আকর-পঞ্জীঃ-
১। ‘সঞ্চয়’ / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২। অনুস্বর ও বিসর্গ/ অপ্রকটচন্দ্র ভাস্কর – শারদীয় ‘দেশ’, ১৩৯৭
৩। অজিতকুমার চক্রবর্তীকে লেখা চিঠি- ‘দেশ’, সাহিত্যসংখ্যা ১৩৮৮
৪। অজিতকুমার চক্রবর্তী- রবীন্দ্রনাথ পত্রালাপ- ‘ভক্ত ও কবি’ [ পশ্চিমবঙ্গ বাংলা
আকাদেমি]
৫। নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে লেখা চিঠি – ঐ, ১৩৯৮
৬। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখা চিঠি- চিঠিপত্র, দ্বাদশ খণ্ড
৭। ক্ষিতিমোহন সেনকে লেখা চিঠি- ‘দেশ’, ২০-১২-১৯৮৬
0 comments: