ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
এক কিশোরীর রোজনামচা - ২৩
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Diary Entry - 21
1st. October, 1942, Thrusday
প্রিয় কিটী ,
জান, গতকাল আমি হঠাৎ খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সত্যিই, বেশ ভালোরকম ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। কোথাও কিছু নেই, হঠাৎ সকাল আটটা নাগাদ, নীচের ডোর বেলটা জোরে বেজে ওঠে। তৎক্ষণাৎ আমার মনে হয়েছিল, ওরা নিশ্চয় চলে এসেছে। “ওদের” কাছে তা’হলে আমাদের জায়গাটা আর লুকানো নেই। সুতরাং আমরা শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে গেছি। বুঝতেই পারছ, কথাগুলো যতক্ষণ সময় নিয়ে তোমায় বললাম, তার চেয়ে অনেক অনেক গুন দ্রুত আমি ভেবেছিলাম। মুহূর্তের মধ্যে আমার শিরদাঁড়ার ভিতর দিয়ে যেন একটা ঠাণ্ডা বরফের স্রোত শির শির শব্দে নেমে গেল। তারপর বুঝতে পারলাম ভয়ের কিছু নেই। কেউ একজন এসেছিল ; সে এক বদমাইশ রাস্তার ছেলে হতে পারে, যে বেলটা তারস্বরে বাজিয়ে পালিয়ে গেছে; অথবা পোষ্টম্যান হতে পারে, যে চিঠি দেওয়ার জন্যে হয়ত জোরে ডোর বেলটা বাজিয়েছিল।
এখন আমাদের অধিকাংশ দিনই কেমন অদ্ভুত শান্তভাবে কেটে চলেছে। আমরা সবাই একসাথে থাকতে থাকতে প্রত্যেকে যেন প্রত্যেকের কাছে একঘেয়ে হয়ে উঠেছি। আমাদের নীচের অফিসের কেমিস্ট তথা কমপাউন্ডার, ছোটখাট দেখতে লীউন (Lewin ), জাতিতে ইহুদি, ল্যাবরেটরি ও কিচেনে মিঃ ক্রেলারের ( Mr. Kraler) সহকারী হিসাবে কাজ করে। লীউন গোটা মেন আর অ্যানেক্স বিল্ডিংটাকে তার “হাতের তালুর” মতো চেনে। ভয় হয়, কোনদিন আবার অতি উৎসাহী হয়ে লীউন পুরানো ল্যাবরেটরি বা কিচেনে এসে ,না উঁকি মেরে দেখে ভিতরে কারা আছে, বা কেউ আছে কি’না !! ওরা যখন পাশের ল্যাবরেটরির কিচেনে কাজ করে, তখন ঠিক তার পিছনের পুরানো ল্যাবরেটরির মধ্যেকার বাথরুমে ভয়ার্ত ইঁদুরের মতো বসে থাকি। বসে বসে ভাবি, আজ থেকে প্রায় তিন/চার মাস আগে এই ‘আমি’ এখানে এসে থার্মোমিটারের পারদের মতো ওঠানামা করতাম। সারা জায়গাটা দাপিয়ে বেড়াতাম। আর এখন সেই আমি, সেই অ্যানি, যে ওপারে কারুর অস্তিত্ব অনুভব করলে চুপ করে বসে থাকে। জীবনের ভয় পায়। এখানে আসার পর আমাদের নিরাপত্তার স্বার্থে,অন্ততঃ এই ল্যাবরেটরির জন্যে প্রায় ঘণ্টা চারেক তাকে চুপ করে বসে থাকতে হয় ---- এর চেয়ে আর বেশী কি আশা করা যায়?
গত ২৯ তারিখে শ্রীমতী ড্যানের শুভ জন্মদিন ছিল। বড় করে জন্মদিন পালন করার মতো অবস্থায় আমরা এখন নেই। তবু শ্রীমতী ভ্যান ড্যানের সম্মানে, ছোট করে, আমাদের বর্তমান সীমিত অবস্থার মধ্যে আমরা তাঁর জন্মদিনটা পালন করলাম। বিশেষ কিছু খাবারের পদ রান্না করা হয়েছিল। যার কাছে যা’ বা যেটা ছিল, তাই দিয়ে তাঁকে ছোটখাটো উপহারও দেওয়া হলো। উপহার হিসাবে কিছু ফুলও তাঁকে দেওয়া হলো। তাঁর স্বামী তাঁকে গোলাপী আভার লাল গোলাপ ফুল উপহার দিলেন। সবকিছু মিলে বেশ ঘরোয়া ভাবে তাঁর জন্মদিন পালন করলাম। আসলে, আমাদের একঘেয়ে জীবনে, একটা দিনের কিছুক্ষণ সময় একটু অন্যরকম ভাবে কাটালাম। এটাই বলতে পার আমাদের সকলের পাওনা।
শ্রীমতী ড্যানের জন্মদিন থেকে কথা ঘুরিয়ে, তোমায় আর কিছু আশপাশের খবর দিই। জন্মদিনের দিন শ্রীমতী ড্যানকে যদি আমার বাবার ( যাকে বাড়িতে সমবয়সীরা সকলে পিম্প নামে ডাকে ) গায়ের উপর ন্যাকামি করে কি ভাবে ঢলে পড়লেন, তা যদি দেখতে, তা’হলে অবাক হয়ে যেতে। বারবার বাবার সাথে ন্যাকামি দেখতে দেখতে আমার মাথায় আগুন জ্বলছিল। বাবার গাল ধরে টিপে দেওয়া, অকারণে চুলের মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে ঝাঁকড়ে দেওয়া বা বাবার শার্টের একটা প্রান্ত ধরে টানা --- এ’সব দেখতে দেখতে যত না রাগ হচ্ছিল, তার চেয়ে বেশী শ্রীমতি ড্যানের এইরকম ন্যাকামি দেখে, বিরক্ত লাগছিল। শুধু এইসব ন্যাকামিই নয়, বাবার নাম ধরে ডেকে টুকরো টুকরো মন্তব্য করা যদি দেখতে, তা’হলে তুমিও আমার সাথে একমত হতে, যে,ওনার ব্যবহারটা সত্যিই অমানানসই আর বিরক্তিকর। শ্রীমতী ড্যনের আসল উদ্দেশ্য ছিল, বাবাকে পিম্প নামে ডেকে বা মন্তব্য করে বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা। তবে বাবার হাবভাব দেখে আমার মনে যেটা মনে হলো, তা’হলো, বাবা বা পিম্পের কাছে শ্রীমতী ড্যান আদৌ আকর্ষণীয় নন। এমন কি বাবাকে দেখে মনে হলো না, তাঁর মধ্যে শ্রীমতী ড্যানের বিষয়ে বিশেষ কোন কৌতূহল আছে, বলে !! বাবাকে শ্রীমতী ড্যানের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতেও দেখলাম না। তা’ হলে এ’ বিষয়ে নতুন আর কি’ই বা বলব? অথচ আমার মাকে কোনদিন আমি মিঃ ড্যানের সাথে এ’রকম ব্যবহার করতে দেখিনি। আমি এ’কথা সুযোগ বুঝে শ্রীমতী ড্যানের সামনে বলে দিয়েছিলাম। শ্রীমতী ড্যান অবশ্য বুদ্ধিমতীর মতোই আমার কথার তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দেননি। প্রতিবাদও করেননি।
ইদানীং পিটার মাঝে মাঝেই তার ছোট্ট কুঠুরী থেকে বেরিয়ে আসে। তখন ও’ বেশ মজার মজার ব্যবহার করে। আমার খারাপ লাগে না। আমদের দু’জনের মধ্যে একটা অন্ততঃ অদ্ভুদ মিল আছে। কথাটা আমি শুধু বলছি না। আমার বাড়ির সকলেই এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করে। আমি বা আমরা দু’জনেই বাড়ির বিষয়ে বা বাড়ির লোকজনকে নিয়ে আলোচনা করাটাকে বেশ উপভোগ করি। কথায় বলে “পর আলোচনা, পর চর্চা”। আমরাও ছোটখাট মন্তব্য করে বেশ মজা পাই। যদিও সরাসরি কিছু বলি না, সকলে বললে তার সাথে বলি। এ’ছাড়া আরও একটা বিষয়ে আমাদের মধ্যে বেশ মিল আছে। আমরা দু’জনেই ভাল জামাকাপড় পড়তে, একটু ফিটফাট হয়ে থাকতে ভালবাসি। একদিন মজা করে পিটার তার মা শ্রীমতী ড্যানের একটা ছোট সাইজের যে গ্রাউনটা আছে, সেটা পড়ে ঘুরছিল। আমিও ওর দেখাদেখি ওর একটা জামা ওর মতো করে পরেছিলাম। পিটার মাথায় একটা হ্যাট পরেছিল, আর আমি মাথায় ক্যাপ পরেছিলাম। আমাদের এই বড়দের মতো পোশাক পরা দেখে, সবাই হেসেই অস্থির। ওদের সাথে আমরাও বিষয়টা বেশ উপভোগ করেছিলাম। আসলে নতুন ত’ কিছু হলো। বুঝতেই পারছ, আমাদের জীবনে সত্যিই নতুন কিছু নেই। যা কিছু নতুন, তা’ আমাদেরই সৃষ্টি করতে হয়, আর আমাদেরই মজা পেতে হয়।
ইলি ভ্যাসন ( ইলি ভ্যসন ওরফে বেপ ভোস্কুজীর বিস্তৃত পরিচয় ১০ নম্বর ডাইরি এন্ট্রিতে দেওয়া হয়েছে, তাই এখানে কিছু দিলাম না ---- অনুবাদক ) কয়েকদিন আগে মারগটের জন্যে আর আমার জন্যে নতুন স্কারট কিনে এনেছে। বিজেনকর্ফ (Bijenkorf ) থেকে। বেশ মোটা খসখসে কাপড় দিয়ে তৈরী। সাধারণতঃ এই ধরণের স্কারট গুলো মহিলারা শোক প্রকাশের দিন পরে। জান, মারগটের স্কারট এর দাম ২৪ ফ্লরিণ [Florin ] ( ১ ফ্লরিণ ইংল্যান্ডের ২ শিলিং এর সমান ) , আর আমারটার দাম ৭.৫০ ফ্লরিন। সত্যি যুদ্ধের আগে এই রকম স্কারটের এইদামের কথা ভাবলে অবাক হতে হয়।
আর একটা ভাল খবর তোমায় লিখিনি। বলতে পার, “জামার আস্তিনের” মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলাম। ইলি আমাদের কথা ভেবে, একটা কর্মশিক্ষা সংস্থায় চিঠি লেখে। ডাকযোগে শর্ট হ্যান্ড লেখা শেখার নিয়মাবলী জানতে চেয়েছিল। এ’টা বেশ কয়েকদিন আগের ঘটনা। সেই সূত্রে , এখন বাড়িতে বসে আমি, মারগট ও পিটার তিনজনেই ডাকযোগে পাঠানো নির্দেশ অনুসারে শর্ট হ্যান্ড লেখা শিখছি। শুধু শিখছি না, ক্রমেই পারদর্শী হয়ে উঠছি। কোন কথা কেউ যদি কোড ওয়ার্ডে লিখতে পারে, তবে তার মতো ভাল আর কিছুই হতে পারে না। আমি খুব তাড়াতাড়ি কোড ওয়ার্ডে লিখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠব।
ইতি,
অ্যানি।
অনুবাদকের সংযোজন
মিঃ ক্রেলার
ইহুদিয়ের উপর ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ ও নিষেধাজ্ঞা জারী হওয়ার পর, মিঃ ভ্যান ড্যান ও মিঃ ফ্রাঙ্ক ব্যবসা থেকে তাদের প্রত্যক্ষ অবস্থান গুটিয়ে নেন। তাঁদের এইভাবে সরে যাওয়ার পর, মিঃ ক্রেলার (মিঃ ক্রেলারের ওরফে মিঃ ভিক্টর গুস্টাভ ক্যুগ্লারের বিস্তৃত পরিচয় ৮ নম্বর এবং ১৪ নম্বর ডাইরি এন্ট্রিতে দেওয়া হয়েছে – অনুবাদক ) একই সাথে Travic Inc. এবং কোহেন এয়ান্ড কোম্পানির দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। মিঃ ক্রেলার জন্মগত ভাবে অস্ট্রিয়ান নাগরিক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি রাজকীয় নৌ- বাহিনীর অন্যতম সদস্য হিসাবে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। যুদ্ধ পরবর্তী কালে তিনি অষ্ট্রিয়া ত্যাগ করে হল্যান্ডে চলে আসেন। ১৯৩৩ সালে তাঁর সাথে মিঃ ফ্রাঙ্কের আলাপ হয়, প্রায় তখন থেকেই তিনি মিঃ ফ্রাঙ্কের ব্যবসায় সাহায্যকারী হিসাবে যোগ দেন। নেদারল্যান্ড অধিকার করার পর যখন জার্মান প্রশাসন ইহুদিদের স্বাধীন ব্যবসার অধিকারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে, তখন মিঃ ক্রেলার মিঃ ড্যান ও মিঃ ফ্রাঙ্কের কাছ থেকে তাঁদের ব্যবসার ভার গ্রহণ করেন। তাঁর এই দায়িত্বভার নেওয়ার জন্যেও তাঁকে বিপদে পড়তে হতে পারত। কারণ সরকার চেয়েছিল, ইহুদিদের ব্যবসাগুলি আত্মস্বাত করতে। কিন্তু মিঃ ক্রেলার সরকারের সেই প্রচেষ্টায় বাধা হয়ে দাঁড়ান।
মিঃ ক্রেলার শুধু ব্যবসার ভারই গ্রহণ করেননি, তিনি তাদের লুকিয়ে থাকার জন্যে উপগৃহ বা অ্যানেক্স ভবন তৈরীতে সবচেয়ে বেশী সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন। শুধু উপগৃহই নয়, অ্যানেক্স ভবনে প্রবেশের দরজায় বই রাখার জায়গা তৈরী করে তিনি অ্যানিদের গোপনীয়তা বজায় রাখতেও সাহায্য করেছিলেন। এছাড়াও মিঃ ক্রেলার অন্তরালবর্তী ব্যক্তিদের জন্যে রেশনে খাবার জোগাড় করে আনতেন। স্বাভাবিক করণেই, মিঃ ক্রেলার ছিলেন অন্তরালবর্তী পরিবারদুটির অত্যন্ত ঘনিষ্ট মানসিক ভরসাস্থল।
0 comments: