0

বইঘর - ঋতবাক

Posted in


বইঘর

চারটি প্রবন্ধের বই
ঋতবাক


'আখির ইয়ে ওয়ক্ত্ কেয়া হ্যায়? কঁহা সে আয়া, কিধার গয়া হ্যায়? ইয়ে কবসে, কবতককা সিলসিলা হ্যায়? ইয়ে ওয়ক্ত্ কেয়া হ্যায় আখির?' জাভেদ আখতারের অমর কবিতা 'ওয়ক্ত্।' যে প্রবন্ধে এটি ঊদ্ধৃত হচ্ছে তার নাম 'সময়'। প্রবন্ধকারের নাম নৃসিংপ্রসাদ ভাদুড়ী। আজ্ঞে হ্যাঁ। ঠিকই পড়েছেন নামটা। মহাভারতের টীকাকার অনায়াসেই, দিন, মাস, বছরে গড়া কালতুরঙ্গের বর্ণনা তুলে আনতে পারতেন মহাকাব্য থেকে। তা না করে, তিনি বলছেন -

ইয়ে ওয়ক্ত্ সাকিত হো অওর হম্ ভি গুজর রহে হোঁ
সফরমে হম্ হ্যাঁয়, গুজরতে হম্ হ্যাঁয়,
জিসে সমঝতে হ্যাঁয় গুজরতা হুয়া, উয়ো থমা হুয়া হ্যাঁয়, 
আখির ইয়ে ওয়ক্ত কেয়া হ্যাঁয়? কেয়া হ্যাঁয় আখির?

বইঘরে স্বাগত বন্ধু। ঋতবাক নির্মিত 'মন্দকথা' বইয়ের নৃসিংপ্রসাদকে আমরা দেখিনি কখনও। এই নৃসিংহ জাভেদ আখতার শুনিয়ে সাফ বলেন তিনি বুড়ো হবেন না। স্মার্ট ভঙ্গীতে লেখেন, কর্পোরেট যুগের গীতাভাষ্য 'Smart গীতা।' যেখানে টিম লীডার বাসুদেব কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন, 'Stop neuter gendering yourself'! ভুল করবেন না। ভঙ্গী সর্বস্ব নয় এই বই। কনটেন্ট স্তরে কোথাও আপোস করেননি লেখক। ক্ষমতা নামের সর্বগ্রাসী শয়তান কেমনভাবে রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র আর স্বৈরতন্ত্রকে এক করে তোলে তার কথা বলেছেন। বলেছেন সিচুয়েশনাল এথিক্সের কথা : যার বিচারে মিথ্যে একটা সিচুয়েশনাল নেসেসিটি। আমি জানি, আপনি কী বলবেন। আপনি বলবেন, 'মহাভারত: নীতি অনীতি দুর্নীতি' বইতে এসব আপনি পড়েছেন। আপনি জানেন, লেখক বলেছেন, অবস্থা ভেদে ধর্মকে অধর্মের মতো আর অধর্মকে ধর্মের মতো দেখতে লাগে : মানুষকে তার বুদ্ধি, শীলন, মেধা দিয়ে ধর্ম আর ন্যায়কে বুঝে নিতে হয় - বিদ্বাদসস্তং সম্প্রশ্যন্তি বুদ্ধ্যা। বলবেন, এসব আপনার আগেই পড়া। না, পড়া নয়। আপনি সেই নৃসিংপ্রসাদকে পড়েননি যিনি এলিয়ট, বোদলেয়র আর মহাভারত মিলিয়ে কথা বলেন; 'শেয়ালদা স্টেশনের ঝগড়া অ্যাবসর্ব করার ক্ষমতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক বেশি'-র মতো সপাট বাক্য লিখতে পারেন; সংযম প্রসঙ্গে চুলকুনি আর তার দার্শনিক তাৎপর্য টেনে আনেন; মুচকি হেসে বলেন, 'চাওয়াটাকে কমাতে হবে বাছা'! সবচেয়ে বড় কথা, এই বইয়ের লাইনে লাইনে নিজের জীবনকে অকপটে মেলে ধরেছেন নৃসিংপ্রসাদ ভাদুড়ী। বলেছেন ছোটবেলার অনটনের কথা, লোকের কাছে চাওয়ার স্বভাবের জন্য মায়ের লজ্জা পাওয়ার কথা। বলেছেন বাঁশবেড়িয়া স্টেশনে নির্মম ভাবে মার খাওয়ার কথা। তারপর, সেই অভিজ্ঞতা থেকে দার্শনিক উপলব্ধিতে পৌঁছেছেন। এর আগে নৃসিংপ্রসাদ এরকম বই লেখেননি? এর আগে কোথাও নিজেকে উপজীব্য করে, বিশ্লিষ্ট করে বোধিতে এসে পৌঁছনোর রচনা প্রকরণ ব্যবহার করেননি তিনি। প্রথম করছেন এই বইয়ে। কারও তোয়াক্কা না করে বলছেন, 'একান্তে বসলেই আমাদের মনের মধ্যে হিজিবিজি ভাবাবেগ জাগে। ...আর তখনই মানুষ সত্য কথা বলে - নিজের সম্বন্ধেও, পরের সম্বন্ধেও। তখন, মুখোশ থাকে না, থাকে না ভদ্রতার আবরণ। যা দেখে খারাপ লাগে, সেটা সরাসরি বলতে লজ্জা পাই না এই সময়।' এই সব কথা সবসময় শ্রবণসুখকর হয় না। তাই, লেখক তাঁর বইয়ের নাম দিয়েছেন ‘মন্দকথা’।

*****************************

‘কখনও কোনো নতুন তথ্য আবিষ্কার করে ইচ্ছে হয়েছে সকলকে জানানোর; কখনও আবার নীরদচন্দ্র চৌধুরীর মতো সুপণ্ডিতের কাঁচা ভুল ধরিয়ে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারি নি। কোনো কোনো বিষয়ে ভুল ধারণা কাটানোর জন্যও কলম ধরতে হয়েছে। তার বিষয় সাহিত্যও হতে পারে, দর্শনও হতে পারে।’

বস্তুবাদী দার্শনিক হিসেবে বিশ্বখ্যাত হলেও রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য আজীবন সাহিত্যেরই অধ্যাপনা করেছেন। তাঁর ‘খোলা চোখে, খোলা মনে’ বইয়ের উনিশটি প্রবন্ধের বিষয়বস্তু তাই যুক্তিবাদ, বাঙালি সমাজ, ভারতীয় ও পাশ্চাত্য সাহিত্য, অনুবাদ কবিতা এবং অবশ্যই চার্বাক/ লোকায়ত দর্শন।

অপরাজিত উপন্যাসে বিভূতিভূষণ অপর্ণাকে প্রথম দেখার পর অপুর মনোভাব বোঝাতে তার মনে এক বিদেশি উপন্যাসের লাইনের গুনগুন করার কথা লিখেছেন। ‘অপরাজিত-য় ধ্বনিময় এক ঊদ্ধৃতি’ প্রবন্ধে লেখক জানিয়েছেন সেই উপন্যাসের নাম-ঠিকানা। দেখিয়েছেন কেমনকরে অন্য ভাষার ধ্বনিময়তার সাহায্যে বিভূতিভূষণ তাঁর নায়কের মনের ভাব অপূর্ব দক্ষতায় প্রকাশ করেছেন। নীরদচন্দ্রের মতো পণ্ডিত কেমন করে যে লিখে বসলেন অপু ইংরিজি কবিতার লাইন বিড়বিড় করছিল, বিয়ের আগেই অপর্ণাকে অপুর বউই বা বানিয়ে দিলেন কেন, তা সত্যিই বোঝা দায়! একটা ফুটনোট কতটা সরস আর কৌতুকোজ্জ্বল হতে পারে, তা লেখকের নীরদচন্দ্রের ‘কাঁচা ভুল’ ধরানোর পদ্ধতি না পড়লে বোঝা যাবে না। অধ্যাপক ভট্টাচার্য জানিয়েছেন কীভাবে শেক্সপীয়ার পড়তে নেই। বিষ্ণু দে-র অনুবাদে ইয়েটস্‌- নিয়ে আলোচনা করেছেন। টেরি ইগল্‌টনের ‘আফটার থিওরি’ বইয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে উত্তর-আধুনিকতাবাদকে তুলোধোনা করেছেন। পাণ্ডিত্য কতটা নির্ভার হতে পারে, কতটা সরলভাবে গভীর চিন্তাকে বাঙ্ময় করা যায়, তা জানতে গেলে এই বই পড়তেই হবে। ঋতবাকের নির্মাণ এই বইটির মতো বই বাঙলায় খুব বেশি নেই।

*****************************

চারদিকে যখন এক অদ্ভুত আঁধার ঘিরেছে বর্তমানকে, তখন অধ্যাপক সুদিন চট্টোপাধ্যায় স্মরণ করছেন তাঁর প্রধানশিক্ষককে। বইপাগল মানুষটি কেমনভাবে ইংরিজি সাহিত্যের প্রাণস্পন্দন পৌঁছে দিতেন তাঁর ছাত্রদের কাছে; কেমন করে তাঁর বিশাল বইয়ের সংগ্রহ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দেশবিদেশের লাইব্রেরিতে বলছেন সে কথা। মনে করছেন সেই অদ্ভুত শর্ত। কোথাও দেওয়া থাকবে না দাতার নাম। বইয়ের ভিড়ে মিশে গিয়েই সার্থকতা পাবে তাঁর বইগুলো। পাগল লোক! আর, এমন পাগলেরই আজ বড় অভাব। ‘আঁধার রাতে একলা পাগল’ এমন এক প্রবন্ধের বই, যেখানে বারবার, আজকের দিনে নিষ্ঠা, আদর্শ এবং নিরপেক্ষ বিচারের কথা বলা হয়েছে। বিখ্যাত পণ্ডিত ও মননশীল প্রাবন্ধিকের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছড়ানো লেখা একত্র করে ঋতবাকের তৈরি এই প্রবন্ধসংকলনে আছে নানা বিষয় নিয়ে লেখা। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে লেখা আছে, আছে সাঁওতাল গণ-অভ্যুত্থান হুল নিয়েও। রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন, গান্ধীজি ছাড়াও দিলীপ কুমার রায়, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কে নিয়ে লেখা যেমন আছে; তেমনই আছে হর্ষবর্দ্ধন ঘোষের ‘ছদ্মনামের অভিধান’ বইটি নিয়ে আলোচনা; আছে শিক্ষাচিন্তা বিষয়ক প্রবন্ধও। অতি মনোগ্রাহী ভাষা। অতি সরল উপস্থাপনা। 

*****************************

‘এত বড়ো ভারতবর্ষে একটা যার মন্দির নেই, সেই সরস্বতী আবার দেবী, আর তার আবার পুজো!’

১৯৪৮ সালে ছোটদের জন্য লেখা ‘কমলাদেবী’ গল্পে লিখেছিলেন বুদ্ধদেব বসু। কথাটা ভেবে দেখার মতো। তাহলে কে এই দেবী সরস্বতী ? দেবী দুর্গার স্বরূপই বা কী? সত্যিই কি এক সাঁওতালি রমণী দেবী কালিকার আদিরূপ? শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথ ধামে কেন জাতের বিচার নেই? বঙ্গীয় স্মৃতি নিবন্ধ অনুসারে দুর্গোৎসব একমাত্র ম্লেচ্ছ অধিকার স্বীকৃত পূজা, শবরোৎসব যার এক অপরিহার্য অঙ্গ। কেন?

জানার ইচ্ছে আছে, কিন্তু জানানোর মতো মানুষ বিরল। উত্তর আসছে হয় দলে টানার উদ্দেশ্য নিয়ে, নাহয় এত জটিল পাণ্ডিত্যপূর্ণ ভাষায় যে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ছি আমরা। কবির ভাষা একটু বদলে নিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, নিতে চাই, দিতে কেহ নাই! ঠিক এরকম সময়ই প্রয়োজন ছিল শিবাংশু দের ‘দেবতার সন্ধানে-একটি অনার্য অডিসি’ –এর মতো এক বইয়ের। 

এ বইতে লেখক অতি সরল ভাষায় কথা বলে গেছেন । একটি বাড়তি কথা নেই তাঁর শব্দে আঁকা ছবিতে। আপনি তাঁর সঙ্গে দেশ বেড়াবেন। পুরীতে ঘুরতে ঘুরতে তিনি আপনাকে জানাবেন কেমন করে আর্যদের সেরিব্রাল আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে, এক অনার্য ঐশীধারণা নীলমাধব, দারুব্রহ্ম রূপ নেন আর্য প্যান্থিয়নে। সরস্বতী নদী কীভাবে দেবী হলেন, আর এই অতি স্বাধীন দেবীটিকে নিয়ে কী বিপাকেই পড়েছিলেন পুরষতন্ত্রের ধারক-বাহকরা তাও জেনে নেবেন আপনি। জানবেন দেবীটিকে শ্বেতবর্ণা করার গূঢ় কারণ। ক্রীট, ব্যাক্ট্রিয়া বা বালখ্‌ অঞ্চলের এক সিংহবাহিনী দেবী কেমন করে শবর, পুলিন্দ প্রভৃতি আদিম ভারতবাসীদের দ্বারা বিন্ধ্যপর্বতে কাত্যায়নী ও কৌশিকী নামে পূজিতা হতে হতে ক্রমে দুর্গতিনাশিনী দুর্গা হয়ে উঠলেন; কোন উপায়ে পারিবারিক এককের রক্ষণশীল নির্মাণ হয়ে উঠল বাঙালির ঘরের মেয়ে উমা, তাও জানবেন আপনি। অনার্য পূজিতা মাতৃকাশক্তি, বাংলা আর আসামের কৌমজনতার আরাধ্যা এক ঘোরশ্যামা দেবীকে, সম্ভবত পঞ্চদশ শতকে, তাঁর তন্ত্রসার গ্রন্থে দেবী মহাকালী রূপে অবয়বদান করেন কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তারপর এক অতি জটিল আত্মীকরণ প্রক্রিয়া। স্ববিরোধ ও সমন্বয়ের পথপরিক্রমা। মাতৃতান্ত্রিক আত্মসন্ধান অনার্যমননের অন্দরমহলে। এই সন্ধানে সামিল হবেন আপনিও।

কালীতত্ত্ব, প্রকৃতপক্ষে ইতরবর্গীয় সংখ্যাগুরু দেশবাসীর আত্মপ্রতিষ্ঠার একটি স্বীকার্য খতিয়ান। গোষ্ঠীগত অধ্যাত্মবৃত্তের বাইরের মানুষ হয়তো নিজস্ব বোধে বিনির্মাণের এই তত্ত্বকে অন্যভাবে বুঝতে পারবে। আনুগত্যের বিচারে সনাতনধর্মীয়রা সামগ্রিকভাবে এই দেবীর প্রতি সতত নিবেদিত থাকলেও তাঁর স্বরূপসন্ধান একান্তভাবে একটি অনার্য অডিসি।

কালী সম্বন্ধে এ কথা বললেও এই বইয়ের মূল কথা এটাই। আজ যখন সনাতনের মৌলিক রূপ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, চলেছে ভারতবর্ষের কৃষ্টি-সংস্কৃতির উৎস-সন্ধান; তখন আপনাকে সঙ্গে নিয়ে দেবত্ব আর মানবতার স্বরূপের খোঁজে বেরিয়েছেন লেখক।


********************

চারটি প্রবন্ধের বই। চার রকম ভাবে বিচার। কিন্তু, মিল আছে। কোথায়? চার প্রাবন্ধিকই কোথাও, একটিবারের জন্যও পণ্ডিতি ফলাননি। ভাষাকে অকারণ জটিল করেননি। আর, সবচেয়ে বড় কথা, পাঠকের মেধাকে তুচ্ছ করেননি। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় পড়ানোর সময় ছাত্রদের বলতেন, ‘তোমরা তো সবই জানো।’ এই ‘সবই’-র মধ্যে নন্দনতত্ত্ব থেকে সাম্প্রতিকতম সাহিত্যতত্ত্ব, সবকিছুই পড়ত। ছাত্ররা বুঝতো, কথাটা পুরোপুরি ঠিক হতে পারে না। তবু, এই গুরুত্ব দেওয়াটায় তারা একেবারে গলে যেত। প্রাণপণ চেষ্টা করত কথাটার মর্যাদা রাখতে। এই চারটে বইও আমাদের ওপর একই আস্থা রেখেছে। একই সম্মান দিয়েছে আমাদের বোধশক্তিকে। এবার আমাদের দায় তাদের মান রাখা। আর সেটা আমরা পারবই।

0 comments: